অরাজ
আর্লি ফিগার্স শিল্পী: অভিনাশ চন্দ্র সূত্র: ফ্রিজি
প্রচ্ছদ » আশিল এমবেম্বের প্ল্যানেটারি ও বিউপনিবেশায়ন ভাবনা

আশিল এমবেম্বের প্ল্যানেটারি ও বিউপনিবেশায়ন ভাবনা

  • অনুবাদ: সারোয়ার তুষার

অনুবাদ সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত জরুরি তথ্য: ক্যামেরুনীয় দার্শনিক আশিল এমবেম্বে (Achille Mbembe) হাল-জমানার অন্যতম প্রভাবশালী তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিজীবী হিশেবে বিশ্বব্যাপী বিপুল পরিমাণে সমাদৃত হন। জৈব-রাজনীতি (biopolitics) প্যারাডাইমের সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে ‘মারণ-রাজনীতি’ (necro-politics) ধারণা হাজির করার মাধ্যমে বৈশ্বিক ক্রিটিক্যাল চিন্তার পরিসরে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বেরও তিনি একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। নরওয়ের বার্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলবার্গ প্রাইজ সেক্রেটারিয়েট কর্তৃক আয়োজিত হলবার্গ বিতর্কে প্রধান বক্তা হিশেবে ২০১৮ সালের পয়লা ডিসেম্বর এমবেম্বে বক্তৃতা করেন। তার একদিন আগে ৩০ নভেম্বর নরওয়ের Klassekampen পত্রিকায় এমবেম্বের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। বর্তমান অনুবাদটি সেই সাক্ষাৎকারটির ইংরেজি-রূপের বাংলা তর্জমা। সাক্ষাৎকারের ইংরেজি-রূপটি প্রথম প্রকাশিত হয় New Frame নামক অনলাইন জার্নালে: Thoughts on the planetary: An interview with Achille Mbembe এই শিরোনামে। আশিল এমবেম্বের এই জরুরি সাক্ষাৎকারটির হদিশ পাই বোধিচিত্তের মাধ্যমে। অনুবাদ সংক্রান্ত নানা পরামর্শ দিয়েছেন সহুল আহমদ ও তানভীর আকন্দ। তাঁদের প্রতি আমার ঋণ ক্রমবর্ধমান। অনুবাদ সংক্রান্ত নানা পরামর্শ দিয়েছেন সহুল আহমদ ও তানভীর আকন্দ। তাঁদের প্রতি আমার ঋণ ক্রমবর্ধমান।

-সারোয়ার তুষার
১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ঢাকা।

[বিউপনিবেশায়ন প্রকল্পের বৈশ্বিক তাৎপর্যের প্রতি জোরারোপ করে; জীবনের মেরামত ও যত্নের অভিপ্রায়ে আশিল এমবেম্বে অংশীদারি মানবীয় অনুষদ হিশেবে যুক্তির পুনর্গঠনের আহ্বান জানান।]

নীলসেন: ২০১৫ সালের এপ্রিলে, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে রোডসের (Rhodes) এর মূর্তি ভূপাতিত করা হয়েছিল। কীভাবে আপনি এই ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করবেন?

আশিল এমবেম্বে: আমরা কার সম্পর্কে কথা বলছি সে সম্পর্কে যারা অবগত নন তাদের জন্য বলে রাখছি: সিসিল জন রোডস (Cecil John Rhodes) ছিলেন একজন শত্রু-জাহাজ লুন্ঠনকারী বেসরকারি ব্যক্তি। তিনি আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে উনিশ শতকে বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশবাদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত বণিক সম্প্রসারণবাদের নির্মম নাটের গুরুদের একজন ছিলেন। রাজনৈতিক লিয়াজোঁ, নিষ্ঠুর বর্বরতা এবং জোচ্চুরিপনার মাধ্যমে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার খনিজ সম্পদ ; বিশেষত কিম্বারলের হীরা এবং উইটওয়টারস্র্যান্ডের স্বর্ণের এক বিশাল অংশ নিজের দখলে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কেপটাউনে দখলকৃত জমির কিছু অংশ বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন, যার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের অন্যতম একটি মূল ভবনের সামনের সিঁড়ির ধাপে রোডসের সম্মানে একটি মূর্তি নির্মাণ করেছিল।

অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদের নিষ্কাশন এবং বেসরকারিকরণের মানব-ইতিহাসে অভূতপূর্ব যে নজির আজকের দিনের নয়া-উদারতাবাদ (Neoliberalism) তৈরি করেছে, রোডস ছিলেন তার পূর্বসূরি। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে যে ধরনের লুন্ঠনজীবী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং ধনতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিরাজমান, তিনি সেটারও পূর্বসূরি ছিলেন। এই ধরনের [লুন্ঠনমূলক ও ধনতান্ত্রিক] রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিণতি স্বরূপই জীবমণ্ডলের বলাৎকার এবং এই গ্রহের সার্বিক জীবনের টিকে থাকার প্রাথমিক শর্তের ব্যাপক মাত্রায় ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়েছে। ফলে, রোডসের মূর্তির পতনকে আমি সর্বজনীন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের পথে একটি ছোট ও প্রতীকী বিজয় হিশেবে বিবেচনা করি।

নীলসেন: তার মানে আমরা দেখতে পাচ্ছি রোডস থেকে বর্তমানের নব্য-উদারতাবাদী ব্যবস্থার একটা যোগসূত্র আছে?

আশিল এমবেম্বে: শেতাঙ্গ বসতি স্থাপন প্রকল্পে কালোদের দাসত্ব, ঔপনিবেশিক লুন্ঠন এবং বর্তমান সময়ের সম্পদ আহরণ ও আত্মসাতের বিভিন্ন বন্দোবস্তের মধ্যে পরিস্কার সম্পর্ক রয়েছে। এই প্রতিটি উদাহরণের একেবারে গঠনগত প্রবণতাই হচ্ছে এই সত্যের অস্বীকৃতি যে: আমরা, মনুষ্যপ্রজাতি জীবজগতের সাথে সম্পর্কিত, এর উপর নির্ভরশীল, এর সাথে এবং এর মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হয়ে একে অপরের প্রতি ঋণী এবং দেখভাল করার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধ।

তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য যা এই সময়ের গণনামূলক পুঁজিবাদের [computational capitalism] উত্থানের দিকে আমাদেরকে ধাবিত করেছে তা হচ্ছে প্রযুক্তিগত উল্লম্ফন। আমরা আর যন্ত্রের যুগে নেই, বরং অ্যালগরিদমের যুগে প্রবেশ করেছি। প্রযুক্তির এই ক্রমবর্ধমান গতি আমাদেরকে বস্তুতে পরিণত করার হুমকি সমেত হাজির, – যাকে আমি অন্যত্র বলেছি “তামাম জাহানের কালো বনে যাওয়া” (the becoming-black-of-the world) এবং দীর্ঘকাল ধরে যে পেশীশক্তি নির্ভর পুঁজিবাদের ওপর আমরা নির্ভরশীল ছিলাম তা অনাবশ্যক হয়ে পড়ছে।

অর্থাৎ, বর্তমানকালে মূল লক্ষ্যটি যদিও এখনো মানবদেহ এবং পার্থিব পদার্থ ; তারপরেও আধিপত্য এবং শোষণ ক্রমবর্ধমান বিমূর্ত ও জালিক হয়ে উঠছে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা, আবেগ, স্বপ্ন, ভয় ও কল্পনার আধার আমাদের মন এবং মনস্তাত্ত্বিক জীবন; এই মন ও মনস্তাত্ত্বিক জীবন হয়ে উঠছে মূল কাঁচামাল যাকে ডিজিটাল পুঁজিবাদ দখল ও পণ্যে পরিণত করতে চায়।

রোডসের সময়কালে, কালো শ্রমের শোষণ এক বর্ণবাদী রূপের সাথে মিলেমিশে গিয়েছিল। হালের পুঁজিবাদ এখনও বর্ণবাদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বর্ণবাদী আচরণের প্রয়োগবিধি আরও বেশি প্রতারণামূলক এবং আরও বেশি বেষ্টিত হয়ে উঠেছে। যেহেতু গোটা দুনিয়া এক বিশাল ডেটা-বাজারে পরিণত হয়েছে, আগামীদিনের বর্ণবাদের প্রযুক্তিগুলো ডেটা, গণনা এবং পরিসংখ্যানের মাধ্যমে আরও বেশি উৎপন্ন এবং প্রতিষ্ঠিত হবে। সংক্ষেপে, বর্ণবাদ ত্বকের উপরিতল এবং নিম্নদেশ উভয় স্থানেই জায়গা করে নিচ্ছে। এটি বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিন এবং আয়নার মাধ্যমে নিজেকে পুনরুৎপাদন করছে। এটি ভূতুড়ে এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উভয়ই হয়ে উঠছে।

অন্যথায়, রোডস এর মূর্তির পতন প্রসঙ্গে বরাবরই আমার যুক্তি এটাই ছিল যে: প্রথমত ওই মূর্তিটা ওখানে স্থাপন করাই উচিত ছিল না।

নীলসেন: প্রতীক হিশেবে?

আশিল এমবেম্বে: হ্যাঁ, দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো মানুষদের মানব-ভবিষ্যতের অধিকার অস্বীকার করার প্রক্রিয়ায় এই নিষ্ঠুর মানুষটি যে নানাবিধ অপরাধ করেছিলেন তার নজির হিশেবে। নিজের অবৈধ সম্পদকে কালিমামুক্ত করতে মানবদরদী সাজার যে ভান তিনি করেছিলেন, সেই ভানের স্মারক হিশেবেও। তবে রোডসীয় ঘরানার লুন্ঠনপরায়ণ অর্থনীতি ও পুঁজিতান্ত্রিক রাজনীতির যথার্থ সমালোচনা কেবল দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা কোন নির্দিষ্ট জাতি-রাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। তিনি যে প্রকল্পের সেবাদাস ছিলেন, তা ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী। এর দিগন্ত কেবল দক্ষিণ আফ্রিকা-কেন্দ্রিক ছিল না। আসলে বর্ণবাদী, ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী-রূপে পুঁজিবাদ মানবজাতি ও জীবমণ্ডলে যে দ্বৈতক্ষতি সাধন করছে, রোডস তারই প্রতীক। জাতীয়তাবাদী শ্রেষ্ঠত্ববাদের চোরাবালি এড়াতে বদ্ধপরিকর রোডস এর যে-কোন সমালোচনার শুরু এভাবেই হওয়া উচিত।

রোডসের মূর্তির পতন; মূল ছবি: গার্ডিয়ান

নীলসেন: বার্জেন বিশ্ববিদ্যালয়ে হলবার্গ বিতর্কে আগামীকাল আপনি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের সামাজিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করবেন। বর্তমান সময়ের সামাজিক আন্দোলনের সাথে আপনি অতীতের বিভিন্ন আন্দোলন, যেমন ধরা যাক,  ১৯৬০ এর শেষের দিকের ছাত্র-আন্দোলনের তুলনা কীভাবে করবেন?

