অরাজ
প্রচ্ছদ » ব্লেড রানার ২০৪৯: যে তুচ্ছ নায়কের গল্প ইতিহাসে থাকে না

ব্লেড রানার ২০৪৯: যে তুচ্ছ নায়কের গল্প ইতিহাসে থাকে না

  • নিসর্গ নিলয়

মাঝে মাঝে মনে হয় না, ‘কোন দুনিয়ায় আছি?’ বক্রোক্তি অর্থে নয়, সত্যি সত্যিই। এই যেমন ধরি করোনাভাইরাসের সময়টা। বুঝে উঠছি না যে কী হল, দুনিয়ার এ কী হল, কিংবা পরিবার-পরিজনদের কেউ আক্রান্ত হয়ে মারা গেল হুটহাট কীভাবে হল? হঠাৎ করে আমাদের সবকিছু খুব অদ্ভুত মনে হয়, মনে হয় আসলে কী হচ্ছে? কিছু মেলাতে পারি না, তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর মনে হয় নিজেকে, নিজের কিছু করার নেই, কোন জায়গা নেই। সবসময়ই কী এরকম ছিল? কী করব এরকম হলে?

ব্লেড রানার ২০৪৯ এর গল্প শুরু এরকম একটা দিন থেকে। তার আগে ব্লেড রানারের কিছু ট্রিভিয়া বলি।

ব্লেড রানার ২০৪৯

Blade Runner 2049 হলিউডি সিনেমা। রিলিজ হয় ২০১৭ সালে। ব্লেড রানার ২০৪৯ একটা সিকুয়েল, এর প্রথম সিনেমা Blade Runner বের হয় মান্ধাতা আমলে, ১৯৮২ সালে। পরিচালক ছিলেন রিডলি স্কট (আমি ব্যক্তিগতভাবে রিডলি স্কটের অধিকাংশ সিনেমা খুবই অপছন্দ করি, কেন জানি না। সম্ভবত রিডলি স্কটের নাম থাকার কারণেই অসংখ্যবার নাম শোনার পরেও প্রথমটা দেখি নাই, এজন্য এখন খুব দুঃখ হচ্ছে। তবে প্রথমটা শিগগিরই দেখে ফেলব আশা করি)। সিনেমাটা বানানো হয় সায়েন্স ফিকশন লেখক ফিলিপ কে. ডিকের একটা উপন্যাস অবলম্বনে, নাম Do Androids Dream of Electric Sheep? সাই-ফাই মুভি দেখতে পছন্দ করলে ডিকের গল্প অবলম্বনে করা আরও অনেক কিছু আপনি দেখেছেন অবশ্যই, যেমন মাইনরিটি রিপোর্ট, টোটাল রিকল, এডজাস্টমেণ্ট ব্যুরো। এবং দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল। যাই হোক, ব্লেড রানার যখন ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় তখন সিনেমাটা কেউ খুব একটা দেখতে চায় নাই। খুবই ধীরে ধীরে, পরের বিশ বছরে সিনেমাটি কাল্ট ফিল্মে পরিণত হয়। এই সিনেমার মোটমাট সাতটা ভার্সন রিলিজ হয়! সর্বশেষ ২০০৭ সালে ওয়ার্নার ব্রাদার্স এর ‘ফাইনাল কাট’ ভার্সন রিলিজ করে।

