অরাজ
আর্টওয়ার্ক: নিউ এরা শিল্পী: উইলিয়াম বেল স্কট সূত্র: দ্য কনভারসেশন
প্রচ্ছদ » মিখাইল বাকুনিন।। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংঘের নীতিমালা প্রসঙ্গে

মিখাইল বাকুনিন।। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংঘের নীতিমালা প্রসঙ্গে

অনুবাদ : খোইরোম রুধির

মিখাইল বাকুনিন
(১৯১৪-১৮৭৬)


L’Égalité
, ৭ই আগস্ট, ১৮৬৯

নতুন সদস্য গ্রহণের বেলায় আন্তর্জাতিক এটি কখনোই জিজ্ঞেস করে না যে সে একজন নাস্তিক না আস্তিক, সে কি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত না কি না। আন্তর্জাতিক শুধু এইটাই জিজ্ঞেস করে– আপনি কি একজন শ্রমজীবী মানুষ? আর যদি শ্রমজীবী না হয়ে থাকেন তবে আপনি কি আন্তরিকভাবে শুধুমাত্র শ্রমজীবীদের স্বার্থকেই সমর্থন করতে চান, এর মূলনীতিগুলোর সাথে সংঘর্ষিক সকল স্বার্থ পরিত্যাগ করে?

আপনি কি মনে করেন এই শ্রমজীবী মানুষেরা যারা সারা বিশ্বের সকল সম্পদের প্রধান উৎপাদক; যারা এই সভ্যতার নির্মাতা এবং বুর্জোয়াদের ভোগ করা যাবতীয় স্বাধীনতাই আসলে যাদের অর্জন; সেই তারাই দারিদ্র্য, তাচ্ছিল্য আর দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকুক? শ্রমজীবী মানুষ যে সকল দুর্দশার কবলে পড়ছে তার মূল উৎস যে তাদের দারিদ্র্য সেটা কি আপনি বুঝতে পারেন? আপনি কি বুঝতে পারেন যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বিশেষ করে পুঁজিবাদের জোয়ালের তলে অর্থাৎ বুর্জোয়াদের কাছে নিজের শ্রমকে সমর্পণ করার বাধ্যতামূলক পরিণতি হিসেবেই সমগ্র দুনিয়াব্যাপী এই শ্রমজীবী মানুষদের আবির্ভাব ঘটেছে?

প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়াদের নিজ নিজ অর্থনৈতিক অবস্থানের অনিবার্য পরিণতিই হচ্ছে তাদের মধ্যে অমোচনীয় এক বৈরিতার সম্পর্ক, তা কি আপনি বুঝতে পারেন? শ্রমিকের কল্যাণ ও স্বাধীনতার সাথে যে বুর্জোয়া শ্রেণির সম্পদের একটি বৈপরিত্যের সম্পর্ক রয়েছে তা কি আপনি বুঝেন? কেননা, এই বিপুল ধন-সম্পদ শুধুমাত্র শ্রমের শোষণ ও অধিগ্রহণের মধ্য দিয়েই গড়ে তোলা যায়। আর এই কারণেই শ্রমজীবী জনতার অগ্রগতি ও মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যেই একটি বিশেষ শ্রেণি হিসেবে বুর্জোয়াদের বিলোপ করতে হবে…. আপনি কি এটা বুঝেন যে কোনো শ্রমিক সে যতই বুদ্ধিমান অথবা উদ্যমী হোক না কেন একা তার পক্ষে বুর্জোয়া শ্রেণির এই সুসংগঠিত শক্তির বিপক্ষে লড়াই করা সম্ভব নয় যেই ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখে রাষ্ট্রগুলো।

অগ্রসর সকল শ্রেণি, সমস্ত পুঁজিবাদী ও সবগুলো রাষ্ট্র মিলিয়ে যেই ভয়ঙ্কর জোট গড়ে উঠেছে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিচ্ছিন্ন একটি শ্রমিক সংঘের পেরে উঠা সম্ভব নয়, তা সেই শ্রমিক সংঘ স্থানীয়ই হোক বা জাতীয় পর্যায়েই, এমনকি যদি বৃহত্তম ইউরোপীয় দেশগুলোর একটিতেও এই সংঘ গড়ে ওঠে— এ ব্যাপারটি কি আপনি বুঝতে পারেন? আপনি কি এটা বুঝেন যে, এই জোটের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র তখনই বিজয় সম্ভব যখন সমস্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংঘগুলো বিশ্বব্যাপী একটি একক সংঘরূপে একত্রিত হবে, আর তাই হচ্ছে এই মহান আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংঘ।

আপনি যদি সর্বাঙ্গে উপলব্ধি করেন ও মন থেকেই এই সবকিছু চেয়ে থাকেন তাহলে আপনার জাতিগত আনুগত্য ও ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে এসে আমাদের সাথে যোগ দিন, আপনাকে সাদরে গ্রহণ করা হবে। কিন্তু আপনাকে প্রথমে অঙ্গীকার করতে হবে যে—

ক) পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমের এই লড়াইয়ে অর্থাৎ বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের এই অর্থনৈতিক সংগ্রামের জন্য নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থের পাশাপাশি নিজের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে আমাদের সংঘের চূড়ান্ত স্বার্থকেই উপরে রাখা।

খ) ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কখনোই বুর্জোয়াদের সাথে আপোষ না করা।

গ) সাধারণ সদস্যের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজের অহমিকাকে তুষ্ট করা থেকে বিরত থাকা। এমনটি যদি করে থাকেন তাহলে তাহলে আপনাকে প্রলেতারিয়েতের শত্রু, একজন বুর্জোয়া হিসেবে বিবেচনা করা হবে। বুর্জোয়ারা সমবেত জনতা এড়িয়ে চলে আর প্রলেতারিয়েতরা চায় যারা শ্রম দেয় ও পুঁজিবাদের হাতে শোষণের শিকার হয় তাদের সংহতি।

ঘ) শ্রম-সংহতির প্রতি সর্বদা আস্থাবান থাকা। এই সংহতির সাথে ন্যূনতম বিশ্বাসঘাতকতাকেও একজন শ্রমিক যতটুকু অপরাধ করতে সক্ষম তার মধ্যে সর্বোচ্চ অপরাধ বলে বিবেচনা করবে আন্তর্জাতিক। সংক্ষেপে বললে, কোনো বাছবিচার ছাড়াই আপনাকে আমাদের সাধারণ বিধি-বিধানগুলো পুরোপুরিভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এগুলোকে মেনে চলার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে।

