অরাজ
শিল্পী: জ্যাকব লরেন্স (১৯১৭-২০০০)
প্রচ্ছদ » যোরাহ্ নীল হার্স্টন ।। কালোমানুষ হতে আমার যেমনটা লাগে

যোরাহ্ নীল হার্স্টন ।। কালোমানুষ হতে আমার যেমনটা লাগে

ভাষান্তর: আনতারা ফারজানা তন্বী

আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটার কথা যেদিন আমি প্রথম কালো মানুষ হয়েছিলাম।”

যোরাহ্ নীল হার্স্টন (১৮৯১ ১৯৬০) একজন আফ্রোআমেরিকান নৃবিজ্ঞানী, ঔপন্যাসিক, ও অধিকার কর্মী; বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধজুড়ে আফ্রোআমেরিকান সমাজ ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রথম সারির চিন্তক। ১৯২০এর দশকে ‘হার্লেম রেনেসাঁ’ নামে খ্যাত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠকদের একজন। মার্কিন নৃবিজ্ঞানের সূচনাপর্বের ইতিহাসে খুব স্বতন্ত্র এক চরিত্র, ঔপন্যাসিক ও লেখক হিসেবে মার্কিন সাহিত্যেও যোরাহ্ কালজয়ী হিসেবে চর্চিত হন এখনো। এই রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘হার্লেম রেনেসাঁ’র তুরীয় পর্বে (১৯২৮)ওয়ার্ল্ড টুমোরো’ সাময়িকীতে, যখন এক সারি আফ্রোআমেরিকান লেখক নিজের আত্মসত্তা নিয়ে অকপট ভাষ্য লিখছিলেন। ১৭টি খেয়ালি অনুচ্ছেদে আত্মসত্তাকে অনুভবের যে বিবরণ যোরাহ্ হাজির করেছেন তা আমেরিকার অধিকার আন্দোলনের এক কাব্যিক মাইলস্টোন হিসেবে পঠিত হয় এখনো।সম্পাদক

ছবি: যোরাহ্‌ নীল হার্স্টনের পোর্ট্রেট

১। আমি কালো মানুষ, কিন্তু এ নিয়ে আমি কোনো আফসোসের আবহ তৈরি করি না শুধু এটুকু ছাড়া যে, আমিই যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র ‘কালামানুষ’ যার মায়ের দিকের নানা একজন ইন্ডিয়ান চিফ ছিল না।

২। প্রথম যেদিন ‘কালামানুষ’ হলাম, সেদিনটার কথা খুব মনে আছে। তেরো বছর বয়স পর্যন্ত ফ্লোরিডার ছোট একটি কৃষ্ণাঙ্গ শহর এ্যটনভিলে থাকতাম আমি। পুরো শহরটাই ছিল আমার মতো কালো মানুষদের শহর। ততদিন পর্যন্ত শাদা মানুষ বলতে দেখেছি একমাত্র যারা শহরের রাস্তা ধরে অরল্যান্ডো আসাযাওয়া করত। স্থানীয় শাদারা ধুলোমাখা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরেবেড়াত, উত্তরের ট্যুরিস্টরা চলাচল করত গাড়িতে, ধূলিময় গ্রামের রাস্তা ধরে। দক্ষিণের লোকেরা শহরের লোকদের চিনত, এবং তারা এই পথে যাওয়ার সময় নির্বিকারভাবে আখ চিবাতে চিবাতে শহরটা পার হতো। অবশ্য উত্তরের ওরা একটু আলাদা ছিল এদিক দিয়ে, খুব সাবধানে মাঝে মাঝে গাড়ির পর্দা সরিয়ে তাকাত আমাদের দিকে। আর এদিকে তাদেরকে দেখার জন্য গ্রামবাসিরা সন্তর্পণে বেরিয়ে আসত, ভয় পেত কাছে যেতে। দেখত বারান্দার আড়াল থেকেই। খুব উৎসুক কেউ কেউ সাহস করে বারান্দার বাইরে সামনের দিকে চলে আসত, গ্রাম দেখে ট্যুরিস্টরা যে আনন্দ পেত, গ্রামের শেষ মাথা পর্যন্ত যেতে থাকা ট্যুরিস্টদের দেখে তারা সমান আনন্দ পেত।

