অরাজ
প্রচ্ছদ » নোম চমস্কির সাক্ষাৎকার।। ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ মহাপ্রলয়ের কালকে ত্বরান্বিত করেছে

নোম চমস্কির সাক্ষাৎকার।। ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ মহাপ্রলয়ের কালকে ত্বরান্বিত করেছে

  • অনুবাদ: ইমন রায় 

অনুবাদকের নোট: নোম চমস্কি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী গণবুদ্ধিজীবী ও আধুনিক ভাষাতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বর্তমানে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের লরিয়েট অধ্যাপক এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (এমআইটি) ভাষাতত্ত্ব ও দর্শন বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক। তাঁর লিখিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত বইয়ের নাম কনসিক্যুয়েন্সেস অফ ক্যাপিটালিজম: ম্যানুফ্যাকচারিং ডিসকন্টেন্টস এন্ড রেজিস্ট্যান্স। নোম চমস্কির সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সি.জে. পলিক্রনিউ। তিনি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, লেখক ও সাংবাদিক যিনি ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করেছেন ও পড়িয়েছেন। বর্তমানে তাঁর গবেষণার আগ্রহের মধ্যে রয়েছে মার্কিন রাজনীতি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনীতি, ইউরোপীয় অর্থনৈতিক একীভবন, বিশ্বায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত অর্থনীতি, এবং নব্যউদারনৈতিকতার আর্থরাজনৈতিক প্রকল্পের বিনির্মাণ। তিনি ট্রুথ আউট এর একজন নিয়মিত প্রদায়কের পাশাপাশি ট্রুথ আউট এর পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল প্রকল্পের একজন সদস্য। মূল লেখাটি ট্রুথআউটে Noam Chomsky: Russia’s War Against Ukraine Has Accelerated the Doomsday Clock শিরোনামে ৩০শে মার্চ ২০২২ তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল।

নোম চমস্কি; শিল্পী: সার্জ মেজেট; সূত্র: আর্টমেজেউর

মূল সাক্ষাৎকার  

ইউক্রেইন যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়ার সামরিক কৌশল ও ভ্লাদিমির পুতিনের ভূকৌশলগত লক্ষ্যসমূহ নিয়ে অনেক জল্পনা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, পুতিন কী চান সেটা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়, এবং ইউক্রেইনীয় প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনেস্কির বারংবার মুখোমুখি বৈঠকের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছে মস্কো, যদিও এটি শীঘ্রই পরিবর্তিত হতে পারে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় দেশগুলো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন একটি ঠাণ্ডা যুদ্ধের সম্ভাব্য স্পষ্টতম ইঙ্গিত দিয়ে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করে তখন ইউক্রেইনের ধ্বংস অদ্যবধি অক্ষুণ্ণ রয়েছে। নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) তার পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টে শক্তি বৃদ্ধি করছে এবং ওয়াশিংটন থেকে এমন কোনো লক্ষণ নেই যে ইউক্রেইনে যুদ্ধ বন্ধ করতে বাইডেন প্রশাসন গঠনমূলক কূটনীতিতে লিপ্ত হতে আগ্রহী। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কার্যত রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জ্বালাময়ী ভাষা ব্যবহার করে আগুনে ঘি ঢালছেন।

নিচের সাক্ষাৎকারে বিশ্বখ্যাত স্কলার ও নেতৃস্থানীয় ভিন্নমতাবলম্বী নোম চমস্কি ইউক্রেইন যুদ্ধের সর্বশেষ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আলোচনা করেছেন, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নৈতিক ক্ষোভের চরম নির্বাচনীয়তাকে আমাদের নিকট সুচারুভাবে উন্মোচন করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সম্পর্কে তাঁর কিছু অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে রয়েছে রিপাবলিকান পার্টির মতাদর্শিক জগতের পুনর্বিন্যাস, রাজনৈতিক উত্তাপ ও বই নিষিদ্ধকরণ।

সি.জে. পলিক্রনিউ: নোম, ইউক্রেইনের যুদ্ধের সর্বশেষ প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, কতিপয় ইউক্রেইনীয় কর্মকর্তার মতে, দেশটিকে “উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া”র মত ভাগ করার উদ্দেশ্যে রাশিয়া তার কৌশল পরিবর্তন করছে। এর মধ্যে ন্যাটো তার পূর্ব ফ্রন্টে শক্তি বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেন রাশিয়ার বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও স্লোভেনিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা রয়েছে। ইউক্রেইনে শান্তির বিষয়ে ওয়াশিংটন কেবল নীরবই থাকছে না, বরং আমরা শুনেছি বাইডেন তাঁর সাম্প্রতিক পোল্যান্ড সফরে পুতিনের বিরুদ্ধে অনেকটা বিষাক্ত তেজোদ্দীপ্ত কথাবার্তায় লিপ্ত হয়েছেন। এর ফলে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন জ্বালাময়ী ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করতে সচেষ্ট হয়েছেন কারণ তিনি প্রকৃতপক্ষে একটি যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। এমনকি আমেরিকান অভিজ্ঞ কূটনৈতিক রিচার্ড হাস বলেছেন যে বাইডেনের কথাগুলো একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতিকে আরও বেশি বিপজ্জনক করে তুলেছে। সমস্ত একাগ্রতার সাথে এই প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি কখনো ভাবতে পারে যে ভীতিপ্রদর্শন ও নিরন্তর শক্তির ব্যবহার ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে সংঘাত নিরসন করা যেতে পারে?

