অরাজ
আর্টওয়ার্ক: সিঙ্গার শিল্পী: হেলমুট মিডেন ড্রফ সূত্র: এলেনি গ্যালারি
প্রচ্ছদ » নোম চমস্কি।। বেরি প্যেটম্যানের সাথে কথোপকথন

নোম চমস্কি।। বেরি প্যেটম্যানের সাথে কথোপকথন

অনুবাদ: সহুল আহমদ

নোম চমস্কি

নব্বইয়ের মধ্যভাগে এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন যে, নৈরাজ্যবাদের একটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে যে এটি হয়তো খুব বেশি নেতিবাচক, এটি সমালোচনাই করে গেছে কিন্তু ইতিবাচক কিছু প্রস্তাব করেনি… 

চমস্কি:  আচ্ছা, যদি আমি বলেও থাকি তবু তা বলা উচিৎ হয়নি কারণ এর সাথে আমি একমত নই। এমনকি, আপনি আমার শেলফও দেখতে পারেন (হেসে, ইঙ্গিত করে)। এখানে অনেক নৈরাজ্যবাদী বইপত্র আছে যেগুলো খুবই সুবিবেচনাপ্রসূত সমাজের প্রস্তাবনা দেয়, যা আমার দৃষ্টিতে যথার্থের চেয়েও বেশি কিছু। দিয়েগো আবাদ দে সান্তিয়ান (Diego Abad de Santillan) একজন বিখ্যাত নৈরাজ্যবাদী, যিনি ১৯৩৬ সালে স্পেনের নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবের পর্যালোচনা লিখেছিলেন। তিনি একজন আর্জেন্টাইন, তখন স্পেনে ছিলেন। তাঁর রচনার নাম ছিল ‘বিপ্লবের পর’(After the Revolution)। এখানে তিনি স্পেন সমাজের এনার্কো-সিন্ডিকালিস্ট ভিশন কেমন হতে পারে কিংবা বলা যায় যে কোনো সমাজই কেমন হতে পারে তার একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ এঁকেছিলেন, এবং, আরও অনেক প্রস্তাবনা আছে। আমি মনে করি ভবিষ্যতের জন্যে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনার বিষয়ে ‘আমরা এটা করতে পারব?’ খুব বড়ো প্রশ্ন নয়। আমরা অবশ্যই করতে পারব। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে আমরা মানুষ, সমাজ, প্রতিষ্ঠান, মানবজীবনে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রভাব সম্পর্কে আদৌ পর্যাপ্ত জানি কি না? একটা সমাজের কেমন হওয়া উচিৎ এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা করার জন্যে উপরোক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা কি পর্যাপ্ত জানি? নাকি, স্বাধীনতা, সমতা, কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিষয়ক কিছু নির্দিষ্ট সাধারণ ধ্যানধারণার ভিত্তিতে এগুলোর আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া উচিৎ? এবং এই গোলকধাঁধার মধ্যে কাজ করে মানুষ অনুসন্ধান চালিয়ে যাক এবং দেখা যাক সহজাতভাবে তাদের কাছে কী আসে? কত রকম বৈচিত্র্য এখানে আসতে পারে? যারা কাজ করতে চায় না বা যাদের মধ্যে অপরাধ-প্রবণতা আছে বা যারা মিটিং-এ যেতে চায় না তাদের সাথে আপনি কী করতে চান? এমন বহু প্রশ্ন সামনে আসবে। আপনি কোন মাত্রা পর্যন্ত চাকরির অদলবদল করতে চাইবেন বা আগ্রহ ও মেধার ভিত্তিতে দায়িত্ব বণ্টন করবেন? যদি কেউ কাঠমিস্ত্রী হতে চায়, বা একজন পারমাণবিক বিজ্ঞানী বা একজন পিয়ানোবাদক হতে চায় এবং আরেকজন প্রশাসক হতে চায়, আপনি কি তখন নীতি মোতাবেক চাকরির অদলবদল চাইবেন, এমনকি তারা যদি সুখী থাকে, বা সুখী না থাকে? আমি মনে করি না আমরা এসব জানি। আপনি এ বিষয়গুলো নিয়ে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক মন্তব্য করতেই পারেন, কিন্তু আমি মনে করি না আমরা এসবের উত্তর জানি।

আমি স্পেনিশ লিবারটারিয়ান কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক আইজ্যাক পুয়েন্তে পড়ছিলাম, তিনি বরঞ্চ যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, ‘যদি কেউ শিক্ষক হয়ে যান, তিনি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করেন, এবং যদি কেউ ডাক্তার হয়ে যান, তিনি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করেন’ এটাতো এমন ছিল না যে কেউ ২২ বছর বয়েসি হয়ে গেলেই ডাক্তার হয়ে যাচ্ছে এবং বোধহয় এভাবেই নৈরাজ্যবাদকে দেখা উচিৎ 

চমস্কি: খুব সাধারণ একটা পর্যায় পর্যন্ত আমি মনে করি আমরা সকলেই একমত হতে পারব। যারা নিজেদের নৈরাজ্যবাদী বলে দাবি করেন– খুব বিস্তৃত অর্থেই– তাদের অন্তত একটা সাধারণ ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে যে, সামাজিক কাঠামো ও বন্দোবস্ত যাই নির্মাণ করা হোক না কেন, এগুলো যেন অবশ্যই মানুষের নিজস্ব সৃজনশীলতাকে অনুসরণ করার সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করে। এবং এই জন্য আপনি কোনো সূত্র বানাতে পারবেন না। মানুষ বৈচিত্র্যময়, এবং বৈচিত্র্যময় হতে বাধ্য। এই বিচিত্রতাকে উৎসাহ দিতে হবে। নিজের বাচ্চাকাচ্চাকে লালন-পালন করা হয় যেন তারা নিজের পথ নিজেরাই খুঁজে নেয়– এই চাওয়ার মতো। আপনি বলতে পারেন না– অনেকেই বলেন, কিন্তু বলা উচিৎ না–  এই দৃঢ় কাঠামো তোমাকে অনুসরণ করতে হবে। আমার নিজস্ব মত হচ্ছে যে– এবং, এই বিষয়ে আমি আমার কাছের অনেক বন্ধুর সাথে দ্বিমত পোষণ করি– ভবিষ্যৎ সমাজের পূর্ণাঙ্গ রূপ আঁকার চেষ্টায় আমাদের সতর্ক থাকা উচিৎ। এমন না যে এটা করা যাবে না। এটা খুব আকর্ষণীয় ও বিচিত্র উপায়ে করা সম্ভব, এবং এবং তা করা হয়েছেও। কিন্তু আমি মনে করি আসল প্রশ্ন হলো, এই কাজ করাটা  আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এবং শুধু চেষ্টা ও পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে বিদ্যমান কাঠামোতেই একে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া কতটা জরুরি।

আসলে, আমি মনে করি আমাদের আরেকটি সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। মানব ইতিহাসের কোনো নির্দিষ্ট সময়ে মানুষ নিপীড়ন কী তা বুঝে উঠতে পারেনি। এটি এমন কিছু যা আপনাকে শিখতে হয়। যদি আমি অতীতে ফিরে তাকাই আমি দেখি যে, আমার মা বা দাদিরা একটা পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের মধ্যে বসবাস করেও এটিকে নিপীড়ন ভাবতেন না। যেখানে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় বাপের সামনে মেয়ে চলে আসলে বাপ মেয়েকে না চিনে চলে যেতেন– মেয়েকে চিনতে পারেননি বলে নয়, বরং আপনি মেয়ের দিকে মাথা নাড়ান না। এটিকে ঠিক নিপীড়ন বলে তাদের কাছে মনে হয়নি। মনে হয়েছিল জীবন এভাবেই কাজ করে। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, অভ্যন্তরীণভাবে এর কী রকম মানসিক প্রভাব রয়েছে– এটি অবশ্য জটিল প্রশ্ন। কিন্তু, যিনি কোনো এক্টিভিজমের সাথে জড়িত আছেন, যেমন ধরেন যিনি নারী আন্দোলনের সাথে আছেন, তার একেবারে প্রথম কাজ হচ্ছে মানুষকে বোঝানো যে তারা নিপীড়ন ও কর্তৃত্বমূলক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করছেন। এটা মোটেও স্পষ্ট নয় এবং কে জানে আমরা কোন ধরনের নিপীড়ন ও কর্তৃত্বকে কোনো সচেতনতা ছাড়াই গ্রহণ করে যাচ্ছি। সেলফ-এনলাইটেনমেন্ট ও সামাজিক বোঝাপড়ার একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা ঠাহর করতে পারব যে এই এই বিষয়কে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে এবং এগুলো সম্পর্কে আমরা কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারব না যদি আমরা এগুলোকে না চিনতে পারি।

