অরাজ

এমএন রায়।। ফ্যাসিবাদ: অতিমানবের কৌলিকতা

  • অনুবাদ: আবদুল্লাহ হেল বুবন

ফ্যাসিবাদের প্রকৃতি নির্দেশক সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো ‘অতিমানবের কূলভক্তি’। এই কূলভক্তির জনক ছিল নিৎসে, যিনি ছিলেন আবার শোপেনহাওয়ারের শিষ্য; এবং শোপেনহাওয়ার  ‘উপনিষদের দর্শনে স্বান্তনা’ খুঁজে পেয়েছিলেন। একারণেই সম্ভবত স্থূল বস্তুবাদের এর নিরেট অভিব্যক্তি ও রক্ষণশীল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আধাত্মবাদী ভাবাদর্শের মাঝে ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতিত্ব রয়েছে। ফ্যাসিবাদ আসলে পুনরূজ্জীবনবাদী ধ্যানধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত জাতীয়তাবাদ। পুনরূজ্জীবন বাদের পরিণতি কী, তা দেখায় ফ্যাসিবাদের অনুশীলন। অন্যদিকে, ফ্যাসিবাদের ভাবাদর্শিক পটভূমি প্রকাশ করে যে, পুনর্জাগরণবাদ সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতার আত্মাস্বরূপ; ফ্যাসিবাদ একটি ভাবাদর্শিক অস্ত্র যা প্রগতির (যে প্রগতির একটি পূর্বশর্ত বিপ্লব) বিরুদ্ধে লড়াই করে।

ফ্যাসিবাদের পিতামহ শোপেনহাওয়ার ছিলেন নৈরাশ্যবাদের প্রচারক৷ উপনিষদের “ঐশ্বরিক দর্শন” এর একজন প্রশংসক হিসেবে তিনি সারাজীবন হেগেলীয় দর্শনের বিপ্লবী সত্তার বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। তবে হেগেলীয় দর্শনকে দার্শনিকভাবে মোকাবেলা করা ছিল তার চিন্তাশক্তির বাইরে৷ একারণে প্রতিক্রিয়াশীলতার অক্ষম ক্রোধ অভিব্যক্ত হয় কুকথায়। প্রকৃতপক্ষে, শোপেনহাওয়ারের দর্শন ছিল ১৮৪৮ সালের বিপ্লবে পরাজিত জার্মান বুর্জোয়ার ভাবাদর্শ। পরাজয় থেকে তৈরি হতাশা প্রকাশিত হয়েছিল জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে পালানোর আকুলতায়।

শোপেনহাওয়ারের মতে, প্রকৃতির অপরিবর্তনীয় ও নিত্য নীতির কারণেই মানুষ বাস করছে সবথেকে নিকৃষ্ট এক দুনিয়াতে। যেহেতু জীবনের এই অসহনীয় পরিস্থিতি গুলোকে পরিবর্তন করা যায় না, তাই এই ধরনের অসহনীয় পরিস্থিতি দ্বারা পূর্ণ এই পৃথিবী থেকে পালানোর আকুলতা অপ্রতিরোধ্য। স্বাভাবিকভাবেই, শোপেনহাওয়ারের পীড়িত আত্মা—যা পরাজিত জার্মান বুর্জোয়ার হতাশাকেই প্রতীকায়িত করতো—উপনিষদের দর্শনে সান্ত্বনা খুঁজে পায়। উপনিষদের দর্শন যুগের পর যুগ ধরে ভারতীয় জনগণকে জীবনের কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সেগুলো পরিবর্তনের সাহসী প্রয়াস থেকে বিরত রেখেছে। শোপেনহাওয়ারের দর্শনের সারবত্তা হলো মানব ইচ্ছাশক্তিকে অবমূল্যায়ন—যে ইচ্ছাশক্তিকে তিনি বর্ণিত করেছেন “সম্পূর্ণরূপে অশুভ ও হীন” হিসেবে। এই দর্শনের তাৎপর্য হলো সকল ধরনের প্রগতির বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব৷ কেননা, প্রগতির বস্তুগত উপাদান সমূহ তাদের বিষষী অভিব্যক্তি খুঁজে পায় ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তিতে৷ এই মতবাদ ধারণ করার মাধ্যমে শোপেনহাওয়ার হিন্দু দর্শনের সাথে একই ভূমিতে দাঁড়ায়; হিন্দু দর্শনও আকাঙ্ক্ষাকে আত্ম-উপলব্ধির (যা প্রকৃত জ্ঞানের উৎস) পথে প্রধান প্রতিবন্ধক মনে করে। শোপেনহাওয়ারের দর্শন এতোটাই অন্তঃদ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ যে দর্শনের একজন ক্রিটিকাল দার্শনিক এই মন্তব্যটি করতে বাধ্য হন:

যদি বিশ্ব এমন এক সত্তা হয়, যার অস্তিত্ব না থাকাই শ্রেয়, তবে দার্শনিকের চিন্তাও—যিনি নিজেও সেই বিশ্বের একটি অংশ—চিন্তা না হয়ে ওঠাই অধিকতর শ্রেয়। (ফ্রাঞ্জ মেহেরিং: অন দি হিস্ট্রি অব ফিলোসোফি”)

