অরাজ
শিল্পী: লুইস ফাতিনো
প্রচ্ছদ » মানস চৌধুরীর সাক্ষাৎকার: লিঙ্গ-রাজনীতি, যৌনতা, শাসনপ্রণালী, দণ্ডবিধান ও সক্রিয়তা প্রসঙ্গে

মানস চৌধুরীর সাক্ষাৎকার: লিঙ্গ-রাজনীতি, যৌনতা, শাসনপ্রণালী, দণ্ডবিধান ও সক্রিয়তা প্রসঙ্গে

[লিঙ্গ প্রশ্নে জ্ঞান/ক্ষমতা ও শাসকতা প্রসঙ্গে এই সাক্ষাৎকার। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে আলোচিত হয়েছে যৌন নিপীড়ন ও বিচারের মানদণ্ড। যৌন নিপীড়নকে নিছক একটি ফৌজদারি ঘটনা হিসেবে পাঠ এবং বিচারিক স্বৈরতন্ত্রে যৌন নিপীড়নের প্রতিকার খোঁজা আদৌ সম্ভব কিনা তা আলোচিত হয়েছে এই সাক্ষাৎকারে। প্রাসঙ্গিকভাবেই এসেছে দণ্ডবিধির বিপরীতে একটা সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে যৌন নিপীড়নের জন্য পুনর্গঠনমূলক বিচারব্যবস্থার কথা। অধ্যাপক মানস চৌধুরীকে আমরা একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম। তিনি উত্তর দিয়েছেন। তাকে আর পাল্টা প্রশ্ন করা হয়নি। সাক্ষাৎকারটি চলমান। বর্তমান টেক্সট থেকে প্রশ্ন গঠন করে আবার আমরা তার সাক্ষাৎকার নেব। অরাজের পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, আরিফ রেজা মাহমুদশ্রবণা শফিক দীপ্তিসম্পাদক]

ছবি: মানস চৌধুরী

যৌন নিপীড়ন: সম্মতি/অসম্মতি ও ধারণায়ন

.আলাপটা একটু পেছন থেকে শুরু করতে চাই। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের সময় এর ধারণায়ন কেমন ছিল? এর সংজ্ঞায়ন এবং শনাক্তকরণ প্রশ্নটি আপনাদের বিবেচনায় ছিল নিশ্চয়…

মানস: আক্রান্ত মানুষজনের জন্য আসলে ধারণায়ন অজরুরি, বিহিত বা প্রতিবিধান বেশি জরুরি। এটা আমার বিবেচনায় বিদ্যাকর্মীদের একটা আত্মশ্লাঘা যে বেইনসাফের পরিবর্তনের (ইচ্ছার) জন্য ‘জ্ঞানার্জন’ বা ‘তত্ত্বপ্রস্তুতি’ আবশ্যক। আমি বিদ্যাকর্মীদের গড়ে কোনো আঘাত দেবার ইচ্ছা থেকে কথাটা বলছি না। অবশ্যই এ নিয়ে বিশদ তর্কের দরকার পড়তে পারে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদী আনুষ্ঠানিক সাংগঠনিক লড়াই পরিচালনার জন্য ইতিহাসবিদ্যা, তত্ত্বালোচনা সহায়তা দিতে পারে সে বিষয়ে কোনো বিশেষ ওজরআপত্তিও আমার নাই। আমার বলবার বিষয়টা খুবই সাধারণ: যিনি আক্রমণের শিকার, যাঁর উপর হামলা হচ্ছে, যিনি জবরদস্তিতে যৌনাত্মক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছেন, তাঁর জন্য বিহিত খুঁজতে চেষ্টা করাটা বিদ্যাকর্মীরা যে অর্থে ‘ধারণায়ন’ বলে থাকেন সেই অর্থে আবশ্যক থাকে না। তিনি ও তাঁরা এর থেকে পরিত্রাণ চেয়েছেন। প্রথমে হয়তো নিশ্চুপভাবে, তারপর কিছু মিত্র পেয়ে গেলে শোরগোল করেই মুক্তি চেয়েছেন। কিন্তু অবশ্যই আপনার এই প্রশ্নের মধ্যে অন্য একটি দিক আছে। তা হলো যাঁরা যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন, তাঁরা কীভাবে বিষয়গুলোকে দেখেন, দেখতে আরম্ভ করেন, দেখতে দেখতে বোঝাবুঝি পোক্ত করেন।

প্রথমেই মেনে নেয়া ভাল, বাংলাদেশ এমন একটা জায়গা, বিশেষত মধ্যবিত্তাঞ্চল যেখানে যৌনতা আর যৌনাক্রমণ প্রায় এক পাল্লায় পড়েযাওয়া অপরাধ। যৌনাক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য এই অঞ্চল খুবই অসুবিধাজনক জায়গা, যেহেতু যৌন কাজকর্ম প্রায় গুরুতর পর্যায়ের মুরুব্বিদের একান্ত ঘরের মধ্যকার গোপন তৎপরতা হিসাবে দেখা হয়ে থাকে। বাস্তবে এই অঞ্চলে যৌনকাজকর্ম এভাবেই সাধিত হয়ে থাকে বলে আমি মনে করি না, তবে সমাজপ্রপাগান্ডা বা সমাজআদর্শেরজয়গান এভাবে চলে। আবারো বলি যদি যৌনকাজ আর যৌনহিংস্রতা কাছাকাছি পাল্লায় প্রজারা রাখতে চেয়ে থাকেন, তাহলে ধারণায়ণের প্রশ্নটা খুবই গুরুতর বটে। যদি আপনার পাঠকেরা অপ্রাসঙ্গিক না মনে করেন, তাহলে আমি উত্তরটাতে কিছু তথাকথিত ‘ব্যক্তিগত’ মাত্রাও যোগ করব। আমার ছাত্রজীবনের কথা বাদ দিলেও, এই আন্দোলনটির ঠিক প্রাক্কালেই প্রশাসনের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন এক সাংবাদিক (তখন ক্যাম্পাসে মাত্র দুই হালি সাংবাদিক থাকতেন) আমার যৌনজীবন নিয়ে ইন্টারভ্যু নিতে এসেছিলেন। নিজের যৌনজীবন ইন্টারভ্যু আকারে বলার ‘নুইস্যান্স’ বাদ দিলেও, এখানে অন্যান্য মানুষের ‘প্রিভেসি’ জড়িত থাকে। তার থেকেও বড় কথা ওই উদ্যোগটাকে আমি আসলে আরেকটা আক্রমণ ভাবছিলাম যাতে আমাকে ‘বিব্রত’ বোধ করানো যায়আমার বলার জায়গা হলো, যৌনআক্রান্ত এবং অনাক্রান্ত উভয়ের বেলাতেই কিন্তু বিব্রতি একটা লাগসই অস্ত্র যার প্রয়োগ বিধিব্যবস্থা করে থাকে। আন্দোলনটি শুরু হবার পর থেকেই, নানাবিধ আলাপচক্র, পাঠচক্র, সভাসমিতিতে এই বিষয়গুলোতে বিভিন্ন সংগঠকেরা জোর দিলেন যে শরম কিংবা লোকলজ্জা কিংবা বিব্রতির বাইরে আসা দরকার। যৌন আক্রমণকে প্রতিহত করতে গেলে আক্রমণকে অগ্রগুরুত্ব দিতে হবে। সেই অর্থে কিছু কর্মীর হয়তো স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশযোগ্য বোঝাবুঝি ছিল, বাকি আন্দোলনকর্মীরাও ক্রমাগত সেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন।

. ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধিতে ধর্ষণের সংজ্ঞায়নে সম্মতি/অসম্মতি ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে। এই ধারণার শেকড়টা কোথায়? ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধ বা নৈতিকতার ছাপ এই ধারণায়নে পড়েছিল কি?

মানস: এসংক্রান্ত আইন নিয়ে আমার জানাশোনা আপনার মতো নয়। কিন্তু আমি সম্পর্কিত একটা জায়গা ধরে আগাতে চাইব। কোনো আইনকেই প্রয়োগকারী ও ভুক্তভোগীর নিয়তের থেকে সার্বভৌম করে আমি দেখি না। এটা বলার সময় চাইব সকল পক্ষ যাতে সতর্ক থাকি যে আমি ‘আধুনিক রাষ্ট্রের লিখিত আইন’সমূহের কথা বলছি। কারণ কথ্য ও তাৎক্ষণিক বিচারিককর্তৃত্বসম্পন্ন যে ‘আইন’, ধরা যাক, শালিসের মতো, সেগুলোকে অপরাধীভুক্তোভোগীর ইচ্ছানিরপেক্ষ জ্ঞান করা চলতে পারে। সেখানেও দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের ইচ্ছা বা নিয়তের উপর নির্ভর করে তথাকথিত ইনসাফ নিশ্চিত হচ্ছে কিনা। কিন্তু পরিস্থিতিটার দশা একদম স্বতন্ত্র। আধুনিক আইন নানাবিধ ব্যাখ্যাসাপেক্ষই থাকে। এটা খোদ আধুনিক সমাজের লিবেরেল দার্শনিক পাটাতনের সঙ্গে সম্পর্কিত এক সমস্যা।

শিল্পী: বেটিনা সেমার

ফলে ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ বা নৈতিকতার ছাপ এখানে থাকতে পারে। কিন্তু আমার জন্য তুল্যবিচারে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এইটা যে ওখানে নির্দিষ্ট বয়সের এক নারীকে যৌনাকাঙ্ক্ষার মালিক বলে গণ্য করা হয়েছে। বয়সটা ছিল ১৪এবং এখন ১৪ওয়ালারা অযৌন শিশু হিসাবে প্রপাগান্ডিত থাকেন। ‌‘পূর্ণবয়স্ক’/‘পরিণত’ নারী সম্মতি দিলেন কিনা এই প্রশ্নকে বিবেচনায় এনে এই আইন সামন্তসমাজে অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে চর্চিত যৌনকাজ করার ক্ষেত্রে পুরুষের ইচ্ছার নিয়ামক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। আমার জন্য তাই ওই আইন ওই পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ ছিল। যেমন একটু আগে আইনের অনুধাবনের ক্ষেত্রে বললাম নিয়ত বা অভিপ্রায়ের কথা, ব্যাখ্যাবিশ্লেষণের গুরুত্বের কথা, এখন পরিপ্রেক্ষিতকেও আইন অনুধাবনে গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রস্তাব করছি। নারী বলছেন তিনি চান না, সেখানে পুরুষের প্রচেষ্টা ধর্ষণঅপরাধ বলে গণ্য হবে এরকম পাটাতন থাকার মাধ্যমে বিদ্যমান যৌনব্যবস্থাতে পুরুষের দখলদারিত্বের ইতিহাসকে স্বীকার করা হয়; বলপ্রয়োগে এই লিঙ্গের অনেক সদস্যের চর্চাকে আমলে আনা হয়; পরিশেষে নারী অন্তত হ্যাঁনা’র মালিকানা দিয়ে তাঁর যৌনকর্তাসত্তাকে জারি রাখার সুযোগ পান।

ভিক্টোরীয় নৈতিকতা নিয়ে নিন্দা করার জন্য বরং অন্য পরিপ্রেক্ষিত আমার জন্য প্রাসঙ্গিক হবে। বরং, আমরা ভাবার চেষ্টা করি যে ওই আইনপ্রণেতারা যদি জানতেন যে দিকেদিকে, ইংলন্ডের গ্রামেগঞ্জে, ১৪ বছরের পরিণত নারীরা ১৪ ও অন্যান্য বয়সের নানান পুরুষের সঙ্গে (হেটারোসেক্সুয়াল আন্দাজে) লাগাতার যৌনসম্পর্ক করছেন, সম্মতি জানিয়ে জানিয়ে, তাহলে তাঁরা আনন্দিত হতে পারতেন কিনা। বাংলাদেশের সমাজে যেমন যৌনতা ও যৌনাক্রমণ মিলেমিশে আছে বলে উল্লেখ করেছিলাম; তেমনি, ইংলন্ডীয় তদীয় সমাজেও যৌনাচারের বিষয়ে গুরুতর ওজরআপত্তি গড়ে উঠেছিল। শিশুদের যৌনজীবন নিয়ে ভাবা তো দূরের কথা, অশিশুদের যৌনজীবনও নানাবিধ রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার বিষয় হয়েছে। ধর্ষণের মতো আক্রমণাত্মক বিষয়কে উপলব্ধি করার জন্য প্রণীত আইনের প্রণেতাগণের অন্যান্য যৌনতা নিয়ে মনোভাব কল্পনা করা চিত্তাকর্ষক হবে বটে; কিন্তু ওই আইনটার পরিপ্রেক্ষিত ও অনুবর্তী বিবেচনা করে হলেও ওটার সঙ্গে যৌনাচারনিয়ন্ত্রণকরার আইন বা বিধিগুলোকে গুলিয়ে না ফেলতে চাইব আমি। যৌনাচার নিয়ন্ত্রণে ভিক্টোরীয় সমাজ ও আধুনিক রাষ্ট্রের মরিয়া চেষ্টা নিয়ে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ আছে দুনিয়ায়। আমি আরো ভাল পড়ুয়া হলে এক্ষুনি হালিখানেক বইয়ের নাম বলে দিতে পারতাম।

এটা দুনিয়ার একটা আজব পরিহাস যে, লোকে যৌনকাজ করে যত খুশি থাকেন, কিছুতেই অন্যের যৌনকাজে তত খুশি হতে পারেন না। শিশুরা এই বিষয়ে সবচেয়ে বঞ্চিত, বৃদ্ধরাও। জৈবতারুণ্যের সঙ্গে যৌনতার অবধারিত সংযোগ ঘটানোও আইনপ্রণেতা ও বিজ্ঞানচর্চাকারদের আরেকটা উদ্ভট কাজ। মনুষ্যযৌনতার কাজ যে নিছক বাচ্চা উৎপাদন নয়, সেটা বোঝার জন্য জীববিজ্ঞানের ডিগ্রিই বরং ঝামেলায় ফেলতে পারে, কমনসেন্সই যথেষ্ট হবার কথা। তাহলে জৈবতারুণ্য নিয়ে মাতামাতি যৌনতার ‘পুলক’/প্লেজার, উৎসবমুখরতা/ফেস্টিভিটি কিংবা অধিকল্পনা/ফ্যান্টাসি কিছুই বুঝতে সাহায্য করে না। ওটা তারুণ্যের বৈশ্বিক ডিসকোর্সের আরেকটা অগণতান্ত্রিক মেনিফেস্টো। ঈর্ষার তাত্ত্বিকেরা হয়তো বিশদ কিছু বলতে পারবেন এই বিস্ময়কর প্যারাডক্সটা নিয়ে। শেষের অনুচ্ছেদে আপনার প্রশ্নের কেন্দ্র থেকে সরে গেছি এই অভিযোগ তুলতে পারেন আপনি। কিন্তু আরেক প্রশ্নে এই কথাগুলো বলতে পারব তা নিশ্চিত তো নই এখনো।


. আপনার/আপনাদের (ন্দোলনকারী অর্থে) ধারণায়নের সঙ্গে দণ্ডবিধির এই বিষয়ক ধারণার সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্যটা কোথায়?

মানস: যদি আপনার আগের প্রশ্নের ভিক্টোরীয় নৈতিকতার ধারণা সমেত এই প্রশ্নে এসে থাকেন, তাহলে সেটা মুলতবি রাখার পক্ষে আমি। কিন্তু সম্মতি অংশের সঙ্গে আগাগোড়াই সম্পর্কিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনআমি প্রথমেই প্রায় বেয়াড়ার মতো বলে নিতে চাই যে যৌনতার নানাবিধ স্টিগমা একদম বৈশ্বিক; সেটার মাত্রা ও রূপভেদ যেমনই থাকুক না কেন। আপনি হলিউডের বলবান ধারার চলচ্চিত্রেও এই সতর্কতার অভাব দেখেন না যে সেখানকার প্রটাগনিস্টরা ‘এক সম্পর্কে’ থেকে আরেক (যৌন)সম্পর্কে ঢুকে পড়েছেন না কিছুতেইঢোকাটি মঙ্গলজনক কিনা, আমার আকাঙ্ক্ষিত কিনা, ঢুকে পড়লে পরে মেলা ভেজাল কিনা সেসব সম্পূর্ণ আরেক বিষয়; এবং এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু তাঁরা মেনে চলেন এই বিধান, এমনকি ছায়াছবিতে্‌ওএই বিধানের লঙ্ঘন হবে কেবল ক্রাইমথ্রিলারে, যেখানে এরকম বিধানবহির্ভূত যৌন/প্রেম/কাম/আবেগাপ্লুতসম্পর্কই খোদ খুনাখুনির কারণ বয়ে আনছে। ছায়াছবির প্যাটার্ন দেখাতে চাইছি কেন? এটা স্পষ্ট করতে যে ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ, কিংবা শুচিতার ভোম্বাকাঠামো আলবৎ বলবৎ। এত বলবৎ যে চলচ্চিত্র কারখানাও বিধানচ্যুতি চায় না, যেমন সহজে চায় না নৈমিত্তিক ছায়াছবিতে সাদা আর কালো মানুষের মধ্যকার এমনকি বিষমলিঙ্গীয় জুটি বানাতেও। কিন্তু যৌনতার ক্ষেত্রে সম্মতির ধারণার রাজনৈতিক যে তুল্য গুরুত্ব আছে সেটাকে সমুন্নত রাখতে চাই আমি কোথাও কোথাও।

যৌনসম্পর্কে নারীর সম্মতি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন সেই প্রশ্নের মধ্যেই খোদ সম্মতির গুরুত্ব আছে এত এত বছর ধরে এত অজস্র ধর্ষণ এবং বহুবিধ যৌন আক্রমণ নারীর উপর হয়েছে যে নারী কীসে অনিচ্ছুক ছিলেন বা আছেন সেই জিজ্ঞাসাটার রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। সেই হিসাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের এবং উনিশ শতকের ব্রিটেনের ধর্ষণ আইনের ধারণায়ন সাদৃশ্যমান ধরে আপনি আগাতে পারেন। তবে আর দুয়েকটি কথা বলতে চাইছি। এসব ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তীয় রাখঢাকে প্রায় কিছুই বলা সম্ভব নয়, আমি জরুরিও মনে করছি না। বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, অথচ সূক্ষ্ম, একটা বিষয়ে আমি আলোকপাত করতে চাই।

সম্মতির ধারণাটিকে আমি অন্য একটা শক্তিশালী লিগ্যাসির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছুক। যৌনতা, যৌনভাবনা, যৌনদশা, যৌনপ্রত্যঙ্গ বিষয়ে নিখিলবিশ্বে সব স্ফটিকস্বচ্ছ ‘বৈজ্ঞানিক’ ধারণা আছে বলে আমি মনে করি না। এমনকি খোদ বৈজ্ঞানিক ধারণা বলে যাসব চালু আছে তারও কতকের সঙ্গে আমি (এবং অনেকেই) টেবিলে বসে একটা একটা করে তর্ক করতে পারব। পুলক, সম্ভোগ, সন্তানধারণ, ঋতুচক্রোর্ধ্ব যৌনেচ্ছা এসব বিষয়ে নারীরা তো পারবেন শব্দে শব্দে। এই তর্কে নামতে চাইলে প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক বিজ্ঞানীদের সতর্ক হওয়াই ভাল হবে। তবে তাঁরা জিতবেন ক্ষমতা দিয়ে, যা হয়ে আসছে। যাহোক, বলছিলাম লিগ্যাসির কথা। ‌‘যৌনকাজকর্ম হয় জৈবতাড়নায়’—এই আকাট ধারণা কেবল স্থানিক কোনো চর্চা নয়; এটি বৈশ্বিক। এর সঙ্গে যোগ হয়ে আছে ‘পুরুষের তাড়না, জাগলে আর থামে না’ ধারণা। এটাও বৈশ্বিক। বিদ্যাজগতে, নারীবাদী আলাপে এটার নাম হলো ‘মেইল সেক্সুয়াল ড্রাইভ’বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে আরো যুৎসই অর্থবোধক ভাষাতে এসব বলা হয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য, যদি কারো মনে হয় স্পষ্ট করে বলিনি, এগুলো সব মিথ, প্রপাগান্ডা, পুরুষের বাহানা। ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউজে বসে থাকার ইচ্ছা থেকে পর্যন্ত সরানো গেছে, যৌনকাজ করার ইচ্ছা সরবে না কেন! অন্যত্র আবার এই ধারণাও অত্যন্ত শক্তিশালী যে ‘নারীকে জাগাতে হয়’এই ধারণাটিকেও কেবল দেশজ ভেবে ভুল করবেন না। সমকালীন যৌনতাঅধ্যয়ন শাস্ত্রে সক্রিয়তানিষ্ক্রিয়তা নিয়ে বিশদ সব আলাপচালু আছে। তাহলে এতক্ষণ যেসব প্রবল চলমান ধারণা সামনে হাজির করলাম, সেখানে জৈবযন্ত্র হিসাবে পুরুষ ও নারীর অবধারিত সব কর্মকাণ্ড পূর্বনির্ধারিত হয়ে আছে তা দিব্যি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমি জানি বহু পুরুষ এ যাবৎ কালে জেনে আসছেন যৌনকাজ করার উপায় কেবল মাত্র ‘ছলেবলেকৌশলে’ নারীকে ‘বাগানো’সমাজে যৌনদর্শনের এই বিচিত্র অগণতান্ত্রিক পাটাতনকে বিবেচনা করে ভাবুন। সম্ভবত, এখন যে বিষয়ে কথা বলছি (লিখছি), যেটাকে আমি সূক্ষ্ম ও ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় বললাম, তা নিয়ে বিশদ করা লাগতে পারে আপনার অন্যান্য প্রশ্নগুলোর কোনোটার উত্তরে। আমি একবারেই সব প্রশ্ন পড়ে উত্তর করছি না।

. ‘সম্মতিবা অসম্মতির জন্য ব্যক্তির কর্তাসত্তা/স্বীয়তা গুরুত্বপূর্ণ। কর্তাসত্তা বা স্বীয়তার বোধন না হলে সম্মতি বা অসম্মতি দেয়ার প্রশ্ন থাকে না। অনেক সামন্ত সমাজে নারীর বিয়ের প্রশ্নে সম্মতির ধারণা নেই বল্লেই চলে। অভিভাবকই সিদ্ধান্ত নেন। বা এবিষয়ে নিজেট মতামত থাকতে পারে এই উপলব্ধিও নারীর থাকে না অনেক ক্ষেত্রেই। সম্পর্ক গঠনকেই যখন যৌনতার সম্মতি বলে বিবেচনা করা হয় তখন এক্ষেত্রে সম্মত বা অসম্মত হতে তার কোন কর্তাসত্তা/স্বীয়তা থাকে কি?