আশিল এমবেম্বে: দুটো ভিন্ন ভিন্ন ঘটনা। দুটি ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় এই দুটি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আমি এমনকি এ-ও নিশ্চিত না বর্তমান সময়ের আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালনকারীদের ১৯৬৮ সালে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে কোন ধারণা কিংবা স্মৃতি আছে কিনা।

আমি যদি ঠিক বুঝে থাকি তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার বিউপনিবেশায়ন আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য পুনরাবৃত্তির কাঠামো হিশেবে বিবেচিত সেই বর্ণবাদী ব্যবস্থাকে উন্মোচন করা যা নিজের পতন ঠেকানোর লক্ষ্যে নতুনের আগমন রোধ করতে চায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে, “সাদাগিরি” (whiteness) গুড়িয়ে ফেলার মানে হচ্ছে আত্মগত জ্ঞানের জাগরণ এবং নিষ্ঠুর অতীতসূত্রে প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানাদিকে নতুন করে ঢেলে সাজানো। এই বিবেচনায় বিউপনিবেশায়ন প্রকল্প জ্ঞান ও প্রতিষ্ঠান উভয়েরই পর্যালোচনা।

এই দৃষ্টান্তের ক্ষেত্রে আসল প্রশ্নটি হলো এই যে, পর্যালোচনা কিংবা মূল্যায়নকে রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিকভাবে বাধ্যতামূলক আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। সমসাময়িক আন্দোলনগুলো এমন এক সময়ে পরিচালিত হতে যাচ্ছে যখন মানব অভিজ্ঞতা বিপুলভাবে পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছে। কেবলমাত্র অর্থনীতিই নতুন জীবনসংগ্রামের কেন্দ্রে নেই। মানুষ ও জিনিসপত্র, প্রকৃতি ও বস্তু সবই ক্রীড়ানকে রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।

এই পরিবর্তনগুলোর অধিকাংশই অংশত সম্ভব হয়েছে সর্বব্যাপী কম্পিউটিং প্রযুক্তির বৃদ্ধির মাধ্যমে। এই “মহান রূপান্তর” এর একটি অন্যতম প্রধান পরিণতি হলো এই যে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মানুষ আর ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকের মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা। স্বাতন্ত্র‍্যবোধের পদ্ধতি এক নয়। এমনকি এক নয় বশে রাখার রূপ বা এর বিষয়বস্তু। মানুষ এবং এই যুগের প্রযুক্তির জটিল রসায়ন প্রত্যক্ষ জ্ঞান ব্যবস্থাপনাকে গভীরভাবে রূপান্তরিত করেছে: মানুষ কীভাবে স্বপ্ন দেখে, কি ধরনের পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে সবকিছুই। সংক্ষেপে বলতে গেলে “রাজনৈতিক” ধারণাটিই নতুন আকৃতি ও অভিজ্ঞতা লাভ করছে। বর্তমান সময়ের আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক আনুগত্য গঠনে মিডিয়া প্রযুক্তির প্রভাব আমলে নিতে হবে।

এক্ষেত্রে লক্ষণীয় ব্যাপারটি হলো যুক্তি থেকে অভিজ্ঞতায় রাজনীতির বাঁকবদল। অনেকের মতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই এখন এই বিশ্বে অস্তিত্বশীল থাকার নতুন উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যেন ফেনাবিহীন এক বুদবুদ।অভিজ্ঞতা আজকাল যুক্তিকে টেক্কা দিচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস করতে হচ্ছে যে আবেগ, অনুভূতি, সংবেদনশীলতা হলো অস্তিত্বের আসল উপাদান এবং এগুলোই মূলত বৈপ্লবিক এজেন্সি। আমাদের যুগের এই বিকারগ্রস্ততার সাথে নব্য-উদারতাবাদী ব্যক্তিসর্বস্বতা অদ্ভুতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি প্রযুক্তি, যুক্তি এবং অন্যান্য মানবিক অনুষদের মধ্যে সম্পর্কের চলমান পুনর্গঠনের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

যাই হোক না কেন, এটি সামস্টিক সক্রিয়তার নানা রূপকে বেশ অস্পষ্ট করে তুলেছে, যার বেশিরভাগের ব্যাপারে আমাদের ‌রোমান্টিকতা পরিহার করা উচিত। বিপ্লবীপনার মুখোশের আড়ালে বিউপনিবেশায়নের রাজনৈতিক কথকতায় বেশ কিছু মৌলক দ্যর্থবোধকতা নিহিত আছে বিশেষত “অপরের প্রতি অবজ্ঞা/ঘৃণা”র প্রশ্নে নির্বিকার থাকা কিংবা বর্ণবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণকে নিয়ন্ত্রণ বা সীমাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে। নিম্নবর্গের প্রতিরোধের রাজনীতি যখন সীমাহীন বিশুদ্ধতা এবং স্ব-আরোপিত সঠিকতার পাঁকচক্রে আটকে যায় কিংবা কে কার চেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার তা বলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে, তখন তা এই রাজনীতিকে মৌলিকভাবে দুর্বল করে।

হুবুহু একই বিকার লক্ষ্য করা যায় পাঠ্যসূচি সংস্কার সম্পর্কিত বেশিরভাগ বিতর্কে। কী পড়তে হবে বা হবে না , কীভাবে পড়তে হবে বা হবে না; সংক্ষেপে, কীভাবে আর্কাইভ পুনরায় আকৃতি দিতে হবে বা পুনরায় ডিজাইন করতে হবে সে সম্পর্কিত তর্ক-বিতর্ক। যদিও সাম্য এবং ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতিতে এসব লড়াই চলে বা চলছে, তবুও এই সংঘবদ্ধতার ফলে দেয়াল তোলার সাম্প্রদায়িক যুক্তি পুনরায় প্রকাশিত হতে পারে ; কারণ এইসকল সক্রিয়তাও পরিচয়, লিঙ্গ বা সংস্কৃতির ত্রুটিযুক্ত ধারণাকেই সুরক্ষা এবং প্রতিরোধের যুক্তি হিশেবেই চিহ্নিত করেছে। “যারা আমাদের মতো বিপ্লবী নয়” তাদের আটকানোর বাসনা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে সীমানা-প্রাচীর ভূমিকা রাখে।

অবশেষে, এই সমাবেশগুলোর বেশ কয়েকটি “আত্ম” এবং অভিজ্ঞতার ধারণাকে অগ্রাধিকার দেয়। আত্ম এবং অভিজ্ঞতা – বা র‍্যাডিকাল এজেন্সি – দৈনন্দিন জীবনের অন্তরঙ্গ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিসরে এদের বিচরণ ও ভূমিকাকে অবশ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার অধীন করতে হবে। প্রায়শই ধরে নেয়া হয় যে আমাদের সত্তার অন্দরমহল, মেজাজ-মর্জি এবং আমাদের মনের অবস্থা বর্ণবাদ এবং নব্য-উদারতাবাদী উন্মাদনা থেকে মুক্ত  “নিরাপদ পরিসর”। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান ব্যবস্থায় এমন কোন পরিসর নেই যা দূষণমুক্ত।

এই রাজনৈতিকতাকে আবেগীয় নিরাপদ পরিসর এবং শরিকানা পরিমণ্ডলের কষ্টসাধ্য ব্যবস্থাপনাতে নামিয়ে আনা যাবে না। বিপ্লবী প্রতিনিধিত্বের অর্থ সীমান্ত ভাগাভাগি নয়। এর অর্থ কাঁটাতারহীনতা। এটা কোনভাবেই সত্য নয় যে হুবুহু অন্য কারোর অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করার আগ পর্যন্ত আমি তার/তাদের যন্ত্রণা বুঝতে অক্ষম কিংবা আমার চুপ থাকা উচিত। মানুষ হওয়ার অর্থ নিজেকে সর্বদা অন্য কেউ হয়ে ওঠার সম্ভাবনার সম্মুখে যতটা পারা যায় অবমুক্ত রাখা; সত্তা ও পরিচয় সংক্রান্ত এই ধারণা মনুষ্যবিরোধী [এন্টি-হিউম্যান]। আমাদের সময়ের “রাজনৈতিক” ধারণা অবশ্যই বিশ্বকে পুনর্গঠন করার আবশ্যকতা থেকে শুরু করতে হবে। গ্রহীয়* (Planetary) পর্যায় থেকে বিবেচনা করলে “বিউপনিবেশায়ন” এর ধারণা কোনভাবেই “আমি আমার প্রতিবেশীর তুলনায় খাঁটি” এই বিন্দু থেকে শুরু হতে পারে না।

আর্ট: ফিরেলে বায়েজ
সূত্র: কন্টেম্পরারি এন্ড আমেরিকা লাতিনা

নীলসেন: আপনি “গ্রহীয় পর্যায়” প্রপঞ্চটি ব্যবহার করায় ধরে নিচ্ছি যে আপনি বৈশ্বিক পর্যায়েও বিউপনিবেশায়ন আন্দোলনকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন?

আশিল এমবেম্বে: আমি যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছি যে বিউপনিবেশায়ন বিশ্বব্যাপী সত্যিকার অর্থেই রাজনৈতিক, তাত্ত্বিক বা নান্দনিক শক্তি হয়ে ওঠার জন্য, বেশ কয়েকটি শর্ত পূরণ এবং বেশ কিছু কাজ সেরে ফেলতে হবে। আপাতত, এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি ন্যায্য আকাঙ্ক্ষা এবং কিছুটা দুর্ভাগ্যজনকভাবে, একটি ক্ষতিপূরণমূলক প্রপঞ্চ। বিউপনিবেশায়ন বলতে কখনই কোনও অহংবোধ বা কিছু মনোনিত স্ব-প্রতিচ্ছবির প্রত্যাবর্তন বোঝায়নি যা কিনা অনড় পরিচয়, নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং নিষ্কৃতি বাগিয়ে নেয়া তথা শেষতক একটি যুদ্ধংদেহী সত্তার প্রতিরোধ বর্ম হয়ে উঠবে। নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যাকুল অনুসন্ধান এবং ঝুঁকির ভয় এমনভাবে রীতিমতো যুগধর্ম হয়ে উঠেছে যে, যেমন ধরা যাক, ফ্রাঞ্জ ফাননের বিউপনিবেশায়ন পরিভাষা-ক্রমাগত যাচাই বাছাই করা কিংবা এমনকি অগ্নি-পরীক্ষার মুখোমুখির হওয়া-র সাথে এর কোন মিল নেই।

তাছাড়া, উপনিবেশায়নের সম্প্রসারণের সাথে “এই পৃথিবীটি কার?” এই প্রশ্নটি বরাবরই সম্পর্কিত। পনেরো শতক থেকে ঔপনিবেশিক  বিজয় এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের এটাই ছিল মূল প্রশ্ন। উনিশ শতকে আফ্রিকাকে বিভক্ত করার সাথে সাথে ইউরোপীয় শক্তিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে এই ভূগোল এটির সমগ্রতাসহই তাদের করতলগত। তারাই এর প্রকৃত মালিক এবং বিদেশী লোকেদের জমি তারা দখল করতে পারে। তারা চাইলে এই জমিগুলো এবং জমিতে চিরকাল ধরে বসবাসকারী মানুষদের যথেচ্ছ শোষণ করতে পারে, যার ফলে তাদের প্রত্যেকের যেখানে নিয়ন্ত্রণ ছিল সেখানে প্রভাবের পরিসর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

অনেকাংশে, ঔপনিবেশিক আগ্রাসন ছিল  একটি গ্রহীয় (Planetary) প্রকল্প। যদিও এই প্রকল্প জাতিরাষ্ট্র এবং জাতীয় বাণিজ্যিক সংস্থাসমূহ দ্বারা বিরাট অংশে চালিত হয়েছে, তথাপি এটি সর্বাধিক সামরিক শক্তি এবং বৃহত্তম প্রযুক্তিগত সুবিধার অধিকারীদের দ্বারা পৃথিবীর সম্পদ পুনর্বণ্টন এবং বেসরকারীকরণের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এ কারণেই সবচেয়ে ঐতিহাসিক অর্থে, বিউপনিবেশায়ন সংজ্ঞাগত দিক থেকেই একটি গ্রহীয় প্রকল্প; এই বিশ্বের বিপ্লবী অবমুক্তি এবং বিচ্ছিন্ন পৃথক একঘরের বিপরীত অবস্থানে গিয়ে গভীরভাবে শ্বাস নিতে পারা।

নীলসেন: আর অপরের প্রতি অবিশ্বাস?

আশিল এমবেম্বে: এবং অপরের প্রতি অবিশ্বাস, অবশ্যই! এবং বর্ণবাদ। কারণ বর্ণবাদ উপনিবেশবাদের একেবারে ডিএনএতে প্রোথিত। এমন কোনও উপনিবেশবাদ নেই যার সাথে কাঠামোগত বর্ণবাদ বিশাল মাত্রায় জড়িয়ে নেই। এবং এমন কোনও উপনিবেশবাদ নেই যা, ধরা যাক, কোন না কোন রূপের জেনোসাইডাল ঝোঁক দ্বারা তাড়িত নয়। এই জেনোসাইডাল সম্ভাবনাটি বাস্তবায়িত হতে পারে বা না-ও হতে পারে। তবে এই সম্ভাবনা সর্বদাই থাকে। এই সম্ভাবনা থাকেই, হান্না আরেন্ট যেমনটি তার জাতি ও আমলাতন্ত্র নিয়ে কাজে দেখিয়েছেন। এই জেনোসাইডাল সম্ভাবনা অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকাতে কাজে লাগানো হয়েছিল। এটি নামিবিয়ায় জার্মানরা কাজে লাগিয়েছিল। সুতরাং এটি সর্বদা আছে। কারণ বর্ণবাদ আছে মানেই এই জেনোসাইডাল সম্ভাবনা বিরাজমান আছে। বর্ণবাদ থাকার অর্থ হচ্ছে দুনিয়াতে অস্তিত্বশীল থাকা এবং অন্যের বিরুদ্ধে থাকা একই কথা। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়োক্তদের এমন কারোর জন্য হুমকি হিশেবে বিবেচনা করা হয় যাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে যে কোন মূল্যে…

নীলসেন: সেক্ষেত্রে কেউ কেউ তর্ক তুলতে পারে যে, নব্য-উদারনৈতিক প্রকল্পে এখনও ঔপনিবেশিক কিংবা উত্তর-ঔপনিবেশিক কাঠামো বিদ্যমান আছে। আপনি কি তাহলে বলবেন যে এখনও জেনোসাইডাল সম্ভাবনা বিরাজমান?