৩। সামনের বারান্দাটিতে যাওয়া গ্রামের অন্যান্যদের জন্য বেশ সাহসী ও বিপজ্জনক কাজ মনে হলেও আমার জন্য তা ছিল গ্যালারি সিটের মতো। গেটের খাম্বার একদম উপরের অংশটা ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। জন্মসূত্রে প্রথম রাতেই দেখতে যাওয়া নাটকপাগল দর্শকের জন্য প্রেক্ষাগৃহের সেরা আসনটির মতো। আমি শুধু তাদের আটপৌরে নাটক দেখাটা উপভোগই করতাম না, এগুলো যে আমার ভালো লাগে সেটা পাত্রপাত্রীদের জানাতেও দ্বিধা করতাম না। প্রায়ই চলতি পথিকদের সাথে আমি কথা বলতাম। তারা আমার স্যালুটের উত্তর দিলে আমি হাত নাড়তাম, এরকম কিছু একটা বলতাম: “হাওডিডুওয়েলআইথ্যাংকইউহোয়ারইউগোয়িন?” তখন মোটরগাড়ি বা ঘোড়ার যাত্রীরা খানিক থামত, খানিক ভদ্রতাসূচক কুশল বিনিময় করত, কেউ বা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গল্প করত। কথা বলতে বলতে আমি তাদের সাথে ‘পথের খানিকটা’, ফ্লোরিডার এই দিকটাতে লোকে যেমন বলে, যেতে চাইতাম। কিন্তু এই আলাপের মাঝে যদি আমার পরিবারের কেউ সামনের দিকটাতে এসে পড়ত, এই দেনদরবার খুব রুঢ়ভাবে ভেঙে যেত। তারপরও, আমিই ছিলাম প্রথম ‘ওয়েলকাম টু আওয়ার স্টেইট” ফ্লোরিডিয়ান এবং আশা করি মিয়ামি চেম্বার অফ কমার্স দয়া করে সেটা খেয়াল করবেন।

৪। এই সময়টাতে কালো মানুষদের সাথে শাদা মানুষদের পার্থক্য বলতে আমি বুঝতাম শুধু এটুকুই যে তারা এই শহর দিয়ে শুধু যাতায়াত করে, কখনো এখানে থাকে না। তারা আমার কথা আর গান শুনতে পছন্দ করত, আমাকে ‘পারসেমেলা’ নেচে দেখাতে বলত, এবং এসব করার জন্য সদয় হাতে তাদের খুচরা রুপার মুদ্রাগুলো দিয়ে দিত। এটা আমার কাছে খুব অদ্ভূত লাগত যে এসব আমি এমনি এমনি করতেই এত পছন্দ করতাম যে পয়সাগুলো যেন আমাকে থামানোর জন্য দেয়া ঘুষ, শুধু যারা দিচ্ছে তারা তা জানে না। কিন্তু কালোমানুষরা কখনো আমাকে পয়সা দিত না। তারা আমার এই মজা করার প্রবণতাগুলোকে প্রশ্রয় দিত না, কিন্তু হাজার হোক আমি তাদের নিজেদেরই যোরাহ্ ছিলাম। আমি তাদের লোক ছিলাম, কাছের হোটেলগুলোর কাছে, গাঁগ্রামে আমি ছিলাম প্রতিদিনের যোরাহ্।

শিল্পী: জ্যাকব লরেন্স (১৯১৭ – ২০০০)

৫। কিন্তু পরিবারের পরিবর্তনটা আসতে শুরু করে যখন আমার বয়স তেরো, এবং আমাকে তারা জ্যাকসনভিলের স্কুলে পাঠিয়ে দেয়। আমি এ্যটনভিল ছেড়ে যাই, করবী ফুলের এক শহর আর আগের যোরাহ্‌কে পেছনে রেখে। জ্যাকসনভিলের পাড়ে আমি যখন নৌকা থেকে নামলাম, আমি আর সেই যোরাহ্ থাকলাম না। দেখা গেল একসমুদ্র পরিবর্তন আমার জীবনকে গ্রাস করেছে। আমি আর সেই অরেঞ্জ কাউন্টির যোরাহ্ নেই, আমি হয়ে গেলাম একটা ছোট কালো মেয়ে। আমি পদে পদে টের পেতে থাকলাম এই পাল্টে যাওয়া। টের পেলাম আমার মনের অন্তঃস্থলে, টের পেলাম আয়নায়, আমি হয়ে গেলাম একটা ক্ষীপ্র গতির বাদামী বর্ণের মানুষ যেটা সে না পারবে ঘষে মুছে ফেলতে, না পারবে এই বর্ণিল পরিচয় থেকে পালাতে।

