অনুবাদ: তানিয়াহ মাহমুদা তিন্নি
বন্দনা শিবা একজন বিখ্যাত পরিবেশবাদী নেতা এবং পরিবেশ নারীবাদের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক। পাশাপাশি তিনি Research Foundation on Science, Technology, and Ecology-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বন্দনার বীজ সংরক্ষণ আন্দোলন এগিয়ে নিতে নবদানা (Navadanya) নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি Alternative Nobel Peace Prize এবং Sydney Peace Prize-সহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহ হল The Violence of the Green Revolution (1991), Biodiversity (1992), Monocultures of the Mind (1993), Biopolitics (1995) ইত্যাদি। বর্তমান প্রবন্ধটি বন্দনা শিবা এবং মারিয়া মায়েস সম্পাদিত Eco-feminism নামক গ্রন্থের একটি অধ্যায় থেকে অনূদিত। – লেখক
[মূল প্রবন্ধ]
জেন্ডার এবং বৈচিত্র্য নানাভাবে একে অন্যের সাথে সম্পর্কিত। নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে নির্মাণ করা ও বিভিন্নতার সাথে খাপখাওয়ানোর অক্ষমতা একই সূত্রে গাঁথা। একইভাবে জৈবিক জগতে বৈচিত্র্যের বিচ্যুতি ও বিলুপ্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যায় যেই উন্নয়নের নমুনা তাও এর সাথে জড়িত। পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষকেই সকল গুণের মানদণ্ড হিসেবে দেখে, যেখানে বৈচিত্র্যের কোনো স্থান নেই। কেবল আছে কর্তৃত্বক্রমের স্থান। পুরুষের থেকে ভিন্ন হওয়ায় নারী অসম এবং অধস্তন হিসেবে গণ্য হয়। প্রকৃতির বৈচিত্র্যকেও স্বাভাবিকভাবে এর স্বকীয়তার জন্য মূল্যবান বিবেচনা করা হয় না, শুধুমাত্র বাণিজ্যিক লাভের উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক শোষণের নিরিখেই এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বাণিজ্যিক মূল্যায়ণের এই মানদণ্ড এভাবেই বৈচিত্র্যকে সমস্যা ও ঘাটতি হিসেবে চিহ্নিত করে। বৈচিত্র্যকে ধংস করে মনোকালচারই উৎপাদনই পুঁজিতান্ত্রিক পিতৃতন্ত্রের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
নারীর প্রান্তিকীকরণ এবং জীববৈচিত্র্যের বিনাশ পরস্পর সহযোগী। পিতৃতান্ত্রিক উন্নয়ন মডেলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের অনিবার্য পরিণতিই হলো মনোকালচার, অভিন্নতা এবং একজাতীয়তা। এই ধরনের বিকৃত উন্নয়ন ভাবনায় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষির উন্নয়নের নামে একদিকে বৈচিত্র্য ধ্বংস করা হচ্ছে, অন্যদিকে বৈশ্বিক স্বার্থ সংরক্ষণের নামে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে সেটা সংরক্ষণের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কৃষি উন্নয়নের নামে অভিন্ন উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে উৎপাদন এবং ভোগ— এ দুটোকে আলাদা করা হয়। যা বৈচিত্র্য সংরক্ষণ নয় বরং এর বিরুদ্ধেই কাজ করে। জীববৈচিত্র্য তখনই রক্ষা করা সম্ভব যখন আমরা উৎপাদন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবো।
বৈচিত্র্যের যৌক্তিকতা জীববৈচিত্র্য ও এর সাথে নারীর যোগসূত্র থেকে উৎসারিত। যা কতৃত্বপূর্ণ কাঠামোকে নিচ থেকে দেখতে সাহায্য করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মনোকালচারের অনুৎপাদনশীল রূপটিকে উন্মোচিত করে। সেই সাথে এটাও প্রকাশ করে যে এই জ্ঞান বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন নয় বরং সেকেলে।
বৈচিত্র্য নানাভাবেই নারীর রাজনীতি এবং বাস্তুসংস্থানগত রাজনীতির ভিত্তি। লিঙ্গ–রাজনীতি মূলত ভিন্নতারই রাজনীতি। পরিবেশ–রাজনীতিও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। পক্ষান্তরে শিল্পকারখানার উৎপাদনের প্রক্রিয়া এবং উৎপাদিত পণ্য অভিন্ন এবং একজাতীয়।
