অরাজ
আর্টওয়ার্ক: কাইট শিল্পী: নৌরি জাফরি সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » পিওতর ক্রপোৎকিন।। কারাগার: অপরাধের বিশ্ববিদ্যালয়

পিওতর ক্রপোৎকিন।। কারাগার: অপরাধের বিশ্ববিদ্যালয়

  • অনুবাদ: তানভীর আকন্দ

বহু বিশিষ্ট আইনজীবী ও সামাজতাত্ত্বিকদের ‘অপরাধ ও শাস্তি’ বিষয়ক যে বিরাট প্রশ্নটি বর্তমানে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সেই প্রশ্নটি দূরে সরিয়ে রেখেই আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখতে চাই এই প্রশ্নের মধ্যে, ‘কারাগারগুলো কি মূল উদ্দেশ্য সাধনে সফলকাম হচ্ছে? অর্থাৎ অসামাজিক কাজকর্ম কমিয়ে আনতে পারছে?’

এই প্রশ্নের উত্তরে কারাগারের ভেতরের খবর সম্পর্কে অবগত যেকোনো নিরপেক্ষ লোকই নিশ্চতভাবে জোর দিয়েই বলবেন, ‘না’।  অপরদিকে, এই বিষয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ফলাফল দেখলেই সবাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে, ভালো কি মন্দ যে কোনো কারাগারই আসলে অপরাধপ্রবণতার উৎসভূমি। এবং এগুলো অসামাজিক কার্যকলাপগুলোকে খারাপ থেকে আরও বেশি খারাপের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবদান রাখে। এক কথায় বলতে গেলে তারা অপরাধের উচ্চতর শিক্ষাঙ্গন, বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ক্রিয়াশীল।

আর্টওয়ার্ক: প্রিজনার
শিল্পী: ব্রাডি ইজকুয়ারডো
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

আমি অবশ্যই বলতে চাচ্ছি না যে, যারা একবার কারাবরণ করেছে তারা সবাই-ই অপরাধকর্মে ফিরে যাবে। নিছক দুর্ঘটনাচক্রে পড়েই হাজার হাজার লোক প্রতিবছর কারাগারে যায়। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি যে, কারাগারে কয়েকবছর অতিবাহিত করার ফলে, কোনো ব্যক্তির মধ্যে সেসমস্ত ত্রুটিসমূহ বৃদ্ধি পায় যার কারণে তাকে আদালতের সামনে হাজির হতে হয়েছিল, আর তা কারাগারের কারণেই হয়ে থাকে। ঝুঁকি নেয়ার বাসনা, কাজের প্রতি অনীহা (একটা বড় অংশের ক্ষেত্রেই কোনো পেশা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানের অভাবে), সামাজের অবজ্ঞা এবং এর অবিচার ও ভণ্ডামি, শারীরিক কর্মক্ষমতা এবং ইচ্ছার অভাব- জেলখানার শাস্তি এই সবগুলো কারণকেই উস্কে দেয়।

পঁচিশ বছর আগে, যখন একটি বইয়ে আমি এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করি, যে বইটি এখন আর বাজারে নেই(রুশ ও ফরাসি কারাগারে), তখন ফ্রান্সে বারবার অপরাধ করা ব্যক্তিদের নিয়ে একটা তদন্তের মাধ্যমে বের হয়ে আসা তথ্যসমূহ নিয়ে একটা গবেষণা করে ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম আমি। এই তদন্তের ফলাফল হিসেবে বের হয়ে আসে যে আদালতে হাজির করা লোকদের দুই পঞ্চমাংশ থেকে শুরু করে অর্ধেক পর্যন্ত এবং পুলিশ কোর্টে বিচার হওয়া মানুষগুলোর পাঁচ ভাগের দুইভাগই ইতোমধ্যেই এক-দুইবার জেল খেটে এসেছে। যার মধ্যে চল্লিশ শতাংশই নারী। মাইকেল ডেভিটের মতে, সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিদের পচানব্বই শতাংশই পূর্বে কারাদীক্ষা লাভ করেছে।

