অরাজ
শিল্পী: ভাসিলি কান্ডিনস্কি
প্রচ্ছদ » বন্ধ রাখার পলিসি প্রসঙ্গে ।। মানস চৌধুরী

বন্ধ রাখার পলিসি প্রসঙ্গে ।। মানস চৌধুরী

গত কয়েকদিন ধরে ইউট্যাবের শিক্ষকদের মধ্যে ক্রমাগত বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেবার, ও সাধারণভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেবার তাগিদ ও দাবিনামা জোরদার হচ্ছে। ইউট্যাবের সূচনাকাল থেকে এর প্রবণতাগুলো লক্ষ্য করলে এই তাগিদবোধ গুরুতর হিসাবে দেখার আছে। এখানে গড়ে যা কিছু ‘সরকারের সমালোচনা’ বলে বিবেচিত হতো, তা কিছুকেই দলবেঁধে হামলা করার চল খুব বেশি কাল আগের কথা নয়। সেরকম একটা পরিস্থিতির বদল গণতন্ত্রমনা শিক্ষকদের জন্য দুর্দান্ত অগ্রগতি হিসাবে দেখা চলে।

বিভিন্ন জনের কণ্ঠস্বর আমি লক্ষ্য করলেও দুজনের দুটো স্বরকে বিশেষ বিবেচনায় আনছি। একজন হলেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্প্যুটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক তাহজীব উল ইসলাম। অন্যজন হলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোঃ মাহবুব উল আলম। শেষোক্তজন মাওলানা আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ’র বরাতে মনোযোগ দিতে বলেছেন গত প্রায় বছর দুয়েক ধরে বেতনহীন জীবন কাটানো বেসরকারী ও নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের দিকে। আমার মনে পড়ে গেল, বছর কয়েক আগে নতুন স্প্রে-মরিচ অস্ত্র যোগাড়কারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের সময়কাল। যখন এসব শিক্ষকেরা ন্যূনতম জীবনধারণের দাবিতে ঢাকা শহরে এসেছিলেন, পুলিশ তাঁদের সদ্যপ্রাপ্ত অস্ত্র ও পানিকামান দিয়ে ঘায়েল করে দিলেন। দুজন অন্তত বৃদ্ধ শিক্ষক এই শোকে বাড়ি ফিরে মারা গেছিলেন। তখন এঁদের আন্দোলনে সমর্থন করে একটা রচনা লিখেছিলাম আমি। ইত্তেফাক বা বণিকবার্তায়। ওসব পত্রিকা তখনো আমার কাছে রচনা চাইতেন। যাহোক, রচনাটি পড়ে বেশ কিছু শিক্ষক আর্দ্র হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা আমার ফোন নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দেন। আর যে বার্তাটা বলেন তা স্তম্ভিত হয়ে যাবার মতো: “বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা আমাদের নিয়ে ভাবেন?” মাহবুব সাহেবের বার্তাটি আমাকে আবার সেই অচেনা সহকর্মীদের কথা মনে করিয়ে দিল আমাকে।

তারপরও আজকের এই রচনাপ্রচেষ্টাটি আমার মুখ্যত তাহজীব সাহেবের রচনার উপলক্ষে। ‘রেড এলার্ট’ নামে তিনি চলমান অবস্থার প্রতি আমাদের দৃকপাত ঘটিয়েছেন। তাঁর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুও মুখ্যত বেসরকারী ওসব স্কুলকলেজকে নিয়েই। রচনাটির শেষদিকে এসে তিনি এভাবে প্রশ্ন হাজির করেছেন:

.অন্য পেশার জন্য যেটা করা খুব সহজ একজন শিক্ষক সরকারের কাছে আর সবার মত রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে পারেন না তাঁদের ক্ষুধার্ত পেটের ক্ষুধা মেটানোর দাবি নিয়ে। প্যান্ডেমিকের দোহাই দিয়ে সবাইকে আয়ের ব্যবস্থা রেখে একটি বিশেষ শ্রেণীকে বাইরে রাখবেন আবার তাঁদের জন্য বিকল্প কোন ব্যবস্থা বা প্রণোদনার ব্যবস্থা করবেন না এটা কি ন্যায়সংগত?স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তাঁরা কি তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেনা?নাকি দেশ শুধু ব্যবসায়ী আর সরকারী কর্মকর্তা দিয়েই চালাবেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব উঠিয়ে দিয়ে? প্রশ্নের উত্তর কারো জানা থাকলে দয়া করে জানাবেন।

