- স্বাধীন সেন
২০৩২ বঙ্গাব্দের বাংলা নববর্ষ পালন না-করে পশ্চিম বাংলা, ভারতের বিজেপির পক্ষ থেকে হিন্দু নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানো হয়। সূত্র: ফেসবুক
কিন্তু এবারের ১৪৩২ সালের বাংলা নববর্ষ বিজেপি ও বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের উদ্যোগে পালন করা হয়। সেখানে বাংলা নববর্ষকে শশাঙ্ক অব্দ হিসেবে পালন করা হয়। সূত্র: ফেসবুক


এ বছরেই পরিকল্পিতভাবে সাধারণ সপ্তম শতকের তৎকালীন গৌড়ের শাসক শশাঙ্ককে হিন্দুত্ববাদীরা বঙ্গাব্দের প্রণেতা হিসেবে খাড়া করানোর প্রবল তৎপরতা শুরু করেছে। তার নমুনার মধ্যে উপরে বামদিকে শশাঙ্কের কল্পিত প্রতিকৃতি এঁকে ব্যাপকভাবে প্রচারণা যেমন হয়েছে, তেমনই তৎকালীন গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ হিসেবে শনাক্তকৃত বর্তমান পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদের চিরুটিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের ওপরে শশাঙ্কের ওই প্রতিকৃতিতে পুজা-অর্চনাও করা হয়েছে উদযাপন করে। প্রধানত পশ্চিম বাংলার নির্বাচনী রাজনীতিতে দাপট দেখানোর জন্য বিজেপি এর আগে উত্তর ভারতের অনুকরণে রামনবমী উদযাপন ও হনুমান জয়ন্তী উদযাপনের ‘ঐতিহ্য’ পশ্চিম বাংলায় প্রচলন করে। মহারাষ্ট্রের শাসক শিবাজিকেও বাংলা অঞ্চলে জনপ্রিয় এবং মোগল তথা মুসলমানদের পরাভূত করে হিন্দুত্বকে রক্ষা করার নায়ক হিসেবে পরিচিত করে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে না-পারার কারণে নতুন করে বাংলা অঞ্চলেরই একজন শাসককে হিন্দুত্বের ত্রাণকর্তা হিসেবে পরিবেশন করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। শশাঙ্ক সম্পর্কে ঐতিহাসিক উৎসগুলো ভীষণ অস্পষ্ট এবং বিভিন্ন স্থান ও কালে রচিত। অন্যান্য বিভিন্ন শাসকের মতনই শশাঙ্কর জীবন ও কাজকর্ম অতিকথন, পরিচয়বাদী কেচ্ছা, আর পরস্পর-বিরোধী বয়ানে আকীর্ণ। একদিকে তিনি শৈব হিসেবে পরিচিত, অন্যদিকে তিনি উত্তর ভারতের বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বী শাসক হর্ষবর্ধনের আক্রমণ থেকে গৌড় অঞ্চলকে (যে-অঞ্চলের তৎকালীন সীমানা ও আয়তন সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ইতিহাসনির্ভর উপাত্ত পাওয়া যায় না) রক্ষা করেছিলেন বলে বাংলা অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদগণের লেখালেখিতে পরিচিত। আবার, হর্ষবর্ধনের জীবনী হর্ষচরিত-এ আর চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের কথিত ও পরে লিপিবদ্ধ বৃত্তান্তে শশাঙ্ককে একজন বৌদ্ধবিদ্বেষী খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী অন্যান্য সংগঠনগুলো পশ্চিম বাংলায় হিন্দুত্ববাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এই অঞ্চলেরই একজন ঐতিহাসিক চরিত্রকে বেছে নিয়ে, তাকে উল্লেখ করে ইতিহাসের নয়া বয়ান নির্মাণ করছে। সেখানে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়ে বাংলা ক্যালেন্ডার প্রকাশ করা হয়েছে শশাঙ্কের বিভিন্ন কল্পিত প্রতিকৃতি আর কল্পিত জীবনবৃত্তান্তের ঘটনাবলির দৃশ্যগত পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে। বঙ্গাব্দ ও বাংলা নববর্ষ পালন ও উদযাপন এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক পার্টিগুলোর নির্বাচনী দাপট প্রতিষ্ঠার জন্য ঐতিহ্যের বাছাই করা রূপান্তর ও পুনর্গঠন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নিচের নিউজটিও বিজেপির প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসের নববর্ষ-কেন্দ্রিক তৎপরতার উদাহরণ, যেখানে বঙ্গাব্দের ইতিহাসগত বয়ান বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ঐতিহ্যের বয়ানের পাল্টা বয়ান হিসেবে খাড়া করানো হচ্ছে। অনলাইনে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে পরিকল্পিতভাবে এসব দৃশ্যগত কনটেন্ট প্রচার করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যা যেকোনো পরিচয়বাদী বয়ানের মাধ্যমে অপতথ্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কেন্দ্রীভূত ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে এবং বিশাল অর্থলগ্নির মাধ্যমে কার্যকর করার কেইস স্টাডি বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো বিভিন্ন নামে সমন্বিতভাবে বট আইডি ব্যবহার করে এবং অনেকক্ষেত্রে অ্যালগোরিদমের ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে অপতথ্য ও হেইট স্পিচ-কনটেন্ট প্রচার করে সফলতা অর্জন করেছে। বিশেষ করে ইতিহাসের এবং অতীত সম্পর্কিত বিভিন্ন মুসলমান-বিদ্বেষী কনটেন্ট প্রচার, মোগল শাসকদের দানবায়ন, বাছাই-করে কোনো শাসককে হিন্দু-পরিচয় আরোপ করে নায়কে পরিণতকরণ এই তৎপরতার অংশ। শশাঙ্কের পাশাপাশি মোগল আমলে বাংলা অঞ্চলের বারো ভূঁইয়া হিসেবে পরিচিত এবং মোগলদের সঙ্গে সংঘাত ও আপোষের সম্পর্কে লিপ্ত স্থানীয় শাসকদের মধ্যে কেদার রায় ও প্রতাপাদিত্যকেও মহিমান্বিত করে বিভিন্ন দৃশ্যগত কনটেন্ট, মিম ও পোস্ট প্রচারিত হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে পশ্চিম বাংলায় হিন্দুত্ববাদী আধিপত্য তৈরি করা আর নির্বাচনী সাফল্য অর্জন করার লক্ষ্য থাকলেও বাংলা অঞ্চলে হঠাৎ করেই শশাঙ্ককে আঞ্চলিক ঐতিহ্যের বয়ান নির্মাণের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন একটি প্রকল্প বলে ভাবার কোনো কারণ নাই। নয়া-হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প বর্তমান ভারতে একটি মনোলিথিক, সমসত্ত্ব, অনৈতিহাসিক উগ্র ও ফ্যাসিস্ট জাতীয়তাবাদী ও আধিপত্যবাদী বয়ান আর বিভিন্ন তৎপরতা যেমন সামনে নিয়ে আসছে, তেমনই বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় ঐতিহ্যের বাছাই করা পুনর্গঠন, পরিমার্জন আর পুনর্নবায়ন করছে। এখানে একইসঙ্গে সর্বভারতীয়করণের সমরূপীকরণ যেমন লক্ষণীয়, আবার আঞ্চলিক ও স্থানিকীকরণের তৎপরতাও লক্ষণীয়। নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিভিন্ন পরিস্থিতি আর প্রক্রিয়াগুলোকে হিন্দুত্ববাদী ঐতিহ্যের পুনর্গঠনে ব্যবহার করার বিভিন্ন কৌশল প্রণালীবদ্ধভাবে প্রয়োগে এই কুশীলবগণ সিদ্ধহস্ত বলেই মনে হবে। প্রচারমাধ্যম ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের জ্ঞানকে নিয়ন্ত্রণ করার বহুবিধ কার্যক্রম স্পষ্টতই নয়া-হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এই কার্যক্রমগুলোকে ঐতিহ্যের বাছাইকৃত পুনর্গঠনের স্থিতিস্থাপক অথচ বুনিয়াদি পরিচয়বাদী আধিপত্য তৈরি করার আর জারি রাখার তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে।

বিজেপির উদ্যোগে প্রকাশিত বাংলা ক্যালেন্ডারে চিত্রায়িত শশাঙ্কের দুটো প্রতিকৃতি ও জীবনের ঘটনার দৃশ্যগত পরিবেশন। দৃশ্যগত মাধ্যম ঐতিহ্যের বাছাইকরণ আর পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় ভীষণ কার্যকর ভূমিকা রাখে।

বিজেপির হিন্দুত্ববাদী বঙ্গাব্দের উদযাপন ও বয়ানের পাল্টা বয়ান উপজীব্য করে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের নিউজের স্ক্রিনশট
দিনাজপুরের বিরামপুরের জম্বুলেশ্বর মণ্ডপের চৈত্র–সংক্রান্তির মেলা এবং শিবমন্দিরের পূজা। গত এক দশকে এই মেলার ব্যাপ্তি ও সময়ের উপরে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা হয়েছে। অন্যান্য অনেক মেলার মতনই। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বৃহত্তর পরিসরে উৎপাদিত আতঙ্ক–অপরত্বের প্রতি বিদ্বেষ–নিরাপত্তাহীনতা মেলার উদযাপনের আচার ও আয়োজনে যেমন প্রভাব ফেলেছে তেমনেই প্রভাব ফেলেছে কেবল ‘ধর্মীয়’ হিসেবে মেলার পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশে বিদ্যায়তনিক আর ভদ্রবিত্তীয় বয়ানে ‘লোক’ বা ‘ফোক’ হিসেবে বিভিন্ন মেলার পরিচয় যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে মেলাগুলো ‘হারিয়ে– যেতে–বসা ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। অথবা কোনো বিশুদ্ধ–নির্ভেজাল–অপরিবর্তনীয় আচার–উৎসবের ক্রমাগত আধুনিকতা দ্বারা প্রভাবিত ও দুষিত সমাবেশ হিসেবে পরিবেশিত হয়। এসব বয়ানে মেলাগুলো কেবলই একধরনের জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের হয়ে ওঠা এবং প্রামাণ্যতার অপরিবর্তনশীল এবং নাগরিক জীবন থেকে দুরবর্তী রোমান্টিক ও এক্সোটিক ঐতিহ্য। মেলাগুলোর অন্য কোনো অর্থ নাই এবং এগুলো যাপিত জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিতও না। অথচ বাংলাদেশে মেলাগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় সাধকদের জীবন অথবা বিশেষ কাল অনুসারে আয়োজিত হলেও ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন স্থানিক ব্যবসা, সম্মিলন, নেটওয়ার্কের বিকাশ ঘটানোয় মেলাগুলোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। স্থানীয় কৃষি ও শিল্পের সঙ্গে আর গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও এই মেলাগুলোর সম্পর্ক গভীর।
দিনাজপুরের বিরামপুরের আশুরার বিলের পাশে চুনা পীরের উরস ও মেলা। বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনের ঋতু ভিত্তি, আবাদের নানা পর্বের সঙ্গে, কারিগরি উৎপাদনের বাৎসরিক বিভিন্ন ধরনের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মাচার, এবং উপলক্ষ্য সম্পর্কিত করে মেলা ও উৎসবের বিকাশ ঘটেছে। রূপান্তর ঘটেছে। নাগরিক ঐতিহ্য বিষয়ক চিন্তা ও বয়ানে সকল মেলাকে সমরূপীকরণ করা হয় জাতীয়তাবাদী চিন্তার ঐতিহ্যে মেলাগুলোকে ‘শিকড়ের সন্ধানে’র বাসনায় পরিণত করার কারণে। নাগরিক মধ্যবিত্তের চেতনায় মেলা মানেই গ্রামীণ, ফোক, রোমান্টিক উদযাপন, নগরের ব্যস্ত, বিচ্ছিন্ন, যান্ত্রিক জীবনযাপন থেকে সাময়িক মুক্তির পরিসর। আমি এই বাসনা ও কল্পনায় মন্দ কিছু আছে বলে মনে করি না। নাগরিক জনসংস্কৃতির পর্যালোচনা করলে এবং ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে জনসংস্কৃতির বহুবিধ ও জটিল রূপান্তরে হিসাব–নিকাশ করলে নাগরিক পরিসরে ঐতিহ্যের উদযাপন অশুদ্ধ, দূষিত অথবা বিকৃত কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করার কোনোই অবকাশ নাই। আবার নগর থেকে দূরে কোনো ‘গ্রাম্য পরিবেশে’, ‘সরল নিসর্গের মধ্যে’, ‘সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক ধারবাহিকতা’র সাক্ষ্য হিসেবে কোনো উৎসব–আয়োজন–উদযাপন–পারফরমেন্সকে পরিবেশন করার বয়ানও সমস্যাজনক। উভয়ক্ষেত্রেই ধরে নেয়া হয় যে, কোথাও না কোথাও দূষণমুক্ত, নির্ভেজাল, আদি ও অকৃত্রিম কোনো ঐতিহ্য টিকে রয়েছে। যুগের পর যুগ ধরে ‘গৌরবময় ঐতিহ্যে’র ধারায় আমরা একটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠী/জাতি/সম্প্রদায় হিসেবে এসব ঐতিহ্য অর্জন করেছি। এই বয়ানের প্রচ্ছন্ন ও অপ্রকাশ্য একটি অনুভূতি হল হারিয়ে ফেলার, লুপ্ত হয়ে যাওয়ার, দূষিত ও নষ্ট হয়ে যাওয়ার উদ্বেগ ও ভীতি। বিশুদ্ধ, পবিত্র, আমাদের পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য নানা বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলার ট্রমা। এই অনুভব ও ভাবাবেগ আধুনিক অনুভূতির ও সংবেদনের রূপান্তরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আধুনিকতা ও ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা আমাদের অনুভব–সংবেদন–আবেগের গঠন–রূপান্তর–বদলের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে কাজ করেছে। বিংশ শতকের শুরু থেকে একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে এই অঞ্চলের আধুনিক অভিব্যক্তি আর ভাষার দুনিয়ায় শহর/গ্রামের বৈপরীত্য নতুন মাত্রা পেয়েছে। এই গঠনে ও বয়ানে উৎপাদন–সম্পর্ক ও অর্থনীতির বদলে প্রচলিত জীবনযাপন রূপান্তরিত হওয়া আর মানুষের শহরমুখী অভিবাসনে শিকড়–বিচ্ছিন্ন হওয়াও বিষাদ ও বিপন্নতা, উন্মুলতা চৈতন্যের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে নগরের বিলাস, ভোগ, উপভোগ, প্রাচুর্য, চাকরির সুযোগ, শিক্ষিত হওয়ার আকুলতা, নতুন মেরিটোক্রেটিক ব্যবস্থায় শ্রেণিবিন্যাসে উপরের দিকে ওঠার বাসনা আমাদের যাপিত জীবনের অনিবার্য অংশ হয়ে উঠেছে। আধুনিকত্ব আর এই বিহ্বলতার লিপ্তি অনিঃশেষ। পরস্পরবিরোধী অনুভূতি আর আবেগ ঘরে ফেরার, গ্রামের বাড়িতে ফেরার অসম্ভব স্বপ্ন দেখায়। আবার শহরে গ্রাম, কল্পিত গ্রাম, বিশুদ্ধ ও আদি অতীত পুনরাবিষ্কার ও পুনর্নিমাণ করার শর্ত তৈরি করে। নব্য উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনকে পণ্যায়িত করে ফেলতে পারে। মেলা বা ঐতিহ্যের পুনরুৎপাদন ঘটে শপিং মলে, পার্কে, অভিজাত বিনোদন–কেন্দ্রে। একই সঙ্গে যে–মেলা ও উৎসবগুলো গ্রাম বা মফস্বলে বিভিন্ন উপলক্ষে আয়োজিত হতে থাকে তার সাজসজ্জা, পণ্য–বেচাকেনা, আচারের ধরন, স্থানিক পরিসরের বিন্যাস এবং সমবেত হওয়ার নানা প্রকারের মধ্যে বহুবিধ রূপান্তর ও বদল ঘটতে থাকে। আসলে শহুরে মধ্যবিত্তের চৈতন্যে ও কল্পনায় গঠিত হওয়া নিসর্গপ্রধান, সরল–জীবনযাপনময়, রোমান্টিক ও নস্টালজিক সেই গ্রাম কখনও ছিলই না। ঔপনিবেশিক আমলের গভীর রূপান্তর ও বদলের প্রক্রিয়ায় গ্রাম ও শহরের কল্পনা ও ধারণা বিকশিত হয়েছিল। সেই গ্রামে বিশুদ্ধ, আদিমতম, প্রকৃত, উপশম–প্রদানকারী ঐতিহ্য কখনও অস্তিত্বশীল ছিল না। এখনও নাই। ঐতিহ্য–গঠন ও নির্মাণের প্রক্রিয়ায় এই গ্রাম, এই ঐতিহ্য, এই হারিয়ে–যাওয়া উৎসব–মেলা–সম্মিলন–সংবেদন গড়ে উঠেছে মাত্র।
