অরাজ
আর্টওয়ার্ক: এনসিয়েন্ট সূত্র: ভাস্কো
প্রচ্ছদ » এরিকো মালাতেস্তা।। উদ্দেশ্য ও উপায়

এরিকো মালাতেস্তা।। উদ্দেশ্য ও উপায়

  • অনুবাদ: সারোয়ার তুষার

উদ্দেশ্যই উপায়ের বৈধতা। প্রচলিত এই উক্তিটির যথেষ্ট অপব্যবহার হয়েছে। তবুও এটিই পরিচালনের বৈশ্বিক মানদন্ডের ভূমিকা পালন করে চলেছে। যাইহোক, বরং এটা বলা যুক্তিযুক্ত হতো যে, প্রত্যেক উদ্দেশ্যেরই নিজস্ব উপায়ের প্রয়োজন রয়েছে। যেহেতু উদ্দেশ্যের মধ্যে নীতিবোধ খুঁজতে হবে, সেই লক্ষ্যেই উপায় নির্ধারণ করা বাঞ্ছনীয়। কোন ব্যক্তির লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, তা সে সচেতনভাবেই হোক আর প্রয়োজনের তাগিদেই হোক, সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি জীবনে আবির্ভূত হয় তা হচ্ছে উদ্দেশ্য যা কিনা পরিস্থিতি মোতাবেক নিশ্চিতভাবে এবং পরিমিতভাবে উদ্দেশ্যকে পরিচালিত করবে। কোন পথে এই সমস্যার সমাধান হবে তা নির্ভর করে মানুষের ইচ্ছার উপর; ব্যক্তি (অথবা পার্টি) স্ব স্ব উদ্দেশ্য অর্জনে সমর্থ অথবা ব্যর্থ হয় কিনা, সে তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উপকারী কিনা নাকি নির্বোধের মত শত্রুর উদ্দেশ্য সাধন করে। ইতিহাসে সাক্ষর রেখে যাওয়া প্রত্যেক মহান ব্যক্তি অথবা পার্টির সফলতার গোপন সূত্র হচ্ছে সঠিক উপায় খুঁজে পাওয়া।

 

এরিকো মালাতেস্তা
১৮৫৩-১৯৩২
সূত্র: ডিফেন্স এনার্কিস্ট গ্রুপ

অতীন্দ্রিয়বাদীদের ধারণা, জেসুইটদের লক্ষ্য ছিল ঈশ্বরের মহানুভবতা। অন্যদের কাছে এটি (লক্ষ্য)  হচ্ছে যীশুর অনুসারীদের ক্ষমতা। সুতরাং, জনগণকে নৃশংস করে তুলতে, সহিংস করতে তুলতে এবং তাদেরকে বশে আনতে তারা অবশ্যই সব রকম চেষ্টাই করবে।

জেকোবিন ও অন্যান্য কর্তৃত্বপরায়ন পার্টি, যারা মনে করে পরম সত্যের অধিকারী কেবল তারাই,  তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেদের মতাদর্শ ‘অজ্ঞ’ জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া। সুতরাং, মানবতাকে তাদের বদ্ধ ধারণার কঠিন নিগড়ে আবদ্ধ করার অভিপ্রায়ে তাদেরকে অবশ্যই ক্ষমতা দখল করতে হবে এবং জনগণকে তাদের অধীনে আনতে হবে।

কিন্তু আমাদের সমস্যা ভিন্ন। কারণ আমাদের উদ্দেশ্য ও উপায় দুটোই ভিন্ন। আজকের শোষক ও নিপীড়কের স্থলে  নিজেদের বসানোর স্বার্থে কিংবা কোন অন্তঃসারশূন্য বিমূর্ত ধারণাকে জয়ী করার লক্ষ্যে আমরা নিজেদের সংগ্রাম পরিচালনা করিনা। ‘ যতক্ষণ পর্যন্ত ইতালী সুসংসহত ও সুমহান আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইতালীয়রা অনাহারে মারা গেলে কি যায় আসে!’, এই ঘোষণা দেয়া ইতালীয় দেশপ্রেমিকের সাথে আমাদের কোন সামঞ্জস্য নেই। কিংবা  চিরায়ত ছকের বাইরে মুক্ত ও সুখী একটি পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর মানবজীবনের চারভাগের তিনভাগ অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নির্লিপ্ত কমরেডের সাথেও আমাদের কোন মিল নেই।

