অরাজ
প্রচ্ছদ » রেহানা মারিয়াম নুর: আয়নায় এড়িয়ে চলা প্রতিচ্ছবি

রেহানা মারিয়াম নুর: আয়নায় এড়িয়ে চলা প্রতিচ্ছবি

নাসরিন খন্দকার 

রেহানা মারিয়াম নুর, একে যদি এক কথায় সংজ্ঞায়িত করতে হয়, তাহলে বলবো, এটি খুব বেশি বাস্তব। আপস যখন সমাজের স্বাভাবিক নর্ম, তখন রেহানা একজন একরোখা, জেদি আপসহীনতার দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মানুষ। কিন্তু সে সমাজের বাইরের কোন ব্যক্তি না, বরং চারপাশের সমস্ত সহিংসতা ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়ে রূক্ষ, ক্ষুব্ধ রেহানা বাঁচে, আবার তা ছড়িয়েও দেয় কাছের জনদের। প্রায় সবগুলো দৃশ্যই দমবন্ধ করা এই চলচ্চিত্রে কোন চরিত্রকেই ভাল-খারাপ, উচিত-অনুচিতের মানদণ্ডে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব না। তাই সংজ্ঞায়িত করতে না পারা, সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে না পারাতেই আমাদের জাজমেন্টাল মন ধাক্কা খায়।

রেহানা মারিয়াম নুর’র পোস্টার

বাস্তবে আমাদের আশেপাশের চরিত্রগুলোকে যেমন আসলে ডিফাইন করতে পারি না, কিন্তু তবু একেকটা পকেটে ভরে ফেলেই আমাদের চলতে হয়, রেহানাও তাই। রেহানাকে আমাদের চেনা জানা পরিচিতির বক্সে ফেলা যায় না। আর সেখানেই আমাদের অস্বস্তি তৈরি হয়। আমার কাছে এই ফিল্মের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এইটি। চরিত্রগুলি বহুমুখি, আমাদের ভালোমন্দের মাপকাঠিতে আমরা এদেরকে মাপতে পারি না।

ফিল্ম বিশ্লেষণের অনেক রকম পদ্ধতি আছে, অনেক বিতর্কও আছে। চলচ্চিত্রের কলাকৌশল, জনরা ইত্যাদিতে ফেলে সিনেমা বোদ্ধারা আলাপ আলোচনা করছেন। সেই দিক থেকে রঙ, ক্যামেরা বা শব্দের ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে অনেকের লেখায় ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে চলচ্চিত্রসহ যে কোন শিল্পমাধ্যমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর যোগাযোগের দিকটি, অর্থাৎ, দর্শকের সঙ্গে এর কী ধরনের যোগাযোগ বা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। অনুভূতির কী আবহ তৈরি করছে? দর্শকদের মধ্যে কী ধরনের চিন্তা ও অনুভূতির সৃষ্টি করছে? আমি নিজেকে একজন চলচ্চিত্রের গ্রাহক মনে করি, চলচ্চিত্র বিশ্লেষক না। ফলে একটি ফিল্মের খুঁটিনাটি নিয়ে আমি যতটা চিন্তা করি, তার থেকে অনেক বেশি আমাকে ভাবায়, ফিল্মটি আমার মধ্যে কী করছে। নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে সেই দিক থেকে এই ফিল্ম কে দুইভাবে দেখতে চেয়েছি। এই দুই ধরন সম্পূর্ণ আলাদা না, বলা যেতে পারে একই বস্তুকে দুই চশমা দিয়ে দেখা।

প্রথমটি হোল, দর্শক হিসেবে আমার সাথে এর যোগাযোগ। এই আমি কে? আমি আমার সত্তায় একজন ব্যক্তি মানুষ না, আমি আমার রাজনীতি, সংস্কৃতি, মতাদর্শ, অনুভূতি, চেতন, অবচেতনের একটা সঙ্কর। তো আমার এই সবগুলো সত্তার মিলে মিশে থাকা যে আমি, যে সমাজের অংশ হিসেবে আমি, যে কাঠামো আর তাঁর পীড়নে লড়াইরত এই আমি, তাঁর সাথে কোন চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতাটা খুব ইন্টিমেট মনে হলেও তা আসলে শুধুমাত্র ব্যক্তিক থাকে নাআমার আনুভূতি আমার ইতিহাস আর রাজনীতি থেকে ভিন্ন না, যাকে সারা আহমেদ (২০০৪) বলছেন অনুভূতির সাংস্কৃতিক রাজনীতি। 

