অরাজ
আর্টওয়ার্ক: বার্নিং অব রয়াল ক্যারিজ ডিউরিং ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিউশন ১৮৪৮ শিল্পী: ন্যাথানিয়েল কুরিয়ার সূত্র: উইকি মিডিয়া
প্রচ্ছদ » মিখাইল বাকুনিন।। বৈপ্লবিক মূলমন্ত্র

মিখাইল বাকুনিন।। বৈপ্লবিক মূলমন্ত্র

  • অনুবাদ: সহুল আহমদ

সম্পাদকীয় মন্তব্য: নিচের রচনাটি রুশ বিপ্লবী মিখাইল বাকুনিনের Revolutionary Catechism এর অনুবাদ। বাকুনিনের চিন্তাভাবনায় বিভিন্ন মুক্তিমুখীন প্রবণতা সময়ে সময়ে দিক বদল করলেও ১৮৬৪-১৮৬৭ সালের দিকে তার নৈরাজ্যবাদী ভাবনা একটা চূড়ান্ত রূপ নেয়। বাকুনিন রচনা সংকলনের সম্পাদক ও অনুবাদক স্যাম ডলগফ মনে করেন, ১৮৬৬ থেকে বাকুনিন নৈরাজ্যবাদী ধ্যান-ধারণার জগতে প্রবেশ করেন। এই সময়েই বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ থেকে বিপ্লবী নৈরাজ্যবাদের দিকে তার রূপান্তর ঘটে। ১৮৬৫-৬৬ সালের দিকে তার তিনটা রচনা প্রকাশিত হয়: The International Family, Revolutionary Catechism, এবং National Catechism; এগুলোতেই তিনি তার মৌলিক ভাবনাগুলো তুলে ধরেন।

মিখাইল বাকুনিন

এইচ.ই.কামিন্সকর মতে, এগুলো পুরো নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন হিসাবে কাজ করেছে। সময়ের সাথে তার এই ধারণাগুলো আরো বিবর্তিত হয়েছে, পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের দিকে গিয়েছে। Revolutionary Catechism লেখা হয় ১৮৬৬ সালে। স্যাম ডলগফ অনূদিত ও সম্পাদিত Bakunin on Anarchy গ্রন্থে রচনাটি সংকলিত হয়েছে। বইটি ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়। নিচের সংস্করণটি দি এনার্কিস্ট লাইব্রেরি থেকে নেয়া হয়েছে। বিদ্যমান কোনো সংস্করণে পুরো রচনা পাওয়া যায়নি, কিছু কিছু অংশ হারিয়ে গিয়েছে।

মূল রচনা

[…]

২) মানবতার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা দ্বারা ঈশ্বরের উপাসনাকে প্রতিস্থাপন করে আমরা মানব যুক্তিকে সত্যের একমাত্র মানদণ্ড হিসাবে ঘোষণা দিচ্ছি; মানুষের বিবেককে ন্যায়বিচারের ভিত্তি হিসাবে ঘোষণা দিচ্ছি; ব্যক্তি ও সমষ্টিগত স্বাধীনতাকে সমাজ ব্যবস্থার একমাত্র উৎস হিসাবে ঘোষণা দিচ্ছি।

৩) স্বাধীনতা হলো প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নর ও নারীর পরম অধিকার; নিজ বিবেক ও যুক্তিবোধ ছাড়া নিজের কাজের জন্য আর কোনো সম্মতি আদায়ের দরকার নেই; তারা দায়বদ্ধ থাকবেন প্রথমে খোদ নিজের কাছে এবং তারপর সেই সমাজের কাছে যে সমাজকে তারা স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছেন।

৪) এটা সত্য নয় যে, একজন ব্যক্তির স্বাধীনতা অন্য ব্যক্তির স্বাধীনতা দ্বারা সীমাবদ্ধ। আদতে মানুষ ততটুকু পর্যন্ত স্বাধীন যতটুকু এই স্বাধীনতা তার সহকর্মীর অবাধ সম্মতি দ্বারা পূর্ণ স্বীকৃত ও প্রতিবিম্বিত; তাদের স্বাধীনতার মধ্যেই এর অনুমোদন ও সম্প্রসারণ খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষ সত্যিকারের মুক্ত কেবল সমানভাবে মুক্ত মানুষের মধ্যেই। একজন ব্যক্তির দাসত্বও মানবতাকে লঙ্ঘন করে এবং সকলের স্বাধীনতাকেই খারিজ করে দেয়।

৫) ফলে প্রত্যেকের স্বাধীনতা কেবল সকলের সমতার মাধ্যমেই বাস্তাবায়িত করা সম্ভব। তত্ত্ব ও চর্চায় সমতার মাধ্যমে স্বাধীনতার বাস্তবায়নই হচ্ছে ন্যায়বিচার।

৬) যদি মানব নৈতিকতার কোনো একটি মূলনীতি থাকে তাহলে সেটা হচ্ছে স্বাধীনতা। আপনার সহকর্মীর স্বাধীনতাকে সম্মান করা আপনার কর্তব্য; তাকে ভালোবাসা, সাহায্য করা এবং সেবা করা সদগুণ।

৭) রাষ্ট্রের সুবিধার্থে যে স্বাধীনতাকে উৎসর্গ করার কথা বলা হয় সেটাসহ সকল ধরনের কর্তৃপক্ষকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আদিম সমাজে স্বাধীনতার কোনো ধারণা ছিল না। সমাজের বিকাশের সাথে সাথে, মানব যুক্তি ও স্বাধীনতার পূর্ণ জাগরণের পূর্বে, এটি এমন একটা পর্ব পার হয়ে এসেছে যা মানুষ ও ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে স্বাধীনতার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে হবে। অতঃপর সমাজের বিন্যাস অবশ্যই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সকল পর্যায়ে সামাজিক সংগঠনের স্বাধীনতার সর্বোচ্চ সম্ভাব্য উপলব্ধি থেকে উঠে আসতে হবে।

৮) সমাজ জীবনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন উপর থেকে নিচের দিকে, অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে- এমন কাঠামোতে পরিচালিত করা যাবে না, জোরজবরদস্তিমূলক কেন্দ্রীয়করণের মাধ্যমে ঐক্য চাপিয়ে দেয়া যাবে না। বিপরীতে, স্বাধীন সংগঠন ও ফেডারেশনের নীতি অনুযায়ী, এটাকে নিচ থেকে উপরে, মানে পরিধি থেকে কেন্দ্র এমন কাঠামোতে পুনর্গঠন করতে হবে।

৯)  রাজনৈতিক সংগঠন। প্রত্যেকটা দেশের [এখানে নেশন বলা হয়েছে, কিন্তু সেটা দেশ, রাষ্ট্র, সংগঠন অর্থে শিথিলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এটা পুরো প্রবন্ধের জন্যই প্রযোজ্য- বাংলা অনুবাদক] আভ্যন্তরীণ বিকাশ ও রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো একটি নির্দিষ্ট, সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক মান [নর্ম] নির্ধারণ করা অসম্ভব। প্রতিটি দেশের জীবন বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক, ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক শর্তাধীন হওয়াতে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য কোনো মডেল দাঁড় করানো অসম্ভব। এমন ধরনের যে কোনো প্রচেষ্টা একেবারেই অবাস্তব। এটা জীবনের ঐশ্বর্য ও স্বতঃস্ফুর্ততাকে আড়াল করে ফেলে; কেবল অসীম বৈচিত্র‍্যের মধ্যেই এগুলো সতেজ হয়ে ওঠে। এবং, এই আড়াল করাটা স্বাধীনতার সর্বাধিক মৌলিক নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। তদপুরি কিছু নির্দিষ্ট অপরিহার্য শর্ত ব্যতীত স্বাধীনতার ব্যবহারিক বাস্তবায়ন চিরকালের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে।

শর্তগুলো হলো:

ক) সকল ধরনের রাষ্ট্রীয় ধর্ম এবং রাষ্ট্রীয় অনুদানে আংশিকভাবে পালিত বা সমর্থিত চার্চসহ সকল সুবিধাভোগী চার্চের বিলোপসাধন। প্রতিটি ধর্মের তাদের দেবতাদের মন্দির তৈরি এবং তাদের পুরোহিতদের অর্থ প্রদান ও সহায়তা করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতাদান।

খ) ধর্মীয় কর্পোরেশন হিসাবে বিবেচিত চার্চগুলোকে উৎপাদনশীল সংস্থাগুলোর [প্রডাকটিভ এসোসিয়েশন] মতো সমান রাজনৈতিক অধিকার উপভোগ করতে দেয়া যাবে না; শিশুদের শিক্ষার ভার তাদের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না। কেননা তারা টিকেই থাকে কেবল নৈতিকতা ও স্বাধীনতাকে নাকচ করার জন্য এবং জাদুবিদ্যার লোভনীয় কলাকৌশল দিয়ে ফায়দা লোটার জন্য।