বগুড়ার মহাস্থানে শাহ সুলতান মাহীসওয়ার (র.)-এর উরসে বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার আয়োজিত মেলায় গানের পারফরমেন্স।
বগুড়ার মহাস্থানে শাহ সুলতান মাহীসওয়ার (র.) এর উরসের সময় তাঁর মাজারে ভক্তদের সমাবেশ ও মিলন।
বগুড়ার মহাস্থানে শাহ সুলতান মাহীসওয়ার (র.)-এর উরসের মেলায় সমবেত সাধক, পাগল আর ভক্তদের একাংশ।
বগুড়ার মহাস্থানে শাহ সুলতান মাহীসওয়ার (র.)-এর উরসের মেলায় বিভিন্ন স্থানে নানা পারফরমেন্স আয়োজিত হয়। গানের এমনই একটি পারফরমেন্স। এই ধরনের গানের আসর নিম্নবর্গের পরিসরে জমায়েত–সম্মিলন–সংবেদনের জারনে যেভাবে ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে তার আত্মসাৎকরণ এবং পুনর্গঠন ঘটে নাগরিক ও আনুষ্ঠানিক পরিসরে এই পারফরমেন্সকে প্রদর্শন ও ভোগ করার প্রক্রিয়ায় আর বিশুদ্ধীকরণে।
বগুড়ার মহাস্থানে শাহ সুলতান মাহীসওয়ার (র.)-এর উরসে মাজার–সংলগ্ন পরিসরে বারোয়ারি গণরান্নার প্রক্রিয়া। এমন গণ ও শরিকি কার্যক্রমও এসব সর্বজনীন মেলা ও উদযাপনের ঐতিহ্যের অংশ।
দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁয়ের রানীশংকৈলে পীর শাহ নাসিরউদ্দীন (র.)-এর উরসের মেলা। তিনি জনপরিসরে নেকমরদ নামেই পরিচিত।
দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁয়ের রানীশংকৈলে পীর শাহ নাসিরউদ্দীন (র.)-এর উরসের মেলার বিস্তৃতি বিভিন্ন ধরনের অস্থায়ী স্থাপনা, আধুনিক বিনোদন, যাত্রাপাত্রা এবং শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইডের সমন্বয়ে এখন উদযাপিত হয়।
নেকমরদের মেলার শিশুদের বিনোদনের রাইডসহ বিভিন্ন প্যান্ডেল, যাত্রার প্যান্ডেলসহ রাত্রিকালীন দৃশ্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে যে–ঔপনিবেশিক জরিপ প্রকল্পগুলো পরিচালিত হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ১৮১০–এর দশকে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন পরিচালিত জরিপ। ১৮৩৩ সালে প্রকাশিত তাঁর জরিপ প্রতিবেদনে এই অঞ্চলের বিভিন্ন বিষয়–আশয় সম্পর্কে বিপুল তথ্য নথিভুক্ত রয়েছে। তাঁর জরিপ প্রতিবেদনে তিনি তৎকালীন নেকমরদের মেলার বিশেষ উল্লেখ করেন। ওই সময়ে এই মেলা একমাসেরও বেশি সময় ধরে চলত। মেলায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ী–বণিকেরা আসতেন বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে। ভুটান থেকে ভুটানি ঘোড়ার সঙ্গে সঙ্গে উড়িষ্যা থেকে তোতাপাখি নিয়েও ব্যাপারীরা আসতেন। এই মেলা ছিল সমসাময়িক গ্রামীণ বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা ও বিস্তৃত অঞ্চলব্যাপী স্থানীয় পর্যায়ে বেচাকেনার অন্যতম বড় পরিসর। সে–সময়ের নেকমরদের মেলার যে–তাৎপর্য তা যে কেবল বাণিজ্যের মধ্যে কেন্দ্রীভূত ছিল না তা অনুমান করা যায়; সামাজিক সম্মিলন, যুক্ততা, উদযাপন আর আচারগত অনুশীলনের ধরন এখনকার মেলায় খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। ঐতিহ্য হিসেবে এই মেলার প্রকৃতি, ধরন ও তাৎপর্য ক্রমাগত রূপান্তরিত হয়েছে।
নদী বঙ্গীয় বদ্বীপ অঞ্চলের মানবীয় সকল বোঝাপড়া আর সংবেদনের সঙ্গে লিপ্ত। ১৮৮০ সালের উপরের আলোকচিত্রে তৎকালীন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাকল্যান্ড বাঁধ ও সংলগ্ন ঢাকার কয়েকটি স্থাপনা আর সে–সময়ের বিভিন্ন ধরনের নৌকা। নদীকে বিভিন্ন বয়ানে এই অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও নদী অবিরাম বদলের মধ্য দিয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক আমল এবং পরবর্তীকালে নদীর রূপগত বদল আর নদী সংশ্লিষ্ট মানবীয় সংবেদন ও ব্যবহারিক বিন্যাসের পরিবর্তনগুলোর ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচনা আর পরিবেশন করার ধরনে আধুনিক নদী–ভাবনা, টেকসই ব্যবস্থাপনা আর পরিবেশবাদী স্বীকৃত আখ্যানগুলোর প্র্রভাব যতটা ততটা নদীর সঙ্গে বিভিন্ন প্রাণ ও অপ্রাণের অবিভাজ্য ও অভেদ লিপ্ততা নিয়ে আলাপচারিতা নাই।
বুড়িগঙ্গা নদীর জীবন, আর ঢাকার ফ্রেডরিক উইলিয়াম আলেকজান্ডার দ্য ফাবেকের আঁকা ১৮৬১ সালের একটি পেইন্টিং।
১৯৬০–এর দশকে ঢাকার পাশের বুড়িগঙ্গা নদীর জীবন।
স্টিমার বা প্যাডেলচালিত স্টিমার ঔপনিবেশিক আমলে এতদাঞ্চলের জলপথের ওপরে আর নৌ–পরিবহনের ক্ষেত্রে বিরাট বদল ও রূপান্তর নিয়ে এসেছিল। বঙ্গীয় বদ্বীপের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার জলপথের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব বিবেচনা করলে স্টিমার সার্ভিসের প্রবর্তন ছিল এখানকার প্রাক–ঔপনিবেশিক পরিবহন–যোগাযোগ–যুক্ততার ধরনে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রভাবক। স্টিমার সার্ভিসের প্রবর্তন পরবর্তীকালে বঙ্গীয় বদ্বীপ এবং বদ্বীপ সংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যতার স্থানান্তর–মোবিলিটি–অভিবাসনের ক্ষেত্রে যেমন বদল নিয়ে এসেছিল তেমনই বদল নিয়ে এসেছিল নদীপথের ব্যবস্থাপনা ও নৌ–যোগাযোগের উপরে কেন্দ্রীভূত বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ব্যক্তি–মালিকানাধীন স্টিমার কোম্পানীও ব্যবসা করার চেষ্টা করেছে। ২০০০ সালের প্রথমদিক অবধিও স্টিমার সার্ভিস দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি স্থানের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের ক্ষেত্রে অল্প হলেও প্রচলিত ছিল। সেসব স্টিমারগুলোর বেশিরভাগই ১৯২০–৩০–এর দশকে নির্মিত ছিল আর বাংলাদেশ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অধীনে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতো। কেবল স্টিমার সার্ভিস আর স্টিমারগুলো বঙ্গীয় বদ্বীপে ঔপনিবেশিক আধিপত্য–নিয়ন্ত্রণ–দখল–রূপান্তর কায়েমের ঐতিহ্য বহন করে না। এই স্টিমার ঔপনিবেশিক আমলে দেশান্তর, উদ্বাস্তুকরণ, দেশভাগের সময় দেশত্যাগ, মুক্তিযুদ্ধের সময় জনপরিবহন–সমেত মানষজনের স্মৃতি–বিস্মৃতি–যাপনের–পরিবর্তনের বড় সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। অদ্ভুত বিষয় হল, স্টিমার ও স্টিমার–সার্ভিসের ঐতিহ্য কেবল একমাত্রিক ও একরৈখিক ঔপনিবেশিক শাসন ও প্রকৃতির ওপরে আধুনিক যান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার ঐতিহ্যের স্মারক না। এই অঞ্চলে মানুষ ও প্রকৃতির অধীনস্তকরণ, মানুষের পুরানো পেশা, যাপন, ব্যবসা, পরিবহনের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তনের বাহকই কেবল না; পাশাপাশি, এই স্টিমারই হয়ে উঠেছে স্থানান্তর–দেশত্যাগ–বিচ্ছিন্নতা–বেদনা অথবা প্রতিরোধ–লড়াইয়ের স্মারক। একটি বস্তুগত ঐতিহ্য হিসেবে স্টিমারগুলো বহুবিধ ও বহুমাত্রিক ইনট্যানজিবল ঐতিহ্যের সঙ্গে লিপ্ত থেকেছে। ঐতিহ্যের কোনো একক, একরৈখিক, স্থানিক–কালিক ভাবে অপরিবর্তনীয় বয়ান হতে পারে না। যখন হয় তখন সেই একক ও নির্দিষ্ট বয়ান নির্মাণ ও বাছাই করণের সঙ্গে বহুবিধ ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ও রাজনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া ও প্রভাবক কাজ করে।
বরিশালের এই ভাসমান নৌকার বাজার দীর্ঘদিনের। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, গত ৫–৬ বছরে এই বাজার একটি অনন্য, বিস্ময়কর, রোমান্টিক, এক্সোটিক স্থানে রূপান্তরিত হয়েছে; যেন হঠাৎ করে নদীতে বা জলপথে বা জলাশয়ে এমন বাজার বা হাট বঙ্গীয় বদ্বীপ অঞ্চলে বিকশিত হয়েছে। নাগরিক পর্যটকদের কাছেও একটি দর্শনীয় স্থান ও যাপন দর্শন আর উপভোগের গন্তব্য হিসেবেও এই ভাসমান বাজার এখন আকর্ষণীয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন স্থান ও যাপনকে নবায়িত রূপে পরিবেশন, বিপণন আর গঠন করা এখন আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থাপনায় খুবই কার্যকর। বহুক্ষেত্রেই প্রণালীবদ্ধভাবে কোনো স্থানিক পরিসর আর কোনো মানবীয় যাপনকে বাজারজাতকরণ করা হয়। ডিজিটাল দৃশ্য–উৎপাদনের কারখানায় বিভিন্নভাবে পরিমার্জন ও আকর্ষণীয় করে উৎপাদিত এসব পর্যটন পণ্য বিপণনের জন্যই নাগরিক মানুষজনকে জনসংস্কৃতির নবায়িত রূপ পরিবেশন করে। অথচ কেবল এই ভাসমান বাজারই না, বাংলা অঞ্চলের নদী ও জলে বিভিন্ন ধরনের আচার ও বাণিজ্য পরিচালনা করার জন্য হাট–বাজার থাকার পরম্পরা দীর্ঘদিনের। আমাদের প্রচলিত অনুমান হল, জমি বা স্থলভাগেই কেবল হাট–বাজার, আবাদ, বসবাস করা সম্ভব। জল ও নদীপথ এসব কর্মকাণ্ডকে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে কেবল যুক্ততা ও পরিবহনের জন্যই ব্যবহৃত হয়। জলভাগ ও স্থলভাগের এই দুইরকমের ধারণায়ন এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনে জল ও জমিনের বিচ্ছেদের ও ভেদাভোদের অনুপস্থিতিতে আমলে নেয় না। বহু পেশাজীবি মাসের পর মাস নদী বা জলে নৌকায় জীবনযাপন করেন। বহু পেশাজীবী বছরের শুকনো মৌসুমে হাওড়/বিল/জলাশয়ে পানি শুকিয়ে গেলে অভিবাসিত হয়ে আবাদ করেন। আবার অন্য ঋতুতে ওই জলাশয়ে জল আসলে অন্যত্র বসতি গড়েন। নদীগুলোর চরে বহু মানুষ বসতি গড়েন সাময়িক সময়ের জন্য। নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আবার চর সরে গেলে অন্য কোনো চরে স্থানান্তরিত হন। বিভিন্ন ঋতুতেই বিশেষ বিশেষ পণ্য বেচাকেনার জন্য নদীতে বা জলাশয়েই বাজার বসে। এই অঞ্চলের জীবনযাপনে ও বসতির ধরনের এমন বৈচিত্র্যকে নতুন ঐতিহ্যবোধ গঠন করার প্রক্রিয়ায় সমরূপীকরণ করা হয়। এই ঐতিহ্যবোধ স্থলকেন্দ্রীক। জল ও নদী এখানে কেবলই পটভূমি বা মাধ্যম।
নৌকাবাইচের মতন নদী ও নৌযান কেন্দ্রিক খেলাধুলা ও উদযাপন নতুন না। তবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন উপলক্ষে একই রঙের শাড়ি ও মাথায় বেগুনী রঙের টুপি পড়ে বরিশালের সন্ধ্যা নদীতে আয়োজিত নারীদের এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা ঐতিহ্যের বাছাই ও পুনর্নবায়নের একটি উদাহরণ।
ঢাকায় পবিত্র আশুরার তাজিয়া মিছিল আর কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাসের স্মরণ। দেহবিজড়িত সংবেদ আর ধর্মাচারের যৌথতার মধ্য দিয়ে ঐতিহ্যের গঠনের ও পুনর্গঠনের উদাহরণ হিসেবে এই মিছিল ও মিছিলের বহুবিধ আচার ও সংবেদের অধ্যয়ন ও অনুভব করা যেতে পারে।
ঢাকায় পবিত্র আশুরার স্মরণে নিয়মিত আয়োজিত কারবালাকে মনে রেখে নিয়মিত আয়োজিত সমাবেশ ও তাজিয়া মিছিলে এক নারীর বেদনা–বিষাদ–স্মৃতির অভিব্যক্তি। Photos: Nayem Ali/ TBS
বঙ্গীয় বদ্বীপ অঞ্চলসহ দুনিয়ার বিভিন্নস্থানে পবিত্র আশুরা উপলক্ষ্যে, বিশেষ করে শিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমানগণ আশুরাকে স্মরণ করে তাজিয়া মিছিল করেন। এই অঞ্চলে বিভিন্ন সময়েই জনসংস্কৃতি ও জনপরিসরে কারবালার বিশ্বাসঘাতকতা, মর্মান্তিক অমানবিকতা, সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের স্মরণ করা হয়েছে। বিভিন্নভাবে। বিষাদসিন্ধুর মতন কাব্য কিংবা ঢাকার মঞ্চে বিষাদসিন্ধু–র মতন অসাধারণ নাটক মঞ্চায়িত হয়েছে। জনসাংস্কৃতিক পরিসরেও মোহাররম বা আশুরা উপলক্ষে মিছিল, বিভিন্ন পারফরমেটিভ কর্মকাণ্ড আর শরীর–সংবেদনের বিজড়নে নিজে বেদনার্ত ও রক্তাক্ত হয়ে কারবালার বেদনা ও হত্যার স্মরণ করা হয়েছে। স্মরণের এই প্রকরণ ও ধরন একই রকম থাকে নাই। বরিশালে শৈশবে আমরা প্রতিবছর মোহাররমের এই মিছিল ও বেদনার্ততার পারফরমেন্স দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। সেই মিছিলে নির্দিষ্ট একটা ছন্দে ঢাকের বাজনার সঙ্গে লাঠিখেলা, আগুন নিয়ে খেলা, কৃত্রিম তলোয়ার নিয়ে অভিনয় আমরা ছোটোরা পরে নৈমিত্তিক যাপনে ও নিজেদের মধ্যে অনুকরণ করার চেষ্টা করতাম। আমরা সেই মিছিলে উচ্চারিত বেদনার্ত উচ্চারণ—‘হায় হাসান! হায় হোসেন!’ বলতে বলতে মিছিল করতাম। ওই বয়সে কতটা বেদনাবোধে তাড়িত হতাম জানি না; কিন্তু জনসংস্কৃতিতে বেদনা—স্বজন হারানোর অনুভূতি—অথবা নিজের শরীরকে বেদনার্ত ও রক্তাক্ত করে বেদনার্ততার অনুভবের সঙ্গে লিপ্ত হওয়ার, যুক্ত হওয়ার, কিংবা সমব্যথী হওয়ার যে–আচার আমাদের যাপনের অভ্যাস ও শরীরী সংবেদনের অংশ হয়ে গিয়েছিল সেই অনুভব ও উপলব্ধি আমাকে ভাবায়। সংবেদন–শরীর–বেদনার অনুভূতি কিভাবে ভাষা, শরীর, সংবেদনের ভেদ অতিক্রম করে যেতে পারে ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে! শরীরজ ও বয়ানগত ঐতিহ্যের ধারণা নিয়ে আলাপ করার ক্ষেত্রে আমরা ক্রমাগতভাবে অক্ষরবাদী ও বয়ানকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছি। সংবেদন আর স্মৃতির যাপন ও পুনর্যাপন ভাষিক নৈমিত্তিকতার সীমানাকে কিভাবে ভেঙে ফেলে!
বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বব্যাপী ঐতিহ্য এবং হেরিটেজ নিয়ে আলাপ–জ্ঞান–সক্রিয়তা–তৎপরতার কেন্দ্রে রয়েছে আদিবাসীগণ অথবা ইনডিজিনাস কমিউনিটি হিসেবে চিহ্নিত জাতি ও জনগোষ্ঠীগুলো। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রক্রিয়ার এই জাতিগুলোর অনেকেই বিলুপ্ত হয়েছে বা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। উদারনৈতিক এবং নয়া–উদারনৈতিক ব্যবস্থায় আর বিশ্বায়নের মহাবয়ানের কালে বিভিন্ন রাষ্ট্রে ও অঞ্চলে কট্টর ও উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানের কারণে সবচেয়ে বিপদে থাকে প্রান্তিক—নিজস্ব জীবনযাপনে অভ্যস্ত—প্রতিবেশের সঙ্গে পরম্পরাগত বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে বিকশিত সংবেদনে যাপন করা এই জাতিগুলো। একদিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রান্তরী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান আদিবাসীদের ঐতিহ্য ও জীবনযাপনের জ্ঞানকে টেকসই উন্নয়ন আর ইনডিজিনাস জ্ঞানের সংরক্ষণকে একভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। অন্যদিকে নয়া–উদারনৈতিক পুঁজিবাদী শাসনে আর বহুজাতিক সংস্থার অসীম মুনাফাকামী তৎপরতাও একইসঙ্গে চলমান থাকে। আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী এই দশাগুলো অনেকসময় বুনিয়াদি কাঠামোর দিক থেকে সদৃশ চিন্তা, ধারণা ও লক্ষ্যের অংশীদার থাকে। এই প্রসঙ্গ ও বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা–প্রকাশনা–অ্যাকটিভিজম–প্রতিরোধ আন্দোলন–আইনী ও নীতিমালাগত বয়ানের পরিমান বিপুল। মজার কথা হল, যে কুশীলবগণ আদিবাসীদের যাপিত জীবনকে রক্ষা করার বিভিন্ন বয়ান জারি রাখে তারাই আবার সেই যাপিত জীবনের জন্য হুমকি ও বিপজ্জনক শর্ত ও প্রভাবকগুলোকে সঠিক বিবেচনা করে এবং তাকে প্রশ্ন করে না। এমন বিপুলবিস্তারী আর বহুবিধ দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত চিন্তা ও বয়ান নিয়ে আলাপ করার অবকাশ এখানে নাই। তবে বাংলাদেশে বিকশিত ও বিকাশমান, পরস্পরবিরোধী জাতীয়তাবাদী ও পরিচয়বাদী বয়ানগুলোতে এমন অদৃশ্যমান, ধারণাগত এবং অংশীদারিত্বমূলক ভাবনাচিন্তা ও জানাবোঝা জনপরিসরে আদিবাসী–সম্পর্কিত প্রবল ও সংঘাতে লিপ্ত বয়ানগুলোক মনোযোগের সঙ্গে পর্যালোচনা করলেই চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। এখানে উদাহরণ হিসেবে যদি কেবল সাঁওতাল জাতির কয়েকটি প্রসঙ্গ বিবেচনায় নিই তাহলেও আন্তর্জাতিক উদারনৈতিক ঐতিহ্যের বয়ান আর রাষ্ট্র ও প্রবল জাতীয়তাবাদগুলো অনুমোদিত ‘আদিবাসী’/‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’/‘উপজাতি’/‘ট্রাইব’/‘ইনডিজিনাস কমিউনিটি’ সম্পর্কিত বয়ানগুলোর নানাবিধ স্ববিরোধীতা, ঐতিহ্যের উৎপাদন–বাছাইকরণ–পুনর্নবায়নের ধরন ও সমস্যাগুলো সংক্ষিপ্ত কিন্তু আংশিকভাবে আলাপ করা যাবে। ধরা যাক, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের কারণে বাস্তুচ্যুত, ধারাবাহিক জাতিবাদী, সাম্প্রদায়িক ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার সাঁওতালদের ঐতিহ্যের রেপ্রিজেনটেশন আর পুনর্গঠনের বয়ানে ও সক্রিয়তাগুলো। একদিকে জাতীয়তাবাদী বয়ান অন্তর্ভুক্তি, সেকুলার চরিত্র, বহুত্ব ও সহনশীলতা আর আন্তর্জাতিক বয়ানের প্রতি আপাত আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য এই স্থানের সাঁওতালদের সহ বিভিন্ন অঞ্চলের সাঁওতালদের পারফরমেটিভ, ধর্মাচরণমূলক, এবং বিভিন্ন ঋতু, পরব, ফসল–কাটা, জলজমির সঙ্গে বিজড়িত বিভিন্ন উৎসব পালন করেন। সিলেকটিভলি রাষ্ট্র এসব উদযাপনকে তার উৎপাদিত বয়ানে অন্তর্ভুক্ত, পুনর্গঠন ও নবায়ন করে, প্রদর্শন করে। অন্যদিকে যেসকল বুনিয়াদি কারণে ও প্রক্রিয়ায় সাঁওতালদের বেঁচে থাকা, নিজেদের জমিতে ও ঘরে থাকা, আর ন্যূনতম মানবিক সত্তা নিয়ে অস্তিত্ব জারি রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে সেগুলোকে প্রশ্নাতীতভাবে এবং জাতিবাদী প্রবল চিন্তার মাধ্যমে অক্ষুণ্ন আর বজায় রাখে। উপরের ছবিটিতে গোবিন্দগঞ্জের সহিংসতার শিকার আর উদ্বাস্তু হয়ে–পড়া সাঁওতাল নারী ও পুরুষদের সোহরাই উৎসবে পারফরমেটিভ ঐতিহ্যের রেপ্রিজেনটেশন।
উপরের গোছালো, পবিত্রায়নকরা/স্যানিটাইজড, প্রবল প্রদর্শনের শর্তমাফিক, বহুত্ব ও পর্যটনের দেখনদারির জন্য তোলা ছবি আর একই সোহরাই পালনের অন্য ধরনের সমষ্টিগত উদযাপনের চিত্র সাঁওতালদের ঐতিহ্যের দুই ধরনের বয়ানকে পরিবেশন করে। একটি চিত্র অনুমোদিত, কর্তৃত্বপরায়ণ ঐতিহ্যের বয়ানগুলোর স্বীকৃত, রাষ্ট্র ও প্রবল জাতীয়তাবাদের সহিষ্ণুতা, অনুর্ভুক্তি, বহুত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও সেকুলারাইজড। আর অন্যটি তুলনামূলকভাবে কম অনুমোদিত। এখানে একটা কথা মনে রাখা জরুরি। দীর্ঘ আধুনিকীকরণ, সভ্যকরণ, আর পবিত্রায়নের প্রক্রিয়ার কোনো বিশুদ্ধ, আদি ও প্রকৃত ঐতিহ্য নাই। পঞ্চদশ শতক পরবর্তীকালে ইউরোপীয় সম্প্রসারণ আর সপ্তদশ শতকের পরবর্তীতে সমাজবিজ্ঞানের শাস্ত্রগুলো আর ঔপনিবেশিক জ্ঞানের পারস্পরিক জটিল সম্পর্কের ইতিহাস এখানে প্রাসঙ্গিক। সমাজবিজ্ঞানীরা ও নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অঞ্চল, ভূখণ্ড খুঁজে বের করতেন এমন পূর্বানুমান থেকে যে, সেই মানুষজন আধুনিকতা, সভ্যতার সংস্পর্শ থেকে দুরে বিচ্ছিন্ন দশায় জীবনযাপন করছেন। এসব জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি–সমাজ–জীবনের উপরে জাতিতাত্ত্বিক গবেষণা পরিচালনা করলে বিবর্তনের রূপরেখায় সভ্যতার আগের পর্যায়গুলো (যেমন আদিম, বর্বর ইত্যাদি) সম্পর্কে প্রত্যক্ষণলব্ধ ও নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞান অর্জন ও বোঝাপড়া তৈরি হবে। সেসব সমাজ ও সংস্কৃতি কিভাবে ক্রিয়াশীল থাকে, তাদের রীতিনীতি, জ্ঞাতিসম্পর্ক, খাদ্যাভ্যাস, বৈবাহিক–ব্যবস্থা ইত্যাদি কেমন তা সম্পর্কে জানা যাবে। এই জ্ঞান ইউরোপীয় সভ্য ও উন্নত ‘আত্মসত্তা’র বিপরীতে সভ্যতার যাত্রায় অতিক্রম করে আসা পিছিয়ে–পড়া দশাগুলো সম্পর্কে জানতে ও তা নথিভুক্ত করতে ভূমিকা রাখবে। উনবিংশ শতক ও বিংশ শতকের প্রথমার্ধের একটি বড় সময় ধরে এ–ধরনের এথনোগ্রাফিক গবেষণা আর সম্পর্কিত প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বিপুল পরিমানের জ্ঞান উৎপাদন করেছে। এসব প্রক্রিয়া নিয়ে পরবর্তীতে প্রচুর সমালোচনা ও আত্মসমালোচনামূলক গবেষণা হয়েছে। নৃবিজ্ঞান–প্রত্নতত্ত্ব–সমাজবিজ্ঞানের বুনিয়াদি এসব পূর্বানুমান, গবেষণালব্ধ জ্ঞান আর সেই জ্ঞানের ভিত্তি অনুকৃত সংস্কারমূলক এবং সভ্যকরণ প্রকল্প, সংশ্লিষ্ট শাসনের তরিকাগুলো নিয়ে পর্যালোচনা অনেক হয়েছে। কিন্তু এই জ্ঞান যেভাবে স্বাভাবিকীকৃতি হয়েছে, জাতিরাষ্ট্রের বুনিয়াদী ধারণায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং জনপরিসরে কাণ্ডজ্ঞান হিসেব শিকড় গেড়ে বসেছে, তাতে করে আমাদের দেশেও নৈমিত্তিক যাপনে, ভাষায় আর তৎপরতাগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে প্রকট বা প্রচ্ছন্নভাবে সভ্যতার অপর হিসেবে, আধুনিকতা থেকে দুরে–থাকা হিসেবে, এক্সোটিক হিসেবে, পর্যটনের ভোগ্য ভিন্ন ও ‘সরল’ ও ’সহজ’ জীবনের প্রমাণ হিসেবে, নাগরিক–যান্ত্রিক–ভোগবাদী জীবন থেকে মুক্তির গন্তব্য হিসেবে ‘উপজাতি’/‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’/‘ট্রাইব’দের জীবন, সমাজ ও উৎসবগুলো গঠিত হয়েছে। একদিকে রাষ্ট্র ও প্রবল ক্ষমতাবান সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতির মানুষজন এদের পরিচয় নিজেদের শর্ত অনুসারে উপস্থাপন করবে। নিজেদের মানদণ্ড অনুসারে গঠন ও প্রদর্শন করবে অন্তর্ভুক্তি, সেকুলার চরিত্র আর বহুত্বের পরিবেশনের জন্য। অন্যদিকে, এই প্রান্তিক জাতিগুলোকে তাদের নিজস্ব জীবন, জমি, উৎপাদন–ব্যবস্থা, এবং পরিচয় থেকে বঞ্চিত করবে। সাহেবগঞ্জ অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এমন প্রক্রিয়া একটু মনোযোগ দিলেই নজরে পড়বে। আদিবাসী বা ট্রাইবাল বা উপজাতিদের ঐতিহ্য সেক্ষেত্রে প্রবল জাতীয়তাবাদ ও প্রবল নিপীড়ক–রাষ্ট্রের উদযাপনের উপলক্ষ্য যতক্ষণ পর্যন্ত সেই ঐতিহ্য প্রবলের শর্ত মেনে পরিবেশিত ও গঠিত হয় ততক্ষণ। অন্যদিকে একথা ভাবার অবকাশ নাই নিজস্ব হিসেবে চিহ্নিতকরণে আর সেই ঐতিহ্যগুলোর পরিবেশনে প্রান্তিক ও অধীনস্থ জাতি ও সম্প্রদায়গুলো সার্বভৌম ও স্বয়ংশাসিত সত্তা ধারণ করে। অসম ক্ষমতার সম্পর্ক আর শাসনের প্রক্রিয়া এমনই যে, শাসিত ও অধীনস্থ শাসিতের ও প্রবলের বয়ানকেই গ্রহণ করে, সেই বয়ানমাফিক নিজসত্তাকে গঠন করে, নিজেদের ঐতিহ্যকে পুনর্গঠিত ও পুনর্নবায়িত করে। প্রবল ও প্রান্তিকের সম্পর্ক যেমন প্রবলের বিরুদ্ধে প্রান্তিকের, আধিপত্যবাদী বয়ানের বিরুদ্ধ বয়ান নির্মাণের, শাসন–নিয়ন্ত্রণ–সহিংসতার বিরুদ্ধে সক্রিয়তার তেমনই প্রবলের সঙ্গে আপসরফারও। প্রবলের বয়ান আর আধিপত্যবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অনেকক্ষেত্রে আধিপত্যবাদী বয়ান ও ভাষা আত্মসাৎ করে ও স্বীকার করে নিয়েও পরিচালিত হতে পারে। পাশাপাশি, শাসনের ও অনুশাসনের আর জাতিরাষ্ট্রের প্রবল ক্ষমতা যখন মনস্তাত্ত্বিক ও নৈমিত্তিক যাপনে হতক্ষেপ করে, সেই হস্তক্ষেপে দৃশ্যমান সহিংসতা ও নিপীড়নের মাধ্যমেই যে ঘটতে থাকে তা তো না; হোজিমোনিক ক্ষমতা আর ভাষা–সংবেদের প্রণালীবদ্ধ পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক জাতি ও জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করা যায়। প্রবল ও আধিপত্যশীল ঐতিহ্যের বয়ান ও পারফরমেটিভ তৎপরতা গ্রহণ করতে প্রান্তিকগণ চৈতন্যগতভাবে বাধ্য হতে পারেন। আইনি ও বিধি–বিধানগত পরিসরে এই বাধ্যতা রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত, দেশপ্রেমী, এবং দায়িত্বশীল নাগরিকের অবশ্যপালনীয় আর অবশ্য অনুকরণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রান্তিক যখন প্রবল হয়ে ওঠার বাসনা ও হক দাবি করতে থাকে তখন প্রান্তিকদের মধ্যে নিজস্ব ঐতিহ্য সম্পর্কিত ধারণাগুলো ও অনুশীলনগুলো প্রবলকে অনুকরণ করতে থাকতে পারে। এই গ্রহণ ও বর্জনের প্রক্রিয়া সরল কার্যকারণ সুত্র মেনে চলে না। এমন বহু উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে প্রান্তিক ও নিপীড়িত প্রবল হয়ে উঠলে নিপীড়ক আর আধিপত্যবাদী হয়ে ওঠে। আবার এমন উদাহরণও দেয়া যাবে যে প্রান্তিকের মধ্যকার বহুত্ব আর প্রবলের মধ্যকার বহুত্বের মধ্যে ক্ষমতা, বিধি–বিধান, ভাষা ও অভিব্যক্তির বৈচিত্র্য সমরূপীকৃত হওয়ার প্রক্রিয়ায় আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠার বাধ্যতার ফলে একে–অপরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে। ঐতিহ্যের উদযাপন ও পুনর্গঠনকে প্রান্তিকগণ আকাঙ্ক্ষা করেন। তাদের চৈতন্যে প্রবলের ঠিক–করে–দেয়া ঐতিহ্যের বয়ান ও উদযাপন স্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের যে–ইতিহাস আছে সেই ইতিহাস পরবর্তীকালে সাঁওতালদের আত্মপরিচয় নির্মাণে ও পরিবেশনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অথচ প্রবল জাতীয়তাবাদী ইতিহাসে সাঁওতালদের স্থানিক ও কালিকভাবে ভিন্ন অভিলাষ ও ভিন্নধরনের নিপীড়নের ও সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইকে প্রবল জাতিয়তাবাদী বয়ানে আত্মসাৎ করার উদাহরণও অনেক। এখন প্রতিরোধের এই ঐতিহ্যকে চলমান আধিপত্য ও সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বয়ান নির্মাণে যেমন ব্যবহার করা যায় তেমনই জাতীয়তাবাদী বয়ানের বৈধতা নির্মাণের ক্ষেত্রেও আত্মসাৎ করা যায়। আবার প্রবলের ভাষা ও অভিব্যক্তি বাছাই করে গ্রহণ ও বর্জন করে প্রবলে সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করার চিহ্ন ও বয়ান তৈরি করা যায়। উপরের চিত্রটি জাতীয়তাবাদী ও রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বয়ান ও তৎপরতাকে রেপ্রিজেন্ট করে যেখানে সাঁওতাল বিদ্রোহের উপলক্ষ্যকে বেছে নেয়া হয়েছে। অবার এই মিছিলে ব্যবহৃত ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডের ভাষা কিন্তু বাংলা। সাঁওতালি না। সাঁওতাল বিদ্রোহের ঐতিহ্যের স্মরণ ও বর্তমানের প্রতিরোধের সক্রিয়তায় সেই ঐতিহ্যের চিহ্ন (যেমন তীর–ধনুক) বহন করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমই রাষ্ট্র–অনুমোদিত বিধিবিধান মেনেই এই ইতিহাস ঐতিহ্য হিসেবে পরিবেশিত হচ্ছে।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বাস্তুচ্যুত খ্রিস্ট–ধর্মাবলম্বী সাঁওতালগণ বিষাদ–বাস্তচ্যুতির উন্মুল দশা–নিপীড়নের দশার মধ্যে বড়দিন পালন করছেন শোক–সমাবেশ করে। প্রবল ঐতিহ্যে সাধারণত এই প্রতিবাদ–সমাবেশকে আড়াল করা হবে, যদিও আবার প্রবলের স্বীকৃত ঐতিহ্যের বয়ানে সাঁওতালদের আধিপত্য ও উপনিবেশ–বিরোধী প্রতিরোধের ইতিহাসকে একইসঙ্গে উদযাপনও করা হবে।
