- ভাষান্তর: সহুল আহমদ
[অনুবাদকের মন্তব্য: মিখাইল বাকুনিনের ‘প্যারি কমিউন ও রাষ্ট্রর ধারণা’ প্রবন্ধটি ১৮৭১ সালে লেখা হয়েছিল। শিরোনামই বলে দিচ্ছে যে তৎকালের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা [এবং আমাদের জন্য ঐতিহাসিক] প্যারি কমিউনই প্রবন্ধের মূল বিষয়বস্তু। এটি বাকুনিনের প্রধান কাজ The Knouto-Germanic Empire and the Social Revolution এর দ্বিতীয় অংশের মুখবন্ধ। প্রবন্ধটি স্যাম ডলগফ সম্পাদিত ও অনূদিত Bakunin on Anarchy গ্রন্থে ১৯৭১ সালে সংকলিত হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে ১৮৭১ সালের প্যারি কমিউন এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে প্রায় সকল সমাজতান্ত্রিক স্কুলই তর্ক-বিতর্ক করেছে, এবং আজতক সেগুলো চালু আছে। মার্ক্স, লেনিন যেমন নিজ নিজ তত্ত্বের আলোকে একে প্রশংসা করেছেন, ব্লাংকুইস্টরাও তেমনি প্রশংসা করেছেন। এই প্রবন্ধেও বাকুনিনও প্যারি কমিউনের উচ্চকিত প্রশংসা করেন। বাকুনিন প্রশংসা করার পাশাপাশি আন্দোলনের কিছু দুর্বলতাও তুলে ধরেন, এবং এগুলোর ঐতিহাসিক হেতু খোঁজার চেষ্টা করেন। তবে বাকুনিনের কাছে প্যারি কমিউন ছিল উছিলামাত্র, তিনি আসলে এখানে রাষ্ট্র নিয়েই আলাপ করেছেন, রাষ্ট্র ও গির্জার [বা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের] সম্পর্কের দিকে আলোকপাত করেছেন। বরাবরের মতন, নিজেকে স্বাধীনতাপ্রেমী হিসাবেই উপস্থাপন করেছেন। অনুবাদের জন্য মার্ক্সিস্ট.অর্গ –এ প্রকাশিত সংস্করণটিকেই ব্যবহার করা হয়েছে। অনুবাদে যে কোনো ধরণের ভুল-ভ্রান্তি নজরে পড়ে অনুবাদকের গোচরে আনার অনুরোধ থাকলো।]
আমার অন্যান্য লেখার মতো এই লেখাও বিভিন্ন ঘটনাবলীর ফসল। এটা আমার লেটার্স টু অ্যা ফ্রেঞ্চম্যান (সেপ্টেম্বর ১৮৭০) লেখার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা, যেখানে আমি বর্তমান ফ্রান্সসহ পুরো সভ্য সমাজকে ঘিরে ধরা ভয়াবহ বিপর্যয় সম্পর্কে সহজ কিন্তু কষ্টদায়ক পূর্বাভাস দিয়েছিলাম; যে বিপর্যয়ের একমাত্র নিরাময় হচ্ছে সামাজিক বিপ্লব।
আমার এখনকার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই ধরণের বিপ্লবের জরুরত প্রমাণ করা। আমি সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশ, এবং বর্তমানে আমাদের চোখের সামনে ইউরোপে যা হচ্ছে তাকে পর্যালোচনা করবো। সুতরাং যারা সত্যের জন্য ব্যাকুল তারা এটা গ্রহণ করে এই দার্শনিক নীতি ও ব্যবহারিক লক্ষগুলোকে প্রকাশ্যে এবং দ্ব্যর্থ-হীনভাবে জাহির করতে পারেন। এই নীতি ও লক্ষ্যগুলো আমরা যাকে সামাজিক বিপ্লব বলছি তার একেবারে কেন্দ্রীয় বিষয়।
আমি জানি আমার এই স্ব-আরোপিত কাজটি সহজ নয়। এটা গ্রহণ আমার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য থাকলে আমাকে অহংকারী বলা হতে পারে। আমি আমার পাঠকদের নিশ্চিত করতে চাই যে আমার এমন কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমি কোনো পণ্ডিত নই, বা দার্শনিক নই, এমনকি পেশাদার লেখকও নই। আমি জীবনে খুব বেশি লেখালেখিও করি নাই, এবং আত্মরক্ষার উদ্দেশ্য ব্যতিরেক কিছুই লিখি নি, এবং যখনই নিজের কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য আমার স্বভাবজাত অপছন্দকে কাটিয়ে উঠতে আমার উৎসাহী প্রতীতি বাধ্য করেছে কেবল তখনই কিছু লিখেছি।
তাহলে আমি কে এবং কোন বিষয়টা আমাকে এই মুহূর্তে বর্তমান কাজটি প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করছে? আমি একজন সত্যানুরাগী, এবং এই দুনিয়াকে বর্বর ও দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার নিমিত্তে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা কর্তৃক ব্যবহৃত কুৎসিত অলীক কাহিনীগুলোর একজন নির্মম শত্রু। এই ব্যবস্থা সকল সময়ের ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, আইনি, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কলঙ্ক থেকে লাভবান হয়েছে। আমি একজন দুর্বার স্বাধীনতাপ্রেমি। আমি স্বাধীনতাকে মানববুদ্ধি, মর্যাদা ও সুখানুভব বিকাশের একমাত্র পরিবেশ হিসাবে বিবেচনা করি। আমি সেই আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতাকে বোঝাচ্ছি না যা কিনা রাষ্ট্র কর্তৃক সরবরাহ, পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কেননা এই স্বাধীনতা এক অন্তহীন মিথ্যালাপ, এবং এটা মুষ্টিমেয়ের সুবিধার্থে বাকীদের গোলামী ব্যতীত আর কিছুই নয়। আমি রুশোসহ অন্যান্য বুর্জোয়া লিবারেল স্কুলসমূহ কর্তৃক উত্থাপিত ব্যক্তিস্বাত্যন্ত্রবাদী, অহংবাদী এবং ভুয়া স্বাধীনতার কথাও বলছি না; এই বুর্জোয়া লিবারেলবাদ রাষ্ট্রের মাধ্যমে প্রকাশিত সকলের অধিকারকে ব্যক্তির অধিকারের সীমা/বাধা হিসাবে বিবেচনা করে, ফলে এটি ব্যক্তির অধিকারকে শূন্যতে পর্যবসিত করে। আমি কেবল সেই স্বাধীনতাকেই বোঝাচ্ছি যা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সুপ্ত বস্তুগত, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক সক্ষমতাগুলোর পূর্ণ বিকাশ ঘটাবে। এই স্বাধীনতা কেবল আমাদের প্রকৃতির আইন ব্যতীত অন্য কোনো বিধিনিষেধ জানে না। সঠিকভাবে বলতে গেলে, এর ফলশ্রুতিতে আর কোনো বিধিনিষেধই