অরাজ
প্রচ্ছদ » ব্যাটস অ্যান্ড জোকারস

ব্যাটস অ্যান্ড জোকারস

  • ইমরান কামাল 

I Name you three metamorphoses of the spirit: how the spirit shall become a camel, and the camel a lion, and the lion at last a child. (Thus Spoke Zarathustra, Friedrich Nietzsche

উট, সিংহ, শিশুজ্জফ্রেডরিখ নীৎশের (১৮৪৪-১৯০০) জরদ-উষ্ট্রের (Zarathustra) মানব চৈতন্যের রূপান্তরের (metamorphoses) তিন প্রতীকী আধার। নীৎশের জরদ-উষ্ট্রের কাছে যা spirit তাকে ডাকছি ‘চেতনা’ বলে। কেনো চেতনা, কেনো অন্য কথা নয়? অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে যা ক্রমে পরিবর্তিত হচ্ছেজ্জক্রমে উপরে উঠে যাচ্ছে বা নেমে যাচ্ছেজ্জতাকে চেতনা ছাড়া অন্য কি নাম দেয়া যেতে পারে, জানা নেই। এই spirit সত্তা নয়, being নয়, psycheও নয়- গুস্তাভ ইয়ুঙের (Carl Gustav Jung) (১৮৭৫-১৯৬১) spirit যেমন। নীৎশের জরদ-উষ্ট্র যে চেতনার কথা বলছে তার রূপের, আধারের তিন পরিবর্তন আছে। চেতনার বিকাশ যেনো এক আধার থেকে আরেক আধারে যাওয়া। ইংরেজিতে যা ghost তাতো চেতনা শূন্য নয় – তা আধারহীন। আধার বা host হারিয়েছে বা খুইয়েছে বিধায় সে ghost। কিন্তু আশ্চর্য, যে ghost কিনা আধার হারালো, হারানোর মধ্য দিয়ে তার দৃশ্যমান রূপ থেকে host বিলুপ্ত হলো না, উল্টো ধাতুর পূর্বভাগে একটা ধ্বনি যুক্ত হয়ে শব্দটা আরো স্ফীত হলো যেনো। এখানেই মজা, ভাবখানা বর্ণচোরা হলো। তার মধ্যে যে এক host আছে তাকে যেনো আর চেনা যায় না। এতে কি দাঁড়ালো? ghost এরও আধার আছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে বিধায় তাকে কেবলই ছায়া,  বিশুদ্ধ চেতনার হাজেরান বলে মনে হয়।

নীৎশের জরদ-উষ্ট্র চেতনার প্রথম যে host বা আধারের কথা বলে তার দেহখানা কর্তব্য আর দায়িত্ববোধের বাঁধনে গড়া। তপ্ত বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে নির্লিপ্ত সে জীবনের বোঝা টেনে যায় অবলীলায়। তার উদর ভরা জল। জীবন সে সংরক্ষণ করতে জানে। সেই আধার থেকে চেতনার ঊর্ধ্ব যাত্রার শুরু। এই থেকে চেতনা উন্মোচিত হয় সিংহাধারে। হিংস্র, প্রবল প্রতাপশালী, উদ্ধত সিংহ মিথিক গিলগামেশ (Gilgamesh), কিংবা ওজিমানদিয়াস (Ozymandias) যেনোজ্জআধার সে উদ্ধত কেনো? কারণ তাকে যে লড়াই করতে হয় মহাপরাক্রমশালী অতিকায় তিমিঙ্গিলের (নীৎশের ভাষায় Dragon) সঙ্গে। নতুন সৃষ্টির পথ তাকে প্রশ^স্ত করতে হয় একা। নিজের পৃথিবী তার হয়ে উঠতে হয় নিঃসঙ্গ কর্তা। তারপর চূড়ান্ত পর্ব আসে। চেতনাকে খুঁজে নিতে হয় শিশুর রূপ। নিষ্পাপ, সরল, ভুলতে পারার আশ্চর্য ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু হয় সে। একটা নতুন শুরু, কর্তাসত্তার ইচ্ছার অধীন নতুন চক্রের শুরু। চেতনা এই পরিক্রমণে মানবিক থেকে অতিমানবিক (Übermensch) হয়। নীৎশের অতিমানব সেই যে তার নিজের জীবনের নিয়ন্তা, হর্তা, কর্তা, বিধাতাজ্জ তার নিজস্ব মরাল (moral) আছে। অপরের বেধে দেয়া মরালিটির ঊর্ধ্বে সে নিজেকে তুলতে পারে। ঈঙ্গ-মার্কিন পপ সংস্কৃতিতে আমরা যে ঝঁঢ়বৎ যবৎড় বা অতিমানবদের গপ্পোগাথা পাই তার মরালিটি এমনই ঊর্ধ্ব স্তরে থাকে না কি?

