অরাজ
শিল্পী: নারগোস হারোনজাদে
প্রচ্ছদ » প্যাট্রিক ডান।। ধর্ষণ নির্মূল কীভাবে?

প্যাট্রিক ডান।। ধর্ষণ নির্মূল কীভাবে?

  • অনুবাদ: নিশাত জাহান নিশা ও শুভম ঘোষ

[“To Abolish Rape, Overthrow Male Desire” শীর্ষক রচনাটি ২০১৩ সালে fith estate ম্যাগাজিনের ৩৮৯তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান অনুবাদটি the anarchist libraryতে সংরক্ষিত সংস্করণ থেকে করা হয়েছেসম্পাদক]

শিল্পী: অ্যান ক্যামেরুন

অন্তত কিছু ক্ষেত্রে হলেও মানুষের সংস্কৃতিকে যৌন আচারের একটি বিস্তৃত ব্যবস্থা হিসেবে দেখা যায়, ফ্রয়েড যেভাবে দেখেন ঠিক সেভাবে নয়, বরং প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সামাজিক মানুষ যা যা কার্যক্রম পালন করে তারই একটা অংশ হিসেবে সমাজ যৌনতাকে সংগঠিত ও যৌন আহ্বানকে প্রতীকিকরণ ও সংরক্ষণ করে; আনন্দ, প্রভাব এবং প্রজননের প্রয়োজনে। ধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন নিপীড়নগুলো; বিশেষ করে নারী, শিশু এবং যাদের লিঙ্গ পরিচয় প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ পরিচয়ের কাতারে পড়ে না, তাদের উপর হওয়া সহিংসতা সামাজের ওই একই দৃষ্টিভঙ্গির স্বাভাবিক বর্ধিতাংশ।

সমাজ একটা সংঘটন হিসেবে, তার যুক্তি ও উদ্দেশ্য এমনভাবে সংঘটিত হয়েছে যেন তা ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, যৌন হয়রানিসহ যৌন সহিংসতার যত উপায় আছে সবকিছুকে উৎসাহিত এবং প্রচার করে। এভাবে যৌন সহিংসতা সমাজের কর্তৃত্বপরায়নতার অস্ত্র হিসেবে সেবা করে এবং সমাজ কখনো সরাসরি কখনো গোপনে এটাকে একটা রোজকার প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে পরিচয় করাতে চায়।

মানব সংস্কৃতিতে যৌন নির্যাতন বিস্তারের মূলকারণ হলো পিতৃতন্ত্র অথবা ব্যাটাছেলেদের শাসন। পুরুষের চেতনাকে কেন্দ্র করে পুরুষালি যৌনকামুকতার নিরবিচ্ছিন্ন রীতিনীতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। পুরুষের বাসনা ও চেতনা থেকে আসা সেইসব আজ্ঞা এবং আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ ও সিদ্ধির প্রয়োজনে পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

পুরুষের নিপীড়নমূলক যৌন আকাঙ্ক্ষার মূলে রয়েছে লৈঙ্গিক বিশুদ্ধতার ভ্রান্ত ধারণা, আধিপত্যশীল বিষয়ী দৃষ্টিভঙ্গি, এবং চর্চিত যৌন রীতিনীতির প্রভাব যা বাস্তব ক্রিয়ার উপর পূর্ণ অধিপত্য বিস্তার করার ও নিয়ন্ত্রণ করার সাংস্কৃতিক বৈধতা তৈরি করে দেয়। এই পুরুষত্বের লৌঙ্গিক ও আধিপত্যশীল চৈতন্য মূলত একটা সমাজের সকল লৈঙ্গিক আচার এবং রীতিনীতি চর্চিত হওয়ার পেছনের গোপন প্রভাবক। এটি সংস্কৃতিকে দৃশ্যমান এবং তাকে গড়ে তোলে কাঠামোবদ্ধ সংকেতের মতো; যৌনতাকে আমাদের সামনে হাজির করা থেকে শুরু করে যৌনতার অভিজ্ঞতা প্রাপ্তি সবই হয় এর কারণে।

মরদতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এই পূর্বানুমান ধরে নেওয়া হয় যে, পুরুষ ইচ্ছানুযায়ী তার আকাঙ্ক্ষা চাপিয়ে দিতে পারে যে কারও উপর। লৈঙ্গিক শ্রেষ্ঠত্বে সে সংস্কৃতিকে এমনভাবে গড়ে যেখানে শুধুমাত্র পুরুষ আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়ার দাবি রাখে আর অন্যান্য যৌনতার ও এর সম্ভাবনাগুলোর ভূমিকা হয় কেবল তাদের সন্তুষ্টি বিধান করা। এর ফলে কোনো পুরুষ যখন যৌনমিলনের তাড়না অনুভব করে, যেকোনোভাবেই হোক তার সেই তাড়না নিবৃত্তির বস্তুগত উপকরণাদির যোগানের সুলভ বন্দোবস্ত সমাজ নিশ্চিত করে।

পুরুষ, নারী, শিশু কিংবা পশুসহ অন্যান্য যাদেরকে এই আকাঙ্ক্ষার অধীন মনে করা হয়, তাদেরকে বিভিন্নভাবে পুরুষের নিয়ন্ত্রণের শিকার হতে হয়। আর যদি তারা কোনোভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়, তবে পুরুষের আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ পরিণতি দিতে, সামাজিক বৈষম্যমূলক স্তরায়নের রীতিতে, তাদেরকে নিপীড়ন করা হয়, শোষণ করা হয় এবং খারিজ করা হয়।

তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ‘অপর’ পুরুষের তৈরি করা আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে প্রথাগত স্বীকৃতি পেয়ে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখে (যেমন: বিয়ে), অন্তত প্রথাগতভাবে, নির্দিষ্ট কিছু যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে। যদিও তাদেরকে এর পরিবর্তে সমর্পিত হতে হয় আরেক ধরনের যৌন সহিংসতার কাছে, সেটা পরিবারের কাছে। এবং যারা তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে সমর্পন করেনি, তারা বিভিন্ন ধরনের হিংসাত্মক কাজের শিকার হয় এবং এসব থেকে তাদের নিজেকে আত্মরক্ষার উপায়গুলো আরও ভয়াবহ ও জটিলতর হতে থাকে।

এই অংশটুকু, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে, প্রমাণ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার অভাব রয়েছে। ধর্ষণের শিকার নারীরা: বিশেষ করে অবিবাহিত ও কারও অধীনস্থ নয় এমন নারীদের যাদেরকে শুধু যৌনসর্বস্ব সত্তা হিসেবে জ্ঞান করা হয়, তাদেরকে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের আকাঙ্ক্ষা নিবারণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করার রীতি বৈধতা পায়। এদিকে বিবাহিত নারীদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যৌন সামগ্রী মনে করা হয়। আসলে এর ফলে ধর্ষণ হয়ে দাঁড়ায় ব্যাটালোকদের সার্বভৌম কামুকতার কাছে নারীদের সহজ, প্রাকৃতিক ও ‘যৌক্তিক’ সহজলভ্য যৌন সামগ্রী হিসেবে বিরাজ করার মামলা।

পুরুষের প্রশ্নাতীত কামুকতা এই জটিল পরিস্থিতির জন্ম দেয় যেখানে ক্ষমতার অদ্ভুত বিকার এবং অসাম্যতার স্ফূরণ দেখা যায়। মারকুইস ডি সাদের গল্পের চরিত্রগুলোর মতো: বিচারক, রাষ্ট্রপতি, পুরোহিত, স্কুলের শিক্ষকসহ সমস্ত পুরুষ কর্তারা মানুষের উপর তাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যৌনতার একটি ধারা স্বাভাবিক করে ফেলছেন।

