অরাজ
প্রচ্ছদ » পার্থ চট্টোপাধ্যায়।। জরুরি অবস্থার সংক্রমণ

পার্থ চট্টোপাধ্যায়।। জরুরি অবস্থার সংক্রমণ

  • অনুবাদ : সারোয়ার তুষার

অনুবাদকের ভূমিকা: প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের The State of Exception Goes Viral শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় সাউথ আটলান্টিক কোয়ার্টারলি জার্নালে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে। বাংলায় আমি এর শিরোনাম করেছি ‘জরুরি অবস্থান সংক্রমণ’। ভারতে বিজেপি দ্বিতীয়-দফায় ক্ষমতায় আসার পর এমন অন্তত চারটি বিপদজনক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে, যা ভারত রাষ্ট্রকে আরও প্রকটভাবে ফ্যাসিবাদ ও হিন্দু-জাতীয়তাবাদের দিকে ঠেলে দেয়। কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করা, আসামে এনআরসি প্রণয়ন করা, গোটা ভারতজুড়ে সিএএ আইন পাশ করা এবং উচ্চ-আদালত কর্তৃক উত্তরপ্রদেশের বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়ার সাথে জড়িত হিন্দুত্ববাদী নেতাদের দায়মুক্তি দেয়া, সেই মসজিদের স্থলে রামমন্দির স্থাপনের অনুমোদন দেয়া।

এই সিদ্ধান্তসমূহ ভারতজুড়ে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি করে, বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে গণজোয়ার তৈরি হয় এবং হিন্দুত্ববাদীদের সাথে দেশটির গণতন্ত্রকামীদের সংঘাতকে অনিবার্য করে তোলে। পাশাপাশি, ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ’ বলে পরিচিত ভারত রাষ্ট্রের নিজ দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি-বিশেষত মুসলমানদের প্রতি-নগ্ন একচোখা ও দমনমূলক নীতি বিশ্ববাসীর সম্মুখে উন্মোচিত হয়। এসময় বিপুলসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া প্রগতিশীল তরুণ-তরুণী, শহরবাসী এবং গ্রামীণ কৃষকশ্রেণী রাজপথে মোদি সরকারকে মোকাবেলা করে। এই প্রবন্ধে স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি ভারতের নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তনের জিনিওলজি তুলে ধরেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং দেখিয়েছেন কী করে নাগরিকত্বের ধারণার সাথে বিজেপি তাদের হিন্দুত্বের ধারণাকে একাকার করে ফেলেছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় দেখাচ্ছেন, একদিকে বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদ সৃষ্ট রাজনৈতিক মহামারি, অন্যদিকে করোনা মহামারির দরুন সৃষ্ট বিশেষ পরিস্থিতি; সবমিলিয়ে ভারত রাষ্ট্র যেন জরুরি অবস্থাকে অনিবার্য ও স্থায়ী করে তুলছে। তবে এ অবস্থা কেবল ভারতে নয়, বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রেই জরুরি অবস্থার মতো আপদকালীন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক শাসনপ্রণালীতে পরিণত করার পাঁয়তারা চলছে।

-সারোয়ার তুষার,  ১ মার্চ ২০২১ 

 

পার্থ চট্টোপাধ্যায়

মূল অনুবাদ 

২০১৯ সালের মে মাসে নরেন্দ্র মোদি যখন দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন, তার সরকার অভিমুখ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিল। ২০১৪ সালে মূলত বৃহৎ ব্যবসায় ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তুষ্ট করার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে তার প্রথম দফা শুরু হয়েছিল। কিন্তু বৈশ্বিক মন্দা কর ও শ্রম আইন মারাত্মকভাবে পরিবর্তন করা কিংবা সামাজিক ব্যয় সংকোচনের তেমন একটা সুযোগ রাখেনি। বরং কৃষকসহ অন্যান্য আঞ্চলিক লবিগুলোর ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের মুখোমুখি হয়ে মোদি নির্বাচনের মাধ্যমে সংগঠিত বিপুল সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে সুযোগ-সুবিধা বন্টনের কাল-পরীক্ষিত জনতুষ্টিবাদী পদ্ধতির দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছিলেন। যাইহোক, পুনর্বার ক্ষমতায় গিয়ে রাজনৈতিক কূটকৌশলে ওস্তাদ বলে স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি অমিত শাহকে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিশেবে পাশে নিয়ে মোদি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোষণা করলেন যে তার সরকার এবার  বিজেপির ‘হিন্দু জাতিরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার মতাদর্শিক স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করবে।

