অরাজ
আর্ট: এনার্কি আর্টিস্ট: আলেক্সি মোরজ
প্রচ্ছদ » হাওয়ার্ড জিন।। এমা গোল্ডম্যান: জীবন ও রাজনীতি

হাওয়ার্ড জিন।। এমা গোল্ডম্যান: জীবন ও রাজনীতি

  • অনুবাদ: মাজহার জীবন

অনুবাদকের ভূমিকা: এমা জীবনীভিত্তিক নাটক। এই নাটকের প্রধান চরিত্র এমা গোল্ডম্যান বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আমেরিকা আর ইউরোপে অ্যানার্কিস্ট রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম প্রচারক। জন্ম বর্তমান ১৮৬৯ সালে লিথুনিয়ায় হলেও পরিবারের সাথে ১৮৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান। শিকাগোর হে মার্কেটে শ্রমিকদের উপর গুলিবর্ষণের ঘটনার পর এমা অ্যানার্কিস্ট আন্দোলনে আকৃষ্ট হন। বন্ধুত্ব ও ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে আরেক অ্যানার্কিস্ট আলেকজান্ডার বার্কম্যানের সাথে। ‘রেড এমা’ আর ‘বিদ্রোহী নারী’ নামে খ্যাত এমা নারীমুক্তি, মুক্তচিন্তা, মুক্তভালবাসা, বিবাহসম্পর্ক, হোমোসেক্সুয়ালিটি ইত্যাদি প্রসঙ্গ সামনে এনে আমূল পরিবর্তনবাদী রাজনীতি এবং নারীর স্বার্থ তুলে ধরেছেন। পুঁজিবাদ, সামরিকায়ন, কারাগার ব্যবস্থাপনা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রভৃতি ইস্যুতে অ্যানার্কিস্ট আন্দোলনে জড়িত থাকায় জেল খাটতে হয়েছে কয়েকবার। শেষে আমেরিকা থেকে বহিষ্কার করে রাশিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। ৭০ বছর বয়সে কানাডায় তাঁর মৃত্যু হয়। হাওয়ার্ড জিন এমা নাটকে এমা গোল্ডম্যানের বৈচিত্রময় জীবনের এক বড় অংশ তুলে এনেছেন সাহিত্যিক দক্ষতায়। হাওয়ার্ড জিন (১৯২২ – ২০১০) আমেরিকান ইতিহাসবিদ, নাট্যকার, দার্শনিক এবং সমাজচিন্তক। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি। স্পেলম্যান কলেজ ও বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। বই লিখেছেন ২০টির অধিক যার মধ্যে অন্যতম আ পিপলস হিস্ট্রি অব দ্যা ইউনাইটেড স্টেটস। এখানেএমা নাটকের ভূমিকার অংশ বিশেষ প্রকাশিত হলো।   

Howard Zinn — Daniel Baxter Art
হাওয়ার্ড জিন

মূল ভূমিকা : এমা 

আমার মতোই আরেক ইতিহাসবিদ রিচার্ড ড্রেনোনের মাধ্যমে এমা গোল্ডম্যানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় (যদিও ব্যক্তিগত না)। ষাটের দশকের প্রথমদিকে পেনসিলভেনিয়ার এক কনফারেন্সে ড্রেনোনের সাথে আমার পরিচয়। তিনি আমাকে জানান, রেভেল ইন প্যারাডাইস  নামে এমা গোল্ডম্যানকে নিয়ে তিনি একটি জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন। বাড়িতে ফিরে এসে আমি বইটি পাই এবং পড়ে ফেলি। আমার মুগ্ধতা বাড়তে থাকে আমেরিকার ইতিহাসের সাথে জড়িত এই বিস্ময়কর নারীর প্রতি। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম আমেরিকার ইতিহাসের সংক্রান্ত আমার যাবতীয় কাজে, তা সে স্নাতক কি স্নাতকোত্তর পর্যায়েই হোক না কেন, এমার নামটি কখনো উঠে আসেনি।

এই ধরনের অনেক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছাড়ার পর যে সকল ব্যক্তি ও ঘটনা সাধারণত ট্র্যাডিশনাল ইতিহাস কারিকুলামে কখনই অন্তর্ভুক্ত হয়নি সেগুলো পড়তে শুরু করি। যেমন: মাদার জোনস্, বিগ বিল হেইউড, জন রিড, লুডলো হত্যাযজ্ঞ, লরেন্স টেক্সটাইল ধর্মঘট, হে মার্কেটের ঘটনাবলী এমন আরও অনেক বিষয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর জন্য প্রেসিডেন্ট, শিল্পপতি, সমরনায়কদেরই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নেয়া হয়। শ্রমিকনেতা, বিপ্লবী, সমাজতন্ত্রী, অ্যানার্কিস্টদের উপেক্ষা করা হয়। এমা গোল্ডম্যানও এই উপেক্ষিতদের একজন।

এরপর আমি এমা গোল্ডম্যানের আত্মজীবনী লিভিং মাই লাইফ পড়তে উদ্বুদ্ধ হই। রাশিয়ার অ্যানার্কিস্ট পিটার ক্রপোটকিন ও মিখাইল বাকুনিনের লেখা পড়ি। এভাবে রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে অ্যানার্কিজমের ওপর আমার আগ্রহ তৈরি হয়। আমি বুঝতে পারি, এটা একাডেমিক জগতের গতানুগতিক অর্থোডক্স রাজনৈতিক তত্তে¡র বাইরের বিষয়।

১৯৬৪ সালে শরৎকালীন সেশনে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগ দিয়ে দর্শনের একজন নতুন ফ্যাকাল্টির সাথে পরিচিত হই। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেছি শুনে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-আপনার রাজনৈতিক দর্শন কী ?

