অরাজ
শিল্পকর্ম: Olgu Ülkenciler
প্রচ্ছদ » বিউপনিবেশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা

বিউপনিবেশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা

  • সৈয়দ নিজার 

[প্রবন্ধটি ১৪-০৫-২০১৫ তারিখে ইতিহাস অধ্যায়ন কেন্দ্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পঠিত। এই প্রবন্ধ পূর্ণাঙ্গরূপে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ‘বিশ্ববিদ্যালয়,উদ্ভব, বিকাশ ও বিউপনিবেশায়ন’ নামে। প্রকাশক: প্রকৃতি-পরিচয়।- সম্পাদক]

বিশ্ববিদ্যালয় চিরদিনই বিলেতের আমদানি টবের গাছ হয়ে থাকবে; সে টব মূল্যবান, হতে পারে, অলংকৃত হতে পারে, কিন্তু গাছকে সে চিরদিন পৃথক করে রাখবে ভারতবর্ষের মাটি থেকে; বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শখের জিনিস হবে, প্রাণের জিনিস হবে না। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

The University is home to an indivisible inquiry in which the question of being . . . and the question of value . . . are brought together again under one roof. – Martin Heidegger

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর একদিকে রয়েছে পুঁজির চাপ অন্যদিকে রয়েছে জ্ঞানচর্চার দায়। অন্যান্য যেকোন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য যেখানে শিক্ষা দেয়া, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান উৎপাদনেরও দায় রয়েছে। সেকারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যতটা সহজে পুঁজির চাপ সুরহা করতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় ততটা সহজে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রায়শই এ দুয়ের মাঝে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে না বলে আত্মসংকটে ভোগে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা তারই উদাহরণ। এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট এবং সম্ভাবনার (যদি থাকে!) ঐতিহাসিক অনুসন্ধান এবং তার দেশজ ঐতিহ্য নির্ভর সমাধান প্রস্তাব। সেই কারণে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে-‘বিউপনিবেশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা’। কিন্তু, বিউপনিবেশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা নিয়ে আলাপচারিতার জন্য দুটি ধারণা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন- ১. বিশ্ববিদ্যালয় কী এবং ২. বিউপনিবেশায়ন কী। তাই প্রবন্ধটি শুরু করব বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা খোঁজার মধ্য দিয়ে, তারপর আলোচনার ধারাবাহিকতায় আলোচিত হবে আধুনিক এবং ঔপনিবেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানতাত্ত্বিক চরিত্র ও সংকট। পরবর্তীতে আলোচিত হবে বিউপনিবেশায়ন কী এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক মহাবিহার যেমন-নালন্দা, সোম, বিক্রমশীলার উপনিবেশোত্তর বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে কেমন ভূমিকা রাখতে পারে।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞায়নে দু’ভাবে অগ্রসর হতে পারি। ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দের ব্যবহার রীতির উপর ভিত্তি করে। যাকে আমরা সাধারণত বর্ণনামূলক সংজ্ঞা বলি। অথবা আমরা ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ এর সংজ্ঞা স্থির করে বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজা শুরু করতে পারি। যাকে ‘আদর্শ সংজ্ঞা’ বলা হয়। ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দের ব্যবহার রীতি অত্যন্ত ব্যাপক।

যেমন ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়’ যেখানে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দের তুলনামূলক একটি সামান্য চিত্র পাওয়া গেলেও, ‘উত্তরা উমেন্স ইউনিভার্সিটি কলেজ’, যুক্তরাজ্যের ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন’, ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি’ অথবা সাভারে ঢাকা-আরিচা রাস্তার পাশে অবস্থিত ‘কিড ইউনিভার্সিটি স্কুল’ প্রমুখ ক্ষেত্রে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দের সামান্য চিত্র পাওয়া দুষ্কর। তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ একটি বর্গ না নামপদ । ভিটগেনেস্টাইন অবশ্য বলবেন এটাই ‘ভাষার খেলা’।

অন্যদিকে, অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে থেকেও বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যায় না। অক্সফোর্ডের বিখ্যাত দার্শনিক গিলবার্ট রাইল তার The Concept Of Mind-এ এমনই একটি অভিজ্ঞতার বয়ান দিয়েছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন ভ্রমণে আসে। সেই কারণে পেশাদার ভ্রমণ গাইড রয়েছে। তারা ভ্রমণকারীদের সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, দর্শন অনুষদ, গ্রন্থাগার , প্রশাসনিক ভবন, মাঠ পরিদর্শনের পর কেউ কেউ প্রশ্ন করেন- ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কই ?’।

তারা হয়তো ভাবেন অক্সফোর্ড নামে অন্য কোন ভবন রয়েছে। আমি কোন এক অজানা কারণে ভেবেছি, এই ধরণের প্রশ্ন শুধুমাত্র চীনারা করতে পারে। কিন্তু সদ্য আমার এক সহকর্মীর একই ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে। ভর্তি ইচ্ছুক ছাত্র সমাজবিজ্ঞান অনুষদে দাঁড়িয়ে তাকে কয়েকবার প্রশ্ন করেছিল- ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কই ?’।

তার মানে, এটি একটি সামান্য চিত্র। প্রত্যেক সমাজেই কিছু লোক থাকে যারা বনে গিয়ে বন আর খুঁজে পায় না; পায় শুধু গাছ, আগাছা এবং লম্বা লম্বা ঘাস। কিন্তু যারা ‘কনসেপ্ট’ বা ‘প্রত্যয়’ বুঝেন তারা কিভাবে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের’ সাথে ‘ঢাকা কলেজ’ এর পার্থক্য করেন। ঢাকা কলেজে গ্রন্থাগার আছে, আছে প্রশাসনিক ভবন, আছে ছাত্রদের জন্য হল। তাহলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরটি নয় কেন ? যদিও প্রশ্নটি হালকা মনে হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা অত্যন্ত গভীর এবং দার্শনিক। কিন্তু আপাতত প্রসঙ্গটি পাশে রেখে আমরা অগ্রসর হই। ‘বিশ্ববিদ্যলয়’ শব্দের বর্তমান ব্যবহাররীতি যেহেতু আমাদের কোন দিক নির্দেশনা দিচ্ছে না তাই আমাদের দ্বারস্থ হতে হবে ইতিহাসে।

