অরাজ
ছবি: মার্ক সাগাল
প্রচ্ছদ » ডেভিড গ্রেইবার ।। ‘পশ্চিম’ বলে কখনো কিছু ছিল না: গণতন্ত্রের উত্থান প্রসঙ্গে

ডেভিড গ্রেইবার ।। ‘পশ্চিম’ বলে কখনো কিছু ছিল না: গণতন্ত্রের উত্থান প্রসঙ্গে

  • অনুবাদ: সহুল আহমদ

অনুবাদকের মন্তব্য: ডেভিড গ্রেইবার ছিলেন নৃবিজ্ঞানী, তাত্ত্বিক, বুদ্ধিজীবী, এক্টিভিস্ট এবং নৈরাজ্যবাদী। বহুজন তাকে ‘নিপীড়িতদের বন্ধু’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। ‘ছিলেন’ বলছি কারণ মাত্র ৫৯ বছর বয়সে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মারা যান। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন থেকে শুরু কুর্দিদের রোজাভা বিপ্লব সবখানেই তার ছিল সরব বিচরণ। একাধিক বার তিনি কুর্দিস্তান সফর করেছিলেন এবং যেখানেই সম্ভব হয়েছে যোগ দিয়েছিলেন কুর্দি সংহতি বিক্ষোভে। তার Debt: The First 5000 years গ্রন্থটি বেস্ট সেলারের খেতাব অর্জন করেছিল যেখানে। একইভাবে তার Bullshit jobs গ্রন্থটিও সমাদৃত। এছাড়াও নৈরাজ্যবাদ, গণতন্ত্র, আন্দোলন ইত্যাদি প্রশ্নে তিনি বিস্তর লেখালেখি করেছেন। Direct Action: An Ethnography এবং The Democracy Project: A History, a Crisis, a Movement বইগুলো তারই সাক্ষ্য দিচ্ছে। আলোচ্য প্রবন্ধটি মূলত ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘There Never Was a West Or, Democracy Emerges From the Spaces In Between’ শীর্ষক প্রবন্ধের অনুবাদ। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ডেভিড গ্রেইবারের Possibilities: Essays on Hierarchy, Rebellion, and Desire গ্রন্থে। প্রবন্ধের হদিস পেয়েছি এনার্কিস্ট লাইব্রেরি থেকে। প্রবন্ধটি অরাজে ছয় কিস্তিতে প্রকাশিত হবে।

ডেভিড গ্রেইবার (১৯৬১- ২০২০)

বিকল্প বিশ্বায়ন আন্দোলনের আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যা বোঝা গিয়েছে তা হচ্ছে গণতন্ত্রের বিষয়াদি বিতর্কের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার নৈরাজ্যবাদী এবং দক্ষিণ গোলার্ধের (Global South) আদিবাসী সংগঠনগুলো অদ্ভুতভাবে একই ধরনের যুক্তিতর্কের মধ্যে নিজেদেরকে খুঁজে পেয়েছিল। ‘গণতন্ত্র’ কি অন্তর্নিহিতভাবে পশ্চিমা ধারণা? এটা কি পরিচালনার (গভার্নেন্স, বা সম্প্রদায়ের নিজেকে সংগঠিত করার পদ্ধতি) একটি রূপ, নাকি সরকারের (রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংগঠিত করার বিশেষ উপায়) একটি রূপ? গণতন্ত্র কি আবশ্যিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকে বোঝায়? প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র কি আদৌ গণতন্ত্র? শব্দের উদ্ভব এথেন্সে হয়েছে বলে কি এটি স্থায়ীভাবে কলুষিত; যে এথেন্স কিনা ছিল নারীর উপর পদ্ধতিগত দমনের ভিত্তিতে গঠিত একটি যুদ্ধবাজ (militaristic), আগ্রাসী ও দাস কেনাবেচার সমাজ? অথবা আমরা যাকে আজ ‘গণতন্ত্র’ বলি তার সাথে অ্যাথেনিয়ান গণতন্ত্রের আদৌ কি কোনো বাস্তব ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে? একটি ঐক্যমত্যভিত্তিক প্রত্যক্ষ (ডিরেক্ট) গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীভূত রূপ গড়ে তোলার মাধ্যমে কি শব্দটাকে পুনরূদ্ধার করা (রিক্লেইম) সম্ভব? যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে বোঝাতে পারি যে প্রতিনিধি নির্বাচনের সাথে ‘গণতন্ত্রে’র কোনো যোগসূত্র নেই? যদি তা না হয়ে থাকে, যদি আমরা এর মানসংজ্ঞাটিই গ্রহণ করে ফেলি এবং প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে অন্য কোনো নামে ডাকি, তাহলে আমরা কীভাবে বলি যে আমরা গণতন্ত্রের বিরোধী— যে শব্দের সাথে কিনা এমন সর্বজনীন ইতিবাচক বিষয়াদি জড়িত?

এই যুক্তিতর্কগুলো যতটা না চর্চার বিষয়ে তার চাইতে অনেক বেশি শব্দ বিষয়ে। প্রকৃতপক্ষে চর্চা বা অনুশীলনের প্রশ্নে বিস্ময়কর মাত্রার ঐকমত্য রয়েছে। বিশেষ করে আন্দোলনের বৈপ্লবিক উপাদানসমূহের মধ্যে এটি রয়েছে। কেউ যদি শিয়াপাসের যাপাতিস্তা সম্প্রদায়ের সাথে কথা বলেন, বা আর্জেন্টিনার বেকার পিকেটারদের সাথে কথা বলেন, বা ডাচ স্কোয়াটারের সাথে কথা বলেন, বা দক্ষিণ আফ্রিকার উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলনকর্মীদের সাথে কথা বলেন, প্রায় প্রত্যেকেই খাড়াখাড়ি কাঠামোর (vertical structure) পরিবর্তে আড়াআড়ি কাঠামোর (horizontal) জরুরতের বিষয়েই একমত হন। সিদ্ধান্ত চেইন অফ কমান্ডের মাধ্যমে নিম্নাভিমুখী হওয়ার চাইতে তুলনামূলক ছোট, স্বসংগঠিত, স্বায়ত্তশাসিত দল থেকে উঠে আসার উদ্যোগের জরুরতের বিষয়েও সবাই একমত হন। স্থায়ী ও নামী নেতৃত্বের কাঠামোকে খারিজ করার বিষয়েও সকলে একমত হন। এবং যে কণ্ঠস্বরগুলো সাধারণত চিরাচরিত প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ে যায় বা প্রান্তিকে চলে যায় তাদের কণ্ঠস্বর যেন শোনা যায় সে বিষয়ে কোনো একরকম কলকব্জা (মেকানিজম) বজায় রাখার জরুরতের বিষয়েও প্রায় সকলেই একমত হন। অতীতের কিছু তিক্ত দ্বন্দ্ব, যেমন, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদানের পক্ষাবলম্বী বনাম ঐকমত্য [কনসেন্সাস] প্রক্রিয়ার পক্ষাবলম্বীদের দ্বন্দ্ব বহুলাংশেই মীমাংসিত হয়ে গিয়েছে, অথবা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। কেননা সামাজিক আন্দোলনগুলোতে ছোট ছোট দলগুলোর ভেতর পূর্ণ ঐকমত্যকে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং বৃহত্তর কোয়ালিশনের জন্য ‘মডিফাইড কনসেনসাস’ এর বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিছু একটার উদ্ভব ঘটছে। সমস্যা হচ্ছে একে আমরা কি নামে ডাকব। এই আন্দোলনগুলোর বহু মূলনীতি (যেমন স্বসংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক সমিতি, পারস্পরিকতা বা মিচুয়াল এইড, রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রত্যাখ্যান) নৈরাজ্যবাদী ঐতিহ্য থেকে গ্রহণ করেছে। তবুও যারা এই ধারণাগুলো গ্রহণ করেছেন তাদের অনেকেই নিজেদেরকে ‘নৈরাজ্যবাদী’ বলতে অনিচ্ছুক বা রাজি নন। সাধারণত আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিটি হচ্ছে অকপটে দুটো শব্দকেই সাগ্রহে গ্রহণ করে নেয়া। প্রকৃতপক্ষে নৈরাজ্যবাদ ও গণতন্ত্র মূলত অভিন্ন বিষয়, অথবা অভিন্ন হওয়া উচিৎ। তদপুরি যেমন আমি বলছিলাম, এই বিষয়ে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, এমনকি কোনো স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিও নেই।