এর সাথে যুক্ত করা যায়, এমা গোল্ডম্যান বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই আশঙ্কা করেছিলেন যে আশু বিপ্লব বোধহয় হবে না তিনি গুস্তাব ল্যান্ডোয়ার দ্বারা খুব প্রভাবিত ছিলেন যিনি বলতেন যে, রাষ্ট্র এখন আর বাইরে নেই এটি আমাদের ভিতরেই আছে এবং আমাদের স্বাধীন সত্তা হয়ে হয়ে উঠতে হবে– পুঁজিবাদের মধ্যে যতটা সম্ভব মুক্ত হয়া যায় আরকি প্রকৃতপক্ষে তিনি সর্বদাই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, জনগণ বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত না হওয়ারও একটা সম্ভাবনা আছে এবং ব্যক্তিগত রাজনীতি বিকাশেরও একটা উপায় আছে যাতে আরও বেশি মানুষ সেই জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে 

চমস্কি: আমার মনে হয় এটি খুব সত্যি। প্রকৃতপক্ষে, যারা এটা বুঝতে পেরেছিলেন তারাই যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যাণ্ডের মতন মুক্ত সমাজের উপর নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছেন, যেখানে আসলে বছরের পর বছর বিভিন্ন জনপ্রিয় আন্দোলন বিবিধ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, এবং রাষ্ট্রের দমন করার ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে। এটা খুব আশ্চর্যের বিষয়, একেবারে এই সমাজগুলোতেই ব্যবসায়ী দুনিয়া ও রাষ্ট্রপরিচালনাকারীর মতো অভিজাত গোষ্ঠীগুলো শুরুতেই আন্দাজ করতে পেরেছিল যে, মানুষের মনোভাব ও মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শক্তিশালী কিছু পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। কারণ, আপনি মানুষকে আর জোরজবরদস্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তাই আপনাকে মানুষের চেতনাকে এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে যেন তারা বুঝতে না পারে যে তারা বিচ্ছিন্নতা, জুলুম ও পরাধীনতার মধ্যে বসবাস করছে। প্রকৃতপক্ষে, এজন্যই বোধহয় যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়ে থাকে। খুব সচেতনভাবেই। একেবারে দুই বছরের বাচ্চার জন্য টিভি বিজ্ঞাপনের পর্দা থেকে শুরু করে গ্র্যাজুয়েট স্কুলের অর্থনীতি বিভাগে আপনাকে কী পড়ানো হবে তা পর্যন্ত। এই পরিকল্পনা করা হয়েছে একটা পরাধীনতার চেতনা সৃষ্টির তাগিদেই এবং বিশেষত একেবারে সাধারণ মানব অনুভূতিগুলোকে দমন করার নিয়তেই।

গুস্তাভ ল্যান্ডাওয়া

সাধারণ মানব অনুভূতিগুলো হচ্ছে সহানুভূতি ও সংহতি, তা শুধু অন্য মানুষের জন্যই নয়, বরং অসহায় অবস্থায় পতিত ডলফিনের জন্যও। এটি মানুষের খুব সাধারণ একটি প্রতিক্রিয়া। আপনি যদি এডাম স্মিথের মতো ধ্রুপদী রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদদের দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন তারা এটাকে মানব প্রকৃতি ও সমাজের মূল হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। বিজ্ঞাপন ও শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অভিনিবেশ হচ্ছে এটাকে আপনার মাথা থেকে বের করে দেয়া। এবং এটা খুব স্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে আজকাল আমাদের চোখের সামনে উপস্থিত সামাজিক পলিসির মধ্যেই এটি স্পষ্ট। সামাজিক নিরাপত্তা (Social Security) ধ্বংসের চেষ্টার কথাই ধরুন। আচ্ছা, এর কারণটা কী? অর্থনৈতিক সমস্যা বিষয়ে অনেক কেলেঙ্কারি আছে, এসব অনর্থক কথাবার্তা। এবং অবশ্যই তারা অল্প সময়ে ও স্বল্প প্রচেষ্টায় প্রচুর অর্থোপার্জন করতে ওয়াল স্ট্রিট চায়। এসবের মূলে গভীরতর কিছু একটা আছে। সামাজিক নিরাপত্তার ভিত্তি মূলত একটি সহজাত মানব-অনুভূতি। এই যে আপনি অন্যের সম্পর্কে উদ্বিগ্ন থাকেন এটাই সেই মানব-অনুভূতি যা মাথা থেকে বের করে দিতে হবে। আপনি অন্যের প্রতি উদ্বিগ্ন থাকেন। এটি সামাজিক ও সম্প্রদায়গত দায়িত্ব যে শহরের একজন অক্ষম বিধবা খাবার পাচ্ছে কি না তার খোঁজ নেয়া, বা রাস্তার পাশের একটা বাচ্চা স্কুলে যেতে পারছে কি না তার খোঁজ নেয়া। আপনাকে এই বিষয়গুলো মানুষের মাথা থেকে বের করে দিতে হবে। আপনি তাদেরকে বলতে বাধ্য করতে হবে যে, ‘দেখো, তুমি নিজের সম্পদ বাড়াও, এটাই যৌক্তিক। যদি ঐ অক্ষম বিধবা নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে না পারে সেটা তার দোষ, তোমার না। সে পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না তা তো আর তোমার দোষ না, তুমি কেন খামোখা উদ্বিগ্ন হচ্ছ?’

তখন তাহলে সমাজ বলতে কিছু থাকছে না, আপনি কি এটাই বলতে চাচ্ছেন?

চমস্কি: হ্যাঁ। এখানে আপনি অন্য কারও কথা না ভেবে কেবল সম্পত্তিটাই বাড়াচ্ছেন এবং নিজেকে ক্ষমতার অধস্তন করছেন। এবং এর একটা প্রভাব আছে। আপনি সেটি মনোভাবের মধ্যেই দেখতে পারবেন। এখন আপনার কথায় ফিরে আসি, এটা তাদের জন্যও সত্য যারা সমাজকে পরিবর্তন করে আরও ভালো রূপে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, আপনাকে জনগণের চৈতন্য ও সচেতনতাকে নিয়েই কারবার করতে হবে এবং, যা আমি বলছিলাম, প্রতিটি সংগঠকই তা জানেন। চমৎকার উদাহরণ হিসেবে নারী আন্দোলনের কথাই ধরুন। এটি সচেতনতা-বৃদ্ধিকারী গোষ্ঠীদের দিয়েই শুরু হয়েছিল। যেখানে লোকেরা একে অপরের সাথে কথা বলেছেন এবং তাদের জীবনের এমন কিছু উপাদান বের করে নিয়ে এসেছেন যেগুলো সম্পর্কে তারা বোধহয় ওয়াকিবহাল না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফ্যাক্টরিসহ সবজায়গার বেলাতে এটি সত্য। এটি কীভাবে বছরের পর বছর কাজ করেছে তা খুবই বিস্ময়কর। শিল্প বিপ্লবের শুরুর দিনগুলোতে ফিরে যান, এই লোয়েল, লরেন্সে দেখেন, যেখানে টেক্সটাইল মিলগুলো তৈরি করা হয়েছিল। শুরুর দিকে কারখানাগুলোতে যারা এসেছিল, যেমন ক্ষেতখামার থেকে আসা যুবতী, বস্তি থেকে আসা আইরিশ কারিগর ইত্যাদি, তাদের সকলের মধ্য অত্যন্ত রেডিক্যাল চেতনা বিরাজ করছিল, যা খুব স্বাভাবিক ছিল। তারা কখনো মার্ক্স পড়েননি, ইউরোপিয়ান র‍্যাডিকালিজম সম্পর্কে কোনো জ্ঞানও ছিল না, এনার্কিজম বা এমন কিছুর নামও শোনেননি। এটি খুব সহজাত বোঝাপড়া। তাদের খুব স্বাধীন একটি প্রেস ছিল– যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সেই স্বাধীন প্রেস কিছু বিষয় নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছিল, (taken for granted) যেমন মজুরি প্রায় শ্রম দাসত্বের মতোই, যারা কারখানায় কাজ করে কারখানা তাদেরই হওয়া উচিৎ, ‘আমাদের কী করতে হবে তা বলার জন্য এই হুজুরদের (boss) কী দরকার?’, ‘এই কারখানা ব্যবস্থা, শিল্প ব্যবস্থা আমাদের সাংস্কৃতিক মান ও সৃষ্টিশীল অনুভূতিগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, এবং আমাদেরকে রোবট বানিয়ে দিচ্ছে’, ইত্যাদি। এই সবকিছুই তারা বুঝেছিল, নিশ্চিত বলে ধরে নিয়েছিল। আপনি আজকে আশেপাশের কোনো শ্রমিক শ্রেণির কাছে যান, এটা পাবেন না। কিন্তু এটা এমন কিছু না যে তাদের শেখাতে হবে, বরং এটা তাদের অন্তঃস্থিত স্বভাব থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে যা খুব সচেতনভাবে দমন করা হয়েছে।