বাংলা ভাষায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি ‘University’ থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয় শব্দের আমদানি নিয়ে বলেন- ‘ইউরোপীয় ভাষায় যাকে ইউনিভার্সিটি বলে প্রধানত তার উদ্ভব ইউরোপে অর্থাৎ ইউনিভার্সিটির যে চেহারার সঙ্গে আমাদের আধুনিক পরিচয় এবং যার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষিত সমাজের ব্যবহার সেটা সমূলে ও শাখা-প্রশাখায় বিলেতি’ [রবীন্দ্রনাথ, ২০১০: ১৭২]। এ থেকে অনুমান করা যায় উনিশ শতকে বাংলায় ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দের আমদানি করা হয় ইংরেজি থেকে। আবার ইংরেজি ‘University’ শব্দটি আমদানি করা হয় ল্যাটিন শব্দ ‘universitas’ থেকে। যার আভিধানিক অর্থ ‘সমগ্র বা যৌথ বা বিশ্ব (universi)’। কিন্তু এই আভিধানিক অর্থ আমাদের তেমন কোন সহায়ক হয় না।

ঐতিহাসিকভাবে ইউরোপীয় চার্চের স্কুলগুলোতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রদান করা হত। যাদের অনেকাংশ সীমাবদ্ধ ছিল ধর্মতত্ত্ব এবং ল্যাটিন ভাষা শিক্ষার মধ্যে। কিন্তু মধ্যযুগে ইউরোপে যখন নগররাষ্ট্র সৃষ্টি হতে শুরু করে তখন প্রশাসনিক এবং বিচার ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রয়োজন পড়ে। তখন আইন ও বিচার ব্যবস্থারও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়। এই আইন শিক্ষা দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়। তবে ইউরোপের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল ছাত্ররা, শিক্ষক বা চার্চ নয়।

রোমান ফৌজদারি এবং দেওয়ানি আইন বিখ্যাত ছিল। বিভিন্ন দেশ-বিশেষ করে ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং ফ্রান্স থেকে শিক্ষার্থী আইন শিক্ষা নিতে আসত ইটালিতে। সে সময় ইউরোপের কিছু কিছু দেশে গোষ্ঠী শাস্তির প্রচলন ছিল। ইটালি তাদের একটি। ইটালির নগর আইনে কেউ ঋণ খেলাপি অথবা অপরাধ করলে তা গোষ্ঠী অপরাধ বলে চিহ্নিত হত। কোন রাজ্য বা গোষ্ঠী কেউ অপরাধ করলে গোষ্ঠীর যে কাউকে গণপিটুনি বা অপদস্ত করা হত। সেকারণে, তারা সংঘবদ্ধ থাকত এবং অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাও ছিল। তখন এই ধরনের নৃতাত্ত্বিক সহযোগী সংঘকে বলা হত ‘নেশন’ (nations) [Ridder-Symoens, 1992: 48-51; Pedersen, 1997: 155-188)। রোমান আইন শিক্ষা নিতে অপরাপর নেশনগুলো মিলিত হয়ে পরবর্তীতে ১০৮৮ সালে একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে ইটালির বলোনিয়াতে। এই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন নেশনগুলো মিলিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করে, তাই তার ল্যাটিন নামকরণ করা হয় ‘Universitas Bononiensis’’ যার অর্থ হচ্ছে বলোনিয়ার নেশনদের যৌথ সংঘ। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম The University of Bononese। বলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থেকে ছাত্রদের ক্ষমতা বেশি ছিল। প্রতিটি নেশনের দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, বেতন নির্ধারণ এবং চাকুরিচ্যুতির বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ছিল। এমনকি প্রথম কয়েক শত বছর এ বিশ্ববিদ্যলয়ের রিক্টারও ছিল শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে কয়েক দশকে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত বিস্তৃতি আসে। তা নগরের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভাব ফেলে। তাই ১১৫৮ সালে রোমান রাজা প্রথম ফ্রেডরিখ বারবারসা সাংবিধানিক রীতি (Constitution Habit) নামে একটি আইন জারি করেন। যাতে উল্লেখ আছে শিক্ষার্থী নগর আইনের আওতার বাইরে। সমকালীন ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, আমাদের জ্ঞানগত (Academic) স্বাধীনতা আইনের ম্যাগনাকার্টা এই আইন। কিন্তু এখানে উল্লেখ্য, এই আইন জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা প্রদান করে না। তাই বর্তমান জ্ঞানগত-স্বাধীনতা আইনের সাথে এর পার্থক্য আছে। এই আইনে শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র চলাচলের স্বাধীনতা এবং গোষ্ঠী শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই আইনের সমকালীন রূপ হবে ‘যেকোন দেশে শিক্ষার্থীদের অবাধ বিচরণের অধিকার’।

বলোনিয়া নিয়ন্ত্রিত হত চার্চ দ্বারা। সেকারণে প্রথমদিকে ডিগ্রী প্রদান করার অধিকার ছিল না। পরবর্তীতে ১১৫৮ সালের দিকে সেই অধিকার প্রদান করা হয়। ফলে বলোনিয়ার শিক্ষার্থীগণ পরবর্তীতে কোন পরীক্ষা ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে পড়াতে পারত। পরবর্তীকালে যেসকল প্রতিষ্ঠান বলোনিয়ার মত ডিগ্রি প্রদানের অধিকার পায় সেগুলো হল প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় (১১৫০), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় (প্রতিষ্ঠা-১০৯৬, স্বীকৃতি-১১৬৭), মদেনা বিশ্ববিদ্যালয় (স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা- ১১৭৫), প্যেলেনসিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (১২০৮) প্রমুখ। সেই সূত্রে এগুলো ইউরোপের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ।

প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি বলোনিয়া থেকে ভিন্ন। তার উৎপত্তির সাথে দশম শতকের ব্যক্তিগত স্কুলগুলোর সম্পর্ক রয়েছে। ব্যক্তিগত স্কুলের পাঠ্যসূচির মধ্যে ভিন্নতা ছিল। তাদের মধ্যে কোন কোনটিতে যুক্তিবিদ্যা, ব্যাকরণ, আইন এবং চিকিৎসাবিদ্যা পাঠদান করা হত। কিন্তু ব্যক্তিগত স্কুল খুলতে হলে নটরডেম ক্যাথিড্রাল প্রধানের অনুমতি প্রয়োজন হত। এমনকি বিষয়বস্তু পাঠের ক্ষেত্রেও নজরদারি করা হত। সর্বোপরি কোন বিদ্যালয়ের ডিগ্রি দেওয়ার অধিকার ছিল না। তাই তাদের শিক্ষার্থীদের চার্চের অধীনে আবার পরীক্ষা দিতে হত।

দ্বাদশ শতকের দিকে ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং ইটালি থেকে প্রচুর ছাত্র আসতে থাকে প্যারিসে। তখন প্যারিসে ব্যক্তিগতভাবে যারা পাঠদান করছিলেন তাদের অনেকে মিলিতভাবে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নটরডেমের ক্ষমতা লোপ। যার জন্য প্রয়োজন ছিল ডিগ্রি প্রদানের অধিকার, বিষযবস্তুর উপর নজরদারি কমানো [Frrruolo, 1985]। জ্যাঁক ভার্জার প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপত্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন-