৬। আমি কিন্তু কোনো আফসোসরত ‘কালো’ নই। এজন্য আমার ভেতরে বা দৃষ্টির গভীরে কোনো তীব্র দুঃখ জমে নাই। এ নিয়ে আমি আদৌ কিছু মনে করি না। যারা ছিঁচকাঁদুনে নিগ্রোহুড চর্চা করত, মানে কালো হওয়াটাকে যারা মনে করত প্রকৃতির অসৎ এক বিচার যা তাদের পতিত করে রেখেছে এবং তাদের বাদবাকি চিন্তা ভাবনার মূলে ছিল এই মনোভাব। এমনকি আমার এই দিগ্বিদিক ক্ষতবিক্ষত জীবনেও আমি দেখেছি দুনিয়া আসলে শক্ত মানুষদের কদর করে এবং চামড়ায় কোনো এক বর্ণিল কণিকার উপস্থিতির তারতম্য তাতে খুব একটা হেরফের ঘটায় না। না, নিজের রঙ নিয়ে দুনিয়ার কাছে কান্নাকাটির সময় আমার নেই, তারচেয়ে আমি বরং আমার ঝিনুক খোলার ছুরিটি ধার দিয়ে সময় কাটাব।

৭। আমার কনুইয়ের কাছে সবসময়ই কিছু মানুষ আছে সদা আমাকে মনে করিয়ে দিতে যে আমি ক্রীতদাসের নাতনি। কিন্তু এটা কখনোই আমার ভেতরে কোনো বিষণ্ণতা জাগাতে পারেনি। দাসপ্রথা এখন ষাট বছর আগের অতীত। এটা অপসারণের অপারেশন সফল হয়েছে এবং রোগী এখন সুস্থ আছে, ধন্যবাদ। দাসপ্রথা বিলোপের ভয়াবহ সংগ্রাম, যা আমাকে সম্ভাব্য দাস থেকে একজন আমেরিকান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, আমাকে বলেছে দৌড়ের লাইনে দাঁড়াতে, আমেরিকার পুনর্নির্মাণ বলেছে ‘রেডি হও’, আর তার পরের প্রজন্ম বলেছে ‘ছুটে যাও’ আর আমি এক উড্ডীন সূচনা করেছি যে জীবনের সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে অতীতের দিকে তাকিয়ে কাঁদার সময় আমার নাই। দাসত্ব হচ্ছে সভ্যতার জন্য আমার চুকানো মূল্য, এবং এই বিনিময় আমার ইচ্ছাতে ঘটেনি। দাসত্ব ছিল কিছু লোকের দুর্ধর্ষ এক অভিযানের ফল যার দাম আমি শোধ করেছি আমার পূর্বসূরিদের জীবনের বিনিময়ে। গৌরব করবার মতো এত বড় কারণ পৃথিবীতে আর কারও নেই। এখন জয় করবার জন্য আছে পুরো দুনিয়া, হারাবার নেই কিছুই। ভাবতেই ভালো লাগে যে এখন আমার যে কোনো কাজের জন্য আমি দ্বিগুণ নন্দিত বা নিন্দিত হবো। কোনো জাতীয় মঞ্চের কেন্দ্রে থাকাটা আসলেই উত্তেজনাকর যখন এর দর্শকরা বুঝে উঠতে পারছে না যে তারা হাসবে নাকি কাঁদবে।

শিল্পী: বিওফোর্ড ডিলানেই (১৯০১-১৯৭৯)

৮। আমার শ্বেতাঙ্গ প্রতিবেশির অবস্থান ছিল আমার চেয়ে করুণ। কোনো বাদামি ভুত খাবার সময় আমার পাশের চেয়ারটি উপরে তুলত না। বিছানায় ঘুমানোর সময় কোনো কালো ভুত আমার পায়ে পা তুলে দিত না। কারো যা আছে তা ধরে রাখার খেলাটা নতুন করে কিছু পাওয়ার খেলার মতো উত্তেজনাকর না।

৯। নিজেকে আমার সারাক্ষণ কৃষ্ণাঙ্গ মনে হতে থাকে না। বরং এখন আমি নিজের অবচেতনে হিজরতের আগের সেই এ্যটনভিলের যোরাহ্‌কে খুঁজে পাই। নিজেকে আমার সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণাঙ্গ মনে হয় যখন আমাকে তীক্ষ্ণ কোনো শ্বেতাঙ্গ পটভূমির বিপরীতে ছুঁড়ে ফেলা হয়।

১০। উদাহারণ হিসেবে বার্নাডের কথাই বলি। ‘হাডসনের জলের ধারে’ এলে আমি নিজের বর্ণ টের পাই। হাজার হাজার শাদা মানুষদের ভিড়ে আমি একাই যেন এক অন্ধকার পাথরের মতো ভেসে ওঠি, আবার ডুবে যাই, কিন্তু এই ভাসাভাসির মাঝেও আমি অনড়, সেই আমিই থাকি। যখন জোয়ারে ডুবে যাই, আমি আমিই থাকি, নেমে যাওয়া বান আবার আমাকেই উদ্ভাসিত করে।