এই দুই ধরনের রাজনীতি একই বিন্দুতে পৌঁছায় যখন নারী এবং জীববৈচিত্র্যের প্রান্তর ও অরণ্যে এসে মোলাকাত ঘটে। মোলাকাত ঘটে শুষ্ক অঞ্চল ও জলাভূমিতে।
নারীর দক্ষতা হিসেবে বৈচিত্র্য
বৈচিত্র্যই নারীর কাজ এবং জ্ঞানের মূলনীতি। এ কারণেই তারা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু এই মূলনীতির সাহায্যেই বিকল্প ‘উৎপাদন পদ্ধতি’ এবং ‘দক্ষতা’ গড়ে তোলা সম্ভব যেটি বিধ্বংসী নয় বরং বৈচিত্র্যকে সম্মান দেয়।
তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ টিকে থাকার জন্য জৈবিক সম্পদ ব্যবহার করে। এই সমাজগুলোতে জীববৈচিত্র্য যুগপৎভাবে উৎপাদনের উপায় এবং ভোগের বস্তু। তাদের জীবন ও জীবিকা অনেকাংশেই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সেগুলোর টেকসই ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পর্কিত। আদিবাসী ও কৃষি সমাজগুলোর জীববৈচিত্র্য–ভিত্তিক প্রযুক্তিকে আদিম এবং অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সেগুলো ‘উন্নত’ যন্ত্রপাতি দ্বারা স্থানান্তরিত হয়। যা মানুষের জীবিকা নির্বাহের উপায় এবং বৈচিত্র্য দুটোকেই ধ্বংস করে।
জনমনে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে বৈচিত্র্য–ভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতি হলো কম ফলনশীল পদ্ধতি। অথচ একটি অভিন্ন এবং একজাতীয় পদ্ধতিতে উচ্চ ফলনশীলতা হলো কন্টেক্সটচুয়াল এবং তত্ত্বীয়ভাবে নির্মিত একটি বিষয়। এটি কেবল একমাত্রিক ফলনকে গুরুত্ব দেয়। তাই কথিত নিম্ন–ফলনশীল এবং উচ্চ ফলনশীল এদুটোকে মুখমুখি দাঁড় করানোকে নিরপেক্ষভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই বরং যারা একমাত্রিক ফলনকে অর্থনৈতিকভাবে অনিবার্য মনে করে তাদের সাপেক্ষে এটি বাণিজ্যিক লাভ–ক্ষতির অঙ্ক দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট।
শস্যের একজাতীয়তা জীবতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যর বিনাশ ঘটায়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন এবং জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেই মানুষগুলো অরণ্য, কৃষি এবং পশুপালনের একটি বহুমাত্রিক ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। উদাহরণস্বরূপ,ভারতের কেরালা রাজ্যের নারিকেল চাষ বহু ধাপবিশিষ্ট। সেখানে একইসাথে নারিকেল, পান, গোল মরিচ, কলা, সাগু, সজিনা, পেপে, আম এবং সবজি চাষ করা হয়। শুধু নারিকেল উৎপাদন করলে প্রতি হেক্টর জমিতে বাৎসরিক ১৫৭ জন্য শ্রমিক প্রয়োজন হয়, যেখানে মিশ্র পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে প্রতি হেক্টরে ৯৬০ জন শ্রমিক লাগে। শুষ্ক ডেক্কান অঞ্চলে মিশ্র পদ্ধতিতে ভুট্টা, কলাই এবং তৈলবীজ উৎপাদন ছেড়ে মানুষ যখন শুধু ইউক্যালিপটাস মনোকালচার শুরু করল তখন সেখানে হেক্টর প্রতি ২৫০ জন মানুষ কাজ হারানো শুরু করে।
যখন শ্রমিকের ঘাটতি দেখা দেয় বা শ্রম ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে তখন শ্রমের বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির ব্যবহার ফলদায়ক ও কার্যকর হয় কিন্তু যখন শ্রমিকের প্রাচুর্য রয়েছে তখন শ্রমের বিকল্প অর্থহীন কারণ তা দারিদ্র্য, উৎখাত ও জীবিকার ধ্বংসসাধনের কারণ হয়ে ওঠে। তৃতীয় বিশ্বের পরিস্থিতিতে এ কারণে একই সাথে দুটি পর্যায়ে স্থায়িত্ব অর্জন করতে হবে: প্রাকৃতিক সম্পদের স্থায়িত্ব এবং জীবিকার স্থায়িত্ব। ফলস্বরূপ, জীববৈচিত্র্যের থেকে উদ্ভূত জীবিকার সংরক্ষণের সাথে জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণকে যুক্ত করে দেখতে হবে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য নারীর কর্ম এবং জ্ঞান কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ, কেননা নারী উভয় সেক্টরে কাজ করে এবং একই সময়ে অনেকগুলো কাজ সম্পাদন করে। কৃষি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকা সত্ত্বেও নারী কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পায় না। অর্থনীতিবিদরা নারীর কাজকে ‘উৎপাদন’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না যেহেতু নারীর কাজ তথাকথিত ‘উৎপাদন–সীমানা’–র অন্তর্গত নয়। কম সংখ্যক নারী কৃষিক্ষেত্রে কাজ করে বলে এই ভ্রান্তি তৈরি হয়নি, বরং নারীরা একইসাথে অনেকগুলো কাজ করে বিধায় এই ধারণার উৎপত্তি।