ব্লেড রানার একটা ডিস্টোপিয়ান ফিকশন, এমন একটা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সময়ে ঘটনা চলতে থাকে যেখানে কিছুই ঠিক নেই। ১৯৮২ সালের সিনেমাটার ফিকশনাল সময়কাল ২০১৯ সাল। মানুষ এত ‘উন্নত’ যে এখন পাড়ি জমাচ্ছে অন্যান্য গ্রহে উপনিবেশ তৈরি করতে। বায়োইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বরাতে আরও শক্তিশালী, শারীরিকভাবে সক্ষম নতুন ধরনের রোবটিক মানুষ ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা যায়, যাদেরকে বলা হয় রেপ্লিক্যান্ট। এই রেপ্লিক্যাণ্ট তৈরিতে একচেটিয়া ব্যবসা করছে টাইরেল কর্পোরেশন, পৃথিবী ও পৃথিবীর বাইরে বিভিন্ন জায়গায় এই কারখানায় উৎপাদিত রেপ্লিক্যাণ্টদের কাজে লাগানো হচ্ছে গতর খাটানোর জন্য। যে সব জায়গায় মানুষের পক্ষে কাজ করা সম্ভব না, যেমন তীব্র তেজস্ক্রিয় পরিবেশ, সেসব জায়গায় রেপ্লিক্যাণ্টদের দিয়ে কাজ করানো হয়। আর ‘মানুষ’ না হওয়ায় তাদের নিয়ে বিশেষ চিন্তাও নেই, তাদের দিয়ে দাসের মত কাজ করানো হয়। রেপ্লিক্যাণ্টরা মানুষের মত হলেও মানুষের মত না, তারপরেও কিছু সন্দেহের কারণে তাদেরকে প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রে বা সদর দপ্তরে হাজিরা দিতে হয় ভয়েট-ক্যাম্পফ টেস্ট বা বেসলাইন টেস্টের জন্য। এই টেস্টের হিসাব হল, একটা নির্দিষ্ট স্কোরের কম-বেশি দিয়ে হিসাব করা যায় টেস্ট সাবজেক্টের কি মানুষের মত অনুভূতি আছে কি নাই। অর্থাৎ স্কোর বেসলাইনের উপরে হলে সে রেপ্লিক্যাণ্ট, নিচে হলে মানুষ। প্রথম সিনেমার ঘটনা শুরুও হয় এই বেসলাইন টেস্ট দিয়ে। রেপ্লিক্যান্টরা বায়োইঞ্জিনিয়ার্ড কৃত্রিম মানুষ হলেও তাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষেরই তৈরি, সেখানে মানুষের অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এসে পড়ে। উপরন্তু, টাইরেল কর্পোরেশন এআই টেকনোলজি আরও এক ধাপ উপরে নিয়ে গেছে, তাদের এডভান্সড এআই প্রযুক্তির নাম নেক্সাস মডেল। এই নেক্সাস মডেলের রেপ্লিক্যাণ্টদের মধ্যে যাতে অস্তিত্বগত সংকট তৈরি না হয় সেজন্য কিছু কৃত্রিম স্মৃতি ইমপ্ল্যান্টও করা থাকে। ব্লেড রানারের ঘটনা যখন চলছে, তখন নেক্সাস-সিক্স মডেলের কিছু রেপ্লিক্যাণ্ট বিদ্রোহ করে বসে। ফলে পৃথিবীতে নেক্সাস-সিক্স মডেলের সব রেপ্লিক্যাণ্টকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন পুলিশ ডিপার্টমেণ্টে আলাদা একটা সেকশনই থাকে, যাদের কাজ হল এসব ‘ভ্রষ্ট রেপ্লিক্যাণ্টদের’ খুঁজে খুঁজে মেরে ফেলা। তাদেরকে বলা হয় ব্লেড রানার।

প্রথম সিনেমার ঘটনা শুরু হয় এরকম এক ব্লেড রানারকে নিয়ে। তার নাম রিক ডেকার্ড (হ্যারিসন ফোর্ড)। ডেকার্ড তার এই কাজ নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট না, কিন্তু তাকে জোর করে পাঠানো হয় নেক্সাস-সিক্স মডেলের কিছু বিদ্রোহী রেপ্লিক্যাণ্টকে খুঁজে বের করে মেরে ফেলার জন্য। যেহেতু রেপ্লিক্যাণ্টরা মানুষ না, তাই তাদেরকে ‘মেরে ফেলার’ প্রশ্ন আসে না, তাদেরকে ‘রিটায়ার’ করা হয়। রিক ডেকার্ডের ঘটনা শেষ হওয়ার প্রায় ৩০ বছর পরে শুরু হয় ব্লেড রানার ২০৪৯ এর ঘটনা। এবারের চরিত্র অফিসার KD6–3.7 (রায়ান গসলিং)। নেক্সাস-সিক্স থেকে নেক্সাস-এইট মডেলের কতগুলো সিরিজ বিদ্রোহের পরে টাইরেল কর্পোরেশনের রেপ্লিক্যাণ্ট উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। বলতে গেলে টাইরেল মোটামুটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাদের যাবতীয় ডাটাবেস সব ধ্বংস হয়ে যায়। একই সাথে পৃথিবীতে শুরু হয় পরিবেশ বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। বিজনেস টাইকুন নিয়ান্ডার ওয়ালেস টাইরেলের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা সংগ্রহ করেন এবং পৃথিবীর দুর্যোগে এগিয়ে আসেন বড় আকারে সিন্থেটিক ফার্মিং ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে। তাঁর কারণে পৃথিবী দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা পায়।

ওয়ালেসের চরিত্রে জ্যারেড লেটো

ওয়ালেস নতুন নেক্সাস-নাইন মডেলের উৎপাদন শুরু করেন। নেক্সাস-্নাইন মডেল আবার শ্রমনির্ভর কাজে ব্যবহার শুরু হয়। এই মডেল আরও উন্নত, আরও অনুগত। নেক্সাস-সিক্স ও সেভেন মডেল আরও আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে, নেক্সাস-এইট মডেলের অনেক রেপ্লিক্যাণ্ট এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে আছে। নতুন ব্লেড রানারদের কাজ হল এই নেক্সাস-এইট মডেল বা আরও পুরানো মডেলের রেপ্লিক্যাণ্টদের ‘রিটায়ার’ করা। ব্লেড রানার ২০৪৯ এর ঘটনায় আমরা এখন প্রবেশ করব, তবে তার সাথে সাথে বলতে থাকব এর ভিতরে আমি আসলে কী কী দেখেছি।