আমরা মনে করি যে আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠাতারা তাদের কর্মসূচি থেকে সকল ধর্মীয় ও জাতীয় প্রশ্নকে পরিহার করতে যথেষ্ট ধীশক্তির প্রমাণ দিয়েছেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের দ্ব্যর্থহীন ধর্মবিরোধী ও জাতীয় বিশ্বাসগুলো আন্তর্জাতিকের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা থেকে বিরত ছিলেন। কারণ তাদের প্রধান চিন্তার বিষয় ছিল সভ্য জগতের সকল নিপীড়িত ও শোষিত শ্রমিকদেরকে একটি একক প্রয়াসের মধ্য দিয়ে একত্রিত করা। তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবেই এমন একটি সাধারণ বনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করতে হতো এবং প্রণয়ন করতে হতো এমন একগুচ্ছ মৌলিক নীতিমালা  যা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে সকল শ্রমিকের কাছে। এমনকি অসংখ্য শ্রমিকের মনকে এখনো আক্রান্ত করে চলা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যেকোনো প্রকার বিকারে তারা সংক্রমিত হওয়ার পরও।

কোনো গোষ্ঠী বা দলের ধর্মবিরোধী ও রাজনৈতিক কর্মসূচিকে আন্তর্জাতিকের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত  করা আর ইউরোপীয় শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করার মধ্যে ফারাক বিস্তর। এতে বরং বর্তমানে শ্রমিকরা যতটা না বিভক্ত হয়ে আছে তারচেয়েও অনেক বেশি বিভক্ত হয়ে পড়ত। শ্রমিকদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ধর্মযাজকেরা, সরকার, বুর্জোয়া দলগুলো— এমনকি এদের মধ্যে সবচেয়ে বামঘেঁষা দলগুলোও যতপ্রকার কুমন্ত্রণা আছে শ্রমিকদের কানে বেশ সফলভাবেই সেগুলো প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছে, যার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রমিকদের মগজ-ধোলাই যাতে তারা নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অগ্রসর শ্রেণিগুলোর জন্য স্বেচ্ছায় মজুর খাটে।

এছাড়াও বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী জনতার উৎপাদন-শিল্প, রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্রমবিকাশের এখনো এত বেশি মাত্রাপার্থক্য রয়েছে যে একটি একক রাজনৈতিক ও ধর্মবিরোধী কর্মসূচির ভিত্তিতে তাদের একত্রিত করা দুরূহ ব্যাপার। এমন একটি কর্মসূচিকে সদস্যপদ গ্রহণের চূড়ান্ত শর্ত করা মানে হচ্ছে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী তৈরি করা, একটি সর্বজনীন সংঘ প্রতিষ্ঠা করা নয়। এটি গোড়াতেই আন্তর্জাতিককে ধ্বংস করে দিতে পারত।

সকল প্রকার রাজনৈতিক প্রবণতাকে অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে এবং শুধু আনুষ্ঠানিকভাবেই পরিহার করার পেছনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এখন পর্যন্ত জনগণের পক্ষে কোনো প্রকৃত  রাজনীতির অস্তিত্ব ছিল না। এই “জনগণ” বলতে আমরা বুঝাচ্ছি নিম্ন শ্রেণির মানুষকে, “ইতর জনতা”, দরিদ্রতম শ্রমিকদের যাদের শ্রমের উপর বিশ্ব টিকে আছে। শুধুমাত্র সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির রাজনীতিই বিদ্যমান ছিল। যারা আধিপত্য অর্জনের এক অশেষ লড়াইয়ে জনগণের শারীরিক পরাক্রমকে ব্যবহার করেছে একে অপরকে উৎখাত ও প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে। জনগণ শুধু এক পক্ষ ছেড়ে আরেক পক্ষকে সমর্থন করে গেছে এই নিষ্ফল আশায় যে, অন্তত এগুলোর মধ্যে কোনো এক রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়তো তাদেরকে শতবর্ষ পুরাতন এই দারিদ্র্য ও দাসত্ব থেকে মুক্ত করবে। এমনকি মহান ফরাসি বিপ্লবও তাদের অবস্থার কোনো বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটায়নি। এর অভিজাতদের হঠিয়ে দিয়েছে স্রেফ বুর্জোয়াদের স্থান করে দেয়ার জন্য। জনগণকে আর ভূমিদাস বলে ডাকা হয় না। তাদেরকে মুক্ত মানুষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং আইনত স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করা নাগরিকে সকল অধিকার তাদের দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা দারিদ্র্য-পীড়িত ভূমিদাসই থেকে গেছে।

শ্রমজীবী জনতা ততদিন ক্রীতদাসই রয়ে যাবে যতদিন পর্যন্ত তারা বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকবে। তা সে সংরক্ষণশীল রাজনীতিই হোক কি প্রগতিশীল, অথবা বিপ্লবী ভেক ধরে থাকা রাজনীতিই হোক। যে মাত্রা বা রঙেরই হোক না কেন সকল বুর্জোয়া রাজনীতির একটাই উদ্দেশ্য, আর তা হচ্ছে— আজীবনের জন্য বুর্জোয়াদের আধিপত্য বজায় রাখা। আর বুর্জোয়াদের আধিপত্য মানেই প্রলেতারিয়েতের দাসত্ব।

প্রথম আন্তর্জাতিকের গঠন, ১৮৬৪

আন্তর্জাতিকের কী করা উচিত ছিল? শ্রমজীবী জনতাকে সকল বুর্জোয়া রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই হতো তাকে, এবং সকল প্রকার বুর্জোয়া রাজনৈতিক কর্মসূচিকেই এর কর্মসূচি থেকে বাদ দিতে হতো। আন্তর্জাতিক যখন প্রথম সংগঠিত হচ্ছিল তখন চার্চ, রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও বুর্জোয়া— এই প্রতিষ্ঠানগুলোই মূল চাপ প্রয়োগ করেছিল। এরপরই রয়েছে বিশেষত উদারনৈতিক বুর্জোয়ারা। এরা নিঃসন্দেহে অন্যদের তুলনায় মানবিক ছিলেন। কিন্তু তারাও জনগণের শোষণের উপরই নির্ভরশীল এবং তাদের আসল উদ্দেশ্যই ছিল তাদের প্রতিপক্ষকে পরাহত করা, যাতে শ্রমশোষণের উপর নিজেদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিককে প্রথমেই তার পথ পরিষ্কার করে নিতেই হতো। যেহেতু মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে চলা সকল রাজনীতিই প্রতিক্রিয়াশীল উপাদানগুলো দ্বারা আক্রান্ত, আন্তর্জাতিককে প্রথমেই তার নিজেকে সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে আনতে হতো, আর তারপর বুর্জোয়া সামাজিক ব্যবস্থার ধ্বংসস্তূপের উপর আন্তর্জাতিকের নতুন রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হতো।