নোম চমস্কি: কয়েকটি প্রশ্ন আছে, সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ, আমি এখানে যা বলার চেষ্টা করতে পারি তার চেয়েও বেশি আলোচনার যোগ্য। আমি মোটামুটি ক্রমানুসারে বলবো।

চলমান সামরিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন দুটো গল্প আছে। পরিচিত গল্পটি দিয়েছেন ইউক্রেইনের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল কিরিলো বুদানভ : ইউক্রেইনীয় সরকার উৎখাতের জন্য রাশিয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, তাই রাশিয়া এখন একটি “কোরিয়ান দৃশ্যপট” পরিকল্পনা করার মাধ্যমে দেশটির দক্ষিণে ও পূর্বে, ডনবাস অঞ্চলে ও পূর্বাঞ্চলীয় আজভ সমুদ্র উপকূলের দিকে পিছু হটছে।

রাশিয়ান ফেডারেশনের জেনারেল স্টাফ অফ দ্য আর্মড ফোর্সেসএর প্রধান পরিচালন অধিদপ্তরের প্রধান কর্নেল জেনারেল সের্গেই রুদস্কয় একদম ভিন্ন একটি গল্প বলেছেন (২৫ মার্চ পর্যন্ত): ইরাকে জর্জ ডব্লিউ বুশের “মিশন সম্পন্ন” হওয়ার অনুরূপ, যদিও নাটকীয় কৃত্রিমতা নেই:

বিগত আট বছর ধরে ইউক্রেইনীয় নাৎসিদের গণহত্যামূলক আক্রমণ থেকে ডনবাস পিপলস রিপাবলিককে রক্ষা করাই হচ্ছে “বিশেষ সামরিক অভিযান” এর মূল লক্ষ্য। ইউক্রেইন যেহেতু কূটনীতি প্রত্যাখ্যান করেছে, তাই অসামরিকদের রেহাই দিয়ে খুব সতর্কতার সহিত সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোকে ধ্বংস করার মাধ্যমে ইউক্রেইনের “বিসামরিকীকরণ ও বিনাৎসিকরণ” এর জন্য অভিযানটি বিস্তৃত করা প্রয়োজনীয় ছিলো। পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথভাবে দক্ষতার সহিত প্রধান লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়েছে। যা অবশিষ্ট আছে তা হলো “ডনবাসের পূর্ণ মুক্তি।”

দুটো গল্প, একই সমাপ্তি, যা আমি মনে করি নিখুঁত।

পশ্চিম, বেশ স্বাভাবিকভাবে, প্রথম গল্পটি গ্রহণ করেছে। এটি সেই গল্পটি গ্রহণ করেছে যা আমাদের বলে যে রাশিয়ানরা তাদের সীমান্ত থেকে কয়েক মাইলের মধ্যে শহরগুলো দখল করতে সক্ষম নয়, যেগুলো বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুসারে একটি নাগরিক সৈন্যবাহিনী সমর্থিত সীমিত সামরিক শক্তি দ্বারা রক্ষিত।

অথবা পশ্চিম কি এই গল্পটি গ্রহণ করে? এর কার্যকলাপ ইঙ্গিত দেয় যে এটি জেনারেল রুদস্কয়ের সংস্করণটি বেশি পছন্দ করে—একটি অবিশ্বাস্যভাবে ক্ষমতাধর ও সুদক্ষ রাশিয়ান সামরিক যন্ত্র ইউক্রেইনে তার লক্ষ্যসমূহ তাড়াতাড়ি অর্জন করার মাধ্যমে হয়ত দক্ষতার সহিত ন্যাটোকে গ্রাস করে এখন ইউরোপকে আক্রান্ত করার জন্য এগিয়ে যেতে প্রস্তুত। যদি তাই হয়, তাহলে এই দানবীয় শক্তির আসন্ন আক্রমণকে ঠেকানোর করার জন্য ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টে শক্তিবৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

আরেকটি ভাবনা নিজেই প্রকাশিত হয়—এটা কি হতে পারে যে ইউরোপকে ওয়াশিংটনের খপ্পরে ঠেলে দেওয়ার মাধ্যমে পুতিন তাকে যে দারুণ উপহার দিয়েছেন সেটাকে ওয়াশিংটন আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, এবং সেজন্য পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টে তার জানামতে আক্রমণের হুমকি না থাকার পরেও সেখানে শক্তিবৃদ্ধি করতে ইচ্ছুক?

আমরা পূর্বে যে যৌথ বিবৃতি নিয়ে আলোচনা করেছি সে অবস্থান থেকে এখন পর্যন্ত ওয়াশিংটন সরে আসেনি। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালার বিবৃতির মাধ্যমে ওয়াশিংটন ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে ইউক্রেইনকে স্বাগত জানিয়েছে এবং “ন্যাটোর বর্ধিত সুবিধাদির একটি অংশীদার হিসেবে ইউক্রেইনের পদমর্যাদা টিকিয়ে রাখার জন্য বলিষ্ঠ প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন কর্মসূচি”র পাশাপাশি ইউক্রেইনকে উন্নত এন্টিট্যাংক ও অন্যান্য অস্ত্র প্রদানের মাধ্যমে “মার্কিনইউক্রেইন কৌশলগত প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য একটি ভিত্তি রচনা করে এমন একটি কৌশলগত প্রতিরক্ষা কাঠামো চূড়ান্ত করেছে।”

