অরাজ
আর্টওয়ার্ক: ভোজো কুশি শিল্পী: সালি শিজাকু সূত্র: পিন্টারেস্ট
প্রচ্ছদ » পিতর ক্রপোৎকিন।। বিদ্রোহের প্রাণস্পৃহা

পিতর ক্রপোৎকিন।। বিদ্রোহের প্রাণস্পৃহা

  • অনুবাদ: পার্থ প্রতীম দাস

ভূমিকা

বিপ্লব দাবি করে সর্বব্যাপি বিদ্রোহ। কিন্তু বিদ্রোহের স্পৃহা আসে কোথা থেকে? স্বাধীনতার বোধ থেকে। কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন-শোষণের জাঁতাকলে মানুষ যখন পিষ্ট, কেবলমাত্র এবং কেবলমাত্র সামাজিক সংহতিই তখন তাকে বিদ্রোহের পথ দেখায়। রাষ্ট্রের কল-কব্জাগুলো অসাড় হয়ে পড়ে, হারাতে থাকে তার ছন্দ। হাজির হয় অনিবার্য বৈপ্লবিক পরিস্থিতি। কেমন করে এই বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে সমাজ লড়াকু হয়ে ওঠে তারই এক চিত্রায়ন বিদ্রোহের প্রাণস্পৃহা।

পিতর ক্রপোৎকিন

রুশ নৈরাজ্যবাদী চিন্তক পিতর ক্রপোৎকিনের The Spirit Of Revolt প্রথম ছাপা হয় Le Révolté নামে, ১৮৮০ সালে। ১৮৯২ সালে Commonweal-এ ছাপা হয় ইংরেজি অনুবাদ। বর্তমান অনুবাদটি ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত The Essential Kropotkin অনুসারে করা হয়েছে।

সামাজিক বিকাশের ধারা-প্রবণতাকে আধুনিক প্রকৃতি বিজ্ঞানের নানামুখি অর্জনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন ক্রপোৎকিন। সামাজিক ডারুইনবাদের Survival for the fittest মতবাদের বিপরীতে তিনি তাঁর Mutual Aid: A Factor of Evaluation বইয়ে দেখান যে, প্রকৃতিতে পারস্পারিক সহযোগিতার মধ্য দিয়েই প্রজাতিগুলো বিকশিত হয়। শরীরবৃত্তীয়ভাবে দুর্বল প্রাণসত্তার প্রবৃত্তি হলো তা সংহতিপরায়ণ। আদতে সামাজিক সংহতিই ক্রমাগত জীবনের উচ্চতর গঠন নিশ্চিত করে।

ক্রপোৎকিন বিদ্রোহকে মানবীয় প্রবৃত্তি মনে করেন। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত চিত্রকর্মটি আলবেনীয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রতীক। ১৯৬৯ সালে স্লাভ চিত্রকর সালি শিজাকু তিরিশের দশকের প্রখ্যাত আলবেনীয় বিপ্লবী  ভোজো কুশির এই প্রতিকৃতি অঙ্কন করেন। দ্রোহ ও সাহসিকতার ভঙ্গি চিত্রকর্মটিকে করে তোলে বিদ্রোহের স্মারক।

মূল রচনা

মানুষের সমাজে এমন কিছু কিছু পর্যায় আসে যখন বৈপ্লবিক তৎপরতা হয়ে ওঠে ভীষণ প্রয়োজনীয়। একেবারে অনিবার্য। নতুন নতুন চিন্তাধারা আলো-বাতাসের খোঁজে মাথা চাড়া দেয় অঙ্কুরের মতো। কিভাবে সেই চিন্তাগুলো জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায়- সেই সন্ধান চলতে থাকে অনবরত।

কিন্তু প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেগুলো বাধার সম্মুখীন হয়। পুরনো সমাজের শৃঙ্খল যারা রক্ষা করতে চায়, তারা সেই বিপ্লবী চিন্তা-তৎপরতাগুলো স্তব্ধ করে দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায়। তবে এতে করে তারা নিজেরাই অন্ধবিশ্বাস ও নানা রকম প্রথা দিয়ে মোড়ানো দমবন্ধ-পরিস্থিতির মুখে পড়ে।

রাষ্ট্রের সংবিধান, সামাজিক ভারসাম্যের আইন, নাগরিকদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত ধ্যানধারণাগুলো টিকে থাকতে পারে না নির্মম সমালোচনার সামনে। ড্রইংরুম, অফিস-রেস্তোঁরা, প্রাত্যহিক আলাপচারিতা, দার্শনিকদের লেখনি; সর্বত্রই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে থাকে পুরনো সমাজে প্রচলিত বিষয়-আশয়গুলো। এমন অবস্থায় নড়বড়ে হতে থাকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভীত। জীর্ণ হয়ে পড়ে সামাজিক কাঠামো। অনেক বিরোধিতা সত্ত্বেও পুরনো সমাজ-রাষ্ট্রের ভাঙ্গতে থাকা দেয়ালে বপিত হতে থাকে নতুন চিন্তার বীজ। সেগুলো বেড়ে উঠতে থাকে আশেপাশে, চারদিকে।

