অরাজ
প্রচ্ছদ » রিসেট।। বীজের কর্পোরেট বাণিজ্যিকীকরণ

রিসেট।। বীজের কর্পোরেট বাণিজ্যিকীকরণ

  • অনুবাদ: রাহুল বিশ্বাস

সম্পাদকীয় মন্তব্য:  RESET – Digital for Good স্বাধীন সাংবাদিকতার একটি প্ল্যাটফর্ম; বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু/সমস্যা সমাধানের দিকে নজর দেয়াটাই তাদের মূল লক্ষ্য। ডিজিটাল পরিসরকে ব্যবহার করে তারা এমনসব প্রকল্প বা ব্যবসা-উদ্যোগকে সামনে নিয়ে আসেন যেগুলো ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম। বর্তমান জমানার দুটো প্রধান প্রবণতাকে- অর্থাৎ, ক্রমবর্ধমান ডিজিটালাইজেশন এবং জলবায়ু পরিবর্তন- সামনে রেখে তারা কাজ করে যান। প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে তাদের পরিবেশ বান্ধব টেকসই উন্নয়নের জন্য কীভাবে ডিজিটাল টুলসগুলো ব্যবহার করা যায়। নিচের প্রবন্ধটি ‘The Privatisation of Seeds’ শীর্ষক প্রবন্ধের অনুবাদ। প্রবন্ধে বীজের প্রাইভেটাইজেশন নিয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ জরুরি কিছু মন্তব্য করা হয়েছে।

আর্টওয়ার্ক: মাদার আর্থ
শিল্পী: সুমিত দত্ত
সূত্র: পিকটোরেম

মূল প্রবন্ধ 

বছরের পর বছর ধরে কৃষকরা তাদের নিজস্ব ফসল থেকে বীজের প্রাপ্তি হারাচ্ছে এবং বীজ সরবরাহকারীদের কাছ থেকে নতুনভাবে কিনতে বাধ্য হচ্ছে। মনসান্টো বীজের বাজারকে একচেটিয়াভাবে দখল করেছে। ফলশ্রুতিতে বাজারে উদ্ভিদের জাত বৈচিত্র্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত হয়েছে। যার পরিণতি স্বরূপ আমাদের পরিবেশ এবং কৃষক, যারা বীজ থেকে ফসল ফলায়, উভয়ের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।

বীজ কারখানাগুলো আগের তুলনায় এখন আরো বেশি একীভূত। বাণিজ্যিক বীজ বাজারের প্রায় তিনচতুর্থাংশ দশটি বৃহত্তম বীজ কর্পোরেশনের আওতাধীন রয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ তিনটি বীজ কর্পোরেশন মনসান্টো, ডুপন্ট এবং সিনজেন্টা বাজারের অর্ধেকেরও বেশি (৫৩ ভাগ) দখল করে আছে। গ্রিনপিসের জিনগতভাবে পরিবর্তিত বীজের পরিসংখ্যান লক্ষ্য করলে দেখা যায়, মনসান্টো ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৯০ শতাংশ জিনগত পরিবর্তিত বীজ বিক্রি করেছে।

তবে আঞ্চলিক পার্থক্য রয়েছে। যদিও শিল্পোন্নত দেশগুলিতে কৃষি প্রধানত বাণিজ্যিক বীজ সরবরাহকারীদের উপর নির্ভরশীল, তবে অনেক উন্নয়নশীল দেশ এখনও এগুলির থেকে তুলনামূলকভাবে স্বতন্ত্র। ভারতীয় কৃষিতে বিদ্যমান বাণিজ্যিক বীজের অনুপাত আনুমানিক ৩০ শতাংশ, এবং সমগ্র আফ্রিকায় ১০ শতাংশের কম।

যদিও এক তৃতীয়াংশ পটপরিবর্তনের মতো নাও শোনাতে পারে, বাণিজ্যিক বীজ বাজার এবং বিশেষ করে মনসান্টো ভারতীয় কৃষকদের উপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে। তুলা চাষীরা বিশেষ করে চাপে পড়েছে কারণ মনসান্টো তার জিনগত পরিবর্তিত বীজের মাধ্যমে তুলার বীজের বাজারের ৯৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।

কিভাবে আমরা এই পর্যায়ে এলাম? খামার থেকে কর্পোরেশন

উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বাণিজ্যিক বীজের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের পিছনে রয়েছে কৃষির পটপরিবর্তনের ইতিহাস, টার্গেটেড কোম্পানগুলো একীভূত হয় এবং পেটেন্টিং প্রক্রিয়া এবং আইনি কাঠামোর ব্যবহারের মাধ্যমে বীজের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে।

