- আলতাফ পারভেজ
আল-মাহমুদ আমার প্রিয় কবিদের একজন। তাঁর অনেক কবিতা বারবার পড়ি। নতুন করে মুগ্ধ হই। কেবল বহুল আলোচিত ‘সোনালী কাবিন’ নয়- তাঁর অনেক কবিতাই অমরত্ব পাবে বলে অনুমান করা যায়। তাঁর ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ও অনেক জনপ্রিয়। বহুল পঠিত।
‘বখতিয়ারের ঘোড়া’য় বঙ্গে ইসলামের ইতিহাসের কিছু চুম্বক ইঙ্গিত আছে। কাব্যিক ব্যবহারে তা অনন্য। কিন্তু ইতিহাস-চৈতন্যের দিক থেকে তা কোন ভুল বার্তা দেয় কি না- সে প্রশ্ন তোলা যায়। ইতিহাস-স্পর্শী কবিতা সে প্রশ্ন এড়াতে পারে না। কবিতার তাফসীরে সবাই একমত হন না। সেটা মেনেই ওইরকম প্রশ্ন তোলা হচ্ছে এখানে।১
কবিতা বহুকাল ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের অন্যতম এক উৎস। ‘হিস্ট্রিক্যাল পোয়েট্রি’ বলে কবিতার একটা সুপরিচিত ধারাই রয়েছে। যা ইতিহাস ও সমাজ গবেষণায় বহু আলোচিত উৎস। যে কারণে ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতার ওপর দাঁড়িয়ে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ইতিহাস লিখিত হয়। যেভাবে উর্দুতে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতায় ১৯৪৭-এর দেশভাগ কিংবা বাংলা ভাষায় শামসুর রাহমানের কবিতায় ১৯৭১-এর বাংলাদেশযুদ্ধকে পাই আমরা। অর্থাৎ কাব্য সুষমার বাইরেও কবিতা নিয়ে আলাপ উঠতে পারে। কবিতায় প্রকাশিত ঐতিহাসিক বিবরণে লুুকিয়ে থাকা আকার-ইঙ্গিতে বাড়তি অনুসন্ধান হতে পারে। যা আবার কবিতা-সাহিত্যের শক্তির জায়গাই প্রকাশ করে। ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’কে আমরা সেভাবেও পাঠ করতে পারি। ব্যক্তি ও কবি আল-মাহমুদকে একদম মিলিয়ে না ফেলেও সে পাঠ চলতে পারে।২
এ কবিতায় ‘ঘোড়া’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে- ধরে নেয়া যায়, বখতিয়ার খলজির বীরত্ব, সাহস এবং স্থানীয় সমাজের সমর্থনের প্রতীক ও প্রমাণ হিসেবে। কবি স্পষ্টত বখতিয়ারকে মহিমান্বিত করেন। সেই মহিমার সঙ্গে পরোক্ষে যুক্ত করতে চান বঙ্গে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ায় ঐ যোদ্ধার ‘অবদান’-এর গৌরব। বখতিয়ারের ঘোড়া’য় কবি পাঠককে ধর্মীয় আবেগে উদ্দীপ্ত করতেও আকুল- যে পাঠক স্থানীয় পর্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠই হয়তো ধর্মে মুসলমান। এমনকি পাঠকের ধর্মীয় পরিচয় বাদ দিয়েও বলা যায়- বখতিয়ায়ের ঘোড়া বাংলায় ইসলামের প্রসার সম্পর্কে ধারণা দিতে চায়। কিন্তু সেই ধারণার যথার্থতা মোটা দাগে খতিয়ে দেখা জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ, এই কবিতার সরল পাঠ নবীন পাঠকের এই বোধ তৈরি করে- ‘ঘোড়ার ক্ষুর’ আর মধ্য এশিয়ার ‘যোদ্ধাদের তরবারি’র ডগায় ইসলামের বীজ রোপিত হয়েছে এখানে। বাংলার ইসলাম যেন শুধুই একটা যুদ্ধ-প্রসঙ্গ।
এরকম বিবরণ কেবল আল-মাহমুদের ৩৩ লাইনের ১৮৬ শব্দের এই কবিতায় রয়েছে তা নয়। বাংলাদেশে ‘ইসলামের ইতিহাস’ নামে যা কিছু প্রচলিত ও প্রচারিত তাতে এটা এক প্রবল বয়ান।৩ এই ধর্মীয়-সমরবাদ গৌরবের সঙ্গেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম লিখিত-পঠিত-প্রচারিত হচ্ছে। যেমন, বাংলাদেশে কলেজ পর্যায়ে ইতিহাসের বহুল প্রচলিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে আব্দুল করিমের ‘ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসন’। খুবই প্রভাবশালী গ্রন্থ এটা। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী এরকম বই পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে ইসলামের আবির্ভাব সম্পর্কে জানছে, পাশাপাশি উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি নিচ্ছে। অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এই গ্রন্থের। এই বইয়ে ‘বিচক্ষণ সমরনায়ক’ বখতিয়ারকে ‘বাংলা জয়’ এবং ‘ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা কায়েম’-এর কৃর্তৃত্ব দেয়া আছে।৪ এরকম গ্রন্থের বাইরে সরাসরি শুধু বখতিয়ার খলজির উপরও অনেক বই লেখা হচ্ছে। যেমন সরদার আব্দুর রহমান লিখেছেন (তাঁর উল্লেখ মতে), ‘বখতিয়ার খলজির পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ’। সেখানে বখতিয়ারকে নিয়ে বলা হয়েছে, ‘পুরাতন ধর্মের নিগড় থেকে নির্যাতিত মানুষকে মুক্ত করার এবং একটা নতুন জীবন ব্যবস্থায় উত্তীর্ণ করার জন্য তিনি প্রথম বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্যোগ নেন।…বাংলাদেশের প্রথম দীক্ষিত মুসলমান দেবকোটের কোচদলপতি… আলীমেচ তাঁরই আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সদলবলে মুসলমান হয়।…বিজয়ী ধর্ম হিসেবে তাঁর (বখতিয়ারের) দ্বারাই এতদাঞ্চলে প্রথম ইসলাম প্রচার শুরু হয়।’৫
ইতিহাস হিসেবে এইসব ভাষ্য কতটা সঠিক তা বাড়তি বিবেচনা দাবি করে। এসব বিবরণের সত্যাসত্য এবং তার পক্ষে নিভর্রযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে কি না এবং বঙ্গে প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলামের আহ্বান কীভাবে প্রচারিত হয়েছে সেসব নিয়ে আমরা ধাপে ধাপে পর্যালোচনা করবো। বাংলায় বিশ্বাস হিসেবে ইসলামের প্রসার কি শুধু বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ঘটেছে- নাকি এর অর্থনৈতিক সামাজিক আধ্যাত্মিক অনেক কারণ ছিল সেসবও খতিয়ে দেখা দরকার। ইসলাম আবির্ভাবের তরবারি ও ঘোড়াতত্ত্ব বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এই ধর্ম প্রসারের যে ধারণা প্রচার করে- তার মাধ্যমে আসলে অপর কোন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সত্য আড়াল হচ্ছে কি না সেটাও আমাদের পর্যালোচনায় থাকবে।
বাংলায় ইসলামের আবির্ভাবের প্রাথমিক দিনগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে কিছু মৌলিক গবেষণা হয়েছে। আরও হবে নিশ্চয়ই। তবে এ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ গবেষণার সারকথা হচ্ছে, এখানে ইসলামের প্রসার ও বিকাশে ভৌগলিক পরিবেশ, মানুষের মনোজগত এবং প্রত্যক্ষ কিছু সমাজ-ঘটনা বিপুল ভূমিকা রেখেছে। তবে ‘বখতিয়ারে ঘোড়া’ আমাদের সামনে তার বিপরীত প্রতিচ্ছবি নিয়ে হাজির হয় এবং লোকপ্রিয়তা পায়। এটা কবিতাশিল্পের জন্য ভালো খবর। কিন্তু ইসলাম ও ইতিহাসের দিক থেকে একে যাচাই করে নেয়া জরুরি।
কারণ, এরকম বিবরণ ইসলাম সম্পর্কে ভীতিকর ধারণার দিকেও নিয়ে যায় পাঠককে। পাশাপাশি ইসলামের কাঁধে সওয়ার হয় ভারতবর্ষে মধ্য এশিয়ার যোদ্ধাদের নানান নির্মমতার কান্ডকৃর্তি। সেসব নির্মমতার কলঙ্ক বাড়ানো-কমানোর একটা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতাও আছে। তাতে করে বিভিন্ন তরফে আবার অস্পষ্ট ও অযৌক্তিক নতুন নতুন বিবরণ হাজির হয়ে চলেছে। যা তৎকালীন বঙ্গসমাজ সম্পর্কে পাঠককে ঐতিহাসিক সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে ব্যর্থ করে দেয়। এরকম এক পরিসরে দাঁড়িয়ে আমরা ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ পুনর্পাঠ করছি। তবে এও বলা দরকার, আল-মাহমুদের কবিতা ও তার ইতিহাস চেতনা এই আলোচনায় একরূপ উপলক্ষ মাত্র। এই আলোচনা কেবল বাংলার ইতিহাসে ইসলাম আবির্ভাবের তরবারিতত্ত্বকে পর্যালোচনা করতে ইচ্ছুক। তবে পাশাপাশি এ প্রশ্নও তোলা হচ্ছে, বাংলার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে বাইরে থেকে আসা আক্রমণের মাধ্যমে রাজত্ব করা শাসকদের আমরা কীভাবে দেখবো। বাংলার ইতিহাস বলতে আমরা আসলে কার বিবরণকে বুঝবো? আগ্রাসী শাসকদের ইতিহাস- নাকি স্থানীয় প্রাকৃতজনের জীবন-জীবিকা-নির্মাণ-ধ্বংস-দুঃখ-সুখের বিবরণ?
আবেগ, বর্ণ, ধর্ম ও জাতিগত পক্ষপাতের বাইরে এসে অতীত বাংলা নিয়ে যেসব নির্ভরযোগ্য গবেষণা রয়েছে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে এই আলোচনা। তবে মূল বিতর্কে প্রবেশের আগে আলোচিত কবিতাটি আমরা আরেকবার পড়ে নিতে পারি-
বখতিয়ারের ঘোড়া
মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে
মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।
জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে।
যেযন বালিশে মাথা রাখতে চায় না এ বালক,
যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে মশারি,
মাতৃস্তনের পাশে দু’চোখ কচলে উঠে দাঁড়াবে এখুনি;
বাইরে তার ঘোড়া অস্থির, বাতাসে কেশর কাঁপছে।
আর সময়ের গতির ওপর লাফিয়ে উঠেছে সে।
না, এখনও সে শিশু। মা তাকে ছেলে ভোলানো ছড়া শোনায়।
বলে, বালিশে মাথা রাখো তো বেটা। শোনো
বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।
আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি
হাতে নাংগা তলোয়ার।
মায়ের ছড়াগানে কৌতূহলী কানপাতে বালিশে
নিজের দিলের শব্দ বালিশের সিনার ভিতর।
সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়। বলে, কে মা বখতিয়ার?
আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।
মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন,
আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি। খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।
দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে
দ্যাখো, দ্যাখো।
মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক
তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার
নিশেন ওড়ায়।
কোথায় সে বালক?
আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা
মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।
বারুদই বিচারক। আর
স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।
বখতিয়ার খলজির বাংলায় আসা
বখতিয়ার খলজি বাংলায় অভিযান চালান ১২০৪-এ (হিজরি ৫৯৮-৯৯; কোন কোন ভাষ্যকারের মতে ১২০৫ খ্রি.) এবং সেটা বাংলার ক্ষুদ্র একাংশে মাত্র।৬ বিহার-নদিয়া-গৌড় ছিল তার অভিযানের পথরেখা। যা ইতিহাসের বইগুলোতে ‘লক্ষণাবতী’ নামেও পরিচিত। রাজা লক্ষণের নামে গৌড়ের ঐ নামকরণ। ইসলাম ধর্মের অনুসারী শাসকদের আমলে লক্ষণাবতীকে ‘লাখনৌতি’ নামে উল্লেখ শুরু হয়।
গৌড় অভিযানের দু’বছর পরই আসাম-তিব্বত অভিযানে খলজি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তখন নিজ পক্ষীয় আরেক সেনাপাতি কর্তৃক ছুরিকাহত হয়ে মারা যান তিনি। তাঁর জন্ম-মৃত্যু-সামরিক কৃর্তির দিন-তারিখে সামান্য হেরফের আছে পুরানো বিবরণে। সেই বিতর্ক এড়িয়ে আমরা মূল প্রসঙ্গের দিকে এগোবো।
বখতিয়ার খলজির অধিকাংশ বিবরণের উৎস কাযী মীনহাজ-ই সিরাজ জোয্জানীর ‘তবকাত-ই-নাসিরী’। বাংলায় মুসলমান শাসনের অনেক তথ্যের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। বাঙলায় মুসলমানদের অভিযান সম্পর্কে এটাকে প্রাচীন প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এও মনে রাখা দরকার, এটি বখতিয়ারের মৃত্যুর প্রায় ছয় দশক পর প্রকাশিত এবং চার দশক পরের শোনাকথার ওপর লিখিত। লেখকের জন্ম বখতিয়ারের বাংলা অভিযানের এক দশক আগে। আর, তিনি হিন্দুস্তানে এসেছেন বখতিয়ারের মৃত্যুর অন্তত দুই দশক পর- তাও বাংলা থেকে বহু দূরের সিন্ধুতে। বখতিয়ারের অভিযান সম্পর্কে তাঁর কোন সরাসরি অভিজ্ঞতা ছিল না। দিল্লীতে কাযী থাকা অবস্থায় ঐ গ্রন্থ লিখিত এবং এর ভিত্তি হলো ১২৪২-এর পর দু’বছর বাংলায় অবস্থান। ১২৬০ সালের অক্টোবরে মীনহাজ-ই-সিরাজ এটা লেখা শেষ করেন। মেজর রেভার্টি পরে সেটা অনুবাদ করেন। যা প্রকাশিত হয় ১৮৮১ সালে।
মীনহাজ-ই-সিরাজ নিজে দিল্লীর মুসলমান শাসকদের ঘনিষ্ট ছিলেন। তাদের সঙ্গে অনেক সামরিক অভিযানেও অংশ নেন।৭ গ্রন্থটি লেখা হয়েছে দিল্লীর ১২৪৬-এর শাসক সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ’র জন্য পুরস্কার হিসেবে। ‘তবকত’ মানে কাহিনী। ‘তবকাত’ হলো তার বহুবচন। ‘তবকাত-ই-নাসিরী’ মানে ‘সুলতান নাসিরের কাহিনী’। বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে এখানে তিনটি তবকতে (২০, ২১, ২২) উল্লেখ আছে।
এ গ্রন্থ স্বাভাবিকভাবেই শাসকদের বিষয়ে প্রশংসামূলক ছিল। কারণ সরাসরি তাদের ছত্রছায়ায়, তাদের গুণগান হিসেবে এটা লিখিত। এরকম একমাত্র উৎসকে ব্যবহার করে বখতিয়ার খলজির যেসব বীরত্বের বিবরণ প্রচারিত হয় তা সঙ্গতকারণেই প্রশ্নসাপেক্ষ। বীরত্বের পাশাপাশি মীনহাজও বখতিয়ারকে ‘অধিকৃত অঞ্চলসমূহে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও উপাসনালয় নির্মাণ’ করার কৃতিত্ব দিয়েছেন। আজ পর্যন্ত বখতিয়ারের আমলের সেরকম কোন স্থাপত্য কোথাও না পাওয়ার পরও এসব বিবরণ সদম্ভে জারি আছে। এসব নিয়ে বাড়তি অনুসন্ধান বেশি হয়নি। বরং পরবর্তী ‘ইতিহাসবিদ’রা সিরাজের বিবরণকেই নানানভাবে পুনর্লিখন করে চলেছেন। আবার তবকাত-ই-নাসিরী থেকে বখতিয়ারের বিষয়ে যত তথ্য-উপাত্ত নেয়া হয় তার ‘প্রতিপক্ষ’ লক্ষণ সেন সম্পর্কে তেমনটি করা হয় না। বাংলায় তখনকার জনসাধারণ সম্পর্কেও সেখানে বিস্তারিত কিছু পাওয়া যায় না।
তবকাত-ই-নাসিরী বা অনুরূপ কোন উৎস আমাদের এমন কোন তথ্য দেয় না যা থেকে বখতিয়ারের জীবনের প্রথমাংশে এমন সাক্ষ্য মেলে যে, ধর্মপ্রচার তার কোন লক্ষ্য ছিল। আধ্যাত্মিকতার দিকে এই যোদ্ধার আগ্রহ ছিল বলে বিস্তারিত প্রমাণ মেলে না। বরং প্রাথমিক সমর অভিযানগুলোতে সম্পদ-সংগ্রহ এবং সৈন্যদল বাড়াতেই তাঁকে আগ্রহী দেখা যায়। প্রাথমিকভাবে জায়গীর পাওয়া (বর্তমানের উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর জেলার) ভিউলী (Bhuili) ও ভগওয়াত (Bhagwat) থেকে তিনি আশে-পাশের হিন্দু শাসকদের রাজ্যগুলোতে মাঝে মাঝে প্রায় বছরাধিক কালজুড়ে যেসব অভিযান চালিয়েছেন সেসব মূলত সম্পদ সংগ্রহের লক্ষ্যে। বিহারের (মগধ) ওদন্তপুরী বিহার আক্রমণের পর বখতিয়ার খলজি সেখানকার ধনসম্পদ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। ধর্মের প্রসার যার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হবে- তিনি কোথাও অভিযান শেষে ধনসম্পদ সংগ্রহ শেষে সেখান থেকে চলে যাবেন- এমনটি হওয়ার কথা নয়। তবকাত-ই-নাসিরীতে লেখা রয়েছে: ‘বিজয় লাভের পর (ওদন্তপুরী বিহার দখলের পর) লুন্ঠিত দ্রব্য নিয়ে মোহাম্মদ বখতিয়ার প্রত্যাবর্তন করেন ও সুলতান কুতুব-উদ-দীন এর নিকট উপস্থিত হন। তিনি সেখানে প্রভূত সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেন।’৮ ওদন্তপুরী থেকে সংগৃহীত সম্পদ যে তখনকার দিল্লীর ‘সুলতান’ কুতুব-উদ-দীন আইবককে উপহার দেয়া হয় সে বিষয়ে গবেষক মোহাম্মদ মোহার আলীও উল্লেখ করেন- যদিও তিনি এটা মানেননি যে, ঐ অভিযানে বখতিয়ার কাউকে খুন করেন।৯
আল বেরুণীর কিতাবুল হিন্দ সাক্ষ্য দেয় ঐ সময়ের ভারতীয় হিন্দুরাজ্যগুলোতে মন্দিরে প্রচুর ধন-সম্পদ গচ্ছিত থাকতো। যা ঐসব রাজ্যে বহিরাক্রমণের বড় কারণ ছিল। বখতিয়ার খলজির সৈন্যদলও গড়ে উঠেছিল ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধাদের দ্বারা। ধর্ম প্রচারক বা আধ্যাত্মিকতার তাড়নাদীপ্ত ব্যক্তিদের দ্বারা নয়। এরা কেউ শাহ সুলতান রুমি, আমানত শাহ, মিসকিন শাহ বা বায়েজিদ বোস্তামির মতো ছিলেন না। এরা জিহাদে লিপ্ত হয়েছিলেন বলেও প্রমাণ নেই। আমাদের প্রিয় কবি আল-মাহমুদ তাঁর কবিতায় জিহাদ ও বখতিয়ার খলজি প্রায় সমার্থক করেছেন এবং এই তুর্কি এই যোদ্ধাকে ‘আল্লার সেপাই’ বলেছেন। ফলে ইসলামের একরূপ কট্টর ও সমরবাদি যে ইমেজ দাঁড়ায় তা বঙ্গে ইসলামের আবির্ভাবের সময়ের সঙ্গে মেলে কিনা সেটা একটু পর আমরা মিলিয়ে দেখবো। আমরা এও দেখবো যে, ‘জিহাদ’ অর্থ যদি হয় ‘ধর্মযুদ্ধ’ হয়- তাহলে তখনকার বাংলার সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির১০ মাঝে সেটার প্রয়োজন বা অবকাশ ঘটেনি। শাসকদের সঙ্গে শাসকদের ক্ষমতা দখলের লড়াই এবং জিহাদ মোটেই সমার্থক নয়। ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক- কোন বিবেচনা থেকেই নয়। বিশেষ করে যেখানে উভয় শাসকই বহিরাগত।
‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতাটির অনন্য কাব্যিক সৌন্দর্য রয়েছে। কিন্তু তাতে এমন এক ব্যক্তিকে বাংলায় ইসলাম প্রচারের গৌরবের ভাগ দেয়া হচ্ছে বা প্রধান এক ইসলাম-পসন্দ ব্যক্তির তকমা দেয়া হয়েছে- যা বাস্তবতার সঙ্গে সামান্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কোরআনে জিহাদ সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরই জন্য- যারা নির্যাতিত হওয়ার পর হিজরত করে, পরে জিহাদ করে ও ধৈর্য ধারণ করে’ (১৬ সুরা নাহল: ১১০)। অর্থাৎ জিহাদ বা অমানবিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম হলো নির্যাতনের একরূপ প্রতিউত্তর। কিন্তু বখতিয়ার খলজি কোথাও নির্যাতিত নন। বরং পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি দিল্লীসহ বিভিন্ন স্থানের মুসলমান শাসকদের দ্বারাই কয়েকবার প্রত্যাখাত। তিনি মগধ বা নদীয়া বা গৌড়ে কোন পূর্ব-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে আসেননি। তাঁর সর্বশেষ তিব্বত অভিযানকেও জিহাদ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। এগুলো সা¤্রাজ্য বিস্তার, সম্পদ সংগ্রহ এবং রাজত্ব কায়েম ছাড়া আর কিছু ছিল না।
বাস্তবে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দ্বারা ইতোমধ্যে এ সত্য সমর্থিত হয়- বখতিয়ার খলজির বহু আগেই বঙ্গে ইসলামের প্রচার ঘটে গিয়েছিল। তবে এর প্রসার তখনো বাকি ছিল। তুর্কি যোদ্ধাদের যদি এখানে ধর্মপ্রচারের কৃর্তৃত্ব দিতে হয় তাহলে বখতিয়ারের আগে প্রায় ৫০০ বছর জুড়ে উপমহাদেশে আগত ইসলাম প্রচারকারীদের সেটা কেন দেয়া হবে না- এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তারাই বরং ধর্ম-প্রচারে প্রাথমিক প্রতিকূলতা অতিক্রমের কৃতিত্বের অধিকারী।
অন্যদিকে, যদি রাজা-বাদশাদের দ্বারা বা তাদের তরবারি শক্তিতে ধর্মান্তকরণ গতি পেতো তাহলে উপমহাদেশে মুসলমানদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি থাকতো দিল্লীতে। কয়েক শতাব্দি ওখানে মুসলমান শাসকদের কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও তেমনটি ঘটেনি। বরং দিল্লীর নগর পরিমন্ডলে মুসলমান জনসংখ্যার বড় অংশ ছিল বাইরে থেকে আগতরা বা তাদের বংশধররা। বাংলাতেও মুসলমান শাসকদের অবস্থানের মূল জায়গাগুলোতে নয়- ইসলামের বেশি বিকাশ ঘটেছে প্রান্তিক অঞ্চলে।
১৮৭১ সালে ভারতে প্রথম জনশুমারি হয় বলে আমরা জানি। তবে তার আগেও কিছু কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে শুমারি হয়েছে।১১ সেই সূত্রে পাওয়া নদীয়ার ১৮০১-এর জনসংখ্যার হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সেখানে তখনও মুসলমানদের হিস্যা ৩৭ দশমিক ৫ ভাগ। দারিদ্র্যের কারণে মুসলমানদের জন্মহার বেশি হওয়া সত্ত্বেও ১৮০১ সালেও নদীয়ায় মুসলমানরা ছিল অমুসলমানদের (৫৪ শতাংশ) চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ কম। অথচ এই নদীয়া ‘জয় করে’ই বখতিয়ার বাংলায় ইসলাম প্রসারের খ্যাতি উপভোগ করে যাচ্ছেন। এবং তার পরও বহুকাল সেখানে মুসলমানদের ‘শাসন’ ছিল। পরিসংখ্যান এখানে ‘তরবারির শক্তি’ ও ব্যবহার সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা দেয় না। বরং ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে আমরা যা পাই, দিল্লীতে মুসলমান শাসকদের প্রতিষ্ঠার বহু আগে বাংলায় আরবদের আগমন ঘটে গিয়েছিল। বখতিয়ারের আগমনের কয়েক শ’ বছর আগের মসজিদের প্রমাণ রয়েছে বাংলায়। ৮০০ খ্রিস্টাব্দের আগের আরবি মুদ্রা পাওয়ার নজির আছে রাজশাহীর পাহাড়পুর১২ ও কুমিল্লার ময়নামতিতে। বখতিয়ারের আগমনের আগে বা সমকালে মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে এসেছেন বাবা শহীদ আদম, নেত্রকোনার মদনপুরে এসেছেন শাহ সুলতান রুমি, বগুড়ার মহাস্থানে এসেছেন সুলতান মাহিসওয়ার (‘মাছের পীঠে আরোহনকারী’ বলে কথিত), সিরাজগঞ্জে এসেছেন ইয়েমেনের মখদুহ শাহ দৌলাপ্রমুখ। এরকম তালিকা আসলে আরও অনেক দীর্ঘ। মুন্সিগঞ্জের রামপালের মতো একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেন আমলে বাবা আদমের উপস্থিতির কাহিনী নিশ্চিতভাবে আমাদের বঙ্গে ইসলাম প্রচার সম্পর্কে সুস্পষ্ট বার্তা দেয়।