থাকে না, কেননা এইসব আইন আমাদের বাইরে থেকে, পাশে থেকে বা আমাদের মাথার উপর থেকে আরোপ করা হয় না। এই আইনগুলো বিষয়ীগত, আমাদের মধ্যেই নিহিত। এগুলো খোদ আমাদের সত্তার ভিত্তি গঠন করে। এগুলোকে সঙ্কোচন করার পরিবর্তে এগুলোর মধ্যে আমাদের প্রকৃত অবস্থা এবং আমাদের স্বাধীনতার কার্যকর কারণটি দেখতে পাওয়া উচিৎ; যেখানে এক ব্যক্তির স্বাধীনতা অন্য আরেক ব্যক্তির স্বাধীনতার সীমা হিসাবে বিবেচিত হবে না, বরঞ্চ তার নিজের স্বাধীনতারই নিশ্চিতকরণ এবং প্রসারণ হিসাবে বিবেচিত হবে। সংহতির মাধ্যমেই স্বাধীনতা, সমতার মধ্যেই স্বাধীনতা। আমি বোঝাচ্ছি নিষ্ঠুর শক্তির ওপর স্বাধীনতার জয়জয়কার, এবং সর্বদাই এ ধরণের শক্তির আসল বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে কর্তৃত্বের নীতি। আমি সেই স্বাধীনতাকে বোঝাচ্ছি যা মর্ত্যে ও স্বর্গের দেবমূর্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিবে এবং সকল গির্জা ও রাষ্ট্রের ধ্বংসাবশেষের ওপর সংহতির ভিত্তিতে মানবজাতির একটি নতুন দুনিয়া তৈরি করবে।
আমি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতার একজন বিশ্বস্ত সমর্থক, কারণ আমি জানি এটা ছাড়া স্বাধীনতা, ন্যায়, মানব মর্যাদা, নৈতিকতা, ব্যক্তির মঙ্গলসহ জাতিসমূহের সমৃদ্ধি সবকিছুই মিথ্যালাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যেহেতু আমি স্বাধীনতাকে মানবজাতির প্রাথমিক শর্ত হিসাবে বিবেচনা করি, আমি বিশ্বাস করি যে শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত সংগঠন এবং স্বাধীনভাবে সংগঠিত উৎপাদক সমিতি কর্তৃক সম্পত্তির সামষ্টিক মালিকানার মাধ্যমে পৃথিবীতে সমতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এবং এটা করতে হবে কমিউনসমূহের স্বতঃস্ফূর্ত ফেডারেশন দিয়ে কর্তৃত্বপরায়ন পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে।
এই জায়গাতেই একটা মৌলিক বিভাজন দেখা দেয়, একদিকে থাকেন সমাজতান্ত্রিক ও বিপ্লবী যৌথবাদী [কালেক্টিভিস্ট] এবং অন্যদিকে থাকেন কর্তৃত্বপরায়ন কমিউনিস্ট যারা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে সমর্থন করেন। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য অভিন্ন। উভয়ই সমানভাবে একটি নতুন সমাজ ব্যবস্থা তৈরির আকাঙ্ক্ষা করেন, প্রথমত সামষ্টিক শ্রম সংগঠনের মাধ্যমে, সকলের জন্য সমান শর্তের অধীনে, ঘটনার সহজাত শক্তির মাধ্যমে সবার ওপর অবধারিতরূপে আরোপ করে, এবং দ্বিতীয়ত উৎপাদনের হাতিয়ারের ওপর সামষ্টিক মালিকানার মাধ্যমে। পার্থক্য হচ্ছে এই যে, কমিউনিস্টরা মনে করেন তারা শ্রমিক শ্রেণির, প্রধানত শহরের প্রলেতারিয়েতদের রাজনৈতিক ক্ষমতার সংগঠন এবং বিকাশের মাধ্যমে তাদের লক্ষ্য অর্জন করবেন, সহায়তা পাবেন বুর্জোয়া র্যাডিকেলবাদের। অন্যদিকে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিকরা বিশ্বাস করেন তারা শহর ও গ্রামের শ্রমিক শ্রেণির অ-রাজনৈতিক বা রাজনীতি-বিরোধী সামাজিক ক্ষমতার সংগঠন ও বিকাশের মাধ্যমে সফলকাম হবেন; উঁচু শ্রেণির বন্ধুসুলভ সকল ব্যক্তি যারা কিনা তাদের অতীতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে খোলামেলাভাবে যুক্ত হতে চাইবেন এবং পুরোপুরি বিপ্লবী কর্মসূচিকে গ্রহণ করবেন তারাও এতে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
এই মতবিরোধ কৌশলগত পার্থক্যের দিকে নিয়ে যায়। কমিউনিস্টরা বিশ্বাস করেন শ্রমিকদের সংগঠিত করা জরুরি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য। বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিকরা সংগঠিত করেন রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে, আরো নরম সুরে বললে, রাষ্ট্রকে ডুবিয়ে মারার উদ্দেশ্যে। কমিউনিস্টরা কর্তৃত্বের নীতি ও চর্চাকে সমর্থন করেন, বিপ্লবীরা সমাজতান্ত্রিকরা তাদের সকল বিশ্বাস স্বাধীনতার ওপর ন্যস্ত করেন। উভয়ই সমানভাবে বিজ্ঞানের পক্ষে, যা কুসংস্কার ধ্বংস করে ধর্মীয় বিশ্বাসের স্থান দখল করে নিবে। কমিউনিস্টরা বিজ্ঞানকে শক্তির মাধ্যমে আরোপ করতে চান; অন্যরা এটাকে এমনভাবে প্রচার করতে চান যেন মানব গোষ্ঠী নিজেরাই সম্মত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ হবেন; তলা থেকে উপর পর্যন্ত মুক্তভাবে নিজেদের সঙ্গতি ও চাহিদা অনুযায়ী সংগঠিত হবেন। তারা কখনোই কিছু ‘ঊর্ধ্বতন মনন কর্তৃক ‘অজ্ঞ’ জনতার ওপর চাপিয়ে দেয়ার কোনো পূর্ব পরিকল্পিত নীলনকশাকে অনুসরণ করেন না।
বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিকরা মনে করেন যে মানবসমাজের সমস্ত ডাক্তার এবং শিক্ষকের গভীর বুদ্ধিমত্তার চেয়ে জনগণের সহজাত আকাঙ্ক্ষা এবং আসল প্রয়োজনগুলির মধ্যে আরও অনেক বেশি ব্যবহারিক ভাল জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা রয়েছে। বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিকরা আরো মনে করেন যে, মানবজাতি দীর্ঘকাল যাবত নিজেকে শাসিত অবস্থায় রেখে দিয়েছে। তার সমস্যার কারণ কোনো একটি নির্দিষ্ট রূপের সরকারব্যবস্থার মধ্যে নয়, বরঞ্চ সরকারব্যবস্থার খোদ অস্তিত্ব ও মৌলিক নীতি সমস্যার কারণ, তা সেই সরকারব্যবস্থা যে রূপেই থাকুক না কেন!