পরিসংখ্যানবিদ এবং গবেষকরা নারীর ঘরের কাজ এবং কৃষি–উৎপাদনমূলক কাজকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থতারই পরিচয় দিয়ে গেছেন। কোন কাজটি শ্রম এবং কোন কাজটি শ্রম নয় সেটি নির্ধারণ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে, যেহেতু নারীরা অধিক পরিমাণ এবং অনেকগুলো কাজ একসাথে করে। এটির আরেকটি বড়সড় কারণ হলো নারীর গৃহস্থলীর কাজ মজুরি দ্বারা পরিমাপ করা হয় না। তাদের কাজ অদৃশ্যই থেকে যায় কারণ তারা বাজার–অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন কাজগুলোতে অধিক সময় দেন এবং একই সাথে একাধিক কাজ করেন।
সময়–বরাদ্দ (Time allocation) সংক্রান্ত গবেষণাগুলো একই সময়ে অনেকগুলো কাজের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এমনকি নারীর দৈনন্দিন গতিবিধি এবং যেই কাজগুলো গতানুগতিক শ্রম–শক্তি হিসেবে চিহ্নিত নয়, কিন্তু বেশিরভাগ গ্রামীণ নারীর জীবিকা যেটার সাথে সম্পর্কিত সেগুলো নিয়ে কাজ করছে । জেন্ডার স্টাডিজের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোও নিশ্চিত করেছে, গুণগত মান, পরিমাণ এবং কর্মঘণ্টা এই তিনটি বিষয় বিবেচনা করলে নারীরাই ভারতের খাদ্যশস্যের প্রধান উৎপাদক।
ফসল উৎপাদন এবং তার প্রস্তুতির জন্য নারীর বিশেষ জ্ঞান এবং দক্ষতার প্রয়োজন। বীজ প্রস্তুত করতে গেলে বীজ অঙ্কুরোদগম, মাটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাদের জানতে হয়। থাকতে হয় দৃশ্যমান বৈষম্য, হাতের আঙুল এবং চোখের সমন্বয়, আর্দ্রতার মাত্রা সম্পর্কিত সংবেদনশীলতা এবং আবহাওয়া সম্পর্কিত জ্ঞান। বীজ বপন করতে ঋতু, জলবায়ু, উদ্ভিদের প্রয়োজনীয়তা, মাইক্রো–জলবায়ুগত অবস্থা এবং মাটি ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় জানতে হয়; এছাড়াও শারিরিক সক্ষমতা এবং নৈপুণ্য দরকার হয়। গাছের যত্ন নিতে হলে উদ্ভিদের বিভিন্ন রোগ–বালাই, কর্তন, স্টেকিং, সেচ, সাথী রোপণ, ক্ষতিকর প্রাণী, উদ্ভিদের বেড়ে উঠার সময়কাল, মাটি রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য জানা জরুরি। ধৈর্য ও অধ্যবসায়, শারীরিক সক্ষমতা এবং উদ্ভিদের প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগ দেওয়া অপরিহার্য। ফসল উত্তোলনের ক্ষেত্রেও আবহাওয়া, শ্রম ও গ্রেডিং; সংরক্ষণ সম্পর্কিত জ্ঞান ও তৎক্ষণাৎ ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হয়।
নারীর জ্ঞান দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনেরও প্রধান অবলম্বন। ভারতে দুগ্ধ উৎপাদন প্রক্রিয়াটি নারী দ্বারা পরিচালিত। তাদের নিজস্ব পদ্ধতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আহরিত ডেইরি সায়েন্সের থেকে আলাদা। নারীরা তাদের চর্চার মধ্য দিয়ে পশু প্রজনন, লালন–পালনে বিশেষ দক্ষ হয়ে ওঠেছে। শুধু গরু কিংবা মহিষ নয়, তারা হাঁস, মুরগি, শুকর, ছাগলও লালন–পালন করে।
বনায়নে উদ্ভিদের খাদ্য এবং সার হিসেবে ব্যবহৃত জৈববস্তু উৎপাদনেও নারীর জ্ঞান অতি গুরুত্বপূর্ণ। গবাদিপশুর গোবর, জ্বালানি হিসেবে কাঠের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার, খাদ্য উৎপাদন এ সমস্ত কার্যক্রমে নারী সক্রিয়। এমনকি স্বল্প পরিসর বনায়নেও নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং পশুপাখির ভূমিকা থাকে।