রেহানা মারিয়াম নূরের একটি দৃশ্য

সংস্কৃতি আর রাজনীতির একটা অংশ হিসেবে, একজন দর্শক হিসেবে আমার সাথে ফিল্মের এই যোগাযোগের অভিজ্ঞতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার মনে হয়েছে রেহানা মারিয়াম নুর, দর্শক হিসেবে আমার উপস্থিতি, আমার অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মজার দিকটি হোল, পরিচালক সাদ তাঁর কোন একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি দর্শকের কথা মাথায় রেখে চলচ্চিত্র বানাননি, তিনি একটা গল্প বলতে চেয়েছেন। এইটা শুনলে অনেকের মনে হতে পারে তিনি অহঙ্কারী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা আসলে উল্টো। তিনি দর্শকের কাছে তাঁর যা বলার তা শেয়ার করতে চেয়েছেন, এটি বরং দর্শককে সম্মান করে, তাঁর গল্প শোনার কান যে অপরপক্ষের আছে, তাঁর স্বীকৃতি দেয়। আমরা কিন্তু অনেক সময়ই সহজে সবকিছু শেয়ার করতে পারি না, আমাদের গল্পটা বলতে পারি না এই ভেবে যে অপর পক্ষ বুঝবে না। এই যে অপরপক্ষ বুঝবে না বলে পরিচালক দর্শককে একটা ছকে ফেলে সেই ছকে ছবিটা বানাননি, এতেই তিনি সবচেয়ে বেশি সম্মান করেছেন দর্শকদের। দর্শকরা খাবে কি খাবে না, সেই চিন্তাটাই দর্শককে একটি সমরূপী বর্গে সীমিত করে, এবং এটি দর্শককের জন্যে খুবই অসম্মানজনক এবং পেট্রোনাইজিং।  

এখন আসি দর্শক হিসেবে আমার অস্তিত্ব কে স্বীকৃতি দেবার প্রসঙ্গে। এইটা কেন গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্যে? কারণ আমার বেড়ে উঠার কালে আমি বেশিরভাগ চলচ্চিত্র, নাটক, কবিতা বা যে কোন শিল্প মাধ্যমের সাথে সরাসরিভাবে যোগাযোগ করতে পারিনিকেন? কারণ আমাকে কবি, পরিচালক বা নাট্যকাররা গণায় ধরেননি। আর এখানেই মেইল গেজ এর সমালোচনাটা আসে । সিনেমার নারীবাদী সমালোচকরা বলেন, নারী যে জীবন যাপন করেন, যে চোখে জীবনকে দেখেন সে চোখের পরিবেশন কালচারাল প্রোডাক্ট গুলোতে পাওয়া যায় না কারণ, নারীকে দর্শক মনে করা হয় না, মনে করা হয় দর্শনের বস্তু, আর পুরুষ হচ্ছে দর্শক। তো এই বিষয়টা এই নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদে বদলে যাচ্ছে, এখন নারীরাও ক্রেতা হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন, ফলে তাঁদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এমন চলচ্চিত্র বানানো হচ্ছে। 