পরিশেষে কমিউনিজম ও প্রুধোনিজমের মধ্যে সুপরিচিত দ্বন্দ্ব রয়েছে; কমিউনিজমের বিজ্ঞানভিত্তিক বিকাশ হয়েছে জার্মান স্কুল কর্তৃক এবং আমেরিকা ও ইংরেজের মধ্যে অংশত গৃহীত হয়েছে, অন্যদিকে প্রুধোনিজমের বিকাশ এবং একটি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে লাতিন দেশগুলোর প্রলেতারিয়েতদের মাধ্যমে। প্যারিস কমিউনে বিপ্লবী সমাজতন্ত্র সবে প্রথম লক্ষণীয় ও কার্যকর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।
আমি প্যারিস কমিউনের সমর্থক, কারণ রাজতান্ত্রিক ও ধর্মতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াতে রক্তক্ষয় হওয়া সত্ত্বেও এটি ইউরোপীয় প্রলেতারিতের অন্তরে আরো শক্তিশালী ও টেকসই হয়ে উঠছে। সবচাইতে বড়ো কথা আমি এর সমর্থক কারণ এটি সাহস করে স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রকে নাকচ করে দিয়েছে।
এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ ফ্রান্সেই সংগঠিত হয়েছে, যা তদ্দিন পর্যন্ত চরম উৎকর্ষতার সঙ্গে রাজনৈতিক কেন্দ্রিকতার জমিন ছিল, এবং যে প্যারিস মহান ফরাসি সভ্যতার নেতা ও উৎসমুখ সেখানেই কমিউনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্যারিস তার মুকুটকে একপাশে সরিয়ে রেখে প্রবল উৎসাহের সঙ্গে নিজের পরাজয় ঘোষণা করছে ফ্রান্স, ইউরোপ সহ সমগ্র দুনিয়াকে জীবন ও স্বাধীনতা দেয়ার নিমিত্তে। প্যারিস তার নেতৃত্বের ঐতিহাসিক ক্ষমতাকে পুনরুদ্ধার করছে, গোলামী জীবন যাপনে অভ্যস্ত সকল জনগণকে (এমন কোন জনতা রয়েছে যারা গোলামী করছেন না?) মুক্তি ও স্বাস্থ্যের পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। প্যারিস বুর্জোয়া র্যাডিকেলবাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ওপর মরণঘাতি কামড় বসিয়েছে, এবং ফ্রান্স ও ইউরোপের সকল প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক বাস্তব ভিত তৈরি করে দিচ্ছে। প্যারিস নিজের ধ্বংসাবশেষে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে জয়োল্লাসিত প্রতিক্রিয়াকে ভুল প্রমাণ করার জন্য; নিজের বিপর্যয়ের মাধ্যমে ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ ও মর্যাদাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে; মানবজাতির কাছে এটা প্রমাণ করছে যে যদি জীবন, বুদ্ধিমত্তা, ও নৈতিক জোর উঁচু শ্রেণি থেকে ঝরে পড়ে, তবে সেগুলোকে প্রলেতারিয়েতের ক্ষমতা ও প্রতিশ্রুতিতে রক্ষা করা করা হয়। প্যারিস জনতার সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণ মুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় সীমান্তজুড়ে তাদের খাঁটি সংহতির নতুন জমানা সূচনা করেছে। প্যারিস জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করে এর ধ্বংসাবশেষের ওপর মানবতার ধর্মকে প্রতিস্থাপন করেছে। প্যারিস নিজেকে মানবতাবাদী ও নাস্তিক বলে ঘোষণা করেছে; ঐশ্বরিক অলীক কাহিনীর স্থলে সামাজিক জীবনের বিরাট বাস্তবতা ও বিশ্বাসকে বিজ্ঞান দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছে; স্বাধীনতা, ন্যায়, সমতা, ভ্রাতৃত্ব (যেগুলো কিনা সকল মানব নৈতিকতার চিরন্তন ভিত্তি) দিয়ে পুরনো নৈতিকতার মিথ্যা ও বৈষম্যগুলোকে প্রতিস্থাপন করেছে! প্যারিস নায়কোচিত, যৌক্তিক ও আত্মবিশ্বাসী। নিজের ধ্বংসযজ্ঞ ও মৃত্যু দিয়ে হলেও মানবজাতির ভবিষ্যতের ওপর তার দৃঢ় বিশ্বাসকে নিশ্চিত করছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সে তার এই বিশ্বাসকে দিয়ে যাচ্ছে! প্যারিস তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্তে প্লাবিত হয়েছিল; খোদ মানবতাই ইউরোপের সংযুক্ত আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিল, খ্রিস্টান গির্জা ও পোপের সরাসরি ইন্ধনে। কিন্তু জনগণের সংহতি প্রকাশ করে আসন্ন আন্তর্জাতিক বিপ্লব হবে প্যারিসের পুনরুত্থান।
চিরস্মরণীয় প্যারিস কমিউনের জীবন ও মরণের দুই মাসের এই হচ্ছে আসল অর্থ এবং এগুলো হচ্ছে এই দুই মাসের অপরিসীম ও হিতকর ফলাফল।
প্যারিস কমিউন খুব অল্প সময়ের জন্য টিকে ছিল। সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি প্রয়োগ না হোক, অন্তত পদ্ধতিগতভাবে পরিকল্পনা করার জন্যও ভার্সেলদের প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী লড়াইয়ে তাদেরকে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। এই প্রাণঘাতী লড়াই দ্বারা এর অভ্যন্তরীণ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। আমাদের অবশ্য এও বুঝতে হবে যে, কমিউনের অধিকাংশ সদস্য আদতে সমাজতান্ত্রিক ছিলেন না। যদিও আপাত সেটা মনে হয়েছিল, কারণ তারা সেদিকে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন ব্যক্তিগত প্রত্যয়ের চাইতে