মানস: এই বিষয়টা গভীরভাবে ইতিহাস ও শ্রেণীসাপেক্ষ। এমনকি দর্শনসাপেক্ষ। আমি প্রগতির ধারণার বশীভূত হয়ে তা বলছি না। এই অর্থে নয় যে কখনো এসব চেতনার অভাব ছিল, অন্য এক সময়ে মন্ত্রবলে দেখা দেবে; আর তখনই এই কর্তাসত্তা জাগ্রত হবে (ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে)এমনকি আমি এই সম্মতিআপত্তি চর্চার প্রসঙ্গটাকে কেবল যৌনতা ও যৌনাক্রমণের মধ্যেই সীমিত রেখেও সাপেক্ষতার বিষয়টা বলিনি। বরং, সম্মতিআপত্তির চর্চা ঘোরতরভাবে নানান পরিমণ্ডলেই শ্রেণীইতিহাসদর্শনসাপেক্ষ। যৌনতার মতো স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ যদি বাদও দিই, কজন ছেলে (নিজ) বাবার অগণতান্ত্রিক কিংবা ক্রুদ্ধ কিংবা হিংস্র কিংবা শোষণকারী আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় বলে ভাবতে পারেন? কেবল সামন্ত পরিসরের বাবাদের কথা হচ্ছে না। শহুরেশিক্ষিতমধ্যবিত্ত শ্রেণীর বেলাতেও কমবেশি বাবা ও ছেলের সম্পর্ক মৌলিক সামাজিক প্রশ্নগুলোতে একপক্ষীয়। সেটা গৃহকর্মীর বেতন হোক, ড্রাইভারের কর্মঘণ্টা হোক, দারোয়ানকে সম্বোধন হোক। আমি খুব স্থূল উদাহরণেই থাকলাম তা সত্য। এখন চুপথাকা সকল ছেলেই বাবার স্বৈরতন্ত্রের সমর্থক তা আমার বক্তব্য নয়। যৌনতার বেলাতেও মানা নাকরা আর মেনে নেয়া বা সম্মতি একাকার করার পক্ষে থাকব না আমি। এই অংশে আমার বলবার বিষয় ছিল, নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে, নির্দিষ্ট শ্রেণীতে বিষয়গুলো অভিন্ন থাকে না। আবার তার উপরে দর্শনগত বিষয় থাকতে পারে। যেমন, উদাহরণের ছেলেটি মুরুব্বিদের আচরণের সমালোচনা নাকরার মূল্যবোধে বিকশিত হয়ে থাকতে পারেন। আর সেই বিকাশ তাঁর চিন্তাপ্রবাহে বাধা দিতে পারে।

এই পর্যন্ত এসে আপনি আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে করা আলাপের প্রসঙ্গ টানতে পারেন এবং বলতে পারেন আমি যে ধারণায়নকে তেমন গুরুত্ব দিলাম না তখন। যখন আক্রান্ত আপত্তি করেন, প্রতিবাদ করেন; কিংবা অন্তত আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ চাইতে থাকেন আর যখন আক্রমণকারী আর আক্রান্তের বাইরে তৃতীয় পক্ষ সেটার সাথে সম্পর্ক নির্ধারণ করেন তখন বিষয়গুলোকে আলাদা করে দেখি আমিএই দেখাদেখি মাইক্রোমনস্ক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ম্যাক্রো ইতিহাস ও আন্দোলনের চর্চা তো আমরা অনেক বছর অবলোকন করলামই। আমি ছোট ছোট পরিসরের এই কর্তাসত্তামূলক অনুধাবনকে যত্ন করে করতে চেয়েছি। সেজন্য বলতে পারি, আমার প্রথম আলাপ আর এখনকার আলাপ সাংঘর্ষিক নয়এখন মনোযৌনজ প্রশ্নে নারীর কর্তাসত্তার বিষয়টাও নানাবিধ জটিল সব পরিপ্রেক্ষিতের উপর দাঁড়ানো। যদি আলোচ্য নারীটির মনোগড়ন, বিচারবুদ্ধি এইভাবে গড়ে ওঠে যে স্বামীর আহ্বানে সাড়া দিতেই হবে তাহলে তাঁর পীড়িত হবার বোধ একই থাকবে না যে নারী যৌনজাগ্রত হবার কারিগরি বিষয়ে ভিন্নভাবে ভাবেন। এই উদাহরণটা সহজ হলো। কিন্তু যেমন আগের প্রশ্নের উত্তরে বললাম যে প্রচুর পুরুষ এই ধারণা নিয়ে বড় হয়েছেন, হয়তো মারাও যাবেন এই ধারণা সমেত যে ‘নারীকে জাগাতে হয়’ সেই মনোভাব (দর্শনই বলছি) যদি কোনো নারীরও থাকে তাহলে ইতোমধ্যেই আমরা খুব সঙ্কটাপন্ন লিঙ্গরাজনৈতিক বাস্তবতাতে পড়ে গেলাম। কিন্তু কোনো নারীর মধ্যেই এই ভাবনা কাজ করে না এমনভাবে ভেবে নেবার কোনো কারণ আমি পাই না। শর্তসাপেক্ষে তাই একথা বলা যায় যে অসম্মত হওয়া বা অসম্মতি জ্ঞাপনের কর্তৃত্ব বোধ একটা নির্দিষ্ট মনোযৌনজ বোঝাবুঝি থেকে আসে।

এই প্রশ্নটাকে আরেকটা সূক্ষ্ম দিকেও নিতে চাই আমি। “সম্পর্ক গঠনকেই যখন যৌনতার সম্মতি বলে বিবেচনা করা হয়” এই বাক্যাংশটিতে মনোযোগ দেয়া দরকার। প্রেমের সম্পর্ক কমবেশি হবুবিয়ের প্রস্তাব হিসাবে প্রচল হয়ে আসছে। হয়তো আমাদের চারপাশে বেশি, হয়তো গ্রামদেশে কিছু কম, হয়তো পাশ্চাত্যে ভিন্ন। এসব ভিন্নতাকে আমলে এনেও বলছি, যেসব সম্পর্কের নাম কমবেশি ‌‘প্রেম’, এবং যেসব সম্পর্ক সাধারণত একজন নারী ও একজন পুরুষকে ঘিরে আবর্তিত হয় সেগুলোর মধ্যে ‌বিয়ে একটা সম্ভাব্য পরিণতি হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। মুখে বলে বা খাতাকলমে লিখে কতখানি চর্চিত সেটা আলাদা প্রসঙ্গ। ধারণা করা যায় প্রেমিকপ্রেমিকারা মুখে বলেন অধিক, লিখে হবুবিয়ের চুক্তি করে আগান কম, বা একদমই করেন না। কিন্তু কথ্য বা লেখ্য সেই প্রতিশ্রুতি না থাকলেও এটা আছে সমাজপাটাতনেএই অর্থে এটা ডিসকার্সিভ একটা শক্তি। এর মধ্যে ‘প্রেমে’ যৌনতা আসতেই পারে একটা প্রিমাইজ বা পূর্বধারণাকিন্তু আমাদের আলোচ্য জুটিটির মধ্যে দুজনেরই এই পূর্বধারণার প্রজা থাকার সম্ভাবনা নাও থাকতে পারে। একজন ভাবতেই পারেন, ‘বিয়ের আগে কক্ষণো না’এই একজন আমাদের চলতি বিচারে মনে হবে নারীটি হতে পারেন, বা কিছু নারী হতে পারেন। তবে আমার সমাজবিচরণ থেকে জানা হয়েছে যে পুরুষটিও এই ভূমিকায় থাকতে পারেন। তাহলে ‘প্রেম’ মাত্রই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ম্যান্ডেট – এরকম ধরে নেয়া পাত্র যদি ধরে নানেয়া পাত্রের সঙ্গে লিপ্ত হন তাহলে সাংঘর্ষিক বিষয় দেখা দিতে পারে। ফলে কর্তাসত্তার প্রশ্নটা গুরুতর বটে। এই বিষয়ে এত ঘন আলাপ করে আমি কিছুতেই ধর্ষণের গুরুত্ব থেকে পাঠককে সরাতে চাইনি। উল্টো, ধর্ষণের মতো বিষয় যে ‘প্রেমে’র মতো আপাতনিরীহ হবুবিয়েমণ্ডিত কাজকর্মের মধ্যেও হতে পারে সেটারই প্রেক্ষাপট বিশদ করলাম।

. বিভিন্ন সময়ে যৌন নিপীড়ন শনাক্ত করণে সম্মতি/অসম্মতির প্রশ্নে কনটেক্সটকে বিবেচনায় নেয়া হয় না। সম্মতি/অসম্মতির ধারণা নিশ্চয় রোবটিক নয়?

মানস: লিঙ্গীয় বৈষম্য যখন এক গভীর বাস্তবতা তখন এ নিয়ে সংশয়ী ভূমিকা নেয়া খুবই কঠিন, রাজনৈতিকভাবে। কিন্তু সাধারণভাবেই বলতে চাই, বিবেচনা কী করা হয়েছে বা হয়নি তা কেবলই তৃতীয় পক্ষের কাছে গেলেই প্রশ্ন ওঠে। যতক্ষণ যৌনতা দুই পক্ষের মধ্যকার মীমাংসিত বিষয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সম্মতিঅসম্মতির পাটাতন ভাবার দরকার পড়ে না। দুইজন এক পক্ষে আছেন কিন্তু তাঁদের মধ্যে অসম্মত যৌনকাজ সাধিত হয়েছে এরকম একটা প্রসঙ্গ ফ্যালাসি হতে বাধ্য, যদি না আমরা বিয়ের মধ্যকার যৌন নিপীড়ন নিয়ে ভাবতে বসি। সাধারণভাবে, আমি সকল রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, লিঙ্গসমেত, গরু এঁকে নিচে গরু লিখে দেবার পক্ষপাতী। অন্তত ইসলামী বিয়েতে কাজী এই কাজটা করে থাকেন ‘কবুল’ শোনার আনুষ্ঠানিকতায়। সেটা প্রতিবার যৌনাত্মক যোগাযোগে করতেথাকা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরুষের জন্য আরো বেশি সুবিধাজনককিন্তু এটাও সত্য যে এতে মনোযৌনজের যে রহস্যময়তা বা মায়াবী বৈশিষ্ট্য আন্দাজ করা হয়ে থাকে, কিংবা কাব্যিক, সেসব ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এগুলো সবই কিছু হারিয়ে কিছু পাবার পরিস্থিতি।

কেন আমি গরু এঁকে গরু লেখার পক্ষপাতী সেটা বরং খোলাসা করি। সেটা এমনকি নিছক যৌনসম্পর্কের বেলাতেই নয়। ধরুন, আপনার আর আমার ভিতর কোনো যৌনসম্পর্ক নেই, অন্তত এখন পর্যন্ত। আমাদের দেখাসাক্ষাৎও যৎসামান্য হয়েছে জীবনে। কিন্তু সাইবার যোগাযোগে ধরুন আমি একটা উচ্ছ্বাসে, বা অন্য কোনো বজ্জাতিমূলক তৎপরতায় একটা চুমাইমো পাঠালাম আপনাকে। যদি দ্বিপাক্ষিক চ্যাট হয় আপনি হয়তো একটা ফোন দিয়ে বসলেন ‘মানসদা, ইমোটা কি ভুলে পাঠাইলেন?’ কিংবা হয়তো চুপ থাকলেন, কিছুই আর লিখলেন না। কিন্তু বহুজনীয় ফোরাম হলে সেসব করাও কঠিন হয়ে যাবে আপনার, যেহেতু আমার চুমাইমোর দর্শক তথা তৃতীয় পক্ষ তৈরি হয়ে আছে। তাহলে যদি একটা ইমোচুমাও আপনি না নিতে চান, আপনার বলতে হয় যে ‘এই ইমো আমাকে আর দিবেন না’যদি আমার বজ্জাতি ভাবনা থাকে, আপনার নিশ্চুপতাকে অস্বস্তি হিসাবে পাঠ করেও কিন্তু আমি ওরকম ইমোবাণ নিক্ষেপ করতে পারি। ফলে আপত্তি বা অসম্মতির একটা প্রকাশ্যরূপ এখানে জরুরি হয়ে পড়ছে। আপনারআমার এরকম আপাতত অযৌন সমলিঙ্গীয় প্রায়পেশাগত যোগাযোগেও। যে অর্থে আপনি রোবটিক বললেন, আমি যদি সুবিধার্থে একটা অনুবাদ এরকম করে নিই ‘অটুট নীতিমালা’, তাহলে সেটার জরুরিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। নারীবাদী যে শ্লোগান – ‘নো মিনস নো’ – এটাও একটা কথ্য বা ভার্বাল ‘নো’এই উচ্চারিত নাটির সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে কিনা সেটা একটা আইনীপ্রক্রিয়াগত প্রশ্ন; কিন্তু নৈতিক মীমাংসার জন্য ওই নাটি উচ্চারিত হওয়া ধন্বন্তরীর মতো। তাহলে তুল্যবিচারে রোবটিক অসম্মতিকে আমি গুরুত্ব দেব। এতে ছায়াছবির বা আধুনিক গানের বা কবিতারও হয়তো ‘না ছুঁয়ো না’ ধরনের দ্ব্যর্থক ‘না’গুলো মাঠেমারা যেতে বাধ্য। কিন্তু উত্তুঙ্গ বৈষম্যের ভিতর কাব্যের ধ্বজা ধরে পার পাব না বলে আমি মনে করি।

তবে আপনার প্রশ্নে পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করতে গিয়ে আসলে উল্টাদৃশ্যের কথাও ভাবা হয়েছে। হতে পারে, সেটাই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়েছে। তা হলো, একটা বাস্তবতায় কোনো পক্ষ, নারীপক্ষই প্রাসঙ্গিক, যৌনসম্পর্কে ‘সম্মতি’ দিয়েছেন, সেই সম্মতিটাকে ওই সময়কার চাপের বাস্তবতায় পাঠ করা লাগতে পারে। যেমনটা, আমাদের অঞ্চলে ‘বাসর রাতে নারীর কর্তব্য’ বিষয়ক মর‍্যালগুলোতে জোরেসোরে প্রচারিত হতে থাকে। ঠিক ওরকম ক্ষেত্রগুলোতে রাজনৈতিক তৃতীয়পক্ষীয় এজেন্সি নিয়ে আমাদের বিশেষ কিছু করার আছে বলে আমার মনে হয় না। এক ধরনের বুর্জোয়ালিবেরেল ন্যায়বিচারও যেখানে সুলভ, সেখানে প্রশ্নগুলোর সূক্ষ্মতার গুরুত্ব আছে। আমাদের পরিমণ্ডলে যৌনাক্রমণ বিষয়ক কোনো অভিযোগ কাঠামোগতভাবেই লঘু হয়ে থাকে – প্রথমত নৈতিক শাসনের দৃষ্টিতে, দ্বিতীয়ত ও মুখ্যত আইনী দীর্ঘসূত্রিতার পদ্ধতিতে, তৃতীয়ত হয়রানির নতুন নতুন আশঙ্কার বাস্তবতায়। সম্মতিঅসম্মতি ধারণা হিসাবে কাজে লাগতে পারে এমন ‘ন্যায়বিচারের’ সম্ভাবনা থেকে ঢের ঢের দূরে আছি আমরা।

হাইকোর্টের নীতিমালা: যৌন নিপীড়ন ও ভিক্টোরিয়ান ভাবালুতা

. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন থেকে এবিষয়ে হাইকোর্টের নীতিমালা প্রণয়ন, একটা লম্বা সময়। বিভিন্নখানে আলাপ আলোচনায় হাইকোর্টের নীতিমালার ভিত্তি হিসেবে এই আন্দোলনকেই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু রিট দায়ের করেছিল উন্নয়ন সংস্থা— বিএনডব্লিউএলএ। একটি র‌্যাডিকেল আন্দোলন, মাঝে একটি এনজিওপ্রক্রিয়া। এতে কোন ফিল্টার লক্ষ্য করেন কিনা? দুটো স্বরের পার্থক্য নিশ্চয় ছিল?

মানস: এখানে কয়েকটা সম্পর্কিত অথচ স্বতন্ত্র বিষয় নিয়ে আলাপ করার দরকার আছে বলে আমার মনে হয়। দীর্ঘ হবে সম্ভবত, কিন্তু আমি নিরুপায়। প্রথম বিষয়টি হলো, লিঙ্গীয় সম্পর্কভিত্তিক আলাপআলোচনা ও আন্দোলনের পূর্বসূত্রের অভাব। বাস্তবতা হলো, যেভাবেই হোক ১৯৯৮ সালের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনটির তেমন কোনো পূর্বসূরী তামাম বিশ্বেই অতি বিরল; খোদ দক্ষিণ এশিয়া বলতে যা একাডেমিকরাজনীতিকরা বুঝিয়ে থাকেন সেখানেও বটেআবার, কোনো কোনো পাঠকের পড়তে যেমনই গাচিড়বিড় লাগুক না কেন, গুরুত্বপূর্ণ ও সূক্ষ্মতর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রশ্নে উত্তরঔপনিবেশিক পাটাতনে ভারত সবসময়েই গুরুত্বপূর্ণ আলাপসূত্র সরবরাহ করে এসেছে। সেটা ভারত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বৈষম্যরহিত দশার প্রশ্ন নয়, আইনী লড়াইয়ে ভারতের বিচারালয়ের দীর্ঘকালীন ‘জনইনসাফ’কেন্দ্রিক পদক্ষেপ/হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গবিচারালয়ের প্রসঙ্গ এলে, ইতিহাস সাক্ষী, পাকিস্তানের অবস্থাও বাংলাদেশের থেকে গুরুত্বপূর্ণভাবে উজ্জ্বল। তো, ভারতের বিশাখা রূপরেখাও কিন্তু ১৯৯৮ সালের আন্দোলনের আগের রূপরেখা; সম্ভবত ১৯৯৭’র দিকে এসেছে, পরে যেটা একটা আইন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, ঘটনাচক্রে বাংলাদেশের আদালতের হস্তক্ষেপের পরে। এটা নিয়ে আমরা ভাবতে পারি যে, কীভাবে পাশের দেশে গুরুতর ক্যাম্পাসআন্দোলন ব্যতিরেকেই রূপরেখা প্রণীত হয়, আবার আমাদের দেশে গুরুতর ক্যাম্পাস আন্দোলনের পর কমবেশি ১১ বছর লেগে গেল আদালতের একটা স্বর প্রক্ষেপণে। তবে এসব ভাবনা দুর্ভাবনা ও বিলাপ না হয়ে ঘটনাপরম্পরা ও কারকদের তৎপরতার বিশ্লেষণ হলেই ভাল হবে।

শিল্পী: গিনি নাগি

এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় যে বিষয়টা উল্লেখ করতে চাই তা হচ্ছে এনজিও নিয়ে মোটের উপর, বিশেষত বামমহলে, একটা গড়গড়া ধ্যাবসা (বা আনক্রিটিক্যাল) অবস্থানবিএনডব্লিউএলএই যে আদেশপত্র বা রিটের আবেদন করেছিলেন সেটা আমার স্মৃতিতে ছিল না। কিন্তু কোনো একটা ‘এনজিও’ই যে তা আমার স্মরণে ছিল। এটা আলাদা করে বলতে চাই আরেকটা বিষয় হিসাবে ঠিক এর পরের অনুচ্ছেদেই। এনজিও বিষয়ক গড়গড়া বিদ্বেষ গুরুতর ক্ষতি করেছে বাংলাদেশে। প্রথম ও প্রধান যে ক্ষতিটা করেছে তা হলো মহাধিপতি এনজিওএম্পায়ারের সঙ্গে টিঁকেথাকা, মামলামোকদ্দমা করে রাষ্ট্রের সাথে দেনদরবারে পেরেশান সংস্থাগুলোর ফারাক পুরা উধাও হয়ে গেছে। এতটাই যে, এমনকি ঢাকার ডাকসাইটে বাম মিত্রকে আপনার মনে করিয়ে দিতে হয় যে অমুক থানার তমুক এনজিওটা বরং চিংড়ি ঘেরের নির্যাতিত মজুরের স্বার্থরক্ষার আইনী কাজটুকু করে থাকে। এটা কি আপনার মনে করানোর কথা ছিল? আমার মুখে ‘সিনেমায় কাজ করছি’ শুনলেই যদি আমাকে আপনার ৫২ ইঞ্চি বুকের ছাতির এবং হাজার কয়েক নতুন তারকা বানিয়েদিতেপারা সালমান খান মনে হয়, তাহলে আপনার আক্কেলআন্দাজ বাদ দিলেও, মাঠপর্যায়েরবিদ্যার হালহকিকতও তো গুরুতর বিপজ্জনক সাব্যস্ত করতেই হবে। ১৯৯৮ সালের আন্দোলনকালীন, এবং পরেও, ‘এনজিও’কে একটা নৈতিকতাশ্রয়ী গালাগালির বিশেষণ হিসাবে সামলাতে হয়েছে আমাদের/আমার খোদ বামমহলের কাছ থেকে। কিছু অভিজ্ঞতা টীকা আকারে না বলে বরং, কখনো প্রয়োজন পড়লে, জীবন ও সংগঠনের ইতিহাস হিসাবে উল্লেখ করতে পছন্দ করব। সারাংশেও যদি বলি, পদ হিসাবে ‘এনজিও’র একটা লেজিসলেটিভ বর্গ হবার কথা ছিল; দীর্ঘদিনের বামদলগুলো এটাকে একটা নৈতিকতাময়/মর‍্যাল বর্গ বানিয়ে সাংগঠনিকতার ক্ষতি করেছেন। কিছু সংগঠন ‘আপনার’ না হতে পারে, কিন্তু নানান সংগঠনের বিচার করার সময় মিত্রপক্ষ নীতিবোধে আক্রান্ত হলে, রাজনীতিবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। রাষ্ট্রনিবন্ধিত হতে গেলে এনজিও হওয়া এখন অনেকের জন্য ‘চয়েস’ নয়, বিশুদ্ধ ‘হকিকত’ কিছু ‘রাগি’ অগ্রজ কম্যুনিস্টের ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমার মাঝেমধ্যে ঈর্ষা জন্মে। তাঁদের কারো মতো হলে এখন ওইসব ২০ বছর আগের শুচিতাক্রান্ত প্রশাসনস্নেহধন্য খারিজপ্রবণ বামবন্ধুদের বলতে পারতাম: “বুঝো না তো কিছু, কাঁঠাল ঝুলায়ে কও লিচু”

তৃতীয় যে প্রসঙ্গটি বলতে চাইছিলাম, এখনো বিভিন্ন প্রসঙ্গে ‘ব্যক্তিসমূহ’ সংগঠনের বিরুদ্ধে আদালতে যেতে হয় চান না, না হয় সুবিধাজনক মনে করেন নাএটা বিশদ নাকরতে চেয়ে বলি, গত ৮১০ বছরেও আমি একাধিকবার বিভিন্ন ক্যাম্পাসে প্রশাসনের হিংস্রতায় কিংবা প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় ঘটা হিংস্রতায় যেসব শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে যোগযোগের চেষ্টা করেছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যোগাযোগই বিশেষ আগায়নি। যেসব ক্ষেত্রে যোগাযোগ কিছুটা আগিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা বা আইনী পদক্ষেপে সেসব পরিবার উৎসাহী হয়নি, যদিও কাগজেকলমে বাংলাদেশের আইন স্পষ্টত ভুক্তভোগীর পক্ষে রয়েছে। কেন আইনী পদক্ষেপ ব্যক্তিসমূহের তুলনায় নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অপেক্ষাকৃত (জ্বি একেবারেই তুলনামূলকভাবে) সুবিধাজনক, সেটা গুরুতর কঠিন প্রসঙ্গ নয় বুঝবার জন্য।

শেষত এটা বলব, অন্তত আপনার প্রশ্নের ফিল্টার অংশকে বিবেচনায় রেখে, হাইকোর্টের নীতিমালাটি যে সংগঠনের আবেদনেই হোক না কেন, এর বাণী, ধারণায়ন ও রাজনৈতিক উপলব্ধি গুরুতরভাবে ভিন্ন কিছু হয়নি আন্দোলনকারীদের চেতনার দিক থেকে। মাঝে যে এক দশক কেটে গেছে সেটার প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র। কিন্তু আসলে ফিল্টার হয়নি। তথ্য আকারে এগুলো বেশ সংবেদনময় যে, হাইকোর্টের নীতিমালা আর তার দশ বছর আগে আন্দোলনকারীদের দাবিনামার মধ্যে অমিল সামান্যই। আন্দোলনের অপেক্ষাকৃত পরিণত পর্যায়ে, দাবিনামার আনুষ্ঠানিক বাণী বানানোর সময়কালে, ঝানু কম্যুনিস্ট আর মানবাধিকার আইনজীবী, (ছোটো) এনজিওর ডিরেক্টর আর (এনজিও নিয়ে মর‍্যাল সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা) বামদলের সভাপ্রধান, মুখর ছাত্রী আর চৌকষ শব্দধারী লেখক সকলে একত্রে কাজ করেছিলেন। বরং, যেসব সংগঠন লাগাতার সমাজপরিসরে দেনদরবার দরকষাকষি জারি রেখে হাইকোর্টের স্পৃহাকে মূর্ত করেছে, ১০ বছর পরে হলেও, সেসব সংগঠনের ‘সংগ্রাম’টাকে লক্ষ্য করা দরকার, বিএনডব্লিউএলএ’র তো বটেই। পরন্তু, এই সংস্থাটি সংগঠনের থেকেও অধিক মোর্চা।

. হাইকোর্টের নীতিমালাটিতে যৌন নিপীড়নকে সম্মতি/অসম্মতির নিরীখে দেখা হয়নি। এই শব্দবন্ধর উপস্থিতিই নেই! এটিকে কিভাবে ব্যাখা করবেন?

