অরাজ
শিল্পী: গণেশ পাইন
প্রচ্ছদ » প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার: পশ্চিমা তত্ত্বচিন্তার আলোচনা বা প্রাদেশিকীকরণই আর যথেষ্ট নয়; খোদ তত্ত্বেরই নতুন তত্ত্বায়ন জরুরি.…

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার: পশ্চিমা তত্ত্বচিন্তার আলোচনা বা প্রাদেশিকীকরণই আর যথেষ্ট নয়; খোদ তত্ত্বেরই নতুন তত্ত্বায়ন জরুরি.…

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লির সেন্টার ফর দ্যা স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ (CSDS)-এর একজন অধ্যাপক। রাজনৈতিকতার ইতিহাস তার অন্যতম প্রধান গবেষণার বিষয়বস্তু। অনেকেরই মনে থাকার কথা, এ বছরের গত জুন মাসে আমি CSDS-এর আরেকজন তাত্ত্বিক আদিত্য নিগামের এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকারটি অরাজে প্রকাশিত হয়েছিল (আদিত্য ২০২১) । আদিত্য নিগাম ও প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় একত্রে ‘doing theory’ নামক প্রকল্পে যুক্ত। বাংলায় আমরা একে বলছি ‘তত্ত্ব করা’ বা ‘তত্ত্ব নির্মাণ’। কেবলমাত্র পশ্চিমা তত্ত্বের চর্চা কিংবা ‘অপশ্চিমা’ সমাজে পশ্চিমের দার্শনিক ও তাত্ত্বিক ক্যাটাগরিসমূহকে সর্বজনীন ও যথাপ্রদত্ত ধরে নিয়ে তার নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা করা কিংবা পশ্চিমের ‘ক্রিটিক’ করাকেই প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার সহ–তাত্ত্বিকরা নিজেদের কাজ মনে করেন না। তারা মনে করেন বিভিন্ন চিন্তা ঐতিহ্যের মধ্যে গতায়াতের (thinking across the traditions) মাধ্যমে ‘অপশ্চিমা’ সমাজই হতে পারে doing theory তথা ‍‘তত্ত্ব করা’র ক্ষেত্র।

তত্ত্ব নাকি অনুশীলন, আগে তত্ত্ব পরে অনুশীলন, অনেক তত্ত্ব হয়েছে এবার অনুশীলনের পালা; এমন নানাবিধ যান্ত্রিকতাকে ছাপিয়ে ‘তত্ত্ব করা’ প্রকল্পে তারা তত্ত্বকে সমাজে এমনভাবে প্রোথিত করতে চান যেন তত্ত্বকে অনুশীলন থেকে কিংবা অনুশীলনকে তত্ত্ব থেকে আলাদা করে ভাবা অসম্ভব হয়ে ওঠে। তত্ত্ব নির্মাণের ভিন্ন তাত্ত্বিক পদ্ধতিই তারা প্রতিষ্ঠা করতে চান। এই সাক্ষাৎকারে প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।

দর্শন, রাজনীতি, রাজনৈতিকতা, তত্ত্ব, ইতিহাস, রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি বর্গ ও ধারণা প্রশ্নে আমাদের নানা প্রশ্নাতীত অবস্থানকে প্রশ্ন করা এবং নতুন ছকে তত্ত্বায়িত করার ক্ষেত্রে প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুনশিয়ানা মনোযোগী পাঠকের নজর এড়াবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

এছাড়াও উনিশ ও বিশ শতকের ভারতবর্ষে কীভাবে রাজনৈতিক কর্তাসত্তা, রাজনৈতিক কর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের মতো আধুনিক ধারণাসমূহের রূপায়ন ও বিস্তার হচ্ছিল তার তদন্ত করাও প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোযোগের ক্ষেত্র।

ভারতীয় বৌদ্ধিক পরম্পরায় Karma এবং শ্রমের আধুনিক ধারণাসমূহের গাঠনিক টানাপোড়েনে Action তথা কর্ম; স্পিরিচুয়ালিটি ও অর্থনীতির দ্বান্দ্বিকতায় সাম্য (equality); প্রাকঔপনিবেশিক ভারতীয় চিন্তাপরম্পরায় আত্মতা, জন ইত্যাদি ধারণায়নে প্রথমার পরীক্ষানিরীক্ষা অত্যন্ত গভীর। উল্লিখিত ক্ষেত্রসমূহে তার তত্ত্বায়ন পশ্চিমা সর্বজনীনতার দাবি, উত্তরঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক/ঐতিহাসিক পার্থক্য, এমনকি বিউপনিবেশায়নের ফ্রেমওয়ার্ককে ছাপিয়ে এক নতুন প্যারাডাইম হাজির করে।

মূলত প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘Doing theory’ বিষয়ক আলোচনা এবং পলিটিক্যাল ক্যাটাগরির নানা বুনিয়াদি দিক; ইতিহাস লিখন পদ্ধতির সাথে সময়ের রাজনীতির যোগাযোগ সংক্রান্ত বই দুটি পড়ে আমি অভিভূত হই এবং সিদ্ধান্ত নিই যে প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নেব। তিনি সানন্দে আমার প্রস্তাবে রাজি হওয়ায় আমি তার প্রতি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের সাথে বাংলাদেশের ক্রিটিক্যাল চিন্তাজগতকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সূত্রপাত হতে পারে এই সাক্ষাৎকার।

আমার চিন্তায় ও দৈনন্দিনতায় যারা অন্তস্থিত সুরের মতন বাজতে থাকেন, তাদেরকে এই সাক্ষাৎকার প্রকাশ উপলক্ষ্যে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই।

এমনকি নিজেনিজে খুলে যাও ঝিনুকের মতো,
ব্যর্থ হও, তবু বালি, ভিতরে প্রবিষ্ট বালিটুকু
ক্রমেক্রমে মুক্তা হয়ে গতির সার্থক কীর্তি হবে।
শয়নভঙ্গির মতো স্বাভাবিক, সহজ জীবন
পেতে হলে ঘ্রাণ নাও, হৃদয়ের অন্তর্গত ঘ্রাণ। [বিনয় মজুমদার]

সারোয়ার তুষার

মূল সাক্ষাৎকার:

সারোয়ার তুষার: আলোচনাটা শুরু করতে চাই আপনার এবং আপনার সহকর্মীদের ‘doing theory’ এবং ‘thinking across traditions’ প্রকল্প দিয়ে। ‘doing theory’-কে আমি বাংলায় পাঠ করছি, ‘তত্ত্ব নির্মাণ/উৎপাদন’ অর্থে (খুব সচেতনভাবেই ‘তত্ত্ব চর্চা’ বলছি না) এবং ‘thinking across the traditions’-কে পাঠ করছি বিভিন্ন চিন্তা ও দর্শন ঐতিহ্যের মধ্যে গতায়াত হিসেবে। আপনার এই প্রকল্প এমনকি উত্তরঔপনিবেশিক (Postcolonial) তত্ত্বচর্চাকে ছাপিয়ে নতুন কিছু বলতে চায় বলে আমার মনে হয়েছে। প্রথমত, উত্তরঔপনিবেশিক তত্ত্ব পশ্চিমা সর্বজনীনতা (universality)-কে কার্যকরভাবে সমালোচনা করলেও, মূলত পশ্চিমা সর্বজনীনতাকেই ‘norm’ তথা মান্যরূপ হিসেবে বিবেচনা করে এবং সেই মান্যরূপএর সীমা উন্মোচন করার মাধ্যমে পশ্চিমের ‘critique’ করে থাকে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমের যেসব তত্ত্ব আবার এই সর্বজনীনতাকে প্রশ্ন করে উত্তরঔপনিবেশিক তত্ত্ব তার সাথেই লিপ্ত হতে চায়। তৃতীয়ত, উত্তরঔপনিবেশিক তত্ত্ব মনে করে পশ্চিমা ধারণাই একমাত্র ‘আধুনিক’ ধারণা, কাজ হচ্ছে একে উপনিবেশোত্তর সমাজবাস্তবতায় ‘যথাযথ’ভাবে প্রয়োগ করা।

সুতরাং, আমি আপনার কাছে জানতে চাইব, উপনিবেশোত্তর সমাজের বাস্তবতায় ‘doing theory’ এবং ‘thinking across the traditions’-এর মাধ্যমে আপনারা আসলে অভিনব কী বলতে চাইছেন? সর্বজনীনতা, উত্তরঔপনিবেশিক সমালোচনা এবং উগ্র স্বদেশীয়ানাকে (ultra-nativism) একইসাথে ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আপনাদের কী কী বিষয় খেয়াল রাখতে হচ্ছে?

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়: একদম গোড়া থেকে শুরু করি। আমার তত্ত্ব ভাবনার তালিম হয়েছে প্রথমে মার্ক্সবাদ আর পরে উত্তরউপনিবেশবাদ পরম্পরায়। মার্ক্সবাদ পড়তে শুরু করি রাজনীতি করতে গিয়ে, আর উত্তরউপনিবেশবাদ ইতিহাস বিভাগের শ্রেণিকক্ষে! দুটোর মধ্যে টানাপোড়েনেই শিক্ষার্থী জীবন কাটল বলা যায়। মার্কসবাদ শেখায় দুনিয়ার মজদুর এক, গরিবের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ এক এবং সেই কারণেই রাজনৈতিক তত্ত্বও সারা পৃথিবীতে মূলত এক। আর উত্তরউপনিবেশবাদ শেখায় ইউরোপীয় তত্ত্বচিন্তার সীমা, আমাদের মনের উপর পশ্চিমা দর্শনের অনুচিত আধিপত্য আর প্রাচ্যের অস্বীকৃত ঐতিহাসিক বিশেষত্ব। এই টানাপোড়েন শুধু আমার একার নয়। বোধহয় এই অনুভব মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সব বাঙালিরই, যারা রাজনীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে। অবশ্য মানতে হয় যে এই দুটি অভিমুখিতা এক দিক থেকে সমভাবাপন্ন। মার্ক্সবাদ আর উত্তরউপনিবেশবাদ দুটিই সমালোচনামূলক বা critical পরম্পরা। দুটিই রাষ্ট্রবাদের সীমা আর সমস্যা দর্শায়। আবার দুটিই অভাজনের জন্য ন্যায়ের কামনা করে। তবুও এই দুটি অভিমুখিতাকে মৌলিকভাবে বিপরীতমনস্ক বলা চলে। প্রথমটি সর্বজনীনতায় বিশ্বাস করে, দ্বিতীয়টি সর্বজনীনতার সমালোচনা করে।

আমাদের Economic & Political Weekly’র লেখাটা (Banerjee, Nigam & Pandey 2016), যাতে আমরা ‘thinking across traditions’-এর কথা বলেছি, সেটার উদ্ভব শ্রেণিকক্ষে। এবার আমরা অধ্যাপক, আর ছাত্রছাত্রী হলেন আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যারা মূলধারার রাজনীতিকে খানিকটা সন্দেহের চোখে দেখে আর অন্য রাজনীতির কল্পনা করার চেষ্টা করে। তাই আমরা চাইনি যে আজকের শ্রেণিকক্ষে আমাদের ছাত্রাবস্থার সমস্যাগুলোর পুনরাবৃত্তি হোক। পড়াতে গিয়ে বুঝলাম যে আজকের দিনেও সেই একই টানাপোড়েন। তাত্ত্বিক সামগ্রী সেই পশ্চিম— সবার ক্ষেত্রে এখন আর তা মার্ক্সবাদ নয়; এখন ফুকো, আগামবেন, লাতুর অনেকসময় বেশি প্রভাবশালী। কিন্তু যে বাস্তব আমাদের ভাবনার বিষয় আর যে ক্ষেত্র আমাদের কাজের এলাকা সেটা পশ্চিম ইউরোপের বাস্তবের থেকে ভিন্ন। সে কারণে পশ্চিমা তত্ত্ব এই বাস্তবের উপর প্রয়োগ করার ব্যর্থ চেষ্টায় শিক্ষার্থীরা অসন্তুষ্ট। আমদের প্রধান বক্তব্য তাই এই— যে বাস্তব নিয়ে আমরা ভাবছি, আমাদের তত্ত্ব নির্মাণের প্রয়োজনীয় উপাদান সেই বাস্তব থেকেই নিতে হবে। এ ছাড়া বৌদ্ধিক আজাদি সম্ভব নয়।

শিল্পী: এস. এম. সুলতান

এ দিক থেকে আমাদের বক্তব্য উত্তরউপনিবেশবাদের বক্তব্যের থেকে খানিকটা আলাদা। আপনি ঠিকই বলেছেন, উত্তরউপনিবেশবাদ পশ্চিমা তত্ত্বচিন্তার সীমা দর্শায় বটে, কিন্তু এও বলে যে আধুনিককালে পশ্চিমা দর্শন ব্যতিরেকে উপায় নেই। আমাদের গত কয়েক শতাব্দীর ঔপনিবেশিক ইতিহাস আমাদের সকলকেই খানিকটা পশ্চিমা করে ফেলেছে। কথাটা কিছুটা সত্যি বটে। তবে এই অবস্থানের সঙ্গে আমাদের মূলত তিনটে মতভেদ রয়েছে। এক, আমরা মানছি না যে পশ্চিমা দর্শনের আধিপত্যের সামনে পৃথিবীর অন্য সমস্ত তত্ত্বপরম্পরা একেবারে মুছে গেছে, মরে কিংবা শুকিয়ে গেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, ভাষায়, অভ্যাসে, পরিবেশে এমন অনেক কিছু পাওয়া যায় যেগুলোর দীর্ঘ প্রাকঔপনিবেশিক ইতিহাস রয়েছে। একটা সাধারণ উদাহরণ নেয়া যাক— আমরা যাকে ধর্ম, দ্বিন, মজহব বা ভক্তি বলি তা কিন্তু religion-এর থেকে আলাদা। তাই ‘religion versus secularism’-এর গল্পটা এখানে ঠিক সরাসরি খাটে না। ধর্ম বা দ্বীনের ইতিহাস আর বর্তমানকে অন্যভাবে ভাবতে হয়। আবার যাকে আমরা নাস্তিকতা বলি তা কিন্তু একেবারেই atheism নয়। নাস্তিকতা ‘না’ বলার— নেতি নেতি বলার— একটা তাত্ত্বিক এবং তার্কিক পরম্পরা, যা আমাদের anti-foundationalist তত্ত্বচিন্তার দিকে নিয়ে যায়; নানান ভিত্তিবাদী পরম্পরাকে খণ্ডন করতে সাহায্য করে। ঠিক তেমনি আমরা যাকে রস বলে উপভোগ করি, তা aesthetics-এর থেকে অনেকটাই ভিন্ন।

দুই, আমরা মনে করি যে তত্ত্বচিন্তার কাজে শুধুমাত্র পশ্চিমকেন্দ্রিকতার সমালোচনা বা critique যথেষ্ট নয়। Critique-এর নেতিবাচক কাজটা প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। আসল মুশকিলের কাজ হলো নতুন আর ভিন্ন তত্ত্ব নির্মাণ করার ইতিবাচক প্রচেষ্টা। ব্যক্তিগতভাবে আমি এও ভাবি যে ‘pure critique’ আমাদের মানসিকভাবে কিছুটা রুঢ়, ক্লিষ্ট, বিদ্রুপী, এমনকি অসূয়ক করে তোলে। তত্ত্ব নির্মাণ কিন্তু শিল্পকর্মের মতো— আমাদের সৃষ্টিশীল আর উদ্দীপ্ত করে তোলে! তত্ত্ব নির্মাণ যদিও কঠিন, তাহলেও একটা আনন্দময় কাজ। আমরা এও বলি যে নানা পরম্পরার মধ্যে দিয়ে গতায়াতের দ্বারা আমরা শুধু আমাদের ঐতিহাসিক ভিন্নতা বা বিশেষত্ব প্রমাণ করতে উৎসুক নই। তাই ‘difference’— colonial difference, historical difference, cultural difference— আমাদের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু নয়। আমরা এমনভাবে তত্ত্ব নির্মাণ করতে চাই যা ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সাধারণীকরণের— universalisation না হলেও generalisation-এর— সম্ভাবনা রাখে। মানে আমরা চাই এমন নতুন তত্ত্ব নির্মাণ যা আমাদের কাজে তো লাগেই, পশ্চিমেরও কাজে লাগে। এই কাজটা একা করা যায় না। অনেকে মিলে একটা তাত্ত্বিক আন্দোলন তৈরি করতে হবে বলে আমরা ভাবি। তাই উত্তরউপনিবেশবাদের critique-সর্বস্বতার থেকে আমরা একটু দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করি।

তিন, আমাদের মতভেদ কালচিন্তা আর ইতিহাসচিন্তা নিয়েও। আমরা মানি না যে কালের গতি সরলরেখার মতো। পুরনো সব পেছনে ফেলে শুধু সামনের দিকে আমরা এগিয়ে চলি। এটা ঔপনিবেশিক প্রগতিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার মতে এটা এক ধরনের কুসংস্কার যেটাকে আজ আমরা ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিয়েছি। আমরা মানি যে কালের চলার পথ নানান গিঁট, পাক আর ব্যাবর্তে ভরা। অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নানা জটিল সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে। পদার্থবিজ্ঞানও কিন্তু আজ একথা মানে। নানা ইতিহাস, নানা পরম্পরা, নানা সম্ভাবনা অনেক সময় এককালীন, আবার অনেক সময় বহুকালীন হয়ে ওঠে। তাই যেকোনো এক মুহূর্তের ভেতর কাজ করে অনেক মুহূর্ত, অনেক স্মৃতি, অনেক সম্ভাবনা, অনেক প্রকল্প। সেই একই কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে ‘আধুনিকতাশব্দটিকে খুব বেশি ব্যবহার করি না। আজকাল অনেকে ‘অন্য’ আধুনিকতা, ‘বিভিন্ন’ আধুনিকতা, ‘ভারতীয়’ আধুনিকতা, ‘প্রাকঔপনিবেশিক’ আধুনিকতার কথা বলে থাকেন। মানে দাবি করেন যে আমরাও ততটা আধুনিক যতটা ইউরোপ বা আমেরিকা, যদিও আমাদের নিজেদের মতন করে। আমার মনে হয় এ আবার সেই ঔপনিবেশিক প্রগতিবাদের ফাঁদে পড়া। আধুনিক হওয়া যেন একটা নৈতিক উৎকর্ষ, সদ্গুণ, পুণ্য। আমার কাছে আধুনিকতা শুধুমাত্র একটা কাল নির্দেশক শব্দ— এর মানে নতুন বা সাম্প্রতিক, এর প্রতিশব্দ (counter-term/opposite হিসেবে ‘প্রতিশব্দ’এর ব্যবহার ব্যবহার ‘বিপরীত শব্দের’ সমার্থক) প্রাক্তন, সাবেক, পুরাতন। মনে রাখতে হবে যে প্রাকঔপনিবেশিককালে প্রাচ্যে আর প্রতীচ্যে ‘আধুনিক’ শব্দটির ব্যবহার ছিল। কিন্তু এই শব্দটি ব্যবহার হতো শুধুমাত্র কালভিত্তিক তুলনার কাজে— যেকোনো তর্কের বা বিতণ্ডার প্রসঙ্গে পূর্বপক্ষ আর উত্তরপক্ষ নির্দেশ করতে। এর ভেতরে কোনো প্রগতিবাদ বা উন্নয়নবাদ লুকিয়ে থাকত না। উত্তরপক্ষ বা আধুনিক মত ভুল প্রমাণ হতে পারত, আবার পূর্বপক্ষ বা পুরাতন মতও খণ্ডিত হতে পারত। আজ অবশ্য আধুনিক হওয়া মানেই প্রামাণ্য হওয়া। এ আমি মানি না। তাই আধুনিকতার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করতেও আমার বিশেষ কোনো ইচ্ছে নেই বললেই চলে। অবশ্য সবাই এ কথা মানবেন না। অনেকেই নিজেদের আধুনিক প্রমাণ করতে চান আজকের দিনেও! যেন আধুনিকতাই সব সমস্যার সমাধান।

অবশ্য আধুনিকতার আদর্শের উপর প্রশ্ন তুললেই একটা কঠিন সমস্যা এসে পড়ে। শিক্ষার্থীরা প্রায়ই এই প্রশ্ন করে থাকে আমাদের। আমরা কি একধরনের conservatism বা রক্ষণশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ছি? ভারতীয় বৌদ্ধিক পরম্পরার নামে কি আমরা কূপমণ্ডূকতার শিকার হয়ে পড়ছি? সারা পৃথিবীজুড়ে আজ যে nativism, nationalism, conservatism, xenophobia’র তাণ্ডব চলেছে, তার মোকাবিলায় আমাদের কি আধুনিকতা, সর্বজনীনতা আর বিশ্বজনীনতাকে আঁকড়ে রাখা উচিত নয়? আবার এও শুনে থাকি যে প্রাকঔপনিবেশিক পরম্পরাগুলোতো সবই ব্রাহ্মণ্যবাদী, হিন্দুবাদী, অভিজাত, সাধারণের নাগালের বাইরে, সাধারণের উপর আধিপত্য ফলানোর কৌশল। আজকের দিনে এসব পরম্পরার প্রাসঙ্গিকতাই বা কী, ঔচিত্যই বা কী?