 


L’Égalité
, ১৪ই আগস্ট, ১৮৬৯

এই কারণগুলোর জন্যেই আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠাতারা এই সংঘকে দাঁড় করিয়েছিল পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে। তাদের যুক্তি ছিল যে, যখন এই শ্রমিকেরা তাদের উদ্দেশ্যের ন্যায্যতা ও একই সাথে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে  আত্মবিশ্বাস অর্জন করে মালিক শ্রেণির বিরুদ্ধে তাদের সর্বজনীন লড়াইয়ে সহ-শ্রমিকদের সাথে যুক্ত হয় তখন ঘটনা প্রবাহ ও লড়াইয়ের তীব্রতা খুব দ্রুতই তাদেরকে আন্তর্জাতিকের সকল রাজনৈতিক, সমাজতান্ত্রিক ও দার্শনিক মূলনীতিগুলো উপলব্ধি করতে প্রবুদ্ধ করবে। যে মূলনীতিগুলো আসলে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন মাত্র।

রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই মূলনীতিগুলোর অনিবার্য ফলাফল হচ্ছে সকল প্রকার প্রাদেশিক রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন এবং তাদের ধ্বংসাবশেষের উপর সকল জাতীয় ও উৎপাদনশীল গোষ্ঠীর মহান আন্তর্জাতিক মৈত্রীর গোড়াপত্তন। দার্শনিকভাবে এর গুরুত্ব মানব সমাজের সুখ, সমতা, স্বাধীনতা ও ন্যায্যতার উপলব্ধি থেকে কোনো অংশে কম নয়। সমস্ত ধর্মীয় ফ্যান্টাসি ও স্বর্গলোকে উন্নত জীবনের ফাঁপা স্বপ্নকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে এই আদর্শগুলো।

কিন্তু রাষ্ট্র ও পৌরোহিত্যের নীতিভ্রষ্ট্র মতবাদ ও প্রপাগান্ডার প্রভাবে যাদের যাদের মন কলুসিত হয়ে আছে সেইসকল অজ্ঞ শ্রমিকদের কাছে এই দুই চূড়ান্ত লক্ষ্যকে সময়ের আগেই তুলে ধরলে নিশ্চিতভাবেই তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে, এবং এর প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাবে তাদের মনে। এমনকি তারা টেরও পাবে না যে এই লক্ষ্যগুলো সত্যিকার অর্থে তাদের স্বার্থের প্রকৃত অভিব্যক্তি। এই লক্ষ্যগুলোর পশ্চাদ্ধাবন যে তাদের অন্তরে লালিত চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব পরিণতি দিতে প্ররোচিত করবে সেইটাও তারা বুঝতে চাইবে না। সুনির্দিষ্টভাবে বললে যে সকল ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোঁড়ামির জন্যে তারা এই সকল ধারণাগুলোকে পদদলিত করে সে সকল গোঁড়ামিই যে তাদের দীর্ঘায়িত দারিদ্র্য ও দাসত্বের মূল কারণ সেইটাও তারা বিশ্বাস করতে চাইবে না।

প্রথম আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস, ১৮৬৬

সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির সংস্কারগুলোকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। জনসাধারণের সংস্কার তাদের নিজেদেরই স্বার্থবিরোধী হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু বুর্জোয়াদের সংস্কারগুলো পুরোপুরিভাবে তাদের শ্রেণিস্বার্থের উপরই প্রতিষ্ঠিত। জনগণ চায়, কিন্তু জানে না। বুর্জোয়ারা জানে, কিন্তু চায় না। এই দুইয়ের মধ্যে কে দুরারোগ্য? অবশ্যই বুর্জোয়ারা।

সাধারণ নিয়ম হচ্ছে আপনি শুধুমাত্র তাদেরকেই উপলব্ধি করাতে সক্ষম হবেন যারা তাদের সহজাত প্রবৃত্তি ও করুণ পরিস্থিতির কারণে ইতোমধ্যেই অনুভব করে যে তাদের অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। কিন্তু যারা আদৌ সেই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না তাদেরকে কখনোই উপলব্ধি করাতে সক্ষম হবেন না। যারা এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চায় কিন্তু  সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক স্বভাবের কারণে যারা আপনার আদর্শের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অন্য এক আদর্শ দ্বারা আকৃষ্ট, তাদেরকেও আপনি উপলব্ধি করাতে সক্ষম হবেন না।

টাকার পাগল কোনো অভিজাত লোক কিংবা কোনো বুর্জোয়া যার একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা হচ্ছে আভিজাত্যের স্বর্ণশিখরে উঠা কিংবা কোনো শ্রমিক যে মনেপ্রাণে একজন বুর্জোয়া হতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদের কাছ থেকে আপনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে সমর্থন আদায় করতে পারবেন না। কোনো বুদ্ধিমান উন্নাসিক লোক কিংবা স্বঘোষিত কোনো ‘মহাপণ্ডিত’ যে কিনা গুটি কয়েক বই অর্ধেক হজম করে তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বহর দেখিয়ে বেড়াচ্ছে তাকে আপনি দলে টানতে পারবেন না। এই লোকগুলো নিরক্ষর জনতার দিকে অবজ্ঞা ও ঔদ্ধত্য নিয়ে আস্ফালন প্রদর্শন করে এবং নিজেদেরকে নতুন এক আধিপত্যবাদী শ্রেণি গঠনে ব্রত বলে কল্পনা করে।

কোনো প্রকার যুক্তি কিংবা বিতর্কই এই নৈতিকভাবে অধঃপতিতদের পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে না। তাদের প্রতিরোধ পার হয়ে যাবার একমাত্র কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে কর্ম তৎপরতা— বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তদের অবস্থান, শোষণ ও আধিপত্য কায়েমের পথ বন্ধ করে দেওয়া। শুধুমাত্র সামাজিক বিপ্লবই সকল অসমতা দূর করতে পারবে এবং তাদেরকে নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষে রূপান্তরিত করে সমতা ও সংহতির মধ্যে সুখ খোঁজায় নিবৃত্ত করতে পারবে।