নতুন সমাজ-জীবনের প্রয়োজনীয়তা হয়ে ওঠে অনিবার্য। প্রতিষ্ঠিত যেসব নীতি-নৈতিকতা দিয়ে মানুষকে শাসনের কাজটা চালানো হয়, তা অপর্যাপ্ত মনে হতে থাকে। পুরনো সমাজ-রাষ্ট্রে যা ন্যায্য মনে হতো, তার অন্যায্যতা ফুটে উঠতে থাকে। অতীতের সাবেকী যত নীতিনৈতিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহই হয়ে ওঠে নৈতিক।

নতুন চিন্তাধারা ও পুরনো প্রথাগুলোর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সমাজের প্রতিটা স্তরে। সম্ভাব্য প্রতিটি ক্ষেত্রে। এমনকি পরিবারেও। ছেলে বাবার বিরুদ্ধাচরণ করে। বাবা যে ব্যাপারগুলো সারা জীবন ধরে স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করে এসেছে, ছেলে সেগুলোর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে শুরু করে। মা তাঁর সারাজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে যে নীতি-নৈতিকতা আঁকড়ে চলেছেন, মেয়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।

প্রাত্যহিকভাবে, পুরনো সমাজের সুবিধাপ্রাপ্তদের আকাম-কুকাম আর কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে জেগে ওঠে জনগণের বিবেক। আওয়াজ উঠতে থাকে শক্তিমানের আইন আর উপরি সুবিধার নামে সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে।

আর্টওয়ার্ক: দ্য ইনসারেকশন
শিল্পী: অনারে দ্যুমিয়ে
সূত্র: ফেসবুক

যারা দীর্ঘদিন ধরে ন্যায়বিচারের উত্থানের অপেক্ষা করছেন, যারা নতুন চিন্তাভাবনাগুলো বাস্তবে চর্চা করতে চান, তারা শিগগিরই টের পেতে শুরু করেন যে, তাদের উদার, মানবিক ও উজ্জীবিত চিন্তাভাবনাগুলো প্রচলিত সমাজে ঠাঁই পাবে না। ফলে তারা একটা আমূল বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করেন। যার মাধ্যমে ধুয়ে যাবে পুরনো সমাজের সব পচন। অলস প্রাণে আবার শোনা যাবে নতুন শ্বাস-প্রশ্বাসের স্পন্দন। মানবজাতির কাছে বয়ে আনবে ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও বীরত্বের চেতনা; যা ছাড়া সমাজ ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে পুরোপুরি ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে।

সংকটের কালপর্বে ঘনীভূত হতে থাকে জরাজীর্ণতার আশঙ্কা। বড় শিল্পের আকস্মিক পতন, উৎপাদনের অন্যান্য ক্ষেত্রে স্থবিরতায় রাতারাতি হৃষ্টপুষ্টরা হয়ে পড়ে শীর্ণ। আর তাতে দেখা দেয় সম্পদ দখলের মচ্ছব। ফলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, উৎপাদন ও বিনিময় নিয়ন্ত্রণকারী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজকে আর উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারবে না। বরং হতে থাকবে ঠিক এর উল্টোটা। শৃঙ্খলার পরিবর্তে তারা নিয়ে আসবে বিশৃঙ্খলা। উন্নয়নের পরিবর্তে তারা দেবে দারিদ্র ও অনিরাপত্তা। সমাজের সমন্বিত স্বার্থে আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পরিবর্তে তারা দেবে যুদ্ধ; শাসক-শোষকদের যে চিরস্থায়ী যুদ্ধটা পরিচালিত হবে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে।

মনুষ্য সমাজ ক্রমশ আরও বেশি মাত্রায় বিভক্ত হয়ে যাবে দুইটি শত্রুভাবাপন্ন শিবিরে। আর একই সময়ে অনেক ছোট ছোট গ্রুপেও বিভক্তি দেখা যাবে, যারা একে অপরের বিরুদ্ধে নির্মম যুদ্ধ শুরু করবে। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত আর এগুলো যে দুর্দশা বয়ে আনে, তা দেখতে দেখতে সমাজে তৈরি হয় নতুন সংগঠন তৈরির তাড়না। সমাজে তীব্র আওয়াজ ওঠে উৎপাদন, সম্পদের মালিকানা, বিলি-বণ্টন ও অন্যান্য সকল অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্মাণের সম্পূর্ণ নতুন একটা ব্যবস্থা কায়েমের।

শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়ভার কাঁধে নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর দায়িত্বে নিয়োজিত সরকার তখনও নানাবিধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পদে পদে বিকল হতে থাকে সেই যন্ত্রের কলকব্জা, থেমে যায় গতি। ক্রমাগত কঠিন হতে থাকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা। আর এর ফলে ক্রমেই বাড়তে থাকে অসন্তোষ। প্রতিদিনই উঠতে থাকে নতুন নতুন দাবি দফা। ‘এটা সংস্কার করো’, ‘ওটা সংস্কার করো’- এই রব ওঠে সব দিক থেকে। সংস্কারবাদীরা বলতে শুরু করে, ‘যুদ্ধ, অর্থনীতি, কর, আদালত, পুলিশ, সবকিছুরই পুনর্বিন্যাস, পুনর্গঠন করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে নতুন ভিত্তিমূল।’ কিন্তু এটাও সবারই জানা যে, মেরামত করে এভাবে কোন কিছুর পুনর্বিন্যাস অসম্ভব। কারণ ডালপালার মতো সব কিছুই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই পুরোটা নতুনভাবে নির্মাণ করতে হবে এবং তা একই সঙ্গে। আর সেটা কিভাবে সম্ভব হবে যখন সমাজ প্রকাশ্যে দুটি শত্রুভাবাপন্ন শিবিরে বিভক্ত? অসন্তুষ্ট একটি পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে গেলে তৈরি হবে নতুন নতুন অসন্তোষ।

ফলে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনাকারীরা। কারণ এটা করতে গেলে পথ তৈরি হবে বিপ্লব-বিদ্রোহের। একই সঙ্গে সরকার খুল্লামখুল্লা প্রতিক্রিয়াশীলও হতে পারে না। তারা এমন একটা অবস্থানে গিয়ে পড়ে যেখান থেকে কোনো পক্ষকেই তুষ্ট করা সম্ভব নয়। বরং জন্ম দেয় নতুন নতুন অসন্তোষের।

এইরকম একটা রূপান্তরের কালে মধ্যমপন্থীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকের আসনে বসলে শুধু একটা বিষয়ই চিন্তা করে: আসন্ন ‘বিপর্যয়’ থেকে নিজেদের রক্ষা করা। সব দিক থেকে আক্রমণে জবুথবু হয়ে তারা শুধু চেষ্টা করে নিজেদের রক্ষার বা পালানোর। একের পর এক ভুল করে রুদ্ধ করে ফেলে বাঁচার সর্বশেষ পথটাও। তাদের কূপমুণ্ডকতায় সরকারের সব প্রতিপত্তি হাস্যকরভাবে ধূলোয় মিশিয়ে যায়।

এমন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের দাবিই হল বিপ্লব। এটা রূপ নেয় সামাজিক প্রয়োজনে। পুরো পরিস্থিতিটা নিজেই হয়ে ওঠে বৈপ্লবিক।

বড় আকারের বিপ্লবী আন্দোলনগুলো কিভাবে দানা বাঁধে আর গড়ে ওঠে, তা জানতে গিয়ে আমরা যখন মহান ইতিহাসবিদদের কাজগুলো দেখি তখন তার কিছু চিত্র পাওয়া যায়। মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা, সাধারণভাবে একটা অনিরাপত্তাবোধ, সরকারের নেওয়া হয়রানিমূলক সব পদক্ষেপ আর ন্যাক্কারজনক সব কেলেঙ্কারির ফলে সমাজে জমতে থাকা ক্লেদ একেবারে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। নতুন নতুন চিন্তাভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেগুলো সাবেক শাসক ও তার সমর্থকদের বিরোধিতার মুখে পড়ে। এমন ঐতিহাসিক চিত্র পর্যালোচনা করলে মনে হয় যে, বিপ্লবটা তখন সত্যিই ছিল    অনিবার্য। আর তার জন্য বিদ্রোহ-অভ্যুত্থান ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিল না।

উদাহরণ হিসেবে, ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের আগমুহূর্তের পরিস্থিতি ইতিহাসবিদরা কিভাবে বর্ণনা করেছেন, তা লক্ষণীয়। আপনি দেখতে পাবেন, কৃষকরা লবণ করের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। আপত্তি তুলছে অন্যায্য খাজনা, সামন্ত-দেনা ইত্যাদির বিরুদ্ধে। আর বুকের মধ্যে সামন্তপ্রভু, যাজক, অধিপতি, অধিকারীদের বিরুদ্ধে বয়ে বেড়াচ্ছে অনমনীয় ক্ষোভ-ঘৃণা। নগরের মানুষ বিলাপ করছে তাদের নাগরিক স্বাধীনতা হারানো নিয়ে আর অভিশাপ বর্ষণ করছে রাজার ওপর। নিন্দা-তিরস্কার করছে রানিকে।