কিন্তু, একজন দার্শনিকের চিন্তা তার সময়ের প্রয়োজনীয়তা এবং যে সামাজিক ও ঐতিহাসিক অবস্থায় সে জীবন যাপন করেছে, তা দ্বারাই নির্ধারিত হয়। তিনি প্রতিক্রিয়াশীলতার দার্শনিক ছিলেন এবং অবস্থানগত কারণেই তিনি এর বাইরে যেতে পারেননি। শোপেনহাওয়ারের দর্শন এতোটাই প্রতিক্রিয়াশীল ছিল যে, ফ্যাসিস্টদের ঘৃণাপূর্ণ ইহুদিবিদ্বেষ ও নারী প্রশ্নে মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গির উৎস তার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়।

নিৎসে তার শিক্ষকের দর্শনকে আরো শাণিত করেন এবং ঘোষণা করেন যে, নিজেদের সহজাত “শয়তানি ও হীনতা” নিয়ে মানুষের লজ্জিত হওয়ার কোন কারণ নেই। যেহেতু, মানব ইচ্ছাশক্তি এরকমই, মানুষের উচিত তা অকপটে গ্রহণ করে নেয়া এবং তা নিয়ে গর্বিত হওয়া। শোপেনহাওয়ার জীবনকে দেখতো একটি অপরাধ হিসেবে। নিৎসে জীবনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন “ভোগপরায়ণতা, রূঢ়তা, নিষ্ঠুরতা এবং অপরিচিত ও দুর্বলকে পরাভূত করা, অত্যাচার ও শোষণ করার আকাঙ্ক্ষা”-র অভিব্যক্তি হিসেবে। এগুলোই ফ্যাসিবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু নিজের শিক্ষকের নৈরাশ্যবাদ থেকে নিৎসে এরকম রণতান্ত্রিক মতবাদ তৈরী করতে পারলেন কিভাবে? প্রতিক্রিয়াশীলতার দর্শনের এরকম পুনঃসংগঠন সম্ভব হয়েছিল জার্মান সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে বুর্জোয়াদের অবস্থানের পরিবর্তনের ফলে।

শোপেনহাওয়ার নৈরাশ্যবাদ প্রচারের পরে জার্মানিতে বহুবিধ ঘটনা ঘটেছিল, যা সেখানকার বুর্জোয়াদের শক্তিশালী করে৷ তখন জার্মান বুর্জোয়ারা নিজেদের মনোভাবকে একটি ভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করতে শেখে। নৈরাশ্যবাদ রূপান্তরিত হয় কৌপদর্শনে। জার্মান বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে ব্যর্থ হয়েছিল। ১৮৪৮ সালের বিপ্লব ব্যর্থ হয়, কারণ তারা বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। কিন্তু, এই বিপ্লব ছিল একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা; এটা হওয়ার কথাই ছিল। বুর্জোয়ারা বিপ্লবকে সফল করতে ব্যর্থ হলেও এটা পরবর্তীতে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল—বিসমার্কের শ্রেষ্ঠ কৃতি হলো একটি দুর্বল ও হতোদ্যম বুর্জোয়া শ্রেণিকে প্রুশীয় ভূমি অভিজাতন্ত্রের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির অবস্থানে নিয়ে যাওয়া (যদিও এই সম্পর্কে জার্মান বুর্জোয়াদের অবস্থান ছিল অধীনস্ত)। সামাজিক অবস্থানে জার্মান বুর্জোয়াদের এই পরিবর্তন তাদের দর্শনকেও প্রভাবিত করেছিল।

পুঁজিবাদী বিকাশের পথ এখন আর বন্ধ নয়। একই কারণে, নৈরাশ্যবাদের কারণও রইলো না। কিন্তু এই নৈরাশ্যবাদ কোন স্বাস্থ্যকর আশাবাদ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়নি। কারণ, স্বাস্থ্যকর আশাবাদ বিজয় দ্বারা অর্জিত আত্মবিশ্বাসের ফসল। প্রকৃতপক্ষে, জার্মান বুর্জোয়াদের জীবন তখনও বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সামরিক গোষ্ঠী ও ভূমি অভিজাতদের অধীনস্ত ছিল। জীবন তখনও ছিল “অশুভ ও হীন”। তাই, তারা ভাগ্যে যা আছে, সেটার সর্বোত্তম ব্যবহারে মনোনিবেশ করেন। এটার প্রতিফলন আমরা পাই নিৎশের কৌপকেন্দ্রিক দর্শনে।