The Birth of the University of Paris can be interpreted as a kind of compromise between the parties involved. It allowed the masters, and the masters of arts in particular, certainly as early as 1208-10, to from themselves into an autonomous guild, to endow themselves statutes, to co-opt their new colleagues and to elude the direct control and exactions of the chancellor of Notre-Dame. [Verger, 1992: 51]

স্বাধীনভাবে চলাচলের যে রীতি এবং আইন রাজা প্রথম ফ্রেডরিখ প্রবর্তন করেছিলেন বলোনিয়া ছাড়া অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার অন্তর্ভুক্ত ছিল না; অথবা তাদের জন্য এই রকম কোন আইনও ছিল না সংশ্লিষ্ট এলাকায়। এই সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর চার্চের প্রভাব জারি ছিল তা বুঝা যায়-ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারার, গ্যালিলিওকে গৃহবন্দি অথবা ১৮৫২ সাল পর্যন্ত দাঁড়ি রাখলে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল করে দেওয়ার আইন থেকে। তারপরও মধ্যযুগের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্বন্দ্ব ছিল তা উপলব্ধি করা যায় রেনেসাঁস এবং আধুনিক চিন্তার ইতিহাস পাঠ করলে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যসূচি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমে আইনশাস্ত্র পাঠ মূখ্য ছিল, পরবর্তীতে তার পরিবর্তন আসে। ধারণা করা হয় ১২২০ সালের আগেই কলা অনুষদের প্রচলন ছিল-যেখানে ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র এবং সামান্য পরিমাণ যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হত। সে সময় পর্যন্ত দর্শনের পাঠ দেওয়া হত না। পরবর্তীতে আনুমানিক ১২৬০ সালের দিকে চিকিৎসা শাস্ত্রে পাঠদান শুরু হয়। পরবর্তীতে কয়েক শতকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে দুটি স্তরে বিভক্ত করা হয়। উচ্চতর ধারায় রয়েছে ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসা এবং আইন। যার ব্যবহারিক উপযোগিতা রয়েছে। নিম্ন ধারা দু’ভাগে বিভক্ত-

[ ট্রিডিয়াম ] ব্যাকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র এবং যুক্তিবিদ্যা।
[কোয়াড্রিয়াম ] পাটীগণিত, জ্যামিতি, সঙ্গীত এবং জ্যোতিষশাস্ত্র।

অনেক গবেষকরা মনে করেন, ট্রিডিয়াম এবং কোয়াড্রিয়াম থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রির রীতি এসেছে।

প্ল্যাটোর একাডেমি
মোজাইক ফ্রম পোম্পেই

আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার রূপকার দুই জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) এবং ভাষাতাত্ত্বিক ভিলহ্লেম হামবোল্ডট (১৭৬৭-১৮৩৫)। কান্টের ভাবনায় ‘ইউনিভার্সিটি’- এর অর্থ বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীর উপস্থিতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে পরিণত হয় ‘সার্বিক জ্ঞানের’ (Universal Knowledge) প্রচার কেন্দ্রে। এবং যে স্বাধীনতার সূত্রপাত সাংবিধানিক রীতির মধ্যে দিয়ে তা হামবোল্ডেটের বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবে পরিণত হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জ্ঞানগত স্বাধীনতায়।

রেনেসাঁস-উত্তর ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোকবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কান্ট মনে করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা। [বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে কান্টের শেষের দিকের লেখা Perpctual Peace (১৭৯৫) এবং The Conflict of the Faculties (১৭৯৮)]। কান্ট মনে করতেন, সার্বিক জ্ঞান প্রদান বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়; যা কোন দেশ-কাল সাপেক্ষ নয়। যা যুক্তিনির্ভর মননশীল ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলবে। কী এই সার্বিক জ্ঞান এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় কান্টের The Critique of Pure Reason (১৭৮১) এবং Prolegomena to any Future Metaphysics (১৭৮৩) গ্রন্থে।

আধুনিকতা এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সার্বিক জ্ঞান। কান্ট জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। প্রাক-সিদ্ধ (a priori) এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান (a posteriori)। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানই হচ্ছে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। যেমন: রাজশাহীর আম মিষ্টি হয়। এই ধরনের জ্ঞান ইন্দ্রিয় নির্ভর এবং ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে। প্রাক-সিদ্ধ জ্ঞান যা অভিজ্ঞতা নির্ভর নয় এবং ভুল হবার সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে, যেকোন বচন বা বিচারের সত্যমূলের উপর ভিত্তি করে দুই ভাগে ভাগ করেছেন তা হচ্ছে-বিশ্লেষণাত্মক বিচার এবং সংশ্লেষণাত্মক বিচার। বিশ্লেষণাত্মক বিচার সেই সকল বিচার যার সত্যতা নির্ভর করে অর্থের উপর। যেমন: সব কুমার অবিবাহিত। এই বাক্যেও সত্যতা নির্ভর করে কুমার এবং অবিবাহিত শব্দের অর্থের উপর। সংশ্লেষণাত্মক বিচার হচ্ছে সেই বিচার যা অর্থের উপর নির্ভর করে সত্যতা নিশ্চিত করা যায় না। যেমন: সকল কাক কালো। কান্ট মনে করতেন, প্রাক-সিদ্ধ সংশ্লেষণাত্মক জ্ঞানটি হচ্ছে সার্বিক জ্ঞান। যেমন: গণিত এবং পদার্থ বিজ্ঞানের জ্ঞান। ২+৯= ১১ তা প্রাক-সিদ্ধ কারণ তা অভিজ্ঞতা নির্ভর নয়। অন্যদিকে, ১১ এর অর্থ ২ এবং ৯ নয়। তাই তার সত্যতা অর্থের উপর নির্ভর করে না। ফলে এটি সংশ্লেষণাত্মক জ্ঞান। পদার্থবিদ্যা থেকে অন্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেমন : ‘প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে’। কান্ট সার্বিক জ্ঞানকে অভিজ্ঞতা নির্ভর মনে করেন না। তার কারণ অভিজ্ঞতায় যা ধরা পড়ে তা অনেক সময় সত্য নাও হতে পারে। যেমন, কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক মডেল। আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। কিন্তু কোপার্নিকাসের আবিষ্কার আমাদের অভিজ্ঞতার উর্ধ্বের সত্যকে প্রকাশ করে। তাই তিনি মনে করতেন, সার্বিক জ্ঞান আমাদের অভিজ্ঞতাকে ছাপিয়ে যাবে। অভিজ্ঞতার নতুন অর্থ দিবে, কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে কোন কিছু গ্রহণ করবে না। এই জ্ঞানের লাভের মাধ্যম যুক্তিনির্ভর বুদ্ধি। এই সার্বিক জ্ঞানই একমাত্র সত্য জ্ঞান। এই সার্বিক জ্ঞানই আধুনিকতার ভিত্তি। তাই বলা হয়ে থাকে, আধুনিকতা দেশ-কাল নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। তাই আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে একমাত্র সার্বিক জ্ঞান চর্চা এবং প্রসার। যার মাধ্যমে তৈরি হবে আলোকিত মানব এবং প্রতিষ্ঠিত হবে বিশ্বশান্তি। তাই বলোনিয়ায় ‘University’র অর্থ ছিল বিভিন্ন জাতির শিক্ষালয় যা আধুনিক কালে পরিণত হয় সার্বিক জ্ঞানের পাঠকেন্দ্রে।