গ) রাজতন্ত্রের বিলোপ সাধন; একটি কমনওয়েলথ প্রতিষ্ঠা।

ঘ) শ্রেণি, পদ ও বিশেষাধিকারের বিলোপ সাধন; সকল নর-নারীর জন্য সমান রাজনৈতিক অধিকার; সর্বজনীন ভোটাধিকার।

ঙ) সর্বব্যাপী, নিয়ন্ত্রিত ও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র [চার্চের অল্টার ইগো], যে রাষ্ট্র দারিদ্র্য, নির্মমতা ও জনতার দাসত্বের স্থায়ী কারণ, সেই রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত করতে হবে, এবং নৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এটি স্বাভাবিকভাবেই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে:

সকল রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলোপসাধন : গণ শিক্ষা কেবলমাত্র কমিউন ও স্বাধীন সংগঠনগুলোর মাধ্যমেই পরিচালিত হবে।

রাষ্ট্রীয় বিচারবিভাগের বিলোপসাধন : সকল বিচারক অবশ্যই জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হতে হবে।

বর্তমান ইউরোপে চালু থাকা সকল ফৌজদারী, সিভিল ও লিগ্যাল বিধানের বিলোপসাধন : কারণ স্বাধীনতার বিধান কেবল খোদ স্বাধীনতাই তৈরি করতে পারে।

ব্যাঙ্ক ও রাষ্ট্রীয় ক্রেডিটের সকল প্রতিষ্ঠানের বিলোপ করতে হবে। সকল কেন্দ্রীভূত প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, সকল স্থায়ী সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীকে বিলোপ করতে হবে।

চ) উভয় লিঙ্গের সর্বজনীন ভোটাধিকার দ্বারা সমস্ত বিচারিক ও নাগরিক কর্মীদের পাশাপাশি প্রতিনিধিদের (জাতীয়, প্রাদেশিক, এবং সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের) তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরি নির্বাচন।

ছ) ব্যক্তি, উৎপাদনশীল সংস্থাসমূহ এবং কমিউনের চূড়ান্ত স্বাধীনতার ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের আভ্যন্তরীন পুনর্গঠন। বিচ্ছিন্নতার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা: প্রত্যেক ব্যক্তি, সংস্থা, কমিউন, অঞ্চল ও দেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের, যুক্ত হওয়া বা না-হওয়ার চূড়ান্ত অধিকার রয়েছে; তাদের ইচ্ছানুযায়ী মিত্রতা তৈরি করার এবং তথাকথিত ঐতিহাসিক অধিকার [পূর্ববর্তী আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অধিকার] আমলে না নিয়ে অথবা প্রতিবেশীদের সুবিধার কথা আমলে না নিয়েই সেই মিত্রতা নাকচ করে দেয়ার অধিকার রয়েছে। যখনই বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন বিচ্ছিন্নকরণের আর প্রয়োজন থাকে না। সহিংসতার মাধ্যমে আরোপিত ‘ঐক্য’কে খারিজ করে সমাজের ইউনিটগুলো একত্রিত হবে তাদের শক্তিশালী পারষ্পরিক আকর্ষণ এবং গভীর জরুরতের ওপর নির্ভর করে। স্বাধীনতা [লিবার্টি] দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে কমিউন, প্রদেশ, অঞ্চল এবং দেশের নতুন ফেডারেশনগুলো হবে আসলেই শক্তিশালী, উৎপাদনশীল এবং দৃঢ়।

আর্টওয়ার্ক: লং লিভ দ্য কমিউন
সূত্র: গ্রাহাম ব্লগ

জ) ব্যক্তিগত অধিকার।

▪ জন্ম থেকে সাবালকত্ব পর্যন্ত প্রত্যেক নর-নারীর পরিচর্যা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, নির্দেশনা, শিক্ষা (পাবলিক স্কুল, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, শৈল্পিক, শিল্প ও বিজ্ঞানভিত্তি)সহ সকল অধিকারের ব্যয়ভার সমাজের।

▪ মুক্তভাবে জীবিকা নির্বাচনের ব্যাপারে কিশোর-কিশোরীদের সমান অধিকার রয়েছে; এই অধিকার সমাজ দ্বারা সহযোগিতা এবং সর্বাধিক সম্ভাব্য পরিমাণে সমর্থন করতে হবে। এরপরে সমাজ তাদের ওপর কোনো কর্তৃত্ব ফলাবে না বা তদারকি করবে না, কেবল তাদের স্বাধীনতা ও অধিকারকে সম্মান করবে, প্রয়োজনে এগুলোকে রক্ষা করবে।

▪ সাবালক নর-নারীর স্বাধীনতা অবশ্যই চরম ও পূর্ণ হতে হবে; তাদের চলাফেরায়, মত প্রকাশে, আলসেমি বা কাজে, নৈতিক বা অনৈতিকতার স্বাধীনতা থাকবে; সংক্ষেপে কারো কাছে কৈফিয়ত না করেও কাউকে বা কোনো সম্পত্তি ত্যাগ করার স্বাধীনতা থাকবে। সৎভাবে নিজের শ্রমের দ্বারা বেঁচে থাকার স্বাধীনতা, এমনকি যারা ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের শোষণ সহ্য করে তাদের ক্ষতি স্বীকার করেও।

▪ জনমতের সহজাত উপকারী ক্ষমতা ব্যাতীত অন্য কোনো ধরণের বাধা ছাড়াই প্রপাগান্ডা, বক্তৃতা, সংবাদমাধ্যম, এবং জনপরিসরে বা ব্যক্তিপরিসরে সমাবেশ করার সীমাহীন স্বাধীনতা। সংগঠন বা সমিতি করার পূর্ণ স্বাধীনতা, এমনকি সেটা অনৈতিক উদ্দেশ্যে হলেও; এমনকি যে সংগঠনগুলো ব্যক্তি এবং জনগণের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করাকে সমর্থন করে তাদেরও রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা।

▪ স্বাধীনতাকে কেবল স্বাধীনতা দ্বারাই রক্ষা করা যায়: স্বাধীনতাকে রক্ষার অজুহাতে স্বাধীনতায় বাধানিষেধ সমর্থন করা একটি বিপজ্জনক বিভ্রান্তি। যেহেতু নৈতিকতার স্বাধীনতা ব্যতীত আর কোনো উৎস নেই, আর কোনো বস্তু নেই, আর কোনো উদ্দীপক নেই সেহেতু নৈতিকতা রক্ষার জন্য স্বাধীনতার সকল বিধিনিষেধ আসলে নৈতিকতাকেই ক্ষতি করে। মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান এবং সকল ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে যে, ব্যক্তিক ও সামাজিক অনৈতিকতা হচ্ছে একটা মিথ্যা বেসরকারি ও সরকারি শিক্ষার অপরিহার্য পরিণতি, জনসাধারণের নৈতিকতার অবক্ষয় ও জনমত বিকারের পরিণতি, সর্বোপরি সমাজের পঙ্কিল কাঠামোর অপরিহার্য পরিণতি। এক প্রখ্যাত বেলজিয়ান পরিসংখ্যানবিদ দেখিয়েছেন যে, সমাজ অপরাধের যে পথ খুলে দেয় সেই পথেই পরবর্তীতে একজন দুর্বৃত্ত অপরাধ সংঘটিত করে। সে অনুযায়ী, যে আইন ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করে তেমন কঠোর আইন দিয়ে সামাজিক নৈতিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এর বিপরীতে অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, একটি দমনমূলক ও কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা অপরাধ প্রতিরোধ না করে উল্টো বাড়িয়ে দেয়। আরও প্রমাণ করে যে, ব্যক্তি-স্বাধীনতা কতটা সীমিত বা প্রসারিত এর ওপর নির্ভর করে জনপরিসরে বা ব্যক্তি পরিসরে নৈতিকতার বৃদ্ধি বা হ্রাস কতটা হবে। এর ফলে, সমাজকে পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে আমাদেরকে এই রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলতে হবে; যে ব্যবস্থাটি বৈষম্য, বিশেষাধিকার এবং মানবতার প্রতি ঘৃণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সবার জন্য সর্বাধিক পূর্ণ স্বাধীনতা, সমতা, ও ন্যায়বিচার, কাজ এবং একটি আলোকিত শিক্ষার [যে শিক্ষা মানুষের প্রতি সম্মান দ্বারা অনুপ্রাণিত] ভিত্তিতে সমাজকে পুনর্গঠন করার পর জনমত একটি নতুন মানবতাকে প্রতিফলিত করবে; এবং জনমত সর্বাধিক চরম স্বাধীনতার একটি সহজাত অভিভাবক হয়ে উঠবে।