তাই একটু জোর গলায় কটা কথা বলা দরকার। এক, কাছের বাস্তব থেকে তত্ত্বের উপাদান জোগাড় করা আর জাতীয়তাবাদী হওয়া কোনোমতেই এক নয়। মনে রাখতে হবে যে কাছের বাস্তব শুধু মাত্র দেশি বা সাম্প্রদায়িক বাস্তব নয়। সবাই মানবেন যে দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তব বহু পরম্পরার মিলনে তৈরি— যেখানে আরবি, ফার্সি, চিনি, দেশজ আর ইউরোপীয় নানা পরম্পরা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে আর দ্রবণে লিপ্ত। দুই, খুব কাছের বাস্তব— যেমন আজকের দিনে আমাদের অতিনিকট জলবায়ু সংকট— একই সঙ্গে প্রাদেশিক আর ভূমাণ্ডলিক, এমনকি মহাজাগতিক হয়ে উঠতে পারে। জাতীয়তাবাদ এ ক্ষেত্রে আমাদের দিশা দেখানোর কাজে পুরোপুরি ব্যর্থ। তিন, কাছের বাস্তব থেকে তত্ত্বের উপাদান নেওয়ার মানে কিন্তু দূরস্থ উপাদান বা তত্ত্বকে ভুলে যাওয়া নয়। তত্ত্ব নির্মাণের ক্ষেত্রে বাহ্যিক দৃষ্টিরও উপযোগিতা রয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র বাহ্যিক দৃষ্টি যথেষ্ট নয় কোনোমতেই। চার, আমি প্রায়ই বলে থাকি যে প্লেটো, অ্যারিস্টটল দাসব্যবস্থামূলক সমাজের লোক ছিলেন। কান্ট, হেগেলের racism নিয়ে বহু লেখা রয়েছে। এমনকি মার্ক্সও বলেছিলেন যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ভারতের উন্নতির পক্ষে উপযোগী। তাই বলে আমরা কি প্লেটো, অ্যারিস্টটল, কান্ট, হেগেল, মার্ক্স পড়া ছেড়ে দিয়েছি? একেবারেই নয়। আমাদের পাঠে এখন নতুন সচেতনতা এসেছে। দেশি পরম্পরাকেও সেভাবে তীব্র সচেতনতার সঙ্গে পড়তে হবে। আমরা গত একশ বছরে বড় ভুল করেছি দেশি পরম্পরাগুলোকে রক্ষণশীল মৌলবাদীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে। এই ভুলটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শোধরাতে হবে। আর পাঁচ, নিজস্ব তাত্ত্বিক উপাদান মানে শুধু অতীত পরম্পরা কেন, আমাদের বর্তমান এবং উদ্ভাবনশীল ভবিষ্যৎএর থেকেও উপাদান নিতে হবে। এখানে ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনা, সাহিত্য, শিল্পকলা আর ভাবীকথন শাস্ত্রের (predictive sciences) কাজও জুড়ে বসে।

সারোয়ার তুষার:The Work of Theory’ (Banerjee, Nigam & Pandey 2016) প্রবন্ধটা আমার কাছে নানাকারণে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধ মনে হয়েছে। তারমধ্যে আছে theory বনাম practice-এর জোড়বিপরীত ধারণা থেকে বের হয়ে theory as practice-এর ধারণা, contemporalization তথা সমসমায়িকীকরণ, de-contextualization (বিপরিপ্রেক্ষিতায়ন) re-contextualization (পুনঃপরিপ্রেক্ষিতায়ন) ইত্যাদি ধারণা। তত্ত্ব নাকি অনুশীলন, আগে তত্ত্ব পরে অনুশীলন, অনেক তত্ত্ব হয়েছে এবার অনুশীলনের পালা; এমন নানাবিধ যান্ত্রিকতাকে ছাপিয়ে আপনারা বলছেন The point is to change the way we do theory (Nigam 2020)। আপনারা তত্ত্বকে সমাজে এমনভাবে প্রোথিত করতে চান যেন তত্ত্বকে অনুশীলন থেকে কিংবা অনুশীলনকে তত্ত্ব থেকে আলাদা করে ভাবা অসম্ভব হয়ে ওঠে। তত্ত্ব নির্মাণের ভিন্ন পদ্ধতিই আপনারা প্রতিষ্ঠা করতে চান। এ সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন। সমসাময়িকীকরণ, বিপরিপ্রেক্ষিতায়ন, পুনঃপরিপ্রেক্ষিতায়ন এর চিন্তা কেন করলেন? আপনারা কি সর্বজনীনতার দাবিকে সুনির্দিষ্ট ইতিহাস ও পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করতে চান এবং পশ্চিম ভিন্ন বাদবাকি চিন্তাঐতিহ্যকে যে ‘অতীতের নিদর্শন’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়, সেইসব চিন্তাঐতিহ্যের পুনঃপরিপ্রেক্ষিতায়ন এবং সমসাময়িকীকরণ করতে চান?

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়: আপনি ভারি সুন্দরভাবে কথাটা ধরেছেন। এই যে theory/practice বা তত্ত্ব/অনুশীলনের তথাকথিত বৈপরীত্য, এটার কিন্তু একটা নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে। এটা ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন নিজেকে প্রাচীন গ্রিক তত্ত্বচিন্তার উত্তরাধিকারী বলে প্রচার করে থাকে। সেই তত্ত্বচিন্তার একটা মূল ধারণা হলো আদর্শ এবং বাস্তবের তফাৎ। এটা সবথেকে বেশি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে প্লেটোর চিন্তাভাবনায়— বিশেষত যাকে আমরা প্লেটোনিক ‘theory of forms’ বলে জানি তাতে। প্লেটো বলেছেন যে বাস্তবে দেখা সব কিছুই মুষ্টিমেয় অনাদি আদর্শের জৈবিক বা মূর্ত রূপ। বাস্তব যেন আদর্শের বিচ্যুত বা বিকৃত বা বিশেষীকৃত রূপ। তাই তত্ত্বচিন্তার কাজ হলো বাস্তবের মৌলিক রূপ বা essence-কে তুলে ধরা আর জ্ঞানের আয়নায় বাস্তবকে সংশোধন আর পরিশীলিত করা। ইউরোপীয় দর্শনে এবং রাজনীতিতে কালক্রমে এই ধারণাটির নানা প্রকারে পুনরুদ্ভাবন হয়েছে। আমাদের সময়ে আদর্শ আর বাস্তবের বৈপরীত্য ধরা পড়েছে আদর্শবাদ বনাম বাস্তববাদ (idealism/materialism) আর মূর্তি বনাম বিমূর্তির (abstract/concrete) দ্বন্দ্বে, যার সবথেকে জোরদার অভিব্যক্তি আমরা মার্ক্সবাদে পাই। মার্ক্সবাদ বাস্তববাদী হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু ভীষণভাবে বিজ্ঞানবাদী। মার্ক্সবাদ শুদ্ধ এবং সার্বভৌমিক বিজ্ঞানের আলোতে বাস্তবের ‘সঠিক’ মূল্যায়ন এবং সংশোধনে বিশ্বাসী। তাই বলা চলে যে তত্ত্ব আর অনুশীলনের বিচ্ছেদের মূলে রয়েছে এক ধরনের উপনিবেশবাদী মানসিকতা যেটা বাস্তবকে, বিশেষ করে ‘তৃতীয় দুনিয়া’র বাস্তবকে উপেক্ষা করে আর জ্ঞানের স্বয়ংক্রিয় প্রামাণ্যতার ভিত্তিতে জীবন আর যথার্থকে পাল্টে ফেলতে চায়— কখনো উন্নতির নামে, কখনো বিকাশের নামে, কখনো আধুনিকীকরণের নামে, আবার কখনো বিপ্লবের নামে। আমি মনে করি যে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা আর পরবর্তী রাষ্ট্রীয় বিকাশবাদ এই বহু পুরোনো theory/practice বৈপরীত্যের উপর ন্যস্ত।

এই বৈপরীত্যের ধারণাটি এমনভাবে আমাদের সামান্য বোধের মধ্যে ঢুকে পড়েছে যে আমরা ভুলেই গেছি তত্ত্বচিন্তাও এক ধরনের ক্রিয়া বা অনুশীলন। তাই আমরা ক্লাসে নানা তত্ত্ব পড়াই বটে, কিন্তু হাতেকলমে তত্ত্ব নির্মাণের কাজটা শেখাই না। তাই আমরা চেষ্টা করছি শিক্ষার্থীদের এটা দেখাতে যে কীভাবে নানা দেশে, নানা কালে, নানা চিন্তাবিদ ভিন্ন ভিন্নভাবে তত্ত্ব নির্মাণের কাজ করেছেন। এটা দেখাতে গিয়ে আমরা আরবি, ফারসি, চিনি, আফ্রিকি, লাতিনি, আর অবশ্যই আমাদের দেশীয় ভাষা পরম্পরার থেকে অনেক চিন্তাবিদদের কাজ শিক্ষার্থীদের সামনে পেশ করেছি। বলাই বাহুল্য অনুবাদের মাধ্যমে।

শ্রেণিকক্ষে এটাও আমরা বারবার বলে থাকি যে প্রাকআধুনিককালে— শুধু এদেশে নয়, পশ্চিমেও— নতুন তত্ত্ব নির্মাণের সঙ্গে নতুন ধরনের আত্মচেতনা আর আত্মঅনুশীলনের কাজ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকত। মানে জীবনশৈলী আর তত্ত্বশৈলী যে পরস্পরের উৎপাদক বা সৃজক— এই কথাটা অতি সাধারণ কথা ছিল সে সময়ে। তখন আমরা তত্ত্ব/অনুশীলনের বৈপরীত্যে এভাবে জড়িয়ে পড়িনি। এটা শুধু একটা নৈতিক ব্যাপার নয় কিন্তু। মানে কথাটা শুধু এই নয় যে আমি যা ভাবি বা বলি নিজের জীবনে আমার তাই করা উচিত। কথাটা আরও জটিল। অন্য ভাবনা ভাবতে গেলে নিজেকে— একক এবং সামূহিকভাবে— কিছুটা অন্য করে তুলতে হয়, পাল্টে ফেলতে হয়। তত্ত্ব পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যক্তিসত্তারও একটা ভাঙাগড়া চলে। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে, যে— কোনো একটা বিশেষ theory বিশেষ ধরনের ব্যক্তিগত, সামাজিক আর সাংস্থানিক practice-এর দাবি করে যেটা সেই theory’র প্রথম শর্ত বা ‘condition of possibility’। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে তত্ত্ব আর অনুশীলনকে আলাদা করে ভাবা যায় না।

আরও একটা কথা। Practice শব্দটির আর একটি জাত্যর্থ (connotation) হলো অভ্যাস, প্রথা, সংস্কৃতি, রেওয়াজ— মানে যাকে আমরা সাধারণ মানুষের সাধারণ দিনচর্যার ক্ষেত্র বলে জানি। এ সবের সঙ্গে theory’র সম্পর্কটা কী? অনেকে বেশ জোরগলায় বলেন যে প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো ক্ষেত্রে একজন দার্শনিক, তত্ত্বজ্ঞানী! ঠিকও বটে, আবার বেঠিকও। জীবনের সব রকম বাচনক্রিয়া বা কর্মক্রিয়াকে আগের থেকেই তত্ত্বজনিত বলে অনুমান করে নেওয়া মুশকিল। তবে নিঃসন্দেহে মানতে হয় যে ‘pure practice’ বলেও কিছু হয় না। এমনকি যে ক্রিয়া একেবারেই অভ্যাসজনিত, মানে যা করতে বেশিকিছু ভাবাভাবি করতে হয় না, সেই ক্রিয়ার ভেতরেও কিন্তু অনেক অতীত ভাবনা, চিন্তা, সংশয়, সিদ্ধান্ত, এমনকি ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা স্তরীভূত হয়ে থাকে, পলির মতো। তবে সেই ক্রিয়া কিন্তু নিজবলে তত্ত্ব নয়। তত্ত্ব নির্মাতার কাজ হলো সেই সমস্ত সাধারণ ক্রিয়াকর্মের ভেতর লুকিয়ে থাকা তাত্ত্বিক উপাদানগুলকে দৃশ্যমান করা; সেগুলো নিয়ে খেলা করা আর সম্ভবত নতুন তাত্ত্বিক সম্ভাবনার জানালা খুলে দেয়া। আমি বলতে চাইছি যে সব ‘practice in and by itself theory’ নয়। কিন্তু সব practice’র মধ্যে theory’র ছায়া বিদ্যমান। অর্থাৎ তত্ত্বের অনুশীলনের ইতিহাস খুঁজতে গেলে যেমন আমাদের দার্শনিক পরম্পরার দিকে যেতে হয়, ঠিক তেমনি আমাদের যেতে হয় ক্রিয়াকর্মের আর রীতিরেয়াজের ইতিহাসের দিকে। তত্ত্বের বাস সবখানে!

এবার আসি ‘সমসাময়িকীকরণ’এর ধারণায়। আমাদের আধুনিক ইতিহাসবোধ শেখায় যে নানা সমাজ শুধু নানা দেশের বা নানা সংস্কৃতিরই নয়, নানা সময়েরও বটে। এ ভারি অদ্ভুত কথা। আমার সঙ্গে আর একজনের দেখা হলো রাস্তায়। জিজ্ঞেস করলাম কোথা থেকে আসছেন, সেখানে কী ভাষা বলেন, কী গান শোনেন, কী কী খেতে ভালোবাসেন? উত্তর শুনে মনে মনে হিসাব করে নিলাম এই বিজাতীয় বন্ধুটি আমার থেকে কালক্রমে অগ্রসর না অনগ্রসর, আধুনিক না পুরাতন! মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভেবে নিলাম যে আমরা শুধু দুই দেশের নই, দুই আলাদা কালের বাসিন্দা! একই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একজন হয়ে গেল ভূত, যে বর্তমানের হয়েও বর্তমান নয়, উপস্থিত হয়েও অনুপস্থিত। সমসাময়িকীরণের অবধারণাটা এই প্রগতিবাদী কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে উঠার প্রচেষ্টা।

এর তিনটে দিক আছে। প্রথমত, আমাদের বুঝতে হবে যে যেকোনো একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে অনেকগুলো ইতিহাস একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে— কিছু অনেক পুরোনো, কিছু আপেক্ষিকভাবে নতুন, কিছু আবার তাৎক্ষণিক। যেমন আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার বয়স হয়তো দুই আড়াইশ বছর, আমাদের সাহিত্যের আর দর্শনের বয়স বহু শতাব্দী, আমাদের অন্তর্জাল মাধ্যমের বয়েস মাত্র দুই দশক, আমাদের শরীরের বয়স কিন্তু সহস্রাব্দেরও বেশি, আবার আমাদের পৃথিবীর বয়স তো আরও আরও অনেক বেশি। কিন্তু এই প্রত্যেক ইতিহাসই একে অপরের সমসাময়িক। কারণ আমাদের মধ্যে এই নানা ইতিহাস একই সঙ্গে কাজ করে চলেছে। এই সচেতনতাটা কিন্তু নতুন ধরনের ইতিহাস লেখনের আর তত্ত্বনির্মাণের দাবি করে। তার ভিত্তি অন্য ধরনের কালচিন্তা।

শিল্পী: সালভাদোর দালি

অন্য কথাটা আগেই বলেছি— আধুনিকরা ভাবেন যে অতীত একেবারেই ভূত, যাকে বলে absolute past। আমি বলি যে সমকালে নানা ধরনের অতীতের উপস্থিতি আমরা টের পাই, কিন্তু সবসময় ধরতে পারি না। Eelco Runia বলে এক ঐতিহাসিক একে presence of the past বলেন (Runia 2006)। আমি একে অতীতের সমসাময়িকতা বলি— কেননা প্রশ্নটা শুধু উপস্থিতিরই নয়, সমকালীনতারও বটে যেটার তাৎপর্য আমাদের বুঝতে হবে। তেমনি কিছুকিছু ভবিষ্যৎ আভাসের মতো আমাদের মনে ছায়া ফেলে। অর্থাৎ অতীত আর ভবিষ্যৎ দুটোই বর্তমানের ভেতরে কাজ করে চলেছে। সেটা আরেক ধরনের সমসাময়িকতা যেটা আমাদের ধরতে হবে— কেননা আকাট বর্তমান বলে কিছুই নেই। অর্থাৎ তাৎকালিকতারও (moment অর্থে) একটা কালিক বিস্তার (extension) আর কালিক গঠন (architecture) রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আর বিভিন্ন প্রসঙ্গে বর্তমানের কালিক বিস্তার আর গঠনকে নানাভাবে আন্দাজ করা হয়ে এসেছে। এই কালচিন্তার গল্পটাও আমাদের লেখতে হবে।

আর সমসাময়িকীকরণের তৃতীয় দিকটি হলো অতীত পরম্পরাকে নতুনভাবে পাঠ করা, নিজের সময় অনুসারে। ইতিহাস আমাদের বলে ‘যে সময়ের যা’— মানে অতীতে যা ভাবা বা বলা হয়েছে তার অর্থ সেই অতীতের পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে। নয়তো হবে কালবৈষম্যের মহাপাপ! এর পাল্টা তর্ক হলো যে কোনো অতীতকেই পুরোপুরিভাবে ধরা যায় না, কারণ অতীত তো অতীতই! তাই ইতিহাস অনিবার্যভাবেই বর্তমানের গল্প, অতীতটা নিমিত্ত মাত্র। আমি মনে করি এর মাঝামাঝি একটা অবস্থান রয়েছে— যেখানে দাঁড়িয়ে সচেতনভাবে অতীত পরম্পরার সঙ্গে বর্তমানের একটা সাক্ষাৎ বা encounter-কে ধরা যায়। অতীতের প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রেখে, অতীতকে সমকালীন করে তোলা, অতীতের চোখে বর্তমানকে দেখা আবার বর্তমানের চোখে অতীতকে— এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই অতীতের সাথে সাথে বর্তমানেরও নবীকরণ সম্ভব হয়ে ওঠে। অর্থাৎ সমসাময়িকীকরণের কাজটা সচেতনভাবে সম্পাদন করতে হয়। এটা কোনো স্বয়ংক্রিয় বা automatic অর্জন নয়। অতীতের আর ভবিষ্যতের নানা কল্পনাকে সম্ভব করে তুলে সাহিত্যও সমসাময়িকীকরণের কাজ করে। অতিকথা, সায়েন্স ফিকশান, utopian লেখন— এ সবই সমসাময়িকীকরণের বিভিন্ন প্রচেষ্টা।

সমসাময়িকীকরণের প্রসঙ্গেই de-contextualization (বিপরিপ্রেক্ষিতায়ন) re-contextualization (পুনঃপরিপ্রেক্ষিতায়ন)-এর কথাগুল এসে পড়ে। আমি বলি শুধু অতীত পরম্পরাকে বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে তোলাই আমাদের কাজ নয়। বর্তমানকেও অতীত আর ভবিষ্যতের আয়নায় নতুন করে দেখা— জানাকে অজানা করা আবার অজানাকে আপন করে নেওয়া— তত্ত্বনির্মাণের কাজে লাগে। ইতিহাসবিদ্যার যে কাল বিভাজন— প্রাচীন, মধ্য আর আধুনিক— তা এই কালচিন্তার পথের একটা বড় অন্তরায়। এই কালবিভাজন আমি অতিক্রম করতে চাই। আমি বলি যে আলাদা আলাদা বস্তুর আর বিষয়ের নিজস্ব কালগতি আর কালবিভাজন থাকে। সব কিছু একসঙ্গে প্রাচীন, একসঙ্গে আধুনিক হয় না। ফুটবলের ইতিহাসের কালবিভাজন সঙ্গীতের ইতিহাসের কালবিভাজনের থেকে যে আলাদা হবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

আর একটা কথাও বলতে হয় এখানে। পরিপ্রেক্ষিত আর প্রসঙ্গকে কিছুটা অতিক্রম না করলে, ইতিহাস থেকে তত্ত্বের দিকে যাওয়া হয়ে ওঠে না। আমরা তথ্য বিশ্লেষণে আটকে থাকি। সর্বাধিক, বিভিন্ন ইতিহাসের বিশেষত্ব আর ভিন্নতা প্রমাণ করে ক্ষান্ত হই। তাই আমি ভাবি যে পরিপ্রেক্ষিতকে মনে রেখেও প্রেক্ষাকে মুক্ত করা প্রয়োজন। না হলে context বা পরিপ্রেক্ষিত আমাদের কারাগার হয়ে ওঠে। তাই ভারত বা বাংলাদেশ বা তিব্বতের ইতিহাস শুধু মাত্র প্রাদেশিক ইতিহাসই হয়ে থেকে যায়। সে ইতিহাসের আর সে ইতিহাস থেকে উদ্ভূত তত্ত্বসামগ্রীর সাধারণীকরণ এবং বিশ্বায়ন হতে পারে না।

সারোয়ার তুষার: বাংলাদেশ ও ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলোতে দেখা যায় এমনকি অনেক প্রগতিশীল এবং [আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে] গণমুখী দলও জনবিচ্ছিন্ন থেকে যায়। এর কারণ কি এই যে, যেসব রাজনৈতিক পরিভাষা ও তত্ত্বায়ন নিয়ে এসব দল/সংগঠন কাজ করে, সেসব পরিভাষা ও তত্ত্বায়নকে সমাজের বহিঃস্থ কিংবা উপরিস্থ বলে ধরে নেয়া হয় এবং সমাজে ‘প্রয়োগ’ করতে চাওয়া হয়? নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, বর্গ (category) সম্বলিত গণমুখী রাজনীতি যদি সমাজে প্রোথিত (embedded) হয়, তাহলে কি এই সংকট কাটার কোনো সম্ভাবনা আছে? আবার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাসের উপর নির্ভর করে গোষ্ঠীজাতীয়তাবাদের (ethno-nationalism) ফাঁদে না পড়ার উপায় কী?