আশিল এমবেম্বে: সম্ভবত অতীতের অন্য যে কোনও মুহূর্তের চেয়ে আমরা ক্রমাগত এই প্রশ্নের বেশি মুখোমুখি হচ্ছি যে যাদের অস্তিত্ব আমাদের পুনরুৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে না তাদের নিয়ে আমরা কী করব; বিশেষত যাদের নিছক অস্তিত্ব বা সান্নিধ্য আমাদের নিজেদের জীবনের জন্য কোনও শারীরিক বা জৈবিক হুমকির প্রতিনিধিত্ব করছে বলে ধারণা করা হয়।

ইতিহাসজুড়ে অযাচিত, অবৈধ, খরচযোগ্য বা অনাবশ্যক হিশেবে প্রতীয়মান মানব-শরীরের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত চিন্তা শাসনের নানা বাঁকবাদল তথা রূপান্তরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। এরমধ্যে একটি ঐতিহাসিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে স্থানিক বর্জনমূলক ব্যবস্থা বলবৎ রাখা। উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক বসতিস্থাপনকারী এবং জেনোসাইডাল উপনিবেশ কায়েম করার প্রাথমিক পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নেটিভ আমেরিকানদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, দ্বীপ কারাগার, অস্ট্রেলিয়ায় শাস্তিমূলক উপনিবেশ, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাম্প এবং এমনকি বান্টুস্টান (কালোদের জন্য বাধ্যতামূলক পৃথক বর্ণবাদী ব্যবস্থা)।

দুটি পরিণত আধুনিক (late modern) উদাহরণ হলো গাজা এবং গতিশীলতার বিরুদ্ধে চলমান বৈশ্বিক যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে অভিবাসী শিশুদেরকে খাঁচায় বন্দী করা। গাজা এবং অভিবাসী শিশুদের খাঁচায় বন্দী করার নজির হয়তো অনাগত নিষ্ঠুরতার আগাম লক্ষণ।

গাজার ক্ষেত্রে, দুর্বল, অবাঞ্ছিত, উদ্বৃত্ত বা বর্ণবাদের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ সমন্বিত কৌশলের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়, যার মধ্যে প্রধানত পরিকল্পিত অবরোধ বা অণু শ্বাসরোধের কৌশল প্রধান। কারা এবং কী কী জিনিস ঘেরাটোপে এ ঢুকতে বা বেরুতে পারবে অবরোধ তা নিয়ন্ত্রণ, নিষিদ্ধ এবং বাধা দিতে পারে। এই নিয়ন্ত্রণ বা বিধি-নিষেধের লক্ষ্য সবক্ষেত্রে সরবরাহ লাইন, অবকাঠামোগত গ্রিড বা বাণিজ্য রুটসমূহ থেকে ঘেরাটোপকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা নয়। তবুও ঘেরাটোপটি তুলনামূলকভাবে বদ্ধ এবং এমনভাবে শ্বাসরোধ করা হয়েছে যাতে কার্যত এটি একটি কারা-অঞ্চলে পরিণত হয়। ব্যাপক কিংবা আপেক্ষিক অবরোধের সাথে সামরিকায়নের পর্যায়ক্রমিক তীব্রতাবৃদ্ধি এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। স্থানিক সহিংসতা, মানবিক কৌশল এবং শাস্তির অদ্ভুত জৈবরাজনীতি এই সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক কারা-অঞ্চল তৈরি করা হয়েছে ; যেখানে উদ্বৃত্ত, অযাচিত বা অবৈধ বলে বিবেচিত মানুষদের জীবন এবং কল্যাণের প্রতি কোন প্রকার দায়বদ্ধতা বর্জিত এক শাসনপ্রণালী বিদ্যমান।

তবে আমি যেমনটি অবহিত করেছি, একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আরও একটি উদাহরণ রয়েছে, যা নতুন ধরনের যুদ্ধের নজির হিশেবে হাজির, যাকে গতি এবং চলাচলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলা যেতে পারে। চলাচলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আসলে এমন যুদ্ধ যার লক্ষ্য হলো খরচযোগ্য দেহকে সীমান্তের দিকে ফেরানো। পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের অস্তিত্ব ও বেঁচে থাকার উপায়কে ধুলো ও ধ্বংসাবশেষের স্তূপে পরিণত করার মাধ্যমে এগুলো শুরু হয়, ফলে এই ঝুঁকিপূর্ণ মানুষগুলো আশ্রয়ের সন্ধানে পালাতে বাধ্য হয়। সামাজিক প্রতিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ধরনের বিষাক্ত এবং বসবাসের অনুপযোগী যুদ্ধ দৈবাৎ ঘটনা নয়। এই কর্মসূচিগুলো পদ্ধতিগতভাবে পরিকল্পিত এবং পরিচালিত হয়। এই ধরনের প্রতিবেশ এবং বাস্তুতন্ত্র নতুন মারণাস্ত্রের পরীক্ষাক্ষেত্র। এই ধরনের যুদ্ধের লক্ষ্য কোনভাবেই আর একক বা পৃথক পৃথক শরীর নয়, বরং মূল্যহীন এবং অতিরিক্ত হিশেবে সাব্যস্ত হওয়া মানবগোষ্ঠী এই যুদ্ধের লক্ষ্য।

আর্ট: পাবলো পিকাসো

নীলসেন: আপনি এ ব্যাপারে আরেকটু বিশদ ব্যাখ্যা করবেন কি?

আশিল এমবেম্বে: তাহলে আরেকটু অন্যভাবে বলা যাক। আজকাল এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে যতবেশি সংখ্যক সম্ভব মানুষকে ‘অতিরিক্ত’ পরিণত করা। এক্ষেত্রে পিলে চমকানো ব্যাপার হচ্ছে অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ব্যাপক মাত্রায় বাতিলযোগ্য দেহ হিশেবে উৎপাদন করা। নতুন জলবায়ু [ক্লাইমেটিক] ব্যবস্থায় প্রবেশের সাথে সাথে এই প্রক্রিয়া আরো ঘনীভূত হবে। যেহেতু এই গ্রহে জীবনের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের বৈশ্বিক শর্ত পরিবর্তিত হচ্ছে, গ্রহীয় পর্যায়ে জনসংখ্যার রাজনীতি “অতিরিক্ত ও অপচয় ব্যবস্থাপনা”র সমার্থক হয়ে উঠবে। আমাদের বিশ্বের ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে, জনসংখ্যা কেবল ডারউইনবাদী অর্থে যৌনজ [সেক্সুয়াল] নির্বাচনেই বিবেচিত হবে না, বরঞ্চ একটি উপযোগবাদী ও জৈব-মনস্তাত্ত্বিক-যান্ত্রিক (bio-physiologico-organic) কাঠামোতেও বিবেচিত হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কোন অঞ্চলের কথা ধরুন যেখানে জনসংখ্যার বিশাল অংশ বেকার। এর কারণ এই নয় যে তেমন কোন কাজ নেই। কারণ এ-ও নয় যে মানুষ কাজ করতে চায় না। আসলে আফ্রিকার অন্যান্য জায়গা এবং বৈশ্বিক দক্ষিণের (global south) মতো দক্ষিণ আফ্রিকাতেও প্রায় সমস্ত কিছুই এখনও করার বাকি। অধিকতর সুখী জীবন নিশ্চিত করতে এখনও কি পরিমাণ কাজ অসমাপ্ত তা ধারণাতীত। কিন্তু অর্থনীতির বর্তমান কাঠামোর সত্যিই আমাদেরকে আর তেমন একটা প্রয়োজন নেই। আমাদের সময়েরও এর দরকার নেই। এই অর্থনীতির সত্যিই প্রত্যেকটি শরীরের কোন জরুরত নেই ; আমাদের পেশীশক্তি কিংবা কর্মশক্তি কিংবা এমনকি আমাদের বিশাল আকারের সামাজিক ও যৌথ মেধার কোন দরকার নেই। এবং ভবিষ্যতে এটাই আরো বেশি বেশি ঘটতে যাচ্ছে কারণ আমরা মানব-ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যেখানে কেবলমাত্র গণনা করা যায় এমন জিনিসেরই কদর আছে। আমরা যখন কথা বলছি, তখনও বহু মানবশরীর গণনার বাইরে পড়ে গেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা কি গণনাযোগ্য, কোন প্রক্রিয়ায় মূল্যমান পরিমাপযোগ্য, এমনকি মূল্যমান আরোপ করার প্রক্রিয়াটা কেমন হবে, কীভাবে মূল্যমান বিনিময় হবে এসব ব্যাপারে নতুন কোন প্রক্রিয়া বের করতে পারছি ; কিছুই বদলাবে না। বিউপনিবেশায়ন প্রকল্প যদি স্রেফ কোন মতাদর্শিক আহলাদ না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলো যে-কোন বিউপনিবেশায়ন প্রকল্পের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় কিছু প্রশ্ন যা অবশ্যই মোকাবেলা করতে হবে।

নীলসেন: বিউপনিবেশায়ন সংক্রান্ত বিতর্কে ফিরে আসি। নরওয়েতে ২০১৮ সালের গ্রীষ্মের সময়, বিদ্যায়তনিক পরিসরের বিউপনিবেশায়ন নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার #RhodesMustFall কীভাবে বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালগুলোর জন্য প্রাসঙ্গিক হতে পারে?

আশিল এমবেম্বে: জ্ঞান, ক্ষমতা এবং প্রতিষ্ঠানাদির মধ্যে সম্পর্কের একটি পর্যালোচনামূলক পুনর্মূল্যায়নের আবশ্যকতা কেবল দক্ষিণ আফ্রিকার একক প্রশ্ন নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায়, “বিউপনিবেশায়ন” প্রপঞ্চের মাধ্যমে “বি-বর্ণবাদীকরণ” (deracialisation) এর বাসনাও প্রকাশিত হয়। “বি-বর্ণবাদীকরণ” এর জরুরত ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশের ক্ষেত্রেও ন্যায্য। ইউরোপ এবং অন্যত্র নতুন ধরনের বর্ণবাদের উত্থান, বিশ্বব্যাপী শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের পুনরাবির্ভাব, লোকরঞ্জনবাদ (populism) এবং পশ্চাদমুখী জাতীয়তাবাদ, ভিন্নতা এবং পরিচয়কে হাতিয়ার বানানো কেবলমাত্র গভীর অবিশ্বাসের লক্ষণ নয়। এগুলো এই বিশ্বকে আমাদের জন্য বসবাসের অনুপযোগী, প্রতিকূল এবং শ্বাসরুদ্ধকর করে তুলতে সক্ষম আন্তর্জাতিক শক্তি দ্বারাও তরান্বিত হয়।

এই সব অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে যা সত্যিই আমাকে অন্তত অংশত ভীত করে তোলে তা হলো সব ধরনের নির্ধারণবাদ দ্বারা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার পুনঃউপনিবেশীকরণ। আমাকে ভীত করে জ্ঞান এবং ডাটা সম্পর্কে কার্যকর বিভ্রান্তি এবং জ্ঞান সংকুচিত হতে হতে তথ্যে পর্যবসিত হওয়া। এই ধারণা যে, বিশ্ব সংখ্যার কারবারি এবং জ্ঞানের কাজ হলো পরিমাণ এর ব্যবস্থাপনা করা। অধিকন্তু, এই বিশ্বাস যে তথ্য তৈরির সর্বোত্তম উপায় হলো কম্পিউটার এবং যা গণনাযোগ্য নয় তার অস্তিত্বই নেই! কম্পিউটারই যেন আমাদের নতুন মস্তিষ্ক।

