অরাজ
আর্টওয়ার্ক: হেড ফুল অব মেরিজ ওপাস শিল্পী: তামারা ওয়াসেরম্যান সূত্র: সাৎসি আর্ট
প্রচ্ছদ » নোম চমস্কি।। নৈরাজ্যবাদ, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আর রাষ্ট্র

নোম চমস্কি।। নৈরাজ্যবাদ, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আর রাষ্ট্র

অনুবাদ: বাধন অধিকারী ও মোকাররম রানা

নোম চমস্কির এই সাক্ষাতকারটি ব্রাজিলে নেয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে। এই সাক্ষাতকারটি নিয়েছিলেন পাবলো ওরটেলাডো এবং আন্দ্রে রায়কি ইনোউ। গণতন্ত্র ও সেলফ ম্যানেজমেন্ট নিয়ে সাউ পাউলো বিশ্ববিদায়লয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রদের পত্রিকা Temporaes এর বিশেষ সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে  এটি সাউ পাউলো থেকে নৈরাজ্যবাদের উপরে চমস্কির রচনা ও সাক্ষাতকারের সংকলন Anarchism: Notas sobre 0 Annrquismo  তে প্রকাশিত হয়।

নোম চমস্কি

আপনাকে ব্রাজিলে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে ব্রাজিলীয় ভাষাবিজ্ঞানীদের সংগঠন এবিআরএএলআইএন। কেন আপনার সিডিউল থেকে কিছু সময় আপনি স্থানীয় সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার স্বার্থে বরাদ্দ রেখেছেন?  

চমস্কি: এটা আমি সবসময়ই করি। সম্ভবত বিগত ৪০ বছর ধরে কেবল ভাষাতত্ত্ব নিয়ে কথা বলার জন্য আমি যে কোনও স্থানে গেছি। আর আমি দুই কাজের মধ্যে [ভাষাতত্ত্ব ও সামাজিক আন্দোলন] সমন্বয় করেছি। আসলে তো আমি সাধারণত সামাজিক/রাজনৈতিক আন্দোলনের স্বার্থেই [বিভিন্ন স্থানে] যাই, সঙ্গে ভাষাতত্ত্ব নিয়েও বক্তৃতা করি। সুতরাং আমি যদি যুক্তরাষ্ট্রের কলেরাডো কিংবা অন্য কোথাও কোনও সামাজিক ন্যায়বিচার আন্দোলনের জন্য বক্তৃতা করি, তো সেটা সাধারণত ভাষাতত্ত্ব বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতাতেই হয় আর তারাই ভ্রমণের ব্যবস্থাটা করে দেয়। এ নিয়ে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। আসলে আমন্ত্রণটা আসে বিভিন্ন গ্রুপের পক্ষ থেকে। সুতরাং এটাই স্বাভাবিক।

নৈরাজ্যবাদ ও রাষ্ট্র

পাওয়ারস অ্যান্ড প্রোসপেক্টস’ নামে আপনার নতুন বইয়ের একটি রচনায় (গোলস অ্যান্ড ভিসনস) আপনি বলেছেন, একজন নৈরাজ্যবাদী হিসেবে আপনার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রের বিলোপ, তবে আপনার আপাত লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, এমনকী কখনও কখনও তাকে শক্তিশালী করা […] যেন গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের সীমা প্রসারিত করার ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তা প্রতিহত করার চেষ্টা রুখে দেওয়া যায় রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করা বলতে আপনি কি বোঝাতে চান? আপনি কি রাষ্ট্রে [জনসাধারণের] কার্যকর অংশগ্রহণের কথা বলেন; এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটদের কিংবা ব্রাজিলে ওয়ার্কার্স পার্টিকে ভোট দেওয়া? যদি তা না হয়, তাহলে আসলে আপনি এর মধ্য দিয়ে কী চান?

চমস্কি: এটা ছিল একটা অ্যানার্কিস্ট কনফারেন্সের বক্তৃতা; আর আমার মতে মানুষের পরিণতির কথা চিন্তা করার বদলে বাঁধাধরা কোনও মতবাদের পেছনে ছুটে বেড়ানোর মানে মুক্তিপন্থি আন্দোলনগুলোকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। যাইহোক, এটা পুরোপুরি যথাযথ… মানে, আমার এবং আমার মতো অন্য কারও কারও মতে রাষ্ট্র একটা অবৈধ প্রতিষ্ঠান। তবে তার মানে এই নয় যে, কখনও আপনি রাষ্ট্রকে সমর্থন করতে পারবেন না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আপনি যদি রাষ্ট্রকে সমর্থন না করেন, তাহলে  এর চেয়েও [রাষ্ট্রের] অবৈধ কোনও প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং যদি আপনি মানুষের কথা ভাবতে চান, তো বাস্তবসম্মত [চিন্তা করুন], যুক্তরাষ্ট্রের কথায় আসেন। সেখানে একটা রাষ্ট্রীয় খাত রয়েছে যা ভয়াবহ সব কর্মকাণ্ড করে। আবার তাদের কিছু ভালো কাজ করতেও দেখা যায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে সেখানে ব্যাপকতর জন-সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে তার ফলস্বরূপ সেখানে যৎসামান্য একটি কল্যাণমূলক ব্যবস্থা চালু আছে যার কারণে গরীব মা-শিশু উপকৃত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের ভূমিকা সংকুচিত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই ব্যবস্থা আজ হুমকির মুখে। তো যাই হোক, অ্যানার্কিস্টরা বুঝতে সমর্থ হয়নি যে তাদের ওই ব্যবস্থাকে সমর্থন করা উচিত ছিলো। তাই তারা অতি-দক্ষিণপন্থিদের সঙ্গে জুটলো এবং তাদের সুরে সুর মেলালো যে, ‘হুম, আমাদের রাষ্ট্রের ভূমিকা সঙ্কুচিত করা উচিত’; যার মানে হলো স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিক্ষমতার হাতে আরও বেশি পরিমাণ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা যারা সম্পূর্ণভাবে জনগণের কাছে জবাবদিহিতাবিহীন ও পুরোপুরি সর্বাত্মক।

