অরাজ
ছবি: মারিনো ভ্যান রাইমারসওয়ালা
প্রচ্ছদ » ডেভিড গ্রেইবার ।। দেনা: প্রথম পাঁচ হাজার বছর

ডেভিড গ্রেইবার ।। দেনা: প্রথম পাঁচ হাজার বছর

  • অনুবাদ: কাজী রবিউল আলম

আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী ও নৈরাজ্যবাদী অ্যাক্টিভিস্ট ডেভিড গ্রেইবারের Debt: The First Five Thousand Years লেখাটি ২০০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম প্রকাশিত হয় Mute ম্যাগাজিনে এবং তুমুল আলোড়ন তোলা এই লেখাটিকে বর্ধিত করে বছর দুই পরে বই আকারে প্রকাশিত হয় ২০১১ সালেবর্তমান অনুবাদটি প্রথম বোধিচিত্তে প্রকাশিত হয়। বোধিচিত্তের অনুমতিসাপেক্ষে লেখাটি পুনঃসম্পাদিত অবস্থায় অরাজে ছাপা হচ্ছে। – সম্পাদক

নিউইয়র্ক টাইমসের স্মরণিকাপত্র

এই লেখাটি মানব ইতিহাসে দেনা এবং দেনার অর্থ (money) নিয়ে একটি বড় গবেষণা প্রকল্পের অংশ। এই প্রকল্পের প্রথম এবং অভূতপূর্ব (overwhelming) উপসংহার এই যে, অর্থনৈতিক ইতিহাস অধ্যয়ন করতে গিয়ে যাকে এখন আমরা ‘অর্থনীতি’ বলছি তার মৌলিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তৈরি এবং রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে সহিংসতা, যুদ্ধ ও দাসত্বের নিরঙ্কুশ কেন্দ্রীয় ভমিকাকে [আমরা] পদ্ধতিগতভাবে উপেক্ষা করেছি। যাই হোক না কেন, যেকোন বিষয়ের উৎপত্তির ধারণা গুরত্বপূর্ণ। সহিংসতা অদৃশ্য হতে পারে কিন্তু এটি আমাদের অর্থনৈতিক সাধারণ জ্ঞান, প্রতিষ্ঠানসমূহের দৃশ্যত স্বতঃসিদ্ধ প্রকৃতির যুক্তির মধ্যে নিহিত থাকে। আর এগুলো সাধারণভাবে সহিংসতার একচেটিয়া আধিপত্যের বাইরে কখনই টিকে থাকতে পারে না। উপরন্তু আধুনিক রাষ্ট্রের মাধ্যমে সহিংসতার এই পদ্ধতিগত হুমকি বজায় রাখা হয়।

প্রথমেই প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাসত্বের ভূমিকা দিয়ে আমি শুরু করতে চাচ্ছি। আমার মতে যার ভূমিকা এখানে মখ্য। বেশিরভাগ সময় এবং স্থানে, দাসত্বকে যুদ্ধের একটি পরিণাম হিসেবে দেখা হয়। কখন অধিকাংশ যুদ্ধবন্দিরাই দাস হয়ে যান, আবার কখন তারা সেটি হয় না। কিন্তু প্রায় অবিকৃতভাবে, যুদ্ধকে এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি ও ওজর হিসেবে দেখা হয়। আপনি যদি যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন, আপনি আসলে আপনার জীবনকে আত্মসমর্পণ করেন; আপনার উপর বিজয়ীর অধিকার রয়েছে আপনাকে হত্যা করবার এবং প্রায়শই তারা তাই করে থাকেন। যদি তিনি সেটা না করেন, আপনি আক্ষরিক অর্থে আপনার জীবনটা তার উপর সমর্পণ করেন; এটি এমন একটা দেনা যাকে নিরঙ্কু, অসীম এবং অপরিবর্তনীয় হিসেবে ধারণা করা হয়। নীতিগতভাবে তিনি যা চান তাই আদায় (extract) করতে পারেন। এবং সমস্ত দেনা বাধ্যবাধকতা যার জন্য হয়তো আপনি অন্যের (আপনার বন্ধু, পরিবার, প্রাক্তন রাজনৈতিক আনুগত্য) কাছে দেনাগ্রস্ত অথবা অন্যরা আপনার কাছে দেনাগ্রস্ত তা সম্পূর্ণরূপে বাতিল হয়ে যায়। যা টিকে থাকে তা হলো মালিকের কাছে আপনার দেনা।

এই ধরনের যুক্তির কমপক্ষে দুইটি খুবই আগ্রহোদ্দীপক গুরুত্ব রয়েছে। যদিও তা হয়তো দুটি বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। প্রথমত, যেমনটা আমরা সবাই জানি, দাসদের ক্রয় বা বিক্রয় করা যায়। আর এটি দাসত্বের একটি আদর্শস্বরূপ এবং সম্ভবত সংজ্ঞানির্ধারক বৈশিষ্ট্য। এ ক্ষেত্রে, নিরঙ্কুশ দেনা (অন্য প্রেক্ষিত, যেমন বাজার পরিস্থিতিতে) আর নিরঙ্কুশ থাকে না। বস্তুত, এটাকে সঠিকভাবে পরিমাপ করা যায়। আর এই ধরনের ক্রিয়াকলাপই যে আমাদের বর্তমান ধরনের মুদ্রার সৃষ্টির শুরু সম্ভব করে তুলেছিল তা বিশ্বাস করবার উপযুক্ত কারণ আছে। কারণ নৃবিজ্ঞানীরা যাকে ‘প্রিমিটিভ মদ্রা’ বলেন, যা রাষ্ট্রবিহীন সমাজে দেখা যায় (সলোমন দ্বীপের পালকের মুদ্রা, ইরোকুইসদের ওয়্যাম্পাম), তা পণ্য কেনাবেচার জন্য ব্যবহৃত হতো না। বরং তা ব্যবহৃত হতো মূলত বিবাহের ব্যবস্থা করতে, রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তি করতে এবং মানুষের অন্যান্য সম্পর্ক বজায় রাখতে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দাসত্ব যদি দেনা হয়, তাহলে দেনা দাসত্বের দিকে পরিচালিত করতে পারে। ব্যাবিলনের একজন কৃষক বিয়ের অনুমোদনের জন্য মেয়ের বাবাকে একটা ভালো পরিমাণের রৌপ্য দিতে পারে। কিন্তু কোন অর্থেই সে তার স্ত্রীর মালিক না। এক্ষেত্রে সে কোনভাবেই তার সন্তানের মাকে বিক্রি বা ক্রয় করতে পারেন না। কিন্তু এর সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে যদি সে ঋণ নেয়। আর যদি সে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তবে পাওনাদার প্রথমে তার ভেড়া ও আসবাবপত্র, তারপরে তার বাড়ি, ক্ষেত এবং বাগান, এবং অবশেষে তার স্ত্রী, সন্তান, এবং এমনকি তাকে পর্যন্ত দেনাশ্রমিক হিসেবে নিয়ে যায় যতক্ষণ না বিষয়টির নিস্পত্তি হয় (যা তার সম্পদের নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার কারণে অবশ্যই ক্রমশ আরও কঠিন হয়ে পড়ে)। দেনা ছিল সেই দ্বারসন্ধি (hinge) যা আধুনিক অর্থে মুদ্রা কল্পনা করা সম্ভব করে তুলেছিল। উপরন্তু ঐ কারণে, আমরা যাকে বাজার বলছি তা সৃষ্টি করেছিল। কারণ বাজার হচ্ছে সেই ক্ষেত্র (arena) যেখানে যেকোন কিছু ক্রয় এবং বিক্রয় করা করা যায়। আর (দাসত্বের মতো) এখানে সব বস্তু তাদের পূর্বের সমস্ত সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিদেহী (disembedded) হয়ে যায় এবং মুদ্রার সাথে সম্পর্কিত হয়েই কেবল টিকে (exist) থাকে।