বরঞ্চ ঘটনাসমূহের অপ্রতিরোধ্য প্রবাহ, পরিস্থিতির প্রকৃতি, এবং তাদের অবস্থানের জরুরতের কারণে। সমাজতান্ত্রিক অংশটা খুবই ছোট ছিল, সর্বোচ্চ চৌদ্দ-পনেরজন। বাকিরা ছিলেন জেকোবিন। কিন্তু স্পষ্ট করে বলা দরকার, সেখানে বিভিন্ন ধরণের জেকোবিনরা ছিলেন। সেখানে লিও গাম্বেত্তার মতো জেকোবিন আইনবিদ ও মতবাদী ছিলেন। তাদের প্রত্যক্ষবাদী দাম্ভিক, স্বৈরচারী ও আইনীয় রিপাবলিকতন্ত্র পুরোন বিপ্লবী বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিল, জ্যাকোবিনতন্ত্রের সমস্তটাই গ্রহণ করেছে কেবলমাত্র তার ঐক্যের কাল্ট ও কর্তৃত্বের অংশটুকু বাদে। এবং ফ্রান্সের জনগণকে তুলে দিয়েছিল প্রুশিয়ানদের হাতে এবং পরবর্তীতে স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে। এবং সেখানে এমনও জেকোবিন রয়েছেন যারা একেবারে স্পষ্টতই বিপ্লবী। তারা নায়ক। তারা ১৭৯৩ সালের গণতান্ত্রিক বিশ্বাসের সর্বশেষ খাটি প্রতিনিধি। প্রতিক্রিয়ার তোড়ে নিজেদের চেতনা/বিবেককে জমা দেয়ার পরিবর্তে তারা তাদের সুসজ্জিত একতা ও কর্তৃত্বকে আত্মোৎসর্গ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মহাত্মা লুই চার্লস ডেলেসক্লুজের নেতৃত্বে এই মহান জেকোবিনরা সবকিছুর ঊর্ধ্বে বিপ্লবের বিজয় কামনা করেছিলেন। যেহেতু জনতা ছাড়া কোনো বিপ্লব নেই, এবং যেহেতু আজকাল জনতা সমাজতন্ত্রের প্রতি একধরণের মনোভাব/প্রবৃত্তি প্রকাশ করছে, এবং যেহেতু এটা একরকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লব হতে পারে, সেহেতু বিপ্লবী মুহূর্তের যুক্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে সৎবিশ্বাসের জেকোবিনরা দিনশেষে সমাজতান্ত্রিকই হয়ে উঠবেন।
যে জেকোবিনরা প্যারিস কমিউনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা একদম এই পরিস্থিতিতেই নিজেদের খুঁজে পেয়েছিলেন। ডেলেসক্লুজসহ অন্যান্যরা এমন সব কর্মসূচী ও ঘোষণা দিচ্ছিলেন যেগুলোর সাধারণ নিহিতার্থ ও ওয়াদা নিশ্চিতভাবেই [পজিটিভলি] সমাজতান্ত্রিক প্রকৃতির ছিল। তদপুরি তাদের সৎবিশ্বাস ও ভালো নিয়ত থাকা সত্ত্বেও তারা অন্তর্নিহিত তাগিদের চাইতে বরঞ্চ বাহ্যিক পরিস্থিতির চাপেই কেবল সমাজতান্ত্রিক ছিলেন। তাদের সময়ের অভাব ছিল। এমনকি তাদের নিজস্ব কিছু বুর্জোয়া কুসংস্কারকে পরাস্ত করা ও ছাড়িয়ে যাওয়ার সক্ষমতারও অভাব ছিল, যে কুসংস্কারগুলো তাদের নবার্জিত সমাজতন্ত্রের বিরোধী ছিল। যে কেউই বুঝবেন, এই অভ্যন্তরীণ সংগ্রামে আটকা পড়ে তারা যেমন সাধারণ বিষয়গুলোকে মাড়িয়ে যেতে পারছিল না, তেমনি বুর্জোয়া জগতের সাথে চিরতরে যাবতীয় যোগাযোগ ও সংহতি রদ হয়ে যাবে এমন কোনো সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপও নিতে পারছিল না।
এটা ছিল কমিউন এবং খোদ এই লোকগুলোর জন্য বড়োই দুর্ভাগ্যের বিষয়। তারা নিজেরা যেমন পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছিলেন, তেমনি কমিউনকেও পঙ্গু করে ফেলেছিলেন। তবু আমরা তাদেরকে দোষারোপ করতে পারি না। মানুষ রাতারাতি পাল্টে যায় না। ইচ্ছামাফিক তাদের প্রকৃতি বা অভ্যাস বদলে যায় না। কমিউনের জন্য প্রাণ দিয়ে তারা তাদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিয়ে গিয়েছেন। তাদের কাছে এর বেশি আর কী চাইতে পারি আমরা?
প্যারিসের জনগণের চাইতে বেশি দোষ তাদেরকে দেয়া যাবে না, যাদের প্রভাবেই তারা চিন্তা ও কাজ করেছেন। জনগণ গভীর চিন্তাভাবনা/বিবেচনার চাইতে বেশি প্রবৃত্তির কারণেই বরঞ্চ সমাজতান্ত্রিক ছিলেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা সর্বোচ্চ মাত্রায় সমাজতান্ত্রিক ছিল, কিন্তু তাদের চিন্তাভাবনা বা তাদের গতানুগতিক অভিব্যক্তিগুলো তেমন ছিল না। ফ্রান্সের শহরগুলোর, এমনকি প্যারিসেরও প্রলেতারিয়েতরা এখনো বহু জেকোবিন কুসংস্কারে, বহু স্বৈরাচারী ও সরকারি ধারণার মধ্যে আটকা পড়ে আছেন। কর্তৃত্বের কাল্ট (সকল অশুভ, বঞ্চনা ও দাসত্বের উৎস ধর্মীয় শিক্ষার ভয়াবহ পরিণাম) এখনো তাদের মধ্যে এখনো নির্মূল হয়নি। এটা এতোই সত্য যে, সবচাইতে বুদ্ধিমান মানুষটা, এমনকি সবচাইতে বিশ্বস্ত বা প্রণোদিত সমাজতান্ত্রিকও এইসব ধারণা থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারেনি। আপনি যদি তাদের মনে একটু অনুসন্ধান চালান তাহলে সেখানে একজন জেকোবিনকে খুঁজে পাবেন যে সরকারব্যবস্থার প্রচারক; এক অন্ধকার কোনে ভয়ে জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় রয়েছে, অবনমিত কিন্তু একেবারে নিষ্প্রাণ নয়।