মানস: সম্মতিঅসম্মতির ধারণায়ন এমনকি আন্দোলনের কালেও যতটা অনুধাবিত ছিল, ততটা উচ্চারিত ছিল না। এর একটা সমাজমনোজাগতিক ব্যাখ্যা করা যায়। সেটা হলো সম্মতির ধারণা যত উচ্চারিত হবে, ততই কিন্তু যৌনতাকে একটা চর্চা হিসাবে মূর্ত গণ্য করা হয়, বা ইঙ্গিতময় হয়এই মূর্তকরণের সামগ্রিক ট্যাবুর দিকে আমি মনোযোগ দিতে চাইব। হাইকোর্টের ক্ষেত্রেও সেটিই ঘটে থাকতে পারেএ প্রসঙ্গে সবচেয়ে লাগসই উদাহরণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রক্টরিয়াল নীতিমালা। যদিও এখানে দীর্ঘকাল ১৯২১ সালের প্রক্টরিয়াল নীতিমালাই বলবৎ ছিল, অতি সম্প্রতি সেটার রদবদল হতে শুরু করেছেমোটের উপর পূর্বানুমান আর বিচারবোধ গুরুতর বদলায়নি তাতে।

১৯২১ এর প্রক্টরিয়াল বিধিমালার যেসব বিষয়ে এখন অপেক্ষাকৃত কৌতুকের সঙ্গে তাকানো যাবে তার একটা অন্তত শাস্তির মুদ্রামান। যেমন, যতদূর মনে পড়ে, কোনো শিক্ষকের প্রতি যদি কোনো শিক্ষার্থী ‘প্রেমে’ পড়েন তাহলে উক্ত শিক্ষার্থীর ২৫ পয়সা দণ্ড হবে। লক্ষ্য করবেন, বিধিতে শিক্ষার্থীর উপলব্ধি লিঙ্গনিরপেক্ষ নয়; শিক্ষকের উপলব্ধিও নয়। বরং, আন্দাজ করা হয়েছে, ‘প্রেমে পড়া’ শিক্ষার্থী অবধারিতভাবেই নারী, আর শিক্ষকটি পুরুষ। কিন্তু এহেন ‘পতনে’ শিক্ষার্থী ২৫ পয়সায় যদি পার পেয়ে যানও, এটা অনেক পরিষ্কার নয় যে বারংবার ২৫ পয়সা খরচ করে তাঁর ‘প্রেমনিপতনের’ লাগাতার সুযোগ থাকছে কিনা। আন্দাজ করে নিতে হবে, তা থাকছে না। পক্ষান্তরে, শিক্ষকের এরূপ ‘প্রেমে পড়া’র শাস্তি চাকুরি থেকে বরখাস্ত। এখন আপনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়বার অধিকার রাখেন যে, যেসব অন্তত পুরুষ শিক্ষক তাঁদের হবুস্ত্রীকে শিক্ষার্থী বর্গ থেকে বাছাই করলেন, এবং পরিশেষে স্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্র ও ঈশ্বরের অফিসে নিবন্ধিত করলেন, তাঁদের কর্মকাণ্ডে ‘প্রেমপতন’ নাঘটে ছিল কিনা; থাকলে কীভাবে নাঘটন সম্ভব। কিংবা ঘটে থাকলে কীভাবে (পুরুষ) শিক্ষকটি চাকুরিতে বলবৎ থাকা অবস্থায় সহকর্মীদের মুরগির রোস্ট খাইয়ে তিনি বিয়েতে শামিল হতে পারলেন ইত্যাদি। বিষয়টা আরো ঘোরতর দুশ্চিন্তার হয়ে পড়ে যেহেতু এই অঞ্চলের প্রেমট্রেম মোটের উপর হবুবিয়ের একটা অলিখিত দলিলই বড়জোর। কিন্তু অধিকাংশ আইনের মত এই প্রক্টরিয়াল বিধানও এরকম রহস্যময়তাসমেতই বিদ্যমান ছিল। এখানে তার থেকে অনেক গুরুতর হলো ‘প্রেম’ পদটার অন্তর্গত অর্থসমেত উপলব্ধি করতে পারাকোথাও ফুটনোটে বলে দেয়া নেই, কিন্তু আপনারই ক্রিটিক্যাল পাঠক হিসাবে বুঝতে হবে যে শব্দটির প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে যাতে বাণীকারদের কোথাও যৌন শব্দটা লিখতে না হয়ফলে আদি প্রক্টরিয়াল বিধির ‌‘প্রেম’ হলো যৌনতা। এই অনুবাদ ছাড়া কোনো মাথামুণ্ডই উদ্ধার হবে না। এটা ইংরাজিবাংলা ভাষার প্রসঙ্গ নয়। ১৯২১ সালে অন্তত ইংরাজিতেই লিখিত ছিল। তারপরও ‘যৌনতা’র মতো গুরুভার শব্দের আমদানি ব্রিটিশরাজও করতে চাননি।

এইসব বলে আমি আপনার প্রশ্নের অমর্যাদা করিনি, বরং প্রশ্নটার গুরুত্বকে সামাজিকমনোযৌনজ পাটাতনে স্থাপন করতে চাইলাম। আমি দুটো অন্তত স্পষ্ট কারণ পাই হাইকোর্টের বাণীমালাতে সম্মতিঅসম্মতির ধারণা না থাকার পিছনে। প্রথমত, এখন সাইবারস্পেসের কিছু উত্তুঙ্গতায় যতটা পরিচিত, প্রাসঙ্গিক ও নির্ধারণী সামর্থ্য এই ভাবনাজোড়ের আছে বলে মনে করা যাচ্ছে, ততটা কিছুতেই হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের কালে ছিল না। পরিপার্শ্বের ভাষাভাবনাপদপ্রত্যয় নিরন্তর বদলাতে থাকে; তার ওজনের তারতম্য হয়। সেই বাস্তবতাটা আমি স্মরণ করতে চাই। কিন্তু মুখ্য কারণ সম্ভবত এই মনোগড়ন যে, সম্মতির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেই একটি প্রতিষ্ঠান হামলাকে হয়তো শনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে; কিন্তু যৌনকাজকর্মকে উৎসাহপ্রদান করেছে বলে প্রতীয়মান হয়ে থাকতে পারে। আমি এমন কিছু নারী অভিভাবককে চিনি যাঁরা তাঁদের তত্ত্বাবধানে বা আধাতত্ত্বাবধানে থাকা বালিকাদের, ১৮ ঊর্ধ্ব বা নিম্ন, বাইরে নড়াচড়ার জীবন শুরুর প্রাক্কালেই জন্মশাসন ও যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ক তালিম দিতে পছন্দ করেন। তাঁদের এই তালিমইচ্ছাকে আমার অত্যন্ত বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ মনে হয়। কিন্তু প্রায়শই বৃহত্তর পরিবারের অপর সদস্যরা এসকল নারীদের উপর অতিশয় বিরক্ত হন; কখনো সাংঘর্ষিক সম্পর্কও তৈরি হয়। তালিমকারী নারীদের দেখা হয় ওইসকল অল্পবয়স্কা নারী, বা জাতিসংঘীয় নারী শিশুদের, যৌনজীবনে উৎসাহপ্রদান হিসাবে। আমার এই উদাহরণে এটা দেখাতে চাইলাম যে কতিপয় ভাষামালা কিংবা কার্যক্রম নৈতিক বিচারে দুষ্ট হিসাবে সাব্যস্ত হবার ঝুঁকিতে থাকে। সম্মতিঅসম্মতি যুগল আলাপ জগতে এখন আপনার যতই প্রাসঙ্গিক লাগুক না কেন, অভিভাবকসুলভ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে এটা যৌনকাজের মতো ‘নিন্দনীয়’ একটা কাজের প্রতি সমর্থনসূচক বিবেচিত হবার পরিস্থিতিতে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সেজন্য এমন ভাষায় আগাতে পারেন যা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, নিশ্চুপ।

. আমরা একটু আগেই দণ্ডবিধির কথা বলছিলাম। তো ঔপনিবেশিক এবং ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধের দ্বারা তাড়িত এই আইনে যৌনতার নানা ফর্মকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। হাইকোর্টের নীতিমালাতেও আমরা কতকগুলো আচরণকে যৌননিপীড়ন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে দেখি। সম্মতি/অসম্মতির প্রশ্নহীন এবং কতকগুলো আচরণ দ্বারা যৌন নিপীড়নকে চিহ্নিত করার এই পদ্ধতিও কি ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধ তাড়িত? এই আচরণগুলো মিউচুয়াল হতে পারে, কিন্তু তা স্বীকার না করাটা খোদ যৌনতার উপরেই ঔপনিবেশিক ধাঁচের নিষেধাজ্ঞা নয় কি?

মানস: আমার আশঙ্কা এই প্রশ্নটিতে দুই নম্বর প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি আছে। তাছাড়া আমি এও মনে করি এই প্রশ্নটির আসলে শেষাংশটাই কেবল লিপিবদ্ধ থাকলে প্রশ্ন হিসাবে তীব্র লক্ষ্যমুখ থাকত। মানুষসমূহের পরস্পরের ইচ্ছানুযায়ী সম্মিলনের ক্ষেত্রে আদালতের আইনগুলো যথেষ্ট উন্মুক্ত নয় কেন এই প্রশ্নটা নিজগুণে গভীরভাবে পর্যালোচিত হবার মতো। ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ আইনকানুনকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে সেটাও আমি নামানার জায়গায় নেই। বরং, আমার আগ্রহ হবে একদম বিদ্যাগত তর্কলড়াইয়ের বাইরে বারংবার ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ না বলারও। কারণ কখনো কখনো আমরা একটা পদপ্রত্যয়ে বন্দি করতে চাইলেও আসলে এই মনোজগতে বিরাজ করে অনেকগুলো সম্পর্কিত অনুভূতি – যৌনশুচিতাবোধ, পাপপুণ্যবোধ, রুচিবোধ, ভালমন্দের বোধ, ন্যায়অন্যায়ের বোধ, কর্তৃত্বনিয়ন্ত্রণের বোধ, ঈর্ষার বোধ। যদি ‘বৈজ্ঞানিক’ প্রমাণ করতে আমাদের অসুবিধাও হয়, আমার তো ধারণা আমার এই রচিত বাক্যটি পঠিত হবার সাথেসাথেই মূর্ত হয়ে গেল যে কতরকমের জটিল অনুভূতিপাটাতনের মধ্যে কখনো ব্যক্তি কখনো প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারে। ফলে আদালত কিংবা আর কোনো প্রতিষ্ঠান যে মূল্যবোধে ‘তাড়িত’ থাকেন তার নাম ভিক্টোরীয় হবে নাকি ঔপনিবেশিক নাকি আর কিছু এসবের আগ্রহের থেকেও আমার আগ্রহ সেগুলোর বৈশিষ্ট্যকে শনাক্ত করা। আমি বরং একটা ব্যানারে বোঝার চেষ্টাকেই বিপজ্জনক মনে করি।

এই প্রশ্নটির একটা পূর্বানুমানঘটিত, বা আশাবাদঘটিত, সঙ্কট আছে। নিপীড়নকে প্রতিহত করার আইন বা বিধিমালার কাছে যৌনচর্চার দিকনির্দেশনা আশা করার সঙ্কট সেটা। আমি সেটা করতে চাই না; আমার মাথা ওভাবে কাজ করে না। করে না কেন ভেঙে বলি। বাংলাদেশ এবং নানান দেশে করোনাকোভিডকালে আইসোলেশনকোয়ারেন্টাইনের যে বিধিগুলো এসেছে সেগুলো প্রায় আইনেরই শামিল। কোনো কোনো রাষ্ট্রে প্রকৃতই সংসদসিদ্ধ, বা রাষ্ট্রপ্রধানসিদ্ধ আইনও হয়েছে (আইন, বিধি, অধ্যাদেশ, কানুন, হুকুম, পরিপত্র, জনস্বার্থেঘোষণা এগুলোর পৃথক সব শক্ত আইনগত/লিগ্যাল সংজ্ঞা আছে; আমার মুখস্ত নয় সেসব; এই আলাপে জরুরিও লাগছে না)তো সেসব আইন পড়ে যদি আমরা বলতে থাকি যে এই করোনাআইন এমনকি বৈধ জুটিসমূহের মধ্যকার চুম্বনচর্চার জন্য জায়গা রাখেনি, তাহলে আমাদের সেই দাবি চূড়ান্ত বিচারে মিথ্যা হয়তো নয়, কিন্তু অস্থানে প্রোথিত হতে বাধ্য। করোনাবিধিগুলোর গুণগত মানই এমন যে দ্বৈতকোয়ারেন্টাইনে থাকা ছাড়া এমনকি ঈশ্বরকে সাক্ষীমানা জুটিগুলোও চুম্বন ও অন্যান্য চর্চা করতে পারেন না। কিন্তু আমার আন্দাজ যে ঠিক সেই আশঙ্কার সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গত বছর সারা দুনিয়ার মানুষ চুম্বনরহিত ছিলেন না আদালত পরিচালকবর্গের মাথায়, রাষ্ট্র পরিচালকবর্গের মাথায়, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালকবর্গের মাথায় যৌনশাসন ও যৌনশুচিতার নানান কিছু কিলবিল করছিল কিনা সেটা আরেক জিজ্ঞাসা। যৌন নিপীড়ন বিরোধী বিধিমালা বুঝবার সময় সেই মনোভাব আমি রাজনৈতিক কারণেই নাভাবতে চাইব। চাইব ঠিক প্রসঙ্গটার বাঁক ঘুরিয়ে। তখন শুচিতার পরাকাষ্ঠার জন্য কেবল আইনআদালতের দিকেই আঙুল তুলতে চাইব না।

বরং, আমরা কিছু ‘বৈজ্ঞানিক’ শাস্ত্রের দিকে তাকাই। এমনকি তেমন কখনো ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল না এমন রাষ্ট্রসমাজের দিকেও তাকাতে পারি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে সমরতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে কথা তুললেই মেলা কথা খরচ করা লাগে। কিন্তু আমার ভরসা আছে যে এর সঙ্গে আইন ও বিচারশাস্ত্র, মনোবিদ্যা, মনোচিকিৎসা, অপরাধবিদ্যা ইত্যাদির সম্পর্ক বুঝতে অত সমস্যা লোকজনের হবে না। তো, চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত কিতাবগুলোতেই বা ‘যৌনতার নানা ফর্ম’ নিয়ে কী এমন সুবিধাজনক আলাপ পাওয়া যায়? বাংলাদেশের পাঠ্যসূচি হয়তো আপনাকে একটু বেশি চমকে দিতে পারে, হয়তো; কিন্তু ইউরোপীয় চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ্যসূচিও ‘স্বাস্থ্যকর যৌনতার’ যেসব ধারণা বা ব্যাখ্যা হাজির করে তাও রীতিমত ঐশী পর্যায়ের। মনুষ্য নানাবিধ কল্পনা, অধিকল্পনার জায়গা অতিশয় সীমিত। এর উপরে ভিত্তি করেই সেক্সোলজি, সাইক্রিয়াট্রি, সাইকোলজি কাজ করে চলেছে। এমন এমন লোককে ‘চিকিৎসাযোগ্য’ বলে সাব্যস্ত করছেন যাঁরা বড়জোর ‘মিচ্যুয়েল’ কিছু যৌনচর্চা করছেন যা ওইসব চিকিৎসাবিজ্ঞানীর কল্পনাতীত। অথবা তাঁরা কাগজেকলমে দাবি করেন তা ‘অস্বাভাবিক’পর্ন কারখানার মাত্রাতিরিক্ত উত্থান সমস্যাটিকে আরো তীব্র করে তুলেছে। এখানে অনেকগুলো শাস্ত্রের প্রহরীরা ‘স্বাভাবিক’এর দুনিয়াকে আরো খর্ব করে বিরাট প্রশস্ত ‘অস্বাভাবিক’এর উপর পর্নকারখানার একচ্ছত্র শাসন কায়েম করতে মদদ দিচ্ছেন। সজ্ঞানে তা তাঁরা করছেন কিনা তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এটা ঘটছে। যৌনতার সার্বভৌম গণতান্ত্রিক কল্পনাময় চর্চার ক্ষেত্রে এটা বিরাট এক জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপর্যয়। এখানে আদালত একটা অত্যন্ত ছোট অনুষঙ্গ মাত্র।

. হাইকোর্টের নীতিমালাটিতে বলা হয়েছে তা কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য। একটি কর্পোরেট বা কর্পোরেট সংস্কৃতির চর্চাকারী প্রতিষ্ঠানে যৌনতা সংক্রান্ত যে যে নিষেধাজ্ঞা গড়ে ওঠে তাকে যৌন নিপীড়নের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পুঁজি ও তার ত্রাসের সংস্কৃতি খোদ যৌনতার বিশেষ বিশেষ ধরনকে অপছন্দ ও অপরাধীকরণ করে কেন?

মানস: এই প্রশ্নটি আমার জন্য অস্পষ্ট। আমি তার জন্য দুঃখপ্রকাশ করি। কিন্তু আমি দুই তিনটা অংশে ভেঙে উত্তর করি। তাতে আপনার প্রশ্নের আদিগুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে অবশ্য। প্রথমেই আমি স্পষ্ট করি যে, হাইকোর্টের নীতিমালাটি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রযোজ্য হলেও বাস্তবে উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানই যারপরই নাই ঢিলেমি দেখিয়েছে এটার প্রতিক্রিয়া হিসাবে একটা কাঠামো দাঁড় করাতে। ঠিক এই মুহূর্তে যে বাক্যটি লিখলাম তাতেই ঝইঝগড়া বাধতে পারে, প্রমাণ হাজির করানোর চাপও কেউ দিতে পারেন। কিন্তু বিষয়টা কেবল খাতাকলমে কী কী করা হয়েছে তার নয়, বরং কী কী গররাজিময় আচরণ আপনি নথিভুক্ত না করতে পারলেও উপলব্ধি করতে পেরেছেন তার প্রশ্ন। সাধারণ বোধবুদ্ধি থেকে ভাবলে, অন্তত ১৯৯৮এর আন্দোলন এবং একাধিক ক্যাম্পাসে গুণ্ডাবাহিনী ও (পুরুষ) শিক্ষকদের একাংশের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনগুলোর কারণেও, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে হাইকোর্টের নীতিমালা আসার সঙ্গে সঙ্গে চটজলদি তার ‘প্রয়োগ’ ঘটবার কথা। কিন্তু বাস্তবে এভাবে ঘটেনি বিষয়গুলো। একাধিক ক্যাম্পাসেই প্রশাসন এই সেলটি গঠনের সময় গভীর অনুধ্যান দিয়েছেন যাতে ক্যাম্পাসে নারীবাদী বলে পরিচিত কোনো শিক্ষকশিক্ষিকা এই সেলের দায়িত্ব না পান। কিংবা, অত্যন্ত নৈতিকতার ঘ্যানঘ্যানানি দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরিচালন করেন এমন শিক্ষকশিক্ষিকারা এই পদে ন্যস্ত হন। উপরন্তু, ওইসব সেলে যেসব নারীরা তাঁদের অভিযোগ নিয়ে গেছেন তাঁদের অনেকেরই বিশদ সব হেনস্তা হবার গল্প ক্যাম্পাসগুলোতে কান পাতলেই শুনতে পাবেন। একটা নয়া নীতিমালার সুযোগ নিয়ে দুচারজন পাল্টা চালিয়াতি/ম্যানিপুলেটিভ আচরণ করার উদ্যোগ নেননি এরকম কোনো দাবি প্রতিষ্ঠা আমার লক্ষ্য নয়। কিন্তু সাধারণভাবেই সেলগুলো অনেকাংশে অভিযোগকারিণীর দুঃস্বপ্নের জায়গা হয়ে পড়েছিল।

শিল্পি: হিথার বুচলার

ক্যাম্পাসের বাইরে কর্মক্ষেত্রগুলোতে যৌন নিপীড়ন বিরোধী এই সেলগুলোর কাগুজে অস্তিত্বের বাইরে আর কোনো কিছুর প্রমাণ করা মুস্কিল হবে। এ কথা বলার সময় আমি সতর্ক আছি যে কর্মক্ষেত্রের মতো একটা ঢিলেঢালা বর্গের মধ্যে সকল ধরনের অবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান আমি রাখতে চাইব না। কিছু উন্নয়ন সংস্থাতে কার্যকরী সেল চালু ছিলআবার যৌন হয়রানির অভিযোগ আসার পর খোদ সংস্থাটিই ‘পরিচালক’ বর্গ ভেঙে দিয়ে আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করলেন এরকম নজিরও আছে (যদিও গণ সাহায্য সংস্থার এই উদাহরণটা হাইকোর্ট নীতিমালা প্রণীত হবার আগে)পত্রিকাটেলিভিশন কোম্পানিগুলোতে বিশেষ সুবিধাজনক কর্মদশা ছিল এরকম নজির আমার নজরে আসেনি। আপনার বা অরাজের মাধ্যমে জানতে পারলে খুশি হব। তবে আমার চোখে আপনার পরের একটা প্রশ্নে মীটু বিষয়ক আলাপ চোখে পড়ল। ঢাকার অতিসংক্ষিপ্ত কালের সাইবারমীটু আন্দোলনই প্রমাণ করে খুব কার্যকরী সেল বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে ছিল না। কিন্তু আপনার প্রশ্নের যৌন নিষেধাজ্ঞা ও যৌন নিপীড়নের সম্পর্ক সংক্রান্ত বিষয়ে দুয়েকটা কথা বলার আগে ‘কর্পোরেট’ সংজ্ঞায়ন নিয়ে আমার অস্বস্তি জানিয়ে নিতে চাই। আমি আসলে এই মুহূর্তের বাংলাদেশে এই বর্গটার অনায়াস প্রয়োগের আর সুযোগ দেখি না। বাণিজ্য ও শিল্প আইনগত দিক থেকে হাজারেবিজারে কর্পোরেট। যাকিছু কয় বছর আগেই লিমিটেড কোম্পানি, তাকিছুই কর্পোরেট সংজ্ঞাযোগ্য। আবার যখন (বাম) রাজনৈতিক কর্মীরা এটা উচ্চারণ করেন তখন অন্তত দুইটা, প্রায়শই অমিশ্রিত অর্থে প্রয়োগকৃত হয় বলে আমি অনুভব করি। একটা হয় সরাসরি পুঁজিবাদী বিশেষণটির বিকল্প হিসাবে; আরেকটা হয় কল্পিত একটা বিলাতি/বিদেশী সংস্কৃতির ধারক হিসাবে। শেষোক্ত অর্থে আবার অফিসের অভ্যন্তরীণ স্থাপত্য, কর্মচারিদের উর্দি বা পোশাকও উঁকি মেরে বিরাজ করে। যতক্ষণ না আমি নিশ্চিত হই যে একটা সাংস্কৃতিকমর‍্যাল জমিনের সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে থেকে এই প্রত্যয় উচ্চারিত হয়েছে ততক্ষণ এর সঙ্গে সম্পৃক্তি করা অসম্ভব লাগে। অন্তত চাকুরিচুক্তির অনিশ্চয়তা, বৃহৎ মুনাফা, সদাছাঁটাইয়ের সন্ত্রস্ততা, আন্তঃরাষ্ট্রীয় লেনদেন, বহুরাষ্ট্রীক ‘ব্র্যান্ড’ ভ্যালু এগুলোর কিছু কিছু অনুধাবনে না দেখি ততক্ষণ মুলতবি রাখার পক্ষে।

যৌন নিষেধাজ্ঞা আর যৌন নিপীড়নের সংযোগস্থাপন করে ভাল করলেন; আপনার আগের প্রশ্নের সঙ্গে বরং সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি আবারো বলব, বিধানপ্রণেতার মাথার মধ্যে কী আছে তা নিয়ে টানাটানি নাকরে লিপিবদ্ধ বিধানের কার্যকরী প্রয়োগ লিঙ্গ রাজনীতির জন্য আরো আশু জরুরি। কিন্তু পুঁজি (ও তার ত্রাসের সংস্কৃতি?!) কিছু কিছু যৌনাচরণকে অপছন্দ করে বা অপরাধীকরণ করে এ বিষয়ে আমি একমত হতে চাইব না। আমার ধারণা সঙ্কটটি কর্তার, সাবজেক্টের। ধরুন, আমাদের কল্পিত কর্মক্ষেত্রটির প্রধান একজন পুরুষ; বা প্রধানসমূহ পুরুষেরা। তিনি বা তাঁরা এক বা একাধিক বিশাল অফিসে বসেন। এর বাইরেও নানাবিধ ‘স্পেস’ রয়েছে তাঁর/তাঁদের দখলে। (এই কল্পনাগুলো করতে গেলে কিছু ছায়াছবি আসবেই মাথায়; কিন্তু সেগুলোতে কোলবালিশ আর জরিটরি ঝুলিয়ে এমন পাকিজাধরনের ইন্টেরিয়র বানায় যে সিরিয়াসলি নেয়া মুস্কিল; কিন্তু এরকম ‘শিল্পপতি’ ‘ভিলেইন’ সিনেমাতে সুলভ)সেই দখলকৃত পরিসরে নানান ধরনের পদকনিষ্ঠ নারীদের তিনি আসতে ‘বাধ্য’ করছেন। এইরকম একটা ব্যবস্থাতে সংস্থার প্রধান পুরুষের/পুরুষমণ্ডলীর কোনো ধরনের যৌনাচরণকে পুঁজি বা (তার ত্রাস) কোনোরকম অপছন্দ করে এসেছে বলে আমি মনে করি না। বরং, এই ব্যবস্থায় আপত্তিকারদেরই ওই সংস্থার পুঁজিরপোঁটলা পরের মাসগুলোতে বেতন না দিতে চাইতে পারে।

আমি বিনীতভাবে মনে করি, এখানে আপনার প্রশ্নটি আসলে অন্যত্র দিকনির্দেশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এত সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয়ে আমরা রয়েছি যে আমি দিকনির্দেশনা উদ্ঘাটন করতে চাইনি এই প্রশ্নে। বেঁচে থাকলে, নিশ্চয়ই আবার প্রশ্নগুলো সাজাতে পারব আমরা।

১০. যৌন নিপীড়নের সাক্ষ্য প্রমাণ হাজিরে অভিযোগকারীর জন্য কতকগুলো এফারমেটিভ একশনের বেনিফিটের প্রশ্ন আলোচিত হয়। এই বিশেষাধিকারকে প্রযোজ্য করা হলে যৌন নিপীড়নের শনাক্তকরণ কতটা নির্মোহ থাকতে পারে?