আমি লিখতে বসেছি আমার অশান্তির জন্য। আমি প্রায় নিশ্চিত যে জনাব তাহজীবের প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। আমি নিজে একে উত্তর হিসাবে দেখছিও না। তবে এই উছিলায় সাধারণভাবেই বন্ধ শিক্ষায়তন পলিসির একটা পাঠপ্রস্তাব আমি হাজির করছি। এটুকু লিখে আমার মনে হলো, এটাও বলা দরকার যে, আমার দেখার পদ্ধতিতে যাঁরা আপত্তি করবেন তাঁরা সরাসরি করলে আমি খুশি হব। উপরন্তু ‘পরে বিশদ লিখব’ বলে বসে থাকতে চাইছি না বলে কিছু বিষয় সংক্ষেপিত হয়ে থাকতে পারে। আপনাদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে সেসব ভাবনা বিশদ করার সময়ও আমি বের করব।

ফ্যামিলি লাইফ ডিউরিং এ প্যান্ডেমিক
শিল্পী: লেইফ লারসন

চলুন প্রথমেই আমরা কমবেশি সকলের জ্ঞাত জিনিসগুলো একবার ঝালিয়ে নিই। এটা আমি স্কিমেটিক্যালি/অনুচ্ছেদীয় পদ্ধতিতে করতে চাই। এখানেও যদিওবা আমি সকলের জ্ঞাত বললাম, কোনো পর্যবেক্ষণে যে কারো আপত্তি পেশাগত রাস্তাতেই জানতে পারব ধরে নিচ্ছি।

এক।। ২০১৯ এর ডিসেম্বর মাস থেকে করোনার বৈশ্বিক হৈচৈয়ের সময় থেকেই বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা নিয়েছিলেন সেই রাস্তা যা বহুকাল ধরেই তাঁরা নিয়ে থাকেন। ডিনায়াল। “আমাদের এইখানে কিস্যু হবে না।” কিংবা “আমাদের অমুক তমুক লিডার থাকার কারণে ভাইরাস ডরায়ে পালায়ে যাবে।” প্রপাগান্ডিস্ট মন্ত্রী-সাংসদ-কর্মী ও প্রেস মোটামুটি এই ভূমিকায় রইলেন।

দুই।। লকডাউন যখন বৈশ্বিক আওয়াজ তখন ২০২০-র মার্চ মাসে আকস্মিক লকডাউন বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করলেন। আর লকডাউন ঘোষণার জন্য দেশের আর্থ-সামাজিক খতিয়ান যতটা আন্তরিকভাবে নেবার কথা তার ধারেকাছেও বাংলাদেশে নেয়া হয়নি। কোনো গরিবের জন্য কোনো ধরনের গৃহাভ্যন্তরীণ জীবনযাপনের রসদ দেয়া হয়নি। যদি ভারতে গরিব মানুষের ঢল রাস্তায় না নামত তাহলে হয়তো বাংলাদেশী প্রশাসনের করোনায় অসংবেদনশীল আসনের প্রথমস্থান লাভ করতে বিশেষ কোনো কম্পিটিশনেরও প্রশ্ন আসত  না।

তিন।। লকডাউনে গরিবেরা নানাবিধ পেশায় মরিয়া জীবনযাপন শুরু করার চেষ্টার শুরু থেকেই লাগাতার গালমন্দ খেয়ে আসছেন ভদ্রলোকদের। তাঁরা স্বাস্থ্য-অসচেতন, লকডাউন মানেন না ইত্যাদি। এই ‘অচেতন’ ফেরিওয়ালা ও মজুরকুলিগণের প্রতি ভদ্রলোকদের গালির বয়সও প্রায় করোনারই বয়সী। এখন পর্যন্ত ঘরের দরজা থেকে পটল কেনার পর বাসায় পটল খেতে খেতে ওই গরিবের “অসচেতন” সত্তাকে গালি দেয়ার অভ্যাস বলবৎ আছে ভদ্রলোক শ্রেণীর।