অতিনায়ক পপ্ সংস্কৃতির স্বভাবজাত সৃষ্টি। পপ্ সংস্কৃতির আইকনিক চরিত্র লাগে। তার জনতার নায়কদের নানা জাতীয় অতিমানবীয় ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হয়। এদের কেউ ভিনগ্রহ থেকে আসা, কেউ আমেরিকার বা অন্যকোনো রাষ্ট্রের নর্দমা থেকে উঠে আসা, কেউ চাকরির ধরাবাধা সময়ের মধ্যে বড় হওয়া, কেউ আবার বিলিওনেয়ার কোনো পরিবারের সন্তান। মোটা দাগে অতিনায়ক শব্দটার মধ্যে সাম্য আছে। এই সাম্য অবশ্য একদিনে তৈরি হয়নি। পাঠকের বৈচিত্র্য যতো বেড়েছে অতিনায়ক প্রতীকেও তত নতুন নতুন অভিব্যক্তি যুক্ত হয়েছে। তারা ছড়িয়েছে কমিক্সের পাতা থেকে ভার্চুয়াল নভেলে। তাদের নিয়ে সিনেমাতে বিশেষ বিশেষ কাল্ট তৈরি হয়েছে, ভার্চুয়াল গেমে তাদের রাজত্ব উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। এই আইকনিক চরিত্রদের মধ্যে ভিন্নতাই প্রবল, মিল এক জায়গাতেই – তাদের ঊর্ধ্বমুখী মরাল। যে ব্যবস্থা, আইন ও শৃঙ্খলাকে রক্ষা করতে এই সব অতিনায়কের জন্ম তার ওপর তারা কেউই আস্থা রাখে না। আস্থা রাখলে তাদের অতিনায়কগিরির কোনো অর্থ থাকে না। কি বলবো একেজ্জঅতিনায়কের প্যারাডক্স। যে ব্যবস্থাকে তারা রক্ষা করতে চায় তা যে সংরক্ষণের মতো অবস্থায় নেই তা তারা জানে, তারপরও তারা একে রক্ষা করতে চায়। খ্রিস্টোফার নোলানের (১৯৭০) বিখ্যাত ট্রিলজি ‘ব্যাটম্যান সাগা’ যা উদ্দেশ্য করে এই আলাপ তার মুখ্য চরিত্রও এই প্যারাডক্সের বাইরে নয়। কিন্তু নোলানের ব্যাটম্যানে ভিন্নতর কাণ্ড আছে। ব্যাটম্যান বিগেনস্ থেকে ডার্ক নাইট, ডার্ক নাইট থেকে ডার্ক নাইট রাইজেস্ – নোলানের অতিনায়কের যাত্রাটি হয় উল্টোমুখে। অনপরাধী শিশু থেকে নিঃসঙ্গ কর্তা সিংহ, নিঃসঙ্গ কর্তা সিংহ থেকে কর্তব্যপরায়ণ উটে। তাঁর ব্যাটম্যান অতিনায়কের মানুষ হয়ে ওঠার গল্প।

আর জোকার, সে কে? নোলানের জোকারও এক রকম রূপান্তর। নীৎশের নয় কাফকার মতো করে রূপান্তর। ফ্রান্স কাফকার (১৮৮৩-১৯২৪) দ্য মেটামরফোসিসের (১৯১৫) শুরুতেই দেখা যাচ্ছে প্রধান চরিত্র গ্রেগর সামসা একটা কিছুতে পরিণত হয়েছে। একটা কিছু বলছি কেনো? তাকে তো আমরা অতিকায় পোকা হিসেবে ভাবতেই অভ্যস্ত। এই অতিকায় পোকার কল্পনার সূত্র মূলত কাফকার অনুবাদকেরা। অধিকাংশ ইংরেজি অনুবাদে সামসার হয়ে ওঠা রূপকে gigantic insect বা bug হিসেবে দেখাই চল হয়ে এসেছে। কিন্তু কাফকা এই হয়ে ওঠা বা পরিণত হওয়ার নাম দিয়েছিলেন – ungeziefer। জর্মন ভাষায় geziefer শব্দের ইংরেজি প্রতিরূপ vermin। অর্থাৎ এমন প্রাণ যা মারি ছড়ায়, মানুষের ক্ষতির কারণ হয়। কিন্তু শব্দটির আগে ‘un’ যুক্ত হয়ে মুশকিল বাঁধিয়েছে। কীট বা পোকা হিসেবে তাকে আর ধরা যাচ্ছে না। অনেকটাই ghostএর hostএর মতো – ungezieferএ geziefer আছে বটে, কিন্তু আছে বর্ণচোরা হয়ে। তাকে আর কীট বলেও চেনা যাচ্ছে না। নীৎশের রূপান্তরে আধারেরা স্পষ্ট। তাদের নিজ নিজ রূপে চেনা যায়। রূপগুলোই চেতনাকে আকার দেয়। কিন্তু কাফকায় ঘটছে উল্টো ঘটনা। আধার খোদ আকার হারিয়েছে। চেতনা কি হবে, তা যেনো আর বুঝে উঠতে পারছে না। গ্রেগর যে জীবনযাপন করে, যে নিয়মানুবর্তিতা আর কর্তব্যপরায়ণতার রুটিনে সে বাস করে তা তাকে ‘উষ্ট্র’ না বানিয়ে এমন কিছু বানিয়ে ফেলেছে যার প্রতিবন্ধকতা ছাড়া অন্যকোনো অর্থ হয় না। তার ওপর রূপকের যে দূরত্ব, তাও গিয়েছে খসে। নিরেট বাস্তবে এ যেনো সত্যি সত্যি হয়ে ওঠা। ইউটোপিয়া (utopia) উল্টে গেলে বাস্তবতা হয়, ডিসটোপিয়া (dystopia) নয়। নোলানের জোকার অবশ্য আরো এক কাঠি সরেস। গ্রেগরের মতো তার আধারও রূপক নয়, নিরেট বাস্তব। কিন্তু নীৎশে কিংবা কাফকায় আধার আর আইডেনটিটির যে ভেদ তা জোকারে নেই। ungezieferকে ভেঙে দিলে গ্রেগর বেরিয়ে আসে। জোকারের পার্সনা (persona) বা মুখোশের পেছনে জোকারই থাকে।