আর্টওয়ার্ক: দ্য একলিপস অব দ্য সান
শির্পী: জর্জ গ্রসজ
সূত্র: রিপ্রোডাকশন

এটা ৩০ এর দশকে ফিরে আসে পুরনো সেই কমিউনিস্ট পার্টির শ্লোগানের মতো একটা স্মারক, দ্য ওর্স, দ্য বেটার। একটা সময়কাল ছিল যখন কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলা করতে অস্বীকৃত ছিল কারণ যদি ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলা করতে হয়, তাহলে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে যোগ দিতে হবে, কিন্তু তারা তো ভালো মানুষ না, সুতরাং ‘খারাপই শ্রেয়তর’। আমার শৈশব স্মৃতি থেকে এই শ্লোগানটি আমি মনে করতে পারি। তো তারা খারাপটাই বেছে নিয়েছিল, তা হলো হিটলার।

একটা সাত বছরের শিশুর জন্য খাবারের নিশ্চয়তার প্রশ্নকে যদি আপনি আমলে নিতে চান, তখন দূরবর্তী বাস্তবতায় অবৈধ বিবেচনা করেও আপনি রাষ্ট্রীয় খাতকে সমর্থন করবেন। আমি জানি, মৌলিক তাত্ত্বিক পাটাতনের অনুগামী নয়, এমন অনেকের কাছেই বামপন্থিদের মোকাবেলা করাটা কঠিন হয়ে পড়ে; এমনকি আমি নিজেও তাদের অব্যাহত সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে থাকি। তাদের কাছে মৌলিক তাত্ত্বিক পাটাতন হলো রাষ্ট্রীয় খাতের বিরোধিতা করা; এমনকি সেই বিরোধিতার কারণে যদি সর্বাত্মক-স্বেচ্ছাচারী কোনও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় যারা শিশুদের ক্ষুধায় মরতে দেখে খুশি হবে, তখনও। আমরা যদি যথাযথভাবে আমাদের ভবিষ্যত সংকট নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে চাই, তাহলে এই বিষয়গুলো আমাদের মাথায় রাখা উচিত। প্রকৃতপক্ষে, আজকের যুগে রাষ্ট্রীয় খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রশ্নের মানে রাষ্ট্র বিলোপের পথে একধাপ অগ্রগতির প্রশ্ন কেননা এটা [রাষ্ট্রীয় খাত] একটা জনক্ষেত্র (পাবলিক অ্যারানা) যেখানে ছোট পরিসরে হলেও জনগণ অংশগ্রহণ করতে পারে, সংগঠিত হতে পারে এবং নীতিগত সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে এবং আরও অনেককিছু করতে পারে। যদি আমরা সেই পথে না হাঁটি তাহলে আমরা একটা ব্যক্তিক-স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থার অধীনে চলে যাব, যা কোনভাবেই স্বাধীনতার পথে অগ্রগতি নয়।

তার মানে আপনার মতে আমরা এমন একটা অবস্থায় রয়েছি রাষ্ট্র যখন শক্তিশালী হয়, সেখানে কর্পোরেট শক্তি হারায় কিংবা কর্পোরেট শক্তিশালী হলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হ্রাস পায়।

চমস্কি: অনেকটা সেরকমই।

আমার মনে হয়, আপনি ক্ষমতার লড়াইয়ে একটি তৃতীয় পক্ষকে শনাক্ত করছেন না, তারা হলো সংগঠিত জনতা। আপনাকে একটা উদাহরণ দিই। গত বর সাও পাওলোর মেয়র শহরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গঠনতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দেন সেখানে ডাক্তার ও নার্সসহ অপরাপর স্বাস্থ্যকর্মীরা রাষ্ট্রের কাছে বেতন-ভাতা গ্রহণ করতো, তবে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিজেদের মতো করে চালায় তাদের বলা হলো, যদি তারা মনে করে যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো তারা ঠিকমতো চালাতে সক্ষম নয়, তাহলে যেন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তা ব্যক্তিখাতের হাতে তুলে দেয় স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে যারা বামপন্থি, তারা সঙ্গে সঙ্গে বললো, এটা স্বাস্থ্যখাত বেসরকারিকরণের একটা অপচেষ্টা যা সংবিধানসম্মত নয় একইসময়ে স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত মুক্তিপন্থিরা প্রস্তাব করলো, বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া কিংবা রাষ্ট্রীয় খাতে রাখার বদলে স্বাস্থ্যখাতকে  স্থানীয় জনসাধারণ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বনিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া উচিত ভবন ও সরঞ্জাম রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হবে, বেতনভাতাও রাষ্ট্র দেবে তবে নীতি-পরিকল্পনা, কার্যক্রম, পরিচালনাবিধির মতো বিষয়গুলো নির্ধারণ করবে স্থানীয় জনসাধারণ ও কর্মীরা এক্ষেত্রে গণতন্ত্রের সীমা বাড়া

চমস্কি: আর না বললেও চলবে, আমি বুঝেছি আপনার কথা।

এবং একইসঙ্গে এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে দুর্বল করা যা

