- অনুবাদ: বখতিয়ার আহমেদ
আজকের এই বক্তৃতায় কি বলব ভাবতে গিয়ে মনে হল চীনের কথা না বলাটা অন্যায় হয়ে যাবে। জন্ম ও পৈত্রিক সূত্রে আমি একজন আমেরিকান নাগরিক এবং বাকি জীবনটুকু নিজের এই দেশেই অতিবাহিত করতে চাই। কিন্তু আমার লেখালেখির যাত্রা আমেরিকান উপন্যাসকে উপজীব্য করে শুরু হয়নি বরং চীনের উপন্যাসই আমার লেখার আঙ্গিক গড়ে দিয়েছে। গল্পের সাথে প্রথম পরিচয়, গল্প বলা ও লিখতে শেখা ইত্যাদি সব বিষয়েই চীনই আমার মহান গুরু। কাজেই আজকের এই দিনে চীনের কথা উল্লেখ না করাটা হবে কৃতঘ্নতার সামিল। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটি কারণে এই আলোচনা আমি সীমাবদ্ধ রাখব চীনের উপন্যাস প্রসঙ্গে। এই একান্ত সিদ্ধান্তটির পেছনে অন্য কারণটি হচ্ছে আমি বিশ্বাস করি চীনের উপন্যাস, পশ্চিমা উপন্যাস আর উপন্যাসিকদের জন্য যে অনন্য দ্যূতি বহন করে তা আমি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারব, নিজের উপর এই আস্থা নিয়েই শুরু করছি।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/07/PearlS.BuckPainting.jpg)
আমি যখন বলি চীনের উপন্যাস, তখন আমি চীনের সম্পূর্ণ নিজস্ব উপাদান নির্ভর উপন্যাসগুলোকেই বোঝাই, সংকরগুলোকে নয়। এই সংকর উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ে বিদেশী ধারায় প্রভাবিত চীনের আধুনিক লেখকদের আত্ম-বিস্মৃত উপন্যাসগুলো।
উপন্যাস কখনই চীনে একটি শিল্প হিসেবে বিবেচিত হয়নি, চীনা উপন্যাসিকেরাও কখনো নিজেদের শিল্পী হিসেবে দেখেননি। চীনা উপন্যাস, এর ইতিহাস, পরিধি আর মানুষের হৃদয়ে এর অবস্থান, সবকিছুকেই বিবেচনা করতে হবে এই সত্যটির আলোকে। নিঃসন্দেহে এই সত্য আপনাদের কাছে অভিনব, পাশ্চাত্যের যে আধুনিক পণ্ডিতেরা উপন্যাসকে একটি উদার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন তাদের জন্য তো বটেই।
চীনে সবসময়ই শিল্প আর উপন্যাস দুটি আলাদা বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সেখানে শিল্প হিসেবে সাহিত্য চর্চার ব্যাপারটি ছিল ক্ষমতাবান বিদ্বানদের একচ্ছত্র দখলে। তারা একে অপরের জন্য শিল্প সৃষ্টি করতো নিজস্ব নিয়মে এবং উপন্যাসের কোন জায়গা সেখানে ছিল না। কিছু সনাতন স্বেচ্ছাচারী আইন দিয়ে তারা দখল করে রেখেছিল দর্শন, ধর্ম আর সাহিত্যের সবকিছু, শিক্ষার সব উপকরণই ছিল তাদের একচ্ছত্র দখলে। ফলে লেখাপড়াও জানতো শুধু তারাই। এই ক্ষমতাবান বিদ্বানদের কোন কোন ক্ষেত্রে সম্রাট পর্যন্ত ভয় পেতেন আর একারণেই তাদের নিজেদের কাজে নিজেদের পাকবদ্ধ রাখবার একটি পথও তিনি বের করে ফেলেন, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জনের একমাত্র পথ হিসেবে কিছু ভয়াবহ কঠিন পরীক্ষার প্রবর্তন করেন। এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতির কাজটি একজন মানুষের সমস্ত জীবন আর চিন্তা নিঃশেষ করবার জন্য যথেষ্ট ছিল। ফলে সে সময় চীনের এই পণ্ডিতদের দেখা গেল বর্তমান সময় আর তার গতি প্রকৃতি বুঝবার জন্য দিন রাত্রি নাক ডুবিয়ে মুখস্থ করছে সনাতন আর মৃত অতীত। আর সেই অতীত ঘেটেই তারা তৈয়ার করছে তাদের শিল্পের নিয়মগুলো যেখানে উপন্যাসের কোন জায়গা নেই। ফলে চোখের সামনে প্রাকৃতজনদের মাঝে উপন্যাসের জন্মটি এই বিদ্বানেরা দেখতে পেল না, সাহিত্যকে এক বায়বীয় শিল্প জ্ঞান করে তারা সব বসে রইল নির্জীব অতীতেই। মানুষদের প্রতি পণ্ডিতদের এই অবজ্ঞার প্রত্যুত্তরে মানুষের মাঝ থেকে এসেছে এই পণ্ডিতদের নিয়ে অসংখ্য রঙ্গ-কৌতুক, তার একটির উদাহারণ দেয়া যাক— একদিন জঙ্গলের পশুদের একটি দল শিকারে যাওয়ার আগে একটি পাহাড়ের পাদদেশে মিলিত হল। সেখানে সিদ্ধান্ত হল যে দিন শেষে যে যা শিকার পাবে তা নিয়ে এই স্থানটিতে এসে মিলিত হবে এবং শিকার সকলে মিলে ভাগ করে নেবে। দিন শেষে দেখা গেল একমাত্র বাঘই কোন শিকার ছাড়া ফিরে এসেছে। সবাই অবাক হয়ে তার কাছে কারণ জানতে চাইলে সে বিমর্ষভাবে জানাল “ভোর বেলায় আমি এক স্কুল বালকের দেখা পেয়েছিলাম কিন্তু মনে হল তার কচি মাংস তোমাদের মুখে ঠিক রুচবে না। দুপুর নাগাদ ঘোরাঘুরি করে দেখা পেলাম এক যাজকের, কিন্তু তাকেও আমি ছেড়ে দিলাম কারণ তোমরা তো জান বাতাস ছাড়া আর তাদের মধ্যে সারবস্তু কিছু থাকে না। কিন্তু তাকে ছেড়ে দেওয়ার পর সারাদিন আর কারো দেখা মেলেনি। যখন সন্ধ্যা নেমে আসছে তখন দেখলাম এক বিদ্বান এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে। তাকে দেখে আমি পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়লাম কারণ এই বিদ্বানদের শুকনো জিরজিরে হাড় চিবুতে গিয়ে আবারো নিজের দাঁতগুলো ভাঙ্গার কোন মানে হয় না”।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/07/Three-white-hair-old-men-Chinese-Huang-Yuming.jpg)
শিল্পী: হুয়াং ইউমিং
সূত্র: পিনটারেস্ট
বিদ্বানেরা শ্রেণী হিসেবে চীনের মানুষদের কাছে এরকমই হাস্যরসের পাত্র ছিল। তাদের লেখা উপন্যাসগুলোতে এদের খুঁজে পাওয়া যাবে সর্বদা একই রূপে, যেমনটি এদের বাস্তব জীবনে দেখা যায়। একই বিষয়ের বারংবার চর্বণ এবং চর্চা এদের যেমন চেহারায় একরকম করে দিয়েছিল তেমনি এক রকম করে দিয়েছে চিন্তার ক্ষেত্রেও। পশ্চিমে এধরনের কিছু ব্যক্তি মানুষ দেখা গেলেও একটি বিশেষ সামাজিক শ্রেণী হিসেবে এদের পাওয়া যাবে না যেরকমটি চীনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই। এখানকার সব জায়গাতেই তাদের উপস্থিতি একই রকম— ক্ষীণ একটি শরীরের উপর বিশাল একটি মাথা, ঝুলে পড়া মুখ, মোটা চশমার আড়ালে ছোট সরল চোখ, উচুঁ কন্ঠস্বর যা দিয়ে অনর্গল শাস্ত্রকথা বের হচ্ছে যেগুলোর কোন আবেদন তার নিজের কাছে ছাড়া অন্যত্র নেই। জ্ঞানগর্ভ আলোচনার জায়গা ছাড়া এদের সাধারণত অন্য কোথায় দেখা যেত না, বেশিরভাগ সময়ই তারা কাটাত কিছু মৃত সাহিত্য পড়ে আর তার মতই কিছু লিখবার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। অভিনব ও মৌলিক সব কিছুকেই তারা ঘৃণা করত কারণ এগুলো তাদের মুখস্থ ছকের কোনটির সাথেই মিলত না। আর না মিললেই তারা নিশ্চিতভাবে ধরে নিত এগুলো ভাল কিছু নয়। যখন তারা কোন কিছু দেখিয়ে বলত “এই হচ্ছে শিল্প” তখন তারা মনে করত এই বস্তুটি এখানে ছাড়া আর কোথাও নেই, তাদের স্বীকৃতি ছাড়া কোথাও কোন শিল্প থাকতে পারে না। আর যেহেতু তাদের এই ছকের সাথে কোন ভাবেই উপন্যাসকে মেলানো যায় না কাজেই তাদের সাহিত্যে উপন্যাস বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল না।
চীনের খ্যাতনামা সাহিত্য সমালোচক ইয়াও হাই ১৭৭৬ সালে বিদ্যমান সাহিত্যিক প্রকরণগুলোর একটি তালিকা প্রস্তুত করেন যার মধ্যে ছিল প্রবন্ধ, সরকারি নথিপত্র, জীবনী, সমাধিফলক, কবিতা, শোকগাঁথা এবং ইতিহাস। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এই তালিকায় উপন্যাস অনুপস্থিত যদিও এই সময়ের আগেই চীনের উপন্যাস গণমানুষের মাঝে জন্ম নিয়ে, প্রাকৃত জীবনের রূপ-রসে পরিপুষ্ট হয়ে এক অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত। ইয়াও হাইয়ের আগে ১৭৭২ সালে প্রতাপশালী সম্রাট চাই এন লুং এর নির্দেশে আরেকটি সাহিত্য কোষ তৈরী করেন সেসময়ের আরেক খ্যাতিমান বিদ্বান সু কু চুয়েন সু। উপন্যাসের কোন উল্লেখ সেখানেও যথারীতি নেই।
উপন্যাসকে বিদ্বানদের সাহিত্য জ্ঞান না করা চীনের উপন্যাস আর উপন্যাসিকদের জন্য আর্শীবাদই বয়ে এনেছিল। এর ফলে উপন্যাস সবসময় তাদের সাহিত্য দর্শন, সমালোচনা, চাপিয়ে দেয়া শিল্প সংজ্ঞা, প্রকাশের প্রথাগত ভঙ্গিমা ও কৌশল, কোনটি শিল্প আর কোনটি নয় এই কূটতর্ক ইত্যাকার বেড়াজালের বাইরে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে থাকল নিজ চারণ ক্ষেত্র প্রাকৃতজনদের নিয়ে। এই উপন্যাস পরিপুষ্ট হতে থাকল নিজ মাটির সোঁদা গন্ধে, সাধারণ মানুষের প্রাকৃত জীবনে, তাঁদের জীবনের অন্তর্গত আলোকচ্ছটায় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তার মাঝে। রক্ষা পেল পণ্ডিতদের শিল্প চর্চার হিম-কুহেলিকার হাত থেকে। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় আমেরিকান কবি এমিলি ডিকিনসন একবার লিখেছিলেন “প্রকৃতি এক রহস্যের আধার, আর শিল্প হচ্ছে সেই আধার যা রহস্যময় হতে চায়”। তিনি লিখেছিলেন,