মুষ্টিমেয় কৃষিব্যবসা কীভাবে কৃষিতে বীজের মতো মৌলিক কিছুর উপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল তা বোঝার জন্য আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। ঐতিহ্যগতভাবে বীজ একটি পূর্ণ পরিমণ্ডল তথা চক্র তৈরি করে, ফসল তোলার পর বীজের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ পরের বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয় এবং চক্রটি কখনই বিঘ্নিত হয় না।

১৯৫০এর দশকে কৃষিকে শিল্পায়ত করা শুরু হয়েছিলো এবং ১৯৬০ এবং ১৯৭০’র দশকে এর রমরমা অবস্থা শুরু হয়েছিল। ফলস্বরূপ, উৎপাদন পদ্ধতি ক্রমবর্ধিতভাবে যান্ত্রিক এবং যুক্তিযুক্ত হয়ে ওঠে। বিশ্বের বহু অঞ্চলে তথাকথিত ‘সবুজ বিপ্লব’ প্রবর্তিত হয়েছিল উল্লেখযোগ্যহারে ফসলের ফলন বৃদ্ধি এবং ব্যাপক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সংকট দূর করার লক্ষ্যে।

রমরমা শিল্প কৃষির এই নতুন মডেল মেনে চলার জন্য, খামারগুলিকে আরও বড় হতে হবে এবং আরও বিশেষায়িত কাজগুলি করতে হবে। কৃষিকে যেমনটা আমরা জানি এটি আগের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, যেমন এর মধ্যে বাজার রয়েছে। কাণ্ডপ্রজনন, বীজ, পশু খাদ্য, সার এবং কীটনাশক প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা বাজার আবির্ভূত হয়েছে। এই ধরনের একটি ব্যবস্থায়, কৃষকরা নিছক একটি উৎপাদন শিকলের সদস্য হয়। তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের ফসল উৎপাদন করতে পারে না।

মনসান্টোসহ আরও কিছু সর্ববৃহৎ কৃষি কর্পোরেশন বাজারে প্রবেশ করায়, মাঝারি আকারের খামার এবং ব্যবসাগুলো নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলি অন্যদের কেনার মাধ্যমে বা অন্যদের ব্যবসা নিজের সাথে যুক্ত করে প্রসারিত হতে সক্ষম হয়েছিল। ফলস্বরূপ, কৃষি অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা হ্রাস পেতে শুরু করে। সেই সাথে বীজের প্রকরণ হ্রাস পায় এবং তা ন্যায্য মূল্যে পাওয়া যায় না। উপরন্তু, যে কর্পোরেশনগুলি বীজ উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত তারা অনেক ক্ষেত্রে কীটনাশক সরবরাহকারীও, যা বিক্রি করা হয় তাদের বীজের সাথে সাথে। বীজ এবং কীটনাশক উভয়ই সম্ভাব্য সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্যে যুক্ত থাকে এবং এই পদ্ধতিটি মনসান্টো দ্বারা সার্বিকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।

মনসান্টোর মত বড় কর্পোরেশন কি অফার করছে? কৃষকরা এটা শুনে আঁতকে ওঠেন যে উচ্চ কার্যক্ষমতাসম্পন্ন বীজের সাহায্যে তারা অনেক বেশি ফলন পাবে, যা শক্তপোক্তভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং সেই সাথে মেশিনের সাহায্যে দক্ষতার সাথে এবং অল্প খরচে ফসল কাটা হবে। সত্যিকার অর্থে ব্যবসাকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে, ফলন আরও বাড়াতে এবং লাভ সর্বাধিক করতে, কর্পোরেশনগুলোর সংকর (হাইব্রিড) বীজের জাত রয়েছে।

হাইব্রিড বীজ: যেমন গুণসম্পন্ন তেমন ক্ষতিকর

কৃষির সূচনা লগ্ন থেকেই সর্বদা কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের একটা বাছাইকৃত অংশ আসন্ন বছরের চাষাবাদ বা ব্যবসার জন্য যত্ন সহকারে আলাদা করে রাখতো। বীজ হিসেবে ফসলের একটা অংশের এইরুপ পুনঃব্যবহার, বিশ্বব্যপী বিভিন্ন দেশে প্রচলিত রয়েছে। তবে বীজ প্রকৌশলী ও প্রদানকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে, বীজ হিসেবে ফসলের অংশের এই পুনঃরোপন কিংবা এই বীজ কেনাবেচার অর্থ হল সম্ভাব্য গ্রাহকদের হারানো। আর এজন্যই সংকরীকৃত বীজ গুণসম্পন্ন।