হিন্দু জাতি-রাষ্ট্রের অভিমুখে পদযাত্রা

প্রথম বড় পদক্ষেপটি ছিল মুসলিম প্রধান রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা কেড়ে নেয়া। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারায় মূর্ত এই বিশেষ মর্যাদা ছিল ব্রিটিশদের সাথে তৎকালীন ভারতীয় শাসকদের সমঝোতার মাধ্যমে গৃহীত বিভিন্ন চুক্তির অংশ যার মাধ্যমে প্রায় ছয়শত ‘দেশীয় রাজ্য’ (প্রিন্সলি স্টেট) ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারতীয় ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বিশেষ মর্যাদার অধিকারী এমন আরো বেশ কয়েকটি রাজ্য ইতোপূর্বে ছিল, এমনকি এখনো আছে। কিন্তু সংবিধানের ৩৭০ ধারা বরাবরই হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের চক্ষুশূল ছিল কারণ তারা এ’কে কাশ্মীরের মুসলমানদের ভারতে রাখার প্ররোচনামূলক উৎকোচ মনে করতো; বিশেষত এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাখার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সাথে তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে।

বিজেপি বরাবরই দাবি করে এসেছে যে, জম্মু-কাশ্মীরের স্থায়ী নিবাসীদের কোন বিশেষ সুরক্ষা ব্যতিরেকেই এই অঞ্চলকে ভারতের অন্য যেকোন রাজ্যের মতো করেই বিবেচনা করা হোক। বহুজন এই অভিযোগ তুলেছেন যে, বিজেপির পরিকল্পনা হলো অন্যান্য রাজ্য থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষকে কাশ্মীরে বসতি স্থাপন করার অনুমোদন দেয়া যেন এর ফলে কাশ্মীরের জনসংখ্যার বিন্যাসগত চরিত্র বদলে যায়। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে কেবলমাত্র ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করাই হয়নি, বরং বৌদ্ধ-অধ্যুষিত লাদাখকেও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এবং পূর্বতন রাজ্যের দুই অংশকে কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত তথা সরাসরি নয়াদিল্লি থেকে শাসিত অঞ্চলের স্তরে পর্যবসিত করা হয়েছে। হাজার হাজার সশস্ত্র সেনা মোতায়নের মাধ্যমে আগাগোড়া লকডাউন কায়েম করা হয়েছিল এবং কাশ্মীরের যাবতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জেলে পোরা হয়েছিল। যদিও গুটিকয়েক নেতাকে শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দেয়া হয়, দশমাস পরেও আজ অব্দি মোটাদাগে কাশ্মীরের পরিস্থিতি অপরিবর্তিতই আছে।

জম্মু-কাশ্মীরের বিরুদ্ধে এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহরে বিপুল উল্লাসের সাথে উদযাপন করা হয়, যেখানে কিনা পাকিস্তানের সাথে কয়েক মাস পূর্বের অতি সাম্প্রতিক যুদ্ধের উন্মাদনায় একটা বড় অংশের মানুষ এখনো বুঁদ হয়ে আছে। তারা এই পদক্ষেপকে পাকিস্তান ও কাশ্মীরে পাকিস্তানের সমর্থকগোষ্ঠীর গালে এক প্রকাণ্ড চড় হিশেবে বিবেচনা করেছে। এর ফলে দীর্ঘকাল যারা অন্যান্য নানা কারণে বিজেপির সমালোচনায় মুখর ছিল, তারা পর্যন্ত এবার কাশ্মীরকে ভারতের বৈধ ভূসম্পত্তি এবং কাশ্মীরের জনগণকে ‘স্থায়ী উপদ্রব সৃষ্টিকারী’ ভাবতে শুরু করলো। তখনো পর্যন্ত বিজেপির নির্বাচনী বিজয়ের অপ্রত্যাশিত সাফল্যের মাত্রায় হতবাক বিরোধীদলসমূহ [বিশেষ মর্যাদা রদের] প্রতিক্রিয়ায় মোটাদাগে নীরব ছিল। এরপর মোদি-শাহ জুটি বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তথাকথিত বেআইনি কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে এমন সব আইন প্রয়োগ করতে থাকলেন যা মূলত সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিবেচনায় প্রণীত হয়েছিল। এর ফলে অস্বস্তিকর সমালোচকদের বিনাবিচারে জেলে পাঠানো অধিকতর সহজ হয়েছে। (এই আইন সাম্প্রতিকালে বিভিন্ন সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছে।) নভেম্বর মাসে ভারতের উচ্চ আদালতের এক রায় হিন্দুত্ববাদী উন্মাদনার আগুনে নতুন করে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। ১৯৯২ সালে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা চারশত বছরের পুরানা বাবরি মসজিদের স্থাপনাটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, উচ্চ আদালতের রায়ের ফলে সেই মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণের আইনি অনুমোদন মেলে। মোদি সরকার তাৎক্ষণিকভাবে মন্দির নির্মাণ প্রক্রিয়া তরান্বিত করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে।