রেহানা মারিয়াম নুরের একটি দৃশ্য

কিন্তু শিল্পমাধ্যম তো শুধু পণ্যবস্তু না, শিল্প আমাদের সত্তার খোরাক দেয়, আর সেখানেই আমি দেখি যে শুধুমাত্র ক্রেতা না, শিল্পের গ্রাহক হিসেবে এই চলচ্চিত্রটি আমার অস্তিত্বকে সম্মান দিচ্ছে। যে বাস্তবতায় আমি বাস করি, বেড়ে উঠি, যে বাস্তবতাকে আমার শরীর মনে ধারণ করি, যে ক্রোধ, অপমান, প্রতিদিনকার পরাজয় একটু একটু করে আমার সত্তাকে গ্রাস করে, যেভাবে প্রতিদিন নীতির সাথে সংঘর্ষ লাগে এই বাস্তবতার, দুমড়ে মুচড়ে পড়ে যাই আবার আহত হয়েই উঠে দাঁড়াই, এই সবকিছুর সাথে রেহানা মারিয়াম নুর যে সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছে, বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এরকম অভিজ্ঞতা আমার আগে হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। রেহানা মারিয়াম নুর আমার চলচিত্র ক্ষুধা মিটিয়েছেআমি যা দেখে আলোড়িত হতে চাই, তার জোগান দিয়েছে। যে ধরনের শিল্প আমাকে নাড়া দেয়, তার জোগান দিয়েছে। এটি দর্শক হিসেবে আমাকে সম্মান করেছে। আমার মতো মানুষকে দর্শক হিসেবে গণ্য করেছে, আমার বুদ্ধিমত্তা আর আকাঙ্ক্ষাকে অপমান করেনি। আমার মনে হয়নি, আরে পরিচালক কি আমাকে বোকা ভাবে, একটা কিছু বানিয়ে গিলিয়ে দেবার চেষ্টা করলেই হোল? 

আমার দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি হোল, আমাদের সমাজের সাথে এই চলচ্চিত্রের যোগাযোগ। এইখানে আমি আগ্রহী হয়ে উঠি শুধু সিনেমাটি না, বরং এই সিনেমার প্রতিক্রিয়া নিয়ে। কে কী রিভিউ দিচ্ছে আমি পড়ি, আমি আমাদের সমাজের মানুষের পাঠ বুঝতে চাই। আবার এই সমাজের মানুষগুলো কিন্তু সমরূপী না। ফলে নানা রকমের বিশ্লেষণ চোখে পড়ে। আমি দেখি বেশিরভাগ বিশ্লেষণের সাথেই আমার ঠিক পুরোপুরি মেলে না। মেলার কথাও না। কারণ আমরা একই সমাজে বাস করলেও, একই সমাজের অংশ হলেও আমাদের পাঠ কিছুটা আলাদা হয়। এই মিল আর অমিলের মধ্য দিয়েই আমি এই চলচ্চিত্রটিকে বাংলাদেশের মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে দেখি। 

এই যোগাযোগে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে, প্রথমত অনেকেই আলোচনা করছেন যে, এইটি নারীবাদী চলচ্চিত্র কিনা। এই প্রসঙ্গে আমি বরং ঘুরে দেখতে চাই, নারীবাদী বলতে উনারা কি বুঝাচ্ছেন? একটা সহজ সংজ্ঞা তো হোল, নারীর বিরুদ্ধে নিপীড়ন বা সহিংসতার বিরুদ্ধে নারীবাদ অবস্থান নেয়যেহেতু এই ফিল্মে এই বিষয়টি আছে, ফলে অনেকেই একে নারীবাদী ফিল্ম হিসেবে দেখছেন, কিন্তু আবার দেখতে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছেন। কারণ এখানে এমন কিছু বিষয়ও আছে, যা ঠিক নারীবাদ বলতে অনেকেই যা বুঝেন তার সাথে মেলে না। 

