অরাজ
শিল্পী: কাহলিল জিব্রান
প্রচ্ছদ » ভাষার বিরুদ্ধতা আর জিব্রানের মুখোশ

ভাষার বিরুদ্ধতা আর জিব্রানের মুখোশ

মানস চৌধুরী

এক. ব্যক্তির ভাষা

ব্যক্তিসমুহের মধ্যে যোগাযোগ নির্মাণ ছাড়া ভাষার অপরাপর ভূমিকাগুলো ‘সামাজিকায়ন প্রক্রিয়া’ (socialisation process) তে গুরুত্বপূর্ণ করে দেখা হয় কি? সামাজিকায়ন প্রক্রিয়া যেহেতু সমাজের মধ্যে ব্যক্তির পৌনঃপুনিক  অন্তরায়নের (internalisation) বিষয়মাত্র, তাই ভাষা সেখানে ধারণ করে ‘ব্যক্তি’ কে; সঠিকভাবে বললে ‘ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে, ব্যক্তির মধ্যকার ‘সামাজিক মানুষ’কেও। প্রাক-ভাষা (ভাষার আধুনিক ধ্বনি ও লিপিকে বিবেচনা করলে) যুগের যোগাযোগ ব্যাপারটি নিশ্বয়ই দুরূহ ছিল। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমরা ‘ব্যক্তি’র, মূলত ‘সামাজিক মানুষে’র অভিজ্ঞতাকে প্রকাশিত হতে দেখি। তার অভিজ্ঞতা প্রকাশ পায় তথ্য আর বর্ণনার মধ্য দিয়ে। তথ্য আর বর্ণনাকে আলাদাভাবে দেখবার কিছু অবকাশ বোধহয় হয়েছে। সাধারণত ভাষা ব্যবহারের অভিমুখ রয়েছে এবং যা কিছু বলা হয় তার সবটাই প্রয়োজনীয় ‘তথ্য’ হয়তো নয়, তবে ক্ষেত্রবিচারে গুরুত্বপূর্ণ ‘ভাষা’ কখনও। ‘সামাজিক মানুষ’ এখানে ‘পর্যবেক্ষণকারী’। কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতাতো বিভিন্ন, তার-তাদের এমনকি তথ্য আর বর্ণনার ভাষাও কি ছিন্ন হচ্ছেনা তাহলে? ‘আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, কোন দুজন বক্তারই একরকমের ভাষা নয়, কারণ কোন দুজন বক্তার ভাষার অভিজ্ঞতা এক নয়।’ ভাষার অভিজ্ঞতা প্রাথমিক বিচারে সামাজিক অভিজ্ঞতা; ‘চৈতন্য’ তাহলে এর পরই আসে। এমনকি ‘চৈতন্য সামাজিক অভিজ্ঞতার অভিঘাত হতে উৎসারিত হলেও তা ক্ষেত্রজ বিশিষ্ট।

আবার, ভাষা মূল্যায়নও বটে, ব্যক্তির ‘মূল্যায়ন’, ‘ব্যাখ্যা’ কিংবা ‘বিশ্লেষণ’। ব্যক্তিসমূহের মূলায়ন, ব্যাখ্যা ও বিম্লেষণ সমাজঘটনা প্রবাহের নতুন অর্থ তৈরি করতে থাকে। মানুষের প্রজ্ঞা তখন, বাড়তে থাকে বা ভিন্ন হয় কারণ ‘সত্য’ কিছুতেই আর বিবলিক্যাল কিংবা বেদ-বাক্য থাকেনা, প্রতিনিয়ত ‘বচনে’র অভিঘাতে পড়ে তা। ব্যক্তিকে আর তখন পর্যবেক্ষণকারী নিতান্ত ‘সামাজিক মানুষ’ হিসেবে পাইনা। পাই ‘উপলব্ধ’ এবং ‘অনুভূত’ মানুষ হিসেবে। এখানেই ব্যক্তির চৈতন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং গুরুত্ব পায় গুটিকতক প্রশ্নও। ‘উপলব্ধ’ এবং ‘অনুভূত’ মানুষ কি সামাজিক মানুষ নাকি একক ব্যক্তি? এই মানুষের সকল ভাষারই কি অভিমুখ রয়েছে; এমন ভাষা কি নির্মিত হতে পারে না বা হয় না যার কোন বিশিষ্ট ‘অন্যপক্ষ’  (শ্রোতা) দরকার পড়ে না –  নিতান্ত নিরাসক্ত-নিলিপ্ত কথন (কথোপকথন নয়,  যে ভাষা বলাই হয় নতুবা নির্মিত হয় মস্তিষ্কে) শুধুই নিজের ‘অস্তিত্ব’ কে স্মরণ করবার জন্য? এই ভাষা প্রকাশ পেলে যোগাযোগ বিভ্রাট এমন কি যোগাযোগহীনতা তৈরি হতে পারে না? যদি হয়ই, ‘সামাজিকায়ন প্রক্রিয়া’ তখন কী প্রকৃতির? বলাই বাহুল্য, হাডসনের বর্ণনায় মানুষের ভাষার চতুর্মাত্রিক স্বতন্ত্র্যের (বয়স, উৎসক্ষেত্র, সামাজিক শ্রেণী বা পেশা এবং লিঙ্গ) সাথে চৈতন্য’ কে যুক্ত করেই দেখতে চাওয়া জরুরি।