কিন্তু একই সময়ে, যেমনটি আমি উল্লেখ করেছিলাম, বিজয় হিসেবে দেনার যুক্তি অন্যদিকে টেনে নিয়ে যায়। সমস্ত ইতিহাসজুড়ে রাজরাজরারা দেনার যুক্তিটিকে পুরোপুরি হাতছাড়া করতে ভীষণভাবে দ্বিধান্বিত ছিলেন। তার অর্থ এই নয় যে তারা বাজারের প্রতি বিদ্বেষী ছিলেন। বরং তারা সাধারণত এগুলোকে (বাজারকে) উৎসাহিত করতেন। বরং এর সাধারণ কারণ ছিল এই যে, প্রয়োজনীয় সবকিছু (রেশম, রথের চাকা, ফ্লেমিংগো জিহ্‌বা, নীলকান্তমণি) সরাসরি অধীনস্ত জনগণের কাছে থেকে আদায় করা সরকারের জন্য ছিল অসুবিধাজনক; এর চেয়ে বরং বাজারকে উৎসাহিত করা এবং তারপর সেখান থেকে ক্রয় করা তাদের জন্য অনেক বেশি সহজ ছিল। প্রারম্ভিক বাজারগুলি সেনাবাহিনী বা রাজকীয় সহচররা যেখানে থাকত সেখানে অথবা প্রাসাদের কাছে কিংবা সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের আশেপাশে গঠিত হতো। এটা বরং রাজদরবারের গোলমেলে আচরণকে প্রকৃতপক্ষে ব্যখ্যা করতে সাহায্য করে: সর্বোপরি রাজারাই সাধারণত স্বর্ণ ও রৌপ্যের খনিগুল নিয়ন্ত্রণ করত। তাই যদি হয়, তাহলে এর কিছু অংশে নিজের মুখচ্ছবি মুদ্রাঙ্কন করা, তা সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া এবং এরপর আবার তা কর হিসেবে ফেরত চাওয়ার প্রকৃত কারণটা কী ছিল? এটি কেবল তখনই বোধগম্য হয় যখন বস্তুত কর আদায়ের উদ্দেশ্যেই সবাইকে মুদ্রা অর্জনে বাধ্য করা হয়। যেটিই আবার বাজারগুলর উত্থানকে সহজ করেছিল। কারণ চারপাশে বাজার থাকাটা এর জন্য সুবিধাজনক ছিল। যাই হোক, এখানে আমাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে: কীভাবে এই করগুলো নায্যতা পেয়েছিল? কেন জনগণ তাদের কাছে দেনাগ্রস্থ থাকত? যখন [কর] প্রদান করতো তখন তারা কোন ধরনের দেনা থেকে মুক্ত হতো? এখানে আবার আমরা বিজয়ীর অধিকারে ফিরে যাই। (প্রকৃতপক্ষে, প্রাচীন বিশ্বে সেটা মেসোপটেমিয়া, গ্রিস বা রোম যেখানেই হোক না কেন, মুক্ত নাগরিকদের এই কারণে সরাসরি কর দিতে হতো না। কিন্তু আমি এখানে স্পষ্টতই সরলীকরণ করছি)। রাজারা যদি বিজয়ী হওয়ার অধিকারের ভিত্তিতে তাদের প্রজাদের জীবন এবং মৃত্যুর অধিকার দাবি করে, তাহলে তাদের প্রতি প্রজাদের দেনাও শেষ পর্যন্ত অসীম; এবং উপরন্তু (অন্তত পক্ষে এই প্রেক্ষিতে) তাদের একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক (প্রজাদের নিজেদের মধ্যে) এবং একে অন্যের প্রতি দেনা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। বাস্তবে যেটা টিকে থাকে তা হচ্ছে রাজার সাথে তাদের সম্পর্ক। এটাই ঘুরেফিরে ব্যাখ্যা করে রাজা এবং সম্রাটেরা কেন দাসদের উপর মালিকদের এবং ঋণগ্রহীতাদের উপর পাওনাদের ক্ষমতাকে সর্বদা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন। নিদেনপক্ষে তাদের হাতে যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে যেসব বন্দি তখনো তাদের জীবন বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিল তারা যেন তাদের মালিকদের দ্বারা হত্যা না হয় সেদিকে তারা (রাজা ও সম্রাটেরা) সর্বদা জোর দিত। বস্তুত কেবল শাসকরাই জীবন ও মৃত্যুর উপর অবাধ ক্ষমতা অর্জন করতে পারতেন। একজনের চূড়ান্ত দেনাটা ছিল রাষ্ট্রের প্রতি। এটাই ছিল একমাত্র বিষয় যা ছিল সত্যিকারের সীমাহীন, যা নিরঙ্কুশ, মহাজাগতিক হিসেবে দাবি করতে পারত।