DSC09878
আর্টিস্ট: পরিপ্লব চক্রবর্তী

 

এদিকে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য আসামে ক্রমবর্ধমান এক উদ্বেগ সংকটবিন্দুতে পৌঁছায়। আসাম রাজ্যে অ-অসমিয়া তথা বহিরাগত অনুপ্রবেশের (মূলত অ-অসমিয়দের বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসী ধরে নেয়া হয়) বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৮৫ সালে [ভারত সরকার এবং অসম আন্দোলন এর নেতৃত্বের মধ্যে] একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল যে, আসামে বসবাসরত প্রত্যেক ব্যক্তির পূর্বপুরুষের ঠিকুজি যাচাই করা হবে এবং একটি নাগরিকপঞ্জি সংকলন করা হবে। কিন্ত এই প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন অসংখ্য আইনি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখে ব্যাহত হয়। যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্র বলতে তেমন কিছু ছিল না এবং জন্মনিবন্ধন সনদ এই সেদিন পর্যন্ত বেশ দুর্লভ ছিল; রেশন কার্ড, ভোটার আইডি কার্ড অথবা সম্পত্তির স্বত্বসহ নানাবিধ নথিপত্র এই রাজ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্তের সাপেক্ষে স্থায়ী নিবাসী এবং কালক্রমে নাগরিকতায় স্বাভাবিক প্রত্যর্পণের প্রমাণের স্মারক হিশেবে গৃহীত হয়। ২০০৩ সালে নয়াদিল্লিতে তৎকালীন বিজেপি সরকার ভারতে অনুপ্রবেশরত অবৈধ শরনার্থী অথবা ভারতে বসবাসরত বৈধ ভিসাবিহীন মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদান ঠেকাতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে। সুপ্রিমকোর্টের পুনঃপুন তাগাদার পর, আসামে নাগরিকপঞ্জি সংকলন শেষ করা হয় এবং ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করা হয়।

ফলাফল ছিল হতবুদ্ধিকর। ঘোষিত ১৯ লাখ ‘অবৈধ শরনার্থী’র মধ্যে ১২ লাখ ছিল হিন্দু এবং ৭ লাখ মুসলমান। এটা বিজেপিকে বেশ কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ফেলে দেয় কারণ এত বিপুল সংখ্যক হিন্দু জনসংখ্যা, যারা মূলত বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের মুখে বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করা শরনার্থী বলে বিজেপি বরাবর দাবি করেছে, তাদেরকে আটক করা কিংবা নির্বাসনে পাঠানো বিজেপির পক্ষে সম্ভব ছিল না। এটাই ছিল তড়িঘড়ি করে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) পাশ করানোর তাৎক্ষণিক উদ্দীপনার কারণ। এই সংশোধনীর ফলে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত অ-মুসলিমদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ বলে গণ্য করা হবে না এবং একটি তরান্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়া হবে। সংসদে অমিত শাহ ব্যাখ্যা করে বলেন, দেশজুড়ে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) সংকলনের মাধ্যমে এই নতুন আইন অনুসরণ করা হবে।