কঠোর পরিশ্রমী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। কঠোর পরিশ্রমী শ্রমিক বলতে আমি তাদেরকে বুঝাচ্ছি যারা শ্রমের ভারে ভারাক্রান্ত। সেই সকল শ্রমিক যাদের অবস্থান এতটাই অন্যের অধীনস্ত যে তারা জীবনে ভালো কোনো পদমর্যাদা প্রাপ্তির প্রত্যাশাও করতে পারে না(অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ব্যতীত)। এই ক্যাটাগরিতে আরও আছে সেসকল বিরল ও মহৎ  শ্রমিকরা যারা শ্রমিক শ্রেণির বাইরে উন্নীত হওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শ্রমিক ভাইদের সাথে কষ্টভোগ ও বুর্জোয়াদের বিপক্ষে সংগ্রাম করাকেই বেছে নিয়েছে। এমন শ্রমিকদের রূপান্তরের প্রয়োজন নেই। তারা ইতোমধ্যেই প্রকৃত সমাজতান্ত্রিকে পরিণত হয়েছেন।

প্রাত্যহিক কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত, অবসন্ন বিপুল শ্রমিক জনতা তাদের শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ। নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক অপপ্রচার সত্ত্বেও এই শ্রমিক জনতারা সমাজতান্ত্রিক, যদিও তাদের সেই সম্পর্কে পূর্ব কোনো ধারণা নেই। তাদের সামাজিক অবস্থানের জন্যই তারা সকল বৈজ্ঞানিক ও বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিকদের চেয়েও অধিক সমাজতান্ত্রিক। বস্তুগত শর্ত ও অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তারা সমাজতান্ত্রিক হয়ে উঠে যেখানে দ্বিতীয় ক্যাটাহরির লোবেরা শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেই সমাজতন্ত্রিক। বাস্তব জীবনে বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে বস্তুগত প্রয়োজন অধিক শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে যা সর্বদা ও সবখানেই সত্তার অভিব্যক্তি, জীবনের ধারাবাহিক বিকাশের প্রতিবিম্ব। কিন্তু এটি কখনোই প্রধান মূলনীতি নয়…।

শ্রমিকদের শুধুমাত্র যে জিনিসটির কমতি আছে তা হলো সমাজতান্ত্রিক ভাবনা, বাস্তবতা কিংবা সমাজতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কিত জ্ঞান নয়। প্রত্যেক শ্রমিকই মনের গহীনে বস্তুগত ধন-সম্পদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সুপ্ত বাসনা লালন করে। তারা জীবনভর এমন এক মুক্ত পরিবেশে জীবনযাপন ও কাজ করতে চায় যা প্রত্যেক মানুষের জন্য ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে অর্জিত। শ্রমজীবী জনতার কঠোর শোষণকে ভিত্তি করে যে সমাজ কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে সেই সমাজ কাঠামোর ভেতরে থেকে সম্ভবত এই চিন্তা প্রক্রিয়াকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। যেহেতু বিরাজমান এই সমাজ বিন্যাসের উৎখাতের মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জিত হবে সেহেতু প্রত্যেক উদ্যমী শ্রমিক মাত্রই একজন সম্ভাব্য বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক।

প্রত্যেক পরিশ্রমী শ্রমিকের মনে সমাজতান্ত্রিক ভাবনার বীজ অবচেতনে রোপিত হয়ে থাকে। সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যই হচ্ছে প্রত্যেক শ্রমিককে তার চাহিদা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন করে তোলা, তার মধ্যে এক বোধের উন্মেষ ঘটানো যা তার অন্তর্নিহিত আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করবে। শ্রমজীবী মানুষের এই বোধ তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভবের স্তরে উন্নীত হওয়া মাত্রই তাদের ইচ্ছা শক্তি একাগ্রতা পেতে বাধ্য হবে এবং তাদের ক্ষমতা হয়ে উঠবে অপ্রতিরোধ্য। এটি সর্বজনবিদিত যে অজ্ঞতা এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোঁড়ামি শ্রমজীবী জনতার মধ্যে বোধশক্তির বিকাশকে স্লথ করে। এই অজ্ঞতাকে কীভাবে দূর করা যায়? কীভাবে মূল উপড়ে ফেলা যায় এই গোঁড়ামির? শিক্ষার মাধ্যমে? প্রচারণার মাধ্যমে?

প্রচারণা ও শিক্ষা মাধ্যম হিসেবে চমৎকার কিন্তু অপর্যাপ্ত। যে শ্রমিকরা একাকী জীবন-যাপন করে এবং শ্রম ও নিত্যনৈমিত্তিক কার্যাবলী দ্বারা ভারাক্রান্ত তারা আলাদা করে নিজের শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করতে পারে না। আর কারাইবা এই প্রচার কার্য সম্পাদন করবে? সেই গুটি কয়েক সমাজতান্ত্রিক যারা সম্প্রতি বুর্জোয়া পরিবেশ থেকে উঠে এসেছে? তারা নিঃসন্দেহে নিবেদিত প্রাণ এবং মহৎ অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত জনতাকে যথেষ্ট পরিমাণে বোঝানোর ক্ষেত্রে সংখ্যায় তারা খুবই অপ্রতুল ।

তাছাড়া শ্রমিকদের সতর্কভাবে বড়জোর সেইসব বুদ্ধিজীবীদের প্রচারণাকেই আমলে নিতে হবে যারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও প্রতিকূল এক সামাজিক পরিবেশ থেকে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিকের সংবিধানের প্রস্তাবনা এটা বলে যে, “শ্রমিকদের বন্ধনমুক্তির ভার শ্রমিকদেরই হাতে”। এটি পরম সত্য। আমাদের মহান আন্তর্জাতিকের মূলনীতিও এটি। কিন্তু শ্রমিকরা এইসব তত্ত্ব সম্পর্কে কমই জানে এবং তারা এই সকল মূলনীতির তাৎপর্য বুঝতে অপারগ। এইসব তত্ত্ব তারা শুধুমাত্র বাস্তব জীবনে চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করতে পারে– কার্যকর কর্ম-তৎপরতার মাধ্যমে বন্ধন-মুক্তি। এর জন্য প্রয়োজন মনিবদের বিপক্ষে শ্রমিকদের সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির পূর্ণ সংহতি। তা হতে পারে ট্রেড ইউনিয়ন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে [স্ট্রাইক ফান্ড[i]]।


L’Égalité
, ২১শে আগস্ট, ১৮৬৯

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই যদি আন্তর্জাতিক যোগদানকৃত শ্রমিকদের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ধারণাগুলোকে বরদাস্ত করে থাকে তাহলে এর মানে এই নয় যে এই ধারণাগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক কোনোভাবে উদাসীন। আমি ইতোমধ্যেই দেখিয়েছি যে, আন্তর্জাতিক এইক্ষেত্রে উদাসীন নয়। সদস্যগণ কর্তৃক এইসব প্রতিক্রিয়াশীল ধারণার চর্চা করার ফলে আন্তর্জাতিকের মূলনীতিসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর সাথে সাথে খোদ আন্তর্জাতিকের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয়।