আমার কাছে মনে হয় এগুলো অন্য যে কোনো কিছুর চাইতে বেশি কৌশলগত, রাজনৈতিক প্রশ্ন। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ‘গণতন্ত্র’ দিয়ে বিভিন্ন বিষয়কে বোঝানো হয়েছে। প্রথম যখন শব্দটি চালু করা হয়েছিল তখন এটি এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝাত যেখানে একটা সম্প্রদায়ের নাগরিকগণ একটি সমষ্টিগত পরিষদে (কালেকটিভ এসেম্বলি) সমান ভোটে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করতেন। ইতিহাসের অধিকাংশ সময়জুড়ে এটা দিয়ে বিশৃঙ্খলা, দাঙ্গা, লিঞ্চিং বা গণপিটুনি এবং দলাদলির সহিংসতাকে বোঝানো হয়েছে (বস্তুতঃ বর্তমানে ‘নৈরাজ্যে’র সাথে এই শব্দের প্রচুর সংযোগ রয়েছে)। অতি সম্প্রতি এটা এমন এক ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে একটা রাষ্ট্রের নাগরিকগণ কয়েকজন প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করেন যারা নাগরিকদের নামে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন। স্পষ্টত এখানে কোনো খাঁটি সত্তার সন্ধান করা হচ্ছে না। এমন ভিন্ন ভিন্ন অর্থের ভেতর কেবল একটা সাধারণ বিষয় হচ্ছে যে, যে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো সাধারণত সংকীর্ণ অভিজাতদের হাতে ছিল সেগুলো এখন সকলের কাছে উন্মুক্ত; তা হোক খুব ভালো কিছু বা হোক খুব মন্দ কিছু। শব্দটা নৈতিকভাবে এতই ভারী যে গণতন্ত্রের কোনো নিরাবেগ ও নির্লিপ্ত ইতিহাস লেখাটা স্ববিরোধী কথা হতে পারে। অধিকাংশ পণ্ডিত যারা একধরণের নির্লিপ্ত ভঙ্গি বজায় রাখতে চান তারা এই শব্দটা পরিহার করেন। যারা গণতন্ত্র সম্পর্কে সাধারণীকরণ করেন তাদের অবধারিতভাবেই কিছু না কিছু ব্যক্তিস্বার্থ থাকে।

ছবি: আভো গারিবিয়ান

আমারও আছে অবশ্য। এই কারণে শুরু থেকেই আমার স্বার্থ পাঠকের সামনে তুলে ধরাটাকেই আমি ন্যায্য বলে মনে করি। আমার কাছে মনে হয় ‘গণতন্ত্র’ শব্দটাকে শাসক ও নেতারা যতই অপব্যবহার করুক না কেনো এর এখনো অদম্য জনপ্রিয় আকর্ষণ রয়েছে। অধিকাংশই একে চিহ্নিত করেন এমন এক ধারণা [নোশন] হিসেবে যা সাধারণ মানুষের সমষ্টিগতভাবে নিজেদের কাজকারবারগুলোকে পরিচালনা করতে পারার সাথে জড়িত। উনিশ শতকেই শব্দটির এই অর্থ বা অভিব্যক্তি ছিল; এবং এই কারণেই উনিশ শতকের রাজনীতিবিদরা যারা কিনা শব্দটিকেই এড়িয়ে চলতেন, তারাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও একে গ্রহণ করতে শুরু করেন এবং নিজেদেরকে ‘ডেমোক্রেটস’ হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের একটা ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে ফেলেন যেখানে তারা নিজেদেরকে প্রাচীন এথেন্সের একটি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে চিত্রিত করতে পারেন। তবু আমি ধরে নেব যে, ‘গণতন্ত্র’ এর ইতিহাসকে ‘গণতন্ত্র’ শব্দের ইতিহাসের চেয়ে জোর দিয়ে গণ্য করা উচিৎ। এটা আমি ধরে নিচ্ছি কোনো বিশেষ কারণ বা বিশেষ কোনো পাণ্ডিত্যপূর্ণ কারণ ছাড়াই, কেননা এইগুলো পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রশ্ন নয় বরঞ্চ নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রশ্ন। গণতন্ত্র যদি কোনো একটা সম্প্রদায়ের সকলের আলাপআলোচনার খোলামেলা ও অপেক্ষাকৃত সমতাবাদী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজস্ব বিষয়াদি পরিচালনার একটি বিষয় হয়ে থাকে তাহলে আফ্রিকা অথবা ব্রাজিলের গ্রামীণ সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার সমতাবাদীরূপটি হালজমানার জাতি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ব্যবস্থার মতো সমান উপযুক্ত না হওয়ার কোনো কারণ নেই। এবং, বহু ক্ষেত্রে সম্ভবত এটি আরও উপযুক্ত।

এই আলোকেই আমি এ সম্পর্কিত একসারি যুক্তি হাজির করব। সেগুলো এখনই তুলে ধরাটা আলাপে অগ্রসর হওয়ার সর্বোত্তম উপায় হতে পারে।