আধুনিক আমেরিকান সমাজে পেন স্টেট ফুটবল কোচ জেরি সানডুস্কি এবং ক্যাথলিক পাদ্রিদের ন্যায় অনেক গণ্যমান্য সদস্যদের মতো পুরুষতান্ত্রিক সিরিয়াল ধর্ষকদের দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত থাকি। পুরুষের কামুকতা পূরণের নির্বাহী ক্ষমতার ছায়ায় নিজেদের করা যৌন নিপীড়নকে একরকম লাইসেন্স দেয় এসব ব্যক্তিত্বরা এবং তারা তাদের যৌন বর্বরতাকে সম্পূর্ণ বৈধ ও বিধিসম্মত মনে করে। পারিপার্শিক সংস্কৃতিও একে বিধিসম্মতরূপে হাজির করে। যাই হোক, একজন ধনী বৃদ্ধ আট বছরের একটি গরিব ছেলেকে নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণ করছে, এটির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কেউ নৈতিক কারণে গোপনে ঐ বৃদ্ধকে খুন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু আমেরিকান সংস্কৃতিতে মর্দামিতে ঠাসা কামুকতার প্রতি বশ্যতা স্বীকার করা হয়, এগুলোকে পুরস্কৃত করা হয়, এসবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় এবং এ ধরনের ধর্ষকদের জন্ম দেয়া হয়।

শিল্পী: ডারউইন লিয়ন

পুরুষালি কামুকতাকে এক অলীক উচ্চতায় প্রশ্নাতীত শ্রেষ্ঠত্বে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হয়েছে এটাকে একধরনের রহস্যকরণ করেই। আনুষ্ঠানিকভাবে যখন পুরুষের কামুকতার ছাঁচে শরীরকে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়, তখন এই কামুকতার পেছনের কলকব্জাগুলোতে গোপনীয়তা থাকে। এমনকি এই ধারণার প্রকৃত বাস্তবতা এড়াতে চাইলে, পুরুষের আকাঙ্ক্ষা তার কাছেও অজানা থাকে। তাদের কর্তৃত্বের অধীনে থাকা নারী, শিশু এবং অন্যান্য সকলের কাছে এর উপায়গুলো সম্পর্কে নিবিড় এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকে। শেতাঙ্গদের নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের যে বিশেষ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়, এটি অনেকটা সেরকম। এটি এমন একধরনের পরীক্ষালব্ধ অভিজ্ঞতা শেতাঙ্গরা যেটি কখনো অনুধাবন করতে পারবে না। অঅনুসারী পুরুষদের পুরুষের আকাঙ্ক্ষার অভ্যন্তরীণ (circuitry) বর্তনী থেকে প্রাপ্ত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যখন প্রেমমূলক নাশকতার সাথে প্রচার ও প্রকাশ করা হয়, তখন সেটি পুরুষতান্ত্রিক সহিংসতার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের জ্ঞান পুরুষকে তার সম্পূর্ণ কর্তৃত্বের জায়গা থেকে সরিয়ে আপেক্ষিকভাবে সহমর্মিতার আচার এবং অনুষ্ঠান পালনের জায়গায় নিয়ে আসে যেখানে পুরুষের প্রশ্নাতীত কামুকতাকে পুরোপুরি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা এবং পরাভূত করা যায়। যেসব রীতিভুক্ত প্রতীক এবং সাইকোম্যাটিক হাতিয়ার দিয়ে পুরুষ তার কামুকতার চরিতার্থকরণে সহিংসতার সংস্থা হিসেবে মূর্তিমান হয়েছে, পুরুষত্বের কিছু বিদ্রোহী সমালোচনা সেগুলোকে খোলসা করছে।

পিতৃতন্ত্রের অবসান এবং মর্দামির উচ্ছেদ করার এসব আলাপ মানুষের মধ্যে বিদ্যমান যৌন সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক অসামঞ্জস্যতাকে অস্বীকার করে। এই অসামজ্ঞস্যতার মূলে রয়েছে যৌন অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত বিভিন্ন আচার, মিথস্ক্রিয়া (interaction) এবং শারীরিক কায়দা যা কিনা অটল (persistent) নির্বাহী কর্তৃপক্ষ এবং পুরুষের দ্বারা পরিচালিত। অন্যভাবে বলতে গেলে লিঙ্গ, মর্দামি এবং পুরুষতান্ত্রিকতার অজস্র সমালোচনাতে যেটি অনুপস্থিত সেটিই মূলত লিঙ্গ বৈষম্যের একটি সমাধান। মূলত ক করে এটি করা যায়, ঘটানো সম্ভব করা যায়, সে সম্পর্কিত সমাধান খুব জরুরি। আমাদের প্রজাতি আর যাই হোক অন্তত স্থায়ীভাবে একটি জায়গা আটকে থাকে না।