কান্টের ভাবনায় যেমন পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানতাত্ত্বিক চরিত্র, ঠিক তেমনি হামবোল্ডেটের ভাবনায় পাওয়া যায় জ্ঞানগত স্বাধীনতার রূপ। হামবোল্ডট ভাষাতাত্ত্বিক ছিলেন। তিনি এক বছরের জন্য পার্সিয়ার শিক্ষামন্ত্রী হন। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি প্রস্তাব তৈরি করেন। সেই প্রস্তাব কার্যকর হয়নি এবং প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর পর। তিনি মনে করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনবে। তাই তার মতে শিক্ষকের ন্যায় শিক্ষার্থীরও পাঠ্যক্রম বেছে নেবার অধিকার থাকা উচিত। তিনি মনে করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী নেই। এখানে হওয়া উচিত একজন উপদেষ্টা এবং অপর জন গবেষক।

Just as primary instruction makes the teacher possible, so he renders himself dispensable through schooling at the secondary level. The university teacher is thus no longer a teacher and the student is no longer a pupil. Instead the student conducts research on his own behalf and the professor supervises his research and supports him in it. [উদ্ধৃত হয়েছে Clark, 2008: 333]

হামবোল্ডটের চিন্তার প্রভাব নিয়ে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিতর্ক রয়েছে [অংয, ২০০৬] কিন্তু ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজন এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের। যে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমেরিকান লিবারাল আর্ট বিশ্ববিদ্যালয় হামাবোল্ডটীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ।

কিন্তু হামাবোল্ডট যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলেছেন তা আইনি-যার একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়, অপরটি রাষ্ট্র। ইউরোপে শুধু মধ্যযুগে গবেষকগণ বিভিন্নভাবে নিপীড়নের শিকার হননি; আজও তা চলছে। এটা বিশ শতকের বাস্তবতা ছিল। তাই ১৯১৫ সালে আমেরিকার শিক্ষক সমিতি (American Association of University Professors) একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা Declaration of Principles নামে পরিচিত। ১৯৪০ সালে এটি Statement of Principles on Academies Freedom and Tenure আইনে পরিণত হয়। যেখানে তিনটি আইন এবং পাঁচটি অধিকার প্রদান করা হয়েছে [সংযুক্তি-১]। শিক্ষকগণ যেকোন গবেষণালব্ধ ফল প্রকাশ করতে পারবেন এমনকি তা সমাজ, প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রবিরোধী হলেও। সেই বিষয়ে শ্রেণিকক্ষে আলোচনা করতে পারবেন। তা ব্যবহার করে তাদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। এই আইন পরবর্তীতে জার্মানি, ফ্রান্স এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে গৃহীত হয়েছে। তাই আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার জন্য দুটি শর্ত-

[জ্ঞানতাত্ত্বিক] বিশ্ববিদ্যালয় সার্বিক জ্ঞান প্রচার ও চর্চা কেন্দ্র।

[আইনি] বিশ্ববিদ্যালয় সার্বিক জ্ঞান উৎপাদন করবে। তা রাষ্ট্র, ধর্ম এবং সমাজে রীতির বিরুদ্ধে হলেও তা প্রকাশযোগ্য।

ইমানুয়েল ক্যান্ট

ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ইউরোপীয় ধাঁচের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মেকলেসহ অন্যান্য অ্যাংলিসিস্টগণ (Anglicist) মনে করতেন ভারতবর্ষে দীর্ঘমেয়াদী শাসনকার্য পরিচালনার জন্য দাপ্তরিক এবং আদালতের ভাষা হওয়া উচিত ইংরেজি। এ বিষয়ে দীর্ঘ দুই দশক প্রাচ্যতত্ত্ববিদ এবং অ্যাংলিসিস্টদের মধ্যে বিতর্ক জারি ছিল। প্রাচ্যতাত্ত্বিকগণ মনে করতেন, ভারতে দাপ্তরিক এবং আদালতের ভাষা আঞ্চলিক হওয়া উচিত তাতে ভারতীয়দের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন হবে। এই বিতর্কের অবসান ঘটে ১৮৩৫ সালে। তখন দাপ্তরিক এবং উচ্চ আদালতের ভাষা করা হয় ইংরেজি এবং নিম্ন আদালতের ভাষা করা হয় আঞ্চলিক। ইংরেজি দাপ্তরিক করার পেছনে বাঙালিদেরও যুক্ততা ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম রামমোহন রায়। তখন থেকে ইংরেজি জানা সরকারি কর্মচারীর প্রয়োজন পড়ে। তখন বাংলায় ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত হত একমাত্র হিন্দু কলেজ (প্রতিষ্ঠা ১৮১৭)। এখানে উল্লেখ্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয় কোম্পানির কর্মচারীদের শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে। তাই হিন্দু কলেজ যথেষ্ট ছিল না। তাই ১৮৫৭ সালে আড়াই লক্ষ রুপি খরচ করে আড়াই একর জায়গার উপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় করার কথা থাকলেও একই অর্থ দিয়ে আরো দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়-মাদ্রাজ ও মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিকে পাঠদান করা হত না। শুধু ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা নেয়া হত। পাঞ্জাব থেকে রেঙ্গুন; ঐদিকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধীনস্থ কলেজ হচ্ছে পাঞ্জাব কলেজ। ১৮৯০ সালের মধ্যে এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ৬০,০০০ শিক্ষার্থী বের হয়। তাদের এক তৃতীয়াংশ উকিল এবং ১৮৮৭ সালের এক জরিপ থেকে দেখা যায় মধ্য পর্যায়ের ২১,০০০ সরকারি চাকরিতে ৭১% এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস। তার মধ্যে হিন্দু ৪৫%, মুসলমান ৭% এবং ইউরোপিয়ান ১৯%; বাকি ২৯% ইউরোপ থেকে পড়া। তখন থেকে, সরকারি চাকরির প্রভাব এত গভীর বাঙাালির জীবনে, তার বয়ান পাওয়া যায় তপন রায় চৌধুরীর লেখায়। তিনি বলেন, প্রাক-ঔপনিবেশিক বাঙালি নারীর প্রার্থনার বিষয় ছিল-প্রথম সন্তান যেন সুস্থ ছেলে হয়। সেখানে ঔপনিবেশিক সমাজে তা পরিণত হয়-ছেলে যেন ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সরকারি চাকরি পায়। উপনিবেশোত্তর কলকাতায় একই প্রবণতা জারি ছিল। তা স্পষ্ট হয় নেহেরু যখন ষাটের দশকে ভারতের শিল্পায়নের কথা বলছেন, তখন বাঙালি পিতা-মাতা তাদের ছেলেদের প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে পাঠানোর প্রবণতা থেকে। ঢাকার বাস্তবতার গুণগত ভিন্নতা থাকলেও প্রবণতা এক। চাকরির জন্য প্রয়োজন হয় প্রশংসাপত্রের, বৈষয়িক জ্ঞানের এবং ব্যবহারিক জ্ঞানের। কিন্তু জ্ঞান উৎপাদনের প্রয়োজন নেই ।

পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করা হয়। শুরুতে তিনটি বিষয় পাঠদান করা হত- ১. ইউরোপীয় ইতিহাস ২. ইউরোপীয় দর্শন এবং ৩. ইংরেজি সাহিত্য। এখানকার পাঠ্যক্রম অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ থেকে নিয়ন্ত্রিত হত কিন্তু তার ন্যায় ছিল না। যেমন ইংরেজি সাহিত্য ইংল্যান্ডে পড়ানোর আগে ভারতে পড়ানো হয়েছে। ইউরোপীয় ইতিহাস এবং ইউরোপীয় দর্শন পাঠদানের একটি ভিত্তি কান্ট ও আলোকবাদের সার্বিক জ্ঞান শিক্ষা। আলোকবাদী জ্ঞানকা- বিবর্তনবাদ এবং প্রগতির ধারণার সাথে যুক্ত। ইউরোপ যে ধারা এবং পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে তা মানব সমাজের বিকাশের একমাত্র সত্য। সেখানে ইউরোপ উচ্চতর এবং ভারত পশ্চাৎপদ অবস্থায় রয়েছে।

এই সার্বিক জ্ঞান একমাত্র সত্যরূপে আমাদের কাছে হাজির হয়েছে এবং বর্তমানেও আছে। দর্শন, বিজ্ঞান, গণিত থেকে শুরু করে সাহিত্য, চিত্রকলার মত সৃজনশীল ধারার ক্ষেত্রেই তা সত্য। ফলে এই সার্বিক সত্যকে যেমন ছেদ করার ক্ষমতা থাকে না তেমনি দেশজ বাস্তবতা, প্রেক্ষাপট এবং সমস্যা সমাধান করতে আমরা ব্যর্থ হই। ফলে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-

ইউরোপীয় বিদ্যাও এখানে বদ্ধজলের মতো, তার চলৎ রূপ আমরা দেখতে পাইনে। যে সকল প্রবীণ মত আসন্ন পরিবর্তনের মুখে, আমাদের সম্মুখে তারা স্থির থাকে ধ্রুবসিদ্ধান্তরূপে। সনাতনত্বমুগ্ধ আমাদের মন তাদের ফুলচন্দন দিয়ে পূজা করে থাকে। ইউরোপীয় বিদ্যাকে আমরা স্থাবর ভাবে পাই এবং তার থেকে বাক্যচয়ন করে আবৃতি করাকেই আধুনিক রীতির বৈদগ্ধ্য বলে জানি। এই কারণে তার সম্বন্ধে নতুন চিন্তার সাহস আমাদের থাকে না। দেশের জনসাধারণের সমস্ত দুরূহ প্রশ্ন, গুরুতর প্রয়োজন, কঠোর বেদনা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে দূরের উপলব্ধির দ্বারা নয়। আমরা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বাক্য মুখস্ত করি এবং সেই টুকরো করা মুখস্থ বিদ্যার পরীক্ষা দিয়ে নিষ্কৃতি পাই। টেক্সটবুক-সংলগ্ন আমাদের মন পরাশ্রিত প্রাণীর মত নিজের খাদ্য নিজে সংগ্রহ করবার নিজের উদ্ভাবন করার শক্তি হরিয়েছে। [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ১৭৯]

রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণ এবং উপলব্ধি সঠিক; কিন্তু ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিশ্ববিদ্যায়ের প্রভাব আরো গভীর। প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ধারাবাহিক জ্ঞানচর্চার ইতিহাস রয়েছে এবং তা সমাজ এবং সময়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজি ভাষা ইউরোপীয় শিক্ষার কারণে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জ্ঞানগত এবং বৈষয়িক কারণে আত্মস্থ করলে সংস্কৃতিতে ও রুচিতে পরিবর্তন আসতে থাকে। ফলে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে লোকজ সংস্কৃতি থেকে। অন্যদিকে, সংস্কৃত ভাষা না জানা থাকার কারণে হাজার হাজার বছরের অর্জিত জ্ঞানকা- থেকে ও সে বিচ্ছিন্ন। ফলে চর্চার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে পড়ে। হয় জ্ঞানতাত্ত্বিক বিচ্ছেদ। ফলে ইউরোপীয় জ্ঞানকা-ের চর্চার কারণে এই অঞ্চলের মানুষের ও রাষ্ট্রের যেমন সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয় ঠিক তেমনি এই অঞ্চলের চর্চার ধারাবাহিক জ্ঞানের উন্নয়নে সক্ষম হয় নাই। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ্যায় পরিণত হয়েছে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা কলেজের মধ্যে আইনি পার্থক্য ছাড়া আর কোন পার্থক্য থাকে না। সর্বোপরি এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মনস্তাত্ত্বিকভাবে উদ্বাস্তু উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। মেকলে যাদেরকে বলেছেন

….[T]o attempt to educate the body of the people. We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern- a class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect. [Macauley, 1835]