“প্রকৃতি হল তাই যা আমরা দেখতে পাই
প্রকৃতি হল তাই যা আমরা শুনতে পাই
হায়! আমাদের প্রকাশের কোন শিল্প নেই
তার সারল্যের সামনে এতই তুচ্ছ
আমাদের অভিজ্ঞান।”
চীনের সাহিত্য পণ্ডিতেরা যদি উপন্যাসের এই জন্ম আখ্যান জানতেন আরও বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতেন একে সাহিত্য হিসেবে চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মাঝে মাঝে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তরুণ সম্রাটদের কেউ কেউ উপন্যাস পড়ে আনন্দ পাওয়ায় এটি আর হল না, রাজ আগ্রহের চাপে পড়ে তাদের কখনও কখনও চোখ মেলে তাকাতে হল অন্ত্যজদের এই সৃষ্টিগুলোর দিকে। একারণেই বা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন উপন্যাসের প্রশ্নে এবার পণ্ডিতেরা একেবারে খড়গহস্ত হয়ে উঠলেন এবং নিজেদের প্রথম খড়গ হিসেবে আমদানি করলেন একটি প্রত্যয় “সামাজিক তাৎপর্য”। লম্বা লম্বা প্রবন্ধ লিখে তারা জানালেন উপন্যাস শিল্প নয় কারণ এর কোন সামাজিক তাৎপর্য নেই। আধুনিক কালের সাহিত্য পাড়ার মানুষেরা সামাজিক তাৎপর্য কথাটি সম্প্রতি শিখলেও চীনের পণ্ডিতেরা এটির ব্যবহার করে আসছেন এক হাজার বছর আগে থেকেই। আজকের আধুনিকদের মতই তারা সেসময় বলেছেন উপন্যাসকে শিল্প হয়ে উঠতে হলে আগে তাকে যেটি অর্জন করতে হবে তা হল সামাজিক তাৎপর্য।
এই যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রাচীন চীনের এই বিদ্বানেরা উপন্যাস সম্পর্কে যে উপসংহারে পৌঁছুলেন সেটি হচ্ছে:
সাহিত্য হচ্ছে শিল্প
সব শিল্পেরই সামাজিক তাৎপর্য আছে
এই বইগুলোর কোন সামাজিক তাৎপর্য নেই
কাজেই এগুলো সাহিত্য হতে পারে না
এভাবেই উপন্যাস চীনে সাহিত্য হয়ে উঠেনি দীর্ঘদিন।
এরকম একটি ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠেছি আমি নিজেও। আমিও বিশ্বাস করতাম প্রকৃত সাহিত্যের সাথে উপন্যাসের কোন যোগ নেই। বিদ্বানেরা এই রকমটিই শিখিয়েছিলেন আমাদের। আমাকে আরো শিখানো হয়েছিল সাহিত্যে নান্দনিকতা যুক্ত করতে পারেন শুধুমাত্র বিদগ্ধ মানুষেরাই। জীবনের গভীরতর উৎস থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঝর্ণাধারার মতো প্রতিভাগুলোকে ঠেকিয়ে রাখতেই যেন বিদ্বানদের মস্তিষ্ক এইসব আইন-কানুনের জন্ম দিত। প্রতিভা, তা সে যে মাপেরই হোক না কেন, তার ভূমিকা সবসময় স্রোতস্বিনীর মত, অন্যদিকে শিল্প, আধুনিক বা ধ্রুপদী যাই হোক না কেন, তার ভূমিকা ক্ষুধিত অবয়বের যার উপর স্রোতস্বিনীর জল নেমে আসে অঝোর ধারায়। চীনের উপন্যাসও সেই স্রোতস্বিনী নদীর মতই যার নেমে আসাকে স্বাগত জানায় প্রকৃতির পাথর আর বৃক্ষেরা, প্রাকৃত মানুষেরা তার জল পানে শীতল হয়, ছায়া আর বিশ্রাম পায় তার আশ্রয়ে।
চীনে তাই উপন্যাস মাত্রই ছিল সাধারণ মানুষের মাঝ থেকে উঠে আসা এক অদ্ভুত সৃষ্টি, এ ছিল তাদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ। এই উপন্যাসের ভাষাও ছিল তাদের নিজস্ব রীতির, সাহিত্য বা পণ্ডিতদের ভাষা ওয়েন লি নয়। সনাতন এই ওয়েন লি ভাষাটি হচ্ছে আজকের ইংরেজদের জন্য যেমন চসারের ধ্রুপদী ইংরেজি তেমনি এক ভাষা যদিও প্রহসন হচ্ছে এই যে ওয়েন লিও একসময় প্রাকৃত ভাষা হিসেবেই চালু ছিল। কিন্তু পণ্ডিতেরা এ ভাষা গ্রহণ করবার পর আর প্রাকৃত ভাষার প্রাণময় গতি প্রবাহের সাথে কোন যোগ রক্ষা করেননি। একটা প্রাকৃত ভাষাকে সাহিত্যের সাঁড়াশিতে চেপে তারা বসে রইলেন, অন্য দিকে সাধারণ মানুষের ভাষা নিজস্ব প্রাণময়তার জোরে তাদের ছাড়িয়ে গেল বহু যোজন দুরে। কাজেই চীনা উপন্যাস হয়ে দাঁড়াল পেই হুয়া বা সাধারণ মানুষের সরল কথকতা। সহজ পাঠ্য এই উপন্যাসগুলোর সহজ গতিময়তা দেখে পণ্ডিতেরা মুখ বাঁকিয়ে বললেন, ওতে প্রকাশের কোন কারুকাজ নেই।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/07/dunhuang.jpg)
মুখ বাঁকানো এইসব পণ্ডিতদের বিপরীতে আমি এখন বলতে চাই কিছু ব্যতিক্রমী বিদ্বানদের কথা যারা ভারতবর্ষ থেকে মহান বুদ্ধের বাণী বয়ে এনেছিলেন চীনে। পশ্চিমে দীর্ঘদিন পিউরিটানিজম ছিল উপন্যাসের সবচেয়ে বড় শত্রু। সে তুলনায় প্রাচ্যের বুদ্ধ অনুসারীরা ছিলেন অনেক বেশি প্রজ্ঞাবান। ঐতিহাসিক কাল বিচারে চীনের ষষ্ঠ রাজবংশের সময়ে তারা চীনে এসে দেখলেন সাহিত্য এখানে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বহু দুরে আটকে আছে প্রথাবাদিতার বেড়াজালে। চীনের সনাতন সাহিত্যিকেরা তখন নিজেদের রচনাগুলোকে ঘষে মেজে আরো বেশি রীতিসিদ্ধ করে তুলবার কাজে ব্যতিব্যস্ত, যে কোন সৃজনশীল প্রয়াসকে অসাহিত্য আখ্যা দিয়ে খারিজ করে রক্ষা করছেন সাহিত্যের সতীত্ব। এরকম একটি শুচিবাদী সময়েই হৃদয়ে অহিংসার বাণী নিয়ে এগিয়ে এলেন বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা যাদের অনেকেই এসেছেন ভারত থেকে, কেউ কেউ চীনেরই মানুষ। তারা সনাতন শুদ্ধবাদীদের খোলাখুলি জানালেন প্রচলিত সাহিত্যের নিয়ম কানুন ভাঙ্গা তাদের উদ্দেশ্য নয়, তারা শুধু নিজেদের আত্মিক অর্জনটুকু খুব সাধারণ ভাষায় গণমানুষের সামনে তুলে ধরতে চান। ধর্ম প্রচারের জন্য তারা বেছে নিলেন সাধারণ ভাষা, যে ভাষায় লেখা হয় উপন্যাস। অন্যদিকে গল্পের প্রতি এই মানুষদের অমোঘ আকর্ষণ লক্ষ্য করে বাণী প্রচারের জন্য তারা গল্পের আদলটিকেই বেছে নিলেন। বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে চীনে সবচেয়ে বেশি খ্যাত বই ফাহ সু চিং এর ভূমিকায় লেখা আছে “যখন আমরা ঈশ্বরের কথা বলি, সবচেয়ে সহজ শব্দগুলি বেছে নিই বাহক হিসেবে”। এই কথাটিকেই আমরা চীনা উপন্যাসিকদের মৌল নীতি হিসেবে বিবেচনা করতে পারি যাদের কাছে ঈশ্বর মাত্রই মানুষ আর সব মানুষেরাই ঈশ্বর।
চীনের উপন্যাসগুলো লেখা হতো প্রথমত গণমানুষের বিনোদনের জন্য। এখানে বিনোদন বলতে আমি শুধুমাত্র হাস্যরসের কথা বলছি না যদিও চীনের উপন্যাসগুলোতে এ জিনিসেরও সাক্ষাৎ মেলে অজস্র পরিমাণে। আমি বিনোদন বলছি এই অর্থে যে তা মানুষের সামগ্রিক মনযোগ আকর্ষণ করতে পারত। এই বিনোদন তাদের কাছে জীবনের ছবি তুলে ধরে আমন্ত্রণ জানাত তার অর্থ অনুসন্ধানে। নিজেদের জীবনেরই সহজ সরল প্রকাশের মধ্য দিয়ে তারা শিল্পের দুর্বোধ্য নিয়মের বাইরে এসে আলোকময় প্রাণ সঞ্চার ঘটাত হৃদয়ে। বৌদ্ধরাও এই সব মানুষদের ঈশ্বরের সন্ধান জানাতে এসে দেখল এই মানুষেরা নিজেদের আটপৌরে জীবনেই ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে ভালবাসে।
কিন্তু তারপরও চীনের উপন্যাস প্রাকৃত ভাষায় লেখা হওয়ার আসল কারণ হচ্ছে যাদের জন্য এই উপন্যাস লেখা তাদের বেশির ভাগেরই কোন অক্ষর জ্ঞান না থাকা। কথ্য ভাষায় লেখা এই উপন্যাসগুলো কেউ একজন পড়ে শোনালেই সবাই তা বুঝতে পারত সহজেই। দেখা যেত যে প্রায় দুই শত মানুষের কোন গ্রামে একজন মাত্র মানুষ আছে যে পড়তে পারে। ছুটির দিনগুলোতে বা সন্ধ্যার অবসরে পিদিমের আলোয় তাকে ঘিরে বসত অসংখ্য মানুষ আর সে পড়ে শোনাতো উপন্যাস। কখনো কখনো একজনের টুপিতে সবাই সাধ্য অনুযায়ী পয়সা ফেলত পাঠকের জন্য যাতে এই মোহনীয় কাহিনীগুলো নিরন্তর পড়ে যায় পাঠক। একসময় দেখা যেত শুধু এই গল্প পড়ে শোনানই কারো কারো পেশা হয়ে যেত। এই গল্প পাঠকদের আবার শ্রোতা ধরে রাখবার প্রয়োজনেই নিত্য নতুন গল্পের দরকার পড়ত। কিন্তু তখনও এত বেশি সংখ্যক গল্প লেখা হয়ে উঠেনি। কাজেই এই পেশাদার গল্প পাঠকদেরই একসময় দায়িত্ব নিতে হলো নতুন গল্প জন্ম দেওয়ার। গল্পের উপাদান হিসেবে তারা বেছে নিল পণ্ডিতদের লেখা ইতিহাসকেই কিন্তু তার সাথে যোগ হলো নিজেদের উর্বর কল্পনা শক্তি। এই অশিক্ষিত গল্পকারদের হাতেই সাহিত্যের শুকনো নদী যেন প্রাণ ফিরে পেল। ইতিহাসের মৃত চরিত্রগুলোকে কল্পনার রক্তে মাংশে সাজিয়ে তারা হাজির করল সাধারণ মানুষের সামনে। ইতিহাস ছাড়াও তাদের গল্পে স্থান পেল নিজেদের প্রতিবেশীদের অভিনব অভিজ্ঞতাগুলো। কিন্তু সবসময়ই এইসব গল্প লেখা হয়েছে শ্রোতাদের কথা মাথায় রেখে। এভাবেই এক সরল প্রক্রিয়ায় উত্থান ঘটেছে চীনা উপন্যাসের।