) যারা এই বিষয়ে লেখালেখি করেছেন তারা প্রায় সকলেই ‘গণতন্ত্র’কে একটা ‘পশ্চিমা’ ধারণা বলে ধরে নেন যার উদ্ভব কিনা হয়েছে প্রাচীন গ্রিসে। তারা এও ধরে নেন যে, অষ্টাদশ এবং উনিশ শতকের রাজনীতিবিদরা পশ্চিমা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় এর পুনরুত্থান শুরু করেছিলেন। এভাবে গণতন্ত্রকে এমন কিছু একটা হিসেবে দেখা হয় যার স্বাভাবিক বাসস্থান হচ্ছে পশ্চিমা ইউরোপ এবং এর ইংরেজি বা ফরাসি ভাষাভাষীদের বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশ। এমন কোনো অনুমানই ন্যায্য নয়। ‘পশ্চিমা সভ্যতা’ বিশেষভাবে একটি অস্পষ্ট বা আলগা ধারণা। কিন্তু যদি এটা কিছু বুঝিয়েই থাকে তাহলে সেটা একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে বোঝায়। এই বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য গণতন্ত্র বলে আমরা যাকে চিনি তার প্রতি ততটাই প্রতিকূল যতটা প্রতিকূল ভারত, চীন বা মেসোআমেরিকার প্রতি।

) গণতান্ত্রিক অনুশীলন, মানে সমতাবাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া যে কোনো স্থানেই দেখা যায়; এটা কোনো একটি ‘সভ্যতা’, সংস্কৃতি অথবা ঐতিহ্যের নিজস্ব নয়। যেখানেই মানবজীবন বলপ্রয়োগ বা জুলুমের পদ্ধতিগত কাঠামোর বাইরে গিয়েছে সেখানেই এসবের বেড়ে ওঠার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।

) ‘গণতান্ত্রিক আদর্শ’ তখনই হাজির হয় যখন নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্র এবং জনপ্রিয় আন্দোলন ও চর্চার মধ্যে তাদের চলাচল সুগম করতে অন্যদের সাথে সংলাপের মাধ্যমে নিজেদের ঐতিহ্যকে প্রশ্ন করেন, অতীত বা বর্তমানের গণতান্ত্রিক চর্চার বিভিন্ন ঘটনাকে হাজির করে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেন যে, তাদের ঐতিহ্যে গণতন্ত্রের বীজ নিহিত রয়েছে। আমি এই মুহূর্তগুলোকে বলি ‘গণতান্ত্রিক পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ (ডেমোক্রেটিক রিফাউন্ডেশন)। বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো পুনরুদ্ধারের মুহূর্তও বটে। বিভিন্ন আদর্শ এবং প্রতিষ্ঠান যেগুলো কিনা বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মানুষের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়ার অবিশ্বাস্যরকম জটিল রূপের ফসল, সেগুলোকেই তুলে ধরা হয় খোদ নিজ বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের যুক্তিবোধ থেকে উদ্ভুত বলে। উনিশ ও বিশ শতকের ইতিহাসজুড়ে এমন মুহূর্ত কেবল ইউরোপেই ঘটেনি, বরঞ্চ প্রায় সর্বত্রই ঘটেছিল।

) প্রকৃতপক্ষে এই আদর্শ সর্বদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে [অন্তত কিছুটা হলেও] উদ্ভাবিত ঐতিহ্যের ভিত্তিতে, এ কথা বলার বলার অর্থ এই নয় যে এটি ভেজাল অথবা অবৈধ অথবা অন্তত অন্যকিছুর চাইতে বেশি ভেজাল বা অবৈধ। তবে স্ববিরোধটা হচ্ছে, এই আদর্শের সর্বদা ভিত্তি ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বা অনুশীলনের সাথে রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক প্রক্রিয়ার মিলনের অসম্ভব স্বপ্নের উপর। এর ফল যা হয়েছে তাকে কোনোভাবেই ‘গণতন্ত্র’ বলা চলে না, বরঞ্চ মোটের উপর কয়েকটি সীমিত গণতান্ত্রিক উপাদান নিয়ে ‘রিপাবলিকস’ তথা ‘সাধারণতন্ত্র’ বলা যায়।

) আমরা বর্তমানে যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তা গণতন্ত্রের সঙ্কট নয়, বরঞ্চ রাষ্ট্রের সঙ্কট। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক সামাজিক আন্দোলনগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা ও প্রক্রিয়ার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এটা অগ্রসর হয়েছে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ স্পষ্টত এই জায়গাতেই নিহিত।

উপরে যেভাবে তুলে ধরেছি মোটামুটি এই ধারাতেই আলাপ শুরু করা যাক। প্রথমেই গণতন্ত্র একটি ‘পশ্চিমা ধারণা’ এটা দিয়েই শুরু করি।

ছবি: ফিলিপ ফোল্ডজ

প্রথম পর্ব: ‘পশ্চিমা ঐতিহ্য’ ধারণার অসঙ্গতি সম্বন্ধে

আমি তুলনামূলক একটা সহজ টার্গেট বেছে নেব: স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের ‘ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশনের বিখ্যাত প্রবন্ধ। হান্টিংটন হার্ভার্ডের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক, স্নায়ুযুদ্ধের একজন ধ্রুপদী বুদ্ধিজীবী, ডানপন্থিদের প্রিয় থিংক ট্যাঙ্ক। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি যুক্তি দেন যে, এখন যেহেতু ঠাণ্ডাযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, বৈশ্বিক দ্বন্দ্ব এখন প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যকার সংঘাতকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খাবে। এই যুক্তিটি সাংস্কৃতিক হীনাবস্থার একটা বিশেষ ইশারা প্রচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর্নল্ড টয়েনবির কাজের উপর ভর করে তিনি পশ্চিমাদেরকে বোঝান যে, তাদের সভ্যতা আরও বহু সভ্যতার মধ্যে একটি, এর মূল্যবোধগুলোকে সর্বজনীন ভাবার কোনো উপায় নেই। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বিশেষ করে গণতন্ত্র স্পষ্টতই পশ্চিমা ধারণা এবং বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এটা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা ইউরোপের পরিহার করা উচিৎ:

উপরিস্তরে দুনিয়ার বাকি অংশেও পশ্চিমা সংস্কৃতির বেশিরভাগ জিনিস ছড়িয়ে পড়েছে। তবু মৌলিক স্তরে পশ্চিমা ধারণাগুলো মৌলিকভাবেই অন্যান্য সভ্যতায় প্রচলিত ধারণা থেকে ভিন্ন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ, উদারনীতি, সংবিধানবাদ, মানবাধিকার, সাম্য, স্বাধীনতা, আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মুক্ত বাজার, রাষ্ট্র ও চার্চের পৃথকীকরণের মতো পশ্চিমা ধারণাগুলোর সাথে ইসলামি, কনফুসিয়ান, জাপানি, হিন্দু, বৌদ্ধ বা অর্থোডক্স সংস্কৃতির মিল খুব অল্পই। এমন ধারণা প্রচারের পশ্চিমা প্রচেষ্টা উল্টো ‘মানবাধিকার সাম্রাজ্যবাদ’ এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে এবং আদি মূল্যবোধগুলোর পুনর্নির্মাণ ঘটাচ্ছে; যেমনটি ধর্মীয় মৌলবাদের প্রতি অপশ্চিমা সংস্কৃতির তরুণ প্রজন্মের সমর্থনে দেখা যাচ্ছে। খোদ ‘সর্বজনীন সভ্যতা’ ধারণাই একটি পশ্চিমা ধারণা, অধিকাংশ এশীয় সমাজের বিশেষত্ববাদ (পারটিকুলারিজম) এর সাথে সরাসরি বিরোধ রয়েছে।’ (১৯৯৩:২০)

পশ্চিমা ধারণার তালিকাটা যে কোনো অর্থেই কৌতূহলোদ্দীপক। উদাহরস্বরূপ, যদি আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করা হয়, তাহলে এর অর্থ হবে যে, ‘পশ্চিম’ কেবল উনিশ অথবা বিশ শতকে কোনো ধরনের স্বীকৃত রূপ নিয়েছিল। কেননা, এর পূর্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘পশ্চিমারা’ এই নীতিগুলোকে এক পলকে খারিজ করে দিতেন। কেউ চাইলে গত দুই তিন হাজার বছরের ইউরোপের বিভিন্ন অংশে সন্ধান চালাতে পারেন এবং এসবের সম্ভাব্য অগ্রদূতকেও খুঁজে পেতে পারেন। অনেকে চেষ্টা করেছেন। এই ক্ষেত্রে পঞ্চম শতকের এথেন্স ভালো উপাদান সরবরাহ করে, যদিবা কেউ পঞ্চম শতক এবং ১২১৫ খিষ্টাব্দ বা ১৭৭৬ এর মধ্যকালের প্রায় সকল বিষয় ইচ্ছাকৃত ভাবে খারিজ করতে চান বা ভাসাভাসা দেখে যান। অধিকাংশ প্রচলিত গ্রন্থাদি মোটামুটি এই পদ্ধতিটাই গ্রহণ করেন। হান্টিংটন আরো একটু চতুর। তিনি গ্রিক ও রোমকে আলাদাভাবে বিবেচনা করেন, যেগুলো পরবর্তীতে প্রাচ্য (গ্রিক) এবং পশ্চিমা (ল্যাটিন) ক্রিশ্চিয়ানিটিতে বিভক্ত হয়ে যায়, এবং পরবর্তীতে অবশ্য ইসলামে। যখন পশ্চিমা সভ্যতার শুরু হলো তখন সেটা ল্যাটিন খ্রিস্ট্রীয় জগতের সাথে অভিন্ন ছিল। বহু সংস্কার ও পাল্টাসংস্কারের উত্থানপতনের মাধ্যমে এই সভ্যতা তার ধর্মীয় নির্দিষ্টিতা হারিয়ে একধরনের বৃহৎ কিছু এবং মূলত সেকুলারে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ফলটা অবশ্য প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকের মতোই, কেননা হান্টিংটন আরও জোর দিয়েছিলেন যে, পশ্চিমা ঐতিহ্য সবসময়ই ধ্রুপদী সভ্যতার ধারণার উত্তরাধিকারী হিসেবে এর গোঁড়া বা ইসলামি প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাইতে ‘অনেক বেশি’ কিছু।

এখন হাজারটা উপায়ে হান্টিংটনের অবস্থানকে আক্রমণ করা যায়। তার ‘পশ্চিমা ধারণা’র তালিকাটা বিশেষভাবে স্বেচ্ছাচারী। পশ্চিমা ইউরোপে বছরের পর বছর অজস্র ধারণা ভেসে ছিল, এবং এর মধ্যে বহু ধারণাকে গ্রহণ করাও হয়েছে। কেন বাকিগুলো না নিয়ে কেবল এগুলোকে বাছাই করা হলো? বাছাই এর মানদণ্ডইবা কী? স্পষ্টত, হান্টিংটনের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য হচ্ছে এটা দেখানো যে, পশ্চিমা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতে ব্যাপকভাবে গৃহীত ধারণাগুলোকে দুনিয়ার অন্যান্য অংশে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। কিন্তু এমনকি এর উপর ভিত্তি করে কেউ কি একেবারে ভিন্ন একটা তালিকা প্রণয়ন করতে পারে না? যেমন যে কেউ যুক্তি দেখাতে পারেন, ‘পশ্চিমা সংস্কৃতি’র ভিত্তি হচ্ছে বিজ্ঞান, শিল্পবাদ, আমলাতান্ত্রিক যৌক্তিকতা, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদী তত্ত্বাবলী এবং ভৌগলিক সম্প্রসারণের অন্তহীন অভিযান; এবং এরপরেই যুক্তি দেখানো যেতে পারে পশ্চিমা সংস্কৃতির চূড়ান্তবিন্দু হচ্ছে তৃতীয় রাইখ বা নাৎসি জমানা। (বস্তুত, পশ্চিমের বহু র‍্যাডিক্যাল সমালোচক যথাযথভাবেই এই যুক্তি দেন) তবুও এমনকি এই সমালোচনা হাজির থাকা সত্ত্বেও হান্টিংটন মোটামুটি সেই খামখেয়ালি তালিকাতেই অনড় থাকেন। (যেমন, ১৯৯৬)