নারীর কর্ম এবং জ্ঞান স্বতন্ত্রভাবে গৃহস্থালি এবং কৃষি উভয় খাতেই উপস্থিত। সম্পদের ঘাটতি সত্ত্বেও খাতগুলোর মধ্যে নারীর অদৃশ্য বাস্তুসংস্থানগত প্রবাহ এবং সংযোগই পরিবেশের স্থায়িত্ব, টেকসই ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদনশীলতা সংরক্ষিত হচ্ছে। নারীর কর্ম এবং জ্ঞানের অদৃশ্যমানতা জেন্ডার পক্ষপাত দ্বারাই উৎসারিত। ফলে নারীর অবদানকে মূল্যায়ন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এটা উন্নয়ন পরিমাপ করার সেক্টরাল, খণ্ডিত এবং রিডাকশনিস্ট এপ্রোচের সাথে সম্পর্কিত যেখানে বন, পশুপালন, ফসল এগুলোর একেকটাকে স্বাধীন খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সবুজ বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল ডরফিং, মনোকালচার এবং মাল্টিকালচার পদ্ধতি ব্যবহার করে ধান ও গমের উৎপাদন বৃদ্ধি। একজন ভারতীয় নারীর কাছে ধান শুধু খাদ্যশস্য নয় বরং পশু–পাখির খাবারের উৎস, ঘরের ছাউনি। উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্যবহার নারীর কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, পাশাপাশি নতুন ধরনের প্রযুক্তি, বীজ এবং শস্য উৎপাদন সম্পদগুলোর থেকে নারীর নিয়ন্ত্রন কেড়ে নেয়। স্মরণাতীতকাল থেকে নারীরাই বীজের জিম্মাদারের দায়িত্ব পালন করে এসেছে, তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা ব্যবহার করেই ফসলের উন্নয়ন পরিকল্পনা করা উচিৎ।
জীববৈচিত্র্যের জিম্মাদার: নারী
বেশিরভাগ সংস্কৃতিতেই নারী জীববৈচিত্র্যের জিম্মাদারের ভূমিকা পালন করে। তারা কৃষি উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, ভোগ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে। কিন্তু অন্যান্য বিষয়াদির মতোই নারীর কর্ম এবং জ্ঞান, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এবং উন্নয়নে তার ভূমিকা অস্বীকৃত। নারীর শ্রম এবং দক্ষতাকে প্রাকৃতিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদিও তার এই কাজগুলো প্রায়োগিক জ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক চর্চার দ্বারা অর্জিত। তবে নারীর পরিবেশ সংরক্ষণের পদ্ধতি কর্তৃত্বপরায়ণ পিতৃতান্ত্রিক সংরক্ষণের থেকে ভিন্ন।
বর্তমানে বৃহৎ পরিসরে মনোকালচার কেন্দ্রিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার বিস্তৃতি এবং এর সাথে সম্পৃক্ত সংকটগুলো বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংরক্ষণে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। মনোকালচার গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থা খণ্ডিত করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পুরো পরক্রিয়াটিকে পরিচালিত হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে কৃষির প্রতিটি উপাদানকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হয়। ফলে বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফসলের একেকটা জাত সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের গাণিতিক চর্চায় রূপান্তরিত হয়েছে।
অপরপক্ষে, ভারতীয় ঐতিহ্যে জীববৈচিত্র্য বিচ্ছিন্ন নয় বরং এখানে পরিবেশের একটি উপাদান আরেকটির সাথে সম্বন্ধযুক্ত। এই সম্পর্কের মাধ্যমেই উপাদানগুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং মান অর্জন করে। জীববৈচিত্র্য বাস্তুসংস্থান এবং সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে থাকে। সংস্কৃতি সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে বৈচিত্র্য পুনরুৎপাদিত এবং সংরক্ষিত হয়। বিভিন্ন উৎসব এবং লোকাচার পালনের মাধ্যমে শুধু জীবনের পুনরাবৃত্তি নয় বরং এটি নানাবিধ বীজ নির্বাচন এবং এর বিস্তারের পরীক্ষা–নিরীক্ষার সুযোগ করে দেয়। যেহেতু এই ধরনের বীজ কোনো পরীক্ষাগার থেকে উৎপত্তি লাভ করছে না, সেহেতু কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি এই সমস্ত পরীক্ষাকে বৈজ্ঞানিক বলে মানতে চায় না। তবে এগুলোই মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সম্পন্ন হচ্ছে, মধ্যবিত্ত পুরুষ নয় বরং গ্রামীণ নারীদের দ্বারা। কৃষির এই সংরক্ষিত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য পদ্ধতিগতভাবেই বিশ্বাসযোগ্য।