একটু ভাবলেই বোঝা যায় যে, এর অন্যথা হতেই পারে না। অবধারিতভাবেই কয়েদিদের ওপর কারাগার একরকম হিংস্র প্রভাব ফেলে। যেকোনো নতুন মানুষকে কারাগারে নেয়া হোক, যেই মুহূর্তে সে কারাকক্ষে প্রবেশ করছে সে আর মানুষ থাকছে না, হয়ে উঠছে ‘নম্বর এত বা অত’। তার নিজের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছাও থাকছে না আর। তাকে পরিয়ে দেয়া হচ্ছে ভাঁড়ের পোশাক, যার মাধ্যমে তাকে অধঃপতিত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এবং যেসমস্ত মানুষদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে পারত তাদের সাথে যেকোনো প্রকারের সংসর্গ থেকেই তাকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে, এবং এইভাবে তার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এমন বিষয়গুলো থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে।

তারপর তাকে কায়িক শ্রমে নিয়োজিত করা হচ্ছে, তবে তার নৈতিক উন্নতি হতে পারে এমন কোনো শ্রমে তাকে নিয়োগ করা হচ্ছে না। কারাশ্রমের উদ্ভবই হয়েছে প্রতিশোধের যন্ত্র হিসেবে। ‘সমাজের এই ভিত্তিগুলোর’ বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে বন্দিদের কী ধারণা তৈরি হবে তাহলে, যারা এইরূপ শাস্তির মাধ্যমে কারাবন্দিদের ‘শোধনের’ ভান করে চলেছে?

ফরাসি কারাগারগুলোতে কারাবন্দিদের কিছু দরকারি কাজ দেয়া হয় এবং তার জন্য মজুরিও প্রদান করা হয়। কিন্তু সেই মজুরিও অসম্ভব মাত্রায় কম, কারাকর্তৃপক্ষের মতানুসারে এর থেকে বেশি মজুরি প্রদান করা সম্ভব না। তারা বলেন, কারাশ্রম হলো নিকৃষ্টমানের দাসের কাজ। আর এর ফলে কারাবন্দিরা কাজকে ঘৃণা করতে শুরু করে, এবং এর শেষপর্যায়ে গিয়ে বলতে থাকে, ‘আমরা আসল চোর না, আসল চোর হলো তারা যারা বন্দি করে রেখেছে আমাদের’।

বন্দিদের মস্তিষ্কে এইভাবে সমাজের অবিচারের ধারণা ঘুরপাক খেতে থাকে, যে সমাজ অধিকাংশ কোম্পানি উদ্যোক্তাদের মতো জোচ্চোরদেরও ক্ষমা করে দেয় এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সম্মানও করে, অথচ তাকে শাস্তি দেয় জঘন্যভাবে, শুধুমাত্র সে আরও বেশি ধূর্ত হতে পারেনি বলে। আর যেই মুহূর্তে সে ছাড়া পায় সেই মুহূর্তেই সে তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে তার আগের অপরাধের চাইতেও কোনো না কোনো ভয়ানক অপরাধ সংঘটিত করে। প্রতিহিংসা কেবল প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। 

আর্টওয়ার্ক: দ্য প্রিজন
শিল্পী: এনরিকো বার্তুসিওলি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

তার উপর যে প্রতিশোধ চালানো হয়, সেই প্রতিশোধ সে সমাজের উপর চালায়। প্রতিটি কারাগারই, তার বন্দিদের শারিরীক শক্তিকে বিনষ্ট করে দেয় ।কারাগারের চরিত্রই এমন। সুমেরু অঞ্চলের কঠিন ঠাণ্ডার চেয়েও ভয়ানকভাবে বন্দিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে কারাগার। বিশুদ্ধ বাতাসের অভাব, গতানুগতিক জীবনযাত্রা এবং বিশেষ করে সামাজিক প্রভাবের অভাব, বন্দিদের থেকে সমস্ত শক্তি শুষে নেয়, এবং উত্তেজক পদার্থের (এলকোহল, কফি) প্রতি নেশা জাগিয়ে তোলে। মিস এলেন বেশ স্পষ্টভাবেই সেদিনের ব্রিটিশ মেডিকেল এসোশিয়েশানের সভায় এসব কথা তুলে ধরেছেন। এবং অবশেষে, অধিকাংশ অসামাজিক কাজকর্মের উৎস হিসেবে যেখানে ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতাকে দায়ী করা যায়, সেখানে কারা শিক্ষা বেশ নৈপুণ্যের সাথেই এই ইচ্ছাশক্তির বিকাশকে হত্যা করার জন্যই পরিচালিত হয়ে থাকে।