সর্বোত্তম সেচ, সার এবং কীটনাশকসহ সংকর জাতের প্রথম ফসলের ফলন ১৫৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। যাইহোক এই বীজগুলোর দ্বিতীয় প্রজন্ম একইধরণের ফলন দেয়না, এর পরিবর্তে এটি বিভিন্নধরণের উদ্ভিদের জন্ম দেয়। তাই সংকরীকৃত বীজ পুনরায় রোপণ করা সম্ভব হয় না এবং কৃষকরা প্রতি মৌসুমে বীজ পুনরায় ক্রয় করতে বাধ্য হয়। বীজ পরিবেশকদের (ডিস্ট্রিবিউটর) জন্য এটি সত্যিই দারুণ, এই বীজ বিক্রির মাধ্যমে তাদের ব্যবসা সুরক্ষিত এবং পরিচালিত হয়।

এটা বলা হয় যে সংকরীকৃত বীজ উচ্চমাত্রায় ফলন প্রাপ্তির জন্য প্রযুক্ত করা হয়, পোকামাকড় ও রোগ প্রতিরোধী ফসল উৎপাদন করে, যা প্রযুক্তিগতভাবে বলতে গেলে, অনেক সহজে কাটা যায়। তবে প্রকৃত অনুসন্ধানকারীরা দেখতে পান যে এই ফলাফলগুলি প্রাকৃতিক বীজের জাতগুলির সাথেও উপলব্ধি করা যেতে পারে, এবং অপরদিকে সংকরীকৃত ফলনের ক্ষেত্রে উৎপাদিত ফসলের গুণমান, সেগুলি উত্পাদন করার জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চ ব্যয়, ফসলের বিরাজমান জাত বৈচিত্র্যতা হ্রাস এবং বড় বীজ কর্পোরেশনগুলির উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতার প্রশ্নগুলি যার সাথে সম্পর্কিত।

ক্ষুধার পরিবর্তে ‘উন্নয়ন’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ জুড়ে কয়েকটি বড় কর্পোরেশন বাজারে একটি শক্তপোক্ত দখল নিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অফ এগ্রিকালচারাল নলেজ, সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফর ডেভেলপমেন্ট (IAASTD)-এর তথ্যমতে, কর্পোরেশনগুলো যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে তা নিম্নোক্ত কারণে সমস্যাযুক্ত:

  • একচেটিয়া শক্তি গবেষণা ও উন্নয়নের একীভূতকরনের দিকে পরিচালিত হয় যা শুধুমাত্র অল্প সংখ্যক বীজের জাতগুলিতে বিনিয়োগ করে।

  • কেন্দ্রীভূত বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অন্যান্য খামারগুলোকে (যা বিকল্প পণ্য ও ব্যবসায়িক মডেল প্রদানে সক্ষম হতে পারে) অর্থনীতিতে প্রবেশ করতে বাধা দিতে পারে।

  • একটি অধিপত্যমূলক বাজারের প্রতিযোগীতা দমনকারী প্রভাব বীজের দামে ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। জীবের জিনগত পরিবর্তন প্রবর্তনের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুলার বীজের দাম তিন থেকে চার গুণ বেড়েছে। তুলার বীজের দামের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও দেখা যায়।

বাজারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, হাইব্রিড বীজ এবং বীজের কঠোর পেটেন্টিংয়ের প্রভাব বিশ্বের দক্ষিণে অবস্থিত দেশগুলোকে মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ভারতে মনসান্টো

বন্দনা শিবা একজন ভারতীয় অ্যাকটিভিস্ট এবং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ইকোলজি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (Research Foundation for Science, Technology and Ecology) প্রণেতা ও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি যুক্তি দেন যে ভারতে মনসান্টোর একচেটিয়া বীজ কৃষকদের আত্মহত্যা বৃদ্ধির মূল কারণ হয়ে উঠেছে। আলজাজিরাতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে শিবা যুক্তি দিয়েছেন যে “মনসান্টো এবং এর জনসংযোগকারীরা মরিয়া চেষ্টা করছে, তুলার বীজ সরবরাহে মনসান্টোর ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতিতে ভারতে কৃষকদের আত্মহত্যার মহামারী যে পরস্পর সম্পর্কিত এই বিষয়টিকে আলাদা করার জন্য৷ আমাদের জন্য এটি বীজের উপর নিয়ন্ত্রণ, সর্বপ্রথম সম্পর্কটা খাদ্য শৃঙ্খলের ভিতরকার, যেটা আমাদের জীবনের উৎস সেটা আমাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। যখন একটি কর্পোরেশন বীজ নিয়ন্ত্রণ করে, তখন তা জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের কৃষকদের জীবনও যার অন্তর্ভুক্ত।