উল্লেখ করা জরুরি যে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের বছরগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নাগরিকত্বের jus soli (ভূমিসন্তানের অধিকার) ধারণাকে বরণ করেছিলেন-অর্থাৎ দেশের মাটিতে জন্মের সাপেক্ষে নাগরিকত্ব। ১৯৫০ সালে গৃহীত সংবিধানে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, ভারতে বসবাসরত যেকোন ব্যক্তি যিনি অন্য কোন দেশের নাগরিক নন তিনি ভারতের নাগরিক। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন ভারতে জন্মগ্রহণ করা প্রত্যেক ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব প্রদান করেছিল। তবে ১৯৮০’র পর থেকে এ সংক্রান্ত সাধারণ ঐক্যমত jus sanguinis (রক্তের অধিকার) এর দিকে পরিবর্তিত হতে থাকে-অর্থাৎ পিতামাতার ধর্মীয়, জাতিগত, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে নাগরিকত্বের দাবি শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করে। এরপর ২০০৩ সালের সংশোধনী ঘোষণা করে, ১৯৮৭ সালের পর জন্মগ্রহণকারীরা নাগরিক হতে পারবে কেবলমাত্র যদি পিতামাতার অন্তত একজন ভারতীয় হয়; ২০০৩ এর পর জন্মগ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে হয় পিতামাতা দুজনকেই ভারতীয় হতে হবে অথবা অন্তত একজনকে ভারতীয় হতে হবে এবং সেক্ষেত্রে অন্যজন অবৈধ অভিবাসী হতে পারবেন না। একইসাথে ২০০৩ এর সংশোধনীতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত অন্য দেশের (বলাই বাহুল্য, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বাদে) নাগরিকদেরও ভারতের ‘বিদেশী নাগরিক’ মর্যাদা প্রদান করে; এই বিশেষ নাগরিক মর্যাদা কেবলমাত্র ভারতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার ছাড়া ভারতীয় নাগরিকত্বের অন্যান্য সকল অধিকার নিশ্চিত করে। এটা হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে সম্পদশালী অভিবাসী জনগোষ্ঠীর এক বিপুল স্রোত তৈরি করে।

ছবি: মহাভারতের একটি দৃশ্য
সূত্র: খান একাডেমি

 

সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ

বিজেপি সরকারের এসব পদক্ষেপ ছিল খুল্লামখুল্লা মুসলিমবিরোধী। স্বাধীনতার পূর্বে ঘোষিত ও প্রচারিত [সাংগঠনিক] মতাদর্শিক অবস্থানের সাথে এইসব পদক্ষেপ দারুণভাবে খাপ খাচ্ছিল। বিজেপীর অন্যতম জাতীয়তাবাদী গুরু, বিনায়ক দামোদার সাভারকর, ১৯২৩ সালে লিখিত আকারে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে হিন্দুত্ববাদ (Hindutva) বা হিন্দুত্ব (Hinduness) হিশেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এবং যুক্তি দিয়েছিলেন যে, যারা ভারতকে তাদের পিতৃভূমি ও পূণ্যভূমি বিবেচনা করে, কেবলমাত্র তারাই এই জাতির অন্তর্গত হওয়ার যোগ্য। এই সংজ্ঞায় মুসলমান ও খৃষ্টানদের বাদ দেয়া হয়েছিল, কারণ তারা অন্যস্থানকে তাদের পূণ্যভূমি বিবেচনা করে। ১৯৩৯ সালে বিজেপির আরেকজন মতাদর্শিক গুরু মাধব সদাশিব গোলওয়াকার লেখেন, যারা সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দু নন, তারা হিন্দু জাতি-রাষ্ট্রে থাকতে পারবেন বটে; তবে নাগরিকত্বের অধিকার ছাড়া কেবলমাত্র স্থায়ী বাসিন্দা হিশেবে। দেশভাগের পর হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা প্রায়শই এই তর্ক তুলতেন যে সমস্ত হিন্দুকে পাকিস্তান থেকে ভার‍তে এনে বসতি স্থাপন করতে দেয়া উচিত এবং সমস্ত মুসলমানকে ভার‍ত থেকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা ভারতে মুসলমানদের উপস্থিতিকে দেশভাগের অসমাপ্ত কাজ বলে উল্লেখ করছেন। এমনকি নরেন্দ্র মোদিকে যদিও এহেন খুল্লামখুল্লা মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়, অন্যান্য বিজেপি নেতারা কদাচিৎ মুসলিমবিদ্বেষী ঘৃণা ছড়ানো থেকে বিরত থেকেছেন; যার দরুণ বিজেপির সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দ্বারা মুসলমানরা অসংখ্য খুনে হামলার শিকার হয়েছেন।