আবার আমি যখন বলছি গল্প, তখন আমি কোন লক্ষ্যহীন খসড়া কর্মকাণ্ডের কথা বলছি না। চীনারা এক্ষেত্রে অনেক বেশি পরিপক্ক। তারা গল্প লিখবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে এর চরিত্রগুলোকে। শুই হু চুয়ান, যাকে চীনারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ তিনটি উপন্যাসের একটি বলে মনে করে, তার শ্রেষ্ঠত্বের কারণও বিদ্যুৎ বা অগ্নিময় কর্মকাণ্ড নয় বরং এর মধ্যে অঙ্কিত একশত আটটি চরিত্র যাদের প্রত্যেককে উপন্যাসটিতে হাজির করা হয়েছে স্বতন্ত্র মহিমায়। এই স্বাতন্ত্র্যের মাত্রা এরকম যে আমি অনেককে বলতে শুনেছি এই একশত আটটি চরিত্রের যে কোনটি কথা বলতে শুরু করলেই আমরা বুঝে যাই সেটি কে, আমাদের নাম বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, চরিত্রের কথা বলার ধরন দেখেই অবলীলায় বলে দেওয়া যায় সেটি কে। চরিত্রসমূহের এই বিশাল বিস্তৃত ছিল উপন্যাসের কাছে চীনের মানুষের প্রথম চাহিদা আর এরপরের বিবেচ্য বিষয়- প্রতিটি চরিত্র দাঁড়াবে নিজস্ব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে, উপন্যাসিকের বর্ণনায় নয়।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/07/Fang-Zhaolin-1914-2006-BANKS-ALONG-THE-YELLOW-RIVER-ink-and-colour-on-paper-framed7-688x1024.jpg)
শিল্পী: ফাং ঝাউলিং
সূত্র: পিনটারেস্ট
এভাবে যখন চীনের গ্রামে-গঞ্জে, চায়ের দোকানে, জনজীবনের সরু অলিগলিতে নিজেদের মাঝ থেকে প্রায় অশিক্ষিত কাউকে ঘিরে উপন্যাসের বিনম্র উত্থান ঘটছে, কৌতুহলের বিষয় হচ্ছে তখন চীনের রাজকীয় প্রাসাদগুলোতেও উপন্যাস জন্ম নিচ্ছে প্রায় একই প্রক্রিয়ায়। চীনের সম্রাটদের একটি প্রথা ছিল, বিশেষত বিদেশি রাজবংশগুলোর মধ্যে যে সম্রাটের বেতনভোগী কিছু লোক রাখা হতো যাদের বলা হতো “সম্রাটের কান”। এই রাজকীয় কানদের কাজ ছিল ছদ্মবেশে রাজ্যের আনাচে কানাচে ঘুরে সবার কথা শোনা এবং তা সম্রাটকে অবহিত করা। এই প্রথার আসল উদ্দেশ্য ছিল নিঃসন্দেহে সম্রাট সম্পর্কে প্রজাদের মনোভাব জানা এবং সম্ভাব্য বিদ্রোহ সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখা।
কিন্তু সম্রাটদের মাঝেও মানব সত্তা কাজ করত এবং এদের বেশির ভাগই শিক্ষিত বা পণ্ডিত ছিলেন না। রাজকীয় কানদের সুযোগ ছিল চীনের প্রাকৃত জীবনের এই সব আশ্চর্য কথকতা শুনবার এবং একসময় তারা আবিস্কার করলো তাদের প্রভূ সম্রাটেরা বিদ্রোহের খবরের চেয়ে এই সব গল্পই শুনতে বেশি পছন্দ করে। ফলে তাদের অনেকেই সম্রাটের সন্তুষ্টি লাভের আশায় আরো বেশি করে এই সব গল্প প্রতিদিন ফিরে এসে শোনাতে লাগল এবং অনেক ক্ষেত্রেই কিছুটা নিজস্ব কল্পনার রঙ মিশিয়ে। কেউ কেউ সম্রাটকে শোনানোর জন্য লিখেও রাখা শুরু করল পাছে এত সুন্দর গল্পগুলো ভুলে যায়। এই রাজকীয় কানদের আরো একটি বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে তারা শুধু প্রজাদের কথা সম্রাটকে জানাতো না, সেই সাথে সম্রাটের অনেক কথাও প্রজাদের জানাত, বিশেষত তিনি কি বলতেন বা করতেন, তাকে সন্তান দানে অক্ষম বেগমের সাথে তিনি কিভাবে ঝগড়া করতেন, কিভাবে সেই বেগম সম্রাটের মন্ত্রণাদাতাদের সাথে ষড়যন্ত্র করে সম্রাটের অপর বেগমকে বিষপান করিয়েছেন ইত্যাদি। সম্রাট সম্পর্কে এই সব গল্প প্রজাদের আনন্দ দিত, তারা ভাবতে পারত স্বর্গপুত্র হওয়া সত্ত্বেও সম্রাটেরও একজন সাধারণ মানুষের মতই জীবনের আটপৌরে ঝামেলাগুলোর মুখোমুখি হতে হয়। আর এভাবেই উপন্যাস সৃষ্টির আরেকটি উৎস বিকশিত হল চীনে যদিও এর অস্তিত্ব তবু কোন স্বীকৃতি পেল না বিদ্বানদের কাছ থেকে।
তবু এই নিদারুণ তাচ্ছিল্যের মাঝেও এক বিক্ষিপ্ত বিনম্র সুচনায়, চীনের উপন্যাস প্রাকৃত ভাষার নদীতে পাল উড়িয়ে নিজ শরীরে ক্রমাগত গেঁথে নিতে থাকল জনজীবনের উঁচু নিচু সব স্তরের মিথ আর কিংবদন্তী, ভালবাসা আর প্রতারণা, সংঘাত আর সম্মিলনের গল্প।
পশ্চিমের মত চীনা উপন্যাসের ধারা অল্প কজন উপন্যাসিকের হাতে গড়ে উঠেনি। এখানে সবসময়ই উপন্যাসিকের চেয়ে উপন্যাস অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চীনে কখনোই কোন ড্যানিয়েল ডিফো জন্ম নেননি, এখানে আমরা ফিল্ডিং, স্মলেট, ডিকেন্স, অস্টিন, থ্যাকারে, ব্রন্টি, মেরেডিথ, হারডি, ফ্লবার্ট বা বালজাকের মত উপন্যাসিকের প্রবল উপস্থিতি কখনই খুঁজে পাই না। কিন্তু চীনে আমরা যে উপন্যাসগুলো দেখতে পাই তা সর্বার্থেই পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের চেয়ে সমৃদ্ধ যেগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে বোদ্ধাদের বিস্মিত মনে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক যে এই সব উপন্যাসের লেখক কারা?
আজকে কয়েক শতক পরে এসে চীনের আধুনিক সাহিত্য বোদ্ধারা এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসে গত বছর পঁচিশেক ধরে চীনের সাহিত্য সমালোচকেরা নিজেদের এই অবহেলিত উপন্যাসগুলোই খুঁজে পেতে পড়ছে। কিন্তু তারপরও বেশির ভাগের ক্ষেত্রে লেখকের পরিচয় শেষ পর্যন্ত একটি অমিমাংসিত বিষয় হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। সবচেয়ে বহুল পঠিত উপন্যাসগুলোর একটি শুই হু চুয়ান কার বা কাদের লেখা, কোথায় তার জন্ম, কোন সময়কালে এটি লেখা ইত্যাদি জানবার জন্যেই এখন গবেষকদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। এদের পরিচয় যাই হয়ে থাকুক এটি নিশ্চিত যে তাদের কেউই আর বেঁচে নেই। ইতিহাসের কোন একসময় বেঁচে থাকা এই মানুষেরা নিজেদের জীবনে যা দেখেছে এবং শুনেছে তাই লিখে রেখে গেছে এই উপন্যাসগুলোতে। এরকমই একটি উপন্যাস রেড চেম্বারের ভূমিকায় অজানা লেখক লিখে গিয়েছিলেন “হান বা তুং এর সময় নয়, আমার নিজের সময়ের গল্প বলাটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি”।
কাজেই এই উপন্যাসিকেরা নিজেদের সময়ের গল্পই বলেছেন তাদের উপন্যাসে, বেঁচে থেকেছেন অন্ধকার আশীর্বাদে। নিজেদের উপন্যাসের কোন পর্যালোচনা তাদের কখনও পড়তে হয়নি,পুরস্কার বা তিরস্কারের ধার ধারতে হয়নি কোন প্রথাজীবী প্রতিষ্ঠানের। বিদ্বানদের মত কোন পাতলা বাতাসে শ্বাস নিতে হয়নি তাদের, মুখাপেক্ষি হতে হয়নি কোন পণ্ডিতের স্বীকৃতির। নিজের লিখবার সামর্থ্য নিঙড়ে তারা সাহিত্য রচনার তৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ভাল-খারাপ যাই লিখুন প্রত্যেকে মারা গেছেন এই তৃপ্তিটুকু সাথে নিয়ে এবং আজকে চীনের সমস্ত পণ্ডিতদের সম্মিলিত স্বীকৃতিও তাদের কাউকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবে না। তারা আজ কোন সাহিত্যিক ময়নাতদন্তেরও উর্দ্ধে। কিন্তু তারপরও তাদের সৃষ্টি বেঁচে থাকবে চীনের গণমানুষের মুখে মুখে, নিরক্ষরদের প্রাকৃত জবানে।
সুই হু চুয়ানের একটি অধুনাতর সংস্করণের ভূমিকায় উপন্যাসটির অজ্ঞাত সংখ্যক লেখকের অন্যতম একজন শিহ নাই এন লিখেছেন- “এই বইটি লিখবার সময় আমার সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার লোকেরা যেন এটি সহজে বুঝতে পারে। সৎ বা শয়তান, শিক্ষিত বা মুর্খ যাই হোক না কেন সবাই যেন এটি পড়তে পারে। আমার গল্পের মান কি হল এটা মোটেও আমাকে ভাবায় না। হায়! আমি যে জন্মেছি একদিন মরে যাব বলে। আমি কি করে জানব আমার পরের মানুষেরা এটি পড়ে কি চিন্তা করবে? আমি নিজেও আরেক জন্মে ফিরে এসে এটি পড়ে কি চিন্তা করব? হয়তো সে জন্মে আমি পড়তেও জানব না। তবে কি হবে আজ এত কথা ভেবে?”