মানস: আশা করি এটা বলা কোনো দপ্তরের অবমাননা হবে না যে, লাগাতার ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে কোনো নিপীড়ন শনাক্তকেই নির্মোহ হিসাবে দেখতে পাওয়া মুস্কিল। তাছাড়া আদালতের, কিংবা বিচারিক কার্যক্রমের নির্মোহতাকে আমি মিথ বা প্রপাগান্ডা হিসাবে মানি। তা নাহলে রোনাল্ড রিগ্যানের সময়কার একাধিক বিচারককে সরানোবসানোর মতো ঘটনাগুলো বোধগম্য হবে না। বাংলাদেশের নিকট অতীতের কোনো উদাহরণ না দেয়াই মঙ্গলময় মনে হলোতবে শহিদুল আলমের মুক্তিকালে আদালতে ওঁর ‘গুম’ নাহবার বাস্তবতায় সন্তোষ প্রকাশ করে বিচারকের সরস মন্তব্যটি বাংলাদেশের পাঠকেরা লক্ষ্য করেছেননিপীড়নকে নির্মোহ যদি শনাক্ত করা যায়ই ধরে নিই, তাহলে তা জনসমাজে চর্চিত ‘ইনসাফ’এর ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখতে পাই আমি। আর এক্ষেত্রে কোন ইনসাফকার ইনসাফকে ঠিক করবে ধরনের বিনির্মাণকারী কলাকৌশলকে কূটকৌশলের সন্দেহেও দেখতে চাইব। কিন্তু আইনী প্রক্রিয়ার নির্মোহতা নিয়ে অনেক উৎসাহ নাই আমার। আমি গণতন্ত্রকে যেমন দশার অধিক, পদ্ধতিগত আকাঙ্ক্ষার চর্চা হিসাবে দেখতে চাই, তেমনি বিপ্লবকেও তাই চাই; আবার আদালতের কাছে নির্মোহনিপীড়নশনাক্তকরণের বেলাতেও এটাকে স্থিরদশা হিসাবে দেখতে চাই না।

কিন্তু এফারমেটিভ একশন বেনেফিট খোদ একটা গোলমেলে প্রসঙ্গ। যৌনতার ক্ষেত্রে সেটা মহাগোলমেলে, এর নৈতিকতাশ্রয়ী বা মূল্যবোধাশ্রয়ী সমাজবিচারিক দশার কারণেই। প্রথমেই আমি পদ্ধতিগত গোলমালটার দিকে নজর দিতে সুপারিশ করব। এফারমেটিভ একশন নিরঙ্কুশভাবে বর্গকে অনুধাবন করে বিকশিত ধারণা। কোর্টকাচারি, পক্ষান্তরে সামলায় ব্যক্তির মামলা। ওদিকে বর্গকে অনুধাবন করে যে গঁৎবাঁধা ধারণাগুলো বা স্টিরিওটাইপগুলো চালু আছে সেগুলোও সক্রিয় থাকে; বিচারকের মাথায় যদি নাও থাকে, আইনজীবীর মাথায় থাকতে পারে, মিডিয়ার মাথায় থাকতে পারে, একটা রায়ের বেনেফিশিয়ারি ও প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রবাসীদের মাথায় থাকতে পারে যেগুলো সব সক্রিয় অবস্থাতেই মোকদ্দমাটি চলতে থাকে। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় নির্দিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠীর ‘কোটা’ সুবিধা নিয়ে নিশ্চয়ই কয়েকবার শুনে থেকেছেন যে ‘হ্যাগো এখন আর কোটা দেয়া ঠিক না; হ্যাগো পোলাপাইন তো আইজকাল বিদেশ থাকে’এই স্টিরিওটাইপটা যতটা একটা নির্দিষ্ট জাতিকে কোটাবঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হয় ততটাই হয়ে থাকে খোদ এই সামান্য কয়টা আসনের (এফারমেটিভ একশন হিসাবে) দাবিদার হিসাবে অনেকগুলো জাতিকেই উৎখাত করার ইচ্ছায়। বাসে নারীদের সংরক্ষিত আসনের বেলাতে এই অভিজ্ঞতা বোধহয় আপনার আরো নিকট অতীতেই হয়ে থাকছে। ফলে এফারমেটিভ একশন চালু থাকে খোদ একটা বিশাল গণপ্রতিপক্ষতার মধ্য দিয়ে, প্রায়শই।

অন্য কিছু উদাহরণ দেখাতে চাইব যেখানে বর্গকেন্দ্রিক স্টিরিওটাইপ অতিশয় ক্রিয়াশীল। কোনো মন্ত্রীকে যখন ‘সৎ মন্ত্রী’ হিসাবে পরিচিত করানো হয়ে থাকে, কোনো শিক্ষককে যখন ‘শিক্ষার্থী বান্ধব’ শিক্ষক হিসাবে পরিচিত করানো হয়ে থাকে, তখন ঐ মন্ত্রী বা শিক্ষককে যতটা ‘প্রশংসা’ করা হলো, তার থেকে অনেক স্পষ্ট করে মন্ত্রী বা শিক্ষকবর্গ নিয়ে সামাজিকধারণা প্রকাশিত হলো। শ্রোতারা প্রায়শই চিন্তার আলসেমিতে সেটা লক্ষ্য না করে প্রশংসাটা নিয়ে মাতামাতি করেন। ব্যক্তি প্রশংসাগ্রহীতার এই ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো দোষ যদি নাও ধরি, তৃতীয় পক্ষ হিসাবে আমরা অন্যরা গুরুতর সব ক্ষয়ক্ষতির পরোক্ষ কারক থাকছি। উদাহরণটা যদি প্রাসঙ্গিক না মনে হয়ে থাকে, আমি এভাবে আগাতে চাই যে, যৌন হয়রানিমূলক কোনো অভিযোগ উত্থাপনকারীর সচ্চরিত্রতা বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়ে থাকে। সংবাদকর্মী থেকে শিক্ষাকর্মচারী, সাধারণ আলাপকারীরা ‘সমতাবিধানকারী কর্মকাণ্ড’ (এফারমেটিভ একশন) জারি রাখার লক্ষ্যে আক্রান্ত নারী যে ‘কত ভাল’, ‘নিরীহ’, ‘সঠিক পোশাকধারী’, ‘নম্র’ ইত্যাদি আলাপমালায় ঢুকতে থাকেন (বা বিপরীত উদ্দেশ্যে বিপরীত চিত্রণ)আমি বলবার সাথেসাথেই এই ধরনের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ার কথা। তাহলে নির্মোহতা তো দূরের কথা, বিদ্যমান আইনী ব্যবস্থার গ্রাহক হবার জন্যও যৌনাক্রান্ত নারীর অন্য অনেকগুলো সামাজিক সনদপত্রের ছাতার তলে আসতে হয়। ওই নির্দিষ্ট নারী তা চান কিনা তার প্রসঙ্গও থাকে না। নির্মোহতা বিষয়ক আলাপটাই তাই মুলতবি রাখলাম গোড়াতে।

বরং, যদি প্রশ্ন করার কালে আপনার মাথায় কোথাও অভিযোগকারীর বদনিয়ত বিষয়ক দুর্ভাবনা থেকে থাকে, তাহলে বুঝতে আরো সহজ হয়। সেটা বাস্তবে যে কোনো ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। নিজের মাথা ফাটিয়ে আদালতে গিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রুজু করার উদাহরণ দুয়েকটা মাত্র নয়। এই ধরনের পরিস্থিতি যদি বিবেচনায় থেকে থাকে, তাহলে তা যৌন হয়রানিমূলক পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট করে দেখতে চেষ্টা করা লিঙ্গীয় রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে।

ভিক্টমের বয়ান: ডিজিটাল প্লাটফরম ও নর্মেটিভ
১১. সাম্প্রতিক সময়ে ‘মিটু’ বেশ আলোচিত। অনেকেই মনে করেন মিটুর মাধ্যমে ভিক্টিম/সার্ভাইভারের স্বর হাজির হয়। কিন্তু ডিজিটাল প্লাটফরমে এই স্বর উপস্থিত হওয়া মাত্রই আমরা পক্ষবিপক্ষ দলবদ্ধতা হাজির হতে দেখি। এতে করে কি পক্ষ, কি বিপক্ষ মিলে যে ডিসকোর্স দাঁড় হয় তাতে অভিযোগকারীর স্বরটি তার পরিপ্রেক্ষিত সমেত আর স্বতন্ত্র থাকতে পারে কি? ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ এই স্বরকে কি কোনভাবে ছাঁচীকরণ করে?

মানস: ডিজিটাল তৎপরতা ও তার ভাষামালা এর বাইরের বস্তুজগতের মতোই একটা অসংবদ্ধকোলাহলে পরিণত হয়। যে হারে একাডেমিতে উৎপাদন হচ্ছে তাতে হয়তো যাকে আমি অসংবদ্ধকোলাহল বললাম তারও একটা পদমালা দাঁড়িয়ে আছে; তবে আমার জানা নেই। যদিও আমি ডিজিটাল জগত ও বাইরের কোলাহলকে এক কাতারে রাখলাম, বাস্তবে এর গুণাগুণ বা প্রভাব কিছুতেই এক নয়। যে কোনো বিষয়েই অসীম মতামত তৈরি হতে থাকা, সেগুলোর একটা প্রণালীবদ্ধতা, যতই খাপছাড়া ও সাংঘর্ষিক হোক না কেন, তার জন্য ভাষাসংযোগের সুযোগসুবিধাগুলো বস্তুজগতে গুরুত্বপূর্ণ হারে কম থাকে। এটা পরিপূর্ণভাবে, আমার বিবেচনায়, পাটাতন/প্ল্যাটফর্মের প্রসঙ্গ, ডিভাইস/যন্ত্রপাতির প্রসঙ্গ। কেবল কথা বলে বলে একটা হৈচৈ বাধানো সহজ কাজ নয়। আরো নির্দিষ্টে উদাহরণ দিলে, গণপিটুনির ঠিক পূর্বকালটাতে, কিংবা দুই দল (তরুণ) পেটোয়াদের মধ্যকার একটা হাতাহাতি বেধে যাবার আগের সময়কালটাতে ভাষা যেভাবে বহুবিধ, নানাউৎসে, আর শ্রোতাহীনতায় উৎক্ষেপ হতে থাকে সেটা কিছুতেই দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রসঙ্গ নয়। তারপর পেটাই শুরু হয়ে গেলে হয়তো ভাষামালার আপৎকালীন, বা পেটাইকালীন, বিরতি চলে; অল্প কিছু সহগ খিস্তিখেউড় ছাড়া। পক্ষান্তরে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এই কালটা, যদি এর নাম দিই তাতানোকাল, একটা স্বাভাবিক দশা। অন্যভাবে বললে, বস্তুজগতে যেটা কিনা একটা বিশেষ সংঘটন, তা ডিজিটাল রাজ্যে দৈনন্দিন। এখানে লোকে লাগাতার ভাষা উৎপাদন করতে পারেন, করতে থাকেন, দিশাবেদিশা নিরপেক্ষভাবে সেগুলো প্রযুক্ত হতে থাকে; উপরন্তু বস্তুজগতের আর্কাইভহীনতার বাড়তি নিরবতাটা এখানে নেই। এখানে ১৪ ঘণ্টা ঘুম থেকে উঠে আপনি কম্পুটার খুলে ১২ ঘণ্টা আগে মোটামুটি স্থিত মুডে আবার তাতিয়ে দিতে পারেন। সাইবাররাজ্যের এই বিশেষ ভাষাবৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় রাখাটা আমার জন্য জরুরি ছিল এই প্রসঙ্গে।

মিটু’র ক্ষেত্রে যাযা ঘটেছে তাও এই পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যেই ঘটেছে। হ্যাঁ, হৈচৈয়ের মধ্যে অভিযোগকারীর স্বরটি তার পরিপ্রেক্ষিতসমেত আর স্বতন্ত্র থাকতে পারে না। কিন্তু ‘মিটু’ প্রসঙ্গে আমি অন্য কিছু প্রসঙ্গের সূত্রপাত করতে চাই যা, আমার আশঙ্কা, আপনার প্রশ্নের পরিসরের বাইরে মনে হতে পারে। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসার পরিক্ষেত্রেরই মধ্যে। আমি প্রশ্নের পরিসরের মধ্যে আনতে বরং চেষ্টা করতে পারি। চলুন, আমরা এই জিজ্ঞাসাটির মীমাংসা করি যে বাংলাদেশে ‘মিটু’ ‘সফল’ হলো না কেন, যদি ধরে নিই যে পাশ্চাত্যের যেসব দেশে, মুখ্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যা হয়েছে তাকে সাফল্য বলা চলে। যদি শর্তসাপেক্ষে পাশ্চাত্যে এর সফলতা আর বাংলাদেশে বিফলতা গ্রাহ্য করে আমরা আলাপটা করি, তাহলে এখানকার বিফলতার কারণ অন্যত্র বলে আমি মনে করি। যেভাবে আপনি প্রশ্নের মধ্যে পক্ষবিপক্ষের দলবদ্ধতা রেখেছেন, কিংবা যেভাবে আমি অসংবদ্ধকোলাহলকে উত্তরে রেখেছি সেগুলো এই ব্যর্থতার কারণ নয়। বরং, সাইবার ও ভৌত দুনিয়ার হৈচৈ বা দলবদ্ধতা বিভিন্ন রাষ্ট্রে নানান ধরনের আইনি মোকদ্দমাতে সহায়তাও করেছে। নিকটবর্তী দুটো উদাহরণ ভারতেই আছে – যথাক্রমে নির্ভয়া ধর্ষণ ও সুশান্ত’র কথিত আত্মহত্যা বা খুন নিয়ে। বাংলাদেশে কমবেশি পাঁচটি ‘মিটু’ কেইস/ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গেছিল। এর মধ্যে অন্তত তিনজনকে আমি কমবেশি চিনতাম। আর জনা দুয়েকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল এই অভিযোগ উত্থাপনের প্রাক্কালে বা পরপরই। বাস্তবে, এমনকি তিনি না করুন ‘মিটু’ তা মনে মনে চাইছিলামও একটি ক্ষেত্রে। তাঁকে বিশদ পরে বলেওছি।

বাংলাদেশে এটির ব্যর্থতা মুখ্যত আইনি (লেজিসলেটিভ অর্থে) ও নৈতিকতা (মর‍্যালিটি অর্থে) রাজ্যের মধ্যে প্রজাদের নির্বিচার আউলে যাবার দশার কারণে। এটা সংক্ষেপে বললাম, বিশদ করতে পারি। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, বিশেষত ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত – তাঁরা বাম হোন, জাতীয়তাবাদী হোন, রাষ্ট্রবাদী হোন বা ‘র‍্যাডিক্যালহোন – সমালোচনাকে বহুকাল ধরেই দ্রুত নিন্দাতে পর্যবসন করতে অভ্যস্ত, আর নিন্দা মোটের উপর আদর্শবাদী এবং/বা মর‍্যাল। এখন, ‘আদর্শবাদ’ বলতে গিয়েও এত উৎকণ্ঠা হচ্ছে যে মনে না পড়ে থাকছে না এখানকার বহু বামচিন্তক দশকের পর দশক আবেগ ভারাক্রান্ত গলায় ও রচনায় ‘আদর্শবাদ’ বলতে বিপ্লবীর ঈমান বুঝিয়েছেন। ফলে আগামীকাল এই সাক্ষাৎকার পড়েই ‘আদর্শচ্যুত প্রতিবিপ্লবী’ ফরমান জারি করে বসতে পারেন তাঁরা আমার বিরুদ্ধে। আমি আদর্শবাদ বলতে আইডিয়ালিস্ট এবং/বা মর‍্যালিস্ট এবং/বা নরমেটিভই বোঝাচ্ছি। আমার তাই বোঝানোর কথা। ধরুন, কালকে আপনার সমালোচনা করতে গিয়ে আমি নিন্দা করলাম এই বলে যে আরিফ তো ব্যবসা পাতায়া বসছে। তার থেকে শ্রোতা হিসাবে কেউ যদি ভাববার চেষ্টা করেন যে আমি বলতে চাইছি আরিফ একটি মুনাফামূলক প্রকল্পের সূচনা করেছেন তাহলে তাঁর বোঝাবুঝির কপাল পুড়ল। তাঁর বুঝতে হবে যে আমি আসলে এই বলে নিন্দা করলাম যে আরিফের যখন কবিতাগানশিল্পনন্দনচলচ্চিত্র ও ইত্যাদি ভুজুংভাজুং করার কথা তখন ব্যবসার মতো একটা ‘নিন্দনীয়’ পেশাজগতে তিনি পা রেখেছেন। এই দুয়ের পার্থক্য অসীম, আমার বিবেচনায়। সেটা আরো বিশাল যৌনতার মতো স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে। সেখানে ‘মিটু’ হাজির হয়েছে এমন একটা পাটাতনে যেখানে নেটিজেন পক্ষ বা জ্ঞাতপক্ষের দুনিয়ায় বিষয়টা দাঁড়িয়েছে ‘তোমার ইয়া আমরা জাইনা ফেলছি’

শেমিংয়ের এই পাটাতন পাশ্চাত্যেও কার্যকর (ছিল)কিন্তু লেজিসলেশনের প্রসঙ্গটা এখানে আনছি একারণে যে, যত কম মাত্রাতেই হোক, প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের জন্য এই অভিযোগগুলো সংশ্লিষ্ট অপরাধী ব্যক্তিদেরকে শাস্তিপ্রদানের ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। বাংলাদেশে এটা প্রথম অভিযোগের আগেই প্রায় নিশ্চিত হওয়া গেছিল যে তা হতে যাচ্ছে না। অর্থাৎ ‘মিটু’ অভিযোগ দায়েরের কারণে কোনো পুরুষ অপরাধী কর্মজগতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ খেসারত দিতে যাচ্ছেন না। ফলে এখানকার অভিযোগকারীরা আইনি সুরক্ষাবলয়বিহীনভাবে কেবল শরমপ্রদানের অস্ত্রপ্রয়োগের চাপে থেকেছেন। পক্ষান্তরে, ‘মিটু’র সুযোগে নারীর রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে কিছুমাত্র ভাবিত নন এমন লোকজনও পরস্পরের বিরুদ্ধে ‘হ জানি জানি’ ধরনের শোরগোল করতে থাকলেন। পাঁচজনের পরে যে আর কোনো নারী অভিযোগ করতে আগালেন না সেটারও একটা মানে এই যে তাঁরা বিশাল ক্ষমতাধর পিতৃতান্ত্রিক বাংলাদেশের অফিসসংস্কৃতির মধ্যে নিছক শরমপ্রদানের রাজনীতি আর করতে চাননি।

১২. একজনের যৌনতার নরমেটিভিটি দিয়ে ডিজিটাল প্লাটফরমে আরেকজননের যৌনতার ধরন ও চর্চাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং অতঃপর নিপীড়ক হিসেবে রায় দেয়ার প্রবণতা আমরা দেখি বিশেষত একগামি/বহুগামি বা ‘পরকীয়া’র মত সম্পর্ক’র ক্ষেত্রে… মিটু এই সংকটকে কিভাবে মোকাবেলা করে?

মানস: একদম পারে না। ‘মিটু’ এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে পারে না। এমনকি যৌনতার প্রবল ভাবনার কোনোকিছুই মোকাবিলা করতে ‘মিটু’ পারে না। এই অপারগতাতে ‘মিটু’ আন্দোলনকেই বরং ছাড় দিয়ে দেখতে চাইব আমি। আর কোনো কারণ না থাকলেও, যে আন্দোলন মাত্র ৫জন (নারী) কণ্ঠস্বরকে আত্মপ্রকাশ করতে দিয়েছে (সঠিক সংখ্যা ভুল হতে পারে আমার) সেই আন্দোলনের উপর, অন্তত বাংলাদেশে, এতবড় দুর্ভার চাপ দেবার কোনো কারণ নেই। বরং, সাধারণভাবেই, এমনকি বাংলাদেশের বিপ্লবী এবং/বা র‍্যাডিক্যাল কিংবা অন্তত শিথিল বাম সংগঠনগুলো, প্রকাশ্যে না হলেও সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরে, যৌনতার প্রশ্নে কোনোরকম স্বচ্ছ ও কার্যকরী ধারণায়ন হাজির করতে যে পারেনি সেই বাস্তবতার উপর জোর দিতে চাইব আমি। যৌনতার প্রশ্নে এসব সংগঠন এমনকি সোয়া শ’ বছর আগের এঙ্গেলসের স্ফটিকস্বচ্ছ অবস্থানের প্রতিও কোনোরকম সুবিচার করেনি। যৌনতার প্রশ্নে স্বশ্রেণীর চিহ্নিত ‘রক্ষণশীল’দের সাথে এক কাতারে থেকেছেন এঁরা। কমবেশি রাখঢাক ও ‘চালায়া নেয়া’ পলিসির বাইরে দৃশ্যমান/ট্যানজিবল যে কর্মকাণ্ড করতে এসব সংগঠনকে দেখা গেছে তা হলো মৃদুবিয়ার ঘটকালি, কিংবা বিয়ার মৃদুঘটকালি – অবশ্যই দু’জন সম্ভাব্য কমরেডের মধ্যে।

এত স্পষ্ট যে আমার মনে পড়ছে তার একটা সাহিত্যপাঠআত্মজৈবনিক দিক আছে। আমি কথাসাহিত্য বিষয়ে আপনার দূরত্ববোধ জানা সত্ত্বেও সবিনয়ে দুয়েকটা জিনিস অবতারণা করছি। দাম্পত্যদর্শনের আরামদায়ক মধ্যবিত্তীয় ফয়সালার বাইরে রবীন্দ্রনাথ গেছিলেন ঘরেবাইরেচারুলতার মাধ্যমে; শরৎচন্দ্র গেছিলেন গৃহদাহ কিংবা চরিত্রহীনএর মাধ্যমে, ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। বুদ্ধদেব বসু রাত ভরে বৃষ্টির মাধ্যমে। এর পরে সমরেশ বসু’র বিবর কিংবা প্রজাপতি’র মতো কাজ থেকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের আরব গেরিলা..ইত্যাদি সময়কাল ও কুলমান (সাহিত্যমান নয়, যৌনতার ধরন) বিচারে স্বতন্ত্রই রাখছি। যতই না কেন এসব ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা আধুনিক বাংলা সাহিত্যনমুনা থাকুক, রাজনৈতিক চেতনার কারণে প্রথমত আপনি খুঁজতে থাকবেন স্থানীয় প্রবন্ধের জগত এবং স্থানীয় সেসব কথাসাহিত্যের জগত যেখানে প্রটাগনিস্ট বা নায়কনায়িকাপ্রমুখ নিজেরা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত। আমার পড়ালেখা গুরুতরভাবে কম, অন্তত আমি পড়ুয়া বলে এত বছরে যাঁদের চিনি তাঁদের তুলনায়। তারপরও যখন খোঁজাখুঁজি করতাম, অত্র অঞ্চলের বৃহত্তর বাম বলয়ে যৌনতার প্রশ্নে পারলৌকিক নিস্তব্ধতার খোঁজ পেয়েছি। এমনকি অন্নদাশঙ্কর রায় যা ও যতটুকু প্রকাশ্য ও স্পষ্ট ছিলেন তা এই মহলের কাজে পাইনি। প্রবন্ধের বাইরে থাকে কথ্যজগত আর কথাসাহিত্য জগত। সেখানে কেবল নিস্তব্ধতা দিয়েও বোঝা যাবে না, বরং বুঝতে হবে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা দিয়ে। সমরেশ বসু থেকে আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন পর্যন্ত সবাই সম্ভবত বিবেচিত হতেন ‘অশ্লীল’ হিসাবে। আমার বিচারবিশ্লেষণ ভুল হতে পারে, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, অন্যরা দেখালে খুশি হব এসব নিছক কথাসাহিত্য নিয়েই বা সংগঠনসমূহের অবস্থান কী ছিল। আশা করি আমি এটুকু নিশ্চিত করতে পারছি যে প্রশ্নটাকে নিয়ে বিপ্লবী সংগঠনের দিকে আসা আমার তরফে অন্তত এই কারণে ছিল যে অপেক্ষাকৃত বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান তাঁরা নিতে পারবেন তা আমি ধরে নিয়েই থাকি। বৃহত্তর মধ্যবিত্ত সমাজ কিংবা রাষ্ট্রসমাজের প্রসঙ্গ তো তাহলে বলাই বাহুল্য।

এর মধ্যে তাহলে এরকম জিজ্ঞাসু সাহিত্যকর্মের দিকে সপ্রশ্ন তাকানো খুবই সঙ্গত হবার কথা। যৌনতা বা সাধারণভাবে মিত্রকর্মীদের বিষমলিঙ্গীয় সম্পর্ক কী হবে এই প্রশ্নে দুটো উপন্যাসের বিশাল প্রভাব ছিল। আমি অন্তত তাই মনে করি। বিস্ময়ের না যে দুটোই কোনো না কোনো ভাবে একদাবামের লিখিত, এবং তাঁদের স্বীয় স্বীয় বামকালে লিখিত। যথাক্রমে, গর্ভধারিণী এবং ওদের জানিয়ে দাওপটভূমি, পাত্রপাত্রী ও গল্পপ্রবাহে দুটো উপন্যাসের বিস্ময়কর মিলের কারণে পাঠকের জন্য চমকপ্রদ দুটো কাজও বটে। তুলনায় আমার অনেক পছন্দের কাজ শাহরিয়ার কবিরের ওদের জানিয়ে দাওসেটা কথাসূত্রেই বলা, কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। বরং যে প্রসঙ্গে বলা, সেটাও আপনার প্রশ্নের ওই নর্মেটিভিটির পুনঃ পুনঃ শক্তি আহরণের প্রেক্ষিতেউপন্যাস দুটোতে নানাবিধ ফ্যান্টাসির সমাহার আছে, রাজনৈতিক স্বপ্নদর্শন আছে, সমাজ বদলের বাসনা আছে, সম্পর্ক রূপান্তরের ডাক আছে। তবে হেটারোসেক্সুয়ালমনোগ্যামাস দাম্পত্যমুখী প্রচলিত সম্পর্কের কিছুমাত্র গুরুতর রদবদল নাই। এই নাইয়ের দায়দায়িত্ব দুজন উপন্যাসকারের মাত্র নয়, সেটা একটা বলার জায়গা আমার। ‘মিটু’র পাঁচ বংশীবাদকদের তুলনায় অনেক ভারী ভারী জাতীয় (এবং পুরুষ) ‘ফিগার’ এনে সেটা বলার চেষ্টা করলাম। বরং, যদি আমার স্মৃতি প্রতারণা না করে থাকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর আগামীকালমহাপৃথিবী গল্পগ্রন্থ দুটোতে লক্ষ্যণীয় ধরনের ভিন্ন ছিলেন। তবে তিনিও কোলকাতায় সমাদৃত হননি, বামরাও অস্বস্তিতে ছিলেন। প্রমাণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু আমি সুনিশ্চিত জানি। অবশ্যই সুনীল মহাতারকা হবার আগের অধ্যায় এটি।

শিল্পী: রিথিকা মার্চেন্ট

উত্তরের দৈর্ঘ্যে পাঠকের বিরক্তি ধরতে পারে কিন্তু এটুকু বলতে চাই যে যৌনতার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সীমানা এখন পর্যন্ত যা দাঁড়িয়েছে তা হচ্ছে প্রবল আদর্শমানওয়ালা/নর্মেটিভ বিষমলিঙ্গীয় একগামি যৌনতার বুর্জোয়া স্বাধীনতা অর্জনের ‘আন্দোলন’এমনকি সেই আদর্শ সম্পর্কটির মধ্যেও দুই পক্ষ (যেহেতু ততোধিক পক্ষ যৌনতায় যুক্ত হবেন এটা ভাবার কারণে আবার আন্দোলন থেকে বের করে দিতে পারেন কেউ) অনেকের কল্পনার বাইরে কোনোরকম (যৌন) কর্মকাণ্ড যদি করে বসেন বা করে বসেছেন বলে জানা যায় কিংবা কখনো বসতে পারেন এমত আশঙ্কা হয় তাহলেও তাঁরা যৌনতার গ্রহণযোগ্য বুর্জোয়া আন্দোলনের মৈত্রী হারাবার ঝুঁকি রাখেন। এই প্রসঙ্গে আরো নির্দিষ্ট প্রশ্ন থাকলেই কেবল আমি আমার ভাবনা বিশদ করতে পারব।

১৩. অনেক সময়ই অভিযুক্ত ব্যক্তি আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রাইভেসি চান। একটি পাবলিক স্টেটমেন্টের বিপক্ষে একটি প্রাইভেট স্টেটমেন্ট। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি প্রদানের কাঠামো অনুপস্থিত। সেক্ষেত্রে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগহীনতা কি অধিকারের খর্ব হওয়া?