পুতিন কেন ইউক্রেইন আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা খুঁজে বের করার জন্য তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত মনের গভীর নিভৃতে পৌঁছানোর ব্যাপারে অনেক বিদগ্ধ আলোচনা রয়েছে। অপরাধমূলক আগ্রাসনের দিকে যাওয়ার মাধ্যমে তিনি ইউক্রেইনের সীমান্তে বাৎসরিক সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগ বিবেচনা করার জন্য তাঁর নিরুত্তর আহ্বানের বিষয়ে কিছুটা মনোযোগ আকর্ষণ করা। এটি অনেক উচ্চপদস্থ মার্কিন কূটনৈতিক, সিআইএ পরিচালক, এবং আরও অনেকের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত যারা এসমস্ত উদ্বেগকে অগ্রাহ্য করার বোকামি সম্পর্কে ওয়াশিংটনকে সতর্ক করেছেন।

শিল্পী: এলেক্স উইলিয়ামসন; সূত্র: নিউস্টেটসম্যান

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুতিনের সিদ্ধান্তকে বোঝার সঠিক পন্থা হচ্ছে সম্ভবত পুতিনের মনের অনুসন্ধান করা। হয়ত আরেকটি সম্ভাবনা আছে। হয়ত ২৫ বছর আগে বরিস ইয়েলেৎসিন থেকে শুরু করে তিনি ও অন্যান্য রাশিয়ান নেতৃবৃন্দ ইউক্রেইনের নিরপেক্ষতার বিষয়ে যা বলে আসছিলেন সেটাই বুঝিয়েছেন; এবং সম্ভবত, অত্যন্ত উস্কানিমূলক যৌথ বিবৃতিটি যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাবিয়ে রাখা হয়েছে, পুতিন হয়ত এ বিষয়ে ভেবে থাকবেন এবং তাই সরাসরি সংঘর্ষের যে প্রচেষ্টাকে প্রতি বছর উপেক্ষিত রাখা হয় সেটিকে ত্বরান্বিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

হয়ত, এটি একটি সম্ভাবনা।

সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, “যদি রাশিয়া সেনা প্রত্যাহার করে নেয় এবং কিয়েভ নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পায় তাহলে ইউক্রেইন নিরপেক্ষতা ঘোষণা করতে, ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা ত্যাগ করতে এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিকশিত না করার জন্য প্রতিশ্রুতি দিতে প্রস্তুত।”

এটি একটি প্রশ্নকে তুলে ধরে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি আলোচনায় অংশ নিতে অস্বীকার করার মাধ্যমে ও গত সেপ্টেম্বরের নীতিমালা বিবৃতির অবস্থানকে বজায় রাখার মাধ্যমে এসব প্রচেষ্টায় বাগড়া দেওয়ার পরিবর্তে নমনীয় হবে, এবং ইউক্রেইনকে অধিকতর দুর্দশা থেকে রক্ষা করার চেষ্টাকে ত্বরান্বিত করতে যাবে?

পুতিনকে পালাবার কোনো পথ না দিয়ে, তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য বাইডেনের অবিবেচনাপ্রসূত বক্তব্যের দিকে এই প্রশ্নটি আমাদের নিয়ে যায়। বাইডেনের বক্তব্য কার্যত একটি যুদ্ধের ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃত যার পরিণতি হতে পারতো ভয়াবহ, বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট আতঙ্ক তৈরি করেছে। এই আতঙ্ক তাঁর কর্মকর্তাদের মধ্যেও কম নয়, যারা ত্বরিত হয়ে বিশ্বকে আশ্বস্ত করেছেন যে তিনি যা বলেছেন তাঁর কথায় সেটা বুঝায় না। জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুগুলোতে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের অবস্থানকে বিচার করলে এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত হওয়া মুশকিল।

বাইডেন তখন থেকে ব্যাখ্যা করেছেন যে তাঁর বক্তব্য “নৈতিক ক্ষোভের” একটি স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ, রাশিয়াকে যে “কসাই” শাসন করে তাঁর অপরাধের প্রতি বিতৃষ্ণা। অন্য কোনো চলমান পরিস্থিতি আছে যা নৈতিক ক্ষোভকে অনুপ্রাণিত করতে পারে?

ঘটনাগুলো ভেবে দেখা কঠিন কিছু নয়। সবচেয়ে ভয়াবহগুলোর মধ্যে আছে আফগানিস্তান। আক্ষরিকভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারের সম্মুখীন, একটি সুবিশাল ট্র্যাজেডি। বাজারে খাবার আছে, কিন্তু ব্যাংকে যাওয়ার সুযোগ না থাকার কারণে যাদের অল্প টাকা আছে তাদের সন্তানদের অনাহারে দেখতে হয়।

কেন? একটি প্রধান কারণ হচ্ছে ওয়াশিংটনের ২০ বছরের যুদ্ধকে প্রতিরোধ করার সাহস দেখানোর কারণে দরিদ্র আফগানদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নিউ ইয়র্কের ব্যাংকগুলোতে রক্ষিত আফগানিস্তানের তহবিলগুলো মুক্ত করতে ওয়াশিংটন অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সরকারি অজুহাত আরও বেশি লজ্জাজনকঃ আমেরিকানরা ৯/১১ এর অপরাধের ক্ষতিপূরণ চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই অনাহারী আফগানদের থেকে তহবিলগুলো আটকে রাখতে হবে, যার জন্য আফগানরা দায়ী নয়। মনে রাখুন তালেবানরা সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়েছিলো, যার অর্থ দাঁড়ায় আলকায়েদা সন্দেহভাজনদের ফিরিয়ে দেওয়া। (মার্কিন আক্রমণের সময়, আদতে তার অনেক পরে, যেটা এফবিআই নিশ্চিত করেছিলো, তারা কেবল সন্দেহভাজন ছিলো) তবে যুক্তরাষ্ট্র এই ঘোষণার মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে জবাব দিয়েছে যে, “যুক্তরাষ্ট্র আত্মসমর্পণের বিষয়ে দরকষাকষি করতে ইচ্ছুক নয়।” ডিফেন্স সেক্রেটারি ডোনাল্ড রামসফেল্ডের কথাটি জর্জ ডব্লিউ বুশের দ্বারা প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো।