ডার্ক নাইটের প্রথম দৃশ্যেই দেখা যায়জ্জজোকার ব্যাংক ডাকাতির নেতৃত্ব দিচ্ছে। ডাকাত দলের প্রত্যেক সদস্যই জোকারের মুখোশ পড়ে ডাকাতিতে অংশ নিয়েছে। দৃশ্যের শেষে জোকার যখন তার মুখোশটা খুলে ফেলে তখন দেখা যায় মুশোশের অন্তরাল থেকে জোকারই বেরিয়ে আসে। আমেরিকার পপ্ সংস্কৃতিতে জন্ম নেওয়া জোকারে বয়সে ব্যাটম্যানেরই সমান। দুটো চরিত্রেরই জন্ম হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম লগ্নে – ১৯৪০ সালে। জন্মলগ্ন থেকেই জোকার এমন এক চরিত্র যার মরাল বলে কিছু নেই, সে বদ্ধ উন্মাদ এবং কার্যকারণ সূত্রে তাকে বোঝা যায় না। ফিকশনাল নির্মিতি বিচারে এই জোকারের অন্তত দুইটি পূর্বসূত্র পাওয়া যাবে। একটি আছে উনিশ শতকে ভিক্টর হুগোর (১৮০২-১৮৮৫) কিশোর উপন্যাস দ্য ম্যান হু লাফস্এ (The Man Who Laughs) (১৮৬৯)। অন্যটি পাওয়া যাবে, ভিক্টোরীয় লন্ডনের প্রখ্যাত ‘জ্যাক দ্য রিপার’ (Jack the Ripper) মামলায়। সঙ্গে যদি বিশ্বযুদ্ধ মাথায় রাখা যায় – মানে যখন ব্যাটম্যান ও জোকারের আবির্ভাব ঘটছে কমিক্সে, তখন নাৎসীদের যেমন শীতল খুনি রূপ জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলো আমেরিকান মিডিয়া তার দিকে খেয়াল রাখলে জন্ম থেকেই জোকারের ইনস্যানিটির (insanity) একটা কার্যকারণ সূত্র মেলানো যায়।

খ্রিস্টোফার নোলানের জোকার অবশ্য এমন নয়, সে আর সমস্ত জোকার থেকে ভিন্ন। সে যেনো ইউরোপীয় মধ্যযুগীয় থিয়েটার থেকে উঠে আসা ফুল (fool)। যে কিনা, ‘Playful, irreverent and frequently irrational, folly at its most serious detonates confrontation with both society and the self. It constantly seeks out a persona or mask through which it can disclaim what it articulates’। সে Super নয় Un, এমন যে বোধের অগমে থেকে যায়।

The Dark Knight (2008), directed by Christopher Nolan, Warner Bros. Entertainment, USA

I believe… whatever doesn’t kill you simply makes you …stranger. Joker

খ্রিস্টোফার নোলানের জোকারের প্রথম পূর্ণ সংলাপ – যা তোমাকে খুন করে না, তোমাকে তা অপর/আগন্তুক বানায়। অনেকটাই রনে দেকার্তের (১৫৯৬-১৬৫০) দর্শনের প্রথম মন্ত্র Cogitoর উল্টো বাক্য। নিজের প্রথম সংলাপেই জোকার তার দর্শনের মূল মন্ত্রটা আমাদের জানিয়ে দেয়। দুদিক থেকে কথাটা কেটে আলাদা করে ভাবা যেতে পারে। প্রথমত কথাটা দেকার্তের কগিটোর মতো আত্মকেন্দ্রিক নয়- পরমুখী। পর এবং আত্মের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হয় সহিংসার (violence) মধ্য দিয়ে।