আশ্চর্যের বিষয় বিদ্বানদের অনেকে এক সময় এই একই দৈন্যতায় মুক্তির স্বাদ পেতে চাইলেন। এদের কারো কারো হৃদয়ে ছিল একান্ত গোপন কষ্টের বোঝা, যা কাউকে বলবার নয়। কেউ কেউ নিজেদের তৈরি জগদ্দল শিল্প কাঠামোর কাছ থেকে মুক্তি চাইছিলেন। তারাও দৈন্যতার এই সুরকে বেছে নিলেন উপন্যাস লিখবার জন্য। বিনম্র নামের এই উপন্যাসগুলোও নিজস্ব সহজ সরল কথকতা নিয়ে স্বতন্ত্র রুপে দাঁড়াল পাঠকের সামনে।
এই উপন্যাসিকেরা বিশ্বাস করতেন লিখবার ক্ষেত্রে তাদের পদ্ধতি সচেতন হওয়ার কোন দরকার নেই। উপন্যাসের বিষয়বস্তুর দাবিই তার লেখার পদ্ধতি তৈরি করে দেবে। একজন উপন্যাসিক যখন একটি সুনির্দিষ্ট ঢংয়ের জন্য সুপরিচিত হয়ে উঠেন, একজন উপন্যাসিকের পরিবর্তে তখন তিনি হয়ে যান একজন সাহিত্যওয়ালা।
অন্তত, চীন আমাকে যা শিখিয়েছে সে হিসেবে, একজন ভাল উপন্যাসিক হবেন অকৃত্রিম, নমনীয় এবং তার মাধ্যমে প্রকাশিত বিষয়বস্তুর প্রতি নিবেদিত, সম্পূর্ণ তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তার দায়িত্ব নিজের মধ্যে বহতা জীবনকে ফুটিয়ে তোলা, স্থান আর কালের বহুধা বিভাজনে জীবনের অনিবার্য, অন্তর্লীন আঙ্গিক আর ছন্দ আবিস্কার করা। এই উপন্যাসিকদের বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে আমরা কখনই বুঝতে পারব না এটি কার লেখা। একজন লেখকের লেখার ধাঁচ যখন নির্দিষ্ট হয়ে যায়, এই নির্দিষ্টতা কারাগার হয়ে তাকে বেঁধে রাখে। বৈচিত্র আর সৃজনশীলতার পথ ছেড়ে চীনের উপন্যাসিকেরা তাই কখনই সে পথে পা বাড়াননি।
পশ্চিমের স্কেলে মাপলে চীনের উপন্যাসের অবশ্যই হাজারো খুঁত বের করা সম্ভব। এগুলোতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোন নির্দিষ্ট প্লট নেই, বাস্তব জীবনের মতই তাদের কোন বাঁধা ছক নেই। প্রায়শই এগুলো অতি দীর্ঘ, হাজারো ঘটনায় ঠাসা, হাজারো চরিত্রে পরিপূর্ণ। বিষয় বস্তুতে এরা বাস্তব আর কল্পনার,পদ্ধতিতে রোমান্টিকতা আর বাস্তবতার সংমিশ্রণ। ফলে যাদু বা স্বপ্ন হিসেবে এখানে যে অসম্ভব ঘটনাগুলো নিয়ে আসা হয় বর্ণনার কারুকার্যের জোরে সব যুক্তির বাইরে গিয়ে পাঠক সেগুলোও অবলীলায় বিশ্বাস করে ফেলেন। এর মধ্যে প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো লোকগাঁথায় ভরপুর যেমনটি ছিল সেকালের মানুষের চিন্তা আর কল্পনার জগত। এই উপন্যাসগুলো না পড়ে আজকের দিনেও কারো পক্ষে চীনের মনোজগত বোঝা সম্ভব নয় কারণ এই মনোজগতও এই উপন্যাসগুলোরই নির্মাণ। এই লোকগাঁথা আজও চীনের রাজন্যবর্গ আর পশ্চিমে প্রশিক্ষিত বিদ্বানদের বিরুদ্ধ প্রচারের মুখে টিকে আছে। চীনের এই মনোজগতের তুলনা মেলে জর্জ রাসেলের বর্ণিত আইরিশ মনোজগতের সাথে- “এই মনগুলো লোকজ কল্পনায় সবকিছুই বিশ্বাস করে নিতে অভ্যস্ত। সেখানে অবলীলায় রূপার থাম দিয়ে সোনার জাহাজ তৈরি হয়, সমুদ্র ভেদ করে জেগে উঠে শহর। এই সুবিশাল লোকজ মন যখন রাজনীতির দিকে চোখ ফেরায় তখন সে সবকিছুই বিশ্বাস করতে প্রস্তুত।”
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/07/800px-Suikoden-701x1024.jpg)
সূত্র: উইকিপিডিয়া
চীনের এই লোকজ মনই হাজার বছর ধরে মানব জীবন ঘেটে জন্ম দিয়েছে চীনের উপন্যাসের। প্রতিটি উপন্যাস এখানে বেড়ে উঠেছে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে। আমি আগেই বলেছি এই উপন্যাসগুলোর কোনটিই একক কোন লেখকের সৃষ্টি নয়, কারণ এর কোনটিই সেভাবে কখনো হাতে লেখা হয়নি। একটি ছোট্ট গল্প দিয়ে শুরু হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অসংখ্য মানুষের কল্পনা শক্তি মিলিয়ে একটি উপন্যাসের কাঠামো গড়ে উঠে। একটি সুপরিচিত গল্পেরই উদাহারণ দেয়া যাক- শাদা সাপ বা পেই শে চুয়ান গল্পটি প্রথম লেখা হয়েছিল সম্রাট তং এর রাজত্বকালে, লেখকের নাম অজ্ঞাত। এটা তখন ছিল সাদা মাটা একটি অতি প্রাকৃত ঘটনার গল্প যার নায়ক একটি শাদা সাপ। একই গল্পের পরবর্তী শতাব্দীর সংস্করণে দেখা যায় নায়ক শাদা সাপ এক মহিলা ভ্যাম্পায়ারের রূপ ধরেছে এবং অশুভ শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছে। তৃতীয় সংস্করণে আবার এই মহিলা ভ্যাম্পায়ারকে আবার শুভ শক্তির প্রতিরুপ হিসেবে পাওয়া যায় যে এক বিশ্বস্ত স্ত্রী হিসেবে নিজের স্বামীকে একটি সন্তান উপহার দেয়। এভাবেই প্রতিটি ধাপে নতুন চরিত্র যোগ হয়ে একটি অতিপ্রাকৃত গল্প হিসেবে শুরু হওয়া একটি গল্প শেষ হয় মানবিক পরিণতি পেয়ে।
কাজেই চীনের ইতিহাসের উষালগ্নের এই সৃষ্টিগুলোকে আমাদের উপন্যাসের চেয়ে উপন্যাসের আকর বলে বিবেচনা করাটাই সমীচিন যে রকম আকর দুহাতে ছেনে শেক্সপিয়ার তার ক্লাসিকগুলো লিখেছেন। এই বইগুলোর অনেকগুলোই এখন হারিয়ে গেছে অধিকারী মানুষদের মর্ম-জ্ঞানহীনতার কারণে। তারপরও রয়ে গেছে হ্যানের গল্পের মত অসংখ্য গল্প যে কাহিনীগুলোর উপস্থাপনে রয়েছে তেজী ঘোড়ার স্বতস্ফূর্ততা, রয়েছে রাজ-পরিবারের উত্থান-পতন নিয়ে অসংখ্য গল্প। মিং রাজ বংশের রাজত্বকালে এগুলোর বেশির ভাগই ধর্ম বা সংস্কারের গল্প হিসেবে, স্বপ্ন আর অলৌকিকতার গল্প হিসেবে, কর্মফলের গল্প হিসেবে, ড্রাগন, ঈশ্বর বা পুরোহিতের গল্প হিসেবে, বাঘ বা শেয়ালের, মৃত্যুর পরের জীবন বা পূনর্জন্মের গল্প হিসেবে কোথাও না কোথাও লিপিবদ্ধ হয়। বৌদ্ধ দর্শনের ধারায় প্রভাবিত প্রথম দিকের এই গল্পগুলোর বেশির ভাগই অতিপ্রাকৃত কাহিনী নিয়ে যার কোনটিতে নায়ক কুমারী মাতার গর্ভে জন্ম নেওয়া দেবতারা, কোন কোনটিতে মানুষের বেশে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়ানো দেবতারা। সবগুলো কাহিনী চমকপ্রদ অলৌকিকতায় ভরপুর। কোথাও কোথাও বিদ্বানের কলম নিমিষেই ফুল হয়ে যায়, কোথাও এক নারী ও পুরুষ স্বপ্ন নির্দেশিত পথ ধরে হাজির হয়ে যায় গালিভারদের দেশে, কোথাও বা জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় লোহার খণ্ডও অনায়াসে ভেসে থাকে পানিতে। কিন্তু এই অলৌকিকতা স্বত্ত্বেও প্রতিটি গল্প সাফল্যের সাথে প্রতিফলিত করেছে কোন না কোন যুগকে। হ্যানের স্বতস্ফূর্ত গল্পগুলোর উপজীব্য ছিল প্রচ্ছন্ন জাতীয়তাবাদ যা সবসময়ই কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র বা মহানায়কের বন্দনা করেছে। চীনের সুবর্ণ যুগের এই উপন্যাসগুলোর আরেকটি সমৃদ্ধ দিক হচ্ছে এদের রসবোধ যার একটি অনন্য উদাহারণ হ্যান তং সুয়ানের সংগৃহিত গল্প সংকলন সিও লিং। কিন্তু এই সুবর্ণ যুগ নিষ্ক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে এই গল্পগুলো মানুষ ভুলে না গেলেও নতুনগুলোতে আর এই রসবোধ খুঁজে পাওয়া গেল না। পরের জরাজীর্ণ শতাব্দীগুলোতে এজন্য চীনের অনেক মানুষই নিজেদের হ্যানের পুত্র হিসেবে পরিচয় দিতে ভালবাসত। তারা বলতো “এই ষষ্ঠ রাজ বংশের সময় তারা শুধু ছোট ছোট বিষয় নিয়ে লিখেছে যেমন,নারী,জলপ্রপাত বা পাখি ইত্যাদি”।
হ্যান রাজবংশের সময়কালকে আমরা এই সুবর্ণ যুগ বিবেচনা করলে পরবর্তী তং রাজবংশের সময়টি ছিল রৌপ্য যুগ আর এই রৌপ্য যুগ উপন্যাসের ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছিল প্রেমের যুগ। সম্রাটের হে বঞ্চিত সুন্দরী রাজকুমারী কুই ফেই এর প্রেম নিয়েই রয়েছে হাজারের উপরে গল্প। কাহিনীর বুননে, বিস্তারে তা পশ্চিমা উপন্যাসের মাপকাঠিতেও মাপা চলে অনায়াসে। একারণেই চীনারা এসময়ের উপন্যাসের মুল্যায়নে আরো যোগ করতো “তারপরেও আমাদের এই ছোট বিষয়গুলোই পড়তে হয় কারণ তা আজও অশ্রু নামায় আমাদের চোখে”।
