অরাজ
প্রচ্ছদ » ক্যারোলিন।। লৈঙ্গিক পরিচয়ের রাজনীতিকরণ: একটি বৈপ্লবিক লিঙ্গীয় রাজনীতির দিকে যাত্রা

ক্যারোলিন।। লৈঙ্গিক পরিচয়ের রাজনীতিকরণ: একটি বৈপ্লবিক লিঙ্গীয় রাজনীতির দিকে যাত্রা

  • অনুবাদ: অধরা শ্রেয়সী অথই

[লিঙ্গ কর্তৃত্ব প্রকৃতি বিষয়ক সংগঠন উপৌলের সৌজন্যে অনুবাদটি অরাজে প্রথম প্রকাশ হলো। ক্যারোলিনের Politicizing Gender Moving toward revolutionary gender politics শীর্ষক রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় 1994 সালে। বর্তমান অনুবাদটি নেয়া হয়েছে Anarchist Library-র ওয়েবসাইট থেকে। সম্পাদক]

শিল্পী: বেটিনা সেমার

নারীবাদী ডিসকোর্সসমূহে সামাজিক নির্মাণবাদী ও জৈবিক নির্ধারণবাদিদের মধ্যকার নিরন্তর প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায়শই তাদেরকে সেইসব মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, নারীবাদীরা আসলে যাদের মুক্তির প্রত্যাশা করেন। সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো নিয়ে একটি গঠনমূলক বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে যে দ্বন্দ্ব এবং প্রয়োজনের মধ্য দিয়ে আমার রাজনৈতিক বোধের জন্ম হয়েছে, তার মাঝে নিজেকে শনাক্ত করা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একজন ২৬ বছর বয়েসি রূপান্তরকামী নারী হিসেবে শুধুমাত্র নৈরাজ্যবাদী এবং নারীবাদী অবস্থান থেকে আমি এসব ঘটনার মুখোমুখি হইনি। ছোটোবেলা থেকেই ব্যক্তিগত মুশকিলগুলোর সাথে বোঝাপড়া করতে করতে আমার লিঙ্গীয় রাজনীতিবোধের বিকাশ ঘটে। বয়সের সাথে সাথে একজন কিশোরী এবং পরবর্তীতে নারী হিসেবে আমার আত্মপরিচয় এবং একজন পুরুষ হিসেবে আমার সামাজিক পরিচয়ের মধ্যকার বেদনাদায়ক বৈষম্য আমি উপলব্ধি করতে থাকি। সে সময় থেকেই আমি প্রথাগত লিঙ্গপরিচয়ের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করি। নিজ পরিচয় প্রকাশ করা আমার জন্য সহজ ছিল না। এই পরিচয়ের সাথে বোঝাপড়া আমাকে লিঙ্গপরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। আমার অর্থনৈতিক অবস্থাসহ অন্যান্য অনেক বিষয় এই প্রক্রিয়াকে আরও বর্ধিত করেছে। একটি পুরুষ দেহে অদৃশ্য নারীসত্তাকে বয়ে বেড়াবার সেই এলোমেলো কালপর্বেও একজন মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গ “পুরুষ” হিসেবে প্রাপ্ত সুবিধাগুলোর ব্যাপারে আমি সচেতন ছিলাম। প্রচলিত লিঙ্গপরিচয় একটি আরোপিত ধারণা। জৈবিক ভিত্তি অনুযায়ী লিঙ্গসমূহের শ্রেণিবিভাগ আমাদের স্বাধীনতাকে সংকীর্ণ করে ফেলে। এই ধারণা অনুযায়ী লিঙ্গপরিচয় প্রশ্নে আমাদের কারও কোনো মতামত থাকে না।

অন্য নারীদের সাথে নিজের মিল ও অমিলগুলোর মুখোমুখি হওয়া আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অনন্যতাকে অগ্রাহ্য না করা, আবার আমাদের নিপীড়নগুলোর স্তরীকরণ না করে ফেলাটাও আমাদের জন্য জরুরি। রূপান্তরকামী মানুষেরা যে নির্দিষ্ট প্রকার জুলুমের শিকার হন তার স্বরূপ উদঘাটনের মধ্য দিয়ে আমরা এই নিপীড়নগুলোর সাথে বোঝাপড়া শুরু করতে পারবো। আর তা কেবল তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং আমরা মোকাবেলায় “ঝাঁপিয়ে পড়বো”— শেরি মোরাগার বর্ণনা অনুযায়ী— “আমাদের নিজস্ব জুলুমের একেবারে গোড়ার সাথে। আমাদের মধ্যকার এবং বাইরের শত্রুদেরকে চিহ্নিত না করা পর্যন্ত নিপীড়িতদের মাঝে প্রকৃত, ক্রমকর্তৃত্বশূন্য যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব নয়।”

