- ইরফানুর রহমান রাফিন
মিসেস গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো আমেরিকা সফরে যান, তখন লাইফ ম্যাগাজিন তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেয়। তাতে তিনি বলেন, তাঁকে কেউ মাদাম প্রাইম মিনিস্টার বলে সম্বোধন করছে, এটা তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না। প্রেসিডেন্ট জনসন লাইফ ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকারটি পড়ে যখন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সেই ক্ষেত্রে ইন্দিরা কীভাবে সম্বোধিত হতে পছন্দ করবেন; রাষ্ট্রদূত মারফত ইন্দিরা জবাব পাঠিয়েছিলেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী’।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/Indira-Gandhi-painting-by-Swayam-Mane.jpg)
(১৯১৭-১৯৮৪)
শিল্পী: স্বয়াম মানে
সূত্র: ইন্ডি আর্ট
কিন্তু তিনি এখানেই কথা শেষ করেন নাই। তিনি আরো বলেছিলেন, প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দিয়েন, আমার মন্ত্রীসভার সব সদস্য আমাকে স্যার ডাকে। চাইলে প্রেসিডেন্ট জনসনও আমাকে স্যার ডাকতে পারেন।
ইন্দিরা জৈবিক অর্থে নারী ছিলেন, বলাই বাহুল্য। কিন্তু সামাজিক নারীত্ব নিয়ে তাঁর দ্বিধা ছিলো। তাই তিনি সামাজিক অর্থে পুরুষ হতে চাইতেন, তাই তিনি মাদাম সম্বোধনকে আপত্তিকর ভাবতেন, তাই তিনি তাঁর মন্ত্রীরা যে তাঁকে স্যার ডাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে গৌরব বোধ করতেন।
কেনো ইন্দিরার কাছে সামাজিক নারীত্ব গ্রহণঅযোগ্য ছিলো? কারণ তিনি জানতেন, সমাজে ক্ষমতা সম্পর্কের জায়গায়, নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাহীন অবস্থানে আছে। এটা কোনো পুরুষের ব্যক্তিগতভাবে খারাপ হওয়ার কারণে ঘটেনি, এটা ঘটেছে প্রায় তেরোহাজার বছর বয়সী পিতৃতান্ত্রিক সমাজবিন্যাসের কারণে!
সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষ ইন্দিরার জন্মশতবার্ষিকীতে ইন্দিরার যে-অসাধারণ জীবনীগ্রন্থটি লিখেছেন, সেটা পড়লে আপনি দেখবেন, পিতা নেহরু এবং শুরুর দিকে কংগ্রেসের বড়ো বড়ো নেতা ইন্দিরাকে বাচ্চা মেয়ে হিসেবে দেখতেন। পাত্তাই দিতেন না। তাঁরা কেউই ইন্দিরার রাজনীতিপ্রতিভা ধরতে পারেন নি।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/88248351_534603990798449_8295737058870165504_n.png)
সূত্র: ওয়ান্ডারলাস্ট
ইন্দিরা বুঝে গেছিলেন, ক্ষমতার রাজনীতিতে যদি তাঁকে টিকে থাকতে হয়, তাহলে সামাজিক অর্থে তাঁকে পুরুষ হতে হবে। দয়া, মায়া, কোমলতার মতো যেসব গুণকে সামাজিকভাবে মেয়েলি মনে করা হয় সেগুলোকে অন্তত রাজনৈতিক জীবনে বিসর্জন দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বর্বর বলপ্রয়োগ করতে হবে, যে-বলপ্রয়োগকে সামাজিকভাবে পুরুষালি কাজ ভাবা হয়।
কিন্তু ইন্দিরা ব্যক্তিজীবনে একান্তই সামাজিক নারী ছিলেন।
ফিরোজের সাথে ইন্দিরার বিবাহ সুখের হয় নাই। এটা নিয়ে তাঁর খুব গভীর গ্লানিবোধ ছিলো, ‘ভালো বৌ’ হতে না পারার গ্লানি। ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি ঠিক করেছিলেন, ‘ভালো মা’ হবেন, ছেলে সঞ্জয় কিছু চাওয়ার আগেই তাঁকে তা দিয়ে দেবেন।
ফল যা চাওয়ার তাই হয়েছিলো, তার এই ছেলে অতি আদরে পুরোপুরি বখে গেছিলো। রাজনীতি সিনেমাটা দেখেছেন? অই সিনেমার গল্পটা, অংশত, গান্ধী রাজপরিবারকে নিয়ে!