মানস: বিরাট প্রসঙ্গ তুলেছেন – ‘আত্মপক্ষ সমর্থন’সকল কিছুতে সাধারণ বুর্জোয়া অধিকারের সীমানাতেও, সীমানাতেই, এইটুকু নাথাকা আর অত্যাচারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই তা যে লিঙ্গের প্রতিই আচরিত হোক না কেন। এখানে আমার মুহূর্তের মধ্যেই মনে পড়লো জায়োনিস্ট ইসরায়েল রাষ্ট্রের কথা। সংখ্যায় অল্প হলেও বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রের ফিলিস্তিন বিরোধী হিংস্রতাকে জায়েজ করার জন্য তামাম বিশ্বে কিছু মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইহুদীদের নিপীড়িত হবার অভিজ্ঞতাকে সামনে আনেন। আপনি নিশ্চয়ই মানবেন যে এটা একটা দুরূহ ধরনের যুক্তিপ্রস্তাব যেখানে আপনার পক্ষে প্রথমেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন, প্রধানত জার্মানির, আরো বিশেষে হিটলারশাসিত পক্ষের কৃত, নির্যাতনকে নিয়ে মাথা নাঘামিয়ে আলাপ আগানো যায় না। এমনকি মাথা ঘামানোই যথেষ্ট নয়, গোড়াতেই নিন্দা জানিয়ে কথা শুরু করতে হবে। এমনিতে আপনার বা আমার হিটলারের শাসনব্যবস্থা আর ইহুদীনিধন নিয়ে যে কঠোর অবস্থানই থাকুক না কেন, ওই আলাপে এর শর্তযুক্তি একটা অশান্তিই কেবল নয়, বরং মারাত্মক ফাঁদ। আমার কথা বললে, আমি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের লাগাতার আক্রমণকে নিছক ধর্মপরিচয়কেন্দ্রিক রাজনৈতিক তৎপরতা হিসাবে দেখারও চেষ্টা করি না, যেমনটা করি না ভারতে মণিপুরী বা কাশ্মীরী নিয়ন্ত্রণকে, মিজো বা নাগা নিয়ন্ত্রণকে, মুসলিম বা মাওবাদীদের নির্যাতনকে নিছক হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক তৎপরতা হিসাবে বুঝতে। যাঁরা বুঝতে চান নিজ দায়িত্বে বুঝবেন, বোঝানোর চেষ্টা করে যে ক্ষতিটা করেন তা ভয়াবহ। অত্যন্ত ভিন্ন পরিসর হলেও এখানে মনে পড়ার কারণ আছে। অভিযুক্ত পুরুষের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রসঙ্গ এলেই মনে না পড়ার সুযোগ নেই যে নারীদের লাগাতার সিস্টেম্যাটিক শেমিংয়ের মধ্যে থাকতে হয় – বছরের পর বছর, দশকের পর দশক, প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে, ঘরে ও বাইরে; এবং কোনোরকম আত্মপক্ষের সুযোগ ছাড়াই।

নারী তুলনামূলক কম পোশাক পরলে পুরুষচক্ষু মনোরঞ্জনের জন্য তা করছেন এবং যাবতীয় ‘ছেনালপনা’র অভিযোগে অভিযুক্ত, সকালবিকাল পাবলিকলি বিচারকৃত। অপেক্ষাকৃত বেশি পোশাক পরলে তিনি সেকেলে, রক্ষণশীল এবং ‘আধুনিক’ কর্মজগতে মানিয়ে নেবার মতো আত্মবিশ্বাসী নন! তিনি হাসিমুখে লাঞ্চবিরতিতে কথা বললে অবশ্যই আপনার আমার সঙ্গে শুতে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে আছেন – পুরুষেরা প্রায়শই সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। আর তিনি যদি গম্ভীরভাবে সময়টা কাটান তাহলে তিনি হয় অহেতু একটা ভাবভঙ্গির চেষ্টা করে যাচ্ছেন, ‘হীনম্মন্যতার’ কারণে কিংবা একটা প্র্যাংকমূলক অফিস সংস্কৃতিতে বড়ই বেমানান! তিনি ‘রূপসী’ বলে সাব্যস্ত হয়ে থাকলে তাঁর বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে পুরুষদের রায় বৈশ্বিকভাবে কাছাকাছি। আর যদি তার উল্টোটা পুরুষদের দ্বারা সাব্যস্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর ঠাট্টাতামাশার শিকার হওয়া নৈমিত্তিক, ও আবারও বৈশ্বিক। হিংস্র পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ও পুরুষাধিপত্যমূলক ‘আধুনিক’ কর্মক্ষেত্রে আসলে এই তালিকাটা কুৎসিত রকমের বড়। আমার মনে পড়ে গেল একটা কবিতা পড়েছিলাম, অনাম্নী কোনো কবির, রেহনুমা আহমেদ পড়তে দিয়েছিলেন। সম্ভবত ১৯৯৭ সালের দিকে। পরে সেটার অনুবাদ আমি করেছিলাম এবং অশুচি’র ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের প্রামাণ্যবইটার গোড়ার দিকে সংযোজিত আছে। আমি সেটা আপনাদের পড়তে দেব – ‘যে যে কারণে আমরা নারীবাদী আন্দোলনের অংশ’ বা এরকম কাছাকাছি নাম। কোনোরকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগবঞ্চিত নারীদের একাংশ যখন আমাদের আলোচ্য প্রসঙ্গে অভিযুক্ত পুরুষদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে খুব একটা ইচ্ছুক থাকেন না, তখন সেটাকে পাঠ করতে আমার সমস্যা হয় না। কিন্তু, আবারো, সেটা চর্চা হিসাবে অসম্ভব একটা প্রস্তাব।

আপনার প্রশ্নের ভরকেন্দ্র বিবেচনা করলে, প্রাইভেট পরিসরের বিষয়টি কেন্দ্রীয়। যৌনতার ক্ষেত্রে পরিসরের দ্বিবিভাজন আরো গভীরভাবে গুরুত্ব দেবার দরকার বলে আমি বিবেচনা করি, এর ইতিহাসের মধ্যেই পরিসর গুরুত্বপূর্ণ রয়েছে বলে। এটা বলার সময়ে আমার আবার সেসব সহকর্মীদের কথা মনে পড়ছে যাঁরা যৌন আক্রমণকে যৌনতার মুখ্য প্রসঙ্গে রাখতে চান না। গণতান্ত্রিক যৌনতাকে আকাঙ্ক্ষা করতেথেকে আমি আবার নারীর জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত যৌনতাকে অযৌনপ্রসঙ্গ হিসাবে দেখতে ইচ্ছুক নই। একান্ত পরিসর বা প্রাইভেট স্পেসের প্রসঙ্গটা গণতন্ত্রীস্বৈরতন্ত্রী সকল ধরনের যৌনসম্পর্কের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ। বরং প্রাইভেট আর পাবলিকের বিভাজনের মধ্যেই যৌনরাজনীতির সবচেয়ে বড় উপাদানগুলোর একটা। এটা বুঝবার জন্য যে কোনো সাবেক প্রেমিকের পক্ষ থেকে নাখোশ অবস্থায় প্রেমিকারসাথেযৌনদৃশ্য সম্প্রচারের দিকে লক্ষ্য করা যায়। ফলে দায়স্বীকারের জন্য প্রাইভেট পরিসর কোনো পুরুষ চাইলে সেটাকেও পরিসররাজনীতির সম্প্রসারিত অংশ হিসাবে আমি দেখব। এক্ষেত্রে এই একান্ত পরিসর প্রদানের পক্ষে না বিপক্ষে থাকছি আমি তাও খুব পূর্বনির্দিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। যদি কোনো একটা তৎপরতার লক্ষ্য হয়ে থাকে আক্রমণকারী পুরুষকে শরমপ্রদান বা শেমিং তাহলে অভিযোগকারী পক্ষ বা তাঁর মিত্রপক্ষ প্রাইভেট পরিসরের সুযোগটা না দেবার রাস্তা কৌশলগতভাবেই নিতে থাকবেন। প্রসঙ্গটা রাজনীতির। তবে সকল অভিযোগকারী আক্রান্ত নারীই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অভিযোগ দায়ের করেননি। সেটা বাংলাদেশ হোক বা বহির্বিশ্ব, অভিযোগকারীদের অনেকেই হয়তো কেবল আক্রমণকারীর দুঃখপ্রকাশ আশা করেছেন। কিংবা আশা করেছেন যাতে অন্যান্য অপুরুষ পেশাজীবী পরিস্থিতির আন্দাজ করেন এবং একা বোধ না করেন। রাজনৈতিক লক্ষ্য নানাবিধ হয়ে থাকে, হতে পারে। সঙ্গত কারণেই কোনো কোনো পক্ষ ব্যক্তিগত দায়স্বীকারের, দুঃখপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করে আগাতে চেয়েছেন।

পরিসর ও যৌনতার প্রসঙ্গের প্যাঁচ লেগে থাকা নানানভাবে খতিয়ে দেখার সুযোগ আছে। কর্মক্ষেত্রে হয়রানিগুলো, কিংবা নিছক হয়রানিহীন যৌনাত্মক মেলামেশাগুলোকে এক কাতারে রাখলে দেখা যায় প্রাইভেট পরিসরের জটিল ও ঘোরালো পেঁচালো অর্থ আছে। বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত যে কলেজকরিডোর পাবলিক পরিসর বলে সাব্যস্ত, সেটাই আধা ঘণ্টা পরে প্রাইভেট বলে সাব্যস্ত হতে পারে। বা অন্তত ‘গোপন’বাংলায় প্রাইভেটকে গোপন হিসাবেই অনুধাবন করা হয়ে আসছে, যৌন পরিমণ্ডলে তো বটেই। আবার ভৌত এলাকা যেমনই হোক, প্রাইভেট বলে তা অনুধাবিত হলে কোনোভাবেই দুই লিঙ্গের একজন করে থাকার পক্ষে সাধারণ রায় থাকে না। সেটারও বহুবিধ অর্থ। একজন পুরুষ সন্ধ্যা ৭টায় ওইরকম একটা খোলা করিডোরেও একজন নারীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে এসে নিজ লিঙ্গশ্রোতাদের কাছে ঘোষণা দিতে পারেন ‘চুমা খায়া আসলাম’এটা সর্বৈব মিথ্যা হলেও সত্য বলে গণ্য ও কিছুকাল উদযাপিত হবে। পক্ষান্তরে, নারী যদি এসে ঘোষণা করেন যে তাঁকে জোর করা হয়েছে, তাহলে আদ্যোপান্ত সত্যি হলেও জনজবানে খারিজ হয়ে যাবে ওই পরিসরের প্রাইভেট বৈশিষ্ট্যের কারণে। কারোরই বিশেষ কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই; আবার কাঠামোগতভাবেই নারী উভয় উদাহরণেই ‘ক্ষতিগ্রস্ত’এই পরিস্থিতিটা জটিল। কিন্তু সকল অভিযোগের উত্তরেই অভিযুক্ত অভিযোগকারীর সঙ্গে মুখোমুখি বসতে চাইলে সেটার ব্যবস্থা করতে পারা সংগঠকদের জন্য দারুণ ব্যাপার বলে আমি মনে করি। শেমিং ছাড়াও অন্য রাজনৈতিক অবস্থান ও পদ্ধতি অভিযোগকারীর থাকতে পারে।

১৪. ভিক্টিম বা সার্ভাইভারের সুরক্ষা পাবার অধিকার প্রশ্নে সামাজিক সংবেদনশীলতা দরকারি। বিশেষত ভিক্টিমকে ব্লেম করার প্রবণতা যখন প্রকট। কিন্তু এই সমাজে আমরা অভিযুক্তর অধিকার প্রশ্নে একধরনের নীরবতা দেখি। কখনো কখনো অধিকার খারিজ করতেও দেখি। ডিজিটাল মাধ্যমে অভিযোগ হওয়া মাত্র একজন অভিযুক্ত যৌন নিপীড়নকারীর লেখা না ছাপানো বা তার আঁকা বা তোলা ছবি নামিয়ে ফেলার চাপ আসে। কোন আদালত যৌন নিপীড়ন প্রমাণিত হলেও আসামির ‘প্রকাশের স্বাধীনতা’ খর্ব করে না। তো,একজন অভিযুক্ত বা প্রমাণিত যৌন নিপীড়কের লেখা বা ছবি প্রকাশ কে আপনি কিভাবে দেখেন? তার এই অধিকার হরণযোগ্য কি না?

মানস: দেখুন বাংলাদেশ নানান প্রশ্নে গুরুতর জটিল একটা জায়গা। যৌনতার প্রশ্নে ঢাকা মহানগরী আরো এককাঠি উপরে। তবে কমবেশি কোলকাতাও সম্ভবত কাছাকাছিই এই প্রশ্নে। শেমিংয়ের কেন্দ্রীয় গুরুত্বের বিষয়টা বলেছি আগেই। কিন্তু এই প্রশ্নের ক্ষেত্রে বয়কটের শাস্তিবিধান প্রসঙ্গ টানতে হবে। অধিকাংশ লোকেই যেমনটা ভেবে থাকেন যে একঘরে করে দেবার শাস্তিবিধান সাবেক কালের প্রসঙ্গ কিংবা যাকে তাঁরা গ্রাম বলে সাব্যস্ত করে থাকেন সেসব এলাকার চর্চা ইত্যাদি, বাস্তব পরিস্থিতি একেবারেই তা নয়। ‘আধুনিক’ প্রতিষ্ঠানে একঘরে করে দেবার কিংবা বয়কট করবার শাস্তিবিধান বরং আরো নিবিড়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক এবং আরো তীব্র। একঘরে করা আর বয়কটকে সঙ্গত কারণেই আমি কাছাকাছি জায়গায় রাখতে চাইছি। মার্কিন সমাজে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে ইউরোপীয় সমাজে হলোকাস্টসংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেলে কাছাকাছি আচরণগুলো ঘটে থাকে। যদি বৃহত্তর মিডিয়াস্কেপিক দুনিয়ার বাস্তবতা হয়ে থাকে এটা তাহলে রাজনীতির দুনিয়ার একঘরে করার গুরুতর ওজরউছিলাও আছে। যেমন ‘ওয়ারক্রাইম’যদি একবার ‘ওয়ারক্রাইম’ করবার তকমা যদি কারো গায়ে লেগে থাকে, তাহলে তাঁর পক্ষে সাধারণভাবে রাজনীতির খোলা মঞ্চে তাঁর কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারার সুবিধা প্রায় নাই বললেই চলে। এসব প্রস্তাব ধরে আগানোও খুব বিপজ্জনক। অনেকগুলো ডিসক্লেইমার দেয়া লাগতে পারে। যেমন ধরুন, এসব কথার মানে যে আমার তরফে যুদ্ধাপরাধ কিংবা হলোকাস্টের প্রতি কোনো সমর্থন নয় সেটাও আবার আগ বাড়িয়ে বলে দেয়া লাগতে পারে; বলার পরও কিছু লোকের সন্দেহ দীর্ঘকালীন বলবৎ থাকতে পারে। আবার হলোকাস্ট বা যুদ্ধাপরাধের তকমা মাথায় লাগলে রাজনৈতিক দুনিয়াতে তৎপর থাকা দুরূহ হয়ে পড়ে বলার সাথে সাথেই এটাও বলার দরকার পড়ছে যে এসব তকমা লাগার পরও কারো কারো রাজনৈতিক সাফল্যের নজির পাওয়া সম্ভব। এসব ব্যাখ্যা বা কৈফিয়ৎ এক হিসাবে বাহুল্য আমার তরফে। কিন্তু ভুলভাল জায়গায় ওজন পড়ার চেয়ে বাহুল্য কথাও কখনো কখনো পদ্ধতিগত পদক্ষেপ।

বয়কটের আধুনিক প্রবণতাগুলো কমবেশি নৈতিকাশ্রয়ী বা মর‍্যালিস্ট; আর পরিচালিত হয় কমবেশি ঘৃণার ফ্রেইমওয়ার্ক দিয়ে। এখানে আদর্শফাদর্শের আলাপ লোকে তুলতে পারেন, কিন্তু আদর্শ শব্দের প্রয়োগের কারণেই আমি ঘাবড়ে গিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা খুঁজতে বসব না। আদর্শ মূলগত ও গুণগতভাবেই মর‍্যালিস্ট। ন্যায্যতার ধারণাও লোকে আমদানি করতে পারেন। আমার জন্য সেটাও খুব বেশি মনোগ্রাহী হবে না। আমার এটাও বক্তব্য নয় যে, ‘সাবেকী’ সমাজে একঘরে করে দেয়া আধুনিক অনুশীলনগুলো থেকে মহত্তর ছিল। উল্টো, এরকম বহু নজিরই বরং পাওয়া যেতে পারে যেখানে একঘরে করা হচ্ছিল একদমই সমাজপতিদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য এবং করা হচ্ছিল এমনসব মানুষদের যাঁরা বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিলেন কখনো। বিবরণী বা ঘোষণা তৈরি করার সময়ে অবশ্যই শাস্তিপ্রাপ্তকে দোষী বা অপরাধী বা হিংস্র বা যাকিছু বলা হয়ে থাকতে পারে। আরো বলা হয়ে থাকতে পারে সমাজবিরোধী বা কাছাকাছি কিছু। এই শেষোক্তটি কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্রের মতো। এখানে থাকবেন অবশ্যই তাঁরা যাঁদের কর্মকাণ্ড সমাজপতিদের জন্য হুমকির অথবা মর্যাদানাশের হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যাঁরা বিদ্রোহ করেছিলেন। সারাংশ হচ্ছে, একঘরে শাস্তিপ্রদানের লক্ষ্য হতে পারেন প্রকৃত ‘চোর’ থেকে ‘প্রকৃত’ বিদ্রোহী – একত্রেই, যুগপৎ, অভিন্ন – এমনকি তাঁরা থাকতে পারেন পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে, পাশাপাশি। তো, বয়কটের যে আধুনিক সমাজপ্রণালী তা কি গুরুতরভাবে ভিন্ন? এখানে বিপ্লবী ও বিদ্যুৎচোর, রাষ্ট্রসমালোচক ও ভাড়াটেখুনি, সর্বহারা ও পাকিস্তানপন্থী কাছাকাছি পদ্ধতিতে বিবেচিত হয়ে থাকেন, অন্তত সামাজিক পরিসর ব্যবহার প্রশ্নে; খোদ বিচারিক শাস্তিপ্রাপ্তির ঢের আগে থেকেই। এমনকি মার্জিন অব ইরর, প্রমাণ করা সম্ভব, কখনো কখনো আরো সূক্ষ্ম আরো ক্ষীণকায় আধুনিক ব্যবস্থাদিতে

গোলাম আজম যে পাড়ায় থাকতেন সেখানে আমার একজন পরিচিতবান্ধব থাকতেন। একজন শাস্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী হবার আগেও তিনি আমার প্রতিপক্ষ হিসাবেই ছিলেন বহুবছর, এমনকি সেই সময়কালেও যখন খোদ তখনকার সরকার তাঁর প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আবার শাস্তিপ্রাপ্ত হবার পর তাঁর সামাজিকমানসিকপারিবারিক দশা নিয়ে আগ্রহ জন্মাতেও আমার কোনো সমস্যা হয়নি। এটার কারণ এই নয় যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাঁর ছোট ছেলের সঙ্গে আমার নৈকট্য ছিল। তাঁর ছোট ছেলে জাহাঙ্গীরনগরে ইংরাজি সাহিত্য পড়তে ভরতি হয়েছিলেন আমার এক ব্যাচ পরে। যদিও ক্যাম্পাসে রাত কাটানো কম হতো তাঁর, তবুও সম্ভবত তাঁর নানাবিধ আগ্রহ ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কারণে আমাদের জানাশোনা হয়ে গেছিল, তাঁর বাবার প্রতি আমার ওইসব প্রতিপক্ষতা সমেতই। গোলাম আজমের সঙ্গে আমার কখনো সাক্ষাৎ হয়নি অবশ্যই, কিন্তু সেটা হয়তো তখনো আমার ঘরকুণো দশার কারণে। নাহলে সালমান, নানান ধরনের দ্বিধাসমেতই, বাসায় যাবার নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সালমান বছরখানেকের বেশি জাহাঙ্গীরগরে টিঁকতে পারেননি, এবং সেই সময়টাও যথাসম্ভব নিগৃহীতভাবে ছিলেন। এরশাদের শাসনামল হলেও ক্যাম্পাসের সামগ্রিক রাজনৈতিক ভাষামালার মধ্যে ওর পক্ষে নিঃশ্বাস নেয়া কঠিন ছিল। এই ঘৃণাময়তার আমি অনুগ্রাহী নই। এবং আপনি জানেন এই উচ্চারণের জন্যও, সালমানের মতো তীব্র না হলেও, আমি নিজেই হয়ে পড়তে পারি বয়কটের বা ঘৃণার টার্গেট। শাস্তিপ্রাপ্ত হবার পর বিস্মৃতপ্রায় সালমানের বাবা হিসাবে নয়, নিছকই একজন যেকোনো বৃদ্ধ রাজনীতিবিদের পারিবারিকমনোজাগতিক দশা নিয়ে আগ্রহ জন্মেছিল। আমার সৌভাগ্য, তাঁর প্রতিবেশী, আমার বান্ধবজন, একটা আন্তরিক উত্তর দিয়েছিলেন। এখন কেউ চাইলে আমার এই মনোভাবকে ‘দয়ালুতা’, ‘ভাবালুতা’, ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ যা কিছু নাম দিতে পারেন। কিন্তু যৌথচর্চার প্রস্তাবিত ঘৃণার পরিকাঠামো যদি আমার গ্রহণযোগ্য না লাগে, তাহলে তো কেবল তিনি বা তাঁরা নন, খোদ আমিও এই ব্যবস্থার শিকার হয়ে পড়বার জায়গায় আছি।

অভিযুক্ত ব্যক্তির অভিব্যক্তির সামর্থ্য হরণ করার প্রশ্নটি আপনি তুলেছিলেন যৌনতার পরিপ্রেক্ষিতে। আমি নিছক যৌনতায় পরিসীমিত থাকিনি উত্তর দেবার বেলায়। আশা করি আমার উত্তরকে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা করছেন না। বয়কট বা ঘৃণার শাসনাধীন বানানো নিয়ে আমার কোনো উৎসাহ নেই, কোনো প্রশ্নেই।

যৌন নিপীড়নের শাসকতা: দণ্ডনীতি ও ধর্ষণের পুনরুৎপাদন

১৫. যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের শাসকতা পর্যবেক্ষণ করলে একটা বিষয় পষ্ট যে,পুলিশউকিলচিকিৎসকসাক্ষ্যপ্রমাণবিচারক মিলে গড়ে ওঠা আগাপাছতলা প্রণালীতে ভিক্টিম/সার্ভাইভারের স্বর থাকে না। এই স্বর হারিয়ে যায়। ফিল্টার হয়। অভিযোগের বয়ানকে ‘আইনানুগ’ করে তোলা হয়। সাক্ষীর সাক্ষ্যকে ‘আইনানুগ’ করে গ্রহন/ বর্জনের মুখে পড়তে হয়। ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণপ্রপঞ্চটিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে এই প্রক্রিয়ায় কনস্ট্রাক্ট হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তো,আমার প্রশ্ন হল: যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের শাসকতা এবং একে ‘আইনানুগ’ করে তোলার সিস্টেমেটিক একশন খোদ ধর্ষণ নামের রাজনৈতিক ঘটনাটিকেই অনুপস্থিত করে তোলে কিনা?