আমি হালকাভাবে উত্তর দিলাম-অ্যানার্কিজম।

তিনি তীর্যকভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-অসম্ভব।

১৯৭৪ সালে প্যারিসে অধ্যাপনার সময় একবার আমস্টারডাম গিয়ে  সেখানকার ইন্টারন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অব সোস্যাল হিস্টোরিতে যাই। সেখানে এমা গোল্ডম্যান ও আলেকজান্ডার বার্কম্যানের চিঠিপত্রের এক বিশাল ধনভাণ্ডারের সন্ধান পাই- যেগুলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে তাঁরা আমেরিকা থেকে নির্বাসিত হয়ে ইউরোপে এসে পরস্পরকে লিখেছিলেন। চিঠিগুলো আমার সাধ্যমতো একটা অবিন্যস্ত নোটবইয়ে কপি করি কিন্তু ফেরত আসার পর দেখি রিচার্ড আর আনা মারিয়া ড্রেনোন একই বিষয়ে কাজ করেছেন। এবং তারা নো হোইয়ার এট হোম নামে গোল্ডম্যান-বার্কম্যানের চিঠিপত্রের একটা সংকলন প্রকাশ করেছেন।

যদিও ষাট ও সত্তরের দশকের প্রথম দিকে আমার জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় হয়, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে-বক্তৃতা দিয়ে, বিক্ষোভে অংশ নিয়ে, জাপান ও ভিয়েতনামে ভ্রমণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আমেরিকান আগ্রাসনের ব্যাপারে লেখালেখি করে। ১৯৭৫ সালে যুদ্ধ শেষ হলে এতদিন ধরে যা চাইছিলাম, এমা গোল্ডম্যানের ওপর অবশেষে একটা নাটক লেখার সুযোগ পাই।

Emma by Howard Zinn

এমা  নাটকটিতে বাস্তবতার কারণেই গোল্ডম্যানের বৈচিত্র্যময় জীবনের একটা অংশ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ১৮৬৯ সালে লিথুনিয়ার কভনোতে জন্মগ্রহণ করেন। তখন এটি রাশিয়ার অংশ ছিল। তাঁর স্মৃতিতে দরিদ্র ইহুদি জীবনের দুঃখের স্মৃতি আর সাথে সাথে জীবনকে আনন্দময় করে তোলে এমন ঘটনার দেখা পাওয়া যায়। আবেগপূর্ণ সম্পর্কে জড়ানোর ব্যাপারে তিনি খুব খোলামেলা ছিলেন। তাঁর জীবনের প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। একটা ছোট মেয়ে হয়ে তিনি কীভাবে গ্রামের এক যুবকের কাছে বারবার ধরা দিয়েছেন। কোনিংসবার্গে তাঁর ধনী আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে অপেরা দেখার অভিজ্ঞতা বলেছেন। বলেছেন অপেরায় ভার্দির কনসার্ট দেখতে দেখতে হল ভর্তি মানুষের মাঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার কথা।

তাঁর পরিবার এক সময় যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন গ্রহণ করে। তাঁরা রোচেস্টার আর নিউইয়র্কের ইহুদি বলয়ে বসবাস করতেন। মাত্র ষোল বছর বয়সে এমা একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করেন। তিনি দ্রুততর সময়ের মধ্যে এক যুবককে বিয়ে করে ফেলেন, যার সাথে তাঁর কোনো ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না। বিয়েটাকে তিনি ফলপ্রসু করতে ব্যর্থ হন। এমার বাবা ছিলেন অত্যাচারী। তাই অল্প বয়সেই বাবা ও স্বামীর সুবাদে তিনি নারীদের অধীনস্ততার বিষয়টি অবগত হন। আর মাত্র সতেরো বছর বয়সে শিকাগো শহরের শ্রমিকদের দৈনিক আটঘন্টা কাজের দাবিতে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৮৮৬ সালের হে মার্কেট আন্দোলনের ঘটনাবলী এসব আন্দোলনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

এ আন্দোলনের উৎস ছিল ইন্টারন্যাশনাল হার্ভেস্টার কোম্পানির বিরুদ্ধে ধর্মঘট, যেখানে পুলিশ বেশ কয়েকজন ধর্মঘটী শ্রমিককে হত্যা করে। শিকাগোর অ্যানার্কিস্ট আন্দোলন তখন তুঙ্গে। তারা হে মার্কেট স্কয়ারে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। সভাটি শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু কিছু পুলিশ সভাটি পণ্ড করার চেষ্টা করলে পুলিশের ওপর একটা বোমা ফাটানো হয়। এতে ৬৬ জন পুলিশ আহত হন, যার মধ্যে ৭ জন পরে মারা যান। এতে পুলিশ জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে, ফলে বেশ কয়েকজন মারা যায় আর আহত হয় দুশোর মতো।

