[বাংলা এই রচনাটি আমারই এপ্রিলের শুরুতে লিখিত ইংরাজি একটা রচনার অনুবাদ। এসব বিষয়বস্তুতে নিজে আগ্রহ বোধ করি এমন প্রকাশনাস্থল খুব বেশি নয়; আমার নিজের ইংরাজিও জগতের যে কোনো পত্রিকায় হুমহাম করে পাঠানোর মত নয়, এখনো। ফলে কিছু দেরি হলো। ২৫শে মে ২০২১–তে ইংরাজি রচনাটি সম্পাদকীয় ডেস্কের ভাষা–সম্পাদনাসমেত প্রকাশিত হচ্ছে লরেন্স উইশার্ট প্রকাশনীর এনার্কিস্ট স্টাডিজ জার্নালের ব্লগ সেকশনে। অনুবাদটি অল্প দুচারটা বাক্য সংযোজনসমেত আদি ইংরাজি–খসড়ার বাংলারূপ। – মানস চৌধুরী, ২২শে মে ২০২১]
মুস্কিলের পরিস্থিতি
বাংলাদেশের বিদ্যাজগতীয় ‘স্বাধীনতা’ বিষয়ে বলতে যাওয়া ভাল রকমের ভেজালের বিষয়। এরকম ভেজালে আমি আগেও পড়েছি যখন ইউরোপীয় শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের প্রেস স্বাধীনতা বিষয়ে আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, অন্তত দুইবার। এরকম আলোচনায় দুইটা গুরুতর সমস্যা ঘটে থাকে যার দুটোই আন্দাজ/পূর্বানুমানের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রথমত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, প্রশ্ন করতে যাঁরা আসেন তাঁরা ধরেই নেন যে তাঁরা ‘স্বাধীনতা’র দেশ থেকে আসছেন— তা বিদ্যাজগত হোক বা সংবাদজগত— যা কিনা আমি আবার নিঃশর্তে মেনে নেয়ার জায়গায় নাই। দ্বিতীয়ত, যাঁরা আলাপ প্রস্তাব করেন তাঁদের নির্দিষ্ট কতগুলো প্যারামিটার বা মানদণ্ড সাজানো থাকে। এদুটোর সঙ্গে সম্পর্কিত করে আমার তৃতীয় সমস্যাটা দেখা দেয়। যত আমি সংজ্ঞা কিংবা পূর্বানুমান/আন্দাজকে তদন্ত করতে আগাই, ততই আমাকে সাব্যস্ত করা সম্ভব হয় বাংলাদেশের বিপজ্জনক পরিস্থিতির বিষয়ে তেমন গা করছি না এমন একজন লোক হিসাবে। অবশ্যই সেটা সত্য নয়। স্বাধীনতাপ্রেমী যেকোনো পেশাজীবীর মতো আমিও আমাদের পরিস্থিতি সম্বন্ধে চিন্তিত। বরং আরো বেশি চিন্তিত যখন পুরা বিষয়টাকে আমি বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখি।
নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই শাসনব্যবস্থার জন্য ‘সুনাগরিক’ পয়দা করার লীলাভূমি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এটা খুব সরল শোনাচ্ছে নিশ্চয়ই, কিন্তু এটা এরকমই। ইউরোপ মহাদেশে বুর্জোয়া জাগরণের কাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান পক্ষ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে ‘প্রজ্ঞা’ আর ‘জ্ঞান’–এর জগতে বুর্জোয়া স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখতে দরকষাকষি চলে আসছে। একটা জানা ইতিহাস আবার করে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে এই কারণে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গণতান্ত্রিক, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে র্যাডিক্যাল, রাজনৈতিক চিন্তার উদ্রেককারী হিসাবে দেখানোর লাগাতার বাগাড়ম্বর চালু আছে। যদিও সারা দুনিয়াতেই শিক্ষার্থীদের কেন্দ্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধাচরণ করতে দেখা গেছে, তথাপি এগুলোকে দেখা দরকার ব্যবস্থাগত মগজধোলাইয়ের মধ্যে আচমকা সব অভিব্যক্তি হিসেবে; এবং কিছুতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিক ফলাফল হিসাবে নয়, যতই না কেন গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের সব ‘লক্ষ্য–উদ্দেশ্য/মিশন’ লেখা থাকুক।