এহেন বাস্তবতায়, “বিউপনিবেশায়ন” ধারণার  শুরু এখান থেকে করতে হবে যে জ্ঞানকে কম্পিউটারাইজড তথ্য প্রক্রিয়াকরণে সংকুচিত করা যায় না। তাই চিন্তা করার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা ভীষণ জরুরি। এবং আমার কাছে, জ্ঞান একটি বাস্তব রূপকে পর্যবসিত হওয়ার পথে। ফলে, আমরা প্রায় সর্বত্র চিন্তার এক ভয়াবহ দৈন্যদশা প্রত্যক্ষ করছি।

নীলসেন: বিউপনিবেশায়নের নরওয়েজিয়ান বিতর্কে, তরুণ শিক্ষার্থী অ্যাক্টিভিস্টদের অন্যতম প্রধান একটি দাবি ছিল অধিকতর বৈশ্বিক পাঠ্যসূচি। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

আশিল এমবেম্বে: এই মুহূর্তে আমরা আক্ষরিক অর্থেই এমন এক শক্তি দ্বারা আক্রান্ত যারা “বিশ্ব” ধারণা থেকে পিছু হটতে চায় এবং জাতি, সম্প্রদায়, পরিচয় ও পার্থক্যের একটি নির্দিষ্ট ধারণা পুনর্গঠন করতে চায় যা কারা অন্তর্ভুক্ত, কারা নয়, কারা অবশ্যই বাদ পড়বে, কে কোথায়, কেন এবং কত সময়ের জন্য বসতি স্থাপন করতে পারবে এসব ফয়সালা করার ক্ষমতা থাকা না থাকার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই ধরনের শক্তি সমস্ত ধরনের কাঁটাতার স্থাপন এবং সেগুলোকে কীভাবে পুলিশী বন্দোবস্তের অধীন রাখা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তারা এক “বিশুদ্ধ” সম্প্রদায় ধারণার গ্রাহক, এমন সম্প্রদায় যারা একই রকম দেখতে এবং একই রকমের আচরণ করে। তাদের বদ্ধমূল বিশ্বাস যে আমরা অতীতে ফিরে যেতে পারি এবং অতীতই আমাদের সত্যিকারের ভবিষ্যত। এই ধরনের খায়েশকে আমি “বর্ণবাদী খায়েশ” বলে থাকি।

আরও এক ধরনের বাসনা আছে, সম্ভবত প্রথমটির সাথে অ-সম্পর্কিত নয়। আমি যেমনটি উল্লেখ করেছি, এটা হলো জ্ঞানকে কম্পিউটার গণনার বিষয়ে পর্যবসিত করা। আসলে এটি হলো সমস্ত কিছুকে গণনাযোগ্য বিষয় বলে মনে করা এবং জৈবিক ও স্নায়বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করার বাসনা। একটি গ্রহীয় গ্রন্থাগার, মহাফেজখানা অথবা পাঠ্যসূচি প্রকল্পের কৌশলগত দিকটি হলো অগণ্য ও হিসাব-নিকাশের ঊর্ধে বিষয়াদির উপলব্ধি তৈরি করা। এটি কেবল প্রত্যক্ষ-জ্ঞানবাদীতাকে ছাপিয়ে যাওয়ার ইচ্ছার উপর ভিত্তি করেই করা যেতে পারে। আমি গণনা বা গণিতের বিরোধী নই। এমনকি আমি স্বয়ংক্রিয় হিসাব-নিকাশের বিরুদ্ধেও নই। আমি কেবল বলছি যে জীবনকে ব্যাখ্যা করার জন্য গণিত, গণনা কিংবা স্বয়ংক্রিয় হিসাব নিকাশ কোনটাই যথেষ্ট নয়। কেবলমাত্র সঠিক গাণিতিক ব্যবস্থা যথেষ্ট হতে পারে না। একবার সঠিকভাবে গণিত সম্পন্ন করার পরে, আমাদের নির্ধারণ করতে হবে যে সার্বিক জীবনের ওপর এর প্রভাবটা কী। একটি নির্দিষ্ট স্তরের কেবলমাত্র সঠিক গাণিতিক চর্চা চিন্তাকে দুর্বল করে এবং তত্ত্বকে ধ্বংস করে।

অন্যথায়, আমাদের তো কেবল এই একটিই পৃথিবী আছে। আমরা ভবিষ্যতে মঙ্গল বা শুক্র বা অন্যান্য অজানা গ্রহকে ঔপনিবেশিক দখলের স্বপ্নে বিভোর হতে পারি, তবে আপাতত এই স্বপ্ন আমাদের বাস্তবতার অংশ নয়। আমাদের কেবল একটি পৃথিবী, একটি সৌরজগৎ রয়েছে এবং এই পৃথিবীকে যতদিন সম্ভব স্থায়ী করতে, এই সৌরজগত যেন জীবনকে ভস্মীভূত না করতে পারে সেজন্য আমাদের আরও কিছুটা বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে। এই পৃথিবী হচ্ছে আমাদের ভাগাভাগি করা ছাদ এবং ভাগ করে নেওয়া আশ্রয়স্থল। পৃথিবীতে জীবনকে টেকসই করার নিমিত্তে এই ছাদ এবং আশ্রয় ভাগ করে নেয়া অত্যাবশ্যক শর্ত। আমাদের যথাসম্ভব ন্যায়সঙ্গতভাবে এটি ভাগ করতে হবে। এবং, যাই হোক না কেন, সর্বত্র আমাদের জীবন, এতটাই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে এদেরকে আলাদা করার প্রয়াসের জন্য প্রচুর পরিমাণে সহিংসতার প্রয়োজন হবে। মানবতাকে তার নিজের থেকে এবং বাদবাকি প্রজাতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে প্রচুর সহিংসতার প্রয়োজন হবে। এজন্যই বিশেষত আমরা যে ধরনের বাস্তুসংস্থানগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি ; জাতিরাষ্ট্র, জাতি, বর্ণ, ধর্ম এবং এ জাতীয় প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে পুনরায় জীবনের সাধারণ সূত্র উদ্ভাবন করতে পারা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি পাঠ্যসূচি যা এ জাতীয় উদ্বেগকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে তা অবশ্যই প্রয়োজনীয়।

আর্ট: ইবনি জি. প্যাটারসন

নীলসেন: এবং আপনি কি এই দুটি শক্তিকেই পাঠ্যসূচি রচনার বিতর্কে দৃশ্যমান দেখছেন?

আশিল এমবেম্বে: হ্যাঁ, দেখছি। আমি এর সাথে আরো যুক্ত করবো যে সত্যিকারের গ্রহীয় পাঠ্যসূচির ডিজাইন তৈরির অর্থ একটি অংশীদারি মানবিক অনুষদ হিশেবে যা কিছু যুক্তির সাথে সম্পর্কিত তা উদ্ধার করা। নিশ্চিত হওয়ার জন্য এবং যুক্তির নিজস্ব সহিংসতা ও অযৌক্তিকতার ইতিহাসের বিবেচনায় এর সংস্কার করতেই হবে। তবে এই শতকে মানবজাতিকে অন্যতম যে প্রশ্নটি তাড়িয়ে ফিরবে, অর্থাৎ জীবনের ভবিষ্যত; যুক্তিকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে সেই প্রশ্নের কীভাবে সুরাহা করা সম্ভব তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।

দীর্ঘকাল ধরে, আমরা জীবনের উদ্ভব এবং এর বিবর্তনের শর্তগুলো নিয়ে ওয়াকিবহাল ছিলাম। আজকের দিনে এসে মূল প্রশ্নটি হলো কীভাবে এর মেরামত, পুনরুৎপাদন, এবং যত্ন করা যায় ; কীভাবে একে টেকসই ও সংরক্ষণ করা যায়, সর্বজনীনভাবে ভাগ করে নেয়া যায় এবং কী পরিস্থিতিতে জীবনের শেষ হয়। সামগ্রিকভাবে, পৃথিবীতে জীবনকে কীভাবে পুনরুৎপাদন ও টেকসই করা যায় এবং কোন পরিস্থিতিতে এটি শেষ হয় তা নিয়ে এই বিতর্কগুলো বর্তমান যুগে আমাদের ওপর সওয়ার হয়েছে; মূলত আসন্ন পরিবেশগত বিপর্যয় এবং প্রযুক্তিগত উল্লম্ফনের ফলে। আমি মনে করি না যে, শুদ্ধ বাজারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গী যা মানুষকে নড়বড়ে পরিস্থিতিতে প্রতিস্থাপনযোগ্য পণ্য হিশেবে গণ্য করে, সেই যুক্তি দিয়ে এই বিতর্কগুলোর সঠিক জবাব দেয়া যাবে।

অন্যদিকে, মানুষ এবং প্রযুক্তির মধ্যে ক্ষমতার বন্টনে পালাবদল ঘটছে এই অর্থে যে প্রযুক্তি  “সাধারণ বুদ্ধিমত্তা” এবং স্ব-প্রতিরূপের দিকে এগিয়ে চলেছে। গত কয়েক দশক ধরে আমরা বুদ্ধিমত্তার অ্যালগোরিদমিক রূপগুলোর বিকাশ প্রত্যক্ষ করেছি। তারা জিনগত গবেষণার সাথে সমান্তরালভাবে এবং প্রায়শই এর সাথে জোটগতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। জৈবিক ক্ষেত্রে অ্যালগরিদমের একীভবন এবং বড় ডেটা বিশ্লেষণ কেবল প্রযুক্তি-দৃষ্টবাদ (techno-positivism) এবং পরিসংখ্যানগত চিন্তাপ্রণালীর প্রতি বিপুল আস্থাই এনে দিচ্ছে না, এটি প্রাকৃতিক বিশ্বের পরিমাপ এবং ভবিষ্যদ্বাণী ও বিশ্লেষণের এমন পদ্ধতির শাসনকে কায়েম করছে যা জীবনকে একটি গণনাযোগ্য বস্তু হিশেবে বিবেচনা করে।

একইসাথে প্রাকৃতিক বিশ্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত অ্যালগরিদম এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন ও বিবর্তনের ধারণাসমূহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেনেটিক অ্যালগরিদমের ক্ষেত্রেও এরকম ঘটনা ঘটছে। যেমন মার্গারিডা মেন্ডেস (“Molecular Colonialism”) দেখিয়েছেন, আজকের দিনের বিশ্বাস হলো সবকিছুই সম্ভাব্য গণনাযোগ্য এবং অনুমানযোগ্য। এই প্রক্রিয়ায়, এই সত্য এড়িয়ে যাওয়া হয় যে খোদ জীবন একটি উন্মুক্ত ব্যবস্থা, অরৈখিক এবং তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিশৃঙ্খল।

আমি এই বিষয়গুলি উত্থাপন করে চলেছি কারণ এগুলো নিছক মতাদর্শিক অহম নয় এমন “বিউপনিবেশায়ন” প্রশ্নের সাথে অসম্পর্কিত নয়। প্রকৃতপক্ষে, এই বিষয়গুলো এমন সন্ধিক্ষণের লক্ষণযুক্ত হতে পারে যা আমরা এখনো ভাবতে ইচ্ছুক বা প্রস্তুত নই। যুক্তি সম্ভবত তার চূড়ান্ত সীমাতে পৌঁছেছে। অথবা, যে কোনও কারণে যুক্তি কাঠগড়ায় হাজির। একদিকে, এটি ক্রমবর্ধমানভাবে পরিবর্তিত হয়ে যান্ত্রিক যুক্তি দ্বারা গৃহীত হচ্ছে যেখানে এটিকে কেবল তথ্যের অ্যালগরিদমিক প্রক্রিয়াকরণে হ্রাস করা যায় না। অন্যদিকে মেশিন এবং কম্পিউটার ও এলগোরিদমের মধ্য থেকে ‘লজিক অব রিজন’ রূপান্তরিত হচ্ছে ন্যানো-মেশিন ও সকল ধরণের যন্ত্রে মানবমস্তিষ্ক ‘ডাউনলোড’ হচ্ছে।

যেহেতু আমরা ক্রমশ গণনার একাধিক এবং প্রসারিত ওয়েবফ্রন্ট দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়ছি, আমরা স্রেফ যা জানতে চাইছি তা হলো প্যাটার্ন সনাক্ত করা বা নিদর্শন পুনরুদ্ধার করা যার অস্তিত্ব ক্ষুদ্রায়ণ এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে নির্মিত আর্থিক মডেলগুলো  থেকে উদ্ভূত। ফলস্বরূপ, কারিগরিবিদ্যা যুক্তির সারবস্তু ধারণকারী  ভাষা এবং একমাত্র বৈধ ইশতেহার হয়ে উঠছে। তদুপরি, যান্ত্রিক যুক্তি কিংবা যুক্তিবেশী কারিগরিবিদ্যাকে (reason in the guise of techne) ক্রমবর্ধমানকভাবে অস্ত্র হিশেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। খোদ জীবন পরিসংখ্যান, মেটাডেটা, মডেলিং, গণিতের মাধ্যমে নির্ধারিত।

যদি বর্তমান প্রবণতাগুলো সম্পর্কে আমার বর্ণনা সঠিক হয়, তবে প্ল্যানেটারি পাঠক্রমে যে প্রশ্নগুলো অবশ্যই অন্তর্ভূক্ত করতে হবে সেগুলোর অন্যতম একটি হলো: তথ্য-যন্ত্র এবং গণনা প্রযুক্তিগুলোর মাধ্যমে যুক্তির যান্ত্রিকীকরণের যুগে মানব কর্তাসত্তার কী অবশিষ্ট আছে?