কমিউনিটি–বেসড ট্যুরিজম নামে ব্রাকের একটি প্রকল্পে সাঁওতালদের পর্যটনের উপযুক্তকরণ করা। এই ধরনের উদ্যোগকে সাঁওতালদের ক্ষমতায়ন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইনডিজিনাস কমিউনিটির প্রদর্শনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাঁওতালদের ক্ষমতায়ন কতটুকু হচ্ছে কি হচ্ছে–না সেটা বাস্তব তথ্য ও গবেষণার ভিত্তিতে জানা যেতেই পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানেই আদিবাসী সম্প্রদায়দের পর্যটনের বিষয়বস্তু হিসেবে পন্যায়ন এবং বিপনন করার তৎপরতা নতুন না। পর্যটনের বিষয়বস্তু হওয়ার উপযুক্ত হিসেবে সাঁওতালদের বিভিন্ন ঐতিহ্যের পরিবেশন–পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে একটি সম্প্রদায়ের বিভিন্ন আচার ও উৎসবকে, জীবনযাপনকে এবং পারফরমেটিভ পরম্পরাকে কমোডিফিকেশন বা পণ্যায়ন করার একটি উদাহরণ হিসেবে এই প্রকল্পকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বহুত্ববাদী ঐতিহ্যধারী বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকীকৃত আদিবাসীসত্তার উদযাপনের সিলেকটিভ নির্মাণের মাধ্যমে সাঁওতালদের ঐতিহ্যগত বৈচিত্র্য সমরূপীকরণ করা যেমন এই ধরনের তৎপরতায় অনিবার্য হয়ে ওঠে তেমনই নয়া–উদারনৈতিক ব্যবস্থায় পণ্যায়ন ও ক্ষমতায়নকে অবিচ্ছেদ্য হিসেবে উপস্থাপন করার মহাবয়ানও এখানে শনাক্ত করা সম্ভব। দরিদ্র ও প্রান্তিক একটি জাতির সিলেকটিভ ঐতিহ্য উদযাপন একদিকে বিলুপ্তির হুমকির মুখে থাকা হিসেবে চিহ্নিত ইনডিজিনাস জীবনযাপনের সুরক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য দরকারি হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে সাঁওতালদের দারিদ্র্য ও প্রক্রিয়াগতভাবে বাস্তুচ্যুতি ও যাপিত জীবন থেকে ক্রমাগত উদ্বাস্তুকরণের প্রবল তৎপরতার মধ্যে আর্থিকভাবে উপকার করতে পারে। সাঁওতালদের সত্তা ও অস্তিত্বকে বৃহত্তর বৈশ্বিক বাজারে প্রমোট করতে পারে। বাছাই করে সুরক্ষা ও সংরক্ষণও করতে পারে। আমরা অন্য একটা উদাহরণও দিতে পারি। বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আদিবাসী জাতিদের প্রণালীবদ্ধভাবে গণহত্যা, জমি দখল, বাস্তুচ্যুতি ঘটিয়ে মোটামুটিভাবে অস্তিত্বহীন করে তোলা হয়েছে। কিন্তু সেই সহিংসতার ইতিহাস ধামাচাপা পড়ে ওই আদিবাসী জাতিগুলোর বিভিন্ন নিদর্শন ও জীবনযাপনকে বিভিন্ন জাদুঘরে বা প্রদর্শনীতে পরিবেশন করার মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহুত্ববাদী, বহুসাংস্কৃতিক ও সহিষ্ণুতার ইতিহাসের উদযাপনে জাতীয় পরিচয় নির্মাণে তৎপরতায় নিপীড়িত আদিবাসীদেরই প্রদর্শন, পণ্যায়ন ও জ্ঞান–অর্জনের বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। একইভাবে যারা কলম্বাসের দখল–উত্তর আমেরিকা নামে চিহ্নিত ভূখণ্ডে সাদা ও ইউরোপীয় মানুষজনের নিপীড়নের ইতিহাস আর কালো মানুষদের দাস হিসেবে নির্যাতন ও নিপীড়নের ইতিহাসকে বর্তমানে মার্কিনী আধিপত্যবাদ আর গণহত্যার ইতিহাস স্মরণে রাখতে চান, বিভিন্ন প্রতিরোধ ও বর্ণবাদ–বিরোধী আন্দোলনে সেই ইতিহাসের ধামাচাপা দেয়া বয়ানগুলো প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে চান তারাও আদিবাসীদের ঐতিহ্যকে উপস্থাপন ও পরিবেশন করেন ভিন্ন পরিসরে ও ভিন্ন ধরনে। এখানে ঐতিহ্যের পুনর্গঠন ও পুনর্নবায়ন যেমন আধিপত্য ও নিপীড়নের ভাষ্য তৈরি করার, বৈধতা দেয়ার বা ভুলিয়ে দেয়ার তৎপরতায় ব্যবহৃত হয়, তেমনই এই ভুলিয়ে দেয়া, আড়াল করা, আর সমসাময়িক সহিংসতাকে ন্যায্যতা দেয়ার বয়ানের প্রতিবয়ান নির্মাণের জন্যও ব্যবহার করা হয়। সাঁওতাল জাতি এবং অন্যান্য আদিবাসী জাতিগুলোর ঐতিহ্য নিয়ে আলাপচারিতায় উপরের প্রসঙ্গটি মনে রাখা প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
শান্তিনিকেতন ও সাঁওতাল জাতির মিথস্ক্রিয়া নিয়ে আলাপ খুবই প্রাসঙ্গিক হতে পারে। বিশদ আলাপের অবকাশ না থাকলেও শান্তিনিকেতনকে বাঙালি জাতিয়তাবাদ ও বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম আকর হিসেবে বিশ্ব–ঐতিহ্যের স্বীকৃতির পরে শান্তিনিকেতনের ইতিহাসের বয়ানে সাঁওতালগণ কিভাবে বিভিন্ন সময়ে পরিবেশিত, উদযাপিত হয়েছেন সেই আলাপ খুব একটা চোখে পড়ে না। একটি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে শান্তিনিকেতনের সাম্প্রতিক বিকাশ এবং শান্তিনিকেতনেরই বিভিন্ন ঐতিহ্যের (যেমন: পৌষমেলা) রূপান্তর, পুনর্নবায়ন আর বাঙালি নাগরিক ভদ্রবিত্ত ও বিদেশি পর্যটকদের উপযোগী করে এসব ঐতিহ্যের বাছাইকৃত পুনর্নবায়ন ও পরিবেশন দারুণ পর্যালোচনার বিষয় হতে পারে। আধুনিক, সভ্যকরণ প্রকল্পের বয়ানের সঙ্গে শান্তিনিকেতন–অনুরাগী বাঙালি মধ্যবিত্তের ‘শিকড় অনুসন্ধান’ আর বৈচিত্র্যের উদযাপনের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত, আত্মসন্ধানী এবং নাগরিক যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তিকামী বাসনা এই ঐতিহ্য ও ঐতিহ্যের বয়ানকে শক্তিশালী করেছে। ঔপনিবেশিক আর আধুনিকায়ন প্রকল্পে আদিবাসী ও সভ্যতার স্পর্শ থেকে মুক্ত পিছিয়ে–পড়া জনগোষ্ঠীগুলো নিয়ে আলোকায়ন ও শিল্পবিপ্লব পরবর্তী ইউরোপে যে–রোমান্টিক প্রাচ্যবাদী সংবেদন ও বয়ানের বিকাশ ঘটেছিল তার পুনর্পরিবেশনের একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ সিনেমাটির পাটাতন হিসেবে পরিবেশন করা সভ্যতা/যান্ত্রিকতা/যুক্তিশীলতা/জটিলতাময়/ভোগবাদী জীবন ও সত্তা বনাম সরল/অযান্ত্রিক/মাটির–কাছাকাছি জীবনযাপন করা সমষ্টির বয়ান। প্রাসঙ্গিকভাবেই উল্লেখ করা দরকার যে এই বয়ান পশ্চিমা সভ্যকরণ ও আধুনিকীকরণে প্রকল্পের বহুমাত্রিক বয়ানের সঙ্গে সম্পর্কিত। রুশোর ‘নোবেল স্যাভেজের’ ধারণার পুনর্বয়ান। শিল্প–বিপ্লবোত্তর ইউরোপে একদিকে প্রগতি, উন্নয়ন আর বিবর্তনের অনিবার্যতা সেই সময়ের পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রভাবিত করেছিল এবং সেই অনুসারে বিভিন্ন পরিকল্পনা–সংস্কার–পরিবর্তনকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছিল। অন্যদিকে শিল্পবিপ্লব পরবর্তী পরিবর্তনগুলো ইউরোপীয় সমাজ–রীতি–অভ্যাস–অর্থনৈতিক পরিসরে যে বিরাট বদল নিয়ে এসেছিল তা বহু চিন্তককেই আধুনিকতা ও উন্নয়নের পরিনতি নিয়ে উভয় সঙ্কটে ফেলেছিল। উন্নয়নকামী আর প্রগতিকামী অনেক দ্বিধান্বিত চিন্তকের মধ্যেই অ–ইউরোপীয় বা বাদবাকি দুনিয়ায় আদিম/সরল/পিছিয়ে পড়া/আবেগ পরিচালিত সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি রোমান্টিক ও মুক্তিদায়ী বাসনা তৈরি করেছিল। সভ্যকরণ ও ঔপনিবেশিক আধুনিকীকরণের সহিংসতা ও বিধ্বংসী বাস্তবতা এই বাসনায় আড়ালে পড়েছে। বরং সহিংসতা ও নিপীড়নের তৎপরতা আর বাদবাকি দুনিয়ার বিধ্বংসী পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন অনুচ্চারিত রেখেছে। বাদবাকি দুনিয়ার সমাজ ও মানুষের জন্য সভ্য ও আধুনিক হয়ে ওঠা বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াগুলোকে সমালোচনা না করে এই বাসনা আদিম হিসেবে সংজ্ঞায়িত, সরল হিসেবে নির্মিত সমাজের মধ্যে নিজেদের বা আত্মসত্তার মুক্তির কল্পনা করেছে। শান্তিনিকেতনে ইতিহাস সাঁওতালদের বড় অংশীদারিত্ব আছে। শান্তিনিকেতনের যে প্রবল পরিচয় ও সত্তা বাঙালি রুচিশীল, মধ্যবিত্তের মধ্যে নির্মিত হয়েছে সেই সত্তার নির্মাণে নিসর্গের কাছাকাছি যাপন করা, সরল আনন্দে বিচরণ করা সাঁওতালদের বিজড়ন স্পষ্টতই ছিল। রামকিংকর বেইজের তৈরি করা সাঁওতালদের ভাস্কর্যগুলো শান্তিনিকেতনের যান্ত্রিকতা, শহুরে জটিল ও প্রতিযোগিতামুখী, বাণিজ্যিক আর প্রতারণাময় সত্তার বিপরীতে দাঁড়ায়। কিন্তু রামকিংকরের ভাস্কর্য যে শান্তিনিকেতনকে রেপ্রিজেন্ট করে সেই শান্তিনিকেতন ক্রমান্বয়ে নাগরিক মধ্যবিত্তের পর্যটনকেন্দ্র আর রোমান্টিক মুক্তির বাসনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। ঐতিহ্যের উদযাপন হিসেবে শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা পুনর্গঠিত ও পুনর্ব্যবস্থায়িত করা হয়েছিল। এই পৌষমেলা ক্রমান্বয়ে কলিকাতা ও শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির পাশাপাশি নাগরিক পরিসরের বাইরের মানুষজনের এবং অবাঙালিদের কাছেও বিনোদনের পরিসরে রূপান্তরিত হয়েছে। অথেনটিক ও নির্ভেজাল বাঙালিত্বের বা ভিন্ন সংস্কৃতির উপভোগের কেন্দ্র হিসেবে গঠিত হয়েছে। এক বিচিত্র মিশ্রণের মধ্য দিয়ে আনন্দ ও বিনোদন বেচাকেনার পরিসরে রূপান্তরিত হয়েছে। হালের আত্মকেন্দ্রিক ও আত্মরতিবাদী সত্তার গঠনের প্রসঙ্গ মনে রেখেই পৌষমেলার ঐতিহ্য হিসেবে গঠন, পুনর্গঠন ও নবায়নকে পর্যালোচনা করা যায়। সাঁওতালদের ব্যবস্থায়িত নাচগান ছাড়া পৌষমেলার অথেনটিক বাঙালিত্ব ও আন্তর্জাতিকতা একই সঙ্গে ভোগ করা/কনজিউম করা সম্ভব না।
‘হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐতিহ্য‘ – এমন বয়ান আমাদের ভীষণ পরিচিত। কিন্তু ধারণাগতভাবেই আধুনিক জ্ঞানে ঐতিহ্যের ধারণা হারিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে আর যা যা হারিয়ে যাচ্ছে বলে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তা তা বাঁচিয়ে রাখা, সংরক্ষণ করার বাসনার সঙ্গে সম্পর্কিত। হারিয়ে যাওয়া বা লুপ্ত হয়ে যাওয়া বা বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার এই উদ্বেগ, ভয়, বেদনা নৈমিত্তিক যাপনের সঙ্গে লিপ্ত অনুভব। প্রাক–আধুনিক কালে বিভিন্ন বস্তু বা স্মৃতি বা বয়ানকে সংরক্ষণ করে রাখার তৎপরতা জারি ছিল। জনপরিসরের বিভিন্ন স্তরে যেমন, তেমনই শাসক ও শাসনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্নভাবে সম্পর্কিত কুশীলবদেরও। কোনো লেখা, লিপি, বয়ান অনুকৃতি তৈরির মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা, স্থাপত্য তৈরির মাধ্যমে নিজেকে অবিস্মরণীয় করে রাখা, মৃতদের স্মরণের জন্য স্থাপনা ও চিহ্ন নির্মাণ আর সংরক্ষণ করার ঐতিহ্য বিভিন্নভাবেই প্রাগৈতিহাসিক সময়কাল থেকে প্রাক–আধুনিক সময় অবধি লক্ষণীয়; ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলোতে স্মরণ–স্মারক–সমাধি–চিহ্নাবলি বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে আসছে। এই গুরুত্বে প্রকৃতি, ধরন এবং ব্যাখ্যাও পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু আধুনিকতা যেভাবে ঐতিহ্যের ধারণাকে মানবীয় সত্তা ও দশার উৎকৃষ্টতা ও নিকৃষ্টতার সঙ্গে, পুঁজি আর ক্ষমতার সঙ্গে, এবং যাপিত জীবনের বিভিন্ন দশার সঙ্গে যুক্ত বা বিযুক্ত করেছে তেমনটা প্রাক–আধুনিক সময়ে ছিল না। প্রাক–আধুনিক কালের বা অতীতের কোনো কিছু ঐতিহ্য হিসেবে নির্বাচন করা (বা খারিজ করা) আর বিভিন্ন বিধি–বিধান ও আইনকানুনের মাধ্যমে কতগুলো বিশ্বজনীন, সমসত্ত্ব আর সর্বজনীন মানদণ্ড তৈরি করার কাজও আধুনিকতার