যদি তাই হয়, এই কথা কি একই সাথে ইউরোপের ইতিহাস আর তার চিন্তার ঐতিহাসিক বিকাশের যে সূত্র তার অন্তরের কথাও নয়।

গোটা সিনেমায় এই কথাটার নানান রকম প্রতিধ্বনি আছে। যেমন গথম (Gothom) শহরের মাফিয়াদের মিটিঙে আগন্তুকের মতো ঢুকে পড়ে জোকার একটি চরিত্রকে খুন করে। খুনের ঠিক আগ মুহূর্তে টেবিলে একটা পেনসিল উলম্ব ভাবে দাঁড় করিয়ে সে বলে, ÔHow about a magic trick. I’m gonna make this pencil disappearÕ। পেন্সিলটা গায়েব হয় সেই মুহূর্তে জোকারকে পাকড়াও করতে আসা ব্যক্তির চোখের কোটরে। এই খুনটির পরপরই দেখা যায়, উন্মাদ অনুপ্রবেশকারী বলে ভাবতে থাকা মাফিয়া চরিত্রেরা তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে শুরু করেছে। আরেকটা চমৎকার প্রতিধ্বনি আছে ইন্টারোগেশন সেলে বন্দি জোকারের একটি সংলাপে, যেখানে জোকার জানাচ্ছে কেনো সে খুনের সময় অস্ত্র হিসেবে পিস্তল ব্যবহার না করে ছুরি ব্যবহার করে। এটা সে করে কারণ, বন্দুক/পিস্তলের গুলিতে মানুষ খুব দ্রুত মরে যায়। মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার আগে তারা কেমন ছিলো তা বোঝার আগেই – তারা মরে যায়। জোকারের কাছে এই মৃত্যু এক রকমের পলায়ন। তাই ধারালো দিয়ে ধীরে ধীরে খুন করার মধ্য দিয়ে সে মৃত্যুমুখে পতিত ব্যক্তিকে তার সত্যিকার চেহারাটা দেখাতে চায়। তাদের প্রকৃত ট্রমাগুলো চেনাতে চায়। জোকার যেনো ছুরি দিয়ে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ায়। অল্প অল্প করে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে সে পেঁয়াজকেই বোঝাতে চায় – পেঁয়াজের অন্তর বলে কিছু নেই।

জোকার এবং তার শিকারের চেহারা একই রকম হয়। ফ্রান্সিস বেকনের (১৯০৯-১৯৯২) ছবির মতো। বেকনের ছবির প্রধান বিষয় যন্ত্রণা ও আর্তি। ব্যাটম্যানের মসৃণ কালো মুখোশের বিপরীতে তার মুখ অসঙ্গতিতে ভরা। জোকারের এই অসঙ্গতি পূর্ণ মুখাবয়ব আইন ও শৃঙ্খলার বৈপরীত্যের প্রতীক।

The Dark Knight (2008), directed by Christopher Nolan, Warner Bros. Entertainment, USA

Francis Becon (1979-80), Three studies for a self potrait

It’s not about money …it’s about sending a massage. Joker

কী চায় নোলানের জোকার? পুরো সিনেমায় এই প্রশ্নটি প্রেতের মতো গল্পকে তাড়া করে ফেরে। প্রশ্নটির দু রকম ফয়সালা হতে পারে। প্রথম ফয়সালা – ভোগবাদী সংস্কৃতিতে যে নির্বাচন বা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আপাতে দৃশ্যমান হয় – জোকার তার মুখোশ উন্মোচন করতে চায়। মানুষকে সে নির্বাচনের প্রকৃত চেহারার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে চায়। এমন নির্বাচন যা অস্তিময়তার সঙ্গে যুক্ত। দ্বিতীয় ফয়সালা – জোকার গণতান্ত্রিকতার গোপন কথা ফাস করতে চায়। জোকারের দৃষ্টিতে গণতান্ত্রিকতা গণকে শৃঙ্খলার (order) মধ্যে রাখা উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত। গণমুক্তি এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য নয়। মুক্তি এই ব্যবস্থায় একটা মিথ যা মানুষের বিশ্বাসের ওপর টিকে আছে।