জীবন একটি ক্ষণস্থায়ী ঘটনা; তাই, জীবন থেকে যতটা সম্ভব আদায় করে নেয়া উচিত। জীবনকে দেখার এই পুনপৌনিক আবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গিকেও—যেখানে প্রত্যেকে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে, পাশেরজন গোল্লায় যাক— একটি আধাত্মিক বাঁক দেয়া সম্ভব। যদি আমরা হিন্দু দার্শনিক মানদণ্ড গ্রহণ করি: “জীবন আমাকে গ্রাস করছে না, বরং আমি এর অধিপতি”। আধুনিক ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের আধ্যাত্মিক গুরু বিবেকানন্দ নিৎসেকেই প্রতিনিধিত্ব করেন, যখন তিনি সগৌরবে বলেন, “আমি মদ পান করি, কিন্তু আমি তা দ্বারা আচ্ছন্ন হই না।” তিনি সম্ভবত ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়াশীল দর্শনের সেই নৈরাশ্যবাদী দার্শনিকের (নিৎশে) কাছ থেকে শিক্ষা নেননি। কারণ, বিবেকানন্দ তা শিখেছেন তার পবিত্র, ভারতীয় গুরুর থেকে। নিজস্ব খেয়ালি ভাষায় রামকৃষ্ণ প্রচার করেছেন, “শুকর খাওয়া ব্যক্তি ঈশ্বরের প্রতি অনুগত হতে পারেন। আবার, হবিষ্যি গ্রহণ করা ব্যক্তি হতে পারেন কামিনী-কাঞ্চনের দাস।” এটার মানে হলো, যদি কোন ব্যক্তি আধ্যাত্মিকতার পোশাক পরিধান করতে সক্ষম হয়, তবে স্থুল বস্তুবাদী জীবন যাপনে তার আর কোন বাঁধা নেই৷ বিংশ শতকের এই অবতারের শিক্ষা নিৎশের নৈরাশ্যবাদ থেকে ভিন্ন কিছু নয়। আসলে, রামকৃষ্ণের সমগ্র শিক্ষণী (যা বিবেকানন্দ যৌক্তিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চেয়েছে) এই ধারারই অংশ, যা আবার হিন্দুধর্মের মর্মকে প্রতিফলিত করে। যেহেতু, কলিযুগে আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌছানো সম্ভব নয়, তাই এ সময়ে মানুষের উচিত সংসারী হওয়া; সংসারী হওয়া কোন পাপ বা অন্যায় নয়, যদি তা ঈশ্বর আরাধনার উদ্দেশ্যে কোন মায়া ছাড়া করা হয়। বাস্তব জীবনে এই আধ্যাত্মিক আদর্শ ও মূল্যবোধ সাধারণত উপেক্ষিত হয়। এটা অবশ্য কখনোই বাস্তবতা ছিল না। সুদীর্ঘ কাল ধরে চলা এই বিভ্রমকে শেষ পর্যন্ত অপসারণ করা হয়েছে; তবে তা বিপ্লবী সাহসিকতার মধ্য দিয়ে নয়, বরং ভণ্ডামিপূর্ণ ধর্মধ্বজার মাধ্যমে। ইতিমধ্যে, পোশাকি আধ্যাত্মিকতাহীন স্থুল বস্তুবাদ ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করে ফেলেছে। (কিন্তু বস্তুবাদী দর্শন এখনো ট্যাবু হিসেবে রয়ে গেছে।) অনেক পূর্বেই নিজস্ব সামাজিক প্রয়োজনীয়তা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় (জীবন সম্পর্কিত) ধর্মীয় দর্শন তার অসততা ও দ্বিভাব থেকে বের হতে পারে না।

পূঁজিবাদ সম্পর্কে নিৎশের দর্শন ভাবনা এই ভারতীয় পন্থাকেই অনুসরণ করে। নিৎশের গুরু শোপেনহাওয়ার মনে করতেন, মানবজীবন একটি অপরাধ ও (মানব) ইচ্ছাশক্তি “অশুভ ও হীন”। নিৎশে দ্বিমত না করে যুক্ত করলেন, যদি মানব জীবন অপরাধই হয়, তবে নিজের আধ্যাত্মিক সত্ত্বাকে দুষিত না করেই আপনি এই অপরাধে নিমজ্জিত হতে পারবেন। যতোক্ষণ পর্যন্ত আপনি নিজের ইচ্ছা শক্তির অধিপতি, ততোক্ষণ পর্যন্ত এই ইচ্ছাশক্তির হীনতা আপনার সত্ত্বার পবিত্রতাকে দূষিত করতে পারে না। সুতরাং, আপনি যা ইচ্ছা তা করতে পারেন—লাগামহীন ভোগ-লালসার পেছনে ছোটা, দুর্বলকে নিপীড়ন, পরাভূত ও আঘাত করা; বিবেকের কোন তাড়না ছাড়া নৈতিক বল নিয়েই আপনি তা করতে পারবেন; কেননা, এই দুনিয়াটাই সবথেকে নিকৃষ্ট দুনিয়া, আপনি যা-ই করেন না কেনো, তা এই দুনিয়াকে অধিক নিকৃষ্ট বানাবে না। নিৎশে শোপেনহাওয়ারের উপনিষদীয় দর্শন থেকে যৌক্তিকভাবে এই সিদ্ধান্ত গুলোতে পৌঁছেছেন। জীবনের সংকল্পের নেতিকরণ থেকে জন্ম নিয়েছে ক্ষমতার সংকল্প। জীবনের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে সহানুভূতি রূপান্তরিত হয়েছে তার প্রতি তীব্র ঘৃণায়। এভাবেই জন্ম গ্রহণ করেছে অতিমানবের কৌল। এবং এই অতিমান হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছিল আধুনিক শিল্পের কাপ্তানরা।