এটা হতে পারে, বখতিয়ার অভিযানের পর বাংলার কিছু অংশে ইসলামের অবকাঠামোগত বিকাশ গতি পেয়েছিল। পুরানো সমাজের গর্ভে নতুনের জন্মের যে তাড়না ছিল- পুরানো শাসকের অপসারণে তা-ই স্বচ্ছন্দ হয়েছে। এটা নতুন চলমানতার সঞ্চার করতে বাধ্য। পাশাপাশি এও সত্য, বাংলায় বাইরে থেকে অভিযানে আসা মুসলমান ধর্মাবলম্বী প্রথম সেনানায়ক বখতিয়ার। কিন্তু যে ধর্মাবলম্বীই হোন- তিনি কিন্তু যোদ্ধা এবং পররাজ্য আক্রমণকারীই। লস্কর-ই-তুরকান (তুর্কীদের সেনাবাহিনী) আর লস্কর-ই-ইসলাম (ইসলামের সেনাবাহিনী) এক বিষয় হতে পারে না।১৩ উপরন্তু রক্ত ও ভাষাগত দিক থেকে স্থানীয় জনপদের সঙ্গে কোনরূপ সম্পর্ক ছিল না এই যোদ্ধাদের। বখতিয়ারের মুসলমানিত্বকে ইসলামের প্রচার-প্রসারের সঙ্গে একাকার করে ভাবা কিংবা একজন মুসলমানের ‘শাসন’কে ‘ইসলাম কায়েম’ হিসেবে দেখার আগে বাংলাভাষীদের কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি:
ক] বখতিয়ারের আগমনের বহু আগেই ইয়েমেন, মক্কা, বাগদাদ ইত্যাদি স্থান থেকে দরবেশ ও আউলিয়ারা এখানে এসেছেন;
খ] বখতিয়ার নিজে বাংলার সামান্য অংশেই অভিযান পরিচালনা করেন; সুতরাং পুরো বাংলায় ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাঁর ভূমিকা রাখার সুযোগ খুবই সীমিত; এটা কেবল ভৌগলিক কারণেই নয়। সময়গত কারণেও। বাংলা অভিযানের দু’বছর পরই তিনি মারা যান। ফলে এত অল্প সময়ে ব্যাপক কোন ধর্মীয় জাগরণের অবকাশ প্রশ্নসাপেক্ষ। পরের আলোচনায় বিভিন্ন গবেষকের বিবরণ থেকে আমরা দেখবো, বাংলায় কখনোই মুসলমানদের সংখ্যা হঠাৎ একসঙ্গে বাড়েনি। বরং বহু বছর ধরে দরবেশদের ধীরলয়ের ভূমিকায় এখানে ধর্মীয় বিশ্বাসের রূপান্তর ঘটেছে।
গ] প্রাথমিক জীবনের বিবরণ থেকে বখতিয়ারের মাঝে ধর্ম প্রচারকের কোন বৈশিষ্ট্য বা লক্ষ্য পাওয়া যায় না; তিনি যদি সেই কাজই করতেন তাহলে বাংলায় আসার আগে তাঁর জায়গীর পাওয়া বিউলি ও ভাগওয়াতে তার স্পষ্ট নজির থাকতো।
ঘ] বখতিয়ারের বীরত্ব সম্পর্কে ব্যাপক অতিকথন দেখা যায়; অথচ তাঁর যোদ্ধা জীবনের বড় অভিযানে (১২০৫ পরবর্তী কামরূপ-আসাম-তিব্বত অভিমুখীন) তাঁর বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিতই হয়েছিল। এমনকি বিহার অভিযান শেষেও মিথিলা (উত্তর বিহার) তাঁর দখলে আসেনি।১৪ কামরূপে এমন এক রাজার কাছে তিনি পরাজিত হন- যুদ্ধবিদ্যায় যাঁর বিশেষ কোন খ্যাতি ছিল না। এই যুদ্ধে কামরূপে বন্দি হয়ে থাকা বখতিয়ারের যোদ্ধাদের বংশধররাই আসামের ইতিহাসে ‘গোরিয়া মুসলমান’ হিসেবে কথিত। মীনহাজ-ই-সিরাজের বিবরণ থেকেই জানা যায় তিব্বত অভিযানে যেসব সৈন্যরা নিহত হয়েছিল তাদের বিধাব স্ত্রী ও এতিম শিশুরা বখতিয়ারকে পেলেই অভিশম্পাত বর্ষণ করতো। মীনহাজ-ই-সিরাজের সেই বিবরণ এরকম:
বখতিয়ার দেওকোটে পৌঁছে অত্যধিক মানসিক যন্ত্রণায় রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। যেসমস্ত খলজি মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার লজ্জায় তিনি অশ্বারোহন করতেন না। যখনই তিনি অশ্বারোহণ করে বের হতেন গৃহচূড়া ও রাস্তা থেকে সমুদয় লোক অভিযোগ করতেন এবং অভিশাপ দিতেন। গালিগালাজ করতেন।১৫
এই হলো বাস্তবে বীর বখতিয়ারের অবস্থা। মীনহাজের বিবরণ থেকে এও লক্ষ্যণীয় যে, এসব অভিযান ছিল ‘খলজি’ উপজাতিদের একটা ব্যাপার। তিব্বত অভিযানের এই পরিণতির আগে নদীয়া দখলেও কোন যুদ্ধ হয়নি লক্ষণ সেনের পালিয়ে যাওয়ার বিবরণ সঠিক হলে। লক্ষণাবতী বা গৌড়েও বখতিয়ার যুদ্ধ করার মতো কোন প্রতিপক্ষ পেয়েছেন বলে জানা যায় না। অথচ বাংলার ইতিহাসগ্রন্থসমূহ তাঁর বীরত্বে ভারাক্রান্ত।
ঙ] বাংলার যে অংশ বখতিয়ারের দখলকৃত ছিল সেখানে তাঁর পরের শাসক শিরান খলজিও দ্রুতই উৎখাত হয়েছিলেন। মাত্র আট মাস তিনি রাজত্ব করেন। ১২০৮-এ তিনিও পলাতক অবস্থায় মারা যান। এই দুই খলজি যদি স্থানীয় সমাজে জনপ্রিয় হতেন তাহলে শিরানের এত দ্রুত অপসারণ নিশ্চয়ই সম্ভব হতো না।
চ] খলজিরা বাংলার নদীয়া বা গৌড়কেন্দ্রীক যে অংশ দখল করেছিলেন তার বাইরে- বিশেষ করে পূর্ববাংলায় সেন বংশের শাসন আরও দীর্ঘকাল অব্যাহত ছিল। লক্ষণ সেন বঙ্গে সেনবংশের ‘শেষ রাজা’ নন মোটেই- আমাদের ইতিহাস বইগুলোতে যেভাবে লেখা হয়। তাঁর দুই পুত্র (বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন) বহু বছর বাংলার বড় এক অংশ শাসন করেছে। বিভিন্ন তাম্রশাসনে ইতোমধ্যে প্রমাণিত, লক্ষণ সেনের এই দুই পুত্র ১২২৩ পর্যন্ত বিক্রমপুরে শাসক ছিল। অর্থাৎ বখতিয়ারের আক্রমণে ‘বাংলায় মুসলমান শাসন কায়েমে’র দাবি ঐতিহাসিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বখতিয়ারের নদীয়া ও গৌড় (বর্তমানের মালদাহ) বিজয়কে ‘বাংলা বিজয়’ হিসেবে ইতিহাস বইগুলো যেভাবে উল্লেখ করে তা খুবই বিভ্রান্তিকর।১৬ এমনকি এরপরের সুলতানি শাসন শুরু হতেও অনেক দশক লেগেছে। আবার সুলতানি শাসনের মাঝেও বাংলায় কংশনারায়ন নামে অ-মুসলমান স্বাধীন রাজা ক্ষমতায় এসেছেন (১৪১৭ খ্রি.)। ইতিহাসকে নির্মোহভাবে পাঠ করতে হলে এসব তথ্য অবজ্ঞার নয়।
ছ] বাংলায় ইসলামের বিকাশকে প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই খলজিদের মতো যোদ্ধাদলের কর্মকান্ডের সঙ্গে মিলিয়ে পর্যবেক্ষণের আরেকটা বিপদের দিক হলো- এতে ধরে নেয়া, এই ধর্ম তার আধ্যাত্মিক ও সামাজিক সামর্থের ওপর দাঁড়িয়ে তলোয়ার বা রাষ্ট্রীয় মদদ ছাড়া প্রচারিত ও বিকশিত হতে সক্ষম নয়। এটা এক অর্থে ইসলামকে ‘রিলিজিয়ন অব সোর্ড’ বলে যেভাবে খন্ডিত প্রচার রয়েছে তাকে মেনে নেয়া। বাংলায় ইসলামের ইতিহাস নিয়ে খ্যাতনামা গবেষকদের ভাষ্যগুলোর সঙ্গে এরকম পর্যবেক্ষণ একদম মেলে না। এমনকি জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তকরণ মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন সম্মতও নয় (২:২৫৬)।
জ] মিনহাজ-ই-সিরাজ যদিও বলেছেন নদীয়া ও গৌড়ে অভিযান শেষে ‘বখতিয়ার খলজি অনেক মসজিদ, খানকা ইত্যাদি নির্মাণ করেছেন’ কিন্তু তার ন্যূনতম কোন অবশেষ চিহ্নের কথা প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে পাওয়া যায় না। গৌড় ও পা-ুয়ায় ১২৩১-এর আগের কোন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ বা শিলালিপির কথা এখনও জানা যায় না- যা থেকে এ স্থানকে সে কালের কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র বলে মনে হতে পারে। গৌড়ে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন শিলালিপিটি ১২৩১ খ্রিস্টাব্দের। যা একটা কূপ খননের ফলক।১৭ তাছাড়া যদি মীনহাজ-ই-সিরাজের এই বিবরণকে সত্য মানতে হয় তাহলে এও মানতে হয়, ‘অনেক মসজিদ’ স্থাপনের মতো বড় সংখ্যায় মুসলমান জনগোষ্ঠী বখতিয়ারের আগে থেকে নদীয়া ও সন্নিহিত অঞ্চলে আগে থেকেই ছিল।
ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে বখতিয়ার খলজি সম্পর্কে প্রচার ও অপপ্রচার
বখতিয়ার খলজি সম্পর্কে উপরোক্ত বিবরণ পাঠের সময় এটা মনে রাখা জরুরি, বঙ্গের ইসলাম প্রসারের মতো তিনিও নানানভাবে ভুল প্রচারণার শিকার। বিশেষ করে মগধের অনেক ধ্বংসলীলার সঙ্গে তাঁকে যুক্ত করা হয় পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই। ফলে ইতিহাসের ওই সময়টা পাঠ করতে যেয়ে আমরা আসলে দুটি সমস্যায় পড়ছি। একদিকে ইসলাম বিস্তৃতির আলোচনা চলে যায় তরবারিবাদের বিবরণের দিকে। আবার বখতিয়ারকে অযথা কালিমালিপ্ত করতে যেয়ে সত্য-মিথ্যার মিশেলে অনেক ধ্বংসলীলার কাহিনী হাজির করা হয় তাঁর নামে। এই দুই বিপরীতমুখী প্রবণতা সামলিয়ে বিহার ও বাংলার ইতিহাসে বখতিয়ারের ভূমিকার একটা নির্মোহ ভাষ্য দাঁড় করানো জরুরি। তবে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমাদের জন্য এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের প্রশ্নে তৎকালীন সমাজের একটা সম্ভাব্য সঠিক ছবি খুঁজে পাওয়া। কাজটি সহজ নয়। কারণ ইতোমধ্যে আমরা এমন এক জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরে আছি যেখানে একদিকে তরবারিতত্ত্ব১৮ কেবল কবিতায় নয়- গদ্যেও বিপুলভাবে স্তুপ হয়ে আছে, আবার বখতিয়ারঘৃণারও আধিক্য সীমাহীন। যারা বখতিয়ারকে বিশিষ্ট জিহাদি হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন তাদের বিবরণে যেমন সত্য, অর্ধসত্য এবং অসত্যের ব্যাপক মিশ্রণ ঘটেছে- তেমনি আরেক দল তাঁকে শুধু নিষ্ঠুর দস্যু হিসেবে দেখাতে যেয়েও তখনকার সামগ্রিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণে অবহেলা করেছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস চর্চায় বখতিয়ারকে আফগানিস্তান থেকে আগত দেখানো হলেও খলজি ট্রাইব মূলত তার্কি অঞ্চলের। তবকাত-ই-নাসিরীর ইংরেজি অনুবাদক রেভার্টির স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে এ বিষয়ে। তুরস্ক থেকেই এদের একাংশ আফগানিস্তানে আসে। তারপর বিভিন্ন আক্রমণকারী সৈন্যদলের হয়ে ভারতে এদের আগমন। আফগানিস্তানে এরা মূলত যাযাবর পশুচারণা পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এরা আফগানিস্তানে আসে। আফগানিস্তানে এরা গিলজি বা গিলজাই নামেও উচ্চারিত ছিল। ঐ ‘গিলজাই’ ভারতবর্ষে এসে ‘খলজি’ রূপে উচ্চারিত।১৯ প্রাথমিকভাবে অন্য শাসকদের সৈনিক হিসেবে এবং সমর কৌশলে দক্ষ হওয়ায় পরে নিজেরাই ‘শাসক’ হয়ে ওঠার আকাঙ্খার বাইরে তাদের চরিত্রে ‘জিহাদি’ গৌরব আরোহ ইতিহাসসম্মত নয়।
বখতিয়ারের মতোই তথ্য-বিকৃতি দেখা যায় বাংলায় তিনি যাকে ‘পরাজিত’ করেন বলে প্রচারিত হয় সেই লক্ষণ সেন সম্পর্কেও। বলা হয় লক্ষণ সেন ‘হিন্দু রাজা’ ছিলেন। কার্যত তিনি বৈঞ্চব ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তথ্য হিসেবে এটা হয়তো সামান্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তবকাত-ই-নাসিরী কিন্তু এও জানাচ্ছে, লক্ষণ সেন রাজা হিসেবে ‘দানশীল’ ও ‘ঔদার্য’-এর প্রতীক ছিলেন। আল-মাহমুদ লক্ষণকে ‘জালিম’ হিসেবে উল্লেখ করলেও মিনহাজ-ই সিরাজ তাঁকে ‘মহান ব্যক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি। লক্ষণ সেন সম্পর্কে তিনি এরকম লিখেছেন:
কোন কোন বিশ্বস্ত লোকের বর্ণনায় এমন পাওয়া যায় যেনো, ছোট বা বড় কোন অত্যাচার তিনি কোনদিন করেননি। এ কালের হাতেম দয়াশীল সুলতান কুতুব-উদ্দ-দীন (তাবসারাহ)-র মতো তিনি দাতা ছিলেন এবং কোন তাঁর নিকট প্রার্থনা করলে তিনি তাঁকে এক লক্ষ মুদ্রা দান করতেন। এ বর্ণনা আছে যে, ঐ দেশে চিতল বা জিতল এর পরিবর্তে কড়ির প্রচলন ছিল। কমপক্ষে এক লক্ষ কড়ি তিনি দান করতেন।২০
বখতিয়ারের জন্য আমরা যদি মিনহাজ-ই সিরাজকে সত্য মানি- তাহলে লক্ষণ সেন সম্পর্কে না-মানা স্ববিরোধিতা। তবে এ প্রশ্নও ওঠে, এত ভালো রাজা হলে লক্ষণ সেন নদীয়ায় হেরে গেলেন কেন? এর কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমত. বখতিয়ারের নদীয়া আগমনকালে লক্ষণ সেন ছিলেন অতিবৃদ্ধ। তাঁর পক্ষে এসময় বিশাল সাম্রাজ্য ঐক্য ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে বখতিয়ার আসার আগেই অন্তত তিনজন স্থানীয় শাসক লক্ষণ সেনের কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকার করছিলেন। অর্থাৎ লক্ষণ সেনের সাম্রাজ্য বখতিয়ার আসার কালে পর্যুদস্ত হওয়ার অপেক্ষাতেই ছিল।২১
দ্বিতীয়ত, নদীয়া (নওদীহ বা নবদ্বীপ) সেনদের ক্ষমতার ভরকেন্দ্রও ছিল না। যদিও মীনহাজ-ই-সিরাজ একে ‘রাজধানী’ বলেছেন- কিন্তু ‘সমগ্র নবদ্বীপে এমন কোন প্রত্নকীর্তির চিহ্ন নেই যাতে করে ধারণা করা যেতে পারে যে লক্ষণ সেনের মতো প্রবল প্রতাপশালী নৃপতির শাসনকেন্দ্র বা কয়েক বছরের অবস্থান সেখানে ছিল।’২২ গঙ্গাতীরে অবস্থিত নবদ্বীপ বা নদীয়া ছিল তখন হিন্দুদের একটা ‘পুন্যস্থান’।২৩ গঙ্গার মূলস্রোতে তখন ভাগীরথী দিয়ে প্রবাহিত হতো। ‘বৃদ্ধ রাজা সেখানে ধর্মকর্মে নিয়োজিত ছিলেন।’২৪ শাসক হিসেবে সেনদের ক্ষমতার বড় ভরকেন্দ্র ছিল বিক্রমপুর বা সোনারগাঁও। সেটা বখতিয়ার খলজির নদীয়া অভিযানের পরও যে অব্যাহত ছিল সেটা আগেই বলা হয়েছে। বঙ্গ ছাড়াও লক্ষণ সেনের রাজ্য মিথিলা (উত্তর বিহার), রাঢ়, বরেন্দ্রেসহ আরও বহু স্থানে বিস্তৃত ছিল।২৫
বখতিয়ার ও লক্ষণ সেন সম্পর্কে উপরোক্ত চিত্র আমাদের এটাই জানায়- ঘোড়া ও তরবারিতত্ত্ব একদিকে যেমন এই উভয় ঐতিহাসিক চরিত্র সম্পর্কে আবেগনির্ভর অনেক বাড়তি তথ্য ছড়িয়েছে, তেমনি অনেক বাস্তব তথ্য আড়াল করেছে।
এরকম আবেগনির্ভর একপেশে ইতিহাসচর্চার সূত্রেই এটাও ছড়ানো হয়, বখতিয়ার খলজি বিহার অভিযানকালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেন। বাস্তবে নালন্দা ধ্বংস হয় ১১৯৩ সালে, আর বখতিয়ারের বিহার অভিযান ছিল আরও দু বছর পর। বখতিয়ার খলজি ভারতবর্ষেই ঢোকেন ১১৯৫-এ। তবে নালন্দা ধ্বংসে যুক্ত না থাকলেও তিনি বিহার বা মগদের উদন্ডপুরে একটা শিক্ষালয় (বিহার) ১১৯৯-এ ধ্বংস করেছিলেন। যারা নালন্দা ধ্বংসে বখতিয়ারকে নির্দোষ দেখান (এবং সেটাই সঠিক) তারা অজ্ঞাত কারণে উদন্তপুরীর ঘটনা নিয়ে নিশ্চুপ থাকেন বা একে শুধুই একটা ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
উদন্তপুরী স্থানটি নালন্দা থেকে দূরে অবস্থিত ভিন্ন জায়গা। ওখানকার অভিযানগুলো থেকে পাওয়া ধন-সম্পদ দিতেই বখতিয়ার খলজি ১২০৩-এ কুতবদ্দীন আইবেকের কাছে গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে ধন-সম্পদ সংগ্রহ ও তা উর্ধ্বতন শাসকদের নজরাণা হিসেবে দেয়ার সঙ্গে ধর্মপ্রচার বা জিহাদের যে সামান্যই সম্পর্ক সেটা বলাই বাহুল্য।২৬ বখতিয়ারের মতোই কুতব-উদ্-দীন আইবেকও ছিলেন তুর্কি। উপমহাদেশে তুর্কিদের এরূপ সমরবাদিতাকে ‘ইসলামের জয়-পরাজয়-বিজয়’ হিসেবে দেখার যে রেওয়াজ আমরা ইতিহাসসূত্রে পাই সেটা প্রকৃতপক্ষে উপমহাদেশের ইসলামের ইতিহাসের বড় এক ভ্রান্তিপূর্ণ অধ্যায়। তুরস্ক বা আফগানিস্তানের যোদ্ধাদের বাংলার অভিযান ও দখলকে আমরা যদি ‘ইসলামের প্রতিষ্ঠা’ বা ‘মুসলমানদের শাসনের শুরু’ হিসেবে দেখি তা হলে এর ৫৫৫ বছর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা বাংলায় সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় ও বিতাড়নকে দেখতে হয় ‘বাংলায় খ্রীস্টানদের শাসন’-এর প্রতিষ্ঠা হিসেবে! সাড়ে পাঁচ দশকের ব্যবধানে ‘ক্ষমতা দখল-বেদখলের’ এই উভয় অধ্যায় অনেক সমরূপতা নির্দেশ করে২৭-কিন্তু তাকে ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা দুরূহ।
বাংলায় ইসলামের প্রচার-প্রসার: কিছু সাধারণ বিবেচনা
নির্মোহভাবে ও সম্প্রদায়গত পক্ষপাতের বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলায় ইসলামের প্রসার সম্পর্কে অনুসন্ধানের চেষ্টা খুবই অল্প। কারণ হিসেবে তথ্য, উপাত্ত এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের অপ্রতুলতার কথা বলা হয়। সেটা অসত্য নয়। ফলে ধর্ম প্রসারের ইতিহাসের জায়গা দখল করে রেখেছে রাজা-বাদশাদের শাসনের কাহিনী। এখানে ইসলামের বিস্তৃতিতে বিশেষ ধরনের এক সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবেশের সহিঞ্চুতা, ভাতৃত্ববোধ ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য আকুলতা যে বড় ভূমিকা রেখেছে সেটা বাংলার ভেতরকার স্বল্প কয়েকজন অনুসন্ধনকারী কেবল গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন এ পর্যন্ত। ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানের মনীষীরা এবং বিদেশের অনেক গবেষক বরং অধিক হারে সেরকম পরিশ্রমসাধ্য কাজগুলো করেছেন এবং করছেন। এরকমই এক লেখায়২৮ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মন্তব্য ছিল-ইসলামের একেশ্বরবাদের মাঝে একটি শক্তিশালী সমাজ গঠনের সদূরপ্রসারী সম্ভাবনা দেখেছিল স্থানীয় সমাজ। ভবিষ্যত সমৃদ্ধির স্বার্থে তাঁদের দরকার ছিল আধ্যাত্মিক ঐক্য। ইসলাম এখানে পুরানো সমাজের সেই অসমাপ্ত কাজের সমাধা করেছে। নতুন ‘বিশ্বাস’কে স্থানীয়রা দেখেছিল নতুন সমাজ বিপ্লবের বীজ হিসেবে। এর পরিবর্তে ইসলামকে কেবল যুদ্ধ-বিগ্রহের ফল হিসেবে দেখলে বাংলার সমাজ-ঐতিহ্যের প্রতি প্রবল অবিচার করা হয়। ইসলাম আবির্ভাবের রাজনৈতিক তাৎপর্য তাতে বাদ পড়ে। ঘোড়া ও তরবারিবাদ ইসলামের স্থানীয় ধরনের তাৎপর্যের সামান্যই বুঝতে সক্ষম।
এ লেখায় ইতোপূর্বে বাংলায় ইসলাম প্রচারের কয়েকজন আরব বুজর্গের নাম করেছি আমরা। উপমহাদেশে ইসলামের প্রচারের প্রাথমিক উদ্যোগগুলো যে এক পর্যায়ে এরকম আরবদের থেকে যুদ্ধ ও লুন্ঠনপ্রিয় কোন কোন তুর্কি ও আফগান আগ্রাসীর হাতে মলিন হয়েছে সেটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। এটাও সত্য, আরবদের তরফ থেকেও ইসলামের ইতিহাসে যুদ্ধের প্রবল ইতিহাস আছে। আশেপাশের অঞ্চলে আরবদের সেই যুদ্ধগুলো ছিল আসলে জরাগ্রস্ত নানান রাষ্ট্র কাঠামো ধ্বংস করে বহুকালের গোত্রযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে সেখানে বাণিজ্য বিকাশের উপযোগী নতুন শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ার প্রকল্প। সেই ইসলামের মাঝে আছে আব্বাসীয় খলিফাদের হাতে বাগদাদে থেকে, ফাতেমীয়দের সময় উত্তর আফ্রিকা জুড়ে এবং উমাইয়াদের মাধ্যমে স্পেনে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বিস্ময়কর সব আয়োজনের কথা।
অন্যদিকে উপমহাদেশে তুর্কি-আফগানদের অভিযানগুলো ছিল স্পষ্টত সাম্রাজ্য দখল ও নিজস্ব ক্ষমতা কায়েম। এটা নেহায়েতই ভিন্ন চরিত্রের অভিযান। যদিও এতে ধর্মীয় আবরণ দিয়েছেন কিছু লেখক-গবেষক। বাংলায় ইসলামের বিস্তৃতির প্রধান কারণ সেটা নয়। প্রধান পদ্ধতিও সেটা ছিল না। ভীতিপ্রদর্শনের মাধ্যমে ধর্মান্তকরণের ধারণা অবশ্যই গৌরবেরও নয়। লুটপাট ও ধর্মপ্রচার ইসলামের প্রাথমিক নির্দেশনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। ‘ফৌজে এলাহি’দের (খোদার সৈনিক) জন্য খলিফা আবু বকরের নসিহত ছিল: ‘ফলের গাছও নষ্ট করা যাবে না- খাদ্যশস্য এমনকি পশুও নয়।’ আশ্রমবাসীদের প্রতিও কদাচ কঠোর হবে।’২৯
অথচ বখতিয়ার খলজি কী করলেন? তবকাত-ই-নাসিরী থেকে বিহারের ওদন্তপুরী অভিযানের ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হলো সংক্ষেপে (মিনহাজ-ই-সিরাজের মূল বিবরণের ইংরেজি তর্জমাও নীচে রেফারেন্স হিসেবে থাকলো পাঠকের বিবেচনার জন্য)।৩০
বিহারের শহর ছিল দূর্গ দ্বারা সুরক্ষিত। সেখানে গুছিয়ে আক্রমণের আগে লুটপাটের অংশ হিসেবে বখতিয়ার বিভিন্ন স্থানে হানা দিতেন। বিশ্বাসী সহযোগিরা তাঁর সঙ্গে থাকতো। এরকম এক সময়েই দূর্গসদৃশ একটা স্থানে দু’শ ঘোড়া সওয়ারীসহ হঠাৎ আক্রমণের ঘটনা ঘটে। সেসময় ফারগানার বেশ শিক্ষিত দুই ভাইও এই অভিযানে ছিল। এদের একজন নিজাম উদ দীন, আরেকজন শামশাম উদ দীন। এদের একজনের সঙ্গে ৬৪১ হিজরীতে কথা বলেই এই বিবরণ লিখছি। দুর্গসদৃশ জায়গাটিতে আক্রমণকালে বখতিয়ার একটা গুপ্ত দরজা দিয়ে সেখানে ঢুকে গেলেন। প্রচুর সম্পদ পাওয়া গেল। এখানে অধিবাসীদের বড় অংশ ছিল ব্রাহ্মণ। তাদের মস্তক মুন্ডিত ছিল। সবাইকে হত্যা করা হয়। প্রচুর কিতাব দেখা গেল। এসব বইয়ের অর্থ উদ্ধারের জন্য কিছু হিন্দুকে ডাকা হলো। সেই হিন্দুদেরও মেরে ফেলা হলো। বইগুলোর বিবরণ থেকে বোঝা গেল এই দুর্গ ও শহরটি আসলে একটা বিদ্যাপীঠ।
অনেক ভারতীয় গবেষক এই ঘটনাকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। ওদন্তপুরী নালন্দার কাছাকাছি বিহার শরীফ নামে একটা জায়গা। মূল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নয় মোটেই। অর্থাৎ বখতিয়ার ও তার বাহিনী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেননি। সেটা বৌদ্ধ ও হিন্দুদের দ্বন্দ্বে ভিন্ন সময় ভিন্ন কারণে পোড়ে। আপাতত সেই আলোচনা থাক। তবে এটা আড়াল করার সুযোগ নেই, ওদন্তপুরীতে বখতিয়ারের মাধ্যমেও অন্যায়ভাবে বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে এটা কি ‘জিহাদ’ হতে পারে? ‘বখতিয়ারে ঘোড়া’য় আমরা জিহাদেরই উল্লেখ পাই।
উপরে সমর অভিযানে ইসলামের প্রথম খলিফার ধ্বংসবিরোধী যে নির্দেশনার উল্লেখ করা হয়েছে সেটা প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলামের মূল অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে ধারণ করে আছে। এর একটা চমৎকার ব্যাখ্যা দেন এম এন রায় এভাবে:
‘‘মূল মতবাদই ইসলামকে সহিঞ্চু করেছে। ইসলাম একথা বিশ্বাস করে- সমস্ত জগত তার দোষত্রুটি নিয়ে এক খোদারই সৃষ্টি।…এই ধর্মমত কোনদিনই অনুসারীদের একথা শেখায় না যে, কোন ভ্রান্তগোষ্ঠী কোন দুর্বৃত্ত ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং সে জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। যারা পূজার্চনা করে থাকে মুসলমানদের দৃষ্টিতে তারা ভ্রান্ত হতে পারে, কিন্তু এক খোদারই সন্তান। সেজন্য তারা ভ্রাতৃস্থানীয়। তাদের ‘সৎপথে আনা’ ইসলামেরই কর্তব্য বটে- কিন্তু যতদিন তারা স্বেচ্ছায় মুক্তিপর পথ বেছে না নেয় ততদিন সহজভাবেই তাকে ছেড়ে দিতে হবে।’’
বলা বাহুল্য, বখতিয়ার খলজির বহুল আলোচিত মগধ অভিযানে আমরা এরকমটি দেখি না।
আর, বাংলায় কী ঘটেছিল? এখানে কী ইসলাম তার মূলশিক্ষা ছেড়ে তরবারির মাধ্যমে এগিয়েছে? প্রশ্নটি এভাবেও তোলা যায়, এখানে ইসলামের বিস্তৃতি কীভাবে ঘটেছিল? ইতিহাসবিদ ও অর্থনীতিবিদ আকবর আলী খান তাঁর ২০১৮ সালের এক বর্ক্তৃতায় এই প্রশ্নের চারটি সম্ভাব্য উত্তর চিহ্নিত করে সবগুলোর একরূপ ময়নাতদন্ত করেন। বাংলায় ইসলাম প্রসারের সম্ভাব্য সেই চারটি উত্তর হতে পারে:
ক. ইসলাম ধর্ম প্রসারে মুসলমান শাসকরা ভূমিকা রেখেছেন;
খ. ব্রাহ্মণ্যবাদের কর্তৃত্ববাদী আচরণের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের প্রতিবাদ হিসেবে আগের ধর্মত্যাগ ঘটেছে;
গ. হিন্দু শাসকদের উৎপীড়ন থেকে বাঁচতে বৌদ্ধরা ব্যাপক হারে ইসলামে দীক্ষা নিয়েছে; এবং
ঘ. পীর-দরবেশদের মাধ্যমে নতুন ধর্মের প্রসার ঘটেছে।
উপরের চারটি সম্ভাব্য উত্তরের মধ্যে ইসলামের প্রসারে সবচেয়ে কম ভূমিকা শনাক্ত হয় প্রথম পদ্ধতিতে। ভীতি প্রদর্শন বা নিপীড়নের মাধ্যমে নতুন ধর্মে দীক্ষার নজির বিরল না হলেও তার উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা দেখা যায় না বাংলায়। এমনকি অন্যত্রও। দিল্লী ও উত্তর ভারতের উদাহরণ দিয়েছিলাম আমরা উপরে। ক্ষমতার উত্তাপে গণহারে কোন নতুন ধর্মের প্রসার ঘটলে উত্তর ভারতে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকতো। ইসলাম-প্রসারে যোদ্ধাদের ভূমিকা-তত্ত্ব এমনকি এমন প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারে না যে, মুর্শিদাবাদ, মালদা, নদীয়া ও ঢাকার মতো মুসলমান শাসকদের অবস্থানের প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলো থেকে নোয়াখালী-চট্টগ্রামের মতো দূরবর্তী অঞ্চলে কেন মুসলমানদের সংখ্যাগত প্রসার অধিক। ১৮৮১-এর শুমারিতেও দেখা গেছে, মুর্শিদাবাদ ও নদীয়ায় যখন মুসলমানদের হিস্যা যথাক্রমে ৪৮ ও ৫৬ শতাংশ- নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে তখন সেটা ৭৪ ও ৭১ শতাংশ। শেষোক্ত অঞ্চলগুলো নতুন ধর্মের প্রসারে এগিয়ে গেল কেন?৩১ এমনকি সুদূর ভেনিস থেকে আসা পর্যটক সিজার ফেডেরিসি সন্দ্বীপের মতো স্থানে কেন ‘প্রায় পুরো জনসংখ্যা মুসলমান’ পেলেন?৩২ তরবারি কাজ করলে অন্তত ১৮৮১ পর্যন্ত বাংলায় ‘শাসক শ্রেণী’র সংখ্যালঘু হয়ে থাকার কোন কারণ থাকতে পারে না।
আকবর আলী খানের মতে, ব্রাহ্মণ্যবাদের উৎপীড়নে নিম্নবর্ণের মানুষের দলে দলে সাম্যবাদের খোঁজে ইসলাম গ্রহণের ধারণাও এই কারণে বিশেষ সমর্থন করা যায় না যে, এরকম সমস্যা ভারতের অন্যত্রও ছিল। কিন্তু সেসব অঞ্চলে ব্যাপক ধর্মান্তরের নজির নেই। ১৮৭২ সালের প্রথম শুমারিতে যে চারটি এলাকায় মুসলমানদের ঘনত্ব বেশি দেখা গেছে সেগুলো ছিল পূর্ববাংলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তান।৩৩ তাছাড়া বাংলায় মুসলমান সমাজেও বর্ণপ্রথার প্রবল প্রভাব ঢুকে পড়েছিল আশরাফ, আতরাফ, আরজল ইত্যাদি শ্রেণীভেদের মাধ্যমে।৩৪ একই রকমভাবে সেনবংশসহ অন্যান্য হিন্দুদের দ্বারা বাংলার বৌদ্ধদের উৎপীড়িত হওয়ারও ব্যাপক কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। ফলে ইসলামের পতাকাতলে গণহারে বৌদ্ধরাও শামিল হয়েছে- এমন সাক্ষ্য মেলে না।৩৫ বরং বাংলায় ইসলামের প্রসারে চতুর্থ ধারণা- তথা পীর-আওলিয়াদের ধীরলয়ের ভূমিকাই প্রবল দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও খাজা মইনুদ্দীন চিশতী, আলী কলন্দর, কুতুবুদ্দিন, নিজামুদ্দিন প্রমুখ প্রভাবশালী পীর থাকার পরও বাংলায় কী কারণে পীরদের সফলতা অধিক বলে ধরতে হবে? এর উত্তর হিসেবে আকবর আলী খান বাংলার গ্রামের গড়নকে চিহ্নিত করেন। গবেষক অসীম রায় এ বিষয়ে যেটা বলেন৩৬, পীর ও দরবেশরা বাংলায় প্রকৃতির রুদ্ররোষের শিকার মানুষকে সংঘবদ্ধকারী শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন। একটা বন্ধন সৃষ্টিকারীর চরিত্র ছিলেন তাঁরা। স্থানীয় সমাজের আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মেটাতে পেরেছিলেন তাঁরা- অস্থিতিশীল ভৌগলিক পরিবেশে অসহায় মানুষের যা দরকার হয়। রিচার্ড এম ইটনও বাংলায় পীরদের অনুরূপ ভূমিকার স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের তিনটি প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী বৈশিষ্ট্যের কথা জানান। সেগুলো হলো সম্মোহনী শক্তি, সাংগঠনিক দক্ষতা ও চাষবাস সম্পর্কে পরামর্শ। এতে তারা স্থানীয়দের আধ্যাত্মিক শান্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও পথ দেখান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাক্তন অধ্যাপক সুশীল চৌধুরী এই প্রক্রিয়াকে এভাবে শনাক্ত করেছেন:
বাংলায় ইসলামের আবির্ভাব এবং উত্থানে কৃষির বিকাশ ও নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে জনবসতি স্থানান্তরের একটা ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে পূর্ববাংলায় ঐতিহাসিক এই প্রক্রিয়াকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। এখানে গণধর্ম আকারে ইসলামের বিকাশে যেসব ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া কাজ করেছে তার মধ্যে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা। এর ফলে বাংলায় কৃষির ভরকেন্দ্র পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলের প্রান্তিক দিকে সরে গিয়েছিল। এরই চূড়ান্তরূপ দেখি আমরা যখন পদ্মার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় গঙ্গা। এতে করে গঙ্গার মূল স্রােত পূর্ববাংলার ভেতর দিয়ে বইতে শুরু করে। অঞ্চলটি তখন তুমুল উর্বর হয়ে ওঠে। এর নিম্নাঞ্চলে ব্যাপক বিস্তার ঘটে বন ও ঝোঁপঝাড়ের। এসময় ক্রমে বাংলার অন্য জায়গা থেকে দরিদ্ররা বিস্তৃর্ণ বনাঞ্চলের দিকে সরে যেতে থাকে। ইতোমধ্যে সেখানে ঝোঁপঝাড় বন সরিয়ে আবাদে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন পীর, গাজী, সুফিদের দল। যাঁরা সেখানে ‘সাংস্কৃতিক মধ্যস্থকারী’র ভূমিকা পালন করছিলেন। এই প্রক্রিয়াতেই পূর্ববাংলার নতুন বসতিস্থাপনকারীরা ইসলামের পরিসরে প্রবেশ করে- তাদের পুরানো সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারসহ। ফলে আমরা দেখবো, যেটা অন্যত্র ঘটেনি- পূর্ববাংলার ইসলামে স্থানীয় অতীত সংস্কৃতির প্রবল জের ছিল এবং এখানকার কৃষিজীবীদের কাছে ইসলামকে কখনো বিদেশী কিছু মনে হয়নি। অন্তত ইসলাম বিস্তৃতির প্রাথমিক দিনগুলোতে।৩৭
এই ধরনের বিবরণের অন্যতম উৎস আসলে রিচার্ড ইটনের বিখ্যাত গবেষণা। ইটন অনেকটা জেলা ধরে ধরে এরকম বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে বাগেরহাটের খান জাহান আলীর বিবরণ দিতে যেয়ে তিনি লিখেন৩৮:
দরবেশ খান জাহান ছিলেন বাগেরহাটের একজন পৃষ্ঠপোষক।…তাঁর স্মরণীয় কৃর্তিসমূহের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় জঙ্গল পরিষ্কার করা, সেটা আবাদের জন্য প্রস্তুত করা, ইসলামের প্রসার ঘটানো এবং এলাকায় অনেক রাস্তাঘাট ও মসজিদ নির্মাণ।…তিনি অবশ্যই একজন কার্যকর নেতা ছিলেন। অঞ্চলটির পূর্বেকার ঘনবনকে ধানক্ষেতে রূপান্তরিত করতে শ্রেয়তর সাংগঠনিক দক্ষতা ও প্রচুর জনশক্তির প্রয়োজন ছিল। একদিকে লোনা পানি সরিয়ে রাখার জন্য পানি প্রবাহ বরাবর জমিতে বাঁধ দেয়া, পানি মজুদের জন্য পুকুর খনন, শ্রমিকদের জন্য কুঠির তৈরি ইত্যাদি বহু কাজ ছিল। এসব সম্পন্ন করেই ধান চাষ শুরু হতো। না হলে নল-খাগড়া ফিরে আসতো। এসব ছিল কষ্টকর তৎপরতা। এসব কাজ কঠিন করে তুলতো বাঘ ও জ্বরের উপস্থিতি। খান জাহান লোকদের স্থাপত্যের বিশাল কর্মকান্ডের দিকেও ধাবিত করেন। বিভিন্ন জরিপ তাঁকে অর্ধশতাধিক স্থাপনা তৈরির কৃতিত্ব দিয়েছে। আর লোক-ঐতিহ্য দাবি করে তিনি ৩৬০টি মসজিদ এবং সমসংখ্যক দীঘি বানিয়েছেন।…তাঁকে অঞ্চলের অসংখ্য সড়ক নির্মাণের কৃতিত্বও দেয়া হয়।…সংক্ষেপে খান জাহানকে স্মরণ করা হয় শুধু বনের একজন অগ্রপতিক হিসেবেই নয়- একজন সভ্যতা নির্মাণকারী হিসেবে।
কেবল কৃষি ও অবকাঠামোগত নতুন ‘সভ্যতা’ নির্মাণই নয়- জেমস ওয়াইজ প্রান্তিক বাংলায় (রাষ্ট্রীয় সেবার অনুপস্থিতির মাঝে) পীরদের বিভিন্ন সেবাধর্মী কর্মসূচির দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যারা মধ্যে ছিল রোগ নিরাময় ও বিচারমূলক কাজ। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এরকম পীরদের অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি আস্থাশীল ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে তাদের ‘মাজার’-এ নানান ধর্মের মানুষের আগমন তা নির্দেশ করতো।
তবে শুধু এসব কারণেই বাংলার পীররা উত্তর ভারতীয় পীরদের চেয়ে বেশি সফল নন। তাঁদের সফলতা এনে দিয়েছিল (আকবর আলী খানের মতে) বাংলার গ্রামের উন্মুক্ত চরিত্র। এর প্রমাণ হিসেবেই দেখা যায় বঙ্গীয় ব-দ্বীপে প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে ইসলামের প্রসার ঘটেছে বেশি। ঐসব গ্রামের চরিত্র ছিল কেন্দ্রের চেয়ে অনেক উদার ও স্বাধীন। যেখানে ব্রাহ্মণ ছিল কম। ‘বিশ্বাস’ বদলের কারণে ত্যাজ্য হলে সেখানে পৃথক গ্রাম গড়বার মতো যথেষ্ট পরিসর ছিল। উত্তর ভারতীয় প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রের আঁটোসাটো গ্রামগুলোতে যা সম্ভব হতো না। মুসলিম শাসনের কেন্দ্রগুলো থেকে বহু দূরের অঞ্চলগুলোতে অধিক মুসলমানের দৃশ্যমান হবার এই চমকপ্রদ বিষয়টি খেয়াল করেই হেনরি বেভারলিও সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, বাঙলায় মুসলমানদের অস্তিত্ব বেড়েছে শাসকদের কারণে নয় বরং কিছুটা বর্ণ শৃঙ্খল প্রভাবিত পরিবেশের কারণ।৩৯ এসব উন্মুক্ত ও দুর্বল গঠনের গ্রাম থেকে ধর্মান্তর যতটা সহজ উত্তর ভারতের কেন্দ্রীভূত গ্রামগুলোতে সেটা সম্ভব ছিল না। এ কারণেই বাংলায় পীর দরবেশদের সফলতার হার বেশি।