আমি আবারও বলছি, আন্তর্জাতিকের প্রতিষ্ঠাতারা এই সহনশীল পন্থা অবলম্বনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা যুক্তি দেখান যে, লড়াইয়ে যুক্ত হওয়া কোনো শ্রমিক বাধ্যতামূলকভাবেই উপলব্ধি করবে যে প্রতিক্রিয়াশীলতা ও তার লালন করা সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটা অসংযত বৈরিতার সম্পর্ক রয়েছে। আর এটা উপলব্ধি করার পর প্রাকশ্যে সে নিজেকে সমাজতান্ত্রিক বলে ঘোষণা করবে।

বুর্জোয়াদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আবার ভিন্ন। তাদের সমস্ত স্বার্থ সমাজের অর্থনৈতিক রূপান্তরের বিরুদ্ধে। তাদের চিন্তাধারাও যদি এটির বিরুদ্ধে হয় তাহলে তারা প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা আজকাল বহুল প্রচলতি শব্দবন্ধ ব্যবহার করে বলা যায় ‘মধ্যপন্থী’। তারা সর্বদাই প্রতিক্রিয়াশীল থেকে যাবে এবং তাদেরকে আন্তর্জাতিক থেকে দূরে রাখা জরুরি। কোনো বুর্জোয়া, যে আন্তরিকভাবে আন্তর্জাতিকের সদস্যপদ পেতে চায় তাকে দেখলেই যেকোনো শ্রমিক চিনতে পারবে বুর্জোয়া বিশ্বের সাথে তার সম্পর্কের কারণে। বুর্জোয়া পুঁজিপতি ও ভূ-স্বামীরা, যারা প্রকাশ্যে শ্রমিক আন্দোলন সম্পর্কে ঘৃণা প্রচার করার সাহস দেখায় তারা আন্তর্জাতিকের শত্রু হিসেবে অন্তত অটল ও অকপট এবং ভণ্ডদের থেকে তারা কম বিপজ্জনক।

কিন্তু বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিকদের মধ্যে অন্য একটি ধরাও রয়েছে যারা এতটা স্পষ্টভাষী কিংবা নির্ভীক নয়। সামাজিক তরলীকরণের (কর্তৃত্ববাদী শোষণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলুপ্তি) বিরোধীরা প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের মতোই সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করে চলে যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রলেতারিয়েতদের দাসত্বের জন্য দায়ী এবং তারপরও নিজেদেরকে শ্রমিক শ্রেণির বন্ধনমুক্তির দূত দাবি করে।

র‍্যাডিকাল ও লিবারেল বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিকরা, যারা লিগ ফর পিস এন্ড ফ্রিডম প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরেই এই লিগ ঘৃণার সহিত সমাজতন্ত্রকে প্রত্যাখান করেছিল। গত বছর, ১৮৬৮ সালে বার্ন কংগ্রেসে তারা আবার বিস্ময়করভাবে অর্থনৈতিক সাম্যকে প্রত্যাখান করল। এখন ১৯৬৯ সালে যখন লিগ বিলুপ্ত হতে চলেছে তখন তাদের বিলুপ্তি আরও কিছুদিন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে। সেই নিমিত্তে তারা অনুধাবন করতে পারছে যে তাদের সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। তারা নিজেদেরকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বলে দাবি করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিক। কারণ তারা সমাজে বিদ্যমান সকল সমস্যাকে সামাজিক সমতার ভিত্তিতে সমাধান করবে। তারা পুঁজি ও ভূমি করের ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে চায়। তবুও তারা শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির কথা বলে।

এমন আশাহীন ও হাস্যকর কাজ সম্পাদনে কী প্ররোচিত করেছিল তাদের? বেশিরভাগ বুর্জোয়াই সিজারিজম ও সামরিকতন্ত্রের উপর ত্যাক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছিল। অথচ প্রলেতারিয়তদের ভয়ে ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যার সূত্রপাত ঘটাতে তারা নিজেরাই সাহায্য করেছিল।

ডিসেম্বরের আগে জুনের দিনগুলির কথা স্মরণ করতে হবে আপনাকে, যখন এই ন্যাশনাল এসেম্বলি একজোট হয়ে কীর্তিমান ও বীর সমাজতান্ত্রিক প্রুধোঁকে গালমন্দ করেছিল। প্রুধোঁই একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা এই বুর্জোয়া সংরক্ষণশীল, লিবারেল ও র‍্যাডিকালদের ভেড়ার পালকে প্রতিরোধ করা ও এদের মুখোশ উন্মোচনের সাহস রাখত। ভুলে গেলে চলবে না যে, তার দুর্নাম রটনাকারীদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন এবং আজকাল তারা পূর্বের চেয়ে আরও বেশি সহিংস হয়ে উঠেছে। তারা বিপ্লবী ব্যাপ্টিজমে দীক্ষা গ্রহণ করেছিল ডিসেম্বরের দিনগুলিতে সংগঠিত নির্যাতন-নিপীড়নের প্রাক্কালে এবং অনেকেই স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছেন। কিন্তু এই প্রণিধানযোগ্য ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলোকে আমলে না নিয়ে সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণি (র‍্যাডিকাল বুর্জোয়ারাও যার অন্তর্ভুক্ত) নিজেরাই একনায়কতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র কায়েমের পথ করে দিয়েছিল, যার কর্মফল বুর্জোয়ারা এখন ভোগ করছে এবং এর জন্য আক্ষেপ করছে। প্রলেতারিয়েতদের বিরুদ্ধে এইসব উপাদান প্রয়োগ করার পর তারা এখন তাদের কাছ থেকে মুক্তি চায়। কেন? কারণ তারা মনে করে এই রেজিম তাদেরকে অপদস্থ করেছে এবং তাদের স্বার্থের উপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু তারা কীভাবে নিজেদেরকে মুক্ত করবে? তখন তাদের যথেষ্ট সাহস ও ক্ষমতা ছিল এই রেজিমকে চ্যালেঞ্জ করার। আর এখন তারা ভীরু, জরাগ্রস্ত ও অক্ষম।