চার।। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল-কলেজ, বেসরকারী স্কুল-কলেজ, এমপিও-ননএমপিও সকলেই ‘লকডাউনে’ কাটা পড়েছে এক কোপে। অর্থাৎ কোনো দূরদর্শী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতাধীন হয়ে তাঁর বন্ধ বা বন্দি নন। দশাটা প্রায় প্রতি সপ্তাহে নবায়নযোগ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোঁতাকুঁতিমূলক ঘোষণাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে আছে।

পাঁচ।। বেসরকারী কথাটা ঘোর এক বে-ইনসাফ বাংলাদেশে। এখানে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ও বেসরকারী। ম্যাপল লিফ বিদ্যালয়ও বেসরকারী। আবার কোনো এক রসুলপুরের দীননাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ও বেসরকারী।

ছয়।। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটের উপর স্বায়ত্বশাসনের দুর্ভার বহনের লজ্জা নিয়ে চলতে চলতে প্রায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক পৃষ্ঠার নোটিসের শাসনের অধীন বানিয়েছে নিজেদের।

সাত।। উপাচার্য নিয়োগ ছাড়া আর যে কাজটাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টগবগে উত্তেজনা দেখা যায় তা হলো বিসিএস নিয়োগ। বস্তুত করোনার মধ্যে যা ও যতটুকু পরীক্ষা হয়েছে তা বিসিএসের লক্ষ্যেই হয়েছে। বিসিএসটা যে পেছালো সেটাই বরং বেরসিকের মতো এন্টিক্ল্যাইম্যাক্স ঘটেছে।

আট।। ইউজিসি একটা রহস্যোপন্যাসের নায়কের মতো সংস্থা যাঁদের কর্মকাণ্ড টের পাওয়া যায়, কিন্তু ঠিক কোনোকালেই বোঝা যায় না যে কী করছেন।

নয়।। করোনা নির্বিশেষেই বাংলাদেশের হেভিওয়েট অধ্যাপকেরা উপাচার্য হওয়াহওয়িকেও থোড়াই কেয়ার করে প্রথমে জাতিসংঘ অন্যান্য বেরাদরিতে “উচ্চমূল্য গবেষক” (কমিশন্ড রিসার্চার বা ভাড়াইট্যা প্রতিবেদক) হলেন; আরো পরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের “গবেষণা ফান্ড” পেতে থাকতেন। এসব ফান্ডের পরিমাণ আপনাদের মধ্যে যাঁদের হৃদপিণ্ড দুর্বল তাঁদের না-জানাই ভাল। আর কীভাবে পাওয়া যায় তা আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমার জানমালের নিরাপত্তাহীনতা ঘটাবেন না প্লিজ। (এই অংশটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার অপ্রাসঙ্গিক ইস্যু নয়; একটু ভাবলেই বুঝবেন। সহজ ক্লু দিই … দেশের উন্নতির জন্য ওসব গবেষণা কি বসে আছে?)

দশ।। সরকার, তার অংশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একপৃষ্ঠা নোটিসে শাসিত থাকতে পেরে খুশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাস্তবে কোনো কিছু জানে না। সকলে সকলের জন্য অপেক্ষা করে আছে। এবং সম্ভবত পাশের দেশের দিকেও তাকিয়ে থাকতে পারে – কখন কী খুলল বা বন্ধ হলো।

এই তালিকাটি আসলে সর্বাত্মক হলো না। আরো কিছু বিষয় অনায়াসেই আসতে পারে। ডিজিটাল কাল। পরেও সংযোজন করা যাবে। আমি আসলে দেরি করতে চাইছি না। যদি এগুলোতে আপনাদের সম্মতি থাকে তাহলে আপনারা নিজেরাও হালিখানেক যোগ দিয়ে নিতে পারবেন। বরং, কী কী পরিস্থিতিতে এই ‘বন্ধ পলিসি’টাই আমাদের অধিনায়কদের সব থেকে পছন্দের হচ্ছে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করি।