ফলে ভারতজুড়ে বসবাসরত মুসলমানদের জন্য ২০১৯ এর ডিসেম্বর পাশ হওয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ছিল বিশেষ উদ্বেগের ব্যাপার। ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের সংজ্ঞায়ন ও অনুমোদন এবং নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) অনুসরণ করে নাগরিকত্ব নির্ধারণ করা হবে এই তথ্য মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় যে এবার তাদেরকে টার্গেট করা হবে। বিশেষত আসামের অভিজ্ঞতা মুসলমানদের আতঙ্ককে আরও প্রবল করে তুলেছিল; যেখানে লক্ষ লক্ষ বাসিন্দাকে ‘অবৈধ শরনার্থী’ ঘোষণা করা হয়েছে কারণ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের মতে তাদের পর্যাপ্ত নথিপত্র নেই। কৌতূহলোদ্দীপকভাবে, আতঙ্ক কেবল মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। উদাহরণস্বরূপ, আসামের সীমান্তরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (এবং পরে বাংলাদেশ হিশেবে স্বাধীনতা লাভ করা) থেকে বহুদশক আগে বহু হিন্দু স্থানান্তরিত হয়েছিলেন এবং ধরে নিয়েছিলেন এতদিনে তারা ভারতীয় নাগরিকত্বে আত্মীকৃত হয়েছেন, তারা আসামের এনআরসি কাণ্ড ও সিএএ আইন পাশের ফলে নতুন করে বিভ্রান্তিতে পড়েন। বিজেপির নেতারা যতই বলুক সিএএ প্রকৃত নাগরিকদের নাগরিকত্ব প্রদানের নিমিত্তে প্রণীত হয়েছে, নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার জন্য নয়; বিভ্রান্তি ও সন্দেহ দূর হয়নি। যদি দেশব্যাপী এনআরসি শুরু করা হয় তার মানে প্রত্যেকের নাগরিকত্বকে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।

২০১৯ এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বিভিন্ন রাজ্যে বিক্ষিপ্তভাবে সিএএ’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। উত্তরভারতে দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি রাজ্য সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর নির্মমভাবে হামলা চালায়। আন্দোলনের ওপর সরকারী নিপীড়নের প্রতিবেদন প্রকাশ করাকে এমন মাত্রায় স্তব্ধ করা হয় যে পুলিশী সহিংসতার প্রকৃত মাত্রা এখনও অব্দি অজানা। অন্তত তিনটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ নির্মমভাবে হামলা চালায় এবং পেটায়। পুলিশী বর্বরতার দৃশ্যাবলী অতিদ্রুত প্রচারিত হয় এবং নগর ও ছোট শহরগুলোতে তড়িৎগতিতে সিএএ-বিরোধী জনমত গড়ে উঠতে শুরু করে।

আর্টিস্ট: অনির্বাণ ঘোষ

জনপরিসরে পরবর্তী দশ সপ্তাহের প্রতিবাদী জনসমাগম নানাদিক থেকে অভিনব ছিল। এই জনসমাগম সংগঠিত ও জনাকীর্ণ হয় এমন সব মানুষের দ্বারা যারা ইতোপূর্বে কখনো রাজনৈতিক মিছিলে অংশ নেয়নি; এদের মধ্যে অনেকেই আবার নিজেদেরকে রাজনীতি সম্পর্কে অনাগ্রহী ও অজ্ঞ হিশেবে দাবি করেন। বিশেষত নানা বয়সের মুসলমান নারীদের উপস্থিতি  ছিল লক্ষণীয় যারা নাগরিকত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে কাগজপত্র দেখানোর ক্ষেত্রে তাদের অস্বীকৃতি ঘোষণা করতে রাজপথ ও বিভিন্ন পার্কে কয়েক সপ্তাহব্যাপী অবস্থান করেন। কিন্ত কেবল তারাই ছিলেন না। নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ তাদের সমর্থন জানান, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম। তরুণরা সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুর অংশ বারবার পাঠ করেছেন যেখানে বলা হয়েছে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ইন্ডিয়ার জনগণ নিজেদেরকে এই সাধারণতন্ত্র (republic) অর্পণ করেছে। এই প্রতিবাদগুলো শান্তিপূর্ণ হওয়ায় এবং বিশেষ কোন রাজনৈতিক দল বা মতাদর্শের সাথে সম্পৃক্ততাহীন মানুষের বিপুল অংশগ্রহণ বিজেপি সরকারকে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে বাধ্য করে।