যখন নারী বীজ সংরক্ষণ করে, তারা বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে, যা পরিবেশের ভারসাম্য এবং সঙ্গতি রক্ষা করে। নবদানা (Navdanya) বা নয়া বীজ হলো উদ্ভিদজগৎ এবং সামাজিক জীবন উভয়েরই বৈচিত্র্যের পুনর্জীবন ও ভারসাম্যের প্রতীক।
পবিত্রতা/ বিশুদ্ধতা (Sacredness): একটি সংরক্ষণ ক্যাটাগরি
একটি দেশজ পরিবেশে সংরক্ষণের একটি বড় অংশ জুড়ে পবিত্রতার ব্যাপারটি জড়িয়ে থাকে। পবিত্রতা বৈচিত্র্যের সহজাত বৈশিষ্ট্যকে পরিবেষ্টিত করে রাখে; এটি একটি সম্পূর্ণ ব্যবস্থার সাথে তার একটা অংশকে সম্পর্কিত করে। ফলে এটি ব্যবস্থাটির অখণ্ডতা রক্ষায় ভূমিকা রাখে। অপবিত্র বীজ বাস্তুসংস্থান চক্রের অখণ্ডতা বিনষ্ট করে। এমনকি কৃষিজ ইকোসিস্টেম এর সংযোগগুলো ভেঙে ফেলে যেগুলো টেকসই উন্নয়নের সাথেও সম্পর্কিত।
১। পবিত্র বীজ হলো নবদানা উদ্যগের ভিত্তি, যা নবগ্রহের প্রতীক। উদ্ভিজ্জ ফসল উৎপাদনে গ্রহ এবং জলবায়ুর ভূমিকা অপরিহার্য। অন্যদিকে উচ্চ ফলনশীল বীজ ঋতুভিত্তিক জলবায়ুর সাথে ফসলের সংযোগ ভেঙে ফেলে। একই সাথে একাধিক ফসলের চাষ এবং আলোক–সংবেদনশীলতা এই দুটি বিষয়কে মাথায় নিয়ে উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজকে গ্রহ এবং জলবায়ুর প্রভাবমুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু ঋতুচক্র থেকে মুক্তি বড় বাধ আর ব্যাপক সেচের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে।
২। বীজের বৈচিত্র্য এবং সুষম পুষ্টি একটা আরেকটার সাথে সম্পর্কিত। উচ্চ ফলনশীল জাতের মনোকালচার ব্যবস্থাটি পুষ্টি এবং ভারসাম্য–হীনতা ঘটায়। এক্ষেত্রে কলাই এবং তেলজাতীয় শস্যের উৎপাদন ত্যাগ করে খাদ্য পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো হয়।
৩। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্যও শস্য বৈচিত্র্য জরুরি। মনোকালচার রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়িয়ে জমির উর্বরতা নষ্ট করে। খর্বাকৃতি ফসলের জাত খড় তৈরি করে না, ফলে মাটির রিসাইক্লিং ঠিকভাবে হয় না। অন্যদিকে রাসায়নিক সার জমিতে থাকা প্রাণী এবং উদ্ভিদ ধ্বংস করে।
৪। জীববৈচিত্র্য স্বনির্ভর খামারগুলোকে টিকিয়ে রাখে, যেখানে উৎপাদনকারীই ভোক্তা। উচ্চ ফলনশীল জাতের এক ফসলী উৎপাদন ব্যবস্থা অধিক কৃষককে অন্যান্য বীজের খদ্দের বানিয়ে ফেলে। ফলে নির্ভরশীলতা বাড়ে, বাড়ে উৎপাদন খরচ, কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য সরবরাহ কমে যায়।
৫। সর্বশেষ, ক্রয়কৃত বীজ নারীদের সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং বীজের জিম্মাদার প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে ফেলে এবং তাদের অদক্ষ শ্রমিক হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়। কর্ণাটকে প্রধান খাদ্যশস্যগুলো ‘আকাদি’ নামে পরিচিত এবং নারীরা এই শস্য উৎপাদনের প্রতিটি স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখে। একজন লাম্বানি নারীর ভাষায়, ‘আকাদি সম্পর্কে পুরুষরা কী জানে, তারা তো শুধু হালচাষ করতে জানে’, যেহেতু বংশ পরম্পরায় নারীরাই এসব বীজ সংরক্ষণ করে আসছে। আরেকজন নারী বলেছেন, ‘আমি এবং আমার মা এই বীজগুলোর দেখাশোনা করে এসেছি, এখন আমার মেয়ে করছে।’
কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায়ের নারীদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং নবায়ন সংক্রান্ত প্রাত্যহিক চর্চা থেকে আমরা কী সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি?