১৯৮৮ সাল থেকে ভারতে মনসান্টোর উপস্থিতি রয়েছে যখন কিনা বিশ্ব ব্যাংক একটি নতুন বীজ নীতি প্রবর্তন করেছিল যার জন্য সরকারকে বীজ খাতকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে, যা কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস নীতিগুলির সাথে অনেকগুলি পদক্ষেপের মধ্যে একটি। শিবা পাঁচটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন শনাক্ত করেছেন যা মনসান্টো ভারতীয় বীজ বাজারে প্রবেশ করার পর থেকে শুরু হয়েছে:

  • ভারতীয় কোম্পানিগুলো যৌথ উদ্যোগ ও লাইসেন্সিং ব্যবস্থার মাধ্যমে মনসান্টোর সাথে সূত্রবদ্ধ হয়, যা এটিকে সেক্টরের উপর একটি শক্তিশালী দখল নিশ্চিত করতে সক্ষম করে।

  • মনসান্টোর বীজগুলিকে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল, যার অর্থ হল মনসান্টো রয়্যালটি সংগ্রহ করতে পারতো–এগুলি অর্জিত মোট বিক্রয়লব্ধ আয় বা নেট আয়ের (gross or net revenues) একটি পার্সেন্টেজ বা ভাগ বা ফসলের একটি নির্ধারিত মূল্য।

  • উপরন্তু যে বীজগুলি একসময় নবায়নযোগ্য সম্পদ ছিল তা এখন নবায়নযোগ্য নয় কারণ পেটেন্টযুক্ত সংকর ও জিন পরিবর্তিত জাতগুলো দ্বারা প্রাকৃতিক, মুক্তপরাগায়িত তুলার বীজ প্রতিস্থাপিত হয়েছিল।

  • তুলা, যা পূর্বে অন্যান্য ফসলের সাথে সমন্বয় বজায় রেখে জন্মানো যেত, তা একটি একক শস্যে পরিণত হয়েছে যেটি পোকামাকড়, রোগ, খরা ও শস্যক্ষয়ের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল কীটনাশক ও সারের উপর নির্ভরশীল।

  • এবং সবশেষে মনসান্টো সরকারি নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়াগুলিকে বিকল করতে শুরু করে। এমনকি ‘সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্ব’এর মাধ্যমে অনবায়নযোগ্য সংকর এবং জিন পরিবর্তিত জাতগুলোকে বর্ধিত করার জন্য সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য সম্পদে প্রবেশাধিকার লাভ করে।

শিবা আরও বলেন, “বীজে একচেটিয়া কর্তৃত্ব সৃষ্টি, বিকল্পের নিধন, রয়্যালটি আকারে অতিমুনাফা সংগ্রহ এবং একফসলী চাষের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা ঋণগ্রস্ততা, আত্মহত্যা এবং কৃষি সংকটের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।”

কয়েক বছর ধরে তিনি ভারতে মনসান্টোর একচেটিয়া ক্ষমতার বিরোধিতা করে আসছেন। উপদ্রব এবং অন্যদের প্রতিযোগিতা কিনে নেবার ফলে এটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে তুলা উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ভারতীয় তুলা চাষীদের কাছে মনসান্টোর জিনগত পরিবর্তিত জাতের বিকল্প নেই।

তবে অধিকাংশ কৃষকের কাছে এই বীজ তাদের সামর্থ্যের অধিক এবং ফলন প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। পরিস্থিতিকে আরও সমস্যাজনক করে তুলেছে নতুন নতুন রোগ যার শস্য বোনা হয়েছে। যা তুলা গাছকে বিনষ্ট করছে কিংবা সম্পূর্ণরূপে তার ফলন ধ্বংস করছে।

অপরদিকে বংশপরস্পরায় চলে আসা তুলা গাছগুলি সেই অঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটির অবস্থার সাথে উপযোগী যেখানে তারা জন্মায়। জিনগতভাবে পরিবর্তিত উদ্ভিদগুলো জলবায়ুর সাথে অভিযোজিত (খাপ খাওয়ানো) হতে পারেনা। জিন পরিবর্তিত শস্যগুলোকে সুরক্ষা দিতে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল, স্বাস্থ্যবিনষ্টকারী এবং পরিবেশ অবান্ধব সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন হয়।