প্রকল্পগুলোর সঙ্গে যুক্ত। আধুনিকতা যে মানুষের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি গঠিত করেছে সেখানে মানুষ হয়ে ওঠার অন্যতম শর্তই হল সেসব মানদণ্ড অনুসারে ঐতিহ্য নির্বাচন, সংজ্ঞায়ন ও সংরক্ষণ করা। ইউনেস্কোর মতন রাষ্ট্রান্তরী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন কনভেনশন ও নীতির মাধ্যমে বিশ্বজনীন ঐতিহ্যের স্বীকৃতি, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের রূপারেখা তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে মৌলিকত্ব/অরিজিনালিটি আর প্রামাণ্যতা/অথেনটিসিটি যেভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে, ট্যানজিবল আর ইনট্যানজিবল নামে যে বর্গ–বিভাজন করা হয়েছে তাতে পৃথিবী বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতিতে বস্তু বা অবস্তুগত অতীত বিষয় ও রীতি, আচার, অভ্যাস, ধর্মাচারে বহুত্ব ও বৈচিত্র্য অনেকক্ষেত্রেই অস্বীকৃত হয়। এসব মানদণ্ড, ঐতিহ্য হিসেবে মনোনয়ন ও স্বীকৃতির ক্ষেত্রে বৈষম্য, রাজনীতি আর জটিলতা নিয়ে বহু পর্যালোচনা রয়েছে। এভাবেই কোনো কোনো ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত রীতি, ব্যবহার ও অভ্যাস ঐতিহ্য হিসেবে মূলধারার অফিশিয়াল পরিসরে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হতে থাকে। স্বীকৃত ও আধিপত্যশীল ঐতিহ্যের বয়ানগুলো বিভিন্ন বিধি–বিধান, মানদণ্ড, নীতিমালা অনুসারে গঠিত হয়। অর্থাৎ অন্যভাবে বললে ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ও সংরক্ষণ–পুনরানয়নে বিধিবিধানগুলো তৈরি হয়ে ওঠারও নানান ঐতিহ্য রয়েছে। বিভিন্ন বিদ্যায়তনিক, প্রাতিষ্ঠানিক, রাষ্ট্রীয়, নৈরাষ্ট্রীয়, মতাদর্শিক বয়ান ও চর্চার মাধ্যমে ঐতিহ্য পরিমাপের ও স্বীকৃতি দেয়ার রীতি তৈরি হয়েছে। সেখান অসমতা ও বৈষম্য আবশ্যিকভাবেই উপস্থিত থাকে। আবার স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ের মানদণ্ডগুলো ও বয়ানগুলোও কোনো না কোনোভাবে বৈশ্বিক পরিসরে সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে। ‘লোকঐতিহ্য’ হিসেবে কোনো কিছুকে চিহ্নিত করার আর সেগুলো সংরক্ষণের আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্ত করার প্রক্রিয়া ও বয়ানও বাছাইকরণের মধ্য দিয়ে যায়। লোক বা ফোক হিসেবে চিহ্নিত করার অর্থ হল লোক বা ফোক বর্গ তৈরি করা, বিভিন্ন বিষয়বস্তু ও রীতি, পারফরমেন্স, বয়ানকে ওই বর্গে অন্তর্ভুক্ত করা (অথবা ওই বর্গের বাইরে ফেলা)। এই বর্গীকরণে প্রধানত আধিপত্যশীল শ্রেণি, চিন্তা আর দাপুটে পরিচয়বাদী বয়ান ও চৈতন্য ভূমিকা রাখে। নাগরিক ভদ্রবিত্ত উনবিংশ শতকের জাতীয়তাবাদের উত্থানে প্রক্রিয়ার মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের বস্তুগত ও অবস্তুগত/অপরিমেয় বিষয়কে খুঁজে খুঁজে বের করে সংগ্রহ, সঙ্কলন ও কিতাব হিসেবে প্রকাশ করার প্রকল্প শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ার অবশ্যই গুরুত্ব ছিল এবং আছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যের অসমতা ও স্বীকৃতি জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয়কে ফোক বা লোক হিসেবে বেছে ও পরিমার্জন করে নেয়া, গ্রহণ ও বর্জনের ইতিহাস রয়েছে। লোক–ঐতিহ্য বিষয়ক আধুনিক শাস্ত্রীয় জ্ঞানচর্চা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিকাশও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। নৈমিত্তিক যাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত বহু কিছুই মধ্যবিত্তের ও রাষ্ট্রীয় ফোক–চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না। সেগুলোকে পরিমার্জিত করে ভদ্রবিত্তের রুচি, দাপুটে নৈতিকতা আর প্রদর্শন রীতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো হয়। মাটির চুলা ও চুলার রান্না একদিকে পরিত্যক্ত হয়, দূষণের কারণ হিসেবে শনাক্তকৃত হয়। অন্যদিকে বাংলা অঞ্চলের ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতিও পায়। এই ঐতিহ্য যেমন হারিয়ে যায় নাই তেমনই মাটির চুলার রান্নাবান্না ঐতিহ্য স্মরণ করতে গিয়ে আমরা এই রান্নায় নারীদের কষ্ট ও পরিশ্রম, জ্বালানীর নতুন ব্যবস্থাপনা, দৈনন্দিন খাদ্যাভাস আর স্বাদের দুনিয়ার রাজনৈতিক অর্থনীতি আমরা আলাপে আনি না। হালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দুনিয়ায় মাটির চুলায় রান্না করা বিভিন্ন পদ, সেসব পদের পরিবেশন ও ভোজনের কনটেন্ট ভীষণ জনপ্রিয় ও বিপণনযোগ্য পণ্য হয়ে উঠেছে। নিচে নৈমিত্তিক জীবনের অংশ, যাপিত জীবনের বিজড়িত আরও কিছু বিষয়বস্তুর আলোকচিত্র দিলাম। এগুলো ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত অফিশিয়াল ও আধিপত্যশীল বয়ানে খুব একটা গুরুত্ব পায় না।
‘বাউল গান’ নামে একটি বর্গ তৈরি করার মাধ্যমে নাগরিক ভদ্রবিত্তের পরিসরে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বিভিন্ন ধরনের গীতরঙ্গকে বিপণন ও পরিবেশনের উপযোগী করা হয়েছে। উপরের ছবিটি শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার। পর্যটক ও নাগরিক সংস্কৃতিপ্রেমী ও ‘শিকড়ের সন্ধানের বাসনাতাড়িত’ মানুষের কাছে পরিবেশনের উপযুক্ত করে পোশাক, পারফরমেন্স এবং শরীরজ অভিব্যক্তি গঠিত হয়েছে।
টাঙ্গাইলের সখীপুরে একটি আসলে বিভিন্ন গীতরঙ্গের পরিবেশনা। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার বাউলগান আর টাঙ্গাইলের সখীপুরের গ্রামের আসরের গানের মধ্যকার ফারাকগুলো অনুভব করার চেষ্টা করলেই পরিপ্রেক্ষিত, বাণিজ্য, আর ‘ফোকের’ সম্পর্ক বোঝা সম্ভব হবে। ঢাকায় আয়োজিত ফোক ফেস্টের ভিডিও আর বছরের নির্দিষ্ট মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় এজমালি আয়োজনে গানের আসরের ভিডিও দেখলে ঐতিহ্য হিসেবে নির্দিষ্ট ও সমরূপ গীতরঙ্গ ও পারফরমেন্সের গঠন কোন প্রক্রিয়ায় ঘটে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাবে।
যে চুলার রান্না ও কলা পাতায় খাওয়া নাগরিক পরিসরে এবং গ্রামের বা মফস্বলের পরিসরেও বিভিন্ন কারণে ক্রমশ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেই রান্না ও খাওয়ার প্রক্রিয়া এখন ইউটিউবের জনপ্রিয় ভোগ্য কনটেন্ট হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে এক্সোটিক, রোমান্টিক, নিসর্গঘনিষ্ট, অরগানিক, মাটির কাছাকাছি পৌছানোর বাসনাতাড়িত নেটিজেনদের কাছে। অথচ এগুলো এখনও সাধারণ ও তুচ্ছতার নৈমিত্তিক জীবনযাপনের অংশ। নিচের ছবিগুলোতে এমনই নৈমিত্তিক যাপিত জীবনের কিছু ধরনের উপস্থাপন আছে। এই সাধারণ ও তুচ্ছতার জীবন ঐতিহ্য হিসেবে গৃহিত ও স্বীকৃত হবে কি হবে না সেটা আধিপত্যশীল ঐতিহ্যের বয়ান তৈরির প্রক্রিয়ার উপরে নির্ভর করে।
খই ভাজা।
রাস্তার পাশে টং দোকানের আড্ডাবাজি।
চা বানানোর শিল্পকলা।
সাধারণ চায়ের দোকান। সমবেত হওয়ার ও আড্ডা দেয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিসর।
নাগরিক মলের বা প্যাকেটজাত পণ্য হিসেবে মাছ বিপণন না। মাছের বাজার। বাংলা ভাষায় মাছের বাজার শব্দটি বিবিধ অর্থ বহন করে। মাছের বাজার মানেই সম্মিলন, দরদাম, শোরগোল, আড্ডা, গন্ধ, সংলগ্ন চায়ের দোকান, স্পর্শ ও স্বাদের নানাবিধ যুক্ততা।
চায়ের দোকান, রঙিন টেলিভিশন, সমাবেশ বারোয়ারি দর্শন, আড্ডা ও তর্ক। বন্ধুত্ব, সখাত্ব, আর ভাব–বিনিময়ের সংবেদনের গঠন। ঐতিহ্য হিসেবে ঠিক বনেদি ও অভিজাত ঘরানার সঙ্গে মানানসই না। কিন্তু যাপিত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নদীপথের একটি স্টেশনের ছোট পন্টুন। নদীপথের যোগাযোগ–ব্যবস্থা, লঞ্চ আর মানুষের যাতায়াতের চেহারা ও ধরন ক্রমাগত বদলে যায়। লঞ্চঘাট মানে যাপিত জীবনের চলমানতা, মিলিত হওয়া বা ছেড়ে যাওয়া। জলপ্রবাহ, স্মৃতির প্রবাহ, চলমানতা, অস্থায়ীত্ব, ঘরে ফেরা বা ঘর ছাড়া। বঙ্গীয় বদ্বীপে ঔপনিবেশিক আমল ও পরবর্তীকালে নৌ–যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে রূপান্তর ঘটেছে তা এখানকার নদী–পানি–জীবনের মিথস্ক্রিয়ার ঐতিহ্যকে পুনর্গঠিত করেছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়। লঞ্চ, ইঞ্জিনচালিত নৌযান, পন্টুন থেকে শুরু করে ফেরি ও যুক্ততার ধরনের বদলের ফলে অনুভব–অভিব্যক্তি–ভাষায় যেমন প্রভাব পড়েছে, তেমনই প্রভাব পড়েছে নদীলিপ্ত জীবনযাপনে। আবার ক্রমাগত নদীগুলোর বদল, উন্নয়ন ও অগ্রগতির আধুনিক প্রকল্পের প্রভাবে আর স্থলপথে যোগাযোগের দাপটে নদীগুলো মানবীয় শাসন–নিয়ন্ত্রণ–দখলের পরিসরে পরিণত হয়েছে। বহু পুরানো নদীপাড়ের ঘাট পরিত্যক্ত বা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নাগরিক মধ্যবিত্তর বয়ানে এবং জাতীয়–আন্তর্জাতিক হালে জনপ্রিয় পরিবেশবাদী ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বয়ানগুলোতে নদী–জল–যাপনের লিপ্তির ঐতিহ্যের পরিবর্তে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক নদী–জলের প্রসঙ্গ ও ইস্যুগুলোই ঐতিহ্য হিসেবে উচ্চকিত হয়ে উঠেছে।
হাট আসলে অফিশিয়াল ঐতিহ্যের কোনো বয়ানেই স্বীকৃত কোনো পরিসর না। অথচ এই বদ্বীপ অঞ্চল এবং উপমহাদেশে কেবল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্থানীয় বা আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক এবং নগরের বাইরের পরিসরে জনজীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত একটি পরিসর হিসেবে হাটের উল্লেখ বহু আগে থেকেই বিভিন্ন লিখিত উৎসে উল্লিখিত হয়েছে। হট্টিকা বা মান্ডবিক বা হট্ট নামে অথবা কখনও কখনও কসবা নামে উল্লিখিত বসতি ও স্থানীয় বাণিজ্যের পরিসর হিসেবে সাপ্তাহিক বা নির্দিষ্ট দিন ভিত্তিক এই ব্যবসা কেন্দ্রগুলো নদীর ব্যবস্থার শাখা–প্রশাখার মতনই এই অঞ্চলের অর্থনীতি–রাজনীতি–রাজস্বআদায়–ক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়া ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ঐতিহ্যের গৌরবময় আখ্যানে কিংবা ‘শিকড়ের সন্ধানের বাসনা’র আকুতিতে বহির্বাণিজ্য, সুনির্দিষ্ট বাছাই–করা পণ্য (যেমন: রেশম বস্ত্র, মূল্যবান ধাতু, মূল্যবান পাত্র, অভিনব বিদেশি পণ্যকেন্দ্রিক) বর্হিবাণিজ্য বা সামুদ্রিক বাণিজ্যকে যতটা প্রবলভাবে উদযাপন করা হয়, হাট বা বাজারের মতন নৈমিত্তিক ও বিশেষ বিশেষ সাধারণ (এবং তাই, জাতীয়তাবাদী গৌরবের বয়ানে গুরুত্বহীন ও তুচ্ছ) পণ্য, কারিগরি পণ্য, শস্যসহ বিচিত্র দ্রব্যাদির বিনিময় ও বাণিজ্যে স্থানীয়, অভ্যন্তরীণ এবং সর্বজনীন পরিসর হিসেবে হাট নিয়ে আলাপচারিতা আমাদের ঐতিহ্যের আলাপে অনুপস্থিতও বটে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোক বা ফোক বা বাছাই করা কোনো দ্রব্যের বা শিল্প হিসেবে চিহ্নিত পণ্যকে জাতীয়তাবাদী গৌরবের ও অর্জনের উপযুক্ত বিবেচনা করলে হাটের উল্লেখ হতে পারে। কিন্তু ধান, পাট, পান, সুপারি, কাঠ, গুড়, চুন, গোলপাতা বা খড়, মাছ, সবজি, নৌকা, পেয়ারা, আম, পোষা প্রাণী, ধাতুর দৈনন্দিন জিনিসপত্র, মাটির বাসন–কোসন ইত্যাদি বেচাবিক্রির স্থানীয় ও জটিল নেটওয়ার্কে সম্পর্কিত পরিসর হিসেবে হাট যাপিত জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নয়া–উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থায় এখনো হাট আমাদের দেশের ব্যবসা–বাণিজ্যের পাটাতন হিসেবে কাজ করছে। নয়া–উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থানীয় ও এলাকাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট পণ্য নির্ভর বানিজ্যিক পরিসর ও নেটওয়ার্কের টিকে থাকা কঠিন হলেও বিভিন্নভাবে হাটগুলোর স্তরভিত্তিক বিপণন ব্যবস্থা কোথাও কোথাও টিকে থেকেছে আবার কোথাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হাটগুলোর সঙ্গে স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থা, স্থানীয় নেটওয়ার্ক, ভূমি ও শস্য উৎপাদনের বিন্যাসে পরিবর্তন ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। বহুজাতিক সংস্থার তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃতি, বদ্বীপীয় নদী–খাল–ভূমির যোগাযোগ নেটওয়ার্কের বদল, বিপণন ও ভোগব্যবস্থার ধরনের পরিবর্তন, বিপণনের নয়া কলাকৌশল, মধ্যস্বত্ব ও ইজারাদারদের দৌরাত্ম্য ও দখলদারিত্ব ইত্যাদির প্রভাব হাট ও পাইকারি স্থানীয় ব্যবসায় পড়েছে। নদীগুলোর মৃত্যু, নতুন সড়কপথের নির্মাণ, সেতু নির্মাণ ইত্যাদিও হাটের ধরন ও বিন্যাসে বদল এনেছে। সেক্ষেত্রে হাটভিত্তিক উৎপাদন–বিপণন–ক্রয়–যোগাযোগ এই অঞ্চলে বহুমাত্রিক ও বিচিত্র সম্মিলনের একটি ঐতিহ্যগত পরিসর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। নিচে কয়েকটি প্রতিনিধিত্বমূলক আলোকচিত্র দিলাম।