সেই বোমাটি কে নিক্ষেপ করেছিল তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি (এটা আজ পর্যন্ত রহস্যই রয়ে গেছে)। কিন্তু পুলিশ শিকাগোতে আটজন অ্যানার্কিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে। ইন্টারন্যাশনাল হার্ভেস্টার কোম্পানির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে অ্যানার্কিস্টদের প্রচারিত সার্কুলার ‘রিভেঞ্জ’, যা বিচারকদের মতে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা ছড়িয়েছে। ফলে ঐ বোমা বিস্ফোরণের দায় অ্যানার্কিস্টদের ওপর চাপিয়ে আটজনকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়া হয়।

এই ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষে সারা ইউরোপজুড়েই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ইলিনয়ের সুপ্রিম কোর্টে তাদের আবেদন নাকচ হয়ে গেলে জর্জ বার্নাড শ লেখেন, ‘দুনিয়াকে যদি তার আটজন সদস্যকে হারাতেই হয়, তবে সেই আটজন ইলিনয়ের সুপ্রিম কোর্টের হলেই ভালো।’ তাদের মধ্যে একজন জেল প্রকোষ্ঠে নিজেকে উড়িয়ে দেয়। গর্ভনর জন পিটার আল্টগেল্ট তিনজনকে ক্ষমা করে দেন। (পরে তিনি হাওয়ার্ড ফাস্টের ঐতিহাসিক উপন্যাস দি আমেরিকান-এর একটি চরিত্র হন)। আর চার জনের ফাঁসি কার্যকর হয়।

এ সব ঘটনা তরুণ এমার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি রোচেস্টারে তাঁর পরিবার ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে স্বামী, চাকরি ও পরিবার ছেড়ে তিনি নিউইয়র্কে চলে আসেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল নতুন শহরে তিনি স্বাধীনভাবে বসবাস ও চলাফেরা করতে পারবেন। সেখানে তিনি একদল তরুণ অ্যানার্কিস্টের সংস্পর্শে আসেন। যাদের মধ্যে অন্যতম আলেকজান্ডার বার্কম্যান। বার্কম্যান নিজেও রাশিয়া থেকে অভিবাসিত হয়ে আমেরিকায় আসেন। নতুন সমাজ গড়ার এক নিবেদিতপ্রাণ পুরুষ ছিলেন তিনি। এমা ও সাশা (বার্কম্যান বন্ধুদের কাছে এই নামে পরিচিত ছিলেন) ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন।

জার্মান বিপ্লবী জোহান মোস্ট। তিনি রাইখস্ট্যাগের (জার্মান সংসদ) সদস্য ছিলেন এক সময়। দীর্ঘদিন জেলে কাটিয়েছেন। অ্যানার্কিজম প্রতিষ্ঠার পক্ষে বক্তৃতার জন্য তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। এমা ও সাশা দুজনই এই বিপ্লবীর দ্বারা প্রভাবিত হন। মোস্টের সাথে এক পর্যায়ে এমার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর ফলে এমা ও সাশার মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়।

এমা ম্যানহাটনে একটা কারখানায় চাকরি জোগাড় করে সেখানে অভিবাসী শ্রমিকদের (অধিকাংশ নারী) সংগঠিত করা শুরু করেন। ১৮৯২ সালে পেনসিলভেনিয়ার হোমস্টিড শহরে জনৈক এন্ড্রু কার্নেগির স্টিল মিলের বিরুদ্ধে শ্রমিকেরা ধর্মঘটের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মিলগুলোর দায়িত্বে ছিলেন নিষ্ঠুর হেনরি ক্লে ফ্রিক (পরবর্তী কালে তিনি কার্নেগির মতোই একজন জনহিতৈষী)। ধর্মঘট দমনের জন্য ফ্রিক পিঙ্কারটন ডিটেকটিভ এজেন্সি ভাড়া করেন। এই এজেন্সি তখন আমেরিকার সবচেয়ে বড় ধর্মঘট দমনকারী প্রতিষ্ঠান ছিল। ধর্মঘটের এক পর্যায়ে তারা রাইফেল ও মেশিনগান দিয়ে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে যার ফলে সাত জন শ্রমিক মারা যায়।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এমা, সাশা ও আরও কয়েকজন কমরেড প্রতিশোধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের এই সাহসী প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকে দেখানো যে, বৃহৎ শিল্প কলকারখানাগুলোও নিরাপদ নয়। তাঁরা হেনরি ক্লে ফ্রিককে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। সাশা এ কাজ সম্পাদনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং তা একাই। সেজন্য তিনি পিটসবার্গে চলে আসেন। ফ্রিকের অফিসে জোর করে ঢুকে পড়েন। এবং গুলি করতে থাকেন। সাশা ঘাতক হিসেবে নিতান্তই অপটু ছিলেন। তাঁর ছোড়া গুলি ফ্রিককে কেবল আহত করতে সক্ষম হয়। তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁর বিচারকার্য অতি দ্রুত সম্পন্ন করা হয়। তাঁর ২২ বছরের নির্বাসন হয় পেনসিলভানিয়ার স্টেট জেলে। জেল জীবনে তাঁর লেখা প্রিজন মেমোয়রস অব এন অ্যানার্কিস্ট একটা ক্লাসিক কারাসাহিত্য।