প্রথমত, নবদানা এটাই চিত্রিত করে যে, জীববৈচিত্র্য কোনো বিচ্ছিন্ন (রিডাকশনিস্ট) ক্যাটাগরি নয় বরং সম্পর্কযুক্ত— এটি কোনো অটমাইজড ধারণা নয় বরং কনট্যাক্সটচুয়াল। অতএব, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ হলো সেসকল সম্পর্কেরও সংরক্ষণ যাতে করে পরিবেশের ভারসাম্য এবং সঙ্গতি উভয়ই রক্ষিত হয়। জীববৈচিত্র্য বিচ্ছিন্নভাবে সংরক্ষণ করতে গেলে এটি কেবল কাঁচামাল যোগান দিতে পারে, বাস্তুসংস্থান এবং সংস্কৃতি রক্ষায় কোনো ভূমিকা পালন করে না।
দ্বিতীয়ত, পারস্পরিক সম্পর্কের সংরক্ষণ পবিত্রতা এবং অলঙ্ঘনীয়তার সাথে সম্পর্কিত। পবিত্রতা এবং বৈচিত্র্যের ধারণা একেবারে ভিন্ন একটা দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে আনে যেখানে বীজকে শুধু পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা কিংবা লাভের অঙ্কে মাপা সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, বেশিরভাগ টেকসই কৃষি ব্যবস্থায় স্ব–নির্ভরতাজাতীয় উৎপাদন এবং ভোগের চক্রটিকে কাছে থেকে বুঝতে সাহায্য করে। প্রচলিত অর্থনীতি এই ধরনের ব্যবস্থাপনাকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ, কারণ এটি কেবল পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেয়, যেখানে উৎপাদনকারী এবং ভোক্তা ভিন্ন। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে স্ব–নির্ভর ব্যবস্থা অনুৎপাদনশীল হিসেবে বিবেচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই নারীর শ্রমসাধ্য কাজকে কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। দুঃখজনক হলো, এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করেই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত নীতিমালাগুলো প্রণয়ন করা হয়।
অতপর, জীবতাত্ত্বিক সম্পদগুলোর সামাজিক, নৈতিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও কেবল অর্থনৈতিক গুরুত্বই সরকারি নীতিমালা প্রণেতাদের সামনে প্রদর্শিত হয়। জীবতাত্ত্বিক সম্পদগুলোর অর্থনৈতিক মূল্য তিন ধরনের—
-
‘ভোগবাদী মূল্য’— যে পণ্যগুলো বাজারে না গিয়ে সরাসরি ভোগ করা হয়। যেমন– জ্বালানি কাঠ, পশুখাদ্য, শিকার করা মাংস;
-
‘পণ্য মূল্য’— যে পণ্যগুলো বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগানো হয়;
-
‘অভোগ্য ব্যবহারিক মূল্য’— ইকোসিস্টেমের কার্যকারিতার পরোক্ষ মূল্য, যেমন– জলাধার রক্ষা, সালোকসংশ্লেষণ, জলবায়ু ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনা।
একটি চমকপ্রদ মূল্যায়নের কাঠামো নির্মিত হয়েছে, যার বিশ্লেষণ এবং অভিমত পূর্ব নির্ধারিত। এই অভিমত অনুযায়ী, দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বের মানুষ সরাসরি প্রকৃতি থেকে জীবিকা নির্বাহ করে এবং শুধু ‘ভোগ’ করে অর্থাৎ এই মানুষগুলো শুধু ভোক্তা। পক্ষান্তরে যারা ব্যবসা–বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত তারাই ‘একমাত্র’ উৎপাদক। তাহলে সহজেই প্রমাণ করা যায় যে তৃতীয় বিশ্ব পরিবেশের সম্পদ ধ্বংস করছে। অপরদিকে বিশ্বের উত্তরের মানুষেরাই এটি রক্ষার সামর্থ্য রাখে। ভোগ, উৎপাদন এবং সংরক্ষণের এই মতাদর্শিক শ্রেণিবিভাগ পুরো প্রক্রিয়াটির রাজনৈতিক অর্থনীতিকে আড়াল করতে সক্ষম হয়।
সুনির্দিষ্টভাবেই এটি নারী, জীববৈচিত্র্য উৎপাদনকারী এবং সংরক্ষণকারীকে নিছক ভোক্তা হিসেবে পরিচিত করে। সংস্কৃতি, নৈতিকতাবোধ, দক্ষতা, জ্ঞান, বিজ্ঞতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে সংরক্ষণ পরিকল্পনা না করে প্রচলিত সংরক্ষণ নীতিমালা এগুলোকে মুছে ফেলে। এরপর এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যেখানে জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় টেকসই জীবিকা এবং উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পরিণত হয়।