চমকপ্রদ বিষয় হলো বিরোধীদলসমূহ শুরুর দিকে সিএএ’র ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সূত্রহীন থাকলেও ধীরে ধীরে এই মোটাদাগে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের সমর্থনে যোগ দিতে শুরু করে। কিন্ত পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে তারা একমত হতে পারেনি। আঞ্চলিক দলগুলো দ্বারা গঠিত কতিপয় রাজ্যসরকার ঘোষণা দেয় যে তাদের সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোতে তারা এনআরসি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবে না। কিন্ত এসব দলেরও অন্যান্য নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ ছিল এবং এমন  ইস্যুতে পক্ষপাতদুষ্ট হিশেবে চিহ্নিত হতে চায়নি যেখানে মুসলমানদের এত বিপুল দৃশ্যমান উপস্থিতি ছিল। ২০২০ এর জানুয়ারির দ্বিতীয়ভাগে দিল্লিতে রাজ্যসভা নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা তুঙ্গে ছিল। ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি (এএপি) নির্বাচনে জয়ের অগ্রভাগে ছিল, ফলে এই ইস্যুতে বেশ সতর্কতার সাথে পা ফেলেছে। অন্যদিকে, বিজেপি এএপিকে রাজধানীতে বিশাল সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভের উস্কানিদাতা হিশেবে অভিযুক্ত করেছে। তবে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে এএপি নির্বাচনে জয়লাভ করে।

গোটা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় বিজেপি আন্দোলনকারী এবং তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহী (anti-national) ও শহুরে সশস্ত্রপন্থীদের প্রতি তাদের বিষোদগার উগরে দিয়েছে; যারা কিনা এই আন্দোলন সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখছে বলে অভিযোগ। বিজেপি নেতৃবৃন্দ প্রায়শই বিজেপি সমর্থকদের উদ্দেশ্যে “এইসব জারজদের গুলি” করার নির্দেশ দিয়েছে। নির্বাচনে হারের পর তারা (বিজেপি) দাবি জানাতে শুরু করে যে আন্দোলনকারীদের তাৎক্ষণিকভাবে ছত্রভঙ্গ করে দিতে হবে; অন্যথায়, তারা নিজেরাই সে দায়িত্ব পালন করবে। ২০২০ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি যখন মোদি ও শাহ জুটি গুজরাটে একটি বিশাল র‍্যালি দ্বারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তুষ্ট করছিলেন, দিল্লির মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে হামলা শুরু হয়। প্রথম এক কি দুইদিন, ইটপাটকেল, পাথর ও দেশজ অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত সংঘর্ষ কিছুটা দ্বিপাক্ষিক ছিল। কিন্তু পরবর্তী দিনগুলোতে এটা ছিল সম্পূর্ণতই মুসলমান বিরোধী হত্যা ও লুন্ঠনযজ্ঞ। বাসাবাড়ি, দোকানপাটে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়, মানুষজনকে এলোপাথারি কেটে টুকরা টুকরা করে, পাথর মেরে এবং পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। এই তাণ্ডবলীলা চলাকালীন পুলিশ আক্ষরিক অর্থেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। আনুষ্ঠানিক মৃতের সংখ্যা তিপ্পান্ন, যাদের মধ্যে ছত্রিশজন ছিল মুসলমান।

দিল্লি সহিংসতার মাধ্যমে বিজেপির গৃহীত বিপজ্জনক অভিমুখ অত্যন্ত পরিস্কারভাবে উন্মোচিত হয়। নাগরিকত্ব ইস্যু পুনর্বিবেচনার আহবানকে ন্যূনতম তোয়াক্কা না করে বিজেপি সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ-বিক্ষোভের প্রতি নির্লজ্জ কট্টর অবস্থান জারি রাখে। এমনকি বেশ কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচনী হারের পর, বিজেপি কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কলকব্জাগুলোতে নিজের লাগাম আরও দৃঢ় করতে শুরু করে এবং বিভিন্ন ধরনের মিডিয়ার মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা যজ্ঞ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। মার্চের মধ্যভাগে মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের পতন এবং মুখ্যমন্ত্রী পদে বিজেপির নেতাকে অধিষ্ঠিত করানোর উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসে একাধিক পদত্যাগের ঘটনা ঘটে অমিত শাহের কারসাজিতে। এই ক্যু সংঘটনে নিশ্চই যথেষ্ট সময় ও উদ্যম ব্যয় করতে হয়েছে বিজেপিকে, কারণ এর ফলে কোভিড-১৯ মহামারির ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে বিলম্ব হয়েছে।

