অরাজ
জুলাই ২০২৪, বাংলাদেশ, শিল্পী : নাজমুল হক বাপ্পী
প্রচ্ছদ » সঙ্ঘবদ্ধ মুক্তির খোঁজে : কেনান থেকে বাংলায়

সঙ্ঘবদ্ধ মুক্তির খোঁজে : কেনান থেকে বাংলায়

  • জান্নাতুল মাওয়া আইনান

আমার সাংবাদিক বন্ধু ফারিয়া (ছদ্মনাম) কিছুদিন আগে কেনান* দেশে গিয়েছিলেন। শনিবারের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে তার কেনান ভ্রমণের পুঙ্খানুপুঙ্খ গল্প শুনছিলাম। খুবই টানটান উত্তেজনায় ভরা গল্প। প্রাচীন কেনানের বুকে প্রতিষ্ঠিত ঝকঝকে নতুন রাষ্ট্রটির বিমানবন্দরে দারুণ কড়াকড়ি। ফারিয়া তাই তার নিয়মিত ফোনটি সাথে নিয়ে যান নাই। তাই দীর্ঘদিন তার কোন যোগাযোগ ছিলো না বন্ধুদের সাথে।

ফারিয়া গিয়েছিলো কেনানের অধিকৃত অঞ্চলগুলো দেখতে। ওই অঞ্চলগুলোতে প্রায় শতাধিক শান্তিকামী সংস্থা কাজ করে। এদের মধ্যে কেনানের দাবীদার দুই গোষ্টি তথা ফিলিস্তিনি এবং ইহুদি উভয় দলের লোকেরাই আছেন। অনেক সংস্থায় তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন। এই ভ্রমণে ফারিয়া এই শান্তিকামী মানুষদের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন। এছাড়াও কথা বলেছেন সাধারণ মানুষের সাথে। সেটলারদের আক্রমণের শিকার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে সেখানকার মানুষদের গল্প শুনেছেন। তারা গল্প শোনাতে ভীষণ ভালোবাসে। এইজাতির মানুষদের মধ্যে প্রচণ্ড রকমের গল্প রক্ষার তাগিদ লক্ষ্য করেন ফারিয়া। জেরুজালেমের একেকটা পাথর তাদের অস্তিত্বের সাক্ষী দেয়।

উম সাফা নামের এক গ্রামে যেদিন ফারিয়ারা গিয়েছিলেন সেদিন সেইখানে শোক সভা হচ্ছে। কিছুদিন আগে এই অঞ্চলের দুইজনকে সেটলাররা গুলি করে হত্যা করেছে। এইজন্য সেদিন গ্রামের মাঝখানে শোকসভা বসেছে। সেইখানে গ্রামের সব নারী পুরুষ কিশোর যুবা বৃদ্ধ একত্র হয়েছেন। নিহতদের স্মরণ সহ ক্ষোভ প্রকাশ চলছে। ফারিয়া অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন তাদের ছোট ছোট শিশুরাও এইসব আলোচনা অনুষ্ঠানে বেশ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। তারা সবাই মোবাইল দিয়ে ক্রমাগত ছবি ভিডিও সংগ্রহ করছিলো। শুধু উম সাফা নয় সমগ্র অধিকৃত কেনানের নির্যাতিত মানুষেরা প্রচুর পরিমাণে ডকুমেন্টেশন করা শিখে গেছে। তারা সর্বত্র তথ্য আর ইতিহাস জমা করে রাখে। তাদের অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনটাকে তারা ছবিতে যতটা পারে আটকে রাখতে চায়। নিজেদের ইতিহাস রক্ষার তাগিদ থেকেই তারা এই কাজ করেন। আমার আরেক বন্ধু রুবির (ছদ্মনাম)বাবা তো তার গ্রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে তাদের পরিবারের সকলের পরিচয় কাজ ইত্যাদি নিয়ে বেশ মোটা মোটা দুই খণ্ডের বই লিখেছে।

বিহারের কবি আমির আজিজের বিখ্যাত সেই বিপ্লবী কবিতায় বলা আছে,

“আর আমি এই সব ঘটনা আমার হাড়ে লিখে রাখব
আমি হাড়ে লিখে রাখব সব প্রমাণ
তুমি যা চাও আমার উপস্থিতির প্রমাণপত্র,
তোমাকে আমার জীবনের সকল প্রমাণ দেওয়া হবে”।

