অরাজ
আর্টওয়ার্ক: মডার্ন টাইম শিল্পী: অ্যান্টোনিও রদ্রিগেজ সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » জর্জ উডকক ।। ঘড়ির স্বৈরাচার

জর্জ উডকক ।। ঘড়ির স্বৈরাচার

  • অনুবাদ: আনন্দ অন্তঃলীন

[সম্পাদকীয় ভূমিকা: কানাডিয়ান লেখক জর্জ উডকক মূলত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জীবনী লেখবার জন্য জনপ্রিয় হলেও নৈরাজ্যবাদী চিন্তাচেতনা ও লেখালেখিতেও তার সক্রিয় অবদান ছিল। কানাডিয়ান এ নাগরিক জন্মেছিলেন ১৯১২ সালে। দীর্ঘ ৮২ বছরের জীবনে লিখেছেন অসংখ্যা বই, প্রবন্ধ, কবিতা। বর্তমান লেখাটি (The Tyranny of the Clock) প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে ওয়ার কমেন্টারি নামক একটি অরাজপন্থী পত্রিকায়। আধুনিক সমাজজীবনে রৈখিক সময়ের ধারণার উদ্ভব ও মানবজীবনের উপর তার নিয়ন্ত্রণপ্রতিষ্ঠা কীভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ও শ্রমশোষণের পথ সুগম করেছে তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যাবে লেখাটিতে। সময় এককালে মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে সম্পর্কিত একটি প্রাকৃতিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হলেও পুঁজিবাদী সংস্কৃতি সেটিকে পরিণত করেছে একটি অবদমনমূলক যান্ত্রিক কাঠামোতে। সময় হয়ে উঠেছে উৎপাদনব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত নিছক গাণিতিক হিসাবনিকাশ, যা প্রতিনিয়ত শ্রমিকের শোষণে ব্যবহৃত হচ্ছে। উডকক তাই মনে করেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কেবল রাজনৈতিক সংগ্রামই যথেষ্ট নয়, সময়ের মতো মানুষের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর পুনর্ভাবনাও জরুরি।]

অতীতের যেকোনো ইউরোপীয় বা অইউরোপীয় সমাজের তুলনায়, বর্তমান পশ্চিমা সমাজের একটি সুস্পষ্ট জায়গায় বৈশিষ্ট্যগত ফারাক আছে। সেই বৈশিষ্ট্যটি হলো সময়ের ধারণা। প্রাচীন চীনা বা গ্রিকদের থেকে বর্তমানের আরব পশুপালক বা মেক্সিকান ক্ষেতমজুর পর্যন্ত সকলের কাছেই সময় উপস্থাপিত হয় প্রকৃতির একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া হিসেবে, দিন ও রাতের বিভাজন হিসেবে, এক মৌসুম থেকে আরেক মৌসুমের যাত্রা হিসেবে। যাযাবর পশুপালক ও কৃষকরা তাদের সময় মাপতো সুর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ভিত্তিতে এবং এখনো অনেক ক্ষেত্রে তাই করে থাকে। তাদের বছরের হিসাব রাখার সূত্র ছিল বীজ বপনের সময়, ফসল তোলার সময়, পাতা ঝরার সময়, কিংবা নদী ও জলাধারে বরফ জমার সময়ের হিসাব। কৃষক কাজ করতো প্রাকৃতিক উপাদানসমূহের অবস্থার ওপর নির্ভর করে, একজন কারিগর কাজ করতো তার পণ্য তৈরির জন্য যতোক্ষণ কাজ করা প্রয়োজন ততোক্ষণ। সময়কে দেখা হতো প্রাকৃতিক পরিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে এবং সময়ের নিখুঁত পরিমাপের ব্যাপারে মানুষ খুব বেশি চিন্তিত ছিল না। এই কারণে সে সকল সভ্যতায় অন্যান্য বিষয়ে প্রভূত অগ্রগতি দেখা গেলেও সময় পরিমাপের ক্ষেত্রে তারা সবচেয়ে আদিম পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করতো; বালিঘড়ির চুঁইয়ে পড়া বালু কিংবা পানি, সূর্যঘড়ি—যা মেঘলা দিনে পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়তো, কিংবা মোমবাতি বা প্রদীপ—যেখানে পুড়ে না যাওয়া তেল বা মোম সময় নির্দেশ করতো। এই সবগুলো যন্ত্রই ছিল অনুমান ভিত্তিক ও ত্রুটিপূর্ণ এবং প্রতিকূল আবহাওয়া কিংবা ব্যক্তিগত আলস্য ও যত্নের অভাবে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনির্ভরযোগ্য হয়ে পড়তো। প্রাচীন জগতের কোথাওই অল্প কিছু মানুষ ব্যতীত কেউ সময়ের গাণিতিক সূক্ষ্মতার ব্যাপারে চিন্তিত ছিল না।