কার্টুনিস্ট: মীর সোহেইল
সূত্র: মীর সোহেইলের ফেসবুক পেজ

মহামারির রাজনৈতিক পরিণতি

ইউরোপ থেকে আগত ভ্রমণকারীদের মধ্যে প্রথম কোভিড-১৯ সনাক্তের রিপোর্ট আসে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে। এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের বিভিন্নপ্রান্তে কোভিড লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে, বিশেষত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য ফেরতদের মধ্যে। কিন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মার্চের ২৩ তারিখের আগে টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়ে দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করার ফুরসত পাননি। ঘোষণা পরবর্তী প্রশাসনিক বিভ্রান্তি প্রস্তুতিহীনতার সমস্ত চিহ্ন বহন করেছিল। পরিকল্পনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়েছিল যে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ার মুখে আদতে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে শারীরিক ও অর্থনৈতিকভাবে রক্ষা করাই ছিল উদ্দেশ্য। যেহেতু মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সরকারী কর্মচারী, এমনকি যখন তারা কাজে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তখনও সরকার তাদের আয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। বৃহৎ বেসরকারী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহও তাদের কর্মচারীদের ছাঁটাই না করার মাধ্যমে জাতীয় আবেগ তুষ্ট করার যজ্ঞে সামিল হয়েছে। বেশিরভাগ দাপ্তরিক কাজকর্ম নানাবিধ “ঘরে থেকে কাজ করা”র দিকে সরে আসতে বাধ্য হয়। লকডাউনের অভিঘাত সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভব করেছিল নিজেদের ঘর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের কোন স্থানে অস্থায়ী কাজে নিযুক্ত বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক এবং তথাকথিত অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকেরা, যাদের বেশিরভাগই খুব সামান্য অথবা শূন্য সঞ্চয় সম্বলিত স্ব-কর্মসংস্থানে নিযুক্ত। যেহেতু সরবরাহ চেইন প্রায় পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিল, যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায় ও কৃষিতে জড়িত তাদের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে পর্যবসিত হয়। ঠিক এই সময়েই শীতের ফসল কাটা ও সংগ্রহের অপেক্ষায় ছিল, ফলে গ্রামাঞ্চলে আতঙ্ক বিরাজ করছিল কারণ ফসল কাটার পর্যাপ্ত মজুর পাওয়া যাচ্ছিল না। তাছাড়া শস্যাদি বাজারজাত করা যাবে কিনা এমন কোন নিশ্চয়তাও ছিল না।

পুঁজিতান্ত্রিক পুঞ্জীভবনের সাধারণ সূত্র মেনে গড়ে ওঠা আনুষ্ঠানিক অর্থনীতি এবং মূলত বাজার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে জীবিকা নির্ভর যেই অর্থনীতি গড়ে উঠে, ভারতে তাদের মধ্যে বহুকাল ধরেই একটি বড়সড় ফাটল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরেরটি যদিও বাস্তবিক অর্থে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রথাগত অর্থনীতি নয়, বরং মার্ক্স যাকে বলেছেন পুঁজির আদিতম পুঞ্জীভবন এটি হচ্ছে তারই সৃষ্টি। অনানুষ্ঠানিক খাতের লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্পোরেট পুঁজির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির আওতাভুক্ত হতে হবে তেমন কোনো কথা নেই, বরং বেশ ক্ষীণ একটা যোগাযোগ থাকে কেবল দুইয়ের মধ্যে। তারা টিকে থাকে সংগঠিত নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশ নেয়ার মাধ্যমে, সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সস্তা খাবার ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপাতির মাধ্যমে নিজেদের জীবিকার কিছুটা নিরাপত্তা বিধান তারা করতে পারে। সরকারও তাদেরকে শ্রম আইন, দূষণ, জনস্বাস্থ্য ও কর সংক্রান্ত বিধিমালার ক্ষেত্রেও কিছু কিছু ছাড় দেয়। ভারতের নির্বাচনী রাজনীতির চরিত্র নির্ধারণ করে যে প্রতিযোগিতামূলক লোকরঞ্জনবাদ (populism), তা-ই এই বিপুল জনসংখ্যাকে টিকিয়ে রাখে।