শুধুমাত্র প্রলেতারিয়েতদের কাছ থেকে তারা সাহায্য পেতে পারে। কিন্তু তারা কীভাবে তা অর্জন করবে? স্বাধীনতা ও সমতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে? এই প্রতিশ্রুতিগুলো শ্রমিকদের মনোজগতে এখন আর নাড়া দিতে পারবে না। তারা তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝতে পেরেছে যে এই শ্রুতিমধুর শব্দগুলোর মানে কেবল অর্থনৈতিক দাসত্বের চিরস্থায়িত্ব। এই দাসত্ব পূর্বের চেয়ে কম জঘন্য কিছু নয়। এই লক্ষ লক্ষ শ্রমদাসদের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে হলে আপনাকে অবশ্যই তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তি যে অন্য সকল মুক্তির ভিত্তি সেই মোদ্দা কথা বুঝেন না এমন শ্রমিক আজকাল আর খুঁজে পাবেন না। এই কারণেই বুর্জোয়াদের অবশ্যই শ্রমিকদের কাছে সমাজের অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে আলাপ তুলতে হবে।

লিগ ফর পিস এন্ড ফ্রিডম-এর বুর্জোয়া সদস্যরা নিজেদের প্রবোধ দেয় যা বলে—

আন্তর্জাতিকে বাকুনিন

সে ভালো কথা, আমাদের নিজেদেরকে সমাজতান্ত্রিক বলেও ডাকতে হবে। আমাদেরকে শ্রমিকদের কাছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাসের অঙ্গীকার করতে হবে এই শর্তে যে— তারা সর্বদা সভ্যতা ও বুর্জোয়াদের সর্বশক্তিমানতা, ব্যক্তিগত ও বংশগত সম্পত্তি, পুঁজি ও বিষয়ী সম্পত্তির উপর কর এবং বুর্জোয়াদের অপরাপর স্বার্থগুলোর কদর করবে। শুধুমাত্র এসকল শর্তগুলোর ভিত্তিতে তাদের উপর আমাদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হবে এবং (আশ্চর্য ঠেকতে পারে যে) এইভাবেই শ্রমিক শ্রেণির বন্ধনমুক্তি ঘটবে। আর তা উপলব্ধি করানোর জন্য আমাদের অন্য কোনো উপায় অবশ্যই খুঁজতে হবে। আমাদের তাদেরকে এই কথাও উপলব্ধি করাতে হবে যে এসমস্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাসের বাস্তবায়নের জন্য প্রধানত একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বিপ্লব সাধন করা জরুরি। যেই বিপ্লব শুধুমাত্র রাজনৈতিকই এবং যতটা লাল হতে পারে ঠিক ততটাই লাল। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে এমনকি কল্লা ফেলে দিতে হবে যতগুলো প্রয়োজন এবং অবশ্যই সম্পত্তির পবিত্রতার প্রতি যথাযথ সম্মান রেখে, যা কিনা পুরোদস্তুর একটি জেকোবিন বিপ্লব। সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমরা আমাদেরকে এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে হাজির করব এবং তারপর শ্রমিকরা যা কিছুর হকদার বলে আমরা মনে করি তাই তাদেরকে প্রদান করব।

একজন ভণ্ড বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিক শনাক্ত করার কিছু অভ্রান্ত লক্ষণ হচ্ছে— সে যদি বলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের পূর্বে রাজনৈতিক রূপান্তর দরকার; সে যদি প্রত্যাখান করে যে উভয় রূপান্তরই একই সময় হওয়া উচিত; অথবা সে যদি অবজ্ঞাভরে কাঁধ ঝাকি দেয় এ কথা বলবার সময় যে, রাজনৈতিক বিপ্লব কেবলমাত্র তখনই অর্থপূর্ণ হবে যখন এটি অবিলম্বে সরাসরি সমগ্র সামাজিক তরলীকরণের সূচনা করবে।


L’Égalité
, ২৮শে আগস্ট, ১৮৬৯

 আন্তর্জাতিককে যদি এটির মূলনীতিতে অবিচল থাকতে হয় তাহলে এটি অবশ্যই সেই পথ থেকে বিচ্যুত হতে পারবে না যেই পথ এটিকে বিজয়ের দিকে নিয়ে যাবে। সর্বপ্রথম এটিকে দুই প্রকার বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিকদের প্রভাবকে নাকচ করে দিতে হবে। এক, যারা বুর্জোয়া রাজনীতির সমর্থক(বিপ্লবী বুর্জোয়ারাও এর অন্তর্ভুক্ত) আর দুই, ‘বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ’ যারা বুর্জোয়াদের মদত দেয়। আমাদের প্রস্তাবনা থেকে আন্তর্জাতিকের রাজনীতির সারসংক্ষেপ নিচে অল্প কথায় তুলে ধরা হলো—

… পুঁজির নিকট শ্রমের সমর্পণই রাজনৈতিক নীতিগত ও বস্তুগত দাসত্বের উৎস এবং এই কারণেই আন্তর্জাতিকের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, প্রত্যেক রাজনৈতিক আন্দোলনই আবশ্যিকভাবে যার অধীন…

এটি স্পষ্ট যে, শ্রমিকদের তাৎক্ষণিক, প্রত্যক্ষ, নিশ্চিত ও পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক বন্ধনমুক্তি যেই রাজনৈতিক আন্দোলনের উদ্দেশ্য নয়, এবং যা স্পষ্ট ও নির্ভুলভাবে অর্থনৈতিক সাম্যের মূলনীতিগুলোকে অর্থাৎ শ্রম বা সামাজিক তরলীকরণের কাছে পুঁজিকে ফিরিয়ে দেয়ার কথা প্রচার করে না, সেরকম সকল রাজনৈতিক আন্দোলনই বুর্জোয়া আন্দোলন এবং এজন্যই এগুলোকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক থেকে বাদ দিতে হবে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ও বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিকদের রাজনীতির পাটাতন এই আদর্শের উপর দাঁড়িয়ে আছে যে রাজনৈতিক স্বাধীনতাই অর্থনৈতিক মুক্তির পূর্বশর্ত। এই সমস্ত কথার শুধু একটাই মানে দাঁড়ায়। শ্রমিকদের অবশ্যই র‍্যাডিকেল বুর্জোয়াদের সাথে জোট বাঁধতে হবে প্রথমত রাজনৈতিক বিপ্লব সাধনের জন্য। তারপর তাদের পূর্বতন প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে অর্থনৈতিক বিপ্লবের জন্য।

আমরা এই ভয়ংকর তত্ত্বকে জোরালোভাবে প্রত্যাখান করছি। যার মারফত আবারও শ্রমিকদের স্বদাসত্বের ঘুটিতে পরিণত করা হবে এবং নতুনভাবে বুর্জোয়া কর্তৃক তাদেরকে শোষণের বন্দোবস্ত করা হবে। প্রথমত রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের এই মানে হতে পারে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো অন্তত অস্থায়ীভাবে অক্ষতই থাকবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, পুঁজিপতিরা আগলে রাখবে তাদের ধন-সম্পদ আর শ্রমিকরা তাদের দারিদ্র্য।