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়: এটাই আজকের দিনের রাজনীতির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। হ্যাঁ, আমি মানি যে লিবারেলিজম, ফ্যাসিজম, অ্যানার্কিজম, মার্ক্সিজম ইত্যাদি যে রাজনৈতিক আদর্শগুলর মাধ্যমে আমরা রাজনীতিকে বুঝতে চাই, সেগুলো সবই পশ্চিমজাত, পশ্চিমা দর্শনের মূর্ত আর ব্যবহারিক রূপ। উপনিবেশবাদের মাধ্যমে এগুলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই এই মতাদর্শগুলো নিয়ে আমাদের ভাবতেই হয়। কিন্তু শুধু এর ভিত্তিতে রাজনীতি করলে জনবিচ্ছিন্নতা অবশ্যম্ভাবী। দুটো উদাহরণ নিই। এক, ধর্ম। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা আর আধুনিকতার নামে, সাধারণ মানুষের জীবন, জরা, মৃত্যু, সুখ, অসুখ, দুঃখ, ভয়, হতাশা, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, ঘৃণা অসূয়া— এরকম নানা জৈবিক (existential), আত্মীয় আর অন্তরঙ্গ (intimate) প্রয়োজনগুলোকে উপেক্ষা করে এসেছি। বলেছি ভাতকাপড় আর ভোটের অধিকারের দিকে মন দিতে। তাই ধর্মটা চলে গেছে মৌলবাদীদের হাতে, আর আমরা হায় হায় করছি। দুই, জাতপাত। আমরা এই আশাতেই বহুদিন কাটিয়েছি যে শিক্ষা আর আধুনিকতার সাথে সাথে caste— বর্ণ আর জাতি— এক সময় class— বা অর্থনৈতিক শ্রেণিতে— বদলে যাবে আর রাজনীতি পৃথিবীব্যাপী শ্রেণিদ্বন্দ্বের চেহারা নেবে। এই ভ্রান্তির ফল হলো যে মার্ক্সবাদী রাজনীতি বেশিরভাগ জায়গাতেই পিছিয়ে পড়ল আর জাতপাত পরিচয়বাদী রাজনীতির চেহারা নিলো। তাই আমার তো উল্টোটাই মনে হয়। যদি আমরা ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, বর্গ, ইত্যাদির প্রশ্নগুলোকে identity’র কবল থেকে বার করে রাজনৈতিক তত্ত্বচিন্তা আর ভাষা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রোথিত করতে পারি তাহলেই আমাদের পরিত্রাণ। অনেকেই চেষ্টা করেছেন— গান্ধী, আম্বেদকার, ফুলে (Phule), ইকবাল, নজরুল, আবুল হাশিম, রবীন্দ্রনাথ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, যোগেন্দ্রানাথ মণ্ডল, আরও সব নামঅনামী ব্যক্তি। তবে রাষ্ট্রবাদের (Nationalism) জোয়ারে ভেসে এঁদের আমরা মনে রেখেও মনে রাখিনি।

সারোয়ার তুষার: বর্তমান সময়ের অনেক ইতিহাসবিদ, দার্শনিকই গ্রহীয় (planetary) পর্যায়ে ইতিহাস ও দর্শনচর্চার উপর জোর দেন। দীপেশ চক্রবর্তীকে তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ধরতে হয়। তিনি মনুষ্যকেন্দ্রিক গ্লোবাল যুগকে ছাপিয়ে বর্তমান যুগকে ‘planetary age’ (Chakrabarty 2018, 2021) বলছেন। প্ল্যানেটারি স্কেল বা দৃষ্টিকোণ থেকে তত্ত্বের বিউপনিবেশায়ন (decolonization)-এর সম্ভাবনা কতদূর? অর্থাৎ, বিভিন্ন চিন্তাঐতিহ্যের মধ্যে গতায়াত, সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তা যেমন অনস্বীকার্য; একইভাবে বিভিন্ন চিন্তাঐতিহ্যকে বর্তমানতার মধ্যে অবস্থিত করলেও এই ঝুঁকি থেকেই যায় যে, এই তত্ত্বানুশীলন মনুষ্যকেন্দ্রিকই থেকে যাবে। যে ধরনের ইতিহাস ও তত্ত্ব চর্চা এই গ্রহের উপর মানুষের সার্বভৌমত্ব/উপনিবেশ নাকচ করবে, প্রকৃতি/সংস্কৃতি মহাবিভাজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং মানুষকে সার্বিক জীববৈচিত্র‍্যের ইতিহাসের সাপেক্ষে স্থাপন করবে, এই মহামারি ও সার্বিক পরিবেশ বিপর্যয়ের বাস্তবতায় তেমন তত্ত্ব নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখেন কিনা?

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়: এই বিষয় নিয়ে আজ আমরা সবাই ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। দীপেশ চক্রবর্তী আর অমিতাভ ঘোষের (Ghosh 2016) বই তো বটেই, আরও নানাজনের লেখাপত্র পড়ছি। সব যে জেনে বুঝে নিয়েছি তা নয়। তবু কয়টা কথা মাথায় এসেছে, সেগুলোই বলি। এক, প্রাকআধুনিক আর প্রাকঔপনিবেশিক ইতিহাস আমাদের শেখায় যে পুরাতন কালে নানা জীবজন্তু কীটপক্ষী, দেবঅসুর, নদীপাহাড়, দৃশ্যঅদৃশ্য শক্তির সাথে মানুষ জড়িয়ে থাকত। অহিংসা আর অনৃশংসতা নিয়ে যে নানা ধরনের তাত্ত্বিক বিতর্ক আমরা পাই কাব্যে আর দর্শনে, সেগুলো আবার নতুন করে খুঁটিয়ে পড়া দরকার, কারণ তাতে মানুষের সঙ্গে অন্য জীব, জীবের উল্লেখ পাওয়া যায়। আমাদের বাংলায় খনার বচনের স্মৃতি এখনো বেঁচে রয়েছে, যাতে মানুষ দ্বারা প্রকৃতিকে বইয়ের মতো পাঠ করার একটা সক্ষমতার গল্প রয়েছে। লাতিনি ডিকলোনিয়াল লেখকেরা Chiapa দেশের আদিবাসীজনের কল্পনা আর চিন্তার জগতটাকে তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে ধনতান্ত্রিক আধুনিকতার বিকল্প হিসেবে। মানে, গ্রহীয় পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্রেও প্রাকআধুনিক পরম্পরার একটা বিশেষ জায়গা আছে। তাই আমার মনে হয় যে অতীত ইতিহাসকে নতুন প্রেক্ষিতে লেখার একটা প্রয়োজন আমাদের সামনে প্রকট হয়েছে। বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে আজ নদীর আর মশার, শীতলা আর দক্ষিণরায়ের গল্প এসে পড়ে। এটা আমাদের শিখতে হবে নতুন করে।

দুই, শুধু পুরোনো ইতিহাস নতুন করে লিখলে হবে না। এটাও মানতে হবে যে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ইতিহাস লিখতে গেলে কাল বিবেচনা আর দেশ বিবেচনা অন্যভাবে করতে হয়। রাষ্ট্র, সভ্যতা, ইতিহাস আর সংস্কৃতির— এমনকি প্রকৃতির, কারণ প্রকৃতির অবধারণাটা সভ্যতার অবধারণার উল্টাপিঠ মাত্র— দায়রার বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে। তবে এ প্রশ্নটাও তুলতে হবে যে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিউপনিবেশায়ন আদৌ সম্ভব কিনা। অনেক ঐতিহাসিক দেখিয়েছেন যে আধুনিক প্রযুক্তির নানা দিক— বিশেষ করে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র আর জীবশাস্ত্র, যাকে আমরা bacteriology, virology, biomedicine, forensics আর biometrics দায়রা বলে মানতে পারি— তার উদ্ভব উপনিবেশের প্রয়োগশালায়। মানে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিরও একটা ঔপনিবেশিক অতীত রয়েছে। এটা ভুললে চলবে না। আর সেই ঔপনিবেশিক ইতিহাসের প্রভাব আজকের অতিমারি আর পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও কীভাবে কাজ করছে তা তো আমরা দেখছিই। আমরা পশ্চিমা genetic data বা জৈবিক তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি ওষুধ আর টিকা ব্যবহার করছি, পশ্চিমা সামাজিক গঠনের ভিত্তিতে তৈরি তথ্যনির্ধারণ প্রণালী কাজে লাগাচ্ছি, আর তারই ভিত্তিতে ভাবীকথন বা prognosis করছি। এই ভ্রান্তির কথা ঐতিহাসিক Warwick Anderson খুব সুন্দর করে বলেন, তার দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার biomedical ইতিহাসের ভিত্তিতে। Warwick Anderson দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাশাস্ত্র আর জীববিজ্ঞানের বিউপনিবেশিকরণের কথা বলে চলেছেন। তার আলোচনাগুলো আমাদের মন দিয়ে খেয়াল করা উচিৎ। [ Anderso, W (2006), Anderson and Soto Laveaga (2020), Anderson and Lindee (2020)]

তিন, disciplines বা জ্ঞানের অনুশাসন নিয়ে আমাদের আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করতে হবে। অতিমারি আর পরিবেশ বিপর্যয় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো যে বিজ্ঞান আর মানবিকির উনিশশতকীয় বিচ্ছেদ আজ আমাদের বিষম অসহায় করে তুলেছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমাজ আর রাজনীতি নিয়ে একসাথে ভাবা অতি জরুরি আজকের দিনে। Yuk Hui (2016, 2020) বলে একজন প্রযুক্তিবিদ আছেন যিনি মহাজাগতিক বিভিন্নতা বা cosmic diversity’র কথা বলেন। ওনার বক্তব্য যে প্রযুক্তিশাস্ত্রকে আমরা decolonise তখনই করতে পারব যখন আমরা এটা স্বীকার করতে শিখব যে বিশেষ বিশেষ প্রযুক্তির পেছনে বিশেষ বিশেষ জৈবিক, মহাজাগতিক আর তাত্ত্বিক কল্পনা কাজ করে। সমাজশাস্ত্র আর মানবিকিশাস্ত্রের কাজ হলো বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির পেছনের সেই দার্শনিক আর মহাজাগতিক কল্পনাকে সামনে নিয়ে আসা আর এটা দেখানো যে প্রযুক্তি তখনই বিভিন্ন হতে পারে যখন তত্ত্ব আর cosmology’র বিভিন্নতা আমরা ধরতে পারব। এই কথাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। উনি একটা উদাহরণ দেন সেটা বলি। যেভাবে social media’র বিবর্তন হয়েছে গত কয়েক দশকে সেটা একটা ব্যক্তিবাদী সমাজবিন্যাসের ফল। Social media— তা Facebook হোক বা Twitter বা Snapchat বা Instagram— এটা ধরে নেয় যে আমরা একক ভাবে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি, সমষ্টিগতভাবে নয়। তাই social media’র তথাকথিত গ্রুপগুলোতেও আমাদের একজন একজন করে আলাদা আলাদাভাবে জুড়তে হয়। Social media sociability বা সামাজিকতাকে একটা বিশেষ ধাঁচে তৈরি করছে। এটা বেশ মজার ভাবার বিষয়, তাই না?

মানে, আমি বলতে চাইছি যে গ্রহীয় প্রেক্ষিত একক বা অনন্য প্রেক্ষিত নয়। এই প্রেক্ষিতের মধ্যে কিন্তু প্রেক্ষিতের বিভিন্নতার কথাটাও নিহিত রয়েছে— কারণ এই ক্ষেত্রে আমাদের মানুষ, জন্তু, বীজাণু আর জলবায়ুর প্রেক্ষিত বা perspective কল্পনা করে নিতে হয়। সেখানেই planetary’র ধারণাটা universal-এর ধারণাটার থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। আমি অনেক সময় planetary’র জায়গায় cosmic শব্দটা ব্যবহার করি। তাতে আরও বেশি বিভিন্নতার— জৈবিক, অজৈবিক, তান্ত্রিক, যান্ত্রিক, ভৌতিক, অভৌতিক, লৌকিক, অলৌকিক, দৃশ্যমান আর অদৃশ্য বিভিন্নতার— জায়গা পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয়। এখন আমরা আর শুধু ঐতিহাসিক আর সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার কথা ভাবছি না, প্রকৃতিগত বিভিন্নতার কথাও ভাবার চেষ্টা করছি। এই বিভিন্নতার সাথে অবশ্যই তত্ত্ব আর কল্পনার বিভিন্নতার কথা এসে পড়বে।

সারোয়ার তুষার: গতবছর প্রকাশিত হয় আপনার Elementary Aspects of the Political (Banerjee 2020) বইটি। এই বইয়ে আপনার একটি কেন্দ্রীয় অনুসন্ধান হচ্ছে political তথা রাজনৈতিক/রাজনৈতিকতা কী? Political বর্গের গাঠনিক রূপটাই বা কী? গত শতাব্দীর আশির দশকে নিম্নবর্গের অধ্যয়ন গ্রুপ নিম্নবর্গের বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামকে ‘রাজনৈতিক’ আখ্যা দিয়েছিল। এর ফলে আধিপত্যশীল জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিবাদ (nationalist culturalism), মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবাদ (Marxist economism) এবং উচ্চবর্গ ও মধ্যবিত্তের রাষ্ট্রবাদ (upper-caste and middle class statism) এর বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান নিতে হয়েছিল। কিন্তু আপনি বলছেন, এমনকি নিম্নবর্গের অধ্যয়নও ‘political’ ক্যাটাগরিটি খতিয়ে দেখেনি, তারা কেবল আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসবাদিতার (historicism) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। নানাবিধ দার্শনিক ও মতাদর্শিক ভিন্নতা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষই যেন ‘political’ বর্গের ব্যাপারে সুনিশ্চিত। আপনি আপনার বইতে যদিও political বর্গটির ব্যাপক ব্যবচ্ছেদ করেছেন, আমাদের এই সাক্ষাৎকারের পাঠকদের জন্য আপনার প্রশ্নটিই পুনরুক্তি করছি, political কী? নিম্নবর্গের সার্বিক অবস্থানগত কোন বিশেষত্ব একে political স্বীকৃতি দেয়?

ইলামেন্টারি এস্পেক্ট অফ দ্য পলিটিকেল বইয়ের প্রচ্ছদ

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়: আমার এই বইয়ের কাজটা শুরু হয় ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। বহুদিন বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। কমরেডদের সঙ্গে নানা আলাপআলোচনা, তর্কবিতর্ক চলল মার্ক্স, লেনিন, মাও নিয়ে; রাজনৈতিক মতাদর্শ (political ideology) আর কলাকৌশল (political strategy) নিয়ে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারলাম কই! অন্য দল জাত, ধর্ম, বা চটজলদি ‘পাইয়ে দেয়ার’ কৌশলে আমাদের হারিয়ে দিলো। আবার কখনো দ্বেষবিদ্বেষ, কখনো বা অন্ধভক্তির জোয়ারে আমাদের মতাদর্শ ভেসে গেল। আমরা সাধারণ মানুষকে নীতি আর যুক্তির পাঠ পড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টায় সময় অপচয় করলাম। ক্রমে বুঝলাম যে কমতিটা শুধু আমাদের মতাদর্শের নয়, আবার শুধু কৌশলেরও নয়, রাজনীতির সংজ্ঞারও।

তাই নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হলাম— রাজনীতি কাকে বলে? একেবারে গোড়ার কথায় ফিরতে চাইলাম। কাজটা কঠিন। ছোটবেলা থেকে আমি নিজেকে গভীরভাবে রাজনীতিমনস্ক বলে ভেবে এসেছি। মাথায় আসেইনি যে রাজনীতি কাকে বলে এ নিয়ে কোনো বিতর্কও হতে পারে। যা পড়ে এসেছি— তা মার্ক্সবাদ হোক বা নিম্নবর্গের ইতিহাস (Subaltern Studies) হোক বা উত্তরউপনিবেশবাদ হোক, তা শিখিয়েছে যে রাজনৈতিকতা নিজগুণে প্রতীয়মান, প্রশ্নাতীত, অবশ্যম্ভাবী, দেশকাল নির্বিশেষে এক ও সর্বজনীন। না জানলেও, না বুঝলেও, আমরা সবাই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব; আর সেই দিক থেকে দেখতে গেলে আমরা সবাই মূলত এক। এই বিশ্বাসটা পেছনে ছেড়ে আশা সহজ নয়। তাই ভাবতে ভাবতে বই হয়ে গেল।

বুঝলাম প্রথম থেকে শুরু করতে গেলে দুটো কাজ করতে হয়। এক, আমাদের দেশে আধুনিক রাজনীতির বিবর্তন নতুনভাবে বোঝা। তার জন্য রাজনৈতিক ইতিহাস (political history) নয়, রাজনৈতিকতার ইতিহাস (history of the political) অন্যভাবে লিখতে হয়। আর দুই, আধুনিক রাজনীতি চিন্তার যে মৌলিক তত্ত্ব আর আদর্শগুল আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি, সেগুলোর উপর প্রশ্ন তোলা। তাই বলা চলে যে এই বইটু দুটি স্তরে কাজ করে— একটি ঐতিহাসিক, অন্যটি তাত্ত্বিক।

তাহলে, রাজনীতির ইতিহাস, রাজনৈতিক তত্ত্ব নির্মাণের কাহিনি আর এ দুটির পারস্পারিক সম্পর্ক— এই নিয়ে বই। সাধারণত, রাজনীতি কাকে বলে তার দুটি বিরোধাভাসী ধারণা নিয়ে আমরা কাজ করে থাকি। এক, পার্টি, সরকার, ভোট, আন্দোলন, রাজা, প্রজা, নেতা বক্তৃতা, আইন পুলিশ— আমরা মনে করি যে এইসব নিয়ে রাজনীতি। দুই, আবার আমরা এও মনে করি যে সব কিছুর ভেতরেই রাজনীতি কাজ করে— তা একান্ত আপন প্রেম ভালোবাসা আত্মীয়তা কুটুম্বিতাই হোক বা ধর্মপূজঅর্চনা, সিনেমাথিয়েটারই হোক আর বাজার খেলার মাঠ বা পাড়ার চায়ের দোকানই হোক। প্রথম সংজ্ঞাটি অতি সঙ্কীর্ণ, দ্বিতীয়টি অতি বিস্তীর্ণ। আমি মনে করি যে আমাদের এই দুটি সংজ্ঞার মাঝামাঝি একটা অবস্থান খুঁজে নিতে হবে, যেখানে রাজনীতি রাষ্ট্র সংক্রান্ত ক্রিয়াকলাপের দায়রার বাইরে হলেও নির্দিষ্ট এবং বিশিষ্ট রূপে প্রতীয়মান। অর্থাৎ আমি মনে করি যে ‘everything is political’ বললে রাজনীতির আর কোনো অর্থ থাকে না, ফলপ্রসূতা থাকে না।

আমি তাই বলছি যে power বা ক্ষমতার অবধারণা (discourse, conceptualisation) আর political বা রাজনৈতিকতার অবধারণা এক নয়। ক্ষমতা সর্বব্যাপী। ফুকো দেখিয়েছেন যে একান্ত নিজি আর ব্যক্তিগত ক্ষেত্র এবং সম্পূর্ণ প্রকাশ্য আর লৌকিক ক্ষেত্র, এই দুই জায়গাতেই ক্ষমতা নানা রূপে ক্রিয়াশীল। কিন্তু উনি কখনোই ক্ষমতা আর রাজনীতির তত্ত্বদুটি গুলিয়ে ফেলেননি। আমি মনে করি যে বিশেষ বিশেষ সময়ে আর প্রসঙ্গে ক্ষমতার প্রতি আমাদের approach বা অভিমুখ রাজনৈতিকতার চেহারা নেয়, কিন্তু সর্বদা নয়। অন্য সময়ে এই অভিমুখ বাধ্যতা, বিশ্বাস, সতর্কতা, পলায়ন, অমনোযোগ, এমনকি বিস্মৃতিরও হয়ে উঠতে পারে। মানে রাজনৈতিকতাকে আমি একটি অনন্য আর বিশিষ্ট অভিমুখ হিসেবে দেখছি এখানে। তাই রাজনীতি কাকে বলে এই প্রশ্নের জায়গায় আমি একটু ঘুরিয়ে প্রশ্নটা করছি। আমি মানছি যে যেকোনো বিষয়— তা রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থ, শিল্প, যৌনতা বা খেলাধুলা যা কিছুই হোক না কেন— কোনো না কোনো সময়ে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে প্রকট হতে পারে। অর্থাৎ রাজনৈতিক বিষয় আর অরাজনৈতিক (non-political) বিষয় বলে দুটি ভিন্ন স্থায়ীভাব বা আলাদা বর্গ হয় না। কিন্তু যেকোনো বিষয়ের ঠিক কীভাবে রাজনীতিকরণ বা politicisation হচ্ছে, সেটা বোঝা প্রয়োজন। রাজনীতিকরণের প্রক্রিয়ার অধ্যয়নই আমাদের বুঝতে সাহায্য করে ‘রাজনৈতিকতা’ বস্তুটা আসলে কী? তাই বইটিতে আমি বোঝার চেষ্টা করছি কীভাবে উনিশবিশ শতকে ভারতবর্ষে ব্যক্তি, কর্ম, ভাব আর সমষ্টির রাজনীতিকরণ হয়েছে, কীভাবে সেই রাজনীতিকরণের ইতিহাসের অন্তর্নিহিত তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বগুলোর সমস্যায়ন হয়েছে আর কীভাবে সেসব দ্বন্দ্বের সমাধান বা সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা করা হয়েছে।

তর্কের প্রথম ধাপটা বিশ্লেষণমূলক। রাজনীতির ধারণাটাকে ভেঙে বোঝার চেষ্টা। সামান্য বোধে বা common sense-এ রাজনীতির চারটি মৌলিক উপাদান (element) আছে বলে আমরা ভাবি— রাজনৈতিক অভিমুখিতা বা স্বচেতনা (political subjectivity), রাজনৈতিক কর্ম বা ক্রিয়া (political action), রাজনৈতিক আদর্শ বা মতাদর্শ (political norm or ideology) আর রাজনৈতিক সমষ্টি (political community) যাকে আমরা জন বা গণ বা আওয়ামের (people) নাম দিয়ে থাকি। এই চারটি উপাদানের রাসায়নিক সংমিশ্রণে যেন রাজনীতি নামক বস্তুটির প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়। যাকে আমরা ‘রাজনীতি’ বলি তা যেন এই নানা উপাদানের মিশ্রণে তৈরি এক যৌগ পদার্থ (compound entity)। এই elements-এর ধারণাটা রসায়নশাস্ত্র থেকে ধার করে সমাজবিদরা কখনো কখনো সমাজসংস্কৃতির নানা দিককে ভেঙে বিশ্লেষণ করার কাজে লাগিয়েছেন। আমরা জানি যে রসায়নশাস্ত্রে মৌলিক উপাদান হলো এমন এক বস্তু যার আর কোনো বিভাজন বা বিশ্লেষণ (decomposition) হয় না, যা বাস্তবের সব থেকে সরল, মূল আর আদিম (primordial) রূপ। তাই এমিল ডুর্খেইম ধর্ম কাকে বলে সেটা বোঝাতে গিয়ে ‘Elementary Forms of Religion’; ক্লদ লেভি স্ত্রস নানা সমাজে জ্ঞাতিত্বের ভিন্ন ভিন্ন গঠন বোঝাতে গিয়ে ‘Elementary Structures of Kinship’; আর রণজিৎ গুহ কৃষক বিদ্রোহের নির্মাণ বোঝাতে গিয়ে ‘Elementary Aspects of Peasant Insurgency’র কথা বলেছেন। এঁরা সকলেই মনে করেন যে স্থানকালের বিভিন্নতা সত্ত্বেও যেকোনো সামাজিক ব্যাপার বা বস্তুর elements বা মৌলিক উপাদানগুলো একক, সাধারণ ও সর্বজনীন। আমি কিন্তু ঠিক উল্টো কথা বলছি। আমি বলছি যে যাকে আমরা রাজনীতির মৌলিক উপাদান বলে জানি, তারই গভীরে দ্বন্দ্ব আর বিরোধাভাস লুকিয়ে আছে। তাই এই উপাদানগুলোকে মৌলিক বা elementary বলা চলে না। এই উপাদানগুলোর আন্তরীণ সংঘর্ষণে আধুনিক রাজনীতি তাই সর্বদাই অস্থির, উদ্বায়ী, অমীমাংসিত, ধরতে গেলে ফসকে যায়।