জেল জীবনে সাশা নানাভাবে কারাপ্রশাসনের আদেশ-নিষেধ অমান্য করতে থাকেন। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাঁকে এবং তাঁর শাস্তিও বেড়ে যায়। কারা কর্তৃপক্ষের অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেক কয়েদি আত্মহত্যা করে। সাশা নিশ্চিত ছিলেন না শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকবেন কিনা। তাঁর এই হতাশার কথা এমা ও তাঁর বন্ধুদের জানান। তাঁরা সবাই মিলে সাশাকে জেল থেকে বের করে আনার এক অবাস্তব পরিকল্পনা করেন। জেলখানার খুব নিকটে একটা বাড়ি ভাড়া করেন তাঁরা। সেখান থেকে একটা টানেল খোঁড়া শুরু করেন যা জেলখানার উঠান পর্যন্ত খননের পরিকল্পনা করা হয়। একজন কমরেড গর্ত খোঁড়ার শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে পিয়ানো বাজাতেন, যাতে টানেল খোঁড়ার শব্দ শোনা না যায়। কিন্তু টানেল খোঁড়া প্রায় শেষ হয়ে আসার এক পর্যায়ে তা কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে। সাশাকে এর জন্য চরম অত্যাচার করে কারা কর্তৃপক্ষ।

বার্কম্যান জেলে থাকার সময় এমা মানুষকে সংগঠিত করা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। ১৮৯৩ সালে মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। শহরগুলোতে শতশত শিশু না খেয়ে অসুস্থ হয় পড়ে ও অনেকে মারা যায়। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে এমা ইউনিয়ন স্কয়ারে কর্তৃপক্ষের কাছে আর্জি বা আইনের জন্য অপেক্ষা না করে খাদ্যের দোকান লুট করে খাবার সংগ্রহের আহ্বান জানান প্রতিবাদ সমাবেশে। এটা ছিল অ্যানার্কিস্টদের ‘ডাইরেক্ট একশন’ নীতির অন্যতম দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। এমাকে বক্তৃতা মঞ্চ থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাঁর ব্ল্যাকওয়েল আইল্যান্ডে দু’বছরের জন্য কারাদণ্ড হয়। কারাগারে এমা নার্সিং ও দাইয়ের কাজ শেখেন। এই প্রশিক্ষণ তাঁর বাকি জীবনে কাজে লেগেছিল। (ই. এল. ডকটোরোর র‌্যাগটাইম উপন্যাসে ঐ আমলের এক শোর্গালকে এমা চমৎকারভাবে বার্তা দিচ্ছেন এমন বর্ণনা রয়েছে)।

এদিকে সাশা যখন জেলে শাস্তি ভোগ করছিলেন এমা তখন দ্রুত শ্রমিক ও অ্যানার্কিস্ট আন্দোলনের একজন অন্যতম সংগঠক ও বক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন।

১৯০১ সালে লিওন ক্লোগেজ প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলেকে গুলি করে হত্যা করার পর এমাকে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। ভুলবশত পুলিশের সন্দেহ গিয়ে পড়ে এমার ওপর যে তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন।

বস্তুত এমা যেমনটি ফ্রিকের ঘটনার সময় মনে করতেন হত্যা অ্যানার্কিজমের জন্য যৌক্তিক কিন্তু তিনি এ সময় থেকে তা আর মনে করতেন না। আবার তিনি ক্লোগেজের শাস্তিরও বিপক্ষে ছিলেন। যেমনটি তাঁর অন্যান্য র‌্যাডিক্যাল বন্ধুরাও মনে করতেন। তাঁদের যুক্তি হলো হত্যাকাণ্ড অযৌক্তিক হলেও, মানুষকে বুঝতে হবে হত্যাকারীর ক্ষোভের পেছনে যৌক্তিক কারণ থাকে।

ভালোবাসার স্বাধীনতার দর্শনে বিশ্বাসী এমা এই সময়কালে অনেক প্রেমিকের সংস্পর্শে আসেন। যদিও তিনি আলেকজান্ডার বার্কম্যানের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অব্যাহত রাখেন। ১৯০৬ সালে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাদের বন্ধুত্ব আগের মতোই অব্যাহত থাকে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে যৌন সম্পর্কে ভাটা পড়ে। তাঁরা অ্যানার্কিজমের স্বার্থে পরস্পরের কমরেড হিসেবেই থাকেন এবং দু’জন মিলে মাদার আর্থ জার্নাল প্রকাশ করেন।

১৯০৮ সালে শিকাগোতে বক্তৃতা দেয়ার সময় এমা প্রথমবারের মতো আকর্ষণীয় বেন রেইটম্যানের সাক্ষাৎ পান। যার সাথে পরবর্তীকালে এমার জীবনে ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ আবেগের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ডা. বেন রেইটম্যান মেডিকেল স্কুলে কোনোরকমে পড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। তথাকথিত ডাক্তারদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ ছিলেন তিনি, যা ভাবাও যায় না। তাঁর চুল কালো এবং তিনি সুপুরুষ ছিলেন। কেতাদুরস্ত পোশাক পরতেন। শিকাগোতে একটা স্টোরফ্রন্ট ক্লিনিক খোলেন তিনি যেখানে সাধারণত যৌনকর্মী, ভবঘুরে আর দরিদ্ররা চিকিৎসাসেবা নিতে আসত। তিনি গর্ভপাত করাতেন আর এভাবেই চিকিৎসাসেবা ও সমাজকে বিদ্রুপ করতেন।