শিশুদের ক্ষমতায়ন এমনভাবে করতে হবে যাতে তারা সহিংসতা, জবরদস্তি এবং নিপীড়নমূলক নিয়ন্ত্রণের মতো জটিলতা এড়িয়ে আনন্দ, আকর্ষণ এবং উত্তেজনা (arousal) উপভোগ করতে পারে।

নারীদেরকে শারীরিকভাবে অক্ষম এবং পরাধীন সত্তা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। নিজের দেহকে রক্ষা, পরিচালনা করা এবং উপভোগ করার মতো মৌলিক ক্ষমতা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়। সহিংসতার (যৌন সহিংসতাসহ) সমস্ত নির্বাহী ক্ষমতা পুরুষের কাছে সমর্পণ করে নারীদেরকে যৌন সামগ্রীর মতো গুপ্ত এবং সজ্জিতভাবে নিজেদের কমনীয়তা ধরে রাখতে বাধ্য করা হয়। এমনকি স্টুবেনভিল, ওহিওতে যে নারী সংস্থা রয়েছে, পুরুষের ইচ্ছাধীন শাসনের অধীনে তাদের চৈতন্যও অস্তিত্বহীন। পুরুষ এবং নারীর যৌনসম্পর্ক এই ভ্রান্তির দ্বারা ক্রমাগত প্রতারিত হচ্ছে।

তাছাড়া, আরও বুনিয়াদি পর্যায়ে মরদপ্রধান সমাজে যৌনমিলনের ক্ষেত্রে পুরুষের কাছে নারীর সমর্পকে যৌনতার সাধারণ ধর্ম হিসেবে হাজির করা হয়। আন্দ্রেয়া ডওয়ার্কিন (যিনি মনে করেন, নারীপুরুষের সমস্ত যৌন সম্পর্কই ধর্ষণ) এর মতো তাত্ত্বিকদের তত্ত্বকে বাদ দিলে, সহবাসের হিংস্র পেনিট্রেটিভ ধর নারীপুরুষের স্বাভাবিক সহজাত যৌনসম্পর্কের প্রতিফলন নয়; এটি ধর্ষণ এবং যৌন সহিংসতার মতোই মরদপ্রধান সংস্কৃতিতে যৌনতা সম্পর্কে সীমাবদ্ধ ধারণা প্রসূত আগ্রাসনের একটি চিহ্ন কেবল।

যৌনতার উর্দ্ধে গিয়ে লিঙ্গকে (sex) বুঝতে হলে, নারীপুরুষের মধ্যেকার যৌনশারীরিক সম্পর্কের ধারণায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। অবশ্যই এটি করতে গিয়ে মানুষের সংস্কৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে অর্থাৎ জৈবিক ভিন্নতার ভিত্তিতে যেসব মরদপ্রধান সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস (লিঙ্গ বৈষম্য)কাঠামো টিকে আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। ইতিবাচকভাবে বলতে গেলে নারী, শিশুসহ যারা পুরুষতান্ত্রিক যৌন সম্পর্ককে খারিজ করবে, তাদেরকে এমনভাবে ক্ষমতায়ন করতে হবে যাতে তারা যৌনতার পরমানন্দকে খুঁজতে, সন্ধান করতে এবং টিকিয়ে রাখতে যেসব রীতি, কৌশল ও নৈপুণ্য দরকার তাতে উদ্ভাবনী ভূমিকা রাখতে পারে। এভাবে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার বিলোপ করা সম্ভব, যা শেষতক মরদতন্ত্রকে এবং পুরুষালি কামুকতার সম্পূর্ণ জিঞ্জিরকেও ধ্বংস করে।

শুভম ঘোষ

নিশাত জাহান নিশা