মানস: তোলে, আলবৎ তোলে। রাজনৈতিক ঘটনাটিকে অনুপস্থিত করে তোলে বা ফেলে। এই বিশেষ ক্ষেত্রে যৌনলিঙ্গীয় রাজনৈতিক ঘটনা বা হামলার কথা আলাপ করছি আমরা। কিছুটা ঝুঁকিসমেতই বলি সকল বিচারের প্রক্রিয়ায় সকল ক্ষতিগ্রস্তের সকল ধরনের বয়ান (স্বর, আর্তনাদ, ফরিয়াদ, বিবরণী, অনুভব, সংক্ষোভ, সংবেদ ইত্যাদি সকল কিছু সমেত যা যা হতে পারে তার একটা পোঁটলা যদি বলি) অনুপস্থিত হবার সম্ভাবনাসমেত বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। যাকে ইনসেপশন বলে। মামলা হিসাবে অনুধাবিত হবার মধ্যেই ব্যক্তিসমূহ কেইসে, বা বাদীতে (বা বিবাদীতে) , পর্যবসিত হন। তাঁর বাণীমালা আইনানুগ হতে হতে তিনি সেগুলোকে আর নাচিনতে শুরু করতে পারেন। আবার একটা রিয়েলিটি শোয়ের মাঝপথে আপনি যেমন আর বের হয়ে আসতে পারেন না, মামলাকারী বা অভিযোগকারী এই অচেনা পথে, খোদ নিজের অভিজ্ঞতার অচেনা লিপিরূপের অত্যাচার থেকে খুব একটা বের হয়ে আসার সুযোগও পান না।

রবীন্দ্রনাথ সাহা। মনে হয় এটাই নাম। হয় আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিংবা কোনো এক সাংবাদিকের বিবরণীতে তাঁর অস্তিত্ব এত জাগরুক লেগেছিল আমার যে আমার মাথায় এরকম চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে যে আমি রবীন্দ্রনাথের পাশে দাঁড়িয়েই তাঁর বিহ্বল অন্তর্গত বিলাপ শুনছি। রানা প্লাজার করুণ ও দুর্বৃত্তায়নগত দুর্ঘটনার পর তিনি একাধিক দিন এই ধ্বংসস্তূপের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর বিলাপকে যদি সূত্র ধরা যায় তাহলে ওই জমিখানা, যেখানে জনৈক ক্ষমতাবান ও রাজনীতিবিদদের চ্যালাচামুণ্ডা রানা একটা প্লাজা বানিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের মালিকানাধীন ছিল এবং রানা সেটাকে জবরদখল করে। যেহেতু আমি চাকরি করি জাহাঙ্গীরনগরে সেজন্য রবীন্দ্রনাথ সাহার পাশে আমার কোনো একটা দুপুরে দাঁড়িয়ে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। রানার কীর্তির জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি এটা যদি আমরা দাবি করি তাহলে নিশ্চয়ই মিথ্যাচার হবে। আবার রানার কীর্তির ‘ন্যায়বিচার’ হয়েছে তা আদৌ সরকারের মধ্যকারও কেউ বলতে রাজি থাকবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। তাঁরা বড়জোর বলবেন ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে..’এগুলো বারবার শুনতেও আমাদের ভাবগাম্ভীর্যের মৌলিক ক্ষতি হতে পারে। এখন আপনি বা আমি তো দূরের কথা, রবীন্দ্রনাথ নিজেই তো জানেন না যে ওই ধ্বংস্তস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক বছর আগে তাঁর বেহাত হওয়া জমির জন্য কী ধরনের শোক প্রকাশ মানানসই; কিংবা শোকের অধিক সেই কৃত ‌‘অন্যায়’এর বিপরীতে ঠিক কী ধরনের ‘ন্যায়বিচার’ পেতে তিনি আদালতে যেতে পারেন। আদৌ এই দুই হাজার মৃতদেহের পরিবেশে আদালতে যাবার স্থৈর্য ও সংকল্পই বা তিনি কীভাবে সংগঠন করবেন! কিংবা সেই বিচারিক প্রক্রিয়াটিই বা কী হতে পারে! আবার তিনি নেহায়েৎ রবীন্দ্রনাথ বলে ‘শুধু বিঘে দুই’ লিখেও তাঁর অনুভূতিরাজ্যের একটা আশু নিষ্পত্তি ঘটাতে পারছেন না। ফলে, আমি তাঁর অসীম বিহ্বলতা প্রায় অনুভব করতে পারি। হতে পারে, সাভার বাজারের ওই অজস্র মানুষের ভিড়ে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন সঠিক কী বা কীকী কারণে তা তিনি নিজেও জানতেন না। যেমন, বাস থেকে আমি বা আপনি নেমে ওইদিকে চেয়ে থাকতাম যে তারও কোনো সঙ্গত ব্যাখ্যা নেই। কিছু কিছু সময়ে কিছু কিছু জন অবশ্যই ত্রাণকর্মী থেকেছেন। তার থেকে বিশাল বাহিনী ছিলেন দর্শক, আবার তাঁদের নিস্পৃহ বা অকরুণ/এপেথেটিক ভাবার কোনো কারণ নেই। হতে পারে, ওই জমায়েতে, নিহতদের আত্মীয়দের বাইরে রবীন্দ্রনাথই সবচেয়ে বিহ্বল ছিলেন। হতে পারে, তিনি বিড়বিড় স্বগতোক্তির মধ্যে, এই বিশাল মৃত্যুরাজির মধ্যেও চাইছিলেন ওই জমির সঙ্গে তাঁর পুরান সম্পর্কটির একটা জনস্বীকৃতি; এমনকি জনস্বীকৃতিও নয়, নেহায়েৎ সামনেথাকা লোকটির মুহূর্তের স্বীকৃতি ও সমবেদনা। তিনি মোকদ্দমা একদমই নাচেয়ে থাকতে পারেন।

আদালতের কাঠগড়া থেকে ঢের ঢের দূরে থাকা এই রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনা আমার তরফে খুবই প্রাসঙ্গিক। আদালতে ‘ন্যায়বিচার’ প্রত্যাশী ধর্ষিতের অভিজ্ঞতা তাঁর নিজেরই কাছে কোনো একটা সময়ে কোনো এক সুদূর অপ্রাসঙ্গিক অন্য মানুষের জীবনের এক নিস্পৃহঅকরুণ কাহিনি লাগতে পারে। এমন এক কাহিনি যা আর পুনঃ পুনঃ বিবরিত হোক তা তিনি না চাইতে পারেন; পুনঃ পুনঃ বিশ্লেষিত হোক তা তিনি না চাইতে পারেন। শোক কিংবা লজ্জার অধিক তা এমন এক বিবরণীবিশ্লেষণে পরিণত হয়ে থাকতে পারে যা আর তাঁকে সম্পৃক্ত করছে না। তিনি এই অধ্যায়ের ‘বেকসুর’ খারিজ চাইতে পারেন। রাজনৈতিকতার অনুপস্থিতি তাঁকে খোদ রাজনৈতিক প্লেয়ার/অংশীদার হিসাবে মিউটেড/নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। আমি প্রশ্নটির মধ্যকার পাত্রীপাত্রের মনোজাগতিক দিকটাতেও তাকাতে চেষ্টা করলাম।

১৬. একটি আদালত কক্ষ, উকিলের জেরা, ভিক্টিমের আইনিভাবে চরিত্র হনন ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন পুণরুৎপাদন হয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে বিচারের দাবি আসলে কোন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে কি? নাকি এটি ভিক্টিমকে একটি বিচারিক স্বৈরতন্ত্রর মুখোমুখি করে?

মানস: বাহ। বিচারিক স্বৈরতন্ত্র! এটা দুর্দান্ত পদবাচ্য। তবে আমি আশঙ্কা করি যে বিচারিক ও স্বৈরতন্ত্র শব্দদুটো পাশাপাশি বসিয়েই প্রথমে আপনি, ও আপত্তি না করে পরেরবার আমি ‘আদালত অবমাননা’র ফাঁদে পড়ার উপযুক্ত হয়ে আছি। তাই চাইলে এখন থেকে আমরা স্বৈরতন্ত্রকে অন্য কোনো কোডেড একটা নামে ডাকতে পারি। ধরা যাক, স্বরতন্ত্র, অর্থাৎ যেসব প্রত্যঙ্গের ব্যবহারে আমাদের আওয়াজ উৎপন্ন হয়ে থাকে। আদালত কিছু নির্দিষ্ট আওয়াজ তৈরি করে থাকে তা বলাই যায়। বিচারিক স্বরতন্ত্র! আমি চাইব, আগের প্রশ্নেও বলেছি, আদালত ও ন্যায়বিচার সংক্রান্ত আমাদের বোঝাবুঝির ইতিহাস ও আকাঙ্ক্ষিত দাবিনামাকে দুই বাক্সে সতর্কভাবে রাখার অভ্যাস করতেএকটার সঙ্গে আরেকটার অন্যমনস্ক, কিংবা সচেতন, গুলিয়ে ফেলার অহরহ নিয়মিত ঘটনা ঘটে। এরপর যে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়টা আমি উচ্চারণ করব তা হচ্ছে ন্যায়বিচারের দাবি মুখ্যত দুইটা অনুপ্রেরণা বা ইনটেন্ট ধারণ করে: প্রতিশোধপরায়ণতা এবং/বা অক্ষমআক্রোশ। এই ভয়ানক দাবিটা আমি কেবল যৌনতার বিচারিক বিষয় নিয়েই করছি না, বরং করছি সাধারণভাবে রাষ্ট্রানুগ বিচারিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের সকল আর্তনাদফরিয়াদ নিয়েই। ন্যায়বিচারের আওয়াজটা ক্ষতিগ্রস্তরা তোলেন সাধারণত ওটা রাষ্ট্রের ভাষামালা বা ডিসকোর্সের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে।

শিল্পী: সায়েদা ইশরাত

যৌন নিপীড়ন এবং বিশেষভাবে ধর্ষণের বিষয় আদালতে যাবার পর ঘটনাপ্রবাহ বা বিস্তারের একদম সুনির্দিষ্ট কয়েকটা মাত্রা আছে যার মধ্যে দুইটার দিকে, বা আড়াইটাও বলা যায়, আমি আলোকপাত করতে চাই। প্রথম বিষয় হলো, প্রাইভেট পরিসরের মধ্য থেকে যৌনক্রিয়াদি এবং মনুষ্যদেহের বিশদ বিবরণী পাবলিককরণের আবশ্যিক শরমের পাটাতন। আক্রান্তের একান্ত অনুভূতি বাদ দিলেও, যদি আনন্দদায়ক তথাকথিত সম্মতিভিত্তিক যৌনাচারের প্রসঙ্গও হতো তার বিবরণী জনদরবারের চর্চার বিষয়বস্তু হয়ে পড়বার আবশ্যিক অস্বস্তি বা উৎপীড়ন বা হয়রানির প্রসঙ্গ সেটা। কিছু বিরল উদাহরণ বাদ দিলে, এই পরিস্থিতিটা লিঙ্গ নির্বিশেষেই পাত্রপাত্রীদের পরম বিব্রতির বিষয় হবার কথা। যদি আধুনিক বিচারব্যবস্থার বাইরে আমাদের কল্পনার পল্লী অঞ্চলকে, কিংবা ইতিহাসগ্রন্থাদির ‘সাবেক’কালীন সমাজভিত্তিক শালিসব্যবস্থার কথাও আন্দাজ করি, এইসব বিবরণীতে সংশ্লিষ্ট পাত্রপাত্রীদের হর্ষআনন্দের কোনো কারণ নাই। তবে মোটের উপর পার্থক্য থাকতে পারে ওটুকুই যতটুকু যৌনতার লজ্জা পুনর্গঠিত হয়েছে আধুনিক কালে। দ্বিতীয় বিষয়টা হলো, আরো সূক্ষ্ম প্রসঙ্গ, ধর্ষণ বা যৌনাক্রমণকে অনুধাবনের ক্ষেত্রে কীসব প্রিমাইজ/পূর্বশর্ত বিভিন্ন কারকের মাথায় কাজ করছে। এখানে আমাদের বাহ্যত মনে হতে পারে যে আদালত মানেই তো বিমূর্ত একটা ব্যবস্থা। কোনো বিমূর্ত ব্যবস্থাকেই এর মধ্যকার ও পার্শ্ববর্তী কারকদের বাইরে স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব হিসাবে আমি দেখি না। বহুদিন ধরে দেখি না। প্রায় শিশুকাল থেকে দেখি না। এই বিশেষ ক্ষেত্রে কারকদের প্রায় শতভাগ, অন্তত আমাদের মতো দেশগুলোতে, পুরুষও বটে। আমি অবশ্য যৌনতা অনুধাবনের বেলায় লিঙ্গনির্দিষ্ট ভিন্নতা যে থাকবেই তা মনে করি না। পুরুষের বা পুরুষালি বা অধিপতি যৌন অনুধাবন খোদ নারী বা অন্যান্য লিঙ্গের মানুষজনও ধারণ করতে পারেন। তো সেখানে, ধর্ষণ কীভাবে ‘সাধিত’ হয় এটা অনুধাবন করতে গিয়ে কারকেরা নিজেদের যৌনতাবিষয়ক বোঝাবুঝির দুনিয়ার সঙ্গেও নানাবিধ কুস্তি লড়তে থাকেন। অন্তত যেসব সম্ভাব্য অমীমাংসিত মনোভঙ্গি তাঁরা কুস্তি লড়েন বলে আমি মনে করি তার মধ্যে আছে: উস্কানিমূলক পরিবেশ, ‘সঠিক’ নৈতিক আচরণ বা তার অভাব, ‘যৌনতা সতত অনৈতিক’, ‘নারীর স্বভাব পুরুষকে উদ্দীপ্ত করে’, পুরুষ নারীটিকে একান্তে পাবার মানে নিশ্চয়ই নারী আগ্রহী ছিল ‘কিছু করতে’, পুরুষটির বদমতলব যদি তাই হয়ে থাকে অবশ্যই নারীটির আগে বুঝতে পারা উচিত ছিল; এমনকি ‘নারীরা আগেভাগেই বিপদের আলামত বুঝে ফেলে উঁইপোকার মতো’এরকম রাজ্যের সব অনুমান নিয়ে ওইসব কারকেরা দিনের ২৪ ঘণ্টা বসবাস করেন। হঠাৎ আদালতে আলখাল্লা পরে যাবার সময়েই সেসব ভোজভাজির মতো মাথা থেকে উধাও হয়ে যাবার কোনো ন্যায্য কারণ আমি দেখি না।

ফলে, ধর্ষক বা যৌনআক্রমককে বাঁচানোর ইচ্ছা ছাড়াও, এইসব নিজের মাথার থিসিসের সঙ্গে কুস্তি লড়তেলড়তে আদালতআচারগুলো সারেন তাঁরা। এর মধ্যে আক্রান্ত নারীর যৌন বিষয়ক জগদ্দর্শনও বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু এখানে তাঁর ভাবনা নতুন করে কোনো বিপদ ঘটাচ্ছে না। ওদিকে আক্রমণকারী এবং বিচারক দীর্ঘকাল চুপচাপ থাকার সুযোগ পান। তাই বলে তাঁদের মাথা সক্রিয় থাকছে না তা তো নয়, নেহায়েৎ একঘেঁয়েমিতে ঘুম পেয়ে যাবার সময়টুকু বাদ দিলে। এই জাগরুক মাথার যৌনবোধকে আমি বিপজ্জনক মোকদ্দমাপাটাতন গড়ে দেয় বলেও মনে করি। আড়াইতম বিষয়টা হলো, মিডিয়ার ব্যস্ততা বা সম্প্রচারগুণ। অন্তত কিছু কিছু ধর্ষণের বিচারকার্য চলাকালীন ব্যাপক ধরনের মিডিয়াশোরগোল হয়ে থাকে। এসব শোরগোলের আয়ু যতটুকুই হোক, এর ফ্রেইমওয়ার্ক প্রদান করার সামর্থ্য প্রচুর। আপনার প্রশ্নে যে দৃশ্যরূপ হাজির করা হয়েছে সেখানে নিজগুণেই আক্রান্ত নারীর পরিস্থিতি বিবরিত হয়েছে। আমি এই সুযোগটা নিয়ে তাকে বিশদ করলাম মাত্র। আর আমার বিবরণীতে যৌনরাজনীতির আরো বিশদ মনোজাগতিক পরিমণ্ডলটাকে আনার তাগিদ আমার ছিল। ‘চরিত্র হনন’ এখানে যতটা অপরাধীকে বাঁচানোর নৈতিক হাতিয়ার, ততটাই যৌনতাকে অনুধাবন করার হাতুড়ে উপায়। ‘ন্যায়বিচার’ এখানে সুদূরপরাহত। বিচারের দাবি, আমি আগেই বলেছি, ‘ন্যায়বিচার’ সংক্রান্ত তাগিদ হিসাবে আমি দেখতেই পাই না। ওটা তীব্র আর্তনাদ হতে পারে, প্রতিশোধ হতে পারে, রিরংসা হতে পারে, অক্ষমগোঙানি হতে পারে। বেইনসাফকে শনাক্ত করার আওয়াজ বললে আমি মানব।

দণ্ডমূলক বনাম পুনর্গঠনমূলক ন্যায় বিচারব্যবস্থা

১৭. ফৌজদারি বা দণ্ডনীতি কি সংঘবদ্ধ ন্যায়বিচারের প্রতিহিংসাকেই অবশেষে নিরুঙ্কুশ করে তোলে না? একটা পিউনিটিভ জাস্টিস সিস্টেম ন্যায়বিচার ধারণাকে যেভাবে শাস্তিমূলক এবং কারাগারকে সামাজিক ভয়ের ক্ষেত্রে পরিণত করে;সমাজের কথিত পঙ্কিলতাকে বন্দী করার নামে খোদ সমাজের গায়ে কারাগার নামক বিমানবিকীকরণ প্রকল্পের জন্ম দেয়,তাতে আদতে দণ্ডনীতি তো সংঘবদ্ধ ন্যায়বিচারের ত্রাসই…

মানস: আমি আপনার বা অরাজের প্রশ্নের তারিফ করতে চাই। আশা করি আমার এই প্রশংসা মোড়লীপনা কিংবা প্যাটার্নালিজম হিসেবে পঠিত হবে না। গড়ে যেভাবে জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হই আমি, বা আমরা, তাতে এই পর্যায়ের সূক্ষ্ম ও জটিলভাবে উপলব্ধি করতে থাকা মানুষদের প্রশ্ন কমই মুখোমুখি হয়েছি আমি।
এই প্রশ্নের মুখোমুখি হবার আগেই আমি প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধপরায়ণতাকে (অক্ষম আর্তনাদসমেত) ‘ন্যায়বিচার’সংক্রান্ত আলাপের কেন্দ্রে এনে কথা তুলেছিলাম। সাক্ষাৎকারে সকল প্রশ্ন একত্রে পড়ে নিয়ে উত্তর শুরু করবার পদ্ধতির পক্ষে অনেকেই থাকেন। তাঁদের পদ্ধতির পক্ষে সঙ্গত সব ব্যাখ্যাও আছে। কিন্তু জটিল ও আগ্রহের বিষয়বস্তুতে অন্তত, আমি পরের প্রশ্ন আগে না পাঠ করে উত্তর করতে পছন্দ করি। আশা করি আমার পদ্ধতির শক্তিটাও স্পষ্ট হলো। নিরঙ্কুশ যদি একটু ঝুঁকিপূর্ণ ভাষাপ্রস্তাব হয়েও থাকে, সংঘবদ্ধ ‘ন্যায়বিচার’ অবশ্যই প্রতিহিংসাকে সংগঠিত করতে সমর্থ, করে থাকে লাগাতার; যতই এর আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্য এটি না হয়ে থাকুক না কেন।

আমি ‘ন্যায়বিচার’ ধারণার গুণগ্রাহী নই, এতে আমার আস্থা নাইআমি একে বাগাড়ম্বর মনে করি। এর আকাঙ্ক্ষাকে অবাস্তব মনে করি। এর প্রতিষ্ঠাপ্রচেষ্টাকে মিথ্যাচার, বা অন্তত অতিকথন, গণ্য করি। সম্ভবত আমার আগের কিছু আলাপে তার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। পক্ষান্তরে, ন্যায়বিচার বা ইনসাফের অভাবকে লাগাতার উপলব্ধি করতে থাকার অনুশীলনকে আমি রাজনৈতিক ও দার্শনিক উভয় বিচারেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ইনসাফের অভাবের উপলব্ধিকে ন্যায়বিচার আকাঙ্ক্ষা হিসাবে পাঠ করা যেতে পারে নিশ্চয়ই, কিন্তু আমি এই পর্যায়ে আকাঙ্ক্ষাকে প্রায় কাল্পনিক ঐশী রাজ্যের বাসনা হিসাবে দেখতে পাই; আর অভাবের উপলব্ধি অতিঅবশ্যই দার্শনিক পটভূমি হিসাবে দেখতে পাই। ফলে ‘ন্যায়বিচার নাই’ উপলব্ধির সাধারণ গড়পরতা প্রতিক্রিয়া আর ‘ন্যায়বিচার’এর জাগতিক অনস্তিত্ববিষয়ক উপলব্ধির উচ্চারণ ঠিক এক কাতারে আমি নারাখতে চাইব। কিন্তু এত সহজে এই আলাপে পার পেয়ে যাওয়া যাবে না মনে হয়। লোকজন ঠেসে ধরতে পারেন এই বলে যে ‘ন্যায়বিচার তুমি মানো না, মানে তুমি হইলা গিয়া স্বৈরাচারের দোসর’কিংবা ‘তুমি আসলে জালিম’আমি কোনোটাই নই। বরং বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবধারিত ইচ্ছানিরপেক্ষ রাষ্ট্রবাসী হিসাবে আমি বিচারিক প্রক্রিয়ার অত্যাবশ্যকতা গাঢ়ভাবে টের পাই। এমনকি, কিছুক্ষণ আগে যেমন বললাম, খুনি আর বিপ্লবীর সমান্তরালে অবস্থানের বাস্তবতা সত্ত্বেও, বিচারিক প্রক্রিয়া ও তার আশা করতে থাকা সাধারণ নাগরিক নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের মতো একটা বিষয়। আমি বড়জোর ‘ন্যায়ের’ ধারণা প্রত্যাহার করে ভাবতে চাইছি মাত্র।

সংঘবদ্ধ ন্যায়বিচারের দাবিনামা বা চিৎকার যে ত্রাসের ব্যাকরণ তৈরি করে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। শৃঙ্খলা, শাস্তি ও কারাগার বিষয়ে বিস্তর সব বিদ্যাজগতীয় আলাপআলোচনা হয়ে আছে। ফুকো নেতৃস্থানীয় বলে বিবেচিত। আমার সেসব মুখস্ত থাকলে, বা অন্তত গ্রহণযোগ্য মাত্রায় পাঠ করা থাকলে এখানে উদ্ধৃতি দিয়েও আগানো যেতো। কিন্তু সেসব উদ্ধৃতির অভাবে মূল বক্তব্য, ভাব, যুক্তি কিংবা অনুভব হীনবল হয়ে যাবে না। অন্তত এ কারণেও যে এসব তত্ত্বের উদ্ভবেরও বহু আগে আর কেউ না হলেও শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষজন, মরতে মরতে, নিজেরা জানতেন কোন ধরনের শাস্তি ঠিক কার কার স্বার্থে তাঁকে দেয়া হচ্ছে। কিংবা সকলের সম্মিলিত উল্লাস আর চিৎকারের মধ্যে প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁর শাস্তি কার্যকর করার মুহূর্তগুলো তাঁর জন্য যতখানি ভীতি বয়ে আনতো, ততোই তীব্রভাবে তিনি সকলের উল্লাস শুনতে পেতেন, মৃত্যুকালে। সেগুলো বেঁচে থাকলে তিনি লিখতেন কিনা বা তত্ত্বায়ন হতো কিনা তাতে এই পরিস্থিতির পাঠ বদলায় না। তবে এই আলাপটি শুরু থেকেই যৌন নিপীড়নকে কেন্দ্র করে হবার কারণে আমার আলাপ, এমনকি আপনার প্রশ্নও, পুরুষএপলজিস্টের দোষারোপ খেতে পারে। বাস্তবে যৌন নিপীড়ন কিংবা ধর্ষণ প্রসঙ্গেই সীমিত করে আমি ভাবিনি। ন্যায়বিচারের চিৎকারের মধ্যে সংঘবদ্ধ প্রতিহিংসাকে চিনবার জন্য যেকোনো ‘সন্দেহাতীত’ (ছোট) চোর বা ছিনতাইকারীর উপর উপর্যুপরি সংঘবদ্ধ শক্তিপ্রয়োগের দৃশ্যের দিকে মনোযোগ দেয়াই যথেষ্ট। প্রায়শই এসব হামলা থেকে ‘অপরাধী’ জীবিত আসতে, বা হাসপাতালে যেতে, পারেন কেবল পুলিশের হস্তক্ষেপে। মবলিঞ্চিংয়ের গড়পরতা যেকোনো পরিস্থিতিরই কাছাকাছি চিত্র।

তবে যৌনাচার ও যৌনাক্রমণের সীমানার মধ্যে বিবেচনা করলেও বিশেষ ভিন্ন পরিস্থিতি নয়। আমাদের শৈশবে সবচেয়ে বড় ‘জাতীয়’ যৌনবিষয়ক ‘অপরাধ’ ছিল রিমা হত্যাকাণ্ড। কথিত ‘পারকীয়’ প্রেমের মীমাংসা করতে গিয়ে রিমার স্বামী মুনীর রিমাকে খুন করে ফেলেছেন বলে জানা গেছিল। মুনীরের ফাঁসির রায় হয়েছিল পরে। কিন্তু তামাম বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যক নারী আন্দোলনের কর্মীরা মুনীরের যৌনসাথি (বা বান্ধবী বা প্রেমিকা) খুকুরও ফাঁসি চাইছিলেন। কেবল মুনীরের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করার কারণে ফাঁসিযোগ্য বিবেচিত হওয়া বিস্ময়কর কম, কিন্তু বীভৎস তো বটেই। উত্তরকালে এরকম একাধিক ঘটনার নিদর্শন আছে যেখানে নারী সংগঠকদের একাংশ কাছাকাছি আওয়াজ তুলেছিলেন। একবার জাতীয় পর্যায়ের একজন নেত্রীর সঙ্গে আমার প্রকাশ্য মতবিরোধও তীব্র আকার পেয়েছিল। মুখ্য প্রবণতা হিসাবে চিন্তা করলে, খুকু বা এরকম কারো শাস্তিকামনা হতে পারে কেবল নৈতিকাশ্রয়ী তীব্র ঘৃণা থেকে, যাকে মর‍্যালিস্ট বলছিলাম। ন্যূনতম চেতনাটি এরকম যে, যে যৌননৈতিকতার শাসনব্যবস্থা কায়েম করে রেখেছি আমরা, তার বাইরে যাবি যখন তখন দেখ আমরা কী করি! একে প্রতিহিংসা বলার যথাযোগ্য কারণ আছে। এখানে গোপন আর প্রকাশ্য, পাবলিক আর প্রাইভেটের প্রসঙ্গটাও আবার চলে আসে।

১৮. ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন কি আদতে ফৌজদারির বিষয় নাকি রাজনৈতিক? মানে পুরুষতান্ত্রিকতা, নারীকে অধঃস্তনীকরণের ধারকবাহক রাষ্ট্রপুঁজিসহ বলপ্রয়োগের যেকোন প্রথাপ্রতিষ্ঠানের বিলোপ ছাড়া কি এর নিরসন সম্ভব?