মুদ্রার উল্টোপিঠ: সাইবারপাঙ্ক ডিস্টোপিয়া

বিশ্বায়নের কারণে পুরো পৃথিবীই এখন প্রযুক্তিগত ‘উন্নয়নের’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, না চাইলেও হাতে হাতে প্রযুক্তি আসছে। প্রযুক্তির আবার ক্লাস ডিভিশনও আছে। সে যাই হোক, এই প্রযুক্তির জোয়ার আমাদেরকে নতুন একটা সামাজিক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে তা আমরা বুঝতেই পারি। প্রযুক্তির ব্যবসায় আসছে নতুন এলিট। আসছে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গ-রা, কিংবা আমাদের উঠতি সফল টেকনোলজিক্যাল উদ্যোক্তারা, যাদের আলিশান জীবনের(তারা যদি প্রচার করে যে তারা খুবই সাধারণ জীবনযাপন করে সেটাও আলিশানত্বের লক্ষণই!) কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না, আবার আমাদের ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত কিংবা নোয়াখালীর অপু ভাই, নীলফামারীর জামাল-কামাল-জরিনাও টেকনোলজির দুনিয়ার বাইরে না, সে মোবাইল ফোন-কম্পিউটার চালায়, সে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত, দুনিয়ার বড় বড় খবর পায়। তাকে হয়ত গ্রীন রেভলিউশনের কৃষিকাজের টেকনোলজি ব্যবহার করতে হয়, বড় বড় কলকারখানায় অদ্ভুত যন্ত্রপাতি চালাতে হয়। কিন্তু তাকে একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস বা টিকটক ভিডিও দেওয়ার সাথে সাথে আবার দুদণ্ড ভাবতে হয়, তার কথা-কাজকর্ম আবার এলিটদের ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে কিনা!

টেকনোলজির প্রসার বাড়তে বাড়তে যখন দৈনন্দিন জীবনে ছড়িয়ে গেল, তখন আধুনিক সাহিত্যেও ঢুকে পড়ল টেকনোলজি। শুধু গল্পের চরিত্র মোবাইল ফোন ইন্টারনেট বা যন্ত্রপাতি চালাচ্ছে এমন নয়, গল্পের বিষয়বস্তুই হয়ে ওঠে টেকনোলজি। সায়েন্স ফিকশনের একটা বড় অংশই হল বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রভাবে ভবিষ্যতে কী হবে বা হতে পারে, তার সম্ভাবনা কল্পনা করা। আপাতত সিনেমাতে সায়েন্স ফিকশনের প্রভাব নিয়ে কথা বলি। এভেঞ্জার্স বা আয়রনম্যান — এসব সিনেমা আমরা শহুরেরা অনেকেই হয়ত দেখেছি। সেখানেও এডভান্সড টেকনোলজির সম্ভাবনা দেখানো হচ্ছে, সবকিছুতে টেকনোলজির প্রভাব একদিন আমাদেরকে এনে দেবে আয়রনম্যান বা ক্যাপ্টেন আমেরিকা, যারা আমাদেরকে বাঁচাবে বড় বিপদ থেকে। তাদের জীবনে আছে অসংখ্য নতুন নতুন যন্ত্রপাতি যেগুলো তাদের জীবনকে করেছে সহজ, তাঁদের পৃথিবী বাঁচাবার প্রচেষ্টাকে করেছে আরও আকর্ষণীয়, মোহনীয়, মন্ত্রমুগ্ধকর। আমরা তাদের টেকনোলজি দেখে হাঁ হয়ে যাই, বিস্ময়ে ভাবতে থাকি, “আহা, আমারও যদি এরকম হত!” এই আয়রনম্যানদের সিনেমার একটা থিমই হল টেকনোক্রেসি, অর্থাৎ টেকনোলজির একচেটিয়া প্রসার এবং তার ফলে উঠে আসা ‘হিরো’রা, যারা আসলে হাই-ফাই উঁচুতলার ‘মহান’ মানুষ।