দেনা বইটির প্রচ্ছদ

আমি যে কারণে এই বিষয়টা গুরুত্ব দিতে চাচ্ছি তা হলো এই যুক্তিটা এখন আমাদের সঙ্গে রয়েছে। আমরা যখন একটি সমাজের কথা বলি (ফরাসি সমাজ, জ্যামাইকার সমাজ) তখন আমরা প্রকৃত অর্থে একটি জাতিরাষ্ট্র দ্বারা সংগঠিত জনগণের কথা বলি। যেভাবেই হোক, এটি একটি অকথিত (tacit) মডেল। ‘সমাজগুলোই’ প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্র, জয়ী হওয়াটাই রাষ্ট্রের যুক্তি, আর জয়ী হওয়ার যুক্তিটা চূড়ান্তভাবে দাসত্বেরও সমরূপ। রাষ্ট্রের কৈফিয়ত প্রদানকারীদের হাতে সত্যিসত্যই এটি আরও বেশি উদার ‘সামাজিক দেনার’ ধারণায় রূপান্তরিত হয়। এখানে একটি ছোট্ট গল্প বলা হয়েছে যা একধরনের মিথ। আমরা সবাই একধরনের অসীম দেনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি। এই দেনাটা সেই সমাজের প্রতি যা আমাদের বড় করেছে, লালনপালন করেছে, খাদ্য দিয়েছে, পোশাকপরিচ্ছেদ করিয়েছে, সেইসব অনেক আগের মৃতদের প্রতি যারা আমাদের ভাষা এবং ঐতিহ্য আবিষ্কার করেছিলেন, তাদের সকলের প্রতি যারা আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব করে তুলেছিলেন। প্রাচীনকালে আমরা ভেবেছিলাম এর জন্য আমরা ঈশ্বরের কাছে ঋণী (এটা অর্ঘ্য [sacrifice, বলিদান] প্রদানের মাধ্যমে পরিশোধ করা হতো অথবা অর্ঘ্যটা ছিল প্রকৃতঅর্থে সুদ পরিশোধ চূড়ান্তভাবে এটি মৃত্যুর মধ্যদিয়ে পরিশোধ করা হতো)। পরবর্তীতে এই দেনা রাষ্ট্র কর্তৃক পরিগৃহিত (adopted) হয়েছিল যেখানে রাষ্ট্র নিজেই একটি ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। এখানে অর্ঘ্যের বিকল্প হিসেবে কর স্থলাভিষিক্ত হয় এবং একজনের জীবনের দেনার বিনিময়ে সামরিক পরিসেবা প্রদান করা হয়। চালিত হওয়ার ধরন অনুযায়ী, মুদ্রা শুধুমাত্র এই সামাজিক দেনারই মূর্ত রূপ। কেইনসীয়রা এই ধরনের যুক্তি পছন্দ করেন। একইরকমভাবে সমাজতান্ত্রিক, সামাজিক গণতন্ত্রীদের বিভিন্ন ধারা, এমনকি অগাস্ট কোঁতের (আমার জানা মতে, যিনি প্রথম ‘সামাজিক দেনা’ শব্দটি ব্যবহার করেন) মতো চোরাফ্যাসিস্টরাও এই যুক্তিটি পছন্দ করেন। কিন্তু এই যুক্তিটি আমাদের বেশিরভাগ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মাধ্যমেও সঞ্চালিত হয়: উদাহরণস্বরূপ এই বাক্যগুলো বিবেচনা করু, ‘সমাজের প্রতি একজনের দেনা পরিশোধ করা’, অথবা, ‘দেশের প্রতি আমার কিছু দেনা আছে’, অথবা, ‘আমি কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই’। এই ধরনের ক্ষেত্রে, সর্বদা পারস্পরিক অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা, পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি বস্তুত মুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক একটি ‘সমাজের’ ধারণায় পরিণত হয়। আর যেখানে আমরা সকলেই কেবল চরম দেনাগ্রস্ত হিসেবেই একজন রাজার সামনে (যে এখন অদৃশ্য) সমান। যে রাজা আমাদের মায়ের পক্ষে, এবং বর্ধিতভাবে, মানবতার পক্ষে দাঁড়ায়

এর মাধ্যমে আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, নৈর্ব্যক্তিক বাজার এবং ‘সমাজের’ দাবি যখন প্রায় সবসময়ই পাশাপাশি অবস্থান করেএবং যাদের নিশ্চিতভাবে সকল বাস্তবিক উপায়ে প্রকাশ্যে এবং অগোচরে প্রতারণা করবার প্রবণতা আছে তখন তারা উভয়েই আসলে চূড়ান্তভাবে সহিংসতার একই যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এটি নিছক ঐতিহাসিক উৎপত্তির বিষয় নয় যাকে অবান্তর হিসেবে দূরে সরিয়ে রাখা যায়: ক্ষমতার নিরবচ্ছিন্ন হুমকি ব্যতীত রাষ্ট্র এবং বাজার কোনোটিই তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না।

কেউ তখন জিজ্ঞস করতে পারে, তাহলে বিকল্পটা ক?

ভার্চুয়াল মুদ্রার ইতিহাসের অভিমুখে

এখানে আমি আমার মূল বিষয়ে ফিরে আসতে পারি: মুদ্রা শুরুতে এই রকম শীতল, ধাতব এবং নৈর্ব্যক্তিক ধরনে উপস্থিত হয়নি। গোড়াতে এটি মূলত একটি পরিমাপ, বিমূর্ততা হিসেবে হাজির হয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটি মানুষের মধ্যে সম্পর্ক (দেনা এবং বাধ্যবাধকতা) হিসেবেও হাজির হয়। এটি লক্ষ্য করা গুরত্বপূর্ণ যে ঐতিহাসিকভাবে পণ্যমুদ্রা সবসময়ই সহিংসতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল। একজন ঐতিহাসিক যেমন বলেন, ‘সোনা বা রূপার বাট যুদ্ধের আনুষঙ্গিক বস্তু, শান্তিপূর্ণ বাণিজ্যের নয়।’[]

কারণটা খুবই সাধারণ। পণ্যমুদ্রা, বিশেষত সোনা বা রপার আদলে, ঋণমুদ্রার থেকে একটি দৃশ্যমান কারণে আলাদা: এটি চুরি করা যায়। যেহেতু সোনার বা রূপার ধাতুপিণ্ড কোন বংশপরিচয় ছাড়াই একটি বস্তু। সমসাময়িক একজন মাদক ব্যবসায়ী সুটকেস ভর্তি ডলারের বিল নিয়ে যে ভূমিকাটা পালন করেন, ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়ে সোনার বা রপার বাট একই ভূমিকা পালন করে এসেছে। এ যেন ইতিহাসবিহীন এমন একটা বস্তু যা যেকোন স্থানে প্রশ্নাতীতভাবে অন্য একটি মূল্যবান বস্তুর সঙ্গে বিনিময় হতে পারে। ফলস্বরূপ, গত ৫০০০ বছরের মানব ইতিহাসকে এক ধরনের পরিবর্তনের ইতিহাস হিসেবে দেখা যেতে পারে। আপেক্ষিক সামাজিক শান্তির সময়ে, আস্থার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র বা (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে) বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা সৃষ্টি হওয়ার মাধ্যমে ঋণব্যবস্থা দৃশ্যত উদ্ভব হয় এবং প্রভাবশালী হয়ে ঠে। আর বিস্তৃত লুটতরাজের সময়কালে মূল্যবান ধাতু এগুলোকে প্রতিস্থাপিত করে। লুণ্ঠণমূলক ঋণদান ব্যবস্থা প্রত্যেকটি সময়ে উপস্থিত থাকে। কিন্তু এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাব দেখা যায় যখন মুদ্রাকে খুব সহজে নগদ অর্থে রূপান্তর করা সম্ভব হয়েছিল।

বর্তমান সময়কে চিহ্নিত করে এমন ছন্দকে উপলব্ধি করবার যেকোন প্রচেষ্টার সূচনা হিসেবে আমি ভার্চুয়াল এবং ধাতব মুদ্রার পর্যায়ানুবৃত্তি অনুযায়ী ইউরেশীয় ইতিহাসের নিম্নলিখিত পর্যায় বিভাজনের প্রস্তাব দিতে পারি:

. প্রথম কৃষি সম্রাজ্যের সময়কাল (৩৫০০৮০০ খ্রি.পূ.)

