অরাজ
শিল্পী: সমীক্ষা সিং
প্রচ্ছদ » বাংলা ভাষার জন্য টুসু সত্যাগ্রহের কথা

বাংলা ভাষার জন্য টুসু সত্যাগ্রহের কথা

আলতাফ পারভেজ

একুশে নিয়ে বাংলাদেশে বিস্তর আলোচনা হয়। কিন্তু তাতে বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত বাংলা ভাষা নিয়ে বাংলাদেশের বাইরের জনপদের সক্রিয়তার কথা।

বহু নজির দেয়া যায় এরকম উদাসীনতার। যেমন, বায়ান্নর ভাষার লড়াইয়ে তখনকার পূর্ববাংলার অনেক কবিতা ও গানের কথা আসে। কিন্তু তারও আগের আরেক ভাষা-সংগ্রামে রাঢ় অঞ্চলের টুসু গান কীভাবে ব্যবহার হয়েছে—ভজহরি মাহাতো, ভাবিনী মাহাতো, লাবণ্যপ্রভা ঘোষের মতো নেতারা কী করেছিলেন—সেসব নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামে আজও তেমন বিশদ আলোচনা দেখি না।

মানভূমি ভাষা সংগ্রামীদের দীর্ঘ পদযাত্রা

কৃষি ও বনজীবী রাঢ় বাংলার আদি এক কবিতাসম্পদ ‘টুসু’। শব্দটি এসেছে বোধহয় ধানের তুষ থেকে। পৌষে ঝাড়খন্ড ও বিহার এলাকার  টুসু উৎসবের রেওয়াজ আছে। টুসু পরবের আদিতে রয়েছে গ্রামীণ বাংলার শস্যের প্রতি ভালোবাসা। এটা অ-পৌরাণিক, অ-ব্রাহ্মণ্যবাদী উৎসব এবং তার সঙ্গে লেপটে আছে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অসামান্য এক পরম্পরা।

পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ড সীমান্তের দুই দিকে আজকের যে রাঢ় বাংলা—তার অনেকখানি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘মানভূম’ হিসেবে পরিচিত। এই মানভূমেই বাংলাভাষা নিয়ে ইতিহাসের দীর্ঘতম সংগ্রাম হয়েছিল। মানভূমের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও সেই সংগ্রাম বিভিন্ন আদলে চলছে। অথচ ঢাকায় ভাষা-সংগ্রাম নিয়ে সকল আলোচনা তৃপ্তির সুরে শেষ হয় কেবল উর্দুর আধিপত্য প্রতিরোধের বিবরণ দিয়ে। সেই আলোচনায় হিন্দির আধিপত্যের বিপরীতে রাঢ় মানভূমের বাঙালিদের লড়ে যাওয়ার ইতিহাস অজ্ঞাত কারণে বেমালুম গরহাজির। ফলে ১৯৫২-এর বাংলাদেশ এবং ১৯৬১-এর বরাকের বাইরে বাংলা নিয়ে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক যন্ত্রণা ও দ্রোহের বিবরণ নিরন্তর আড়ালেই পড়ে থাকছে বাংলাদেশের পাঠক-শ্রোতার কাছে। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের অনেকে এও শুনে আশ্চর্য হন— মানভূম এলাকায় বাংলা নিয়ে সংগ্রামের শুরু ১৯৫২-এর চার দশক আগে, ১৯১২ সালে। মানুভূমকে তখন প্রশাসনিকভাবে বিহার-ওড়িষ্যার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তারই প্রতিবাদ। বিহারের সঙ্গে মানভূমের ওই সংযুক্তি থেকেই বৃহত্তর বাংলাভাষী সমাজের খন্ড-বিখন্ডের শুরু। সেই মানভূমি অঞ্চলেরই একাংশ আজকের পুরুলিয়া—আরেকাংশ আজকের ধানবাদ। দুঃখজনকভাবে তাদের দুই প্রদেশে ভাগ হয়ে থাকতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সর্ব পশ্চিমের জেলা পুরুলিয়া যে হিন্দির আধিপত্য থেকে মুক্তি পেয়েছিল সেটাও ১৯৫৬ সালে ১৬ দিনের মহাকাব্যিক এক গণমিছিল কলকাতা কাঁপানোর পর। দশ নারীসহ এক হাজার সংগঠকের সেই পদযাত্রা শুরু হয়েছিল পুরুলিয়ার পুঞ্চা থেকে। পুঞ্চার জৈন তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত পাকবিড়রা গ্রাম থেকে বেরিয়ে এই মিছিল কলকাতা পৌঁছে ৬ মে। ৩০-৪০ জন বাদে মিছিলকারীদের সবাইকে আটক করা হয়েছিল কলকাতায়। সপ্তাহ দুয়েক পরে এরা মুক্তি পান এবং মাস ছয় পর দাবির একাংশ মানা হয়। মানভূমের কিছু অংশ পুরুলিয়া নামে পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত হয়।