দুই. জিব্রানের মুখোশগুলো

জিব্রানের মুখোশহীন যে পাগল সে কি ব্যক্তি না কি সামাজিক মানুষ? “…For the first time the sun kissed my own naked face and my soul was inflamed with love for the sun, and I wanted my masks no more…”। যদি মুখোশগুলো হয় ব্যক্তিত্বের ধরনসমূহ তাহলে মুখোশ হারিয়ে পাগলটি পরিণত হয় সামাজিক মানুষে এমনকি বিজ্ঞানের বেলায় প্রাকৃতিক মানুষেও হয়তো। কিন্তু, আমাদের দূর-কল্পনাতেও তো এমন সমাজ দেখি না যেখানে এই মুখোশহীনকে সামাজিক মানুষ হিসেবে দেখবার সুযোগ মিলবে। বরং সে পাগলই হয়ে পড়ে, যেহেতু তার চারপাশে ‘সুস্থ’ মুখোশধারী মানুষেরা। সে মানুষেরা সমাজবদ্ধ এবং সামাজিক ক্রিয়াশীলতা তাদেরকেই ঘিরে। আর সেই ক্রিয়াশীলতা নিদারুণ উপদ্রুত হয় এই নগ্নমুখের মানুষটিকে নিয়ে। এভাবে একটি সংকটকে আমরা উম্মোচন করে ফেলি এবং নিশ্চিত হতে বাধ্য হই: যে রাস্তায় ও জনপদে জিব্রানের মুখোশহীন মানুষটি দৌড়ে বেড়ায় সেই রাস্তা ও জনপদ অনিবার্যভাবেই ভিন্ন ‘অভিজ্ঞতা’, সঠিকভাবে বললে ‘উপলব্ধি’ নিয়ে ঐ মানুষটি কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়ান এবং বলেন “… And I have found both freedom and safety in my madness; the freedom of loneliness and the safety from being understood, for those who understand us enslave something in us…”।

এই ব্যক্তির নিজস্ব একটি ভাষা আছে। সমাজে সেই ভাষা ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে নিজেও বিযুক্ত হয়ে পড়ছে। ব্যক্তি-একই সঙ্গে, যেহেতু ভাষাই তার যোগাযোগের মাধ্যম, বিযুক্ত হচ্ছে। বিযুক্তির আদল নানাবিধ। ‘শ্রেণী’ যখন ভাষাকে তৈরি করে, তখন সে ভাষায় ‘রাজনীতি’ থাকে, ‘স্তর’ থাকে যখন, আর থাকে ‘অবদমন’। সে ভাষাও তখন বিযুক্ত হয়ে পড়ে পরস্পর হতে। কারণ, ভাষা তখন নিছক তথ্য আদান প্রদানের যোগাযোগ নয়, সে নির্মাণ করে কতকগুলো বিরুদ্ধ-চেয়ার যেখানে উপবিষ্ট থাকছেন ব্যক্তিসমূহ। এই বিরুদ্ধতা প্রকারান্তরে তৈরি করে অচেনা পরিবেশের পটভূমি। বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব বিরুদ্ধাচারী হতে হতে সংঘাতময় এমনকি যোগাযোগহীন ও তো হতে পরে। ‘রাজনীতি’ই সেখানে নিয়স্তা।