হান্টিংটন কেন এই তালিকা তৈরি করলেন তা বোঝার জন্য একমাত্র তরিকা আমার মনে হয় তার ব্যবহৃত ‘সংস্কৃতি’ ও ‘সভ্যতা’ পদদুটোকে পরীক্ষানিরীক্ষা করা। প্রকৃতপক্ষে কেউ যদি সতর্কভাবে তাকে পাঠ করেন তাহলে দেখবেন ‘পশ্চিমা সংস্কৃতি’ ও ‘পশ্চিমা সভ্যতা’ বাক্যাংশদুটো অনেকটা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে [অদলবদল করে]। প্রত্যেক সভ্যতার নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। এর পরিবর্তে, সংস্কৃতি মূলত ‘ধারণা’, ‘প্রত্যয়’, এবং ‘মূল্যবোধ’ নিয়ে গঠিত বলে মনে করা হয়েছে। পশ্চিমা ক্ষেত্রে এই ধারণাগুলো একদা খ্রিস্টধর্মের একটি বিশেষ ধরণের সাথে যুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়; এবং মনে করা হয়, এখন এগুলো [ধারণাগুলো] পশ্চিমা ইউরোপ এবং এর ইংরেজি ও ফরাসি ভাষাভাষী বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশগুলোতে শিকড় গেড়ে একটি ভৌগলিক ও জাতিগত বিন্যাস তৈরি করেছে। অন্যান্য সভ্যতার তালিকাগুলো কোনো ভৌগলিক দিক থেকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি, কেবল জাপান ছাড়া। তারা এখনো ধর্ম: ইসলাম, কনফুসিয়ান, বৌদ্ধ, হিন্দু এবং গোঁড়া খ্রিস্টান সভ্যতা। এটা ইতোমধ্যেই কিছুটা বিভ্রান্তিকর। কেন পশ্চিমকে ১৫২০ সাল নাগাদ ধর্মীয় দিক থেকে সংজ্ঞায়িত করা বন্ধ করা হলো, (যদি বেশিরভাগ পশ্চিমারা নিজেদেরকে ‘খ্রিস্টান’ সম্বোধন করা সত্ত্বেও) যেখানে অন্যান্যরা এখনো তাই রয়ে গেল (যদিও অধিকাংশ চীনারা নিশ্চিতভাবেই ‘কনফুসিয়ান’ বলে সম্বোধন না করা সত্ত্বেও)? আমি মনে করি, হান্টিংটনের এই ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য হয় পশ্চিম থেকে কিছু গোষ্ঠীকে বাদ দিতে হবে যেগুলোকে তিনি বাদ দিতে চান না (ক্যাথলিক বা প্রোটেস্ট্যান্ট, ইহুদি, যৌক্তিক একেশ্বরবাদ, সেকুলার দার্শনিক) অথবা তাকে কেন পশ্চিমে বিশ্বাস ও দর্শনের জটিল সংমিশ্রণ রয়েছে এবং অন্যখানে নেই তার কারণ সরবরাহ করতে হবে। যদিও কেউ ভারত বা চীনের ভৌগলিক অঞ্চলকে পরীক্ষানিরীক্ষা করবেন তখন সেখানেও বিশ্বাস ও দর্শনের মধ্যে জটিল সংমিশ্রণ খুঁজে পাওয়া যাবে।

ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। পরবর্তীতে “What Makes the West Western” (1996) প্রবন্ধে হান্টিংটন দাবি করেন যে, ‘বহুত্ববাদ’ই পশ্চিমের অন্যতম অনন্য গুণ:

পশ্চিমা সমাজ ঐতিহাসিকভাবেই খুব বহুত্ববাদী। কার্ল ডয়েচ যেমন বলছিলেন, পশ্চিমের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ‘রক্ত বা বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নয় এমন গোষ্ঠী বা দলের উদ্ভব ও ছড়িয়ে পড়া’। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের শুরুতে এই গোষ্ঠীতে বিভিন্ন আশ্রম, গিল্ড অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও বহু ধরনের সমিতি ও সমাজ ছড়িয়ে পড়েছিল।’ (১৯৯৬: ২৩৪)

তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, এই বৈচিত্রের মধ্যে শ্রেণি বহুত্ববাদ (শক্তিশালী অভিজাততন্ত্র), সামাজিক বহুত্ববাদ (প্রতিনিধিমূলক সংঘ), ভাষাগত বৈচিত্রসহ আরও অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত। তার মতে এই সবকিছু ধীরে ধীরে পশ্চিমা নাগরিক সমাজের অনন্য জটিলতার জন্য মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়েছিল। এখন এগুলো যে কতটা হাস্যকর তা সহজেই দেখানো সম্ভব। যেমন, যে কেউই চাইলে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন যে, প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসজুড়ে চীন ও ভারতে পশ্চিমা ইউরোপের চাইতে অনেক বেশি ধর্মীয় বহুত্ববাদ ছিল। অধিকাংশ এশীয় সমাজ বহু ধরনের আশ্রম, গিল্ড, মঠ, গোপন সমাজ, সংঘ, পেশাজীবী ও নাগরিক গোষ্ঠী দ্বারা চিহ্নিত ছিল। ধর্মদ্রোহিদের নিশ্চিহ্ন করে, বা ডাইনি শিকার করে (উইচ হান্ট) সমরূপতা কায়েমের জন্য পশ্চিমা কায়দায় যুদ্ধ আর কেউই করেনি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, হান্টিংটন তার বর্গের অস্পষ্টতাকেই এর নির্ধারিত বা চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যে পরিণত করার চেষ্টা করছেন। প্রথমত, তিনি এমনভাবে এশিয় সভ্যতাকে বর্ণনা করার চেষ্টা করছেন যেন তারা সংজ্ঞানুসারে বহুত্ববাদী হতেই পারে না। এরপর যদি কেউ অভিযোগ করেন, তিনি যাদেরকে ‘পশ্চিমা’ বলে দলা পাকিয়েছেন তাদের মধ্যে কোনো সাধারণ ভাষা, ধর্ম, দর্শন, বা সরকারপদ্ধতি নেই, তখন হান্টিংটনের উত্তর প্রস্তুতই আছে: এই বহুত্ববাদই পশ্চিমের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এটি এক নিখুঁত চক্রিয় যুক্তিধারা।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হান্টিংটনের যুক্তি সেই পুরান আমলের প্রাচ্যবাদী ধাঁচের: ইউরোপীয় সভ্যতাকে দেখা হয় অন্তর্নিহিতভাবে গতিশীল, ‘প্রাচ্য’কে তুলে ধরা হয় নিশ্চল, কালহীন ও একশিলাভূত (monolithic) হিসাবে। আমি যেদিকে আসলে মনযোগ দিতে চাই সেটা হচ্ছে ‘সভ্যতা’ ও ‘সংস্কৃতি’ নিয়ে হান্টিংটনের ধারণা কতটা অসমাঞ্জস্য বা অস্পষ্ট তা দেখানো! সর্বোপরি ‘সভ্যতা’ শব্দটি দুইভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। এটি এমন এক সমাজকে বোঝাতে ব্যবহার করা হতে পারে যেখানে লোকজন শহরে বসবাস করে, প্রত্মতাত্ত্বিকরা যেমন করে সিন্ধু উপত্যকার কথা বলেন। অথবা এর অর্থ হতে পারে পরিমার্জন, অভীষ্টলাভ, সাংস্কৃতিক অর্জন। সংস্কৃতিরও একভাবে দ্বৈত অর্থ রয়েছে। কেউ নৃতাত্ত্বিক অর্থে একে ব্যবহার করতে পারেন, অর্থাৎ কোনো একটি সংস্কৃতির সদস্যদের বেড়ে ওঠার সাথে জড়িত অনুভূতির কাঠামো ও প্রতীকী বিধিকে বোঝাতে ব্যবহার করতে পারেন যা কিনা সদস্যদের প্রত্যাহিক জীবনযাপনের প্রতিটি দিক সম্পর্কে অবহিত করবে। মানে কীভাবে লোকেরা কথা বলে, খায়, বিয়ে করে, ভাবের আদানপ্রদান করে, গান শুনে ইত্যাদি। বোওর্দিওর পরিভাষা ব্যবহার করে কেউ এই সংস্কৃতিকে জীবনাচার[হ্যাভিটাস] বলতে পারেন। এর বিপরীতে, কেউ এই শব্দটি দিয়ে ‘উঁচু সংস্কৃতি’ বলে যা চালু আছে সেটাকে বোঝাতে পারেন। মানে, কোনো শৈল্পিক, সাহিত্যিক বা দার্শনিক অভিজাতদের সেরা ও অসামান্য উৎপাদনকেও বোঝাতে পারেন। পশ্চিমাকে কেবল তার সবচেয়ে মূল্যবান ধারণা, যেমন স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার, দিয়ে সংজ্ঞায়িত করার দিকে হান্টিংটনের জোরারোপ থেকে আন্দাজ করা যায় যে, তার মনে আসলে সংস্কৃতির এই দ্বিতীয় সংজ্ঞাই রয়েছে। যদি নৃতাত্ত্বিক অর্থে ‘সংস্কৃতি’কে সংজ্ঞায়ন করতে হয় তাহলে স্পষ্টত প্রাচীন গ্রিকদের সরাসরি উত্তরাধিকারী আধুনিক ইংরেজ বা ফরাসিরা হতেন না, আধুনিক গ্রিকরাই হতেন। কিন্তু হান্টিংটনের যুক্তি অনুযায়ী, আধুনিক গ্রিকদের সাথে পশ্চিমের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল ১৫০০ বছর পূর্বে, যে মুহূর্তে তারা খ্রিস্টধর্মের ভুল রূপে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।