আমাদেরকে বলা হবে যে, একবার যদি রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করা যায় তবে তা পরবর্তীতে শ্রমিকদের সমতা ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতা অর্জনের জন্য প্ররোচিত করবে। অবশ্যই স্বাধীনতা একটি মহৎ ও ক্ষমতাবান শক্তি যদি শ্রমিকরা এটির সদ্ব্যবহার করার সুযোগ পায় এবং কার্যকরভাবে এটি তাদের অধিকারে থাকে। তবে তা না হলে, এই রাজনৈতিক স্বাধীনতা একটি স্পষ্ট ছলনা ও কল্পনা হিসেবেই থেকে যাবে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে বাস করে কোনো শ্রমিক প্রকৃতপক্ষে ও কার্যকরভাবে তার রাজনৈতিক স্বাধীনতা চর্চা করছে এমন ভাবনার জন্য সেই ব্যক্তিকে কাল্পনিক পৃথিবীর বাসিন্দা হতে হবে। এমন কাজের জন্য তার সময় ও বস্তুগত ভিত্তির অভাব রয়েছে।

ফ্রান্সে ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পরের দিন আমরা কী দেখতে পাই? রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল সবার কাম্য সবচেয়ে র‍্যাডিকাল বিপ্লব। ফরাসি শ্রমিকরা উদাসীন কিংবা নির্বোধ কোনোটাই ছিল না। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সমস্ত কিছু বুর্জোয়াদের হস্তগত হয়েছিল কেন? কারণ রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে বাস্তব রূপ দান করার জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত ভিত্তি সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল ছিল না। র‍্যাডিকাল ও লিবারেল বুর্জোয়ারা সংরক্ষণশীল বুর্জোয়াদের সাথে নিয়ে গত পরশুদিন গঠিত নয়া রিপাবলিকের রিপাবলিকানরা ও অপরাপর রূপান্তরিত ব্যক্তিরা সকলে মিলে তখন শ্রমিকদেরকে উপেক্ষা করল এবং চক্রান্তে লিপ্ত হলো। একদল সাধুবাদ জানাল ভূসম্পত্তি থেকে আসা আয় কিংবা তাদের অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক অবস্থানকে, অপর দল সাধুবাদ জানাল তাদের রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে যে অবস্থানে তারা স্বাভাবিকভাবে থেকে গেল। যার দরুন তারা পূর্বের চেয়ে আরও দৃঢ়ভাবে তাদের আসন সুরক্ষিত করল।

ধরে নেয়া যাক যে, অভিজ্ঞতার দরুন প্রাজ্ঞ হয়ে জাতীয় সংসদে কিংবা আইনসভায় বুর্জোয়াদের নির্বাচিত করার বদলে সাধারণ শ্রমিকদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি পাঠানো হলো। তখন কী ঘটতে পারে? নতুন শ্রমিক প্রতিনিধিরা যারা বুর্জোয়া আদর্শ ও জীবনাভ্যাস আয়ত্ত ও চর্চা করার মাধ্যমে বুর্জোয়া পরিবেশে বেড়ে উঠেছে তারা আর শ্রমিক থাকতে চাইবে না, হয়ে উঠবে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা। এই শ্রমিক প্রতিনিধিরা বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত হবে। এমনকি তারা বুর্জোয়াদের চেয়েও আরও সাচ্চা বুর্জোয়া হয়ে উঠবে। কারণ মানুষ তার অবস্থান তৈরি করে না, অপরপক্ষে তার অবস্থানই সেই শ্রেণির মানুষ তৈরি করে। আর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে, বুর্জোয়া শ্রমিকরা বুর্জোয়া শাসক-শোষকদের থেকে কম অহংকারী নয়; বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিকদের চেয়ে তারা আন্তর্জাতিকের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ নয় এবং তারা মহান সাজা বুর্জোয়াদের চেয়ে কম ভণ্ড ও উদ্ভট নয়।

প্রথমে সমাজতন্ত্রের আলোচিত বিষয়গুলোর সুরাহা না করে এবং বুর্জোয়ারা যা শুনে কেঁপে উঠে সেই সামাজিক পুনর্বিন্যাসের কথা আদৌ উচ্চারণ না করে শ্রমিকদেরকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ঠেলে দেয়ার মানে, এটাই বলা যে, ‘আমাদের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনো যাতে পরবর্তীতে তোমাদের বিপক্ষে এটি ব্যবহার করতে পারি’।

বুর্জোয়া সমাজতান্ত্রিকরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে শ্রমিকদের মধ্যে জোর প্রচার চালিয়েছিল এবং শ্রমিকদেরকে বাগে আনতে সমাজতন্ত্রকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। শ্রমিক জনতার উচিত নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ও বিশদ ধারণা নিয়ে এবং আন্তর্জাতিকের মূলনীতি দ্বারা চালিত হয়ে নিজেদেরকে কার্যকরভাবে সংগঠিত করতে শুরু করা। তাদের উচিত বুর্জোয়াদের কর্মপন্থাকে নিজেদের কর্মপন্থা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার নিমিত্তে আন্তর্জাতিক পরিসরে একটি প্রকৃত শ্রমিক শক্তি গড়ে তোলা। রিপাবলিকান প্রতিষ্ঠানগুলোর ছত্রছায়ায় পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংক্রান্ত আদর্শগুলো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বুর্জোয়াদের প্রয়োজন একটি বিপ্লব। আর কোনো বিপ্লবই জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া সংগঠিত হওয়া সম্ভব নয়। বুর্জোয়া ভদ্রলোকদের স্বার্থে কঠিন অগ্নি পরীক্ষা দেওয়া থেকে শ্রমিক আন্দোলনকে বিরত রাখা জরুরি। বিপ্লবকে শুধুমাত্র জনগণের বিজয়ের জন্য পরিচালিত করতে হবে, সেই সকল মানুষের জন্য যারা শ্রম-শোষকদের থাবা থেকে মুক্তির জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে।

আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংঘ এটির মূলনীতিতে স্থির থাকতে কখনোই এমন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের অনুমোদন কিংবা সমর্থন করবে না যেটি অবিলম্বে, সরাসরি ও সম্পূর্ণভাবে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং জনসাধারণের থেকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন বুর্জোয়া শ্রেণির বিলোপ সাধনের কথা বলে না। বিপ্লবের প্রচার-প্রচারণায় শুরু থেকেই সামাজিক পুনর্বিন্যাসের কথা অনুপস্থিত এমন কোনো বিপ্লবের সমর্থন আন্তর্জাতিক করবে না।

