অরাজ
আর্টওয়ার্ক: দ্য ডেমাগগ শিল্পী: ওরোজোকো সূত্র: উইকিপিডিয়া
প্রচ্ছদ » মিখাইল বাকুনিন।। ক্ষমতা ও পচন

মিখাইল বাকুনিন।। ক্ষমতা ও পচন

অনুবাদ : তানভীর আকন্দ

প্রবহমান রচনাটি মিখাইল বাকুনিনের Federalism, Socialism, Anti-Theologim রচনার কয়েকটি অনুচ্ছেদ মাত্র। ১৮৬৭ সালে লিগ অব পিস অ্যান্ড ফ্রিডমের জেনাভা কংগ্রেসে বাকুনিন এই শিরোনামে দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। তাঁর বক্তৃতার টেক্সটটির অনেকখানি হয়তো ধ্বংসপ্রাপ্ত, নয়তো হারিয়ে গেছে। বাকুনিন এটি বক্তৃতার ঢঙেই রচনা করেন। এর তিনটি অংশ ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয়াংশ FederalismSocialism বিষয়ে। কিন্তু তৃতাংশ Anti-Theologim অংশটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই অংশটি থেকে শুধু  Rousseau’s Theory Of  The State অংশটি অক্ষত ছিল। স্যাম ডলগফ ১৯৭১ সালে বাকুনিনের এই রচনাটি ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং তা তাঁর Bakunin And Anarchy গ্রন্থে স্থান পায়। Rousseau’s Theory Of  The State অংশেরই কয়েকটি অনুচ্ছেদ Power Corrupts The best শিরোনামে ১৯৮০ দশকে লিফলেট আকারে প্রকাশিত হয়। ধারণা করা হয়, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ লর্ড এক্টনের Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely এই উক্তি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই শিরোনামটির আর্বিভাব। বাকুনিন রচনা সম্পাদনাকারী স্বনামধন্য গাই এ অলড্রিন, জি পি ম্যাক্সিমফ বা স্যাম ডলগফ কেউই তাদের গ্রন্থে Power Corrupts The best উপশিরোনাম যুক্ত করেননি। Rousseau’s Theory Of  The State এর অংশ হিসেবে মূল রচনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অরাজ সংস্করণে ক্ষমতা ও পচন শিরোনামে এটি প্রকাশ করা হল।–সম্পাদক

মিখাইল বাকুনিন

রাষ্ট্র আদতে শাসন ও শোষণের নিয়মতান্ত্রিকতা ও নিয়মিতকরণ ছাড়া আর কিছু না। আমরা যাচাই করে দেখানোর চেষ্টা করবো যে, গুটিকতক লোক দ্বারা শাসিত জনগণের সরকারের পরিনাম আসলে কি! এক্ষেত্রে প্রথমেই আমরা বিবেচনা করব, স্বাধীন চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত কোন আদর্শ রাষ্ট্রের বুদ্ধিদীপ্ত ও নিষ্ঠাবান সরকারকে, যেমনটি আপনি চান ।

ধরা যাক, সর্বোৎকৃষ্ট নাগরিকদের নিয়েই সরকার গঠিত হলো। প্রথমে এই নাগরিকগণ অধিকারের দিক থেকে নয় বরং বাস্তবতার বিবেচনায় বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। জনগণের দ্বারাই তারা নির্বাচিত হবেন; কারণ তারা বুদ্ধিমান, চতুর, জ্ঞানী, সাহসী এবং নিষ্ঠাবান। সম-অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিকগণের মাঝ থেকে বেছে নেয়া এই মানুষগুলো আলাদা কোনো শ্রেণি প্রতিষ্ঠা করবে না প্রথমে বরং তারা হবে কিছু মানুষের সমষ্টি যারা চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে অগ্রাধিকারী বলে গণ্য হবেন, এবং এই কারণে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার জন্য বেছে নেয়া হবে এদের। তাদের সংখ্যাটাও অবশ্যই সীমিত থাকবে। কারণ, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, সবসময়ই সবদেশে অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন যে সমস্ত মানুষ দেখা যায়, যারা স্বভাবতই কোনো জাতির সর্বসম্মত শ্রদ্ধা অর্জন করেন, তাদের সংখ্যাটা অতি ক্ষুদ্র হয়। অতএব, ভুল সিদ্ধান্তগ্রহণের যন্ত্রণা মেনে নিয়েই, জনগণ সবসময়ই বাধ্য হবে এদের মধ্য থেকেই শাসক নির্বাচিত করতে।