ছবি: Jacques Réattu

সংক্ষেপে হান্টিংটন যে অর্থে ‘সভ্যতা’ ধারণাকে ব্যবহার করছেন তা বুঝতে সভ্যতাগুলোকে মূলত মানুষের একে অপরের বই পড়ার ঐতিহ্য হিসাবে কল্পনা করতে হবে। বলা যেতে পারে প্লাটো বা থুসিডাইডের সময়ের কোনো গ্রিক মেষপালকের চাইতে নেপোলিয়ন বা ডিসরায়েলি ওনাদের কাছের উত্তরাধিকারী, কারণ এই দুইজনেই প্লাটো বা থুসিডাইডের লেখাপত্র বেশি পড়েছেন। পশ্চিমা সংস্কৃতি কেবল চিন্তা বা ধারণা সম্ভার নয়, বরঞ্চ এটি এমন কিছু ধারণার সম্ভার যা পাঠ্যপুস্তকে পঠিত হয়, বক্তৃতা মঞ্চে, ক্যাফে বা সাহিত্যমণ্ডপে আলোচিত হয়। যদি তা না হয় তাহলে এটা কল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে যে কীভাবে একটা সভ্যতা প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু হয়ে প্রাচীন রোম, এরপর মধ্যযুগের ক্যাথলিক দুনিয়াতে প্রায় অর্ধজীবন কাটিয়ে ইতালীয় নবজাগরণে আবার জেগে ওঠে, অতঃপর মূলত উত্তর আটলান্টিক সীমান্তবর্তী দেশের বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছে যায়। এও ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে যাবে কীভাবে ইতিহাসের অধিকাংশ সময়জুড়ে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মতো ‘পশ্চিমা ধারণা’ কেবল সম্ভাবনা হিসাবেই [in potentia] জারি ছিল। আমরা বলতে পারি: এটি একটি সাহিত্যিক ও দার্শনিক ঐতিহ্য; প্রাচীন গ্রিসে কল্পিত ধারণাসমষ্টি বইপুস্তক, বক্তৃতা, সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে হাজার বছরে ধীরে ধীরে পশ্চিমাভিমুখী হয়েছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত এসবের [ধারণাসমূহের] উদার ও গণতান্ত্রিক শক্তি গত এক বা দুই শতক পূর্বে আটলান্টিকের সীমান্তবর্তী গুটিকয়েক দেশ উপলদ্ধি করতে পেরেছে। নতুন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থান পাওয়ার পর তারা ধীরে ধীরে সাধারণ নাগরিকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানে পরিণত হয়। পরিশেষে এই ধারণাগুলোর প্রবক্তারা এগুলোকে সর্বজনীন হিসাবে দেখেছেন এবং বিশ্বের বাকি অংশেও চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু এখানেই ধাক্কা খায়, কারণ এই ধারণাগুলোকে শেষপর্যন্ত এমন অঞ্চলে প্রসারিত করা যাবে না যেখানে সমানভাবে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রন্থীয় ঐতিহ্য রয়েছে যা অন্যান্য ধারণা ও মূল্যবোধ ধারণ করে আছে; যেমন কোরআন বা বুদ্ধের শিক্ষা।

এই অবস্থান অন্তত বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সংযত। একে সভ্যতার গ্রেট বুকস তত্ত্ব বলা যেতে পারে। একদিকে এইটা খুবই আগ্রহোদ্দীপক। কেউ বলতে পারেন পশ্চিমা হওয়ার সাথে জীবনাচারের[হ্যাভিটাস] কোনো সম্পর্ক নেই। দুনিয়া সম্পর্কে যে গভীর বোঝাপড়া শৈশবে সহজাতভাবে গ্রহণ করা হয়, অর্থাৎ যে পরিস্থিতি কিছু লোককে উঁচু শ্রেণির ইংরেজ নারী করে তোলে, কাউকে বাভেরিয়ান ক্ষেতের ছেলে বা ব্রুকলিনের ইতালীয় বাচ্চা করে তোলে, তার সাথে এটি সম্পর্কিত নয়। বরঞ্চ পশ্চিম একটি সাহিত্যিকদার্শনিক ঐতিহ্য যার মধ্যে মূলত কৈশোরে সূচনা ঘটে, যদিও সেই ঐতিহ্যের কিছু কিছু উপাদান ধীরে ধীরে সকলের কাণ্ডজ্ঞানের অংশ হয়ে যায়। সমস্যাটা হচ্ছে, যদি হান্টিংটন এই মডেলটি ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগ করেন তাহলে সেটা খোদ তার যুক্তিকেই ধ্বসিয়ে দেয়। যদি সভ্যতা খুব গভীরভাবে অঙ্গীভূত না হয় তাহলে কেন একজন পেরুর নারী বা বাংলাদেশের কৃষকের ছেলে একই পাঠ্যক্রম গ্রহণ করে অন্যান্যদের মতো পশ্চিমা হয়ে উঠতে পারবে না? কিন্তু হান্টিংটন তো আসলে এটাই খারিজ করার চেষ্টা করছেন।

