অরাজ
আর্টওয়ার্ক: রাইট টু প্রাইভেসি শিল্ফী এলেনা ওসপিনা সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ।। সাম্রাজ্যিক রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রধান এক অস্ত্র হতে পারে ক্রিপ্টোগ্রাফি

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ।। সাম্রাজ্যিক রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রধান এক অস্ত্র হতে পারে ক্রিপ্টোগ্রাফি

অনুবাদ: সেলিম রেজা নিউটন

আদি সাইফারপাঙ্কগণ ছিলেন প্রধানত ক্যালিফোর্নীয় লিবার্টারিয়ান। আমি এসেছিলাম ভিন্ন একটা ধারা থেকে। কিন্তু আমরা সবাই চেয়েছিলাম রাষ্ট্রীয় জুলুমবাজির হাত থেকে ব্যক্তির স্বাধীনতার সুরক্ষা। ক্রিপ্টোগ্রাফি ছিল আমাদের গোপন অস্ত্র। কতটা অন্তর্ঘাতমূলক জিনিস এটা ছিল তা এখন ভুলে গেছে মানুষ। ক্রিপ্টোগ্রাফি তখন ছিল রাষ্ট্রসমূহের একচেটিয়া সম্পত্তি। তারা সেটা ব্যবহার করত তাদের বিভিন্ন যুদ্ধে। আমাদের নিজস্ব সফটওয়ার লিখে লিখে দিগদিগন্তে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ক্রিপ্টোগ্রাফিকে আমরা মুক্ত করেছিলাম। আমরা একে বশ মানিয়েছিলাম এবং এর পরিব্যাপ্তি ঘটিয়েছিলাম নতুন ইন্টারনেটের সীমান্তে সীমান্তে।

এর পরিণামে নানাবিধ ‘অস্ত্র পাচার’ আইনের আওতায় ঘটানো ক্র্যাকডাউন ব্যর্থ হয়েছিল। ওয়েব ব্রাউজারগুলোতে এবং আরো যেসব সফটওয়ার মানুষ নিত্যদিন ব্যবহার করে সেগুলোতে ক্রিপ্টোগ্রাফি হয়ে উঠেছিল আদর্শ মান স্বরূপ। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন মোকাবেলা করার জীবন্ত হাতিয়ার হলো শক্তিশালী ক্রিপ্টোগ্রাফি। আর এটাই আমার সাইফারপাঙ্কস বইয়ের মূল কথা। কিন্তু শক্তিশালী ক্রিপ্টোগ্রাফিকে সর্বজনীনভাবে সুলভ করে তোলার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে অবশ্যই এর চেয়ে বেশি কিছু হাসিলের জন্য। আমাদের ভবিষ্যৎ স্রেফ ব্যক্তির স্বাধীনতার ওপরই নির্ভর করে না।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ
সূত্র: দ্য হিন্দ্যু

উইকিলিকস নিয়ে আমাদের কাজকর্ম থেকে আন্তর্জাতিক বিধি-বন্দোবস্তের গতিবিধি ও সাম্রাজ্যের যুক্তিপ্রণালী সম্পর্কে শাণিত উপলব্ধি অর্জন করা যায়। বড় বড় দেশ কীভাবে ছোট দেশগুলোকে তর্জন-গর্জন করে শাসায় এবং তাদের ওপর মাতব্বরি করে অথবা বৈদেশিক বাণিজ্য সংস্থাগুলো কীভাবে ঢুকে পড়ে ছোট ছোট দেশের ভেতরে এবং কীভাবে ছোট দেশগুলোকে কাজ করতে হয় নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে— তার সাক্ষ্যপ্রমাণ আমরা দেখেছি উইকিলিকসের উত্থানের দিনগুলোতে। আমরা দেখেছি গণ-আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা খুঁজে না-পেতে। নির্বাচন কেনাবেচা করতে দেখেছি আমরা। কেনিয়ার মতো আরো নানা দেশের ধনসম্পদ চুরি হয়ে যেতে এবং তা লন্ডন ও নিউ ইয়র্কের ধনিকগোষ্ঠীর হাতে নিলাম হয়ে যেতে আমরা দেখেছি।