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিউপনিবেশায়ন হচ্ছে আত্মসত্তার বি-বিচ্ছেদায়নের প্রচেষ্টা। এই আত্মসত্তার কোন বিশেষ রূপ নেই। তা বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। ঔপনিবেশিক আমলে আত্মসত্তার বিভিন্ন ধরন এবং মাত্রায় বিচ্ছেদায়ন হয়েছে। তাই বি-বিচ্ছেদায়নই হচ্ছে বিউপনিবেশায়ন। বিউপনিবেশায়ন এবং উত্তর-উপনিবেশবাদ এক নয়। উত্তর-উপনিবেশবাদ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর শিল্প-সাহিত্য-চিন্তার অভিব্যক্তি। এই অভিব্যক্তির মধ্যে বিউপনিবেশায়নের প্রবণতা থাকলেও তা যেমন একমাত্র প্রবণতা নয় তেমনি সার্বিক কোন চরিত্রও বলা যায় না। বিউপনিবেশায়নের শুরু উপনিবেশায়নের জন্ম থেকে। এটি একটি সচেতন বিষয়ী প্রক্রিয়া যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে উপনিবেশায়নের প্রভাবগুলো চিহ্নিত করে তা মাড়িয়ে ওঠা। যেহেতু ঔপনিবেশিক জ্ঞানকা- বিশ্ব জুড়ে সার্বিক না হলেও আমাদের কাছে বৈশ্বিক রূপে আবির্ভূত হয়, তাই বিউপনিবেশায়ন মানে দরজা-জানালা বন্ধ করে প্রাক-ঔপনিবেশিক মননে ফিরে যাওয়া নয়। বাস্তবে তা সম্ভবও নয়। কিন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক চিন্তার সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে বিউপনিবেশায়ন সম্ভব নয়। সে কারণে বিউপনিবেশায়ন প্রাক-ঔপনিবেশিক ভাবনাগুলোর সৃষ্টিশীল বৈশ্বিক রূপান্তর বলা যেতে পারে। উপনিবেশের ছাপ এবং বিকৃতিগুলো চিহ্নায়ন প্রক্রিয়া এবং তা থেকে উত্তরণ প্রাক-উপনিবেশ চিন্তা নির্ভর হলেও বিউপনিবেশায়নের বিশেষ কোন রূপরেখা নেই। তা সক্রিয় ব্যক্তি, সমাজ এবং রাজনীতি সাপেক্ষ। তাই বিউপনিবেশায়ন আত্মসত্তা বি-বিচ্ছেদায়নের একটি সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া।

ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদেরকে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে প্রাক-ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ড থেকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠছে পশ্চিম থেকে আসা সার্বিক নামে উপস্থিত একটি স্থবির জ্ঞানকাণ্ডের শিক্ষা এবং প্রসার কেন্দ্র। ঐ জ্ঞানের উদ্ভব এবং বিকাশের সাথে আমাদের কোন মিল নেই। ফলে ঐ জ্ঞানের উদ্ভবের কারণ আমাদের কাছে সব সময় থাকে অপরিচিত; তাই জ্ঞান পরিণত হয় সত্য-তথ্যে। ফলে তাকে ছেদ করে জ্ঞান উৎপাদনের আত্মবিকাশ থাকে না। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞান প্রকাশের আইনি অধিকার থাকলেও জ্ঞান উৎপাদনে ব্যর্থ। ফলে এগুলো শুধুমাত্র আচার সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র।

এই পরিস্থিতি থেকে উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ২০০৫ সালে একটি কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে। প্রহসন হল এই যে কৌশলপত্রের জন্য কমিশন দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের বা অধ্যাপকের উপর নির্ভর করেনি; করার কথাও না। কিন্তু তার জন্য অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বা হার্ভাডের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেও দ্বারস্থ হবার কথা। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন দ্বারস্থ হয়েছে অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাংকের উপর!

কৌশলপত্রটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাবা হয়েছে ‘সেবা’ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রূপে। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সেবা বিক্রেতা এবং শিক্ষার্থী হচ্ছে সেবা ক্রেতা। শিক্ষাকে ‘স্কিল’ ছাড়া কিছু নয়। এটা দুই-একটা অনুষদের জন্য সত্য হলেও সকল বিষয়ের জন্য সত্য নয়। কার্যত বন্ধ্যা বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে জাতি গঠনে কাজে আসতে পারে তার চেয়ে বেশি আলোচনা করা হয়েছে কিভাবে মুনাফা লাভ করা যায়। সম্পূর্ণ ‘কৌশলপত্র’ হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ বাগিয়ে নেয়ার ‘কৌশল’ মাত্র। অথচ সমকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান থেকে রাষ্ট্র গঠনে মূখ্য ভূমিকা রাখার কথা। এ প্রসঙ্গে রোনাল্ড বারনেট বলেন-

‘[T]he university has abandoned any calling to pursue universal reason and has given itself up to local or national agendas, to the exigencies of the moment, and to the particular.’[ Barnett, R. & Standish. P., 2002: 224]

শিল্পী: জিওর্জিও দি ছিরিকো

একবিংশ শতকে পুঁজি এবং বৈশ্বিক ক্ষমতা চাপ এবং প্রস্তুতির জন্য রাষ্ট্রে যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন তার দিক নির্দেশনা পাওয়া যেতে পারে প্রাক-ঔপনিবেশিক মহাবিহারগুলোতে। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নালন্দা। আনুমানিক চতুর্থ শতকের দিকে নালন্দা প্রতিষ্ঠা করা হয় মগধে। যা বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্যে। পরবর্তীতে আনুমানিক অষ্টম শতকের দিকে বিক্রমশীল, সোমপুর এবং ওদন্তপুর প্রতিষ্ঠা করেন ধর্মপাল। সোমপুর বর্তমানে বাংলাদেশের পাহাড়পুরে অবস্থিত। নালন্দা সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় হিউয়েন সাঙের ভ্রমণ কাহিনীতে এবং তিব্বতীয় সূত্র সাহিত্য থেকে। ধারণা করা হয়ে থাকে আনুমানিক সপ্তম শতকের দিকে নালন্দা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে যায়। সে সময়ে নালন্দায় দশ হাজার শিক্ষার্থী এবং দুই হাজার শিক্ষক ছিলেন। যদিও হিউয়েন সাঙের অবস্থানকালে যেখানে ছয় হাজার শিক্ষার্থী ছিল। তাদের অনেকে কোরিয়া, জাপান, চীন, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান এবং তুরস্ক থেকে আগত। সে সময় নালন্দায় ছিল বিশালাকার তিনটি গ্রন্থাগার-রত্মসাগর, রত্মদধি এবং রত্নরজ্ঞক। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় রত্মোদধি নয় তলা ছিল। তাছাড়া প্রায় একশ শ্রেণিকক্ষ ছিল। বিতর্ক এবং সভার জন্য পৃথক কক্ষ ছিল। শিক্ষক এবং ছাত্রদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা ছিল। সোমপুর, বিক্রমশীল এবং ওদন্তপুর মহাবিহার তাদের দশম এবং একাদশ শতকের দিকে, নালন্দার মত অবস্থা না হলেও সেখানে ছয়-আট হাজারের মত শিক্ষার্থী ছিল এবং তাদের অনেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছিল। এই সকল মহাবিহারের ইট-পাথর-মাটির রং নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন আলেক্সজান্ডার কানিংহাম, জেমস ফার্গসনসহ সমকালীন অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকগণ। এই প্রাচীরের মধ্যে থাকা মানুষের ভাবনা এবং তৎপরতা এ প্রবন্ধের আলোচনার বিষয়।

মহাবিহারগুলো ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় ছিল না। কিন্তু এগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায়। এই কারণে নয় যে এখানে অনেক দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটেছিল; বরং তার ভাবনা, চর্চা এবং উদ্দেশ্যের কারণে। এর মধ্যেই নিহিত আছে কেন ইউরোপের আগে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ ঘটেছে, কেন এগুলোর আকার ইউরোপের তুলনায় এত বৃহৎ। সর্বোপরি ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে না হয়ে কেন মাধ্যমিক বৌদ্ধদের মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