এটা যে কতটা সচেতন প্রয়াস তা অবাক করার মতো। প্রায় শতবর্ষ পূর্বে ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে টেলোরিজম চালু করা হয় – ফ্রেডরিক টেলোরের নামানুযায়ী। মূলত তা শ্রমিকদের রোবটে পরিণত করে যেন তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সুতরাং, তাদের আর কোনো পছন্দ-অপছন্দ রইল না, এবং তারা মূলত রোবটেই পরিণত হয়। বাদবাকি সবকিছুর মতোই এটাও মিলিটারি ব্যবস্থাতেই শুরু করা হয়, কারণ আপনি এখানে জনগণের খরচে ও ঝুঁকিতে ব্যয়-মুক্ত পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে পারেন। তারপর অচিরেই এটি ইন্ডাস্ট্রিতে, মাস-প্রডাকশন সিস্টেমে নিয়ে আসা হয়। লেনিন এই পদ্ধতিতে খুব মোহিত হয়েছিলেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপকের মতো লেনিনও প্রায় একই ধারণা পোষণ করতেন এবং ধারণাটা ছিল কাজের যান্ত্রিকীকরণ (robotize)। কিন্তু ১৯২০ সাল নাগাদ তারা খুব দ্রুতই আন্দাজ করতে পেরেছিল যে, এই ‘অন-জব-কন্ট্রোল’কে বর্ধিত করে ‘অফ-জব-কন্ট্রল’ পর্যন্ত করা যায়। মানে একইভাবে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রও নিয়ন্ত্রণ করা। সুতরাং মানুষ কেন রোবট হবে না? এবং রোবট হয়ে যাওয়া মানে আসলে জীবনের উপরিভাগ বলতে যা বুঝায় সেদিকেই মনযোগকে ধাবিত করা। যেমন মনযোগ হবে ফ্যাশনেবল ভোগের ব্যাপারে। মনযোগটা অন্যের প্রতি দরদের দিকে নয়, একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টিতে নয়, বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্য কেমন পৃথিবী হবে সেদিকেও নয়। আপনাকে নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত করা হবে, যিনি কয়েক বছর পরপর বোতামে চাপ দিয়ে আসবেন এবং বলা হবে যে এটাই গণতন্ত্র। চিন্তা করার দরকার নেই, শুধু আদেশ অনুসরণ করুন। যে পরিমাণ অনর্থক ভোগ আপনি করে যেতে পারেন তার দ্বারাই মানুষ হিসেবে আপনার মূল্য নির্ধারণ করা হবে। এটাই ‘অফ-জব-কন্ট্রোল’। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে এটি চালু আছে এবং এটি বিশাল একটি ইন্ডাস্ট্রি। এবং এই ‘অফ-জব-কন্ট্রোল’ কাটিয়ে উঠতে চাইলে মানুষকে বোঝাতে হবে যে, আপনি কত বেশি ধার-দেনা করেছেন এবং চাহিদানুযায়ী পণ্য জোগাড় করতে আপনার সর্বোচ্চ কয়টা ক্রেডিট কার্ডের দরকার এসব দিয়ে মানুষ হিসেবে আপনার মূল্য নির্ধারিত হয় না। মানুষ হিসেবে এটি আপনার মূল্য নয়। যেকোনো সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আপনি শপিং মলে গেলে দেখবেন অল্প বয়স্ক বাচ্চারা, বিশেষত অল্প বয়েসি মেয়েরা মজা করার  জন্য কোনো কিছু না কিনে দোকানে দোকানে ঘুরাফিরা করে (window-shopping)। আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, তারা যদি এটা করতে চায় আপনি তাদের এটা করতে মানা করতে পারবেন না, কিন্তু এটি আপনাকে দেখাবে যে, এই ‘অফ-জব-কন্ট্রোল’ মানুষের চেতনকে যেভাবে পরিবর্তিত করেছে তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর।

এর সাথে যুক্ত করি, আপনি যখন এনার্কিজমের ইতিহাসের দিকে তাকান তখন আমার মনে হয় এর অন্যতম লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সবচেয়ে জনপ্রিয় সময়েই এগুলো প্রায় সংগঠিত বা অর্গানিক আন্দোলনই ছিল সমাজের প্রয়োজনেরই জবাব দিচ্ছিল যেমন, ১৮৯০ সালে নিউইয়র্কে ইহুদি নৈরাজ্যবাদীদের আন্দোলন, অবশ্যই স্পেনের উদাহরণ আছে, আর্জেন্টিনার কথা আপনিই বলেছেন, আছে ফ্রান্স এই সমাজ কি এখন প্রযুক্তির মতো জিনিস ধ্বংস করে দিচ্ছে না? আমি বা আপনি যে ধরনের সমাজে বড়ো হয়েছি এখন সাইবারস্পেসে এর চেয়ে বেশি সমাজ আছে আমি নিজে বেড়ে উঠেছি কয়লা খনির সম্প্রদায়ের মধ্যে, যেখানে সবাই সবাইকে চিনত হ্যাঁ, এখানেও উত্তেজনা ছিল, কিন্তু সম্পর্কের বোধটাও ছিল এটা কি খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে না এবং প্রযুক্তি কি এটাকে বিদায় করতে সাহায্য করছে না?

চমস্কি: আমার দৃষ্টিতে প্রযুক্তি খুব নিরপেক্ষ যন্ত্র। এটি এই দিকে যেতে পারে, বিপরীত দিকেও যেতে পারে। প্রযুক্তিকে কোনো পরিচালক ছাড়াই কোনো কারখানায় কর্মক্ষমদের চালাতে সহায়তা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রের লোকদের তাৎক্ষণিক তথ্য সরবরাহ করতে পারে যেন তারা অন্যদের সাথে মিলে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। এটাও প্রযুক্তির আরেক ধরনের ব্যবহার। অবশ্য এই প্রযুক্তি বিকাশিত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এটা কীভাবে কাজ করবে তা নিয়ে বেশ চমৎকার কিছু গবেষণা রয়েছে। চমকপ্রদ এক গবেষণা করেছিলেন ডেভিড নভেল, তিনি এখানেই (MIT) ছিলেন, কিন্তু তিনি একটু বেশিই রেডিকাল ছিলেন। তিনি একটি দুর্দান্ত কাজ করেছিলেন। তার গবেষণার অন্যতম বিষয় ছিল নিউমেরিকাল কন্ট্রোল– কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যান্ত্রিক হাতিয়ার উৎপাদন– এই জাতীয় জিনিস। জনগণের খরচেই তা সামরিক ব্যববস্থাতে গড়া হয়েছিল। কিন্তু এটির নকশা করা হয়েছিল এমনভাবে যেন এর ব্যবহার ব্যবস্থাপকের ভূমিকাগুলোকে (managerial roles) দূর করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দক্ষ কারিগরদের হাতে তুলে দিয়েছিল যারা আসলে জানেন তারা কী করছেন। সাধারণত এই মানুষেরা অফিসের উপরের দিকে থাকা লোকদের চেয়ে বেশি জানেন। আমি নিশ্চিত এটা কয়লা খনির কাজের বেলাতেও সত্য। সুতরাং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তাদের হাতে দেয়ার মতো প্রযুক্তি তৈরি করা যেতে পারে। গবেষণা দেখিয়েছে যে এটি লাভ আরও বাড়িয়ে তুলবে। কিন্তু এটি করা হলো একেবারে উল্টোভাবে, যে পদ্ধতি ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের (management control)  মাত্রা আরও বৃদ্ধি করেছে। এটি খুবই অকার্যকর এবং কারিগরদের অদক্ষ বানিয়ে এদের রোবটে পরিণত করছে যারা এখন শুধু বোতাম টিপে চলে। আসলে প্রযুক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করবেন এটা আসলে আপনার ইচ্ছার ব্যাপার এবং এটি একটা শ্রেণিসংগ্রামের মতোই। তবে প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত প্রকৃতির সাথে এর কোনো যোগসূত্র নেই। তবে আপনি যে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন তা একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়। আমি জানিনা এর থেকে আসলে কী ফল আসবে, কিন্তু এটা সত্য যে এখন অনেক ভার্চুয়াল সমাজ গড়ে উঠেছে যেগুলো খুবই বাস্তব। আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমি আমার কাছের ৯৫ ভাগ বন্ধুদেরকে কখনো দেখিনি, কিন্তু ইন্টারনেটে আমরা সবাই সারাক্ষণ একে অপরের সাথে যোগাযোগ করি। এবং আমার এই বয়সে আমার কাছে এটি পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়, কিন্তু আমি যখন আমার নাতি-নাতনিদের এটি করতে দেখি তখন আমি তা পছন্দ করি না। আমার মনে হয় মুখোমুখি যোগাযোগের বিষয়ে অনেক কিছু তাদের জানার দরকার আছে।