উদাহরণ দিয়ে বলি। যাকে আমরা রাজনৈতিক স্বচেতনা বলি তার মধ্যে দুটো বিপরীত ঝোঁক কাজ করে— এক দিকে আত্মত্যাগের, অন্য দিকে স্বার্থান্বেষের। তাই রাজনৈতিক ব্যক্তি কখনো সন্ন্যাসী, ফকির বা শহিদের চেহারায় প্রকট হয়, আবার সেই একই ব্যক্তি কখনো চাণক্যরূপী হয়ে ওঠে। এক দিকে বলিদান, স্বার্থত্যাগ; অন্য দিকে ধূর্ততা, নিষ্ঠুরতা, নৈরাজ্যবাদএকদিকে নীতি, সমভাব আর আধ্যাত্মিকতা, অন্য দিকে খলতা, নাটকীয়তা, বিগ্রহকৌশল। গান্ধীর মধ্যে এই দুটো ঝোঁকই দেখতে পাওয়া যায়— এক দিকে মহাত্মা, অন্য দিকে চতুরচাণক্য। এই দুই অভিমুখিতা দুজন আলাদা ব্যক্তির বা চেতনার নয়; একই ব্যক্তির, একই চেতনার। দ্বন্দ্বটা সেখানেই। তাই প্রথম দুটি অধ্যায়ে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি কীভাবে আধুনিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আত্মত্যাগ আর কূটনীতির দুটো পরম্পরা একসাথে কাজ করে, যার ফলে political subjectivity’র অর্থকে কখনোই তাত্ত্বিকভাবে স্থির আর সিদ্ধ করা যায় না।

ঠিক তেমনি আমার পরের দুটি অধ্যায়ে দেখাচ্ছি কীভাবে রাজনৈতিক কর্মের ক্ষেত্রেও দুটি বিপরীত ঝোঁক কাজ করে। এক দিকে নিষ্কাম কর্মের ধারণা, যা ফলের আশা রাখে না, শুধু কাজ করার জন্য কাজ করে যায়। এখানে জোরটা কাজের প্রক্রিয়া, মাধ্যম, নিমিত্ত বা process এর উপর। অন্যদিকে শ্রম, যা উৎপাদন আর সৃজনের আদর্শে বিশ্বাসী, তাই ফলের কথা বলে। এখানে জোরটা পরিণাম, লক্ষ্য বা consequence-এর উপর। আধুনিককালে এই দুই বিরোধী ভাবাদর্শ অনুসারে রাজনৈতিক কর্মকে কল্পনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। যুদ্ধ, বিগ্রহ আর সংগ্রামের ধারণা আসে এই দুটি বিপরীত ঝোঁককে সমকক্ষ করার চেষ্টায়— যেখানে স্থির নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অবধারণা থাকলেও প্রক্রিয়ার অনিশ্চয়তা অনিবার্য। তাই ‘লড়াই’ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক কর্মের উপমা বা নকশা। গান্ধীআম্বেদকরের মধ্যে কর্মমাধ্যম আর কর্মলক্ষ্যের সমীকরণ, যাকে কার্যকারণ সম্বন্ধ বা means-end equation বলা হয়ে থাকে, তা নিয়ে যে বিতর্ক হয় তার কেন্দ্রেও রয়েছে সংগ্রাম আর লড়াইয়ের প্রশ্ন। এটাকে শুধুমাত্র হিংসা আর অহিংসার নৈতিক দ্বিধা বলে ধরে নিলে কিন্তু আমরা রাজনৈতিক ক্রিয়া কাকে বলে এই প্রশ্নটার জটিলতা পুরোপুরি ধরতে পারি না। আর এটাও আন্দাজ করতে পারি না যে আধুনিক রাজনীতির ঠিক কেন্দ্রে একটা অসমাধেয় দ্বন্দ্ব কাজ করে। তা হলো এই যে, যদি জীবনযাত্রা মানে অবিরাম কর্মক্রিয়া হয় তবে আমরা শুধু রাজনীতিকেই action বা activism বলি কেন? এ কথা বললে সাধারণ জীবনকে একধরনের নির্জীব নিষ্ক্রিয়তা (passivity) বলে ধরে নেওয়া হয় না কি? পশ্চিমা রাজনীতিশাস্ত্র রাজনীতিকে action বলে সংজ্ঞায়িত করার ফলে দৈনন্দিন জীবনের গতিশীলতাকে আমরা ঠিক চিনে উঠতে পারি না। ফলে event/everyday আর normal/exceptional-এর দ্বৈতবোধ সর্বদাই আধুনিক রাজনীতিশাস্ত্রে হানা দেয়।

আধুনিক রাজনৈতিক আদর্শের ধারণাটাও ঠিক তেমনি দ্বন্দ্বপ্রসূত। তাই এর পরের দুই অধ্যায়ে আমি দেখাচ্ছি কীভাবে আধুনিক রাজনীতির ক্ষেত্রে সাম্যের ধারণাটির বিবর্তন হয়েছে আধ্যাত্মিকতা আর অর্থনীতির আভিমুখ্যতার বা encounter এর মাধ্যমে— যেখানে একদিকে বেদান্ত, ইসলাম আর বৌদ্ধ ধর্ম এসে পড়েছে, অন্যদিকে এসেছে নির্ভেজাল অর্থনীতির যুক্তি, বাঙালি মার্ক্সবাদ। অথচ ধর্ম বা অর্থনীতি কোনোটাই নিজবলে যথেষ্ট হয়ে উঠতে পারছে না রাজনীতিকরণের কাজে। তাই রাজনীতির ক্ষেত্রে কার্যকর হতে গেলে আধ্যাত্মিক চিন্তাকে জীবন আর জীবিকার প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে; আর অর্থনীতিকে সমাজচিন্তা আর সাহিত্যভাবনার থেকে অন্তর্দৃষ্টি ধার নিতে হচ্ছে। অথচ ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা দুটিই দাবি করছে যে তারা রাজনীতির নয়, রাজনীতিকে অতিক্রম করে— রাজনীতির আগে ও পরে— মানুষের আদিম অস্তিত্ব আর প্রাণীত্বের কথা বলে থাকে। যদিও ধর্ম আর অর্থকে বিপরীতধর্মী বলে আমরা জানি, ধর্ম আর অর্থের দায়রার মধ্যে এখানে আমরা একটা সমাপতন বা overlap দেখছি। দুটোই একই সঙ্গে রাজনৈতিকতার সীমা দর্শাচ্ছে আবার রাজনীতির মূল ভিত্তি হয়ে উঠার দাবি করছে। রাজনীতির প্রকৃতিজ অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার প্রশমন করার চেষ্টা করছে।

ঠিক তেমনি দেখি রাজনৈতিক সমষ্টি বা people-এর কল্পনাটা দুটো বিপরীত অবস্থানের মধ্যে দোদুল্যমান। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে people-এর ধারণাটা তৈরি হচ্ছে সমষ্টির অন্যান্য কল্পনার বিরুদ্ধে। সে সময়কার বিকল্পগুল ছিল এক, সমাজ বা society; দুই, জন বা population; তিন, ভিড় বা crowd; চার, লোক বা folk আর পাঁচ, প্রজা বা subject— যেগুলর কোনোটাই ঠিক people-এর সূচক বা প্রতিরূপ হয়ে উঠতে পারছে না। কেন সে কথাটা বইয়ে বিশদ করা আছে। এখানে এটা বলাই যথেষ্ট যে তৎকালীন এই প্রাকদত্ত বর্গগুলো people-এর অপরিহার্য ঐক্যবদ্ধতার নির্দেশ দিতে অক্ষম হচ্ছে। তাই রাজনীতির ক্ষেত্রে এই বর্গগুলো অতিক্রম করে সামনে আসছে people-এর ধারণাটি, দুটি বিপরীত তত্ত্বায়নের আর প্রয়োগের মাধ্যমে। একদিকে পাচ্ছি political party বা রাজনৈতিক দলের একটা নতুন অবধারণা, আর অন্যদিকে পাচ্ছি জন বা গণ নামক একটা নান্দনিক বা aesthetic বর্গের উদ্ভাবন। একদিকে পার্টির শক্ত আর দৃঢ় বাঁধনের মধ্যে বেঁধে এক ঐকিক বা singular জনগণকে হাজির করার চেষ্টা। অন্যদিকে সাহিত্যকবিতানাটকের মাধ্যমে আগামীদিনের নতুন লোকএকতার কল্পনাকে সাকার করার চেষ্টা। একদিকে সংগঠন বা structure, আর এক দিকে স্বপ্ন বা fiction। একদিকে অনুশাসন, অন্যদিকে রস। এর থেকে বড় অসঙ্গতি আর কীইবা হতে পারে! বইয়ে এটাকেই আমি people-এর অসম্ভাব্যতা বলছি। মনে রাখতে হবে যে এখানে প্রশ্নটা কিন্তু ‘people কে?’ সেটা নয়। আমরা তো জানিই যে সময় বিশেষে people শ্রমিকজাতি বা কৃষক বা দলিত বা হিন্দু বা মুসলমান হতে পারে। প্রশ্নটা আসলে ‘people কী’ সেটার। প্রশ্নটা people-এর সংরচনা, পরিকাঠামো আর সারতত্ত্বের আর people-এর সাথে সমাজ, ভিড়, জন, দল, লোক আর প্রজার ভেদের।

শিল্পী: ফিলিপ ফোল্টজ্‌

তাহলে, রাজনীতির মূল উপাদানগুলো নানাভাবে দ্বন্দ্বগ্রস্ত, এটা আমরা বুঝলাম। তাহলে আধুনিক রাজনীতিতত্ত্বের বুনিয়াদটা কী, যে বুনিয়াদের জোরে পশ্চিমা রাজনীতি দর্শনের সারা বিশ্বে এত রমরমা? এই বুনিয়াদটা হলো রাজনৈতিক (political) আর অরাজনৈতিকএর আনুশাসনিক বিভেদ। এখানে জ্ঞানের রাজনীতির কথাটা এসে পড়ছে। আধুনিক সমাজশাস্ত্র আর মানবিকির ইতিহাস দেখলে এটা আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে প্রত্যেকটি আধুনিক অনুশাসনের কেন্দ্রে এই political/non-political-এর তাত্ত্বিক বিভাজনটা কাজ করে। যেমন, রাজনীতিশাস্ত্র বা political science দাঁড়িয়ে আছে ধর্ম আর রাষ্ট্রের বিভেদের উপর— তাই দুইশ বছর পুরানা secularism-এর বিতর্কটা আজও চলছে। Economics বা অর্থশাস্ত্রের গোড়ায় রয়েছে বাজার আর রাষ্ট্রের বিভাজন। নৃতত্ত্ব আর সমাজতত্ত্বের, অর্থাৎ anthropology আর sociology’র কেন্দ্রে কাজ করছে রাজনীতি আর সংস্কৃতির দ্বৈতভাব— রাজনৈতিক ঘটনা (Event) আর রাজনৈতিক কর্মের (Action) সঙ্গে জীবনপ্রবাহ, আদতঅভ্যাস, দৈনন্দিনতার বৈপরীত্য। যেন রাজনৈতিক বস্তু বা বিষয় নিজবলে নিজগুণে ‘রাজনৈতিক’ বলে সিদ্ধ হয় না, তথাকথিত অরাজনৈতিক বিষয় বা বস্তুর আয়নায় ধরা পড়ে। তাই বইটাতে রাজনীতি কাকে বলে এই প্রশ্নটির সাথে বারবার এসে পড়ছে সমাজ কাকে বলে, শিল্প কাকে বলে, সংস্কৃতি কাকে বলে, দর্শন কাকে বলে, অর্থনীতি কাকে বলে, এইসব প্রশ্নগুলোও। মানে রাজনীতির প্রত্যয়ের সঙ্গে সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প, অর্থ, দর্শন আর অর্থের প্রত্যয়েরও বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে।

আধুনিককালে আমরা মেনে বসেছি যে ‘রাজনৈতিকতা’ এক সর্বব্যাপী, সর্বজনীন, সমভাবী অভিযোজন। কিন্তু ‘রাজনৈতিক’ হওয়ার অর্থ কী? না; স্রেফ সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শন, ধর্ম, বা অর্থমনস্ক হওয়া না। অথচ একই সঙ্গে আমরা এও বলি যে সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শন, ধর্ম আর অর্থ অনিবার্যভাবে রাজনৈতিক যুক্তিসাপেক্ষ। কাজেই যা রাজনৈতিক নয় তাও রাজনৈতিক বটে। এ ধরনের ভাবনা কি অনুলাপ বা tautology’র দোষে দোষী নয়? আমার বক্তব্য যে আধুনিক রাজনীতিভাবনার এই ধাঁচটা আমাদের আসলে রাজনীতি নিয়ে ভাবতেই দেয় না। রাজনীতির ধারণাটা একটা স্বতঃসিদ্ধ আর প্রাথমিক সত্যের চেহারা নেয়, যা ঈশ্বরের মতো প্রশ্নাতীত। এতে আমরা রাজনীতিতেই কমজোর হয়ে পড়ি। কারণ আমরা রাজনীতির নির্দিষ্টকরণ করতে ভয় পাই। তাই আমি জিজ্ঞেস করছি— আমাদের জীবনে আর ভাবনায় কি রাজনীতি ছাড়া কিছু থাকতে পারে, যা রাজনীতিকে মেনে নিয়েও রাজনীতির অতিক্রমণ করে, যাকে আমরা extra-political-এর নাম দিতে পারি? যখন জীবনের শেষে আম্বেদকার শূন্যতত্ত্বের কথা বলেন বা যখন নজরুল বিদ্রোহের রাজনীতিকে পাগলামির সীমার পারে খোঁজেন, ইকবাল কবির খুদ’ইকে আল্লাহর সমকক্ষ করে তোলেন, রবীন্দ্রনাথ কালের সীমা আর অসীমের খোঁজ করেন, বা গান্ধী নিজের যৌনতার সঙ্গে আজীবন লড়াই চালান— তা কি শুধুমাত্র রাজনীতির নাগালে ধরা যায়? নাকি অন্য কোনো অন্বেষণ এখানে কাজ করছে যা রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকলেও রাজনীতির থেকে কিছুটা ভিন্ন? এই অন্বেষণগুলোর সম্পূর্ণ রাজনীতিকরণ কখনোই হয় না, অথচ এগুলো রাজনীতির কাজকে পরিসীমিত আর নির্দিষ্ট করে, আবার একই সঙ্গে রাজনীতির নবায়ন আর পুনরুজ্জীবন সম্ভব করে তোলে। তাই বইটাতে আমি বলছি যে রাজনীতি কাকে বলে সেটা বুঝতে গেলে, political-এর সঙ্গে non-political আর extra-political-কে নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। এ দিক থেকে আমি দীপেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে একমত— পরিবেশ সংকটের প্রসঙ্গে ভূমণ্ডল আর মহাজগত নিয়ে ভাবতে হলে, তা শুধুমাত্র বর্তমান রাজনীতিতত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে ভাবলে চলবে না। কারণ জলবায়ু, ভাইরাস, জীব, কীটাণু, যন্ত্র আর প্রযুক্তির নানান রাজনৈতিক মাত্রা থাকলেও সেগুলোকে কিন্তু সর্বাঙ্গরূপে রাজনৈতিক পাত্র হিসেবে দেখা যায় না। তাই রাজনীতির বাইরেও আমাদের ভাবতে হবে। তবেই রাজনীতিতত্ত্বের নবীনিকরণ আমরা করতে পারব।

সারোয়ার তুষার: দর্শন এবং মতাদর্শকে (ideology) রাজনীতির মূল নির্যাস ভাবার বহু প্রচলিত রেওয়াজ আছে। আপনি Elementary Aspects of the Political বইতে দর্শন ও ইতিহাসের সম্পর্ক এবং রাজনীতিতে এর প্রয়োগ সংক্রান্ত ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন। দর্শনকে রাজনীতির ‘স্বাভাবিক ভিত্তি’ ভাবার বিরুদ্ধে আপনার অবস্থান (আপনার ভাষায়: I wish to displace philosophy itself from being the natural ground of the political)। রাজনীতিতে দর্শনের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই বা থাকতে পারে না এমন কোনো দাবি অবশ্য আপনি করছেন না। আপনার মতে, পশ্চিমা রাজনৈতিক দর্শন নিজেকে তার নিজস্ব ঐতিহাসিকতা থেকে মুক্ত করে দুইভাবে। প্রথমত, ফরাসি বিপ্লব বা শিল্প বিপ্লবের মতো স্থানীয় ঘটনার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে; দ্বিতীয়ত, এসব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে সর্বজনীন দার্শনিক আদর্শ হিসেবে হাজির করে। স্বাধীনতা, সাম্য, পুঁজি, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদের মতো দার্শনিক ও মতাদর্শিক বর্গের মধ্যে নিহিত ঐতিহাসিকতা মুছে দেয়ার মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়। এর ফলে ইতিহাসের উপরই কেবল দর্শনের আধিপত্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় না, এমনকি এক ইতিহাসের উপর অন্য ইতিহাসের কর্তৃত্বক্রম (hierarchy) প্রতিষ্ঠিত হয়। এক ইতিহাস (অর্থাৎ পশ্চিমের ইতিহাস) নিজেকে দার্শনিক ও আদর্শিকভাবে (normatively) প্রধান/অনুসরণীয় দাবি করতে পারে, কিন্তু অন্য ইতিহাসের (এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ইতিহাস) এমন দাবির কোনো সুযোগ থাকে না।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই দর্শন ও মতাদর্শ হয়ে ওঠে রাজনীতির ভিত্তিভূমি। আপনি এই কর্তৃত্বক্রমকে চিহ্নিত করেছেন। এর পটভূমি বিস্তারিত জানতে চাই। কোন উপলব্ধি থেকে আপনি কেবল সাংস্কৃতিক পার্থক্য (cultural difference), কিংবা ইউরোপের প্রাদেশিকিকরণে (provinicializing) কিংবা পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসবাদিতার সমালোচনার মাধ্যমে আপনার অবস্থানগত হিস্যা (stake) নিশ্চিতকরণে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে খোদ দর্শনকে এর আধিপত্যশীল অবস্থান (hegemonic location) থেকে অপসারণ করতে চেয়েছেন? কোনো সুনির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের সাপেক্ষে ‘what is political?’ এই প্রশ্ন না তুলে কেন এমন এক মিলনবিন্দু/মোহনা (crossroad) আপনি বেছে নিলেন, যা কিনা বিভিন্ন দর্শন ও ইতিহাস আদানপ্রদানের মিলনক্ষেত্র? দক্ষিণ গোলার্ধ (global south)-কে আপনি ‘non-place’-ই বা বলছেন কেন?

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়: আপনি ঠিকই ধরেছেন। আধুনিককালে পশ্চিমা তত্ত্বচিন্তার প্রভাবে আমরা মেনে নিয়েছি যে রাজনীতি (politics) আর রাজনীতিদর্শনের (political philosophy) মধ্যে একটা জৈব বা প্রাকৃতিক সম্বন্ধ রয়েছে। তাই রাজনীতির কথা ভাবলেই মার্ক্স, হেগেল, কান্ট, ফুকো, রঁসিয়ের নাম এসে পড়ে। অথবা লিবারেলিজম, মার্ক্সবাদ, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি ভাবাদর্শের কথা এসে পড়ে; যেগুলো পশ্চিমা ইতিহাসজাত তত্ত্বের উপর নির্ভর অভিব্যক্তি বিশেষ। এই পশ্চিমা চশমা চোখে পরে আমরা আমাদের নিজস্ব রাজনীতি পরম্পরাকে অনেক সময় ভুল বুঝি। তবে পশ্চিমা দর্শনের জায়গায় শুধুমাত্র প্রাচ্য দর্শনকে নিয়ে এলেই সমস্যা কিন্তু সমাধান হয় না। কাজেই মার্ক্স, হেগেল, কান্টের জায়গায় গান্ধী, আম্বেদকার বা নেহরু পড়লেই কাজ খতম, এটা ভাবা কিন্তু একেবারেই ভুল। গান্ধী, আম্বেদকার তো পড়তে হবেই। কিন্তু তার সাথে সাথে আমাদের দর্শন— আর মতাদর্শসর্বস্ব চিন্তাশৈলীকেও পাল্টাতে হবে। ঔপনিবেশিক ও আধুনিককালে রাজনীতিচিন্তার ক্ষেত্রে দর্শনের যে আধিপত্য স্থাপন হয়েছে সেটার উপর প্রশ্ন তুলতে হবে।

পশ্চিমা রাজনীতিদর্শনের আধিপত্যের ঐতিহাসিক উৎস তিনটি। প্রথম উৎস philosopher-king-এর প্রাচীন গ্রিক আদর্শ। দ্বিতীয় উৎস হলো ঔপনিবেশিক শাসন— যা তথাকথিত অনগ্রসর সমাজের উপর পশ্চিমা দর্শনজাত নীতি আর তত্ত্ব চাপিয়ে দেয়, যা স্থানীয় সমাজ বা প্রথার মধ্যে থেকে জৈবিকভাবে গড়ে ওঠেনি। আর তৃতীয় উৎস হলো সাম্প্রতিক শাসনব্যবস্থা, যাকে অনেকে বিশেষজ্ঞ বর্গের শাসন বা rule of experts (Mitchell 2002) নাম দিয়েছেন।

দর্শনের (philosophy) সার্বভৌমিক আধিপত্য একটি বড় সঙ্কট খাড়া করে। তত্ত্ব আর অনুশীলনের মধ্যে বিচ্ছেদ তৈরি করে। ফলে আমরা বারবার বাস্তবের সঙ্গে ভাবের, তত্ত্বের সঙ্গে প্রয়োগের অমিলের প্রশ্নে বাঁধা পড়ি। এই সনাতন সঙ্কট থেকে বেরুতে হলে দর্শনের আয়নায় বাস্তবকে চিনতে চেষ্টা না করে আমাদের সাধারণ জীবনে নিহিত তাত্ত্বিক সম্ভাবনাগুলো চিনতে শিখতে হবে। এ কথা আমি আগে বিশদভাবে বলেছি প্রথম প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে। তবে আমি কোনো আকাট বাস্তববাদী চিন্তাশৈলীর কথা বলছি না এখানে। রাজনীতির ক্ষেত্রে ভাবের আর কল্পনার খুব বড় ভূমিকা রয়েছে। তাই সেসব ভাব আর কল্পনার কীভাবে রাজনীতিকরণ হচ্ছে সেটা আমাদের বোঝা দরকার। কল্পনা আর ভাবের ভূমিকা আর দর্শনের ভূমিকা— এ দুটি কিন্তু আলাদা প্রশ্ন। যাকে আমরা philosophy বলি— যার সঠিক অনুবাদ কিন্তু দর্শন নয় — সেটি চিন্তার একটি বিশেষ শৈলী আর চিন্তার সঙ্গে জীবনের সম্পর্ককে বোঝার একটি বিশেষ পরিকল্পনা। আমি এখানে political philosophy’র আধিপত্যের সমালোচনা আর বিনির্মাণ করছি। বলছি যে philosophy আর রাজনীতিতে philosophy’র ভূমিকাকে পূর্বদত্ত বা pre-given বলে মেনে নেওয়া চলবে না। কিছু কিছু সময়ে দর্শনচিন্তা রাজনীতির কেন্দ্রে এসে পড়ে, আবার অন্য সময়ে দর্শনচিন্তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তাই রাজনীতিতত্ত্ব আর রাজনীতিক্রিয়ার সম্বন্ধটা প্রসঙ্গ আর সময় অনুসারে পাল্টায়। Political philosophy’র কোনো একচেটিয়া অধিকার নেই রাজনীতিকে বোঝার ব্যপারে; ঠিক যেমন কোনো বিশেষ শ্রেণি, বর্গ বা জাতির বিশেষাধিকার নেই, তা সে শ্রমিক শ্রেণিই হোক বা শিক্ষিত বর্গ বা ব্রাহ্মণ জাতিই হোক।