তখনো একে পৃথক দুটি শ্রেণি যদি নাও বলি,  তবুও সমাজ এখানে দুইভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, যার একটি ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিপুল সংখ্যক নাগরিক নিয়ে তৈরি, অকুণ্ঠচিত্তে যারা তাদের নির্বাচিত নেতাদের নিয়ে গঠিত সরকারের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। আর অপরপক্ষ, যারা কিনা জনগণের স্বীকৃতি ও রায় পেয়ে ক্ষুদ্র সংখ্যাক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মানুষদের দ্বারা গঠিত, জনগণকে শাসন করার জন্য তারা নিয়োজিত হয়। গণনির্বাচনের ওপর নির্ভর করে প্রথমে এদেরকে জনগণের থেকে আলাদা করা হয় তাদের বিশেষ গুণাবলী দেখে, যেই গুণাবলীর কারণে জনগণের পছন্দ-অপছন্দের বিষয় হয়ে ওঠেন তারা, এবং তারা স্বাভাবিকভাবেই যে কারও চেয়ে অনেক বেশি নিষ্ঠাবান ও প্রয়োজনীয় হিশেবে বিবেচিত হন। তখনো তারা নিজেদের কোনো অগ্রাধিকার আদায় করে নেন না, কোনো বিশেষ অধিকারও আদায় করেন না, কেবল জনগণের ইচ্ছা আনুসারে যেই বিশেষ কর্তব্য তাদের প্রদান করা হয়েছে সেটার চর্চা ছাড়া। আর বাকিদের ক্ষেত্রে, তাদের জীবনাচরণের জন্যই এবং তাদের অস্তিত্বরক্ষার শর্ত ও উপায়ের কারণেই নিজেদেরকে তারা অন্যদের থেকে পৃথক করে নেন না কোনোভাবেই, যাতে করে একটা নিপুণ সাম্য সবার মধ্যে বজায় থাকে। এই সাম্য কি বেশিদিন রক্ষা করা সম্ভব? আমরা বলব যে সম্ভব নয়, এবং এটা প্রমাণ করে দেখানোর চেয়ে সহজ বিষয় আর কিছুই হতে পারে না।

মানুষের ‘ব্যক্তিগত নৈতিকতাবোধ’ ও ‘হুকুমপ্রদানের অভ্যাসের’ মতো ভয়াবহ কিছু আর নেই। সবচাইতে সেরা মানুষটাও— সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান, নির্লিপ্ত, উদার এবং শুদ্ধ মানুষটাও এই ক্ষেত্রে এসে যে কোনো সময়েই অধপতিত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ক্ষমতার মাঝে দুটি স্বভাবসিদ্ধ প্রবণতা থাকে যার কারণে এই নৈতিকস্খলন অবধারিত। আর এই দুটি প্রবণতা হচ্ছে, সাধারণ জনগণের প্রতি অবজ্ঞা ও নিজের যোগ্যতার অতিমূল্যায়ণ করা। তার মনে হতে থাকে, “জনতা তার নিজের শাসনের ভার নিজে নিতে পারে না বলেই আমাকে নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর এর মাধ্যমে তারা প্রকাশ্যে নিজেদের হীনতা ও আমার উৎকৃষ্টতা ঘোষণা করেছে। এই জনতার ভিড়ে আমার সমকক্ষ কোনো লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর, সুতরাং আমি একাই এই জনসাধারণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখি। এই জনগণের আমাকে দরকার, আমার সেবা ছাড়া এরা কিছুই করতে পারবে না, কিন্তু আমার একার পক্ষেই বেশ ভালোভাবেই সফলকাম হওয়া সম্ভব। সুতরাং নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই আমাকে মেনে চলতে হবে তাদের, এবং তাদের কথা শুনে চলার ক্ষেত্রে তাচ্ছিল্য দেখিয়ে বরং তাদের উপকারই করছি আমি।”

এর মধ্যেই কি মানুষের মাথা এবং তার অন্তর খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণ নিহত থাকে না? এবং এই  আত্মঅহঙ্কার তাকে পাগল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়? আর এইভাবে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও নিষ্পাপ মানুষটার ক্ষেত্রেও তার বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক স্খলনের উৎস হয়ে ওঠে ক্ষমতা এবং হুকুম করার অভ্যাস।

তানভীর আকন্দ