এবং একেবারে বিশ্বস্ত সমাজতান্ত্রিক যে ছোট দলটি কমিউনে অংশগ্রহণ করেছিল তারা খুব কঠিন পরিস্থিতিতে বা অবস্থানে ছিলেন। একদিকে রয়েছে প্যারিসের জনতার কাছে তাদের সমর্থনের অভাব এবং আন্তর্জাতিক এ্যাসোসিয়েশনের অসম্পূর্ণতা, অন্যদিকে জেকোবিন সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিরুদ্ধে তাদেরকে প্রাত্যহিক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছিল। এমন সংঘর্ষের মধ্যেও তাদেরকে কয়েক হাজার শ্রমিকদের কাজ ও খাদ্য সরবরাহ করতে হচ্ছিল, তাদেরকে সংগঠিত ও সজ্জিত করতে হচ্ছিল, এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের কাজকারবারের দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হচ্ছিল। প্যারিসের মতন শহরে ঘেরাও অবস্থায়, অনাহারের হুমকির মুখে এবং ভার্সেইলের অনুমতিতে ও প্রুশিয়ানদের বদৌলতে প্রতিক্রিয়ার ছদ্মবেশী চক্রান্তের সম্ভাব্য শিকার অবস্থাতেই এগুলো করতে হচ্ছিল। তাদেরকে ভার্সেইলের সেনাবাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হচ্ছিল। রাজতন্ত্র ও পুরোহিত তন্ত্রের প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যে, বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রের প্রথম শর্তকে ভুলে বা ত্যাগ করে, তারা বাধ্য হচ্ছিলেন জেকোবিন পদ্ধতিতে সংগঠিত হতে।
এরকম বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতিতে, এটা খুব স্বাভাবিকই ছিল যে জেকোবিনরাই সমাজতান্ত্রিকদের ওপরে থাকবেন। জেকোবিনরাই কমিউনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিলেন, তারা একটি বেশ বিকশিত রাজনৈতিক প্রবৃত্তি এবং শাসনতান্ত্রিক সংগঠনের চর্চা ও ঐতিহ্যের ধারক ছিলেন। এটা অবাক করার মত বিষয় যে, তারা তাদের সুবিধাগুলোকে বেশি চাপায়ে দেন নি। তারা প্যারিস বিদ্রোহকে পুরোপুরি জেকোবিন চরিত্র দেন নি। পরিবর্তে তারা নিজেদেরকে একটি সমাজবিপ্লবের দিকেই চালিত করেছিলেন।
আমি জানি বহু সমাজতান্ত্রিক, যারা তাদের তত্ত্বে খুবই যৌক্তিক, তারা আমাদের প্যারিসের বন্ধুদেরকে দোষারোপ করবেন: কেন তারা সমাজতন্ত্রীদের মতো যথার্থভাবে বিপ্লবী চর্চায় সাড়া দিলেন না! অন্যদিকে বুর্জোয়া প্রেস চেঁচামেচি করে খুব বিশ্বাসের সাথে তাদের কর্মসূচি অনুসরণ করার জন্য দোষারোপ করছে। একমুহূর্তে জন্য প্রেসের এই ইতরামি নিন্দাকে ভুলে যাওয়া যাক। আমি প্রলেতারিয়েতের মুক্তির তাত্ত্বিকদের একটা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই: তারা আমাদের প্যারিসের ভাইদের প্রতি অন্যায় করছেন। কারণ সবচেয়ে সঠিক তত্ত্ব ও এর প্রয়োগের মধ্যকার বিরাট দূরত্ব তা মাত্র কয়েকদিনে দূর করা সম্ভব নয়। যেমন, যাদের ইউজেন ভার্লিন সম্পর্কে জানার সৌভাগ্য হয়েছে তারা জানেনে যে, ভার্লিন ও তাঁর কমরেডরা অগাধ, প্রগাঢ় ও সুবিবেচিত সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। যারা তাদেরকে জানেন তারা কখনোই তাদের উদ্দীপনা, একনিষ্ঠতা এবং গভীর আস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। তবু তারা এই গভীর আস্থাসম্পন্ন বা সৎবিশ্বাসের মানুষ হওয়ার কারণে যে বিপুল কর্মযজ্ঞে নিজেদের মন ও দেহকে উৎসর্গ করেছিলেন সে যজ্ঞের মুখোমুখি হয়ে তারা আত্ম-অবিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। তারা নিজেদের নিয়ে খুব অল্পই ভাবতে পেরেছিলেন! এবং তারা নিশ্চিত ছিলেন, সামাজিক বিপ্লবে, যা কিনা রাজনৈতিক বিপ্লবের চাইতে বিভিন্ন দিক থেকে একদম ভিন্ন, ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের চাইতে জনতার স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকাণ্ডই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি যা কিছু করতে পারেন তা হচ্ছে জনতার স্বভাবজাত আকাঙ্ক্ষাগুলি প্রকাশ করে এমন ধারণা তৈরি করা, স্পষ্ট করা ও প্রচার করা; এবং জনতার স্বভাবজাত শক্তির বিপ্লবী সংগঠন নির্মাণে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া। এইটাই। এর চাইতে বেশি কিছু না। বাকি সব কাজ কেবল খোদ জনতা দ্বারাই সম্পন্ন করা যেতে পারে। অন্যথায় রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রই পরিণতি হবে, অর্থাৎ, রাষ্ট্রের পুনর্গঠন, সাথে থাকবে এর সকল বিশেষাধিকার, বৈষম্য ও জুলুম। একটি সর্পিল/প্রতারণাপূর্ণ কিন্তু অনিবার্য পথ অবলম্বন করে আমরা জনসাধারণের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দাসত্ব পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার দিকেই যাবো।
ভার্লিন ও তাঁর কমরেডগণ বাকিসকল আন্তরিক সমাজতান্ত্রিকদের মতন এবং সাধারণত জনতার মধ্যে বিকশিত হওয়া সকল শ্রমিকদের মতন এক ও একই গোষ্ঠীর ব্যক্তির ক্রমাগত ক্রিয়াকলাপের প্রতি একধরণের সতর্ক মনোভাব পোষণ করতেন; এবং কয়েকজন উচ্চতর ব্যক্তিত্বের আধিপত্যের বিরুদ্ধেও সতর্ক ছিলেন। এবং যেহেতু তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে ন্যায়বিচারী ছিলেন, সেহেতু তারা তাদের এই দূরদর্শিতা, এই অবিশ্বাসকে ততটাই নিজের বিরুদ্ধে করেছিলেন যতটা অন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে করতেন।