আমাদের অভিমত হচ্ছে, যে সকল কর্মসূচী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণ অবসানের লক্ষ্যে পরিচালিত, যা কিনা জনগণের নৈতিক ও বৌদ্ধিক মাত্রাকে জাগ্রত করতে উদ্যোগী, যা জনগণকে তাদের ব্যক্তিঅধিকার ও ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করতে চায়, যা জনগণকে নিজেদের পক্ষে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে; [এক কথায় ], সমস্ত কর্মসূচী যা শোষণের প্রতি ঘৃণা এবং মানুষের মধ্যে ভালোবাসা জাগাতে উৎসাহ প্রদান করে, তা আমাদেরকে স্বীয় লক্ষ্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় এবং তা অবশ্যই ভালো ( আমাদের করায়ত্তে থাকা শক্তিসমূহ থেকে প্রাপ্ত সর্বোৎকৃষ্ট ফলাফলের শর্তাধীন)। অপরপক্ষে, যে সমস্ত কর্মসূচী বর্তমান অবস্থাকে সংরক্ষণ করতে বদ্ধপরিকর, যা  কোন মতাদর্শের সফলতার স্বার্থে মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করে, তা খারাপ কারণ তা আমাদের উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করে। আমরা স্বাধীনতা ও ভালোবাসার বিজয়ের অন্বেষণ করি।

আমরা কি তবে সহিংস উপায় পরিত্যাগ করবো?  অবশ্যই না। আমাদের উপায় হলো তা যা পরিস্থিতি কর্তৃক  অনুমোদিত ও আরোপিত।

অবশ্যই আমরা কাউকে একটা আঙ্গুলের টোকাও দিতে চাইনা। মানবতার সমস্ত অশ্রু আমরা নিঃশেষ  করতে চাই এবং আরো অশ্রুর জন্য দায়ী হতে চাইনা। কিন্তু আমাদের হয় পৃথিবী যেমন আছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে অথবা অসহায় কল্পনাবিলাসী হয়ে থাকতে হবে। এমন দিন নিশ্চই আসবে, যখন মানবতার সেবা করতে গিয়ে কাউকে আঘাত করতে হবেনা। তাই সর্বোতভাবে, সর্বোৎকৃষ্ট সম্ভাব্য পন্থা অনুসন্ধানে সবচেয়ে কম ক্ষতিসাধনের প্রশ্ন বরাবরই প্রাধান্য পায়।

নিঃসন্দেহে বিপ্লব অনেক  ট্রাজেডি ও অনেক ত্যাগের কারণ হবে, তবুও এমনকি যদি আরো শতবারও এটা এসবের কারণ হয়ে থাকে, তারপরেও এটা বর্তমান বিশ্বের ক্ষতিকারক সামাজিক সংগঠনগুলোর সৃষ্ট দুঃখ-দুর্দশার তুলনায় একটি আশীর্বাদ হিশেবে বিবেচিত হবে।

সবধরণের সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রামে বরাবরই দুই রকমের সম্মোহক বিরাজ করে।

এক পক্ষে আছে তারা যারা মনে করে আমরা কখনোই যথেষ্ট পরিণত নই, আমরা খুব বেশ প্রত্যাশা করছি, আমাদের অবশ্যই অপেক্ষা করা উচিৎ এবং কোন নির্দিষ্ট সময়ে কোন সমাধান ছাড়াই সাময়িকভাবে অল্প সংস্কারের মাধ্যমে কোন অর্জন ও ক্ষয় যতটুকু অগ্রসরতা নিশ্চিত করেছে  তাতেই সন্তুষ্ট হওয়া উচিৎ। আরো এক পক্ষ আছে  যারা ক্ষুদ্র জিনিসের স্বার্থে ঘৃণাকে প্রভাবিত করে, ‘হয় সব নয়তো কিছুই না’ এমন সুপারিশ করে এবং এমন পরিকল্পনা হাজির করে যা পর্যাপ্ত সাহায্য ছাড়া উপলব্ধি করা সম্ভব না। অন্যের কাজকে সাধ্যমত বাধা দেয় অথবা দিতে চায়।

আমরা কী অর্জন করি তা নয় , বরং কীভাবে আমরা তা অর্জন করি; আমাদের ক্ষেত্রে সেটাই, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

যদি কেউ কোন অবস্থার উন্নতি নিশ্চিত করতে নিজের মূল কর্মপরিকল্পনা পরিত্যাগ করে, প্রচারণা বন্ধ করে, অথবা অনুধাবন করতে ও করাতে পরিশ্রম না করে; যদি কেউ জনতাকে  নিজস্ব সরাসরি সক্রিয়তার প্রতি উদ্বুদ্ধ না করে তাদের সব আশা আইন ও শাসকের শুভ ইচ্ছার উপর গচ্ছিত রাখতে উদ্বুদ্ধ করে, যদি কেউ বৈপ্লবিক উদ্দমকে শ্বাসরোধ করে এবং অসন্তোষ ও প্রতিরোধ উস্কে দেয়া বন্ধ করে দেয়, তখন সকল সুবিধাদি অলীক ও স্বল্পস্থায়ী বলে প্রতিয়মান হবে। এই সকল ঘটনা ভবিষ্যত সমাজের পথকে রুদ্ধ করবে।

সারোয়ার তুষার