এই প্রসঙ্গে আর একটা কথাও এসে পড়ে। আমি মনে করি যে পশ্চিমা দর্শনের আলোচনা আর প্রাদেশিকীকরণের পরও আর একটা কাজ রয়ে যায়। তা হলো দর্শনের সংজ্ঞার পুনর্চিন্তন। যাকে আমরা ‘theory’ বলে জানি তার একটা বিশেষ ব্যুৎপত্তি আর ব্যাকরণ আছে। Theoria শব্দটি গ্রিক ভাষাজাত— যার মানে contemplation বা মনন, যার সাথে মন দিয়ে আর দূর থেকে দেখার একটা সম্বন্ধ আছে। Peter Sloterdjik (2012) খুব সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন কীভাবে এই দৃষ্টিনিরপেক্ষ, অনুভূতিহীন, নিষ্ক্রিয় আর অচেষ্ট বলে কল্পনা করা হয়েছে। উনি বলেন ‘theoria’ মননকারিকে যেন প্রায় মৃত আর জড় করে তোলে, মননে তন্নিষ্ঠতার নামে! এই অভিমুখিতার আধুনিকীকরণ হয় ইউরোপীয় দর্শনে, বিশেষ করে phenomenology’র দ্বারা। মনে রাখতে হবে যে ইউরোপীয় দর্শন পরম্পরার কেন্দ্রে কাজ করে mind/body, subject/object আর idea/reality’র দ্বৈতভাব। সব পরম্পরায় কিন্তু তা নয়। যেমন সাংখ্যদর্শনে মানস আর বুদ্ধি প্রকৃতির অন্তর্গত, অর্থাৎ যাকে আমরা mind বলি তা কিন্তু এখানে বস্তুগততা বা materiality আর শারীরিকীকরণ বা embodiment-এর প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। কাজেই এখানে philosophy বা theory অপরিহার্যভাবে বাস্তব বা ব্যবহারিক জীবনের বিপরীত নয়।

এদিকে আঠারো শতকে ইউরোপে বিতর্ক চলে যে ভারতীয় বা চিনি দর্শনকে philosophy বা theory বলা যায় কিনা এই নিয়ে। উপনিবেশবাদের হাত ধরে নানা দেশের তত্ত্বপরম্পরা তখন সবে ইউরোপে পৌঁছেছেসিদ্ধান্ত হলো যে যেহেতু ভারতে দর্শনচিন্তা অধ্যাত্ম আর অস্তিত্ব সম্বন্ধীয় প্রশ্নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেহেতু এগুলোকে ঠিক theory বলা চলে না, এগুলোকে ধর্মচিন্তা আর কর্মচিন্তার অঙ্গ বলাই সমীচীন। ফলে নানা ভারতীয় চিন্তাবিদ লেগে পড়লেন এটা প্রমাণ করতে যে ভারতের প্রাকআধুনিক দর্শন পরম্পরাগুলো pure theory, নির্ভেজাল মনন যার সঙ্গে কর্মক্রিয়া বা আত্মানুশীলনের কোনো যোগ নেই। অন্যদিকে দর্শন কাকে বলে এই প্রশ্নটাই চাপা পড়ে গেল। Theory’র নামে আমরা ক্রমশ পশ্চিমা তত্ত্ব পরম্পরাই বুঝতে লাগলাম।

এদেশে কিন্তু প্রাকআধুনিককালে তত্ত্বচিন্তার নানান নাম ছিল— মত, দর্শন আর আগম, যেগুলোর মানে হলো opinion, perspective আর পথ। শব্দগুলো থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে দর্শন theory’র মতো কোনো meta-category বা অধিবর্গ নয়। দর্শন বিভিন্ন, ভিন্ন ভিন্ন প্রথা আর অবস্থান সাপেক্ষ। ইসলামি পরম্পরায় ‘falsafa’ শব্দটির ব্যবহার দেখতে পাই; যেখানে দর্শন, আইন আর ধর্ম এই তিনটার মধ্যে একটা টানাপোড়েনের গল্প আছে। অতীতে কিন্তু তত্ত্ব কাকে বলে সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে যেগুলো নিয়ে আমরা এখন আর ভাবি না— যেমন, তত্ত্বের সঙ্গে প্রত্যয়, পদার্থ, কাল, কার্যকারণ, ধর্ম আর নিয়মের সম্বন্ধ কীভাবে ভাবা উচিত; তত্ত্বের কোনো নির্ধার্য স্বত্ব আছে না তা প্রচলন মাত্র; বস্তু বা বর্গ একক না সর্বদাই তার প্রতিত্য সমুৎপাদ হয়; অনেকান্তবাদ আর সাপেক্ষবাদ এক কিনা ইত্যাদি।

আমার মনে হয় আমরা পশ্চিমা তত্ত্বচিন্তার আলোচনা আর প্রাদেশিকীকরণ করেছি বটে, কিন্তু তত্ত্বের তত্ত্বকে নতুন করে ভাবার কাজটা এখনো করতে শুরু করিনি। তেমনি ঐতিহাসিক ঘটনা আর প্রক্রিয়ার সঙ্গে তত্ত্বভাবনার সম্বন্ধ নিয়ে আমরা তেমন ভাবিনি। ফলে আমরা যে শুধু পশ্চিমা তত্ত্বকে নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করার চেষ্টা করি তা নয়, তা করতে গিয়ে সেই তত্ত্বগুলোর অন্তর্নিহিত ইতিহাসকেও বিনা প্রশ্নে মান্য বলে গ্রহণ করি। তাই যখন আমরা liberty বা equality’র কথা বলি, তখন আমরা ফরাসি বিপ্লবকেও একটা ‘model event’ বা আদর্শ ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মেনে নিই। স্বপ্ন দেখি একটা ভারতীয় ফরাসি বিপ্লবের, সোনার পাথরবাটির! আর মনে করি যে অন্য ধরনের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া বা ঘটনার কোনো তত্ত্বগত তাৎপর্য যেন হতেই পারে না। তাই শুধু বিভিন্ন দর্শন পরম্পার মধ্যেই নয়, বিভিন্ন ইতিহাসের মধ্যেও একটা না বলা ক্রমকর্তৃত্ব তৈরি হয়।

এসব বলার অর্থ কিন্তু আদৌ এই নয় যে আমি ভারতীয়, চিনি বা আফ্রিকি তত্ত্ব পরম্পরার‍ ওকালতি করছি। চিন্তার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ খাটে না। চিন্তার গতি, ভাবনার দিশা কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানা মানে না। আবার এ কথাও ভুললে চলবে না যে প্রাকঔপনিবেশিককালে বিশ্বের নানা অঞ্চলের মধ্যে নানা ধরনের বৌদ্ধিক আর সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ছিল। যেমন দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, চীন, তিব্বত আর জাপানের মধ্যে বৌদ্ধ দর্শনের একটা চলাচল ছিল। আবার দক্ষিণ এশিয়া, আরব দেশ, পারস্য আর ইউরোপের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে বহু শতক ধরে নানা তাত্ত্বিক আদানপ্রদান হয়েছে। এগুলোকে আমি তত্ত্বাঞ্চল (thought region) বা তত্ত্বাবর্তনী (thought circuit) বলি। এই বিভিন্ন তত্ত্বচর্চার ক্ষেত্রগুলোর সঙ্গে কিন্তু আধুনিক জাতীয় মানচিত্রের কোনো সম্বন্ধ নেই। এও জোর দিয়ে বলা দরকার যে ‘ভারত’ বলে একটি রাষ্ট্র থাকলেও, সংস্কৃতি, ভাষা আর চিন্তার ক্ষেত্রে কিন্তু ভারত এক এবং সমভাবী নয়। বহু তাত্ত্বিক পরম্পরা আর বহু চিন্তাশৈলীর এক আলগা সমষ্টি মাত্র। কাজেই ভারতীয় তত্ত্ব পরম্পরা বলে কিছু নেই।

তাই আমি নানা পরম্পরার মধ্যে গতায়াতের কথা বলি। আবার প্রসঙ্গ বিশেষে global south-এরও উল্লেখ করে থাকি। আগে আমরা তৃতীয় বিশ্বের কথা বলতাম। সোভিয়েতআমেরিকা ঠান্ডা যুদ্ধের কালে তৃতীয় বিশ্বের একটা ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল। কিন্তু global south-এর তা নেই। এটা একটা বৌদ্ধিক অবস্থান মাত্র, একটা ইউটোপিয়াও বলা চলে। তাই এটিকে আমি ‘non-place’ বলছি। এই কল্পরাজ্যের অনুভূতিটা আমাদের একধরনের বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতা দেয়। এখানে আমরা নানা পরম্পরার মধ্যে অনায়াসে বিচরণ করতে পারি। আর অধ্যয়নের এক নতুন অনুশীলন গড়তে পারি। এতদিন আমরা হয় ভারতীয় নয় পশ্চিমা ইতিহাস আর দর্শন পড়তাম। অন্য আঞ্চলিক পরম্পরাকে বুঝতে গেলে তার পশ্চিমা অভিযোজন আর তর্জমাই শুধু নজরে আসত। পশ্চিমের মধ্যস্ততা ছাড়া অন্য পরম্পরায় ঢোকার উপায় ছিল না। অবশ্য সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বহুভাষী আর বহুপারম্পরিক চর্চার চেষ্টা বহুদিন আগেই শুরু হয়েছে। Global south-এর ধারণাটা আমাদের অন্য পরম্পরাকে স্বরূপে দেখার কাজে সাহায্য করে বলে আমার মনে হয়। জ্ঞানের রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা বৌদ্ধিক সংহতি তৈরি করতেও মদদ মেলে।

সারোয়ার তুষার: State (and) Violence (Banerjee 2017) প্রবন্ধে আপনি রাষ্ট্র, সহিংসতা, সার্বভৌমত্ব এবং সমাজ/রাষ্ট্র বাইনারি সংক্রান্ত যে সমস্ত normative চিন্তা প্রচলিত আছে, সেগুলোকে সমস্যায়ন করেছেন এবং হাল আমলের সহিংসতা, সার্বভৌমত্বকে বোঝার প্রচলিত কায়দাগুলো থেকে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন। একদিকে সহিংসতাকে রাষ্ট্রের মনোপলি ধরে নেয়া, সার্বভৌমত্বকে একক ও সুসংহত হিসেবে কল্পনা করে আইনের শাসন এবং শাসনের ‘ব্যতিক্রম’ জরুরি অবস্থাকে তত্ত্বায়ন/ব্যাখ্যা করার যে রেওয়াজ আছে, আপনি সেখান থেকে সরে এসেছেন। অন্যদিকে, রণজিৎ গুহ, বীণা দাসদের মতো গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিকরা যে ঔপনিবেশিক সার্বভৌমত্বকে dominance without hegemony কিংবা illegibility of the state হিসেবে দেখেছেন, আপনি তার সাথেও নিজেকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে পারছেন না বলে আমার মনে হয়েছে। এই উল্লিখিত দুই চিন্তাতেই (পশ্চিমের সার্বভৌমত্ব ও ঔপনিবেশিক সার্বভৌমত্ব) সহিংসতাকে কেবলই রাষ্ট্রের সাথে সংশ্লিষ্ট করে ভাবা হয়েছে। কিন্তু আপনি বলছেন, সহিংসতা, রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্বের যে নিরেট ও সুসংহত আন্তঃসম্পর্কের কথা ভাবা হয়েছে, বৈশ্বিক ও জাতীয় উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই এই প্রচলিত তত্ত্বায়ন আজ আর যথার্থ নয়। এ বিষয়ে আপনাকে কেন ভিন্ন অবস্থান নিতে হয়েছে?

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়: সহিংসতাকে প্রাকআধুনিক আর আধুনিককালের মধ্যে ফারাকের একটা সূচক বলে মানা হয়। আগেকার দিনে হিংসার অধিকার আর চলন পুরো সমাজে পরিব্যাপ্ত ছিল। আধুনিক সভ্যতার সাথে সাথে সমাজের বেসামরিকীকরণ হয়, আর সহিংসতা রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার হয়ে দাঁড়ায়। এ কথাটা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে। রাষ্ট্র আইনের দায়রার মধ্যে প্রয়োজন মতো হিংসার প্রয়োগ করবে আর সামাজিক ও ব্যক্তিগত হিংসাকে ন্যায়গতভাবে দণ্ড প্রদান করবে, এটাই আধুনিক লিবারেলিজমের ধারণা। আইন স্থাপিত করার কাজ রাষ্ট্রের, আবার আইন স্থগিত করা আর আইনের ‘ব্যতিক্রম’ নির্দিষ্ট করার কাজও রাষ্ট্রের; আবার প্রসঙ্গ বিশেষে বলপ্রয়োগ আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কাজও একমাত্র রাষ্ট্রের— এটাই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের পশ্চিমা সংজ্ঞা।

বলাই বাহুল্য, এই ধারণাটা বাস্তবে একেবারেই খাটে না। আজকের দিনেও নানা ধরনের সামাজিক হিংসার প্রচলন আমরা দেখি— তা জাতিবাদী, সাম্প্রদায়িক, আঞ্চলিক বা শ্রেণিগত হিংসা হতে পারে। পারিবারিক হিংসা এবং নারী আর অন্য— লৈঙ্গিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হিংসার কথাও মনে রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, আজ আমরা রাষ্ট্রকে সমাজের বিশেষ বিশেষ অংশের প্রতিনিধি আর মুখপাত্র হিসেবে সামাজিক হিংসায় অংশগ্রহণ করতে দেখি। ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নামে রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর প্রশাখা, এমনকি কোর্ট পুলিশকেও দেখি পাড়ায় পাড়ায় সাধারণ মুসলমান বা দলিতকে দমন করতে। ভারতে কাশ্মিরে আর উত্তরপূর্ব অঞ্চলে সামরিক শাসন একটা স্থায়ী অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা তো জানা কথাই। যদিও প্রকরণগতভাবে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা জনপ্রতিনিধিত্ব এবং আইনসভামূলক, বাস্তবে কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো শুধু নির্বাচন আর রাষ্ট্রপরিচালনার কাজেই নয়, নানা ধরনের সামাজিক নজরদারি আর বলপ্রয়োগের কাজে ব্যস্ত— এমনকি সাধারণ ছেলেমেয়ের প্রেম ভালোবাসা, জামা কাপড় আর হেঁশেলে কী রান্না হবে তার নিয়ন্ত্রণে উৎসুক। এটা অবশ্য আমেরিকার মতো দেশেও দেখা যায়— যেখানে racial বা সাদাকালোর মধ্যে হিংসা এখনো চলছে আর তাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা সবসময় অনিন্দনীয় বলা চলে না।

রাষ্ট্রের সামাজিকীকরণের সাথে সাথে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘রাষ্ট্রীয়করণ’ আর সার্বভৌমিকতার কথাও ভুললে চলবে না। আনাঘা ইঙ্গলে (Ingole 2021) caste assembly বা জাতিসভার ইতিহাস ও বর্তমান নিয়ে নতুন বই লিখেছেন। উনি দেখাচ্ছেন কীভাবে নানা আঞ্চলিক জাতিসভা জাতিসদস্যদের উপর বলপ্রয়োগ আর বহিষ্কারদণ্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর রাষ্ট্রীয় দণ্ডের থেকে বেশি জাতি ধর্ম আর জাতি হিংসা এখানে বেশি কার্যকর। তেমনি আধুনিককালে পরিবারের বিবর্তন দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে বিবাহ, গার্হস্থ্য আর যৌনতার ক্ষেত্রে এখনো বিষমকামী (heterosexual) পরিবার ব্যবস্থার কর্তৃত্ব আর সার্বভৌমত্ব অনেকটাই বজায় রয়েছে। ভারতে তো ধর্মভিত্তিক personal law বা সাম্প্রদায়িক আইন এখনো প্রচলিত। আবার এও আমরা জানি যে পরিবারের পর্দার মধ্যে হিংসা রাষ্ট্রীয় ন্যায়ব্যবস্থার অপেক্ষা রাখে না। একে আমি বলি ‘dispersed sovereignty’ বা বণ্টিত, পরিব্যাপ্ত বা বিভাজিত সার্বভৌমত্ব। আবার খানিকটা সোনার পাথরবাটির মতন। এ ক্ষেত্রে sovereignty’র পশ্চিমা তত্ত্বটি বর্জন করে আধুনিক রাজনীতিতে বল আর হিংসার ভূমিকার একটা অন্য তত্ত্বায়ন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

রণজিৎ গুহর ‘dominance without hegemony’(Guha 1998) ধারণাটা একটু অন্য। এই বাক্যাংশটি উনি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্রায়নে ব্যবহার করেছেন। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার গঠনটা পশ্চিমা আর ঔপনিবেশিক। উনি বলছেন যে সাধারণ মানুষ এ রাষ্ট্রব্যবস্থার তাত্ত্বিক আর প্রাতিষ্ঠানিক রূপকে কখনোই সেভাবে আত্মভূত করে উঠতে পারেনি। সেটি এখনও অনেকটাই অজানা আর অচেনা থেকে গেছে, স্বাধীনতার পর জনপ্রতিনিধির সরকার আসা সত্ত্বেও। তাই এই রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে জনতার সম্মতি আছে বললে ভুল হয়। মানে পশ্চিমা অনুশাসনের বিশ্বায়ন হয়ে থাকলেও তার সাথে জড়িত মানসিকতা আর অভিমুখিতার বিশ্বায়ন হয়নি। একথাটাই অন্যভাবে বীণা দাস আর অন্য নৃবিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘illegibility of the state’ (Das 2007)-এর প্রণয়নে। এরা বলেন যে আধুনিক আনুশাসনিক গঠন, আমলাতন্ত্র আর আইনব্যবস্থা সাধারণ মানুষের কাছে আজও অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ, alien। তাই আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হলেও ঠিক সফল নয়। অন্যদিকে কিন্তু পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন যে উত্তরঔপনিবেশিককালে আধুনিক অনুশাসনব্যবস্থা দেশের দূরদূরান্ত আর অভ্যন্তরীণ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তার পেয়েছে (Chatterjee 2011, পার্থ ২০২১)। সাধারণ মানুষ আজ এই অনুশাসনের গতি আর গঠনকে ভালোই বোঝে, তার ব্যবহার করতে জানে। নিম্নবর্গ গণতন্ত্রের খেলায় দক্ষতা অর্জন করেছে। একে উনি politics of the governed বা অনুশাসিতের রাজনীতি বলেছেন (Chatterjee 2004)। দেখিয়েছেন যে আধুনিক রাষ্ট্রের উপর জনতার তলবে, এই রাষ্ট্রের, পূর্ববর্তী পশ্চিমা চরিত্র সত্ত্বেও, একটা স্থানীয়করণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। এই দুটি মতই আংশিকভাবে সত্য। কিন্তু এর পরও একটা তত্ত্বায়নের কাজ থেকে যায়— তা হলো এই রাষ্ট্রের আর অনুশাসনের সঠিক চরিত্রায়ন।

সারোয়ার তুষার: আপনার আরও একটি প্রবন্ধের প্রসঙ্গ টানতে চাই। ‘The Abiding binary: The Social and the Political in Modern India’ (Banerjee 2018); এই প্রবন্ধে আপনি বলছেন, উপনিবেশোত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় অর্থবহ লিপ্ততার ক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বপ্রশাসনিকতা (sovereignty-governmentality) বর্গগুলো যথেষ্ট নয়। আপনি developmentality বর্গটি প্রণয়ন করেছেন। বাংলায় আমি একে ভাবছি ‘উন্নয়নতান্ত্রিকতা’ কিংবা কেউ হয়তো একে ‘উন্নয়নশাসকতা’ও বলতে পারে। আশিল এমবেম্বে, জৈবরাজনীতি (biopolitics) আদিকল্পের [প্যারাডাইম] সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে মারণরাজনীতি (necro-politics) [Mbembe 2019] ধারণাটি হাজির করেছেন। উন্নয়নতান্ত্রিকতার আদিকল্পে যাওয়ার আগে প্রশাসনিকতা বর্গটি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে আপনার সামনে কী ধরনের বাস্তব সমস্যা হাজির হয়েছিল?