এই চলমান অপরাধের ব্যাপারে যদি কোনো নৈতিক ক্ষোভ থাকে, সেটা শনাক্ত করা কঠিন। এটি একমাত্র ঘটনা নয়। কোনো শিক্ষণীয় কিছু আছে? হয়ত আছে, কিন্তু এগুলো যথেষ্ট সাধারণ মনে হলেও এ বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার।

ইউক্রেইনে রাশিয়ার অপরাধের ব্যাপারে নৈতিক ক্ষোভটি বোধগম্য এবং ন্যায়সঙ্গত। নৈতিক ক্ষোভের চরম নির্বাচনও বোধগম্য কিন্তু ন্যায়সঙ্গত নয়। এটি অনেক দেখা যায় বলে বোধগম্য।

শ্রেষ্ঠ নিয়মের চেয়ে আরও বেশি প্রাথমিক মৌলিক নীতির কথা চিন্তা করা দুষ্কর—ইহুদী ঐতিহ্যে নিয়মটি হচ্ছে, “তোমার কাছে যা ঘৃণিত তা অন্যদের সাথে করো না।”

এমন কোনো নিয়ম নেই যা এর চেয়ে বেশি মৌলিক, কিংবা নিয়মিতভাবে এর চেয়ে বেশি লঙ্ঘিত হয়। একটি অনুসিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও তা সত্য : উদ্যম ও মনোযোগ সেখানেই কেন্দ্রীভূত করা উচিত যেখানে আমরা সবচেয়ে বেশি ভালো করতে পারি। আন্তর্জাতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে সাধারণত এর অর্থ হচ্ছে নিজ রাষ্ট্রের কাজে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা, বিশেষত কমবেশি গণতান্ত্রিক সমাজগুলোতে যেখানে ফলাফল নির্ণয়ে নাগরিকদের কিছু ভূমিকা থাকে। আমরা মিয়ানমারের [বার্মা নামেও পরিচিত] অপরাধকে ঘৃণা করতে পারি, কিন্তু মিয়ানমারের ভেতরে কষ্ট ও দুর্ভোগ দূর করার জন্য আমরা বেশি কিছু করতে পারি না। যেসকল দুর্দশাগ্রস্ত ভুক্তভোগী পালিয়ে এসেছেন কিংবা উৎখাত হয়েছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা, তাদেরকে সাহায্য করার জন্য অনেক কিছু করতে পারি। কিন্তু আমরা করবো না।

পর্যবেক্ষণটিকে সর্বজনীন করা হয়। নীতিটি প্রকৃতপক্ষে মৌলিক। প্রকৃত চর্চাটি নীতির সাথে সঙ্গতি রাখতে ব্যর্থ হয়, এটা বললে খুবই অবমূল্যায়ন হবে। 

ওয়ার; কার্টুনিস্ট: ফ্রাগিস্কস; সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

এমন নয় যে আমরা নীতিটি বুঝি না এবং সেটাকে সম্মান করি না। আমরা সত্যিকারের অনুরাগের সহিত তা করি যখন আনুষ্ঠানিক প্রতিপক্ষদের সমাজে এই নীতিটি পরিলক্ষিত হয়ঃ যেসকল রাশিয়ান সাহসিকতার সাথে কঠোর রাশিয়ান স্বৈরতন্ত্রকে অস্বীকার করছেন ও রাশিয়ান আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন তাঁদের প্রতি আমরা কুর্নিশ জানাই। এর একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। আমরা সবসময়ই সোভিয়েত ভিন্নমতাবলম্বীদের গভীরভাবে সম্মানিত করেছি যারা তাঁদের নিজ রাষ্ট্রের অপরাধগুলোর নিন্দা জানিয়েছেন এবং এমনকি অন্যরা যখন প্রধান মার্কিন অপরাধগুলোকে প্রশংসিত করতেন, তাদের নিয়েও কথা বলতে একদমই কুণ্ঠিত হতেন না। চীনা ও ইরানি ভিন্নমতাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও তাই। যখনই কেবল আমাদের ওপর নীতিটি প্রযোজ্য হয় তখন এটি একদমই অনুশীলন করা হয় না।

ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণ হচ্ছে আমাদের অনেক নাটকীয় নিদর্শনের মধ্যে অন্যতম। একে একটি “কৌশলগত সাংঘাতিক ভুল” (বারাক ওবামার মতে) হিসেবে সমালোচনা করা যেতে পারে এবং এটি যা ছিলো সে হিসেবে নয়ঃ অপ্ররোচিত ও খুনে আগ্রাসন, ন্যুরেমবার্গের দণ্ডাদেশ অনুসারে “সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ।”