দ্বিতীয়টি প্রশ্নটি হলো: গণনাযোগ্য ও অগণাযোগ্য, মূল্যবান ও মূল্যহীন তথা খরচযোগ্যের পার্থক্যকারী দেয়াল বা সীমা কে নির্ধারণ করবে?

তৃতীয়টি প্রশ্নটি হলো: আমরা গণনা এবং ক্ষমতার এই নতুন কলকব্জাগুলোকে মুক্তির কলকব্জায় পরিণত করতে পারব কিনা। অন্য কথায়, আমরা কি মূল্যায়নের বিভিন্ন প্রণালী উদ্ভাবন করতে পারব কিনা যা ভিন্ন নন্দনতত্ব, পৃথিবীতে বাস করার সম্পূর্ণ নতুন রাজনীতি, এই গ্রহের মেরামত ও ভাগ করে নেয়ার নতুন সম্ভাবনা উন্মুক্ত করতে পারে?

নীলসেন: তবে যারা ‘দেবত্ব’ অর্জন করা ইউরোপীয় তাত্ত্বিক এবং চিন্তাবিদদের টেক্সট শিথিল করার ব্যাপারে সচেতন তাদের ব্যাপারে কী বলবেন?

আশিল এমবেম্বে: আমি মহাফেজখানা প্রসারিত করার কথা বলছি, সংকোচন করতে বলছি না। এটি সম্ভব করে তোলার জন্য, অবশ্যই সবার কাছে পরিষ্কার হওয়ার কথা যে মানুষ এবং মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীব-জড় উপাদানের বর্তমান ও ভবিষ্যতের ইতিহাস সংক্রান্ত জটিলতার কৈফিয়ত খোঁজার জন্য কেবলমাত্র ইউরোপীয় মহাফেজখানা আর কোনভাবেই যথেষ্ট নয়। আমরা সকলেই এই বিশ্বের মুক্ত মহাফেজখানার উত্তরাধিকার। শুধুমাত্র এক ধরনের মহাফেজখানা নয়। আমার কাছে এটি কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়। আমি মহাফেজখানা প্রসারিত করার পক্ষে, বিশ্বের বিভিন্ন মহাফেজখানাকে সমালোচনামূলকভাবে অধ্যয়নের পক্ষে, যে মহাফেজখানা প্রত্যেকটি অন্যটির সাথে এবং বিরুদ্ধে রয়েছে। গ্রহীয় পাঠ্যসূচির আর তো কোন অর্থ হতে পারে না!

নীলসেন: সব ক্ষেত্রেই?

আশিল এমবেম্বে: সবক্ষেত্রেই। সঙ্গতকারণেই। এই বিশ্বের ভবিষ্যত ইতিহাস এবং সার্বিক জীবনের ইতিহাসের ওপর প্রভাব আছে এমন যেকোন বিষয়ের ক্ষেত্রে বলছি আমি। কিংবা আমার কথাটাকে এবার এভাবে বলা যাক: আমি এমন যেকোন তরুণের প্রতি সমব্যথী যিনি নরওয়েজিয়ান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়েছেন কিংবা হচ্ছেন অথচ আফ্রিকা, এশিয়া বা চায়না সম্পর্কে কিছুই জানেন না ; কোনদিন কোন আফ্রিকান, ভারতীয় বা চাইনিজ কবিতা বা সাহিত্য পড়েননি; কখনোই কোন আফ্রিকান, জাপানিজ বা চাইনিজ গুরুত্বপূর্ণ চিন্তককে পড়েননি। আমি সত্যিই গভীরভাবে সেই তরুণের জন্য দুঃখ অনুভব করি। এমন যেকোন তরুণ/তরুণীর বেহাল দশা আমাকে সত্যিই দুঃখিত করে। কারণ এটা এক ধরনের মানসিক আত্ম-বিচ্ছেদ, বিশ্বকে জ্ঞাতে কিংবা অজ্ঞাতে প্রত্যাখান করার সামিল। গ্রহীয় পাঠ্যসূচির উদ্দেশ্য হবে আমাদের মনকে মনুষ্য-আরোপিত বিকারমুক্ত করা।

নীলসেন: নরওয়ের বিতর্কে, আরও বেশি মাত্রার বৈশ্বিক পাঠ্যক্রমের দাবিকে নিন্দুকেরা “পরিচয়বাদী রাজনীতি” হিশেবে অভিযুক্ত করেছিলেন। আপনি এই যুক্তিটি কীভাবে দেখছেন?

আশিল এমবেম্বে: এটা কোন কোন বিষয় বিপদাপন্ন তার ভুল বৈশিষ্ট্যায়ন। কারণ এতে যা নয় তাই ধরে নেয়া হয়। আসলে এটি পরিচয়বাদী রাজনীতির বিষয় নয়। এটি আগে আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কথা বলেছি সে বিষয়ক। এটি আজকের দিনে আমরা কীভাবে নিজেদের বিশ্বে স্থাপন করি তার বিষয়। এমন এক বিশ্ব যা টেকসই এবং সাধারণ্যের নীতিতে নির্মিত। এর সাথে জাতিবিদ্বেষের কল্পনার কোন যোগসূত্র নেই।

“পরিচয়বাদী রাজনীতি”র এক ধরনের সমালোচনা চালু আছে যা ডানপন্থী সমালোচনা। এটি সাধারণত সেই গোষ্ঠী থেকেই আসে যারা নির্দিষ্ট লোকেদের নিপীড়ন ও বর্জনের খড়্গ চালিয়েছেন, বর্ণবাদী আচরণ ও বিমানবিকীকরণের উদ্দেশ্যে পরিচয়কে ব্যবহার করেছেন। ঐতিহাসিকভাবে পরিচয়বাদী রাজনীতি তাদের দ্বারাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে, যারা বিভিন্ন “জাত”কে কালিমা লেপনে বেশ উৎসুক ছিলেন, যারা আগাগোড়া মানবতার সাধারণ সূত্রের প্রতি অবিশ্বাসী ছিলেন। তারা পার্থক্যের পূজারি ছিলেন, যাকে তারা অস্ত্র হিশেবে প্রয়োগও করেছেন।

এইখানে রঙ্গটি হলো এই যে, ফ্রাঞ্জ ফাননসহ অনেকেই দেখিয়েছেন এইভাবে যাদের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে এবং একপাশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে, দুর্ভাগ্যক্রমে তারা এই কুসংস্কারগুলো গ্রহণ করেছে এবং এগুলোর আত্মীকরণ করেছে। স্বর দাবি করার প্রয়াসে তারা যে “পার্থক্য” তাদের কপালে সেঁটে দেয়া হয়েছিল, সেই সংজ্ঞা ও শর্তের মধ্যেই নিজেদেরকে আবিষ্কার করে। সুতরাং আমরা যখন “পরিচয়বাদী রাজনীতি”র কথা বলি, তখন আমাদের সঠিকভাবে এর ঐতিহাসিক ঠিকুজি তলিয়ে দেখতে হবে এবং কারা এর অনুশীলনকারী সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।  উদাহরণস্বরূপ, যারা এটি অনুশীলন করছেন তারা হলেন, যখন কোনও কালো আফ্রিকান অন্য অনেক কিসিমের লোকের সাথে নরওয়ের বিমানবন্দরে অবতরণ করে, তখন ঠিক সেই ব্যক্তিটিকে বেছে নিয়ে তাকে বর্ণবাদী কায়দায় “প্রোফাইলিং” করা হয়।

গ্রহীয় পাঠ্যসূচি সম্পর্কে কথা বলার সাথে মানুষ, টেক্সট কিংবা মহাফেজখানার বর্ণবাদী প্রোফাইলের কোন লেনদেন নেই। এটি প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রতিটি টেক্সট, আর্কাইভ, স্মৃতিকে যথাসম্ভব ন্যায়সঙ্গতভাবে যত্ন এবং সংস্রবের আওতায় নিয়ে আসার সাথে সম্পর্কিত। এটি একঘরে করে রাখা কিংবা হয়ে থাকার বিপরীতে নৈকট্যের বিষয় ; একটি ভাগাভাগির অভ্যন্তর, অভিন্ন ছাদ আশ্রয় উদ্ভাবনের বিষয়।

অফ লাভ পসেসড
আর্ট: ফিরেইলি বায়েজ

নীলসেন: নরওয়েজিয়ান বিমানবন্দরে কি আপনার ক্ষেত্রে বর্ণবাদী প্রোফাইলিং ঘটেছে?

আশিল এমবেম্বে: আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বহু মানুষ যারা আজকের দিনে বিশ্ব ভ্রমণ করেন, তাদের ক্ষেত্রে এটা নিয়মিত ঘটনা। এই মুহূর্তে আমি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।

তবে আপনি যেহেতু প্রসঙ্গটি তুলেছেনই, আমার কাছে মনে হয় পরিচয়বাদী রাজনীতি এবং পার্থক্যকে কেন্দ্র করে অপরাপর রাজনীতি আমজনতার নতুন আফিম। নিজেকে এইভাবে প্রকাশ করে, আমি কোনওভাবেই সেইসব লোককে আঘাত করার চেষ্টা করছি না, যারা আজ পর্যন্ত একটি এমন স্বর কিংবা মুখ পুনরুদ্ধার এর লড়াই এ নিয়োজিত, যাকে সত্যিকার অর্থে মানুষের কন্ঠস্বর বা মুখ হিশেবে চিহ্নিত করতে পারি।

আমার বলার কথাটি হলো গ্লোবায়িত (globalized) পুঁজিবাদের এই যুগে পরিচয়বাদী রাজনীতি আমাদের মধ্যকার দুর্বলতমদের ওপর আরও নিষ্ঠুরতা করার স্বার্থে এবং বিশুদ্ধ বা প্রামাণিক ভিক্টিমের স্ট্যাটাস দাবি করার অজুহাত হিশেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নৃশংসতা বা নির্যাতনের শিকার হওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিকার, ন্যায়বিচার, যত্ন, প্রতিকার বা ক্ষতিপূরণের দাবিদার হওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায়। আমি যে প্রশ্নটি তুলতে চাই তা হলো কেন এমন হলো? আমাদের সময়ের পরিস্থিতিতে, প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধপরায়নাতাকে ন্যায়বিচারের সাথে গুলিয়ে ফেলার কারণগুলো কী কী? এর কারণ কি এই যে, আমরা এমন এক বিন্দুতে এসে পৌঁছেছি যেখানে আমরা পুঁজিবাদের যে রূপে বাস করি, যে ধরনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অর্জন করেছি, তা এখন আর উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়?

পরিচয়বাদী রাজনীতির যে দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমি তুলে ধরেছি তা নব্য-উদারনীতি এবং প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদের ভয়াবহ থাবা থেকে উদার গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারবে না। আমরা যত বেশি সংখ্যক মানুষকে নির্দেশনা দিতে পারি যে কোন কোন জিনিস আসলে কোন ব্যাপারই না— কারা জনপরিসরে বোরকা পরছেন, কারা মুসলিম দাড়ি রাখছেন, বিদেশিরা আমাদের চাকরি, “আমাদের নারীদের” ছিনিয়ে নিচ্ছে, এবং আমাদের সংস্কৃতিকে দূষিত করছে আমাদের চাকরি চুরি করে এবং “আমাদের মহিলা” এবং আমাদের সংস্কৃতিকে কলুষিত করে— এগুলো যে আসলে ইস্যু না তা আমরা বলতেই পারি কিন্তু এই ধরনের গা বাঁচানো কথা বলে আমরা আজকের দিনের বিশৃঙ্খলার মূলে পৌঁছাতে পারব না। এগুলো কেবলমাত্র বর্তমান সংকটকেই প্রতিধ্বনিত করবে যা বহু লোকে ইতোমধ্যেই লালন করছে, উন্মাদনার অনলে পুড়ছে এবং পাশবিকতা প্রদর্শনের পথ প্রশস্ত করছে।

নীলসেন: আপনার নিজের দেশে ক্যামেরুনেও কি আপনি এই ধরনের পরিচয়বাদী রাজনীতি প্রত্যক্ষ করেন?