অন্যদিকে আধুনিক, পশ্চিমা মানুষ এমন একটি জগতে বাস করে যা ঘড়ির সময়ের যান্ত্রিক ও গাণিতিক প্রতীক দ্বারা পরিচালিত হয়। এখানে ঘড়ি মানুষের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ ও দমন করে থাকে। ঘড়ি সময়কে প্রাকৃতিক একটি প্রক্রিয়া থেকে একটি পণ্যে পরিণত করে যা সাবানের মতোই মাপা যায় ও কেনাবেচা করা যায়। যেহেতু সময়ের নিখুঁত পরিমাপ ব্যতীত শিল্পায়িত পুঁজিবাদ বিকাশ লাভ করতে এবং পরবর্তীতে শ্রমিককে প্রতিনিয়ত শোষণ করতে পারতো না, তাই ঘড়ি আধুনিক মানুষের জীবনে যান্ত্রিক স্বৈরাচারের একটি প্রতীক যা অন্য যেকোন ব্যক্তি বা যন্ত্রের চেয়ে অধিক শোষণমূলক। ঘড়ি কোন প্রক্রিয়ায় আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার সামাজিক সংগঠনকে প্রভাবিত করেছে তা জানা গুরুত্বপূর্ণ।

ইতিহাসের সাধারণ প্রবণতা হলো, একটি সভ্যতা বা সংস্কৃতি এমন কিছু উপাদান বা কলাকৌশল উৎপাদন করে যা পরবর্তীতে তার নিজেরই ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন চীনের একটি আবিষ্কার হলো বারুদ, যা পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞদের হাতে বিকশিত হয় এবং একটা পর্যায়ে এই বারুদই শক্তিশালী বিস্ফোরক ও আধুনিক যুদ্ধবিগ্রহের সূচনা ঘটিয়ে চীনাসভ্যতার ধ্বংস ডেকে আনে। একইভাবে মধ্যযুগের ইউরোপীয় শহরের কারিগরদের সর্বোৎকৃষ্ট উদ্ভাবনসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল ঘড়ি, যা সময়ের ধারণায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং একই সাথে শোষণমূলক পুঁজিবাদের বিকাশে সহায়তা করে ও মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির অবসান ঘটায়।

বলা হয়ে থাকে ঘড়ির আবির্ভাব ঘটে ১১ শতকে, মঠগুলোতে নির্ধারিত সময় পর পর ঘণ্টা বাজানোর যন্ত্র হিসেবে। মঠ এবং কারাগারের কয়েদিদের জীবন নিয়ন্ত্রণের এই মধ্যযুগীয় পন্থার সাথে বর্তমান সময়ের কারখানার শ্রমিকদের জীবনের তুলনা করা যায়। প্রথম নির্ভুল প্রমাণিত ঘড়ির আবির্ভাব অবশ্য ঘটে ১৩ শতকে এবং ১৪ শতকে এসে ঘড়ি জার্মান শহরগুলোর বিভিন্ন গণস্থাপনার অংশ হয়ে উঠতে থাকে।

ঘড়ির এই আদিম রূপগুলো ভারের মাধ্যমে পরিচালিত হতো এবং খুব বেশি কার্যকর ছিল না। নির্ভরযোগ্য ঘড়ির আগমন ঘটে ১৬ শতকে। ইংল্যান্ডের হ্যাম্পটন কোর্টে অবস্থিত ১৫৪০ সালে নির্মিত একটি ঘড়িকে বলা হয় সে দেশের প্রথম ত্রুটিমুক্ত ঘড়ি। ১৬ শতকের এই ঘড়িগুলোর নির্ভরযোগ্যতাও আপেক্ষিক, কারণ এগুলোর কেবল ঘণ্টার কাঁটা ছিল। সময়কে মিনিট ও সেকেন্ডে ভাগ করার চিন্তা ১৪ শতকের গণিতবিদদের মধ্যে থাকলেও ১৬৫৭ সালে পেন্ডুলাম আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত মিনিটের পরিমাপ সম্ভব হয়ে ওঠেনি; সেকেন্ডের কাঁটার আবির্ভাব ঘটে ১৮ শতকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই ১৭ ও ১৮ শতক ছিল পুঁজিবাদের গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সময়; যখন এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শিল্প বিপ্লবের সুযোগ নিয়ে পুরো সমাজের ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করে।