প্রধান মুদ্রা ধর: ভার্চুয়াল ধার (ক্রেডিট) মুদ্রা

মুদ্রার উৎপত্তি সম্পর্কে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া থেকে আমরা সবচেয়ে ভালো তথ্য পাই। তবে দৃশ্যত এটা বিশ্বাস করবার কোন কারণ নেই যে ফারাওয়ের মিশর, চীনের ব্রোঞ্জ যুগ বা সিন্ধু উপত্যকাতে বিষয়গুলো খুব আলাদা ছিল। মেসোপটেমিয়ার অর্থনীতি বৃহত্তর সরকারি প্রতিষ্ঠানের (উপাসনালয় এবং রাজপ্রসাদ) অধীনে পরিচালিত হতো। এর আমলান্ত্রিক প্রশাসকরা রুপা এবং প্রধান ফসল বার্লির মধ্যে নির্দিষ্ট সমতল্য প্রতিষ্ঠা করে কার্যকরভাবে হিসাব মুদ্রা (money of account) সৃষ্টি করেছিল। দেনাগুলো হিসেব করা হতো রপাতে কিন্তু বিনিময়ের ক্ষেত্রে রুপা কদাচিৎ ব্যবহৃত হতো। এর পরিবর্তে পাওনা প্রদান করা হতো বার্লি বা অন্য যেকোন কিছুতে (যা সুবিধাজনক এবং গ্রহণযোগ্য মনে করা হতো)। দেনা লিপিবদ্ধ করা হতো কীলকাকার (cuneiform) ফলকে যা উভয় পক্ষের লেনদেনের জামানত হিসেবে রাখা হতো।

অবশ্যই, বাজারের অস্তিত্ব ছিল। কিছু পণ্যের মল্য যা উপাসনালয় এবং প্রসাদের আয়ত্তে উৎপন্ন হতো না। ফলে এগুলো প্রশাসনিক মূল্য তালিকার অধীনে ছিল না। সরবরাহ ও চাহিদার মর্জি অনুযায়ী এগুলোর মূল্য ঠানামা করত। তবে বেশিরভাগ প্রাত্যহিক কেনাবেচার কাজ (বিশেষত যেগুলো সম্পূর্ণ অপরিচিতদের মধ্যে সম্পাদিত হতো না) দৃশ্যত ঋণের মধ্যে দিয়ে সম্পাদিত হতো। উদাহরণস্বর, ‘এয়াল নারী’, অথবা পান্থশালার মালিকরা, বিয়ার পরিবেশন করত এবং প্রায়শই ঘর ভাড়া দিতেন; গ্রাহকরা হিসাব লিপিদ্ধ করে রাখতেন; স্বভাবত পুরো পাওনাটা ফসল উঠার সময় প্রেরণ করা হতো। বাজারের বিক্রেতারা সম্ভবত আজকের আফ্রিকা, মধ্য এশিয়ার ছোট আকারের বাজারের মতো বিশ্বাসযোগ্য গ্রাহকদের একটি তালিকা তৈরি করত যাদেরকে তারা ঋণ দিত।

সুদে অর্থ আয়ের অভ্যাসটি সুমের (Sumer) থেকেও উৎপত্তি হয়। উদাহরণস্বরূপ, যা মিশরে অজানা ছিল। ২০ শতাংশ হারে নির্ধারিত সুদের হার ২,০০০ বছর ধরে বজায় ছিল (এটা সরকার কর্তৃক বাজার নিয়ন্ত্রণের নিদর্শন ছিল না: এই পর্যায়ে, এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই বাজারকে সম্ভব করে তুলেছিল)। যাইহোক, এটা কিছু গুরুতর সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছিল। বিশেষত যে বছর ফসল খারাপ হতো, কৃষকরা আশাহতভাবে ধনীদের নিকট ঋণগ্রস্থ হওয়া শুরু করে। এর ফলে তাদেরকে তাদের খামার দিয়ে দিতে হতো এবং শেষ পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের ঋণদাসত্বে আত্মসমর্পণ করতে হতো। ক্রমশ এই পরিস্থিতিটি দৃশ্যত একটি সামাজিক সঙ্কটে পরিণত হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত এটি খুব বড় জনপ্রিয় গণজাগরণে রূপ নেয় না। কিন্তু সাধারণ মানুষ শহর এবং যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসরত ছিল তা স্থায়ীভাবে পরিত্যাগ করা শুরু করে এবং আধাযাযাবর ‘দস্যু’ এবং আক্রমণকারী হয়ে ওঠে। প্রতিটি শাসকের পক্ষে স্লেটটি পরিষ্কার করে ফেলা, সব দেনা বাতিল করা এবং সাধারণ ক্ষমা বা ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণা করা ঐতিহ্য হয়ে পড়ে। এর উদ্দেশ্যে ছিল যেন সকল দণ্ডিত শ্রমিকরা তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারে। (এখানে তাৎপর্যপূর্ণ যে, যেকোন মানবভাষায় ‘স্বাধীনতা’ সম্পর্কিত জ্ঞাত প্রথম শব্দ, সুমেরিয়ায়ান ভাষায় আমর্গা (amarga)। আক্ষরিক অর্থে এটা ‘মায়ের কাছে ফিরে আসা’ বোঝায়।) বাইবেলে উল্লখিত ধর্মপ্রবক্তারা একটি অনুরূপ প্রথা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এটি ছিল জয়ন্তী, যার দ্বারা সাত বছর পরে সমস্ত দেনা একইভাবে বাতিল করা হতো। এটিই New Testament-এর ‘মুক্তি’ ধারণার প্রত্যক্ষ পূর্বপুরুষ। অর্থনীতিবিদ মাইকেল হডসন যেমন উল্লেখ করেছেন, বিশ্বইতিহাসের দৃশ্যত একটি অন্যতম দুর্ভাগ্য যে সুদের ভিত্তিতে ঋণ দেওয়ার প্রতিষ্ঠানটি তার আদি চেক আন্ড ব্যালেন্সের(check and balance) অনুষঙ্গী ছাড়াই মেসোপটেমিয়া বাইরে, অধিকাংশ অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

ছবি: মারিনো ভ্যান রাইমারসওয়ালা

. অক্ষীয় সময়কাল [Axial Age] (৮০০ খ্রি.পূ. – ৬০০ খ্রি.)

প্রধান মুদ্রার (money) ধরনঃ ধাতব মুদ্রা (coinage) এবং ধাতব বাট (metal bullion)

এই সময়ে মুদ্রার আবির্ভাবের পাশাপাশি চীন, ভারত এবং মধ্যপ্রাচ্যে সব বড় বড় বিশ্বধর্মের জন্মের সূত্রপাত হয়েছিল।[] চীনের Warring States-এর সময়কাল হতে ভারতের ভান এবং হত্যাকাণ্ড ও গণদাসত্ব সহযোগে রোমান সম্রাজ্যের বিস্তৃতি (এবং পরবর্তীতে, বিলোপ ঘটা) পর্যন্ত, এটি সারা বিশ্বজুড়ে সৃজনশীলতার জমকালো প্রদর্শনী ছিল। কিন্তু প্রায় সমানভাবে এটি সহিংসতারও জমকালো প্রদর্শনীর সময়কাল ছিল।