মানস: না সম্ভব নয়। কিন্তু বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা একটা বাস্তবতা, অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা রীতিমত। হকিকত, এই মুহূর্তে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রপ্রজা হিসাবে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে না দেখার সুযোগ আমাদের বিশেষ নেই। তাছাড়া এগুলোকে সাপেক্ষিকভাবে দেখতেই হবে। এমনিতেই আদালতের বাইরে জনসমাজে সালিশের নামে যেভাবে যৌনাপরাধগুলোকে সামলানোর চেষ্টা করে সেটা অতিশয় বিপজ্জনক। উপরন্তু, সেখানে ‘বিধিবহির্ভূত’ যৌনতা আর যৌনআক্রমণ একই কাতারের ‘অপরাধ’অবশ্যই গোপনে কিছু করে গিলে ফেলতে পারলে আরেক কথা। না পারলে ব্যভিচারও যা, ধর্ষণও তাই। পুরা ব্যবস্থাটা গড়ে অতিশয় ক্রুদ্ধ, যৌননিয়ন্ত্রণকামী, পুরুষালি ঈর্ষাপরায়ণ ও লিঙ্গবিদ্বেষী। আদালত সেখানে ওরকম শাসনব্যবস্থার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ, যত মৃদু যত কমজোর আর যত অনীহই তা হয়ে থাকুক না কেন। তাছাড়া প্রশ্নটার আরেকটা দিক আছে যা অসতর্ক থাকলে এই মর্মে পর্যবসন ঘটাতে পারে যে আপনি বলতে চাইছেন পুঁজিবাদের বিলোপে এমনকি লিঙ্গীয় সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে; কিংবা লিঙ্গভিত্তিক আক্রমণাত্মক পরিস্থিতির অবসান ঘটবে। আপনাকে চিনি বিধায় আপনার প্রশ্নের এই মানে আমি করব না। তাছাড়া প্রশ্নটিও তার থেকে সূক্ষ্মভাবে বিন্যস্ত। প্রসঙ্গটা আসছে এই কারণে যে দীর্ঘকাল বাংলাদেশের বাম আন্দোলনগুলোতে নারীবাদী চিন্তন নিয়ে একটা কাঠামোগত ডিনায়াল ছিলডিনায়ালটা প্রথমত ছিল নারীবাদী চৈতন্য মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলে যে দানা বাঁধছিল সেটার বিষয়ে আনদেখা করা। দ্বিতীয়ত ছিল, মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতন্ত্রভাবে লিঙ্গপ্রশ্নকে বিবেচনা করার প্রয়োজন নাই। দুইটাই যে আত্মঘাতী মাথানাড়ানি ছিল তা আশা করি আর নতুন করে প্রমাণ দিতে হবে না। তারপরও যাঁদের সংশয় আছে, জানিয়ে রাখি আমি মনে করি ওগুলো বিপজ্জনক সব ফয়সালা ছিল। এতটাই যে পরে একটা একটা করে নারী শাখা খুলে এই লিঙ্গউৎকণ্ঠাগুলোর যথেষ্ট মীমাংসা করবার মতো খুঁটি দেয়া যায়নি, এমনকি কম্যুনিস্ট পার্টির মহিলা পরিষদের মতো জাতীয় পর্যায়ের বৃহদায়তন সংগঠন দিয়েও। সঙ্কটটি বাংলাদেশের মার্ক্সবাদী দলগুলোতেই প্রথম আমদানি হয়নি সবাই জানেন। সোভিয়েত বিপ্লবেরই সমান বয়সী লিঙ্গীয় বিতর্ক। এটা আমার খুবই মনে হয় যে পার্টিগুলোর মধ্যে লিঙ্গচৈতন্য জাগরুক থাকলে রাষ্ট্রের ম্যানিপুলেটিভ আচরণগুলো সতর্ক হতো। আরো সহজ করে বললে, নারীবাদকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করার সময় সকল প্রতিষ্ঠানেরই মনে পড়ে যে এমনকি মার্ক্সবাদী দলগুলোতেও নারীবাদীরা কোণঠাসা। আশা করি আমার বক্তব্যটা স্পষ্ট হলো।

আবার আরেকদিক থেকেও দেখা দরকার। সমাজতন্ত্রী বিপ্লব কোনো না কোনোভাবে সাধিত হয়েছে এসব রাষ্ট্রে যৌন নিপীড়ন গুরুত্বপূর্ণ মাত্রায় কম ইত্যাদি হিসাব পাওয়া যায়। সেটা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন হোক, কিউবা হোক কিংবা বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি। এমনকি সমাজতন্ত্রী নয় এমন বিপ্লবসম্পন্ন রাষ্ট্রেও যৌন সহিংসতার মাত্রা কম থাকার, নারীর অধিকতর নিরাপদ যৌন জীবনের আলাপ চালু ছিল। এই তালিকায় ইরান থাকবে, সাবেক লিবিয়া থাকতো, কিংবা ইরাকও। কারো কারো মন খারাপ হলেও তালিবানশাসিত আফগানিস্তানও থাকতে পারত। লিঙ্গীয় বৈষম্যের সঙ্গে যৌন নিরাপত্তার প্রশ্ন যে জড়িত তা একদম সাধারণ বোধবুদ্ধির আলাপ। কিন্তু লিঙ্গীয় বৃহত্তর বৈষম্যের মধ্যেও কিছু রাষ্ট্রে নারীর যৌন নিরাপত্তা অধিকতর প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুঁজিবাদ ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার সঙ্গে নারীবাদের বিবিধ স্পন্দনকে মেলানোর চেষ্টা যারা করে চলেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই করতে থাকবেন। কিন্তু ওই তৎপরতাগুলোর পাশাপাশি এই মুহূর্তের রাষ্ট্রতে এই মুহূর্তের বিচারিক ব্যবস্থায় যৌনহামলা ও হয়রানিগুলোর বিচার চাইতে থাকার দরকার পড়বে। অনেকটা ন্যাশনাল আইডি বা এসএসসির ফর্ম পূরণের মতো নৈমিত্তিক কর্মসূচি হিসাবে।

১৯. দণ্ডমূলক বিচার ব্যবস্থার বিপরীতে রেস্টোরেটিভ বা পুনর্গঠনমূলক ন্যায়বিচার ব্যবস্থার কথা আমরা শুনতে পাই এই ধারণাটি সম্পর্কে কিছু বলবেন… কিভাবে এটি গড়ে উঠতে পারে?

মানস: খুব অপ্রাসঙ্গিক না শোনালে বলব জনপদীয় সালিশ ব্যবস্থা কিংবা ভারতে যাকে গ্রাম পঞ্চায়েত বলা হয়ে আসছে, সেগুলোর ধারণায়ন কিন্তু এইরকম সমন্বয়মূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক, কিছুটা মোটাদাগে বললে। এটা গড়ে উঠতে পারে যেখানে শক্তিশালী সমাজব্যবস্থা বা ইংরাজিতে বললে কম্যুনিটি আছে। আপনি নিশ্চয়ই মানবেন যে এই অনুবাদগুলো একদম নাট আর বল্টুর মতো মাপ করে করে হয়নি। বাংলায় দেশ বা সমাজ প্রায়ই ইংরাজি সনাতনী কম্যুনিটির কাছাকাছি। অন্যদিকে, আমরা লাগাতার সামাজিক অনুশাসনের নিন্দা করছি। অন্তত আমাকে সমাজের একজন অনুগত প্রজা হিসাবে ভাবার বিশেষ কোনো ঐতিহ্য নাই। আমার মনে হয় না, আপনারাও সেই দলে পড়বেন। যেখানে সারাক্ষণ সমাজের কঠোর নৈতিকতাধর্মি বলবানপক্ষীয় বজ্জাতিগুলোর আমরা নিন্দুক, সেখানে ‘শক্তিশালী’ সমাজের প্রস্তাব করার মাথামুণ্ড পাওয়া শ্রোতার জন্য দুরূহ। ফলে এইসব আলাপকে একদম নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতেই কেবল কিছুটা অর্থবহ করে বলা সম্ভব। সমাজ বা কম্যুনিটি বলতে তাহলে সেই অংশের কথা বলা হচ্ছে যেখানে গণতন্ত্র অধিক সুলভ; যেটা গুণগতভাবে ম্যানিপুলেটিভ নয়। আবার অন্যদিকে, আধুনিক রাষ্ট্রের অনেকগুলোতে কম্যুনিটি পুনর্গঠিত হয়েছে একটা ধারাবাহিক বিন্যস্ত প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে। আরো নিশ্চিত করে বললে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, নরম আমলাতন্ত্র দিয়েই জনপদগুলোর কম্যুনিটিরূপ তৈরি করা হচ্ছে; ঠিক ঈশ্বরের ‘প্রাকৃতিক পল্লী’ এগুলো নয়। এসব প্রচেষ্টায় সেসব রাষ্ট্রে বৃহদায়তন শহর কিংবা শিল্পনগরগুলোকে না পারলেও অপেক্ষাকৃত অল্পব্যস্ত লোকালয়গুলোকে ‘কম্যুনিটি’ বানিয়ে ফেলতে পেরেছে; কিংবা সেরকম একটা সন্তোষময়তা আছে।

শিল্পী: ক্রিস্টিনা কোয়ার্লস

যদি ভাবতেই হয় যে, পুনর্গঠনমূলক বা সঞ্জীবনী বিচারব্যবস্থা বলে কিছু একটা আমরা ভাবতে পারি, সেটা ন্যায়বিচার হোক বা নাহোক অহিংস বিচারব্যবস্থা হওয়া সম্ভব, বা অন্তত কমহিংস্র। তবে গোড়াতেই স্পষ্ট করার দরকার যে, অন্তত বুর্জোয়া অর্থেও যাকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বলে সেসবের নিশ্চয়তা হচ্ছে এইরকম শাস্তিব্যবস্থা (বা আপনি বলছিলেন বিচারব্যবস্থা) গড়ে তোলার একদম প্রথম দিকের শর্ত। উপরন্তু, দুর্নীতি বলতে মোটামুটি যাকে চেনা হচ্ছে, এবং যেগুলো দুঃখজনকভাবে দক্ষিণের সমাজে ঐতিহাসিকভাবেই বেশি, সেগুলোও এই ধরনের সৃজনশীল বিচারব্যবস্থাকে দাঁড়াতে দেবে না। তবে এই ধরনের বিচারব্যবস্থার সমর্থকদের একটা অংশ মনুষ্যমহত্ত্বের উপর অনেক আস্থা রেখে ব্যবস্থাটাকে কল্পনা করেন। আমার মনুষ্যমহত্ত্ব বা মনুষ্যক্রূরতা নিয়ে আলাদা করে কোনো আস্থা বা হতাশা নেই। এসব মিলেমিশে মনুষ্যচরিত্র গঠিত। পাহারাদারিত্বে আমার তীব্র আপত্তি হলেও, আমি মনে করি না যে মনুষ্যক্রূরতা কেবল জগাইমাধাই কোলাকুলিতে পানি হয়ে যাবে। বরং, একটা সামাজিক/কম্যুনিটি পাহারাদারিত্ব থাকবে বলেই আক্রান্ত ও আক্রমণকারী একত্রে একটা পরিসরে গাঠনিক ভূমিকা নিতে পারবেন। এখন ওই কম্যুনিটির ‘শাসনপ্রণালী’ মৃদু বা কোমল হতে পারে, এর প্রজা ও প্রশাসকের সম্পর্ক হাস্যরসের হতে পারে, কিন্তু ব্যবস্থাটির মাজার জোর প্রগাঢ় না হলে কিছুতেই দুই পক্ষের সংমিশ্রণে ‘সম্ভ্রম’ উৎপন্ন করা সম্ভব নয়। এটা একটা গাঢ় ব্যবস্থাপনাগত বিচারব্যবস্থা হিসাবে আমি দেখি। অন্তত এই মুহূর্তে আমাদের এদিকে এই ধরনের দূরবর্তী কোনো কল্পনার জন্যও সবই অপ্রস্তুত – রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা, জনসমাজ।

সমকালীন নারীর যাপনঅভিজ্ঞতা 

২০ একদিকে, নারী আন্দোলনকে রাজনৈতিকনা ভাবার চল, অর্থাৎ এমনকি প্রগতিশীল/বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পরিসরেও পুরুষাধিপত্য; অন্যদিকে খোদ অধুনা নারীবাদের ক্ষমতাপ্রীতি, সাথে আছে নারী স্বাধীনতার মোড়কে নব্যউদারনৈতিক সাফল্যগাথা দেখা যাচ্ছে যে, নারীর অধিকারের প্রশ্নকে রাজনীতির ময়দানে নিয়ে আসার ক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা না কাটতে কাটতেই, [অনুশাসনমূলক এবং প্রাতিষ্ঠানিক] ক্ষমতা কর্তৃত্ব অর্জন হয়ে উঠছে নারীবাদের এজেণ্ডা এই পরিস্থিতিতে আজকের দিনের প্রতিরোধী/ক্রিটিক্যাল নারীবাদকে কী কী জিনিস রপ্ত/রিক্লেইম করতে হবে বলে মনে করেন?

মানস: বর্গমূলক পরিচয় অত্যন্ত বিপজ্জনক ও পিচ্ছিল, সেটা মানুষের বেলায় যেমন, প্রবণতার বেলাতেও। ‘নারীবাদী’ কে কিংবা ‘রাজনৈতিক’ কী এই ধরনের প্রশ্নগুলোতে হাজার লোকের প্রায় হাজারখানেক উত্তর বা আউটলেট থাকতে পারে। আজকে আমরা আলাপ চালানোর স্বার্থে উভয়পক্ষই কিছু লক্ষণ থেকে নারীবাদী বর্গকে আন্দাজ করে নিয়েছি। তবে যাবতীয় ক্ষমতাসংঘাতকে রাজনৈতিক নাভাবার কোনো সুযোগ নেই। এখানে অবশ্যই নানান ধরনের উত্তরকাঠামোবাদী জিজ্ঞাসার বিপদ যে আছে তা তো আমরা জানিই। ‘সবকিছু রাজনৈতিক, মানে কোনোকিছুরই তাহলে আর বিশেষত্ব নাই’! এরকম একটা বিপদ থাকেই। নারী আন্দোলন তার থেকে ব্যাপকতর প্রসঙ্গ। একে রাজনৈতিক দেখতে নাপারা আসলে অজ্ঞতামূলক নয়, প্রতিপক্ষতামূলক। এখানে আমি এই বিষয়টা স্পষ্ট করতে চাই, আশা করি কোনো আলাপের পুনরাবর্তন হচ্ছে না, আমি সংঘর্ষ বুঝবার ক্ষেত্রে চারপাশের বিদ্বান ও রাজনীতিকর্মীদের লাগাতার জ্ঞানের ঘাড়ে চড়ার ঘোরতর বিরোধী। এমনকি বিরক্ত। ‘মানুষ অজ্ঞ, তাই উহা করিছে’ – এইটা কিছু ব্যতিক্রম বাদে আগাপাছতলা একটা ভুল থিসিস। ‘মানুষ উহা করিছে, কারণ তাই তিনি চান’! ফলে জ্ঞানের ‘আলো’ দিয়ে সংঘর্ষের প্রাথমিক ক্ষেত্রগুলো যাঁরা সারাই করতে চান তাঁদেরকে আমি দূর থেকে সালাম জানাই, এবং দূর থেকেই জানাই। ইন্টেন্ট বা নিয়ত বদলের কার্যক্রম ভিন্ন হবে। আমার নাজানা থাকতে পারে, পরিশেষে আমি একজন মাস্টারির চাকুরিজীবী মাত্র, কিন্তু সেটা ‘জ্ঞানেরআলো’ কার্যক্রম নয় তা বুঝি।

একটা প্রশ্নে এফারমেটিভ একশনের আলাপ চলছিল। সমাজে বৈষম্য থাকলে সেগুলোকে সামলানোর একটা আধুনিক রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এটি। কিন্তু আপনি যে বাস্তবতাটার কথা বললেন সেটা সর্বৈব ভিন্ন একটা পরিস্থিতি। অনেকটা কৃষকদের সমবায় সমিতি আর ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মধ্যকার তুলনার মতো। বিগত বছরগুলোতে সারা পৃথিবীর নারীবাদীদের মধ্যেই এই সতর্কতাটা তৈরি হয়েছে যে সাম্রাজ্যবাদ, বহুজাতিক কর্পোরেট পুঁজিবাদ, সমরতন্ত্র ইত্যাদির গুরুতর সমর্থক নারীবাদী স্বর ময়দানে আছে। আরো স্পষ্টভাবে তাকালে, এমনকি তার আগেই কড়া জাতীয়তাবাদ কিংবা পুঁজিবাদের সমর্থক নারীবাদী স্বর বিরাজমান ছিল। এই ধরনের আধিপত্যমূলক নারীবাদকে চাইলে রাগ করে আমরা সিউডো বা ভ্রান্ত নারীবাদ নামে ডাকতেই পারি। কিন্তু তাতে সমস্যা গুরুতরভাবে কমছে না, কারণ সেসব স্বর নিজস্ব দাবিনামা থেকে সরছেন না। বরং, নানাবিধ বৈষম্য নিয়ে চিন্তা করছেন এমন নারীবাদীরা যে সতর্ক হয়েছেন সেটার দিকে আশা নিয়ে তাকানো কাজের বলে আমি মনে করি। ‘সাম্রাজ্যবাদী নারীবাদ’ ঠিক বিদ্যাগত একটা বর্গ হিসাবে না প্রতিষ্ঠা পেলেও পলেমিকের দুনিয়ায় কমবেশি আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্টের হামলার সময় থেকেই গ্রাহ্য হয়ে আসছে। একটা মুখ্য কারণ হলো আমেরিকার হামলা করবার নানান রকমের সাফাইগাওয়া পক্ষ দেখা দিয়েছিল যাঁরা তালিবান শাসনে নারীদের দুরাবস্থার চিত্র হাজির করেছেন। বাহ্যত, তাতে মার্কিন সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড নারীদের দুরাবস্থা থেকে ‘মুক্ত’ করার ‘স্যালভেশন মিশন’ হিসাবে চিত্রিত হতে পেরেছেসকলেরই মনে পড়বে যে এই কাজটা নিছক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক নারীদের ছিল না, এমনকি সাধারণভাবে পাশ্চাত্যীয় নারীদেরও নয়, এটা আমাদের চারপাশে বহু নারীঅধিকার বিষয়ে সরবরাও করেছেন। এখন নিজের মনকে আপনি যেভাবেই বুঝ দেন না কেন যে এঁরা ‘প্রকৃত’ নারীবাদী নন, তাতে ওই মতপ্রকাশক বা সংগঠকের আগের বছরগুলোর নারীবাদী পরিচয়ের লিগ্যাসি সরানো সম্ভব নয়। এটা প্রচলিত বামপন্থীদের অনেকের বেলাতেও সত্য। তাঁদের অনেকেই তালিবানবিদ্বেষে আটকা পড়ে মার্কিন সামরিক তৎপরতার বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বরের সঠিক তীব্রতা খুঁজে পাচ্ছিলেন না; কিংবা ‘যদিওতথাপি’ দিয়ে সাজাচ্ছিলেন।

এই মুহূর্তের পরিস্থিতি আগের যেকোনো সময়ের চাইতে অনেক কঠিন, বিপজ্জনক এবং পিচ্ছিল। বৈশ্বিক পুরুষাধিপত্যের কাঠামো নিবিড়ভাবে নিওলিবেরেল মতাদর্শকে আশ্রয় করেছে যেমন, নারীবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও করেছেন। ব্যক্তিসমূহের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখানে সুতীব্র, আর এক্সেলেন্সের ধারণাকে অধিকারের ধারণার উপর চড়াও হতে দেয়া হচ্ছে। সেই লজিকের গ্রাহক ও বেনেফিশিয়ারি দুই ভাবেই নারী আবির্ভূত হচ্ছেন। তবে এগুলো অন্তর্প্রবিষ্ট পরিক্ষেত্র বা ওভারল্যাপিং কন্টেস্টিং জোন। বিদ্যাজগতের ও রাজনীতি জগতে মোটামুটি নিওলিবেরেল অভিধাটি যেহেতু পরিচিত, বোঝাবুঝিতেও তেমন সমস্যা হবে না। ক্রিটিক্যাল কিংবা সমাজতন্ত্রী কিংবা র‍্যাডিক্যাল কিংবা দক্ষিণের নারীবাদীদের পক্ষে আসলে অগ্রাহ্য/উপেক্ষা করতে থাকাই কাজ। সমতার জন্য লড়াইয়ে আছেন যাঁরা তাঁদের নানান কিছু ডিজওউন করতে থাকার অভ্যাস আছে। কেবল নামটা কম্যুনিস্ট পার্টি বলেই তো আর নিশ্চয়ই নিখিল বিশ্বের শ্রমিকপক্ষীয়রা চীনের পার্টিটাকে নিজপক্ষীয় মনে করতে থাকেন না।

২১ অনলাইন স্পেসে যে ধরনের নারীবাদের প্রাধান্য দেখা যায়, তার অনেক চর্চাই সত্যিকারের নারী আন্দোলন/অধিকারের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর বলে আমার অন্তত মনে হয় প্রসঙ্গত স্মরণ করিয়ে দেই, এক সাক্ষাৎকারে আপনি মন্তব্য করেছিলেন: নেতৃত্বস্থানীয় হয়ে ওঠার প্রবণতা বাংলাদেশের নারীবাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা অনলাইন জগতে চর্চিত নারীবাদের আর কোন কোন প্রবণতাকে সমস্যায়িত করবেন?