উল্লেখ্য, বেভারলি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম শুমারির পরিচালক তথা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন। বাংলার সকল প্রান্ত থেকে আসা তথ্য-উপাত্তগুলোর তাৎপর্য প্রকৃতই এমন এক বাস্তবতা যা আজো তখনকার সমাজ বুঝতে অগ্রাহ্য করার মতো নয়। বেভারলি সেটাই কেবল সকলকে জানিয়ে গেছেন দীর্ঘ এক বিবরণে ‘রিপোর্ট অন দ্য সেনসাস অব বেঙ্গল’ শীর্ষক ১৮৭২ সালের প্রকাশনায়।৪০ উদ্বৃতি দীর্ঘ হলেও ঐ রিপোর্ট থেকে কিছু চুম্বক কথা তুলে ধরা হলো এখানে:
“৩৪৯…. কৌতূহল বেড়ে গেল, যখন দেখা যাচ্ছে- মোগলদের সান্নিধ্য পাওয়া রাজধানীসুলভ এলাকাগুলো নয়, মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি বাংলার অন্যত্র। এরকম কিছু কিছু জেলায় তারা সংখ্যায় চার ভাগের তিন ভাগ। বগুড়ায় দেখা গেল পাঁচ ভাগের চার ভাগ। …অথচ গৌড়ের মালদায় ৪৬ শতাংশ। মুর্শিদাবাদে ৪৫।..অথচ বাকেরগঞ্জ-ত্রিপুরা-রংপুর-ময়মনসিংহে তারা দুই তৃতীয়াংশ।…এসবই ইংগিত করে বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যায় বেড়েছে মোগলদের মতো শাসকদের আবির্ভাবের কারণে নয়। বরং প্রাক্তন অধিবাসীদের মাঝে থাকা বর্ণপ্রথার কঠোর অসহিঞ্চুতার কারণে।…
৩৫০. বিশ্বাস করার কারণ ঘটেছে, নিম্নবর্গ এবং বিভিন্ন ট্রাইব ইসলামে আকর্ষিত হয়েছে। ফরিদপুরে ও বাকেরগঞ্জে অনেক বড় সংখ্যায় চন্ডাল, রংপুরে অনেক কোচ ইসলাম গ্রহণ করেছে। যাদের মর্যাদা রাজবংশীদের মতো ছিল না।… যেখানেই মুসলমানদের সংখ্যায় বেশি পাওয়া গেছে সেখানেই এও দেখা গেছে কৃষিজীবী ও শ্রমজীবীরা বেশি।৪১ এটা একটা নিয়ম হিসেবে পাওয়া গেছে…
৩৫২. …ইসলাম যখন বঙ্গের নিম্নাঞ্চলে আসে…তখন হিন্দুধর্ম একটা অনিশ্চিত ভিত্তির উপর অবস্থান করছিল। তখন এটা কেবল ধর্ম হিসেবে নয়, এমন এক ব্যবস্থা হিসেবেও আসে- যার মাধ্যমে নিম্নবর্গীয়রা আগের অবজ্ঞার জীবনের পরিবর্তে পুরানো প্রভুদের সমান না হলেও- একরকম প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে শিখে।…ধর্মান্তরে এখানে শাস্তি বা ভয় দেখানোর ঘটনা বিরল।…পূর্বতন অবজ্ঞাসূচক অবস্থান থেকে রক্ষা পেতেই তারা ইসলামে আকর্ষিত হয়।
৩৫৩. বিদেশী রক্তের জোরে নয়- মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধি অন্য কারণে- এর জন্য যদি যদি আরও প্রমাণ চাওয়া হয়- তাহলে বলতে হবে, এখানে যারা মুসলমান হলো এবং সম পাটাতনের যারা হয়নি উভয়ের প্রথাসমূহ, গড়ন এক, চুল আঁচড়ানোর মতো বিষয়ও এক। তারা একই আধ্যাত্মিক শ্রদ্ধাস্থলে যায়। তারা প্রায় একই ধাঁচে প্রার্থনা করে। যদিও প্রভুর নাম ভিন্ন। এক দলের কাছে যা ‘সত্য নারায়ন’- অন্যদলের কাছে তা ‘সত্য পীর;। কেবল ‘শেখ’ পরিচয়টি এই মুসলমানদের আলাদা করেছে। এটা দিয়ে বোঝা যেত সে ধর্মান্তরিত।
লক্ষ্যণীয়, বেভারলির বিবরণে তৎকালীন বাংলার ইসলাম সামাজিক মুক্তির একটা ছবি হাজির করে। পাশাপাশি বহুত্ববাদী একটা বাংলাকে দেখি আমরা সেখানে। এই দুটি ছবিরই ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। এর সঙ্গে, ইতিহাসবিদ আব্দুল মমিন চৌধুরী বাংলার বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে প্রাথমিক ইসলামের অগ্রযাত্রার পেছনে সেখানকার মানুষের চারিত্রিক নমনীয়তার বৈশিষ্ট্যকেও বিবেচনায় নেয়ার কথা বলেছেন।৪২ তাঁর মতে এ কারণেই বাংলার পশ্চিমবাঞ্চলের পরিবর্তে অন্যান্য দিকে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছিল দ্রুতলয়ে। অথচ সেসব এলাকা ছিল শাসকদের অবস্থান থেকে দূরের এলাকা। তাঁর এই বক্তব্য এমন সামাজিক ধারণাকেও সমথর্ন করে যে, কৃষিজীবী সমাজ বহির্জগতের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয় কম।
উপরোক্ত মতামতসমূহের সমর্থনসূচক বিবরণ আমরা পাবো জেমস ওয়াইজের বিবরণ থেকেও। একদা (১৮৬৬-৬৮তে) ঢাকায় সিভিল সার্জন হিসেবে কাজ করে যাওয়া ওয়াইজ ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত (মাত্র ১২ কপি মুদ্রিত!) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থটিতে লিখেছেন৪৩:
বঙ্গদেশে ১৮৭২ সালের লোক গণনা শেষে চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসে। এতে দেখা যায় মুসলমানরা দক্ষিণবঙ্গে বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাচীন বঙ্গের রাজধানীগুলোর সন্নিহিত এলাকা নয়। সমগ্র বদ্বীপের প্লাবনভূমিতে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ঢাকা, মালদা, মুর্শিদাবাদ ও পাটনায় মুসলমান সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫৬, ৪৫, ৪৫ এবং ১২ শতাংশ। অন্যদিকে বাকেরগঞ্জ ও ময়মনসিংহের নদীবিধৌত অঞ্চলে তারা ছিল স্পষ্টভাবে অনেক সংখ্যাগরিষ্ঠ। লোক গণনার এরকম তথ্য ছিল কল্পনাতীত।.. .. প্রাচীন বঙ্গের ইতিহাস আমরা যত জেনেছি অষ্টাদশ শতাব্দির পূর্বে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুরাই ছিল সংখ্যায় অধিক।
ওয়াইজ, ইটন, বেভারলি প্রমুখের এসব বিবরণ বাংলায় ইসলাম প্রচারে মধ্যযুগের মুসলমান শাসকদের অতি সীমিত ভূমিকার কথাই জানায়। সেক্ষেত্রে আমরা কী সরাসরি এই উপসংহারেই পৌঁছাবো- অসীম রায়, ইটন, আকবর আলী খান প্রমুখ যেমনটি বলেছে- পীর-দরবেশদের মাধ্যমে এখানকার উন্মুক্ত গ্রামে সহজে ইসলাম প্রচার হয়েছে? তখন আবার প্রশ্ন ওঠে, আউলিয়া-দরবেশদের দ্বারা কারা আকর্ষিত হলো? নতুন ধর্মে কারা দীক্ষিত হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ইসলাম প্রসারের (উপরে উল্লিখিত চারটি বিকল্পে) দ্বিতীয় বিকল্পটিকে প্রথম বিকল্পের সঙ্গে মিলিয়ে উপসংহারে পৌঁছা যৌক্তিক হবে। অর্থাৎ পীররা এখানে সফল হয়েছেন একদিকে যেমন এখানকার প্লাবনভূমির উন্মুক্ত চরিত্রের গ্রামীণ ভূগোলের কারণে- তেমনি নিম্নবর্ণ এবং বর্ণচ্যুত সনাতম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ব্রাহ্মণ্যবাদের কঠোর নীতির কারণেও। এ বিষয়ে ওয়াইজের বিবরণ৪৪ এরকম:
হিন্দুধর্ম উচ্চবর্ণ প্রভাবিত গ্রাম থেকে নিম্নবর্ণের অচ্ছুতদের নির্বাসিত করেছে। তাদের কঠিন কায়িক পরিশ্রম ও হেয় বৃত্তি গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। বৃহত্তর নিম্নবর্ণের জনসাধারণ মানবেতন জীবনযাপন করতে ছিল বাধ্য। দীনতা হীনতা ছাড়া কিছুই তারা পায়নি। পুর্নজন্মবাদী ব্রাহ্মণরা দলিতদের জন্য পরকালেও ভালো কিছু পাবার আশ্বাস দিতে পারেনি। অথচ মৌলানারা ইহলোকে ফললাভের আশ্বাসবাণী তো শোনাতেনই- পরলোকেও ন্যায়বিচারের কথা শোনাতেন।
ওয়াইজের এ বিবরণ পরবর্তীকালের বিভিন্ন শরীরতাত্ত্বিক জরিপদ্বারাও সমর্থিত হয়। নৃতত্ত্ব ও পরিসংখ্যানবিদ্যার সমন্বয়ে এসব শ্রমসাধ্য গবেষণায় শরীরের গঠন, মাথার আকৃতি, ওজন, রক্তের গ্রুপ ইত্যাদির মাধ্যমে দেখা গেছে, বাংলার মুসলমানদের শরীরী মিল রয়েছে একই অঞ্চলের বর্ণ-বহির্ভূত হিন্দুদের (এর কিছু ব্যতিক্রম ছিল কেবল চট্টগ্রাম)।৪৫ একই রকম সাক্ষ্য দেয় এ বিষয়ক নৃতাত্ত্বিক জরিপগুলোও। অর্থাৎ আমরা যদি মধ্যযুগের বাংলার বর্ণ-সম্পর্ক এবং পীর-দরবেশদের ভূমিকাকে সমন্বয় করি তাহলে এখানে ইসলামের প্রসারের একটা বিশ্বাসযোগ্য পথনির্দেশ খুঁজে পেতে পারি বলেই মনে হয়। এর সঙ্গে মিলাতে পারি আমরা মমতাজুর রহমান তরফদারের সেই বিবরণকেও যেখানে তিনি প্রাক-মধ্যযুগীয় বাংলায় নৌ-বন্দর এবং ময়নামতি-লালমাইয়ে পাওয়া আরবীয় মুদ্রার মধ্যদিয়ে বহির্বাণিজ্যের ইঙ্গিত দেন।৪৬ অর্থাৎ বখতিয়ার খলজির মতো যোদ্ধারা আসার আগেই কৃষিজীবী বাংলার সঙ্গে আরবের একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে পাওয়া এসব মুদ্রা বাংলার প্রাথমিক মুসলমান শাসকদের চালু করা মুদ্রা থেকে ভিন্নতর। শেষোক্ত মুদ্রাগুলো কেবল সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে তৈরি হতো। বাণিজ্যিক লেনদেনের অংশ হিসেবে নয়। মুসলমান শাসকরা দ্বিতীয় ধরনের মুদ্রার প্রচলন করে চৌদ্দ শতকের দিকে অনেকগুলো টাকশাল বানিয়ে।৪৭
ইসলামের ইতিহাস-সন্ধান ও বাংলার ইতিহাসের মুক্তি
বহিরাগত একজন শাসক হয়েও বাংলার ইতিহাসে বখতিয়ারের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত হওয়া যে বাস্তবসম্মত নয়- সেটা দেখেছি আমরা উপরে। প্রশ্ন হলো, এর পরও কেন তার জন্য এমন উম্মত্ত গর্ববোধ ছড়িয়ে পড়তে পারলো। এর কিছু কারণ জ্ঞানতাত্ত্বিক, বড় কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক। বাংলার ইতিহাস চর্চার এখনও বাঙলায়ন হয়নি বলেই এমনটি ঘটতে পারে। স্থানীয় অতীতের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আকাঙ্খার বিবরণের চেয়ে এখানে ‘ইতিহাসচর্চা’য় বিদেশী শাসকদের শৌর্য-বীর্যকে মহিমান্বিত করার চল। সেটা একারণেও যে, এ অঞ্চলের শাসন সংস্কৃতি এখনও সংখ্যালঘু অভিজাত এবং সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের হাতেই রয়ে গেছে। তাদের জন্য বখতিয়ার বা লক্ষণ সেনদের মতাদর্শ ও রাষ্ট্রদর্শন যতটা উপযোগী ও আরামদায়ক- নিম্নবর্গের রাজনৈতিক আকাঙ্খার বিবরণ ততটাই অস্বস্তিকর। খেয়াল করলে আমরা এও দেখবো, লক্ষণ সেনকে হটিয়ে বখতিয়ারের আগমনে সন্তোষ থাকলেও- ঐরকম কোন রচনায় এরকম কোন অসন্তোষ দেখা যায় না যে, বখতিয়ার বা মুসলমান রাজশক্তি বাংলার সমাজ কাঠামোতে শোষণমূলক সামাজিক সম্পর্কের সামান্যই কোন পরিবর্তন সাধন করেছে। নিজেদের প্রভাবের সুরক্ষায় শাসনতান্ত্রিক নতুন কিছু পদ্ধতির বিস্তারেই বিশেষ মনোযোগী ছিল তাঁরা।
বাস্তবে সমরবাদ ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রচিন্তার জায়গা থেকে সেন বা খলজিদের নীতি-কৌশলে একালের শাসকরা নিজেদের সম্ভাবনা, স্বস্তি ও স্থায়িত্ব দেখেন। ‘রাষ্ট্রীয়’ সীমার বাইরে দাঁড়িয়ে অতীত বাংলায় পীর-দরবেশ-বুজর্গ-সন্ন্যাসী-বাউলদেও নতুন সমাজ-নির্মাণ চেষ্টার দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল বোঝার মতো বাংলার ইতিহাস হয়তো আজও সাবালক হয়নি। এই ইতিহাসে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার স্থানীয় জীবন্ত মানুষদের খুঁজে পাই না আমরা। তারই ছাপ পড়ে আমাদের সাহিত্যচিন্তায়, গতানুগতিক ভাবুকতায় এবং চর্চায়। কিন্তু এর মাঝে প্রবল এক বিপদের দিক আছে। হয়তো আছে হীনমন্যতা বোধও।