বরিশালের সন্ধ্যা নদী কেন্দ্রিক নৌকায় ধানের হাট।
বরিশালের সন্ধ্যা নদীর পাড়ে ধানের হাট। নৌকার উপরেই ধানের পরিবহন, বিপণন, যাচাই–বাছাই চলে। পাইকারি ব্যাপারীরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান কেনার জন্য এই হাটে জড়ো হন।
ছোট নৌকায় করে অল্প পরিমাণ ধান আনা–নেয়া হচ্ছে।
ঝালকাঠিতে সন্ধ্যা নদী সংলগ্ন কাঠ ও গাছের টুকরা বেচাকেনার হাট।
গাছের গুড়ি এনে রেখে দেয়ার স্থানীয় কৌশল। ঝালকাঠির হাটে।
নৌকায় করে নৌকার হাটে ছোট নৌকা বহন করে নিয়ে যাওয়া।
বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদে অনুষ্ঠিত ঈদের নামাজের দৃশ্য। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে মসজিদের শহর বাগেরহাট ইউনেস্কো–কর্তৃক স্বীকৃত। প্রধানত সুলতানি আমলের কয়েকটি মসজিদকে কেন্দ্র করে এই স্বীকৃতি কতৃত্বশীল হেরিটেজের বয়ানে প্রাধান্য পেয়েছে। পর্যালোচনামূলক হেরিটেজ অধ্যয়নশাস্ত্রের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই স্বীকৃতি এবং তার পরবর্তী বয়ানের উৎপাদনকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সেই বিশদ আলাপে যাওয়ার সুযোগ এখানে নাই। তবে স্পষ্টতই অফিশিয়াল ও কর্তৃত্বশীল বয়ানে খলিফতাবাদ নামের হযরত খান জাহান আলী (র.)-এর মাজার ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধর্মীয় আচার ও অনুশীলন বয়ানগুলোতে গুরুত্ব পায় নাই। উলুঘ খান জাহান আলী (র.)-এর উরস উপলক্ষে প্রতিবছর যে মেলা এবং সম্মিলন এখানে হয় সেই ঐতিহ্যকে অপরিমেয় বা ইনট্যানজিবল হেরিটেজ হিসেবে এখানকার স্থানিক পরিসর, স্থাপত্য, দিঘি ও পুকুর এবং এমনকি অন্যান্য না–মানুষী কুশীলব (যেমন: মাজার–সংলগ্ন দিঘির কুমির এবং মানত করে কুমিরকে খেতে দেয়া মুরগি), দিঘি, এবং সম্মিলিত বিভিন্ন তরিকার সাধক ও পাগলগণের বিভিন্ন পারফরমেটিভ ও আচার–অনুষ্ঠান এই অফিশিয়াল ঐতিহ্যের বয়ানে অনুপস্থিত। পাশাপাশি, খলিফতাবাদের অন্যান্য বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও অন্যান্য কয়েকটি নিদর্শনের তুলনায় গুরুত্বহীন থাকে। যখন কেবল জড়, স্থাপনাকে প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তখন ওই স্থাপত্যগুলোর বর্তমান জীবনকে গৌণ করে ফেলা হয়। কেবল মাজারের বিভিন্ন ধর্মীয় আচারই না, ষাট গম্বুজ মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করা হয়। সেই হিসেবে এই স্থাপত্যটি একটি জীবন্ত ও বর্তমান মানুষের জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত একটি নিদর্শন। স্থানীয় জনপরিসের প্রচলিত কথ্য ইতিহাস, কিংবদন্তী, ধমীয় আচার এখানকার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ারত থাকে। দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলের জোয়ার–ভাটা বিশিষ্ট নদী, ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, আর এখানকার নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রতিবেশের সঙ্গে এখানকার অতীত বসতি ও স্থাপত্য তৈরি হওয়ার জটিল ইতিহাস ঐতিহ্যের স্বীকৃত বয়ানগুলোতে পুরোপুরি অনুপস্থিত। সেক্ষেত্রে বিদ্যায়তনিক ও অফিশিয়াল বয়ানগুলোতে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্যগুলোর সঙ্গে সংবেদন ও ধর্মাচার এবং প্রতিবেশের সঙ্গে মানুষের মিথস্ক্রিয়ার বহুমাত্রিক সম্পর্কের বয়ান স্বীকৃত হয় না। যদিও হালের ঐতিহ্যকেন্দ্রিক বিভিন্ন শাস্ত্রীয় ও বিদ্যায়তনিক আলাপচারিতা ও বাহাছে ভেদবাদী ঐতিহ্যের ধারণা এবং শরীরজ ও সংবেদন বিচ্ছিন্ন ঐতিহ্যের আধিপত্যশীল বয়ানগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। ইউনেস্কো, আইকমোস, আইইউসিএন, আইকমের মতো আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রান্তরী সংস্থাগুলোর তৈরি করার বিভিন্ন বিধিবিধান ও নীতিমালার সঙ্গে পশ্চিমকেন্দ্রিক, আধুনিক বিশ্বজনীনকৃত মানবায়িত ঐতিহ্যের আধিপত্যবাদী ধারণার যুক্ততাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ঐতিহ্যের এসব প্রবল ধারণার সঙ্গে বহুবিধ প্রান্তিক ও দুর্বল ধারণাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা আর সেগুলোকে মোকাবিলা করতে থাকার মধ্য দিয়েই বিভিন্ন পরিসরে ঐতিহ্যের বহু ধারণা ও অনুশীলন জারি থাকে। আমরা চাই বা না–চাই।
গতবছর পবিত্র ঈদ–উল–ফিতরে ষাট গম্বুজ মসজিদে ঈদের জামাত।
অ্যালেন গিনসবার্গের কবিতার কারণে হোক বা সেই কবিতার পৌনঃপুনিক পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে হোক না কেন যশোর রোড আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাপ্তির পাশাপাশি বেদনা, দেশান্তর, উদ্বাস্তু হওয়ার কাহিনি, বিচ্ছেদ, ঘর ছাড়ার ও ঘরে ফেরার স্মৃতি, স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দসহ বহু অনুভবের সঙ্গে বিজড়িত একটি স্থানিক পরিসর। যশোর রোডের গাছগুলো এই স্মৃতির সঙ্গে যেমন যুক্ত তেমনই যশোর রোড যেন আমাদের দেশের উচ্চারিত ও অনুচ্চারিত, অনুভূত এবং ভুলে যাওয়ার, হারানো আর ফিরে পাওয়ার পরস্পরবিরোধী, জটিল এবং ভীষণভাবে সংবেদী এক যাত্রার প্রতীক বা চিহ্ন হয়ে অস্তিত্বশীল আছে। যশোর রোড বাংলাদেশের সত্তার যাত্রার একটি পথকে প্রকাশ করে যেন। যশোর রোডের গাছগুলো কেটে ফেলা নিয়ে আন্দোলন হওয়ার উদাহরণ মনে করলে ঐতিহ্যের গঠিত হওয়ার প্রক্রিয়ার ও তৎপরতার বহুমুখী অভিমুখ বুঝতে আমাদের সুবিধা হতে পারে। এই গাছগুলো মুক্তিযুদ্ধের মানবকেন্দ্রিক স্মৃতিকে প্রশ্ন করে। মানুষ ও না–মানুষী জগতের ঘনিষ্ট যোগসূত্রের সঙ্গে মুক্তির ধারণার ঘনিষ্ঠতার কথা বারংবার আমাদের মনে করিয়ে দেয়।
দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি প্রবল প্রতিষ্ঠিত চিহ্ন। বিভিন্নভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে এই মন্দির ও মন্দিরের পোড়ামাটির চিত্রফলক আমাদের অতীত গৌরব, সম্প্রীতি, শৈল্পিক উৎকর্ষ, স্থাপত্য প্রযুক্তির প্রতীক হিসেবে উদযাপিত হয়। কিন্তু এই উদযাপনে এই মন্দিরের স্থাপত্য–কেন্দ্রিকতা প্রকটভাবেই উপস্থিত থাকে। গৌণ হয়ে পড়ে মন্দিরের জীবনবৃত্তান্ত, মন্দিরের সঙ্গে সম্পর্কিত নদী, ধর্মাচার এবং সংবেদনের সম্পর্ক। এই আলোকচিত্রটি প্রতিবছর কান্তজীর মন্দিরের প্রতীমার মন্দির থেকে দিনাজপুর রাজবাড়ির মন্দিরে সংলগ্ন ঢেপা নদীপথে যাত্রা ও ফেরার একটি পরিবেশন। এই যাত্রা ও সম্পর্কিত বিভিন্ন শরীরজ ও ধর্মাচারকে, নদীর যুক্ততাকে আর দিনাজপুরে রাজবাড়ির যুক্ততাকে বাদ দিয়ে কান্তজীর মন্দিরের ঐতিহ্যর বয়ান একপেশে, একরৈখিক এবং জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। নদীকে যদি আমরা একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে কান্তজী বিগ্রহের এই যাত্রা কেবল মানুষ বা বিগ্রহই না, পাশাপাশি অন্যান্য জীবিত ও সক্রিয় সত্তার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার প্রামাণ্য।
সাধারণত আমাদের প্রবল ঐতিহ্য চর্চায় স্থাপত্য–কেন্দ্রিকতা যেমন প্রবল তেমনই প্রবল বাছাই করা স্থাপত্যকে ঐতিহ্য হিসেবে পরিবেশন করার চর্চা। পুরান ঢাকার নারিন্দার খ্রিস্টান সমাধিস্থল যেমন প্রবল ঐতিহ্যের বয়ানে গৌণ একটি প্রসঙ্গ হিসেবে উল্লেখিত হয়। পুরান ঢাকা কেন্দ্রিক ঢাকা শহরের ঐতিহ্য নিয়ে যেসব আলাপচারিতা জনপরিসরে নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে উচ্চকিত ভাব দৃশ্যমান, সেখানে প্রান্তবর্তী উল্লেখ ছাড়া এই সমাধিস্থল প্রসঙ্গে বিশদ কথাবার্তা ও আলাপ নজরে পড়ে না। নগর হিসেবে ঢাকার জীবনে বহুবিধ কুশীলব ও তৎপরতার যে সন্নিবেশ ঘটেছে সেখানে ঢাকার প্রাচীনত্ব নিয়ে যত দাবি, ও ঘোষণা প্রবলভাবে নজরে পড়ে, ততটাই দুর্বল পুরান ঢাকার বহুবিধ বস্তুগত ও অবস্তুগত ঐতিহ্যের উল্লেখ। এখানে নগর হিসেবে ঢাকার জীবনবৃত্তান্ত যখন মধ্যবিত্ত ও বিদ্যায়তনিক পরিসরে গঠিত হতে থাকে তখন স্পষ্টতই পক্ষপাত ও বিশেষ বিশেষ স্থাপত্য ও আচারের প্রতি পক্ষপাত পরিলক্ষিত হয়। এই সমাধি স্থলের সঙ্গে এক সময়কার জীবন্ত ঢাকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্মৃতির যেমন লীন হয়ে আছে, তেমনই সেসব সম্প্রদায়ের বিলীন হয়ে যাওয়ার, বিস্মৃতি হয়ে যাওয়ার চিহ্নাবলিও রয়েছে।
প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য বিষয়ক বয়ানে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন বস্তুগত নিদর্শন গুরুত্ব পায়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। বস্তুগত ও অবস্তুগত অথবা পরিমেয় ও অপরিমেয়/ট্যানজিবল ও ইনট্যানজিবল ঐতিহ্যের বর্গীকরণ ও বিচ্ছেদ নিয়ে বিভিন্ন আলাপচারিতা রয়েছে। একইসঙ্গে কোন ধরনের আলামতকে প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে বিবেচনা করা হবে, আর কোন ধরনের আলামতকে বিবেচনা করা হবে না, অথবা গুরুত্ব প্রদান করা হবে না সে প্রসঙ্গেও বাহাছ জারি থাকে। এখানে বিরাজমান প্রবল তাত্ত্বিক ও চর্চাগত ঐতিহ্যের সঙ্গে এই বাছাইকরণ, গুরুত্বপ্রদানের স্তরবিন্যাস এবং অতীত ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সত্তাশ্রয়ী/সাবজেকটিভ বিভিন্ন শর্ত সম্পর্কিত থাকে। আমাদের দেশে স্থাপত্যগত অবশেষ এবং বিভিন্ন স্থাপনাকে যতটা প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় কেন্দ্রীয় বিবেচনা করা হয় ততটা অস্থাপত্যগত বিভিন্ন বস্তুকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। বস্তুর ক্ষেত্রের ভাস্কর্য, মুদ্রা, লিপি বা বিশেষ ধরনের মৃৎপাত্রকে বাছাই করার প্রবণতা ও ঝোঁক লক্ষণীয় থাকে। সাধারণ ও নৈমিত্তিক ব্যবহারের অন্যান্য বস্তুসামগ্রীকে গৌণ করে বিবেচনা করার যে চর্চা ও প্রবণতা রয়েছে সেখানে প্রবল প্রাতিষ্ঠানিক ও মতাদর্শিক দশা যেমন ভূমিকা রাখে, তেমনই জাতীয়তাবাদী অতীত গৌরব, সমৃদ্ধি আর শ্রেষ্ঠত্বকে উপস্থাপন করার জন্য উপযোগিতার বিবেচনাও কাজ করে। এমনই একটি প্রান্তিক এবং পরিত্যক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক আলামত হল আমাদের এই অঞ্চলের পুরানো পুকুর ও দিঘিগুলো। অগণিত পুকুর ও দিঘি বদ্বীপের বিভিন্ন স্থানে গত দুই হাজারের বেশি সময় ধরে বৃষ্টির জল সঞ্চয় করে রেখে সেচ দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হওয়ার পাশাপাশি নৈমিত্তিক বহুবিধ কাজে এবং ধর্মাচরণের জন্য এই পুকুর/দিঘিগুলো খোঁড়া, ব্যবহার করা, সংস্কার করা, দেখভাল করা হতো। শত শত বছর ধরে এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো এই অঞ্চলের মানুষের বসতির সীমানা হিসেবে, বসতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত বহুবিধ মানবীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হয়ে বিরাজ করেছে। দক্ষিণাঞ্চলে নোনাপানির প্রভাবযুক্ত এলাকায় সুপেয় পানির উৎস হিসেবেও পুকুর ও দিঘিগুলো অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অতীতের বসতি বিন্যাস ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও এই পুকুর বা জলাধারগুলো প্রাসঙ্গিক। পুকুর ও দিঘি খোঁড়ার পরের মাটি যেমন এগুলোর পাড় উঁচু করে বিভিন্ন বৃক্ষ রোপন করার জন্য ব্যবহৃত হতো, তেমনই বসতিতেও নানা কাজে ব্যবহৃত হতো। আবার পুকুরের ঘাট, পুকুরের পাড়ে নির্মিত বিভিন্ন ধরনের স্থাপনাও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায়। অন্যদিকে অনেক পুরানো পুকুর এখনও মানুষজন ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন পরিবেশ ও বৃষ্টিপাতের বদল আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার পরেও। প্রতিটি পুকুর ও দিঘি নিয়ে স্থানীয় জনপরিসরে নানান কথ্য ইতিহাস, কাহিনি, কিংবদন্তী ও গল্প প্রচলিত রয়েছে যেগুলো প্রাক–আধুনিক কালে মানুষ ও প্রকৃতির মিথস্ক্রিয়ার সাক্ষ্য বহন করে। যখনই আমরা এই পুকুরগুলো এবং সংলগ্ন কাহিনিগুলোকে অবজ্ঞা করি, প্রতিষ্ঠিত প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বয়ান থেকে বাদ দিয়ে দিই তখন এতদাঞ্চলের মানুষ–জমি–বৃষ্টি–পানি–আবাদ–আচার–অভ্যাসের ইতিহাসকে ও ঐতিহ্যকে আমরা পুনর্গঠন ও বাছাই করতে থাকি।