রূপান্তরকামিতা: পরিচয় ও ক্ষমতার সীমারেখা

নারীপুরুষ বাইনারির ভেতর যারা নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেন না, তারা সকলেই আমাদের দলে। চিকিৎসা শাস্ত্রে একে “রূপান্তরকামিতা” কিংবা “জেন্ডার ডিসফোরিয়া” হিসেবে আখ্যা দেওয়া খুব বেশি আগের ঘটনা নয়। রূপান্তরকামিদের সংজ্ঞায়িত করা হয় মূলত এমন মানুষ হিসেবে, দীর্ঘকালব্যাপী যারা বিবিধ বেমানান লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য নিজেদের ভেতর ধারণ করে আসছেন। যৌনতা বিষয়ে এই লঘু ধারণায়নের ফলে যেসব রূপান্তরকামীরা মানসিক ও শারীরিক সেবাদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তা নিতেন (এবং তা নেওয়ার সামর্থ্য রাখতেন), তাদের লৈঙ্গিক পরিচয় নির্ধারিত হতো আলফ্রেড কিনসের যৌনতাপরিমাপক মডেল অনুযায়ী। তারপর সেই পরিচয় বাস্তবায়নে কী কী করতে হবে, সেই বিষয়ে তাদের নির্দেশনাও দেওয়া হতো। বলা বাহুল্য, চিকিৎসা “বিশেষজ্ঞদের” প্রণীত এসব বিকল্প পথগুলোও যথেষ্ট রক্ষণশীল ছিল। আরোপিত বিষমকামিতা থেকে শুরু করে পোশাকআশাক ও আচরণের শক্ত মাপকাঠি বেঁধে দেওয়া সবই এরমধ্যে পড়তো। ১৯৭৩ সাল পর্যন্তও যেখানে সমকামিতাকে মানসিক ব্যাধি হিসেবে দেখা হতো, যেখানে মনরোগ শাস্ত্র এখনও রূপান্তরকামিতাকে এই চোখে দেখে, সেখানে তাঁদের সবচেয়ে ঐকান্তিক সহায়তাগুলোকেও আমরা যথেষ্ট সংশয় নিয়েই বিবেচনা করবো।

লিঙ্গ পরিচয় কেবল মানুষের মনস্তাত্বিক অবস্থাই নয়, এটি একটি রাজনৈতিক অবস্থানও বটে। রূপান্তরকামিতাকে আমি স্বাধীনতারই ভাষা হিসেবে দেখি, যা আমাকে অন্যান্য সকল দলিত লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের সাথে একাত্ব হয়ে মুক্তির একটি সর্বজনীন ভাষা তৈরির প্রেরণা দেয়। এই পরিচয় বুলড্যাগার, ট্র্যান্সভেসটাইট, ড্র্যাগ কিং, ড্র্যাগ কুইন, ফেম, জেন্ডারফাকস, উভলিঙ্গ কিংবা যারা কোনো নির্দিষ্ট বিভাজনের মধ্যে থাকতে অস্বীকার করেন— তাদের সকলকেই রূপান্তরকামিদের সাথে ঐক্যবদ্ধ করে। যদিও এসব গোষ্ঠীগুলোতে এই অবস্থানের বহুল প্রচলন নেই।

নারীমুক্তি: কেমনতর বিপ্লব?

১৯৬০এর শেষভাগে নাগরিক অধিকার ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গ উঠে আসে। নারীরা তাদের সাথে ঘটা নিপীড়নের স্বরূপ উপলব্ধি করতে শুরু করেন, এবং এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে ইচ্ছুক দলগুলোতে কীভাবে এসব নির্যাতন ঘটে, তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে শুরু করেন। বিবিধ বৈপ্লবিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া প্রথম দিককার এই আমূলপরিবর্তনকামী নারীবাদিদের মধ্যে পুঁজিবাদ বিরোধিতার একটি প্রবণতা ছিল। নারীমুক্তি প্রসঙ্গে বিভিন্ন বৈপ্লবিক চিন্তাধারারও চর্চা করতেন তারা। লৈঙ্গিক পরিচয়কে নীপিড়নের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখা হতো। কেননা এটি মেয়েলিপনা ও মর্দামির কৃত্রিম ভূমিকা নির্মাণ করে, যা আখেরে সমাজে পুরুষাধিপত্যকেই বৈধতা দেয়। পুঁজিবাদ এই পুরুষাধিপত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে, কিন্তু শুধুমাত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছেদই যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন গোষ্ঠীর নারীরা বিবিধ পথের অন্বেষণ করছিলেন। লৈঙ্গিক সারবাদী (essentialist) রাজনীতি এই আন্দোলনের সাথে শুরু থেকেই ছিল, তবে ১৯৭৩ সালের দিক থেকে সাংস্কৃতিক নারীবাদ আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। অ্যালিস ইকোলস যুক্তি দিয়েছিলেন যে, যেহেতু “মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তনের সম্ভবনা দূরবর্তী বলে মনে হয়েছিল” তাই নারীবাদকে “নারীনীতি” হিসেবে পুনঃব্যাখ্যা করা হয়।