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়: Social and political— এ দুটি বর্গের তাত্ত্বিক বিভাজনের উপর আমি প্রশ্ন করার চেষ্টা করেছি। এই বিভাজনটি আধুনিক পশ্চিমা রাজনীতি দর্শনের একেবারে গোড়ার কথা। এর ভিত্তিতে রয়েছে রাষ্ট্র আর সমাজের বা state and society’র পারস্পরিক স্বাতন্ত্র্য বা বৈপরীত্যের ধারণা। Liberalism আমাদের শেখায় যে রাষ্ট্র সমাজের প্রতিনিধিত্ব করলেও তা সামাজিক আর সাম্প্রদায়িক প্রভাবের ঊর্ধ্বে। আর সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ মানলেও রাষ্ট্রের অযথা হস্তক্ষেপের বিরোধী আর রাষ্ট্র হতে স্বতন্ত্র। এর মূলে কাজ করে এক রাষ্ট্র আর এক সমাজের বা ‘one state one society’র ভ্রান্ত ধারণা।

এটা ধরে নেওয়া হয় যে, রাষ্ট্র একক ও সর্বভৌম, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অধিকারের বা এক্তিয়ারের অন্য কোনো প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বী হতেই পারে না। এটা ঠিক নয়। আগেই বলেছি যে বাস্তবে এমন অনেক সামাজিক আর সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান আছে যা রাজনৈতিক আর সার্বভৌমিক চরিত্র জাহির করে আর অনেকসময় রাষ্ট্রের counter-polity বা পাল্টাঅনুশাসন হয়ে দাঁড়ায়। আবার অনেক বাহ্য শক্তিও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নির্ধারণ করতে পারে, তা অন্য কোনো রাষ্ট্র হতে পারে, বা বহুরাষ্ট্রিক সংগঠন হতে পারে, আবার বহুজাতীয় কোম্পানি বা কর্পোরেশনও হতে পারে (Bigo 2006)এদিকে রাষ্ট্র নিজেও অনেকসময় একটি সামাজিক যন্ত্রের স্বরূপে সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অংশী হয়ে পড়ে। তাই সার্বভৌমত্বের অবস্থান একমাত্র রাষ্ট্রই নয়। অন্য দিকে এটাও ধরে নেওয়া হয় যে সমাজ বলে একটি অবিছিন্ন, ঐক্যবদ্ধ আর সীমায়িত ক্ষেত্র আছে। এটাও ঠিক নয়। আম্বেদকার খুব সুন্দর করে বলেছেন যে ভারত এক জাতি এক দেশ হয়েও এক সমাজ নয়— বহু সমাজের একটা আলগা সমষ্টি মাত্র। প্রাকঔপনিবেশিককালে সমাজ শব্দটির মানে কিন্তু তাই ছিল— তাই আমরা বলতাম ব্রাহ্মণসমাজ, কায়স্থসমাজ, নাগরিকসমাজ, বৈষ্ণবসমাজ ইত্যাদি। সমাজ মানে ছিল এমন একটি গোষ্ঠী যা এক সঙ্গে ‘গমন’ করে, যার সদস্যরা সামাজিকতার বাঁধনে বাঁধা। তার মানে এক দেশে যে নানা সমাজ হতে পারে এটা খুব সাধারণ কথা ছিল। আম্বেদকার বলেছেন যে যেহেতু ভারতে নানা জাতি, বর্ণ আর সমাজের মধ্যে আত্মীয়তা, কুটুম্বিতা, এমনকি আকস্মিক সংস্পর্শ পর্যন্ত প্রতিষিদ্ধ ছিল, তাই ভারতকে আর যাই বলা হোক ‘society’ বলা চলে না। ঔপনিবেশিককালে আমরা society’র তর্জমায় সমাজ শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করি আর দাবি করি যে ভারতীয় সমাজ ভারতের জাতীয় ঐক্যভাবের প্রতিমূর্তি। ভারতীয় সমাজ সবরকম রাষ্ট্রনৈতিক আর রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, একটি বিশুদ্ধ সামাজিক অবস্থান। তার কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বা আলোচনা চলে না। কিন্তু বাস্তবে এ দেশে এক নয়, নানা সমাজের সহাবস্থান আর বিরোধ রয়েছে। আর এই সব সমাজের রাজনৈতিক আর আনুশাসনিক মাত্রাও রয়েছে।

যদি আমরা মানি যে সমাজ বিচ্ছিন্ন আর বিভক্ত আর রাষ্ট্রভাব সমাজের বিভিন্ন কেন্দ্রবিন্দুতে বণ্টিত, তাহলে কিন্তু state/society আর social/political এর সাফ বিভাজন আর খাটে না। অবশ্য এ কথা ঠিকই যে আধুনিককালে রাজনৈতিক অনুশাসন, নীতিপ্রণালী আর মতাদর্শ এই পশ্চিমা state/society বিভেদের মান্যতার ভিত্তিতে কাজ করে। ফুকো বলেন যে আধুনিক governmentality হলো একধরনের ‘rule by the social’। কিন্তু যদি আমরা social বা society বর্গটারই বিনির্মাণ করতে চাই তাহলে আমরা governmentality’র ধারণাটাকে কীভাবে সরাসরি (as it is) প্রয়োগ করব? আবার ফুকো এবং আরও অনেকে biopolitics বা জৈবরাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেন ‘politics of life’ বা জীবনদান আর জীবনোৎপাদনের অনুশাসন হিসেবে, যা প্রাকআধুনিক দণ্ড, শাস্তি আর মৃত্যুর অনুশাসনের বিরোধাভাসী বলা চলে। কিন্তু যদি আমরা মানি যে আধুনিককালেও যুদ্ধ, মৃত্যু আর হিংস্রতার রাজনীতি চলেছে, শুধু তৃতীয় বিশ্বেই নয়, সারা পৃথিবীজুড়ে; আর যদি বলি যে আধুনিকতার সঙ্গে ঔপনিবেশিকতার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল আর আছে, আর উপনিবেশবাদ মূলত জবরদস্তি দখল আর হিংসার রাজনীতি, তাহলে আশিল এমবেম্বের necro-politics বা মারণরাজনীতির তত্ত্বটা আমাদের মানতেই হয়।

তাই এই প্রবন্ধটিতে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি কেন ফুকোর governmentality’র ধারণাটা আমাদের ক্ষেত্রে সরাসরি খাটে না, এ কথা মানলেও যে উত্তরঔপনিবেশিককালে ভারতে জাতীয় রাষ্ট্র governmentality’র যুক্তি খাটাতে চেয়েছে আর তার জন্য রাষ্ট্র আর সমাজের তত্ত্বগত বিভাজনের প্রচেষ্টা করে এসেছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে ‘developmentality’ বা উন্নয়নতন্ত্র বলে একটি আনুশাসনিক ব্যবস্থা যা ইউরোপীয় governmentality’র থেকে অনেকটাই আলাদা। এই তন্ত্রটির মূলে যে ধারণাটি কাজ করে তা হলো এই যে, রাষ্ট্র সমাজের তুলনায় আধুনিক, উন্নত আর অগ্রসর। তাই রাষ্ট্রের কাজ হলো আইন এবং অনুশাসনের মাধ্যমে সমাজকে নিজের প্রতিচ্ছবি অনুযায়ী গড়ে তোলা, সমাজের সংশোধন আর পুনর্গঠন করা। সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের একটা উপদেশাত্মক বা didactic সম্পর্ক গড়ে তোলা। সমাজের থেকে রাষ্ট্রের দূরত্ব আর পরভাব (alienation) এখানে কিন্তু একটা ইতিবাচক ব্যাপার হিসেবে দেখা হচ্ছে। তার ফলে এখানে আধুনিক গণতান্ত্রিক কল্পনার ভেতরে আমরা একটা স্ববিরোধ বা অসঙ্গতি দেখতে পাই— একদিকে সামাজিক প্রতিনিধিত্বের ঝোঁক, অন্যদিকে সমাজকে অস্বীকার করার ঝোঁক। ফলে রাষ্ট্র কখনো বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, কখনো আবার সমাজের সঙ্গে একীকৃত। আমাদের রাজনীতিতে এই ব্যাপারটা কিন্তু পুনরাবর্তের মতো দেখা দেয়।

তাই আমি বলি যে ঠিক যেমন প্রাকঔপনিবেশিক রাজনীতিতত্ত্ব আর সমাজতত্ত্বের ইতিহাস আমাদের নতুন করে লিখতে হবে, ঠিক তেমনি আমাদের আধুনিক আর উত্তরঔপনিবেশিক কালের রাজনীতির ইতিহাসকেও নতুন করে ভাবতে হবে। একথা মেনে বসে থাকলে চলবে না যে আধুনিককালে সারা দুনিয়ায় রাজনীতির ধরন আর গঠন এক।

সারোয়ার তুষার: পার্থ চট্টোপাধ্যায় তার ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ প্রবন্ধে (পার্থ ২০১৫) ভারতবর্ষের ইতিহাসরচনার পদ্ধতি (historiographical) সংক্রান্ত সংকট উন্মোচন করেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলার জাতীয়তাবাদ এবং বিভিন্নতার মাঝে ঐক্য (unity in diversity) এই তিন আপাত ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসচেতনাই হয় একদিকে রাষ্ট্রের অখণ্ডতার প্রশ্নে নিঃসংশয়, অথবা অন্যদিকে ধরে নিচ্ছে ভারতের সমাজজীবনের অন্তনির্হিত সত্য এক এবং অপরিবর্তিত। এই ইতিহাসচেতনাসমূহ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক অথবা আধুনিক ইতিহাসবোধের ঊর্ধ্বে এক অবধারিত ‘অখণ্ডতা’, ‘ঐক্য’ কল্পনা করে নেয়। পার্থ চট্টোপাধ্যায় চতুর্থ এক ধরনের ইতিহাসচেতনা ও পদ্ধতির সম্ভাবনা দেখেন; যাকে তিনি বলেছেন ‘বিকল্প ইতিহাস’। এই ইতিহাসচেতনা রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতা, অখণ্ডতা ইত্যাদিকে সন্দেহ করে এবং মনে করে ইতিহাসের সামগ্রিকতা যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা রাষ্ট্রীয় নয়, যুক্তরাষ্ট্রীয়। ভারতের ইতিহাসের অখণ্ডতার ধারণাটাই ভারতের অধিবাসিদের খণ্ডিত ও বিভাজিত করে রেখেছে বলে তিনি মনে করেন।

হিস্টোরিওগ্রাফি (Banerjee 2006, 2016) নিয়ে আপনিও লিখেছেন। এই ‘বিকল্প ইতিহাস’এর ধারণাকে আপনি কীভাবে দেখেন? ইতিহাসের সাথে রাষ্ট্র বা রাজনীতির লেনদেন/যোগাযোগ কেমন হওয়া উচিত? বিশেষত বিজেপির এই সময়ে জনজীবনে (public life) ইতিহাসের ভূমিকা কী হতে পারে? ইতিহাস কি নিজেই নিজের উদ্দেশ্য? নাকি অধিকতর ন্যায্য, গণতান্ত্রিক সমাজরাষ্ট্র চরিতার্থ করার হাতিয়ার হয়ে ওঠবে ইতিহাস? সেক্ষেত্রে দর্শনের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে যে সমস্যা আপনি চিহ্নিত করেছেন, তেমন কোনো আধিপত্য বা হায়ারার্কি ইতিহাসকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয় কিনা?

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়: Politics of Time (Banerjee 2006) বইটিতে আমি ভারতে ইতিহাস চেতনা আর ইতিহাস লেখনশৈলীর উদ্ভবের গল্পটা বলার চেষ্টা করেছি। তবে সে কথায় আসার আগে আর একটা কথা বলে নিই। অনেক ঐতিহাসিক বলে থাকেন যে ‘ভারতে প্রাকআধুনিককালে ইতিহাস লেখনের চল ছিল। ভারতের অতীতে ইতিহাস নেই, কালচেতনা নেই, গতিশীলতা নেই, রাজনীতি নেই— ইংরেজদের এই পরদ্বেষী ধারণাটা ভারতকে জয় করার ছুতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্য সব দেশের মতো, ভারতেও কালক্রমে নানা পরিবর্তন এসেছে আর সেই পরিবর্তনের আখ্যানও যথাযথভাবে হয়ে এসেছে।’ এ কথা নিশ্চিতভাবে ঠিক। কিন্তু অনেকে এও বলেন যে ইংরেজরা আসার আগে ভারতে আশু আধুনিকতা বা ‘early modernity’ দেখা দেয় আর সে সময় আধুনিক ইতিহাস বোধের উদয় হয়। এ কথাটা কিন্তু আমি পুরোপুরি মেনে উঠতে পারি না। আমার মনে হয় যে এ ধরনের তর্কের পেছনে একটা ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি কাজ করে। আমরা এটা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে যা পশ্চিমে ছিল তা ভারতেও ছিল— আধুনিকতা ছিল, ইতিহাস ছিল, আবার অনেকে এমনটাও বলেছেন যে আধুনিক ধনতন্ত্রের উদয়ের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। ইংরেজরা এসে সব গড়বড় করে দেওয়াতে আমাদের আধুনিকতায় বাধা পড়ে। এই মনোভাবটা আমাদের আধুনিকতা, ইতিহাস, ধনতন্ত্র ইত্যাদি পশ্চিমা তত্ত্বের বিনির্মাণ আর সমালোচনার পথে বাধা হয়ে ওঠে। ভিন্ন অতীত, ভিন্ন পরম্পরা আর ভিন্ন তাত্ত্বিক সম্ভাবনা আমরা আর দেখতে পাই না।

পলিটিক্স অফ টাইম বইটির প্রচ্ছদ

আমি মনে করি যে আজকের দিনে আমরা যাকে ‘history’ বলি সেটি একটি আধুনিক অনুশাসন, যার বিবর্তনের একটা ঔপনিবেশিক কুলজী বা genealogy রয়েছে। প্রাকআধুনিককালেও অবশ্যই অতীত চেতনা ছিল আর অতীতকে আখ্যায়িত করার বিভিন্ন রীতিও ছিল, যার মধ্যে ইতিহাস ছিল একটি বিশেষ রীতি। মনে রাখতে হবে যে প্রাককালে ইতিহাস ছিল কাব্যের একটি ধারা। এ ছাড়া ছিল শ্রুতি, স্মৃতি, অতিকথা, পুরাণ, আগম, বংশাবলী, কুলজী, চরিত, শব্দপ্রমাণ ইত্যাদির অবধারণা। রাজকার্যের ক্ষেত্রে ছিল নানা ধরনের কালপঞ্জিকা বা chronology’র চলন, যেগুলোর মধ্যে মধ্যযুগীয় ‘তারিখ’ ছিল একটি প্রধান রূপ। এ ছাড়া ছিল নানা ধরনের নথি আর দলিল— যেমন জমি আর সম্পত্তি সংক্রান্ত কাগজপত্র— যাতে কালক্রম নির্ধারণ আর আর সাক্ষ্যপ্রমাণের একটা নিখুঁত ধারণা দেখা যায়। মানে আগেকার দিনে অতীতকে নানাভাবে পেশ করার চলন ছিল যা ক্ষেত্র আর প্রসঙ্গ অনুযায়ী আলাদা আলাদা রূপ নিতো। সব অতীত আর সব আখ্যানকে ইতিহাসের নাম দেওয়া হতো না। তফাৎ এখানেই। আধুনিককালে history একটা meta-category বা অতিবর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সব ধরনের কালচিন্তার আর অতীতচিন্তার প্রতিরূপ একমাত্র ইতিহাসই, আমরা এই ভ্রান্ত ধারণার শিকার হয়ে পড়েছি।

আধুনিক ইতিহাসচেতনার উদয় হয় উপনিবেশবাদের কালে, আঠারোউনিশ শতকে, ইউরোপ আর ইউরোপের উপনিবেশগুলোর মিথস্ক্রিয়ায়। আমরা জানি যে এ সময়ে ইউরোপীয় দর্শনে philosophy of history’র উদয় হয়, যার সবচেয়ে বিখ্যাত প্রবক্তা ছিলেন হেগেল। উনি বলেন যে ভারত, চীন, আফ্রিকা ইত্যাদি শুধুমাত্র ভিন্ন দেশ, ভিন্ন সমাজই নয়, কালের পরিমাপ অনুসারে ইতিহাসের ভিন্ন পর্ব বা পর্যায়ের প্রতিরূপ। অর্থাৎ, ইতিহাসের একটা বিশ্বব্যাপী অভিব্যক্তি রয়েছে। পৃথিবীর সব দেশ আর সব সমাজ এই বিশ্বইতিহাসের অন্তর্গত আর সব ধরনের ভিন্নতা সত্ত্বেও ইতিহাসের মানদণ্ডে পরস্পরের সঙ্গে তুলনীয়। এই তুলনা অনুসারে কিছু দেশ আধুনিক ও অগ্রসর; অন্য দেশ আদিম, প্রাচীন বা পিছিয়ে পড়া। এই গল্পটা আমরা জানি। Politics of Time বইটিতে এরই সম্পূরক গল্পটা আমি বলছি। উপনিবেশের আর ইতিহাসবর্জিতের প্রেক্ষা থেকে ইতিহাসের বৈশ্বিকীকরণের গল্পটা। আমি দেখিয়েছি যে ঠিক যেমন ইউরোপে আধুনিক ইতিহাসবোধের উদয় হয় উপবিশগুলোর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায়, ঠিক তেমনি ভারতের মতো দেশে ইতিহাসের উদয় হয় পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চজাতি মধ্যবিত্তের সঙ্গে আদিবাসিজনের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে। এখানে অহিন্দু, জঙ্গল, পর্বত আর সীমান্তবাসী মানুষকে ‘আদিম’ আখ্যা দেওয়া হয়। বলা হয় যে আদিবাসিদের মধ্যে কালচেতনার একান্ত অভাব। তাই এদের ঐতিহাসিক বিবর্তন হয়ে ওঠেনি। তাই ভারতের জাতীয় সমাজ আর সভ্যতা থেকে এরা আলাদা। এরা ভারতের জাতীয় উন্নতিকে বিঘ্ন করে। আমি দেখিয়েছি যে কীভাবে ভারতের কিছু জনজাতি আর কিছু এলাকাকে ভারতের ইতিহাসের ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়ার থেকে আলাদা করা হয়েছে। এই আলাদা করার প্রক্রিয়াটি কিন্তু একটা শুদ্ধ বিশ্লেষণাত্মক প্রক্রিয়া নয়, যা শুধুমাত্র তত্ত্বচিন্তার স্তরে কাজ করে। এর একটা বাস্তব আনুশাসনিক দিকও রয়েছে। তাই আমি দেখাচ্ছি কীভাবে শ্রম আর ঋণের বাজারে, জমি বণ্টনের আর প্রাদেশিক সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে, অভিপ্রয়ান আর ভ্রমণের নতুন রীতিতে, এমনকি আইনকানুন, প্রশাসন, বিদ্রোহ দমন আর সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক আর [একদা] উপনিবেশিত দুই পক্ষই একসাথে সীমান্তবাসিদের ইতিহাসবর্জিত জন বা ‘people without history’ করে তুলছে। রাজনৈতিক অধীনতা এখানে ঐতিহাসিক অধস্তনতার রূপ নিচ্ছে। তাই বলছি যে ইতিহাসের যে আধুনিক আনুশাসনিক রূপ আমরা জানি তার পেছনে তথাকথিত ইতিহাসবর্জিতজনের উপস্থিতি আজও ছায়ার মতো দেখা যায়। এই তাত্ত্বিক ও আনুশাসনিক অন্যায়ের পরিণামের সঙ্গে আজও আমরা লড়ে চলেছি।

যেহেতু আমরা মেনে নিয়েছি যে অতীতকে একমাত্র ইতিহাসই চিত্রায়িত করতে পারে, আর সারা বিশ্বে ইতিহাসের অবয়ব আর পরিকাঠামো মূলত এক, তাই আজও আমরা ইতিহাস নিয়ে লড়াই করছি। রাজনৈতিক অধিকার ইতিহাসের অধিকারের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের দলই হোক আর আদিবাসী, দলিত বা নারীবাদীই হোক— লড়াইয়ের রূপটা কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এক। কার ইতিহাস বেশি প্রামাণ্য, কার ইতিহাস প্রভাবী, কার ইতিহাস প্রগতিশীল, কার ইতিহাস রক্ষণশীল, কার ইতিহাস আদর্শ বা প্রতিনিধিকর, কার ইতিহাস প্রযোজ্য, কার ইতিহাস অপ্রাসঙ্গিক, কার ইতিহাস এ পর্যন্ত দমিত ছিল আর আজ তার পুনরদ্ধার হয়েছে, কার ইতিহাস বর্তমানে ঐতিহাসিক ন্যায়ের দাবি করে ইত্যাদি। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঠিকই বলেছেন যে ভারতবর্ষের ইতিহাস এক আর ঐকিক, এ কথাটা ভুল। ভারতবর্ষের নানা ভাষা, নানা অঞ্চল, নানা জাতির নানা ইতিহাস। তাই এই ইতিহাস মূলত federal বা যুক্তরাষ্ট্রীয়। বহু ইতিহাসের কল্পনা করলে তবেই ইতিহাসের লড়াই প্রশমিত হবে।

তবে আমি এখানে আর একটা কথা জুড়তে চাই। সমাজের সব স্মৃতিকাহিনিকে যে ইতিহাসসাপেক্ষই হতে হবে এ কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। যে জনজাতির কোনো লিখিত দলিল বা স্থাপত্য নেই, তার অতীতকে গানে, গল্পে, অতিকথায় আর স্মৃতিতে খুঁজতে হবে। আধুনিক ইতিহাস যে ধরনের তথ্য আর প্রমাণ খোঁজে, তা খুঁজতে গেলে কিন্তু এ ধরনের অনেক সমাজই ইতিহাসবর্জিত থেকে যাবে; বা কাল্পনিক গাথাকে ইতিহাস বলে চালাতে চাইবে, যার ফলে বিদ্যায়তনিক ইতিহাস আর জনইতিহাসের মধ্যে একটা বিরোধ তৈরি হবে। শুধু তাই নয়, এটাও আমাদের মানতে হয় যে মানবজীবনের এমন অনেক মাত্রা আছে যার নাগাল ইতিহাসের মাধ্যমে পাওয়া মুশকিল। আমাদের জীবনে দেবদৈত্য, জীবকীটাণু, হাওয়াবাতাস, নদীপাহাড় ইত্যাদির যে ভূমিকা তাকে কিন্তু শুধুমাত্র ইতিহাসের বিষয় হিসেবে ভাবা সম্ভব নয়। এগুলোর অন্তর্নিহিত সময়গতি আর সক্রিয়তা ঠিক ঐতিহাসিক কালধারণা দিয়ে ধরা যায় না। তাই আমি বলি যে ইতিহাসের সাম্রাজ্যবাদী এক্তিয়ার থেকে আমাদের নিজেদের মুক্ত করতে হবে। তাহলেই ইতিহাসের রাজনীতির থেকে আমরা বেরুতে পারব আর ইতিহাসকে শুদ্ধ ইতিহাস হিসেবে দেখতে শিখব। তবেই ইতিহাসের আসল রসটা উপভোগ করা সম্ভব হয়ে ওঠবে।

সারোয়ার তুষার: আপনি বর্তমান ডিজিটাল ও ভাইরাল যুগে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়েও কাজ করছেন বলে জানি। এটা কিন্তু ঠিক যে, আজকের নিওমিডিয়ার যুগে অনেক বেশি মানুষ নিজের কথাটা বলতে পারছে। এইদিক থেকে কথা বলার কিংবা মত প্রকাশের এক ধরনের গণতন্ত্রীকরণ (democratization) ঘটেছে বলা যায়। আবার এটাও ঠিক যে, এর ফলে নানা ধরনের ভার্চুয়াল লিঞ্চিং (অনেক সময় তা বাস্তব লিঞ্চিং পর্যন্ত গড়ায়), ডিজিটাল ভিজিল্যান্টি মবের উত্থান ঘটেছে। প্রযুক্তির বিপুল প্রসারের এই যুগে [contextual judgement অর্থে] ইতিহাসচর্চা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এক রকম মার খাচ্ছে বলা যায়।

History as Confession (Posel 2008), History as Testimony (Attwood 2008) বিষয়গুলো নিয়ে যারা লিখছেন; তারা বলছেন আজকের দিনের যুগধর্ম হলো এত বিপুল পরিমাণ মানুষের এখন কথা বলার মাধ্যম আছে যেটা আগে অকল্পনীয় ছিল। এখন যত বেশি মানুষ কথা বলবে ততই তো ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু মুশকিল হলো এই মানুষগুলো অতীতে নানা কারণে, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ নানা পরিচয়ের কারণে নিপীড়িত হয়েছে। এখন কথা বলার মাধ্যম ও সুযোগ পেয়ে তারা তাদের গ্রিভেন্সএর কথা বলা শুরু করেছে। এবং এই সাক্ষ্য, স্বীকারোক্তিই ‘ইতিহাস’ বনে যাচ্ছে। ইতিহাস মানে যে ব্যক্তিগত খেদটা দূরে রেখে contextual objective জাজমেন্ট করা, সেই জাজমেন্ট মার খাচ্ছে। যার যার ‘সত্য’ই হয়ে ওঠছে চূড়ান্ত ইতিহাস, চূড়ান্ত ফ্যাক্ট। এটা আজকের যুগের এক বড় সংকট বলে অনেকে মনে করেন। স্ক্রুটিনি, অথেনটিসিটি, ফ্যাক্টচেকিং, ভেরিফিকেশনের মারাত্মক ধ্বস লক্ষ করা যাচ্ছে।

এই ডিজিটাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তের যুগে পপুলিস্ট উত্থানের পেছনেও এই রিভেঞ্জ নির্ভর বঞ্চনার বোধ একটা বড় কারণ। একদিকে লাঞ্চিতবঞ্চিতদের দুঃখদুর্দশাকে পুঁজি করা, অন্যদিকে সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশের মধ্যে ‘কল্পিত শত্রু’র জুজু তৈরি করা; দুইক্ষেত্রেই ডিজিটাল মিডিয়ার ভূমিকা ব্যাপক। তথাকথিত পপুলিস্ট সুপারলিডাররাও এত সুনিপুণভাবে মানুষের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তাকে এখন কাজে লাগাতে পারে, যা দুই যুগ আগেও কল্পনা করা যেত না। যেমন মিডিয়াশাস্ত্রের পণ্ডিত সিভা ভৈধ্যনাথান (2018) দেখাচ্ছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদেরকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করার পরিবর্তে ঘৃণা, সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দেয়াল তুলে বিচ্ছিন্ন করছে; অন্যদিকে গণতান্ত্রিক আলাপআলোচনা পরিসরের মারাত্মক অবনতি ও সংকোচন ঘটাচ্ছে

এমন পরিস্থিতিতে, যুক্তি ও ন্যায়অন্যায়বোধের ক্রম অবনতি এবং প্রযুক্তির অত্যাচারের আজকের জমানায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত কী?