১১। আবার কখনো কখনো ঘটনা পুরো উল্টো ঘটে। আমাদের মাঝে একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষ বসলে বৈসাদৃশ্যের তীক্ষ্ণতা আমার জন্য সমানই থাকে। যেমন যখন আমি ‘নিউ ওয়ার্লড ক্যাবারে’র বদ্ধ বেজমেন্টে একজন শাদা মানুষের সাথে বসি, আমার রঙ প্রকট হয়। আমরা বলার মতো কথা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে থাকি আর জ্যাজ শিল্পীরা সেই শূন্যতা পুষিয়ে দেয়। জ্যাজ বাজনদারদের পরিবেশনের যে নাটুকে চরিত্র, তাতে এটা ঘনঘন ঘটতে থাকে। দুই পরিবেশনার মাঝে এরা কোনো ফাঁপা কথায় না মেতে পরেরটা শুরু করে দেয়। সুর, লয় আর মাদকীয় ছন্দে জ্যাজ আমাদের শ্বাসরুদ্ধ করে তোলে, হৃদয়কে বিদীর্ণ করে। এই অর্কেস্ট্রা আরো তুঙ্গে উঠতে থাকে, পেছনের পায়ে উত্তুঙ্গ ভর রেখে তারস্বরে আদিম চিৎকারকে ফিরিয়ে আনে, তাকে আবার বিদীর্ণ করে ফেলে, জঙ্গলের গহীনে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত খামচে ধরে রাখে। জ্যাজ ধর্ম আমি নিধর্মী হয়ে অনুসরণ করি, উদযাপন করি। নিজের ভেতরেই আমি এক ক্ষ্যাপাটে নাচ শুরু করি, নিঃশব্দে চিৎকার করি, উল্লাসে চিৎকার করি; নিজের কুঠারটি আমি নিজের মাথার উপরে ঘোরাতে থাকি, কোনো একটা কিছুর দিকে নির্ভুল নিশানায় ছুঁড়ে মারি! আমি জঙ্গলে আছি এবং জঙ্গলের নিয়মে চলি। আমার মুখে লালহলুদ আঁকিবুকি, আমার শরীর নীল রঙ মাখা। আমার হৃৎপিণ্ড দামামার তালে বাজতে থাকে। আমি কিছু একটাকে খুন করতে চাই, ব্যথা দিতে চাই, মৃত্যু দিতে চাই, কিন্তু সেটা কী তা আমি জানি না। ঠিক তখনই বাজনাটা থেমে যায়। অর্কেস্ট্রার শিল্পীরা তাদের ঠোঁট মুছে নিতে থাকে, আঙুলগুলোকে বিশ্রাম দেয়। শেষ মুর্ছনাটুকুর সাথে আমি আস্তে আস্তে কুঁকড়ে সভ্যতা নামের আলতো প্রলেপটার নিচে ফিরে আসতে থাকি এবং দেখি যে আমার শাদা বন্ধুটি নিজের সিটে নিশ্চল বসে থেকে শান্তভাবে সিগারেট টানছে।

শিল্পী: জ্যাকব লরেন্স (১৯১৭ – ২০০০)

১২। ‘এদের এখানে মিউজিকটা ভালো হয়’, টেবিলে আঙুল বাজাতে বাজাতে সে বলে।

১৩। মিউজিক। লালনীল আবেগের শিশিরগুলো তাকে স্পর্শ করেনি। আমি যা অনুভব করেছি সেটা সে শুধু শুনতে পেয়েছে। আমার থেকে সে বহুদূরে, আমি তাকে আমাদের মাঝে জেঁকে বসা সমুদ্র আর মহাদেশ পেরিয়ে আবছা দেখতে পারছি। নিজের শুভ্রতা নিয়েও সে বড় বিবর্ণ, আর বিপরীতে আমি দারুণ বর্ণিল।