রেইটম্যানের যৌনক্ষুধা ছিল তীব্র। তিনি এমার সাথে গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়েন। মাত্র কিছুকাল আগেই আবিষ্কৃত তাদের চিঠিপত্র- এযাবৎকাল লেখা সবচেয়ে উষ্ণ ও খোলামেলা চিঠিপত্রের নজির বহন করে। এমার বয়স ছিল ঊনচল্লিশ আর রেইটম্যানের ঊনত্রিশ বছর। কিন্তু তাঁদের এই বয়সের পার্থক্য ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। লিভিং মাই লাইফ -এমা রেইটম্যানের সাথে সাক্ষাতের বর্ণনা করছেন:

‘ও বিকেলে এলো। যৌন আবেদনময়, চিত্রোপম চেহারার পুরুষ। মাথায় কালো কাউবয় হ্যাট। সিল্কের টাই বাধা, হাতে বড় বেতের ছড়ি-কণ্ঠ গম্ভীর, কমনীয় আর অকৃত্রিম-লম্বা আর সুন্দর গড়নের মাথা যা কোঁকড়ানো কালো চুলে ঢাকা। হয়তো বেশ কিছুদিন ধোয়া হয়নি। চোখ দুটো খয়েরি, বড় এবং স্বপ্নীল। ওর ঠোঁট যখন হেসে ওঠে-সুন্দর দাঁত বের হয়ে আসে: আকর্ষণীয় ও কমনীয়। ও দেখতে সুদর্শন, বুনো। -আমি তার হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারতাম না।’[1]

রেইটম্যানের সাথে সাক্ষাতের কিছুদিনের মধ্যে এমা তাঁকে লেখেন, ‘তুমি আমার নারীত্বের কারাদুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছ। জানা বোঝার জগত আর আমার শরীরের আগুন জ্বালানো বসন্তের মাঝে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বললে আমি বসন্তকেই বেছে নিতাম।’[2]

আর্ট: দি স্ট্রাইক
আর্টিস্ট: রবার্ট কোয়েহলার

এমা শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য রেইটম্যানের ওপর দ্রুত নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। রেইটম্যান এমার সাথে সব জায়গাতেই সফরসঙ্গী হতে থাকেন। তাঁর বক্তৃতার ব্যবস্থাপনার কাজ করেন কিন্তু অন্য নারীর প্রতি তার আসক্তি অব্যাহত থাকে। তারপরও এমা রেইটম্যানের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেননি। এক পর্যায়ে এমা তাঁকে লেখেন: ‘যদি কখনো আমাদের দু’জনের চিঠিপত্র প্রকাশিত হয় দুনিয়া এই ভেবে হতবুদ্ধি হয়ে যাবে যে, আমি, এমা গোল্ডম্যান, একজন পরাক্রমশালী বিপ্লবী, ডানপিটে যে আইন ও কনভেনশনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারে- সে কিনা ফেনিল সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজের একজন অসহায় নাবিক।’[3]

তারপরও এমা গোল্ডম্যান তাঁর নিরবিচ্ছিন্ন বক্তৃতা দেওয়া, বিক্ষোভে অংশগ্রহণ আর সাংগঠনিক কাজকর্ম থেকে কখনো বিরত থাকেননি। তিনি নিরলসভাবে সারা দেশের সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন, অসংখ্য মানুষের সামনে বক্তৃতা করেছেন-জন্মনিয়ন্ত্রণ (একজন নারীর তার নিজের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত), প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবাহের সমস্যাবলী (ভালোবাসার সাথে বিবাহের কোনো সম্পর্ক নেই), দেশপ্রেম (ধনীলোকের শেষ আশ্রয়স্থল), মুক্ত ভালোবাসা (যদি মুক্তই না হয় তাহলে কীসের ভালোবাসা) এবং স্ট্রিন্ডবার্গ, ইবসেন ও বানার্ড শ এর নাটক।

তিনি বারবার গ্রেফতার হয়েছেন কেবল বক্তৃতা করার অপরাধে। ১৯০৮ সালে শিকাগোতে তাঁকে মঞ্চ থেকে গ্রেফতার করা হয়। শিকাগো ট্রিবিউন এর এক সাংবাদিক এই ডায়লগ লিপিবদ্ধ করেন: ‘এখানে এসে ঝামেলা পাকাবেন ভেবেছেন?’ ক্যাপ্টেন বলেন। ‘ভদ্র ব্যবহার করুন’ এমা গোল্ডম্যান তীক্ষ্ণভাবে উত্তর দিলেন, ‘একজন পুরুষের মতো কথা বলুন, যদিও আপনি একজন পুলিশ।’[4]