এভাবে শ্রেণী কিংবা রাজনীতি, চৈতন্য বা বোধ বিবিধ, তাই বিবিধ উপলব্ধিতে তা প্রকাশিত। মুখোশহীনের গল্পটাকে তাহলে অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। যদি অসংখ্য সুদূর বিভাজিত মুখোশ – ভাষার, সৃষ্টি হয় সমাজের অভ্যন্তরে, তাহলে যোগাযোগের অর্থহীনতা তৈরি হয়েই যায়। কারোরই মুখোশহীন হবার দরকার পড়ছে না, সংকট তৈরিতে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে ‘ভাষার’ শর্তহীনতায় দেখা যাচ্ছে না। তাই এই টানাপড়েন। এই টানাপড়েনই তৈরি করে কখনও নির্যাতনের ভাষা। সে নির্যাতন শ্রেণীর, বয়সের কিংবা লিঙ্গের।

শিল্পী: কাহলিল জিব্রান

তিন. অর্থের ভাষা

ভাষার যোগাযোগ বিভ্রাটের বিষয়টি ‘অর্থ’ নিয়ে। আপাত অর্থহীন ভাষা-কাঠামো কিংবা ভাষা-কাঠামোর প্রাথমিক অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা যোগাযোগের উপাদান নিয়ে গঠিত হতে পারে। শ্রোতা কিংবা অভিলক্ষ্য মানুষদের সেই প্রাথমিক অর্থের সীমারেখা অতিক্রম করে যেতে হয়। সেখানে ভাষার তাবৎ গাঠনিক প্রক্রিয়া দৃশ্যত কোনো মানেই তৈরি করে না কিংবা বলা যায় গাঠনিক প্রক্রিয়ার বিন্যাস একটা বা বিবিধ ‘অনুভূতি’ নির্মাণ করে। ভাষার জাল বিন্যাস তখন ‘সাবলাইম’ হয়ে যায় ‘অনুভূতি’ প্রকাশে।

“:      আমাকে সইতে পারবে?

 :      পারব, রাজা, পারব। আমার প্রমোদবনে আমার রাণীর ঘরে তোমাকে দেখতে চেয়েছিলুম বলেই তোমাকে এমন বিরূপ দেখেছিলুম – সেখানে তোমার দাসের অধম দাসকেও তোমার চেয়ে চোখে সুন্দর ঠেকে।         তোমাকে তেমন করে দেখবার তৃষ্ণা আমার একেবারে ঘুচে গেছে-তুমি সুন্দর নও, প্রভু, সুন্দর নও, তুমি      অনুপম।

:       তোমারই মধ্যে আমার উপমা আছে।

:       যদি থাকে তো সেও অনুপম। আমার মধ্যে তোমার প্রেম আছে সেই প্রেমেই তোমার ছায়া পড়ে, সেই     খানেই তুমি আপনার রূপ আপনি দেখতে পাও — সে আমার কিছুই নয়, সে তোমার।

:       আজ এই অন্ধকার ঘরের দ্বার একেবার খুলে দিলুম — এখানকার লীলা শেষ হল। এসো, এবার আমার   সঙ্গে এসো, বাইরে চলে এসো- আলোয়।”

রবীন্দ্রনাথের রাজার রাজা ও সুদর্শনার ‘কথোপকথনের’ মধ্যকার আপাত অর্থ নয় বরং ভেতরকার অর্থই অনুসন্ধিৎসার মুল বিষয়। ‘লা’ ও ‘পারোলে’র মতোই একটা দ্বিবিধ জগৎ তৈরি হয়ে যায় এই ভাষার মধ্যে যাকে প্রতীকী কিংবা রূপক-ভাষা বলা হয়। কিন্তু মনে রাখতেই হচ্ছে যে প্রতীক ক্রিয়াশীল—এমনকি রূপকও, শুধুই অর্থবহতার মধ্যে-অর্থহীনতার মধ্যে নয়; তবে সে ‘অর্থ’ অনুধাবনের জন্য নির্দিষ্ট একটি ‘জনসমাজ’ অর্থে সাংস্কৃতিকভাবে প্রস্তুত থাকে।

ভাষার ক্ষেত্রে এই প্রতীক বা রূপক এবং ভাষা-বহির্ভূত জগতের প্রতীক বা চিহ্ন সংস্কৃতির সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো মাত্রা। প্রতীকবিদ্যা (semantics) আলোচনা করে সেই বিষয় নিয়েই যা মানুষেরা পরস্পর ব্যবহার করে, এবং সার্বজনীনতা দিয়েছে। বিপরীত দিকে ভাষার ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তি’ কখনো নিজেই স্বপ্রণোদিত। প্রতীকী বা রূপক-ভাষা তখন তার চৈতন্যেরই স্মারক থাকে। যোগাযোগ সেখানে বিভ্রাট তৈরি করতে পারে।