কিন্তু আমার কাছে নারীবাদ আরও অনেক অনেক ব্যাপ্ত এবং জটিল একটি বিষয়। আমি নিজেকে একজন নারীবাদী হিসেবে পরিচিত করতে চাই। যদি আমার নারীবাদী সত্তাকে এই ফিল্ম তৃপ্ত করতে পারে তাহলে একে নারীবাদী ফিল্ম বলাই যায়। কিন্তু আমি আসলে এই চলচ্চিত্রকে নারীবাদের লেবেলে ফেলতে অস্বস্তি বোধ করি, কারণ আমার মনে হয় এতে একে সীমিত করে ফেলার ঝুঁকি থাকে। এই প্রসঙ্গে আমার কাছে একটা দৃশ্য খুব ইন্টেরেস্টিং লাগে, রেহানাকে দেখতে আসা আত্মীয়দের মধ্যে নারীবাদ সম্পর্কিত খুবই ক্লিশে আলাপ। বিষয়টি একটু অপ্রাসঙ্গিক এবং বিরক্তিকর লেগেছে প্রথমে আমার কাছেপরে আমি ভাবছিলাম, পুরো দৃশ্যটাতে ঐ আলাপে রেহানার কোন অংশগ্রহণ তো থাকেই না, বরং সে তার ভাইয়ের সাথে ইশারায় অন্য আলাপ চালিয়ে যায়, তারই ফাঁকে ফাঁকে ইমু ক্রমাগত জানালার কাছে যায় আবার ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যায়। এই যে একটি দৃশ্যে সমান্তরালে কয়েকটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটে এটি আমাকে ভাবায়পরে আমার মনে হয় হয়তো এটি এই সব ক্লিশে এবং অতি সরলীকৃত নারীবাদের বাহাসে ঢাকা পড়ে যাওয়া নারীর বাস্তব জীবন আর তার লড়াইকে দেখানোর একটা দৃশ্য। এইটা আমার পাঠএমনটা নাও হতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না। নারীবাদ বলতে অনেকেই যা বুঝে তার সাথে হয়তো এই ফিল্ম পুরোপুরি মেলে না। ফলে এই ফিল্মটিকে সেই লেবেল না দিয়ে বরং আমি বলতে চাই, এই ফিল্মটি কোন কোন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত এবং অভ্যস্ত ধারণাগুলোকে ধাক্কা দেয়। 

রেহানা মারিয়াম নুরের একটি দৃশ্য

একটা তো খুব সহজভাবেই বলা যায় যে, এটি ভালো মেয়ে, ভালো মায়ের ইমেজকে ধাক্কা দেয়। মাতৃত্বের কারণে, বিশেষ করে একজন সিঙ্গেল মাকে যে সার্বক্ষণিক কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, সেই কাঠগড়াকে ভালভাবেই ধাক্কা দেয় এই ফিল্মটি। কিন্তু তার থেকেও বড় যে, এটি এই একা মায়ের লড়াই, আর প্রতিদিনকার অসহনীয় চাপ আর প্রতিকূলতাকে দারুণভাবে দেখায়। তবে দেখতে পাবার বিষয়টাতো আসলে দর্শকের দেখার উপরে নির্ভর করে।  