মন্ত্রিবর্গের ফরমানের প্রতিবাদে তারা বিদ্রোহ করে। আর তারা উচ্চকণ্ঠে বলতে থাকে, এত বেশি খাজনা-কর দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে, আর এগুলো গলাকাটার সামিল। ক্ষেতে ফসল ভালো হয়নি, শীত পড়েছে ভয়াবহ। জীবন ধারণের রসদ পাওয়া দুরূহ অথচ অধিপতিদের লালসা এত বেড়েছে যে, গ্রামের আইন-ব্যাপারিরা কৃষকের সমস্ত ফসল গলাধঃকরণ করছে আর গ্রামের শান্ত্রী নিজেই যেন ক্ষুদে রাজা। এমনকি ডাকসেবাও অকার্যকর, কর্মচারিরা একবারেই অকর্মা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, কোনো কিছুই ছন্দে নেই। সবাই কিছু না কিছু নিয়ে অভিযোগ করছে। ‘এভাবে আর চলতে পারে না, এর একটা বাজে পরিসমাপ্তি ঘটবে’- এমন কথাই সর্বত্র শোনা যায়।

কিন্তু শান্তভাবে এসব কথাবার্তা বলা আর বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থানের মাঝখানে একটা বিশাল ফারাক বিদ্যমান। মানব ইতিহাসের একটা বড় অংশজুড়ে আদতে যুক্তি ও কর্মের, চিন্তা ও সংকল্পের এই ফারাকটাই হাজির করে কিছু করতে চাওয়ার তাড়না। কিন্তু ফারাক ঘুচিয়ে কিভাবে সংযোগের সেই সেতু নির্মিত হয়? যে মানুষটা গতকালও শান্তশিষ্টভাবে পাইপ খেতে খেতে তার দুর্ভোগ নিয়ে অভিযোগ করছিল আর পরমুহূর্তেই কোনো স্থানীয় বরকন্দাজ বা নিরাপত্তা রক্ষী দেখে অভিবাদন জানাচ্ছিল; সেই মানুষটাই কিভাবে কয়েক দিন পর কাস্তে আর লোহার পাইক নিয়ে রাজার দুর্গ আক্রমণ করতে চলে যায়- যে রাজা কদিন আগেও ছিল দুর্দমনীয়? কোন অলৌকিক শক্তির বলে এই মানুষগুলো রাতারাতি বীরে পরিণত হয়ে গেল? নিজেদের বৌয়ের কাছ থেকে হরহামেশা যারা কাপুরুষ গালি শুনেছেন, রাতারাতি তারা কিভাবে দল বেঁধে বুলেট-কামানের সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে লড়তে গেলেন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য? কিভাবে তাদের অস্ফূট উচ্চারণ যা এতদিন গীর্জার ঘন্টাধ্বনির মতো মিলিয়ে যেত, এমন বাস্তবে রূপান্তরিত হয়ে গেল?

উত্তরটা সহজ। বহুবিচিত্র সক্রিয়তা। নিরবিচ্ছিন্ন চলতে থাকা কর্মতৎপরতা। একটা ছোট গোষ্ঠীর নিরন্তর কর্মতৎপরতা এই রূপান্তরটা ঘটিয়ে দেয়। শুধু কাপুরুষতা, নতি স্বীকার করা আর ভীতিই ছোঁয়াচে নয়। সাহস, ভালোবাসা, আত্মত্যাগও ছোঁয়াচে।

তো, এই কর্মতৎপরতা কী রূপ নেবে? যেকোন রূপ নিতে পারে। আদতে এটা নির্ধারিত হবে সেই সময়ের পরিস্থিতি, তার উত্তাপ ও উত্তরণের পন্থা ইত্যাদি দ্বারা। কখনো তা ট্র্যাজিক, কখনো রসাত্মক; কিন্তু সবসময়ই অকুতোভয়। আবার কখনো এই তৎপরতাগুলো   সামষ্টিক, কখনোবা তা সংঘটিত হয় পুরোপুরি ব্যক্তি প্রচেষ্টায়। কর্ম-তৎপরতার নীতি প্রযুক্ত হয় সম্ভাব্য সব উপায়ে; বাদ পড়ে না জনপরিসরের কোনো অংশ। আর বিদ্রোহকে জীবন্ত-সজীব রাখতে অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ ও প্রচার, শোষকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-ঘৃণা জাগিয়ে তোলা, সরকারের সমালোচনা ও এর দুর্বলতা ফাঁস করে  দিতে চলতে থাকে বিপুল কর্মযজ্ঞ। সবচেয়ে বড় কথা, সত্যিকারের দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয় সাহস। উজ্জীবিত হয় বিদ্রোহের প্রাণস্পৃহা।

কোনো দেশে যখন একটা বৈপ্লবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন জনসাধারণের মধ্যে বিদ্রোহের চেতনা পুরোপুরি জাগ্রত হওয়ার আগে চোখে পড়ে অল্প-সংখ্যকের নানাবিধ কর্মকাণ্ড-তৎপরতা। আর এর মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয় স্বাধীনতার বোধ। জেগে ওঠে ইস্পাতসম দৃঢ় স্পর্ধা। এছাড়া কোনো বিপ্লবই পরিণতি পায় না। ফলস্বরূপ, জনসাধারণ রাস্তায় নেমে আসে, মিছিল-প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। সর্বোপরি বিদ্রোহের মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটায়।