১৯০৯ সালে পুলিশ এক মাসে এমার এগারোটি সভা পণ্ড করে দেয়। সান ফ্রান্সিসকোতে দেশপ্রেমের ওপর ৫ হাজার শ্রোতার সামনে তিনি বক্তৃতা করেন যেখানে জনতা পিছু না হটা পর্যন্ত পুলিশকে বাধা দিয়ে আটকে রাখে।[5] সানদিয়াগোতে উত্তেজিত জনতা বেন রেইটম্যানকে অপহরণ করে তাঁকে শহরের বাইরে নিয়ে যায়। নগ্ন করে আলকাতরা ও পালক লাগিয়ে দেয় তাঁর শরীরে। তাঁর পশ্চাৎদেশে আইডব্লিউব্লিউ [ইন্ডাসট্রিয়াল ওয়ার্কার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড] চিহ্ন এঁকে দেয়। (তাঁর সাহসের প্রশংসা করতে হয় সাথে সাথে এমারও) এ ঘটনার পরও তাঁরা তৎক্ষণাৎ সানদিয়াগোতে এমার বক্তৃতার জন্য ফেরত আসেন।

পেনসিলভেনিয়ার নিউ কেনসিংটনের এক নারীর সাথে এমার অল্পদিনের যৌন সম্পর্ক এমার যৌন স্বাধীনতার বিষয়টি লক্ষ করা যায়। সেই নারী আলমেদা স্পেরি। যদিও এমার আত্মজীবনীতে কোথাও আলমেদার উল্লেখ নেই, বোস্টন ইউনিভার্র্সিটি লাইব্রেরিতে রক্ষিত এমাকে লেখা আলমেদার অনেকগুলো চিঠি আমি পেয়েছি। আলমেদা একজন অসাধারণ নারী ছিলেন। একজন শ্রমজীবী নারী। যখন তাঁর অর্থের প্রয়োজন হতো তখন তিনি পুরুষদের দেহদান করতেন। থিয়েটার আর অপেরা ভালোবাসতেন তিনি। নিউ কেনসিংটনে তিনি সোস্যালিস্ট গ্রুপ তৈরি করেন।

এমাকে লেখা আলমেদা স্পেরির চিঠিগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের প্রণয়ের তীব্র আবেগীয় বহিঃপ্রকাশ, সমাজ সম্পর্কে গভীর সচেতনতা, বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত কোনো নারীর জীবন নিয়ে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা, অপেরা, থিয়েটার এবং সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা-এর সব কিছুই চিঠিতে পাওয়া যায়। চিঠিগুলো পড়ে আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, যে কোনোভাবে আলমেদার উপস্থিতি আমার নাটকে রাখব-এমনকি তাঁর একটা চিঠির ঘটনার মাধ্যমে হলেও। যে চিঠিটাতে তিনি বেন রেইটম্যানের সাথে তাঁর সাক্ষাতের বর্ণনা করেছেন। অন্য আরেকটি চিঠি থেকে একটি অনুচ্ছেদ তুলে দিচ্ছি: ‘আমি ভাবি, শো দেখার জন্য আমার মতো আর সবাই এমন পাগল কিনা-আমি প্রায় আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলাম, গতবার যখন সারা বার্নহাডার্স্ট এখানে এসেছিলেন, আমার হাতে তখন একদম টাকা-পয়সা ছিল না। অবশেষে ফ্রেড আমাকে এক ডলার দিয়েছিল, তাই সারার অপেরা দেখতে পেরেছিলাম। কী অসাধারণ কণ্ঠ সারার-কী সোনালি আর মধুর কণ্ঠস্বর আর কী চমৎকার উচ্চারণ! আয়নার সামনে আমি তাঁর লা টোসকা অপেরা প্র্যাকটিস করেছি।-এটা কি দারুণ হতো, এমা, যদি সরকার থিয়েটার পরিচালনা করত আর জনগণকে তা বিনে পয়সায় দেখতে দিত-আমি যদি প্রতি রাতে একটা ভালো শো দেখতে যেতে পারতাম তাহলে আমার শরীরের নগ্নতা ঢাকার জন্য কাপড় আর খাবারের জন্য কেবল কাজ করতাম। আমি সবার প্রতি দয়ালু হতাম।’[6]

এমা আর রেইটম্যান ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দশ বছর একসাথে কাটিয়েছেন। এই সময়ে মানসিক অশান্তি থাকলেও এমা অসাধারণ রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে গেছেন, যা শেষপর্যন্ত ১৯১৭ সালে আমেরিকার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিরোধিতা পর্যন্ত গড়ায়। এ ঘটনা তাঁদের মধ্যে সম্পর্কেরও পরিসমাপ্তি ঘটায়। যদিও অনেকক্ষেত্রেই ব্যক্তিগতভাবে বেশ সাহসের পরিচয় রেইটম্যান দেখিয়েছেন কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে যুদ্ধের বিরোধিতা করে নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দেবার সাহস দেখাননি।

এমা আর বার্কম্যান এতকিছুর পরও একে অপরের সহযোদ্ধা হিসেবে কনসক্রিপশন ও যুদ্ধকে ধিক্কার জানিয়ে আইন অমান্য করেছেন। ফলে তাঁরা দুজনই ১৯১৮ সালে জেলে যান। যুদ্ধ শেষ হলে তাঁদের মুক্তি দেয়া হয় অন্যান্য র‌্যাডিক্যালদের সাথে দেশ ত্যাগের শর্তে। যুদ্ধ শেষে ভয়াবহ অত্যাচার শুরু হয়। একজন ডানপন্থী ফ্যানাটিক হিসেবে তাঁর কুখ্যাত ক্যারিয়ার শুরুর প্রথম দিকে জে এডগার হুভার তাদের দেশত্যাগের বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেন। তাঁদেরকে জন্মস্থান রাশিয়াতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