প্রকৃত অবস্থা এর চাইতেও জঘন্য। কারা সংস্কারকদের আমি বিশেষভাবে আলেকজান্দার বার্কম্যানের বইটা পড়ে দেখার জন্য সুপারিশ করব।বার্কম্যান, যিনি আমেরিকায় চৌদ্দ বছর জেল খেটেছিলেন,  বেশ আন্তরিকতার সাথে তার অভিজ্ঞতার কথা লিখে গেছেন তিনি। এই বইটি পড়লে যে কেউই বুঝতে পারবে, যখন এই নরক থেকে বের না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কোনো বন্দি, তখন নিজের ভেতরের প্রতিটা সৎ অনুভূতিকেই কীভাবে চাপা দিয়ে ফেলে সে।

পাঁচ বা ছয় বছর ধরে এইরূপ শিক্ষার ফলে মানুষের ইচ্ছাশক্তির আর কতটুকুই বা বাকি থাকতে পারে? এবং ছাড়া পাওয়ার পর আর কোথায়ইবা যাওয়ার জায়গা থাকে তার? সেই একই সঙ্গীদের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া, যাদের সঙ্গের কারণেই তাকে জেলে যেতে হয়েছিল? একমাত্র তারাই তাকে সমমর্যাদায় আপন করে নিবে। কিন্তু যখন সে তাদের সাহচার্যে ফিরে যাবে নিশ্চিত কয়েক মাসের মধ্যেই তাকে আবার কারাগারে যেতে হবে। আর সেটাই ঘটে থাকে আসলে। কারা কর্তৃপক্ষ এটা ভালো করেই জানে।

আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করা হয়— কারাগার ব্যবস্থাপনার কোন ধরনের সংস্কার আমি প্রস্তাব করব; কিন্তু পঁচিশ বছর আগে যেমন, এখনো কারাগারের সংস্কার কীভাবে সম্ভব সেটা আমার মাথায় আসে না। কারাগার বন্ধ করে দিতে হবে অবশ্যই। আমি হয়তো বলতাম, ‘কম নির্দয় হোন, এবং আপনার কাজকর্মের ব্যাপারে আরও বেশি চিন্তাশীল হোন’। কিন্তু এখন আমি বরং বলব যে, ‘প্রতিটি কারাগারেই পরিচালক হিসেবে একজন করে প্যাস্তালৎসি  নিয়োগ দেয়া হোক এবং আরও ষাটজন প্যাস্তালৎসি নিয়োগ দেয়া হোক কারা পরিদর্শক হিসেবে।’ এটা অযৌক্তিক মনে হতে পারে, কিন্তু এর চেয়ে কমে কোনোভাবেই চলবে না।

আর্টওয়ার্ক: ড্রিমিং অব ফ্রিডম
শিল্পী: মোহাম্মদ সাবানেহ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

সুতরাং ম্যাসাচুসেটসের কয়েকজন কারাকর্মকর্তা যখন সত্যি সত্যিই সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমার উপদেশ চাইতে আসে, তখন আমার এই একটা বিষয়ই বলার ছিল, যদি কারাব্যবস্থাপনার বিলুপ্তি ঘটাতে নাই পারেন তাহলে অন্তত শিশু বা তরুণ বয়সের কাউকে কারাগারে নিবেন না। আর যদি তা করেন,  তাহলে তা হবে নরহত্যার সামিল। এবং কারাগার কী জিনিস অভিজ্ঞতা থেকে সেই শিক্ষা পাওয়ার পর, জেলারের পেশাটাকেই অস্বীকার করুন, এবং নিরলসভাবে এই কথাটা প্রচার করুন যে, অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র সহি পন্থাই হলো একে প্রতিরোধ করা। সুলভ মূল্যে স্বাস্থ্যকর নাগরিক  বাসস্থানের ব্যবস্থা, পিতামাতা ও সন্তান উভয়েরই পরিবার ও বিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষাদান, প্রতিটি ছেলে ও মেয়ের পেশাভিত্তিক শিক্ষা, সামাজিক ও পেশাগত সহযোগিতা, সবদিক থেকেই অনুকরণীয় সমাজ গঠন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আদর্শবাদিতার বিকাশ ঘটানো, যাতে করে মানবপ্রকৃতির উন্নতির দিকে তাদের তাড়িত করা সম্ভব হয়। আর এর মাধ্যমে শাস্তিপ্রদান করে যা সম্ভব নয় তা অর্জন করা যেতে পারে।

তানভীর আকন্দ