উত্তর ভারতের সেনরা বা আরও দূরের আফগান-তুর্কি থেকে আসা খলজিরাই যদি আমাদের ‘ইতিহাস’ এবং সেই ইতিহাসের প্রধান চরিত্র হয়ে থাকে তাহলে বাংলার জাতীয় পরিচয় কীভাবে নির্মিত হবে? নতুন প্রজন্ম ‘বাংলার ইতিহাস’ হিসেবে কী জানবে বা জানছে? আমরা বাঙলার বহিরাগত আক্রমণকারীদের কীভাবে দেখবে? বহিরাগতের শাসনই কী বিশাল বাংলার শত শত বছরের ইতিহাস? আমাদের পাঠ্য-পুস্তকগুলো কবে প্রকৃতপক্ষে আমাদের হবে? কবে সেগুলো হীনমন্যতা থেকে এই জাতিসত্তাকে মুক্তি দিবে? সেগুলোতে যদি বহিরাগত সেন ও খলজিরাই মহিমান্বিত থাকে তাহলে বাংলার স্বকিয়তা থাকলো কোথায়? আগ্রাসী শক্তিসমূহের জন্য গৌরব অন্যভাবে আবার বাংলায় ঐতিহাসিক সামাজিক-সন্ত্রাসকে গৌরবদানও বটে। অথচ গৌরবান্বিত হওয়া উচিত স্থানীয় ‘সমাজ’ কীভাবে ঐ বাইরের শাসকদের বিরুদ্ধে তাদের মতো করে প্রতিরোধ রচনা করেছিল- সেসব পদ্ধতিসমূহ। যেকোন জনপদের যে নিজস্ব চৈতন্য থাকে তার সঙ্গে আগ্রাসনকারীকে মহিমান্বিত করা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। এটা এমন এক বিপজ্জনক তাবেদারি- যা এখানকার সমাজের রাজনৈতিক অভিমুখকেও অস্পষ্ট করে রাখে।
শেষকথা
প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কিংবা আমাদের বহুল আলোচিত ইতিহাস বিষয়ক কিতাবসমূহে মধ্যযুগের বাংলা নানানভাবেই উপস্থিত। সেখানে যে বাংলাকে আমরা পাই তার একরূপ কাব্যিক প্রকাশ আল-মাহমুদের ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’। তিনি আমাদের মূলধারার ইতিহাসকে নিজের আবেগ, বিশ্বাস ও দর্শন দিয়ে একটি বিশেষ ভঙ্গীতে তুলে ধরেছেন ১৮৬ শব্দে। সেই দেখা কাব্যের বিবেচনায় সফল। কিন্তু ইতিহাস চৈতন্যের দিক থেকে কীভাবে সমস্যা তৈরি করে সেটা দেখেছি আমরা উপরে। এটা একই সঙ্গে বাংলার ইতিহাসবিদ্যার গভীর সংকটেরও একাংশ। বাংলার ইতিহাসের এই অসুস্থতা ইসলামের ইতিহাসকেও সংক্রমিত করতে উদ্ধত সেটাও আমরা কিছুটা আলোচনা করেছি। বাংলায় ইসলামের ইতিহাসের প্রকৃত অনুসন্ধান আসলে স্থানীয় সকল জাতিসত্তার ইতিহাস সারাইয়ের কাজের অপরিহার্য অংশ। এটা রাজনৈতিক কাজও বটে। সেই ‘কাজ’ আত্ম পরিচয়ের রাজনীতি নির্মাণের জন্য নয়। বরং আত্ম পরিচয়ের সত্য খুঁজতে। যে ‘সত্য’ বর্তমান ‘বাংলা’কে ভবিষ্যতের পথ দেখাবে এবং ছদ্ম-আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েনকে অতিক্রম করে যাবে।
এটা বাংলায় জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা যুদ্ধের মতোও। ইতিহাসের পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতেই হবে আমাদের। ভৌগলিক স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির লগ্নে আমাদের ‘ইতিহাস’-এরও ‘মুক্তি’ দরকার। পাশাপাশি তার পুরাণধর্মী চরিত্রও বদলাতে হবে। ভৌগলিক স্বাধীনতার পরও আমরা যখন অতীতের দখলদারদের শৌর্যবীর্যে মুগ্ধ তখন অবশ্যই আমাদের চিন্তার ইতিহাসের দৈন্যতা নিয়ে পুনর্ভাবনা দরকার আছে। এই পুনর্ভাবনা এমনকি ‘ইসলামী উম্মাহ’র সঠিক ইতিহাস পুননির্মাণের স্বার্থেও।
আজকে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলে বাংলাভাষীরা ইসলামী ‘উম্মাহ’র বড় এক মুসলিম জনগোষ্ঠী। বৌদ্ধ ও হিন্দু প্রধান একটা অঞ্চলে কীভাবে ইসলামের এত বিস্তৃতি ঘটলো- তার কোন আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক বিশেষত্ব ছিল কি না- সে বিষয়ে সঠিক একটা বিবরণ তৈরি অবশ্যই ইসলামের বৈশ্বিক ইতিহাসের দিক থেকে জরুরি। উপরন্তু আমরা ইতিহাসকে ঘটনা হিসেবে বা বীরপূজা বা জাতিঘৃণার অংশ হিসেবে পাঠ করবো- নাকি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের অংশ হিসেবে পাঠ করতে চাই- সেটাও আজ দরকারি প্রশ্ন হিসেবে সামনে চলে এসেছে।
বখতিয়ারের ঘোড়ায় এমন এক ‘শ্রেষ্ঠত্ববাদ’-এর কাব্যরূপ পাওয়া যায়- যা ধর্মের আবরণে আমাদের কোন অসত্য জাতিবাদের দিকে নিয়ে যায় কিনা সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। এরকম জাতিবাদের মাঝেই লুকিয়ে থাকে ‘অপর’ ‘অশ্রেষ্ঠ’কে ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দখলের চেতনা। এ কবিতার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলামের ইতিহাসের মহিয়ান সব সাংস্কৃতিক অবদান এবং তার দার্শনিক শক্তির ছাপ দুর্বল হয়ে পড়ে স্থানীয় পাঠকের মননে।
তথ্যনির্দেশ:
১. লেখাটি এক বছর আগে ‘প্রতিচিন্তা’ (জানুয়ারি-জুন ২০২১) জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। অন-লাইন পাঠকদের অনুরোধে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
২. আল-মাহমুদ যেমন বখতিয়ারকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন তেমনি তাঁর কবিতাতেই আমরা ‘সাম্যের দাওয়াত’ দেখি ‘ফসলের সুষম বন্টন’ ও ‘শ্রেণী উচ্ছেদ’-এর জন্য (সোনালী কাবিন, ১০ নং সনেট)। তিনি যেমন একটি বিশেষ রাজনৈতিক ধারার সংবাদপত্র হিসেবে ঢাকায় দৈনিক সংগ্রাম ও চট্টগ্রামে দৈনিক কর্ণফুলীতে যুক্ত ছিলেন তেমনি আবার অনেকখানি বিপরীত ধারার দৈনিক গণকন্ঠেও তার আগে যুক্ত ছিলেন। কতটুকু আদর্শিক কারণে এবং কতটুকু আর্থিক কারণে এসব যুক্ততা সেটা শনাক্ত করা সহজ নয় আজ আর। সুতরাং একটি কবিতায় ব্যক্ত কোন বিশেষ ঐতিহাসিক চৈতন্য নিয়ে ব্যক্তি আল-মাহমুদ বা তাঁর সমগ্র কাব্যসত্তাকে বিবেচনা করা অসঙ্গত। আমরা এখানে কেবল তাঁর কবিতা ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’য় ব্যক্ত ঐতিহাসিক উপাখ্যানকে পর্যালোচনা করবো।
৩. এ ক্ষেত্রে ইসলামের ইতিহাসের একজন সুপরিচিত গবেষক মোহাম্মদ মোহার আলীর লেখা থেকে একটা উদাহরণ তুলে ধরছি এখানে: ‘It was one such goup of Turkish chieftains and military adventurers under the leadership of Ikhtiyar al-din Muhammad bin Bakhtiyar Khalji who planted the victorious banner of Islam on the soil on Bengal.’ (History of The Muslims of Bengal, V. IA, 1985, p. 47)|
এখানে একই বাক্যে একদিকে খলজিকে military adventurers বলা হচ্ছে এবং অন্যদিকে তাকে দেয়া হচ্ছে ‘ইসলামের পতাকা ওড়ানোর বিজয়ের গৌরব’। কয়েক খন্ডে প্রকাশিত বিপুল কলেবরের এই গবেষণাটি হয়েছে আবার সৌদি আরবের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সৌজন্যে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের পর গবেষক মোহাম্মদ মোহার আলী সৌদি আরবে চলে গিয়েছিলেন।
৪. আবদুল করিম, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসন, বড়াল প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৭, পৃ. ৩২-৩৪।
৫. সরদার আবদুর রহমান, ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি, দিব্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ১৯৫-১৯৬।
৬. আজকের বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার মালদা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর ইত্যাদি এলাকাকে সেই অভিযানের ভরকেন্দ্র বলা যায়।
৭. যেমন, তোঘরীল তোঘান খানের সঙ্গে ওড়িষ্যা সহযোগী হন তিনি। গোওয়ালিয়ার আক্রমণে তিনি সুলতান ইলতুৎমীশের সহযাত্রী ছিলেন।
৮. অনুবাদ: আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, দিব্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৪, পৃ. ২৪।
৯. History of The Muslims of Bengal, V. IA, 1985, p. 51.
১০. বাংলার ‘সমাজ’ থেকে সেই সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির সংগঠিত উৎখাতের সূচনা মাত্র গত কয়েক শতাব্দির ঘটনা। মধ্যযুগের বাংলার স্বাধীন মুসলমান সুলতানদের আমলে বরং উল্টোচিত্রের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সুলতান রুকুন-উদ-দীন, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, নাসির উদ্দীন নুসরাত শাহ প্রমুখের সময়ে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা হতে দেখা গেছে, শ্রী কৃষ্ণ বিজয় (মালাধর বসু), মনসা বিজয় (বিপ্রদাস পিপলাই), পদ্মপুরাণ (বিজয় গুপ্ত), কৃষ্ণ মঙ্গল (যশোরাজ খান) ইত্যাদি বাংলাকাব্য। মালাধর বসু ছিলেন বর্ধমানের, বিপ্রদাস উত্তর চব্বিশ পরগণার, বিজয় গুপ্ত বরিশালের মানুষ। একই সময়ে আলাউদ্দিন হুসেন শাহের লস্কর চট্টগ্রামের শাসক পরগাল খাঁর অনুরোধে মহাভারতের একাংশ অনুবাদ করছেন কবিন্দ্র পরমেশ্বরণ। এরকমই ধারাবাহিকতা পাওয়া যায় সপ্তদশ শতকেও দৌলত কাজী এবং আলাওলে লেখনির বিষয়বস্তুতে। এই উভয় খ্যাতনামা মুসলমান লেখকের রচনায় অনেকভাবে শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রকে উপস্থিত দেখা যায়। বলাবাহুল্য, এটা মুসলমান শাসকদের দিক থেকে শুধুই ঔদার্যের বিষয় ছিল না। বহিরাগত শাসক হিসেবে অপরিচিত জমিনে নিজেদের রাজত্বের দীর্ঘস্থায়ীত্বের কৌশল হিসেবেই হিন্দু-মুসলমানের সুসম্পর্ক তাদের জন্য কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক ছিল। আবার একই সঙ্গে এটা স্থানীয় সমাজের সংস্কৃতির সঙ্গেও মানানসই ছিল। এ আিরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখা যেতে পারে: Sushil Chaudhury, Identity and Composite Culture: The Bengal Case, Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, Hum., Vol. 58 (1), 2013.
১১. আকবর আলী খান, বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রসার, জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ২০১৮, পৃ. ২৭।
১২. এটা ছিল ৭৮৮ সালের আব্বাসীয় খলিফা হারুণ আল-রশীদের মুদ্রা। Md. Shah Noorur Rahman, Islam and its early introduction in Bengal, Indian History Congress, Vol. 56 (1995), pp. 425-434 (10 pages).
১৩. রিচার্ড এম. ইটন, ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: হাসান শহীদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৮, পৃ. ১৪৯।
১৪. Dr. Sangeeta B. Sahay, Re-assessing the military career of Bakhtiyar Khilji in Bihar, www.iosrjournals.org, Feb 2019.