লুইস মামফোর্ডের মতে ঘড়ি যান্ত্রিক যুগের সবচেয়ে গুরুত্ববহ যন্ত্র। কারণ ঘড়ি, প্রযুক্তি এবং মানুষের কাজকর্ম ও অভ্যাস উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট প্রভাব রেখেছে। কার্যত ঘড়িই প্রথম স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র যা মানব জীবনে গুরুত্ব লাভ করে। এর আবিষ্কারের পূর্বে যন্ত্র সাধারণত এমন হতো যে সেগুলোর পরিচালনা নির্ভর করতো পেশি শক্তি কিংবা পানি বা বায়ুর মতো বাহ্যিক অনির্ভরযোগ্য শক্তির ওপর। প্রাচীন গ্রিকরা যদিও কিছু স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিল, কিন্ত সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল হিরোর বাষ্পীয় ইঞ্জিনের মতোই মন্দিরের অতিপ্রাকৃতিক প্রভাব দৃশ্যমান করে তোলার উদ্দেশ্যে, নয়তো লেভান্টাইন শহরগুলোর স্বৈশাসকদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ঘড়ি ছিল প্রথম স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র যা জনজীবনে গুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং সামাজিক ক্রিয়া সম্পন্ন করা শুরু করে। ঘড়ি উৎপাদনের শিল্প থেকেই মানুষ অন্যান্য জটিল যন্ত্রপাতি তৈরির কলাকৌশল রপ্ত করে এবং এর ফলে শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব হয়ে ওঠে।

সামাজিক ভাবে অন্য যেকোন যন্ত্রপাতির চেয়ে ঘড়ির প্রভাব অনেক বেশি। এর মাধ্যমেই মানুষের জীবনের নিয়মিতকরণ ও সময়ের নিখুঁত বিভাজন করা সম্ভব হয়েছে, যা শিল্পের শোষণমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য আবশ্যক। ঘড়ির কাঁটা ও ডায়ালের মাধ্যমে সময়কে—এটি এমন একটি প্রসঙ্গ যার প্রকৃতি এখনও কোন দর্শনে নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি—পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মাপা সম্ভব হয় ও সময়ের ধারণাকে মূর্ত করে তোলা সহজ হয়। সময়কে ব্যাপ্তিকাল হিসেবে দেখা বন্ধ হয়ে যায় এবং মানুষ সময়কে ‘দৈর্ঘ্যের’ ভিত্তিতে মাপা শুরু করে, অনেকটা কাপড় মাপার মতোই। এবং এই সময়কে—যা গাণিতিক প্রতীকসমূহ দ্বারা চিহ্নিত হওয়া শুরু করে – দেখা হতে থাকে একটি পণ্য হিসেবে, যাকে অন্য যেকোন পণ্যের মতোই কেনাবেচা করা সম্ভব।

বিশেষত নব্য পুঁজিপতিরা অতিমাত্রায় সময় সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। তাদের কাছে সময়ের আরেক অর্থ ছিল শ্রমিকের শ্রম এবং তারা এই শ্রমকে দেখতো শিল্পের প্রধান কাঁচামাল হিসেবে। পুঁজিবাদী আদর্শের স্লোগান হয়ে ওঠে ‘সময়ই অর্থ’ এবং সময়ের হিসাবরক্ষক তথা ‘timekeeper’ হয়ে ওঠে পুঁজিবাদী বিধানের নতুন কর্মচারীদের মধ্যে অন্যতম।