অর্থাৎ, আমরা যে ছিলাম, আমরা যে কথা বলছিলাম, আমরা যে দলে দলে জড়ো হচ্ছিলাম চৌরাস্তার মোড়ে, উম সাফা গ্রামের মাঝখানে, যাত্রাবাড়ির মোড়ে; সেইসব গল্প লিখে রাখতে হবে, দেয়ালে দেয়ালে, অনলাইনে-অফলাইনে। ক্যাফে গ্র্যাটিচুডে বসে উম সাফা গ্রামের গল্প শুনতে শুনতে ঢাকা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। একটা দেশের পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছালে সেই দেশের দশ বারো বছর বয়সের কিশোরদেরকেও রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠতে হয়?

যেই ছেলেটি তার বন্ধুর মৃতদেহ দেখে রাগে ক্ষোভে ফেটে গিয়ে দেয়ালে দেয়ালে লিখে রেখেছে :

“বুকের ভেতর অনেক ঝড়
বুক পেতেছি গুলি কর”

আপনি তাকে কী করে ফেরাবেন? এর মতো তীক্ষ্ণ তীব্র অহিংস বিপ্লবের বাণী আমরা আর কোথায় শুনেছি কবে?

২০২৪ সালের বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবে বিপ্লবী জনগণ ছিলো নিরস্ত্র, তাদের হাতে পাথরের টুকরো আর লাঠি ছাড়া কিছু ছিলো না। বিপরীতে ছিলো এই জনগণেরই ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্রের মুখ। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে তাদের সরকার নামক যন্ত্রটি ভয়াবহভাবে শোষণ আর অত্যাচার শুরু করলে সেই রাষ্ট্রটিকে কি স্বাধীন বলা যায়?

ফারিয়া যখন আমাকে বলছিলো কেনানের অধিকৃত অঞ্চলের মানুষ কড়া নজরদারিতে বন্দী থাকে, তখন আমার মনে পড়ে গেলো, মাত্র দুই মাস আগে বাংলাদেশের মানুষেরা বাসায় রেগুলার মোবাইল রেখে বাড়ির বাইরে যেতো ভিন্ন মোবাইল নিয়ে। কারণ মোবাইলে বিপ্লবের কোন ছবি বা ফেসবুকে কোন সক্রিয়তা দেখতে পেলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো সাধারণ ছাত্রদের।

বাংলাদেশের সব মানুষ সংঘবদ্ধভাবে একটা ভয়াবহ ট্রমাটিক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগেরই তাদের শহরের অলিতে গলিতে পুলিশ আর সেনাবাহিনীর অস্ত্রযান ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা মূলত মানুষ খুন করে বাকিদের ভয় দেখিয়েছে, যেন আর কেউ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি কথাও না বলে। সাভারে তারা একজন অর্ধমৃত ছাত্রের লাশ নিয়ে শহরের রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল তারপর সেই শরীরটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবারও দরকার বোধ করলো না, ছেলেটিকে ট্যাংক থেকে টেনে হিঁচড়ে ফেলে দেয়া হলো, দুর থেকে ধারণ করা ক্যামেরায় দেখা গেলো ছেলেটার তখনো শ্বাস ছিলো। ঢাকা শহরের অলি গলি এখনো অনেক মানুষকে ট্রমাচ্ছন্ন করে ফেলে। এরকম অনেকেই লিখেছেন, শহরের পথে পথে হাঁটতে চলতে দারুণ কষ্ট হয়। বারবার সেই ভয়ংকর কয়েকটা দিন, সেই যুদ্ধক্ষেত্র ফিরে ফিরে আসে।