স্বাধীনতার এই পথে দৃঢ় পায়ে অগ্রসরমান সেই নারীরা কী উন্মাতাল শক্তির আকরের দেখা পেয়েছিলেন তা আমরা আজ কল্পনাও করতে পারি না। “ভগিনীবোধই (sisterhood) শক্তি” শুধুমাত্র শ্লোগান কিংবা বইয়ের শিরোনামে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং নারীদের প্রতি যুগ যুগ ধরে চলে আসা পদ্ধতিগত জুলুমের যে স্বরূপ হঠাৎ মানুষের সামনে আসে, তারই গণস্বীকৃতি এই বাণী। অনেক আন্দোলনকারীর মতে আন্দোলনের মূলসুরটি ছিল এই যে, নারীদের অভিজ্ঞতাগুলো মূলত একই, পার্থক্যটা কেবল বাইরে থেকে চাপানো। এটা একেবারে যুক্তিহীন কথাও নয়। গোড়ার দিককার এই নারীবাদিদের বেশিরভাগই ছিলেন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত শ্বেতাঙ্গ, বামপন্থী, কলেজ পড়ুয়া নারী। আন্দোলনের পরিসর বাড়তে শুরু করলে বিভিন্ন শ্রেণি ও পরিবেশের নারীরা এসে যুক্ত হতে শুরু করেন। তাদের অনেকে শুধুমাত্র আত্মসহায়তার জন্যই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন, সমাজের আমূল পরিবর্তন তাদের উদ্দেশ্য ছিল না।

যদিও ১৯৬৮ সালের দিকে আন্দোলনটিকে ঐক্যবদ্ধ মনে হয়, ১৯৭০’র মধ্যেই এটি নানান প্রতিদ্বন্দ্বী দলেউপদলে বিস্ফোরিত হতে থাকে। নিক্সনের নির্বাচনের সময়কার তীব্র দলবাজি এবং ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলতার মধ্যে সাংস্কৃতিক নারীবাদের এই পাল্টাসংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক উদারতা নিশ্চয়ই মানুষের কাছে বেশ আশাপ্রদ মনে হয়েছিল।

ক্যাথলিন ব্যারি এবং রবিন মরগ্যানের মতো সাংস্কৃতিক নারীবাদীরা একটি সংঘাতমুক্ত, আপামর ভগিনীবোধের প্রস্তাব করেছিলেন। স্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল নারীত্বের এমন এক অবস্থা হিসেবে যা বর্ণ, শ্রেণি, লিঙ্গ পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্যের ঊর্ধ্বে। নারীবাদী পাল্টাসংস্কৃতিতে, বা এমন কোনো গোষ্ঠী যারা যাপনের হাতিয়ার হিসেবে রাজনৈতিক সংগ্রামে ছাড় দিয়ে আরোপিত একাত্মতা মেনে নিয়েছেন— এমন জায়গায় বিপ্লবের কথা তোলা মানে “পুরুষ প্রভাবিত” হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার ঝুঁকি নেওয়া।

শিল্পী: বেটিনা সেমার

অন্যদিকে, অ্যান স্নিটো, প্যাট পার্কারের মতো আমূলপরিবর্তনকামী নারীবাদীরা ১৯৬৭র দিকেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, নারী নিপীড়নের শিকড় পুঁজিবাদ এবং পুরুষাধিপত্যে প্রোথিত। যৌনতাবাদকে (sexism) একটি মনস্তাত্বিক অবস্থা হিসেবে দেখা হতো, এবং বর্তমান কিংবা অতীতে যতক্ষণ পর্যন্ত পুরুষেরা নারী নিপীড়নের সাথে জড়িত থাকবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এভাবেই এই র‍্যাডিকাল নারীবাদীরা মার্ক্সবাদী এবং বামপন্থীদের চিন্তা প্রণালীর কিছু অংশ গ্রহণ করেছেন, আবার নারীদের প্রতি বৈষম্যের এই বিষয়টিকে বৃহৎ পরিসরে তুলে না ধরায় তাদের সমালোচনাও করেছেন। সাংস্কৃতিক নারীবাদিদের কাছে আবার বামপন্থী এবং পুরুষ সম্পর্কিত সকল কিছুই ছিল রীতিমতো দূষিত। এর ফলে দেখা গেল নারীরা পরস্পরের উপর একেবারে পুলিশি নজরদারি চালিয়ে সম্মিলিতভাবে “মরদতান্ত্রিক” রাজনীতি ও তাদের আলোচিত সমাধানগুলি প্রত্যাখ্যান করছেন।

সাংস্কৃতিক নারীবাদীদের মত হলো নারী ও পুরুষের মধ্যে জন্মগত, অপরিবর্তনীয় পার্থক্য রয়েছে। এবং এর উৎস ঐতিহাসিক, সামাজিক কিংবা জৈবিক যাই হোক না কেন— তাদের মতে— এই পার্থক্যের মর্যাদা রক্ষা করা উচিত। একে সুরক্ষিত এবং সংরক্ষিত রাখা উচিত। সকল পুরুষকেই, বা “মর্দামি”র সকল কিছুকেই নির্বিশেষে নিপীড়ক হিসেবে বিবেচনা করা হতো (এমনকি লিঙ্গবৈষম্যবিরোধীদেরও রক্ষা ছিল না)। বুচ ও ফেম লেসবিয়ান, স্যাডোম্যাসোচিজম ডাইকস, পর্নোগ্রাফিপন্থী নারীবাদী, যৌনকর্মী, ট্রান্সভেস্টাইট, রূপান্তরকামী, বিপ্লববাদী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নারীরাও এর বাইরে ছিল না। জেন অ্যালপার্টের ঘটনাটাও এরকমই।