প্রথম দিককার কারখানাগুলোতে নিয়োগকর্তারা শ্রমিকদের থেকে অতিরিক্ত শ্রম শোষণ করে নেওয়ার জন্য নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী সময়ের হিসাব রাখার মতো কাজও করতো, যাতে করে শ্রমিকের কাছ থেকে বিনামূল্যে কিছুটা হলেও সময় নামক পণ্যটি আদায় করে নেওয়া যায়। পরবর্তীতে যদিও এ ধরনের ঘৃণ্য কাজের প্রবণতা কমে যায়, কিন্তু ঘড়ির প্রভাব বেশিরভাগ মানুষের জীবনকেই কাঠামোবদ্ধ করে ফেলে, যা আগে কেবল যাজকাবাসগুলোতে দেখা যেতো। বলা যায় মানুষই আসলে ঘড়ির মতো হয়ে ওঠে; তার কাজকর্ম হয়ে ওঠে একঘেয়ে নিয়মানুবর্তী, যার সাথে কোন প্রাকৃতিক বা জীবিত সত্তার কাজকর্মের কোন মিল নেই। মানুষ হয়ে ওঠে এমন এক সত্তা যাকে ভিক্টোরিয়ান একটি প্রবাদে বলা হয়েছে ‘ঘড়ির মতো নিয়মানুবর্তী’ (as regular as clockwork)। কেবল গ্রামাঞ্চলগুলোতে, যেখানে পশুপাখি, উদ্ভিদ ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ মানুষের জীবনের সাথে অধিক সম্পৃক্ত, সে জায়গাগুলোতেই কেবল জনসংখ্যার একটা বড় অংশ এই একঘেয়েমির ফাঁদে পড়েনি।

প্রাথমিকভাবে সময়ের সাথে নতুন এই বোঝাপড়া, জীবনের নতুন এই কাঠামো ঘড়ির মালিক পুঁজিপতিশ্রেণি অনিচ্ছুক দরিদ্র মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েহিল। এর প্রতিক্রিয়ায় কারখানার একজন দাস তার অবসর সময় কাটাতো বিশৃঙ্খল অনিয়মের সাথে; যার চিত্র ফুটে উঠেছিল ১৯ শতকের শিল্পায়নের ফলে গড়ে ওঠা বস্তিগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের প্রবণতার মধ্যে। শোষণ থেকে পলায়নের একমাত্র মাধ্যম ছিল মদ কিংবা খৃষ্টীয় মেথডিস্ট চর্চায় নিমজ্জিত হয়ে সময়ের উর্ধ্বে চলে যাওয়ার চেষ্টা করা। কিন্তু নিয়মানুবর্তিতার ধারণা ক্রমশ শ্রমিকদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। ১৯ শতকের ধর্ম ও সামাজিক মূল্যবোধ ‘সময় নষ্ট’ করাকে পাপ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে পুঁজিবাদী আদর্শকেই বলবৎ করে তোলে। ১৮৫০ এর দশকে হাতঘড়ি ও দেয়াল ঘড়ি গণউৎপাদনের ফলে সময় সচেতনতা এমন মানুষের কাছেও পৌঁছে যায় যারা পূর্বে কেবল কারখানার বাঁশি শুনে বা সময়ের হিসাবরক্ষকের কথায় চলতো। চার্চ, স্কুল, অফিস থেকে কারখানা পর্যন্ত সব জায়গায় সময়ানুবর্তিতা হয়ে ওঠে মহত্তম গুণ।

শিল্পী: সালভাদর দালি

যান্ত্রিকভাবে সময় নির্ধারণের এই প্রতারণামূলক পদ্ধতি ও এর দাসত্ব সুলভ নির্ভরশীলতা ১৯ শতকের মধ্যেই সকল শ্রেণির মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে গড়ে উঠেছিল মনোবল বিনষ্টকারী একটি কাঠামো, যা আজও কারখানার কাজের একটি বৈশিষ্ট্য। যে ব্যক্তি এই কাঠামোর সাথে খাপ খাওাতে পারে না তাকে সামাজিক হেনস্তা আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়। কারখানায় আসতে দেরি করলে রমিক তার চাকরি হারাতে পারে, এমনকি এখনকার দিনে (১৯৪৪ সাল, যখন যুদ্ধকালীন নীতি বলবৎ ছিল) তাকে কারারুদ্ধও করা হতে পারে। তাড়াহুড়ো করে খাবার খাওয়া, সকালে সন্ধ্যায় বাস বা ট্রেনের জন্য ঠেলাঠেলি করা, শিডিউল অনুযায়ী কাজ করে যাওয়ার চাপ, এর সবকিছুই হজম সংক্রান্ত ও স্নায়বিক ব্যধির বিকাশে, স্বাস্থ্যের অবনতিতে এবং আয়ু কমাতে ভূমিকা রাখে।