কিন্তু সবাই তো আর এরকম ‘মহান হিরো’ হয়ে ওঠে না, টেকনোলজিও সবসময় ত্রাতা হয় না। একে-ফর্টিসেভেন বা নিউক্লিয়ার বোম — সেও প্রযুক্তিই। যে কম্পিউটার-মোবাইলফোন আমরা চালাই তার কাজ যতটা না আমাদের জীবন সহজ করা তার থেকেও বেশি নজরদারি করা। এই যে উল্টোপিঠে পড়ে থাকে সেসব মানুষ যারা আয়রনম্যানের ‘সাইড-ক্যারেক্টার’ও থাকে না, যারা রাস্তায় হেঁটে চলে এবং যাদের জীবন আয়রনম্যানদের মত এত রোমাঞ্চকর না, তাদের কথা কই? কিংবা তাদের কী কোন গল্প নাই? আছে। এগুলো উঠে আসে সাইবারপাঙ্ক ডিস্টোপিয়াতে। ডিস্টোপিয়া ব্যাপারটা কী আসলে? কাগজে কলমে ডিস্টোপিয়া হল এমন এক কল্পিত অবস্থা যেখানে পুরো সমাজ ধ্বসে পড়েছে, সিস্টেম এত খারাপ ও ভয়ংকর যে বেঁচে থাকাই কষ্ট, অর্থাৎ ‘ইউটোপিয়া’ ধারণার উল্টোটা। তবে একটু চিন্তা করলে দেখব, আসলে ইউটোপিয়া-ডিস্টোপিয়ার ব্যাপারটা খুবই আপেক্ষিক। ইউটোপিয়ায় শুধু একপাশের ছবি দেখা যায়, আরেকপাশের যায় না। সজীব ওয়াজেদ জয় বা ডিজিটাল বাংলাদেশের হোতাদের জন্য যে সিস্টেমটা ইউটোপিয়া, সেটাই আমাদের মত সাধারণ মানুষ, ফটোগ্রাফার শহীদুল ইসলাম, সাংবাদিক কাজলদের জন্য ডিস্টোপিয়া। এরা একই সাথে পাশাপাশি থাকতে পারে! আয়রনম্যানের গল্প পুরো ইউটোপিয়া না হলেও সেখানে টেকনোক্রেসির ইউটোপিয়ারই একটা ছায়া দেবার চেষ্টা করা হয়। ডিস্টোপিয়ান ফিকশনে আসলে দেখানো হয় উল্টোপাশের ছবিটা। ব্লেড রানার ২০৪৯ ডিস্টোপিয়ান ফিকশন হলেও নিয়াণ্ডার ওয়ালেসের জন্য সেটা হয়ত ইউটোপিয়ার কাছাকাছিই। কিন্তু নিচুতলার মানুষেরা, যাদের জীবনে প্রযুক্তির বাহার প্রবেশ করলেও তাদের রুক্ষ, জর্জরিত, দরিদ্র জীবনধারার তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি, যাদের এই ‘হাই-টেক লো-লাইফ’ জীবনধারা সাইবারপাঙ্ক নামে সায়েন্স ফিকশনে পরিচিত, তারা তো আসলে ডিস্টোপিয়াতেই থাকে!

বাস্তবতার হেঁয়ালি

ব্লেড রানার ২০৪৯ এর মূল চরিত্র কোন ‘মানুষ’ না, একজন ‘কৃত্রিম মানুষ’ যার নিজস্ব কোন ইচ্ছা নাই, ইচ্ছার অধিকার নাই। অফিসার KD6–3.7 (রায়ান গসলিং) ‘নামের’ একজন রেপ্লিক্যাণ্ট কাজ করে পুলিশ ডিপার্টমেণ্টে, ব্লেড রানার হিসেবে। তার মডেল নেক্সাস-নাইন। তার এক মিশন থাকে নেক্সাস-এইট মডেলের এক রেপ্লিক্যাণ্টকে রিটায়ার করানোর। তাকে রিটায়ার করতে গিয়ে সে একটা বাক্স খুঁজে পায়, বাক্সের ভিতরে কিছু হাড়গোড়। কোন এক রেপ্লিক্যাণ্টের দেহাবশেষ। সেগুলো টেস্ট করানোর সময় দেখা যায়, এই রেপ্লিক্যাণ্ট মারা গেছে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে। রেপ্লিক্যাণ্টদের সাধারণত বাচ্চা হয় না, তাদেরকে প্রজনন সক্ষমতা দিয়ে তৈরি করা হয় নাই। খুবই কম সংখ্যক রেপ্লিক্যাণ্টকে এই সক্ষমতা দেওয়া হলেও এরকম কোন রেকর্ড ছিল না। রেপ্লিক্যাণ্টের বাচ্চা হওয়া ভয়ংকর জিনিস, মানুষের ধারণা তাহলে তারা নিজে নিজে জনসংখ্যা বাড়াতে পারবে এবং আবারও বিদ্রোহ করবে। অতি দ্রুত অফিসার K-কে পাঠানো হয় সেই বাচ্চাকে খুঁজে বের করে ‘রিটায়ার’ করানোর জন্য। খুঁজতে গিয়ে অফিসার K দেখে যেখানে দেহাবশেষ কবর দেওয়া ছিল সেই মরা গাছের গোড়ায় একটা তারিখ খোদাই করা, ৬-১০-২১।

ব্লেড রানার ২০৪৯

ঝলক দিয়ে অফিসার K-র মনে একটা স্মৃতি মনে পড়ে। সে ছোটবেলায় একটা বিল্ডিঙের ভিতর দিয়ে দৌড়াচ্ছে, তাকে ধাওয়া করছে আরও কয়েকটা বাচ্চা, তার হাতের একটা কাঠের খেলনা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। খেলনাটার গায়েও তারিখ খোদাই করা, ৬-১০-২১।

অফিসার K খুব চিন্তায় পড়ে যায়। এই স্মৃতিটা কি তার কিনা সে জানে না, কারণ সে বরাবরই জানে সে একজন রেপ্লিক্যাণ্ট, তার কোন মানবীয় স্মৃতি নেই। যেগুলো আছে সেগুলো কৃত্রিমভাবে ইমপ্ল্যান্ট করা, যাতে রুক্ষ, মানবেতর কাজ করতে করতে রেপ্লিক্যাণ্টরা অপ্রকৃতিস্থ না হয়ে যায়। কিন্তু তাহলে এই বিষয়টা মিলে গেল কীভাবে?