স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় নয়াদিল্লিস্থ সরকারের নজিরবিহীন ও ব্যতিক্রমী চরিত্র এর জনতুষ্টিবাদী মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। হাজার হাজার কর্মহীন গৃহহীন পরিযায়ী শ্রমিক হাজার হাজার মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কেউ জানে না পথিমধ্যে ঠিক কতজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। একইসময় ইউরোপ ও চীনে আটকা পড়া শিক্ষার্থী ও ট্যুরিস্টদের ফিরিয়ে আনতে বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মাঝেমাঝে টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়ে মানুষজনকে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিবাদন জানানোর আহবান জানিয়েছেন। কখনওবা ঘরের আলো নিভিয়ে মোমবাতি, প্রদীপ অথবা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে করোনা দানবকে তাড়াতে বলেছেন। যাদের বাসায় ব্যালকনি আছে, অর্থাৎ শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী, বিপুল উদ্দীপনাসহ নেতার নির্দেশনা অনুসরণ করেছেন।

Kashmir story Mir Suhail
কার্টুনিস্ট: মীর সোহেইল সূত্র: আল-জাজিরা

সত্যি বলতে গেলে, কোভিড-১৯ মহামারি এতটাই অভূতপূর্ব যে বিশ্বের বিভিন্ন সরকার এর মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রমাদ গুনছে। ইন্ডিয়ার জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে আসন্ন অনিবার্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। সমস্ত রকমের রাজনীতি স্থগিত করা হয়েছে কারণ মোদি নতুন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আদেশ জারির একটা কেন্দ্রীয় কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা চলমান যা প্রত্যেক রাজ্য, প্রত্যেক জেলা ও প্রত্যেক এলাকায় এই ‘যুদ্ধ’ পরিচালনা করবে। যেমনটা এক জন-আদেশে [পরবর্তিতে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়] উত্তরপ্রদেশের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, “এটা আপনার বিচার-বিবেচনা কিংবা বুদ্ধিমত্তা চর্চার সময় নয়। এটা আদেশ অনুসরণের সময়।” সরকারের চাকায় এমনভাবে প্রলেপ লাগানো হয়েছে কিংবা এমনভাবে বাঁধা হয়েছে যেন এ এক জরুরি অবস্থা যেখানে স্বাভাবিক আইন-কানুন স্থগিত।

কিন্তু স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনার দাবি এবং অনিবার্য অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রকট পূর্বাভাসের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার সরকারি প্রচেষ্টার মধ্যে টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের দৃশ্যমান মরিয়াভাব কর্তৃপক্ষকে তাদের জন্য বাড়ি ফেরার ট্রেনের বন্দোবস্ত করতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু ইতোমধ্যেই, কিছু সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণে আসা মহামারি আবার জ্যামিতিক হারে ছড়াতে শুরু করেছিল। রাজ্য সরকারসমূহ, যারা কিনা মানুষের জীবনের প্রাথমিক জিম্মাদার, আকস্মিকভাবে রাজ্য সীমান্তে টহল ও পুলিশী ব্যবস্থা জোরদার করতে শুরু করে এবং নিজেদের জনসংখ্যার প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে থাকে। তবুও কেন্দ্রীয় সরকারই মূলত সমস্তকিছুর মুখ্য নিয়ন্ত্রক। মোদি সরকার একদিকে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করেছে, অন্যদিকে রাজ্য সরকারগুলোর কাছে জনগণের ক্ষোভ ও অভিযোগ সামাল দেয়ার দায়িত্ব ঠেলে দিয়েছে। স্বাভাবিক রাজনীতির অনুপস্থিতিতে, জরুরি অবস্থার আনুষ্ঠানিকীকরণ প্রক্রিয়া চলমান। অতিশীঘ্রই নির্বাচনী গণতন্ত্রের সাজসজ্জা/অলঙ্কারাদি ব্যতিরেকেই হিন্দু জাতি-রাষ্ট্র প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘটতে পারে।

 

সারোয়ার তুষার