শিল্পী: কাহলিল জিব্রান

চার. বেকেটের ব্যক্তিবর্গ

স্যামূয়েল বেকেটের ‘মানুষদের ভাষা অসংলগ্ন নাকি ‘মানুষেরাই’ পরস্পর অসংলগ্ন কিংবা অসংলগ্ন খোদ সামাজিক প্রক্রিয়াটিই? অসংলগ্নতার বিপরীতে নিশ্চয়ই ‘নিমগ্নতা’ কাজ করে। স্যামুয়েল বেকেটের মানুষেরা সমাজে নিমগ্ন নয়–নিমগ্ন খোদ ‘আত্ম’তেই, আত্মনিমগ্ন তারা। অথবা গাঢ় বিচারে দেখলে, নিমগ্ন হবার মত সামাজিক পরিসরই সেটা নয় বরং নিবিড় অসংলগ্নতাই সেই পরিসর তৈরি করতে পারে যার অন্য নাম ‘বিযুক্ততা’। বস্তুত ‘বিযুক্ত’ মানুষেরা বিচরণ করছে এক সমাজহীনতার মধ্যে — সমাজকে সেখানে শিথিল হতে হতে ক্ষীণকায়, হীনবল, ধোঁয়াটেই দেখি। আর তাই মানুষেরা কিছুতেই ‘সামাজিক মানুষ’ দৃষ্ট হয় না হয়তো বরং ঘোরতর ‘ব্যক্তি’ হিসেবেই তারা দৃষ্ট হয়। ভাষা সেখানে ঐ অসংলগ্ন, বিযুক্ত ‘ব্যক্তি’ ও ‘ব্যক্তি-চৈতন্যে’রই ধারক। বিযুক্ত ‘ব্যক্তি’রা চৈতন্য প্রবাহে কাছাকাছি কি না সে বিচারটি অর্থাৎ ‘মনস্কতা’র প্রসঙ্গ ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে কারণ ‘যোগাযোগ’ই সেখানে সচরাচর নয়। তারা বলে:

“:      কিন্তু যেহেতু আমরা নীরব থাকতে অসমর্থ অতএব ইতিমধ্যে একটু শান্তভাবে আলাপ করার চেষ্টা করা   যাক।

:       ঠিক বলেছো, আমরা অফুরন্ত।

:       যেন চিন্তা করতে না হয় সেজন্য।

:       সে অজুহাত আমাদের আছে।

:       যেন আমাদের শুনতে না হয় সেজন্য।

:       যুক্তি আছে আমাদের।

:       সমস্ত মৃতকন্ঠস্বরগুলো।

:       পাখার মতো শব্দ করে তারা।

:       পাতার মতো।

:       বালির মতো।

:       লতার মতো।

কিংবা

:       আমরা আমাদের ব্যায়ামগুলো করতে পারি।

:       আমাদের মুভমেন্টগুলো।

:       আমাদের এলিভেশনগুলো।

:       আমাদের রিলাক্সেশানগুলো।

:       আমাদের এলঙ্গেশনগুলো।

:       আমাদের রিলাক্সেশানগুলো।

:       গরম করে তোলার জন্যে।

:       ঠাণ্ডা করে দেবার জন্য।”