শিল্পী: লিওন জারনিটস্কি

ক. আতঙ্ক ও অজনপ্রিয়তার পরিস্থিতি      

এটা সবচেয়ে সহজ বিষয়। আমি না লিখলেও চলত। অন্তত যে তিনটা পরিস্থিতি আমি লিখব তার মধ্যে এটাই ধ্যাবসা কিসিমের। বাচ্চারা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে সংক্রমিত হতে পারেন। আর তাতে বিশ্বদরবারে ভারী বদনাম হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা প্রতিপালকদের মনে দেখা দেয়া সঙ্গত। এটাই দীর্ঘসূত্রিতার কারণ। তবে কোনো পরিকল্পনা বা দূরদর্শিতা না থাকার পক্ষে এই আতঙ্ক যথেষ্ট নয়। কিন্তু কী করা! বলা হয়ে থাকে রাজা তাঁর প্রজাদের আত্মার অনুরূপ। হয়তো আমরাই ভ্যাদভ্যাদা। তবে এটা ঠিকই যে বাংলাদেশের করোনার মৃত্যুমিটার বেশ স্লো। আমাদের কম ভয় পাওয়া অন্যায্য হতো না। বিশেষত, লকডাউনের সময় গরিব মানুষের জন্য ঠেলাঠেলির পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে যে রাষ্ট্র তার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এত ভয় মানায় না। 

খ. বেতনভুক ও অবেতনভুক ভেদাভেদ পরিস্থিতি/পলিসি    

জনাব তাহজীব ও জনাব মাহবুবের কনসার্নের সঙ্গে খুব যায় এগুলো। বিভিন্ন আপৎকালীন সময়ে সমাজের শ্রেণীগত পাটাতনকে দোমড়ানো-মোচড়ানো কিংবা পুনর্গঠন করা শাসকদের (এটা কেবল একটা সরকারী দল বোঝাচ্ছি না, বৃহত্তর সিস্টেমের দণ্ডমুণ্ড কর্তারা) অত্যন্ত প্রিয় ও পুরাতন কাজ। যাঁরা মার্ক্সবাদকে তীব্র ঘৃণা করেন তাঁরাও এই শ্রেণীভেদ পুনর্গঠনের বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারেন। বস্তুত ইনসাফ-বেইনসাফের প্রসঙ্গ, কিংবা সুবিধা দেয়া ও হরণ করার প্রসঙ্গ একজন বেচারা মার্ক্সের সঙ্গে অত সম্পর্কিতই নয়। এই যে আমরা বেতন পাচ্ছি ও বগল বাজাচ্ছি, রাতের বেলা চিচিঙ্গার হালুয়া রান্না করে ফেসবুকে পোস্ট করছি আর তাহজীব-মাহবুব যাঁদের কথা বললেন তাঁরা চোখের পানিতে নিশাবসান চাইছেন এইখানে একটা কেরামতি সব সময়েই থাকে। সেজন্যই আমাদের নাকের ডগাতেই্ যখন ম. খা. পুলিশ ওই গরিব মাস্টারদের পেটাই দিল আমরা ঠিকই পাশে ঢাবি কলাভবনে বা কার্জন হলে ঢুকে ফুকো বা মার্ক্স, রবীন্দ্রনাথ বা পার্টিকেল ফিজিক্স পড়তে পারলাম। অন্য সময়ে “ওহে সহকর্মী বৃন্দ, আ গলে লাগ যা” বলে সেসব স্কুলের মরিচের গুঁড়াচোখের শিক্ষককে কোলাকুলি করলেও, আমরা উভয়পক্ষই জানি শিক্ষক হয়েও আমরা একজাতের শিক্ষক না। বাস্তবে, শ্রেণী পুনর্গঠনে অত্যন্ত পাকা হলো জাতিসংঘ। দেশে যখন চার হাজারের চাকরি মাস্টার্স পাশেরা (ধরুন পুরুষই) পাননি, তাঁরা বিশ হাজারের চাকরিতে ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ’ শুরু করে দিলেন। আপাতত বন্ধ শিক্ষায়তন মানেই মিনিমাম দুই রকমের মাস্টার – খেতে পাওয়া মাস্টার, আর না-খেতে পাওয়া মাস্টার। মেলা বুদ্ধি এঁদের।