মনসান্টোর কারণে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় কৃষক আর্থিকভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ঋণগ্রস্ত হয়েছে, কেউ কেউ অন্য উপায় না দেখে আত্মহত্যার দিকেও ঝুঁকছে। ভারত সরকারের মতে, প্রায় ৭৫% গ্রামীণ ঋণ নেওয়া হয় কৃষকদের মাঠ পর্যায়ের প্রয়োজনগুলো মেটাতে। কৃষকের ঋণ যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি মনসান্টোর লাভও বাড়ে এবং এটি এমন পদ্ধতি যে তাদের বীজের নাম দেওয়া হয়েছে “আত্মহত্যার বীজ”। শিবা নোট করেছেন, “প্রতি কেজি তুলার বীজের দাম ৭ থেকে ১৭০০০ রুপি…. মনসান্টো বছরে ১৫০০ কেজি ফলন হওয়ার প্রতারণামূলক দাবি করে তার জিনগতভাবে পরিবর্তিত বীজ বিক্রি করে, যখন কৃষক বছরে গড়ে ৩০০৪০০ কেজি ফলন পেয়ে থাকে”।

বছরের পর বছর ধরে বৃহৎ বীজ কর্পোরেশনগুলি উন্নয়নশীল দেশের বাজারগুলিতে প্রভাব বিস্তার করেছে, যেখানে বাণিজ্যিক বীজ সরবরাহকারীদের উপস্থিতি নগণ্য ছিল। এই অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ করার সময়, তারা এই আশা নিয়ে জুয়া খেলেছে যে বীজের ক্রমবিকাশ এবং জিনগত প্রযুক্তির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক সমস্যার অলৌকিক সমাধান পাওয়া যাবে। যাইহোক, তথ্যউপাত্ত একটি ভিন্ন গল্পকে সামনে আনেখাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর মতে, বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার্ত ৮৬৮ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই সম্পদ বঞ্চিত কৃষক যারা উর্বর জমির ছোট ছোট প্লটে চাষ করে।

এতদসত্ত্বেও, বিশাল বীজ কর্পোরেশনগুলি তাদের গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ১ শতাংশ বীজে বিনিয়োগ করে যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত। একই সাথে, তারা চাপ এবং তাপপ্রতিরোধী জিনগুলির উপর কঠোর পেটেন্ট অর্জনের মাধ্যমে প্রতিযোগীদের এই বাজারগুলিতে খাদ্য সরবরাহ করা থেকে আটকাতে সক্ষম হয়, যা ফলত নিশ্চিত করে যে বাজারে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক যেকোন কর্পোরেশনগুলিকে প্রথমে তাদের সাথে নিজেদের সন্ধি স্থাপন করতে হবে।

অলিভিয়ার ডি শুটার, যিনি জাতিসংঘের খাদ্য অধিকার কর্মসূচির জন্য ‘বীজ নীতি এবং খাদ্যের অধিকার’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছিলেন, বলেছেন যে বিশ্বের দক্ষিণ অঞ্চলে দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা মোকাবেলা করতে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে ক্ষুদ্র পরিসরের, জীবিকানির্বাহের উপায় অবলম্বনকারী কৃষকদের বীজে প্রবেশাধিকার থাকতে হবে। অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক এবং স্থানীয় কাঠামোগুলির মাধ্যমে এগুলো বিক্রি ও লেনদেন করা যেতে পারে এবং তা আবহাওয়া, পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজনের জন্য যথাযথভাবে বিকশিত করা দরকার।

জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন

একটি একচেটিয়া বীজ অর্থনীতি এবং বীজ জাতগুলোর উপর আরোপিত প্রকৌশলের ফলে, উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের সামগ্রিক হ্রাস উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর মতে, বিংশ শতাব্দীর মধ্যে প্রায় ৭৫% ফসলের জাত হারিয়ে গেছে। ভারতে সবুজ বিপ্লবের আগে প্রায় ৫০,০০০ ধানের জাত ছিল, এবং বিশ বছরের মধ্যে এই সংখ্যাটা মাত্র ৪০–৫০,০০০ থেকে ৪০। অনেকগুলো নতুন সংকর জাত সৃষ্টি হয়েছে যা সর্বপ্রকারের জিনগত বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে সক্ষম হবেনা।