সাহসী মানুষেরা শুধু মুখের কথায় তুষ্ট হতে পারেন না। তাই সব সময় নিজেদের সংকল্পকে বৈপ্লবিক কর্মে রূপান্তরের পথ খুঁজতে থাকেন। দৃঢ়চেতা মানুষ, যাঁরা নিজেদের নীতি-আদর্শের বিরুদ্ধাচরণ করার চেয়ে কারাদণ্ড, নির্বাসন বা মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেন তারা নির্ভয়। তারা জানেন যে, সফল হতে গেলে সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর এই মানুষগুলোই অন্য সবার আগে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে দাবি আদায়ের প্রেরণা, বিক্ষোভ-বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থানের স্পৃহা জেগে ওঠার অনেক আগেই লিপ্ত হন বৈপ্লবিক কর্মে।

নানাবিধ আলাপ-সংলাপ, মতপার্থক্য, তত্ত্ব আলোচনা ইত্যাদির মধ্যেই, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড হাজির হয়ে পড়ে। মূর্ত হয়ে ওঠে প্রবলতম আকাঙ্ক্ষা। তবে শুরুতে এমনও হতে পারে যে, জনসাধারণ কোনো ভ্রুক্ষেপই করল না। আবার কখনো বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডের সূচনাকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সাহসী উদ্যোগকে মনে মনে প্রশংসা করলেও, জনসাধারণ অনুসরণ করবে তাদের, যারা সমাজে পরিচিত বিচক্ষণ ও সতর্ক হিসেবে। আর সেই বিচক্ষণের দলই হয়তো বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডকে আখ্যা দেবে ‘পাগলামো’ হিসেবে। আর বলবে যে, ‘এরা উন্মাদ। এদের উন্মত্ততা সব কিছুকে হুমকির মুখে ফেলছে।’

সেই বিচক্ষণ আর সতর্ক মানুষগুলো বা তাদের দল-পার্টি সব কিছু খুব ভালোমতো হিসেব করবে। তারা সবাইকে বলবে যে, তাদের ধীরগতির কর্মকাণ্ড দিয়ে একশ বছর, দুইশ বছর, অথবা হয়তো তিনশ বছরের মধ্যে তারা পুরো বিশ্বজয় করবে। আর এখন এর মধ্যে এসে পড়েছে কিছু উটকো আগন্তুক! বিচক্ষণ আর সতর্ক গোষ্ঠী যা কখনো চিন্তা করেনি, এমন সব কিছুই তাদের কাছে উটকো, অপ্রত্যাশিত। ইতিহাস সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জ্ঞান আছে আর খোলা মাথায় চিন্তা করতে পারে, এমন যেকোন মানুষ শুরু থেকেই খুব ভালোমতো জানেন যে, বিপ্লবের তত্ত্বগত প্রচার স্বাভাবিকভাবেই নানামুখি তৎপরতায় রূপ নেয়। বিপ্লবের ‘মোক্ষম সময় এসে গেছে’ তাত্ত্বিকদের এমন সিদ্ধান্ত জানানোর অনেক আগে থেকেই সেটা শুরু হয়। তারপরও, সেই সতর্ক তাত্ত্বিকরা এই পাগলাটেদের প্রতি ক্ষুব্ধ হবেন। তাদের সমাজচ্যুত করবেন, তাদের মুণ্ডুপাত করবেন। কিন্তু ধীরে ধীরে এই পাগলাটে মানুষগুলোই সাধারণ মানুষের সহানভূতি পাবেন। জনসাধারণের বড় একটা অংশ গোপনে তাদের সাহসের প্রশংসা করবেন। অনেকেই হয়ে উঠবেন তাদের অনুসরণকারী। পাগলাটে এই মানুষদের অনেকেই জেলখানায় যাবেন, নানা দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অন্যদিকে আরও অনেকে তখন তৈরি হয়ে যাবেন। এভাবেই বেআইনি প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, প্রতিরোধ দিনদিন বাড়তে থাকবে।

এই পর্যায়ে এসে নিরপেক্ষ একটা অবস্থানে দাঁড়ানো হয়ে পড়বে অসম্ভব। শুরুতে যারা বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেননি যে, এই ‘পাগলাটে মানুষগুলো’ কী চান, তারাও এদের ব্যাপারে চিন্তা করতে বাধ্য হবেন। তাদের ভাবনাগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করবেন। এ থেকে হয় তারা সেই পাগলাটেদের পক্ষে দাঁড়াবেন বা বিপক্ষে। তাদের এই কর্মকাণ্ডগুলো সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তাদের নতুন চিন্তাভাবনাগুলো সাধারণ মানুষের মাথায় ঢুকে পড়তে শুরু করবে। আর অনেকেই তাদের অনুসারী হয়ে উঠবে। এরকম একটা তৎপরতা কয়েকদিনের মধ্যে এমন প্রচার তৈরি করবে, যা হয়তো হাজারটা প্রকাশনা দিয়েও সম্ভব হতো না।