অফিসার K নিজের বাসায় ফিরে আসে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে তার হলোগ্রাফিক প্রেমিকা। প্রেমিকা কিনতে পাওয়া যায়, সে আচরণ করে ঠিক যেমনটা তার ক্রেতা চায়, তেমনি করেই। সেই পণ্য-প্রেমিকা, একখণ্ড হলোগ্রাফিক এআই চালিত ডাটাসেট, অফিসার K-কে বলে যে সে তাকে ভালবাসে। অফিসার K-ও জানে যে এই এআই ঠিক তেমনই আচরণ করবে যেমনটা সে চায়। কিন্তু সে তার অনুভূতিকে আলাদা করতে পারে না, সে বুঝতে পারে সে এই এআইকেই ভালোবাসে। এই রক্তমাংসহীন ফাঁপা হলোগ্রাফিক ইমেজের সাথেই সে মিলিত হতে চায়। হলোগ্রাফিক প্রেমিকাই তার জীবনে বাস্তব হয়ে ওঠে, কোন রক্তমাংসের মেয়ের প্রতি সে আকৃষ্টও হয় না। সেই প্রেমিকা তাকে আদর্শ কোমল প্রেমিকার মত গিফটও দেয়, একটা পোর্টেবল হলোগ্রাফিক কন্টেইনার, যেটাতে করে অফিসার K তার প্রেমিকাকে যে কোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে।

— “I want to be real for you.” — “You are real to me.”

মুভির কাহিনীর প্রায় পুরোটাই চলে অফিসার K-র এই স্মৃতিটুকুর খোঁজ নিয়ে। সে খুঁজতে খুঁজতে সেই এতিমখানায়ও চলে যায় যেখানে তার সেই স্মৃতিটুকু ঘটেছিল। সে কাঠের খেলনাটাও খুঁজে বের করে, খোদাই করা তারিখটা মিলিয়ে দেখে। কিন্তু সে একটা দোটানায় বারবারই পড়তে থাকে। জেনেটিক কোড খুঁজতে গিয়ে দেখে ঐ দিন একইসাথে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে জন্মেছিল, যাদের জেনেটিক কোডে অসম্ভব রকমের মিল। তাহলে তার স্মৃতিটা কি সত্য? নাকি ইমপ্লাণ্টেড? সে জানতে পারে না। কিন্তু আমরা দেখি সে প্রবল আশা নিয়ে বেঁচে থাকে, মেমরি-মেকার স্টেলিনের সাথে দেখা করে সে জানতে পারে এই স্মৃতি সত্য। সে প্রবল ধাক্কা খায়। সে দেখা করতে যায় ডেকার্ডের সাথে, যে সম্ভবত তার বাবা।

সেখানেও আমরা দেখতে পাই অফিসার K-র জীবনে বাস্তব আর কৃত্রিমতার কোন পার্থক্য নেই। ডেকার্ডের কাছে সে নিজের পরিচয় দেয়, তার নাম জো। তার KD6–3.7 রেপ্লিক্যাণ্ট পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে তার ‘কৃত্রিম’ প্রেমিকার দেওয়া নাম, জো। তার নাম জো।

জোয়ের প্রথম মৃত্যু

এই সিনেমার শেষ দিকে দুইটা মোড়-ঘুরানো মুহূর্ত আছে। একটা হল, যখন জো জানতে পারে সে আসলে ডেকার্ডের সেই সন্তান না। জো বুঝতে পারে, মেমরি-মেকার স্টেলিনই ডেকার্ডের মেয়ে। স্টেলিন লুকিয়ে তার সবচেয়ে বিষাদগ্রস্ত স্মৃতির একটা ইমপ্ল্যাণ্ট করে দিয়েছে অনেক রেপ্লিক্যাণ্টের মধ্যেই। তাদেরই একজন জো। জো যেমন সামান্য একজন রেপ্লিক্যাণ্ট ছিল, সে তাই-ই রয়ে গেল। সে এক কৃত্রিম মানুষ, যার কোন ‘বাস্তব স্মৃতি’ নেই। কিন্তু আসলেই কি সব কৃত্রিম? জো-এর ‘কৃত্রিম’ জীবনের যে টানাপোড়েন, তা কি আর কৃত্রিম থাকে দর্শকের মাঝে?

জো-কে রেজিস্ট্যান্স গ্রুপের সদস্যরা (যারা সবাই রেপ্লিক্যাণ্ট) উদ্ধার করে, এবং বলে, “Dying for the right cause is the most human thing we can do.” আমরা দেখতে পাই কৃত্রিম মানুষেরা হয়ে উঠছে মানুষের থেকেও মানবিক। তারা মানুষের মতই মুক্তির স্বপ্ন দেখছে। দর্শক হিসেবে আমিই তখন আর পার্থক্য করতে পারি না, কে আসল মানুষ আর কে কৃত্রিম?