সে অনুযায়ী নৈতিক ক্ষোভের নাটকীয় নির্বাচনটি বোধগম্য এবং সেটি আরেকটি ক্ষোভ। অপরাধকে লঘু করার দুর্বল প্রয়াস হিসেবে আমরা আরও বলতে পারি যে এটি মার্কিন আবিষ্কার নয়। আধিপত্যকামী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আমাদের পূর্বপুরুষেরা, ব্রিটেন সহকারে, ভিন্ন কিছু ছিলেন না; তর্কসাপেক্ষে আরও খারাপ ছিলেন, যদিও শতাব্দীব্যাপী জঘন্য আচরণের পর এখন দায়স্বীকারের সূচনা হয়েছে।

পরবর্তী প্রশ্নের দিকে গেলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি কখনো ভাবে যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংঘাত নিরসন করা যেতে পারে? কোনো সন্দেহ নেই। দৃষ্টান্ত রয়েছে যেগুলোর প্রতি গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা দরকার। আমরা চাইলে আন্তর্জাতিক বিষয়াদির ব্যাপারে সেগুলো থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি।

ঠিক এই মূহুর্তে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংঘাত নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তকে উদযাপন করার জন্য আমাদের সবাইকে আহ্বান জানানো হচ্ছে—ইসরায়েল ও চার আরব স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে চলমান “নেগেভ সম্মেলন।” এই ঐতিহাসিক সভাতে ওয়াশিংটনের প্রতিনিধি সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্থনি ব্লিংকেনের মতে, এটি “এই অঞ্চলে শান্তি ও সংঘাত নিরসনের সম্ভাবনাকে বর্ধিত করবে।”

সম্মেলনটি আব্রাহাম চুক্তির ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের কক্ষপথের মধ্যে থাকা সর্বাধিক নিষ্ঠুর ও সহিংস রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত করেছে। চুক্তিটি ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও মরক্কোর মধ্যকার মৌন সম্পর্ককে আনুষ্ঠানিকতা দিয়েছে, যেখানে সৌদি আরব তার মুখাপেক্ষী বাহরাইন একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে অন্তর্নিহিতভাবে উপস্থিত ছিলো। সম্মেলনে মিশর তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিলো, যেটি এখন প্রায় ৬০,০০০ রাজনৈতিক বন্দী ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তার কুৎসিত ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য একনায়কতন্ত্রের অধীনে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। ইসরায়েলের পর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার সবচেয়ে বড় গ্রাহক হচ্ছে মিশর। সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক বর্ণবাদী রাষ্ট্রের তকমা পাওয়া শীর্ষস্থানীয় গ্রাহকের জঘন্য রেকর্ড পর্যালোচনা করার দরকার নেই।

বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানবিক সংকট হিসেবে জাতিসংঘ যাকে আখ্যা দিয়েছে, সেই ইয়েমেনের জন্য প্রাথমিক দায়ের ভাগীদার হচ্ছে ইউএই ও সৌদি আরব। গত বছর সরকারি হিসেবে মৃত্যু সংখ্যা তিন লাখ সত্তর হাজারে পৌঁছেছে। আসল সংখ্যা কেউ জানে না। খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির জন্য ব্যবহৃত একমাত্র বন্দরটির ওপর সৌদি আরব তার অবরোধ জোরদার করেছে। জাতিসংঘ চরম সতর্কবার্তা প্রচার করছে, লক্ষ লক্ষ শিশুর আসন্ন অনাহারের ঝুঁকির কথা বলছে। মার্কিন বিশেষজ্ঞরা সাধারণ সতর্কবার্তার সাথে গলা মিলিয়েছেন। ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের ব্রুস রিডেলের কথা এখানে উল্লেখযোগ্য, যিনি চার জন প্রেসিডেন্টের আমলে মধ্যপ্রাচ্যে সিআইএএর সাবেক শীর্ষ বিশ্লেষক ছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, সৌদির “আক্রমণাত্মক কাজকে” একটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে তদন্ত করা উচিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান, প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য, খুচরা যন্ত্রাংশ ছাড়া সৌদি ও আমিরাতি বিমান বাহিনী কাজ চালাতে পারে না। অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির সাথে ব্রিটেন এই অপরাধে অংশ নিচ্ছে, তবে নেতৃত্ব দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ট্রাম্পের শান্তি উদ্যোগে মরক্কোর একনায়কতন্ত্রকেও স্বাগত জানানো হয়েছিলো। ডোনাল্ড ট্রাম্প এমনকি তাঁর ক্ষমতার শেষ দিনগুলোতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের বিরুদ্ধে গিয়ে মরক্কো কর্তৃক পশ্চিম সাহারার অন্তর্ভুক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন—যা ঘটনাক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপূরণীয় সম্পদ পটাশিয়ামের ওপর মরক্কোর কার্যত একাধিপত্যকে জোরদার করেছে, যা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আওতাধীন।

মরক্কোর অপরাধমূলক অন্তর্ভুক্তির অনুমোদন দেওয়াকে আশ্চর্যজনক হিসেবে নেওয়া উচিত নয়। এটি ইসরায়েল কর্তৃক গোলান উপত্যকা এবং বিশালাকারে বিস্তৃত বৃহৎ জেরুজালেমের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ট্রাম্পের স্বীকৃতিকে অনুসরণ করেছে, উভয় ক্ষেত্রেই নিরাপত্তা পরিষদের আদেশগুলো লঙ্ঘিত হয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই চমৎকার বিচ্ছিন্নতা, যা যুক্তরাষ্ট্র প্রায়ই উপভোগ করে, তার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য ট্রাম্পের সমর্থনটি গৃহীত হয়েছিলো, যেমনটা ৬০ বছর ধরে কিউবাকে তার অত্যাচারের ক্ষেত্রে দেখা যায়।