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়: এ বড় কঠিন প্রশ্ন। আমাদের আরও অনেক ভাবতে হবে। প্রথমেই বলি যে প্রযুক্তির প্রভাব আগেও ছিল। আদিমকালে লোহার যন্ত্রের উদ্ভব কৃষি সম্ভব করে তোলে আর তাতে পুরো পৃথিবীর চেহারা পালটে যায়। আবার লেখনও তো একটা প্রযুক্তি, তাই না? লেখনশিল্প কথা আর ভাবকে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে মানুষের আর অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যতের সম্পর্ক পাল্টে দেয়। বিজলি (ইলেক্ট্রিসিটি) রাত আর দিনের সম্পর্ক পাল্টে ফেলেছে। আর বেনেডিক্ট এন্ডারসন দেখিয়েছেন যে ছাপার প্রযুক্তি ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রবাদকে কল্পনাই করা যায় না (Anderson, B. 1983)। কাজেই প্রযুক্তির গল্পটা অনেক পুরনো, এটা মনে রাখা দরকার। তবেই আমরা বর্তমান প্রযুক্তির নতুনত্ব আর অভিনবত্ব ধরতে পারব।

যাকে আমরা ‘high-speed information and communication technology’ বা দ্রুতগতি যোগাযোগ আর তথ্যপ্রযুক্তি বলি তার কয়েকটি দিক নিয়ে কথা বলা যাক। প্রথমত, আপনি ঠিকই বলেছেন যে এই প্রযুক্তি লেখা আর ছাপার প্রযুক্তির তুলনায় আরও অনেক বেশি মানুষকে নিজের কথা বলতে দেয়। যারা লিখতে পড়তে জানে না তারাও অডিও আর ভিডিও দ্বারা নিজেকে ব্যক্ত করতে পারে। ফলে গণতন্ত্রীকরণের একটা ঝোঁক এই প্রযুক্তির মধ্যে দেখা যায় বটে।

দ্বিতীয়ত, এই একই প্রযুক্তি আমাদের প্রতিজনের উপর জাতীয়রাষ্ট্র, পররাষ্ট্র আর বহুজাতিক পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর নজরদারি বা surveillence আরও সহজ করে তোলে। নজরদারির প্রশ্ন আর ডাটার উপর অধিকার কার, সরকারের না ব্যক্তিগত উদ্যোগের, এই প্রশ্ন নিয়ে আজ ভারত সরকার নানা social media company’র সাথে সংগ্রামে লিপ্ত। এই লড়াইয়ে সাধারণ মানুষের একান্ত বা privacy’র প্রশ্নটা খানিকটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। আবার আমরা এও দেখছি যে digital inclusion বা ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির আকাঙ্ক্ষায় বহু সাধারণ মানুষ নিজের ইচ্ছাতেই ব্যক্তিগত ডাটা সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছে। ফলে অভিব্যক্তির স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল অনিরাপত্তার আর পরাধীনতার সম্ভাবনাও আগের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে ওঠেছে। এদিক থেকে দেখতে গেলে বলতে হয় যে গণতন্ত্রের প্রতিস্পর্ধায় এক ধরনের সর্বাত্মকবাদ বা totalitarianism মাথা চাড়া দিয়ে ওঠছে।

তবে সব প্রযুক্তিরই দুটি বিপরীত দিক থাকে। কৃষি প্রযুক্তি যেমন খাদ্য সঙ্কট দূর করেছে তেমনি পরিবেশ দূষণ আর ভূমণ্ডলের উষ্ণায়ন করেছে। প্রশ্নটা কিন্তু শুধু প্রযুক্তির অপব্যবহারের প্রশ্ন নয়। যেকোনো প্রযুক্তির মধ্যে নিহিত যে সম্ভাবনা আর ঝোঁক (potential) থাকে তার প্রশ্ন। কাজেই নতুন প্রযুক্তির পেছনে যে দর্শন আর কল্পনা কাজ করে সেটা ধরা আমাদের মতো সমাজতাত্ত্বিক আর দার্শনিকদের কাজ। আমাদের অঞ্চলগুলোতে এখনো কিন্তু ‘philosophy of technology’ নিয়ে তেমন কাজ শুরু হয়নি।

তৃতীয়ত, এই যোগাযোগ প্রযুক্তি আজকে তথ্যের ধারণাটা পাল্টে দিয়েছে। যাকে আগে আমরা ‘fact’ বলতাম তার জায়গায় এসেছে ‘data’। ফ্যাক্টের একটা প্রতীয়মান অর্থ থাকে যার সাথে অভিজ্ঞতা বা প্রয়োগের একটা সংযোগ আমরা খালি চোখে চিনতে পারি। Statistics আর census’র তথ্য যেমন হয়। Digital data’র কিন্তু কোনো নিজস্ব অর্থ নেই। তা হলো তথ্যের একটা টুকরো বা ভগ্নাংশ, একটা digital trace মাত্র। এর কোনো অর্থগত পরিচিতি নেই। আর এর সঙ্গে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সরাসরি যোগাযোগ বোঝা মুশকিল। এর দুটি তাৎপর্য আছে।

এক, cyberspace-এ আমাদের বিচরণ কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে নয়। আমাদের রুচি, অভ্যাস, কৌতূহল, গতায়াত, প্রয়োজন আর আকাঙ্ক্ষাগুলো সাইবারস্পেসে টুকরো টুকরোভাবে ছড়িয়ে থাকে। এই ট্রেসগুলো একটা নিজস্ব জীবন আর গতি পায়। কাজেই যে ব্যক্তি বা individual-এর অবধারণার উপর ভিত্তি করে আমরা নাগরিকত্ব দাবি করি, সেই ব্যক্তি কিন্তু সবসময় সমভাবে প্রকট হতে পারে না। Citizen বা নাগরিকের জায়গায় এসে পড়ে user বা ব্যবহারকারী। তার রাজনীতি আর রাজনৈতিক অধিকারের চেহারাটা আলাদা। আমাদের ডিজিটাল ব্যক্তিত্বের অধিকার আর সুরক্ষা শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় আইন কানুন দ্বারা সম্ভব হয় না।

দুই, আমাদের ডিজিটাল গতিবিধি আর জীবনের ব্যাখ্যান করে একটা নতুন ভাষা যাকে আমরা algorithm বা কলনবিধি বলে জানি। নানা দেশের নানা ব্যক্তির নানা ডিজিটাল কর্মক্রিয়াকে একসাথে নিয়ে তার মধ্যে নানা ধাঁচ নির্ধারণ বা pattern recognition-এর কাজ করে এই কলনবিধি। কলনবিধি তৈরি হয় বিশেষ বিশেষ প্রয়োজন অনুসারে, কখনো বাণিজ্যিক চাহিদার আকলন করতে, কখনোবা রোগ সংক্রমণের গতিপথ আন্দাজ করতে, কখনো ভিন্ন ভিন্ন যৌনপ্রবৃত্তির নকশা জানার কাজে। তাই আমাদের data identity কখনো উপভোক্তার কখনোবা রুগীর কখনোবা যৌনতার। অর্থাৎ, সাইবারস্পেসে আমরা নানান পরিচিতিতে হাজির থাকি। আবার আমরা মিথ্যা পরিচয়ও তৈরি করতে পারি, যেমন অনেকে করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আমাদের identity চুরিও যেতে পারে, যেমন হয় ডিজিটাল লেনদেনের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ একক আর স্বায়ত্ত identity বা আত্মপরিচিতি, যার ভিত্তিতে লিবারেলিজমের rights-এর ধারণাটা দাঁড়িয়ে আছে, তা ঠিক একভাবে কাজ করে না big data’র ক্ষেত্রে। তাই সময় এসেছে সামাজিক আর রাজনৈতিক সমালোচনার সাথে সাথে algorithmic critique-এর বা নানা ধরনের কলনবিধির বিনির্মাণ আর আলোচনা করার। এটা করতে গেলে প্রযুক্তিবিদ আর সমাজবিদদের একসঙ্গে ভাবতে হয়। সেটা সোজা কাজ নয়।

তৃতীয়ত, সমষ্টির সংজ্ঞাও আজ নানাভাবে পাল্টেছে। আজ আমাদের সামাজিক পরিচিতির সঙ্গে ডিজিটাল পরিচিতির সম্বন্ধের পুনর্বিবেচনা করতে হবে। যাকে আমরা জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গ ইত্যাদি বলে থাকি— যেগুলো সামাজিক পরিসংখ্যান আর জনবিদ্যা (statistics and demographics) নির্ভর আর যার সঙ্গে রাজনৈতিক সমষ্টির কল্পনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত— তার সঙ্গে নানা ধরনের ডিজিটাল সমবায়ের কী সম্পর্ক সেটা নতুন করে বুঝতে হবে। ডিজিটাল সমবায় আবার অনেক সময়েই রাষ্ট্রীয়সীমা লঙ্ঘন করে। কাজেই জাতীয় রাজনীতির স্বাতন্ত্র‍্যের কথাটাও নতুন করে ভাবতে হয়। আবার আমরা অনেকসময় নানা দেশীয় রাজনীতির হিস্যা হই ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্যে। অনেকে এও বলেছেন যে ডিজিটাল সংযোগের যুগে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে আবেগের প্রেষণ আর সংক্রমণ অনেক দ্রুত আর তাৎক্ষণিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একে আমরা ‘virality of affect’ বলে জানি। তাই যেমন আশা আর বিদ্রোহের আবেগ আর অনুভূতিকে আমরা এক পলকে আরব থেকে ভারত, হংকং থেকে আমেরিকায় ছড়িয়ে যেতে দেখি; ঠিক তেমনি ঘৃণা আর দ্বেষের ভাবকেও মুহূর্তের মধ্যে এক থেকে বহুতে সঞ্চারিত হতে দেখি। তাই আজকের দিনের রাজনৈতিক সমষ্টিকে অনেকে ‘affective public’ বলে থাকেন (Papacharissi 2014)

ভাবের প্রসঙ্গে প্রভাবের কথাটাও এসে পড়ে। জনমানসকে এখন অনেক সহজেই দোলা দেওয়া যায় ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রতিজনকে এককভাবে উদ্দেশিত করা যায়। আগে নেতারা যে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন তা সমষ্টি বা ভিড়কে উদ্দেশ্য করত। আজ সমষ্টির সাথে প্রতিটি ব্যক্তিকে তার নিজস্ব আর ব্যক্তিগত রুচি অনুযায়ী প্ররোচিত করা যায়। আর বিরতিহীন তথ্যের আক্রমণে থেমে দাঁড়িয়ে ভাবার সময় পাওয়া যায় না বলে ঠিকবেঠিক, সত্যঅসত্যের বিচার করা হয়ে ওঠে না। ফলে গণতন্ত্রের আদর্শ deliberative public বা মননশীল জনগণের জায়গায় আমরা পাই এক অমনোযোগী আর অপারদর্শী জনতাকে; যে পলকে মারণোন্মুখী, পলকে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।

তাই নিঃসন্দেহে আজ সমাজসংস্কৃতিরাজনীতি নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের প্রযুক্তি নিয়েও ভাবতে হবে। কথাটা যতটা সরল মনে হয় তা কিন্তু নয়। আমাদের আলাপ আলোচনায় দুটো প্রবৃত্তি ধরা পড়ে। কখনো আমরা বলি যে প্রযুক্তি নিজগুণে ভালো বা মন্দ হয় না, প্রয়োগে হয়। আবার অন্য সময় আমরা সবকিছুকেই প্রযুক্তি দ্বারা নির্ধারিত মনে করে থাকি, যেটাকে প্রযুক্তিপরিণামবাদ বা ‘technological determinism’ বলা যায়। এ সমস্যার সমাধান আমার কাছে নেই, যদিও এই দ্বন্দ্বটা আমায় ভারি ভাবায়।

র একটা কথা নিয়ে আমি এখন ভালোভাবে ভেবে উঠতে পারিনি। তা হলো প্রযুক্তির সার্বভৌমত্ব। সমাজ সংস্কৃতির নানা রূপ আমরা জানি। কিন্তু প্রযুক্তির কি নানা রূপ হতে পারে? বিভিন্ন সমাজের ক্ষেত্রে কি সেই সমাজ হতে জৈবভাবে বা organically উদ্ভূত প্রযুক্তির কথা বলা চলে? না প্রযুক্তি সর্বদাই universal, সর্বজনীন? চিকিৎসাশাস্ত্র আর জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে খানিকটা ভিন্ন ভিন্ন পরম্পরা আর ইতিহাসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাও নামমাত্র। Communication technology’র ক্ষেত্রে একবারেই নয়। তাই আমার মাথায় এই প্রশ্নটা বারবার চাড়া দিয়ে ওঠে— প্রযুক্তির বিউপনিবেশিকরণ কি সম্ভব? অন্য প্রযুক্তির কল্পনা কি করা যায়? না প্রযুক্তি আমাদের স্বপ্রদত্ত আর চিরন্তন নিয়তি?

টীকা:

) প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সাক্ষাৎকারে বেশ কয়েকবার ‘রাষ্ট্রবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আমাদের এখানে সাধারণত statism-এর পরিভাষা হিসেবে ‘রাষ্ট্রবাদ’ পাঠ করার রেওয়াজ আছে। কিন্তু প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সাক্ষাৎকারে nation-state-এর সেন্স ধরতে গিয়ে ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘রাষ্ট্রবাদ’ পরিভাষা দুটি প্রায় অদলবদল করে ব্যবহার করেছেন। কারণ প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের ক্ষেত্র প্রধানত দিল্লি; যেখানে হিন্দি ভাষার ডিসকোর্সে ‘নেশনকে’ রাষ্ট্র এবং ‘স্টেট’কে রাজ্য বলা হয়। হিন্দিতে যাকে রাষ্ট্র বলা হয়, তাতে আবার স্টেট আর পিপল জুড়ে গিয়েছে (পার্থ ২০২১)

বাংলায় আমরা কিন্তু ‘স্টেট’ বলতে রাষ্ট্র, আর ‘নেশন’ বলতে জাতি বুঝি। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেশনকে নেশনই বলার পক্ষপাতী ছিলেন, তিনি মনে করতেন বাংলা ভাষার ‘জাতি’ আর ইউরোপীয় ‘নেশন’ ঠিক এক জিনিস নয়, গুরুতর পার্থক্য আছে। [এ নিয়ে চিত্তাকর্ষক আলোচনার জন্য দেখতে পারেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাবীন্দ্রিক নেশন কী?’, ‘রাবীন্দ্রিক নেশন প্রসঙ্গে আরও দু’চার কথা’ (পার্থ ২০০৫) এবং ‘Tagore’s Non-nation’ (Chatterjee 2011)]

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় যুগপৎভাবে ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলা পরিভাষাডিসকোর্সের আওতায় বিচরণ করেন বলে তার ক্ষেত্রে নেশনস্টেট অর্থে জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রবাদকে অদলবদল করে ভাবাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে স্টেট আর নেশনের পার্থক্যটা মনে রাখা জরুরি। সাথে এও মনে রাখা উচিত, এই দুইয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও, নেশন মাত্রই স্টেট নয়; বরং নেশন ও স্টেট সংক্রান্ত সাম্প্রতিক আলোচনাগুলোতে দেখা যাচ্ছে স্টেট তথা রাষ্ট্রই নেশন (জাতি) গঠন করে; এর অন্যথায় নয়: As modern research in nationalism has demonstrated, it was the state that established fixed territories, introduced new cultural practices, and ‘produced’ their nationscontrary to the earlier view that it was pre-existent nations which demanded and eventually obtained their states. (Kaviraj 2010: 54 )

) প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠানো ড্রাফটে ‘নেতি নেতি’ দ্বিরুক্ত হওয়ায় প্রথমে ভাবলাম ভুলজনিত রিপিটেশন কিনা? তার কাছে এই প্রশ্ন রাখতেই তিনি নিম্নোক্ত ক্ল্যারিফিকেশন পাঠালেন: ‘নেতি নেতি’ হলো not this, not that বলার একটা তাত্ত্বিকশৈলী। যেকোনো বস্তুর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথমে এটা নির্ধারণ করা যে বস্তুটি কী নয়। এটা বিশেষ করে কাজে লাগে এমন বস্তু বা তত্ত্বের বিশ্লেষণে যার কোনো positive essence নেই, সার নেই— যেমন আত্ম বা self, অর্থ বা referential meaning ইত্যাদি। বৌদ্ধ দার্শনিকেরা আবার অনেক উপনিষদবাদী চিন্তাবিদরা এই তার্কিকশৈলী ব্যবহার করেছেন reality আর appearance, যথার্থ আর বাস্তবের দৃষ্টিগোচর রূপের বিনির্মাণ করতে।

) ‘Political’-এর বাংলা পরিভাষা হিসেবে রাজনৈতিক/রাজনৈতিকতা দুইই ব্যবহার করার কারণ বিভিন্ন তাত্ত্বিকের আলোচনায় বিশেষ্য ও বিশেষণ হিসেবে ‘political’-এর ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার দেখা যায়। জার্মান দার্শনিক ও জুরিস্ট কার্ল স্মিট ‘political’-কে স্বনির্ধারিত বিশেষ্য হিসেবে দেখতেন। তার চিন্তায় সিদ্ধান্ত/বিধি এবং বিধির ‘ব্যতিক্রম’ সার্বভৌমত্ব ধারণার মূল নির্যাস। তার রাজনৈতিক সম্প্রদায়/জনগোষ্ঠীর ধারণার মূলেও রয়েছে বন্ধু/শত্রুর সুস্পষ্ট পার্থক্যকরণ। স্মিট পলিটিকস তথা রাজনীতির (অর্থাৎ আইন, প্রতিনিধিত্ব ও সরকারের নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকাণ্ড) বিপরীতে পলিটিক্যাল তথা রাজনৈতিকতাকে ব্যাখ্যা করতেন। সমসাময়িক ফরাসি দর্শনও ‘politics’ বনাম ‘political’-এর ভেদ মেনে চলে।

প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় চমৎকার আলোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন ক্লদ লেফোর্ট, জঁলুক ন্যান্সি (ফরাসিতে জঁলুক নঁসি), ফিলিপ্পে ল্যাকোওল্যাবার্থে, আলাঁ বাদিয়্যু ও জ্যাক রঁসিয়ের মতো [ফরাসি উচ্চারণ নিয়ে বেশ একরকমের বিশুদ্ধবাতিকতা আছে। সেজন্য আমি কোনো ঝামেলায় না গিয়ে নামগুলোর উচ্চারণ নির্ণয়ে বন্ধুপ্রতীম শাহীন খানের দ্বারস্থ হয়েছি। তিনি নানাভাবেই আমার মতো অভাজনের ভরসাস্থল হয়ে আছেন। সারোয়ার তুষার] দার্শনিকদের মধ্যে ‘what is political’ প্রশ্নে বিস্তর ভিন্নমত থাকলেও; তাদের প্রত্যেকেই politcal-কে politics, policy, police ইত্যাদি থেকে আলাদা করেই ব্যাখ্যা করেন। উল্লেখ্য, জ্যাক রঁসিয়ে ‘police’ বলতে কেবল দমনমূলক কলকব্জা/প্রতিষ্ঠান কিংবা ফুকোডিয়ান ‘disciplinarization of bodies’ বোঝান না; বরং তার ক্ষেত্রে ‘police’ ক্যাটাগরিটি আরও ব্যাপক বিস্তৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়। For me the police designates not an institution of power but a distribution of sensible within which it becomes possible to define strategies and techniques of power. (Ranciere 2010)