কাজেই এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে এই প্রেম কাহিনীগুলো সেই প্রেম নিয়ে কথা বলত না যা একমাত্র বিয়েতে পর্যবসিত হয়ে পরিণতি পায়। বরং বিবাহ প্রথার বাইরের প্রেম নিয়েই এদের কাহিনী বিন্যাস। কোন কোনটির ক্ষেত্রে বিয়ে কাহিনীর ঈপ্সিত পরিণতি হয়ে গেলে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তা ট্রাজেডিতে গড়াতো। এর মধ্যে দুটি বিখ্যাত গল্প পেই লি শি এবং চিয়াও ফ্যাং চি- তে দেখা যায় পরকীয়া প্রেমের কাহিনী যেখানে কার্তেজান রমনীদের গুণকীর্তন করা হয়েছে। তারা লেখাপড়া জানা, অনিন্দ্য সুন্দরী, বুদ্ধিমতি এবং সুগায়িকা। অন্যদিকে সাধারণ স্ত্রীদের বলা হয়েছে “হলুদমুখি” স্বভাবতই তারা নিরক্ষরও।
কিন্তু উপন্যাসের এই প্রথা বিরোধী অভিযাত্রা এবং সাধারণ মানুষের মাঝে তার জনপ্রিয়তা স্বভাবতই ভাবিয়ে তোলে চীনের সামাজিক কর্তৃত্বের কেন্দ্রগুলোকে। কেননা এই বিপ্লবাত্মক এবং বিপদজনক প্রবণতা চীনা সমাজের মৌলিক ভিত্তি পরিবার ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে দিচ্ছিল। এর বিপরীতে প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতারও অভাব ছিল না। উদাহারণ হিসেবে আসতে পারে হুই চেন চি’র একটি গল্পের কথা যেখানে কাহিনীর নায়ক এক তরুণ পণ্ডিতকে নিজের সুন্দরী প্রেয়সী ইং ইং’কে বলতে শোনা যায় “অনন্যা নারীরা সবসময়ই বিপজ্জনক যারা নিজের সাথে অন্যদেরও ধ্বংস ডেকে আনে। এমনকি অনেক সম্রাটকেও তারা ধ্বংস করেছে এবং যেহেতু আমি কোন সম্রাট নই, সযতনে তাদের সংসর্গ এড়িয়ে চলতে চাই”। এবং আরো অনেক মহাজ্ঞানী মহাজনের পথ ধরে চ্যাং নামের এই তরুণ বিদ্বানও তাই করে। তার কথার উত্তরে সুন্দরী ইং ইং জানায় “আমাকে ছেড়ে যাওয়ার অধিকার তোমার সবসময়ই আছে এবং আমি তোমাকে পিছু ডাকব না”। কিন্তু এই উপন্যাস প্রথম লেখা হওয়ার পাঁচশত বছর পরে তাদের প্রেমের সহায়তায় এগিয়ে আসে চীনের উপন্যাসপ্রিয় মানুষদের প্রেমিক হৃদয়। যে কারণে একই কাহিনীর এই সময়ের সংস্করণে আমরা ইং ইং এবং চ্যাং’কে দেখতে পাই স্বামী-স্ত্রী হিসেবে। উপন্যাসের নতুন পাদটিকায় বলা হয় “আমরা প্রার্থনা করি জগতের তাবৎ প্রেম যেন মিলিত হয় সুখী দাম্পত্য জীবনে”। চীনে সময়ের যে গতিধারা তাতে একটি সুখময় পরিসমাপ্তির জন্য পাঁচশত বছরের প্রতীক্ষা একেবারেই মামুলি ব্যাপার।
কথা প্রসঙ্গে বলা যায় এই উপন্যাসটি চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর একটি। সুং রাজত্বের সময় এটি কাব্য রূপে আবার লেখেন চাও তে লিয়াং, অবসন্ন প্রজাপতি নামে। ইয়ুয়ান রাজ বংশের রাজত্বকালে এটি পুনরায় গীতিনাট্যের আঙ্গিকে লেখেন চাই উয়েন, শুহ সি জিয়াং নামে। মিংদের রাজত্বকালে আমরা পাশাপাশি এর আরেকটি সংস্করণ দেখতে পাই- লি রেহ হুয়ার দক্ষিণের ছন্দময় ঢং তজি ’র আঙ্গিকে লেখা নান সি জিয়াং চি নামে যেটি আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এমনকি আজকের চীনের শিশুদের কাছেও চ্যাং সেন একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় চরিত্র।
তং যুগের রোমান্সের প্রতি আমি বেশি জোর দিচ্ছি কারণ নর-নারীর প্রেমই চীনের উপন্যাসের ক্ষেত্রে এযুগের সবচেয়ে বড় অবদান। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এযুগে অন্য কোন উপন্যাস লেখা হয়নি। এসময়ে আমরা অসংখ্য রসবোধ সম্পন্ন ব্যাঙ্গাত্মক উপন্যাস পেয়েছি। এর বেশির ভাগই সেময়ের রাজদরবারের নানা কৌতুককর ঘটনা নিয়ে লেখা। এগুলোর মধ্যে সেরা একটি গল্প চেন হুং’এর লেখা তুং চেং লাও ফু চুয়ান’এ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি চরিত্র হিসেবে চিয়া চ্যাং নামে এক মোরগযোদ্ধাকে দেখতে পাই যে নিজের কৌতুককর কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে সম্রাটেরও অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে উঠে।
এভাবেই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সুং রাজত্বকালে এসে চীনের উপন্যাস একটি সুস্পষ্ট অবয়ব পায়। ইউয়ান রাজত্বের সময় এসে তা পৌঁছে যায় বিকাশের সর্বোচ্চ শিখরে যার কাছাকাছি পরবর্তী যুগের কোন উপন্যাসই পৌঁছুতে পারেনি তুং যুগের হুং লাও মেং বা লাল প্রকোষ্ঠের স্বপ্ন’র মত দু’একটি উপন্যাস ছাড়া। কয়েক শতক ধরে সবার অলক্ষ্যে, প্রাকৃত জীবনে শেকড় গেড়ে ডাল, কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দিয়ে যে উপন্যাস ফুল পাতা মেলে দিল তুং রাজত্বে এসে, তার প্রকৃত রাজকীয় মূল্যায়ন হয়েছিল মোঙ্গলদের সময়। তারা এই প্রাচীন দেশটি দখল করার পর তাদের যাযাবর হৃদয়ে প্রথাগত সাহিত্য কোন আবেদনই সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হল। বরং তারা উৎসাহ নিয়ে ঝুঁকে পড়ল নাটক আর উপন্যাসের দিকে। সাহিত্য জগতের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মাঝেও এই রাজ আনূকুল্য পেয়ে চীনের উপন্যাস যেন সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হল। এসময়েই একে একে লেখা হয় চীনের ইতিহাসের সেরা তিনটি উপন্যাস শুই হু চুয়ান, স্যান কুও এবং সর্বশেষ হুং লাও মেং।
চীনের মানুষের কাছে এই তিনটি মহান উপন্যাস কি গভীর বার্তা বহন করত তা আপনাদের সামনে তুলে ধরবার সুযোগ আজকের আয়োজনের পরিসরে নেই। কিন্তু আমি পুরো পশ্চিমা সাহিত্যে এদের কোন জুড়ি খুঁজে পাইনি। আমাদের উপন্যাসের ইতিহাসে এমন কোন মুহূর্ত আসেনি যাকে দেখিয়ে আমরা বলতে পারি “এটাই আমাদের উপন্যাসের বিকাশের সর্বোচ্চ চূড়া”। চীনের এই উপন্যাস তিনটি গণমানুষের সাহিত্যের অমিত স্বাক্ষর। বিদ্যাজীবীদের না হলেও এগুলো গণ-সাহিত্যের পরিণত স্তম্ভ। আর সব গণ-সাহিত্যের মত এগুলোকেও পড়তে হয়েছে সমসাময়িক বিদ্যাজীবীদের কোপানলে। বিপজ্জনক, বিদ্রোহী, উদ্ধত ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে দাঁড়াতে হয়েছে রাজরোষের কাঠগড়ায়। কিন্তু তারপরও চীনের সাধারণ মানুষ গল্প হিসেবে পড়ে, বলে, গান হিসেবে গেয়ে, নাটক হিসেবে অভিনয় করে এদের বাঁচিয়ে রেখেছে কয়েক শতাব্দী ধরে। যার ফলে বিদ্যাজীবীরাও একসময় বাধ্য হয়েছে এগুলোকে আমলে আনতে। তাদের সংকীর্ণ স্বর এরপর এগুলোকে আখ্যা দিয়েছে ‘লোককথা’, সেই সাথে পাদটিকায় তত্ত্ব দিয়েছে এগুলোকে সাহিত্য হিসেবে দেখা ঠিক নয়। কিন্তু চীনের সাধারণ মানুষ এসব তত্ত্ব বা তার যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য লেখা ভুরি ভুরি নিবন্ধে কর্ণপাত করেনি বিন্দুমাত্র। তারা নিজেদের সৃষ্ট উপন্যাসে মগ্ন থেকেছে, নিপাট আনন্দ ছাড়া যার আর কোন লক্ষ্য নেই, নিজেদের জীবনের প্রকাশ ছাড়া যার আর কোন বাড়তি উদ্দেশ্য নেই।
চীনের উপন্যাস প্রকৃত অর্থেই সাধারণ মানুষের সৃষ্টি। শুই হু চুয়ানের লেখক হিসেবে আধুনিক সংস্করণগুলোতে শি নাই এন’ র নাম ছাপলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একক কোন ব্যক্তির লেখা নয়। অনেকগুলো প্রচলিত গল্পের সমন্বয়ে সুং রাজত্বে এক দস্যুদল নিয়ে দাঁড়িয়েছে এই উপন্যাসের বিশাল কাঠামো। এর সুচনা নিহিত ছিল ইতিহাসে। এই দস্যুদের সত্যিকার আখড়াটি এখনও বিরাজমান শানতুং প্রদেশে। সময়ের পশ্চিমা হিসাবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর এসময়টি চীনের ইতিহাসের এক দুঃখময় অধ্যায় যখন সম্রাট হুই চুংয়ের রাজত্ব জুড়ে চলছে অরাজকতা। প্রতিদিন ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, গরিবেরা আরো গরিব। যখন অনাচার রুখে দাঁড়ানোর মত আর কেউ নেই তখন শোষিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল এই দস্যুদল।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/07/800px-Lu_Zhishen_Water_Margin_2.jpg)