অতিমানবরা “মুক্ত আত্মা”, “ভালো ইউরোপীয়ান”—দুনিয়ার জার্মান রক্ষাকর্তা এবং ‘আর্য আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি’-র গর্বিত অভিভাবক। ব্রিটিশদের সাথে ‘সাদাদের দায়’ বহন করার সভ্যকরণের মিশন গ্রহণে তারা প্রস্তুত। আসলে নিৎশের দর্শনের তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক অভিব্যক্তি ছিল জার্মান সাম্রাজ্যবাদের জন্য সুবিধাজনক অবস্থান তৈরী—যার অর্থ ছিল উপনিবেশবাদী সম্প্রসারণ। ক্ষমতা ও লুণ্ঠন কেন্দ্রিক এই দর্শনের সবথেকে স্থুল অভিব্যক্তি হলো ফ্যাসিবাদ। (ফ্যাসিবাদের সবথেকে মৌলিক মতবাদ) অতিমানবের নিৎশীয় কৌলকে যথার্থভাবেই বলা হয়েছে “এটা সেই দর্শন যা বৃহৎ পুঁজিকে মহিমান্বিত করে এবং এভাবেই জনতার মাঝে তার জন্য আবেদন সৃষ্টি করে।” (মেহেরিং, ‘অন দি হিস্ট্রি অব ফিলোসোফি’)

ছবি: নাৎসী ভোটিং ক্যাম্পেইনের পোস্টার

উপনিষদের স্বর্গীয় দর্শন থেকে জার্মান সাম্রাজ্যবাদ এবং পরবর্তীতে, ফ্যাসিবাদের ভাবাদর্শ নির্মিত হয়। এই ভাবাদর্শ উপনিষদের অপব্যবহার কিংবা দূষিত রূপ ছিল না। দুনিয়াতে স্বীয়-ইচ্ছা অনুযায়ী অবাধ ক্ষমতা আরোপের বৈধতা সর্বদাই অধিবিদ্যক প্রাথমিক নীতি থেকে আসে, যে প্রাথমিক নীতি অন্য কোন নীতির অধীনস্ত নয়। এই অনুমিতির উপর নির্মিত ভারতীয় দর্শনও একসময় স্থুল বস্তুবাদের ভাবাদর্শে পরিণত হবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে শ্রেণি সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস, যা বুর্জোয়াদের বল প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতায় সজ্জিত করতে হবে। ক্ষমতার ভাগ দিলেই দেখা যাবে যে, বুর্জোয়ারা আমাদের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির সুপ্রাচীন রূপ ও পরিভাষা ঝেড়ে ফেলে নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের স্বর্গীয় আধ্যাত্মিক দর্শন উঁচু শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা ছাড়া কখনোই অন্য কিছু করেনি। তবে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের শাসক শ্রেণির সামাজিক গঠন অনুযায়ী এই দর্শনকে তার রূপ ও পরিভাষা পরিবর্তন করতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এমনকি আজও ‘সত্য ও অহিংসা’-র স্বর্গীয় মতবাদ সামাজিক ক্ষোভ ও রাজনৈতিক বিদ্রোহের গতিকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ প্রদত্ত সীমাবদ্ধ ক্ষমতার স্বাদ এখনি আমাদের আধ্যাত্মিক জাতীয়তাবাদীদের ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যে দেশের দর্শন (জার্মান) ফ্যাসিবাদের অগ্রদূতদের অনুপ্রাণিত করেছে, সে দেশে সম্ভবত এটা ঘটারই ছিল।

নিৎসের নির্মিত “মুক্ত আত্মা”-দের মাঝে ঈশ্বরের ‘বিভূতি’ রয়েছে। একারণেই স্বভাবতই তারা ‘শাসক’ ও ‘অধিপতি’ হবে; তাদের জন্মগত ‘অধিকার রয়েছে মানব পালকে শাসন ও অধীনস্ত করার’; যে মানুষরা ‘সহজাতভাবেই ক্ষমতাহীন এবং যাদের ভাগ্যই অন্যায্য আচরণের শিকার হওয়া’। মানুষের স্বভাবগত শয়তানি ও হীনতা সম্পর্কে শোপেনহাওয়ারের মতবাদ থেকে যৌক্তিকভাবে উদ্ভুত হয়েছে মানব সম্পর্ক নিয়ে নৈরাশ্যবাদী এই নিৎশীয় দর্শন৷ এই দর্শনের কারণেই নিৎশে ছিল সমাজতন্ত্রের উগ্র বিরোধী। একারণেই মার্ক্সবাদ বিরোধী ফ্যাসিবাদী ক্রুসেডের প্রাথমিক ভাবাদর্শিক গুরু হিসেবে ইতিহাসে আমরা নিৎশেকে খুঁজে পাই।