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ নিয়ে মাতামাতি
বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ একটা বড়সড় আলোচ্য বিষয়, বিশেষত সেসব বিদ্যাকর্মীদের মধ্যে, যাঁরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘স্বায়ত্বশাসন’ নিয়ে গর্ববোধ করে থাকেন। মাঝেমধ্যে এই অধ্যাদেশটা নিয়ে জন–আলাপসালাপ বেশ মাত্রাতিরিক্ত ধরনেরই হয়ে থাকে। ক্যাম্পাসভিত্তিক রাজনৈতিক শব্দমালার মধ্যে ‘স্বায়ত্বশাসন’ খুবই পরিচিত এবং যেকোনো জমায়েত–প্রতিবাদে বারংবার উচ্চারিত হয়ে থাকে। বিদ্যাকর্মী হিসাবে আমার এই হৈচৈটা একটু বেশি রকমের উদ্দীপ্ত লাগে, অবশ্য সেটা বাংলাদেশের দীর্ঘ সামরিক শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা সারাক্ষণই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্বশাসনকে নস্যাৎ করতে চেয়েছে। এমনকি আমি নিজেও একজন ‘তরুণ রাজনীতি–সচেতন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র’ হিসাবে এবং পরে একজন ‘নবীন শিক্ষক’ হিসাবে এই পদটা নিয়ে বেশ অভিভূত ছিলাম। আরো প্রশ্নমনস্ক মন নিয়ে ভাবলে ১৯৭৩ অধ্যাদেশকে ‘আধুনিক’ যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সাধারণ একটা পথপ্রণালীই মনে হবে। আদিতে ইংরাজিতে লিখিত এই অধ্যাদেশটি নয়া স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের জন্য একটা সূচনা পদক্ষেপ ছিল যা ৬০–এর দশকে রাষ্ট্রযন্ত্রের লাগাতার হস্তক্ষেপের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যমান উত্তেজনা প্রশমনে সম্ভবত বেশ ভূমিকা রেখেছে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এই ভূখণ্ডে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, সাকুল্যে পাঁচটা আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে এবং তাদের জন্য এগুলো রাষ্ট্রবিরোধী এবং/বা ‘জাতীয়তাবাদী’ উত্থানে মদদ–দেবার প্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র। তাদের সেজন্য এগুলো দমন করতে হয়েছে, নতুন রাষ্ট্রের পক্ষে এরকম নিয়ন্ত্রণ করবার তেমন কারণ ছিল না। অধিকন্তু, এই অধ্যাদেশটা পড়তে বেশ নিষ্প্রাণ আর খসখসেও বটে। আমার বক্তব্য হচ্ছে, প্রাথমিক খসড়াটা প্রতিষ্ঠানের বিন্যাস নিয়ে বলে, পদমর্যাদা নিয়ে বলে, আইনগত বিধান ইত্যাদি নিয়ে বলে; কিন্তু কিছুতেই শিক্ষাদর্শন নিয়ে গুরুতর কিছু বলে না কিংবা শিক্ষার্থী–শিক্ষকের ‘সম্পর্ক’ নিয়ে দিকনির্দেশনা দেয় না। এই অধ্যাদেশের আরেকটা খামতি হচ্ছে যাকে আধুনিক দুনিয়া ‘পোস্টগ্রাজুয়েট’ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে জানে সেটার বিষয়ে নিস্পৃহতা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কমবেশি ‘নিম্নস্নাতক’–ভারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবেই শুরু হয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সাথে বিশেষ তাল মেলানো হয়নি।