ধাতবমুদ্রা (coinage) বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে সত্যিকার অর্থে সোনা এবং রপার ব্যবহারকে সম্ভব করেছিল। উপরন্ত সেটি এখনকার প্রচলিত, নৈর্ব্যক্তিক অর্থে বাজার সৃষ্টিকে সম্ভব করে তুলেছিল। মূল্যবান ধাতবগুলো চুরি করা সম্ভব ছিল। আর সেই অনস্বীকার্য কারণে এটি সাধারণ যুদ্ধবিগ্রহযুক্ত সময়কালের জন্য অনেক বেশি যথাপযুক্ত ছিল। ধাতবমুদ্রা (coinage) অবশ্যই ব্যবসাকে সহজ করবার জন্য উদ্ভাবিত হয়নি (ফিনিশীয়রা প্রাচীন বিশ্বের নিখুঁত ব্যবসায়ী ছিলেন এবং এটি গ্রহণে সর্বশেষদের মধ্যে ছিলেন)। দৃশ্যত এটি প্রথমে উদ্ভাবিত হয় সৈনিকদের বেতন দেওয়ার জন্য। সম্ভবত সর্বপ্রথম এশিয়া মাইনরের লিডিয়ার শাসকদের কর্তৃক তাদের গ্রিক সৈন্যদের বেতন দেওয়ার মাধ্যমে। কার্থেজ আরেকটি বিখ্যাত ব্যবসায়ী জাতি এবং এরা অনেক পরে ধাতবমুদ্রা (coin) তৈরি করা শুরু করে। নিশ্চিতভাবেই তারা সেটা করে তাদের বিদেশি সৈন্যদের বেতন দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

পুরো প্রাচীনকালকে জিওফ্রে ইঙ্গামএর মতো করে ‘সামরিকধাতব মুদ্রা কমপ্লেক্স’ (‘military-coinage complex’) শিরোনামে অভিহিত করা যায়। যেহেতু নতুন সামরিক প্রযুক্তির বিস্তার (গ্রিক হপলাইটস, রোমান লেজিওনস্‌) দাসদের আটক এবং বিপণনের সাথে ঘনিষ্টভাবে আবদ্ধ ছিল, সেক্ষেত্রে এটাকে তিনি ‘সামরিকধাতব মুদ্রাদাসত্ব কমপ্লেক্স’ (‘military-coinage-slavery complex’) বললে আরও ভালো করতেন। দাসের অন্যান্য প্রধান উৎস ছিল দেনা: এখন রাষ্ট্রগুলো পর্যায়ক্রমে স্লেটগুলো পরিষ্কার করে দেয় না। ফলে এখন এরা বড় সামরিক নগররাজ্যের নাগরিক হওয়ার মতো ভাগ্যবান নয়। যারা সাধারভাবে লুণ্ঠনকারী ঋণদাতাদের কাছে থেকে সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে এই ব্যবস্থাটাই অনেক ভালো ছিল। Near East-এর ঋণব্যবস্থা বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার অধীনে এসে ভেঙে পড়েনি; সেগুলো আলেকজেন্ডারের সেনাবাহিনী দ্বারা নির্মূল হয়েছিল। যে সেনাবাহিনীর মজুরি দেওয়ার জন্য প্রতিদিন আধা টন বাট (bullion)-এর প্রয়োজন পড়ত। যে খনিগুলোতে বাট তৈরি হতো সেখানে সাধারণত দাসরা কাজ করত। অন্যদিকে সামরিক অভিযান নতুন দাসদের অন্তহীন প্রবাহকে নিশ্চিত করত। আগেই যেমনটা বলা হয়েছিল, মূলত তাদের প্রজাদের দ্বারা বাজার সৃষ্টি করতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে সাম্রাজিক কর ব্যবস্থা পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল সৈন্যরা (এবং অবশ্যই সরকারি কর্মকর্তারা) যা কিছু চান তা কিনতে যেন এই বাট ব্যবহার করতে পারে। যে নৈর্ব্যক্তিক বাজার একসময় একটি সমাজ থেকে আরেকটি সমাজে অথবা সামরিক অভিযানের প্রান্তে দেখা দেওয়া শুরু করেছিল, এখন তা পুরো সমাজে পরিব্যপ্ত হওয়া শুরু করল।

তাদের উৎপত্তি যতই চটকদার হোক না কেন, নতুন বিনিময় মাধ্যমের সৃষ্টির দৃশ্যত একটা গভীর বৌদ্ধিক প্রভাব ছিল। উল্লেখ্য গ্রিস, ভারত এবং চীনে একইসাথে ধাতব মুদ্রার সূচনা ঘটে। কেউ কেউ এমন যুক্তি পর্যন্ত দিয়েছেন যে গ্রিক দর্শনের আবির্ভাব সম্ভব হয়েছিল ধাতব মুদ্রা কর্তৃক উপস্থাপিত ধারণাগত উদ্ভাবনের ফলে। তা সত্ত্বেও, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সেই একই সময় এবং স্থানে যেখানে ধাতব মুদ্রার প্রাথমিক প্রসারকে দেখা যায়, সেখানেই আধুনিক ধর্মসমূহের উদ্ভব লক্ষ করা যায়। যেমন প্রফেটিক ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈনধর্ম, কনফুসিয়ানবাদ, তাওবাদ এবং শেষপর্যন্ত, ইসলাম ধর্ম। যদিও যথাযথ সম্পর্ক এখন বিশ্লেষণ করা যায়নি, তা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কিছু দিক থেকে এই ধর্মসমূহ দৃশ্যত বাজারের যুক্তির প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভব। কিছুটা স্থূলভাবে বললে: কেউ যদি শুধুমাত্র বস্তুগত বিষয়াদির স্বার্থপর অর্জনের জন্য একটি নির্দিষ্ট সামাজিক স্থানকে ন্যস্ত করে, তবে এটি প্রায় অনিবার্য যে খুব শীঘ্রই অন্য কেউ আরেকটি জায়গা আলাদা করবেন। আর যেখান থেকে সে চূড়ান্ত মূল্যবোধের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বলে উপদেশ দিতে পারে যে, বস্তুগত বিষয়াদি হচ্ছে গুরুত্বহীন। আর এখানে স্বার্থপরতা, এমনকি স্বত্ত্বাও হচ্ছে কল্পনাপ্রসূত বিষয়।

. মধ্য যুগ (৬০০ খ্রী. – ১৫০০ খ্রী.)[]

ভার্চুয়াল ঋণ মুদ্রার ফিরে আসা

অক্ষীয় যুগ যদি পণ্যবাজার এবং বিশ্বধর্মের পরিপূরক আদর্শের উত্থান দেখে থাকে, মধ্য যুগ ছিল সেই সময়কাল যেখানে এই দুই প্রতিষ্ঠান একীভূত হওয়া শুরু করে। ধর্মসমূহ বাজার ব্যবস্থার দায়দায়িত্ব বুঝে নেওয়া শুরু করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে শুরু করে স্থানীয় মেলার সংগঠন পর্যন্ত সমস্ত কিছু ক্রমশ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সম্পাদিত হওয়া শুরু হয়। এটিই পালাক্রমে সমস্ত ইউরোশিয়া জুড়ে ভার্চুয়াল ঋণ মুদ্রার বিভিন্ন ধরণকে সক্ষম করে তোলে।