▪ তদপুরি, সমাজকে দুষ্টু ও ক্ষতিকর ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একেবারে অরক্ষিত অবস্থায় ছেড়ে দেয়া যাবে না। সকল রাজনৈতিক অধিকারের ভিত্তি হবে কাজ। সমাজের প্রতিটি ইউনিট তার নিজস্ব এখতিয়ারের মধ্যে এমন সকল সাবালক সমাজবিরোধীদেরকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে [বৃদ্ধ, অসুস্থ, যারা বিভিন্ন ভর্তুকির ওপর নির্ভরশীল তারা ব্যতীত], এবং যখনই তারা নিজ শ্রমে জীবিকা বাঁচতে শুরু করবেন তখনই তাদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে সমাজ বাধ্য থাকবে।

▪ প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা অবিচ্ছেদ্য; এবং সমাজ কখনোই কোনো ব্যক্তিকে তার স্বাধীনতা সমর্পণ করতে ফরমায়েশ করবে না, অথবা সর্বাধিক পূর্ণ সমতা ও পারস্পরিকতার ভিত্তি ছাড়া এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের দরকার পড়বে না। যে নর বা নারী আত্মসম্মান নষ্ট করে স্বেচ্ছায় অন্যের গোলামিতে নিযুক্ত করে সমাজ তাকেও জোরজবরদস্তি করে আটকাতে পারে না; কিন্তু সমাজ তাকে পরজীবী হিসাবে বিবেচনা করতে পারে, গোলামির কালে সে কোনো রাজনৈতিক অধিকার উপভোগ করতে পারবে না।

▪ যে ব্যক্তিরা রাজনৈতিক অধিকার হারাবেন তারা তাদের শিশুদের অভিভাবকত্ব হারাবেন। যারা স্বেচ্ছা-চুক্তি লঙ্ঘন করবেন, চুরি করবেন, শারিরীক ক্ষতি করবেন, অথবা সর্বোপরি দেশী বা বিদেশী কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করবেন তারা সমাজের বিধি-বিধান অনুযায়ী দণ্ডিত হবেন।

▪ […]

▪ যে কোনো সংস্থার [কমিউন, প্রদেশ, অঞ্চল বা দেশ] আইনানুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তি উক্ত সমিতি থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়ে শাস্তি থেকে বাঁচার অধিকার সংরক্ষণ করেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সংস্থাটিরও তাকে বহিষ্কার করার সমান অধিকার রয়েছে এবং এর নিশ্চয়তা ও সুরক্ষার বাইরে ঘোষণা করার অধিকার রয়েছে।

ঝ) সংস্থা/সমিতি/সংগঠনের [ফেডারেলিজম] অধিকার

সমবায় শ্রমিক সংগঠন ইতিহাসের একটি নতুন বাস্তবতা। ভবিষ্যতের নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় এর যে বিপুল বিকাশ হাজির হতে যাচ্ছে নিঃসন্দেহে সে বিষয়ে  আমরা কেবল অনুমান করতে পারি, নির্ধারণ করতে পারি না। খুব সম্ভব এমনও দিন আসতে পারে যখন এগুলো শহর, প্রদেশ, এমনকি রাষ্ট্রের সীমা অতিক্রম করে যাবে। এগুলো হয়তোবা পুরো সমাজকে পুনর্গঠিত করে তুলতে পারে; জাতিতে বা দেশে দেশে সমাজকে বিভক্ত না করে বিভিন্ন শিল্প-গোষ্ঠীতে বিভক্ত করতে পারে, রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুসারে না করে বরঞ্চ উৎপাদনের প্রয়োজন অনুসারে ভাগ করতে পারে। কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। সে যাই হোক না কেন, আমরা ইতোমধ্যে এই মৌলিক নীতি ঘোষণা করতে পারি: ব্যক্তির মতোই সকল সংগঠন/সংস্থা/সমিতি তাদের কাজ বা লক্ষ্য নির্বিশেষে সবাই চরম স্বাধীনতা উপভোগ করবেন। সমাজ বা সমাজের কোনো অংশই (কমিউন, প্রদেশ বা দেশ) কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে যে কোনো উদ্দেশ্যে সংগঠিত/সমবেত হতে বাধা দিতে পারবে না। সে উদ্দেশ্য রাজনৈতিক, ধর্মীয়, বিজ্ঞানভিত্তিক, অথবা শৈল্পিক হতে পারে; অথবা এমনকি নিরীহ বা মদ্যপদের স্বার্থসাধন বা বিকৃতির জন্য হলেও তাকে সমবেত হতে বাধা দেয়া যাবে না যদি সে নাবালক না হয়ে থাকে।  প্রতারক এবং ক্ষতিকর সঙ্ঘের বিরুদ্ধে লড়াই জনমতের একটি বিশেষ কাজ। কিন্তু যে সংগঠন বা সমিতির লক্ষ্য বা বিধি মৌলিক মানবিক ন্যায়বিচারকে লঙ্ঘন করে তার নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা খারিজ করার বাধ্যবাধকতা সমাজের রয়েছে। কেবলমাত্র এমন একটি অ-স্বীকৃত সমিতির সাথে যুক্ত আছেন বলেই কোনো ব্যক্তিকে দণ্ডিত করা বা তার পূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। স্বীকৃত ও অ-স্বীকৃত সংগঠনের পার্থক্য হবে নিম্নরূপ: আইনত স্বীকৃত সমিতিগুলো তাদের স্বেচ্ছাধীন বাধ্যবাধকতা অস্বীকারকারী ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে সম্প্রদায়ের সুরক্ষা অধিকার পাবে। আইনত অ-স্বীকৃত সমিতিগুলো সম্প্রদায় কর্তৃক এমন কোনো ধরণের সুরক্ষার অধিকারী হবেনা এবং তাদের কোনো চুক্তিই বাধ্যবাধকতা হিসাবে বিবেচিত হবে না।

ঞ) একটি দেশকে বিভিন্ন অঞ্চলে, প্রদেশে, জেলাতে এবং কমিউনে বিভক্ত করা (যেমনটা ফ্রান্সে) স্বাভাবিকভাবেই নির্ভর করবে সেই নির্দিষ্ট দেশের ঐতিহ্য, নির্দিষ্ট পরিস্থিতি এবং বিশেষ প্রকৃতির ওপর। যদি কোনো দেশ গুরুত্ব সহকারেই মুক্ত সমাজ গড়ার চেষ্টা করে তাহলে আমরা কেবল দুটো মৌলিক ও অপরিহার্য নীতিকে নির্দেশ করতে পারি। প্রথমত, সমস্ত সংগঠনকে অবশ্যই তলা থেকে শীর্ষ এমন কাঠামোতে যেতে হবে; কমিউন থেকে দেশের সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত। দ্বিতীয়ত, কমিউন এবং দেশ বা বিভাগ বা অঞ্চল বা প্রদেশ এর মধ্যে অবশ্যই অন্তত একটি স্বায়ত্তশাসিত মধ্যবর্তী সংস্থা থাকতে হবে। এমন একটি স্বায়ত্তশাসিত মধ্যবর্তী সংস্থা ছাড়া কমিউন রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিক কেন্দ্রিক চাপ মোকাবিলায় খুবই বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হয়ে যাবে, যা কিনা অনিবার্যভাবে একটি স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে (যেমনটি ফ্রান্সে দুবার হয়েছে)। রাজার স্বৈরাচারী চরিত্রের চাইতে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সংগঠনের মধ্যে স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব বেশি হয়।

ট) প্রতিটি দেশের সমস্ত রাজনৈতিক সংস্থার প্রাথমিক ইউনিটগুলোকে সম্পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত কমিউন হতে হবে; প্রাপ্তবয়ষ্ক নর-নারীর সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে এটা গঠিত হবে। কমিউনের আভ্যন্তরীণ কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করার কারোরই কোনো ক্ষমতা বা অধিকার থাকবে না। কমিউন নিজেই নির্বাচন করবে সকল কর্মী, আইন-প্রণেতা এবং বিচারকদের। সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ও আর্থিক বিষয়াদি কমিউনই পরিচালনা করবে। প্রতিটি কমিউনেরই নিজেদের গঠনতন্ত্র তৈরি ও আইন প্রণয়নের প্রশ্নাতীত অধিকার থাকবে; উচ্চতর কোনো অনুমোদন লাগবে না। কিন্তু প্রাদেশিক ফেডারেশনে যুক্ত হওয়া এবং এর অংশ হওয়ার উদ্দেশ্যে, কমিউনের নিজস্ব নির্দিষ্ট সনদটি অবশ্যই প্রাদেশিক গঠনতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, এবং প্রদেশের সংসদ কর্তৃক তা গৃহীত হতে হবে। কমিউনকে অবশ্যই প্রাদেশিক ট্রাইব্যুনালের রায় এবং প্রদেশ সরকার কর্তৃক আজ্ঞাপিত যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। (প্রাদেশিক সরকারের সকল পদক্ষেপ অবশ্যই প্রাদেশিক সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।) প্রাদেশিক আইন গ্রহণে অস্বীকারকারীরা এর সুবিধা পাবে না।