যাহোক, আমার উদ্দেশ্য এই অধ্যাদেশকে খাটো করা নয়, বরং খানদুই সামান্য বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেয়া: প্রথমত, বিশ্বের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর প্রশ্নে কমবেশি কাছাকাছি বিধানপ্রণালী দিয়েই গড়ে উঠেছে; দ্বিতীয়ত, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাস্তবে যে কোনো প্রতিষ্ঠানেই, গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল নিশ্চিত করার জন্য নিছক একটা নথি বানানোর চেয়ে বেশ কিছু বেশি পদক্ষেপ নিতে হয়। এতটাই সিধাসরল হলে অধিকাংশ রাষ্ট্রেই মানুষজনের সুখ নিশ্চিত থাকত। সবার নিশ্চয়ই মনে পড়বে যে খুব বেশি কোনো রাষ্ট্রে কোনো বৈষম্যমূলক আইন নেই— তা জাতিবিদ্বেষ বলুন, বা ব্লাসফেমি, বর্ণ বা লিঙ্গ ভেদাভেদ এবংবিধ। সারা দুনিয়াতে লিখিত–দলিলকে ভিত্তি করে যেসব রাজনৈতিক আলাপ–আলোচনা চলে তাকে আমি ঘোরতর অপছন্দ করি।
ক্লাসরুমে কোনো পাহারাদার নাই
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, বিশেষত পাবলিকগুলোতে, ক্লাসরুম একেবারে পাহারামুক্ত, অন্তত সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত। আমার পাঠকদের আমি নিশ্চিত করছি যে এই পাহারামুক্ত জীবন বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক দীর্ঘকাল ধরে উপভোগ করেছেন— তাঁদের নিজেদের জীবনের সাফল্যের গল্প করে, বিদেশ সফরের গল্প করে, পরিবারের খান্দান নিয়ে, সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে, রাজনৈতিক আইকনদের তিনি কতটা বন্দনা করেন তা নিয়ে গল্প করে, এবং আরো মেলাকিছু; তাঁদের হাতে থাকা সিলাবাসের সঙ্গে দূরবর্তী কোনো সম্পর্কস্থাপনেরও কোনোরকম পরোয়া না করেই। এরকম একটা পরিস্থিতিতে, কোনো শিক্ষক অনায়াসেই উপরের বিষয়বস্তুগুলোর তুলনায় আরেকটু সিরিয়াস ধরনের আলাপ তুলতেই পারেন; যার মধ্যে থাকতে পারে রাষ্ট্রযন্ত্র, দুর্দশাগ্রস্ত প্রশাসন, কর্পোরেট গোষ্ঠী, বহুজাতিক সংস্থা, মুনাফামূলক ব্যবস্থা, এবং সম্ভবত মিলিটারি ও তার রাষ্ট্রোর্ধ্ব নেক্সাস নিয়ে। এখন আপনারা একটা জটিলতার কথা বলতে পারেন যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ থাকতে পারেন যাঁরা এসব খবর ‘পৌঁছে’ দেবেন প্রশাসনের কাছে কিংবা ‘দায়িত্বরত’ প্রতিষ্ঠানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের কাছে। এটাই এই কাজে একমাত্র ঝুঁকি হতে পারে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে শিক্ষকদের অনেকেই, অধিকাংশ যদি নাও হন, আরেকটা সহজ রাস্তা বেছে নিয়েছেন। আমি আশা করি পাঠকেরা বুঝবেন যে কোথায় ঠিক করে তাকাতে হবে। কোন পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যাকর্মীরা গুরুতর বিষয়ে কথা বলবার ক্ষেত্রে নিজেদের সেল্ফ–সেন্সরশিপের মতবাদে দীক্ষিত করেছেন কিংবা ক্লাসরুমে আবোলতাবোল কথাবার্তা বলার তালিম নিয়েছেন সেগুলো অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হবে।