Color illustration of 1886 Haymarket Square Riot
আর্ট: হে মার্কেট স্কয়ার রায়ট সূত্র: থটকো

তখন রাশিয়ায় জার শাসনের অবসান হয়েছে। নতুন সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিন নানা রাজনৈতিক মতামতের প্রতিনিধিত্বকারী সংসদ ভেঙে দিয়ে বলশেভিকদের শাসন শুরু করেছেন। এমা ও সাশা লেনিন ও ট্রটস্কির সাথে সাক্ষাত করেন। ভিন্নমতালম্বীদের জেল, বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করা, পেত্রগাদের বাইরে ক্রনস্টাডট্ এ নাবিকদের সহিংসভাবে দমন ইত্যাদি ঘটনা সোভিয়েত ইউনিয়নে তাঁদের অবস্থান করার ইচ্ছার মৃত্যু ঘটায়।

তাঁরা পরবর্তী বছরগুলোতে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে অতিবাহিত করেন। বিশেষ করে ফ্রান্সের মেডিটারিয়ান উপক~লে। এক অপরকে অসংখ্য চিঠি লেখেন (এসব চিঠির বড় অংশ রিচার্ড ও আনা মারিয়া ড্রেনোন সংগ্রহ করেন)। তাঁরা ইউরোপ ও আমেরিকার চলমান ঘটনাবলীর সাথে যোগাযোগ রাখতেন। মানুষের মুক্তির পক্ষের ঘটনাবলীর সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত ও সমর্থন অব্যাহত রাখেন। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় এমা স্পেনে ছুটে গেছেন। এবং ১৯৩৬ সালে বার্সেলোনায় বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা করেছেন যেটা ছিল মূলত অ্যানার্কিস্টদের দখলে (জর্জ অরওয়েলের হোমেজ টু কাতালোনিয়া-তে বিস্তারিত বর্ণনা আছে)।

বার্কম্যান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অপরিসীম শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করে ১৯৩৬ সালে তিনি মারা যান। এমা ১৯৪০ সালে রুজভেল্টের প্রগতিশীল শ্রমমন্ত্রী ফ্রান্সেস পার্কিন্সের অফিসের মাধ্যমে আমেরিকায় এক বিরল সফরের সুযোগ পান। কিন্তু শর্ত ছিল তিনি কেবল নাটক নিয়ে বক্তৃতা করতে পারবেন। ফলে তিনি আমেরিকায় ইবসেন, বানার্ড শ, স্ট্রিন্ডবার্গ এবং চেখভের ওপর বক্তৃতা করেন। পরে সে বছরই কানাডায় সংক্ষিপ্ত অবস্থানকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।

১৯৬০ দশককে অ্যানার্কিজমের প্রতি আগ্রহের পুনর্জন্ম বলা যেতে পারে। এর একটা কারণ আমেরিকায় সরকারের প্রতি চরম অসন্তোষ। ফেডারেল সরকার প্রায় একশ বছর ধরে দক্ষিণের সাথে জাতিগত বিভেদে সহযোগী ছিল। এই সহযোগিতার সমাপ্তি হয় যখন জর্জিয়া, আলাবামা, মিসিসিপি এবং অন্যান্য দক্ষিণের রাজ্যগুলোর জনগণ এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামে এবং জাতিকে সারা বিশ্বের সামনে নগ্নভাবে তুলে ধরে।

আর সেই একই সরকার দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় দানবীয় যুদ্ধ বাধিয়ে রাখে যা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ছিল। এই যুদ্ধ থেকে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয় যখন ভিয়েতনামে প্রতিরোধ এবং আমেরিকায় যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।

১৯৩০ দশকের মতো ১৯৬০-এর দশকে র‌্যাডিক্যালরা কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত বা সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থক ছিল না। তারা নিজেদেরকে নিউ লেফ্ট হিসেবে পরিচয় দিত। এবং তাদের অ্যানার্কিজমের সাথে গভীর মানসিক ও আদর্শগত সম্পর্ক ছিল যদিও অ্যানার্কিজম শব্দটার সাথে সরাসরি তেমন পরিচয় ছিল না। এই যোগসূত্রে কেবল সরকারের প্রতি সন্দেহই ছিল না, স্টুডেন্ট ফর ডেমোক্রেটিক সোসাইটি ও অন্যান্যদের ‘অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের’ ওপর বিশ্বাস ও ভূমিকা রেখেছিল। পুরাতন বামপন্থীদের পার্টি শৃঙ্খলার বিপরীতে অ্যানার্কিস্ট নীতি বিকেন্দ্রীকৃত সংগঠনের ধারণা ১৯৬০-এর দশকের আন্দোলনে বিকশিত হতে থাকে। স্টুডেন্টস নন-ভায়োলেন্ট কোঅর্ডিনেটিং কমিটি যার অধিকাংশ সদস্য ছোট ছোট গ্রুপ, যুবক আর অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। এই কমিটি ডিপ সাউথের সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গায় কাজ করত। তারা স্থানীয় কমিটি গঠন করত এবং তাদের আটলান্টার প্রধান কার্যালয়ের সাথে কেবল মাঝে মাঝে যোগাযোগ রাখত।