ঠ) প্রদেশটিকে অবশ্যই স্বায়ত্বশাসিত কমিউনসমূহের একটি স্বাধীন ফেডারেশন হতে হবে। প্রাদেশিক সংসদ প্রতিটি কমিউনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি একক সভাগৃহ হতে পারে, অথবা দুটো সভাগৃহও হতে পারে, যেখানে অন্যটা কমিউন বাদে প্রদেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করবে। প্রাদেশিক সংসদ কমিউনের আভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তে কোনোভাবেই নাক না গলিয়ে প্রাদেশিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করবে (এই ক্যাটেকিজমের ওপর নির্ভর করে)। প্রাদেশিক সংসদে যোগদানে ইচ্ছুক সকল কমিউন দ্বারা এটা অবশ্যই গৃহীত হতে হবে। প্রাদেশিক সংসদ ব্যক্তি, কমিউন এবং প্রাদেশিক ফেডারেশন সম্পর্কিত সমিতিগুলির অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা সংজ্ঞায়িত করে আইন জারি করবে এবং এই আইন লঙ্ঘনের জন্য দণ্ডবিধি জারি করবে। তদপুরি এটা কমিউনকে গৌণ বিষয়গুলোতে ভিন্নমত দেয়ার অধিকার দিবে যদিও মৌলিক বিষয়গুলোতে দিবে না।

প্রাদেশিক সংসদ কমিউনের ফেডারেশনের সনদের সাথে কঠোরভাবে সঙ্গতি রেখে কমিউন, সংসদ, বিচারবিভাগ এবং প্রাদেশিক প্রশাসনের মধ্যকার অধিকার ও বাধ্যবাধকতাকে সংজ্ঞায়িত করবে। এটা কমিউন এবং প্রদেশের স্বায়ত্ত্বশাসন লঙ্ঘন না করে পুরো প্রদেশের জন্য আইন জারি করবে, জাতীয় সংসদের জন্য সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কমিউনের আভ্যন্তরীণ প্রশাসনে কোনো ধরণের হস্তক্ষেপ না করে এটি প্রতিটি কমিউনকে প্রাদেশিক অথবা জাতীয় আয়ের অংশ বণ্টন করে দিবে; এটি কমিউনের নিজ সদস্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবহৃত হবে। সর্বজনীন ভোটাধিকার দ্বারা নির্বাচিত প্রাদেশিক সংসদ প্রাদেশিক প্রশাসনের সকল নীতিমালা ও পদক্ষেপ অনুমোদন বা প্রত্যাখান করবে। প্রাদেশিক ট্রাইব্যুনাল (সর্বজনীন ভোটাধিকার দ্বারা নির্বাচিত) কমিউনের সাথে ব্যক্তির, কমিউনের সাথে কমিউনের এবং কমিউনের সাথে সাথে প্রাদেশিক প্রশাসন বা সংসদের বিরোধ নিষ্পত্তি করবেন, কোনো আপীল ছাড়াই। [এই ব্যবস্থাগুলো] কোনো নিস্তেজ প্রাণহীন অভিন্নতার দিকে নিয়ে যাবে না, বরঞ্চ একটি বাস্তব সজীব একতার দিকে নিয়ে যাবে, সম্প্রদায়গত জীবনের সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। এমন একটি ঐক্য সৃষ্টি হবে যা কমিউনের প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করবে; সংক্ষেপে বললে, আমরা ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিত [কালেকটিভ] স্বাধীনতা পাব। এই ঐক্য প্রাদেশিক ক্ষমতার বলপ্রয়োগ বা সহিংসতা দ্বারা অর্জন করা যায় না। এমনকি সত্য ও ন্যায়বিচারের জন্যও যদি বলপ্রয়োগ করা হয় তবু সেটা মিথ্যাচার ও দুবৃত্তির দিকে নিয়ে যায়।

ড) দেশ [নেশন] স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রদেশসমূহের একটি ফেডারেশন।

ঢ) আন্তর্জাতিক ফেডারেশনের নীতিমালা। আন্তর্জাতিক ফেডারেশন গঠনে যে দেশগুলো [নেশন] একত্র হবে তা উপরোক্ত নীতিমালার আলোকেই হবে। এটা সম্ভাব্য, এবং আমাদের প্রত্যাশাও যে, যখন গণবিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্ত হাজির হবে তখন প্রতিটি দেশ একটি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সংহতিতে ঐক্যবদ্ধ হবে এবং প্রতিক্রিয়াশীল দেশগুলোর বিরুদ্ধে একটি অলঙ্ঘনীয় জোট গঠন করবে। এই জোট হবে ভবিতব্য জনগণের সার্বজনীন ফেডারেশন [অর্থাৎ, ইউনিভার্সেল ফেডারেশন অফ পিপল] এর বীজ হবে, যা ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বকেই আলিঙ্গন করে নিবে। বিপ্লবী জনসাধারণের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন একটি সংসদ, একটি ট্রাইব্যুনাল ও একটি আন্তর্জাতিক নির্বাহী কমিটি সহকারেই সাধারণত বিপ্লবের নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে। আন্তর্জাতিক পলিটিতে যে নীতিগুলো প্রয়োগ করা হবে তা হচ্ছে নিম্নরূপ:

❖ তথাকথিত ঐতিহাসিক অধিকার, এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, ব্যবসায়ীক অথবা কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নির্বিশেষে প্রতিটি ভূমি, দেশ, জনগণ- তা ছোট বা বড়ো, দুর্বল বা শক্তিশালী যাই হোক না কেন- অঞ্চল, প্রদেশ এবং কমিউনের আত্মনিয়ন্ত্রণের, ইচ্ছামতো মিত্রতা, ঐক্যবদ্ধ বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। সত্যিকার টেকসই ও ফলপ্রসু হতে হলে সমাজের উপাদানগুলোর ঐক্যকে অবশ্যই পূর্ণ স্বাধীন হতে হবে: এটি কেবলমাত্র সমাজের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোর আভ্যন্তরীন প্রয়োজন ও পারষ্পরিক আকর্ষণ থেকে উদ্ভূত হতে পারে…

❖ তথাকথিত ঐতিহাসিক অধিকার এবং বিজয়ীর ভয়াবহ অধিকারকে বাতিল করতে হবে।

❖ রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ, ক্ষমতা ও গৌরবের রাজনীতিকে চূড়ান্তরূপে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। কেননা এটি এমন এক রাজনীতি যা প্রতিটি দেশকে একটি স্ব-নির্মিত দুর্গে পরিণত করে, বাকিদেরকে বাইরে রেখে এবং সকল মানব সংহতি থেকে মুক্ত করে একটি বদ্ধ দুনিয়াতে নিজেকে সংগঠিত করে, অন্য দেশের ওপর যত মন্দ কাজকারবার করা যায় তার মধ্যেই গৌরব ও সমৃদ্ধি খুঁজে পায়। দখলদারিত্বে সংকল্পবদ্ধ একটি দেশ আদতে আভ্যন্তরীণভাবে দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ দেশ।

❖ একটি দেশ বা জাতির গৌরব ও মহিমা তার মানবতা বিকাশের মধ্যে নিহিত। তার শক্তি ও অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি স্বাধীনতার মাত্রা দিয়ে পরিমাপ করা হয়।

❖ ব্যক্তির পাশাপাশি দেশের ভালো থাকা ও স্বাধীনতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং ফেডারেশনভুক্ত সমস্ত দেশের মধ্যকার বাণিজ্য, বিনিময় ও যোগাযোগ মুক্ত থাকবে; এদের মধ্যকার সীমান্ত, পাসপোর্ট ও বহিঃশুল্ক বিলুপ্ত করতে হবে। ফেডারেশনভুক্ত একটি দেশের প্রত্যেক নাগরিকই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবেন এবং একই ফেডারেশনভুক্ত অন্যান্য দেশের নাগরিকত্ব অর্জন ও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করা তার পক্ষে সহজ হবে। যদি স্বাধীনতাই হয়ে থাকে সূচনাবিন্দু, তাহলে এটি আবশ্যিকভাবেই ঐক্যের [ইউনিটি] দিকেই নিয়ে যাবে। কিন্তু ঐক্য থেকে স্বাধীনতার দিকে যাওয়াটা অসম্ভব না হলেও কঠিন। এমনকি যদি সম্ভবও হয়ে থাকে তবু এটা সম্ভব কেবলমাত্র বলপ্রয়োগ দ্বারা আরোপকৃত কৃত্রিম ‘ঐক্য’ ধ্বংসের মাধ্যমে…

❖ […]

❖ […]