এটা একটা অদ্ভুত সময় ছিলো। যেই কয়দিন দেশের মানুষ বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের জন্যে, সেই কয়দিন প্রবাসের ডায়াস্পোরা দেশের বাংলাদেশিরা দলে দলে রাস্তায় নেমে এলো। তাদের দাবী ছিলো খুব সহজ- আমরা আমাদের পরিবারের লোকেদের সাথে কথা বলতে চাই। এটা একটা রীতিমত মানবিক বিপর্যয় ছিলো। এক প্রবাসী শ্রমিক তার মায়ের মুখ শেষবারের মত দেখতে পেলো না, মায়ের বিদায় মুহূর্তে ভারচুয়ালিও উপস্থিত হতে পারলো না। দেশের মানুষ যখন জানেও না তখন প্রবাসী বাঙালিরা নানান জায়গায় “দফা এক দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ” বলে শ্লোগান দিয়েছে। সুতরাং, এই আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রে অরগ্যানিক ছিলো।

আওয়ামী লীগের কঠোর সমর্থক বাদে, সচেতন মানুষেরা প্রায় সবাই যে যার মত করে কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন। অনেকেই নতুন করে তার রাজনৈতিক স্বত্ত্বাকে খুঁজে পেয়েছেন, অনেকে পুরানো ঘর ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন, কিন্তু নতুন ঘরের সন্ধান পান নাই। অনলাইন এবং অফলাইন সমাজজুড়ে আজকে নানান রকমের মত। রাজনীতিবিমুখ তরুণেরাও ধীরে ধীরে রাজনীতি বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো। আমাদের পারিবারিক গ্রুপ মেসেজে মধ্য জুলাইয়ের আগে আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিলো আম্বানিদের বিয়ে। তারপর আমরা দেখতে পেলাম একটা মামুলি গল্পের পারিবারিক গ্রপ সরাসরি রীতিমত রাজনৈতিক আলোচনার একটা জায়গা হয়ে উঠলো।

অনেকদিন কোনরকমে পিঠ বাঁচিয়ে বেঁচে থাকতে থাকতে বাংলাদেশের বাঙালিরা ও অন্যান্য জাতিগোষ্টীর মানুষেরা যে বুক উঁচু করে রাইফেলের নলের সামনে দাঁড়িয়ে শাসকের চোখে সরাসরি চোখ রেখে ভীষণ রাগে বলে উঠেছিলো, “মইরা যামু কী হইছে! কইয়া যামু কী হইছে! ষোল বছর কী হইছে, আর স্বাধীনতার কী হইছে?”

এই যে, মুক্তির জন্য জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়ে প্রকাশ্য রাজপথে নিরস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে যেতে কখন আর মানুষ দ্বিধা করে না? যখন মানুষের আর কিছুই থাকে না। সে যখন বুঝতে পারে যে তাকে যাদের রক্ষা করার কথা অথবা যারা তাকে রক্ষা করতে পারতো তারা তাকে মানুষ বলেই গণ্য করছে না। শাসকের অথবা শোষকের কাছে তার দুঃখ যেন অদৃশ্য, কিংবা সে নিজেই অদৃশ্য। মজলুম অবাক হয়ে লক্ষ্য করে তাকে যেন কেউ দেখতেই পাচ্ছে না। অনস্তিত্বের এই অনুভূতি তার অস্তিত্বকে স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ করে তোলে। সে তুমুল শক্তি নিয়ে প্রতিরোধ করে নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয়।

হ্যাঁ, আমরা ঠিক করেছি, যা হবার হবে, আমরা বলে যাবো, বলে যেতে থাকবো- আমাদের স্বাধীনতার কী হইছে? আমাদের স্বাধীনতা কারা হরণ করেছে, আমরা বলবো। যেই প্রচণ্ড শক্তি এই মানুষগুলো অর্জন করেছে জুলাই মাসের ৩৬ দিনে, সেই শক্তিকে যদি আমরা কাজে না লাগাই তাহলে সেইটা হবে ক্ষতিকর একটা ব্যাপার।