এগুলো কেবল “আইনের শাসন” ও সার্বভৌমত্বের অলঙ্ঘনীয়তার প্রতি অঙ্গীকারের আরও কিছু দৃষ্টান্ত, যা ওয়াশিংটন ৭০ বছর যাবত ইরান, গুয়াতেমালা, ব্রাজিল, চিলি, ইরান ও আরও অনেক দেশে দেখিয়েছে—ইউক্রেইনকে ন্যাটোতে যোগ দিতে স্বাগত জানানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন।

আমরা এখন যে সম্মেলটিকে উদযাপন করছি সেটি আব্রাহাম চুক্তির একটি সরাসরি বিকাশ। এগুলো প্রণয়ন করার জন্য জেয়ারড কুশনারকে (হার্ভার্ডের আইনের অধ্যাপক অ্যালান দারশোভিচ কর্তৃক) নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।

সংঘাতের শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় ওয়াশিংটন যে তার নিষ্ঠা প্রদর্শন করেছে সেটা আব্রাহাম চুক্তি ও আজকের নেগেভ সম্মেলনেই প্রথম নয়। সর্বোপরি, হেনরি কিসিঞ্জার কূটনৈতিক ইতিহাসে গণহত্যার অন্যতম অসাধারণ আহ্বানটি প্রচার করার পরপরই ভিয়েতনামে শান্তি আনয়নে তাঁর অর্জনের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছিলেনঃ “কম্বোডিয়াতে এক ব্যাপক বোমা হামলা অভিযান। যা কিছু চলনশীল তার ওপর দিয়ে উড়তে হয়।” পরিণাম ছিলো ভয়াবহ, কিন্তু কোনো ব্যাপার নয়।

কিসিঞ্জারের পুরস্কার মনে করিয়ে দিয়েছে যে [ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী] মেনাশিম বেগিনকে পদার্থবিজ্ঞানে পুরস্কার প্রদানের জন্য একজন ইসরায়েলি পদার্থবিজ্ঞানী প্রস্তাব করেছিলেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, “দেখুন, তাঁকে শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে, তাহলে পদার্থবিজ্ঞানের পুরস্কার কেন নয়?”

এই ঠাট্টা অনেক সময় অন্যায্য। জিমি কার্টার নিশ্চিতভাবে শান্তি পুরস্কারের যোগ্য ছিলেন যা তিনি প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর তাঁর প্রচেষ্টার জন্য লাভ করেছিলেন। পুরস্কার কমিটি অবশ্য জোর দিয়ে বলেছিলো যে ক্ষমতায় থাকার সময় প্রেসিডেন্ট কার্টারের “ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যকার ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানটি নোবেল পুরস্কারের জন্য যোগ্য হওয়ার একটি অতিশয় যথেষ্ট কৃতিত্ব ছিলো।”

কার্টারের ১৯৭৮ সালের প্রচেষ্টাগুলো নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম নিয়তের সহিত গৃহীত হয়েছিলো। এটি পুরোপুরি সেরকম ফল লাভ করেনি। মেনাশিম বেগিন মিশরীয় সিনাইয়ে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের প্রকল্পকে পরিত্যাগ করতে রাজি হয়েছিলেন কিন্তু চুক্তিগুলো থেকে ফিলিস্তিনিদের অধিকারসমূহকে বাদ দেওয়ার জন্য জোর করেছিলেন, এবং অ্যারিয়েল শ্যারনের পরিচালনায় সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন সহায়তার সহিত ও নিরাপত্তা পরিষদের নিদের্শনাকে লঙ্ঘন করে অবৈধ স্থাপনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। আর ইসরায়েলি কৌশলগত বিশ্লেষকরা দ্রুতই বের করেছিলেন যে, মিশরীয় প্রতিবন্ধকতাকে সরিয়ে ফেলার কারণে ইসরায়েল লেবাননে তার আক্রমণ বৃদ্ধি করতে পেরেছিলো, যার ফলে অবশেষে ১৯৮২ সালের মার্কিন সমর্থিত আক্রমণে প্রায় ২০,০০০ লেবানিজ ও ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন এবং কোনো বিশ্বাসযোগ্য অজুহাত ছাড়াই লেবাননের অধিকাংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলো।

রাজধানী শহর বৈরুতের ওপর বোমাবর্ষণ যখন ওয়াশিংটনের জন্য আন্তর্জাতিক গ্লানি তৈরি করছিলো তখন রোনাল্ড রিগ্যান অবশেষে ইসরায়েলকে আক্রমণ বন্ধ করতে আদেশ দেন। ইসরায়েল অবশ্যই সম্মত হয়েছিলো কিন্তু তাদের ভাষায় যে “সন্ত্রাসবাদী গ্রামবাসীরা” নিষ্ঠুর দখলদারিত্বের প্রতিরোধ করেছে তাদের প্রতি ক্রমাগত অত্যাচারের মাধ্যমে দক্ষিণ লেবাননে তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলো। এটি খিয়ামেও একটি জঘন্য নির্যাতন কক্ষ স্থাপন করেছিলো। হিজবুল্লাহ গেরিলা যুদ্ধকৌশলের মাধ্যমে শেষমেশ ইসরায়েলকে চলে যেতে বাধ্য করার পর একে একটি স্মৃতিস্থাপনা হিসেবে রাখা হয়েছিলো। ইসরায়েলি বোমা হামলার মাধ্যমে অপরাধের স্মৃতিকে ধ্বংস করার আগে আমাকে সেটা ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছিলো।