প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈচিত্র্যকে বাস্তুসংস্থানগত নয় বরং একটি সংখ্যাতাত্ত্বিক এবং গাণিতিক বিষয় হিসেবে দেখা যায়। এটি বীজগাণিতিক বৈচিত্র্যের সাথে ঐক্যপোষণ করে পারস্পরিক মিথোজীবিতা ও জটিলতার সাথে নয়। জীববৈচিত্র্যর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে সংখ্যা এবং বাস্তুসংস্থানের ফ্রিকোয়েন্সি, প্রজাতি এবং জিনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণই কেবল ব্যবহৃত হয়। এর বিপরীতে, যেই সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে বৈচিত্র্যের চর্চা করা হয়, সেখানে জীববিচিত্র্যকে জালের মতো বিভিন্ন উপাদানের সম্পর্ক দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় যেটি ভারসাম্য এবং স্থায়িত্ব উভয়ই নিশ্চিত করে। ব্যাপকভাবে এটি গ্রহ এবং উদ্ভিদ, কসমিক সঙ্গতি এবং কৃষি ইত্যাদির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দেশ করে।
পার্থিব দিক বিবেচনায়, বৈচিত্র্য এবং পরস্পর সম্পর্কই সকল টেকসই কৃষি ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্য হলো বৃক্ষসমূহ, ফসল এবং গৃহপালিতের পরস্পর নির্ভরশীলতা যা জৈব বস্তুর প্রবাহ দ্বারা জমির উর্বরতা চক্রের ব্যবস্থাপনা করে। নারীর কর্ম এবং জ্ঞান যেখানে কাজে লাগানো হয়। এছাড়াও মিশ্র এবং চক্রাকার চাষ পদ্ধতিতে ফসলের বৈচিত্র্যের সাথে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সম্পর্ক রয়েছে। খাদ্যশস্য এবং ডাল বীজের মিশ্রণ নাইট্রোজেন চক্রে পুষ্টির ভারসাম্য তৈরি করে; ফসলের মিশ্রণ ক্ষতিকর প্রাণী থেকেও ফসল বাঁচায়; রাসায়নিক বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবহার ছাড়াই ক্ষতিকর কীট–পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি জলের চক্র ব্যবস্থাপনা এবং মাটির আর্দ্রতা ও উর্বরতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের সমৃদ্ধ এই পদ্ধতি বহু বছর থেকে ভারতের ক্ষুদ্র খামারগুলোতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি একইসাথে খাদ্য এবং পুষ্টি সরবরাহ করে আসছে, স্থায়িত্ব এবং ন্যায়বিচার টিকিয়ে রেখে।
জৈব প্রযুক্তি এবং জীববৈচিত্র্যের বিনাশ
বিভিন্ন উপায়ে তৃতীয় বিশ্বের নারীর সাথে জীববৈচিত্র্যের সম্পর্কের থেকে কর্পোরেট পুরুষদের সাথে জীববৈচিত্র্যের সম্পর্ক ভিন্ন। নারীরা জীববৈচিত্র্যের মাধ্যমে উৎপাদন করে পক্ষান্তরে কর্পোরেট বিজ্ঞানীরা অভিন্নতার উপর ভিত্তি করে উৎপাদন করে।
নারী কৃষকদের কাছে জীববৈচিত্র্য মূল্যবান। বৈশ্বিক বীজ এবং কৃষিবাণিজ্যিক কর্পোরেশনগুলোর কাছে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব শুধু কাঁচামাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে। নারী কৃষকদের জন্য বীজের অর্থ হলো জীবনের ধারাবাহিকতা। মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশনের কাছে বীজ মানে হলো বীজের জীবনের সমাপ্তি। বীজ কোম্পানিগুলো বীজের শংকরায়ন ঘটিয়ে কৃষকদের বীজের জিম্মাদার থেকে ভোক্তায় রূপান্তরিত করে। যেহেতু শঙ্কর বীজের স্বত্ব কোম্পানিগুলো নিয়ে রাখে সেহেতু কৃষককে প্রতি বছর কোম্পানিগুলোর কাছেই ফিরে যেতে হয় বীজ কিনতে। বীজ স্বত্ব আইনের মাধ্যমে কর্পোরেশন বীজগুলোকে তাদের নিজস্ব উদ্ভাবন বলে দাবি করতে পারে। ফলে অন্য কেউ স্বত্বাধিকারী পণ্য উৎপাদন করতে পারে না।