আর্য-ভারতীয় আধ্যাত্মিক জীবন-দর্শনের একটি কেন্দ্রীয় নীতি হলো আনন্দের সহিত জীবনের দুঃখ-কষ্ট ও দূর্দশাকে গ্রহণ করে নেয়া। নিৎশে এই নীতিতে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি ধারণা করতেন, শ্রমিক শ্রেণির অবস্থার প্রকৃত উন্নয়ন, কেবল তাদেরকে আনন্দের সহিত দুর্দশাকে মোকাবেলার শিক্ষাদানের মাধ্যমেই আনা সম্ভব। এটা খুব সহজেই বোঝা যায় যে, নিৎশের সমাজতন্ত্র বিরোধী প্রোপাগান্ডা আসলে ছিল গান্ধীবাদের আগাম ছায়া। সুতরাং, যদি গান্ধীবাদকে সংজ্ঞায়িত করা হয় ধর্মীয়-নৈতিক মতবাদের একটি সুসংগঠিত আকর হিসেবে—যা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির সারমর্ম—তবে বলা চলে যে, এর আধুনিক রাজনৈতিক অভিব্যক্তি বিশ্ব ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছে। একটি দার্শনিক ঐতিহ্য হিসেবে গান্ধীবাদ আমাদেরকে চালিত করেছে হিটলারবাদের অভিমুখে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের এই সত্যটা মাথায় রাখা উচিত৷ কেননা, ইতিহাসের যুক্তি ভারতেও ততটাই প্রয়োগযোগ্য, যতটা ছিল জার্মানিতে।

ফ্যাসিবাদের আধ্যাত্মিক গুরু (নিৎশে) বিশ্বাস করতেন যে, যা ধনীদের জন্য অসহনীয়, তা গরীবরা (শ্রমিক) বহন করতে সক্ষম; একারণে, তিনি মনে করতেন যে, শ্রমিকদের খুব সহজেই কষ্টভোগের (যা একটি পুণ্যকর্ম) শিক্ষা দেয়া যাবে। গান্ধীবাদও একই স্বরে বলছে, পুঁজিপতি ও শ্রমিক উভয়ই ঈশ্বরের সন্তান; এবং দরিদ্রদের উচিত না তাদের ধনী ভাইদের হিংসা করা। গান্ধীবাদ ত্যাগ ও দুর্দশাকে পূণ্য কর্ম হিসেবে মহামান্বিত করে। যদি এই গান্ধীবাদী মতবাদকে গ্রহণ করেই নেয়া হয়, তবে এই “পূণ্য” গুলোকে (ত্যাগ ও দুঃখ-দুর্দশা) বাস্তব করে তোলার জন্য গৃহীত সকল পদক্ষেপকে নীতি (নৈতিকতা) ও যুক্তি উভয় দিক থেকে বৈধতা দিতে হবে। একটি আদর্শ ধারণ করে লাভই বা কি, যদি না ব্যক্তি সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত না থাকে? সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনায় দায়িত্বরত গান্ধীবাদীরা প্রমাণ করছে যে, তারা এই পূণ্য কর্মগুলোর অনুশীলন নিশ্চিতকরণে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত। কেননা, তাদের বিকৃত দর্শন অনুযায়ী, এই পূণ্যগুলোর অনুশীলনই সক্ষম হবে ভারতীয়দের উন্নত করতে।

শ্রেণি শোষণকে বৈধতা দানকারী নিৎসের দর্শনের সাথে হিন্দু দর্শনে বিদ্যমান ‘কর্ম’ ধারণার লক্ষণীয় সাদৃশ্য রয়েছে। প্রকৃতিপক্ষে, নিৎশের দর্শন যেন ভারতীয় ঈশ্বরেরই প্রতিধ্বনি: “গুন ও যোগ্যতা অনুযায়ী আমি চারটি বর্ণ তৈরী করেছি” (গীতা)। এই বর্ণ প্রথা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন সামাজিক অবস্থায় স্থাপন করেছে। এই প্রথা যদি ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত হয়, তবে নিম্নকোটির চিরতরে এই অবস্থানে মানিয়ে নিতে হবে। স্বর্গীয় ইচ্ছা সামাজিক অসমতাকে চিরস্থায়ীত্ব প্রদান করেছে। দাসকে চিরদিনের জন্যই দাস হতে হবে! শাসক শ্রেণি নিজেদের ক্ষমতা ও ক্ষমতা থেকে লব্ধ সুযোগ-সুবিধাকে দেখে ঈশ্বরের উপহার হিসেবে, যা কেবল পাপীরাই তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইবে। গীতায় ঈশ্বর আরো ঘোষণা করেন যে, সকল পার্থিব ক্ষমতা তার নিজস্ব ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ। ব্রাহ্মণদের যাজকীয় কর্তৃত্বকে ঈশ্বরের ক্ষমতার সম্প্রসারণ হিসেবে দেখানো হতো; অতীতের রাজা-বাদশাহরাও ঈশ্বরের অবতার হিসেবে শাসন করতেন; এমনকি আজকের দিনের পরজীবী ভূস্বামীরা নিজেদেরকে উপস্থাপন করেন কৃষক জনতার “সহজাত নেতা” বলে (যদিও তারা নিজেরাই এই কৃষক জনতার শোষক)। আবার, দেশীয় রাজারা ঐ সব সনাতনী জাতীয়তাবাদীদের সহায়তায় (নিজ রাজত্বে) স্বৈরতান্ত্রিক বল প্রয়োগ করে, যারা নিজেরা আবার ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত প্রদেশগুলোতে প্রতিনিধিত্ব সূচক গণতন্ত্রের জন্য গোলমাল করছে।