লৈঙ্গিক সারবাদ (essentialism) : প্রতিক্রিয়াশীল নারীবাদ

১৯৬৯ সালে অ্যালপার্ট যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর সাথে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িত ছিলেন। তার প্রেমিক স্যাম মেলভিলসহ তিন সহযোদ্ধা সমেত ধরা পড়ে যাবার পর অ্যালপার্ট জামিনে বের হয়ে আসেন এবং পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। এর কিছু পরে তিনি ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড অর্গানাইজেশন (ডাব্লুইউও) নামে মূলত শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবীদের একটি দলে যোগ দেন। তার পরপরই তিনি এই দল থেকে সরেও আসেন। এই সময় তিনি তার বহুল পঠিত ও অত্যন্ত প্রভাবশালী নিবন্ধ “মাদার রাইট: এ নিউ ফেমিনিস্ট থিওরি” রচনা করেন। এই লেখাটি সাংস্কৃতিক নারীবাদের আলোচনায় একটি দুর্দান্ত সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।

এই প্রবন্ধে অ্যালপার্ট সমস্ত বামপন্থী বিপ্লবী দলগুলোকে তাদের অন্তর্জাত মর্দামি প্রবণতার জন্য ধিক্কার জানান। তিনি ডাব্লুইউও সংগঠনের ভেতর লিঙ্গবৈষম্যের বিস্তারিত বিবরণ দেন এবং প্রেমিক স্যাম মেলভির সাথে— যিনি ১৯৭১ সালে অ্যাটিকা কারাগারে একটি বিদ্রোহের সময় খুন হন— নিজের ঘনিষ্ঠতার বিশদ বিবরণ দেন। তিনি লেখাটি শেষ করেন এক চূড়ান্ত আহ্বানের মধ্য দিয়ে, “তাই, ওয়েদারম্যানের বোনেরা আমার, অ্যাটিকার জন্য তোমরা প্রস্তুত হও। নিজেদের সংগঠিত করো। সংবাদপত্রে এই নিয়ে কী লেখা হচ্ছে আমি জানতে চাই না। এই মৃত্যু তোমাদের কতটা ব্যথিত করে, তাও আমাকে বলতে এসো না। এই ৪২ জন আধিপত্যবাদির মৃত্যুতে আমি আর শোকগ্রস্ত হবো না।”

এর কিছুকাল পরেই অ্যালপার্ট এফবিআইয়ের কাছে আত্মসমর্পন করেন। এফবিআই সগর্বে ঘোষণা করেছিল যে, অ্যালপার্ট তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে সহযোগিতা করছেন এবং তার আন্ডারগ্রাউন্ডকালীন অভিজ্ঞতাও সবিস্তারে বর্ণনা করছেন। যদিও তিনি আসলে কী তথ্য এফবিআইকে দিয়েছেন তা তর্কসাপেক্ষ বিষয়। অ্যালপার্টের দাবি ছিল এফবিআইয়ের কাছে তিনি কোনো সত্য খবর ফাঁস করেন নাই। যদিও ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে অ্যালপার্টের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্যাট সুইনটনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে, আত্মসংরক্ষণ আইনের আওতায় অ্যালপার্ট আদালতে সুইনটনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ সেসময় জেল থেকে প্রকাশিত পত্রিকা মিডনাইট স্পেশাল “নারী কয়েদিদের সতর্ক করে দিয়েছিল যে, তাদেরই মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতক রয়েছেন।”

জেন অ্যালপার্টের সমর্থনে রবিন মরগ্যান একটি নারীবাদী সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। তারা ডাব্লুইউও’তে “পুরুষ সহিংসতা” খণ্ডানোর ক্ষেত্রে অ্যালপার্টের ভূমিকা নিয়ে সোচ্চার হন এবং কারাভোগের দুই বছর তাকে সহযোগিতা প্রদান করেন। অথচ ওই একই বছরে ঘোষিত সমকামী এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বিপ্লবী সুসান স্যাক্সকে যখন গ্রেপ্তার করা হলো, তখন সমকামী নারীবাদী গোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যই দলের ভেতর এফবিআইয়ের ছোঁকছোঁকানির দায় চাপান তার উপরই। তারা বলতেন, “কারও উপর ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগ আসলেই সে সমকামী হয়ে যায় না।” অবশেষে প্রাক্তন ডাব্লুইউও নেতা অ্যালেন ফ্র্যাঙ্কফোর্ট ক্যাথি বুদিন এন্ড দ্য ড্যান্স অব ডেথ বইয়ে এক চাঞ্চল্যকর বিবরণীতে এই নারীদের কথা লেখেন। যৌন সম্পর্কের মধ্যে ক্ষমতার চর্চাকে অবলুপ্ত করতে না পারার অক্ষমতা, এবং সমাজে মাতৃত্বের ভূমিকা ও ক্যাথি বুদিনের মায়ের প্রশান্তিবাদকে প্রত্যাখ্যানের সাথে সশস্ত্র সংগ্রামে এই নারীদের ভূমিকার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন ফ্র্যাঙ্কফোর্ট।

সশস্ত্র সংগ্রাম নিয়ে গবেষণা করার সময় এর ভেতরকার সম্ভাব্য হঠকারী অ্যাডভেঞ্চার, নাস্তিবাদ কিংবা ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়াশীলতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে এগোনোই ভালো। ডাব্লুইউওর ইতিহাসে পুরুষালি চালচলনের প্রবণতা তো কিংবদন্তির মতো। যদিও সাংস্কৃতিক নারীবাদীরা মানুষ ও মনুষ্য আচরণকে কেবল পুরুষালি ও মেয়েলি ছাঁচে বিভক্ত করতেই আগ্রহী বলে মনে হয়। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তাদেরকে কখনো প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় না।

পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হওয়া ট্র্যান্সসেক্সচুয়ালদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহানুভূতির জায়গায় পৌঁছাতেও সাংস্কৃতিক নারীবাদিদের এখনো অনেক পথ যেতে হবে। রূপান্তরকামিতার ধারণাটা তাদের কাছে বেশ অস্বস্তির, কেননা এটা স্পষ্ট দেখিয়ে দেয় যৌনতা পরিবর্তনশীল। জেনিস রেমন্ডের বই দ্য ট্র্যান্সসেক্সচুয়াল এমপায়ারএ তিনি রূপান্তরকামিদের সমালোচনা করেছেন। “নারীদের জীবতত্ত্ব দখল করে বসে আছে,” যদিও তারা কখনোই সম্পূর্ণ নারী হতে পারবে না। রেমন্ডের মতে রূপান্তরকামীরা আসলে “নারীদেরকে ধর্ষণ করে”, বিশেষত সমকামী ট্র্যান্সসেক্সচুয়ালরা, যারা অন্যান্য সমকামী নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তার মতে এটা “বিপরীতকামিতার উচ্ছিষ্ট।”

গাইন/ইকোলজি বইতে ম্যারি ডেলি বলেন, রূপান্তরকামীরা আসলে নারী সম্প্রদায়কে নির্মূল করতে চান। তিনি লেখেন, “তাদের উপস্থিতি নারীদের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ, এবং তা আমাদের ভেতরকার বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে দেয়।” এসব প্রচ্ছন্ন ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলো অতটাও বিরক্তিকর লাগতো না, যদি সেগুলো এত বিরাট পরিসরে গ্রহণযোগ্যতা না পেত। “পুরুষচিহ্নিত” সবকিছুর প্রতিই রবিন মরগ্যানের প্রাক্তন সম্পাদকের আক্রমণ থেকে শুরু করে মিশিগান উইমেন্স ফেস্টিভ্যালে “শুধুমাত্র জন্মগতভাবে নারীদের জন্য” প্রযোজ্যতার ঢালাও নীতি কিংবা ব্র্যান্ডন টিনা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নারীবাদিদের প্রেস কভারেজ— লিঙ্গআতঙ্ক আমাদের মাঝে জেঁকে বসে আছে। তীব্রভাবেই আছে।

শিল্পী: বেটিনা সেমার

ব্র্যান্ডন টিনা: অস্বীকৃতির নজির

ব্র্যান্ডন টিনা ছিলেন একজন রূপান্তরকামী পুরুষ। তার আদি নাম ছিল টিনা ব্র্যান্ডন। ছোটোবেলাতেই তিনি গৃহত্যাগ করেন এবং নেব্রাস্কার বৃহত্তর শহর ফলস সিটিতে আশ্রয় নেন। এখানে তিনি একজন পুরুষ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন এবং বিষমকামী সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। লানা টিসডেল নামক এক নারীর সাথে তার গভীর প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল। এসময় ব্র্যান্ডন খুচরা চুরিছিনতাই এবং জাল চেক লেখার কাজে জড়িয়ে পড়েন। জালিয়াতির অভিযোগে পুলিশের কাছে ধরা পড়বার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তার জন্মপরিচয়টি স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেয়া হয়। তার পরপরই, ১৯৯৩ সালের ক্রিসমাসের আগেরদিন, লানার প্রাক্তন প্রেমিক ও তার বন্ধু মিলে ব্র্যান্ডনকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করে। পুলিশকে ব্র‍্যান্ডন এই ঘটনার কথা জানালেও তারা কিছুই করেনি। এর এক সপ্তাহ পর নববর্ষের প্রাক্কালে ওই দুই ব্যক্তিই ব্র্যান্ডনকে কুপিয়ে জখম করে এবং গুলি করে হত্যা করে। মূলধারা এবং বিভিন্ন বিপ্লববাদী সংবাদমাধ্যমগুলোতে বারবার ব্র্যান্ডনকে একজন নারী হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছিল— একজন প্রতারক, এবং আত্মঘৃণিত সমকামী নারী।

দ্য ভিলেজ ভয়েজএ প্রকাশিত ডোনা মিনকোভিচের “লাভ হার্টস” প্রবন্ধের ঘটনাটাও এই। মিনকোভিচ যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, ব্র্যান্ডন ছিলেন একজন আত্মঘৃণিত সমকামী নারী, যিনি কেবল প্রয়োজনের খাতিরেই নিজেকে পুরুষ পরিচয়ে আবৃত রেখেছিলেন। ব্র্যান্ডন যে নিজেকে একজন পুরুষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতেন এবং নিজের লিঙ্গপরিবর্তন চাইতেন, মিনকোভিচের কাছে তা কেবল “আত্ম প্রবঞ্চনা”। “প্রকৃত নারীদের” অভিজ্ঞতাগুলোকে ধাতবাদী কায়দায় তুলে ধরার যে দর্শন মিনকোভিচ লালন করেন, তার বাইরে এই কথার মধ্যে আর কোনো সার নেই। তিনি যে আদৌ কোনো রূপান্তরকামিকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, কিংবা আমাদের ইতিহাসটাকে জানার পেছনে ন্যূনতম সময়ও ব্যয় করেননি— সেটাও তার এই আচরণের অন্যতম কারণ হতে পারে।