এই বিপ্লবে বাংলাদেশের সকল ধারার মানুষ যোগ দিয়েছিলো, কিন্তু একটা পর্যায়ে পরাজয় চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আওয়ামী লীগ নামের কুচক্রী দলটি গোটা আন্দোলনটিকে জামায়াতের এবং ইসলামপন্থীদের আন্দোলন বলে প্রচার করতে চায়। এইজন্য তারা, আন্দোলনের উত্তপ্ত সময়ে হুট করে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। তবে, ওই অভূতপূর্ব সময়টাতে বাংলাদেশের সব মানুষ প্রচণ্ড শক্তভাবে একমাত্র একটা লক্ষ্যে একত্রে এগিয়ে যায়। সেই একমাত্র লক্ষ্য ছিলো হাসিনার পতন। আর এর ফলেই ৩৬ জুলাই অথবা ৫ আগস্টে লক্ষ লক্ষ মানুষ বুলেটের ঝড় উপেক্ষা করে ঢাকার পথে এগিয়ে যায়। পথে পথে তাদেরকে জনতা স্বাগত জানায়। নিরস্ত্র জনতা নিজেদের জান আর জীবন দিয়ে একটা ভয়াবহ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়। সারাবিশ্ব দেখে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান।

স্বাভাবিকভাবেই, বিপ্লবে অংশগ্রহণ করা প্রতিটা পক্ষই নিজ নিজ দলের ভূমিকাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই প্রমাণে তর্কে লিপ্ত হয়। মজার ব্যাপার হলো, হাসিনাশাহীর সমর্থকেরা এইক্ষেত্রে ইসলামপন্থীদের সাথে যুক্ত হয়েছে এখন। অর্থাৎ তারা প্রচার করছে যে এটা শুধুমাত্র ইসলামপন্থীদেরই বিপ্লব ছিলো। এর ফলে, সাধারণ মানুষদের একটা বিশাল অংশের ভয়েসকে পুরাপুরি নাই করে দেয়ার একটা চেষ্টা দেখা যায়। মধ্য জুলাইয়ে আমরা দেখি হাজার হাজার নারী বিভিন্ন পোশাকে হিজাবে অথবা জিনসে এসে রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন, অসীম সাহস নিয়ে স্লোগানে স্লোগানে দেশ করেছেন মুখরিত। মধ্য আগস্টে তাদেরকে সেভাবে আর দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, আওয়ামীপন্থীদের সাথে সাথে ইসলামপন্থী রাজনীতিকরাও সাধারণ জনতার ভয়েসকে অগ্রাহ্য করছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ জনতা যে রাজনৈতিক কর্তাস্বত্ত্বা অর্জন করেছে এইটাকে সুশৃঙ্খলভাবে ধরে রাখতে পারলেই কেবল আমাদের বিপ্লব পরিপূর্ণ হবে। তাই অন্য অনেকের মত আমি মনে করি, আমাদের বিপ্লব এখনো চলমান।

ফারিয়া কেনানের শান্তিকামী বিপ্লবীদের গল্প করছিলেন। তারা অহিংস পথে সংগ্রামে বিশ্বাসী। অনেকে ভাবে, যারা শান্তির কথা বলে থাকে তারা কাপুরুষ। অথচ, এই যোদ্ধারা কী ভয়াবহ বিপদ মাথায় নিয়ে শান্তির লক্ষ্যে কাজ করে যান কেউ এটা হয়তো বোঝে না। তারা দুইপক্ষেরই প্রচুর লোকের অপছন্দের পাত্র। এদের মধ্যে অনেক প্রাক্তর ইহুদি যোদ্ধা আছে যারা সেটলার আক্রমণ থেকে ফিলিস্তিনীদেরকে রক্ষার জন্য আক্রান্ত গ্রামগুলোতে ঢাল হিসেবে সক্রিয় অবস্থান করেন। মেরুকরণের আর ভয়ের রাজনীতির দুনিয়ায় এই অসাধারণ বিপ্লবীদের গল্প আমরা খুব কমই শুনতে পাই। কেনানের দুই মেরুর দুই পক্ষই এই শান্তিকামী মানুষদেরকে নিয়ে আলোচনায় নারাজ। ফিলিস্তিনের অনেক সশস্ত্র বিপ্লবীও এই শান্তিকামীদের দলে যোগ দিয়েছেন। দীর্ঘ অনেক বছরের ট্রমার সাথে যুদ্ধ করতে করতে এই মানুষেরা একটা বিপুল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসে একে অপরের হাত ধরে অহিংস বিপ্লবের পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। আমরা তাদের সাথে একমত হতে পারি আবার না ও পারি, কিন্তু তাদেরকে উপস্থিতিকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না।

জেরুজালেম থেকে উপহার হিসেবে ফারিয়া আমার জন্য একটা টাইল নিয়ে এসেছে, বিখ্যাত জেরুজালেম পাথরের তৈরি টাইল। জেরুজালেম পাথর তার বুকে যত্ন করে রেখে দিয়েছে সেইসব মানুষদের গল্প যাদের গল্প মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে বিস্তর। সেই শীতল প্রাচীন পাথর গালে ঠেকিয়ে ভাবি, জেরুজালেম আমাদেরকে কী শেখায়?