একটি সামাজিক বিপ্লবকে অবশ্যই রাজনৈতিক বিপ্লব থেকে উদ্ভূত স্বৈরশাসন বা নির্বাচনী সংসদের ফরমানে সংগঠিত করতে হবে, স্বৈরচারী কর্তৃত্বপরায়ন কমিউনিস্টদের এই বিশ্বাসের বিপরীতে আমাদের প্যারিস সমাজতন্ত্রী কমরেডেরা বিশ্বাস করতেন যে, একা যেমন তিনি/তারা বিপ্লব করতে পারবেন না, তেমনি জনতা, জনগণের সকল গোষ্ঠী ও সংঘের স্বতঃস্ফূর্ত ও ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড ব্যতীত বিপ্লবের পূর্ণ বিকাশ সাধন সম্ভব নয়।
আমাদের প্যারিসের কমরেডরা বহুগুণে সঠিক ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কোথায় সেই উজ্জ্বল মনন বা ধীশক্তি যা চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা ও জরুরতের বিচিত্রতা ও অসীম বহুতাকে (এসব মিলেই জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছা তৈরি হয়) ধারণ করবে? (এমনকি আমরা যদি সামষ্টিক স্বৈরতন্ত্রের কথাও বলি, এমনকি সেটা যদি উচ্চতর মানসিকতাসম্পন্ন হাজার হাজার ব্যক্তি দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে।) এবং এমন একটি সামাজিক সংগঠন উদ্ভাবন করবে যা সমাজের ওপর রাষ্ট্রের সহিংসতাকে দীর্ঘায়ত করার পদ্ধতি বা পরিকল্পনা হবে না? এটা সর্বদা এমনই ছিল। এবং সামাজিক বিপ্লবকে আদতে এই জোরজবরদস্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের পুরাতন ব্যবস্থার ইতি টানতে হবে। এটা করতে হবে ব্যক্তির পাশাপাশি জনতা, সকল গোষ্ঠী, কমিউন ও সংঘের পূর্ণ স্বাধীনতাদানের মাধ্যমে। এটা করতে হবে সকল ধরণের সহিংসতার সকল ঐতিহাসিক কারণকে একেবারে ধূলিসাৎ করার মাধ্যমে। এই সহিংসতাই হচ্ছে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও অস্তিত্ব। এর পতন আইনের সকল বৈষম্য এবং বিভিন্ন ধর্মের সকল মিথ্যের অবসান ঘটাবে, কেননা আইন ও ধর্ম উভয়ই রাষ্ট্র দ্বারা প্রকাশিত, প্রতিশ্রুত ও সুরক্ষিত সকল সহিংসতার আবশ্যিক পবিত্রকরণ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
এটা নিশ্চিত যে, যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মুক্তি আসবে না, সমাজের সকল গোষ্ঠী, স্থানিক সংঘ ও ব্যক্তিবর্গের আসল স্বার্থ পূর্ণ হবে না। এটা সুস্পষ্ট যে সমাজের সমস্ত তথাকথিত সাধারণ স্বার্থ, যা রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করে বলে মনে করা হয় এবং যা বাস্তবে রাষ্ট্রের অধীন অঞ্চল, কমিউন, সংঘ এবং ব্যক্তিদের সত্যিকারের স্বার্থকে নাকচ করে দেয়, সেই তথাকথিত সাধারণ স্বার্থ বিমূর্ততা, অলীক ও মিথ্যা। রাষ্ট্র হচ্ছে একটি বিরাট কসাইখানা ও গোরস্থানের মত, যেখানে সকল আকাঙ্ক্ষা, দেশের সকল সজীব শক্তি সেই বিমূর্ততার ছায়ায় খুশিমনে নিজেকে খুন করে এবং সমাধিস্থ করে। এবং যেহেতু কোনো বিমূর্ততাই নিজ থেকে টিকে থাকতে পারে না, দাঁড়ানো জন্য পা নেই, হাত নেই, শিকারিদের হজম করার মতো কোনো পাকস্থলী নেই, এটা সম্ভবত স্পষ্ট যে, এই ধর্মীয় বিমূর্ততা, মানে ঈশ্বর আসলে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণির স্বার্থেরই প্রতিনিধিত্ব করেন, মানে পুরোহিতদের প্রতিনিধিত্ব করেন। অন্যদিকে ধর্মীয় বিমূর্ততার রাজনৈতিক সম্পূরক, মানে রাষ্ট্র নামক রাজনৈতিক বিমূর্ততা শোষণকারী শ্রেণি, অর্থাৎ বুর্জোয়াদের স্বার্থ ছাড়া আর কোনো কিছুরই প্রতিনিধিত্ব করে না। যেমন করে এই পুরোহিততন্ত্র সর্বদা বিভেদ-সৃষ্টিকারী ছিল এবং বর্তমানে মানুষকে শক্তিশালী ও সম্পদশালী সংখ্যালঘু এবং পরাধীন ও হতভাগ্য সংখ্যাগুরুতে বিভক্ত করে ফেলছে, তেমনি বুর্জোয়ারা শিল্প, কৃষি, ব্যাংকিং ও বাণিজ্যে তাদের সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং রাষ্ট্রের সকল প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, আইনি, শিক্ষাব্যবস্থা, পুলিশ ও সামরিক কার্যক্রম একদিকে প্রবল আধিপত্যকারী অভিজাতদের কাছে কুক্ষিগত করেছে। এর অন্যদিকে রয়েছে একটা বিরাট সংখ্যক জনতা যারা কমবেশি আশাহত জীব, স্থায়ী মোহের মধ্যে বসবাসকারী প্রতারিত জীব, এবং ধীরে ধীরে ও অনিবার্যরূপে যারা বিদ্যমান অর্থনৈতিক বিকাশের অপ্রতিরোধ্য শক্তির দ্বারা সর্বহারায় পরিণত হচ্ছে। তারা এই সর্বশক্তিমান অভিজাতদের নিছক আন্ধা-হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে।
গির্জা ও রাষ্ট্রের বিলুপ্তিই সমাজের প্রকৃত মুক্তিলাভের প্রথম ও অপরিহার্য শর্ত হওয়া উচিত। যে সমাজ নিজেকে পুনর্গঠন করতে পারবে ও করা উচিত, কিন্তু সেটা কয়েকজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বা পণ্ডিতদের আদর্শ পরিকল্পনামাফিক বা কোনো স্বৈরশাসকের বা সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের ফরমান অনুযায়ী উপর-নিচ আদলে হবে না। পূর্বেই বলেছি, এই ধরণের ব্যবস্থা অনিবার্যভাবেই একটি নতুন রাষ্ট্রের দিকেই নিয়ে যাবে, এবং ফলস্বরূপ একটি ক্ষমতাসীন অভিজাত গঠন করবে। অর্থাৎ একটি শ্রেণি তৈরি হয় যাদের সাথে জনতার কোনো মিল নেই। এবং নিঃসন্দেহে এই শ্রেণি সাধারণ মঙ্গল অথবা রাষ্ট্রকে বাঁচানোর অজুহাতে আপামর জনতাকে শোষণ করে।