ইউরোপে, যেখানে খ্রিস্টীয় সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় এই সমস্ত ঘটনা ঘটেছিল, ধাতব মুদ্রা কেবল বিক্ষিপ্তভাবে এবং বিষমভাবে পাওয়া যেত। ৮০০ খ্রিস্টাব্দের পরে দামগুলো মূলত পুরানো ক্যারোলিংএর মুদ্রা দ্বারা হিসেব করা হতো যার অস্তিত্ব এখন নেই (সেই সময় এটি আসলে ‘কাল্পনিক মুদ্রা’ হিসেবে পরিচিত ছিল)। কিন্তু প্রাত্যহিক কেনাবেচা অন্যান্য মাধ্যম দ্বারা সম্পাদিত হতো। উদাহরণস্বর, একটি প্রচলিত পন্থা ছিল গণনাকাঠি (tally-sticks)-এর ব্যবহার। এটি ছিল খাঁজকাটা কাঠের টুকরা যাকে দুইভাগ করা হতো। অর্ধেক ঋণ প্রদানকারী এবং বাকি অর্ধেক ঋণ গ্রহীতা রাখতেন। এই গণনাকাঠিগুলো ১৬ শতক পর্যন্ত ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ স্থানেও প্রচলিত ছিল। বড় লেনদেনগুলো হুন্ডির (bills of exchange) মাধ্যমে পরিচালিত হতো। যেখানে বড় বড় বাণিজ্যক মেলাগুলো এগুলোর ক্লিয়ারিং হাউস হিসেবে কাজ করত। ইতমধ্যে, চার্চ একটি আইনি কাঠামো প্রণয়ন করে, যার মাধ্যমে সুদে অর্থ ধার দেওয়া এবং ঋণদাসত্বের নিষেধাজ্ঞার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব হয়।

ছবি: ট্যাক্স কালেক্টর অফিস,
পিটার ব্রুগেল

তা সত্ত্বেও, মধ্যযুগীয় বিশ্ব অর্থনীতির স্নায়ুকেন্দ্র ছিল ভারত মহাসাগর। এটি ভারত, চীন, এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত সভ্যতাগুলোর সাথে মধ্য এশিয়ার কাফেলা (caravan) [সড়ক পথ] পথসহ যুক্ত ছিল। এখানে, ইসলামের কাঠামোর আলোকে বাণিজ্য পরিচালিত হতো। এটি শুধু ব্যবসায়িক কার্যক্রলাপ সম্পাদনের অত্যন্ত সহায় বা উপযুক্ত একটি আইনি কাঠামো দেয়নি (যেখানে সুদে টাকা ধার দেওয়া সম্পূর্ণরপে নিষিদ্ধ ছিল)। বরং বিভিন্ন ধরনের পরিশীলিত ঋণকৌশল তৈরির মাধ্যমে বিশ্বের উল্লেখযোগ্য বড় অংশজুড়ে ব্যবসায়দের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করেছিল। প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই পশ্চিম ইউরোপ এক্ষেত্রে আপেক্ষিকভাবে অনেক দেরিতে হাজির হয়: তালি এবং ফ্রান্সে যেসব আর্থিক উদ্ভাবনগুলো ১১তম এবং ১২শ শতকে দেখা যায়, সেগুলো মিশর বা ইরাকে ৮ম বা ৯ম শতক থেকেই সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। যেমন, ‘চেক’ (‘cheque) শব্দটি আরবি সাক (sakk) শব্দ থেকে উদ্ভূত এবং যা ইংরেজি ভাষায় আবির্ভূত হয় মাত্র ১২২০ খ্রিস্টাব্দের দিকে।

চীনের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল: বৌদ্ধধর্মের দ্রুত প্রসারের মধ্য দিয়েই মধ্যযুগের শুরু হয়েছিল। যদিও আইন প্রণয়ন অথবা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের মতো অবস্থানে বৌদ্ধধর্ম সেসময়ে ছিল না। তা সত্ত্বেও, বন্ধকী দোকান উদ্ভাবনের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্ম সেসময় স্থানীয় সুদখোরদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছিল। গরিব কৃষকদের জন্য স্থানীয় সুদখোরদের বিকল্প হিসেবে বৌদ্ধমন্দিরকে ভিত্তি করেই প্রথমদিকের বন্ধকী দোকানগুলো গড়ে ওঠে। তা সত্ত্বেও, খুব দ্রুতই রাষ্ট্র নিজেকে পুনর্বহাল করে, যেমনটি চীনে রাষ্ট্র বরাবরই করে এসেছে। কিন্তু শুধু সুদের হার নিয়ন্ত্রণ এবং ঋণদাসত্ব চূড়ান্ত বিলোপ করার চেষ্টা করে না। বরং কাগুজে মুদ্রা উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে সোনা বা রুপার বাট (bullion) [নির্ভর বিনিময় মাধ্যম] থেকে পুরোপুরি সরে যায়। আর এর সবকিছুই ঘটেছিল বিভিন্ন ধরনের আরও জটিল আর্থিক উপকরণের বিকাশের মধ্য দিয়ে।

তার অর্থ এটা বলা না যে, এই সময়কালে (বিশেষত বিখ্যাত যাযাবর আগ্রাসনের সময়কালে) হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠন দেখা যায়নি অথবা ধাতব মুদ্রাকে বিনিময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন সময়ে ও স্থানে দেখা যায়নি। তবুও ভিন্ন একটি গতিধারার দিকে অগ্রসর হওয়ায় দৃশ্যত এই সময়কালের মূল বৈশিষ্ট্য। মধ্যযুগের বেশিরভাগ সময়েই দমনমূলক প্রতিষ্ঠান হতে মুদ্রার বিভক্তি দেখা যায়। বলা যেতে পারে, মুদ্রা পরিবর্তনকারীদের (money changers) পুনরায় উপসনালয়ে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যেখানে তাদেরকে নজরদারি করা যায়। অনেক বেশি দৃঢ় সামাজিক আস্থার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিকাশই ছিল এর ফলাফল।

. ইউরোপীয় সাম্রাজ্যকাল (১৫০০১৯৭১ খ্রি.)

মূল্যবান ধাতুর প্রত্যাবর্তন

বৃহৎ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের (আইবেরিয়ান বা তদানীন্তন উত্তর আটলান্টিক) আবির্ভাবের সাথে সাথে বিশ্ব একই সাথে দুটি বিষয়ের প্রত্যাবর্তন দেখে। ব্যাপকভাবে দাসত্ব, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যাবর্তন এবং এর ফলাফল হিসেবে মুদ্রার প্রধান ধরন হিসেবে সোনা এবং রুপার বাট (bullion)-এর ফিরে আসা। ঐতিহাসিক অনুসন্ধান সম্ভবত শেষ পর্যন্ত এটা দেখাবে যে, আমাদের সাধারণ অনুমানের চেয়েও এই রূপান্তরগুলো আরও জটিল ছিল। এমনকি এর কিছু কিছু নতুন বিশ্বকে (New World) জয় করবার পূর্বেই ঘটতে শুরু করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৫তম এবং ১৬শ শতাব্দীতে মিং রাজবংশের সময় জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোর উত্থান আবারও সোনা বা রুপার বাটে ফিরে যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। এটি শেষপর্যন্ত সরকারকে কেবল তাদের কাগুজে মুদ্রা বাতিল করতে বাধ্য করেনি বরং নিজস্ব মুদ্রা চাপিয়ে দেওয়ার যে কোন চেষ্টাকেও বাতিল করেছিল। এটি বিশাল চীনা বাজারকে একটি অমুদ্রিত রূপার মানদণ্ডে প্রত্যাবর্তন করায়। ক্রমান্বয়ে করও (ট্যাক্স) পাতে বিনিময় করা শুরু হয়। ফলে যতটা সম্ভব দেশে রুপা আনার চেষ্টা করাটাই খুব দ্রুত একটা অফিসিয়াল চীনা নীতিতে পরিণত হয়। এটি করা হয় যেন এর মাধ্যমে কর নিম্নগতির রাখা এবং নতুন সামাজিক অস্থিরতার প্রাদুর্ভাব রোধ করা সম্ভব হয়। রূপার জন্য হঠাৎ প্রচুর চাহিদা সারা বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছিল। বিজয়ীদের দ্বারা লু করা এবং পরবর্তীতে মেক্সিকো ও পোটোসির খনি হতে (প্রায় কল্পনাতীত মানুষের জীবনের মূল্য বিনিময়ে) সংগ্রহ করা বেশিরভাগ মূল্যবান ধাতু শেষ পর্যন্ত চীনে গিয়ে পৌঁছেছিল। আটলান্টিক, প্রশান্ত মহাসাগর, এবং প্রশান্ত মহাসাগরের জুড়ে শেষপর্যন্ত গড়ে ঠা এই বিশ্বব্যাপী সংযোগ সম্পর্কে বিস্তর প্রমাণাদি পাওয়া যায়। এখানে গুরত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে অর্থের (money) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হতে বিযুক্তি, দমনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর (বিশেষত রাষ্ট্র) সাথে সংযুক্তি এবং সেইসাথে ‘ধাতবতা’র দিকে মতাদর্শিক প্রত্যাবর্তন এগুলোর অনুষঙ্গী হওয়া।[]