আমার ছেলে ইন্সট্যান্ট মেসেজিং করে এবং সে এমন অনেকের সাথেই মেসেজ আদান-প্রদান করছে স্কুলে থাকাকালীন যাদের সাথে খুব একটা কথাই বলেনি এটা নিরপেক্ষ কাঠামো প্রদান করছে, কিন্তু প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই কারণ আমি চাই সে কথা বলুক এবং কথোপকথন করুক …

চমস্কি: আমি আপনার সাথে একমত। ছোট বাচ্চাদের উপর এটা কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা আমি জানি না। মানে তারা একটি কাল্পনিক জগতে বাস করে। এবং এমনকি তারা কথোপকথন করছে এমন কিছু মানুষের সাথে যারা ভুয়া ব্যক্তিত্ব গ্রহণ করেছে। যখন বাচ্চারা ডানজিয়নস এন্ড ড্রাগনস খেলত… মানে, ঠিক আছে, আমি পছন্দ করতাম না, কিন্তু এতে খুব ভুল কিছুও দেখতাম না। অন্যদিকে যখন আপনার জীবনের একটা বড়ো অংশই একটা কাল্পনিক জগতে বসবাস করে এমন কিছু চরিত্রের সাথে যাদের আপনি সৃষ্টি করেছেন এবং যাদেরকে তারা নিজেরাই সৃষ্টি করেছে, এবং তাদের সাথে আপনার কখনো মুখোমুখি যোগাযোগ হয় না, এর তো একটা মানসিক প্রভাব থাকবে, যা আমার মনে হয় না আমরা বুঝতে পারছি। এটি খুব অমঙ্গলকর হতে পারে…

আরেক ধাপ সামনে যাই, আপনি জানেন যে গত ১০ বছর যাবত নৈরাজ্যবাদে আরেকটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যাকে আমরা বলি আদিমতাবাদ (primitism) তারা এটিকে বলছে অ্যানার্কো-প্রিমিটিজম। বলছে যে, পুঁজিবাদ এতই পচে গিয়েছে, পুঁজিবাদের প্রযুক্তি এতই ধ্বংসাত্মক যে এই পুরো বিষয়টা থেকেই আমাদের মুক্ত হওয়া উচিৎ এটি এতই ধ্বংসাত্মক, এতই ক্ষতিকারক, এতই ভয়াবহ যে এটি কেবল মানুষের ক্ষতিই করছে সুতরাং, এর থেকে মুক্ত হয়ে এবং একধাপ পেছনে গিয়ে, বা তাদের ভাষায় সামনে গিয়ে, আরও বেশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া দরকার এটি কি সম্ভব?

চমস্কি: আপনি জানেন যারা এইসব বলছেন তাদের প্রতি আমার সহানুভূতি রয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় না তারা বুঝতে পারছেন যে, বর্তমানে সমাজ যেভাবে কাঠামোগত ও সংগঠিত সেখানে তারা আসলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে গণহত্যার কথা বলছেন। আপনি যদি এই কাঠামো নির্মূল করে দেন, সবাই মারা যাবে। যেমন আমি আমার নিজের খাবার ফলাতে পারবো না। এটি ভালো ধারণা কিন্তু তা এই দুনিয়াতে কাজ করবে না। এবং বাস্তবে আমরা কেউ শিকারি-সংগ্রহকারী জীবনযাপন করতে চাইব না। এমন অজস্র জিনিস আছে যেগুলো আধুনিক বিশ্ব আমাদের দিচ্ছে। সহজ সরলভাবে বেঁচে থাকার নামে তারা যা আহ্বান করছে তা আসলে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য গণহত্যা। এবং যদি এই বিষয়গুলো বিবেচনায় না এনে চিন্তা করা হয়ে থাকে, তাহলে এসবকে পাত্তা দেয়ার কিছু নেই।

দানিয়েল গ্যারাঁ

হ্যাঁ আমি একমত ইউরোপের অনেক লোকই আপনার সাথে পরিচিত হয় দানিয়েল গ্যারাঁর বই Anarchism-এর ভূমিকার মাধ্যমে একে প্রেস তার ‘নো গডস, নো মাস্টার্স’ বইটা ইংরেজিতে প্রকাশ করেছে… 

চমস্কি: হ্যাঁ, বইটা শেল্ফেই রাখা রয়েছে।

এটি একটি দুর্দান্ত বই স্পষ্টতই, নৈরাজ্যবাদের (anarchism) সর্বোত্তম দিকগুলো ও সমাজতন্ত্রের (socialism) সর্বোত্তম দিকগুলো মিশিয়ে মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের (Libertian Socialism) দিকেই গ্যারাঁর বেশি আগ্রহ ছিল আপনার কি মনে হয় যে, এই দুটো শব্দ– মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র ও নৈরাজ্যবাদ সমার্থক, নাকি এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে?

চমস্কি: আমি জানি না আমরা আসলেই এটা বলতে পারব কি না, কারণ রাজনৈতিক ডিসকোর্সের শব্দগুলো খুব একটা ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত নয়। পুঁজিবাদ, বাণিজ্য, রাষ্ট্র, যে কোনো একটি নেন … এগুলো খুবই আলগা শব্দ। ঠিক আছে, তবে যদি আপনার কাছে এই শব্দসমূহের ব্যাখ্যামূলক তত্ত্ব না থাকে তাহলে এগুলোকে সতর্কভাবে সজ্ঞায়িত করার কোনো মানে হয় না। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, আমরা আসলে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। নৈরাজ্যবাদের ব্যপ্তি অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত, মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের ব্যপ্তিও অনেকদূর পর্যন্ত প্রসারিত। তবে তিনি যা করার চেষ্টা করেছিলেন তার প্রতি আমি সহানুভূতি প্রকাশ করি। আমার মনে হয় এটাই সঠিক বিষয়। আপনি যদি সতর্কভাবে দেখেন এই দুটো শব্দ খুবই নিকটবর্তী। তাদের যেমন মিল আছে, তেমনি সম্পর্কও আছে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বামদের মধ্যে যারা যত বেশি রাষ্ট্রবিরোধী ও ভ্যানগার্ডবিরোধী– মার্ক্সবাদী আন্দোলনের কথাই ধরুন– আন্তন প্যানেককদের মতো যারা আছেন– এদের সাথে এনার্কো-সিন্ডিকালিস্টদের প্রচুর মিল রয়েছে। এনার্কো-সিন্ডিকালিস্টদের সমাজকে সংগঠিত করা সংক্রান্ত ধারণা ও প্যানেককের ওয়ার্কাস কাউন্সিলের মধ্য পার্থক্য খুঁজে বের করা খুব দুরূহ কাজ। কিছু পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু  মানুষ যখন বন্ধুসুলভ সম্পর্কের মধ্যে কাজ করে তখনো একধরনের পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। সুতরাং হ্যাঁ, আমার মতে এটি বেশ বিচক্ষণ মিশ্রণ। এই ধরনের আন্দোলনের সাথে বলশেভিজম ও কর্পোরেট পুঁজিবাদের মতো সর্বাত্মকবাদ (Totalitarianism) রূপের প্রচুর পার্থক্য বিদ্যমান। এখানে আপনি আলাদা করতে পারেন। সর্বাত্মকবাদী কাঠামো একদিকে, মুক্ত সমাজ অন্যদিকে। প্রকৃতপক্ষে আমি মনে করি মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র ও নৈরাজ্যবাদের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ মিল রয়েছে, এবং এই দুটোকে মিশিয়ে ফেলাটা জন ডিউয়ের মতো মূলধারার চিন্তাবিদদের মধ্যেও দেখা যায়।

আমি জানি তিনি স্টেলটন ও দ্যা মডার্ন স্কুল দ্বারা খুব প্রভাবিত ছিলেন এবং তাঁদের কাছ থেকে তিনি অনেক ধারণা ও চিন্তা নিয়েছিলেন…

চমস্কি: তাঁর মূল অভিমত ছিল যে, আমরা যদি রাজনৈতিক ও শিল্পজাত (industrial) সামন্ততন্ত্রকে উপড়ে ফেলে এটিকে শিল্পজাত গণতন্ত্রে পরিণত করতে না পারি– মানে পুরোপুরি শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারি– তাহলে এই পুরো প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আসলে খুব কাজের কিছু না। এবং তিনি একেবারে মূলধারার আমেরিকান ইতিহাস থেকেই উঠে এসেছেন। তিনি একেবারে খাঁটি আমেরিকান।

আপনার লেখা পড়ার মারফতেই জানি যে, আপনি বামপন্থী কমিউনিস্ট প্যানেকক ও গোর্টার দ্বারা বেশ প্রভাবিত আমি ধরে নিচ্ছি, আপনি এসবের বিপদগুলোকে টের পাচ্ছেন না, যেমন ওয়ার্কাস কাউন্সিল বা প্যানেকক বা গোর্টারের কাজও একধরনের সর্বাত্মকবাদের দিকেই ঝুঁকে পড়ে আপনি কি মনে করেন এদের থেকে পার্থক্য