গ. আন্দোলনহীন দন্তনখরহীন ক্যাম্পাস পলিসি    

এটাকে অতিশয় গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। আপনারা যদি ভেবে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ কেবল ভিসি নিয়োগ দেয়া, আর ভিসিদের কাজ কেবল ফিতা কেটে বিভিন্ন জিনিস উদ্বোধন করা তাহলে তা ঠিক নয়। এগুলো অতিশয় মস্ত কাজ। তবে একাংশ মাত্র। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা এলে কিছু উত্তেজনার সম্ভাবনা আছে। এটা ঠিকই বাংলাদেশ এখন প্রায় শতভাগ মিঁউবিলাইয়ের দেশ। তা সত্ত্বেও কিছু কিছু পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে যে কিছু মানুষের ঈমান জাগ্রহ হতে পারে এবং ইনসাফ-ন্যায্যতার লড়াই দেখা দিতে পারে। সেটার বিষয়ে চুলচেরা খতিয়ান ছাড়া কর্তৃপক্ষ নড়বেন না বলেই মনে হয়।

আপনারা বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন। ঘটনাচক্রে আমি জাহাঙ্গীরনগরে চাকরি করি। আমার চাকরিপ্রাপ্তির ইতিহাস সহজ ছিল না। যদি ২৫ বছর আগে দেশে এতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকত, তাহলে আমারও যে কোনো একটাতেই হয়তো কাজ করতে থাকার বাস্তবতা তৈরি হতো। আমি শুধু চাইছি আপনারা ভাবুন যে কেন তিনটা তিন তলা ভবন দাঁড় করিয়েই একটার পর একটা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষত “বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি” বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হলো! এমনকি কোনো কোনো ক্যাম্পাস একটা স্ট্যান্ডার্ড জেলা শহরের সরকারী স্কুলের তুলনায় ক্ষীণকায়া, কোনো কোনো ক্যাম্পাসে যে কোনো পুরান কলেজের সমান একটা (প্রধানত পুরুষের) খেলার মাঠ নেই। আপনারা একটু ভাবুন যে কেন ঢাকা বা রাজশাহী বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে থাকা কলেজগুলোকে টেনেটুনে একটা ম্যালফাংশনিং কর্তৃপক্ষের হাতে দেয়া হলো! কীভাবেই বা সময়কালটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিকাশকালের সঙ্গে মিলেমিশে গেল! এগুলো ভাবলেই উচ্চশিক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিনের একটা নকশা (নীলনকশা মেলাদিন ধরে বলে বলে কেমন জানি হয়ে গেছে) বুঝতে পারবেন। এই নকশার মধ্যে খাপছাড়া যেটা ঘটে গেছে তা হলো ভ্যাট ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যা কিনা কর্তৃপক্ষের হিসাবের বাইরে থেকে গেছিল। তবে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে কী চলছে, কীভাবে ‘শিক্ষার্থী-বান্ধব’ শিক্ষকদের আলাদা করে টার্গেট করা হচ্ছে তা মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারেন।