কিন্তু তার থেকেও বেশি যে বিষয়টি ফিল্মটি করে তা হোল আমাদের মনে জাস্টিস বা ন্যায়বিচারের যে ছকবাঁধা ধারণা বিদ্যমান তাকে দারুণভাবে ধাক্কা দেয়। রেহানা বলে, কেউ দেখেনি বলে তো ঘটনাটি মিথ্যে হয়ে যায়নি।” যৌন সহিংসতার আইনি বিচার প্রক্রিয়ার এই যে একটা অসম্ভব লুপহোল, অপরাধ প্রমাণ করার যে অসম্ভব গোলকধাঁধা, এটি সেই গোলকধাঁধার দেয়ালে ধাক্কা দেয়। বারে বারে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দেয়ার বিষয়টি আমাকে দেয়াল ঘেরা বন্দী মানুষের ক্রমাগত দেয়াল ভাঙ্গার আওয়াজকে মনে করিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, রেহানা এই জাস্টিসের জন্যে একটা আপাত মিথ্যা অভিযোগ দেয়। আপাত বলছি এই কারণে যে, নিপীড়নের ঘটনাটি রেহানার সাথে ঘটেনি, ফলে সাদা চোখে সেটা মিথ্যেকিন্তু আসলে তো ঘটনাটি ঘটেছে। কিন্তু রেহানার মাথায় যিনি অপরাধকারি, শাস্তিটা তাঁর দরকার, নইলে সে আবার এই কাজ অন্য মেয়ের সাথে করবে। ফলে কার সঙ্গে ঘটনাটি ঘটছে, সেটি তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। এটা আমাকে জাহাঙ্গীরনগরের ৯৮ এর ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের সময়কে মনে করিয়ে দেয়। আন্দোলনের সময় যখন প্রশাসন বারে বারে জানতে চাইছিল ধর্ষিতার পরিচয়, আন্দোলনকারী ছাত্রীরা সমস্বরে বলে উঠেছিল “আমরা সবাই ধর্ষিতা”। একইভাবে বেগমগঞ্জের ধর্ষিতা নারীও বলেছিলেন, তাঁর উপরে নিপীড়নের বিচার না হলে বাংলাদেশের সব নারীর পরাজয় হবে। আরেকজন নারীর নিপীড়নের অভিজ্ঞতার পাশে দাঁড়ানো নারী প্রতিমুহূর্তে তাঁর নিজের সাথে নিপীড়িতকে সম্পর্কযুক্ত করেন। তখন ব্যক্তির নিপীড়নের অভিজ্ঞতা থেকে বড় হয়ে যায় যৌথ নিপীড়নের অভিজ্ঞতা। আরেকজন নারীর নিপীড়নের অভিজ্ঞতার পাশে দাঁড়ানো সংহতি থেকে আরেক ধাপ দুরে গিয়ে যখন তাঁর হয়ে লড়াইটি করতে চায় রেহানা, তখন সেটি সত্য থেকে বিচ্যুত হয় ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি কি মিথ্যে হয়ে যায়? নিপীড়িত নারী প্রতিরোধের লড়াই করতে না পারলে, বা না চাইলে, তাঁর হয়ে লড়াইটাকে করতে চাওয়া কি শুধুই সত্য আর মিথ্যের বাইনারি দিয়ে বোঝা সম্ভব? আমার মনে হয়েছে, ন্যায় বিচারের এই পজিটিভিস্ট এবং ব্যক্তিক ধারণাকে রেহানা ধাক্কা দেয়। 

রেহানা একজন একরোখা চরিত্রের মানুষ, যে দরজা বন্ধ দেখলে ক্রমাগত দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে বের হতে চায়, শক্তি দিয়ে ঐ একটা পথেই হাঁটে, কিন্তু পথ ঘুরিয়ে  অন্য পথে লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেন না, জানেন না, বা চান না। আপাতভাবে মনে হতে পারে এইটা তো আসলে খুব দারুণ একটা বিষয়, কিন্তু আমরা দেখি এই একমুখি একরোখা স্বভাবের কারণেই তিনি বুঝতে পারেন না, কিভাবে ইমুর শৈশবের আনন্দকে নষ্ট না করে নিজের নীতির প্রশ্নে অটল থাকবেন। রেহানার এই একরোখা চরিত্র তাঁকে আরও বন্দী করে ফেলে, মেডিকেল কলেজের একটা করিডরের মতো ছোট্ট জায়গায় আটকে ফেলে। এর মধ্যে আর কোন পথ দেখায় না। তিনি বুঝতে পারেন না কিভাবে নিপীড়ন ছাড়াই ইমুকে তার সিদ্ধান্তকে বুঝিয়ে বলবেনএই দ্বন্দ্ব তাঁকে ভয়াবহভাবে বন্দী করে। মা হিসেবে আমার তখন অস্থির লেগেছে, মনে হয়েছে তিনি তো মেয়েটাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলেই পারতেন, একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত না ফেলে রেখে আরও দক্ষতার সাথে পুরো বিষয়টাকে মোকাবেলা করতে পারতেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই আমার মনে হয়, রেহানা তো আসলে দর্শকের বিবেচনাবোধ দিয়ে চলা জীবন যাপন করছেন না, তিনি তাঁর নিজের জীবন যাপন করছেন রেহানা আপনার আমার থেকে একটি ভিন্ন চরিত্র। সেই সাথে রেহানা এটি মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা প্রতিমুহূর্তে কত শত করা উচিত কাজ জেনেও করতে পারি না, অন্য কিছু করি, এবং পরে অনুশোচনায় ভুগি। ফলে দেখা যাচ্ছে তিনি যাকে ঠিক মনে করছেন, সেই ঠিক কাজ করার জন্যে তিনি অন্যকে কষ্ট দিচ্ছেন। তাঁর এই অনমনীয়তা আরেকজনের নিপীড়নের কারণ হচ্ছে। এখানে আমি দেখতে পাই, ব্যক্তির সাথে আমাদের চারপাশের মানুষযে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে, তার ডিলেমা। অর্থাৎ রেহানা তাঁর নিজের নৈতিকতার বিষয়টাকে যত গুরুত্ব দিচ্ছেন, তার প্রভাবে তাঁর কাছের মানুষগুলো কিভাবে ভুগছে তাকে আমলে নিতে পারছেন না। রেহানার তাঁর ব্যক্তিগত নীতির প্রশ্নে অবিচল থাকা যে অন্যের কাছে তাঁকে অনৈতিক করে তুলতে পারে তা বুঝতে পারছেন না। আমাদের খুবই চেনা ঘটনা এটি, আমরা চারপাশে, এবং নিজেদের মধ্যে সারাক্ষণ এই দ্বন্দ্ব দেখি। 