Why so serious? Joker

আগেই বলেছি, নোলানের জোকার এর পূর্বসূরিদের মতো সাইকোপ্যাথ নয়। তার অস্তিবিদ্যা (ontology) যতোটা বোধগম্য হয়, মনবিদ্যা (psychology) ততটা নয়। নোলানের জোকারের অতীতানুসন্ধান – বৃথা প্রচেষ্টা মাত্র। গোটা সিনেমায় জোকার তিনবার তার অতীতের গল্প বলে – তিনটি গল্পের মধ্যে মিল যতো তার চাইতে অমিলই বেশী। গল্পগুলো বলার উদ্দেশ্য অপরের কাছে তার অতীত উন্মোচন করা নয়। মূল উদ্দেশ্য শিকারের মস্তিষ্কের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এটা তার পন্থা যা সে অপরের ওপর বার বার প্রয়োগ করে। এটা প্রমাণ করার জন্য যে মানুষ তার নিজের বিভৎস চেহারাটা কখনো দেখতে চায় না। একটা চমৎকার উদাহরণ হলো রেচেলকে বলা জোকারের অতীতের গল্প। জোকার রেচেলকে বলে তার সহধর্মিনী এক সময় নিগ্রহের শিকার হয়েছিলো। অপর দ্বারা নিষ্পেষিত হয়ে তার মুখ বিকৃত হয়ে যায়। জোকার তার স্ত্রীর প্রতি সমবেদনাবসত নিজেই নিজের মুখ বিকৃত করে ফেলে। এবং সেই বিকৃত মুখ নিয়ে যখন সে তার সহধর্মিনীর সামনে দাঁড়ায় তখন তার সহধর্মিনী আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, আর তাকে ত্যাগ করে চলে যায়। জোকারের বিভৎস মুখ তার সহধর্মিনীকে নিজের বিকৃত মুখের কথাই মনে করিয়ে দেয়। সেই সত্য যা সে দেখতে চায় না তাই যখন তার সামনে এসে দাঁড়ায় তখন তাকে সহ্য করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এই গল্পের মধ্য দিয়ে জোকার প্রমাণ করতে চায়, মানুষ এমন ব্যবস্থা চায় না যেখানে সে তার মুখদর্শন করতে পারবে বরঞ্চ এমন ব্যবস্থা চায় যেখানে সে নিজের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারবে।

স্লাভয় জিজাক (১৯৪৯) যেমন বলেন – জ্জোকার সত্যের শুদ্ধ বর্তমানতা। অপসারিতের (dispossessed) বিশুদ্ধ আকৃতি। সিনেমায় পুলিশী হেফাজতে আনার পর তার ক্রিমিনালিটির অতীতানুসন্ধান করতে গিয়ে ব্যর্থ পুলিশের অধিকর্তা গর্ডনের বক্তব্য হয় এমনজ্জ ‘Nothing. No matches on prints, DNA, dental. Nothing in his pockets but knives and lint’। ইতিহাসের পুরুষ/ মানুষ/কর্তা হয়ে ওঠার যে বক্ররেখা বা Curve নোলানের জোকার তা ছেদ করে যায়। সে পোস্ট হিউম্যান। তার ইতিহাস নাই। একারণেই গথমের প্রচলিত আইন ও শৃঙ্খলায় তাকে সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে রোগের ইতিহাস নেই তাকে চেনার উপায় কি? – আধুনিক মানুষের জানা নেই।

And that’s the point. You’ll have to choose. Joker

নোলানের জোকার মনে করে, গথম শহরে জনতা চেতনাশূন্য হয়ে আছে। তারা কেউই আর নিজের শরীরের কর্তা নয়। ফলে জোকারের কাছে তারা গিনিপিগ। আর গথম তার বিরাট পরীক্ষাগার। এই পরীক্ষাগারে জোকার তার সামাজিক নিরীক্ষা চালিয়ে যায়। তার সকল কর্মকাণ্ডই বস্তুত সামাজিক নিরীক্ষা। জোকার দেখতে চায়, ভোগবাদী সংস্কৃতির মধ্যে নির্বাচনের মেকি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষকে যদি বেছে নেওয়ার বা নির্বাচনের আস্তিত্বিক সমস্যার মুখে ফেলে দেয়া হয় – তখন কী ঘটে? ডার্ক নাইটে তিনটি চমৎকার উদাহরণ আছে এমন নিরীক্ষার।

The Dark Knight (2008), directed by Christopher Nolan, Warner Bros. Entertainment, USA