কোভিড–১৯ ক্লাসরুম পরিবেশের আমূল রূপান্তর ঘটিয়েছে। সারাদেশে ইন্টারনেটের সুলভতা বিষয়ে সরকারের লাগাতার দাবির মধ্যে, শিক্ষকতা মুখ্যত অনলাইন পদ্ধতিতে সরে গেছে। কার্যত এতে শিক্ষকেরা আগের যেকোনো সময়ের থেকে বেশি নিরীক্ষার মধ্যে থাকার পরিস্থিতিতে আছেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেলায় ক্লাসরুম নিরীক্ষা মোটামুটি নৈমিত্তিক একটা কার্যক্রম, মুখ্যত যেটাকে কর্তৃপক্ষ ‘গুণমান নিশ্চিত করার’ কারণে করা হয় বলে থাকেন। তাছাড়া, বাংলাদেশে কেবল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই বা কিছু কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতিটা চালু আছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা যদিও এক্ষেত্রে খুব ভিন্ন ছিল যেখানে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক মূল্যায়ন আমার খণ্ডকালীন চাকরিটাকে লম্বা করতে পারেনি। সেটা অবশ্য বেশ আগের কথা, আর খুবই অল্প সময়ের জন্য; ঠিক উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করার মতো নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো এটা চালু হয়নি তবে ইউজিসিতে আলাপ–আলোচনা চলছে বলে শোনা যায়। সাধারণভাবে বললে, গুণমান নিশ্চিতকরণের সঙ্গে ‘সেন্সরশিপ’ কিংবা ‘নজরদারি/সার্ভেলিয়েন্স’–এর কোনো সম্বন্ধ থাকার কারণ নেই যেমনটা আজকের আলোচনার প্রসঙ্গ। স্থাপত্যের কিছু দিকও আমাকে আগ্রহী করেছে। অধিকাংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ঘরের জন্য কাচের দরজাতে উৎসাহী, যেসব শিক্ষকদের ব্যক্তিগত বসবার ঘর আছে। এই দরজাগুলো ‘স্বচ্ছতা’র প্রসঙ্গে একটা মজাদার আয়রনি বলা চলে যেহেতু অনেক বিশ্লেষক এই দরজাগুলোর প্রয়োজন দেখতে পান কর্মক্ষেত্রে যৌন–হয়রানি বন্ধের জন্য, এবং বাস্তব সামাজিক সম্পর্কবৃদ্ধির জন্য নয়। যাহোক, তবুও এসবের মধ্যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ও বাইরে এতক্ষণ যে আলাপ করলাম তাতে রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাষ্ট্রোর্ধ্ব নেক্সাস নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন সুদূরপরাহত।
সাইবারস্পেস–ভীতি এবং প্রতিবাদ হিসাবে গালমন্দের চর্চা
‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ প্রসঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপাতদৃষ্টে, এই আইন বিদ্যাকর্মী ও সংবাদকর্মী উভয়কেই নানান মাত্রায় আক্রান্ত করছে। তবে উদাহরণসমেত আরো গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে সিটিজেন সাংবাদিকেরা অধিকতর ঝুঁকিতে আছেন, একেবারেই তাঁদের কার্যপদ্ধতির কারণে। বিদ্যাজগতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে কেন আমি অন্যান্য পেশার উদাহরণ টানছি তা স্পষ্ট করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করব যাতে তাঁরা অনুধাবন করেন যে বৃহত্তর পরিসরের মধ্যে কীভাবে ‘অভিব্যক্তি’র ‘প্রত্যাশিত’ রূপ কেবল নির্দেশ করাই হচ্ছে না, বরং ‘গড়ে দেয়া’ হচ্ছে এবং ‘হুকুমদারি’ চলছে। মানে দাঁড়াচ্ছে, আমি আসলে এটা