অতীত–শৈশব–সামাজিক যূথবদ্ধতা–বন্ধুত্ব কি ঐতিহ্য হিসেবে গণ্য হবে? একজন মানুষের স্মৃতি–বিস্মৃতি অথবা একটি কালে একদল মানুষের যৌথতা–সম্পর্ক–তুচ্ছাতিতুচ্ছ খেলাধুলা ও আনন্দের ইতিহাস কি ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হবে? যাপিত জীবনের চারপাশে ফেলে দেয়া, কম দামি বা প্রকৃতি থেকে সহজলভ্য জিনিসপত্র দিয়ে শৈশব বা কৈশোর বা যাপিত জীবনের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক যাত্রার ইতিহাস কি ঐতিহ্য হিসেবে বেছে নেয়া যাবে? হালের সেলুলার ফোন–আইপ্যাড–কম্পিউটার গেইমিং–অনলাইন গেইমের মধ্যে নিমজ্জিত যে শৈশব ও কৈশোর সেখানে এই শৈশবের বিস্মৃতি বহু পরিসরে অনিবার্যভাবেই এসেছে। নতুন প্রজন্মের মানুষজন আগের প্রজন্মের যোগাযোগ ও যৌথতার ধরন যেমন জানেন না, তেমনই আগের প্রজন্মের মানুষ নতুন ভারচুয়াল আর মেশিনের সঙ্গে যাপনকেও বুঝতে পারেন না। যাপিত জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ দিকগুলোতে মনোযোগের সঙ্গে নজর দিলে সেইসব দিকে বহুমাত্রিক ও বহুবিধ রূপান্তর ও বদল আর ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। অফিশিয়াল আর কেতাবি অভিজাত ঐতিহ্য–ভাবনা ও বয়ানে এসব জিনিসপত্র, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, কাহিনি, ও বয়ান কখনও কখনও ‘হারানো সোনালি যুগের’ নস্টালজিয়া হিসেবে উদযাপিত হলেও, পরিশেষে সেই উদযাপন বৃহত্তর ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে স্বীকৃত হওয়ার উদাহরণ খুবই কম। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতেই বেছে নিলাম শৈশবের খেলাধুলার বিভিন্ন ধরন। এসব খেলা ও আনন্দ এখনও বিলুপ্ত হয়ে যায় নাই। আবার বহুল পরিসরে প্রচলিতও নাই। হয়তো যাপিত জীবনের বদল–প্রক্রিয়ার ক্রান্তিকালে এই তুচ্ছাতিতুচ্ছ আনন্দের ও উচ্ছ্বাসের অনুশীলনগুলো বেঁচে আছে। সাইকেল রিকশার বিয়ারিং আর কাঠ মিলিয়ে বানানো গাড়িতে চড়া ও বন্ধুদের সঙ্গে গাড়ি চড়ার আনন্দ করা এমনই একটি খেলা ছিল বা এখনো কোথাও কোথাও টিকে আছে। তবে খেলনা গাড়ি, রিকশা, সাইকেল এখন মোটামুটি সস্তায় গ্রামগঞ্জেও পাওয়া যায়। একত্রে নিজেরা টুকরা–টাকরা অংশগুলো যোগাড় করে এমন বাহন বানানোর যে অভিজ্ঞতা ও উত্তেজনা সেই উত্তেজনা ও আনন্দ এখন অব্যাহত আছে কি না সেটা ভাবনার বিষয়। আনন্দ–উচ্ছ্বাস–উদযাপনের অনুভবগুলো আছে মানবীয় সংবেদনের সঙ্গে লিপ্তির কারণে। কিন্তু অনুভবের প্রক্রিয়া–ধরন–অভিব্যক্তি বদলে যায়। এই বদলানোটা অনিবার্যও বটে। কিন্তু এমন প্রগাঢ় অনুভূতির ইতিহাস যেমন আমাদের বিদ্যায়তনে ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে নাই, তেমনই প্রবল ঐতিহ্যের বয়ানগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখিত, কথিত এবং প্রদর্শিতও হয় নাই। নিচের কিছু ছবিতে আমি এমনকিছু আপাত তুচ্ছ ও অনভিজাত খেলাধুলার আলোকচিত্রীয় উদাহরণ পেশ করলাম:
ইচিং বিচিং খেলা।
ওপেনটি বায়স্কোপ খেলা।
সাতচাড়া খেলা।
ডাংগুলি খেলা।
ডিজিটাল আর ডিভাইসের প্রচলিত ও জনপ্রিয়তার আমলে আশেপাশের নারকেল পাতা, বা তালির কড়ি বা কাঁঠালপাতা বা পাতা দিয়ে শিশুদের বানানো ঘড়ি, চশমা, সাপ, চরকা, নৌকা ইত্যাদি সাধারণ ও নৈমিত্তিক প্রকৃতি ও গাছপালার সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠ যাপনের যেমন চিহ্ন তেমনই শৈশবের বিভিন্ন খেলাধুলার বিভিন্ন পণ্য, বিশেষ করে প্লাস্টিক ও সস্তা চায়নার খেলনার বাজার তৈরি হওয়ার আগেকার জনপরিসরে শিশুদের বড় হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা, কিংবা সস্তা ও সহজে প্রাপণীয় উপকরণ দিয়ে খেলার সামগ্রী তৈরি করে নেয়ার বিস্তৃত চর্চার প্রমাণও এই পাতার খেলনাগুলো বহন করে। বাংলাদেশের শহর–মফস্বল–গ্রামের জনপরিসরে ও বাজারের মধ্যকার ফারাক ও বৈচিত্র্যও এই উপকরণগুলো সামনে নিয়ে আসে। সেই ফারাক এখন আরও বেড়েছে আর বিনোদন বা খেলাধুলার উপকরণের ধরনের বদল ঘটেছে, খেলাধুলার চর্চা ও উপলব্ধিতে বদল ঘটেছে।
প্রযুক্তি আর প্রযুক্তি ব্যবহারের ঐতিহ্য জনপরিসরের বিনোদন–দর্শন–শ্রবণের স্মৃতি ও বয়ানের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই অঞ্চলে ৮০–৯০ এর দশকের ক্যাসেট প্লেয়ার বা টু–ইন–ওয়ান আর অডিও ক্যাসেটে গান–শোনা সহ বিভিন্ন ধরনের রেকর্ডিং, শ্রবণ আর বাজারজাতকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। ক্যাসেটে গানের বা ব্যান্ডের বা দলের সঙ্গীতের অ্যালবাম রিলিজ হতো। সেই ক্যাসেট কপি ও রেকর্ডিয়ের জন্য শহরে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে আলাদা দোকান ছিল। ক্যাসেট বিক্রির জন্য আলাদা দোকান ছিল। সিডি বা ডিভিডিতে বা হালে ইউটিউবে বা অনলাইন প্লাটফরমে গান–নাটক–পডকাস্ট–সাক্ষাৎকার শোনার ঐতিহ্যের ঠিক আগেই। আর ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ার ও ভিডিও ক্যাসেট ছিল সমসাময়িক সিনেমা, বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান রেকডিং করে রাখার অন্যতম দৃশগত মাধ্যম। সিনেমা হল থেকে দেশী–বিদেশী সিনেমা ঘরে ঘরে বা উঠান বা ছাদে আয়োজন করে দেখার জন্য ভিসিপি বা ভিসিআর ভাড়া পাওয়া যেত। সর্বজনীন ইন্টারনেট সংযুক্তির আগেই যেমন পাওয়া যেত ও দেখা/শোনা হতো সিডি বা ভিসিডি। সিডি প্লেয়ারে। জনসংস্কৃতির পরিসরে নৈমিত্তিক বিনোদন, বিভিন্ন বয়ান শ্রবণ, দর্শনসমেত ভোগ বা উপভোগের বড় রূপান্তরের সাক্ষ্য এইসব ডিভাইজ। তখনও স্মার্টফোনের প্রচলন হয় নাই। ঘরে ঘরে ভিসিপি বা ভিসিআর ছিল না। অনেক বাড়িতেই টুইনওয়ান বা অডিও ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল, যা রেডিওর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শ্রুতিগত পারফরমেন্সকে জনসংস্কৃতির ঐতিহ্যের বদলে এবং সামাজিক–রাজনৈতিক–বিনোদনের সঙ্গে জনরুচি ও ভোগের বিন্যাসের ধরনের রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বিভিন্ন তথ্য বা বয়ান রেকর্ড করা এবং পরে বারংবার শোনা বা দেখার সুযোগ তৈরি হওয়ায় শিল্প উৎপাদনের কারখানায় কপিরাইট, বৈধতা, প্রমাণ্যতা, অরিজিনালিটি, ও শুদ্ধতার প্রসঙ্গগুলো পুনরায় প্রশ্নের মুখে পড়ল। ক্যামেরা বা চলচ্চিত্রের প্রচলনের পরে যেমন পড়েছিল। জনসংস্কৃতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা ও সংবেদন, রাজনৈতিক পরিসরের উপরে রেকর্ড করা ভাষণ–বয়ান–গান–নাটক–আবৃত্তি–ধর্মীয় বয়ান সঞ্চালিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় ও ভোগের/শোনার/দেখার সংবেদী ঐতিহ্যের এই বদল নিয়ে তেমন সিরিয়াস আলাপচারিতা ও বয়ান ঐতিহ্যের বয়ানে যেমন নজরে পড়ে না, তেমনই বিদ্যায়তনিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরেও এইসব প্রযুক্তি আর শিল্প–কারখানার মিথস্ক্রিয়া জনসাংস্কৃতিক পরিসরে কিভাবে প্রভাব ফেলেছিল তা নিয়েও পর্যালোচনা চোখে পড়ে না।
বেতের তৈরি নির্দিষ্ট আকারের গোলাঘর। উপরে খড়ের ছাউনি। ঔপনিবেশিক ও আধুনিকীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে যে জটিল প্রক্রিয়ায় এই অঞ্চলের যাপিত জীবনের সকলক্ষেত্র প্রভাবিত ও রূপান্তরিত হয় তার ধারাবাহিকতা উপনিবেশোত্তর কালেও অব্যাহত থেকেছে। রূপান্তর প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয় এই বদ্বীপের জমি–জলের সঙ্গে মানবীয় সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের মধ্যে। এই অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল ক্ষেত্রই রূপান্তরিত হয়েছে। ১৯৬০–এর দশকের সবুজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে হাইব্রিডাইজেশন, শস্য আবাদের প্রক্রিয়ায় বদল, ধান ও অন্যান্য শস্য আবাদ, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিপণন, ও ভোগের প্রক্রিয়ার যে বদল ঘটেছে সেই বদলের ইতিহাস নিয়ে আমাদের অঞ্চলের চিন্তক–গবেষণগণ খুব বেশি আগ্রহী ও মনোযোগী নন। নাগরিক ও বিদ্যায়তনিক ঐতিহ্যের আলাপে আর ইদানিংকালের জলবায়ু ও ইকোলজির পরিবর্তনের হুমকির মুখে টেকসই উন্নয়নের বয়ানে স্থানীয় ঐতিহ্যগত ধান ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নিয়ে প্রচলিত উন্নয়ন আর আধুনিকতার বয়ানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ স্থানীয় জ্ঞান/ইনডিজিনাস নলেজ এবং স্থানীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধান ও শস্য উৎপাদনের আলাপ উত্থাপিত হয়। সেই আলাপ বৃহত্তর বহুজাতিক সংস্থা, রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষির উপরে নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন পদ্ধতি ও উপকরণের উপরে নিয়ন্ত্রণ আর বাজার–ব্যবস্থার প্রভাবের মধ্যে বিদ্যমান শর্তগুলোর সঙ্গে মানানসই হতে হয়। আমাদের প্রচলিত চিন্তা ও ঐতিহ্যে যেমন শস্য নিয়ে আলাপগুলো অনেকটাই হয় বিজ্ঞান নয়তো সমাজবিজ্ঞানের পরিসরের মধ্যে রেখে হয়। বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা, ইতিহাস, আর রাজনৈতিক বাস্তুবিদ্যার সংশ্লেষে জারিত বিদ্যাচর্চার পরিসরে আমাদের এই অঞ্চলের চাষাবাদকে তার রূপান্তরের বহুমাত্রিক ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে বয়ান করা হয়। ঔপনিবেশিক আধুনিকতা আর শাসনের অনিবার্য প্রভাবে বদ্বীপীয় পরিসরের আবাদ–শস্যব্যবস্থাপনা–ভূমিব্যবস্থাপনা–প্রতিবেশের বুনিয়াদী রূপান্তর ঘটেছিল। এই রূপান্তরে ফলে এখানকার প্রতিবেশ, অর্থনীতি, সামাজিক ও ধর্মীর আচার ও সংবেদের যে পরস্পরাগত লিপ্তির সম্পর্ক ছিল তা পাল্টে গেছে। এখন বিদ্যায়তনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের চর্চায়, নীতিমালা প্রণয়নে আর বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়নের বয়ানগুলোতে এগুলো পরিস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ ও বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়। ঐতিহ্য তো কেবল পুরানো ও অতীতের কোনো কিছুর ধারাবাহিকভাবে জারি থাকার সন্ধান করা আর বয়ান জারি করা না। সন্ধানের কারণ ও পদ্ধতি, এছাড়া বয়ান জারির পরিপ্রেক্ষিত, পূর্বানুমান আর পাটাতনগুলোও জ্ঞানচর্চার নির্দিষ্ট ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হতে থাকে। এই ঐতিহ্য হিসেবে কোনো কিছুকে বাছাই করা আর নির্মাণ করা আর সেই বাছাই ও নির্মাণের জ্ঞানের ঐতিহ্যের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া আধিপত্যশীল ঐতিহ্য নিয়ে আলাপ ও বাহাছে পুরোপুরি অনুপস্থিত থাকে। বঙ্গীয় বদ্বীপের চাষাবাদের ঐতিহ্য নিয়ে আলাপে মানবায়িত যে–বয়ান জারি থাকে, তেমন আলাপ নদী–জল–বৃষ্টিপাত–জমির সংশ্লেষের ইতিহাস নিয়ে হয় না আমাদের জ্ঞানচর্চার বা বাহাছের ঐতিহ্যে। কেবল প্রতিনিধিত্বশীল দৃশ্য হিসেবে আমাদের দেশের ধান সংরক্ষণ করার গোলাঘরের বিভিন্ন প্রকারের মধ্য থেকে দুইটির ছবি দিলাম। দুটোর