তাছাড়া তারা নিশ্চুপ থাকে অল্পক্ষণ, দীর্ঘক্ষণ; নৈঃশব্দ্যে বসবাস করতে থাকে। এই নৈঃশব্দ্য তাদের স্বতঃস্ফুর্ত কামনা নয়, উল্টো তারা নৈঃশব্দ্য এড়াতেই চায়। কিন্তু বেকেটের ব্যক্তিদের এই-ই পরিণতি। নৈঃশব্দ্য তাদের ভাষারই অংশ, নৈঃশব্দ তাদের ভাষাই। আধুনিক অভিঘাতের সমাজের মানুষদের নৈঃশব্দ্য ভাষা-পরিপূরক হয়ে ওঠে। নৈঃশব্দ্য তখন নিছকই চুপ থাকা নয়। সত্যজিতের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে সিদ্ধার্থ যখন ছোটভাইয়ের গতিবিধি নিয়ে আলোচনা করতে যায়, ছোটভাই তখন ‘চে গুয়েভারা’র জীবনী বের করে দেখায়, জানতে চায় এই বইটি যে একদা সিদ্ধার্থই উপহার দিয়েছে—সেটা সিদ্ধার্থের খেয়াল আছে কি না। এর পর সিদ্ধার্থের চুপ থাকা ভাষাই। এই নির্মাণ আমরা পাই সত্যজিতের আরো সব কাজে, এমনকি চলচ্চিত্রকার অনেকেরই কাজে। ভাষার অভ্যন্তরে নৈঃশব্দ্যের বেড়ে ওঠা এমন এক অনুভবের জন্ম দেয় যা ‘রঙ’ ও ‘সুরে’র প্রকাশভঙ্গির সাথে তুলনীয় হতে চায়। কিন্তু ‘সাধারণ’ বলে সমাজের যে পরিচয়টা আমরা নির্মাণ করি—সেখানে বেকেটের ব্যক্তিদের ভাষা কি স্বতঃস্ফূত অর্থ তৈরি করে? যোগাযোগ কি সেখানে সহজ—যেখানে এই ব্যক্তিরা এতটুকু পরিচিত নয় কিংবা স্বল্প পরিচিত? যোগাযোগহীনতার কোন সঙ্কটই কি তৈরি হয় না?

দি স্লেভ;
শিল্পী: কাহলিল জিব্রান

পাঁচ. Outsider এবং অস্তিত্ত্বের ভাষা

জিজ্ঞাসা ছিল—নিতান্তই নিজের অস্তিত্বকে স্মরণ করবার জন্য নিস্পৃহ কখন কি সম্ভব নয়, যে কথন সংলাপ-রূপান্তরিত হয় না, অভিমুখ পায় না এ কারণে? কিংবা অভিমুখ প্রয়োজন হয় না বলে? ভাষা তো তৈরি হয় মস্তিস্ক কাঠামোতে। চিন্তার ভাষা কি ধ্বনি-লিপির ভাষা? এ বিয়টিও নিশ্চয়ই ‘চৈতন্যের’ বিষয় অর্থাৎ চৈতন্যের শর্তযুক্ত। যেহেতু চৈতন্য সততই ব্যক্তিক পরিসরে ভিন্ন, তাই চিন্তাও ব্যক্তিক পরিসরে ভিন্ন। চিন্তাকে চৈতন্যের সাথে প্রত্যক্ষভাবেই সম্পর্কিত দেখতে হচ্ছে। চিত্রশিল্পী এবং সুরনির্মাতাদের চিন্তার ভাষা ধ্বনি-লিপির ভাষা নির্ভর হতে হবে কেন?

বেকেটের ব্যক্তিদের ভাষা অভিজ্ঞতা জারিত এবং ছিন্নভিন্ন; অথচ সেই একই নগর-অভিঘাতে বিচরণশীল নিঃসীম আউটসাইডার ব্যক্তি কাম্যুর ভাষায় এক নিস্পৃহ বিজড়ন ধরা পড়ে। এই ‘নিস্পৃহ-বিজড়ন’ আবার এক বিষমসঙ্গতি (paradox)। কোথাও বিজড়িত নয়, তাই ‘আউটসাইডার’ এবং তাই তার ভাষা নিস্পৃহ। কিন্তু সেই ভাষা আবার পরস্পর ‘বিজড়িত’—‘অসংলগ্ন’ নয়। কাম্যুর ঐ কথন কি কোনো শ্রোতার অভাব বোধ করে? এ কি আমাদের অভিজ্ঞাত, উপলব্ধ, অনুভূত, অভিঘাতে-দীর্ণ মস্তিস্ককাঠামোতেই নির্মিত প্রগলভ ভাষা নয়? “Mother died today, Or Maybe yesterday, I don`t know…After the funeral though, the death will be a classified fact and the whole thing will have assumed a more official aura… … I had to go up to Emmanuel’s place to borrow a black tie and armband. He lost his uncle, a few months ago… কিংবা  And I fired four more times at a difeless body and the buttets sank in without leaving a mark. And it was like giving four sharp knocks at the door of unhappiness..”