❖ ফেডারেশনভুক্ত কোনো দেশই স্থায়ী সেনাবাহিনী রাখতে পারবে না, অথবা বেসামরিক লোকদেরকে সৈন্যদেরকে পৃথক করে রাখে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান রাখতে পারবে না। স্থায়ী সেনাবাহিনী ও পেশাদার সৈন্যরা কেবল আভ্যন্তরীণ ভাঙ্গন, নৃশংসতা ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিই তৈরি করে না, বরঞ্চ তারা অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা ও মঙ্গলকেও হুমকির মুখে ফেলে দেয়। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে সমস্ত সক্ষম ব্যক্তিরাই নিজেদের ঘর ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে অস্ত্র হাতে তুলে নিবে। প্রতিটি দেশের সামরিক প্রতিরক্ষা ও সরঞ্জাম স্থানীয়ভাবে কমিউনের মাধ্যমে বা প্রাদেশিকভাবে সংগঠিত করা উচিৎ, অনেকটা সুইজারল্যান্ড বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিশিয়াদের মতো [circa 1860-7]।

❖ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের দেশ ও স্ব-স্ব-প্রদেশের মধ্যকার সমস্ত বিরোধ নিষ্পত্তি, আপিল ব্যতিরেকে, করা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকবে না। ফেডারেশনভুক্ত দুটো দেশের পার্থক্য কেবল আন্তর্জাতিক সংসদ কর্তৃক কোনো আপিল ব্যাতিরেক নির্ধারিত হবে, যা কিনা সমগ্র বিপ্লবী ফেডারেশনের নামে একটি সাধারণ নীতিমালাও প্রণয়ন করবে এবং যদি অনিবার্য হয়ে উঠে তখন প্রতিক্রিয়াশীল জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

❖ ফেডারেশনভুক্ত এক দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না। যদি যুদ্ধ হয়ে থাকে এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা দিয়ে থাকে তাহলে আক্রমণকারীকে অবশ্যই সমর্পণ করতে হবে। যদি এটা না হয়ে থাকে তাহলে ফেডারেশনভুক্ত অন্যান্য দেশ এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে এবং আক্রমণকারীর আক্রমণকে প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ হবে।

❖ বিপ্লবী ফেডারেশনের সকল সদস্যকে অবশ্যই ফেডারেশনভুক্ত নয় এমন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনুমোদিত যুদ্ধে অংশ নিতে হবে। যদি একটি ফেডারেশনভুক্ত দেশ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধাচরণ করে বহিরাগত রাষ্ট্রের সাথে অনায্য যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে সেটা আগেই জানিয়ে দেয়া হবে যে, এই যুদ্ধ তাকে একাই করতে হবে।

❖ আশা করা যায় ফেডারেশনভুক্ত রাষ্ট্র ধীরে ধীরে বিদেশী রাষ্ট্রগুলোতে পৃথক পৃথক কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের ব্যয়বহুল বিলাসিতা ত্যাগ করবে এবং সমস্ত ফেডারেশনভুক্ত রাষ্ট্রের পক্ষে প্রতিনিধিদের কথা বলার ব্যবস্থা করবে।

❖ যে দেশ বা ব্যক্তি এই ক্যটকিজমে বর্ণিত নীতিগুলো গ্রহণ করবেন তারাই কেবল ফেডারেশনে যুক্ত হতে পারবেন।

[…]
আর্টওয়ার্ক: প্যারিস কমিউন
সংগ্রহ: গেটি ইমেজ

১০) সামাজিক সংগঠন। রাজনৈতিক সমতা ব্যতীত কোনো সত্যিকারের রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকতে পারেনা, কিন্তু রাজনৈতিক সমতা কেবল তখনই সম্ভব যখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা থাকবে।

o সমতা মানে এই নয় যে ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ঘুচে যাবে, বা ব্যক্তি শারিরীকভাবে, মানসিকভাবে অথবা নৈতিকভাবে অভিন্ন হয়ে যাবে। জাত, দেশ, লিঙ্গ, বয়স ও ব্যক্তিদের মধ্যকার সক্ষমতা ও ক্ষমতার বিচিত্রতা সামাজিক অমঙ্গল তৈরির বিপরীতে মানবতার প্রাচুর্যতাকেই গঠন করে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার অর্থ হলো ব্যক্তি সম্পত্তির সমতাবিধান, কিন্তু নিজ দক্ষতা, উৎপাদনশীল কর্মশক্তি ও মিতব্যায়ীতার মাধ্যমে ব্যক্তি যা অর্জন করবেন সেটাকে সীমাবদ্ধ করে নয়।

o সমতা ও ন্যায়বিচার কেবল সেই সংগঠিত সমাজে দাবি করা যায় যেখানে প্রতিটি মানুষ জন্ম থেকে শুরু করে কৈশোর ও সাবালকত্বসহ জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে সমান সুযোগ পাবে: প্রথমত রক্ষণাবেক্ষন ও শিক্ষার, এবং পরবর্তীতে তার সহজাত সক্ষমতা ও তৎপরতাগুলো অনুশীলনের। যে ন্যায়বিচারের ভিত্তি জন্মের পর থেকে সবার জন্য সমতা, তা ততক্ষণ পর্যন্ত অর্জন করা অসম্ভব যতক্ষণ পর্যন্ত উত্তরাধিকার সম্পত্তি বজায় থাকবে।

o […]

o উত্তরাধিকারের [right of inheritance] বিলুপ্তি। উত্তরাধিকারের বিলুপ্তি না ঘটা পর্যন্ত সামাজিক বৈষম্য, অর্থাৎ শ্রেণি, সুবিধা ও সম্পদের বৈষম্য বজায় থাকবে। এটি এমন এক সামাজিক আইন, যার মধ্যে কার্যত বৈষম্য মজ্জাগত রয়েছে, তা অনিবার্যভাবে অধিকারের বৈষম্য তৈরি করে। সামাজিক বৈষম্য রাজনৈতিক বৈষ্যমের দিকে নিয়ে যায়। এবং রাজনৈতিক সমতা ব্যতীত (সত্য, সার্বজনীন ও লিবার্টিয়ান অর্থে রাজনৈতিক সমতা বলতে যা বোঝায়) সমাজ সর্বদাই দুটো অসম অংশে বিভক্ত থাকবে। প্রথম অংশ, যা মানবজাতির বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিয়ে গঠিত, যাদেরকে জনসাধারণ বলা হয়, তারা সুবিধাভোগী ও শোষণকারী সংখ্যালঘু দ্বারা নির্যাতিত হবেন। উত্তরাধিকারের অধিকার স্বাধীনতার নীতি লঙ্ঘন করে এবং তা অবশ্যই বাতিল করতে হবে।

o […]

o […]

o যখন উত্তরাধিকারের ফলে প্রাপ্ত বৈষম্য বিলুপ্ত হয়ে যাবে তখনও ব্যক্তিদের মধ্যকার বিচিত্র পরিমাণের কর্মশক্তি ও দক্ষতার কারণে [সম্পদের] বৈষম্য অব্যাহত থাকবে। এই বৈষম্যগুলো কখনো পুরোপুরি উবে যাবে না, কিন্তু শিক্ষা ও সমতাবাদী সামাজিক সংগঠনের প্রভাবে এগুলো কমতে থাকবে। সর্বোপরি উত্তরাধিকার অনাগত প্রজন্মের ওপর আর কোনো বোঝা চাপিয়ে দিবে না।

o শ্রমই সম্পদের একমাত্র উৎস হওয়াতে সবাই ক্ষুধার্ত অবস্থায় মরতে বা মরুভূমিতে বাঁচতে বা জঙ্গলে পশুদের মধ্যে বাঁচতে স্বাধীন, কিন্তু যিনি সমাজে বসবাস করতে চাইবেন তাকে অবশ্যই শ্রমের মাধ্যমে জীবনধারণ করতে হবে। অন্যথায় তাকে পরজীবী হিসাবে বিবেচনা করা হবে, যিনি অন্যের শ্রমের ওপর জীবন ধারণ করেন।

o শ্রমই হচ্ছে মানব মর্যাদা ও নৈতিকতার ভিত্তি। কারণ কেবলমাত্র মুক্ত ও বোধশক্তিসম্পন্ন শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ তার পশুত্বকে অতিক্রম করে মানবতা ও ন্যায়বিচার বোধ অর্জন করেছে, তার পরিবেশকে পরিবর্তন করেছে এবং এই সভ্য দুনিয়া তৈরি করেছে। প্রাচীন আমলে ও সামন্তযুগেও শ্রমের সাথে যে কলঙ্ক যুক্ত করা হয়েছিল, এবং ‘শ্রমের মর্যাদা’ নিয়ে মোনাফেকি ধরণের কথাবার্তা চালু থাকা সত্ত্বেও বর্তমানেও সেই কলঙ্ক বিদ্যমান, শ্রমের বিরুদ্ধে সেই বেকুবি কুসংস্কারের দুটো উৎস রয়েছে: প্রথমটা হচ্ছে এই বিশ্বাস (ফলে সেটা প্রাচীন দুনিয়ার বৈশিষ্ট্যও ছিল) যে, সমাজের একটা অংশকে জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প দর্শন এবং অন্যান্য মানবিক অধিকারের সুযোগ করে দিতে স্বাভাবিকভাবেই সমাজের সবচাইতে বড়ো অংশটাকেই দাস হিসাবে কাজ করতে হবে। প্রাচীন সভ্যতার এই মৌলিক বিধানটি এর পতনের কারণ ছিল।