চমস্কি: না, আমি মনে করি এতে প্রচুর বিপদ আছে। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতিও (participatory economics) সর্বাত্মকবাদের দিকে পরিচালিত করতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে। আমরা সবাই আন্দোলনের সভায় গিয়েছি, আমরা এই চালিকাশক্তিটির (dynamics) ব্যাপারে জানি। আপনি কী কাজ করছেন তা কোনো বিষয় না, সেটা এক কোণে ট্রাফিক লাইট জ্বালানো হতে পারে বা ভিয়েতনামের যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সভা করা হতে পারে বা তা যাই হোক না কেন… সবখানেই সভা হয়ে থাকে এবং বিরক্তিকর ক্রিয়াকলাপ সহ্য করার মাত্রানুযায়ী আমরা একেকজনের চেয়ে আলাদা। কেউ কেউ খুব দ্রুত সরে যায়–  যেমন আমি। আমি  এসবের অনেককিছুই সহ্য করতে পারি না। অন্য ব্যক্তিরা মূলত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করতে নিজেদের সঁপে দেয়। এখানে একটা সহজাত চালিকাশক্তি(dynamic) থাকে যা সবচেয়ে মুক্ত, সহায়ক ও উদারপন্থী কাঠামোও কর্তৃত্ববাদে পরিণত করতে পারে, কেবল এই কারণে যে, চারদিকে যে ঘুরঘুর করছে যেন যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে ফেলে যতক্ষণ না পর্যন্ত অন্যান্যরা অন্যকিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। এগুলো সর্বদাই বিপজ্জনক।

শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা ব্যক্তিই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে

চমস্কি: এবং আমরা সবাই এর সাথে পরিচিত; বন্ধুদের মহলে, কিংবা অন্য কাজের সমমনা ব্যক্তিদের মহলে। সুতরাং হ্যাঁ, এই সমস্যাগুলো সর্বদাই মোকাবিলা করতে হয়। এটা প্রতিরোধ করার কোনো জাদুকরী কৌশল (ম্যাজিক ফর্মুলা) জানা নেই।

এর সাথে যুক্ত করি, সামাজিক পরিবর্তন ও নৈরাজ্যবাদে শ্রেণির ভূমিকা সম্পর্কে আপনার কী মত?  কোনো সন্দেহ নেই যে, আমেরিকায় নৈরাজ্যবাদের মধ্যে, মানে কিছু নতুন নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে, শ্রেণিকে অতীতের বিষয় হিসেবে দেখার একটি প্রবণতা আছে এটি আর পরিবর্তনের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কেন্দ্রে নেই

চমস্কি: এদের মধ্যে কয়জন লোক আপনার কয়লাখনিতে বা কারখানাতে বা ডাটা প্রসেসর হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছে? যদি এগুলো আপনার চাকরি হয়ে থাকে, তবে শ্রেণি নিয়ে আপনার কোনো সমস্যা নেই। আপনি জানেন কে বস, এবং কে আদেশ দেন ও কে আদেশ গ্রহণ করেন। কারা আদেশ দেন এবং কারা আদেশ নেন এসবের বাইরে পুঁজি যে কেন্দ্রীভূত থাকে তা আপনি বুঝতে পারেন। এবং সেগুলোই শ্রেণি পার্থক্য। অন্য কোনো ডোমেইন থেকে আপনি বলতে পারেন, ‘আমি তো দেখছি না’, কিন্তু আপনি যখন সমাজে বসবাসরত ও কর্মরত মানুষের বাস্তব জীবনে প্রবেশ করবেন তখন আমার মনে হয় না তাদের এই শ্রেণি পার্থক্য ও এর গুরুত্ব বুঝতে খুব একটা মুশকিল হয়। আদেশ দেয়া ও আদেশ গ্রহণ করার মধ্যে অনেক  বড়োসড়ো পার্থক্য রয়েছে। এমনকি এও সত্য যে, যারা আদেশ দিচ্ছেন তারা অন্যখান থেকে আদেশ নিচ্ছেন। এটাই সর্বাত্মকবাদী ব্যবস্থার চরিত্র। এমন না যে একেবারে উঁচুতে যিনি বসে আছেন তিনি তলানিতে থাকা লোকদের আদেশ দিচ্ছেন: এই আদেশ আদান প্রদানের সংক্রমণের কয়েকটি স্তর রয়েছে। ব্যবস্থাপনাবাদ তদারকি ও বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্তর মৌলিক শ্রেণিভেদের দিকে ধাবিত করে। এমন প্রচুর লোক রয়েছে যাদেরকে আদেশ গ্রহণ করতেই হবে, নাহলে না খেয়ে মরতে হবে। কোনো উপায় নেই। প্রকৃতপক্ষে আমরা শ্রেণি বিষয়টাকেই সবসময় উঠে আসতে দেখছি।

আন্তন প্যানেকক

আউটসোর্সিং এর মতো বাস্তবিক ইস্যুর কথাই ধরুন। আউটসোর্সিং সম্পর্কে মানুষের মনোভাব কেমন হওয়া উচিৎ? পরস্পরবিরোধী বোধ আছে। প্রথমত, আউটসোর্সিং খুবই বিভ্রান্তিকর একটি শব্দ। আউটসোর্সিং সর্বাত্মকবাদী ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ। যদি জিএম আউটসোর্স করে, এর অর্থ তারা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এমন কিছু সংস্থায় চাকরি স্থানান্তর করছে যারা শ্রম আইন, পরিবেশগত বাধা ইত্যাদি থেকে বেঁচে যেতে সক্ষম এবং উৎপাদনের পরবর্তী পর্যায়ের জন্য সস্তায় যোগান সরবরাহ করবে। কিন্তু এগুলো কমান্ড অর্থনীতির ভেতরকার বিষয়। আউটোসোর্সিং একটা ভণ্ডামির মতো। মুক্ত বাজারের সাথে এর কিছু সম্পর্ক রয়েছে। কমান্ড অর্থনীতির ভেতরের কাজকারবারের সাথে এটি সম্পর্কযুক্ত। তবে এর প্রতি আমাদের মনোভাব কেমন হওয়া উচিৎ? যেহেতু ভারত বা চীন থেকে আপনি ১০ শতাংশ ব্যায় করে শ্রমিক পাচ্ছেন যার ফলে আপনি চাকরি হারাচ্ছেন, সেহেতু, আমাদের এটার পক্ষে না বিপক্ষে থাকা উচিৎ?

হ্যাঁ, উভয় দিকেই যুক্তি দেয়া যায়। কিন্তু আমি মনে করি দুটোই বিভ্রান্তিকর, কারণ এরা এমন একটি কাঠামো (framework) গ্রহণ করছে যা আমাদের গ্রহণ করা উচিৎ নয়। আমি বলতে চাইছি, যদি আপনি এই কাঠামো মেনে নেন যে, সর্বাত্মকবাদী কমান্ড অর্থনীতির এইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার রয়েছে, এবং যদি মজুরির স্তর ও কাজের শর্তগুলো স্থির অবস্থা হয়, তাহলে আমাদের এইসব অনুমানের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তখন আপনি এই যুক্তি দিবেন যে, এখানকার দরিদ্রদের অন্য জায়গার দরিদ্রতর মানুষদের কাছে চাকরি হারনোটাই উচিৎ… কারণ এটা ইকনোমিক পাই এর প্রবৃদ্ধি ঘটায়, এবং এটাই প্রচলিত। কেন এই অনুমান? সঙ্কটটি মোকাবেলার অন্য উপায়ও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ধনী ব্যক্তিদের কথা ধরুন। আমার মতো যারা আয়ের সিঁড়ির শীর্ষ কয়েক শতাংশের মধ্যে আছেন তাদের কথাই ধরুন। আমরা আমাদের বিলাসবহুল জীবনধারা কমাতে পারি, যথাযথ কর পরিশোধ করতে পারি, এমন অনেক কিছুই আছে। আমি এমনকি বিল গেটসদের কথাও বলছি না, বরঞ্চ বলছি যারা যৌক্তিকভাবেই সুবিধাপ্রাপ্ত। দরিদ্র লোকদের উপর বোঝা চাপানোর পরিবর্তে যদি বলি, মানে, ‘আপনি দরিদ্র আপনাকে চাকরি ছাড়তে হবে, কারণ অন্য জায়গায় দরিদ্রতর লোকদের এই চাকরি দরকার’ এটা না বলে যদি বলি, ‘আমরা ধনীরা আমাদের বিলাসবহুল জীবনের ছোট একটা অংশ ছেড়ে দেব এবং অন্য জায়গার মানুষের জীবনমান ও কাজের পরিস্থিতি উন্নয়নে এটার ব্যবহার করব, যেন তারা নিজস্ব উপায়ে নিজেদের অর্থনীতির বিকাশে পর্যাপ্ত পুঁজি পেতে পারে’। তাহলে এই বিষয়টি আর উঠবে না। কিন্তু এটা বলা বেশি সুবিধাজনক যে, কমান্ড অর্থনীতি, সর্বাত্মকবাদী কাঠামোর আওতায় দরিদ্র লোকদেরই এই ভার বহন করা উচিৎ। কিন্তু আপনি যদি তলিয়ে চিন্তা করেন তাহলে এটি বোধগম্য হবে যে প্রায় প্রতিটি সামাজিক ইস্যুরই এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। চিন্তা ও মনোভাবের আধিপত্যের এই যে কাঠামো যা শুধু নির্দিষ্ট কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুমতি দেয় এবং এই সিদ্ধান্তগুলো সবসময়ই দরিদ্রদের উপর বোঝা চাপিয়ে দেয়, সে কাঠামোকে আমরা গ্রহণ করব না, করা উচিতও না। এটাই শ্রেণি সংগ্রাম। এমনকি আমাদের মতো ভালো মানুষ যারা মনে করি দরিদ্র শ্রমিককে সাহায্য করা ভালো, তারাও এই শ্রেণিসংগ্রামের কাঠামোর মধ্যে বিশেষাধিকার বজায় রাখি এবং ভারটা দরিদ্রদের উপর চাপিয়ে দিই। এটি আসলে ভদ্র লোকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়।