১৪। কখনো কখনো মনে হয় আমার কোনো জাতিবর্ণ নেই। আমি শুধু আমিই। যেমন, নিজের হ্যাটখানা নিজের নির্দিষ্ট কায়দায় মাথায় দিয়ে আমি যখন হার্লেম সিটির সেভেনথ অ্যাভিনিউতে হাঁটতে বের হই, নিজেকে তখন ফোর্টি সেকেন্ড স্ট্রিট লাইব্রেরির সামনের দুর্বিনীত সিংহগুলোর মতো মনে হয়। আমার অনুভব যেটুকু বুঝতে পারি, ‘বৌল মিচে’র রাস্তায় রাজকীয় বাহনে বসা পেগি হপকিন্স জয়েসের জমকালো পোশাক, খুব অভিজাত ভঙ্গীতে দুলতে থাকা হাঁটু জোড়া আমার বাসনায় কোনো দাগ কাটে না। আমার ভুবনজুড়ে শুধু যোরাহ্ উদয় হয়। আমি কোনো জাতিবর্ণের নই, আমি কোনো সময়ের নই। আমি পুঁতির মালা গলায় শ্বাশ্বত সেই নারীত্ব।

১৫। আমেরিকান নাগরিক এবং কৃষ্ণাঙ্গ হওয়া নিয়ে আমার আলাদা কোন অনুভূতি নেই। আমি বড় জোর এই সীমান্তজুড়ে উত্থিত মহাত্মার এক ক্ষুদ্র কণা। ভুল বা শুদ্ধ যাই হোক, এটা আমার দেশ।

১৬। কখনো কখনো টের পাই যে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি, কিন্তু সেজন্য আমার রাগ হয় না। এসব আমাকে বড় জোর আশ্চর্য করে। একজন মানুষ কীভাবে আমার আনন্দময় সঙ্গ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারে? এটা আমার বুঝের বাইরে।

১৭। কিন্তু সর্বোপরি, নিজেকে আমার একটি দেয়ালে ঠেক দিয়ে রাখা ইত্যাকার জিনিসে ঠাসা বাদামি ব্যাগ মনে হয়। দেয়ালের বিপরীতে আরও সব সাদা, লাল এবং হলুদ ব্যাগের সাথে রাখা এক ব্যাগ। ভেতরের সব ঢেলে বের করলে দেখা যায় এলেবেলে সব অমূল্য, অথচ মূল্যহীন ছোট ছোট জিনিস। একটি স্বচ্ছ জলজ হীরে, সুতাশূন্য নাটাই, ভাঙা কাঁচের কিছু টুকরো, একটু তার, একটা দরজার চাবি যে দরজা বহু বছর আগেই ভেঙে গেছে, জং ধরা একটা ছুরি, এক জোড়া পুরোনো জুতো যা তুলে রাখা ছিল সেই রাস্তার জন্য যে রাস্তা না কখনো ছিল এবং না কখনো হবে, চাপানো জিনিসের ভার বইতে না পেরে বেঁকে যাওয়া একটা পেরেক, একটি বা দুটি শুকনো মরা ফুল যারা সামান্য সুগন্ধ এখনো ধরে রেখেছে। আপনার হাতে এখন সেই বাদামি ব্যাগটি। মেঝেতে পড়ে আছে তার ভেতরের হাবিজাবি সবকিছু— এই ব্যাগের এসব হাবিজাবির মতো আর সব ব্যাগও কি খালি করে দেখা যায়, সবগুলোর সব জিনিস কী একসাথে ঢিবি করে রাখা যায়, কোনো জিনিস অদলবদল না ঘটিয়ে কি ব্যাগগুলো আবার ভরে রাখা যায়, এক টুকরো রঙিন কাঁচ এদিকঅদিক হলে হয়তো খুব কিছু আসে যায় না। হয়তো প্রথম বিশালকায় ব্যাগটি এভাবেই প্রথম ভরা হয়েছিল— কে জানে?

আনতারা ফারজানা তন্বী

আনতারা ফারজানা তন্বী পড়াশোনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। যুদ্ধদলিল প্রকল্পে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন রাজশাহী জেলা কো-অর্ডিনেটর হিসেবে। ইতোমধ্যে তার কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন নবীন লেখকদের সঙ্গে যৌথ সংকলনে। পাশাপাশি নিজেও সম্পাদনা করেছেন ক্যাম্পাস-ভিত্তিক ছোট কাগজ ’স্নান’-এর দুইটি সংখ্যা। কাজ করছেন সাহিত্যিক সংগঠন ’চিহ্ন’-র সাথে। অল্প কিছু দিন নাট্যকর্মী হিসেবে যুক্ত ছিলেন ’অনুশীলন নাট্যদল’-এ। ছোট থেকেই আবৃত্তির প্রতি আগ্রহের কারনে নিয়মিত চর্চা করতে গড়ে তুলেছেন ক্যাম্পাস-ভিত্তিক আবৃত্তির সংগঠন ‘স্বরায়ণ’। তার ইচ্ছে একটা উন্মুক্ত গ্রন্থাগার তৈরী করবার এবং গোটা বিশ্ব ঘুরে ঘুরে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র দেখবার।