কিন্তু বিপ্লব কোনো ব্যক্তি কিংবা সর্বশক্তিমান সংঘের ছকানুসারে ও ইচ্ছামতো উদ্ভাবিত কোনো বস্তু নয়। সকল অভিলাষ ও চক্রান্তের অধীন না থেকে ঘটনার স্বাভাবিক প্রবাহের দরুন বিপ্লব সংগঠিত হয়। আসন্ন বিপ্লব সম্পর্কে হয়তো পূর্বানুমান করা যায় কিন্তু বিপ্লবের বিস্ফোরণকে কৃত্রিমভাবে ত্বরিত করা যায় না। এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরেই আমরা প্রশ্ন করি, ‘সর্ব-প্রত্যাশিত ও অপ্রতিরোধ্য সামাজিক বিপ্লবপূর্ব এই কম-বেশি প্রলম্বিত মধ্যবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিকের কোন কর্মপন্থা অবলম্বন করা উচিত?’

আন্তর্জাতিক সকল স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিকে উপেক্ষা করে এবং শুধুমাত্র অর্থনৈতিক চরিত্রকে আমলে নিয়ে সকল স্থানের শ্রমিক আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করার প্রচেষ্টা চালায়। এটির তাৎক্ষণিক লক্ষ্য হচ্ছে শ্রমঘণ্টা হ্রাস ও অধিক মজুরি নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রমিক ধর্মঘটের প্রস্তুতি নেয়, ধর্মঘটের জ্বালানি সরবরাহ করে এবং শ্রমিকদেরেকে একটি সংগঠনের আওতায় একত্রিত করার চেষ্টা করে।

[চলুন আমরা আমাদের সংগঠনকে সম্প্রসারিত করি। কিন্তু একই সাথে এটিকে দৃঢ় ও শক্তিশালী করতেও যেন ভুলে না যাই আমরা, যাতে আমাদের মধ্যেকার সংহতি যা কিনা আমদের সামগ্রিক শক্তি তা যেন দিনকে দিন বৃদ্ধি পায়। চলুন আমাদের শিক্ষায়, আমাদের কাজকর্মে, নাগরিক কর্ম তৎপরতায় ও খোদ ব্যক্তি জীবনে এই সংহতি জ্ঞাপনের ব্যাপক চর্চা করি। চলুন আমাদের জীবনকে আরেকটু বেশি সমর্থনযোগ্য ও কম মুশকিলের করে তুলতে যৌথ কর্ম প্রচেষ্টায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। যখনই সম্ভব চলুন উৎপাদক-গ্রাহক সমবায় ও পারস্পরিক বিনিময়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি। যদিও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিবেশে এই ব্যবস্থাগুলো আমাদেরকে প্রকৃত কিংবা উপযুক্ত অর্থে মুক্তি দিতে পারবে না কিন্তু এই ব্যবস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ তারা যতদূর সম্ভব শ্রমিকদেরকে অর্থনীতি পরিচালনার কর্মপন্থা সম্পর্কে হাতে কলমে শিক্ষা দেয়। একই সাথে ভবিষ্যতের সংগঠনের জন্য মূল্যবান বীজ রোপণ করে।]

আন্তর্জাতিক এটির মূলনীতিগুলো প্রচার করতে থাকবে কারণ এই মূলনীতিগুলো সারা বিশ্বের সকল শ্রমিকদের সামষ্টিক স্বার্থের নিখাদ অভিব্যক্তি। এই মূলনীতিগুলো আমাদের সংগঠনের সারসত্তা এবং জীবন্ত চালিকা শক্তি। আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া সংবেদনশীলতাকে বিবেচনায় না নিয়ে এটির প্রচার চালাবে যাতে প্রত্যেক শ্রমিক তাকে যেই বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক অসাড়তার মধ্যে রাখা হয়েছিল তার থেকে জেগে উঠে তার অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে পারে। একই সাথে জানতে পারে যে সে কী চায় ও কী করতে হবে এবং কোন শর্তের সাপেক্ষে একজন মানুষ হিসেবে তার অধিকারগুলো অর্জন করতে পারবে। আন্তর্জাতিককে আরও প্রবলভাবে এটির প্রচার চালাতে হবে কারণ খোদ আন্তর্জাতিকের অভ্যন্তরেই আমরা এমন প্রভাবের সম্মুখীন হই যা এই মূলনীতিগুলোর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। মূলনীতিগুলোকে ফাঁপা, বেহুদা তত্ত্ব হিসেবে প্রচার করে এবং শ্রমিকদেরকে বিভ্রান্ত করে তাদেরকে বুর্জোয়াদের অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় পঠন-পাঠনের দিকে পরিচালিত করার চেষ্টা চালায়।

আন্তর্জাতিকের পোস্টার

আন্তর্জাতিক নিজেকে সম্প্রসারিত করবে এবং দৃঢ়ভাবে সংগঠিত হবে। ঘটনার প্রবাহে পরিপুষ্ট হয়ে বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার মুহূর্তে উপস্থিত হবে এক প্রকৃত শ্রমিকশক্তি যারা তাদের করণীয় সম্পর্কে অবগত এবং সেই বিপ্লবকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত অভিমুখে প্রবাহিত করতে সক্ষম। সকল ভূখণ্ডের শ্রমজীবী সংঘের সম্মিলনে গড়ে উঠা একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক সংগঠন এটি, যা রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিভাজিত এই মৃত বিশ্বকে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হবে।

আমাদের সর্বজন গৃহীত সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশের সমাপ্তিসূচক অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিকের কর্মপন্থা সম্পর্কে যথাযথ ব্যাখ্যা দেয়া যায়—

ইউরোপের শিল্পায়িত দেশগুলোতে যে আন্দোলনগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তা আমাদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। একই সাথে পুরনো ভুলগুলো পুনরাবৃত্তি না করার গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তাও দিচ্ছে।

টীকা

[i]    শ্রমিক ধর্মঘটের সময় যেহেতু কারখানা থেকে শ্রমিকেরা মজুরি পাচ্ছে না, সে সময়টা ধর্মঘট চালিয়ে যাবার জন্য শ্রমিকদের অর্থসাহায্য দেয়ার উদ্দেশ্যে ইউনিয়ন যে ফান্ড গড়ে তুলে।

খোইরোম রুধির