এমা গ্রন্থের প্রচ্ছদ, গ্রন্থিক প্রকাশনী, ২০২১

এই সময়ের ফেমিনিস্ট আন্দোলনও, অ্যানার্কিজমের সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও, বিকেন্দ্রীকৃত সংগঠন এই অ্যানার্কিস্ট নীতি অনুসরণ করত-ছোট ছোট নারী সংগঠনে তারা সারা দেশব্যাপী কাজ করত। সময়ে সময়ে যৌন-সমতার পক্ষে প্যারেড এবং জাতীয় আন্দোলন পরিচালিত হতো। নারী আন্দোলনকারীরা কোনো একক ক্যারিশমাটিক নেতার অধীনস্ত ছিল না।

অ্যানার্কিজমের ঐতিহাসিক দর্শন হলো ডাইরেক্ট একশন। এই ডাইরেক্ট একশনের আইডিয়া ১৯৬০-এর দশকের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। এর অর্থ হলো কোনো পার্টির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব না। কিন্তু নাগরিকের সম্মিলিত ঐক্য এবং তাদের শোষণের উৎসের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে ডাইরেক্ট একশনের মাধ্যমে তা সম্ভব।

ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় নেতৃত্ব রক্ষণশীল না হলে শ্রমিক আন্দোলন নানামুখী কর্মসূচির মাধ্যমে শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমঘণ্টা আদায় করতে সমর্থ হয়েছিল। এ ধরনের প্রতিবাদের একটা ধরন ছিল মালিকের বিরুদ্ধে সরাসরি ধর্মঘট। সরকার শ্রমজীবী মানুষের জন্য কোনো কিছুই করেনি। শ্রম সেক্টর কর্পোরেট শক্তির সাথে গাঁটছড়া বেঁধে পুরোপুরি ধনী ও ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তাই শ্রমিকদের দাবি শ্রমিকদেরই আদায় করতে হতো।

দক্ষিণে সিভিল রাইটস আন্দোলন ‘নন-ভায়োলেন্ট ডাইরেক্ট একশন’ এই শ্লোগান ব্যবহার করতো তাদের ক্যাম্পেইনে। আর এসব ক্যাম্পেইন ছিল মূলত অবস্থান-ধর্মঘট ও মুক্তিযাত্রা। যুদ্ধবিরোধী একটিভিস্টরা ওয়াশিংটন ডিসির রাস্তা অবরোধ করতো, পেন্টাগন ঘেরাও করতো, দাবি আয়ের জন্য আন্দোলনে নামতো। উপরোক্ত কর্মসূচিগুলো ছিল ডাইরেক্ট একশন। ভিন্নমতালম্বীদের আইন ও সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে নানা ধরনের সিভিল আইন অমান্য আন্দোলন অ্যানার্কিস্ট দর্শনের পরিপূরক-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা জানুক বা না জানুক।

দর্শন হিসেবে অ্যানার্কিজম ঊনিশ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপ এবং আমেরিকায় ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় কিন্তু ১৯১৬ সালের কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কের কারণে এ দর্শন ম্লান হয়ে পড়ে।

কিন্তু ১৯৬০-এর দশকের আন্দোলনের ফলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। নতুন রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতি সাথে সঙ্গীত, যৌনতা, যৌথ জীবনযাপন ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সংস্কৃতির বিকাশ ইত্যাদি অ্যানার্কিজমের প্রতি আগ্রহের পুনর্জন্ম ঘটে। দশকের পর দশক অজ্ঞাত থাকার পর এমা গোল্ডম্যান এখন একজন স্মরণীয় নাম বিশেষ করে নারী আন্দোলনে। এমনকি অন্যান্য রাজনৈতিক আন্দোলন ও নানামুখী আন্দোলনেও তিনি স্মরণীয়।

 

তথ্যসূত্র ও টীকানির্দেশ: 

[1] বোস্টন ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি স্পেশাল কালেকশনস, এমা গোল্ডম্যান পেপারস, কালেকশন # ২৪৩, বক্স ১, ২, ৩। আরো দেখুন দি এমা গোল্ডম্যান পেপারস: এ মাইক্রোফিল্ম এডিশন (অ্যান আরবার, এমআই: চাডউইক-হিলি, ১৯৯১), রিলস ৬,৭ এবং ৬৮; এমা গোল্ডম্যান: এ গাইড টু হার লাইফ অ্যান্ড ডকুমেন্টারি সোর্সেস (অ্যান আরবার, এমআই: চাডউইক-হিলি, ১৯৯৫); এমা গোল্ডম্যান: দি আমেরিকান ইয়ারস (বেকার্লি: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বেকার্লি;

[2] ক্যানডাস ফক, লাভ, অ্যানার্কি, এন্ড এমা গোল্ডম্যান (নিউইয়র্ক: হল্ট, রাইনহার্টম অ্যান্ড উইন্সটন, ১৯৮৪), ৪

[3] প্রাগুক্ত

[4] প্রাগুক্ত, ৬৫

[5] গোল্ডম্যান, লিভিং মাই লাইফ, ভলুউম ১, ৪২৭-২৮। সংলাপটি ‘প্যাট্রিয়াটিজম: এ ম্যানাস টু লিবার্টি’ তে রয়েছে যা গোল্ডমানের অ্যানার্কিজম এন্ড আদার এসেজ এ অন্তর্ভুক্ত।

[6] দেখুন নোট ১

মাজহার জীবন

লেখক