পরিষ্কার করতে চাই যে নিয়ন্ত্রণকামী আচরণ বাহ্যত পাবলিক পরিসরে আরো বেশি শক্তিশালী; আর সাইবারস্পেস ‘জনপরিসরের’ ক্ষেত্রে অবশ্যই জোরদার নতুন দশা তৈরি করেছে। আমি আরো বলতে চাই যে সাইবারস্পেসের মতামত–অভিব্যক্তির তুলনায় বিদ্যাজগতের কাজকর্ম অনেক কম নজরদারির মধ্যে আছে; শ্রেণীকক্ষের কার্যক্রম আরো কম আছে। ‘বিদ্যামূলক’ লেখালেখির ক্ষেত্রে ইংরাজি রচনা তেমন কোনো রাষ্ট্রীয়–রাডারে থাকে না। তার তুলনায় বাংলা (বিদ্যা) রচনা অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু দৈনিক পত্রিকার কোনো রচনার তুলনায় কম, আর ফেসবুক পোস্টের তুলনায় আরো কম। সমসাময়িক বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রপাতির (বর্তমান সরকার, মন্ত্রীবৃন্দ, সরকারের সুনজরে থাকা কর্পোরেট গোষ্ঠী, আমলাতন্ত্র, এবং অবশ্যই মিলিটারি) সমালোচনা করার ক্ষেত্রে মোটামুটি এটাই সর্বাত্মক রিস্ক–গ্রাফ।
তাহলে, পরিশেষে এটা পেশাজীবীর চয়েসের বিষয় যে তিনি কমফোর্ট–জোনে থাকবেন, নাকি কনফর্মিস্ট–জোনে থাকবেন, গুরুতর ক্ষেত্রে এমনকি এমন একটা জোন একমাত্র সেটাই তিনি জানেন। তাঁদের ক্লাসরুম কর্মকাণ্ড তদন্ত হয় না, তাঁদের বিদ্যারচনা কমই গায়ে মাখা হয়, ইংরাজি রচনা এমনকি আরো ঝুঁকিমুক্ত। তাহলে সমালোচনামূলক অবস্থান থেকে এত দীর্ঘকাল দূরে দূরে থাকা তাঁদের কেবল সেল্প–সেন্সরশিপের কারণেই হতে পারে। এই প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দীর্ঘদিনের নিয়োগদান ব্যবস্থার একটা ফলাফল, আরো কিছু বিষয়সমেত। ‘মিডিওক্রিটি’ একটা কর্কশ শব্দ, অসম্মানজনকও বটে, কিন্তু বাংলাদেশী বিদ্যাজগতের সাম্প্রতিক নিয়োগব্যবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ এই শব্দটা ছাড়া আর কিছু খুঁজে নাও পেতে পারেন। মতাদর্শিক/নিউলিবেরেল বিশাল বদলের মধ্যে ‘সাকসেস’ কিংবা ‘ক্যারিয়ার–ড্রাইভ’ কথাগুলোর যে মানে দাঁড়িয়েছে, তাতে অধিকাংশ বিদ্যাকর্মীর কপালেই ঝুঁকি কিংবা হুমকি–ধামকির সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। আনুগত্যের ক্রমবর্ধমান দশার মধ্যে, অল্প কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যাঁরা এখনো গণতান্ত্রিক অনুশীলনের উপর জোর দেন কিংবা ক্রিটিক্যাল জ্ঞানের রাস্তা খোঁজেন, অধিকাংশই যাঁরা মানবিকী–সমাজবিদ্যার লোকজন, তাঁদের জন্য পরিস্থিতি দিনকে দিন দুরূহ হয়ে উঠছে। শিক্ষকদেরকে তাঁদের মতামতের জন্য গুরুতর অভিযোগ করা হচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, এবং রুটিনমাফিক শাস্তি দেয়া হচ্ছে – সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু ঘটনা এরকম ঘটেছে।