প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর একজন রূপান্তরকামী নারী দ্য ভয়েজ পত্রিকায় লিখেছিলেন, মিনকোভিচ ব্র্যান্ডনকে সম্বোধনকালে পুরুষবাচক সর্বনাম ব্যবহার করেননি এবং তাকে তার সত্যিকারের পরিচয় থেকে বঞ্চিত করেছেন। ব্র্যান্ডনকে একজন প্রকৃত রূপান্তরকামী হিসেবে উল্লেখ করে তিনি লেখাটি শেষ করেন। জবাবে মিনকোভিচ বলেছিলেন যে এই জাতীয় কোনো লৈঙ্গিক শ্রেণিবিভাগে তিনি বিশ্বাস করেন না। এবং রূপান্তরকামিদের অভিমতকে মানুষের অবশ্যই সম্মান জানানো উচিত কিন্তু প্রকৃত রূপান্তরকামী বলে আসলে কিছু নেই। মজার ব্যাপার হলো, তার অন্যান্য প্রবন্ধে মিনকোভিচ লিখেছেন, আবশ্যিক কোনো লিঙ্গপরিচয় হয় না বলেই তিনি নিজেকে একজন সমকামী নারী হিসেবে বেছে নিয়েছেন। অথচ, এই একই যুক্তিতেই কি তিনি ব্র্যান্ডনের সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করতে এবং সম্মান জানাতে পারেন না? আমি ব্র্যান্ডনকে একজন রূপান্তরকামী পুরুষ হিসেবে দেখি কোনো এজেন্ডা পূরণের উদ্দেশ্য থেকে নয়, বরং তিনি কীভাবে তার জীবন যাপন করেছেন এবং কীভাবে তিনি নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতেন— তার ভিত্তিতে। দ্য ভিলেজ ভয়েজ এক অতি প্রচলিত নিদর্শনেরই পুনরাবৃত্তি করল কেবল। যেহেতু সাপ্তাহিকটি ঘোষিতভাবেই ক্যুইয়ারপন্থী, তাদের বিবেচনায় ক্যুইয়ার মানে আবার কেবল সমকামী নারীপুরুষ; উভকামী কিংবা রূপান্তরকামী নয়। তাছাড়া দ্য ভয়েজ গত তিন বছরে এই সম্প্রতি একজন রূপান্তরকামী মানুষের নিবন্ধ প্রকাশ করল।

মিনেস ইন মিশিগান বইয়ে রিকি অ্যান উইলচিন্স এবছরের আগস্টের মিশিগান উইমেন্স ফেস্টিভাল নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। এই বছর পর্যন্তও অনুষ্ঠানটিতে “শুধুমাত্র জন্মগতভাবে নারীদের জন্য” প্রযোজ্যতার স্থায়ী নীতি ছিল, যা আনুষ্ঠানিকভাবে রূপান্তরকামী সম্প্রদায়কে বঞ্চিত করে। নীতিটি পুনর্বিবেচনা করার কোনো কথাও এখনো ওঠেনি। উইলচিন্সের বর্ণনায় জানা যায় অনুষ্ঠানটির শুধুমাত্র একটা পর্বে রূপান্তরকামীরা ঢুকতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেসময় তারা হর্ষধ্বনি, কটুক্তি এমনকি হুমকিরও শিকার হন। অনুষ্ঠানটি ভবিষ্যতেও এই রীতি চালিয়ে যাবে কিনা তা অনিশ্চিত। কিন্তু এই ক্ষুদ্র সাফল্যের ফলে রূপান্তরকামিদের আন্দোলন সমাজে বড় পরিসরে লিঙ্গপরিচয়ের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার বদলে সমকামী সম্প্রদায়ে নিজেদের অবস্থান জোড়ালো করবার দিকেই মোড় নেয় কিনা, তা নিয়ে মনে সন্দেহ জাগে।

আর দ্য ভিলেজ ভয়েজএর ক্ষেত্রে— এই নিবন্ধটি রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের প্রতি পত্রিকাটির নীরবতা এবং সূক্ষ্ম আক্রমণের ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারে না। এই পত্রিকার একটি বিশেষ সংস্করণে দু’জন স্বীকৃত নারীবাদী সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্ব সিনেমায় উপস্থিত সমকামভীতি নিয়ে আলোচনা করেন। সিনেমাটিতে একজন রূপান্তরকামী চরিত্রকে স্রেফ মেরে ফেলার ভেতর তারা আপত্তিকর কিছুই পেলেন না, অথচ এখানে জোডি ফস্টারের এফবিআই এজেন্ট চিত্রায়ণের মতো দৃঢ় নারীবাদী বার্তা আছে। মনিকা টট নামক একজন সমকামী নারীবাদী নির্মিত জার্মান প্রামাণ্যচিত্র “ফিমেল বিহেভিয়ার”এর উপর এক নারীর একটি পর্যালোচনা ছেপেছিল দ্য ভয়েজ পত্রিকা। লেখক সেই লেখায় প্রামাণ্যচিত্রটির রূপান্তরকামী এক পুরুষকে রীতিমতো আক্রমণ করে বসলেন, তার “নারীত্বকে” অস্বীকার করবার জন্য। আমার বিশ্বাস, এই ছোটো ছোটো উদাহরণগুলোই সমকামী সম্প্রদায়ে রূপান্তরকামভীতির একটি বৃহত্তর চিত্র তুলে ধরে।