যে নগর একদিকে সুবিধাভোগী নাগরিকদের অলসতার দ্বারা দুর্নীতিগ্রস্থ ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল, অন্যদিকে অধিকার থেকে বঞ্চিত দাস দুনিয়ার অদৃশ্য কিন্তু নিরলস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ধ্বংসসাধণের চেষ্টা করা হচ্ছিল; এবং দাসরা তাদের দাসত্ব সত্ত্বেও সাধারণ শ্রমের মাধ্যমে নিপীড়নের বিরুদ্ধে পারষ্পরিক সহায়তা [মিচুয়াল এইড] ও সংহতির বোধ গড়ে তুলেছিল; সে নগর বর্বর লোকদের ধাক্কায় ভেঙ্গে পড়ে।

খ্রিষ্টধর্ম, দাসদের ধর্ম হিসাবে, অনেক পরে প্রাচীন দাসপ্রথাকে ধ্বংস করে নতুন দাসপ্রথা গড়ে তোলে। বৈষম্য এবং বিজয়ীর অধিকার এবং ঐশ্বরিক অনুগ্রহের ভিত্তিতে সুবিধাভোগ সমাজকে আবারো দুটো শিবিরে বিভক্ত করে ফেল: ‘জনতা’ এবং অভিজাত, ভূমিদাস এবং মালিক। দ্বিতীয় শিবিরের কাছে সেনাবাহিনী ও সরকারের মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল; ভূমিদাসের জুটেছিল জোরপূর্বক শ্রমের অভিশাপ। একই কারণ একই প্রভাব উৎপাদন করার কথা; অধোগামী অলসতার কারণে দুর্বল ও হতাশ অভিজাতরা ১৭৮৯ সালে বিপ্লবী ভূমিদাস ও শ্রমিকদের ধাক্কায় পতিত হন। ফরাসী বিপ্লব শ্রমের মর্যাদা ঘোষণা করেছিল এবং শ্রমের অধিকারকে আইনে পরিণত করেছিল। তবে সেটা কেবল আইনেই ঘটেছিল, কারণ বাস্তবে শ্রম দাসত্বেই আটকে থাকে। শ্রমের অবক্ষয়ের প্রথম উৎস, মানে মানুষের [ম্যান] রাজনৈতিক অসমতার ডগমা বা মতাদর্শ মহান বিপ্লবের ধাক্কায় ধ্বংস হয়ে পড়ে। ফলে অবক্ষয়ের দ্বিতীয় উৎসকে দায়ী করতে হবে; এবং সেটা হচ্ছে কায়িক ও মানসিক শ্রমের মধ্যে বিদ্যমান বিচ্ছিন্নতা [সেপারেশন], যা কিনা প্রাচীন বৈষম্যকে নতুন রূপে পুনরুৎপাদন করে এবং দুনিয়াকে দুটো শিবিরে বিভক্ত করে: একদিকে সুবিধাভোগী সংখ্যালঘু, তবে সেটা আইনগত দিক দিয়ে সুবিধাভোগী নয় বরঞ্চ পুজির দিক দিয়ে সুবিধাভোগী; অন্যদিকে সুবিধাবঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠরা, যারা আইনের কাছে আর বন্দী নয় বরঞ্চ ক্ষুধার কাছে বন্দী।

বর্তমানে শ্রমের মর্যাদা তাত্ত্বিকভাবে স্বীকৃত, এবং জনমত কর্মহীন জীবনধারণকে অসম্মানজনক বলে মনে করে। কিন্তু এটা প্রশ্নের কেন্দ্রে যায় না। সাধারণত মানব শ্রম এখনো দুটো এক্সক্লুসিভ বর্গে বিভক্ত: প্রথমটিতে আছেন কেবল বুদ্ধিজীবী ও ব্যবস্থাপকরা, সেখানে বিজ্ঞানী, শিল্পী, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, হিসাবরক্ষক, শিক্ষাবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের অধীনস্থ অভিজাত যারা শ্রম শৃঙ্খলা প্রয়োগ করেন। দ্বিতীয় বর্গ প্রচুর পরিমাণে শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত, যারা কিনা সৃজনশীল ধারণা বা বুদ্ধি প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত এবং যারা উপরোক্ত বুদ্ধিজীবী-ব্যবস্থাপক অভিজাতদের আদেশগুলো অন্ধভাবে ও যান্ত্রিকভাবে পালন করেন। শ্রমের এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন সুবিধাভোগী শ্রেণি, জনসাধারণ এবং সর্বোপরি সমগ্র সমাজের সমৃদ্ধি এবং নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি নিয়ে এসেছে।

সুবিধাভোগী শ্রেণির জন্য বিলাসবহুল আলসেমির জীবনযাপন ধীরে ধীরে নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবক্ষয়ের দিকে পরিচালিত করে। এটা পুরোপুরি সত্য যে, শিল্পী, বিজ্ঞানী অর্থাৎ মানুষের মানসিক বিকাশের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের অবসর একান্তই প্রয়োজনীয়। সৃজনশীল অবসরের পথ ধরেই আসে দৈনন্দিন শ্রমের স্বাস্থ্যকর অনুশীলন, যা কিনা ব্যক্তির সক্ষমতা ও পছন্দ অনুসারে উপার্জিত ও সামাজিকভাবে সরবরাহকৃত। মানবপ্রকৃতি এমনভাবে গঠিত যে মন্দের প্রতি প্রবণতা সর্বদাই বহিরাগত পরিস্থিতির দ্বারা তীব্র হয়, এবং ব্যক্তির নৈতিকতা ব্যক্তির নিজের ইচ্ছার চাইতে বেশি সে যে পরিবেশের ওপর বসবাস করে তার ওপর নির্ভর করে। এই ক্ষেত্রে অন্য সবকিছুর মতো সামাজিক সংহতির আইন অপরিহার্য: পূর্ণ সমতা ভিত্তিক স্বাধীনতা ব্যতীত ব্যক্তি বা সমাজের অন্য কোনো নৈতিকতা থাকতে পারে না। সবচেয়ে আন্তরিক গণতান্ত্রিক ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসিয়ে দিন; তিনি যদি শীঘ্রই সরে না দাড়ান তাহলে নিশ্চিতভাবেই তিনি একজন বজ্জাতে পরিণত হবেন। একজন জন্মগত অভিজাত (যদি তিনি কোনোভাবে তার আভিজাত্যপূর্ণ সিলসিলার জন্য লজ্জাবোধ করেন এবং জন্মগত সুবিধাগুলো ত্যাগ করেন) অতীতের গৌরবের জন্য আকুল হয়ে থাকেন, বর্তমানে অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকেন এবং ভবিষ্যতের অগ্রগতির চরম বিরোধীতা করেন। একই জিনিস বুর্জোয়াদের বেলাতেও ঘটে: পুজি ও অলসতার এই প্রিয় সন্তানটি অসততা, দুর্নীতি ও ধোঁকাবাজিতে তার অবসরকে নষ্ট করে, অথবা সেই শ্রমিক শ্রেণিকে দাস বানিয়ে রাখার নৃশংস হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে যে শ্রেণি কিনা একসময় তার বিরুদ্ধে ১৭৯৩ চাইতে ভয়াবহভাবে রুখে দাঁড়াবে।

শ্রমবিভাজনের ফলে শ্রমিকরা যে অনিষ্টের শিকার হন তা নির্ধারণ করা আরও সহজ: অন্যের জন্য কাজ করতে বাধ্য করা হয় কারণ তারা দারিদ্রতা ও দুর্দশদার মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছেন, সমস্ত যৌক্তিক পরিচর্চা ও শিক্ষাদীক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং ধর্মীয় প্রভাব দ্বারা নৈতিকভাবে আবদ্ধ হয়েছেন। তারা প্রতিরক্ষা, কোনো ধরণের উদ্যোগ এবং নিজের নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছা ছাড়াই জীবন পরিচালিত করেন। দুঃখ-দুর্দশার কারণে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে কখনো কখনো তারা বিদ্রোহ করেন, কিন্তু তাদের সহকর্মী বা অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে ঐক্যের অভাবে এবং যে আলোকিত চিন্তাভাবনার ওপর ক্ষমতা নির্ভর করে সেটার অভাবে, তারা প্রায়শই নেতাদের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন এবং বিক্রি হয়ে যান। অধিকাংশ সময় তারা বুঝতে পারেন না যে কে বা কী তাদের দুর্দশার জন্য দায়ী। নিরর্থক বা ব্যর্থ লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে তারা আবারো সেই পুরনো দাসত্বের বন্ধনে আটকা পড়ে যান।