ঘ. গুদামপোড়া ও আলুপোড়া পরিস্থিতি     

এটা গ্রামীণ গল্প, আপনারা সবাই জানেন। কারো গুদাম পোড়ে আর কেউ আলুপোড়া খাবার শখ করে তখন। যে কোনো আপদকালীন পরিস্থিতিতেই কেউ কেউ বাণিজ্য সম্ভাবনা দেখতে পান। ১৯৭১ সালেও জমির দালালি করেছেন অনেকে যাঁরা নামমাত্র বা বিনি পয়সায় কারো না কারো, সাধারণত হিন্দুদের, জমি বিক্রির দালালি করেছেন। করোনায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে কী কী ঘটেছে তা বলে আমি আমার কপাল পোড়াতে চাইব না। কিন্তু আমি না বললেই যে আপনারা জানেন না তা তো নয়। তাছাড়া বাংলাদেশ কেন শুধু, পৃথিবীর মহাশাসক আমেরিকাতে পর্যন্ত জনসন আর ফাইজার কাইজার কথা আপনারা জানেন। সারা বিশ্বে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মাস্তানি বিষয়ে আমার মতো রোগাপটকা শিক্ষক না বললেও চলবে। আর বাংলাদেশের কথা তো বলবই না। কিন্তু করোনা বা যে কোনো মহামারীতে স্বাস্থ্যখাতের বাণিজ্যগুলো যত সহজে বোঝা যায় শিক্ষাখাতের বাণিজ্যগুলো তো অত সরল নয়।

শিল্পী: আরশিল গোর্কি

আপনারা পাশের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতেই যদি লক্ষ্য করেন, যদিও এসব চ্যানেলের আদিমালিক বা আসল মালিক খুব জটিল বিষয়, কিন্তু টার্গেট অডিয়েন্স হিসাবে ভারতীয় চ্যানেল ধরেই আগাই, দেখবেন এই করোনাকালে (ভদ্রলোকী) শিশুদের জন্য কতগুলো ডিজিটাল-শিক্ষালয় চালু হয়েছে। এসব কাজে প্রায়শই সামাজিক দায়দায়িত্বের গালগল্প থাকে; কিংবা নন-প্রফিট ট্যাগ। দয়া করে আদ্যোপন্ত অবিশ্বাস করবেন গোড়াতেই। এগুলো বিশাল সব বাণিজ্যিক প্রকল্প। কেবল বৈশ্বিক মধ্যবিত্ত বাসায় বসে বসে খরচ করেছেন বলেই এমাজন বা নেটফ্লিক্সের মতো কোম্পানি সব লালে লাল হয়ে আছে (ফাইজার টাইজার তো আছেই)। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে নয়া বাণিজ্য সম্ভাবনাগুলো আমাদের মতো দেশে এখনো পুরোটা খতিয়ে দেখা হয়নি। কে খতিয়ে দেখেনি? মানে হলো, যাঁরা “সামাজিক দায়দায়িত্ব” নিয়ে নিছক “ননপ্রফিট’ কর্মকাণ্ড চালান তাঁরা পুরোটা এখনো বুঝে সারতে পারেননি যে এখানে কী কী বাণিজ্য লুকায়ে রয়েছে। কথায় বলে “যেখানে দেখিবে ছাই”। আর আমরা যাঁরা এখানকার কর্মচারি আমাদের তো কল্পনাশক্তিতেই পুরা নাই যে কী কী বাণিজ্য হতে পারে। এখানে আপনাদের হোমওয়ার্ক হিসাবে যে কোনো নতুন প্রকল্প লিখে গুগলসার্চ করলেই যে পেয়ে যাবেন অংকের খতিয়ান ততটা সহজ নয়। তারপরও কোঁতাকুঁতি করলে কিছু জিনিস বুঝবেন।