“মানব পাল”-এর ভাগ্যে কেবল ক্ষমতাহীনতা ও অধীনস্ততা আরোপ করে নিৎশে বলেন: “প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন দ্বারা পৃথিবীতে সুখ আসবে না। সুখ আসবে কেবল দুখি, বিষাদগ্রস্ত, করুণা প্রার্থী ও (সবসময় যারা অভিযোগ করায় ব্যস্ত) অভিযোগকারীদের অনুপস্থিতির মাধ্যমে।” এখানে আমরা আবারো খুঁজে পাই ভারতীয় দর্শনের প্রতিধ্বনি—যে ভারতীয় দর্শন আসলে ফ্যাসিবাদেরই দর্শন। পার্থিব বিষয়বস্তু মানুষকে সুখি করতে পারে না: সুখ একটি মানসিক অবস্থা, এবং তা বস্তুগত অবস্থার উপর নির্ভর করে না। সুখ মনন নির্ভর। অর্থ্যাৎ, কেবল নিজেকে সুখি ভেবেই আপনি সুখি হতে পারবেন।

যখন ভারতীয় জনগণকে সামাজিক অসাম্যের কথা বলা হয়, তখন তারা একই হাতে থাকা পাঁচ আঙুলের ভিন্ন ভিন্ন দৈর্ঘ্যের (অর্থ্যাৎ হাতের পাঁচ আঙুল তথা সবাই সমান হয় না) দিকে লক্ষ্য করতে বলেন। এটা তাদেরকে শিখিয়েছে ভারতীয় আধ্যাত্মিক সংস্কৃতি ও দর্শন। আরো শেখানো হয়েছে—নিজেদের সামাজিক অবস্থানকে নিজস্ব মেধা ও যোগ্যতার প্রতিফলন হিসেবে গ্রহণ করে নিতে। অবশ্য কেবল নিজেদের নিষ্ঠুর ভাগ্যকে মেনে নেওয়ার শিক্ষাই তাদের দেওয়া হয়নি, একইসাথে তাদেরকে শেখানো হয়েছে — প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ব্যাবস্থাকে স্বর্গীয় ইচ্ছার অভিব্যক্তি হিসেবে দেখতে। নিৎশে আরো যুক্তি দিয়েছিলেন যে, “এতো এতো কঠিন ও কষ্টকর কাজ এখনো বাকি রয়েছে। তাই, কিছু কিছু মানুষকে এমন অবস্থায় রাখা উচিত, যা তাদেরকে এইসব কাজের জন্য উপযুক্ত করে তুলবে।” ভারতীয় প্রতিভার বিশেষ সৃষ্টি—বর্ণ প্রথা, পুরোপুরি এই নীতির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফ্যাসিবাদের এই দার্শনিক (নিৎশে) বর্ণপ্রথা সম্পর্কিত আর্য চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই সম্ভবত লিখেছিলেন, “এশীয় ও আফ্রিকার বর্বরদের এখানে নিয়ে আসা যেতে পারে, যাতে করে অ-সভ্যরা সর্বদাই সভ্য পৃথিবীর সেবা ও কল্যাণে ব্যবহৃত হতে পারে।” কেন নয়? আর্য ব্রাহ্মণরা কি তাদের ক্ষত্রীয় মিত্রদের সহায়তা নিয়ে ভারতীয় আদিবাসীদের শূদ্র হওয়ার চিরস্থায়ী দাসত্বে বন্দী করেননি? আপনি (অন্যের সাথে) যেমন আচরণ করেছেন, কেউ যদি আপনার সঙ্গে ঠিক তেমনটাই করে, তবে সেটা নিয়ে অভিযোগ করা ভণ্ডামি বা অন্যায়। কৌল সেবাধর্ম ভারতীয় আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির একটি অংশ। এটা গান্ধীবাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, আর গান্ধীবাদ সনাতনী জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শ। সেবাকে অধিবিদ্যক গুনের মোড়ক পড়ানো গেলে, দাসত্বকেও সম্মানের মর্যাদায় উন্নীত করা সম্ভব এবং এর পরিসরের উপর কোন যৌক্তিক সীমা আরোপ করা যায় না। তোমার উচিত সেবা করা, যখন কিনা তুমি ঈশ্বরের কৃপায় আশীর্বাদপ্রাপ্ত, যা তাঁর অধিক সৌভাগ্যবান শ্বেতাঙ্গ সন্তানদের মাধ্যমে কার্যকর থাকে।