যদিও দীর্ঘ মেয়াদে, নিয়মানুবর্তিতার ওপর এরূপ জোরারোপ কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে না। বরং দেখা যায় উৎপাদিত পণ্যের মান তুলনামূলকভাবে খারাপ হতে থাকে; কারণ নিয়োগকর্তা সময়কে একটি পণ্য হিসেবে দেখে যা তাকে কিনতে হয় এবং সেজন্য কাজের গতি বৃদ্ধির জন্য শ্রমিকদের ওপর এতোটাই চাপ তৈরি করে যে শ্রমিকেরা বাধ্য হয় কাজের মান কমিয়ে আনতে। পণ্যের গুণগত মানের চেয়ে পরিমাণ হয়ে ওঠে মুখ্য মানদণ্ড। এর ফলে কাজ করার আনন্দ পুরোপুরি নস্যাৎ হয়ে যায় এবং শ্রমিকের পুরো মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয় ঘড়ির দিকে, অর্থাৎ কাজ শেষ হওয়ার সময়ের দিকে। কাজের চেয়ে শ্রমিকের মনোযোগ বেশি থাকে কখন এই কাজ শেষ হবে সেদিকে এবং কাজ শেষ হওয়া মাত্রই সে শিল্পায়িত সমাজের একঘেয়ে অবসরে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেলে। এই অবসরে সে তার নির্ধারিত ও যান্ত্রিক সময় কাটায় সিনেমা, রেডিও কিংবা খবরের কাগজে ডুবে থেকে; অর্থাৎ তার মজুরি ও ক্লান্তি তাকে বিনোদন উপভোগের যতোটুকু সুযোগ দেয় ততোটুকুর মধ্যে। কেবল যদি কেউ তার বিশ্বাস বা বুদ্ধির মাধ্যমে বিত্তহীন হয়ে বেঁচে থাকার বিপত্তি মেনে নিতে পারে তবেই সে পারবে ঘড়ির দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে।

ঘড়ির সমস্যা অন্যান্য যন্ত্রের সমস্যার মতোই। সময় নির্ধারণের যান্ত্রিক পদ্ধতি উন্নত সমাজের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ; ঠিক যেভাবে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি অপ্রয়োজনীয় শ্রম হ্রাস করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। দুটোই সামাজিক কার্যক্রম সাবলীলভাবে চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলোকে ব্যবহার করা উচিত একঘেয়ে শ্রম ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে এগুলো যেভাবে মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে তা কোনভাবেই হওয়া উচিত না।

এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, ঘড়ির কাঁটার তালই মানুষের জীবনের ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ সময়ের একটি যান্ত্রিক ধারণার দাস হয়ে উঠেছে, যেই ধারণার জন্ম সে নিজেই দিয়েছে। অনেকটা ফ্রাংকেন্সটাইনের মতো সে নিজেই তার সৃষ্টির ব্যাপারে ভীত। একটা সুস্থমস্তিষ্ক ও মুক্ত সমাজে মানুষের কার্যক্রম কোনভাবেই ঘড়ি বা অন্য কোন যন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। মানুষ কর্তৃক মানুষের অবদমনের চেয়েও উদ্ভট ধারণা হলো মানুষের একটা সৃষ্টির দ্বারা মানুষের অবদমন। যান্ত্রিক সময় গণনা পদ্ধতিকে যদি তার প্রকৃত কাজ তথা সমন্বয়কারী বা উল্লেখ বিন্দু (means of reference) হিসেবে তার কাজের পর্যায়ে আবদ্ধ রাখা যায়, তবেই মানুষ ঘড়ির আরাধনা ও কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হতে পারবে। পূর্ণ স্বাধীনতার অর্থ মানুষের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি বিমূর্ত চিন্তার কর্তৃত্ব থেকেও মুক্ত হওয়া।

আনন্দ অন্তঃলীন

আলোকচিত্রী, প্রাবন্ধিক, ও অনুবাদক। নৃবিজ্ঞানে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা সমাপ্ত। প্রথম একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজিত ২০২২ সালে৷ প্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ - 'একটি নৈরাজ্যবাদী নৃবিজ্ঞানের খণ্ডচিত্র' (২০২২); 'শাসকবিহীন জনগোষ্ঠী: নৈরাজ্যের নৃবিজ্ঞান' (২০২৩); 'ওভারটাইম: কেন আমাদের সংক্ষেপিত কর্মসপ্তাহ প্রয়োজন' (২০২৩)।