সবচেয়ে বড় কথা, এই কর্মকাণ্ড-তৎপরতাগুলো একটা বিদ্রোহী চেতনার জন্ম দেবে: সাহস উৎপাদন করবে। পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট-নিরাপত্তারক্ষী-সৈনিকদের সমর্থনে থাকা পুরোনো শাসকদের শুরুতে মনে হবে অদম্য। ঠিক যেমনটা মনে হয়েছিল বাস্তিল দুর্গকে। কামানের গোলা দিয়ে ঠাঁসা উঁচু দেয়ালগুলোর বাইরে দাঁড়ানো নিরস্ত্র মানুষের চোখেও শুরুতে এটা ছিল দুর্ভেদ্য। কিন্তু দ্রুতই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলাকে যতটা দৃঢ় মনে হয়েছিল, ততটা আসলে নয়। একটা সাহসী কর্মকাণ্ড অল্প কদিনে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ভীত কাঁপিয়ে দেয়, অতিকায় মূর্তি নড়বড়ে করে দেয়; তো আরেকটি বিদ্রোহ পুরো প্রদেশ টালমাটাল করে তোলে। আর সবসময়ই খুব জরবদস্ত মনে হওয়া সেনাবাহিনী পিছু হটে অল্প কিছু কৃষকের হাতে লাঠি আর পাথর দেখে। মানুষ অবাক হয়ে দেখে যে, রাষ্ট্র-সরকারের দৈত্যটা আসলে ততটা ভয়ঙ্কর কিছু নয়, যেমনটা তারা মনে করেছিল। তারা অসচেতনভাবেই এটা মানতে শুরু করে যে, অল্প কিছু তেজী কর্মকাণ্ডই দানবটাকে মাটিতে নামিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট। তাদের মনে আশার জন্ম নেয়। আমাদের স্মরণ করা উচিত যে, ক্রোধ মানুষকে বিদ্রোহের দিকে তাড়িত করে। আশা থেকেই আসে জয়ের আকাঙ্ক্ষা, যা জন্ম দেয় বিপ্লবের।

সরকার তীব্রভাবে এই বিপ্লবের পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করে। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বর্বর আচরণ করতে থাকে। অন্য সময় দমন-পীড়নের মাধ্যমে এসব ঠাণ্ডা করে দিতে পারলেও, বিপ্লবের উত্তাপ-উত্তেজনায় এখন তৈরি হয় ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। এসব নিপীড়ন উল্টো তৈরি করে নতুন নতুন বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড। সেটা হতে পারে ব্যক্তিক বা সামষ্টিক। এসব তৎপরতা বিদ্রোহীদের নিয়ে যায় নায়কোচিত সব কর্মকাণ্ডের দিকে। আর খুব দ্রুততার সঙ্গে এসব  তৎপরতা প্রচারিত হতে থাকে। আলোচনা তৈরি করে জনপরিসরে। বিপ্লবী রাজনৈতিক দলগুলোও এসব তৎপরতায় আরও সংহত হতে থাকে। যদিও তারা শুরুতে ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করেনি বা কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বিরোধিতাও করেছে।

সাধারণ বিভেদ তৈরি হতে থাকে সরকার, শাসক শ্রেণী ও সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর মধ্যেও। কেউ কেউ বিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেয়। কেউ কেউ আবার কিছুটা ছাড় দেওয়ার পক্ষে। কেউ কেউ আবার এগিয়ে যায় আরও বেশ খানিকটা। বিদ্রোহের চেতনাকে তুষ্ট করতে গিয়ে অনেকেই ঘোষণা দেয় সুযোগ-সুবিধা পরিত্যাগের যাতে ভবিষ্যতে আবার শাসন করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ভেঙে যায় সরকার ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর চিরায়ত ঐক্য।

কোনো ক্ষেত্রে বর্বর প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শাসক শ্রেণী আবারও সুরক্ষিত হতে চায়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। লড়াইটা হয়ে ওঠে আরও তীব্র, আরও নির্মম। আর আসন্ন বিপ্লবটা হয়ে ওঠে আরও রক্তক্ষয়ী। অন্যদিকে, শাসক শ্রেণী যে কিছু পরিমাণ ছাড় দেয়, তাতে বিদ্রোহের স্পৃহা আরো বেশি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। বিপ্লবের আগুন আরও বেশি করে জ্বলে ওঠে। সাধারণ মানুষ কিছুদিন আগেও হয়তো এসব ছিটেফোটা দক্ষিণা নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু বিপ্লবের মুহূর্তে তারা লক্ষ্য করে যে, তাদের শত্রু শাসক শ্রেণীর অবস্থা টালমাটাল। বিজয় আসন্ন। তাদের সাহস বাড়তে থাকে। যে মানুষটা কিছুদিন আগেও নিজের দৈন্যদশার কথা ভেবে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলত, সেই মানুষটিই এখন মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে মিছিলে সামিল হয়। জয় করতে যায় নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎ।