আশিল এমবেম্বে: সুনির্দিষ্টভাবে ক্যামেরুনের কথা বলতে গেলে, পরিচয় ও ভাষার প্রশ্নকে ঘিরে ঔপনিবেশিকতার সূত্রে প্রাপ্ত এক ধরনের উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায়। যেমন বর্তমানে চলমান অন্যতম একটি প্রধান বিবাদের বিষয় হচ্ছে কার ফরাসিপনার চেয়ে ব্রিটিশগিরি বেশি কিংবা কার ব্রিটিশগিরির চেয়ে ফরাসিপনা বেশি। এটা সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক এক তর্ক। তবে এই কথাটি বলার পরে, আমাদের যে প্রশ্নটি তোলা দরকার তা হলো: স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং সাধারণ অধিকারের বিভিন্ন সংগ্রাম কেন আবশ্যিকভাবে এহেন খারিজি (exclusionary) পরিভাষায় নিজেকে প্রকাশ করে? নিছক নিপীড়নের বিভিন্ন বর্গের অনুকরণ ব্যতীত অন্যান্য পরিভাষায় কেন সাধারণ অধিকারের বিষয়াদি নিজেকে খুঁজে পায় না? কেন সাধারণ মানুষ সেইসব শক্তি/ধারণার সাথেই আঁতাত করে যেগুলো তাদের নিজস্ব বস্তুগত স্বার্থের বিরুদ্ধেই কাজ করে? স্বেচ্ছা-দাসত্বের নানা রূপ হিশেবে আবির্ভূত হয় এমন শক্তি/ধারণার সাথে যুক্ত হওয়ার সুবিধা বা মাশুলই বা কী?

নীলসেন: তাহলে সমাধান কী?

আশিল এমবেম্বে: আমরা কিসের বিরুদ্ধে সক্রিয় সে সম্পর্কে আমাদের আরও গভীর বোঝাপড়া তৈরি করা উচিত এবং বহু পুরানা অনুমান ছুঁড়ে ফেলা উচিত। আমরা যদি আমাদের পর্যালোচনা-বিচার বিশ্লেষণের অনুষদটি পুনরুদ্ধার না করি, আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে পুনরায় ঝালাই না করি এবং স্বাধীনতা বা মুক্তির যে কোনও প্রকল্পের প্রাণভোমরা হিশেবে যুক্তিকে পুনঃস্থাপন না করি, তাহলে এটা সম্ভব হবে না। যুক্তি আজ অবরুদ্ধ এবং যান্ত্রিকতার মাত্রায় পর্যবসিত হয়েছে। একদিকে বিকট প্রযুক্তিবাদ (technicism), অন্যদিকে সমস্ত রকমের নেতিবাচক ভাবাবেগ যুক্তির স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। আমি অবশ্যই যুক্তির সহিংস ও মর্মান্তিক ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত এবং কেবল আমাদের বিশ্বের অংশেই নয়।

সুতরাং, এটি সম্ভবত যতটা যুক্তির ধারণাকে পুনঃর্গঠন করা, ততটা অন্যকিছুই নয়। তবে যুক্তির ধারণাটাকে হরেদরে খারিজ করে দিয়ে কী করে খোদ সত্যের ধারণাকেই গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা না যায় তা আমার বোধগম্য নয়। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে যুক্তির অনুপস্থিতিতে গণতন্ত্র টিকতে পারে না। অর্থাৎ, যুক্তির একটা পরিমার্জিত রূপ ছাড়া না আমরা এই বিশ্বে মিলেমিশে বাস করতে পারি, না পারি এ’কে মেরামত করতে, না পারি সার্বিকভাবে জীবনের যত্ন নিতে। যুক্তি বলতে আমি তেমন যুক্তিকেই বোঝাচ্ছি যার সাথে চিন্তাশীলতা, আবেগ-অনুভূতি ও অভিক্ষেপের সংমিশ্রণ ঘটবে।

নীলসেন: নরওয়েতে বিউপনিবেশায়ন আন্দোলনের আরেকটি সমালোচনা হলো এটি “আমেরিকান ক্যাম্পাস অ্যাক্টিভিজম” এর গন্ধপ্রবণ ছিল এবং নরওয়েজিয়ান পরিপ্রেক্ষিতে এর তেমন কোন প্রাসঙ্গিকতা ছিল না।

আশিল এমবেম্বে: বিউপনিবেশায়ন আন্দোলনের যথার্থ সমালোচনাকে অবশ্যই পর্যাপ্ত তথ্যভিত্তিক হতে হবে। আমার নিজেরই এই প্রকল্পের সাথে সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি ব্যাপারে সমালোচনামূলক পর্যবেক্ষণ আছে। এটা সত্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্দোলনের ধরন, কর্মী-সমাবেশ এবং বিভিন্ন বর্গ সারা বিশ্বের অন্যান্য আন্দোলনে বিস্তার লাভ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে, এটি সত্য যে আন্দোলনটি প্রায়শই আফ্রিকান-আমেরিকান অভিজ্ঞতা বা পরিভাষার, (বিশেষত বর্ণ বা লিঙ্গ সম্পর্কিত সমালোচনার ক্ষেত্রে) ওপর নির্ভর করার ফাঁদে পড়েছে। এটি সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার নিজস্ব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে তত্ত্বায়ন করা এবং নিজের সর্বজনীনতার সম্ভাবনাকে ভাষা দিতে না পারার অক্ষমতা থেকে উৎসারিত কারণ।

কিন্তু এটি বলার পরেও, আমি আমার নরওয়েজিয়ান বন্ধুদের বলবো: বিউপনিবেশায়ন প্রসঙ্গে আপনাদের নির্দিষ্ট বাস্তবতায় নিজেদের শিক্ষার্থী অ্যাক্টিভিজমের রূপ আবিষ্কার করতে পারা উচিত। তবে খোদ বিউপনিবেশায়নের জরুরত অস্বীকার করা জঁ পল সার্ত্র যাকে “Bad Faith” হিশেবে চিহ্নিত করেছিলেন তার অংশ।

স্পিরিট অফ কার্নিভাল
শিল্পী: টাম জোসেফ

নীলসেন: তবে এই তর্কের অন্তর্নিহিত মূল ধারণাটি সম্ভবত এই যে, নরওয়েজিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপনিবেশবাদের সাথে সংযুক্ত নয় যেমনটা কিনা অন্যান্য দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংযুক্ত থাকতে পারে।

আশিল এমবেম্বে: আমাদের পুরো কথোপকথন জুড়ে, আমি বিউপনিবেশায়নের এমন একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করার চেষ্টা করেছি যেটি যতটা সম্ভব বিস্তৃত। নরওয়ে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপ নয়। নরওয়ে বিশ্বের অন্যান্য অংশের সাথে জড়িত এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশের সম্ভাষণে একে সাড়া দিতে হবে। এবং এই সম্ভাষণে নরওয়েকে খুব গুরুত্বের সাথেই সাড়া দিতে হবে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে যেমন সাড়া দিতে হবে আফ্রিকা মহাদেশের এবং সারাবিশ্বের সম্ভাষণে। এভাবেই আমরা যুক্তিকে উদ্ধার করব এবং টেকসই একটি বিশ্ব গড়ে তুলব।

নীলসেন: আমাদের জ্ঞান ব্যবস্থাপনা ঠিক কতটা উপনিবেশবাদ বা নিপীড়ন দ্বারা নির্ধারিত?

আশিল এমবেম্বে: “উপনিবেশায়ন” সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া আরো বিস্তৃত করা উচিত। বিশ্বব্যাপী জ্ঞান ব্যবস্থাপনা এখনও মূল্য নিষ্কাশনের যুক্তি দ্বারা চালিত। প্রকৃতপক্ষে, মূল্য নিষ্কাশনের প্রধান উপায় হিশেবেই জ্ঞানব্যবস্থার ডিজাইন করার চল বেড়ে চলেছে। উপনিবেশায়ন এখনো বলবৎ আছে কারণ ধরে নেয়া হচ্ছে আমরা যে বিশ্বে বসবাসরত সেটা ডেটা নিষ্কাশন করার এক বিশালক্ষেত্র মাত্র। উপনিবেশায়ন তো এখনো বলবৎ আছে কারণ আমরা পর্যালোচনামূলক যুক্তি, তাত্ত্বিক চিন্তার জরুরতকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি এবং ডাটা সংগ্রহ, এর বিশ্লেষণ এবং সরকার, সামরিক আমলাতন্ত্র, কর্পোরেশন কর্তৃক সেই ডাটার ব্যবহার করাকেই “জ্ঞান” হিশেবে ধরে নিচ্ছি। উপনিবেশায়ন এখনো আমাদের ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে কারণ আমরা এমন তথাকথিত স্মার্ট ডিভাইস ব্যবহার করছি, যা আমাদের প্রত্যেকটি মুহূর্তের নজরদারি করছে, রেকর্ড রাখছে এবং বিপুল পরিমাণের ডাটা উৎপাদন করছে। আমাদের প্রত্যেকটি কার্যক্রম এই এইসব ডিভাইসের সাথে জুড়ে দেয়া ক্যামেরা এবং সেন্সরে ধারণ করা হচ্ছে। এই হচ্ছে একুশ শতকের উপনিবেশায়নের রকমফের। এটা হচ্ছে ডাটার উত্তোলন, সংরক্ষণ এবং বলয় তৈরি করা, মানুষের চিন্তা করার সক্ষমতার পণ্যায়ন ঘটানো এবং প্রোগ্রামিং এর স্বার্থে ক্রিটিকাল যুক্তিবোধকে নির্বাসনে পাঠানো।

বিউপনিবেশায়ন প্রকল্পকে যদি স্রেফ একটা স্লোগানের চেয়ে বেশি কিছু হতে হয়, তাহলে অবশ্যই এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের এখন অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় বেশি দরকার আমাদের জীবনে প্রযুক্তির ভূমিকার পর্যালোচনা এবং প্রাযুক্তিক জীবনের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন। সমস্ত যুক্তিতেই। আমরা যার সাক্ষ্য হচ্ছি, বুঝতে পারি আর না-ই পারি, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের মানুষ প্রজাতির উত্থান। রেনেসাঁর যুগের বা আঠারো শতকের অথবা বিশ শতকের শুরু বা মাঝামাঝি পর্যন্ত যে “মানুষ” দেখা যেত এবং তার সাথে বস্তুর যে সম্পর্ক ছিল এ তা নয়।

মানুষ এবং বস্তুর মধ্যে আমরা যে ফারাক করতাম, তার সবটা আজ আর কার্যকর নয়। কারণ আজকাল নকল অঙ্গ (prosthesis) ছাড়া আর কোন মানুষ নেই। কেবলমাত্র সব ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার দ্বারা আমাদের পরিবেশের চূড়ান্তকরণ ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় স্ক্রিনে বা স্ক্রিনের মাধ্যমে অতিবাহিত করছি। আমাদের চৈতন্যের উপর এর মারাত্মক প্রভাব রয়েছে, বিশেষত বিভিন্ন জিনিস ও বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা অর্জন করার ক্ষেত্রে। বিশেষত আমরা কি জানি বা কি আমাদের অবশ্যই জানা উচিত, আমরা যা জানি তা কীভাবে জানি, ফ্যাক্ট ও ফিকশন, বস্তু ও পদার্থের পার্থক্য করার ক্ষেত্রে এবং চিন্তার একচেটিয়াকরণে প্রাযুক্তিক অবকাঠামোর ভূমিকা সীমাহীন।

বিউপনিবেশায়নকে স্রেফ একটা স্লোগানের চেয়ে বেশি কিছু এবং কোন এক প্রান্তে পৌঁছাতে হলে, এই বাঁকবদলগুলোর মোকাবেলা করতেই হবে। বিশেষত অ্যান্থ্রোপসিনের** সাথে এবং কম্পিউটারাইজড প্রযুক্তির জালিক প্রকৃতির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। পৃথিবীতে মানুষ ও অন্যান্য জীবন্ত সত্তার অস্তিত্বের “সফটওয়্যারকরণ” এর বিরুদ্ধে। আমাদের অবশ্যই জ্ঞানকে “কেনা-বেচার” ব্যবস্থাপনায় সংকুচিত হওয়াকে আটকাতে হবে এবং “প্রাসঙ্গিকতা” বর্গের পুনরুদ্ভব ঘটাতে হবে। এটা তখনই ঘটবে যদি আমরা নতুন করে কেবলমাত্র “উপায়” নয়, “উদ্দেশ্য” প্রশ্নে জোরারোপ করি। এই সবকিছু বলার পর, আমি অবশ্যই আমাদের যুগের গুপ্ত নিহিলিজম, নিষ্ঠুর বর্বরতার নয়া আদর্শ এবং শেষ জমানার বাসনা যে খুব দূরে নয় সে সম্পর্কেও অবগত।

নীলসেন: আপনি যাকে বলেন “Savage Object” সে সম্পর্কেও সম্প্রতি আপনি লিখেছেন। এগুলো যে এখনো পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন জাদুঘরের দখলে রয়ে গেছে, এর তাৎপর্য কী? ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়াই বা কীভাবে করা যেতে পারে?