নিৎশে মুক্ত-আত্মাদের ভালো ও মন্দ সম্পর্কিত নৈতিকতার উপরে স্থাপন করেন। কেননা, নিৎশের মতে, খ্রিস্টধর্মের জন্মলগ্ন থেকে ভালো-মন্দের এই নৈতিকতাকে দুর্বল মানব-পালরা ব্যবহার করেছে মুক্ত-আত্মাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি হাতিয়ার হিসেবে। অতিমানবের নৈতিকতা নিয়ে নিৎশের কাজ ফ্যাসিবাদের বাইবেলে রূপান্তরিত হয়েছে। নিৎশে থেকে উদ্ধৃত এই অনুচ্ছেদ তার পরিচয় বহন করে: “ধর্ম শক্তিশালী ও স্বাধীন সত্ত্বাদের জন্য সর্বদাই একটি অস্ত্র। যারা শাসন করতে প্রস্তুত এবং যাদের নিয়তিই শাসন করা; বুদ্ধিমত্তা ও শিল্পের মিশ্রণ যাদেরকে গড়ে তোলে একটি শাসক জাতি হিসেবে, তারাই ধর্মকে ব্যবহার করতে পারবে। শাসন করার ক্ষেত্রে তারা যে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন, তা দূর করার হাতিয়ার ধর্ম। ধর্ম অধীনস্তদের শাসকদের সাথে বেঁধে রাখে, তাদের ভিতরের সেই লুকায়িত ও সুপ্ত বিবেককে দমিয়ে দেয়—যা তাদের শাসকদের অমান্য করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারত।

ধর্ম যখন সর্বময় ক্ষমতা অধিকার করতে চায়, নিজেকে একটি লক্ষ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, অন্যান্য উপায়গুলোর মধ্যে একটি উপায় হিসেবে না থেকে, তখন এর পরিণতি সর্বদা অকল্যাণকর হয়। ধর্ম যদি দার্শনিকদের হাতে গঠন ও লালনের একটি উপায় না হয়ে নিজেই চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে, তবে তা বিপর্যয় ডেকে আনে।

একটি সত্যিকারের সুস্থ ও উৎকৃষ্ট অভিজাত শ্রেণির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, তারা পরিস্কার বিবেক নিয়ে এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারে যে, একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে তাদের স্বার্থে নিপীড়িত হতে হবে, মানবিক মর্যাদার নিচে নামিয়ে আনতে হবে, দাসত্বে পরিণত করতে হবে—শুধুমাত্র শ্রমের যন্ত্ররূপে।

অহমভাব হলো উচ্চ আত্মাদের স্বভাব। আমি ‘ঈগোবাদ’ বলতে বুঝি সেই দৃঢ় বিশ্বাস, যেখানে স্বভাবতই ধরে নেওয়া হয় যে, অপরেরা আমাদের মতো সত্তাদের অধীন হবে, নিজেদের উৎসর্গ করবে। এই ধরণের অহমবোধ উচ্চ আত্মাদের অন্তর্গত; এর মধ্যে কঠোরতা, জোরজবরদস্তি কিংবা খামখেয়ালিপনা নেই। বরং এটি হলো জগতের মৌলিক বিধান।

এর জন্য যদি আমি একটি নাম খুঁজতে চাই, তবে একে আমি বলব—ধার্মিকতা। (নিৎশে “Beyond Good and Evil”)

ফ্যাসিবাদের সকল মৌলিক নীতি নিৎশে দ্বারা নির্মিত হলেও, এই রক্তাক্ত আন্দোলনের ভাবাদর্শ উৎপাদনকারী হিসেবে আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এদের মধ্যে বার্গসন ও জর্জ সোরেলের অনুসারীরা উল্লেখযোগ্য। এই আধ্যাত্মিক সিলসিলার তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে এটা মনে রাখা জরুরী যে, বার্গসন তার অধিবিদ্যাগত মতবাদের সাথে বস্তুর বিষয়গত বাস্তবতার সামঞ্জস্যবিধান করতে চেয়েছেন। বস্তুবাদী দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করলেও, আধ্যাত্মিকতার মোড়কে স্থুল বস্তুবাদের চর্চা করেছেন তিনি। আধ্যাত্মবাদ তথা ভাববাদের প্রাথমিকতা স্বীকার করে তিনি বস্তুবাদ ও আধ্যাত্মিকতার একটি সংযুক্তি নির্মাণ করতে চেয়েছেন। এই প্রচেষ্টা দর্শনকে আবারো দ্বৈতবাদের দুষ্টচক্রে স্থাপন করেছে। অতীতে দ্বৈতবাদী দর্শনের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি ছিল সামন্তীয় রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচার; আজকের দিনে তা সংসদীয় গণতন্ত্রের অবসান ও ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। দ্বৈতবাদী দর্শন ধর্মীয় মৌলবাদকে পুনরুত্থিত করে—যে ধর্মীয় মৌলবাদ মানুষ স্বরূপ ঈশ্বর ও তার দ্বারা সৃষ্ট জগতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এই আদিম ধর্মীয় ভাবনা নিজেই অবাধ (রাষ্ট্রীয়) ক্ষমতা প্রয়োগের একটি ভাবাদর্শিক প্রতিফলন—যা বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের (তথা বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্রের) রূপ গ্রহণ করেছে। একটি বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে অতীতে বুর্জোয়ারা রাজাদের ঐশি অধিকারকে অস্বীকার করেছে; বর্তমানে একটি প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণি হিসেবে তারাই আবার ঐ কল্পিত-ঐশি অধিকারের দিকে ঝুঁকছে; নিজেদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য অতীতে তারা যেসব সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছেন, এখন তারা সেগুলোকেই সমর্থন করছে; রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্র, জনগণের উপর বলপ্রয়োগ, অর্থনৈতিক তাণ্ডব ও সামাজিক বর্বরতা সহ যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণে তারা রাজি।