১৫. তবকাত-ই-নাসিরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০।
১৬. মূল ফারসি থেকে তবকাত-ই-নাসিরীর অনুবাদক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া লিখেছেন, ‘সেনদের দলিলপত্রে কোথাও দেখা যায় না গৌড়ে তাদের কোন রাজধানী বা প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। অথচ সেই নগরীর নামের সঙ্গে সংযুক্ত করে প্রায় সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলকে লখনৌতি রাজ্য বলে অভিহিত করে গেছেন মীনহাজসহ অনেক মুসলমান ঐতিহাসিক।’ পূর্বোক্ত, উপক্রমনিকা, পৃ. চৌত্রিশ।
১৭. আবিদ আলী খান, গৌড় ও পাণ্ডুয়ার স্মৃতি, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: চৌধুরী শামসুর রহমান, দিব্য প্রকাশ, ২০০৭, পৃ. ১৬৯ । ১৯০২ সালে মালদহে লর্ড কার্জনের হাতে গৌড় ও পাণ্ডুয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনগুলোর এই তালিকা দেয়া হয়েছিল। গৌড়ের প্রত্ন-ইতিহাস সম্পর্কে এটা একটা নির্ভরযোগ্য দলিল। একই বিষয়ে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-এর গৌড় কাহিনীতে (বঙ্গদর্শন, কার্তিক, ১৩১৪) বলা হয়েছে: ‘লক্ষণাবতীর ধ্বংসাবশেষের মাঝে বখতিয়ার নির্মিত কোন পুরাতন মসজিদের পরিচয় পাওয়া যায় না। সেরকম কোন জনশ্রুতিও বর্তমান নাই।’
১৮. দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামের ইতিহাসে জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তকরণের ধারণা তথা ‘তরবারিতত্ত্ব’-এর অন্যতম উদ্যোক্তা হলে উইল ডুরান্ট (The Story of Civilization: Our Oriental Heritage, 1935)। পরে এই তত্ত্ব এখানে প্রচার করেছে ব্রিটিশ শাসক-বুদ্ধিজীবীরা। মূলত ভারতবাসীকে বিভক্ত করে শাসন করার জন্যই এই তত্ত্বের প্রসার ঘটায় তারা। এরপর সেটা হস্তান্তরিত হয় হিন্দুত্ববাদী বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের কাছে। এভাবেই এর অনুপ্রবেশ ঘটে বাঙ্গালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী সমাজের একাংশের মাঝেও। তারই একরূপ পার্শ্বফল হতে পারে বখতিয়ারের মতো চরিত্রদের ক্রমাগত ‘মুসলমান শাসনের প্রতিষ্ঠা’ হিসেবে তুলে ধরা। বখতিয়ারকে ‘মুসলমান শাসক’ হিসেবে চিহ্নিত করা স্পষ্ট ইঙ্গিতবহ। বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে দশকের পর দশক তার প্রচার- ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার কোন সচেতন প্রয়াস কি না- সেটাও গভীরভাবে পুনর্ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এরকম তুর্কি যোদ্ধাদরে ‘কাজ’কে ভারতবর্ষে ‘মুসলমানদের অবদান’ হিসেবে দেখানো আজকের ভারত বিজেপির তরফ থেকেও বিরাট এক বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মসূচি হিসেবে হাজির আছে।
১৯. Sayiedmomin Sayied, Khilji Dynesty, www.taand.com,https://bit.ly/3890RaU
২০. তবকাত-ই-নাসীরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫।
২১. এ পর্যায়ে এও মনে রাখা দরকার যে, সেনরাও খলজিদের মতোই বাংলায় বহিরাগত শাসক। মূলত কানাড়িভাষী তারা। সেনরা এসেছিল কনার্টকের মহীশূর থেকে। প্রাথমিকভাবে এরা ছিল ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয়। অর্থাৎ একই সঙ্গে স্বঘোষিত শাসক ও যোদ্ধা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা যখন দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের বাংলার ইতিহাস পড়ি তখন কেবল এসব বহিরাগত যোদ্ধাদের ইতিহাস পড়তে বাধ্য হই। এসব শাসকদের আমরা মহিমান্বিতও করি। কার্যত এসব বাংলার সমাজের ইতিহাস নয়। তখনকার আগ্রাসী ‘শাসকদের ইতিহাস’ মাত্র। যদিও তাকেই ‘বাংলার ইতিহাস’ হিসেবে দেখানো চলছে। আরও বিস্ময়ের দিক হলো, সেন বংশ এবং খলজিদের সঙ্গে তুলনা করলে শাসক হিসেবে পালবংশই অনেক লোকজ এবং বাঙ্গালি চরিত্রের। এই শাসক বংশের গোড়াপত্তনের ধরনও ছিল তুলনামূলকভাবে গণতান্ত্রিক ধাঁচের। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সুযোগে তাদের উৎখাত করেই সেনরা এসেছিল। আর সেই সেনদের পর এলো তুর্কি-আফগান খলজিরা। কিন্তু পূর্বতন স্থানীয় শাসকদের পরিবর্তে বাংলার ইতিহাসচর্চায় বহিরাগত শাসকরাই প্রশংসিত- যাঁরা মূলত আক্রমণকারী এবং ক্ষমতা দখলকারী।
২২. সরদার আবদুর রহমান, ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি, দিব্যপ্রকাশ, ২০১৯, পৃ. ৯৩।
২৩. তবে এমনকি সেখানে কোন বড় মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও মিলেনি। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর অনুবাদের উপক্রমনিকায় লিখেছেন, ‘মীনহাজের বর্ণনায় দেখা যায়, বখতিয়ার বিহার অধিকারের সংবাদ পাওয়ার পর মহারাজা লক্ষণ সেন আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেটা হলে এই মহারাজা যে নগরীতে কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করবেন না তা কল্পনাতীত। আর কিছু না হোক, নগরীর চারদিকে একটা পরিখা অন্তত থাকতো। অথচ সারা নবদ্বীপে কোন পরিখার চিহ্ন পাওয়া যায় না। পূর্বোক্ত, পৃ. একচল্লিশ।
২৪. সরদার আবদুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯১।
২৫. হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেনের রাজধানী ছিল বিজয়পুর। সেটা রাজশাহী থেকে আট মাইল দূরের বিজয়নগর।
২৬. কোরআনের বিধান অনুযায়ী অন্যের সম্পদ অন্যায়ভবে সংগ্রহ অনুমোদিত নয়। সুরা বাকারাহ’য় এর বিরুদ্ধে নির্দেশ রয়েছে (২:১৮৮)। এরকম ধন সম্পদ গ্রাস করার লক্ষ্যে উর্ধ্বতনকে উৎকোচ প্রদানেও নিষেধ করা হয়েছে সেখানে (২:১৮৯)।
২৭. H. Bolchmann, Journal of Asiatic Society of Bengal, 1873, No. 3, p.211.
২৮. মানবেন্দ্রনাথ রায়, ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা, রেনেসাঁস, ২০১৫, কলকাতা, পৃ.৩১।
২৯. মানবেন্দ্রনাথ রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭। এ বিষয়ে ইসলামের বিধান সম্পর্কে সাইয়েদ আবুল আ’ল মওদূদী লিখেছেন,
‘যারা ইসলামের রাষ্ট্র পরিচালনা করবে তারা কোথাও বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলে সেখানকার লোকেরা গণহত্যা, জনপদে ধ্বংসলীলা, জুলুম নির্যাতন, গুন্ডামী এবং ব্যভিচারের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হবে না। বরং বিজিত জনপদের অধিবাসীরা এদের প্রতিটি সিপাহিকে পাবে জানমাল, ইজ্জত, আব্রু ও নারীদের সতীত্বের পূর্ণ হেফাজতকারী হিসেবে।’ (ইসলামী রাষ্ট্র ও সংবিধান, মওদূদী রিসার্চ একাডেমি, ১৯৯৭, ঢাকা, পৃ. ৪৬৯)।
আর ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’য় যাকে ‘আল্লার সেপাই’ বলা হয়েছে এবং শত শত গবেষক যাকে ‘বাংলায় মুসলমান শাসনে’র কর্তৃত্ব দিচ্ছেন তার নদীয়া অভিযান শেষে কী ঘটছে? তবকাত-ই-নাসিরী থেকে উদ্বৃতি:
রায় (লক্ষণ সেন) নগ্নপদে পশ্চাৎদ্বার দিয়ে নিজ প্রাসাদ থেকে পলায়ন করেন। তাঁর সমুদয় ধনাগার, হারেমের নারী, দাসদাসী, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুর নারী বখতিয়ারের করতলগত হয়। তিনি অসংখ্য হস্তীও অধিকার করেন। মুসলিম সৈন্যদের হস্তে এত লুন্ঠিত দ্রব্য পতিত হয় যে, তা বর্ণনা করা যায় না।…
(তবকাতের বখতিয়ার অধ্যায়, সরদার আবদুর রহমানের ‘ইখতিয়ারউদ্দীন মোহাম্মদম বখতিয়ার খলজি’ গ্রন্থের পরিশিষ্ট হিসেবে সংযুক্ত, দিব্যপ্রকাশ, ২০১৯, পৃ. ২২৬)
৩০. He (Bakhtiyar Khilji) used to carry his depredations into those parts and that country until he organized an attack upon the fortified city of Bihar. Trustworthy persons have related on this wise, that he advanced to the gateway of the fortress of Bihar with two hundred horsemen in defensive armour, and suddenly attacked the place. There were two brothers of Farghanah, men of learning, one Nizamu-ud-Din, the other Samsam-ud-Din (by name) in the service of Muhammad-i-Bakhtiyar; and the author of this book [Minhaj] met with at Lakhnawati in the year 641 H, and this account is from him. These two wise brothers were soldiers among that band of holy warriors when they reached the gateway of the fortress and began the attack, at which time Muhammad-i-Bakhtiyar, by the force of his intrepidity, threw himself into the postern of the gateway of the place, and they captured the fortress and acquired great booty. The greater number of inhabitants of that place were Brahmans, and the whole of those Brahmans had their heads shaven; and they were all slain. There were a great number of books there; and, when all these books came under the observation of the Musalmans, they summoned a number of Hindus that they might give them information respecting the import of those books; but the whole of the Hindus were killed. On becoming acquainted (with the contents of the books), it was found that the whole of that fortress and city was a college, and in the Hindu tongue, they call a college Bihar.” (Tabaqat-i-Nasiri, English translation by H.G. Raverty, pages 551-52).
৩১. ১৯০১-এর শুমারিতে এও দেখা যায়, বাংলায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর পেশা মূলত কৃষি এবং তারা গ্রামনিবাসী। (Abdul Momin Chowdhury, Reflections on Islamisation in Bengal, Bangladesh e-Journal of Sociology, 2011)। যদি যোদ্ধা-শাসকদের সূত্রেই প্রধানত ধর্মান্তর ঘটতো তাহলে মুসলমানদের মাঝে শহুরে পেশাজীবীদের সংখ্যাও থাকতো উল্লেখযোগ্য এবং তাদের অবস্থান হতো নগরগুলোতে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের দীর্ঘসময় পরের শুমারিও সেরকম আভাস দেয় না।
৩২. তাঁর গ্রন্থ ‘The voyage and travaile into the East India’, London 1588. এখানে সন্দ্বীপের তথ্য উদ্বৃত হয়েছে ইটনের গ্রন্থ থেকে। পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৮।
৩৩. রিচার্ড এম. ইটন, ইসলামের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫২।
৩৪. বেভারলিও ব্রিটিশদের তৈরি ১৮৭১-এর প্রথম শুমারি দলিলে বাংলার মুসলমানদের মাঝে বর্ণপ্রথার অস্তিত্বের কথা বলেছেন। পৃ. ১৯০।
৩৫. মুসলমান শাসকরা আসা মাত্র যে ‘গণহারে ইসলাম কায়েম’ হয়নি তার আরেক প্রমাণ ইবনে বতুতার পূববাংলা ভ্রমণের কাহিনী। এসময় ১৫ দিন মেঘনা নদীতে ভ্রমণ শেষে নদীর দু’পাড়ে কেবল ‘মুসলমান রাজত্বের অধীনে কাফের’দের দেখেছিলেন তিনি। এ বিবরণ সাক্ষ্য দেয়, অন্তত ১৪ শ’ শতাব্দিতেও এ বাংলায় অ-মুসলমানদের ব্যাপক আধিক্য ছিল।
‘গণহারে’-এর বদলে যে ‘ধীরলয়ে’ বিশ্বাস বদলের ঘটনা ঘটেছে সেটা এমনকি নদীয়ার পরের সময়ের শুমারি প্রতিবেদনগুলোতেও লক্ষ্য করা যায়। যেমন, ১৮৭২-এ নদীয়ায় মুসলমান জনসংখ্যার হিস্যা ছিল ৫৪ ভাগ, ১৮৯১-এ ৫৭ ভাগ এবং ১৯০১-এ ৫৯ ভাগ। লক্ষ্য করার বিষয়, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠী হিসেবে জন্মহার বেশির বিষয় বিবেচনা করলে সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা বেড়েছে খুব ধীরলয়ে। [জেলা গেজেট নদীয়া ১৯২৭]
নদীয়ার মতোই তখনকার আরেক ‘মুসলমান শাসক প্রভাবিত অঞ্চল’ ঢাকার ১৮৩০ সালের শুমারি থেকে হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যা পাওয়া যায় যথাক্রমে ৩১ হাজার ও ৩৫ হাজার। অর্থাৎ তখনও এখানে প্রায় অর্ধেক জনগণ ছিল অ-মুসলমান। এইচ ওয়াল্টনের উদ্যোগে শুধু ঢাকায় এই শুমারি হয়েছিল বলে জেমস ওয়াইজ জানিয়েছেন। (পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও পেশার বিবরণ, ১ম ভাগ, অনুবাদ: ফওজুল করিম, আইসিবিএস, ২০০০, পৃ. ২৬)
৩৬. Asim Roy, Islamic Syncretistic Tradition in Bengal, Princetion University Press, 1983, p. 42.
৩৭. Sushil Chaudhury, Identity and Composite Culture: The Bengal Case, Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, Hum., Vol. 58 (1), 2013, P.3.
৩৮ রিচার্ড এম. ইটন, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৫৩-৫৪।
৩৯. H. Beverley, Census of Bengal 1871, Bengal Secretariat Press, 1872, P, 133.
৪০. Bengal Secretariat Press, Calcutta, 1872, p. 132-134.অনুবাদ: বর্তমান লেখকের।
৪১. বেভারলি মুসলমানদের মাঝে কৃষিজীবীর পাশাপাশি তাঁতি ও জোলাদের বড় সংখ্যায় পাওয়ার তথ্য দিয়েছেন। পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯০।
৪২. একই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই বাংলার এসব এলাকায় একদা বৌদ্ধ বিশ্বাসেরও বিস্তৃতি ঘটেছিল বলে আব্দুল মমিন চৌধুরী দাবি করেন। সেনদের আমলে ব্রাহ্মণ্যবাদী কঠোরতা এসব এলাকায় ইসলাম প্রসারের জমিন তৈরি করে রেখেছিল বলেই তিনি ইঙ্গিত দেন। পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০।
৪৩. জেমস ওয়াইজ, পূর্বোক্ত, ২৩
৪৪. জেমস ওয়াইজ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭।
৪৫. এরকমই এক গবেষণা Dhirendra Nath Majumdar and Radhakrishna Rao, Race elements in Bengal: A quantitative analysis, Asia Pub. House, 1960. এর মাঝে প্রথমজন ছিলেন নৃবিজ্ঞানী। দ্বিতীয়জন পরিসংখ্যানবিদ। ১৯৪৫ সালে এই জরিপটি পরিচালনা করা হয় বাংলার ২৯টি জেলার ১৪টিতে ৪১টি সামাজিক গ্রুপের মাঝে। ৩৬৮১ জন পুরুষকে নমুনা হিসেবে নেয়া হয়েছিল। এরকম বিষয়ে এত বৃহৎ পরিসরের ব্যবহারিক গবেষণা খুবই বিরল।
৪৬. ইটন তাঁর বিবরণে অন্যান্য পশ্চিমী গবেষকদের সূত্রে দাবি করেছেন সুলায়মান তাহির (মৃ. ৮৫১), ইবনে খুদাদাদবিহ (মৃ. ৮৫০), মাসুদি (মৃ. ৯৫৬) ও ইদ্রিসির (মৃ. ১১৫০) মতো আরবের ভূগোলবিদদের কাছে বাংলা পরিচিত ছিল এবং তাদের মধ্যে অন্তত একজন (মাসুদি) সেখানে মুসলমানদের বসবাসের উল্লেখ করেছেন। পূর্বোক্ত, পৃ. ১৬৫।
৪৭. মমতাজুর রহমান তরফদার, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক, বাংলা একাডেমি, ১৯৮১, পৃ. ৪ ও ১৩।
প্রথম প্রকাশ: প্রতিচিন্তা, জানুয়ারি-জুন ২০২১