চমস্কি: না, এটা রাষ্ট্রকে দুর্বল করা না, এটা রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করা, কেননা খেয়াল করে দেখেন যে আপনি নিজেই বলেছেন বেতন-ভাতা দেবে রাষ্ট্র। মালিকানা থাকবে রাষ্ট্রের হাতে, তারমানে রাষ্ট্রীয় খাত শক্তিশালী হবে। আমি খুব করে এটার পক্ষে। আমি মনে করি, সেখানে কর্মীদের স্ব-ব্যবস্থাপনা থাকবে তবে তহবিল বরাদ্দ হবে সামাজিক। যেমন ধরেন, আপনি যদি এখানে একটা ব্যাপার যুক্ত করেন যে, তহবিল আসবে জনসাধারণের কাছে থেকে, তো সেটা ধনীদের জন্য বিরাট একটা উপহার হবে। তারা এতে খুব খুশি হবে। কারণ কর-ব্যবস্থায় কর পরিশোধের মধ্য দিয়ে তাদের যে ভূমিকা পালন করতে হয়, সেটা থেকে তারা মুক্তি পেতে চায়। সেটা [তাদের দেওয়া কর] যতো কমই হোক না কেন, এতে অন্তত সামাজিক কল্যাণে সহযোগিতার কিছু দায়িত্ব তাদের পালন করতে হয়। এটা যদি তাদের না করতে হয়, তাহলে তো তারা খুশি হবে। সুতরাং আপনি যদি স্ব-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার কথা বলেন, তো সেটা দারুণ, আমি মনে করি এটা একটা দুর্দান্ত চিন্তা, এবং আমি যা বলেছি তার সঙ্গে এর মোটেও কোনও বিরোধ নাই। যেমন ধরেন আমি আগে যা বলেছি সেটাও কারখানার স্বনিয়ন্ত্রণ, কারখানাতে কর্মীদের স্বনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটা একই ব্যাপার। তা হলো, চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করতে হবে, চলমান বাস্তবতায় গরিবেরা নয়, স্বাস্থ্যখাতের ব্যয় হবে সামাজিক। আর এটাই হলো ব্যক্তিমালিকানার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় খাতকে শক্তিশালী করা। সুতরাং ব্যাপারগুলো একইরকম, আপনি যা বলেন, সেটা কোনও তৃতীয় পন্থা নয়, আমি যে দ্বিতীয় পন্থার কথা বলেছি, সেটাই  [স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিমালিকানাকে রুখতে রাষ্ট্রীয় খাতের সুরক্ষা।] প্রকৃতপক্ষে প্রতিনিধিত্বমূলক/সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের যে দায়দায়িত্ব নির্ধারিত, তার  মধ্যে সংরক্ষিত জনক্ষেত্রে লড়াইয়ের নানান ধারার সুযোগ রয়েছে। এর অন্যতম কিন্তু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণটি হলো, সব ধরনের ব্যক্তিখাতের ব্যবস্থাপনা ও মালিকানার অবসান ঘটানোর লড়াই।  ধারণাগতভাবে এটি সংসদীয় ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই করা সম্ভব। বাস্তবে এটি হয়তো সম্ভব নয়, তবে সেখানে এ সংক্রান্ত আলোচনার কথা তুলবার সুযোগ রয়েছে ওই ব্যবস্থার মধ্যেই। অধিজাতিক কর্পোরেশনগুলো যে লিবারেলদের ব্যাপারে আগ্রহী, সেটার একটা কারণ হলো লিবারেলরা রাষ্ট্রের ভূমিকা সঙ্কুচিত করার পক্ষে। আর রাষ্ট্রের ভূমিকা সঙ্কুচিত করার মানে ব্যক্তিমালিকানাকে শক্তিশালী করা। তবে এরমধ্য দিয়ে আসলে জনগণের প্রভাবকে সীমিত করা যায়। আর সেটা কিন্তু নৈরাজ্যবাদী লক্ষ্য হতে পারে না। বলতে চাইছি, ‘রাষ্ট্রের ভূমিকা সংকোচন’ নামের ধারণায় মানুষ বিমোহিত হতে পারে, এর ফাঁদে পা দিতে পারে; তবে ভেবে দেখা দরকার আসলে এর মধ্য দিয়ে কী হচ্ছে। এটা কিন্তু রাষ্ট্রের ভূমিকা সঙ্কুচিত করার মধ্য দিয়ে আরও ভয়াবহ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা। এটা নৈরাজ্যবাদী লক্ষ্য হতে পারে না।

এইযে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নৈরাজ্যবাদী লিবারটেরিয়ান পার্টিকে ভুল করে নৈরাজ্যবাদী ধারার কিংবা তার কাছাকাছি ধারার মনে করে; সেজন্যই কি আপনি জোর দিয়ে এই কথাগুলো বলছেন?

চমস্কি: খানিকটা সম্পর্কতো আছেই। ইংরেজিভাষী দুনিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এটি এক অদ্ভুত অ্যাংলো-স্যাক্সন প্রপঞ্চ। সেখানে [যুক্তরাষ্ট্রে] নৈরাজ্যবাদের একটিমাত্র স্বপ্ন, একটিমাত্র ধরন টিকে ছিল। সেটি হলো উগ্র ডানপন্থি নৈরাজ্যবাদ, যা আপনি লিবার্টারিয়ান পার্টিতে দেখেন; যা শুধু মাত্র বড় কর্পোরেশন এবং বিনিয়োগ সংস্থাগুলির মতো প্রতিষ্ঠানের হৃদ্যতা পেয়েছে। এমন নয় যে তারা এতে [নৈরাজ্যবাদে] বিশ্বাস করে। তারা ভালভাবে জানে যে, এই রাষ্ট্র থেকে তাদের মুক্তি মিলবে না কারণ নিজেদের স্বার্থেই এটি তাদের দরকার। তবে তারা এটিকে [নৈরাজ্যবাদ] অন্য সবার বিরুদ্ধে একটি মতাদর্শিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পছন্দ করে। তাই, মূলধারার ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে উদারপন্থি দল অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে গৃহীত হয়েছে। যেখানে তারা আসলে নৈরাজ্যবাদ নিয়ে গোপনে টিটকারি মারে। কেননা তারা ভালভাবে জানে যে, বিপুল রাষ্ট্রীয় সহায়তা ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারবে না, তাই তারা একটি ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র চায়। তবে তারা উদারপন্থি মতাদর্শ পছন্দ করে যা তারা অন্য সবার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। যদি আপনি আসলেই উদারপন্থি দলের আদর্শ অনুসরণ করেন তবে আপনি বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সর্বাত্মক জুলুমবাজ তৈরি করতে পারবেন। আসলে, সেখানে [উদারপন্থী দলে] আমার অনেক বন্ধু রয়েছেন। অনেক বছর ধরে, আমি শুধুমাত্র অতি-ডান উদারপন্থি পত্রিকাগুলোতেই লিখতে পারতাম কেননা অনেক বিষয় ছিলো যেগুলো নিয়ে আমরা একমত ছিলাম। উদাহরণ হিশেবে বলা যায়, মার্কিন  সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার বিষয়ে আমরা একমত। উদাহরণ হিশেবে বলা যায়, পূর্ব তিমুরের উপরে আমি প্রথম যে লেখাটি লিখেছিলাম তা ছাপতে কেউ রাজি   ছিল না। সত্তরের দশকের শেষদিকে, তারা এটি প্রকাশ করেছিল। এটি  সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে  এই বিষয় নিয়ে প্রকাশিত একমাত্র নিবন্ধ। তারা আরো অনেক কিছু ছাপিয়েছে এবং এখনো  ব্যক্তিগত  পর্যায়ে  আমাদের  বন্ধুত্ব  রয়েছে। যদি পার্থক্যের একটি বড় পরিসরও বিদ্যমান।

যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক শ্রেণির নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন, মানে বাম নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনও ছিল। বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে তাদেরকে প্রায় ধ্বংস করা হয়। ঠিক তখন যখন এমা গোল্ডম্যান এবং আলেকজান্ডার বার্কম্যানের মতো লোকদের জেলে বন্দী করা হয়েছিল এবং দেশ থেকে নির্বাসন দেয়া হয়েছিল। শ্রমিক শ্রেণির বাম উদারপন্থি আন্দোলন ব্যাপক অর্থে থেঁতলে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রশংসিত হয়েছিল ডান উদারপন্থি আন্দোলন। ক্ষমতাশালীরা নিজেদের বিশ্বাস থেকে এমন করেছিল তা নয়, এটা করা হয়েছিল কারণ এটা একটা কার্যকর পন্থা [ব্যাটারিং র‍্যাম]। অনেক  নৈরাজ্যবাদী এ নিয়ে খুব বিভ্রান্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিতান্ত্রিক নৈরাজ্যবাদের ঐতিহ্য রয়েছে। ” আমি বনবাসে  চলে যাব এবং নিজেই কাজ করব, “এই ধারার নৈরাজ্যবাদ। এটি এমন এক ব্যাপার যা ব্যাপক ভাবে ব্যবসা-পরিচালিত সমাজে বিকাশ লাভ করে, যেখানে ব্যাপক শূন্যতা রয়েছে। এটি বহু ধারার। এর একটি ধারা সশস্ত্র পন্থাকে গ্রহণ করে, যারা অত্যন্ত রাষ্ট্রবিরোধী। আমি বোঝাতে চাইছি যে, আমি যদি এমন গোষ্ঠীগুলির সাথে কথা বলি যেখানে অতি-ডান সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি  দৃঢ় সমর্থন রয়েছে, তবে আমরা অনেকগুলি বিষয় নিয়ে  একমত হই। তারা আমার বই বিতরণ করছে। আপনি সেই সশস্ত্রপন্থিদের কনফারেন্সে যান, সেখানে আমার বই আছে। তারা মনে করে আমরা একই দিকে আছি কারণ আমরা দুই পক্ষই রাষ্ট্রকে আক্রমণ করছি।

ঠিক যেভাবে নৈরাজ্যবাদীরা মনে করে আমরা ভিন্ন পক্ষে রয়েছি, কারণ আমি  রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য কিছু একটা করি। আপনি যদি এই বিষয়গুলি নিয়ে  ধীরে-সুস্থে ভাবেন, আমি যা বোঝাতে চাইছি তা হলো, একটি স্লোগান আপনাকে সবটা বোঝার সুযোগ দেয় না। আপনাকে আরো গভীর বাস্তবতার নিরিখে স্লোগানটিকে বিবেচনা করে দেখতে হবে।

এটা খুবই হাস্যকর যে আমেরিকানরা অতি-ডান এবং অতি-বামের মধ্যে এত বড় বিভ্রান্তি তৈরি করে

চমস্কি: এটি অস্বাভাবিক নয়, ইতিহাস দেখুন, মুসোলিনি কোথা থেকে এসেছে।

বিশেষায়িতকরণ ও শ্রমের বুদ্ধিবৃত্তিক বিভাজন

আপনি [ভাষা ও দায়বদ্ধতা]’র কোথাও একবার উল্লেখ করেছিলেন যে, বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা হলো সামাজিক ভেদাভেদ বজায় রাখা এবং এলিট শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করা। সামাজিক জ্ঞানের (ইতিহাস, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ইত্যাদি) বিশেষ তত্ত্ব-পদ্ধতি প্রয়োজন যা সাধারণ মানুষের নেই; এমন ধারণার সমালোচনাও করেছিলেন আপনি। একই সময়ে, একার্থে যে সমালোচনা সামাজিক জ্ঞানের বিশেষায়নের নিন্দা করে তা নিজেই বিশেষায়িত, কেননা এটি ব্যাপক পরিশ্রমের  দাবি করে যা কেবলমাত্র  একজন পেশাদার বুদ্ধিজীবী বা কঠোর পরিশ্রমী সমঝদার ব্যক্তিই  করতে পারে। একজন সমালোচক বুদ্ধিজীবী কীভাবে বিশেষায়নের সমালোচনা করা ও নিজেই বিশেষজ্ঞ হওয়ার এই উভয় সংকট এড়াতে পারেন?