১৯৫৬ সালের ঐতিহাসিক ঐ গণমিছিলের পাটাতন তৈরি করতে মানভূমের সংগঠকদের এক নাগাড়ে ১০টি বছর লেগেছিল। বহু ধরপাকড় সইতে হয়েছে তাদের। কিন্তু সেসব মেঠো সংগ্রামের কথা ঢাকার একুশে-সাহিত্যে পাওয়া যায় না। আবার বাংলাভাষী ধানবাদ যে আজও ঢাকা-কলকাতা-আগরতলা থেকে সাংস্কৃতিকভাবে বিছিন্ন হয়ে ঝাড়খন্ডে পড়ে আছে তারও রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিপুল। সমৃদ্ধ এক খনি এলাকা এটা—যা ‘বাংলা’ চিরতরে হারালো। ধানবাদ ছাড়াও ঝাড়খন্ডের অন্তত ১১ জেলায় বাংলাভাষীরা আছে। ঢাকার পাঠক সেই বাঙালিদের সাহিত্য সম্পর্কে জানেন সামান্যই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞান সেখানকার ভজহরি মাহাতোদের কথাও শুনেছে কদাচিৎ।

ভজহরি (১৯১১-২০০৩) ছিলেন একই সঙ্গে কবি এবং রাজনীতিবিদ। পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের মানুষ। ভাষার লড়াইয়ে এসেছিলেন তিনি অতুল চন্দ্র ঘোষেরর হাত ধরে। অতুল চন্দ্রের স্ত্রী ছিলেন লাবণ্যপ্রভা ঘোষ। এরা সবাই মানভূমি বাংলা ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোক্তা। শুরুতে এরা ছিলেন রাঢ় বাংলায় কংগ্রেসের ভিত্তি। কিন্তু মানভূমে বাংলাভাষী অঞ্চলগুলোতে হিন্দির প্রশ্ন ওঠা মাত্র মাতৃভাষার পক্ষ নিয়ে অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে রাঢ়ের রাজনীতিবিদরা ১৯৪৮ সালে কংগ্রেস ভেঙ্গে বেরিয়ে চলে আসেন। এসময় স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠে ‘লোকসেবক সংঘ’ নামে একটি সংগঠন। দফায় দফায় মার খেয়ে, কারা জীবন কাটিয়ে  ভজহরি মাহাতোরা পরে এই আন্দোলনকে চূড়ান্ত এক উচ্চতায় নেন। টুসু গান ছিল এসময় তাঁদের সাংগঠনিক হাতিয়ার। এই গান দিয়ে খুব সহজে মানভূমের কৃষিজীবী জনপদকে এক কাতারে আনা যেত। ওনাদের ভাষার লড়াইয়ে প্রধান সাংস্কৃতিক অস্ত্র ছিল ভূমিজ এই গান।

টুসুতে সুর বা যন্ত্রপাতির বাড়তি কারিগরী থাকে না। মুখে মুখে ছোট ছোট এসব কবিতা আওড়ায় মানুষ– অনেকটা সমবেত আরাধনার মতো। রাঢ় জনপদের পরিবারগুলো টুসুতে দ্রুত এক সঙ্গে সাড়া দেয়। টুসুর আরেক বৈশিষ্ট্য এটার আবৃত্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ থাকে বেশি। মানভূমের ভাষার লড়াইয়েও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল বিপুল। ইতিহাসে যা ‘টুসু সত্যাগ্রহ’ হিসেবে পরিচিত। বাংলা নিয়ে তখনকার এই সত্যাগ্রহ পুরো ভারতে অন্যান্য ভাষা-ভাষীর মানুষকে হিন্দির আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস যুগিয়েছিল। এরপরই ভারতজুড়ে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গড়ার প্রবণতা জোরদার হয়। 

মানভূম ভাষা আন্দোলনের পদযাত্রা ১৯৫৬ সালে কলকাতায় পৌছালো

মানভূম বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রধান এক সংগঠক ভজহরি মাহাতো টুসু কবিতার বড় এক শরিকও বটে। আন্দোলন চলার সময় তাঁর বিখ্যাত একটা গানের কয়েক চরণ খুব গাওয়া হতো:

শুন বিহারি ভাই
তোরা রাখতে লারবি ডাঙ্গ দেখাই
তোরা আপন তবে ভেদ বাড়ালি
বাংলা ভাষায় দিলি ছাই…
শুন বিহারি ভাই…
বাঙালিকে মারলি তবু
বিষ ছড়ালি হিন্দি চাই।
বাংলা ভাষার দাবিতে ভাই
কোন ভেদের কথা নাই… ভাইয়ে ভাইয়ে মাতৃভাষার রাজ্য চাই।

আরেকটি টুসু গানে জগবন্ধু লিখছেন:

প্রাণে আর সহে না
হিন্দি কংগ্রেসীদের ছলনা
ইংরেজ আমলে যারা গো
করতো মোসাবিয়ানা
এখন তারা হিন্দি-কংগ্রেসি
মানভূমে দেয় যাতনা।।

মধুসূদন মাহাতো লিখেছিলেন:

মন মানে না রে হিন্দি সইতে
ভাষা মোদের হরে নিল হিন্দিতে।
মাতৃভাষা হরে যদি
আর কি মোদের থাকে রে
মধু বলে মাতৃভাষার
ধ্বজা হবে বহিতে।

ভজহরি মাহাতো

রাঢ়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক এই আন্দোলন চলাকালেই ‘টুসু গানে মানভূম’ নামে এক ফর্মার একটা সংকলন তৈরি হয়। যা সেকালে এক লাখ কপি ছাপা হয় বলে কথিত আছে। শিগগির তা পুলিশি বাজেয়াপ্তির শিকার হয়েছিল।

এসময়কার টুসু কবিদের অন্যতম মধ্যমনি ভজহরি মাহাতো ছিলেন একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠকও। নিত্যনতুন টুসু গান লিখে মানুষকে সংঘবদ্ধ রাখতে সাইকেল চালিয়ে মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়াতেন তিনি। ভজহরি ছাড়াও মানভূমের ‘লোকসেবক সংঘ’ এসময় প্রভাবশালী সংগঠক ছিলেন অরুণচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা, ভীমচন্দ্র মাহাতো প্রমুখ। এদের কাজের কৌশল ছিল গান্ধীর ধারার— দাবির সমর্থনে অহিংস সমাবেশ শক্তি প্রদর্শন।

হিন্দির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঝাড়খন্ডে আজও বাংলাভাষার মর্যাদা ও বিকাশের আন্দোলন চলছে

পুরুলিয়া থেকে ভজহরি মাহাতো দু’বার লোকসভায় জিতেছিলেন। ভজহরিদের সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতাতেই আজও ঝাড়খন্ডের বহু এলাকায় হিন্দির আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলাভাষীরা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় লড়ছে। যদিও ঢাকা তার সামান্যই খবর রাখে। এরকম সীমাবদ্ধতার কারণেই বাংলাদেশের একুশের বিবরণ আজও বাঙালি জনজাতির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ হয়ে উঠছে না। রাঢ় মানভূমে টুসুর হদিস তদন্ত করতে গেলে আমরা বাংলা ভাষা আন্দোলনের একান্তই নতুন এক সাংস্কৃতিক ইতিহাস খুঁজে পেতাম। যার স্রষ্ট্রা নাগরিক মধ্যবিত্ত নয়, কৃষিজীবী নিম্নবর্গ। সেজন্যই কি ঐ ইতিহাসে আমাদের আগ্রহ কম?

আলতাফ পারভেজ

আলতাফ পারভেজ মূলত স্বাধীন গবেষক হিসেবে কাজ করেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ প্রায় দশটি। ‘অরাজ’সহ বিভিন্ন জার্নালে নিয়মিত লিখে থাকেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেছেন। ছাত্রাবস্থায় সামরিকজান্তাবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমর্থনে ডাকসু’র সদস্য নির্বাচিত হন তখন। বর্তমানে আগ্রহের জায়গা রাষ্ট্রপ্রশ্ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার এথনো-পলিটিক্স।
সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘রাষ্ট্র ও ভাবাদর্শ: লুই আলথুসের’ (সংহতি) এবং ‘মিয়া অসমিয়া এনআরসি: আসামে জাতিবাদী বিদ্বেষ ও বাংলাদেশ’ (প্রথমা)।
যোগাযোগ : altafparvez@yahoo.com