ব্লেড রানারের পুরো প্লটের একটা প্রধান থিম হল এই বিষয়টা — যেখানে বাস্তব আর কৃত্রিমের পার্থক্য ধোঁয়াটে হয়ে যায়। যেখানে বাস্তবের থেকেও বেশি বাস্তব হিসেবে এসে হাজির হয় বাস্তবতার প্রতিলিপি।ফরাসি দার্শনিক জাঁ বদ্রিয়া যাকে বলেছেন হাইপাররিয়ালিটি।

ব্লেড রানারের এনার্কিজম ও নায়কের তুচ্ছতা

সিনেমার দ্বিতীয় মোড়-ঘুরানো মুহূর্ত হল যখন জো-কে পাঠানো হয় ডেকার্ডকে খুন করতে। রেজিস্ট্যান্স গ্রুপের রেপ্লিক্যাণ্টরা জো-কে বলে, যে করেই হোক আমাদের মুক্তির লড়াইয়ে নামতে হবে। সঠিক লক্ষ্যের জন্য মারা যাওয়াই সবচেয়ে মানবীয় কাজ যেটা এখন তাদের পক্ষে করা সম্ভব। জো-কে পাঠানো হয় ডেকার্ডকে খুন করতে, যাতে ডেকার্ডকে দিয়ে নিয়ান্ডার ওয়ালেস তার মেয়েকে খুঁজে বের করতে না পারে। ডেকার্ডের মেয়ে একটা মিরাকল, কারণ এর আগে কখনো কোন রেপ্লিক্যাণ্টের সন্তান জন্মে নি। তাই সেই মেয়ে রেপ্লিক্যাণ্টদের কাছে মুক্তির সিম্বল। সেই মেয়েকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।

কিন্তু যে জো ঝুলে আছে অতিবাস্তবতার মাঝামাঝি কোথাও, সে কী হতে চেয়েছিল আর সে কী হয়ে উঠল, এর মাঝামাঝি শূন্যতায় যে টানাপোড়েন চলছে, সে কী করে বুঝবে কোনটা সঠিক লক্ষ্য আর কোনটা না? সে কি ফিরে যাবে পুরনো কাজে? সেটা সম্ভব না আর। সে কি ডেকার্ডকে খুন করবে? যোগ দেবে রেজিস্ট্যান্সে?

আমরা শুরু থেকেই দেখতে পাই জো এমন একটা অস্তিত্ব যার কোন ‘ফ্রি উইল’ নেই। ‘জন্মসূত্রে’ তার ফ্রি উইল কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসলেই কি আমরা এমন একটা জগতে বাস করি, যেখানে আমাদেরকে নির্মাণ করে সিস্টেম, সিম্বল ইত্যাদি এবং যেখানে আমাদের কোন ফ্রি উইল থাকে না?

জো এইখানে বিদ্রোহ করে, এই কারাগার ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে ডেকার্ডকে বাঁচাবে। ওয়ালেসের লোকজন ডেকার্ডকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় সে ডেকার্ডকে উদ্ধার করে। উদ্ধার করে তাকে নিয়ে যায় তার মেয়ের সাথে দেখা করাতে, যে স্বপ্ন, যে আশা কিছু একটা ‘হয়ে ওঠার’ স্বপ্ন দেখিয়েছিল জো-কে, সেটা অন্য কাউকে দিয়ে পূরণ হবে। কিন্তু সেটা তৈরি করার সিদ্ধান্তটা নেয় জো — যেই জো একজন তুচ্ছ রেপ্লিক্যাণ্ট মাত্র, সামনের বিশাল ইতিহাসে, সংগ্রামের কিংবা বিজয়ীর ইতিহাসে হয়ত তার জায়গা সামান্যই, অথবা কোন জায়গাই নেই।

শেষ দৃশ্যে জো ডেকার্ডকে নিয়ে আসে তার মেয়ে স্টেলিনের কাছে। ডেকার্ডের হাতে খেলনা কাঠের ঘোড়াটা তুলে দেয়। এই ঘোড়াটা তার সবচেয়ে মূল্যবান ভেবে আসা স্মৃতির আধার, যেই স্মৃতি সবচেয়ে বিষাদগ্রস্ত, সেটাই তার জীবনের সেরা স্মৃতি, হয়ে উঠত। কিন্তু সে এখন জানে, এটা তার স্মৃতি না, সে সামান্য এক রেপ্লিক্যাণ্ট মাত্র। সে ঘোড়াটা ডেকার্ডকে দিয়ে বলে, “All the best memories are hers.” শেষ মুহূর্তে তার মুখে দেখা যায় সেই বুক ভেঙে যাওয়া হাসি।ডেকার্ড তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এত কিছু কেন করছ? আমি কে হই তোমার?” জো কিছু বলতে পারে না, হাসে। “যাও, তোমার মেয়ের সাথে দেখা করে আসো।”

“All the best memories are hers.”