ক্যানভাসে ‘অস্তিত্বে’র চিত্রকলা আঁকবার যে ভাষা—নিঃসীম ব্যক্তির, ব্যক্তির চৈতন্যের; এমনকি কোন অভিমুখ মাত্র বিবেচনায় না এনে—সে ভাষা সাধারণ সামাজিক মানুষের ভাষা কি? ‘আউটসাইডারে’র ভাষাই কি নয়?

স্যামুয়েল বেকেট

ছয়. কানামাছির ‘অর্থ’ তার যোগাযোগ

‘ব্যক্তি’ আর ‘সামাজিক মানুষ’ প্রতিনিয়তই আলাদা। ‘ব্যক্তি’ সমূহের মধ্যে বিস্তর ফারাক চৈতন্যপ্রবাহে। ব্যক্তির ভাষা তাই জটিল এক সময়। মানুষের ভাষা যোগাযোগ তৈরি করবার মৌলিক তাগিদেই তাড়িত। কিন্তু আধুনিক ব্যক্তির যোগাযোগ-প্রক্রিয়া নতুন পরিসর তৈরি করে। ভাষাহীনতাও যেমন ‘অর্থ’ তৈরি করে—তাই অনিবার্য যোগাযোগ সৃষ্টি হয়; আবার ভাষাই অনিবার্য অর্থহীনতা—তাই যোগাযোগহীনতা তৈরি করে।

‘ভাষা মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম’ এই সরল বচনটিকে এমনকি খুব সীমিত শর্তেই কার্যকরী বলা যেতে পারে। ব্যক্তির নানাবিধ ভাষা ‘অর্থে’র নানা ধরণ তৈরি করে, সেই অর্থসমূহ বিভিন্ন ব্যক্তির অভিজ্ঞতা জারিত হয় না বলে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে তা অর্থ বিভ্রাট, স্তরবিভ্রাট ও চূড়ান্ত বিচারে যোগাযোগহীনতা তৈরি করে। ভাষাই যখন যোগাযোগহীনতার নিয়ামক হয় তখন তার ‘সামাজিকায়ন প্রক্রিয়া’ বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে। ব্যক্তির বিবিধ চৈতন্যের ফল হিসেবে বিভিন্ন অধিরূপগুলো অংশত বিভিন্ন প্রতীক-রূপক কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে, ভাষার ভিন্নতা তাই মুখোশের ভিন্নতা কিংবা মুখোশহীনতা। সামাজিক পরিসরে ‘ব্যক্তি’কে কিংবা ‘ব্যক্তিসমূহের’ সমাজবদ্ধতা (বা বিযুক্ততা) কে দেখতে ভাষাই বিশ্লেষক-মানদন্ড হতে পারে কি? জিব্রানের পাগলেরা সমাজ-সংযুক্ত হবেন কীভাবে?

 

তথ্যপঞ্জী

    ১. R. A. Hudson, Sociolinguistics, Cambridge, 1980

    ২. Karl Marx, Capital, Moscow, 1965.

    ৩. Hudson, পূর্বোক্ত।

    ৪. Kahlil Gibran, Madman, The Gratest Works of Kahlil Gibran, Delhi, 1991

    ৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা, বিশ্বভারতী, কলিকাতা, ১৯২০।

    ৬. স্যামুয়েল বেকেট (অনুবাদঃ কবীর চৌধুরী), গডোর প্রতীক্ষায়, ঢাকা, ১৯৮১।

    ৭. Albert Camus, (Trans from the French by Joseph Laredo), Outsider, London, 1982.

 

  • রচনাকাল: ১৯৯৬। প্রকাশ: সমাজ নিরীক্ষণ, সংখ্যা ৬১, ১৯৯৬। পরে লেখকের ‘জনসংস্কৃতি ও মধ্যবিত্ত’ গ্রন্থে সংকলিত, আদর্শ, ২০২১

মানস চৌধুরী

মানস চৌধুরী নৃবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিদ্যায়তনিক পরিসর ছাড়াও লেখালেখি করেন নানাবিধ ফোরামে। প্রকাশিত বই: জনসংস্কৃতি ও মধ্যবিত্ত (২০২১); দৃশ্যগত নৃবিজ্ঞান (২০২০); নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ (রেহনুমা আহমেদ-এর সঙ্গে যৌথ বিরচিত) ২০০৩; কর্তার সংসার (সায়দিয়া গুলরুখ-এর সঙ্গে যৌথ সম্পাদিত) ২০০০; জলপরী আর জলাতঙ্ক (২০২০); কাকগৃহ (২০০৮) ইত্যাদি।