ব্রাহ্মণদের সাথে জৈন এবং বৌদ্ধদের জ্ঞান ও জ্ঞানলাভের অধিকার প্রসঙ্গে পার্থক্য ছিল। ব্রাহ্মণদের কাছে জ্ঞান, কান্টের মত সব সময় সার্বিক এবং ঐকান্তিক। অর্থাৎ প্রকৃষ্ঠ জ্ঞান যাকে সংস্কৃতে প্রজ্ঞা বলা হয়ে থাকে তা সার্বিক। তা দেশ-কাল নির্ভর নয় এবং যেকোন বিষয়ে একটি মাত্র সত্য রয়েছে। তাই তা ঐকান্তিক। এই জ্ঞানকে বলা হয়েছে কখনো পরমার্থ আবার কখনো ব্রাহ্মজ্ঞান। ধারা ভেদে পার্থক্য থাকলে জ্ঞানের সার্বিক এবং ঐকান্তিক চরিত্র বিষয়ে বৈদিক সকল ধারার অবস্থান অভিন্ন। সেই জ্ঞান আত্মস্থ করাই শিক্ষা এবং জ্ঞানলাভের অধিকার বর্ণ নির্ভর। সে কারণে জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটেনি ব্রাহ্মণদের হাতে। কিন্তু, জৈন এবং বৌদ্ধদের কাছে জ্ঞান এবং জ্ঞানলাভের অধিকার প্রসঙ্গে অবস্থান ভিন্ন। জৈনরা মনে করেন, প্রতিটি তত্ত্বই আংশিক সত্যকে উপস্থাপন করে। অন্ধের হাতি দেখার যে উদাহরণ আমরা ছোট বেলা শুনে থাকি তা আসলে জৈন সাহিত্য থেকে পাওয়া। কিন্তু বৌদ্ধদের অবস্থান, বিশেষত মাধ্যমিকদের অবস্থা আরেকটু বৈপ্লবিক। তারা মনে করেন, জগত এবং জীবন সম্পর্কিত সকল তত্ত্ব আংশিক সত্য নয়, আপাতত সত্য বা ব্যবহারিক সত্য। সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলে সংবৃত। এ সম্পর্কে নার্গাজুন বলেন-

‘শূন্য’ বলা যাবে না
“শূন্য নয়” তাও বলা যাবে
উভয়ই অথবা এটিও নয়, ওটিও নয়; তাও বলা যাবে না।
তা ব্যবহার করা হয়ে থাকে সম্বৃতি হিসাবে।।

(মূলমধ্যামক কারিকা, XXII:11)

কিন্তু এই ব্যবহারিক জ্ঞানকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কৌশলপত্রে শিক্ষাকে যে অর্থে স্কিল বলা হয়েছে সে অর্থে নয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের র্শিক্ষা যদি কর্মদক্ষতা প্রশিক্ষণ হয় তবে নতুন জ্ঞান উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে বিশ্ববিদ্যালয়। এ সম্পর্কে ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ ফ্রাসোয়া লিয়োতার বলেন-

Science does not expand by means of the positivism of efficiency. The opposite is true: working on a proof means searching for and ‘inverting’ counterexample, in other words the unintelligible; supporting an argument means looking for a ‘paradox’ and legitimating it with new rules in the games of reasoning . [ Lyotard, 1979 : 54]

টমাস কুন ও পল ফায়ারাবেন মনে করেন জ্ঞানের বিকাশ বা বিজ্ঞানের বিকাশ দক্ষতা দিয়ে হয় না। বরং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ বিজ্ঞান বা অন্যান্য বিষয়ের স্ববিরোধিতা বা সমস্যাগুলোকে চিহ্নায়নের মধ্য দিয়ে হয়। এ বিষয়ে মাধ্যমিকদের অবস্থানও একই। এই বিহারগুলোতে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ গ্রন্থ রচিত হয়েছে যাতে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন তত্ত্বের সমস্যাগুলো আলোচিত হয়েছে। তাই এই সকল মহাবিহারগুলোর পাঠ্যক্রম কোন বিশেষ তত্ত্ব এবং ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। তাই হিউয়েন সাঙ এবং তিব্বতীয় সূত্র থেকে জানা যায় নালন্দায় বেদ, যুক্তিশাস্ত্র, ব্যাকরণ, আয়ুর্বেদ, গণিত, সঙ্গীত, নৃত্য, শিল্পকলাসহ ব্যবহারিক অনেক জ্ঞানের পাঠ এবং উৎকর্ষ সাধন করা হত। অনেক তত্ত্বের উন্নয়ন করেছেন সেই সময়কার আচার্যগণ। তাদের অনেকের গবেষণা ভারতবর্ষসহ বিভিন্ন দেশে আজও পঠিত হয়। তাদের অনেকে বিভিন্ন রাজসভার উপদেষ্টা ছিলেন। জ্ঞানের অধিকার সর্বজনের ছিল। বিশেষ কোন বর্ণ বা লিঙ্গ, এমনকি ইউরোপের মত কোন অর্থনৈতিক শ্রেণির ছিল না। সে কারণে মধ্যযুগের ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংখ্যা হাজার অতিক্রম করত না সেখানে এই সকল বিহারগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যা আট-দশ হাজারেও পৌঁছেছে। তবে জ্ঞানের অধিকার সর্বজনের হলেও সকলকে প্রবেশের অধিকার দেওয়া হত না। হিউয়েন সাঙ উল্লেখ করেছে প্রতি দশ জনের মধ্যে দুজনকে প্রবেশের অধিকার দেওয়া হত এবং মেধার ভিত্তিতে প্রবেশানুমতি দেওয়া হত।

মহাবিহারগুলো কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ছিল না। কারণ তাদের অর্থ সংস্থান হত খাজনা থেকে। রাজা নালন্দার ব্যয় নির্বাহের জন্য শতাধিক গ্রামের খাজনা দান করেছিল। ফলে তার উৎপাদন এবং ব্যবস্থাপনার সাথে মহাবিহারের প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল। এই মহাবিহারগুলো হয়ত প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন তার উদাহরণ। তাদের তৎপরতা এবং চর্চা লোকসংস্কৃতির এবং জীবনের সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। যা আমাদের সমকালীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা। সদ্য গবেষণায় সোমপুর মহাবিহার সম্পর্কেও একই সত্যতা পাওয়া গেছে। [Furui, 2011, Sen, 2014]