এই প্রেক্ষিতে, সার্বিকভাবে ঋণ ছিল রাষ্ট্রের একটি বিষয় যারা নিজেরাই বড় ধরনের আর্থিক ঘাটতির মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল। ক্রমবর্ধমান ব্যয়বহুল যুদ্ধসমূহের অর্থায়ন করতে গিয়েই পালাক্রমে এই ধরনের দেনার সৃষ্টি হয়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পুরো নিশ এবং বিশ শতকজুড়ে আন্তর্জাতিকভাবে সোনাকে মানদণ্ড হিসেব বজায় রাখতে অবিচল ছিল এবং সোনাকে নাকি রপাকে মানদণ্ড হিসেবে চালু রাখা উচিৎ হবে তা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড় ধরনের রাজনৈতিক লড়াই সংগঠিত হয়েছিল।

উপরন্তু এটি স্পষ্টতই পুঁজিবাদ, শিল্প বিপ্লব, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র ইত্যাদির উত্থানেরও পর্যায়কাল ছিল। আমি এখানে এদের গুরুত্বকে অস্বীকার করিনি। বরং পরিচিত ঘটনাসমূহকে অপরিচিত প্রেক্ষিত থেকে দেখবার একটি কাঠামো প্রদান করবার চেষ্টা করেছি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, এটি যুদ্ধ, পুঁজিবাদ এবং দাসত্বের মধ্যকার সম্পর্কগুলোকে সনাক্ত করবার কাজকে সহজ করে তোলে। মজুরি শ্রম প্রতিষ্ঠানের, উদাহরণস্বরূপ, ঐতিহাসিকভাবে দাসত্বের মধ্য থেকেই উদ্ভুত হয়েছিল (আমরা জানি যে গ্রিস থেকে মলয়ের নগর রাষ্ট্র পর্যন্ত প্রারম্ভিক মজুরি চুক্তিগুলো প্রকৃতপক্ষে দাসের ভাড়া ছিল)। ঐতিহাসিকভাবেও এটির বিভিন্ন ধরনের ঋণ দাসত্বের সাথে অন্তরঙ্গভাবে জড়িত থাকার প্রবণতা ছিল এবং সে প্রবণতা প্রকৃতপক্ষে আজও বজায় আছে। আর আমরা এই সবধরনের প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ভাবছি। কিন্তু বিষয়টি এরকম নয়। আমরা এখন যাকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হিসেবে ভাবছি সেটা প্রকৃতপক্ষে মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়জুড়ে বিদ্যমান দাসত্বের যুক্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত।

. বর্তমান যুগ (১৯৭১ পরবর্তী)

দেনার সাম্রাজ্য

১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট বর্তমান যুগের সূচনা হয়েছিল বলা যেতে পারে। এই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারকে স্বর্ণে রপান্তরের নিয়ম বাতিল করেছিলেন এবং কার্যকরভাবে বর্তমান ভাসমান মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। যেভাবেই হোক, আমরা ভার্চুয়াল মুদ্রার একটি যুগে ফিরে এসেছি। এখানে ধনী দেশগুলোর ভোক্তাদের কেনাকাটায় খুব কমই কাগুজে মুদ্রা প্রয়োজন হয় এবং জাতীয় অর্থনীতিও মূলত ভোক্তা ঋণ দ্বারা পরিচালিত হয়। এটা সেই প্রেক্ষিত যেখানে আমরা পুঁজির ‘আর্থিকীকরণ’ সম্পর্কে কথা বলতে পারি। এর মাধ্যমে মুদ্রা এবং আর্থিক সরঞ্জামাদি সম্পর্কিত অনুমান নিজেই একটি পরিসর হয়ে ওঠে। এটি উৎপাদন এমনকি বাণিজ্যের সাথে যেকোন ধরনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই সেক্টরটি স্বভাবতই আজ সংকটে পড়েছে।

ছবি: চতুর্দশ শতাব্দীর একটি ম্যানুস্ক্রিপ্ট

এই যুগ সম্পর্কে আমরা নিশ্চিতভাবে কি কিছু বলতে পারি? এখনো পর্যন্ত খুবই সামান্য। আমরা যে সময়কাল নিয়ে কাজ করছি তার বিবেচনায় ৩০ বা ৪০ বছর কিছুই না। স্পষ্টতই, এই সময়কাল সবে শুরু হয়েছে। তা সত্ত্বেও, পূর্বোক্ত বিশ্লেষণগুলো যতই অপরিপক্ক হোক না কেন তা আমাদের কিছু অভিজ্ঞ (informed) ব্যক্তি পরামর্শ প্রদান শুরু করাকে অনুমোদন করে।

ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, ভার্চুয়াল, ঋণমুদ্রার যুগ একধরনের অতিরিক্ত (overarching) প্রতিষ্ঠানও সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন মেসোপটামিয়ার পবিত্র রাজপদ (Mesopotamian sacred kingship), মোজাইক জুবলি (Mosaic jubilees), শরিয়া বা ক্যানন (canon) আইন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের সম্ভাব্য বিপর্যয়মূলক সামাজিক পরিণতির উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো (সাধারণত রাষ্ট্রের যথাযথ সমস্থানিক নয়, বরং এর চেয়ে বৃহত্তর) ঋণখেলাপিদের রক্ষা করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে এখনো পর্যন্ত এগুলোর গতিবিধি ভিন্ন একটি দিকে পরিচালিত হচ্ছে: ৮০’র দশকের পর থেকে আমরা প্রথম একটা বৈশ্বিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার সৃষ্টি হতে দেখি। এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক, কর্পোরেশন এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আর এগুলো মূলত ঋণদাতাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। যাইহোক, এই প্রতিষ্ঠানগুলো খুব দ্রুতই সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। প্রথমত, খুব দ্রুত বেড়ে ওঠা বৈশ্বিক সামাজিক আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে (বিশ্বায়ন বিরোধী আন্দোলন) যে আন্দোলনগুলো কার্যকরভাবে এইএমএফএর মতো প্রতিষ্ঠানের নৈতিক কর্তৃত্বকে ধ্বংস করে এবং অনেককে প্রায় দেউলিয়া করে ফেলে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান সময়ে এসে সাম্প্রতিক ব্যাংকিং সংকট ও অর্থনৈতিক পতনের মাধ্যমে। ভার্চুয়াল মুদ্রার নতুন যুগটি সবে শুরু হয়েছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখন প্রায় পুরোটাই অস্পষ্ট। তা সত্ত্বেও, আমরা ইতিমধ্যে কিছু বিষয় বলতে পারি। প্রথমত, ভার্চুয়াল মুদ্রার দিকে অগ্রসর হওয়া আবশ্যিকভাবে পুঁজিবাদের কোন কূটকৌশলের প্রভাব নয়। আদতে, এটির ঠিক বিপরীতটা হতে পারে। মানব ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়জুড়ে, ভার্চুয়াল মুদ্রার রূপরেখা প্রণয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে করা হয়েছিল যাতে এটা নিশ্চিত করা যায় যে পুঁজিবাদের মতো কোন কিছুই যেন কখন আরম্ভ হতে না পারে। অন্তত এটি নিশ্চিত করা যে, পুঁজিবাদ যেন এর বর্তমান রূপে আবির্ভত না হয়। যে পুঁজিবাদে, বিশ্বের জনসংখ্যার বেশিরভাগই এমন একটি অবস্থার মধ্যে রয়েছে যাকে ইতিহাসের অন্যান্য বহু সময়ে দাসত্বের সমতুল্য বিবেচনা করা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে, যেসব শর্ত দ্বারা আমরা ‘সমাজ’ ও ‘বাজার’ এবং স্বাধীনতা সম্পর্কিত সবচেয়ে প্রাথমিক ধারণাগুলো কল্পনা করি তা নির্ধারণে সহিংসতার নিশ্চিত গুরত্বপূর্ণ ভমিকাকে জোর দেওয়া। একটি বিশ্ব যত বেশি সহিংসতা মুক্ত হবে তত দ্রুত সে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিকাশ শুরু করবে। পরিশেষে, রাষ্ট্র ও বাজারের যমজ বুদ্ধিবৃত্তিক স্ট্রেইট জ্যাকেটের বাইরে গিয়ে দেনা সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা রোমাঞ্চকর সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা এখন জিজ্ঞস করতে পারি: একটি সমাজ থেকে যখন সহিংসতার ভিত্তিটি শেষ পর্যন্ত দূরে সরে যায়, তখন সেখানে মুক্ত পুরুষ ও মহিলারা একে অন্যের প্রতি ঠিক কিসের ভিত্তিতে দেনাগ্রস্থ থাকে? তারা একে অন্যের প্রতি কোন ধরনের প্রতিশ্রুতি এবং অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়?

আশা করি যে একদিন আমরা সকলেই এই ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞস করবার মতো অবস্থানে থাকব। কিন্তু আপনি কোনভাবেই জানেন না যে এরকম সময়টা কখন।

১০ই ফ্রেব্রুয়ারি, ২০০৯

পাদটীকা

[] জেফ্রি ডব্লিউ. গার্ডিনার, ‘The Primacy of Trade Debts in the Development of Money’, in Randall Wray (ed.), Credit and State Theories of Money: The Contributions of A. Mitchell Innes, Cheltenham: Elgar, চেলটেনহ্যাম: এলগার, ২০০৪, পৃষ্ঠা .১৩৪।

[] মূলত আপেক্ষিকভাবে সংক্ষিপ্ত ৮০০ B.C.E – ২০০ B.C.E সময়কালকে বর্ণনা করবার জন্য [জার্মান অস্তিত্ববাদী দার্শনিক] কার্ল ইয়েসপার্স প্রথম ‘এক্সিয়াল এজ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তার ধারণা মতে আমরা আজ যে সমস্ত প্রধান দার্শনিক ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত সেগুলো সবগুলিই প্রায় একসাথে চীন, ভারত এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে এই সময়কালেই উত্থিত হয়েছিল। এখানে, আমি লুইস ম্যামফোর্ডের মতো করে আরও বৃহৎ পরিসরকে বোঝাবার জন্য এই প্রত্যয়টি ব্যবহার করেছি। জরাথ্রুস্তের সময় থেকে শুরু করে মোহাম্মদ পর্যন্ত বর্তমানে বিদ্যমান সব বিশ্বধর্মের জন্ম এই সময়কালেই দেখা যায়।

[] আমি এখানে প্রারম্ভিক পর্যায়ে যাকে ইউরোপে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো সেটাকে বুঝিয়েছি। এই সময়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে লুণ্ঠনকারী সামরিকবাদ এবং ফলশ্রুত সোনা বা রূপার বাটের গুরত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা: ভাইকিং আক্রমণ, এবং অষ্টম শতকের ইংল্যান্ড থেকে ড্যানেজেল্ডের বিখ্যাত নিষ্কাশন। এটাকে সম্ভবত এমন যুগের শেষ হিসেবে দেখা যেতে পারে যেখানে লুণ্ঠনকারী সামরিকবাদ সোনা এবং রপার বাটের শোভাযাত্রার হাত ধরে এগিয়ে চলেছিল।

[] নিশ্চিতভাবে এই সময়েই মুদ্রার বার্টার ব্যবস্থা এবং এর তত্ত্বসমূহের বিকাশ ঘটেছিল।

কাজী রবিউল আলম

কাজী রবিউল আলম বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত আছেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়াশুনা শেষ করে তিনি ২০০৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি জলবায়ু ও কৃষিজ পরিবর্তনের নৃবৈজ্ঞানিক সম্পর্ক নিয়ে উচ্চতর অধ্যয়ন করছেন। শিক্ষকতার এই সময়কালে তিনি একাধারে ধর্ম, কৃষক সমাজ, জাতিসত্ত্বা, জাতীয়তাবাদ, নৃবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও পদ্ধতি, বিশ্বায়ন , উন্নয়নসহ নানা বিষয়ে কোর্স পড়িয়েছেন। এই সময়কালে তিনি দেশি, বিদেশি পত্রিকায় বেশকিছু প্রবন্ধ প্রকাশসহ বই সম্পাদনার কাজও করেন। এছাড়া তিনি বোধিচিত্ত, সংবিৎসহ বিভিন্ন অনলাইন পরিসরে বেশকিছু জনবক্তৃতায় অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি অনুবাদসহ বেশকিছু তাত্ত্বিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ লেখা বিভিন্ন অনলাইন পরিসরে প্রকাশ করেছেন। একজন সামাজিক বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি সামাজিক প্রপঞ্চকে ক্রিটক্যালি বিশ্লেষণ করতে পছন্দ করেন। চিন্তক হিসেবে আধুনিকতার সার্বজনীনতার বিপক্ষে উনার অবস্থান। আধুনিকতা ও আধুনিকতা উত্তরকালে যে কোনো প্রপঞ্চকে উপনিবেশবাদ, বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদ, উদারনৈতিকতাবাদ চিন্তাসহ ও এর দার্শনিক কাঠামোর ইতিহাসের আলোকে দেখার মাধ্যমে সেটিকে ক্রিটিক্যালি বিশ্লেষণের চিন্তা পরিসরে বিচরণ করতে তিনি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।