ফলে তিনি ‘সভ্যতা’ ও ‘সংস্কৃতি’র দুইটা অর্থের এদিকওদিকে ক্রমাগত পিছলাতে বাধ্য হন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পশ্চিম তার বিভিন্ন মহৎ আদর্শ দ্বারাই সংজ্ঞায়িত হয়। কিন্তু কখনোসখনো এটা চলমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দ্বারাও সংজ্ঞায়িত হয়। যেমন, মধ্যযুগের শুরুর দিককার সকল গিল্ড, সংঘ; এগুলোকে প্ল্যাটো এবং এরিস্টটল পাঠ দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে ধরা হয় না, বরঞ্চ নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী বেড়ে উঠেছিল। কখনো কখনো পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদকে একটি বিমূর্ত ধারণা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, যা বিভিন্ন প্রাচীন পাঠে লুকিয়ে ছিল, হঠাৎ হঠাৎ ম্যাগনা কার্টার মতো দলিলাদিতে মাথা বের করেছে। কখনো কখনো এটাকে ধরে নেয়া হয়েছে আমজনতার মধ্যে গভীরভাবে খচিত ধারণা হিসাবে যা অন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বেড়ে উঠা জনতার মধ্যে কোনো সজ্ঞাত চেতন তৈরি করবে না।

আমি বলছিলাম, আমি হান্টিংটনকে বেছে নিয়েছিলাম কারণ তিনি সহজ লক্ষ্যবস্তু। ‘ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশ’এ তার যুক্তিধারা অস্বাভাবিক রকম পিচ্ছিল। সমালোচকরা যথাযথভাবেই অপশ্চিমা সভ্যতা বিষয়ক তার মন্তব্যকে আক্রমণ করেছেন। পাঠক হয়তোবা ভাবতে পারেন আমি কেন এতটা সময় তার পিছনে ব্যয় করছি। এর একটা কারণ হচ্ছে যে, প্রায় প্রত্যেকে যে অনুমানগুলো ধারণ করেন সেগুলোর অসঙ্গতি হান্টিংটনের যুক্তিবোধ প্রকাশ করে দিয়েছে। কিন্তু ‘পশ্চিম’ বলে যে একটা সত্তাকে প্রাচীন গ্রিসে উদ্ভূত একটা সাহিত্যিক ঐতিহ্য হিসাবেও সমানতাকে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং আজকের পশ্চিমা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার জনগণের সাধারণ সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে— আমার জানামতে তার কোনো সমালোচকই এই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করেননি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও গণতন্ত্রের মতো ধারণাগুলোকে পশ্চিমের নিজস্ব জিনিস হিসাবে অনুমান করাটাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রয়ে গিয়েছে। বিতর্কের কারণ হিসেবে এসবকে স্বতঃসিদ্ধ বলেই ধরে নেয়া হয়েছে। কেউ কেউ পশ্চিমকে স্বাধীনতার জন্মস্থান হিসেবে উদযাপন করেছেন, কেউ কেউ একে খারিজ করেছেন সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতার কারণে। কিন্তু ডান বা বামের এমন কোনো রাজনৈতিক, দার্শনিক বা সামাজিক চিন্তক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব যিনি সন্দেহ পোষণ করেছেন যে, আদতে ‘পশ্চিমা ঐতিহ্য’ নিয়ে কেউ অর্থবহ জিনিস বলতে পারেন কিনা। প্রকৃতপক্ষে অনেক র‍্যাডিকেলরা মনে করেছেন যে কোনো বিষয় সম্পর্কে কোনো অর্থবহ জিনিস বলা অসম্ভব।

ছবি: ইন্টারনেট

সম্পূরক মন্তব্য: পশ্চিমা দৃষ্টির পিচ্ছিলতা প্রসঙ্গে

আমি বলতে চাচ্ছি যে, পশ্চিমা ধারণাটি পাঠগত ঐতিহ্য ও দৈনন্দিন চর্চার মধ্যকার একটা ঝাঁপসা দাগের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর একটি অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ হচ্ছে: ১৯২০এর দশকে লুসিয়ান লেভিব্রুহ্ল নামক একজন ফরাসি দার্শনিক একসারি বই লিখে প্রস্তাব করেন যে, নৃবিজ্ঞানী দ্বারা নিরীক্ষিত বহু সমাজ এক ধরনের ‘প্রাকযুক্তি মানসিকতা’ প্রদর্শন করে। তার যুক্তি হচ্ছে, যেখানে আধুনিক পশ্চিমারা যুক্তিপরীক্ষানিরীক্ষামূলক চিন্তার প্রয়োগ ঘটান সেখানে আদিমরা একেবারেই ভিন্ন নীতি প্রয়োগ করেন। পুরো যুক্তিধারাটা তুলে ধরার দরকার নাই। লেভিব্রুহ্ল যা বলেছিলেন তা তৎক্ষণাৎ তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে এবং এসব যুক্তি বাতিল হিসাবেই গণ্য করা হয় এখন। সাধারণত তার সমালোচকরা যা বলেননি সেটা হচ্ছে লেভিব্রুহ্ল আসলে আপেলের সাথে কমলার তুলনা করেছিলেন। মূলত তিনি যা করেছিলেন তা হলো আফ্রিকা নিউগিনি ও অনুরূপ স্থানের উপনিবেশিক কর্মকর্তা এবং ইউরোপীয় মিশনারিদের পর্যবেক্ষণগুলো থেকে বিভিন্ন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে স্থানীয়দের অদ্ভূত প্রতিক্রিয়া বা গোলমেলে রীতিনীতিকে বাছাই করেন এবং এসব জ্ঞাত তথ্যের ভিত্তিতে অজ্ঞাত কোনো বিষয়ে যুক্তিটা হাজির করেন। এরপর তিনি এই বস্তুগুলোকে ফ্রান্স বা পশ্চিমা কোনো দেশের সমান বস্তুর সাথে তুলনা না করে বরঞ্চ পশ্চিমারা কীভাবে দার্শনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক পাঠের ভিত্তিতে আচরণ করে তার একটা পরিপূর্ণ আদর্শ ধারণার সাথে তুলনা করেন। ফলাফল স্পষ্টতই অযৌক্তিক, কারণ আমরা সবাই জানি সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন কাজকারবারে অ্যারিস্টটলিয়ান সিলেজিজম ও পরীক্ষামূলক পদ্ধতি প্রয়োগ করে না, কিন্তু তার রচনাশৈলির জাদুর জন্য কেউই এটাকে মোকাবিলা করেননি।