ফলে সাধারণ মানুষ পলিটিকসএর ডোমেইনে সংঘটিত কর্মকাণ্ডকে ‘political’ ধরে নিলেও, উল্লিখিত ডাকসাইটের দার্শনিকেরা মনে করেন politics/political-এর ভিত্তিমূলক পার্থক্য থাকতেই হবে। প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আবশ্যিক বিভাজনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তিনি ‘political’ বর্গটিকে ‘politics’-এর বিপরীতে স্থান দেন না। তিনি মনে করেন না যে নির্বাচন, দল, গণমাধ্যম, আন্দোলন ইত্যাদি রাজনৈতিকতা (political) বিবর্জিত। এই সাক্ষাৎকারেও তিনি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন দর্শনের আয়নায় বাস্তবকে চিনতে চেষ্টা না করে, সাধারণ জীবনে নিহিত তাত্ত্বিক সম্ভাবনাগুলো চিনতে শেখা জরুরি। তিনি কেবল ‘পলিটিক্যাল’এ অভিগম্যতার ক্ষেত্রে দর্শনের(philosophy) বিশেষাধিকারকেই প্রশ্ন করেন না; অধিকন্তু, তিনি দর্শনের ‘priority of the political’ ধারণার আগাপাশতলা তদন্ত করতেও ইচ্ছুক।

সুতরাং, political/politics-এর সুস্পষ্ট পার্থক্যকরণের চেয়ে প্রথমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, “what is political about politics in the first place?” অর্থাৎ, কার্ল স্মিটের বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রথমা ‘political’-কে বিশেষণে ধরে রাখতে চান। প্রথমার বিবেচনায় ‘everything is political’ বলা মূলত রাজনৈতিকতা আর ক্ষমতাকে গুলিয়ে ফেলার ‘যৌক্তিক’ পরিণতি। ফুকোর বরাতে প্রথমা আমাদের জানাচ্ছেন যে, ফুকো কখনোই ক্ষমতা আর রাজনীতিকে একাকার করে ফেলেননি। স্কুল, কলেজ, কারাগার, হাসপাতাল, পাগলাগারদ থেকে শুরু করে বেডরুম পর্যন্ত— ক্ষমতা সর্বব্যাপী। তথাপি, “politics does presume power, but power does not necessarily presume politics. Perhaps the only definition, a minimalist one, that we can have of politics is one kind of orientation toward power, though not necessarily the only kind.” (Banerjee 2020)

এমনকি বাংলাদেশের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রিটিক্যাল তাত্ত্বিক মোহাম্মদ আজমও ‘রাজনীতি’ আর ‘রাজনৈতিকতা’র এক অবধারিত পার্থক্য ধরে নিয়েই আগান। আজমের ভাষ্যে: রাজনীতি’ বলতে বুঝব ক্ষমতার লড়াই, পক্ষপ্রতিপক্ষের সুস্পষ্ট ধারণা, আর সেই ধারণার অনুকূলে সক্রিয়তা। অপরদিকে, রাজনৈতিকতা এক ধরনের চৈতন্য, যা ব্যাপ্ত থাকতে পারে সর্বত্র। ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক জীবনচর্চার যে কোনো অংশই হয়ে ওঠতে পারে রাজনৈতিক, যদি তা রাষ্ট্রক্ষমতা বা জনগোষ্ঠীর রূপরূপান্তরের ব্যাপারে সজাগ থাকে। এই সচেতনতা কেবল সক্রিয়তা আর উচ্চকণ্ঠ ভাষণে প্রকাশ পাবে এমন নয়, বরং শিল্পকলার উচ্চাভিলাষী সব পরীক্ষানিরীক্ষাও ব্যাখ্যাসূত্রে গণ্য হতে পারে রাজনৈতিক বলে…(মোহাম্মদ ২০২০: ৯৫)

এক্ষেত্রে মোহাম্মদ আজম কার্ল স্মিট কিংবা উল্লিখিত ফরাসি দার্শনিকদের মতোই ‘রাজনীতি’ ও ‘রাজনৈতিকতা’র সুস্পষ্ট বিভাজনের পাটাতনেই অবস্থান করেন বলে প্রতীয়মান হয়। ফলে কীভাবে আমরা ‘রাজনৈতিকতা’কে সংজ্ঞায়িত করি কিংবা কীভাবে করা উচিত, তার চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন, শিল্পসাহিত্যসমালোচনার কোন কোন আঙিনা কতটা ‘রাজনৈতিক’ হতে পারছে সেই প্রসঙ্গ। প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, আসলে যেটা মনে রাখা উচিত— রাষ্ট্র, সমাজ, রিলিজিয়ন, অর্থ, শিল্প, যৌনতা বা খেলাধুলা যা কিছুই হোক না কেন— কোনো না কোনো সময়ে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে প্রকট হতে পারে। অর্থাৎ রাজনৈতিক বিষয় আর অরাজনৈতিক (non-political) বিষয় বলে দুটি ভিন্ন স্থায়ীভাব বা আলাদা বর্গ হয় না। কিন্তু যেকোনো বিষয়ের ঠিক কীভাবে রাজনীতিকরণ হয়, সেটা বোঝা প্রয়োজন। রাজনীতিকরণের প্রক্রিয়ার অধ্যয়নই আমাদের বুঝতে সাহায্য করে ‘রাজনৈতিকতা’ বস্তুটা আসলে কী? সেজন্য সবার আগে এই উপলব্ধি প্রয়োজন যে, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রই সবসময় ‘রাজনৈতিক’ নয়।

দ্বিতীয়ত, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায়শই ‘রাজনৈতিকতা’কে আমরা মূলত ‘ক্ষমতা’র সাথে গুলিয়ে ফেলছি। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতি আর প্রসঙ্গে ক্ষমতার প্রতি আমাদের অভিমুখ এবং ক্ষমতার সাথে আমাদের লেনদেন রাজনৈতিকতায় রূপ নেয় বটে; কিন্তু সকলক্ষেত্রে রাজনৈতিকতা আমাদের সকল কর্মলক্ষ্যের একমাত্র উদ্দেশ্য ও ফল নয়। প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিকতাকে ‘ontological priority’ হিসেবে মানতে নারাজ। [This is obviously more a historical question than a philosophical one because it does not presume that there is any one thinga force, an essence, an orientation, a subjectivity, a site that is priori or ontologically political. The political is not just a self-standing noun but an orientation, a qualifier, that is sometimes assumed or worn by subjects, forces, acts and images, irrespective of their origin. What is political becomes so and does not remain so forever. (Banerjee 2020)]

) নৈরাজ্যবাদকে সাধারণত আমাদের এখানে অনেকেই Anarchism-এর বাংলা পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। অনেকে আবার নৈরাজ্যবাদকে এনার্কিজমের বাংলা পরিভাষা হিসেবে ব্যবহারের বিরোধী। সেজন্য আমি প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠানো ড্রাফটে ‘নৈরাজ্যবাদ’এর ব্যবহার দেখে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম: “নৈরাজ্যবাদকে অনেকে একটা পলিটিকাল ফিলোসফি/আইডিয়া হিসেবে দেখে; সেই অর্থে এর একটা সদর্থক তাৎপর্য আছে, এখানে আপনি কি ‘বিশৃঙ্খলা’ অর্থে বোঝালেন?” বলা বাহুল্য, নৈরাজ্যবাদকে আমি এনার্কিজম ধরে নিয়েই প্রশ্নটা করেছিলাম।

এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে লিখে পাঠালেন: “এটা মুশকিল প্রশ্ন। বিশৃঙ্খলা তো বটেই, তার থেকে বড় কথা হলো পলিটিকসএর কোনো foundation নেই, এই ভয়টা। রাজনীতি ক্ষমতা অর্জনের একটা কৌশল মাত্র, তাই নৈরাজ্য বলছি। অধ্যায়টায় আমি দেখাচ্ছি যে কূটনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কূটনীতিকৌশলকে রাজনীতিদর্শন বা political philosophy’র আওতায় আনা আর বাঁধার চেষ্টা করা হচ্ছে। নয়তো কূটকৌশল একধরনের নৈরাজ্যবাদের দিকে চলে যাচ্ছে। তাই চাণক্যকে political philosopher বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে বিশ শতকে ভারতবর্ষে, ঠিক যেমন Machiavelli-কে ইউরোপে। এরা নিজেরা কিন্তু নিজেদের দার্শনিক বলে কখনোই পরিচয় দেননি। এরা নিজেদের স্রেফ রাজনীতিজ্ঞ বলে ভেবেছেন। চাণক্য নীতিশাস্ত্র আর অর্থশাস্ত্রের প্রবক্তা— যেটা দর্শন বা philosophy’র থেকে একেবারে আলাদা অনুশাসন।

সে সময়ে philosophy-কে আন্বীক্ষিকী বলা হতো, যার একটা উল্লেখ আমরা অর্থশাস্ত্রে পাই। Philosophy দিয়ে রাজনীতিকে বাঁধার এই প্রচেষ্টাটা আধুনিকতার অঙ্গ। রাজনীতিকে একটা foundational imperative বা মূল অনুজ্ঞা হিসেবে দেখানো এটার উদ্দেশ্য। এভাবে একটু বিশদ করলে হয়তো কথাটা বোঝা যায়। এটাও বলা যায় যে এখানে ‘নৈরাজ্য’ শব্দটা ভারতের প্রাকআধুনিক নীতিশাস্ত্রের আভিধানিক অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে, পশ্চিমা দর্শনের ‘anarchism’ শব্দটির অনুবাদ হিসেবে নয়।”

) বর্তমানে আমরা ‘আধুনিকতা’ ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন, প্রগতি, সভ্যতা, পুঁজিবাদ (পুঁজির পুঞ্জীভবন যার প্রাণভোমরা), রাইটস (অধিকার) ধারণার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যক্তি বলতে যা বুঝি; তা বিশেষভাবে পশ্চিম কর্তৃক নির্মিত প্রভাবশালী ডিসকোর্সের শাসন। লাতিন আমেরিকার বিঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক ওয়াল্টার মিনালুর অনুসরণে একে “পশ্চিমা আধুনিকতা” বলাই যুক্তিযুক্ত; ঔপনিবেশিকতা যার আবশ্যিক অন্যমুখ।

এশিয়া, আফ্রিকা, আরব, চীন ও লাতিন আমেরিকায় জ্ঞানবিজ্ঞানপ্রযুক্তি, আধুনিকতা ও র‍্যাশনাল থিংকিং, অতিপ্রাকৃত বর্জিত চিন্তাপদ্ধতি (secularization of thought), ইন্ডাস্ট্রি বাণিজ্যের বিকাশের ইতিহাস বহু বহু পুরাতন। এটা কিন্তু পশ্চিমের ‘আধুনিকতা’কে মান্য ধরে এর সাথে পাঞ্জা কষে বা একে নিজেদের পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করে ‘আমাদের আধুনিকতা’ খোঁজার মামলা নয়। এটা খোদ ‘আধুনিকতা’ ও তৎসংশ্লিষ্ট ধারণার মূলগত আদিকল্প থেকে বের হয়ে, নতুন আদিকল্প নির্মাণের মাধ্যমে জ্ঞানতাত্ত্বিক পুনর্গঠনের প্রসঙ্গ।

পৃথিবী বিভিন্ন জনপদের উপর ঔপনিবেশিক নির্যাতন, লুণ্ঠন ও আধিপত্যবিস্তারকারী ইউরোপের ইতিহাস কেবল এশিয়া, আরব, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার ভূমি দখল ও এসব অঞ্চলের মানুষকে জবরদস্ত নির্যাতন, দাসে পরিণত করার ইতিহাসই নয়; আধুনিক ঔপনিবেশিক ইউরোপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে এর বৌদ্ধিকজ্ঞানগতশিল্পের বিকাশে এশিয়া, আফ্রিকা, আরব ও লাতিনের অমোচনীয় ঋণ। [বিস্তারিত দেখুন (Nigam 2020), বিশেষত দ্বিতীয় অধ্যায়। এছাড়াও দেখুন (Abu-Lughod 1989; Mignolo 2002, 2011, 2018; Quijano 2000, 2007)]

) বোধিচিত্তে গত ২রা মে, ২০২০ তারিখে আশিল এমবেম্বের প্রবন্ধ ‘The Universal right to breathe’-এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ‘শ্বাস নেয়ার চিরন্তন অধিকার’ শিরোনামে এই প্রবন্ধের চমৎকার একটি অনুবাদ করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। এই অনুবাদেই আমরা Necro-Politics-এর বাংলা পরিভাষা হিসেবে ‘মারণরাজনীতি’র ব্যবহার প্রথম লক্ষ করি। Necro-politics-এর বাংলা পরিভাষা হিসেবে ‘মারণরাজনীতি’ শব্দবন্ধনীর প্রবক্তা আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পূর্বক আমরা ‘মারণরাজনীতি’ শব্দবন্ধনী ব্যবহার করছি।

) Govermentality বর্গটির হালের ব্যবহার ফুকোডিয়ান। অর্থাৎ ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর তত্ত্বায়নের পর আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্রের একটি অন্যতম প্রধান সিগনেচারে পরিণত হয়েছে গভার্নমেন্টালিটি। আধুনিক ক্ষমতা আর পূর্বেকার রাজা বা সম্রাটদের মতন কেবল বলপ্রয়োগ বা জবরদস্তির মাধ্যমে টিকে থাকে না। আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্র শাসিতের কাছে ন্যায্যতা আদায় করার দিকেই বেশি মনোযোগী (তাই বলে আধুনিক রাষ্ট্রকে সার্বভৌম ক্ষমতাবিবর্জিত নখদন্তহীন কোনো সাধুপ্রতিষ্ঠান মনে করার কোনো কারণ নেই)। এজন্য মিশেল ফুকো আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্রকে বায়োপলিটিকস তথা জৈবরাজনীতি ও গভার্নমেন্টালিটি এই দুই বর্গে ধরতে চেয়েছেন। বলাই বাহুল্য, একদা উপনিবেশিত [এমনকি আজকাল পশ্চিমের মেট্রোপলিটন রাষ্ট্রেও] উত্তরঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহকে বায়োপলিটিকস ও গভার্নমেন্টালিটির ছকে ব্যাখ্যা করার বেশকিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। বায়োপলিটিকসকে ছাপিয়ে আশিল এমবেম্বে’র নেক্রোপলিটিকস এবং গভার্নমেন্টালিটিকে ছাপিয়ে প্রথমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডেভেলপমেন্টালিটি তথা উন্নয়নতান্ত্রিকতা আদিকল্পে মোড় নেয়া এই সীমাবদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

গভার্নমেন্টালিটির ক্ষেত্রে ‘শাসনপ্রণালী’, ‘প্রশাসনিকতা’, ‘শাসকতা’ ইত্যাদি নানা পরিভাষা ব্যবহার করার চল আছে। তন্মধ্যে ‘প্রশাসনিকতা’ শব্দটি বিপুলভাবে ব্যবহার করেন সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (পার্থ ২০০৫, ২০২১)। গভার্নমেন্টালিটি বলতে যেহেতু কেবল শাসন করার ধরন কিংবা বৈশিষ্ট্যগত প্রকরণ বোঝায় না; বরং এর সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক দ্যোতনা আছে। সুতরাং, ‘প্রশাসনিকতা’ পরিভাষাটিকেই অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়।

) Antisocial Media: How Facebook Disconnects Us and Undermines Democracy শীর্ষক সিভা ভৈদ্যনাথানের গুরুত্বপূর্ণ বইটির হদিস পাই বন্ধু সহুল আহমদের কাছে। এ নিয়ে সহুল আহমদের আলোচনার জন্য দেখুন (সহুল ২০২১)

হদিশ:

আদিত্য নিগাম; “তত্ত্ব করা’র মানে সবার আগে আমাদের নিজেদের ইতিহাসকে তত্ত্বের দিক থেকে বোঝা”; সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: সারোয়ার তুষার; অরাজ,২০২১
https://www.auraj.net/aditya-nigam/5615/

পার্থ চট্টোপাধ্যায়; প্রজা ও তন্ত্র; অনুষ্টুপ, কলকাতা, ২০০৫।
—; ‘
ইতিহাসের উত্তরাধিকার’, ইতিহাসের উত্তরাধিকার, পঞ্চম মুদ্রণ, প্রথম সংস্করণ, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১৫।
নাগরিক; অনুষ্টুপ, কলকাতা, ২০২১।

মোহাম্মদ আজম; কবি ও কবিতার সন্ধানে; কবিতাভবন, চট্টগ্রাম, ২০২০।

সহুল আহমদ; “নাগরিক আন্দোলন: কিছু সমসাময়িক পর্যালোচনা”; শুদ্ধস্বর, ২০২১
https://cutt.ly/cQJ8gQv

Abu-Lughod, Janet L. Before European Hegemony: The World System A.D. 1250–150. New York and Oxford: Oxford University Press, 1989.

Anderson, Warwick. Colonial pathologies: American tropical medicine, race, and hygiene in the Philippines (original 1st edition). Durham NC: Duke University Press, 2006.

Anderson, W, and Soto Laveaga, G. “Decolonizing Histories in Theory and Practice”. History and Theory 59 no. 3 (September 2020): 369-375.
https://doi.org/10.1111/hith.12164

Anderson, W and Lindee, S. “Pacific Biologies: How Humans Become Genetic”. Historical Studies in the Natural Sciences 50 no. 5 (November 2020): 483–497.
https://doi.org/10.1525/hsns.2020.50.5.483

Anderson, Benedict. Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism, London: Verso Books, 1983.

Attwood, Bain. “In the Age of Testimony: The Stolen Generations Narrative, ‘Distance,’ and Public History”; Public Culture 20 no. 1 (1 January 2008): 75–95. https://doi.org/10.1215/08992363-2007-017

Banerjee, Prathama. Politics of Time: “Primitives” and History-Writing in a Colonial Society. Delhi: Oxford University Press, 2006.
—“Writing the Adivasi: Some historiographical notes”.
The Indian Economic & Social History Review 53 no. 1 (2006): 131-153.
—“State (and) violence”.
Seminar 691 (March 2017).
https://www.india-seminar.com/2017/691/691_prathama_banerjee.htm
—: “The Abiding Binary: The Social and the Political in Modern India”. In South Asian Governmentalities: Michel Foucault and the Question of Postcolonial Orderings. Edited by S. Legg & D. Heath, 81-105. Cambridge: Cambridge University Press, 2018.
Elementary Aspects of the Political: Histories from the Global South, Durham and London: Duke University Press, 2020.

Banerjee, Prathama; Nigam, Aditya and Pandey, Rakesh. “The Work of Theory: Thinking across Traditions”. Economic & Political Weekly LI no. 37 (2016): 42-50.

Bigo, Didier. “Globalized-In-Security: The Field and the Ban-opticon”. In Translation, Biopolitics, Colonial Difference. Edited by Noki Sakai and Jon Solomon, 109-56. Hongkong: Hongkong University Press, 2006.

Chakrabarty, Dipesh. The Crises of Civilization: Exploring Global and Planetary Histories. New Delhi: Oxford University Press, 2018.
Climate of History in a Planetary Age, Chicago: Chicago University Press, 2021.

Chatterjee, Partha. Politics of the Governed: Reflections on Popular Politics in Most of the World. New York: Columbia University Press, 2004.
Lineages Of Political Society, New York: Columbia University press, 2011.

Das, Veena. Life and Words: Violence and the Descent into the Ordinary, Berkeley: University of California Press, 2007.

Ghosh, Amitav. The Great Derangement: Climate Change and the Unthinkable, London: Panguin Books, 2016.

Guha, Ranajit. Dominance without Hegemony: History and Power in Colonial India; New Delhi: Oxford University Press, 1998.

Ingole, Anagha. Caste Panchayats and Caste Politics in India. Singapore: Palgrave Macmillan, 2021.

Kaviraj, Sudipta. The trajectories of the Indian State: Politics and Ideas. Bengalore: Permanent Black, 2010.

Mbembe, Achille. Necro-politics, Durham and London: Duke University Press, 2019.

Mignolo, Walter. ‘Geopolitics of Knowledge and the Colonial Difference’. South Atlantic Quarterly 101, No. 1 (Winter 2002): 57–96.
The Darker Side of Western Modernity: Global Futures, Decolonial Options, Durham and London: Duke University Press, 2011.
—“Decoloniality and Phenomenology: The Geopolitics of Knowing and Epistemic/Ontological Colonial Differences”.
The Journal of Speculative Philosophy 32 No. 3 (Special issue with the Society for Phenomenology and Existential Philosophy) (2018): 360– 387.

Mitchell, Timothy. Rule of Experts: Egypt, Techno–politics, Modernity. Berkeley: University of California Press, 2002.

Nigam, Aditya. Decolonizing Theory: Thinking Across Traditions, New Delhi: Bloomsbury India, 2020.

Papacharissi, Zizi. Affective Publics: Sentiment, Technology, and Politics, ed. 1st. New York: Oxford University Press, 2014.

Posel, Deborah. “History as Confession: The Case of the South African Truth and Reconciliation Commission”. Public Culture 20 no. 1 (2008): 119–141.
https://doi.org/10.1215/08992363-2007-019

Quijano, Anibal. “Coloniality and Modernity/Rationality”, Cultural Studies 21, no. 2–3 (2007): 168–178.
(“ঔপনিবেশিকতা ও আধুনিকতা/যুক্তিবাদিতা” শিরোনামে প্রবন্ধটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বোধিচিত্তের ওয়েবসাইটে। লেখাটি পড়ার জন্য লিংক অনুসরণ করুন)
—“Coloniality of Power, Eurocentrism and Latin America”, Nepantla: Views from the South 1 no. 3 (2000): 533–580.

Ranciere, Jaques. Dissensus: On Politics and Aesthetics. Trans. Steven Corcoran. New York: Continuum International Publishing Group, 2010.

Runia, Eelco. “Presence”, History& Theroy, 45 no. 1 (2006): 1-29.

Sloterdjik, Peter. The Art of Philosophy: Wisdom as Practice. Trans. Karen Margolis. New York: Columbia University Press, 2012.

Vaidhyanathan, Siva. Antisocial Media: How Facebook Disconnects Us and Undermines Democracy; New York: Oxford University Press, 2018.

Yuk Hui. The Question Concerning Technology in China. An Essay in Cosmotechnics. Falmouth, UK: Urbanomic, 2016.

Yuk Hui. “On Technodiversity”. Interview by Anderson Dunker. Los Angeles Review of Books. June 9, 2020.
https://www.lareviewofbooks.org/article/on-technodiversity-a-conversation-with-yuk-hui/

সারোয়ার তুষার

প্রথমা বন্দ্যোপাধায়