ল্যাটিন আমেরিকার আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াই ল্যাটিন আমেরিকায় যাঁরা বাস করেন তাঁরা ছাড়াও আরো অনেকের জন্য জরুরি কেননা এ থেকে বাকি দুনিয়া দেখতে সক্ষম হয় যে, কাজটা করা সম্ভব। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার স্বাধীনতা এখনও তার শৈশবে পড়ে আছে। ল্যাটিন আমেরিকার গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের চেষ্টা এখনো চলছে— অতি সম্প্রতি যা ঘটেছে হন্ডুরাসে, হাইতিতে, ইকুয়েডরে এবং ভেনিজুয়েলায়।

এই জন্যই সাইফারপাঙ্কসের মর্মকথা ল্যাটিন আমেরিকার মানুষের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাইকারি নজরদারি স্রেফ গণতন্ত্র আর শাসনপ্রণালীর ইস্যু নয়— এটা একটা ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু। পুরো একটা জনগোষ্ঠীর ওপর একটা বৈদেশিক শক্তির নজরদারি স্বাভাবিকভাবেই তার সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। ল্যাটিন আমেরিকার গণতন্ত্রের ওপর হস্তক্ষেপের পর হস্তক্ষেপ আমাদেরকে বাস্তববাদী হতে শিখিয়েছে। আমরা জানি, এখনো ল্যাটিন আমেরিকার স্বাধীনতার আবির্ভাবকে বিলম্বিত করার অথবা দমিয়ে রাখার যেকোনো সুযোগ কাজে লাগাতে চাইবে পুরাতন শক্তিগুলো।

স্রেফ ভূগোলটা ভেবে দেখুন। তেলসম্পদ যে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির চালিকাশক্তি সেটা সকলেই জানেন। কে মাতব্বর হবে, কে অধিকৃত হবে, আর কে একঘরে হয়ে পড়ে থাকবে সেটা নির্ধারিত হয় তেলের প্রবাহ দিয়ে। তেলের পাইপলাইনের এমনকি একটা টুকরার ওপর বাস্তব নিয়ন্ত্রণ থাকাটাও তৈরি করে বিশাল ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতা। এ ধরনের অবস্থানে থাকা সরকারগুলো নানাবিধ ছাড় আদায় করতে পারে বিপুল পরিমাণে। পূর্ব ইউরোপ এবং জার্মানিকে এক ধাক্কায় একটা তাপবিহীন শীতকালে পাঠিয়ে দেওয়ার মতো শাস্তি দিতে পারে ক্রেমলিন। এবং তেহরানের তরফে পূর্ব অভিমুখে ভারত ও চীনের দিকে তেলের একটা পাইপলাইন চালাতে পারার একটুখানি সম্ভাবনাও কিন্তু ওয়াশিংটনের মারমুখো যুক্তি খাড়া করার অজুহাত হয়ে উঠতে পারে।

নতুন বিরাট খেলাটা কিন্তু তেলের পাইপলাইন নিয়ে যুদ্ধ নয়। এটা তথ্য-পাইপলাইনের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ সমুদ্রতলদেশ দিয়ে এবং মাটির ওপর দিয়ে যাওয়া ফাইবার-অপটিক কেবলের গতিপথের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। নতুন এ বৈশ্বিক ধনভাণ্ডার হচ্ছে দৈত্যাকার ডেটা-প্রবাহসমূহের নিয়ন্ত্রণ। এসব ডেটা-প্রবাহ সংযুক্ত করছে গোটা গোটা মহাদেশ এবং সভ্যতাকে, গ্রথিত করছে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ ও সংগঠনের মধ্যকার যোগাযোগসমূহকে।