যেমন আমি এই রচনা লিখতে গিয়েই রিসেন্ট প্রকল্পের তালিকায় যৎসামান্য ১০ হাজার কোটি টাকার কিছু হিসাব পেলাম যা কিনা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ হয়েছে। এর মধ্যে ১৮০০ কোটি টাকার একটা প্রকল্প হচ্ছে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যকার শিশুদের এনআইডি বা এইরকম কিছু। আমি আরো মনোযোগ দিয়ে খুঁজতে পারতাম। খুঁজিনি তাড়াহুড়ার কারণে নয়। দুটো কারণে। এক, খুঁজলেও স্ফটিকস্বচ্ছ কিছু পাব না। দুই, না খুঁজলেও আমার বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু আপনাদের যাঁদের হাতেনাতে প্রমাণ না পেলে কোনো কিছুই বোঝা হয়ে ওঠে না, তাঁরা অবশ্যই নানান কায়দা করে খোঁজা চালিয়ে যান। নেটে ভূত থাকে। নানান কিছু খেয়ে ফেলে। সাংবাদিকতার জগতে ভূত থাকে, নানান কিছু খেয়ে ফেলে। তারপরও নানান আলামত পাবেন, যার সঙ্গে আপনার কল্পনাশক্তি মিশিয়ে ভালমতো কিছু “ডেটা” বুঝে যাবেন আপনি। ধরুন বিডিরেন। এটা তো আজ আপনাদের সকলেরই চেনা। কী লেখা আছে তাঁদের কোম্পানি বিষয়ে? কয়েকটা বাক্য এরকম: “BdREN is being operated as a Non-profit Trust organization with a board of trustees consisting of representatives from the universities/user communities, UGC, MoE and other members co-opted for their expertise and position in relevant industries.” এই যে শেষে কয়েকটা শব্দ পেলেন – এক্সপার্টিজ, ইন্ডাস্ট্রিজ – এগুলো কিন্তু বোমার মতো। আপনি কনুই কামড়িয়ে মরে গেলেও সঠিক জানতে পারবেন না যে কার কী ভূমিকা, কী কর্তৃত্ব, কী পরিকল্পনা, আর কী আয়। ঠিক সেভাবে পাসপোর্ট ছাপানোর কন্ট্রাক্ট কে পান, ওই অভূতপূর্ব সাবেক এনআইডি’র ঠিকাদারি কার ছিল ইত্যাদিরও পুরা হদিশ হয়তো করতে পারবেন না। কিন্তু এটুকু যদি বিশ্বাস করেন যে এগুলো বস্তা বস্তা টাকার প্রজেক্ট, তাহলে আমার উপর বিশ্বাসের কারণে আপনার কোনো পাপ হবে না। পরের যেটা স্মার্ট আইডি সেখানে অবশ্যই গণেশ মুখার্জির নাম গণি মণ্ডল হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে ওটা কম টাকার প্রকল্প তা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং ওটা আগের ওই দুর্দান্ত মানের বস্তুটার তুলনায় দশগুণ বেশি হয়ে থাকবার কথা। এটুকু বুঝে গেলে আপনারা বুঝতে পারবেন যে আগামীতে কিছু লোক ঘাপটি মেরে নানান এ্যাপ, ঠ্যাপ ইত্যাদির ভূয়সী “ননপ্রফিট” সব প্রকল্পের অপেক্ষাতেও আছেন।

আমার এই রচনাটি সম্পূর্ণ হলো না। কিন্তু অসম্পূর্ণ রচনা এটি নয়। নন-এমপিও ওই শিক্ষকেরা যদি এখনো বেঁচে থেকে থাকেন তাহলে তা অবশ্যই তাঁদের জানের শক্তি। কিন্তু আমরা যাঁরা প্রতিমাসে বেতন ব্যাংকে পেয়ে যাচ্ছি, তাঁরাও যে এই ব্যবস্থায় বেঁচে আছি তা প্রমাণ করা খুব কঠিন। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ গায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ চিমটি কেটে দেখা দরকার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আদাবর।। ২৭ মে ২০২১।। বিকাল ৫:৩২

মানস চৌধুরী

মানস চৌধুরী নৃবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিদ্যায়তনিক পরিসর ছাড়াও লেখালেখি করেন নানাবিধ ফোরামে। প্রকাশিত বই: জনসংস্কৃতি ও মধ্যবিত্ত (২০২১); দৃশ্যগত নৃবিজ্ঞান (২০২০); নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ (রেহনুমা আহমেদ-এর সঙ্গে যৌথ বিরচিত) ২০০৩; কর্তার সংসার (সায়দিয়া গুলরুখ-এর সঙ্গে যৌথ সম্পাদিত) ২০০০; জলপরী আর জলাতঙ্ক (২০২০); কাকগৃহ (২০০৮) ইত্যাদি।