এই দাসত্ব ততদিনই অব্যাহত থাকবে যতদিন না পর্যন্ত শ্রমিকদের সম্মিলিত প্রয়াসে পুঁজিবাদকে উৎখাত করা যাবে। তারা ততদিন পর্যন্ত শোষিত হবেন যতদিন পর্যন্ত শিক্ষা (যা কিনা একটি মুক্ত বা স্বাধীন সমাজে সবার জন্য সমানভাবে থাকবে) কেবলমাত্র সুবিধাভোগী শ্রেণির জন্মগত অধিকার হিসাব থাকবে; যতদিন পর্যন্ত এই সংখ্যালঘুরা একচেটিয়া ভাবে দখল করে রাখবে বিজ্ঞানভিত্তিক ও ব্যবস্থাপনামূলক কাজকারবার এবং জনগণ কেবল তাদের ওপর অর্পিত শোষকদের কাজগুলো মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। মানব শ্রমের এই অবক্ষয় ভয়াবহ অনিষ্টকর, এটি সমাজের নৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে দুষিত করে তোলে। ইতিহাস দেখায় যে, একটি অশিক্ষিত জনতা যার সহজাত বুদ্ধিমত্তাকে দমন করা হয় এবং প্রাত্যাহিক কঠোর পরিশ্রমের যান্ত্রিক গতানুগতিকতা যাদেরকে বর্বর করে তোলে, যারা কোনো একটা জ্ঞানার্জনের [এনলাইটেনমেন্ট] জন্য উদ্দেশ্যহীনভাবে হাতড়ে বেড়ান, সেই জনতা একটি নির্বোধ মব তৈরি করে, যারা অন্ধ হাঙ্গামা খোদ সমাজের অস্তিত্বকেই হুমকিতে ফেলে দেয়।

কায়িক ও মানসিক [বা বুদ্ধিবৃত্তিক] শ্রমের এই কৃত্রিম বিভাজনকে অবশ্যই একটি নতুন সামাজিক সংশ্লেষণের দিকে নিতে যেতে হবে। যখন বিজ্ঞানের লোক কায়িক শ্রম করবেন এবং কায়িক শ্রমের লোক বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দিবেন, তখন মুক্ত বৌদ্ধিক কাজ হয়ে উঠবে মানবজাতির গৌরবের বিষয়, হয়ে উঠবে এর মর্যাদা ও অধিকারের উৎস।

o […]

o বৌদ্ধিক ও স্বাধীন শ্রম অত্যাবশকীয়ভাবে সম্মিলিত বা যৌথ শ্রম হবে। প্রত্যেক ব্যক্তি একা বা যৌথভাবে কাজ করতে স্বাধীন থাকবেন। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই যে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজে, এমনকি বিজ্ঞানভিত্তিক বা শৈল্পিক উদ্যোগের ক্ষেত্রেও সকলের কাছে যৌথ শ্রমই অগ্রাধিকার পাবে [ব্যক্তিগতভাবে সর্বোত্তমভাবে সম্পাদিত কাজগুলোর বাইরে]। কেননা সমিতি বা যৌথতা দুর্দান্তভাবে প্রত্যেক শ্রমিকের কর্মদক্ষতাকে বাড়িয়ে দেয়; ফলে একটি উৎপাদনশীল সমিতির সহযোগী সদস্য কম সময়ে বেশি আয় করতে পারবেন। যখন স্বাধীন উৎপাদনশীল সমিতিগুলো (যা সমবায় ও শ্রমিক সংগঠনের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করবে) তাদের প্রয়োজন ও বিশেষ দক্ষতা অনুযায়ী স্বেচ্ছায় সংগঠিত হবে, তখন তারা জাতীয় সীমানাকে অতিক্রম করে একটি বৃহৎ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ফেডারেশন গঠন করবেন। এতে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সংসদ অন্তর্ভুক্ত থাকবে, সমিতি বা সংগঠনগুলো নিখুঁত ও বিস্তারিত বৈশ্বিক পরিসংখ্যান হাজির সরবরাহ করবে। যোগান ও চাহিদার সাথে মিল রেখে এই সংসদ বৈশ্বিক শিল্প-উৎপাদনকে বিভিন্ন দেশে বণ্টন ও বরাদ্দ দিবে। বাণিজ্যিক ও শিল্প সঙ্কট, বেকারত্ব, পুজির অপচয় ইত্যাদি আর মানবাজাতিকে যন্ত্রণা দিবে না; মানব শ্রমের মুক্তি বিশ্বের পুনরুত্থান ঘটাবে।

o জমি এবং সকল প্রাকৃতিক সম্পদ সবার সাধারণ সম্পত্তি। কিন্তু সেটা তারাই ব্যবহার করবেন যারা সেখানে নিজের শ্রম দ্বারা চাষ করবেন। বাজেয়াপ্তকরণ ছাড়া; শ্রমিক সংগঠন বা সমিতিগুলোর শক্তিশালী চাপের মাধ্যমে পুঁজি ও উৎপাদনের হাতিয়ার কেবল তাদের হাতেই পড়বে যারা নিজের শ্রমের দ্বারা সম্পদ উৎপাদন করেন।

o সমান রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অধিকারের পাশাপাশি নারীদের জন্য সমান বাধ্যবাধকতা।

o প্রাকৃতিক পরিবারের বিলুপ্তি নয়, বরঞ্চ আইন ও সম্পত্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত আইনি পরিবারের বিলুপ্তি। ধর্মীয় ও সিভিল বিবাহের পরিবর্তে থাকবে মুক্ত বিবাহ। সাবালক নর ও নারী নিজের ইচ্ছেমতো একত্রিত হওয়ার বা আলাদা হওয়ার অধিকার রাখেন। সমাজ তাতে বাধা দেয়ার বা জোরজবরদস্তি করার অধিকার রাখে না। উত্তরাধিকার প্রথার বিলুপ্তি ও সমাজ কর্তৃক শিশুদের শিক্ষার দায়ভার গ্রহণের মাধ্যমে বিবাহ বাতিলের অসাম্ভ্যবতার আইনি যুক্তিগুলো হাওয়াতে মিলিয়ে যাবে। একজন নারী ও পুরুষের মিলন অবশ্যই স্বাধীনভাবে হতে হবে, কেননা নৈতিক জোরের অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে বাছাইয়ের স্বাধীনতা [ফ্রি চয়েস]। বিবাহের মধ্যে নারী ও পুরুষ পরম স্বাধীনতা উপভোগ করবেন। সহিংসতা বা আবেগ বা অতীতের অধিকার কোনো কিছুই একজন কর্তৃক অন্যজনের স্বাধীনতায় আক্রমণকে ন্যায্যতা দেয় না, এবং এমন প্রতিটি আক্রমণই অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হবে।

o গর্ভকালীন মুহূর্ত থেকে বাচ্চা জন্মদানের আগ পর্যন্ত সেই নারী ও শিশুকে দেখভালের জন্য সম্প্রদায়ের সংগঠন ভর্তুকি দিবে। যে নারী বাচ্চার পরিচর্যা করতে চান ও মায়ের দুধ ব্যতীত অন্য খাবারে অভ্যস্ত করতে চান তাকেও ভর্তুকি দেয়া হবে।

o সন্তানদের যত্ন এবং শিক্ষার নির্দেশনা দেয়ার অধিকার পিতা-মাতাদের থাকবে, এই অধিকার থাকবে কমিউনের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের অধীনে যা কিনা পিতামাতার কাছ থেকে সন্তানকে দূরে সরিয়ে দেয়ার অধিকার ও বাধ্যবাধকতা বজায় রাখে; উদাহরণস্বরূপ, যারা নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করবেন, মনোবল ভেঙে দিবেন বা শিশুদের শারিরীক ও মানসিক বিকাশকে বাঁধা দিবেন তাদের থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হবে।

o শিশুরা যেমন তাদের পিতামাতার না, তেমনি সমাজেরও না। তারা তাদের নিজেদের ও খোদ নিজের ভবিষ্যতের মধ্যে নিহিত। নিজেদের যত্ন নেয়ার মতো বয়স না হওয়া পর্যন্ত শিশুদের অবশ্যই তাদের বড়োদের নির্দেশেই লালিত করা উচিত। এটা সত্য যে, পিতামাতারা হচ্ছেন প্রাকৃতিক শিক্ষক, কিন্তু যেহেতু খোদ কমিউনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে শিশুদের কি বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তার ওপর, সেহেতু কমিউনকেও শিক্ষক হয়ে উঠতে হবে। সাবালকদের স্বাধীনতা সম্ভব কেবল তখনই যখন মুক্ত সমাজ নাবালকদের শিক্ষার দেখভাল করবে।