জেরুজালেম আমাদেরকে শেখায় রেজিস্ট্যান্স। জেরুজালেমে সকল সত্য উন্মোচিত হয়। যেদিন নিরস্ত্র যীশুকে হত্যা করা হয়েছিলো, সেইদিন জেরুজালেমের বড় মন্দিরের বিশাল পর্দা দ্বিখণ্ডিত হয়েছিলো, সেইদিনও সত্য উন্মোচিত হয়েছিলো। তাই মুসলিমদের দয়াল নবী জেরুজালেম থেকেই মেরাজে যান। জেরুজালেম আমাদেরকে দেখায় পার্টিশনে ছিন্নবিচ্ছিন্ন জাতিসমূহের ট্রমাটাইজড মনস্তত্ত্ব। পোস্ট ট্রমাটিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত অতীতের শেকলে বন্দী মানুষদেরকে দেখায় জেরুজালেম, তেমনি দেখায় ট্রমার পথে হাঁটতে হাঁটতে নিজের কর্তাস্বত্বাকে হাতে তুলে নেয়া অহিংস বিপ্লবীদের। ট্রমার সাইকেলে ঘুরপাক খেতে থাকা জীবন অথবা মুক্তি; দুই পথই দেখায় জেরুজালেম। মানুষ ঠিক করুক তারা কী চায়! মুক্তি নাকি শেকল!

পাদটীকা : 

*কেনান : জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগরের মধ্যখানে বিস্তীর্ণ ঐতিহাসিক সমৃদ্ধ ভূমিটিকে আমার ইহুদি বন্ধু শেকিনা (ছদ্মনাম) কেনান বলে ডাকার পক্ষপাতী। এছাড়াও এই অঞ্চলের প্রচলিত রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নামগুলো উচ্চারণ করাকেও সমস্যাজনক করে তুলেছে সোশ্যাল মিডিয়ার এলগরিদম। ফলে আমি এই লেখায় কেনান নামটিই ব্যবহার করেছি। শেকিনা অহিংস বিপ্লবী এবং কালেক্টিভ লিবারেশনে বিশ্বাসী একজন নন-বাইনারি ইহুদি। শেকিনা ও তার বন্ধুরা ইফ নট নাও নামের একটা সংগঠনের পক্ষ থেকে, চিরস্থায়ী অস্ত্রবিরতির দাবিতে তিশা বাভের দিন পশ্চিম লস এঞ্জেলসের ব্যস্ত সড়ক ৪০৫ ফ্রি ওয়েতে কিছুক্ষণের জন্য যান চলাচল বন্ধ করে দেন। তাদের দাবি ছিলো তিশা বাভকে ইহুদিদের ক্যালেন্ডারে সবচাইতে দুঃখের দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই দিন নানান ধরণের রিচুয়ালের মাধ্যমে তারা শোক উদযাপন করে। কেউ কেউ ২৫ ঘণ্টা রোজা রাখে। এই দিনটিতে মূলত সেকেন্ড টেম্পল ধ্বংসের ইতিহাস মনে করে রিলিজিয়াস ইহুদিরা শোক প্রকাশ করে থাকেন। তবে ইহুদি এক্টিভিস্টরা তাদের ট্র্যাডিশনাল রিচুয়াল গুলোকে চলমান অন্যায়ের প্রতিবাদের মাঠে নিয়ে আসেন। ইফনটনাও সংগঠনটির কর্মসূচিগুলোতে প্রায়ই ধর্মীয় রিচুয়াল উদযাপনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিবাদ করে থাকে এবং কালেক্টিভ লিবারেশনের পক্ষে কথা বলে।

জান্নাতুল মাওয়া আইনান