Choose between one life or the other. Joker

ভোগবাদে দুটি খাদ্যের মধ্যে একটি বেছে নেওয়া কিংবা দুটি কসমেটিক্সের মধ্যে একটি নির্বাচন করা আর মৃত্যুমুখে পতিত দুই জীবনের মধ্যে এককে বেছে নেওয়ার মধ্যে যে দূরত্ব জোকার যেনো তার স্পষ্ট সীমান্তরেখা। সিনেমায় তার সবগুলো সমাজতাত্ত্বিক নিরীক্ষাই এই প্রকারের আস্তিত্বিক নির্বাচনের বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। অন্যভাবে বললে জোকার তার নিরীক্ষায় নির্বাচনের বিলাসিতাকে নির্বাচনের বাস্তবতায় বদলে দেয়। ডার্ক নাইটে এমন নিরীক্ষার প্রথম উদাহরণ, মি. রিসের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা। মি. রিস ব্যাটম্যানের পরিচয় জানতে পারে। মিডিয়ার সামনে যখন সে সেই পরিচয় উন্মোচন করতে যায় তখনই জোকার ঘোষণা করে যে – গথমের জনতা যদি ষাট মিনিটের মধ্যে রিসকে খুন না করে তাহলে সে গথমের যেকোনো একটি হাসপাতাল উড়িয়ে দেবে। এই ঘোষণার পরপরই দেখা যায় জনতা থেকে পুলিশের সাধারণ কর্মী সবাই রিসকে হত্যা করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। দেখা যাচ্ছে, জোকার গথমের জনতাকে একটা আস্তিত্বিক সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি মানুষদের (যাদের মধ্যে তাদের আত্মীয়-স্বজন আছে) বাঁচাতে গেলে কাউকে হত্যা করতে হবে। অর্থাৎ কোনো জীবন বাঁচাতে হলে কোনো জীবনকে খুন করতে হবে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে জোকার মানুষের নৈতিকতাকে মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। বোঝা যায় নৈতিকতা বিষয়টা আপেক্ষিক। জোকারের পৃথিবীতে বিশুদ্ধ নৈতিকতা বলে কিছু নাই। একই সঙ্গে দেখা যায়, যে আইন ও শৃঙ্খলাকে জনতা তাদের রক্ষা-কবচ বলে বিশ্বাস করে – তাদের সেই বিশ্বাস টলিয়ে দেওয়ার জন্য সামান্য নৈরাজ্যই যথেষ্ট এবং যে নৈতিকতার ওপর শৃঙ্খলা নামক রক্ষা-কবচ প্রকিষ্ঠিত তাই নৈতিকতার শিকারে পরিণত। দ্বিতীয় উদাহরণ, জোকারের পাতা ফাঁদ। জোকারের পরিকল্পনা অনুসারে গথম শহরের সাদা নাইট এবং আইন ও নীতির প্রতীক হার্ভি ডেন্ট আর আইনজীবী রেচেলকে অপহরণ করে দুই ভিন্ন স্থানে বন্দি করা হয়। তাদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে টাইম বোমা আর তেলের ড্রাম সাজিয়ে রাখা হয়। ইন্টারোগেশন সেলে বন্দি জোকার ব্যাটম্যানকে হাসতে হাসতে সবই জানায়। কোথায়, কি অবস্থায় তাদের রাখা হয়েছে সবকিছু। তারপর ব্যাটম্যান এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে সে নির্বাচনের স্বাধীনতাকে হাজির করে। দুটো বোমাই একই সময়ে বিস্ফোরিত হবে। তারা কেবল একজনকেই বাঁচাতে পারবে। তাদের বেছে নিতে হবে কাকে তারা বাঁচাবে। ঘটনা শেষ হয় রেচেলের মৃত্যু এবং আগুনে মুখের একপাশ পুড়ে যাওয়া হার্ভির বেঁচে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। ব্যাটম্যান এবং নিরাপত্তা বাহিনী হার্ভিকেই বাঁচানো চেষ্টা করে, রেচেলকে (যে কিনা ব্যাটম্যানের সাবেক প্রেমিকাও) নয়। আইনের প্রতীক উদ্ধার হয়, সাধারণ নাগনিককে কোরবানি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। তৃতীয় উদাহরণ, সিনেমার শেষ পর্বে আছেজ্জযখন জোকারের হাত থেকে বাঁচাতে গথমের নাগরিকদের শহর থেকে বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। নাগনিকদের নৈরাজ্য থেকে উদ্ধার করতে দুটো যাত্রীবাহী স্টিমার ভাড়া করা হয়। একটি স্টিমারে তোলা হয় গথমের নাগরিকদের। অন্য স্টিমারে স্থান পায় শহরটির নাম কাটা আসামীরা। আসামীদের এই সুবিধা দেওয়ার কারণ কমিশনার গর্ডন (জোকারকে বন্দি করার পুরষ্কার হিসেবে গর্ডন ততদিনে কমিশনার বনে গিয়েছে) চাইছিলো না জোকারের অপরাধী চক্র আর বড় হোক। দুটো স্টিমার যখন যাত্রা শুরু করে তখনই যাত্রী ও মাল্লাদের কাছে আশ্চর্য এক উপহারের প্যাকেট আসে। দুটো প্যাকেটেই দুটো ডেটোনেটর (detonator) পাওয়া যায়। দুটো স্টিমারেই জোকারের কণ্ঠ ভেসে ওঠে। জোকার তাদের উদ্দেশ্যে জানায়, দুটো স্টিমারেই পেট্রোল আর বোমা বসানো আছে। দুই স্টিমারের যাত্রীদের কাছে বোমার চাবি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। যদি এক স্টিমারের যাত্রীরা বাঁচতে চায় তাহলে, নিজেদের বাঁচাতে তাদের অপর স্টিমারটি উড়িয়ে দিতে হবে। এখানেও নির্বাচনের একই তরিকা জোকার মানুষের ওপর প্রয়োগ করে। দুই স্টিমারেই হল্লা শুরু হয়, স্ব স্ব স্টিমারে থাকা স্বাধীন নাগরিক ও কয়েদিরা কেউই সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। অবশেষে দেখা যায় দুই স্টিমারেই ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। তারা কি করবে তা নির্ধারিত হবে সমষ্টির রায়ে। দুই স্টিমারেই অপর স্টিমারটি উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে বেশি ভোট পড়ে। কিন্তু কেউ সেই নির্বাচনের প্রথা বা ritual কার্যে পরিণত করতে পারে না। সমস্যাটা যে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবে এমন সংকট। এক পর্যায়ে দুই স্টিমারে দুইজন সাহসী ব্যক্তি এগিয়ে আসে। কয়েদিদের স্টিমারে যে কয়েদি এগিয়ে আসে সে ডেটোনেটরটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আর নাগরিকদের মধ্যে এগিয়ে আসা ব্যক্তি ডেটনেটর তুলে নিয়ে আবার বাক্সেই রেখে দেয়। তারপর তারা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এখানেও মজার বিষয় – জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অসারতা। সমষ্টি ভোটের মধ্য দিয়ে যে রায় দিলো, বাস্তবে ঘটলো তার উল্টো ঘটনা। সমষ্টির সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হলো। এবং সেই ভুল পর্যবসিত হলো ভুল স্বীকার -নীরবে মেনে নেওয়াও মধ্য দিয়ে।