জো শুয়ে পড়ে বরফের মধ্যে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। যে শূন্যতায় সে ঝুলে আছে, ঝুলে থাকবে — আমরা জানতেও পারি না আহত, ক্ষতবিক্ষত জো আর বেঁচে আছে কি নেই। শুধু জানতে পারি, অনুভব করতে পারি তার শূন্যতাটুকু। তার তুচ্ছতা। সে এমন এক গল্পের নায়ক যার কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই বিশাল ইতিহাসে। সে রীতিমত এক অপ্রাসঙ্গিক, তুচ্ছ নায়ক। সে কাঁদে কিনা আমরা জানি না, কারণ তার কান্না অনবরত তুষারপাতে মিশে যায় হয়ত। কিংবা তার কান্না করার মত পূর্ণতাও আর নেই। ডেকার্ড যখন তার মেয়ের সাথে দেখা করে, সেই শেষ সেকেণ্ডেই আমরা বুঝতে পারি, জোয়ের গল্প ফুরিয়ে গেছে। জোয়ের আর কোথাও জায়গা নেই।

এই অপ্রাসঙ্গিকতাই জো-কে করে তুলেছে মানুষের চেয়েও বেশি মানুষ। ব্লেড রানার দেখবার সময় দর্শক হিসেবে আমরাই হাইপাররিয়ালিটিতে ঘুরপাক খেতে থাকি। আমাদের জীবন কি এমনই তুচ্ছ না? বিশাল এক মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র একটা গ্রহের প্রজাতি আমরা, তার থেকেও ক্ষুদ্র আমাদের সত্ত্বা, সেই সত্ত্বার প্রাসঙ্গিকতা আর কতটুকু? এত অপ্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমরা কীভাবে মেতেছি ইতিহাস নির্মাণের যজ্ঞে, হিরো বানানোর খেলায়?

জো আমাদেরকে একটা আশা দেখায়। এই তুচ্ছ জীবন নিয়েও আমাদের নিজেদের তৈরি কারাগারের বিরুদ্ধেই আমরা দাঁড়াতে পারি, এক মুহূর্তের জন্য হলেও আমাদের ফ্রি উইলের সম্ভাবনা সে দেখায়। হতে পারে সেই ফ্রি উইল তেমন কিছু এদিক সেদিক করবে না, নিয়ে আসবে না চিরন্তন কিছু। কিন্তু সেই ফ্রি উইল থাকার সম্ভাবনা দেখানোটাই অনেক বিশাল ব্যাপার। হয়ত অনেক মানবীয় কিছুর জন্যই সে ফ্রি উইল দাঁড়াতে পারবে। যে মানবীয়তাকে আমরা মনে করে এসেছি আমাদের একান্ত শ্রেষ্ঠত্ব, আমরা এখন জানি সেই শ্রেষ্ঠত্বের শ্লাঘাই আমাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। হয়ত যাকে আমরা মানবিক ভাবি, সেইসব বৈশিষ্ট্য আমাদের আশেপাশে সবসময় ছিল, আছে, থাকবে। হয়ত মানুষের মধ্যে নয়, অন্য কোন প্রজাতির মধ্যে। অন্য কোন ইতিহাসে। এই সহজ বিষয়টা মেনে নিতে আমরা ভুলে গেছি। জো আমাদের সেগুলো মনে করিয়ে দেয়। এরপর জো, আমাদের মতই, তুচ্ছ, অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। জো কেবল বেঁচে থাকে শূন্যতা, নিরর্থকতার ট্র্যাজেডিতে।

“All those things become tears in rain.”

মেল ফ্যাণ্টাসি? সেক্সিজম?

খুব সংক্ষেপে এবার ব্লেড রানারের কিছু ঝামেলার কথা বলি। ব্লেড রানার দেখে সবারই ভাল লাগবে এমন না, তবে যারা দেখবেন তাদের কাছে এটা কেমন লাগতে পারে? যেমন, একটা শহরবাসী মেয়েই ধরলাম ব্লেড রানার দেখল। তার কাছে ব্লেড রানার কেমন লাগবে? আমি একটা ছেলে, আমার কাছে দেখে কেমন লাগল?