চমস্কি: আমি মনে করি আপনাকে সৎ হতে হবে। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, আমার স্নাতক কোর্সগুলিতে ভাষাবিজ্ঞানের যা পড়াই তা পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনাকে ব্যাখ্যা করতে পারব কি না, আমি “না” বলতাম কেননা এর জন্য অনেক বেশি পূর্বধারণা থাকা প্রয়োজন। এখানে, অনেক  বোঝাপড়া ও প্রায়োগিক জ্ঞানের দরকার। কিন্তু আপনি যদি আমাকে পাঁচ মিনিটে ব্রাজিলের ঋণ  সঙ্কট ব্যাখ্যা করতে বলতেন তাহলে আমি “হ্যাঁ” বলতাম কেননা এটি তুলনামূলকভাবে সোজা। এবং আসলে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সব বিষয়গুলি বাহ্যত একই। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো অনেকেই তেমন ভালো বোঝে না, আপনি যখন বড় অণুগুলোর বাইরে চলে যান তখন এটি খুবই বর্ণনামূলক হয়ে যায়। তাই আমি কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে কোন বক্তব্য দিতে যাচ্ছি না যা সম্পর্কে আমি কিছু জানি না।

অন্যদিকে, এই প্রশ্নগুলি [সমাজ সংক্রান্ত] আসলেই সবার কাছে বোধগম্য। বুদ্ধিজীবীরা যে কাজগুলি করেন তার মধ্যে একটি হলো এগুলোকে দুর্বোধ্য করে তোলা। অনেক কারণে তারা এটি করেন। এর মধ্যে কর্তৃত্ব রক্ষা ও ব্যক্তিগত সুবিধা পাওয়ার বিষয়ও রয়েছে। এটি খুব স্বাভাবিক ব্যাপার যে, বুদ্ধিজীবীরা সহজ জিনিসকে কঠিন করে দেখান। এটি অনেকটা সেই সময়ের মত যখন মধ্যযুগের চার্চ এর গুরুত্ব ধরে রাখার জন্য রহস্য তৈরি করছিলো। দস্তয়েভস্কির গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর পড়ে দেখুন-সেখানে এটি সুন্দর করে বলা আছে। গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর ব্যাখ্যা করেছেন যে, আপনাকে রহস্য তৈরি করতে হবে তা না হলে সাধারণ মানুষ সবকিছু বুঝে যাবে। তাদের শাসন করার জন্য কোন বিষয়কে রহস্যময় ও জটিল করে তুলতে হবে। এটাই বুদ্ধিজীবীদের পরীক্ষা করার উপায়। এটি তাদের জন্যও ভাল: তখনই আপনি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, এমন বড় বড় কথা বলছেন যা কেউ বুঝতে পারে না। কখনো কখনো এটি হাস্যকর হয়ে ওঠে। উত্তরাধুনিক আলাপের কথাই ধরুন। বিশেষ করে, প্যারিসজুড়ে এটি একটি [কমিক স্ট্রিপে] পরিণত হয়েছে। আমি বলতে চাইছি, এগুলো খবই অর্থহীন বকবকানি। তবে এটি খুব ফোলানো ফাঁপানো; টেলিভিশন ক্যামেরা, বিপুল ভান [ঢং] সহকারে। যা আপনি আট বছরের কোন বাচ্চাকেও ব্যাখ্যা করে বলতে পারেন, তারা সেটি অনেক গভীরভাবে উন্মোচন করার এবং এর পিছনে আসল অর্থ কী তা বোঝার চেষ্টা করে। সেখানে আদতে কিছুই নেই। কিন্তু এগুলো হলো বামপন্থিসহ  সমকালীন বুদ্ধিজীবীদের কিছু পথ; যার মাধ্যমে তারা নিজেদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পেশা ও প্রভাব তৈরি করে, জনমানুষকে প্রান্তের দিকে ঠেলে দেয়, ভীত করে তোলে।

আর্টওয়ার্ক: ওয়ার্কার্স আপরােইজিং
শিল্পী: জ্যাকোব স্টেইনহাট
সূত্র: ওয়েমিয়ার

উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যায়, তৃতীয় বিশ্বের জন্য এটি আরো বেশি করে প্রযোজ্য যে; তরুণ  র‌্যাডিকাল অ্যাকটিভিস্টদের অনেকেই বাম ঘরানার বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন অথবা র‌্যাডিকাল  নারীবাদী আন্দোলন কিংবা এই রকমের কোনও ঘরানা থেকে  আসা  অবোধ্য বকবকানি  দ্বারা ভীত হয়ে পড়েন। এগুলো [বকবকানি] বুঝে ওঠা একেবারেই অসম্ভব। এটি মানুষের মনে এই অনুভূতি তৈরি করে যে, তাদের আসলে কিছু করার নেই। কেননা যতোক্ষণ তাদের পোস্ট-মডার্নিজমের সর্বশেষ চিন্তাধারা সম্পর্কে জানাশোনা নাই, ততোক্ষণ তাদের পক্ষে রাস্তায় নেমে জনগণকে সংগঠিত করা সম্ভব নয়। কেননা, এইসব বোঝার মত যথেষ্ট বুদ্ধিশুদ্ধি তাদের নেই।  হয়তোবা এটি উদ্দেশ্যপ্রণিত কিছু নয়।বতবে এর প্রভাব প্রান্তিককরণ, নিয়ন্ত্রণ ও আত্মস্বার্থ হাসিলের কৌশল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তারা নিজেরাই নিজেদের মর্যাদাশীল করে তোলেন, এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করেন এবং উচ্চপর্যায়ের জীবন-যাপন করেন এবং এরকম আরো অনেক কিছু। সম্ভবত প্যারিস এটির চরমতম সংস্করণ। সেখানে এটি প্রায় একটি কমিক স্ট্রিপ হয়ে গেছে। তবে আপনি এটি অন্য জায়গাতেও খুঁজে পাবেন।