শেষপর্যন্ত বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। পূর্ববর্তী সংগ্রামটা যত তিক্ত হয়, বিপ্লবের চেহারাও ততটা ভয়ানক রূপ ধারণ করে।

আর্টওয়ার্ক: ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলিউশন ১৭৯৫
শিল্পী: আগস্ত ভিসোঁ
সূত্র: পিন্টারেস্ট

বিপ্লব-বিদ্রোহ কোন পথে হাঁটবে, তা নির্ভর করে বেশ কিছু পরিস্থিতির ওপর। নিঃসন্দেহে পরিস্থিতিই নির্ধারণ করে দেয় বিপ্লবের প্লাবনটা কেমন রূপ ধারণ করবে। তবে প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রগতিশীল শক্তি কী ধরনের তেজদীপ্ত কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছে, তা বিচার করে আগে থেকেই কিছু অনুমান দাঁড় করানো যায়।

কোনো পার্টি হয়তো সমাজবদলের তত্ত্ব খুব ভালোভাবে তৈয়ার করেছে। যা অর্জন করতে চায়, সে সংক্রান্ত বিস্তারিত পরিকল্পনাও হাজির করেছে। ব্যাপকভাবে প্রচার করেছে নিজেদের কথাবার্তা। বক্তৃতার মাধ্যমে, বই-প্রকাশনার মাধ্যমে। কিন্তু এই পার্টি হয়তো রাস্তায়, জনপরিসরে নিজেদের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটাতে পারেনি পর্যাপ্তভাবে। যে কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্য দিয়ে তাদের চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটার কথা, সেরকম কর্মকাণ্ড তারা পরিচালনা করতে পারেনি। তাহলে বলতে হয়, সেই পার্টি খুবই অল্প কাজই করেছে। অথবা মূল শত্রুর বিরুদ্ধে তারা হয়তো কিছুই করেনি। যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা ধ্বংস করতে চায়, সেগুলোকে তারা আক্রমণ করেনি। তাহলে বুঝতে হবে, এই পার্টির শক্তি শুধু তত্ত্বে, কাজে না। বিদ্রোহের চেতনা জাগ্রত করার জন্য তাদের অবদান খুব সামান্যই। অথবা বিপ্লবের সময় নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রয়োজনীয়তাকে তারা অগ্রাহ্য করেছে। ফলস্বরূপ, দেখা যায়, এই পার্টি থেকে গেছে অনেকটাই অপরিচিত শক্তি হিসেবে। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যায়নি প্রাত্যহিক নানা তৎপরতা-কর্মকাণ্ডের মধ্যে। তারা সক্রিয় হলে তাদের তৎপরতার খবর পৌঁছে যেত দূরদূরান্তে। তারা গণমানুষের চেতনায় জায়গা করে নিতে পারেনি বা পারলেও সেটার পরিমাণ খুবই নগণ্য। বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে রাজপথে বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে তাই সেই পার্টি নিজেদের মেলাতে পারে না। জনপ্রিয় শ্লোগানগুলোতে তারা নিজেদের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে না।

এমন পার্টির সবচেয়ে সক্রিয় লেখককে তাঁর পাঠকরা চিনতে পারেন উচ্চ মেধাসম্পন্ন চিন্তাবিদ হিসেবে। কিন্তু সক্রিয় কর্মতৎপরতার সঙ্গে জড়িত হওয়ার মতো পরিচিতি বা সক্ষমতা তাঁর নেই। আর যেদিন রাস্তায় বিক্ষুব্ধ মানুষের ঢল নামবে, সেদিন জনতা তাদের কথা-পরামর্শই অনুসরণ করবে, যাদের তারা দেখেছে নানাবিধ তৎপরতার সঙ্গে জড়িত থাকতে। যারা হয়তো তাত্ত্বিকভাবে অতো পোক্ত বা নির্ভুল না। কিন্তু গণমানুষ তাদের চেনে অনেক ভালোভাবে। কারণ বিভিন্ন সময়ে জনসাধারণ তাদের দেখেছে নানাবিধ কর্মকাণ্ড-তৎপরতায় সামিল হতে।