Do I really look like a guy with a plan? You know what I am? I’m a dog chasing cars. I wouldn’t know what to do with one if I caught it. You know? I just do things. Joker

গণতান্ত্রিকতা, ভোগবাদের সংস্কৃতি, নীতিনির্ভর আইন ও শৃঙ্খলাজ্জজোকার এই সবকিছুর এক প্রবল নাহং। তার দৃষ্টিতে গথমের শহরের নাগরিকদের দশা কারাগারে বন্দি কয়েদিদের মতোই। পার্থক্য কেবল অনুশাসনের ধরনে এবং স্বীকৃতিতে। এখানেই ব্যাটম্যান এবং জোকারের মিল। তারা একে অপরের নেমেসিস (Nemesis) -এই কারণেই। সিনেমায় জোকারের প্রথম সংলাপটি যদি পুনরায় স্মরণ করা যায়, যেখানে জোকার বলছে – যা তোমাকে খুন করে না তা তোমাকে অপর/আগন্তুক বানায়। জোকার ব্যাটম্যানকে খুন করে না। ইন্টারোগেশন সেলে সে এটা স্পষ্ট করেই জানায় যে ব্যাটম্যানকে খুন করার কোনো ইচ্ছাই তার নেই। কারণ ব্যাটম্যান তাকে পূর্ণ করে। তার অপূর্ণতাকে অর্থ দেয়। অর্থাৎ ব্যাটম্যান ও জোকার পরস্পরের আস্তিত্বিক অপরত্বের সম্বন্ধে প্রতিষ্ঠিত। জোকারের চৈতন্য এবং চৈতন্য তাড়িত সমস্ত কর্মকাণ্ড ব্যাটম্যানের অস্তিত্বের কারণে অর্থপূর্ণ হয়। একই ঘটনাকে উল্টোভাবেও দেখা যায়।

When there enemies were at the gates …the Romans would suspend democracy and appoint one man to protect the city. It wasn’t considered an honor, it was a public service. Harvey Dent