অন্যদিকে, এটি বোঝার জন্য আপনার নিজেকেই প্রশ্ন করতে হবে যে, “আসলে কোন সূত্র, কোন নিয়মাবলী বা মতবাদ যদি থেকে থাকে যা বোঝার জন্য কঠিন কিন্তু সত্যিই তা নিয়ে আপনার পড়াশোনা করতে হবে, তাহলে আপনি আমাকে এমন কিছু একটা  দেখান যা সহজ কথায় বলা যায় না।” যদি কেউ আপনাকে তা দেখাতে পারে তাহলে এটি  সিরিয়াসলি নিন।  পদার্থবিজ্ঞানের কাউকে  জিজ্ঞেস করে দেখুন সে এটি পারবে। [কিন্তু] এখানে একটা পার্থক্য আছে। উদাহরণস্বরূপ, কখনো কখনো এরকম ঘটে যে পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে উদ্ভূত এমন কিছু  থাকে যা আমি বুঝি না তখন আমি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে আমার বন্ধুদের যেতে পারি এবং  তাদেরকে বিষয়টি  ব্যাখ্যা করতে বলতে পারি। আমি তাদেরকে বলব আমার লেভেলে এসে এমনভাবে ব্যাপারটি বোঝাতে যাতে আমি বুঝতে পারি এবং তারা এটি পারে। ঠিক একইভাবে আমি যেমন করে স্নাতকোত্তর ভাষাতাত্ত্বিক  সেমিনারের কোন কিছু নিয়ে তার পরিভাষাসহ সবিস্তারে তাদের বোঝাতে পারি।তারা এ ব্যাপারে একটি ধারণা পাবে।  দেরিদার সর্বশেষ রচনা   অথবা অন্য কারো কিছু  নিয়ে কাউকে এমন পরিভাষায় বুঝিয়ে বলতে বলার চেষ্টা করে দেখুন  যা আপনি বুঝবেন।তারা এটি পারে না।  অন্তত আমার ক্ষেত্রে তারা এটি  পারে না: আমি বুঝি না। এবং আমি মনে করি আপনার অবশ্যই নিজেকে খুব যত্ন নিয়ে  জিজ্ঞাসা করতে হবে যে বিবর্তনের ক্ষেত্রে কী এমন দুর্দান্ত উল্লম্ফন ঘটেছে  যাতে কারও কারও মধ্যে এইসব দুর্দান্ত অন্তর্দৃষ্টি তৈরি হয়েছে যে তারা সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়গুলি পরিষ্কার করতে পারে না, কেউই এগুলো বোঝে না। এটি সম্পর্কে সবারই খুব সংশয়ী হওয়া উচিত যে, এটি মানুষের মতামতের ওপর বুদ্ধিজীবীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম কৌশল।

বিবেক এবং ভ্যানগার্ড

আপনি কেবল দেরিদার প্রসঙ্গই তুললেন। তবে পরবর্তীতে  রিলেটিভিজম (একটি উত্তর আধুনিক ধারণা, যেখানে মনে করা হয়, শাশ্বত কিংবা বস্তুগত সত্য বলে কিছু নেই। এটি নিজ নিজ অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত) নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। এটি অনেককে এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছে যেখানে সাংস্কৃতিক  বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধার নাম করে নিষ্ক্রিয়তাকে জায়েজ করা  হয়। আমার কাছে মনে হয়  এই আলোচনাটি দ্বিমুখী। এর একটি উদার দিক রয়েছে, যা হলো বহুসংস্কৃতিবাদ, তবে এর একটি বামপন্থি দিকও  রয়েছে, যা গ্রামসি থেকে পাওলো ফ্রেয়ারে পর্যন্ত বিস্মৃত। পরবর্তী (এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয়) দিককার (বামপন্থি) আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছিল একটি আলোকিত ভ্যানগার্ড এবং সংকীর্ণ মনের সর্বহারা শ্রেণির মধ্যকার দ্বন্দ্বের কর্তৃত্ববাদবাদের দিকে ধাবিত হওয়ার বিষয়টি। সাধারণ নিষ্ক্রিয়তা এবং কর্তৃত্ববাদ দুটোকেই এড়াতে চাইলে কী অবস্থান নেওয়া উচিত?

চমস্কি: ভ্যানগার্ড ধারণাগুলো সহজেই বোঝা যায়; ডানপন্থি উদারনীতির মতো করেই এটিও মানুষের জন্য নিজেদের  ক্ষমতাকে ন্যায্যতা দেয়ার একটি উপায়। এটি মানুষকে ক্ষমতা অর্জনের এবং অন্যদেরকে মূল্যায়ন না করার মতাদর্শিক বৈধতা দেয়। নিষ্ঠাবান মানুষেরা জনগণের সঙ্গেই কাজ করবে।  আপনি যখন সত্যিই কিছু শেখাতে চান তখন আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতাবাজি করেন না, যা জনগণ নকল  করবে। আপনি তখন সত্যিই জনগণের সাথে কাজ করেন। হোক তা ছয় বছর বয়সী বাচ্চাদের শেখানো অথবা পোস্ট গ্রাজুয়েট স্কুলে শেখানো,সব ক্ষেত্রেই এটি সত্য। আপনি একসাথে কাজ করছেন, নিজেকে আলোকিত করার চেষ্টা করছেন।কখনো কখনো  যে শেখায় সে তার শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি শেখে। তো আপনার যে জ্ঞান, সম্পদ ও সুবিধা আছে অন্যদের সাহায্য করার জন্য এবং তাদের কাছ থেকে শেখার জন্য আপনি তা ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। সম্মানজনক বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ এটাই। তার মানে এই নয় যে, কেউ কেউ ভ্যানগার্ড; আসলে বুদ্ধিজীবীরা হলেন সেবক, যারা শ্রেয়তর বোঝাপড়ার স্বার্থে যারা অপরাপর মানুষের সঙ্গে মিলে কাজ করে।