মধ্যে একটি বেত ও খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি বিশেষ গড়নের গোলাঘর আর অন্যটি ইট–মাটির দেয়ালের উপরে টিনের ছাউনির গোলাঘর। দুই ধরনের গোলাঘরই হালে ব্যবহারের দিক থেকে প্রায় বিলুপ্ত। কৃষক ধান ও বীজের উপর থেকে তার সার্বভৌম অধিকার হারানোর পরে এবং বীজ–সেচ–সার–কীটনাশক–জমির ব্যবস্থাপনা–বিপণনের সকল পর্যায় রাষ্ট্র–বহুজাতিক পুঁজি– রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান–ব্যাংক ইত্যাদি কুশীলবদের অধীনস্থ হয়ে যাওয়ার পরে ধান সংরক্ষণের প্রক্রিয়া ও ধরনও পাল্টে গেছে। এই পাল্টানো বা বিলুপ্তি নিয়ে প্রচলিত ঐতিহ্য হারানোর আহাজারি ও আর্তনাদ করাটাই স্বাভাবিক বলে মনে হতে পারে। টিকিয়ে রাখার বা ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করার আকুতিতাড়িত হাহাকার ও বিলাপ জারি থাকতে পারে। সেটাই প্রতিষ্ঠিত ও হেজিমোনিক ঐতিহ্য–ভাবনা ও বয়ানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে হয়তো; কিন্তু এই বয়ানে ঐতিহ্য অনন্ত ও অপরিবর্তনীয় এমন একটা পুর্বানুমান যেমন বহাল থাকে, তেমনই খুবই সিলেকটিভলি প্রচলিত ঐতিহ্য–ভাবনার ছাঁচে রেখে আকুতি–বাসনা–আকাঙ্ক্ষা তৈরি হতে থাকে। বেশিরভাগ থেকেই এই বয়ানে ইতিহাস নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড দিয়ে বিচার ও রচনা করা হয়। বিলীন হওয়ার সামগ্রিক পর্যালোচনার বদলে যেভাবে আলাপ করলে আরাম হয় সেভাবেই আলাপ–হাহাকার–আকুতি প্রকাশ করা হতে থাকে। একই কথা প্রযোজ্য পরের দুটো ছবিতে প্রদর্শিত মাটি দিয়ে তৈরি ঘর, হয় খড়ের ছাউনি অথবা গোলপাতার ছাউনি, বাঁশের বেড়া, খুটি দিয়ে বানানো ঘর নিয়ে নাগরিক ভদ্রবিত্তীয় পরিসরে ঐতিহ্য হারানোর বা রক্ষা করার হাহাকার নিয়েও প্রযোজ্য। ঔপনিবেশিক আমলে বদ্বীপ অঞ্চলে গ্রামের কুড়েঘর হিসেবে নথিভুক্ত বা আলোকচিত্রায়িত করে মহাফেজখানার নথিতে রূপান্তরকরণের যে প্রকল্পগুলো তৈরি হয়েছিল সমীক্ষা–জরিপ–নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়ায় বর্তমানের ঐতিহ্য নিয়ে প্রচলিত বয়ানগুলোকে সেই প্রক্রিয়ার ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ঐতিহ্য নিয়ে আলাপচারিতা ও অনুভুতি উপলব্ধ ও অভিব্যক্ত হয় নির্দিষ্ট ও স্বীকৃত ঐতিহ্যের ছাঁচে ফেলে। আপাত দৃষ্টিতে কথাটা পরস্পরবিরোধী বা কুটাভাসমূলক মনে হলেও চলতি সংবেদ ও অনুভূতির ঐতিহ্য মধ্যে থেকেই রক্ষা করা, বাছাই করার ও নির্মাণ করার ঐতিহ্য গঠিত হয়।
বাতাস চলাচলের উপযোগী করে এবং ভেতরের তাপ–আর্দ্রতা ও ইঁদুর থেকে নিরাপদ রাখার জন্য ইটের ভিত্তির উপরে মাটির দেয়ালের সিলিন্ডারাকার গোলাঘর। উপরে টিনের ছাউনি।
মাটির তৈরি ঘর, সামনের উঠোন ঘিরে তৈরি করা মাটির দেয়াল। উপরে শন ও খড়ের ছাউনি।
দক্ষিণাঞ্চলে বাঁশ, বেত, হোগলার বেড়া আর গোলপাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি ঘর। এসব ঘর নাগরিক ভাষায় ‘কুঁড়েঘর’ নামে পরিচিত।
১৮৬০ এর দশকে বদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে বাঁশ–বেত, মাটি আর খড়–ছনের দো–চালা ও ধনুকের মতন বাঁকানো ছাউনি–বিশিষ্ট ঘর। এসব ঘর ঔপনিবেশিক ভাষাদুনিয়া ও অভিধানে বাংলা–ঘর (যা থেকে বাংলো শব্দটি এসেছে) পরিচিতি লাভ করে। পরে এই অঞ্চলের প্রাক–আধুনিক স্থাপত্য ও শিল্পকলার ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের আর স্থাপত্যবিদ্যার পরিভাষায় এই শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। মসজিদের কার্নিশ, মন্দিরের শ্রেণিকরণের পাশাপাশি স্থাপত্যশৈলির বিচার ও বিবরণীতে এই বাংলা এবং দো–চালা, চৌচালা, আট–চালা, বাঁকানো কার্নিশ ইত্যাদি শব্দের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। প্রান্তিক ও নিম্নবর্গীয় গৃহ ও গৃহনির্মাণ শৈলি বনেদি ও অভিজাত শাস্ত্রীয় ঐতিহ্য ও বিদ্যাচর্চায় আত্মীকৃত হয়ে পরিচয়বাদী অন্যতম চিহ্নে রূপান্তরিত হয়েছে ‘বাংলো’ (> বাংলা স্থাপত্য শিল্প) হিসেবে। অধুনা স্থানিক প্রতিবেশ ও জলবায়ুর উপযোগী এবং ঐতিহ্যগত মানুষ–প্রতিবেশের মিথস্ক্রিয়ার প্রতীক হিসেবে এই ধরনের স্থাপনাকে বিবেচনা করা আর আত্মীকরণ করার তৎপরতা লক্ষণীয়ও বঠে। ঐতিহ্যের বোঝাপড়ার নতুন ধরন আর ধারণায়নের একটি প্রতিফলন হিসেবে এই চিন্তাকে বিবেচনা করা যায়।
ঢাকার আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একটি গ্যালারি।
মিউজিয়াম বা জাদুঘরকে ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠিত ও স্বাভাবিকীকৃত আধুনিক চিন্তা ও বয়ানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এবং পরিসর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। জাদুঘরবিদ্যা বা মিউজিওলজি নামে একটি আলাদা শাস্ত্র যেমন বিকশিত হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদ্যায়তনিক চর্চায়ও তেমনই বহুমুখী গুরুত্ব অর্জন করেছে। হেরিটেজ (যা ট্রাডিশন অর্থে ঐতিহ্য থেকে ভিন্ন অথচ সম্পর্কিত একটি ধারণাকে নির্দেশ করে) ধারণা ও সংশ্লিষ্ট হেরিটেজ অধ্যয়ন ও হেরিটেজ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত শাস্ত্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ও চর্চার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিউজিয়ামও একটি কেন্দ্রীয় ধারণা ও ঐতিহ্যের বয়ান তৈরির ক্ষেত্রে আবশ্যকীয় পরিসর ও প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে। পাশাপাশি, ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পুনরানয়ন, প্রদর্শন এবং ব্যবস্থাপনার বহুবিধ শাস্ত্রীয়, বিধিবিধানগত, নীতিমালাগত এবং গবেষণাগত প্রবণতা ও চর্চা তৈরি হয়েছে। এখনকার যেকোনো বয়ানে এসব শব্দ বা পদ বহুল উচ্চারিত হয়। তবে এসব প্রতিষ্ঠান, ধারণা এবং চর্চা স্থানিক ও কালিকভাবে রূপান্তর, পরিবর্তন, পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁর পরবর্তীতে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ইউরোপীয়দের সমুদ্রপথে বাণিজ্য ও যোগাযোগের সঙ্গে সঙ্গে অতীত ও পূর্বপ্রজন্মের উত্তরাধিকার সুত্রে অর্জিত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, ধারণা, জাতিগত ও নরবর্ণগত ধারবাহিকতা নিয়ে জানা ও সংরক্ষণ করার যে তৎপরতা শুরু হয় তা ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ায় আরো প্রবল ও বহুমাত্রিকতা অর্জন করে। জাদুঘরবিদ্যা বিষয়ক যেকোনো বুনিয়াদি কিতাবে বা অন্তর্জালিক টেক্সটে বা বইয়ে বা মাধ্যমে এই ইতিহাস নিয়ে বিশদ আলাপ ও পর্যালোচনা পাওয়া যাবে। ঔপনিবেশিক ও পশ্চিমা জ্ঞানের বুনিয়াদ হিসেবে এবং অপশ্চিমা সমাজ, সংস্কৃতি, মানুষজন সম্পর্কিত প্রাচ্যবাদী বয়ান নির্মাণে বিভিন্ন ধরনের জরিপ ও সমীক্ষা যেমন ভূমিকা রেখেছিল তেমনই ভূমিকা রেখেছিল জাদুঘরীকরণ/মিউজিওলাইজেশন। বিভিন্ন বস্তু সংগ্রহ করা, নির্দিষ্ট প্রণালীবদ্ধ প্রক্রিয়ায় একটি পরিসরে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা এবং সেই প্রদর্শনীকে শিক্ষাপ্রদানের (বা সভ্য ও আধুনিক করে তোলার) মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার তৎপরতাকে আধুনিকীকরণের প্রকল্পগুলোর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে শনাক্ত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে, পরিচয়বাদী ও জাতীয়তাবাদী চেতনা ও বয়ান নির্মাণ, প্রদর্শন, এবং সঞ্চালন করে ‘নিজ জাতিগত বা সম্প্রদায়গত বা জাতি–রাষ্ট্রগত বা নরবর্ণগত গৌরব ও উজ্জ্বল অর্জনের’ প্রামাণ্যগুলো জনপরিসরে ছাড়ানোর জন্য জাদুঘর ভীষণ কার্যকর ছিল। উপনিবেশোত্তর কালে, বিশেষ করে, গত দুই–তিন দশকের বহুমুখী পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে জাদুঘরের ধারণা, প্রদর্শনীর রাজনীতি এবং জাদুঘরের বয়ান নির্মাণের সঙ্গে পরিচয়বাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে আলাপচারিতা আর ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ অনেক বেড়েছে। একইসঙ্গে, প্রবল বয়ান ও দৃশ্যমানতার রাজনীতি আর আধিপত্যবাদের প্রতিরোধের নানাবিধ তৎপরতায় জাদুঘরের ভূমিকা সম্পর্কেও বহু নতুন জিজ্ঞাসা ও ধারণার বিকাশ ঘটেছে। যেসব প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: কে, কেন ও কীভাবে সংগ্রহ করছে? কী কী সংরক্ষণ করছে (কিংবা করছে না)? কীভাবে প্রদর্শন ও পরিবেশন করছে (বা লুকিয়ে রাখছে বা অপর হিসেবে হীনভাবে প্রদর্শন করছে)? কারা দর্শক ও শ্রোতা? কারা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে? সচেতনকরণের প্রকল্প কারা ও কেন গ্রহণ করছে? কোন উপাদান, প্রসঙ্গ, বিষয়বস্তু জাদুঘরে কিভাবে দেখানো ও পরিবেশিত হচ্ছে? বাছাইকরণের ও প্রদর্শনের রাজনীতি ও বুনিয়াদি ধারণা কোন জ্ঞানের পাটাতনে তৈরি হচ্ছে? জাদুঘর বলতে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসরকে সংজ্ঞায়িত করা বা না–করা জরুরি কি না? অন্তর্জালিক ও অপরবাস্তব পরিসরের প্রদর্শন, পরিবেশন ও ভোগ/গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আগেকার জাদুঘরের বোঝাপড়া কেমন হবে?—এমন বহু প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। একইসঙ্গে জাদুঘরের বহুমাত্রিক ও বহুপ্রকারের অস্তিত্বের উন্মেষ ঘটছে। ভুলে যাওয়ার বিপরীতে মনে রাখার যে–রাজনীতি সেই রাজনীতি ও ভোলানোর বা মনে রাখানোর ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বয়ান তৈরি করার জন্য বিকল্প জাদুঘর ধারণার বিকাশ ঘটছে। উন্মুক্ত পরিসরে, অস্থায়ীভাবে, স্মৃতির দৃশ্যগত ও শ্রুতিগত পরিবেশনের প্রক্রিয়ায়, অপরবাস্তব পরিসরে আর্কাইভিং, সকলের জন্য উন্মুক্ত, ভোক্তা বা গ্রহীতার সক্রিয় অংশগ্রহণ নির্ভর সংলাপমুখর জাদুঘরের ধারণা এখন বহু পরিসরে খুঁজে পাওয়া যাবে। অন্তর্জালের দুনিয়ায় বহু পুরানো, বনেদি, ও বিখ্যাত মিউজিয়াম ও সংগ্রহশালায় প্রবেশ করা, দেখা, ও শোনার সুযোগ এখন তৈরি হয়েছে। একটি স্থাপত্য, বা একটি সুনির্দিষ্ট পরিসরই জাদুঘর আর কিছু সুনির্দিষ্ট বস্তু বা নিদর্শনই জাদুঘরে থাকবে—এমন ধারণাকে এখন আধিপত্যবাদী হিসেব বিবেচনা করার চলও রয়েছে। আমি এখানে বাংলাদেশের তিনটি জাদুঘরের তিনটি ছবি দিলাম। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের, পটুয়াখালীর পানি জাদুঘরের আর রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের একটি করে তিনটি ছবি। প্রতিটি ছবি জাদুঘরগুলোর ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে প্রদর্শন, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ধরন উপস্থাপন করছে। ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত অতীত ও বর্তমানের বিষয় ও প্রসঙ্গগুলোর ভিন্নতাকেও উপস্থাপন করছে।
পটুয়াখালীতে নির্মিত পানি জাদুঘরে বিভিন্ন নদীর পানির সংরক্ষণ ও প্রদর্শন আর পানি ব্যবহারের বিভিন্ন মৃৎপাত্রের প্রদর্শন।
রাজশাহীর বরন্দ্রে গবেষণা জাদুঘরে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক পাথরের প্রতীমা প্রদর্শনকক্ষ ও গ্যালারি। অবিভক্ত বাংলা অঞ্চলে প্রত্নতত্ত্ব চর্চা ও জাদুঘরের প্রথম দিককার একটি নিদর্শন হিসেবে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরকে বিবেচনা করা যায়। জাতীয়তাবাদের বিকাশের কালে উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র নামে চিহ্নিত অঞ্চলের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চার যে আঞ্চলিক তৎপরতাগুলো লক্ষ করা যায় তার মধ্যে বরেন্দ্র গবেষণা সমিতি একটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঐতিহ্যের সংজ্ঞায়ন, মানদণ্ড নির্ধারণ, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ আর সংরক্ষণের সঙ্গে পরিচয়বাদী বয়ানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে আলাপ করার জন্য এই জাদুঘর একটি ভালো কেইস–স্টাডি হতে পারে।