অজনপ্রিয়তার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সমাপনী হিসাবে আমি কয়েকটা কথা বলব। প্রথমত, বাংলাদেশের সরকার, অথবা সরকারের কিছু কিছু অংশ, অতিসম্প্রতি অভূতপূর্ব সব সাইবার–ফোবিয়া আচরণ করছেন যাকে কৌতূহলী লোকজন সরকারের অপ্রস্তুতি হিসাবে দেখতে পারেন। দ্বিতীয়ত, সরকারের এতসব পক্ষ আছে (আমি এখানে চাঞ্চল্যকর কোনো আবিষ্কারের দাবি করছি না, তবে সত্যি সত্যি লোকজন দেখতে পাই যাঁরা যুক্তি সাজানোর সময়ে এই সাধারণ বিষয়টা লক্ষ্য করেন না) যে কখনো কখনো সরকারের হেডকোয়ার্টার বা থিংকট্যাংক সব ধরনের ‘নির্যাতন’ বা ‘শাস্তি’ সম্বন্ধে পরিপূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকে বলে মনে হয় না (যদি না মিডিয়া সম্প্রচার ঘটে)। তৃতীয়ত, ডিএসএ এবং কাছাকাছি আইনগুলো আসলে করছে সেই কাজটা যা কিছু কাল আগেরও সংঘবদ্ধ গুণ্ডাদের ভূমিকা ছিল (গত ২/৩ দশকের ঘটনার একটা তালিকা হতে পারে এরকম, যদিও কেবল এতটুকুই নয়: সাংবাদিকের হাত বা পা কেটে ফেলা, পিটিয়ে মেরে ফেলা, শিক্ষককে পেটানো বা চড়–লাগানো, চাকরি খেয়ে ফেলা, কয়েকটার উদাহরণ হিসাবে)। চতুর্থত, সাইবার–ব্যবহারকারীরা, শিক্ষকরাও আছেন যার মধ্যে, প্রায়শই নজরদারিতে থাকেন আর টার্গেট হয়ে পড়েন তাঁদের ‘মুহূর্তীয়’ মতামত বা অভিব্যক্তির জন্য, এবং তাঁদের দীর্ঘদিনের, পদ্ধতিগত, সুশৃঙ্খল বিশ্লেষণের জন্য নয়। শেষোক্ত কথাটা কিছুটা বিশদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
ধামকাধামকি (বুলিং) আর ঠাট্টামস্করা (মকিং) কে বৌদ্ধিক–সাংস্কৃতিকভাবে ঠিক কখনোই গুলিয়ে ফেলবার মতো জিনিস নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে সাইবার পরিমণ্ডলের মাতমের মধ্যে সেটাই ঘটছে, সরকারের পর্যাপ্ত পরিমাণ বাতিকগ্রস্ত আচরণের কারণে আরো বেশি, অন্তত বাংলাদেশে। বহু ‘ঠাট্টামস্করার’ চেষ্টা কার্যত ‘বুলিং’ বা ‘এবিউসিভ’ বর্গে পড়ে যেতে পারে (আইনের ভাষায় ‘ডিফেমেটরি’); ঠিক তাতেই আমার মনে হতে থাকে যে ভেদরেখাটা খামোকা সূক্ষ্ম হয়ে যাচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্রের চালাকি করে ম্যানিপুলেট করা সম্ভব হচ্ছে। পরিহাসের বিষয় যে, সাইবার–বাসিন্দারা লাগাতার প্রতিপক্ষকে বুলিং আর এবিউসিং করতে থাকেন। নারীরা সুলভ টার্গেট ধারাবাহিক পুরুষালি–ব্যাটাগিরির, প্রায়শই যা দল বেঁধে হয়ে থাকে। আর সরকারের–অনুগতরা এই শাসকদের যথেষ্ট অনুগত–নয় বলে ভাবেন যাঁদের তাঁদেরকেই করতে থাকেন। বুলিং/হুমকিধামকি বাংলাদেশে একটা ধারাবাহিক সাইবার ঘটনা এবং যতক্ষণ না সরকার বা এর নেক্সাসের প্রতি ঘটছে এসব আচরণ রোধ করার তেমন কোনো চেষ্টা নেই। এখন অবধারিত প্রশ্নটা আসে: ‘জনগণ’ যদি ‘সরকার ব্যবস্থাকে’ বুলি করেন আমি কি তাতে মনভার করব? বোঝাই যাচ্ছে, আমি তা করব না। কিন্তু তাঁরা – জনগণেরা – সত্যিকার অর্থে এমন একটা ব্যবস্থাকে বুলি/হুমকি করতে পারেন না যে ব্যবস্থা খোদ ধারাবাহিকভাবে তার সাধারণ মানুষকে ‘বুলিং’ করে চলেছে। বরং কিছু একটা করতে গিয়ে এই অভিযোগের ফাঁদে তাঁরা পড়তে পারেন যদি এবং যতক্ষণ না ঠাট্টামস্করার সূক্ষ্ম সব রূপ পুনরাবিষ্কৃত হয়, যা কিনা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে দানা বাঁধবে। এটা একটা চক্কর আসলে। চারপাশে যখন এত কম সহযোদ্ধা, এতটাই শক্তভাবে যখন হাজারে–বিজারে সহকর্মী সেল্ফ–সেন্সরশিপ চালাচ্ছেন, যখন লঘুদৃষ্টির সাফল্যপীড়িত সব বিদ্যাকর্মীদের ভিড়, তখন যে কোনো পদক্ষেপই বৃহৎ পদক্ষেপ। আমার ধারণা সূক্ষ্মতা আর ধৈর্য আমাদের প্রস্তুতির একদম কেন্দ্রে থাকতে হবে।