o সেক্যুলার স্কুল চার্চকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। কেননা যেখানে ধর্মীয় শিক্ষা কুসংস্কার ও ঐশ্বরিক কর্তৃত্বকে বিলোপ হতে রক্ষা করে, সেখানে সেক্যুলার গণশিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও ইচ্ছাশক্তি এই ত্রয়ীর বিকাশের মাধ্যমে  তাদেরকে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যাওয়া। যুক্তি, সত্য, ন্যায়বিচার, সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা, ব্যক্তিগত মর্যাদার অনুভূতি যা কিনা অপরের মর্যাদার সাথে অবিচ্ছেদ্য, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সবার স্বাধীনতার প্রতি ভালবাসা, কর্মই যে অধিকারের ভিত্তি ও শর্ত তাতে বিশ্বাস – এগুলোই গণশিক্ষার মৌলিক নীতি হওয়া উচিৎ। সর্বোপরি শিক্ষা মানুষের ভেতর প্রথমেই মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করবে, এবং পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিবে। শিশুর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে কর্তৃপক্ষ স্বাধীনতার দিকে আরো বেশি করে পথ দেখাবেন, ফলে কৈশোরে তিনি পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে উঠবেন এবং ভুলে যাবেন কীভাবে শৈশবে তাকে কর্তৃত্বের কাছে অনিবার্যভাবে নিজেকে সমর্পন করতে হয়েছিল। মানব মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা, যা কিনা স্বাধীনতার বীজ, তা প্রতি মুহূর্তে উপস্থিত থাকতে হবে, এমনকি যখন শিশুদেরকে কঠোরভাবে নিয়মনিষ্ঠ করে তোলা হবে তখনও। সকল নৈতিক শিক্ষার সারমর্মটি হলো এই যে: মানবতার প্রতি সম্মান শিশুদের হৃদয়ে গেঁথে দিলে আপনি তাকে ভালো মানুষ বানাতে পারবেন…

o সাবালকত্বে পৌঁছানো মাত্র তরুণ/তরুণীদেরকে স্বায়ত্বশাসিত ও স্বাধীন বলে ঘোষণা করা হবে এবং নিজে যা ভালো মনে করবেন তাই করার জন্য তারা স্বাধীন থাকবেন। এর বিনিময়ে সমাজ তাদের কাছ থেকে তিনটা বাধ্যবাধকতা পূরণ করার প্রত্যাশা রাখবে: তিনি স্বাধীন বা মুক্ত থাকবেন, নিজের শ্রমের মাধ্যমে জীবনধারণ করবেন এবং অন্যের স্বাধীনতাকে সম্মান দেখাবেন। যেহেতু বর্তমান সমাজকে যেসকল অপরাধ ও দুষ্কর্ম দুষিত করে তুলছে সেগুলো সমাজের মন্দ সংগঠনের কারণেই, সেহেতু এটা নিশ্চিত যে, যুক্তি, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, মানবতার প্রতি সম্মান এবং পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ মঙ্গলদায়ক হবে। এবং সেখানে অশুভ বা মন্দ হবে একটি ব্যতিক্রম, যেগুলো একটি আলোকিত ও মানবিক জনমতের বিস্তৃত প্রভাবের ফলে ধীরে ধীরে আরো কমে যাবে।

o প্রবীণ, অসুস্থ ও দুর্বলরা সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার উপভোগ করবেন এবং সমাজই তাদের ভার গ্রহণ করবেন।

আর্টওয়ার্ক: প্যারিস কমিউন
সংগঠন: গ্রাঞ্জার

১১) বিপ্লবী নীতি। এটা আমাদের গভীর বিশ্বাস যে, যেহেতু সকল দেশের স্বাধীনতা অবিভাজ্য সেহেতু জাতীয় বিপ্লবগুলো আন্তর্জাতিক রূপ ঘটবে। যেহেতু ইউরোপ ও বিশ্ব প্রতিক্রিয়া একীভূত থাকবে, সেহেতু আর কোনো বিচ্ছিন্ন বিপ্লব হবে না, বরঞ্চ একটি সর্বজনীন বিশ্বব্যাপী বিপ্লব সংঘটিত হবে। সুতরাং দেশগুলোর ভেতর যে বিশেষ স্বার্থ, অহংকার, আত্মাভিমান, হিংসা এবং শত্রুতা রয়েছে তা বিপ্লবের একীভূত, সাধারণ ও সর্বজনীন স্বার্থে রূপান্তরিত হবে। কেবল এটাই পারবে সকল দেশের সংহতির মাধ্যমে প্রতিটি দেশের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে। আমরা এও বিশ্বাস করি যে, বিশ্বের প্রতিবিপ্লবী এবং রাজা, পাদ্রী, অভিজাত ও বুর্জোয়াদের জোট আধুনিক কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের সকল ভয়ঙ্কর হাতিয়ারে সজ্জিত হয়ে বিশাল বাজেট, স্থায়ী সেনাবাহিনী, দুরূহ আমলাতন্ত্রের ওপর ভর করে একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তি গঠন করবে। প্রকৃতপক্ষে, এই বৃহৎ প্রতিবিপ্লবী জোটকে পরাস্ত করা যাবে কেবলমাত্র যুগপৎ বিপ্লবী জোট ও সভ্য দুনিয়ার সকলের অংশগ্রহণে তৈরি এক বিরাট শক্তির মাধ্যমে; এই বৃহৎ প্রতিবিপ্লবী জোটের বিরুদ্ধে একক জনতার বিচ্ছিন্ন বিপ্লব দিয়ে সফলকাম হওয়া যাবে না। এ ধরণের বিপ্লব হবে নির্বুদ্ধিতা, বিচ্ছিন্ন দেশের জন্য হবে একটি বিপর্যয় এবং এরফলে বাকি দেশগুলোর বিরুদ্ধে এটি একটি অপরাধ হবে। এখান থেকে বলা যায়, একক জনগোষ্ঠীর অভ্যুত্থান কেবল নিজের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে হবে না, বরঞ্চ পুরো বিশ্বের দিকে তাকাতে হবে। এটি একটি বিশ্বব্যাপী কর্মসূচী দাবি করে যেন তা পুরো বিশ্বের স্বার্থকে অন্তর্ভুক্ত করে। জাতীয়তা নির্বিশেষে ইউরোপের জনগণের আবেগকে আরও উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে এই কর্মসূচীটি কেবল হতে পারে সামাজিক ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী।

সংক্ষেপে বলা যায়, সামাজিক ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে:

রাজনৈতিকভাবে: রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক অধিকার, বিজয়ের অধিকার এবং কূটনৈতিক অধিকারের বিলুপ্তি। এর লক্ষ্য হচ্ছে ঐশ্বরিক ও দুনিয়াবি বন্ধন থেকে ব্যক্তি ও সংগঠনের মুক্তি; এটা সমস্ত বাধ্যতামূলক ইউনিয়ন, এবং কমিউন জড়ো করা প্রদেশ এবং দখলকৃত দেশ জড়া করা রাষ্ট্রের পূর্ণ ধ্বংস কামনা করে। পরিশেষে এর জন্য প্রয়োজন সামরিক, আমলাতান্ত্রিক, প্রশাসনিক, বিচারবিভাগীয় ও আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো সহ কেন্দ্রীভূত, আগ্রাসী ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের আমূল অবসান। সংক্ষেপে বিপ্লবের লক্ষ্য হচ্ছে: সকলের জন্য স্বাধীনতা, যেমন ব্যক্তির জন্য তেমনি যৌথ বা সম্মিলিত সংস্থা, সমিতি, কমিউন, প্রদেশ, অঞ্চল ও রাষ্ট্রের জন্য; এবং ফেডারেশনের মাধ্যমে সেই স্বাধীনতার পারষ্পরিক নিশ্চয়তা প্রদান।

সামাজিকভাবে: এটা অর্থনৈতিক সমতার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমতার নিশ্চয়তা কামনা করে। এটা ব্যক্তির সহজাত পার্থক্যের অপসারণ নয়, বরঞ্চ এটি জন্ম থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির সামাজিক অধিকারের সমতা। বিশেষত সাবালক হওয়ার আগ পর্যন্ত ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সকল শিশুর জীবনধারণ, অবলম্বন শিক্ষা ও সুযোগের সমান উপায় নিশ্চিত করা; এবং সাবালকত্বের পর যেন নিজের শ্রমের মাধ্যমে নিজের মঙ্গল তৈরি করা যায় সেই উদ্দেশ্যে সমান সম্পদ ও সুবিধা প্রদান।

সহুল আহমদ

সহুল আহমদ, লেখক, অনুবাদক ও অ্যক্টিভিস্ট। গবেষণার পাশাপাশি সমকালীন বিষয়াবলীর বিশ্লেষক। জন্ম সিলেটে, ১৯৯১ সনে। পড়াশোনা করেছেন শাবিপ্রবিতে, পরিসংখ্যান বিভাগে। একাধিক জার্নাল সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত বই: মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের অপব্যবহার; জহির রায়হান: মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক ভাবনা; সময়ের ব্যবচ্ছেদ (সহ-লেখক সারোয়ার তুষার)। অনুবাদ: ইবনে খালদুন: জীবন চিন্তা ও সৃজন।