আরও একটি গুরুতর প্রশ্ন ১৯০০ এর দশকে লিখিত এক প্রবন্ধে ভোল্টায়রিন ডি ক্লেয়ার আরও ভালো এক দুনিয়ার দিকে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের আশাবাদ ব্যক্ত করছিলেন এবং তারপর তিনি এই শাসকদের কথা বললেন যারা এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করছেন যে, তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে আমরা কি এখনো এমন অবস্থায় আছি যেখান থেকে আরও মুক্ত, আরও ভালো এক দুনিয়ায় শান্তিপূর্ণ স্থানান্তর সম্ভব, নাকি সময়ের সাথে এর সম্ভাবনাও কমে যাচ্ছে?

চমস্কি: আসলে কেউ জানে না। কিন্তু আমার মনোগত, স্বল্প-বিশ্বাসযোগ্য মত হচ্ছে যে, শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের সম্ভাবনা অতীতের তুলনায় এখন আরও বেশি। এর কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্র ও কর্পোরেট শক্তির দমনমূলক হাতিয়ার হ্রাস পেয়েছে। আপনি এখন পিংকারটন দারোয়ানদের দিয়ে ধর্মঘট ভাঙতে পারবেন না। এটা করে আপনি বেশি দূরে যেতে পারবেন না। ন্যাশনাল গার্ড দিয়ে আপনি হোমস্টেডের মতো শ্রমিক শ্রেণির শহরগুলোকে ধ্বংস করতে পারবেন না। এগুলোই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। দমন যাতে কমে তার জন্য যথেষ্ট জয়লাভ করা হয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনে কতজন শ্রমিক মারা যাচ্ছেন, এই সাধারণ প্রশ্নটাই দেখুন। ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এটি খুব বেশি ছিল। বাচ্চাকালে আমার মনে আছে, শ্রমিক আন্দোলনে নিরাপত্তা কর্মী, পিঙ্কারটন ও পুলিশের হাতে শ্রমিকরা নিয়মিত মারা যাচ্ছেন। এবং তা এখন বন্ধ হয়েছে। মাঝেমধ্যে হয়তোবা এটি ঘটে, কিন্তু এটি বেশ ভালো একটি পরিবর্তন।

নিউ ইয়র্ক টাইমস এর এমা গোল্ডম্যানের পেপারগুলোর দিকে যদি আমরা নজর দিই, বা ১৮৯০’র দিকের পত্রিকাগুলো যদি দেখি তাহলে দেখা যাবে, প্রতি সপ্তাহেই অন্তত একজন করে শ্রমিক মারা যাচ্ছেন

চমস্কি: আমি বাচ্চাকালে এসব দেখেছি। আমার শৈশবের স্মৃতি আছে, পুলিশ একটি টেক্সটাইল প্ল্যান্টের নারী আন্দোলনকারীদের উপর প্রবলভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এবং তাদের জখম করছে।  এবং আমি মনে করি না বর্তমানে আপনি এসব করে পার পাবেন। এটি সাধারণ রূপ নিয়েছে। ঠিক যেমনটি ব্রাজিলে সামরিক ক্যু করা আমেরিকার পক্ষে ৪০ বছরের আগের চেয়ে বর্তমানে আরও কঠিন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অনেক কঠিন, অসম্ভবও বলা যায়। কারণ, এমন যথেষ্ট পরিবর্তন হয়েছে যে মানুষ আর এটা গ্রহণ করবে না, এবং ক্ষমতার কাঠামো (structures of power) দ্রবীভূত হয়েছে। আসলে ক্ষমতার অনেকগুলো গড়ন এখন খুব ভঙ্গুর। অনেক কিছুই সরাসরি জোরজবরদস্তি থেকে অনুশাসন (indoctrination), চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণের দিকে ধাবিত হয়েছে। এটি যথেষ্ট খারাপ যে আপনার বাচ্চারা ভয়ঙ্কর টেলিভিশন দ্বারা আক্রান্ত, কিন্তু পুলিশের হাতে মার খাওয়া ও চারদিকে নির্যাতন কেন্দ্রের উপস্থিতির চেয়ে এর অনেক পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং এই পরিবর্তনগুলো আমাদের জানাচ্ছে যে, শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য আরও অনেক বিকল্প রয়েছে।

কিন্তু এটা লড়াইকে আরও জটিল করে তুলছে না? পিঙ্কারটন গার্ডেরা থাকলে তো আপনার শত্রু কে তা অন্তত জানতে পারতেন 

চমস্কি: হ্যাঁ, আপনি জানেন আপনার শত্রু কে। যখন এই ভয়াবহ কর্পোরেশনের বন্ধুসুলভ কার্যনিবাহী দাবি করছেন যে, তিনি আপনার পাশেই আছেন, তখন এটা কঠিন। কিন্তু এর মানে এই না যে, এটি অসম্ভব। দুই দিন আগে আমি হার্ভার্ডে যুব লেবার এক্টিভিস্টদের একটি বড়ো দলের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছিলাম। ইলাইনে বার্নার্ড নামের এক দুর্দান্ত ব্যক্তি এই দল পরিচালনা করেন। তিনি বাস্তবিকই প্রগতিশীল, উদ্যমী লেবার এক্টিভিস্ট, নারীবাদী, এক কথায় দুর্দান্ত। হার্ভার্ডে তরুণ শ্রমিক নেতাদের নিয়ে আসার এই কর্মসূচি শুরু হয়েছিল ১৯৪০ সালের দিকে। রেডিকাল শ্রমিক আন্দোলন (labor action) যা দেশে বিপ্লব ঘটানোর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল সেই বাস্তব হুমকি আমলে নিয়ে কর্পোরেট একাডেমিক প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে এই কর্মসূচি শুরু হয়েছিল। অবস্থান ধর্মঘট (sitdown strike) কারখানা দখল থেকে একটু দূরে ছিল। এটি খুব নিকটবর্তী ছিল। যেহেতু পিঙ্কারটন গার্ড ও পুলিশের পক্ষে এই ধর্মঘট ভাঙা কঠিন হয়ে পড়ছিল, সেহেতু এটিকে আটকানোর কৌশলের অংশ হিসেবেই ধরে নেয়া হলো যে, আপনাকে আসলে তরুণ শ্রমিক নেতৃত্বের বেড়ে উঠাকে সামাজিকীকরণ করতে হবে (socialize), এদেরকে সভ্য করে তুলতে হবে, এবং হার্ভার্ডে নিয়ে এসে শিক্ষা দিতে হবে। এবং হার্ভার্ড যে কাজে ওস্তাদ, তাই করুক। প্রকৃতপক্ষে হার্ভার্ড আসলে তার নিজের শিক্ষার্থীদের সাথে কী করে? কীভাবে মার্জিত কথোপকথন করতে হবে, শ্রেণি সংহতি বজায় রাখতে হবে, কোনো ওয়াইনটা পান করতে হবে, সঠিক মনোভাব ও সম্পর্ক বেছে নিতে হবে এই শিক্ষা দেয়। এই তরুণদের (লেবার এক্টিভিস্ট) এখানে নিয়ে আসেন, তারা দেখবে ‘আমরা সকলেই বন্ধু’ এবং আমরা সবাই একই জিনিস করছি। বছরের পর বছর এটি এভাবেই চলছিল। এবং তারপর ইলাইনে বার্নার্ড এসে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এরপর থেকেই এটি রেডিকাল আন্তর্জাতিক লেবার এক্টিভিস্টদের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এটা হয়েছে কারণ, এইসব ধারণা (idea) আসলে সবসময় ছিল, বড়োজোর উপরিতলের একটু নিচেই, এবং যখনই উপরিতলে খোঁচা লেগেছে তখন সব বেরিয়ে এসেছে। এটি খুবই সহজাত এবং অবশ্যই এটিকে হারাতে বহু প্রচেষ্টার দরকার হয়। বর্তমানে হার্ভার্ড প্রোগ্রাম সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং দুনিয়াজুড়ে এর ব্যপক প্রভাবও রয়েছে। এবং সব ধরনের জায়গাতেই এটি করা যেতে পারে, তবে এইসব শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের উপায় (mode)। এবং ইলাইনের নিজের জীবদ্দশাতেই তারা খুব বড়ো পরিবর্তনের দিকে নিয়ে গিয়েছেন।