অতএব, হ্যাঁ, কিছু ঘটনা আছে যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার পূর্বেকার অন্যান্য আধিপত্যকামী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মত, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করেছে।

সি.জে. পলিক্রনিউ: দেশে রিপাবলিকানরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নীতির জন্য মদদ দিচ্ছে, যদিও তাদের “মহান নেতা” চলমান ঘটনাপ্রবাহের সাথে তাল মেলানোর জন্য পুতিনের ব্যাপারে তাঁর সুর পরিবর্তন করে চলেছেন। এখানে প্রশ্ন হচ্ছেঃ এখনও জিওপি (রিপাবলিকান পার্টি) সদস্যদের মধ্যে, বিশেষত রাজনৈতিক বলয়ের অতি ডানপন্থীদের মধ্যে, রাশিয়া ও পুতিনের জন্য সমর্থন থাকার কারণ কী? দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত যখন ইউক্রেইনের পক্ষে তখন কোন জিনিসটি রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে রাশিয়ার বিষয়ে মতদ্বৈধতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অতি ডানপন্থীদের অনুপ্রাণিত করছে?

নোম চমস্কি: এটি শুধু রাশিয়া ও ইউক্রেইন নয়। ইউরোপ যখন হাংগেরিতে প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানের “সংকীর্ণ গণতন্ত্র”কে নিন্দা জানিয়েছে তখন এটি আমেরিকান ডানপন্থার অনেকাংশের প্রিয়ভাজন হয়েছে। ফক্স নিউজ ও তার প্রধান সম্প্রচারক টাকার কার্লসন এর নেতৃত্বে আছেন, কিন্তু অন্যান্য প্রখ্যাত “রক্ষণশীলরা” হাঙ্গেরির স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেওয়ার মাধ্যমে ওরবান কর্তৃক আরোপিত আদিফ্যাসিস্ট খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রশংসায় গা ভাসাচ্ছে

এসব কিছুই রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে একটি সংঘাতকে প্রতিফলিত করে—অথবা আরও সঠিকভাবে বললে, এক সময়কার একটি বৈধ রাজনৈতিক দলের যা অবশিষ্ট আছে তা এখন নব্যফ্যাসিবাদী উৎসের ইউরোপীয় দলগুলোর কাতারে অবস্থান করছে। ট্রাম্প যে প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করেছেন তার মূলে আছে ৩০ বছর আগে নিউট গ্যাংরিচ কর্তৃক পার্টির কর্তৃত্ব গ্রহণ। ট্রাম্প এখন ডানপন্থীদের কাছে পরাস্ত হচ্ছেন, খুব বেশি দিন আগেও এটা কল্পনা করা কঠিন ছিলো না। অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ তাদের সাথে ভক্তিপূর্ণ জনতাকে সঙ্গে নিয়ে ওরবান মডেলের দিকে ঝুঁকছেন অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু। আমি মনে করি রাশিয়া ও ইউক্রেইনের বিষয়ে দলটির ভেতরের বিতর্ককে এই প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা উচিত।

সি.জে. পলিক্রনিউ: জিওপি আইনপ্রণেতারা বর্ণ বিষয়ক বইগুলোকে নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টাকে জোরদার করছেন, যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্ব ও বর্ণগত অত্যাচার ঐতিহাসিক সত্যের পরিবর্তে কারোর কল্পনাপ্রসূত উদ্ভাবন। বই নিষিদ্ধ করা ও ভোট দমন করার চেষ্টা কি সম্পর্কযুক্ত? এসব ঘটনাপ্রবাহ কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ ঘনীভূত হওয়ার ইঙ্গিতকে প্রতীয়মান করে?

নোম চমস্কি: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বই নিষিদ্ধকরণ নতুন কিছু নয় এবং গতানুগতিকভাবে বলা যায়, “ভুল” লোকদের ভোট দমন করা আপেল পাইয়ের মতই আমেরিকান। শীঘ্রই ক্ষমতা পুনঃদখল করতে উদ্যত রিপাবলিকান প্রতিষ্ঠান যখন এক ধরনের আদিফ্যাসিবাদের দিকে এগোচ্ছে তখন এগুলো শক্তি নিয়ে ফিরে আসছে। কতিপয় সাবধানী বিশ্লেষক গৃহযুদ্ধকে আঁচ করেন। অন্ততপক্ষে একটি গুরুতর অভ্যন্তরীণ সংকট রূপধারণ করছে। আমেরিকার অবক্ষয় নিয়ে অনেক দিন যাবত অনেক আলোচনা হচ্ছে। এর যতটুকু বাস্তব, তার প্রধান নিয়ামক হচ্ছে অভ্যন্তরীণ। গভীরে তাকালে দেখা যাবে অভ্যন্তরীণ সামাজিক অবক্ষয়ের বেশিরভাগই বিগত ৪০ বছরের নব্যউদারনৈতিক কার্যক্রমের নিষ্ঠুর প্রভাব থেকে উদ্ভূত। এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। হাঙ্গেরি যখন খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদী আদিফ্যাসিবাদের দিকে যায় তখন এটি যথেষ্ট খারাপ। বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে যখন এটি ঘটে তখন এর পরিণাম হয় অশুভ।

সি.জে. পলিক্রনিউ: যেসব দেশ ওয়াশিংটনের আদেশ মোতাবেক চলতে অস্বীকৃতি জানায় তাদের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত কৌশল। এমনকি নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা দেশগুলোতে বসবাসরত বিদগ্ধজনদের অবাঞ্ছিত হিসেবে গণ্য করা হয়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গণপরিসরে ভিন্নমতাবলম্বী কণ্ঠস্বরদের ব্যাপকভাবে শুনতে দেওয়ার অনুমোদন দিতে একদমই আগ্রহী নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত্তিগত বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে কিছু বলতে চান?