লাই দিয়ে দিয়ে তিনি সঞ্জয়কে দানব বানিয়েছিলেন, তৈরি করে ফেলেছিলেন একটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব।
ইমার্জেন্সির সময় ইন্দিরার পান্ডারা যতো অন্যায় করেছে, তার একটা বড়ো অংশের জন্য, সঞ্জয় গান্ধী একেবারে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী।
স্বর্ণমন্দিরে সেনাবাহিনী ঢোকানো একটা আত্মঘাতী পদক্ষেপ ছিলো। ঈশ্বরের ক্ষমতার জায়গায় জোরজবরদস্তিমূলকভাবে ঢুকে নশ্বর মানুষ ক্ষমতা দেখাচ্ছে, এটা কোনো কমিউনিটির পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না। শিখরা যে ব্যাপারটাকে সহজভাবে নেয় নি, তাঁদের পক্ষে সহজভাবে নেয়া সম্ভব ছিলো না, তা ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪তে ইন্দিরা নিজের রক্তে ডুবে যেতে যেতে হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। হয়তো।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/03/8251672_orig.jpg)
নারীর ক্ষমতায়নকে খুবই সমস্যাজনক ধারণা মনে করি। কারণ ক্ষমতা মানুষকে বিমানবিকীকৃত করে, যে-কোনো মানুষকে। হ্যাঁ, নারীদেরকেও করে।
মিসেস গান্ধী নিজের সীমাহীন ক্ষমতার শিকার হয়েছিলেন, উনি এই নারীর ক্ষমতায়ন ধারণাটি কতো সরলীকৃত, তার টেক্সটবুক এগজাম্পল।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতায়নের পক্ষে না, ক্ষমতাবিরোধিতার পক্ষে। অর্থাৎ নারীরা পুরুষদের মতো ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে, এটা মানবমুক্তি প্রশ্নে আমার অবস্থান নয়। আমার অবস্থান হচ্ছে পুরুষদেরকে বিক্ষমতায়িত করতে হবে, যাঁরা ক্ষমতাবান নারী তাঁদেরকেও, ক্ষমতা জিনিশটাকেই ধবংস করে দিতে হবে।
ক্ষমতাবিরোধী মানুষেরা কেমন হতে পারে সুজ্যানা অরুন্ধতী রায় বা নোয়াম চমস্কি তার ভালো উদাহরণ, বাংলাদেশে এমন যাঁরা আছেন বুদ্ধিবৃত্তিক স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠতে পারে এই আশঙ্কায় তাঁদের নামটা নিলাম না। এই বিক্ষমতায়নের পথে রাষ্ট্র নেই, কর্পোরেশন নেই, পদক আর পুরস্কারের চোখধাঁধানো আলো নেই। প্রাণ আছে, প্রকৃতি আছে, আর আছে নিজের ব্যক্তি সত্ত্বাকে সাথে নিয়েই সমাজের জন্য কাজ করতে পারার আনন্দ।
পোস্টস্ক্রিপ্ট
এই লেখাটি শুরুতে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছিলো। সেখানে সুস্মিতা চক্রবর্তী একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেন, লেখকও সংক্ষেপে সেই মন্তব্যের জবাব দেন। এই ছোটো চিন্তাবিনিময়টিকে লেখকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় তা হুবহু উদ্ধৃত করা হলো।
সুস্মিতা চক্রবর্তী: লেখাটা ভালো লাগলো! শুধু যে ক’টি নামের উদাহরণ দিলেন তারাও শেষ পর্যন্ত ‘ক্ষমতাহীন’ কিনা খানিক সংশয় অাছে তবুও বক্তব্যের সাথে একমত৷
ইরফানুর রহমান রাফিন: এরা ক্ষমতাবিরোধী। আপনি ঠিক বলেছেন, কেউই পুরাপুরি ক্ষমতাহীন অবশ্যই না। আমি ক্ষমতা বলতে আসলে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা বুঝিয়েছি।