নিউইয়র্কে স্টোনওয়াল ২৫ উপলক্ষে যখন ক্যুইয়ার সম্প্রদায় একত্রিত হলো, তখন আবারও রূপান্তরকামিদেরকে চিয়ারলিডারের আসনে ন্যস্ত করা হলো। মাঝেমধ্যে কিঞ্চিৎ হাস্যরসের সঙ্গী হিসেবে আমরা ভালো, তবে ২৬শে জুন ইউনাইটেড নেশনে পেশ করা দাবিদাওয়ার অংশ হওয়ার যোগ্য ঠিক নই আমরা। এটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে ক্যুইয়াররা আর মানুষের যৌনস্বাধীনতা নিয়ে লড়াই করছেন না, বরং অন্য সকলকে বাদ দিয়ে একটি ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠীর মানুষের নাগরিক অধিকার রক্ষার লড়াই করছেন তারা।

আমরা এককভাবে লড়ে যাই

রূপান্তরকামী মানুষের চেহারায় এক ধরনের অস্পষ্টতার কারণে আমরা কটুক্তিকারিদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হই। লৈঙ্গিক গোঁড়ামি দ্বারা পরিচালিত একটা সমাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে এসব কটুক্তি উপেক্ষা করে যাওয়াটা প্রায়শই দরকারি, ক্ষেত্রবিশেষে বাঞ্ছনীয়। এর মাধ্যমে আমরা এক প্রচ্ছন্ন অদৃষ্টকে স্বীকার করে নেই। এই উপেক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা আসলে আমাদের ইতিহাসকেই প্রত্যাখ্যান করি। পরিপাটি, মেরুপ্রবণ লিঙ্গভূমিকার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত একটা সিস্টেমকে আমরা আরও শক্তিশালী করে তুলতে থাকি। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, দলিত লিঙ্গ পরিচয়ের একজন মানুষের জন্য একটা কাজ পাওয়া অনেক কঠিন। আর চাকরি পেতে হলে যদি প্রচলিত লিঙ্গের মানুষের মতো চলাফেরা করতে হয়, কাপড় পরতে হয়— তবে তা আদতে জান বাঁচানোরই তাগিদ। লিঙ্গ পরিচয়ের স্বাধীনতার কথা বলে এমন যেকোনো তত্ত্বেরই ভিত্তি হতে হবে এসব মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রাম। এছাড়া, বিপ্লববাদী সংঘগুলো থেকে পর্যাপ্ত আনুকূল্যের অভাবে রূপান্তরকামিদেরকে আসলে একাই লড়াই চালিয়ে যেতে হয়— এমনকি বৃহত্তর সমকামী সম্প্রদায়ের সহায়তাও অতি নগণ্য।

শিল্পী: বেটিনা সেমার

লিঙ্গ বিপ্লব: কর্তৃত্ববিরোধী ও দলিত লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষেরা যেভাবে পরস্পরকে শক্তি যোগাতে পারে

যেকোনো নিপীড়নের সবচেয়ে নির্মম দিকটি হলো, এটি আমাদেরকে নিজেদেরকে ঘৃণা করতে শেখায়। এই অভ্যন্তরীণ নিপীড়নের সাথে বোঝাপড়া করাটাই অনেক সময় সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে প্রগতিশীল বন্ধুবর্গে মেশবার সময় যখন লক্ষ্য করি যে আমি অন্যান্য রূপান্তরকামী মানুষদের থেকে নিজেকে একটু দূরে দূরে রাখতে চাচ্ছি, তখন প্রচণ্ড খারাপ লাগে। ড্র্যাগ কুইনদের খেলো রসবোধকে হয়তো আমি অরাজনৈতিক হিসেবে তাচ্ছিল্য করবো। কিংবা কোনো রূপান্তরকামী মানুষের সাজসজ্জার বাড়াবাড়ি নিয়ে হয়তো একটা মন্তব্য করে বসবো, যেন সেই মানুষটার “অধিকতর নারীসুলভ” এই উপস্থিতিতে আমি মনে মনে একটুও ঈর্ষান্বিত নই। অথবা আমি তাদেরকে স্রেফ এড়িয়ে যাবো কারণ মাঝে মাঝে আমার ভান করতে ইচ্ছে হয় যেন আমি তাদের কেউ নই।

একই সাথে, প্রগতিশীল মানুষেরা লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবাদ কিংবা সমকামভীতির মতো বিষয়গুলোর সাথে তাত্ত্বিক দিক থেকে বোঝাপড়া করেছেন বলেই যে তারা কুসংস্কার মুক্ত বা সর্বদা সহানুভূতিশীল থাকেন, সেটাও তাদের ধরে নেওয়া উচিত নয়। আমি অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্লান্ত বোধ করি যখন তারা জানান আমি “সমকামিদের জন্য নিরাপদ” স্থানে আছি, আর তারপর মানুষের লৈঙ্গিক পার্থক্য নিয়ে স্থূল রসিকতা করতে থাকেন অথবা রূপান্তরকামীরা কেন আদৌ নিপীড়িত নয় তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন!