রেহানা মারিয়াম নুরের একটি দৃশ্য

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আমাদের দেশি চলচ্চিত্র কান উৎসবে প্রদর্শিত হতে পারা নিশ্চয়ই অনেক বড় খবরফলে এর প্রতিক্রিয়াও এরকম। অনেকেই তাঁদের নানারকম প্রত্যাশা নিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন, তাঁদের দেখার অভিজ্ঞতা হয়তো প্রত্যাশার সাথে মেলেনিকান-এ প্রদর্শিত হওয়া, আলোচিত হওয়ার ফলে এর পাঠ প্রতিক্রিয়াও প্রভাবিত হচ্ছে। সামাজিক বিজ্ঞানী হিসেবে এগুলো বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ফলে চলচ্চিত্রটি যেমন আমার সত্তাকে ঝাঁকুনি দেয়, তেমনি একে ঘিরে এতো আলোচনাও নৃবিজ্ঞানী হিসেবে সমাজ বিশ্লেষণের অনেক অনেক পথ খুলে দেয়। মনোবিজ্ঞানী রেহানাকে দেখছেন মানসিক রোগী হিসেবে। আইনজ্ঞ দেখছেন মিথ্যা অভিযোগকারী হিসেবে। কেউ কেউ তাঁকে দেখছেন নিপীড়ক মা, অযৌক্তিকভাবে ক্ষুব্ধ শিক্ষক, ইত্যাদি ইত্যাদি। রেহানা হয়তো সবগুলোই তবে কিভাবে কে রেহানাকে পাঠ করছেন, সেটা যতটা না রেহানাকে দেখায়, তার থেকেও বেশি দেখায় যিনি দেখছেন তাঁকে এবং যে সাংস্কৃতিক রাজনীতির অংশ তিনি সেটিকেও।  

সবশেষে এই ফিল্মটিকে আমার কাছে মনে হয়েছে, একজন একগুয়ে মানুষকে কিভাবে আপাদমস্তক আপসকামী সমাজ ভেঙ্গেচুরে গুড়িয়ে দেয় তার দলিল। সেই সাথে এই ভাংচুর কিভাবে তাঁর আপনজনদের জীবনকেও একে একে চক্রাকারে ভাঙতে থাকে তারও চিত্রায়ন। 

আমি নিশ্চিত রেহানাকে অনেকেই আয়নায় দেখতে পান, কিন্তু স্বীকার করেন না। বা দেখতে চান না। 

তথ্যপঞ্জি

Ahmed, Sara (2004) The cultural politics of emotion; Edinborough University Press.

নাসরিন খন্দকার

নাসরিন খন্দকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, বর্তমানে শিক্ষাছুটিতে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করছেন। তিনি মেইনুথ ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে তার পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন এবং ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ আয়ারল্যান্ড, গলওয়েতে জেন্ডার বেসড ভায়োলেন্স এবং মাইগ্রেশন আয়ারল্যান্ড প্রজেক্টে রিসার্চ ফেলো হিসেবে গবেষণা করছেন । তিনি নারীবাদী অবস্থান থেকে অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধের পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকা এবং ব্লগে নিয়মিত লেখেন।