সূত্র: উইকিপিডিয়া
চীনের এই উপন্যাসটির সুদীর্ঘ রচনাকালের পুরো ইতিহাস বা প্রতিটি পর্যায়ে এর বাঁকগুলো পুরোপুরি আপনাদের সামনে তুলে ধরবার সুযোগ নেই। বলা হয়ে থাকে শি নাই এন এর আদি রূপটি খুঁজে পেয়েছিলেন একটি পুরনো বইয়ের দোকানে যেখান থেকে নিয়ে গিয়ে তিনি এটি আবার পরিশুদ্ধরূপে লেখেন। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত এই গল্প চীনের ঘরে ঘরে প্রচলিত। আজকে প্রচলিত এর পাঁচ বা ছয়টি সংস্করণ পর্যালোচনার দাবি রাখে। চুং ই শুই হু নামের একটি সংস্করণে রয়েছে একশতটি অধ্যায়, অন্য আরেকটিতে রয়েছে একশত সাতাশটি অধ্যায়, অন্য আরেকটিতে একশতটি। শি নাই এন এর সম্পাদিত সংস্করণটিতে অধ্যায় ছিল একশত বিশটি। কিন্তু আজকের দিনে সবচেয়ে প্রচলিত সংস্করণটিতে রয়েছে মাত্র সত্তুরটি অধ্যায়। এই সংস্করণটি মিং রাজত্বকালে চিং সেন তন লিখেছিলেন যার পেছনে রয়েছে একটি মজার ইতিহাস। চিং জানতেন তার পুত্রও চীনের আর দশজন কিশোরের মত এ উপন্যাস না পড়ে পারবে না। এই বিশাল পরিসরের উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে যাতে পুত্রের বেশি সময় না লাগে এজন্য তিনি নিজেই এর একটি সংক্ষিপ্ত রূপ লিখে ফেলেন। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এই উপন্যাসের একটি সরকারি সংস্করণও পাওয়া যায়। চীনের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ যখন বুঝতে পারলেন জনগণকে কিছুতেই তাদের জন্য অস্বস্তিকর এই উপন্যাস পাঠ থেকে নিবৃত্ত করা যাবেনা, নিজেরাই সরকারি আয়োজনে এর একটি সংস্করণ লিখলেন যাতে কাহিনী উল্টে গিয়ে উপন্যাস শেষ হয় রাজকীয় বাহিনীর হাতে দস্যুদলের শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে। কিন্তু চীনের সাধারণ মানুষ মোটেও নেয়নি এই চাপানো গল্প, বরং প্রতিদিনের চর্চায় বাঁচিয়ে রেখেছে এই মহান দস্যুদলকে যাদের মধ্যে তারা জরাজীর্ণ রাজনীতির বিরুদ্ধে গণমানুষের নিরন্তর সংগ্রামের অনুপ্রেরণা খুঁজে পায়।
শুই হু চুয়ান আংশিক অনূদিত হয়েছে ফরাসি ভাষায়, লা শেভালিয়ারস্ চিনইস নামে। সত্তুরটি অধ্যায় নিয়ে যে শুই হু চুয়ান তার পুরোটাই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি আমি নিজে, নাম অল মেন আর ব্রাদার্স। বইটির মূল নামের কোন অর্থ ইংরেজিতে দাঁড় করানো যায় না। চীনা ভাষায় কোন বড় লেকের প্রান্তিক জলাভূমি বোঝানো হয় এই শব্দগুলো দিয়ে যেখানে এই দস্যুদের আস্তানা ছিল। এই নাম মুহুর্তেই শতাব্দী প্রাচীন যে স্মৃতি অনুভব চীনাদের মনে নিয়ে আসে, আমাদের পশ্চিমা মনোগড়নে সেই অনুভব কখনই সম্ভব নয়।
প্রাচীন এই উপন্যাসটি চীনে শুধু টিকেই নেই, সেই সাথে সম্প্রতি ভিন্নতর এক তাৎপর্যও লাভ করেছে। চীনের কমিউনিস্টরা এই উপন্যাসের আরেকটি সংস্করণ প্রকাশ করেছে যার ভূমিকা লিখেছেন সেখানকার এক প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা যাতে তিনি একে উপস্থাপন করেছেন চীনের প্রথম সাম্যবাদী সাহিত্য হিসেবে। উপন্যাসটির মাহাত্ম তার অন্তর্গত আবেদনের এই কাল নিরপেক্ষতার মধ্যেই আমরা পেয়ে যাই। সাম্রাজ্যের কালে যে সত্যের দ্যূতি এটি ছড়িয়ে ছিল, আজকের সময়েও তা নিষ্প্রভ হয়নি এতটুকু। আজও এর পাঠকের সারিতে আমরা পেয়ে যাই পুরোহিত, আমলা, বণিক, বিদ্বান, নানা পদের, বয়সের নারী এমনকি দুষ্ট কিশোরদেরও। এই সারিতে নেই শুধু পশ্চিমা পি এইচ ডি ধারী আধুনিক বিদ্বানেরা। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে এই বিদ্বানেরা যদি উপন্যাসটিতে শেষ যার কলমের আঁচড় পড়েছে সেই গল্পকারের সময়েও জন্ম নিতেন, তাদের নিয়েও মানুষের মুখে মুখে চালু হয়ে যেত হাজারো মজাক।
চীনারা বলে কিশোরদের পড়া উচিত না শুই হু আর বুড়োদের স্যান কু। কারণ শুই হু পড়ে তাদের ডাকাত হওয়ার শখ জাগতে পারে আর স্যান কু পড়ে বুড়োদের বল প্রদর্শনের ভীমরতি পেয়ে বসতে পারে। শুই হু চুয়ান যদি চীনের সমাজের প্রামাণ্যরূপ হয়, স্যান কু হচ্ছে চীনের যুদ্ধ আর রাজনৈতিক জীবনের প্রামাণ্যরূপ আর হুং লাও মেং তার পারিবারিক জীবন, মানবিক প্রেমের অনুসন্ধানী কথকতা।
স্যান কু বা তিন রাজ্য উপন্যাসটির ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় কাঠামোগত বুনন আর লেখক পরিচয়ের সংশয়ের প্রশ্নে এটিও শুই হু চুয়ানের মতই। গল্পটি শুরু হয় হ্যান রাজত্বের সময়ে পরস্পর ভাতৃত্বের শপথে আবদ্ধ তিন বন্ধুর জীবন নিয়ে এবং শেষ হয় সাতানব্বই বছর পরে ষষ্ঠ রাজবংশের সময়কালে এসে। আজকের পরিচিত সংস্করণটির লেখক হিসেবে জানা যায় লো কুয়ান চুং এর নাম যাকে অনেক গবেষকই শিহ নাই এন এর শিষ্য বলে মনে করেন। সম্ভবত শুই হু চুয়ান লিখবার ক্ষেত্রেও তার কিছু অবদান আছে। কিন্তু তাদের এই সম্পর্কটি অনেকটাই বেকোনান্দ-শেক্সপিয়ার সম্পর্কের মত নানা পরস্পর বিরোধী তথ্যে পরিপূর্ণ।
ইউয়ান রাজত্বের শেষ ভাগে জন্ম নেয়া লো কিয়ান চুং বেঁচে ছিলেন মিং রাজত্বের সময় পর্যন্ত। তার লেখালিখির তালিকায় অনেকগুলো নাটক থাকলেও তিনি বিখ্যাত হন রচিত উপন্যাসগুলোর জন্য, যার মধ্যে সেরা স্যান কু। আজকের চীনে সবচেয়ে প্রচলিত সংস্করণটি সম্রাট কং সি’র সময়ে পরিমার্জন, পরিবর্ধন করেছিলেন মাও চেন কান। এই পরিমার্জনে যেমন অনেক কিছু বাদ পড়েছে তেমনি যুক্ত হয়েছে আরো অনেকটা। যেমন উপন্যাসের অন্যতম প্রধান সুয়ান ফু রেন চরিত্রটি তিনি যোগ করেছিলেন মূল কাহিনীর সাথে। একই সাথে তিনি বদলে ফেলেন কাহিনীর কথকতার ভঙ্গিমাও। শুই হু চুয়ান যেখানে চীনের মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে বুঝবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, স্যান কু সেখানে চীনের একেবারে নিজস্ব সমর-কলা আর সমর-দর্শনকে বিশদভাবে তুলে ধরে। জাপানের সাথে যুদ্ধের সময় চীনের হাজার হাজার কৃষক গেরিলাদের প্রত্যেকেরই পড়া ছিল স্যান কু, নিজে না পড়লেও অন্তত অলস শীতের দিনে বা কোন প্রলম্বিত গ্রীষ্মে ঘরোয়া আসরে অন্যের মুখে শোনা ছিল এই উপন্যাসের কাহিনীগুলো। কোন না কোন গল্প বলিয়ে অপূর্ব ভঙ্গিমায় তাদের শুনিয়েছে তিন রাজ্যের যুদ্ধের কথা, যুদ্ধের প্রাচীন কলা-কৌশলের কথা যেগুলোর অনেকগুলোরই বাস্তব প্রয়োগ হয়েছে জাপানিদের বিরুদ্ধে গেরিলা প্রতিরোধের সময়। এই উপন্যাসের পাঠক হিসেবে চীনের আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই জানে একজন যোদ্ধা হতে হলে কি প্রয়োজন, কিভাবে শত্রু আক্রমণের মুখে পিছু হটতে হয় বা কিভাবে পশ্চাৎধাবন করতে হয় পলায়নপর শত্রুর।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/07/Cui-Ying-ying.jpg)
সূত্র: পিনটারেস্ট