এই পরিসংখ্যানগুলি দেখলে অনেকটা ক্ষয়ক্ষতির মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু ফসলের বৈচিত্র্য রক্ষা করা কি সত্যিই এতটা গুরুত্বপূর্ণ? কারণ জাত বৈচিত্র্যতা অগণিত জিনগত বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে যা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিমুখে উদ্গত হওয়ার (জন্মানোর) কার্যকর বিকল্প হিসাবে কাজ করতে পারে। আসুন আমরা ভুলে না যাই যে আমাদের পরিবেশ তীব্রভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর সাথে আমাদের কৃষি পদ্ধতি বা অন্তত আমরা যা রোপণ করি, তারও পরিবর্তন হতে পারে। যদি জলবায়ু অবস্থার বদল ঘটে তবে এমনও হতে পারে যে একটি পুরানো জাতের উদ্ভিদ আরও উপযুক্ত হয়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭০এর দশকে ভারতে একটি ভাইরাস দ্বারা প্রচুর পরিমাণে ধানের ফসল (জাত) নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যাইহোক, বাদবাকি ৬২৭৩ ধানের জাতগুলির মধ্যে একটি ছিল যা ভাইরাস প্রতিরোধী।

জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি প্রথম সারির প্রতিবেদন যা ৪০০ জন বিজ্ঞানীর জ্ঞান সংকলন করেছে এবং ৫৮ টি দেশ দ্বারা সমর্থিত হয়েছে, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফসলগুলি দারিদ্র্য, ক্ষুধা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা খুব কমই করে থাকে। উত্তম বিকল্প সুলভসহজলভ্য এবং রিপোর্টটি টেকসই উপায় হিসাবে জৈব (অর্গানিক) চাষকে বিজয়ী করেছে।

এটি কার্যকর কিছু করার সময়

এটি উদ্বেগের কারণ যে মুষ্টিমেয় কিছু বীজ কর্পোরেশন বীজের বাজারে, এবং পরবর্তীকালে আমাদের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার বুনিয়াদগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করে।

আপনি যদি এই সমস্যার বিপরীতে অধিকতর সক্রিয় হতে চান তবে কেন কতক পিটিশনে স্বাক্ষর করে শুরু করবেন না?

প্রয়াস ২, কৃষকের আত্মহত্যার সংকটে ঠেলে দেওয়ায় মনসান্টোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে একটি পিটিশন সাইট সাক্ষরের আহ্বান জানাচ্ছে, পক্ষান্তরে অনিবার্য ঋণে ভুগছেন এমন কৃষকদের মনসান্টোকর্তৃক আর্থিক সহায়তার তাগিদে, যদি আপনিও এটি করতে চান তবে স্বাক্ষর করুন৷

অনলাইন অ্যাক্টিভিজম সংগঠন Avaaz মনসান্টোর পেটেন্ট অধিকার সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে একটি পিটিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছে, এটি সম্পর্কে এখানে আরও পড়ুন:

যদি এই বিষয়টি আপনার আগ্রহের হয়, তাহলে আপনি লিয়া বোরোমিও (Leah Borromeo)-এর একটি ডকুমেন্টারি ডার্টি হোয়াইট গোল্ড দেখতে আগ্রহী হতে পারেন যার লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন শিল্প ও আন্তর্জাতিক ভোক্তাদের স্বভাবপ্রকৃতি ভারতীয় কৃষকদের জীবন ও মৃত্যুতে কতোটা অবদান রাখে তুলার সরবরাহ চেইন তদন্তের মাধ্যমে তার উপর আলোকপাত করা৷

বিটার সীডস মিচা পেলেড পরিচালিত সিনেমা, যা একটি কিশোরী মেয়ের গল্প ধরে আগায় যার বাবা অনতিক্রম্য ঋণের বোঝা বইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলো৷ এটি মর্মস্পর্শীভাবে কৃষকদের সাথে মনসান্টোর প্রতারণাপূর্ণ আচরণ এবং তাদের পরিণতি দেখায়৷

রাহুল বিশ্বাস

রাহুল বিশ্বাস, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলোজি ডিসিপ্লিন থেকে গ্রাজুয়েশন ও পোস্ট-গ্রাজুয়েশন শেষ করে বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রকাশিত বইঃ অষ্টক-তত্ত্ব (২০১৭), ভাঙো অচলায়তন (২০২১)। লেখালেখির বিষয়: প্রবন্ধ ও গল্প।