আশিল এমবেম্বে: ফেলওয়াইন সার ও বেনেডিক্ট স্যাভোয় এই জটিল প্রশ্নের চুলচেরা গবেষণা করেছেন। এ বিষয়ে তাদের গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পশ্চিমা জাদুঘরগুলোতে আফ্রিকান জিনিসপত্র থাকার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী ব্যক্তিবর্গকে আমি এই দুইজনের গবেষণা পড়ে দেখতে বলব। আমি এই পুনরুদ্ধারের দাবিকে আরও বৃহৎ পরিসরে অর্থাৎ ঋণ, ক্ষতিপূরণ এবং সর্বজনীন ন্যায়বিচারের প্রশ্নের সাথে জড়িয়ে দেখতে চাই।

আফ্রিকান চিন্তার প্রাক-ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাপনায়, কারো জীবনের ওপর পরিকল্পিত, ঘৃণ্য এবং সচেতন সহিংসতা সংঘটনের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা হিশেবে ক্ষতিপূরণের দাবিকে বিবেচনা করা হতো। কারোর “প্রাণশক্তি”র ওপর আঘাতকে সবচেয়ে ধবংসাত্মক ক্ষতি হিশেবে বিবেচনা করা হতো। এই ধরণের প্রেক্ষাপটে, যখন কিনা জীবন ছিল ভঙ্গুর বা জীবনের খর্ব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, মানব বা অন্য কোনো ধরণের সত্তার সংহতি ও জীবনীশক্তির ওপর সকল আঘাত— সে আঘাত যত ছোটই হোক— পুনরুদ্ধারের দাবি করতো।

ক্ষয়ক্ষতি বা ক্ষতকে অর্থনীতির বিচারে মাপা যেতে পারে। কিন্তু একটু আগে যে উদাহরণ দিলাম সেই বিবেচনায় ক্ষয়ক্ষতি বা ক্ষতকে জীবনের মূল্যের সাথে তুলনা করে বিচার করা হতো। এই দর্শন অনুযায়ী, যথার্থ ক্ষতিপূরণ সেটাই যা জীবনকে পুনর্গঠনে অংশ নেয়। এ সংক্রান্ত আইনটি ব্যক্তিকে ঘিরে আগায়, সম্পত্তি বা বস্তু নয়। যেখানেই বস্তুগত ক্ষতি এবং স্বার্থের প্রশ্ন এসছে, এগুলোর একমাত্র অর্থ দাঁড়িয়েছে জীবনের পুনর্গঠন।

শেষ পর্যন্ত, কোন সত্যিকারের ‘ক্ষতিপূরণ’ ঘটবে না যদি আমরা “স্বীকারোক্তি” তথা সত্য বলতে না পারি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ক্ষতিপূরণ ছিল একটি নিঃশর্ত দায়িত্বের অংশ— অসীম অকাট্য জিনিসের অংশ যা জীবন, সকল জীবন; ঋণের সেই রূপের অংশ যা ছিল সত্যের ঋণ।

সত্যি বলতে গেলে ইউরোপ আমাদের কাছ থেকে এমনসব জিনিস নিয়েছিল যা ইউরোপ কখনও পুনরায় ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবে না। আমরা এই ক্ষতি নিয়েই বাঁচতে শিখব। তবে ইউরোপকে তার কৃতকর্মের দায় নিতে হবে, আমাদের অংশীদারিত্বের ইতিহাসের সেই ছায়াময় অংশের, যা ইউরোপ অস্বীকার করে চলেছে বা যা থেকে নিজেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে ঝুঁকিটি হলো নিজের কৃতকর্মের কৈফিয়ত না দিয়ে ইউরোপ আমাদের যেসব জিনিস নিয়েছিল, তার ক্ষতিপূরণ দেয়ার মাধ্যমে ইউরোপ যেন বলতে চায়, ক্ষতিপূরণ সম্পন্ন হলেই যেন আমরা সত্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলব। নতুন সম্পর্ক বোনার ক্ষেত্রে ইউরোপকে অবশ্যই সত্যকে সম্মান করতে হবে, কারণ সত্যই দায়দায়িত্বের শিক্ষক। সত্যের এই ঋণকে কখনোই নীতিগত বিষয় হিশেবে মুছে ফেলা যাবে না। এটি আমাদের শেষ অবধি তাড়িয়ে বেড়াবে।

সত্যকে সম্মান করা একসাথে শেখার এবং মনে রাখার প্রতিশ্রুতি সমেত আসে। এডুয়ার্ড গ্লিসান্ত কখনোই পুনরাবৃত্তি করা থেকে বিরত হননি, আমাদের প্রত্যেকেরই অন্যের স্মৃতি দরকার। এটি সদকা কিংবা করুণার বিষয় নয়। এটি এই বিশ্বের আমাদের বেঁচে থাকার শর্ত। আমরা যদি বিশ্বের সৌন্দর্য ভাগ করতে চাই, এডুয়ার্ড গ্লিসান্ত হয়তো যোগ করবেন, সমস্ত দুর্দশা নিয়েই আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া শিখতে হবে। আমাদের একসাথে মনে রাখতে শিখতে হবে, এবং এই কাজটি করে বিশ্বের বুনন এবং এর দৃশ্যধারণ মেরামত করতে শিখতে হবে। ক্ষতিপূরণ সর্বদা অসম্পূর্ণই থাকবে। কিছু ক্ষতি অপূরণীয় যা কোন ক্ষতিপূরণের মাধ্যমেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়— যার অর্থ আবার এই নয় যে ক্ষতিপূরণের কোন দরকার নেই। ক্ষতিপূরণ লাভ করার অর্থ, অন্যায় মুছে ফেলা নয়। ক্ষতিপূরণ দেয়ার অর্থ হচ্ছে, কোয়ামে এন্থনি আপিয়া (Kwame Antony Appiah) যেটা চিহ্নিত করেন, সম্পর্ক মেরামতের প্রস্তাব রাখা।

শিল্পী: রবার্ট কোলেসকট

[অনুবাদকের নোট:

* প্ল্যানেটারি: সাক্ষাৎকারে আশিল এমবেম্বের কেন্দ্রীয় একটি ক্যাটাগরি Planerary; এর বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে ‘গ্রহীয়’ কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে ‘গ্রহ সংক্রান্ত/সম্পর্কিত’। জলবায়ু সংকট, অতিমারি, সার্বিক পরিবেশ বিপর্যয় ও বিউপনিবেশায়ন সংক্রান্ত দার্শনিক ও ঐতিহাসিক লেখাপত্রে ‘গ্রহীয়’ বর্গটির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এর গুরুত্ব ও অর্থগত তাৎপর্য সম্পর্কে আমাদের মনোযোগের দাবি রাখে।

ভূ-ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানে (Earth System Science) Planetary (গ্রহীয়) ও Global (বৈশ্বিক) বর্গদ্বয় পৃথক পৃথক অর্থ নির্দেশ করে। ‘বৈশ্বিক’ বর্গটি মনুষ্যকেন্দ্রিক বর্গ। ‘আধুনিক’ মানুষের যাবতীয় রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি কেন্দ্রিক চিন্তা ও তৎপরতা দাঁড়িয়ে আছে ‘প্রকৃতি বনাম সংস্কৃতি’র এক কৃত্রিম বিভাজনের ওপর; যেখানে ধরেই নেয়া হয় মানুষ হচ্ছে ‘সংস্কৃতি’ আর মানুষ ভিন্ন এই গ্রহের অপরাপর স-জীব ও অ-জীব সত্তা ‘প্রকৃতি’ এবং ‘প্রকৃতি’র কাজ হচ্ছে মানুষী-আয়োজনের কাঁচামাল/রসদের জোগান দেয়া। অর্থাৎ মনুষ্য-কল্পিত সমাজ-দুনিয়ার প্রয়োজন মেটানো ভিন্ন এই গ্রহের বাদবাকি সত্তার কোন তাৎপর্য নেই। ‘আধুনিকতাবাদী’ সমস্ত চিন্তা ও দর্শনই এ ধরনের ভাবনার অংশীদার; যা’কে আজকাল ‘মনুষ্য-কেন্দ্রিকতা’ হিশেবে অভিহিত করা হয়। গ্লোবাল তথা ‘বৈশ্বিক’ প্রত্যয়ের মাধ্যমে এই মানুষী-দুনিয়াকেই ধরা হয়।

‘বৈশ্বিক’, তার মানে, আবশ্যিকভাবে একটি মনুষ্য-নির্মিত অবকাঠামোর দুনিয়াকে বোঝায়। অর্থাৎ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশায়ন ও পুঁজির সঞ্চালন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তামাম ভূগোলকে অখণ্ড ‘বিশ্বে’ বাঁধার যে বয়ান ও পরিকাঠামো, ‘global’  তারই দ্যোতক। তার মানে আমরা বলতে পারি, ‘global’ একটি মনুষ্য-কল্পিত ‘বিশ্ব’ (‘কাল্পনিক’ বা ‘অলীক’ বলা হচ্ছে না; ‘কল্পিত’ অর্থাৎ বিশেষ ও বাস্তব সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান আর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তামাম ভূগোলের বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিকতা, লেনদেন ও সমসাময়িক অস্তিত্বের বোধ তৈরি করা); মানুষ যার কেন্দ্রে। ফলে Globalization তথা গ্লোবায়নের ইতিহাস ও বিশ্ববীক্ষায় এই গ্রহের সার্বিক আয়োজন মানুষের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজন মেটানোর নিমিত্তে সজ্জিত। এ ধরনের চিন্তা আজ এতটাই উৎকট চেহারা ধারণ করেছে যে, এ’কে কেবল ‘মনুষ্যকেন্দ্রিক’ চিন্তা বলাই আর‍ যথেষ্ট নয়; বরং এ’কে ‘মনুষ্যসর্বস্ব’ চিন্তা বলাই যুক্তিযুক্ত।

‘মানুষী’ এই বিশ্ববীক্ষার পাটাতনে দাঁড়িয়ে যারা সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে জরুরি ও সঙ্গত লড়াই করেন, তাদের ভাবিত ও অধীত বিষয় মানুষে মানুষে পার্থক্য ও বৈষম্য। মানুষে মানুষে পার্থক্য ও বৈষম্যজনিত অন্যায়ের অবসান ঘটানোই ‘সামাজিক ন্যায়কেন্দ্রিক’ তৎপরতার লক্ষ্য ও অন্তিম গন্তব্য। ধরেই নেয়া হয় যে, ‘বিপুলা পৃথিবী’র অফুরন্ত ভাণ্ডার মানুষী-যজ্ঞ মেটানোর জন্য সদা-প্রস্তুত। ব্রুনো লাতুর কথিত উল্লেখিত প্রকৃতি বনাম সংস্কৃতির এক আশ্চর্য মহাবিভাজনের ওপর দণ্ডায়মান এই জগৎবীক্ষা; যেখানে ‘প্রকৃতি’র কাজ কেবল মানুষী ভোগ-বিলাস নিশ্চিত করা। আবার আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যারা সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে নিঃশর্ত, তাদের কাজ হয়ে দাঁড়ায় আইনগত ও অর্থনৈতিক বণ্টনে সাম্য ও সুষমতা নিশ্চিত করা। কিন্তু রসদের পর্যাপ্তি নিয়ে মনুষ্যবাদীদের কোন প্রশ্ন নেই। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:

“পৃথিবীর কাছে ও অন্য প্রাণীর কাছে মানুষের যে কী এবং কত পরিমাণে ঋণ, মানুষ যেন ভেবেছিল তা সম্পূর্ণ ভুলে মেরে দিয়েও নিজের ক্ষমতা, সুখস্বাচ্ছন্দ্য আর মুনাফা অনির্দিষ্ট ভাবে বাড়িয়ে চলবে। এই সহজ কথাটাও মনে থাকে না, যে অক্সিজেন ব্যতীত আমরা বাঁচতামই না, তাও বাতাসকে জোগান দেয় নানান ‘মনুষ্যেতর’ প্রাণী, এবং এই পৃথিবী গ্রহটির নানান প্রক্রিয়া। এই ভুলে-যাওয়াটার প্রথম শুরু ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দিনগুলোতে, ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার সূচনায়। তার পর সেই পশ্চিম-প্রদর্শিত পথে অন্যান্য দেশের নেতারাও হেঁটেছেন।

অনেক দিন ধরে শিল্প-সভ্যতার সমাজপতি মানুষেরা, তাঁরা শিল্পপতিই হন বা দার্শনিক— মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন মর্তেই স্বর্গরচনার। পন্থা নিয়ে অবশ্যই তর্ক হয়েছে— ধনতন্ত্র না সমাজতন্ত্র, রক্তক্ষয়ী বিপ্লব না শান্তিপূর্ণ পথ, মুক্ত বাজারের অর্থনীতি না কি রাষ্ট্রের মালিকানায় শিল্প, এই সব আলোচনা। যুদ্ধ-বিগ্রহ-বিপ্লবী হিংসা। তবু মানুষ নিজের অবস্থার উন্নতিকেই, কবির ভাষায়, ‘পৃথিবীর ক্রমমুক্তি’ বলে ভুল করেছে। যেন পৃথিবীটা, সেই কবীর সুমনের গানের কথার মতো, ‘সব আমাদের জন্য, আমাদেরই জন্য।’ পৃথিবীতে প্রাণের আয়োজন কিসে বজায় থাকে, বন্যপ্রাণী বা গাছগাছালি না থাকলে মানুষের কী ক্ষতি, সে সব ভুলে শুধু নিজের অবস্থার লাগামছাড়া উন্নতির সাধনায় মানুষ ডেকে এনেছে নিজেরই সর্বনাশ। কৃষিজমি, বাসস্থান, ফসলজাত জ্বালানি, খনিজ পদার্থ ইত্যাদির খোঁজে ক্রমাগত জঙ্গল কেটে ফেলায় আমরা এসে পড়েছি এক অতিমারির যুগে, যখন ঘন ঘন অতিমারির আক্রমণ সম্ভব। আর জঙ্গল কেটে ফেলার সঙ্গে শুধু যে ভাইরাসের কথা বা বন্যপ্রাণীর ঘরছাড়া হওয়ার গল্প জড়িয়ে আছে তা নয়, জড়িয়ে আছে যে সব গ্যাস বাতাসে নির্গত হয়ে পৃথিবীর উপরিভাগের তাপমাত্রা বাড়ায়, সেই সব গ্রিনহাউস গ্যাসেরও গল্প। অর্থাৎ, আজকের অতিমারি আর পৃথিবীর উষ্ণতাবৃদ্ধি, দু’টি আলাদা কাহিনি নয়। আমাদের সার্বিক সঙ্কটেরই দু’টি ভিন্ন প্রকাশ।” (দীপেশ ২০২১ খ)

সূত্র: স্কুল ফর এনভারেনমেন্ট এন্ড সাস্টেইনেবিলিটি; ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান এর ওয়েবসাইট

অপরদিকে, প্ল্যানেটারি তথা গ্রহীয় ইতিহাসবীক্ষা ‘প্রকৃতি বনাম সংস্কৃতি’র এই আবশ্যিক বিভাজনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও সমস্যায়িত করে। গ্রহীয় ইতিহাসবীক্ষায় মানুষ আর এই গ্রহের কেন্দ্রে নয়; এর ‘সমাজ’ কল্পনাও কেবল মানুষকে ঘিরে নয়। মানুষ ছাড়াও এই গ্রহের সার্বিক জীব ও জড়-সত্তার অস্তিত্ব ও কর্তৃত্ব গ্রহীয়-শাস্ত্রে বিপুলভাবে স্বীকৃত। ফলে গ্রহীয়-শাস্ত্রে সঙ্গত কারণেই ‘না-মানুষ’ (non-human) এজেন্সিকে কেন্দ্রে রেখে এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডকে ব্যাখ্যা করা হয়। অর্থাৎ, ‘গ্রহীয়’ ঐতিহাসিক-দার্শনিক ক্যাটাগরিতে এসে মানুষ কেন্দ্রচ্যুত হয়ে যায় এবং এই গ্রহের সার্বিক জীবনের প্রসঙ্গ মুখ্য হয়ে ওঠে। গ্রহীয়-বিজ্ঞান ও ইতিহাসেও মানুষ প্রসঙ্গ গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়, কিন্তু মানুষকে এই গ্রহের নায়ক ধরে নিয়ে নয়; বরং সার্বিক জীবনের ইতিহাসের অংশ হিশেবেই ‘মানুষ’ পঠিত হয়।

প্রকৃতপক্ষে, আজ ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তির (sixth great extinction) এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষের এই প্রবল আত্মকেন্দ্রিকতা বিষয়ে কার্যকর প্রশ্ন না উঠে পারে না। মানুষই তুলছে প্রশ্ন। যে ছকে এতদিন মানব-অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করার চল ছিল, তার বিপদ সম্পর্কে নানা শাস্ত্র আজ ওয়াকিবহাল। মানুষকে মহাবিশ্ব ও ইতিহাসের নায়ক ধরে নিয়ে সাম্য, স্বাধীনতা, মুক্তির বাণীতে মূর্ছিত হওয়া বিষয়ে সন্দেহ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। অতিমারি বা সার্বিকভাবে পরিবেশগত সংকটের ফলে মানুষী–যজ্ঞ সংকোচনের কথা উঠছে। যে ধরনের ইতিহাস ও তত্ত্ব চর্চা এই গ্রহের ওপর মানুষের সার্বভৌমত্ব/উপনিবেশ নাকচ করে দিয়ে মানুষকে আর দশটা প্রজাতির মতো এক প্রজাতি; অর্থাৎ মানুষের ‘ভূ–তাত্ত্বিক কর্তাসত্তা’ (geological agency)-কে ‘জীবতাত্ত্বিক কর্তাসত্তা’ (biological agency)-তে সংকুচিত করবে; ইতিহাসের ‘নায়ক’ হিসেবে মানুষকে বিবৃত না করে সার্বিক জীবনের ইতিহাসে মানুষকে অবস্থিত করবে; তেমন ইতিহাস ও তত্ত্ব-চর্চার জরুরতকে আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, প্ল্যানেটারি তথা গ্রহীয় ইতিহাস, বিজ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষ আর সমস্তকিছুর কেন্দ্রে নয়।

তাহলে এক্ষেত্রে ইতিহাস, দর্শন ও তত্ত্ব-চর্চার কাজ বা ভূমিকা কী?  বর্তমান সময়কে যিনি ‘Planetary age’ তথা ‘গ্রহীয় যুগ’ (Chakrabarty 2021) হিশেবে অভিহিত করে থাকেন— সেই ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর মতে— গ্রহীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে জীববৈচিত্র‍্যের সঙ্গে মনুষ্য-সভ্যতার সম্পর্ক ভাবাই নতুন ইতিহাস-চর্চার কাজ (দীপেশ ২০২১ক)। প্রথাগত পুঁজিবাদের বিশ্লেষণে যে সকল বিদ্যার অধ্যয়ন করতে হয়; যেমন ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, সাহিত্য ইত্যাদির সাথে ভূ-তত্ত্ব, জেনেটিক, জীববিজ্ঞান, জীব ও প্রাণের ইতিহাস সংশ্লিষ্ট নানাবিধ বিদ্যা অধিগত করতে হয়।

অর্থাৎ পুঁজির ইতিহাসের সঙ্গে পৃথিবী ও প্রাণের ইতিহাস এক বিন্দুতে এসে পৌঁছানোর ফলে গ্লোবাল ও প্ল্যানেটারি তথা বৈশ্বিক ও গ্রহীয়’র যুগপৎ বোঝাপড়ার কোন বিকল্প নেই। এই অপারগ ও নিরুপায় পরিস্থিতি মানবতাবাদী সমাজ-তাত্ত্বিককে বিজ্ঞানের সাথে এবং ইতিহাসবিদকে সময়ের প্রচলিত ধারণার সাথে নতুন সংলাপে লিপ্ত হওয়ার দিকে ধাবিত করছে। ফলে এই নতুন পরিস্থিতি অনুধাবন ও মোকাবেলায় পুনর্গঠিত বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই বিশ্ব-নাগরিককে স্ব-স্ব নৈতিক ও রাজনৈতিক বর্গসমূহকে বাছাই করতে হবে বলে আমরা মনে করি। বর্তমান অনূদিত সাক্ষাৎকারেও আশিল এমবেম্বের প্রধান তর্কের জায়গা এটাই যে, বর্তমান সময়ের যে-কোন ধরনের বিউপনিবেশায়ন প্রকল্পের অভিমুখ গ্রহীয় পর্যালোচনার দিকে হতে বাধ্য।

** অ্যান্থ্রোপসিন: শব্দটির ব্যবহার সাম্প্রতিক। মূলত এই শব্দের দ্বারা মনুষ্য নিয়ন্ত্রিত সম্পূর্ণ নতুন এক ভূতাত্ত্বিক যুগের উত্থানকে বোঝানো হয়। অ্যান্থ্রোপসিন বলতে মনুষ্যকেন্দ্রিক এমন এক ভূতাত্ত্বিক কালপর্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়, যখন মানুষ তার সংখ্যা, ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার অর্থাৎ মানুষী ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে পৃথিবীর সার্বিক স-জীব ও অ-জীব উপাদান, পরিবেশ প্রতিবেশ ও জলবায়ুর ভয়াবহ বিপন্নতার সম্ভাবনা তৈরি তথা খোদ একটি গ্রহের চেহারা পাল্টে দিতে সক্ষম এক ভূতাত্ত্বিক ক্ষমতা (geological agent) হয়ে উঠেছে। অ্যান্থ্রোপসিন এমন এক যুগ যখন মানুষই পৃথিবী নামক এই গ্রহের একমাত্র ভূতাত্ত্বিক শক্তি। এছাড়াও, অ্যান্থ্রোপসিন মানুষী ক্রিয়াকলাপের এমন এক নেতিবাচক বিবরণী হাজির করে যেখানে মানুষের সর্বগ্রাসী সর্বময়তার দরুন এক আপামর বিপর্যয় খোদ মানুষী অস্তিত্বকেই হুমকির মুখোমুখি করছে; বিশেষত জলবায়ু সংকটের বাস্তবতায়।

মানুষের সচেতন সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের ফলে পৃথিবীব্যাপী লক্ষাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবী নামক এই গ্রহের নজিরবিহীন রূপান্তর লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক গবেষণার বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, মানবসৃষ্ট বস্তুর ওজন জীবসমষ্টিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নজিরবিহীন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে (Briggs 2020)।  সব মিলিয়ে এই গ্রহের সার্বিক জীবনের ওপর মানুষী ক্রিয়াকলাপের ফলে যে এক সম্পূর্ণ হতবুদ্ধিকর বাস্তবতার তৈরি হয়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।]

অনুবাদকের রেফারেন্স:

দীপেশ চক্রবর্তীঃ দীপেশ চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার: “জীববৈচিত্র‍্যের সঙ্গে মনুষ্য সভ্যতার সম্পর্ক ভাবাই নতুন ইতিহাস চর্চার কাজ”, সাক্ষাৎগ্রহণকারী: সারোয়ার তুষার, অরাজ, ঢাকা, ২০২১ক

—: ‘মানব-প্রজাতির লাগামছাড়া আত্মকেন্দ্রিকতায় আজ এ গ্রহ বিপন্ন’, আনন্দবাজার, কলকাতা, ২২ আগস্ট, ২০২১খ

Briggs, Helen. “Human-made objects to outweigh living things”, BBC, 09 December, 2020

Chakrabarty, Dipesh. Climate of History in a Planetary Age, Chicago: Chicago University Press, 2021.

সারোয়ার তুষার