পরিবর্তন দুই দিকেই হয়েছে। একদিকে যেমন আপনি ১০০ বছর আগের মতো হোমস্টেডকে দমন করতে পারবেন না, অন্যিদকে তেমনি হোমস্টেডের সেই চেতনাও হারিয়ে গেছে। সুতরাং এটি কেবল অগ্রগতি নয়, তবে সেই চেতনার পুনর্নির্মাণ এমন এক ধরনের শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ড যা এখন আমাদের করতে হবে এবং অনেক দিক থেকেই এটি ন্যাশনাল গার্ডের সাথে লড়াইয়ের চেয়ে সহজতর।

শেষ একটি প্রশ্ন, কারণ আমার মনে হয় আমাদের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে আমি অ্যালেক্সান্ডার বার্কম্যানের বই Now and Then: an ABC of Anarchism বইয়ের উপর কাজ করছিলাম, কারণ, একে প্রেস এটি What is Anarchism নামে পুনঃপ্রকাশ করেছে ১৯২০ সালের দিকের তার চিঠিপত্র পড়ছিলাম যখন তিনি এই বইয়ের কাজ করছিলেন এবং তার কাছে এটি খুব কঠিন মনে হচ্ছিল, এই বইয়ের মধ্যে তিনি যে বিষয়গুলো ধরার চেষ্টা করছিলেন তার একটি হচ্ছে , ‘কেন মানুষ এই ধারণায় আসে না? এই ধারণা, যা আমার কাছে একেবারে কাণ্ডজ্ঞান (common sense)… সহমর্মিতা ও সহযোগীতার প্রতি এই সহজাত প্রবৃত্তি? আমি রাশিয়া দেখেছি, এবং আমি সর্বাত্মকবাদের কাজকারবার দেখেছি কেন নৈরাজ্যবাদী ধ্যানধারণা জগতে আরও ব্যপক প্রভাব রাখতে পারছে না?’ এটা বলার প্রায় ৮০ বছর হয়ে গেছে এবং এই প্রশ্নের মুখোমুখি এখনো হতে হচ্ছে, আমরা যারা অন্তত বিশ্বাস করি, যেমন এমা গোল্ডম্যান বলেছেন, ‘নৈরাজ্যবাদ একমাত্র বিশ্বাস যা নর ও নারীকে তাদের প্রকৃত চেহারা (true selves) এবং তারা কী হতে পারবে তা দেখায়’ স্বভাবতই আমরা এটি দেখি ও জানি, তবু এখনো এর প্রভাব একেবারেই সামান্য এটি কি সত্য?

চমস্কি: আমি মনে করি না এটা সত্য যে, এর প্রভাব একেবারে সামান্য। গত শতাব্দীর অনেকগুলোর প্রগতিশীল সামাজিক পরিবর্তন নৈরাজ্যবাদী নয়। বৃদ্ধিশীল কর (Progressive taxation), সামাজিক নিরাপত্তা (Social Security) এগুলো নৈরাজ্যবাদী নয়, কিন্তু এগুলো এমন কিছু মনোভঙ্গি ও বোঝাপড়ার প্রতিচ্ছবি যা, আরও একটু সামনে এগোলেই দেখা যাবে, নৈরাজ্যবাদী প্রতিশ্রুতিই প্রতিফলিত করছে। এগুলো এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য সংহতি, সমাজ(community), পারস্পরিক নির্ভরতা ও পারস্পরিক সহায়তা থাকা উচিৎ। এইসব এগুলোর উপর ভিত্তি করেই হয়েছে। এগুলো বশীভূত, খণ্ডিত ও সংশোধিত আকারে রয়েছে বলে কখনো মুক্তিপরায়ন আকার (libertarian forms) ধারণ করতে পারেনি। কিন্তু এগুলো আছে, এবং এগুলোই সামাজিক পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করছে।

কেন এটি আরও এগোয়নি? এর বড়ো একটা অংশ হচ্ছে সহিংসতা। উদাহরণস্বরূপ বার্কম্যানের রাশিয়ার অভিজ্ঞতার কথাই ধরুন। তিনি প্রবেশ করেছিলেন একটি সহিংস সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে। ক্যু, বিপ্লব যে নামেই ডাকুন না কেন, বলশেভিকরা কর্তৃত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত ইউক্রেনের কৃষকদের নৈরাজ্যবাদ (Peasent anarchism) থেকে শুরু করে সোভিয়েতে ওয়ার্কাস কাউন্সিল পর্যন্ত অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় মুক্তিপরায়ন, কখনো কখনো নৈরাজ্যবাদী উদ্যোগও ছিল। এগুলোকে কেবল জোরজবরদস্তি ও প্রবল সহিংসতার মাধ্যমে ধুলিস্যাত করে দেয়া হয়। লেনিন ও ট্রটস্কি সর্বাত্মকবাদী উগ্রপন্থী ছিলেন এবং এসবের পেছনে তাদের একটি তত্ত্ব ছিল। তারা খুব নিবেদিত মার্ক্সবাদী ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন যে, রাশিয়ার মতো পশ্চাৎপদ ও আদিম দেশ সমাজতন্ত্রে পৌঁছাতে পারবে না কারণ গুরুর নীতি তো তাই বলে। অতএব আমাদেরকে জোর করে মূলত রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী উন্নয়নের মধ্য দিয়ে দেশকে পরিচালিত করতে হবে এবং তারপর অবশেষে কিছু একটা ঘটবে। তারা নির্ভুলভাবে গুরুকে পুনরাবৃত্তি করছিলেন না, রাশিয়ার কৃষিসমাজ সংক্রান্ত তার অধ্যয়নসহ মার্ক্সের বহু বছরের শেষ দিককার কাজগুলোকে এর জন্য দমনের  প্রয়োজন পড়েছিল– আক্ষরিক অর্থেই দমন করা হয়েছিল।

বার্কম্যান ও এমা

আসল কথা হচ্ছে, তাদের হাতে শক্তি ছিল। এটি ধ্বংস করা সহজ ছিল না। মাখনোর আন্দোলন, ক্রোনস্টাড্ট বা সোভিয়েতদের নির্মূলের বিষয়টি বিবেচনা করুন: এটি কোনো মামুলি অভিযান ছিল না। বার্কম্যান তা দেখেছিলেন, এবং তিনি দেখেছিলেন যেভাবে নৈরাজ্যবাদীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সেভাবেই সহিংস সর্বাত্মকবাদী সমাজ উত্থিত হয়েছিল। মানে বাকুনিন তো অনেক আগেই এসব কিছু বলে দিয়েছিলেন। এমনকি ট্রটস্কিও তার শুরুর দিককার কাজে, বলশেভিকে যোগদানের পূর্বে, বলেছিলেন যে এমনই হতে যাচ্ছিল। একই কথা রোজা লুক্সেমবার্গ বা অন্যান্যরাও বলেছিলেন। কিন্তু  এটি ঘটেছিল এবং সেটা ছিল তাদের রূপ। আমাদের রূপটি ছিল ভিন্ন। বার্কম্যান লিখছিলেন উইলসনের লাল ভীতির (Red Scare) পরপরই, যার তুলনায় প্যট্রিয়ট এক্ট কিছুই না। এটি ছিল ‘প্রগতিশীল’ উইড্রো উইলসন ও অন্যান্যদের পরিচালিত হিংস্র দমন নিপীড়ন, এটি কেবল নৈরাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধেই ছিল না, কেবল এমা গোল্ডম্যানের বিরুদ্ধেই ছিল না যাকে বের করে দেয়া হয়েছিল, বরঞ্চ ইউজিন দেবসের মতো একেবারে মূলধারার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ছিল। উইলসন পুরোপুরি প্রতিহিংসাপরায়ন ছিলেন, তাকে জেলে প্রেরণ করা হয় কারণ তিনি উইলসনের যুদ্ধের মাহাত্ম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। উইলসন যেখানে সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন, সেখানে তাকে সাধারণ ক্ষমা দিতে অস্বীকার করেন। এইসব বাস্তবিক অর্থে সমস্ত স্বাধীন চিন্তা ও লেবারকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিল। এর প্রভাব অনেক বেশিই ছিল।