আমার কাছে মনে হয়েছে ব্লেড রানারের ঘটনাপ্রবাহ প্রচণ্ডভাবেই মেল-ফ্যান্টাসি। ছেলে হয়ে ব্লেড রানার দেখতে আমার খুবই ভাল লাগবে এটাই স্বাভাবিক। এমন না যে ব্লেড রানারে কোন মেয়ে চরিত্র নেই। মেয়ে চরিত্রের সংখ্যা অনেকঃ জো-র বস লেফটেন্যান্ট জোশি, জো-র প্রেমিকা জোয়ি,নিয়ান্ডার ওয়ালেসের এসিস্টেন্ট রেপ্লিক্যাণ্ট লাভ, রেজিস্টেন্সের সদস্য মারিয়েত, ডেকার্ডের মেয়ে স্টেলিন। কিন্তু একটা মেয়ে যদি ব্লেড রানার দেখে, তার কী বোধ হবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা সম্ভব না, কারণ আমি পুরো সিনেমাটা দেখেছি ‘ছেলে’ হিসেবে। তবে দুই একটা বিষয় বলা যায়। যেমন, এই সিনেমার ঘটনাপ্রবাহ পুরোটাই আবর্তিত হয় তিনজন ছেলেকে ঘিরে — জো, ডেকার্ড আর নিয়াণ্ডার ওয়ালেস। এমনকি যে মেয়ে চরিত্রগুলো আছে, তাদের চরিত্রও গড়ে ওঠে এই তিনজন ছেলে চরিত্রকে কেন্দ্র করে। ন্যারেটিভগুলো সব ছেলের। এবং প্রত্যেক মেয়ের চরিত্রই(স্টেলিন বাদে) ওয়ালেস কিংবা জো-য়ের সাথে কোন না কোন সেক্সুয়াল টোনের ভিত্তিতে সামনে গড়ায়।

এই পরিস্থিতিতে সিনেমায় সেক্সিজম এসেছে কিনা আমার জানা নাই। বা এই আসাটা খুব ব্যতিক্রম কিছু, তাও না।আধুনিক ফ্যাণ্টাসি ফিকশনের বেশিরভাগ মেল ফ্যাণ্টাসিই। সে লর্ড অব দ্য রিংস হোক কিংবা ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ। তবে নয়া সাইকোএনালিস্টরা নারীকে যে আল্টিমেট সাবজেক্ট হিসেবে দেখেন, তার কিছু প্রতিচ্ছবি হয়ত এখানে পাওয়া যায়, যেমন জো-র প্রেমিকা জোয়ি অবজেক্ট থেকে উল্টোদিকে গিয়ে সাবজেক্ট হয়ে ওঠে। লাভ চরিত্রটা পুরোপুরিই সাবজেক্টিভিটিতে ভরা, নিয়ান্ডার ওয়ালেসের কমপ্লিমেন্ট (“তুমি সব রেপ্লিক্যাণ্ট থেকে সেরা, তুমি এঞ্জেল”) তার প্রথম মৃত্যু ঘটায়, সেটা প্রমাণ করতে গিয়ে তার দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে।

“The best of all angels. Aren’t you, Luv?”

তবে ডিস্টোপিয়াতে মেয়েদেরকে আবর্জনা ভাবা হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। ডিস্টোপিয়াতে মেয়েদের বেচাকেনা করা হবে, তাদের যৌনতা পরাধীন হবে, তাদেরকে পুরুষের চাহিদামত আচরণ করতে হবে, তাদের একটার পর একটা মানসিক মৃত্যু ঘটবে, সেটাই তো হবে, সেটা তো বাস্তবেই হচ্ছে, হচ্ছে না?

পরিশেষ

সিনেমার পরিচালক ডেনি ভিলনুভ, আমার খুবই পছন্দের পরিচালক। ভিলনুভের সিনেমা অনেকেই হয়ত দেখেছেন, না দেখলে এরাইভাল আর ইন্সেন্ডিজ দেখে ফেলতে পারেন। রায়ান গসলিংকে আমি যেভাবে চিনতাম, ব্লেড রানার দিয়ে গসলিং আমার সেই ধারণা মোটামুটি আকাশ-পাতাল ঘুরিয়ে দিলেন।প্রথমে আমি ব্লেড রানার হিসেবে গসলিংকে দেখে ধাক্কাই খেয়েছিলাম বলা যায়! গসলিং এত অসাধারণ, এত ঠিকঠাক অভিনয় করেছেন যে বলার মত না।নিয়ান্ডার ওয়ালেসের সংক্ষিপ্ত চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছেন জ্যারেড লেটো। সিনেমার সাউণ্ডট্র্যাক অসাধারণ, বিশেষ করে সেই বিখ্যাত ‘Tears in Rain’. শেষ দৃশ্য টেনে টেনে অন্তত ১৫-২০ বার দেখা হয়ে গেছে। এই সিনেমা সবার জন্য না, সবাই হয়ত একে মিলাতে পারবেন না। তবে আমি চোখ বন্ধ করে ১০ এ ৯ দেব। এরকম সিনেমা বারবার পাওয়া যায় না!

৬ই আগস্ট, ২০২০
শংকর

নিসর্গ নিলয়

নিসর্গ নিলয় গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, নৃবিজ্ঞান বিভাগে। ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। জন্ম ১৯ জুলাই, ১৯৯৪। নিলয় এনার্কি, এথনিসিটি, জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশ, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে লিখছেন। এছাড়া সম্পাদনা করেছেন ’আর্টিলারি’ পত্রিকা। বর্তমানে অরাজ সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। ইমেল: nisharggoniloy@gmail.com