ভবিষ্যৎ সামাজিক সংগঠনকে নিচ-উপর আদলে হতে হবে। সেটা হবে মুক্ত সমিতি বা শ্রমিক ফেডারেশনের মাধ্যমে। সমিতি থেকে শুরু হয়ে, তারপর কমিউন, অঞ্চল, দেশ এবং পরিশেষে একটি আন্তর্জাতিক ও সর্বজনীন ফেডারেশনের সমাপ্তি ঘটবে। কেবল তখনই স্বাধীনতা ও সাধারণ মঙ্গলের জীবনদায়ী সামাজিক ব্যবস্থা [অর্ডার] প্রতিষ্ঠিত হবে। এই ব্যবস্থা ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থকে সীমিত করার চাইতে বরঞ্চ সমর্থন যোগাবে এবং এগুলোর মিলন সাধন করবে।
বলা হয়ে থাকে যে, সমাজের সাথে ব্যক্তির একাত্মতা এবং সর্বজনীন সংহতি বাস্তবে কখনও অর্জন করা যায় না, কারণ তাদের স্বার্থ পরস্পরবিরোধী হওয়ার কারণে কখনও মিলিত/সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না। এর প্রত্যুত্তরে আমি বলি যে, যদি এই স্বার্থগুলো এখনো পারষ্পরিক সমঝোতায় না আসে, তাহলে সেটা এই কারণে যে রাষ্ট্র গুটিকয়েক সুবিধাভোগীর জন্য সংখ্যাগুরুর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। এই বিখ্যাত অসামঞ্জস্যতা, অর্থাৎ সমাজের ব্যক্তিগত স্বার্থের এই সংঘাত, ভুয়া ও রাজনৈতিক মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি একটি ধর্মতাত্ত্বিক মিথ্যা থেকে জন্ম নিয়েছে, যা আদিপাপের তত্ত্ব হাজির করে মানুষকে অসম্মান করেছে এবং আত্ম-সম্মানকে ধূলিসাৎ করেছে। শত্রুভাবাপন্ন স্বার্থ সম্পর্কিত এই ভ্রান্ত ধারণা অধিবিদ্যা দ্বারাও জ্বালানি পেয়েছিল এবং সেটা ধর্মতত্ত্বের নিকটাত্মীয়। অধিবিদ্যা মানব প্রকৃতির সামাজিক চরিত্রকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়ে সমাজকে ব্যক্তির যান্ত্রিক এবং একেবারে কৃত্রিম সমষ্টি হিসাবে দেখেছিল, যারা কিছু আনুষ্ঠানিক বা গোপন চুক্তির নামে একত্রিত হয়ে নির্বাধে বা একটি উচ্চতর শক্তির প্রভাবের অধীনে পর্যবসিত হয়েছিল। অধিবিদ্যার পণ্ডিতদের মতে, সমাজে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পূর্বে ব্যক্তি একধরণের অমর আত্মার অধিকারী হয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতো। আমরা নিশ্চিত যে, মানব বুদ্ধির সকল সম্পদ, তার নৈতিক ও বৈষয়িক বিকাশ, এবং তার আপাত স্বাধীনতা সবকিছুই সমাজে তার জিন্দেগীর ফসল। সমাজের বাইরে সে মুক্ত মানুষ হওয়া দূরে থাক, সে এমনকি প্রকৃত মানুষই হতে পারবে না; অর্থাৎ যে সত্তা নিজের বিষয়ে সচেতন, একমাত্র সত্তা যে চিন্তা করতে পারে এবং কথা বলতে পারে। কেবল বুদ্ধিবৃত্তি ও সম্মিলিত শ্রমের সংমিশ্রণই মানুষকে তার আদি বর্বরতা ও বর্বর অবস্থা (যা তার আদি প্রকৃতি গঠন করেছিল অথবা তার বিকাশের সূচনাবিন্দু ছিল) থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল। আমরা আরও নিশ্চিত যে, মানুষের সমগ্র জীবন – অর্থাৎ, তাদের স্বার্থ, প্রবণতা, জরুরত, মোহ, এমনকি বোকামি, সহিংসতা, অবিচার এবং আপাত স্বেচ্ছাধীন কার্যকলাপ – কেবলমাত্র অনিবার্য সামাজিক শক্তির পরিণামকে তুলে ধরে। মানুষ যেমন পারস্পরিক স্বাধীনতার ধারণাটিকে খারিজ করতে পারে না, তেমনি বাহ্যিক প্রকৃতির প্রকাশকে তুলে ধরে এমন বিপরীতমুখী প্রভাব ও সমরূপতাকেও অস্বীকার করতে পারে না।
খোদ প্রকৃতির মাঝে এই বিস্ময়কর পারস্পরিক সম্পর্ক [কোরেলেশন] এবং আন্তঃনির্ভরতা নিশ্চিতভাবেই সংগ্রাম ছাড়া তৈরি হয়নি। বরঞ্চ প্রকৃতির শক্তিগুলোর মাঝে সামঞ্জস্যতা/সংগতি দেখা দেয় কেবল ক্রমাগত সংগ্রামের ফলেই। এটাই জীবন ও পরিবর্তনের প্রকৃত শর্ত। সমাজের মতো করেই প্রকৃতিতেও সংগ্রাম বিনা শৃঙ্খলা[অর্ডার] মানেই মৃত্যু।
মহাবিশ্বে যদি শৃঙ্খলা [অর্ডার] প্রাকৃতিক ও সম্ভাব্য হয়েই থাকে, তবে সেটা কেবল এই কারণে যে মহাবিশ্ব কোনো এক সুপ্রিম বা মহত্তম ইচ্ছা দ্বারা আরোপিত কিছু প্রাক-কল্পিত ব্যবস্থা অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে না। ঐশ্বরিক বিধানের ধর্মতাত্ত্বিক হাইপোথিসিস কেবল সকল শৃঙ্খলা/ব্যবস্থাকেই খারিজ করে দেয় না, বরঞ্চ খোদ প্রকৃতিকেই খারিজ করে দেয়। প্রাকৃতিক আইনই [ন্যাচারাল ল’] কেবল প্রকৃত কেবল এগুলো প্রকৃতিতে অন্তর্নিহিত, এবং এগুলো কোনো কর্তৃত্ব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। এই আইনগুলো আমরা যাকে ‘প্রকৃতি’ বলি তার সমরূপতার সহজ বহিঃপ্রকাশ, অথবা নিরবচ্ছিন্ন রূপান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও বিজ্ঞান এগুলোকে পর্যবেক্ষণ করেছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, একটা পদ্ধতিতে জড়ো করেছে এবং এগুলোকে আইন বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতি এমন কোনো আইন জানে না। প্রকৃতি অবচেতনভাবেই কাজ করে যাচ্ছে। সে তার মধ্যে অসীম ধরণের ঘটনা/প্রপঞ্চকে ধারণ করে, অনিবার্যভাবে পুনরাবৃত্তি করে। কাজের এই অনিবার্যতাই হচ্ছে মহাবিশ্বের শৃঙ্খলার টিকে থাকার কারণ।