ব্যাটম্যান এবং জোকার হার্ভি ডেন্টের হাতে থাকা মুদ্রাটির মতো। তারা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। গণতান্ত্রিকতা, আধুনিক সভ্যতার আইন ও শৃঙ্খলার ওপর দু’জনেরই ঘোর অবিশ্বাস। কিন্তু দু’জনের হয়ে ওঠা দুই পথে। গথম শহরের ধনীতম পরিবারের অনাথ সন্তান ব্রুস ওয়েইন যে কিনা চোখের সামনে পিতা-মাতাকে খুন হতে দেখে। সেই ঘটনা থেকে সৃষ্ট ক্ষতজাত মর্মপীড়া তাকে তাড়া করে ফেরে। ব্রুস এটা বিশ্বাস করে যে, গথম শহরের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইন শৃঙ্খলা, আমলাতন্ত্র শহরটিকে ধ্বংস থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। বরঞ্চ এইসব ব্যবস্থা ধ্বংসকে আরো তরান্বিত করছে। সে মনে করে শহরটার এমন একটা প্রতীক প্রয়োজন যে কিনা হবে শহরের বিচার ব্যবস্থা আর নীতি-দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। এটা অতিনৈতিক দশা। এখানেই ব্যাটম্যানের প্যারাডক্স। যা সে রক্ষা করতে চাচ্ছে তার শক্তির ওপর তার নিজের ভরসা নেই। তার অস্তিত্ব তার নিজের কাছেই এক অর্থে অগুরুত্বপূর্ণ। ব্যাটম্যানের কাছে গণতান্ত্রিকতা, আইন ও শৃঙ্খলায় আবদ্ধ ব্যবস্থা যেমন অকার্যকর একইভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিক থেকে দেখা যাচ্ছে ব্যাটম্যানের অস্তিত্ব অপরিহার্য। এই সূত্র সিনেমাতেই আছে। হার্ভি ডেন্ট ব্যাটম্যানকে একেবারেই পছন্দ করে না। কিস্তু সে বিশ্বাস করে ব্যাটম্যান এই ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় শয়তান। সিনেমায় এক ভোজ সভায় তার মুখে যে সংলাপ বসানো হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, হার্ভি বলছে – রোমের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হলে রোমানরা গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠাতো এবং সমস্ত ক্ষমতা তুলে দিতো একজনের হাতে। রোমকে সমূহ বিনাশ থেকে রক্ষা করা নির্বাচিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে আলাদা কোনো সম্মানের বিষয় হতো না, এটা তার নাগরিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়তো। হার্ভির সংলাপে সরলীকরণ আছে। সংকটকালে রোমের ডিকটেটর নির্বাচনের ক্ষমতা থাকতো সিনেটের হাতে। অন্তত অগাস্টাস সিজার রোমের মসনদে পুরোপুরি জেঁকে বসার আগে এটা ছিলো সিনেটের অসাধারণ নিয়ম। সংকটকালে গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে – নির্বাসনই একমাত্র পথ। এটাই গণতন্ত্রের প্যারাডক্স এবং ব্যাটম্যানদের মতো সমস্ত পপ্ অতিনায়ক আর আধুনিক যুগের স্বৈরাচারের উত্থানের মূল পথও এই সূত্রে প্রশ্বস্ত হয়। গণতন্ত্রকে উদ্ধার করতে হলে, জনগণের রাষ্ট্র ও ব্যবস্থাকে উদ্ধার করতে হলে তাকে আপাতত কবরে পাঠাও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্বে উইনস্টন চার্চিলের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে এভাবে গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়েছিলো ব্রিটেনের জনগণ। আরো ধ্রুপদী উদাহরণ এডলফ হিটলারের উত্থান।

The Dark Knight (2008), directed by Christopher Nolan, Warner Bros. Entertainment, USA

যদি ব্যাটম্যান হয় super order তাহলে জোকার ‘un’order । ব্যাটম্যান super plan হলে জোকার ‘un’plan । গথম শহরের ব্যাধি জোকার নয়। তার ব্যাধি সেই super order’র মধ্যে যা সে তার গড়ে তোলা আধুনিক গণতান্ত্রিকতার প্যারডক্সিকাল পরিস্থিতির ঔষধ বলে মনে করে। প্যারাডক্সিকালিটি আছে বলে তা ঢাকতে গণতান্ত্রিকতার সংস্কৃতির super moral (ফিকশনাল এবং ঐতিহাসিক) একনায়কের প্রয়োজন হয়। তাকে super moralityর মিথ গড়ে তুলতে হয়। আর যে অপসারিত, dispossessed যে – সে যেহেতু সেই super moralityর মিথের নাহং – সেহেতু নিরেট সত্য বা ব্যত্যয় রূপে তার উত্থানের সম্ভবনাও একই আস্তিত্বিক সূত্রে আবর্তিত হতে থাকে।

 

তথ্যসূত্র :

১. Friedrich Nietzsche (1961), Thus Spoke Zarathustra, translated by R. J. Hollingdale, Penhuin Classics, UK, Pg. 54

২. মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ Zarathustra নামটার বাংলা করেছিলেন জরদ-উষ্ট্র। জরদ অর্থ পীত বর্ণ। আকরম খাঁর ভাষ্যে,‘আরব ও এশিয়ার বহু দেশে জরদ বা পীতবর্ণের উট অতিশয় মূল্যবান বলিয়া বিবেচিত হয়।’ [সূত্র. মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (২০০২), মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, ঢাকা, পৃ. ২১] সংস্কৃত সাহিত্যে হরিৎ উষ্ট্র নামটাও পাওয়া যায়। অনুমিত হয় জরদ-উষ্ট্রকেই হরিৎ উষ্ট্র নামে অভিহিত করা হতো প্রাচীন ভারতে।

৩. হলিংডেলের অনুবাদে স্থান পাওয়া spirit শব্দটার বাংলা তরজমা চেতনা করা গেলো।

৪. Susan Bernofsky, On Translating Kafka’s “The Metamorphosis”, https://www.newyorker.com/books/page-turner/on-translating-kafkas-the-metamorphosis

৫. Tim Prentky (2012), The Fool In European Theatre: Stages of Folly, Palgrave macmillan, London, P.1

৬. The Dark Knight (2008), directed by Christopher Nolan, Warner Bros. Entertainment, USA

৭. http://myheartwillgoonandsoonandsoon.blogspot.com/2019/11/slavoj-zizek-more-on-joker.html

৮. The Dark Knight (2008), directed by Christopher Nolan, Warner Bros. Entertainment, USA

 

 

ইমরান কামাল

ইমরান কামাল, সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি করেছেন অমিয়ভূষণ মজুমদারের ওপর।