আসলেই এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই।  বিশেষভাবে হার্ড সায়েন্সের কথা যদি ধরি, তো বিষয়টা ভালোভাবে বোঝা যাবে।  যদি আপনি উচ্চতর গণিত কিংবা উচ্চতর পদার্থবিজ্ঞান অথবা এমনকি আমাদের ভাষাবিজ্ঞানের স্নাতক কোর্সের মতো প্রচুর পরিমাণ স্বতন্ত্র আধেয় রয়েছে এমন কিছুর কথা বলেন, তো সেখানেও সবকিছু নিয়ে স্পষ্ট বোঝাপড়া অর্জন করা যায়।  ব্যাপারটা এমন নয় যে এখানে অধ্যাপক দাঁড়িয়ে আছেন এবং অন্যেরা নোট নিচ্ছেন কিংবা তার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছেন। এটা একটা বিনিময়ের প্রশ্ন। আপনি যা নিয়ে কাজ করছেন সেটি সম্পর্কে কথা বলবেন। কিছু শিক্ষার্থী উঠে দাঁড়াবে এবং তারা বলবে যে এটি ভুল। অন্য কোন রাস্তায় আপনার এটি ভাবা উচিত হবে। তখন আপনি সমস্যাটি নিয়ে আবার কাজ করবেন। যখন আপনি শ্রমজীবী মানুষের বস্তিতে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলেন এবং তারা তাদের সমস্যাগুলো বোঝার চেষ্টা করে এটি তার চেয়ে আলাদা কিছু নয়। আমি বোঝাতে চাইছি যে, আমার কিছু জ্ঞান আছে এই ব্যাপারে আর আপনার এবং তাদের আছে অভিজ্ঞতা। এগুলো একসাথে করার চেষ্টা করুন এবং দেখুন এগুলোকে গঠনমূলক পথে ব্যবহার করা যায় কি না। আমি অতি বিনয়ী কিংবা অন্য কিছু হওয়ার চেষ্টা করছি না। আমি যখন শ্রমিকদের সামনে কথা বলি তখন আমি ভালভাবেই জানি যে আমি এমন কিছু জানি যা এই শ্রমিকরা জানে না। এবং এমন অনেক কিছু আছে যা তারা জানে কিন্তু আমি জানি না। আমরা সেগুলোকে একসাথে করি এবং আমাদের পারস্পরিক বিকাশ ঘটে।

‘‌নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় গণতন্ত্র ও বাজার” [ক্ষমতা ও প্রত্যাশা] তে আপনি বলেছিলেন যে শতকরা আশি ভাগেরও বেশি মার্কিন জনগণ মনে করে, শ্রমিকদের প্রভাব খুবই সামান্য, যদিও শ্রমিক ইউনিয়ন সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা পোষণকারীর সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশ। আর শতকরা চল্লিশ ভাগ  তাদেরকে [শ্রমিক ইউনিয়ন]  অতি প্রভাব বিস্তারকারী হিশেবে বিবেচনা করে, এটি প্রোপাগন্ডা কীভাবে বিভ্রান্তিকে উস্কে দেয় তার আরেকটি প্রমাণ।সেখানে [অবশ্য কেবল সেখানেই নয়] আপনি দুভাবে পরিসংখ্যানগত প্রমাণ ব্যবহার করেছেন। একটি হলো, জনগণের প্রকৃতআগ্রহ তুলে ধরতে এবং অন্যটি গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যমূলক প্রভাব তুলে ধরতে। জনগণের কথা ও চিন্তা যদি তাদের সত্যিকারের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ না হয় তাহলে আমরা কীভাবে তা বুঝতে পারব?

চমস্কি: আমরা জানি যে সাধারণ মানুষ খুব সোজাসুজি পথে চিন্তা করে। তারা মনে করে, যা ঘটছে তা নিয়ে শ্রমিকদের আরো বেশি মতামত থাকা উচিত তবে ইউনিয়নের ক্ষেত্রে এই ক্ষমতা কম হওয়া উচিত। তাদের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের দুইটি অনুমানই তাদের কাছে যৌক্তিক। তাদের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউনিয়ন হলো শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত একটি অস্ত্র। আপনি বহু বছর আগের একটি বিখ্যাত সিনেমা On The Waterfront  দেখেছেন? এটা এক ধরনের মডেল, যাকে মিডিয়া পঞ্চাশ বছর ধরে [battering ram] এর মত করে উপস্থাপন করে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, ইউনিয়ন হলো শ্রমিকদের শত্রু এবং একজন শ্রমিককে এই ইউনিয়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং একে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। আপনি বুঝতে পারবেন  কেন বৃহৎ কর্পোরেট সিস্টেম হিসেবে বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি  ইউনিয়নের ধারণাকে প্রতিরোধ করতে চায়। এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়। সুতরাং মানুষ সত্যিই বিশ্বাস করে যে ইউনিয়নের হাত থেকে শ্রমিকদের নিজেদেরকে মুক্ত করা উচিত এবং যা ঘটছে তা নিয়ে শ্রমিকদের মত প্রকাশের পথ প্রশস্ত করার একটি পথ এটি (ইউনিয়ন বিযুক্তি)।

এখানে অবশ্যই বাস্তব তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। এমন নয় যে, মানুষ কী বিশ্বাস করে তা আমরা জানি না। ইউনিয়ন শ্রমিকদের শত্রু, এমন ভুল ধারণায় বিশ্বাস করে তারা। যেকোন প্রোপাগান্ডার মতই এটি কখনো কখনো সত্য। সবসময়ই সবচেয়ে উন্মত্ত প্রোপাগান্ডা হলো হলো তা যার সাথে কিছুটা সত্য মিশ্রিত থাকে। এবং এখানেও কিছুটা সত্য রয়েছে। ইউনিয়ন শ্রমিকদের শত্রু পরিণত হয়েছে কিন্তু তারা একইসাথে সম্ভবত সবচেয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো যা আমাদের চরম অগণতান্ত্রিক সমাজে টিকে আছে। এমন অনেকগুলি সমিতি থাকতে পারে এবং আছেও যার মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা নিজেদের মুক্ত করতে এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে পারে। তবে এই কথা মিডিয়া আপনাকে বলবে না। তাই এই উভয় সংকটের সমাধান  হল, ইউনিয়ন কী বা কী হতে পারে তা বোঝার জন্য শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাস সম্পর্কে জানা।