নোম চমস্কি: এটি এত বড় বিষয় যে এখানে বলা যাবে না। আর এটি নৈমিত্তিক বক্তব্যের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি স্মরণ করা উচিত যে আবারও এটি নতুন কিছু নয়। আমরা সবাই স্মরণ করতে পারি যে ইরাকে ওয়াশিংটনের অপরাধমূলক হামলায় যোগ দিতে ফ্রান্সের দুর্বিনীত অস্বীকৃতির ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হিসেবে মহান সিনেট ফ্রেঞ্চ ফ্রাইকে পরিবর্তিত করে “ফ্রিডম ফ্রাইজ” করেছিলো। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন, যিনি পাশ্চাত্য মহলের মুষ্টিমেয় কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কণ্ঠস্বরদের মধ্যে একজন, যদি কথায় ও কাজে পরিমিতির এবং কূটনৈতিক বিকল্পসমূহের খোঁজ করতে আহ্বান জানান তাহলে আমরা একই রকম কিছু দেখতে পারি। ভীতি প্রদর্শনের এই সহজ প্রবণতার ঝোঁক অনেক আগে থেকে চলে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো তখন এটি হাস্যকর গভীরতায় পৌঁছেছিলো এবং জার্মান সবকিছুই তৎক্ষণাৎ গর্হিত হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলো।

যে রোগের কথা আপনি উল্লেখ করেছেন তা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একটি ব্যক্তিগত উদাহরণ দেই, আমি সম্প্রতি এক সহকর্মীর কাছে শুনলাম যে ব্রিটেনের একটি অত্যন্ত সম্মানিত দর্শনের জার্নাল তাঁর একটি নিবন্ধ না পড়েই ফেরত দিয়েছে। তাঁকে নোটিশ দিয়ে বলা হয়েছে নিবন্ধটি বিবেচনা করা যাবে না কারণ তিনি ইরানের নাগরিক, যা নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা একটি দেশ।

নিষেধাজ্ঞাকে ইউরোপ দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করেছে, কিন্তু বরাবরই প্রভুর কাছে নতি স্বীকার করেছে, এমনকি একজন ইরানি দার্শনিকের নিবন্ধটিও নিষিদ্ধ করেছে। ক্ষমতার প্রতি এই নতি স্বীকারকে জোরদার করাই হচ্ছে ওয়াশিংটনকে দেওয়া পুতিনের সেরা উপহার।

আমার কিছু নিজস্ব ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি এখানে অনেক উদাহরণ যোগ করতে পারি, কিন্তু বিদ্বেষ যে এর চেয়েও বেশি দূর যেতে পারে সেটা উপেক্ষা করা উচিত নয়।

আমরা বিপজ্জনক সময়ে বাস করি। আমরা হয়ত স্মরণ করতে পারি মহাপ্রলয়ের ঘড়িটি ট্রাম্পের আমলে মিনিট ত্যাগ করে সেকেন্ডে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং বর্তমানে মধ্যরাত—সমাপ্তি—থেকে ১০০ সেকেন্ড আগে স্থির করা হয়েছে। যেসকল বিশ্লেষক ঘড়িটিকে স্থির করেছেন তারা তিনটি কারণ দেখিয়েছেন—পারমাণবিক যুদ্ধ, পরিবেশগত ধ্বংস, এবং গণতন্ত্র ও একটি মুক্ত গণপরিসরের পতন। এগুলো এই আশাকে ক্ষুণ্ণ করে যে অবগত ও জাগ্রত নাগরিকরা তাঁদের সরকারকে দুর্যোগের এই দ্বৈত প্রতিযোগিতাকে অতিক্রম করতে বাধ্য করবে।

ইউক্রেইনের যুদ্ধ এই তিনটি দুর্যোগময় প্রবণতার সবগুলোকে খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। পারমাণবিক হুমকি তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়ার হাত থেকে সভ্যতাকে রক্ষার জন্য পৃথিবীতে জীবনের ধ্বংসকারীদের প্রশংসিত করার মধ্য দিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমশ কম ব্যবহারের গুরুতর প্রয়োজনীয়তাকে বাতিল করা হয়েছিলো। আর গণতন্ত্র ও একটি মুক্ত গণপরিসর ভয়ানক পতনের দিকে রয়েছে।

এসব কিছু আমাদেরকে ৯০ বছর পেছনে নিয়ে যায়। অবশ্য ঝুঁকিগুলো আজ অনেক বেশি। তারপর, ব্যাপকভাবে পুনরুজ্জীবিত শ্রম আন্দোলনের প্রেরণায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোশ্যাল ডেমোক্রেসির পথে অগ্রসর হয়ে এই সংকটের মোকাবেলা করেছিলো। ইউরোপ ফ্যাসিবাদী অন্ধকারের নিমজ্জিত হয়েছিলো।

এখন কী ঘটবে তা অনিশ্চিত। এটি যে আমাদের ওপর নির্ভর করছে সেটাই একমাত্র নিশ্চয়তা।

ইমন রায়