বিপ্লবের আগে যে পার্টি সবচেয়ে বেশি বিপ্লবী প্রচার চালিয়েছে আর বিদ্রোহের স্পৃহা ও সাহস দেখিয়েছে, বিপ্লবের উত্তাল সময়ে গণমানুষ তাদের দিকেই বেশি ঝুঁকবে। বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে তাদের পাশেই রাজপথে হাঁটবে। কিন্তু যে পার্টি বিপ্লবের আগে নানাবিধ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের সাহসী হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে না, ব্যক্তিমানুষ বা গোষ্ঠীকে বিপ্লবী চেতনায় অনুপ্রাণিত করার মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না, নিজেদের চিন্তাভাবনাকে কর্মে রূপান্তরিত করার অদম্য ইচ্ছা যাদের মধ্যে দেখা যায় না (এই ইচ্ছাটা যদি তাদের থাকত, তাহলে নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্যে সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ দেখা যেত। সাধারণ মানুষ বিদ্রোহে সামিল হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেগুলো দেখা যেত), যারা জানে না কিভাবে নিজেদের প্রতীক-পতাকা জনপ্রিয় করে তুলতে হয়, নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব বিস্তৃতি ঘটাতে হয়, সেই পার্টি নিজের কর্মসূচির ক্ষুদ্র একটা অংশও বাস্তবায়ন করতে পারে না। বিপ্লবী পরিস্থিতিতে তাদেরকে একপাশে সরে যেতে হয়। আর প্রধান জায়গা দখল করে ক্রমাগত নানাবিধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া সক্রিয় পার্টিগুলো।

বিগত সময়ের সব বড় বড় বিপ্লবের ইতিহাস থেকে আমরা এই জিনিসগুলোই শিখতে পারি। [ফরাসি বিপ্লবে] বিপ্লবী বুর্জোয়ারা এটা খুব ভালোভাবে বুঝেছিল। তারা যখন রাজতন্ত্রের কর্তৃত্ব ধুলিসাৎ করার লক্ষ্যে জনসাধারণের মধ্যে বিদ্রোহী চেতনা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছে, তখন বিক্ষোভ-বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার কোনো উপায়ই অগ্রাহ্য করেনি। অষ্টাদশ শতকের ফরাসি কৃষকরা এটা নিজেদের প্রবৃত্তি দিয়েই বুঝতে পেরেছিল যে, সামন্ততান্ত্রিক অধিকারের বিলুপ্তি ঘটানো কতটা জরুরি। আর অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল একই রকম নীতি-আদর্শ নিয়ে কাজ করেছিল শহরের শ্রমিকদের মাঝে। চেষ্টা করেছিল তাদের বিদ্রোহী চেতনা জাগিয়ে তুলতে। আর তাদের তাড়িত করেছিল মজুরি-শ্রমিকদের সহজাত শত্রু, উৎপাদনের উপায় ও কাঁচামাল কুক্ষিগত করে রাখা মালিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে।

তথ্যপঞ্জি

১. ফরাসি শব্দ Debacle অর্থ collapse, crash, break-up। বাংলায় ভেঙ্গে পড়া।

২. Feudal baron এর সহজ বাংলা করা হয়েছে সামন্ত প্রভু। মধ্যযুগে ইউরোপে রাজা কর্তৃক দেয়া উপাধি এবং ভূমি-বন্দোবস্তপ্রাপ্ত। ব্যারনরা বংশানুক্রমিকভাবে জমির মালিকানা পেতেন। এর চল শুরু হয় ইংল্যান্ডে। তবে ফ্রান্স, জার্মানি, প্রুশিয়া, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডসহ নানা জায়গায় তা পরবর্তীতে ব্যপ্ত হয়। ব্যারনরা রাজার প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করতেন এবং কর আরোপ ও সংগ্রহ করতেন।

৩. Bailiff– এর সহজ বাংলা করা হয়েছে অধিকারী। মধ্যযুগে ইউরোপে প্রশাসনিক ও বিচারিক ফরমান তামিলকারী কর্তৃপক্ষ।

৪. Gendarme– এর সহজ বাংলা করা হয়েছে নিরাপত্তা রক্ষী। মধ্যযুগে ইউরোপে দৈনন্দিন আইন-শৃঙ্খলা দেখভালে সামরিক বাহিনী  থেকে  লোক এনে তৈরি করা এলিট ফোর্স।

পার্থ প্রতীম দাস

পার্থ প্রতীম দাস লেখক, অনুবাদক ও অরাজপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট। সম্পাদনা করছেন অরাজ গ্রন্থগুচ্ছ সিরিজ। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। যুক্ত ছিলেন ছোটকাগজ সম্পাদনার সঙ্গে। ২০০৭ সালের আগস্ট বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন সক্রিয়ভাবে। পরবর্তীতে কারাবন্দী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠা কর্তৃত্ব বিরোধী আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষে যুক্ত হন সাংবাদিকতা পেশায়। বর্তমানে সাংবাদিকতা বিষয়ক গবেষণা প্রকল্পে কাজ করছেন। যোগাযোগ: ইমেল: partho2830@gmail.com