মানস: সাইবার পরিমণ্ডল প্রসঙ্গে ভাবতে গিয়ে আমি নারীবাদী বা সম্ভাব্য নারীবাদী নড়াচড়াগুলোকে আলাদা করে কোনো দায় দেবার পক্ষে নই। একটা প্রশ্নের উত্তরে আমি বলছিলাম সাইবার পরিমণ্ডলকে দেখতে হবে নিরন্তর ভাষা ও ভঙ্গি উৎপাদনের একটা উৎপাদনক্ষেত্র হিসাবে। প্রাকসাইবার কালে ভাষা, তাই বার্তা, তাই অভিব্যক্তি, প্রকাশের জন্য সকলেরই যথেষ্ট সাংগঠনিক প্রস্তুতি লাগত। এখানে আমি সংগঠনের প্রচলিত অর্থে বলিনি, বলেছি কোনো একজন ব্যক্তির চিন্তার সংগঠন বা সংবদ্ধতার কথা বলছি। আট জন সখাসখীর একটা দল নিছক ক্যাম্পাসের মাঠে চাখাবার কালেও যদি একজন কিছু একটা বলতে চান অন্য অন্তত ছয়জনের নৈঃশব্দ্যের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তাঁকে। হাতপা নাড়িয়ে তাঁদেরকে থামাতে চাইবেন আপনি, আপনার কথাটুকু বলার জন্য। মুদ্রিত মতামত বা অভিব্যক্তির বিষয়ে তো আরো সব পদক্ষেপ নিতে হতো। একটা পোস্টকার্ড কাউকে লিখে পাঠানোর আগেও আপনার কতগুলো ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হতো। তার মানে যেকোনো মানুষেরই অভিব্যক্তি প্রকাশের অনেকগুলো পর্যালোকীয় বা সম্পাদকীয় পর্যায় থাকতো। এটা ইচ্ছাসাপেক্ষ কোনো পরিস্থিতি নয়। সাইবার পরিমণ্ডলে রচয়িতা তাঁর সকল অভিব্যক্তিরই তাৎক্ষণিক সম্প্রচারের সুযোগ পান, তার পাঠক যতজনই হোন না কেন। অভিব্যক্তি প্রকাশের সম্পাদকীয় পর্যালোচনাহীন এই তাৎক্ষণিকতার বিষয়ে আমি সতর্ক থাকতে চাইব। ফলে নারীবাদীদের কারো কারো অভিব্যক্তিই কেবল নয় জাতীয়তাবাদী, পুঁজিবাদী, পিতৃতন্ত্রবাদী, নারীবিদ্বেষী, অন্যজাতিবিদ্বেষী কিংবা বামপন্থী সকলেরই উত্তুঙ্গউত্তেজিত অভিব্যক্তি প্রকাশিত হতে থাকে

আমার সাক্ষাৎকারটি আপনি লক্ষ্য করেছেন বলে ধন্যবাদ জানাই। তবে একটা আলাপের মধ্য থেকে একটা শিরোনাম আলাদা করে পড়তে অত স্বস্তিকর লাগছে না। আমার সামান্য ওই আলাপটার ভিতরে লক্ষ্য করবেন যে আমি ‘নৈতিকতার শাসন’ জারি রাখার প্রবণতা নিয়ে বেশি দুর্ভাবিত ছিলাম। এখনও তাই আছি। অনলাইন জগতের তৎপরতাতে নারীবাদী প্রবণতাগুলো কেবল যে ক্ষতিই করেছে তা আমি মনে করি না অবশ্য, যেটা আগেও বলেছি। নানান রকমের আপত্তির কারণে পুরুষদের একাংশ নানাবিধ অভিব্যক্তি প্রকাশে সতর্ক হয়েছেন, সংযমী হয়েছেন। সেগুলো অবশ্যই লাভ, তাতে পেটের মধ্যে যার যাই থাকুক না কেন। কিন্তু সত্যি সত্যিই আমি অনলাইনের হৈচৈমূলক নানান নড়াচড়াতে অতটা বিচলিত নই। আচরণবিধি একটা নিরন্তর অনুশীলনসাপেক্ষ বিষয়; এমনকি দরকার মতো নির্দেশনারও (যাকে চাইলে বুর্জোয়া সমাজের কারেকটিভ মেজার বলতে পারেন)। ধরুন একটা খেলার ময়দানে আপনিআমি গেছি একটা দলকে সমর্থন করতে। যতক্ষণ নাচানাচি, পটকা ফোটানো, ঢোলবাজানো ছিল আমাদের হয়তো সমস্যা হয়নি; কিন্তু একটা পর্যায়ে আমাদের সহসমর্থকেরা ব্যাপক পিটানি দিতে শুরু করলেন প্রতিপক্ষকে। এই পর্যায়ে আপনিআমি ব্যথিত হতে পারি তাঁদের আচরণে, কিন্তু ওই দলটিকে সমর্থন করার কারণে আপনার আমার আলাদা করে বিচলিত হবার দরকার পড়ে না। ওই পিটানিওয়ালাদের নিজপক্ষীয় ভেবে পদ্ধতিগত সমস্যাতেও পড়ার দরকার নেই। এখন মনে হতে পারে, যে খেলার উদাহরণ লঘু হয়ে গেল। কিন্তু আমি তা মনে করি না; বিভিন্ন মতের পক্ষাবলম্বনকারীরা ধারাবাহিক ও অটুট সব বৈশিষ্ট্যের মানুষ ধরে নেবার সমস্যা সেটা। চূড়ান্ত বিচারে আদর্শবাদের সমস্যা। আমি বিবিধ রাজনৈতিক পক্ষকে আদর্শমানসিদ্ধ অটুট পক্ষ হিসাবে দেখি না। ফলে এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া যে কোন কোন বিষয়ে আমিআপনি দূরত্ব বোধ করছি; দরকার মতো ঘোষণা করছি। যদি সংশ্লেষ/সংশ্লেষণ পদ্ধতিগত হয়ে থাকে, তাহলে বিশ্লেষ/বিযোজনও তাই। এটার ধ্রুব এবং প্রসঙ্গনিরপেক্ষ কোনো দশা নেই। স্পষ্ট করি যে, আমার বক্তব্য এই নয় যে সাইবারের অনেক নারীবাদী দীর্ঘমেয়াদে ক্ষয়ক্ষতি করছেন না, আমার বক্তব্য হলো নতুন অভিব্যক্তিপাটাতনে নতুন নতুন ক্ষয়ক্ষতি হবে এবং সেগুলো নেতিকরণের রাস্তা বের করাও একটা কাজ অন্যদের। সাইবারের অভিব্যক্তির ইনফ্লেশনের দুইটা সুবিধা মাথায় রাখা খুবই কাজের হবে। প্রথমত, এখানে বানের পানির মতো চলমান ভাষামালায় কোনো কিছু স্থিরঅনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ পায় না। দ্বিতীয়ত, একটা বিশেষ সময়ে কত রকমের বিদ্বেষ ও চিন্তাকল্প/প্রিমাইজ ক্রিয়াশীল আছে চারপাশের সমাজে তা আপনি অল্প আয়াসে সাইবার পরিমণ্ডল থেকে জেনে যেতে পারছেন।

২২ হালের নারীবাদী এজেণ্ডায় এমনকি মধ্যবিত্ত পরিসরের সকল নারীকে কল্পনা করা হয় বলে আমার মনে হয়নি কোথাও না কোথাও এই নারীবাদী ডিসকোর্সে “transition” এর ধারণা বিদ্যমান থেকেছে অর্থাৎ, মধ্যবিত্ত নারীদের মধ্যেও জ্ঞানগম্যি, প্রগতি, আধুনিকতা ইত্যাদিতে যে সকল নারীদের উত্তরণঘটেছে বলে মনে করা হয়; সেই সকল নারীই যেন বর্তমান নারীবাদের এজেণ্ডায় কল্পিত হচ্ছে বাকি [মধ্যবিত্ত] নারীরা একটা ‘desired’ জীবন চিনতে শেখেননি বলে কতকটা আহাচুকচুকের বাইরে তাদের কোন কোন সমস্যা নারীবাদের এজেণ্ডায় আসা উচিত, সেই সম্যক বোঝাপড়ার অভাব দেখতে পাই আমার এই পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই

মানস: দুর্দান্ত পর্যবেক্ষণ। ট্রানজিশন বা রূপান্তরশীলতার ধারণা প্রবলভাবে কাজ করে। এটার অপেক্ষাকৃত সহজ উদাহরণ সম্ভবত মধ্যবিত্ত নারীদের পোশাকবাছাই আর গৃহিণীজীবন নিয়ে পাওয়া যায়। ডিজায়ার্ড/কাঙ্ক্ষিত জীবন চিনতে ‘শেখেননি’ যে বর্গ, সেই বর্গ বরং তুলনামূলকভাবে সাদরে গৃহীত হন অন্তত এই কারণেও যে তাঁদের চিনানির দায়িত্বটা তখন আঁভাগাদে বা ‘অগ্রসর’রা নিতে পারেন সমস্যাটা বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক বেশি সেসব মধ্যবিত্ত নারীদের যাঁরা সম্প্রচারিত-‘কাঙ্ক্ষিত’ জীবনযাপনটা চিনেছেন এবং সেটা অবলম্বন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থেকেছেন মোটের উপর তাঁদের অভিজ্ঞতা ‘এবিউজিভ’ বা জবরদস্তির আচরণ সামলানো এর মধ্যে একটা বর্গকে নাবিবেচনা করার সুযোগ নেই যে বর্গের মধ্যবিত্তশিক্ষিত নারীরা আকাঙ্ক্ষিত জীবনাচরণ চিনেছেন, তা পালন করতে চান, কিন্তু পরিপার্শ্বের পৌরুষময় ব্যবস্থা তা পালন করতে বাধা দেন তাঁদের এই বর্গের জন্যও নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা প্রকাশ্য নারীবাদীরা নিতে পারেন, নিয়ে থাকছেন আর এটা নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেইও কিন্তু অন্য যাঁদের কথা ভাবলাম তাঁরা আসলেই একটা টানাহেঁচড়ার মধ্যে থাকেন – একপক্ষের জন্য শেখার টানাহেঁচড়া, আরেক পক্ষের জন্য বদলানোর টানাহেঁচড়া

অন্যকে তালিম দেয়া বা রূপান্তরের এই আচরণগুলোর বা হৈচৈগুলোর ক্ষমতাদর্পিতা বা বুলিইং দেখতে পাওয়াটা সাধারণ বুদ্ধির বিষয় আমি বরং আলাপ করি আচরণগুলো তৈরি হবার চিন্তাপাটাতন বা প্রিমাইজ নিয়ে আমার বিবেচনায় কমবেশি প্রগতিবাদিতার স্থূল মডেলকে আত্মসাৎ করা থেকে এইসব আচরণ আসে আরো নির্দিষ্টে আসে ধর্মকে পিতৃতন্ত্রের নিরঙ্কুশ কারণ হিসাবে দেখার মাধ্যমে প্রধান ধর্মগুলোর চর্চিত ফর্মগুলো পিতৃতন্ত্রের আকর এটা নিয়ে এই মুহূর্তে বিশদ করার কিছু দেখি না কিন্তু পিতৃতন্ত্রের মুখ্য বা একমাত্র রূপকার ধর্মকে ভাবা বাস্তবানুগ নয় এমনকি এভাবে ভাবা পিতৃতন্ত্রকে দীর্ঘকালীন মোকাবিলার রাস্তা বের করতে অন্তরায় করবে মাত্র মাস্টারি করি বলে প্রগতিবাদিতার স্থূল মডেলের কিছু উদাহরণ একদম সহজেই ক্লাসে পাওয়া যায়। বহুবছর ক্যাম্পাসে ‘স্মার্ট বনাম খ্যাত’ মাপামাপির একটা চল আছে। এখানে স্মার্টবর্গ অবধারিতভাবে আরবানমিডলক্লাস, প্রায়শই হালের সাহিত্যছায়াছবির খোঁজ রাখা, ইংরাজি জানা, এবং অবশ্যই পোশাকে নির্দিষ্ট ফর্ম বা ব্র্যান্ডসচেতন। ‘খ্যাত’বর্গ এর বিপরীতগুলো। হালের সাংস্কৃতিক প্রডাকশন নিয়ে অজ্ঞ, ইংরাজি নাজানা বা কমজানা ইত্যাদি। মোটের উপর ‘শহুরেগ্রাম্য’ যে জোড়টা সাহিত্যেচলচ্চিত্রে সুলভ সেটারই একটা সংস্করণ। এই বিভাজন কিন্তু কমবেশি লিঙ্গনিরপেক্ষ (ছিল)। এখন, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের (বা তার মধ্যকার বনেদীগুলোর) একটা স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিকপরিচয় তৈরি হবার কারণে, এবং অন্যান্য কারণেও, পাবলিক ক্যাম্পাসগুলোর মধ্যকার এই বিভাজন অতটা তীক্ষ্ণ নয়। অন্তত আমি দেখি না। বিশেষত পোশাকপ্রবণতা বা ফ্যাশনের একটা অবধারিত বৈশ্বিক রূপান্তর ঘটেছে সাইবারবিকাশে আর গার্মেন্টশিল্পের কারণে। এখন একজন আর্থিকভাবে টানাপড়েনে থাকা শিক্ষার্থীও একটা টিশার্ট পরার ‘স্মার্টনেস’ দেখাতে পারেন। কিন্তু, যেসব পোশাক ধর্মীয় কোড বহন করে বলে ভাবা হয়, সেসব পোশাকধারীরা লাগাতার চাপের মধ্যে থাকেন। এবং দশাটা অতটা লিঙ্গনিরপেক্ষও নয়। মোটের উপর নারীদের চাপটা গুরুত্বপূর্ণভাবে বেশি। সহপাঠী বা ক্যাম্পাসবাসীদের চাপ তো আছেই, অধ্যাপকদের একাংশও ঠাট্টাতামাশা যে করেন তার অজস্র ঘটনা আছে, হয়তো প্রামাণ্য নেই। এখন কেউ উল্টাদৃশ্যের কথা বলতে পারেন যেখানে ‘পাশ্চাত্যীয়’ পোশাকধারী নারীর ভোগান্তিও আছে। আমি সেটাকে খাট করার জায়গায় নেই। কিন্তু প্রগতিবাদিতার এই আলাপে ওই ঘটনাগুলো অধিক প্রাসঙ্গিক যেখানে হিজাবী কিংবা সম্পূর্ণ শরীরঢাকা পোশাকধারীকে সাব্যস্ত করা হচ্ছে ‘অনগ্রসর’ (তাই মেরামতসাপেক্ষ) হিসাবে।‘

শিক্ষিত নারীদের নিজেচ্ছাতে অচাকুরিজীবী গৃহিণী থাকা কিংবা শ্বশুরকুলের শাসনব্যবস্থায় থাকা কিংবা অবগুণ্ঠনে থাকার সুবন্দোবস্ত নাই। মানে এই থাকাথাকি তাঁর পক্ষে ‘বন্ধুবান্ধব’ (পিয়ারগ্রুপ) থেকে ব্যাপক চাপের হবে। বিপজ্জনক হচ্ছে যে নারীবাদীদের কেউ কেউও চাপটা দিয়ে বসতে পারেন। সঙ্কটটা আপনার প্রশ্নেই দিকনির্দেশ করে। এটা জীবনযাপনের আদর্শমান (স্ট্যান্ডার্ড লাইফস্টাইল কিংবা আপনার ভাষায় কাঙ্ক্ষিত জীবন) বলবৎ রাখার আধিপত্য। এগুলো সূক্ষ্মভাবে অজস্র বিষয়ে ক্রিয়াশীল থাকে, নারীবাদী তৎপরতাতেও আছে মাত্র। আপনার পরিবারের কোনো বিপদের মধ্যে আপনি শান্তভাবে কাজকর্ম করলেও আপনার ‘সংবেদনহীনতা’র অভিযোগ নিতে হতে পারে, আর পাঁচজন বিলাপরতদের সমরূপ আচরণ করার টানাহেঁচড়া চলতে পারে।

২৩ যৌন স্বাধীনতাবলতে কি বুঝতে হবে তার একটা অনুশাসন আছে খোদ সেক্যুলারলিবারেল পরিসরেও আবার ইন্টারেস্টিংলি যৌন স্বাধীনতানিয়ে আলাপও আছে; আমার কাছে এই স্বাধীনতা প্রশ্নটাকে অনুশাসনের প্রশ্ন মনে হয় ইদানীং মানুষের খুবই জৈবিক অস্তিত্বের সাথে জড়িত এই যৌনতাকেও কেন শাসনের মামলায় পরিণত করতে হয়?

মানস:যৌন স্বাধীনতা’ আর অনুশাসন যে সম্পর্কিত ধারণা তা একদম গোড়াতেই কবুল করে বলছি। স্বাধীনতার প্রসঙ্গ গুণগতভাবেই শাসনের প্রসঙ্গের সাথে সম্পর্কিত সেই অর্থে। আমি গোড়াতেই সতর্ক করতে চাইব যে ‘যৌন স্বাধীনতা’ বলতে লোকে অভিন্ন জিনিস বোঝেন না, এবং সম্ভবত সাংঘর্ষিক জিনিসপত্রও বোঝেন। একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেব যে পাশাপাশি কয়েকটা ভাষামালা আছে যেগুলোর ভারে বা অর্থময়তার মধ্যে এই ধারণাটাও জুড়ে যায়। যেমন: ‘অবাধ যৌনাচার’, ‘ফ্রিসেক্স’, ‘যত্রতত্র বা যার তার সাথে’, ‘বাছবিচার নাই’, ‘পশুর সাথে পার্থক্য নাই’, ‘অজাচার’, ‘লুজ’, ‘চরিত্রের ঠিক নাই’ ইত্যাদি। এরকম আরো দীর্ঘ তালিকা বানানো সম্ভব; আর এগুলো, ভাষানির্দিষ্ট অর্থ রাখলেও, মোটামুটি বৈশ্বিক। আপনি যে ভাবনা মাথায় রেখেই ‘যৌন স্বাধীনতা’ শব্দমালা প্রয়োগ করেন না কেন, যেসব ডিসকার্সিভ পরিমণ্ডলে তার অর্থ নির্ধারিত হবে সেগুলো সমূহ ঘোরালোপ্যাঁচালো এবং নৈতিকতার ধ্বজাধারী। এর প্রথম মানেই দাঁড়ায় বহুগামিতা। ফলে খুবই মুস্কিলের প্রসঙ্গ।

অন্যদিকে, ‘প্রেসের স্বাধীনতা’র মতোই, এটা একটা অতিকথন বা মিথও। যেসব রাষ্ট্রসমাজে যৌন স্বাধীনতা আছে বলে ধরে নেয়া হয় সেখানেও নানান মাত্রার ও প্রকারের অনুশাসনের পদ্ধতি চালু আছে, যদি, অবশ্যই, অনুশাসনকে স্বাধীনতার বিপরীত ধরে নিই। আপনার প্রশ্নেও সেটাই আছে। কাজ চালানোর জন্য অনুশাসনের অর্থ করছি নানাবিধ নৈতিকতাধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি ও বিধিনিষেধ। একটা উদাহরণ মনে পড়ল। ২০০৪এ দিকে জার্মান চলচ্চিত্র নির্মাতা ফাতিহ্ আকিন তুর্কীজার্মানইংরাজি ভাষার একটা ছবি বানান, ইংরাজিতে যার নাম হেডঅনছবির মুখ্য চরিত্রে নেয়া হয়েছিল সিবেল কেকিলি নামের তুর্কীজার্মান এক অভিনেত্রীকে। ছবিটি জনপ্রিয় হয়, আবার চিন্তকদের মনোযোগও পেয়েছিল। ছবিটা বেশ কিছু পুরস্কারও পায় গোল্ডেন গ্লোবসমেত। কিন্তু সিবেক কেকিলিকে এই ছবিতে নেবার কারণে জার্মান মধ্যবিত্ত আলাপআলোচনায় নির্মাতা অত্যন্ত নিন্দিত হন। কারণ সিবেল পর্নছবিতে কাজ করতেন এই ছবির আগে পর্যন্ত। আমি এই ঘটনা টাটকা জেনেছিলাম জার্মান এক বন্ধুনির কাছ থেকে যিনি এই ছবিতে আলোকচিত্রীদের একজন হিসাবে কাজ করেছেন। ফাতিহ্ আকিন ও নির্মাতাদলের নিন্দিত হবার মাধ্যমে অনুশাসনের বিষয়ে পাশ্চাত্যীয় সমাজের পরিস্থিতি বোঝার বিরাট সুযোগ তৈরি হয় আমাদের। জার্মানিতে পর্ন কারখানা আইনসিদ্ধ, ফলে সেবিলের নিয়োগ আইনগত কোনো সমস্যা ছিল না; ছিল নৈতিকতার আপত্তির বিষয়। বেশ আয়রনিক যে, এর কয়েক বছর পরে, ‘রক্ষণশীল’ বলে পরিচিত ভারতে আরেক পর্নতারকা সানি লিওন অপেক্ষাকৃত সহজে মধ্যবিত্ত মননে ‘গৃহীত’ হয়েছেন। লক্ষ্য রাখতে অনুরোধ করি, পর্নকারখানা বিষয়ে পক্ষবিপক্ষের আলাপের জন্য এই উদাহরণ আমি আনিনি। আমার বলার জায়গা, যৌনস্বাধীনতা কিংবা যৌনঅনুশাসনের যে আন্দাজগুলো চালু আছে তা প্রায়শই ত্রুটিপূর্ণ। সম্ভবত আপনার, বা অনেকেরই, দুর্ভাবনার জায়গা হতে পারে কোথায় অনুশাসন নিছক নিন্দামন্দেই সীমিত, কোথায় তা হিংস্রতায় মদদ দিতে পারে।

আপনার প্রশ্নের শেষাংশটি বরং আমি খানিকটা অভিমানাত্মক মনে করি। হয়তো এটা বিরক্তির মরিয়াপনা থেকে এসেছে। কিন্তু ‘জৈবিক’ বিষয় কেন অনুশাসনে পড়বে এই জিজ্ঞাসা আমার জন্য নিরর্থক। প্রথমত, যৌনতাকে জৈবিকমাত্র বলার বিপদ নতুন করে বাধানোর কোনো কারণ নেই। নারীবাদীরা বছরের পর বছর লিঙ্গকে সমাজসংস্কৃতির প্রসঙ্গ হিসাবে দেখিয়ে এসেছেন। যৌনাচরণও নিছক ‘জৈবিক’ নয়। দ্বিতীয়ত, যদি ‘জৈবিক’ ধরেও আমরা আগাতে চাই, তাহলেও অন্তত কয়েক শ’ বছর ধরে শ্রমিকদের বড় অংশের বিশ্রামহীনতা নিয়ে আগে ‘অভিমান’ করা দরকার। ঠিক আমরা যখন এই আলাপ লিখছি, পৃথিবীর পেটের মধ্যে কোটি কোটি খনিশ্রমিক দিনরাত্র অন্ধকারে ‘সম্পদ আহরণ’ করছেন। অন্য আরো কোটি কোটি শ্রমিক ভূতলে থাকলেও ন্যায্য মজুরি বা বিশ্রাম কোনোটাই পাচ্ছেন না, যেখানে ‘ন্যায্য’কে বড়জোর বুর্জোয়া ব্যবস্থার ন্যায্য বোঝাচ্ছি। খাদ্য বা বিশ্রামকে বরং ‘জৈবিক’ হিসাবে দেখা দরকার; আর সেখানে চলে কঠোর ধরনের শোষণ, অনুশাসনের থেকে যা নিশ্চয়ই তীব্র। যাহোক, অবশ্যই আমি সরল সমাধান জানি না। আর কেবল আমি নই, গাঢ় সব চিন্তকেরা, তীক্ষ্ণ নারীবাদীরাও রাস্তা বা উত্তর খুঁজছেন। কিন্তু যৌনতার বিষয়ে তামাম দুনিয়াতেই মারাত্মক লজ্জাশরমের যে কাঠামোটা আছে, বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন হতে পারে, সেই কাঠামোটার সঙ্গে বোঝাপড়া করা দরকার। অন্তত যেসব এলাকায় শারীরিক আক্রমণমূলক হিংস্রতার মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা কম, কেবল কলঙ্ক হবে, সেসব এলাকায় যৌনশুচিতার চাপ বহন না করার ঘোষণা আসা দরকার। ঝুঁকি সত্ত্বেও, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, যৌনশুচিতার চাপ নারীর জন্য স্বতন্ত্র হতে পারে, কিন্তু চাপমুক্তির ঘোষণাটা নারীপুরুষসমেত সকল লিঙ্গের যৌথ পাটাতন হওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, এমনকি নারীবাদীদের মধ্যেও যৌনশুচিতার বা পিউরিটির গুরুতর সব প্রবক্তা রয়েছেন, বা তার আলামত আছে। সবই অত্যন্ত ওভারল্যাপিং পরিস্থিতি।

মানস চৌধুরী

মানস চৌধুরী নৃবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিদ্যায়তনিক পরিসর ছাড়াও লেখালেখি করেন নানাবিধ ফোরামে। প্রকাশিত বই: জনসংস্কৃতি ও মধ্যবিত্ত (২০২১); দৃশ্যগত নৃবিজ্ঞান (২০২০); নৃবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ (রেহনুমা আহমেদ-এর সঙ্গে যৌথ বিরচিত) ২০০৩; কর্তার সংসার (সায়দিয়া গুলরুখ-এর সঙ্গে যৌথ সম্পাদিত) ২০০০; জলপরী আর জলাতঙ্ক (২০২০); কাকগৃহ (২০০৮) ইত্যাদি।