এটা এখন আর কোনো গোপন ব্যাপার নয় যে, ইন্টারনেট এবং ফোন উভয় ক্ষেত্রেই ল্যাটিন আমেরিকা থেকে বের হওয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার ভেতরে ঢোকা সমস্ত পথ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে যাওয়া-আসা করে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বের হওয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার ভেতরে ঢোকা ডেটা-ট্রাফিকের ৯৯ শতাংশকেই ইন্টারনেট-অবকাঠামো যেসব ফাইবার-অপটিক লাইন দিয়ে চলাচল করায় সেসব লাইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত ছেদ করে চলে। এসব লাইনে আড়ি পেতে নিজদেশের নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করার জন্য তার নিজের আইন লঙ্ঘন করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কোনো সঙ্কোচ কাজ করে না। বৈদেশিক নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দাগিরির বিরুদ্ধে তো কোনো আইনই নাই। প্রত্যেকটা দিন, গোটা ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশের শত শত মিলিয়ন মেসেজ গপ গপ করে গিলে খায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাসংস্থাগুলো, এবং ছোট ছোট শহরের সমান বিভিন্ন গুদামঘরে সেগুলো জমা করে রাখে চিরতরে। ইন্টারনেট-অবকাঠামোর ভৌগোলিক ঘটনারাশিও তার মানে ল্যাটিন আমেরিকার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।

সমস্যাটা ভূগোলকে কিন্তু অতিক্রমও করে। ল্যাটিন আমেরিকার অনেক সরকার ও মিলিটারি তাদের গোপন ব্যাপারস্যাপারকে নিরাপদে রাখে ক্রিপ্টোগ্রাফিক হার্ডওয়ারের সাহায্যে। এগুলো এমনসব বক্স ও সফটওয়ার যা দিয়ে মেসেজ-পত্র আউলাঝাউলা করে দেয়া হয় এবং তারপর অপর প্রান্তে আউলাঝাউলা অবস্থাটা ঠিক আগের মতো গোছগাছ করে নেওয়া হয়। সরকারগুলো এগুলো কেনে তাদের গোপনকে গোপন রাখার জন্য কেননা ন্যায্যতই তারা তাদের যোগাযোগ ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত থাকে। এটা তারা করে অবশ্য জনসাধারণের মঙ্গলের বিনিময়ে।

কিন্তু এইসব দামি যন্ত্রপাতির বিক্রেতা কোম্পানিগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা-সম্প্রদায়ের থাকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। প্রায়ই দেখা যায় তাদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আসলে এনএসএ-র গণিতজ্ঞ ও প্রকৌশলী। মার্কিন নজরদারি-রাষ্ট্রের জন্য নিজেদের উদ্ভাবনগুলো থেকে লাভবান হয় তারা। তাদের যন্ত্রপাতিগুলো প্রায়শই দুর্বল প্রকৃতির হয়। অবশ্য এগুলো দুর্বল করে রাখা হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে। কারা এসব যন্ত্র ব্যবহার করছে বা কী প্রক্রিয়ায় এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে সেটা কোনো ব্যাপার না— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সিগুলো আউলাঝাউলা সিগন্যালগুলোকে ঠিকই আবার গোছগাছ করে নিতে পারে এবং পড়ে নিতে পারে মেসেজগুলো।

ল্যাটিন আমেরিকার এবং অন্যসব দেশের কাছে এসব যন্ত্রপাতি বিক্রি করা হয় ওসব দেশের গোপনকে সুরক্ষিত করার উপায় হিসেবে কিন্তু ওগুলো আসলে গোপন বিষয়আশয় চুরি করারই উপায়।