মহাবিহারগুলো কেন বিশ্ববিদ্যালয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুটি শর্ত আগে আলোচনা করা হয়েছে তা শুধু বর্তমান ছিল না বরং এই মহাবিহারে মধ্যযুগের ইউরোপী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্ঞানতাত্ত্বিক স্বাধীনতা বেশি ছিল। তাই ভারতে ইতিহাস সর্বাধিক সংখ্যক সূত্র সাহিত্য রচিত হয়েছে এই মহাবিহারগুলোর শিক্ষার্থী দ্বারা। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়-এই মহাবিহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় সোমপুর। তাই, বিউপনিবেশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা হল-

১. সর্বজনের জ্ঞান সর্বজনের জন্য।
২. সার্বিক জ্ঞানের নামে পশ্চিমা জ্ঞানকাণ্ডের শিক্ষা নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয় সংবৃত জ্ঞানকাণ্ড বা জ্ঞানতাত্ত্বিক বহুত্ববাদ চর্চা।
৩. বিশেষায়নের নামে বিষয় ভিত্তিক জ্ঞানচর্চা জগত-জীবনবীক্ষা তৈরী করতে ব্যর্থ হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগভিত্তিক বিভাজন না করে হওয়া উচিত পদ্ধতি ভিত্তিক।
৪. তা আঞ্চলিক এবং জাতীয় বিষয়ে জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক হবে।
৫. যেহেতু সার্বিক জ্ঞান বলে কিছু নেই। তা পাঠও আত্মস্থ করার প্রয়োজন নেই। তাই শিক্ষার্থীর মূল উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানের সঙ্কট চিহ্নায়ন এবং তা ছাপিয়ে গিয়ে নতুন জ্ঞান তৈরি।
৬. সাধনা মানে নিষ্ঠা, শ্রম এবং অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে নতুন জ্ঞান তৈরি। তাদের মধ্যে সম্পর্ক শিক্ষক-শিক্ষার্থী নয়; উত্তর-সাধক এবং পূর্ব সাধকের সম্পর্ক।

বিউপনিবেশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপরেখা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র গঠনে তা ভূমিকা রাখবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে প্রাণ ফিরে আসবে।

বিশ্ববিদ্যালয়: উদ্ভব, বিকাশ ও বিউপনিবেশায়ন (প্রকাশনী: প্রকৃতি-পরিচয়)

সংযুক্তি-১
Statement of Principles on Academies Freedom

1. Teachers are entitled to full freedom in research and in the publication of the results, subject to the adequate per for mance of their other academic duties; but research for pecuniary return should be based upon an understanding with the authorities of the institution.

2. Teachers are entitled to freedom in the classroom in discussing their subject, but they should be careful not to introduce into their teaching controversial matter which has no relation to their subject. Limitations of academic freedom because of religious or other aims of the institution should be clearly stated in writing at the time of the appointment.

3. College and university teachers are citizens, members of a learned profession, and officers of an educational institution. When they speak or write as citizens, they should be free from institutional censorship or discipline, but their special position in the community imposes special obligations. As scholars and educational officers, they should remember that the public may judge their profession and their institution by their utterances. Hence they should at all times be accurate, should exercise appropriate restraint, should show respect for the opinions of others, and should make every effort to indicate that they are not speaking for the institution.

 

সহায়কপঞ্জি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১০), ‘শিক্ষা’, ঢাকা: প্যাপিরাস।

Ash, Mitchell (2006) ‘Bachelor of What, Maste of Whom? The Humboldt Myth and Historical Transformations of Higher Education In German-Speaking Europe and The US’, in European Journal of Education, Vol. 41(2).

Barnett, R. & Standish. P., (2002) `Higher Education and the University’ in Blake, Nigel; Smeyers, Paul; Smith, Richard, & Satndish, Paul (eds) (2003) The Blackwell Guide to The Philosophy of Education, Oxford: Blackwell Publishing House.

Clark Christopher (2007) Iron Kingdom: The Rise and Downfall of Prussia, 1600-1947, London: Penguin.

Feyerabend, Paul (1987) Against Method, Chicago: The University of Chicago Press.

Frrruolo, S. C (1985) The Origins of the University: The school of Paris and their citics 1100-1215,  Stamford: Stamford University Press.

Furui, R.  (2011) Indian  Museum  Copper  Plate  Inscription  of  Dharmapala,  year  26:  Tentative  reading  and  study.  South Asian Studies 27 (2): 145-156.

Lyotard, Jean-Francois [1979] (1984) The Postmodern Condition: A Report on Knowledge, trans. Geoff Bennington and Brian Massumi, Theory and History of Literature 10, Manchester: Manchester University Press.

Macauley, Thomas B. (1835) Minute on Education, ColumbiaUniversity.
http://www.columbia.edu/itc/mealac/pritchett/00generallinks/macaulay/txt_minute_education_1835.html

Pedersen, Olaf (1997)THE FIRST UNIVERSITIES: Studium generale and the origins of university North, Richard(trns.) Cambridge: Cambridge University Press.

Ridder-Symoens, (1992) A History of the University in Europe:  Universities in Middle Age, Vol- 1, Hilde de(eds) Cambridge: Cambridge University Press.

Verger, Jacques (1992) ‘Patterns’ in Ridder-Symoens, Hilde de (eds) (1992) A History of the University in Europe:  Universities in Middle Age, Vol- 1, Cambridge: Cambridge University Press.

Watters, Thomas (trns.) (1996) On Yuan Chwang’s Travels in India, Davids, Rhys and Bushell, S. W. (eds). New Delhi: Mnushiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd. Sen, Swadhin; Rahman, Syfur & Ahsan, A (2014) ‘Crossing The Boundaries of The Archaeology of Somapura Mahavihara: Alternative Approches and Propositions’ in Pratnatattva: A Journal of The Department of Archeology, Jahangirnagar University, Vol. 20, pp.49-79.

সৈয়দ নিজার

সৈয়দ নিজার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। মানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন ও সমাজবিজ্ঞান উভয় বিষয়ে স্নাতক। পরবর্তীতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে গাণিতিক যুক্তিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন। বিউপনিবেশিত জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণ তার অন্যতম দার্শনিক প্রকল্প। গবেষণা করেছেন যুক্তিবিদ্যা, ভাষাদর্শন, নন্দনতত্ত্ব এবং বিউপনিবেশিত বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে। বর্তমানে এই অঞ্চলের যুক্তিতত্ত্বকে গাণিতিক ক্যালকুলাসে রূপান্তরের কাজ করছেন। ইতিমধ্যে নব্যন্যায়-যুক্তিতত্ত্বকে গাণিতিক ক্যালকুলাসে রূপান্তর করেছেন এবং বর্তমানে বৌদ্ধ যুক্তিবিদ্যা নিয়ে কাজ করছেন। পাশাপাশি 'বিউপনিবেশিত জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণ' প্রকল্পকে একটি আন্দোলনে পরিণত করার চেষ্টা করছেন। প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ 'ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা (২০১৭), বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভব, বিকাশ ও বিউপনিবেশায়ন (২০১৮)।