রূপান্তরকামী আন্দোলন তার প্রারম্ভিক পর্যায়ে আছে মাত্র। একারণেই, কর্তৃত্ববিরোধিরা এই দলিত লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদের সাথে সম্ভাব্য দোস্তি পাকাতে পারেন। আমরা উভয়ই এই কর্তৃত্ববাদী কাঠামোর আমূল পরিবর্তন চাই। রূপান্তরকামী আন্দোলনকে খোদ নিপীড়নের ধারণাটা নিয়েই আরও বৃহৎ পরিসরে পর্যালোচনা করতে হবে। একইসাথে, যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের উপর এই নিপীড়ন চালায় তাদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। রূপান্তরকামিদের জন্য একটা “মুক্তাঞ্চল” অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এই মুক্তির কোনো মূল্যই থাকবে না, যদি না আমরা বৃহত্তর সমাজকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।

রূপান্তরকামী সম্প্রদায় প্রকৃতি প্রদত্তভাবে বিপ্লববাদী কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল নয়। অন্যান্য যেকোনো সামাজিক গোষ্ঠীর মতনই আমরাও বিবিধ জাতিসত্তা, লিঙ্গ পরিচয়, শ্রেণি ও রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে এসেছি। একটি লিঙ্গীয় বিপ্লব তখনই অর্থবহ হয়ে ওঠবে, যখন তা সত্যিকার অর্থে প্রত্যেক মানুষের ক্ষমতায়ন ঘটাবে। যেকোনো বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ হলো কোনো পূর্বানুমান ছাড়াই নিপীড়িত সম্প্রদায়ের কথা শোনা। প্রশ্ন এবং সমালোচনাও এর একটি অংশ। যদিও তা যেন কোনোভাবেই প্রয়োজনীয় আলোচনার পরিসরকে সংকুচিত না করে ফেলে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।

লিঙ্গীয় ক্রমকর্তৃত্বে ভরা এই গোঁড়া, অনড় সমাজের কোন স্তরে আমরা আছি, এবং আমাদের পরিচয়ের শক্তিমত্তারই বা কী স্বরূপ— তার ভিত্তিতেই মূলত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী নির্ধারিত হয়ে থাকে। ১৯৭০এর দশকে নারীবাদীরা (মধ্যবিত্ত, কলেজ পড়ুয়া, শ্বেতাঙ্গ নারী) তাদের আন্দোলন থেকে বুচ এবং ফেমদেরকে প্রায় দশ বছরের জন্য বহিষ্কৃত করেছিল তাদের “পুরুষপ্রভাবিত” লিঙ্গ ভূমিকার কারণে। এই জাতীয় ভুল আমরা আর না করি। লিঙ্গীয় স্বাধীনতা সকলেরই কাম্য। কিন্তু, এই স্বাধীনতার অর্থটা কী, তা নির্ধারণে আমাদের সকলের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। কোনো দুর্বোধ্য, পূর্বনির্ধারিত তত্ত্ব থেকে নয়, বরং সত্যিকারের মানুষের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে মূর্ত হয়ে ওঠবে এই স্বাধীনতা। আমার বিশ্বাস এর মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাবো, নির্ধারিত লিঙ্গভূমিকার ধারণাকে অনেকেই স্বস্তিদায়ক মনে করেন, আবার এর মাধ্যমেই অনেকে গুরুতরভাবে নিপীড়িত হন। স্বাধীনতা অর্জনে আমরা যে পথই গ্রহণ করি না কেন, আমাদেরকে সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার প্রতি সৎ থাকতে হবে। শাস্তি কিংবা সত্যিকার সহিংসতা ব্যতীত কীভাবে এই সম্প্রদায়গুলো পারস্পারিক বৈপরীত্য ও বৈরী চাহিদার সাথে সমঝোতা করতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে৷ এখনো আমাদের অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া বাকি। আমাদের সমষ্টিগত শক্তি এবং দুর্বলতাগুলোর মাঝেই আমাদের ক্ষমতার স্বরূপ নিহিত রয়েছে।

অনুবাদকের নোট: ক্যুইয়ার শব্দটির অর্থ বিচিত্র/অদ্ভুত। নিপীড়িত বিভিন্ন যৌন ও লিঙ্গ পরিচয় বোঝাতে বৃহদার্থে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে, সমকামিতা বোঝাতে ‘ক্যুইয়ার’ নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হতো, যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে এলজিবিটির(LGBT) বদলে আরও অন্তর্ভূক্তিমূলক শব্দ হিসেবে ‘ক্যুইয়ারের’ নেতিবাচকতাকে পরাভূত করে আন্দোলনকারীরা রাজনৈতিকভাবে এর ব্যবহার শুরু করে।

জুডিথ বাটলারের তাত্ত্বিকভাবে বায়োলজিক্যাল সেক্সের ধারণা আর সামাজিক জেন্ডারের ধারণার ফারাক মোচন/সংকোচন, ক্যুইয়ার থিয়োরি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এটা তত্ত্ব হিসেবে দাঁড়িয়েছে বাটলারসহ অন্যান্য তাত্ত্বিক ও দার্শনিকদের কাজের ভিত্তিতে। বাটলারের শরীরের ধারণা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

অধরা শ্রেয়সী অথই

অধরা শ্রেয়সী অথই পড়াশোনা করছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। উপল-এর একজন সংগঠক। অনুবাদক। ক্রিপ্টোগ্রাফির সোসিওলজি নিয়ে তার আগ্রহ আছে।