এরই মধ্যে, পরের ধাপের বিরাট অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে চাগিয়ে তুলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে আক্রমণের জন্য তৈরী অতিশয় জটিল সব অস্ত্রায়িত সফটওয়ারের নতুন যুগকে আবাহন করছে Stuxnet ভাইরাসের আবিষ্কার — এবং তারপর Duqu ও Flame ভাইরাসের আবিষ্কার। ইরানের ওপর এসবের প্রথম-আঘাতমূলক আগ্রাসী হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ইরানের প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য। ইরানের এসব চেষ্টা এ অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি স্বার্থের জন্য অভিশাপ স্বরূপ।

অোর্টওয়ার্ক: ডেঞ্জারাস ফর হোম
শিল্পী: ভ্লাদিমির কাজানেভস্কি
সূত্র: কার্টূন মুভমেন্ট

আক্রমণাত্মক অস্ত্র হিসেবে কম্পিউটার ভাইরাসের ব্যবহার এক কালে কল্পবৈজ্ঞানিক উপন্যাসের প্লট বলে ভাবা হতো। এখন এটা এক বৈশ্বিক বাস্তবতা। আন্তর্জাতিক আইনের বিপরীতে বারাক ওবামার প্রশাসনের বেপরোয়া আচরণ একে উৎসাহিত করে চলেছে। নিজ নিজ আক্রমণাত্মক সামর্থ্য বাড়ানোর জন্য অন্য রাষ্ট্রগুলোও এখন একই কায়দা অনুসরণ করবে। তাদেরকেও তো নাগাল ধরতে হবে, তাই না?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র অপরাধী নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উগান্ডার মতো সব দেশের ইন্টারনেট-অবকাঠামো সমৃদ্ধ হয়েছে প্রত্যক্ষ চীনা বিনিয়োগে। চীনা কোম্পানীগুলোর সাথে আফ্রিকীয় চুক্তিসমূহের বিনিময়ে বণ্টন করে দেওয়া হচ্ছে নাদুস-নুদুস ঋণ। উদ্দেশ্য ইন্টারনেটের মেরুদণ্ড হিসেবে ব্যবহার্য অবকাঠামো গড়ে তোলা। আর এ অবকাঠামো আফ্রিকার স্কুল, সরকারি মন্ত্রণালয় এবং নানান সম্প্রদায়কে গ্রথিত করছে বৈশ্বিক ফাইবার-অপটিক সিস্টেমের সাথে।

আফ্রিকা অনলাইনে আসছে ঠিকই, কিন্তু সে আসছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক বৈদেশিক পরাশক্তির সরবরাহ করা হার্ডওয়ারের মাধ্যমে। আফ্রিকীয় ইন্টারেনটই কি হবে সেই উপায় যা দিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে বশীভূত হতে থাকবে আফ্রিকার দেশগুলো? আফ্রিকা কি আরো একবার পরিণত হতে যাচ্ছে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সংঘাতের নাট্যশালায়?

যেভাবে সাইফারপাঙ্কদের মর্মকথা ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে অতিক্রম করে যেতে পারে এসব তারই কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দিক। নাগরিক স্বাধীনতা আর ব্যক্তি-অধিকারই শুধু নয়, ক্রিপ্টোগ্রাফি সুরক্ষা দিতে পারে গোটা গোটা দেশের সার্বভৌমত্ব আর স্বাধীনতাকে; ক্রিপ্টোগ্রাফি সুরক্ষা দিতে পারে একই লক্ষ্যে কর্মরত নানান গ্রুপের ভেতরকার সংহতিকে, এবং বৈশ্বিক বন্ধনমুক্তির প্রকল্পকে। ব্যক্তির ওপর রাষ্ট্রের উৎপীড়নবিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, ক্ষুদ্রতর দেশগুলোর ওপর সাম্রাজ্যের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহৃত হতে পারে বৈকি।

সাইফারপাঙ্কদের মহত্তম কাজ এখনো করা বাকি। আমাদের সাথে যুক্ত হোন।

সেলিম রেজা নিউটন

লেখক