চীনের শ্রেষ্ঠ তিন উপন্যাসের মধ্যে অধুনাতমটি হুং লাও মেং বা লাল প্রকোষ্ঠের স্বপ্ন। মানচু সাম্রাজ্যের এক প্রভাবশালী রাজকর্মচারী জাও যু চিং আত্মজীবনী আকারে লিখেছিলেন এই উপন্যাসটি। রাজ পরিবারসহ তৎকালীন মানচু সাম্রাজ্যের আট বাহিনীর প্রতিটির সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু তিনি এই উপন্যাসটি একা শেষ করেননি, শেষ চল্লিশটি অধ্যায় লিখেছিলেন আরেকজন যার নাম সম্ভবত কাও ও। এছাড়াও জাও যু চিং এর এই আত্মজীবনীও ঐতিহ্যের ধারায় পড়ে পরিবর্তিত-পরিমার্জিত হয়েছে প্রথমে ইউয়ান মেই’র হাতে, পরে হু শিহ’র হাতে। স্বভাবতই এর নামও পরিবর্তন হয়েছে, জাও যু চিং এর নাম দিয়েছিলেন শিহ তো চি যা পরবর্তীতে এসে হয়ে গেছে হুং লাও মেং। ১৭৬৫ সালের দিকে এই উপন্যাসটি পিকিং এসে পৌছায় এবং মাত্র পাঁচ ছয় বছরের মধ্যে চলে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। মুদ্রিত বইয়ের দাম তখনও চীনে আকাশচুম্বী, ফলে বইটির প্রতিটি কপি ঘুরেছে হাজারো হাতে।
বিষয় বিচারে উপন্যাসটি সরল হলেও রস বিচারে, চরিত্রের গভীরতা, মানবিক আবেগের প্রকাশের প্রশ্নে মোটেও তা নয়। কাহিনীর শুরু এক রাজকর্মচারীর ক্ষয়িষ্ণু পরিবারের গভীর বিশ্লেষণধর্মী বর্ণনা দিয়ে যার মূল উৎস জাও যু চিং এর যাপিত জীবন, যেখানে দীর্ঘদিনের লালিত আভিজাত্যে ক্রমশ চিড় ধরছে। সঞ্চিত সম্পদের উত্তরাধিকারী একমাত্র পুত্র চিয়াও পাও ইউ পরিবারের ভিতর থেকে পাওয়া ইন্ধনে দুহাতে টাকা ওড়াচ্ছে যদিও সে জন্ম নিয়েছে মুখে সৌভাগ্যতিলক নিয়ে। কাহিনীর শুরুতেই তার পরিচয় দেয়া হয়েছে “স্বর্গ ভেঙ্গে যাওয়ার পরে যখন আবার নির্মিত হল, ছোট্ট একটি টুকরো বাদ পড়ে গিয়েছিল সে নির্মাণে,ঈশ্বর সেটিকে তিল বানিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন চিয়াও পাও’র মুখে… …”। অতি-প্রাকৃতিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী এই চীনা ঐতিহ্য আজও আমরা চীনা জীবনে খুঁজে পাই।
এই উপন্যাস অনায়াসে চীনের পাঠকদের ধরে রাখতে পেরেছিল কারণ এর উপজীব্য বিষয় ছিল তাদের নিজস্ব পরিবার ব্যবস্থার সমস্যাগুলো, বাড়িতে নারীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, মাতৃতান্ত্রিকতার একচ্ছত্র আধিপত্য। চীনের পরিবারে নানী, মা এমনকি কখনও কখনও বাড়ির দাসী পর্যন্ত পারিবারিক ক্ষমতার একক অধিকারী হয়ে যেত। অভিজাত পরিবারের সুন্দরী যুবতী দাসীরা প্রায়শই মালিক পুত্রের ক্রীড়ানকে পরিণত হতো বা নিজেরাই নাচিয়ে বেড়াতো তাদের। চার দেয়ালে আবদ্ধ এই নারীরা, যাদের বেশির ভাগই চিরকাল নিরক্ষর থেকে যেত, প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতো বাড়ির পুরুষদের। এমনি এক আগলে রাখা পুরুষ হিসেবে আমরা লাল দেয়ালের প্রকোষ্ঠে চিয়া পাও ইউকে দেখতে পাই।
এই উপন্যাসের খ্যাতি যখন সাধারণ মানুষের গন্ডি পেরিয়ে সমাজের উঁচু স্তরে পৌঁছে গেল, স্বয়ং সম্রাটকেও দেখা গেল এতে নাক ডুবিয়ে নিমগ্ন থাকতে, বিদ্বানরা ব্যস্ততার সাথে কয়েকশত মাইল সমালোচনা লিখে ফেললো এটাকে খারিজ করে। আমার কোন সন্দেহ নেই যে এই বিদ্বানদেরও অনেকে উপন্যাসটি গোপনে হলেও পড়ে ফেলেছিল। পণ্ডিতদের এই গোপনে উপন্যাস পাঠ এবং প্রকাশ্যে অস্বীকার নিয়েও চীনাদের মাঝে নানা কৌতুক প্রচলিত আছে। যা হোক, তাদের অনেকে নিবন্ধ লিখে এই অভিযোগও করলো যে হুং লাও মেং আদৌ কোন উপন্যাস নয়, এটি একটি রাজনৈতিক প্রচারণা যা বিদেশি মানচুদের হাতে চীনের ক্ষমতা তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রচিত। উপন্যাসের নামে লাল শব্দটি মানচুদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং পাও ইউ’র বাগদত্তা লিং তাই ইউ, যে কাহিনীর এক পর্যায়ে মৃত্যূবরণ করে, প্রতিনিধিত্ব করে চীনের। অন্যদিকে তার প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী পাও জাই, যার সাথে শেষ পর্যন্ত পাও ইউ’র মিলন হয়, প্রতিনিধিত্ব করে বিদেশি শক্তির। এরকম বহু যুক্তি খাড়া করে তারা এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে এগুলো ছিল উপন্যাসটির বিকৃত বিশ্লেষণ। এই প্রতিবন্ধকতাও পেরিয়ে উপন্যাসটি চীনা ঐতিহ্যে বাস্তবতা আর রোমান্সের শৈল্পিক সংমিশ্রণের আরেকটি শক্তিশালী উদাহারণ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। একই ছাদের তলায় কয়েক প্রজন্মের নারী-পুরুষের সুদীর্ঘ জীবন যাপনের যে চৈনিক প্রথা, এক ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতাবান পরিবারের প্রেক্ষাপটে তারই নিবিড় পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায় এই উপন্যাসের পাঠকেরা।
এই তিনটি উপন্যাসকে যে আলাদা গুরুত্ব আমি দিয়েছি, চীনের মানুষেরাও তাই দিয়ে থাকে। উপন্যাস সম্পর্কে জানতে চাইলে গড়পড়তা চীনের মানুষেরা একনাগাড়ে বলে যাবে “শুই হু, স্যান কু, হুং লাও মেং”। কিন্তু তারপরও সত্য যে এর বাইরেও শত শত উপন্যাস রয়ে গেছে চীনে। এর মধ্যে বলতে হয় জি ইউ চি’র নাম যার খ্যাতি এই তিনটির কাছাকাছিই। বলতে হয় এক দেবর্ষি যোদ্ধার কাহিনী ফেং সেন চুয়ান’র কথা যার লেখক অজ্ঞাত হলেও ধারণা করা হয় এটি মিং আমলে লেখা। এছাড়াও আছে তুং রাজত্বে রাজকর্মচারী আর বিদ্বানদের অত্যাচারের কাহিনী নিয়ে লেখা রু লিং ওয়ে শি, বিদ্রুপাত্মক এই উপন্যাসটিতে রয়েছে দ্ব্যর্থক সংলাপের ছড়াছড়ি যা একাধারে করুণ এবং হাস্যরসাত্মক ঘটনার পরম্পরায় সাজানো। প্রাত্যহিক জীবনের প্রায়োগিকতা বিচ্ছিন্ন, সৃজনশীলতায় অক্ষম বিদ্বানদের নিয়ে এ উপন্যাসে রয়েছে অসংখ্য কৌতুক। দীর্ঘ এই উপন্যাসের কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। প্রতিটি চরিত্র আরেকটির সাথে ঘটনা পরম্পরায় সম্পর্কিত যাকে খ্যাতিমান আধুনিক লেখক লু জুন বলেছেন “একসাথে জড়ানো সিল্ক আর সাটিনের সমাহার”।
আর আছে কর্তৃত্ব বিরোধী উপন্যাস ইয়ে শো পেই ইন যার অর্থ সূর্যের মাঝে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের কন্ঠস্বর, লিখেছেন কিয়াং ইনের এক খ্যাতিমান ব্যক্তি- শিয়া। ব্যতিক্রমী কাহিনীর উপন্যাস চিং হুয়া ইয়েন যার বিষয় কল্পিত এক নারী সাম্রাজ্য যেখানে সম্রাজ্ঞীর অধীনে জ্ঞানচর্চা করে নারী বিদ্বানেরা। কাহিনীর একটি সুপ্ত লক্ষ্য ছিল জ্ঞানের প্রশ্নে নারী-পুরষের সমতার প্রশ্নটি উত্থাপন যদিও উপন্যাসটি শেষ হয় নারী পুরুষের এক যুদ্ধ দিয়ে যেখানে নারী রাজ্যের সম্রাজ্ঞী পরাজিত হন একজন সম্রাটের কাছে।
তারপরও এগুলো চীনের গণমানুষকে উজ্জীবিত করা উপন্যাস সম্ভারের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশ। তারা যদি আজকের এই আলোচনায় থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই বলত “এসব বাদে আসল তিনটির কথাই বলুন, শুই হু চুয়ান, স্যান কু আর হুং লাও মেং”। যেগুলো ধারণ করে হাজার বছর ধরে চীনের মানুষেরা যে জীবন যাপন করছে সেই জীবনের প্রাঞ্জল বর্ণনা, সেই গানের সুর যা তারা গেয়েছে এতদিন। আছে তাদের প্রাত্যহিক জীবনের রঙ্গরস। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের মানস গড়ে উঠেছে এগুলোকে ঘিরে, তারা ফিরে ফিরে এসেছে এই কাহিনীগুলোর কাছে। পরিবর্তিত জীবনের নতুন গান, গীতিকা আর উপন্যাসও সৃষ্টি হয়েছে এখান থেকেই। এগুলোর কোন কোনটি আসলটির মতই খ্যাতি লাভ করেছে, যেমন শুই হু চুয়ানের একটি একক ঘটনাকে ঘিরে লেখা শরীরি প্রেমের গল্প চিং পিং মেই।