এই সহিংসতার পাশাপাশি জনগণের মনোভাব ও বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিরাটকায় প্রোপাগান্ডার উত্থান হলো, উত্থান হলো জনসংযোগ কৌশলের। এর বাইর আরও একটি সহজ বিষয় আছে: জীবন যেভাবে সংগঠিত তার শৃঙ্খলাজনিত প্রভাব। আজকের শিক্ষার্থীদের কথাই ধরুন। কিছু কিছু দিক থেকে তাদের মনোভঙ্গি, প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি বিষয়ে তারা ৬০ বছর আগের তুলনায় বেশ মুক্ত। অন্যদিকে তারা আরও বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ। তারা ঋণ দ্বারা শৃঙ্খলিত। শিক্ষার বন্দোবস্ত করার জন্য যেহেতু আপনাকে ঋণের বোঝা নিয়ে বের হয়ে আসতে হবে, তাই আপনি শৃঙ্খলিত। গত ২০ বছরের নয়া উদারবাদী জমানার কথাই ধরুন, ‘বিশ্বায়নে’র খুব উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে এটি কেবল শৃঙ্খলার দিকেই নজর দিয়েছে। এটি বাছাইয়ের স্বাধীনতা (Freedom of choice) দূর করতে চায় এবং শৃঙ্খলা আরোপ করতে চায়। আপনি এটি কীভাবে করলেন? হ্যাঁ, আপনি যদি এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত দম্পতি হয়ে থাকেন, টেবিলে খাবার জোগাড় করতে দুজনকেই সপ্তাহে ৫০ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। কীভাবে মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রী হবেন সেই চিন্তা করার মতো সময় আপনার থাকবে না। যখন এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হই যে, ‘আমি কীভাবে খাবার জোগাড় করব’ অথবা ‘আমার বাচ্চাকাচ্চাকে লালন-পালন করতে হবে এবং তারা যখন অসুস্থ হবে তখনো আমাকে কাজে যেতে হবে, তখন তাদের কী হবে’, এগুলো শৃঙ্খলা আরোপ করার খুব সুপরিকল্পিত কৌশল। স্বাধীন হওয়ার চেষ্টার মধ্যেও অনেক খরচা আছে। ধরেন, আপনি একটি শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। যদি আপনি সংগঠক হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে এর মূল্য দিতে হবে। হয়তোবা শ্রমিকদল লাভবান হবে কিন্তু আপনাকে মূল্য দিতেই হবে। আমরা জানি যে, এই মূল্য শুধু শক্তি ও চেষ্টাতেই নয়, বরঞ্চ শাস্তিতেও আছে। নাজুক পরিস্থিতিতে বসবাসকারী লোকেরা যৌক্তিকভাবেই হিসেব করে, ‘আমি যেখানে সহজেই পার পেয়ে যেতে পারি সেখানে কেন এই মূল্য দিতে যাব?’ সুতরাং সহজাত প্রবৃত্তি ও মনোভাব প্রকাশ না করার প্রচুর কারণ রয়েছে। যদিও সময়ে সময়ে তা প্রকাশিত হয়ে থাকে। সর্বোপরি আরও ভালোর জন্য এভাবেই আমাদের সামাজিক পরিবর্তন হয়ে থাকে।

সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার সাথে দেখা করে দারুণ লাগল আপনার চিন্তার জন্য ধন্যবাদ

পাদটীকা

১. আইজ্যাক পুয়েন্তে স্প্যানিশ নৈরাজ্যবাদী ছিলেন। (৩রা জুন, ১৮৯৬- ১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬)। জন্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যবিধি ও এবং যৌনতা নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। ১৯৩২ সালে প্রকাশিত El comunismo libertario (Libertarian Communism) নামক পুস্তিকার জন্যই তিনি মূলত পরিচিত। পুয়েন্তে একজন ডাক্তার ছিলেন, তিনি চিকিৎসা-চর্চাকে ন্যাচারালিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতেন, এবং এনার্কো-ন্যাচারিজমের গুরুত্বপূর্ণ প্রচারক ছিলেন। তিনি মনে করতেন, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা আর্থ-সামাজিক ও স্বাস্থ্যবিধি উভয় তরফ থেকেই মানবজাতিকে হুমকির সম্মুখীন করে ফেলে। ন্যাচারিজমের পাশাপাশি তিনি এনার্কো-কমিনিউজমকেও এর সমাধান হিসেবে মনে করতেন।

২. এমা গোল্ডম্যান (১৮৬৯-১৯৪০), রাশিয়ায় জন্ম নেয়া প্রখ্যাত নৈরাজ্যবাদী, বামপন্থী রাজনীতিবিদ, দার্শনিক এবং নারীবাদী তাত্ত্বিক। তিনি ছিলেন তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক কর্মবাদিতার এক বিরল মিশ্রণ। একদিকে রচনা করেছেন তাত্ত্বিক-রচনাবলী, অন্যদিকে যোগ দিয়েছে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে।

৩. গুস্তাব ল্যান্ডোয়ার (৭ই এপ্রিল ১৮৭০-২রা মে ১৯১৯) ছিলেন জার্মানীর একজন অগ্রগণ্য এনার্কিস্ট তাত্ত্বিক। তিনি সামাজিক নৈরাজ্যবাদ বা সোশিয়াল এনার্কিমের সমর্থক ছিলেন এবং একজন স্বীকৃত শান্তিবাদী বা প্যাসিফিস্ট ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কেবল রাষ্ট্র বা অর্থনৈতিক হাতিয়ারের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করলেই সামাজিক বিপ্লব সাধিত হয় না, বরঞ্চ এর জন্য দরকার আন্তঃব্যক্তিক (ইন্টারপারসোনাল) সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বিপ্লব।

৪. বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা বা সাইন্টিফিক ম্যানেজমেন্টকে কখনো কখনো টেলোরিজম বলা হয়। বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা হচ্ছে ব্যবস্থাপনার যন্ত্রপাতিতে বিজ্ঞান প্রয়োগের প্রাথমিক প্রচেষ্টা। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কর্মপ্রবাহের বিশ্লেষণ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক দক্ষতা (ইকনোমিক এফিসিয়েন্সি), বিশেষত শ্রমের উৎপাদীশলতা বৃদ্ধি করা। এর উদ্ভাবক ফ্রেডরিক টেলোরের নামানুসারেই এই তত্ত্বকে টেলরিজম বলা হয়। ফ্রেডরিক টেলোর (২০শে মার্চ ১৮৫৬- ২১শে মার্চ ১৯১৫) একজন আমেরিকান মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন।

৫. দানিয়েল গ্যারাঁ (১৯ মে ১৯০৪, ১৪ এপ্রিল ১৯৮৮) একজন ফরাসি এনার্কো-কমিউনিস্ট লেখক। বিখ্যাত দুই গ্রন্থ হচ্ছে: Anarchism: From Theory to Practice, এবং No Gods No Masters: An Anthology of Anarchism

৬. আন্তন প্যানেকক (২রা জানুয়ারি ১৮৭৩- ২৮শে এপ্রিল ১৯৬০) একজন ডাচ জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী ছিলেন। তিনি কাউন্সিল কমিউনিজমের একজন অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক। কাউন্সিল কমিউনিজম রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ/রাষ্ট্রীয় সমাজন্ত্রের বিরোধী ছিল। তারা বিশ্বাস করতেন, শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবের জন্য লেনিনবাদী ভ্যানগার্ড পার্টির উপর নির্ভর করার প্রয়োজন নেই। এই ধরনের পার্টি পরবর্তীতে দলীয় একনায়কতন্ত্র কায়েম করে।

৭. ভোল্টায়রিন ডি ক্লেয়ার (নভেম্বর ১৭, ১৮৬৬- জুন ২০, ১৯১২) একজন আমেরিকান নৈরাজ্যবাদী। তিনি রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ, পুঁজিবাদ, বিবাহ-প্রথা এবং নারী ও যৌনতার উপর ধর্মের খবরদারির বিরোধিতা করতেন। শুরুর দিককার একজন গুরুত্বপূর্ণ নারীবাদী হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। এমা গোল্ডম্যান  তার সম্পর্কে বলেছিলেন যে, “the most gifted and brilliant anarchist woman America ever produced“।

নোট: এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয় ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বেরি প্যটম্যান এমা গোল্ডম্যান প্রেসের সহযোগী সম্পাদক ।

সহুল আহমদ

সহুল আহমদ, লেখক, অনুবাদক ও অ্যক্টিভিস্ট। গবেষণার পাশাপাশি সমকালীন বিষয়াবলীর বিশ্লেষক। জন্ম সিলেটে, ১৯৯১ সনে। পড়াশোনা করেছেন শাবিপ্রবিতে, পরিসংখ্যান বিভাগে। একাধিক জার্নাল সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত বই: মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের অপব্যবহার; জহির রায়হান: মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক ভাবনা; সময়ের ব্যবচ্ছেদ (সহ-লেখক সারোয়ার তুষার)। অনুবাদ: ইবনে খালদুন: জীবন চিন্তা ও সৃজন।