আর্টওয়ার্ক: হেড ইন ক্লাউডস
শিল্পী: ইমানুয়েল দেল রসো
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

শ্রমিক শ্রেণির ইতিহাস সম্পর্কে কেউ জানে না, কেউ পড়েও না। আসলে, সারা বিশ্বের মিডিয়ার দিকে তাকান। দেখবেন, সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য নামের বিভাগ রয়েছে। কিন্তু আপনি কি কখনো শ্রমিক বিভাগ দেখেছেন? শ্রমিকদের নিয়ে কোনও বিভাগ রয়েছে, এরকম একটি পত্রিকার কথাও আমার জানা নেই। প্রত্যেকের একটি ব্যবসা বিভাগ রয়েছে। ব্যবসা নিয়ে সংবাদপত্র আছে। কিন্তু শ্রমিকদের নিয়ে কি কোনও সংবাদপত্র আছে? আপনি যদি এখানে দেখেন, আমি জানি না, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন প্রতিবেদককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন যিনি শ্রমিক আন্দোলন কাভার করার জন্য নিযুক্ত হয়েছেন। সারা দেশে হয়ত মাত্র দুজনএ নিয়ে কাজ করছেন। তার মানে পুরো জনগোষ্ঠী গণমাধ্যমের আওতায় আসে না। যা আসে তা হলো ব্যবসার জগত এবং এটি ক্ষমতারই প্রতিফলন। যতক্ষণ না পর্যন্ত জনগণ প্রোপাগন্ডার কৌশল উন্মোচনে সফল হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের মুক্ত করতে  সক্ষম হবে না। সুতরাং, এই পার্থক্যগুলো অতিক্রম করতে পারাটা কাজের অংশ।

সরকারের সেবামূলক খাতের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। জনসাধারণের একটি বড় অংশ মনে করে যে মানুষকে নূন্যতম জীবন যাপনের মান, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। অন্যদিকে, তারা একই ধারার সেবার বিরোধিতাও করে। এর কারণ, সেবার [দৃশ্যমান] চিত্রটি এরকম যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ধনী নারী একের পর এক বাচ্চা জনম দিচ্ছেন যার জন্য আমাদেরকে [জনগণকে] টাকা দিতে হচ্ছে এবং ক্যাডিলাকে চড়ে তিনি সমাজকল্যাণ অফিসে সেই টাকার চেক ভাঙ্গাতে যাচ্ছেন। সেবা সম্পর্কে জনগণের ধারণাটি এরকমই। এতে আপনি বুঝতে পারবেন তারা কেন কল্যাণমূলক খাতের বিপক্ষে। কেন আমি তাকে [ধনী কৃষ্ণাঙ্গ] টাকা দেয়ার জন্য কাজ করব?  সুতরাং তারা কল্যাণ খাতের বিপক্ষে। আবার ওই মানুষেরাই কিন্তু বলছে, আচ্ছা ঐ গরিব নারীতো তার বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারছেন না, তার সাহায্য দরকার। এটি কোন স্ববিরোধ নয়। এটি ব্যাপক মতাদর্শিক দীক্ষায়নের ভিতরে নির্মিত একটি ভুল ধারণা। এবং এর সমাধান হলো, মতাদর্শিক দীক্ষায়ন প্রক্রিয়াকে উন্মোচন করা। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে, ব্রাজিলকে তার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এটি একটি মতাদর্শিক দীক্ষায়ণ। কারা ঋণ পরিশোধ করবে? যারা এই টাকা গ্রহণ করেছে এবং আরো টাকা বানানোর জন্য এটি নিউ ইয়র্কে ফেরত পাঠিয়েছে তারা? কাউকে যদি ঋণ পরিশোধ করতে হয়, তাহলে সেটা ওরা, ব্রাজিলের মানুষ নয়। আপনাকে এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে কথা বলতে হবে। যাতে জনগণ বুঝতে পারে। এগুলো খুব কঠিন নয়। এগুলো নিয়ে আপনাকে উত্তরাধুনিক ভাষ্যে কথা বলতে হবে না। আপনি এগুলো নিয়ে খুব সহজ ভাষাতেই কথা বলতে পারেন। কারণ এগুলো খুব সহজ ব্যাপার। জনগণও এগুলো সহজে বোঝে। একমাত্র তারাই এই সহজ ব্যাপারগুলি বোঝে না যারা বুদ্ধিজীবী। কিন্তু তাদের আগ্রহ না বোঝার দিকেই। কেননা, যদি তারা বোঝেন তাহলে তাদের নিজেদের ক্ষমতা আর থাকবে না। সুতরাং তারা এগুলো বুঝতে যাবেন না, বরং তারা একে আরো রহস্যাবৃত করে আরো  ঘোরপ্যাচে করে ফেলতে চাইবেন।

বাধন অধিকারী

বাধন অধিকারী প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। ক্ষমতা-মিডিয়া ও নিও লিবারালজম তার অন্যতম আগ্রহের জায়গা। এ বিষয়ে গবেষণা ও পর্যালোচনামূলক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। সম্পাদনা করেছেন ছোটকাগজ অভীপ্সাসহ একাধিক প্রকাশনা। ১/১১’র সেনা কর্তৃত্বের জরুরি অবস্থার সময়ে সহযোদ্ধা বন্ধুদের সঙ্গে জরুরি আইন ভঙ্গ করে আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই সময়ে গড়ে ওঠা কর্তৃত্ব বিরোধী মঞ্চে সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রাখেন। প্রকাশিত গ্রন্থ: ক্ষমতা, মিডিয়া আর মানুষ; বাংলাদেশ পরিস্থিতি: নয়া উদারবাদী যুগে শাসনপ্রণালী ও কথকথা (সম্পাদনা); প্রেম ও প্রতিরোধ: সমাজ, রাষ্ট্র ও বাজারের ভার্চুয়াল দিনলিপি।
যোগাযোগ: badhanadhikari84@gmail.com

মোকাররম রানা