![](https://www.xn--84b0czcuc.xn--54b7fta0cc/wp-content/uploads/2020/07/Screenshot_2020-07-22-Lantern-Festival-in-the-Chinese-paintings-Chinese-Arts-Chinese-Culture-Page-1-chinesetimeschool....png)
শিল্পী: ঝাউ লি
সূত্র: চাইনিজ টাইমস
কিন্তু আজ আমার উদ্দেশ্য চীনের উপন্যাসের তালিকা প্রণয়ন নয়। যে দিকটির প্রতি আমি জোর দিতে চাই তা প্রোথিত আছে বিশ্ব সাহিত্য ইতিহাসে বিরল এই গণতান্ত্রিক জনগোষ্ঠির কল্পনার প্রাণময় বিকাশে। চীনে বহুল প্রচলিত গল্প’র একটি প্রতিশব্দ হচ্ছে জিয়াও শু ও যার মানে দাঁড়ায় অর্থহীন, বায়বীয় কোন কিছু। এমনকি উপন্যাসের প্রচলিত প্রতিশব্দ জং পিয়েন জিয়াও শু ও’র মানে দীর্ঘ অথচ অর্থহীন ও বায়বীয়। চীনের মানুষেরা অক্ষরের বেড়াজাল থেকে উপন্যাসকে ক্রমাগত মুক্তি দিয়ে গেছে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি কাহিনীকে জীবন্ত রেখে। আজকে আমরা এর যে রুপটি পাই তা বর্তমান তো বটেই, আসছে দিন সম্পর্কেও অনেকখানি ইঙ্গিত বহন করে। বিপরীতে শিল্প নামে যে প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের সতীত্ব রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা পণ্ডিতরা কয়েক শতাব্দী জুড়ে করেছেন, প্রকৃত প্রস্তাবে আজ তা মৃত। প্রাণবান উপন্যাসগুলোর বাঁধা কোন প্লট নেই, কাহিনীর মাঝে নেই পরিণতি পাওয়ার আরোপিত প্রয়াস, নায়িকারা যেমন এগুলোতে সবসময় সুন্দরী নয়, সব নায়কই তেমন অদম্য সাহসের অধিকারী নয়। কোন কোনটি আবার ঠিক জীবনের মতই মাঝ পথে এসে থেমে যায়, যেভাবে মৃত্যু আকস্মিকভাবে থামিয়ে দেয় জীবনের স্রোতধারা।
উপন্যাসের এরকম একটি ঐতিহ্যেই আমি জন্ম নিয়েছি, একজন লেখক হিসেবে অনুসরণ করেছি। শিল্প সৃষ্টি বা আরোপিত নান্দনিকতা তাই কখনই আমার লক্ষ্য ছিল না। চীন থেকে এই একটি শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার প্রয়োজন আছে পশ্চিমা উপন্যাসের। শিল্প-কলার পুরোহিতদের মোকাবিলা করবার জন্য চীনের উপন্যাসিকদের এই দৈন্যপন্থী প্রতিরোধ আখ্যানটি আমি নিজের কথায় বললাম যেহেতু তারা কেউ বিষয়টি লিখে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি।
মানুষের যে প্রবৃত্তিটি শিল্প ‘সৃষ্টি’ করে তা শিল্প ‘তৈরি’র প্রণোদনার চেয়ে ভিন্নতর। চূড়ান্ত বিচারে এবং সহজতম কথায় সৃজনশীল প্রবৃত্তি হচ্ছে একটি বিস্তৃত প্রাণময়তা, এক অমোঘ শক্তি যা ব্যক্তি এককের মাঝে অতিযৌক্তিকভাবেই জন্ম নেয়, নিজের জীবনের সমস্ত প্রয়োজনকে ছাপিয়ে যায় সে তাগিদ, কোন একক জীবন সৃষ্টির সেই শক্তিকে ধারণ করতে পারে না। ফলে এই শক্তি ছড়িয়ে পড়ে এক জীবন থেকে আরেক জীবনে, কখনও সুর, কখনও ছবি, কখনও সাহিত্য বা প্রকাশের অন্য কোন মাধ্যমকে আধার করে। ব্যক্তি চাইলেও তখন আর একে অগ্রাহ্য করতে পারে না কারণ এই প্রকাশের মাঝেই সে তখন স্বস্তি পায়, এই অদ্ভূত বাড়তি শক্তি ক্ষয় করবার স্বস্তি। এই শক্তি যখন কারো শরীর-মনে ভর করে, তার ইন্দ্রিয় গড়পড়তা মানুষের চেয়ে আরো প্রখর এবং সংবেদনশীল হয়ে যায়, আরো গভীরতর হয় সমস্ত অনুভব। এই সংবেদনশীলতা মস্তিষ্কে যে চাপ সৃষ্টি করে তা বস্তু জগতের সীমানা ছাড়িয়ে তাকে নিয়ে যায় কল্পনার জগতে। এটি এক অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া যা ক্রমশ তার অস্তিত্বের প্রতি বিন্দুতে ভাগ বসায়। এই প্রক্রিয়া শুধু তাকেই ভাসিয়ে নেয়না, সাথে নেয় তার কল্পনার এবং সক্রিয়তার পরিবৃত্তকেও।
কখনও কখনও ব্যক্তি না চাইলেও এই সক্রিয়তার ফলাফল থেকে বাদ পড়ে যায় শিল্প। শিল্প সৃজনের প্রক্রিয়া আর শিল্পের আঙ্গিক নির্ধারণের প্রক্রিয়া এক জিনিস নয়। কাজেই শিল্পের সংজ্ঞা নিরূপণ মুখ্য নয় বরং গৌণ একটি প্রক্রিয়া। কাজই কেউ যখন মুখ্য কর্মকাণ্ডের জন্য জন্ম নিয়ে গৌণ কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে যায়, তার সক্রিয়তার কোন অর্থ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়ে। সে যখন আঙ্গিক, রূপ, কৌশল আর নতুন ধারা প্রবর্তনকে নিজের দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করে, তখন তার অবস্থা হয় অগভীর খাড়িতে আটকা পড়া জাহাজের মত, শত চেষ্টাতেও আর এগিয়ে যেতে পারে না সমুদ্রের বিশালতার দিকে।
একজন সত্যিকারের উপন্যাসিকের জন্য রচনার একমাত্র উপাদান তার নিজের ভিতরের ও বাইরের মানব জীবন। তার কাজকে মাপার একমাত্র মাপকাঠি হচ্ছে তার সৃজনীশক্তি নিজ জীবন ছাড়িয়ে কতটা উপচে পড়ল সেই পরিমাপ। তার সৃষ্টি কি বেঁচে আছে? এই হওয়া উচিত তার নিরন্তর প্রশ্ন। আর এ প্রশ্নের উত্তর এক গণমানুষ ছাড়া তাকে আর কে দিতে পারে? শিল্প কি বা এটি কিভাবে তৈরি হয় এই জাতীয় কূটতর্কে এ মানুষরা ডুবে নেই। বরং তারা ডুবে আছে প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষুধা, হতাশা, আনন্দ-বেদনা আর সর্বোপরি স্বপ্নের মাঝে। একমাত্র এরাই আসলে একটি উপন্যাসের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারে, কারণ তাদের মূল্যায়ন সব সময়ই হয় বাস্তবতার মাপকাঠিতে। শিল্পের মূল্যায়ন কখনই শিল্পের মাপকাঠিতে হয় না, হয় পাঠকের জীবন বাস্তবতার সাথে সরলতর তুলনার মাধ্যমে।
একজন উপন্যাসিক শিল্পকে নিখুঁত অবয়ব হিসেবে বিবেচনা করতে পারে, মার্বেল পাথরের অধিষ্ঠিত দেবতা হিসেবে পূজা করতে পারে দুর থেকে, কিন্তু তার নিজের অবস্থান কখনই তাদের সাথে নয়। তার জায়গা পথে, সেখানেই সে সবচেয়ে সুখী। পথ কখনও নিশ্চল নয়, পথিকদের প্রকাশ ভঙ্গি কখনও পাথরের মূর্তির মত নিখুঁত নয়। তারা কদাকার, খুঁতসম্পন্ন এমনকি মানুষ হিসেবেও অসম্পূর্ণ। তারা কোথা থেকে আসে আর কোথায় যায় তাও বোধগম্য কিছু নয়। কিন্তু তারপরও তারাই গণমানুষ এবং শিল্পের বিষয় হিসেবে তারাই নমশ্য, শিল্পের পাদদেশে দাঁড়ানো প্রতিটি প্রকৃত শিল্পীর কাছে।
আর চীনের এই উপন্যাসিকদের মত,আমিও এই গণদের জন্য লিখতে শিখেছি। কতিপয়ের পত্রিকার চেয়ে আমি সবসময়ই আমার লেখা ছাপতে চেয়েছি এই গণদের পত্রিকায়। আমি বিশ্বাস করি গল্প তাদের জন্যই। তারা আর যে কারো চাইতে গল্পের ভাল সমঝদার। তাদের বোধ দূষিত নয়, তাদের আবেগ মুক্ত। একজন উপন্যাসিক কখনও খাঁটি সাহিত্য তৈরিকে নিজের লক্ষ্য বানাতে পারেন না। এমনকি তার এই বিষয়টি খুব বেশি বুঝবারও দরকার নেই। কারণ তার লেখার উপাদান যে মানুষেরা, তাদের সাথে এই খাঁটি (?) সাহিত্যের সে সে রকম কোন যোগ নেই। তার ভূমিকা মূলত গ্রামের তাঁবুতে বসা গল্প বলিয়ের যে গল্প দিয়ে জয় করবার চেষ্টা করে তার শ্রোতাদের মন। এক বিদ্বান যখন পাশ দিয়ে হেঁটে যায় তখন তার কণ্ঠ উঁচু করবার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার ড্রামটি যেন সজোরে বেজে উঠে একদল সমর্পিত অসহায় মানুষ যখন পর্বতের দিকে রওনা হয় ঈশ্বরের খোঁজে। সে যেন চিৎকার করে তাদের বলে “আমিও ঈশ্বরের কথাই বলি”। সে যেন কৃষকের কাছে জমি আর শস্যের কথা জানতে চায়, বৃদ্ধদের কাছে সে যেন শান্তির কথা বলে, বৃদ্ধাদের কাছে যেন সন্তানদের কথা বলে, তরুণ-তরুণীদের যেন বলে পারস্পরিক সংবাদ। সাধারণ মানুষদের আনন্দিত মুখ যেন তাকে তৃপ্ত করে। একজন উপন্যাসিক হিসেবে মহান চীনের কাছে এই শিক্ষাই আমি পেয়েছি।
সম্পাদনা নোট: বক্তৃতাটি ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে অনুবাদ করা। বেশ কয়েকটি পত্রিকায় তা ছাপাও হয়। বর্মান সংস্করণটি অনুবাদকের কাছে থেকে প্রাপ্ত।