এর কারণ হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে এমন রচনাশৈলী খুবই সাধারণ [কমন]। তো এই জাদু কীভাবে কাজ করে? এটি মূলত পাঠকের সাথে অর্নিধারিত গুণাবলির এমন এক মানুষের পরিচয় ঘটিয়ে দেয় যিনি কিনা একটি ধাঁধার সমাধানের চেষ্টা করছেন। পশ্চিমা দার্শনিক ঐতিহ্যে, বিশেষত এরিস্টটলের কাজ থেকে শুরু করে এবং অন্যান্য দার্শনিক ঐতিহ্যের সমান ধরনের কাজগুলোর সাথ তুলনা করলে যে কেউ এমন একটা ছাপ খুঁজে পেতে পারেন যে, এই মহাবিশ্ব কেবল গতকাল সৃষ্টি হয়েছে, কোনো প্রাকজ্ঞানের প্রয়োজন নেই। এছাড়াও একজন সাধারণ বোধবুদ্ধির কথককে কোনো ধরনের উদ্ভট অনুশীলনের মুখোমুখি দেখানোর প্রবণতাও রয়েছে। এটাই আসলে তা সম্ভব করে তোলে। যেমন, একজন সমসাময়িক জার্মানের জন্য টাসিটাসের জার্মানিয়া পড়ে নিজের পূর্বপুরুষের চাইতে বরঞ্চ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইতালীয় কথক বা বর্ণনাকারীর দৃষ্টিকোণকে শনাক্ত করতে পারেন। অথবা একজন ইতালীয় নাস্তিক যখন জিম্বাবুয়ের কিছু প্রথা বিষয়ে ইংরেজি মিশনারির বর্ণনা পড়েন, এবং সেটা করেন সেই পর্যবেক্ষকের [বা মিশনারির] উদ্ভট চা প্রথা বা ট্রানসাবস্টানশিয়েশন মতবাদের প্রতি নিয়োজিত থাকার কথা চিন্তা না করেই। ফলে পশ্চিমের সমগ্র ইতিহাসকে ‘আবিষ্কার’ এবং ‘উদ্ভাবন’ এর একটি গল্প হিসেবে দেখানো যেতে পারে। সবচাইতে বড় কথা, এটাও ঠিক যে যখনই কেউ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছু লিখেন, যেমন এখন আমি লিখছি, তিনি আসলে কার্যকরভাবেই এমন এক অনুশাসন ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যান যাকে কিনা অত্যন্ত অপরিহার্য বলে মনে হয়।

সবচাইতে বড় কথা, সমসাময়িক নৃবিজ্ঞানীদের কাছেও যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটা হচ্ছে, লেভি ব্রুহ্লতে ‘পশ্চিমা ব্যক্তি’ এমন এক ব্যক্তি যিনি নির্দিষ্ট ঘরানার গদ্য রচনাকালে একধরণের বৈশিষ্ট্যহীন, যুক্তিবাদী পর্যবেক্ষক, বিমূর্ত দৃষ্টিসম্পন্ন হিসেবে ব্যক্তিক বা সামাজিক বিষয়বস্তু থেকে বিচ্যুত করে নিজেকে জাহির করেন বলে মনে করেন। যে মানুষের অস্তিত্ব রয়েছে, বেড়ে উঠেছে, ভালোবেসেছে, ঘৃণা করেছে, ওয়াদা করেছে তার সাথে এর সম্পর্ক অতি অল্পই রয়েছে। এটি নিখাদ বিমূর্ততা। এইগুলোকে স্বীকার করে নেয়া নৃবিজ্ঞানীদের জন্য একটা মারাত্মক সমস্যা তৈরি করেছে: যদি ‘পশ্চিমা ব্যক্তি’র অস্তিত্ব নাই থাকে, তাহলে আমাদের তুলনা করার জায়গা কী?

যদিও আমার কাছে মনে হয় যারা এই চেহারাকে ‘গণতন্ত্র’ বাহক হিসাবে দেখতে চান তাদের জন্য এটা আরও বড় মুশকিল তৈরি করে। যদি গণতন্ত্র সম্প্রদায়ের স্বশাসনের প্রক্রিয়া হয়ে থাকে তাহলে পশ্চিমা ব্যক্তি এমন এক কর্তা যে কিনা ইতোমধ্যে সম্প্রদায়ের সকল বন্ধন ছিঁড়ে ফিলেছে। যদিও এই অপেক্ষাকৃত বৈশিষ্ট্যহীন, যুক্তিবাদী পর্যবেক্ষককে বাজার অর্থনীতির কিছু নির্দিষ্ট রূপের চরিত্র হিসাবে কল্পনা করা সম্ভব; তাকে গণতন্ত্রবাদী [ডেমোক্রেট] করে তোলা সম্ভব কেবল তখনই যদি কেউ খোদ গণতন্ত্রকে এমন একধরনের বাজার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন যেখানে কর্তারা [এক্টরস] অর্থনৈতিক স্বার্থের চাইতে অল্পকিছু বেশি অন্বেষণে প্রবেশ করেন। অবশ্য এই মনোভাব [এপ্রোচ] র‍্যাশলানচয়েস থিওরি দ্বারাও প্রচারিত হয়েছিল। একভাবে আপনি বলতে পারেন, রুশোর পর সাহিত্যে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তপ্রণয়নের প্রতি এই আধিপত্যশীল মনোভাবকেই পাওয়া যায়, যা ‘আলাপআলোচনা’কে কোনো একটা বিষয়ের গঠন বা আদলের প্রক্রিয়া হিসাবে না দেখে বরঞ্চ নিছক স্বার্থের ভারসাম্য হিসাবে দেখে। (ম্যানিন ১৯৯৪) যাবতীয় সম্প্রদায়গত সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন এমন বিমূর্ত চরিত্রকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সবচাইতে বিমূর্ত রূপের [যেমন কয়েকদিন পর পর নির্বাচনে অংশ নেয়া] চাইতে অন্য কোনো ধরনের আলাপচারিতা ও সমঝোতায় প্রবেশ দেখা খুবই কঠিন।

(চলবে…)

সহুল আহমদ

সহুল আহমদ, লেখক, অনুবাদক ও অ্যক্টিভিস্ট। গবেষণার পাশাপাশি সমকালীন বিষয়াবলীর বিশ্লেষক। জন্ম সিলেটে, ১৯৯১ সনে। পড়াশোনা করেছেন শাবিপ্রবিতে, পরিসংখ্যান বিভাগে। একাধিক জার্নাল সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত বই: মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের অপব্যবহার; জহির রায়হান: মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক ভাবনা; সময়ের ব্যবচ্ছেদ (সহ-লেখক সারোয়ার তুষার)। অনুবাদ: ইবনে খালদুন: জীবন চিন্তা ও সৃজন।