এমন একটা শৃঙ্খলা/ব্যবস্থা [অর্ডার] মানব সমাজেও দৃশ্যমান। এটি একটি কথিত প্রকৃতি-বিরোধী উপায়ে বিকশিত হয়েছে বলে মনে হয়, কিন্তু এটা সহজাত/প্রাকৃতিক প্রাণির জরুরতের দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। তার চিন্তা করার সক্ষমতা তার বিকাশে একটি বিশেষ উপাদান সরবরাহ করেছে; এটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান এই অর্থে যে, মানুষ বিদ্যমান সবকিছুর মতোই প্রাকৃতিক শক্তির মিলন ও কর্মকাণ্ডের বস্তুগত উৎপাদনের প্রতিনিধিত্ব করে। এই বিশেষ উপাদান হচ্ছে যুক্তি [রিজন], মানে সাধারণীকরণ ও বিমূর্তকরণের সক্ষমতা। যার ফলে মানুষ অদ্ভুত বহিরাগত বস্তুসমূহকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণের মতো করে নিজেকেই নিজের চিন্তায় প্রজেক্ট করতে সক্ষম হয়। নিজেকে চিন্তায় নিজের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এবং তার চতুঃপার্শ্বের দুনিয়া থেকে নিজেকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সে পৌঁছে যায় নিখুঁত বিমূর্তন ও পরম শূন্যতা উপস্থাপনের দিকে। এবং এই পরম তার বিমূর্তকরণের সক্ষমতা ব্যতীত আর কিছুই নয়, যা বিদ্যমান সবকিছুকে তুচ্ছ করে এবং সবকিছুকে নাকচ করার মধ্য দিয়ে স্থির হয়। এটাই মনের সর্বোচ্চ বিমূর্তকরণের চূড়ান্ত সীমা। এই পরম শূন্যতাই ঈশ্বর।
এইটাই প্রতিটি ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদের অর্থ ও ঐতিহাসিক ভিত্তি। যেহেতু আগের মানুষজন ও তাদের সমাজ নিজস্ব চিন্তার প্রকৃতি ও বস্তুগত কারণ বুঝতে পারেনি, এমনকি তাদের এমন চিন্তার তলায় লুকিয়ে থাকা শর্তাবলী বা প্রাকৃতিক নিয়মও খুঁজে পান নি, ফলে তারা আন্দাজও করতে পারেন নি যে, তাদের পরম ধারণাগুলি কেবল বিমূর্ত ধারণা প্রণয়নের তাদের নিজস্ব ক্ষমতারই ফলাফল ছিল। ফলে প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত তাদের ধারণাগুলোকে তারা আসল বস্তু হিসাবে দেখেছিলেন, এর পরে খোদ প্রকৃতিই সফল হতে নিবৃত্ত করে। তারা তাদের কাহিনীকে, পরমের অসম্ভব ধারণাকে পূজা করা শুরু করে এবং শ্রদ্ধা দেখাতে শুরু করে। কিন্তু যেহেতু তারা শূন্যতার বা ঈশ্বরের বিমূর্ত ধারণাকে একটা দৃঢ় বা কনক্রিট আকার দেয়ার জরুরত অনুভব করলো, তখন ঐশ্বরিক [ডিভাইনিটি] ধারণা তৈয়ার করে নিলো। অধিকন্তু এগুলোকে শুভ ও অশুভ সকল গুণাবলী ও ক্ষমতা দিয়ে জড়িয়ে দিল। প্রকৃতি ও সমাজে তারা কেবল এই শুভ ও অশুভ-কেই খুঁজে পেল। এমনটাই ছিল সকল ধর্মের গোড়া ও ঐতিহাসিক বিকাশ, একেবারে প্রতিমাপূজা বা বস্তুপূজা থেকে একেবারে খ্রিস্টানধর্ম পর্যন্ত।
ধর্ম, ধর্মতাত্ত্বিক ও অধিবিদ্যার অর্থহীন/হাস্যকর ইতিহাস আলোচনা করার ইচ্ছা নেই। অথবা শত বছরের বর্বরতার ফলে সৃষ্ট সকল ঐশ্বরিক অবতার ও কল্পনার মিছিল নিয়েও আলোচনা করতে চাই না। আমরা জানি যে, কুসংস্কার বিপর্যয় ডেকে আনে, রক্ত ও অশ্রুর বন্যা বইয়ে দেয়। হতদরিদ্র মানবজাতির এই বিদ্রোহী বিকারগুলো ছিল সামাজিক সংগঠনের স্বাভাবিক বিকাশ ও বিবর্তনের ঐতিহাসিক ও অনিবার্য পর্যায়। এই বিকারগুলো একটি ভয়াবহ ধারণার জন্ম দিয়েছে: মহাবিশ্ব একটি অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা ও ইচ্ছা দ্বারা চালিত হচ্ছে। এই ধারণাই মানুষের কল্পনায় আধিপত্য বিস্তার করেছে। শতকের পর শতক পার হয়ে গিয়েছে, সমাজগুলো এই ধারণাতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে, এসবের ভেতর থেকে উত্থিত যে কোনো প্রগতি অর্জনের সক্ষমতা বা তাড়নাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল।
শুরুতে কিছু ব্যক্তির এবং পরবর্তীতে কিছু সামাজিক শ্রেণির ক্ষমতার অভিলাষ দাসত্ব ও দখলকে প্রধান নীতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, এবং ঐশ্বরিকতার এই ভয়াবহ ধারণাটি সমাজের অন্তরে রোপণ করে দিয়েছিল। ফলস্বরূপ, মূলে গির্জা ও রাষ্ট্র এই দুই প্রতিষ্ঠান ব্যতীত কোনো সমাজকে কার্যকর/সম্ভাব্য বলে দেখাই গেলো না। এই দুই সামাজিক দুর্দশাকে তাদের সকল সমর্থক মতবাদগুলো রক্ষা করে গিয়েছে।
পৃথিবীতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো আবির্ভূত হওয়া মাত্রই দুই শাসক শ্রেণি, অর্থাৎ পুরোহিত ও অভিজাতরা তাত্ক্ষণিকভাবে নিজেদের সংগঠিত করে ফেলে; এবং তারা গির্জা ও রাষ্ট্রের উপযোগিতা, অপরিহার্যতা এবং পবিত্রতার ধারণাগুলো দিয়ে বন্দি জনগণের মগজ ধোলাই করতে খুব বেশি নেয় নি।