কর্পোরেট বিজ্ঞানীদের নিজস্ব উদ্ভাবনের দাবি অন্যায্য, বরং এটি উদ্ভাবিত জীবনের প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাদের দাবি অন্যায্য এ কারণে যে, তারা প্রকৃতি এবং তৃতীয় বিশ্বের কৃষকদের উদ্ভাবিত বীজকে তাদের নিজস্ব উদ্ভাবন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে দাবি করে। বীজের উপর স্বত্বাধিকার দাবি ২১ শতকের এক ধরনের পাইরেসি। যার মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের নারী কৃষকদের সমন্বিত ঐতিহ্য এবং জিম্মা কোম্পানিগুলোর দ্বারা লুণ্ঠিত হচ্ছে। এই কাজে সহায়তা করছে GATT-এর মতো বৈশ্বিক কিছু সংগঠন। স্বত্ব এবং জৈব প্রযুক্তি দুই ধরনের চুরির শিকার। তৃতীয় বিশ্বের উৎপাদনকারিদের থেকে তারা জীববৈচিত্র্য ছিনিয়ে নিয়েছে। সকল ভোক্তার কাছ থেকে তারা নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর খাবার কেড়ে নিয়েছে। বর্তমানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ‘সবুজ’ প্রযুক্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হচ্ছে। ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ জেনেটিক ইঙ্গিনিয়ারিং–এর সাহায্যে উৎপাদিত খাদ্যকে ‘প্রাকৃতিক’ এবং নিরাপদ হিসেবে রুল জারি করেন । যাই হোক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কোনোভাবেই প্রাকৃতিক কিংবা নিরাপদ নয়।
সাম্প্রতিককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ড্রাগ প্রশাসন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং–এর মাধ্যমে উৎপাদিত খাদ্য গ্রহণের ঝুঁকি সংক্রান্ত একটি তালিকা তৈরি করেছে:
-
জেনেটিক্যালি উৎপাদিত খাদ্যে নতুন বিষাক্ত পদার্থ যোগ করা হতে পারে।
-
খাদ্যের পুষ্টিগুণ হ্রাস পেতে পারে।
-
নতুন পদার্থ খাদ্যের গঠন পরিবর্তন করতে পারে।
-
নতুন প্রোটিনের কারণে এলার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
-
জিনের পরিবর্তন ক্ষতিকর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে ।
-
এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধক জিন মানুষ বা পশুর শরীরের কিছু এন্টিবায়োটিক–এর কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে।
-
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ‘নকল সজীবতা’ (‘counterfeit freshness’) উৎপাদন করতে পারে।
-
ইঞ্জিনিয়ারিং খাদ্য গৃহপালিত প্রাণীদের জন্যও ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
-
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং–এর সাহায্যে উৎপাদিত খাদ্য বণ্য–প্রাণীর ক্ষতিসাধন করতে পারে এবং আবাস পরিবর্তন করতে পারে।
আমাদের জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ারড খাদ্যের উপর আস্থা আনতে বলা হচ্ছে, আবার একইসাথে সেইসব কোম্পানিকে বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে যারা খাদ্যে কীটনাশক ব্যবহার করে। মনসানটো (আমেরিকান কর্পোরেশন) এখন নিজের পণ্য ‘সবুজ’ হিসেবে বিক্রি করছে, যে আগে আমাদের বলত ‘রাসায়নিক ব্যবহার না করলে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়বে। মনস্যান্টোস, সিবা–গিগিস, ডুপন্টস, আইসিআই এবং ডওস এই কোম্পানিগুলোও ঘোষণা দিচ্ছে তারা আমাদের সবুজ পণ্য দেবে। যাই হোক, জ্যাক ক্লোপেনবারগ সম্প্রতি বলেছেন, ‘নেকড়ে হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর এইসব শিল্পপতিরা এখন নিজেদের ভেড়া এবং সবুজ ভেড়া হিসেবে পুনরায় উপস্থাপন করতে চাচ্ছে।’