অবাধ ক্ষমতার প্রয়োগ এবং সর্বশক্তিমান ইচ্ছার সমর্থনে দার্শনিক-নৈতিক সম্মতি অতিমানবের কৌলিকতার ভিত্তি—এই কৌল অনিবার্যরূপে নিষ্ঠুরতা, সহিংসতা, বল প্রয়োগ ও নিপীড়নের জন্ম দেয় (সবগুলোই ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য)। একজন মুসোলিনি বা হিটলার, এই অতিমানব কৌলিলতারই মূর্তায়ন। অতিমানব হিসেবে তিনি আধ্যাত্মিক ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেন এবং পার্থিব বিষয়ে স্বাধীনতা, অধিকার, ন্যায্যতা অথবা নৈতিকতার মতো মানবীয় ধারণা দ্বারা সীমাবদ্ধ নন। একারণে পৃথিবীর এই রক্ষাকর্তা ও পুনর্জীবনদানকারী, কোন রাখডাক না রেখেই ঘোষণা করেন যে— স্বাধীনতা নাগরিকত্বের কোন অপরিহার্য উপাদান নয়; ব্যক্তি নাগরিক কেবল রাষ্ট্রের অবাধ ইচ্ছা ও ক্ষমতার মাঝেই প্রকৃত স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে৷ একইভাবে, বুর্জোয়া স্বার্থ রক্ষাকারী আধুনিক একনায়ক অতীতের সামন্ত প্রভুর মতো ঘোষণা করেন “L’État c’est moi”—”আমি নিজেই রাষ্ট্র”। সামন্ত প্রভুর মতো তিনিও ঐশি অধিকারের দাবি করেন। প্রুশিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণকালে গোয়েরিং নিজেকে ঐ সব প্রুশীয় রাজাদের “সরাসরি উত্তরাধিকারী” বলে ঘোষণা করেন, যারা একইসাথে ছিলেন সর্বশক্তিমান বিশপ। এই সর্বশক্তিমানরা “পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি” হিসেবে শাসন করতেন; তাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে ফ্যাসিবাদী একনায়করাও এই ঐশি অধিকার লাভ করেছেন।

হিটলারের মতে, রাষ্ট্রই সবকিছু এবং সার্বভৌম শক্তি রাষ্ট্রের গুটি হিসেবে বেঁচে থাকা ছাড়া ব্যক্তি নাগরিকের অন্য কোন অধিকার নেই। সার্বভৌম রাষ্ট্র নিজ খেয়াল খুশি অনুযায়ী যেকোন মুহুর্তে তার জীবন নিয়ে বাজি ধরতে প্রস্তুত। সার্বভৌম ক্ষমতার মধ্যযুগীয়-আধ্যাত্মবাদী রাজনৈতিক দর্শন যৌক্তিকভাবেই ফ্যাসিবাদীদের দায়িত্ব-জ্ঞানশূন্য যুদ্ধ-প্রোপাগান্ডার দিকে বাঁক নেয়। সার্বভৌম-সর্বশক্তিমান শাসকের অহমিকা অথবা খাম-খেয়ালিতা যেকোন সময় জনগণকে আহবান কর‍তে পারে মলোখের (কাননবাসীদের ঈশ্বর, যার বেদীতে শিশুদের উৎসর্গ করা হতো) বেদীতে আত্মো-উৎসর্গ করতে। জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগুক বা না লাগুক, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য অথবা দেশপ্রেমের কর্তব্যের কারণে নিজেদেরকে উৎসর্গের জন্য জনগণকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে৷ জার্মান বুর্জোয়াদের মাঝে হিটলারের (ক্ষমতা গ্রহণের) পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করা ভ্যান পাপেন, ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দর্শনের এই ব্যবহারিক তাৎপর্য অত্যন্ত অকপটে ঘোষণা করেছেন। তার মতে: “নারীদের কাজ হলো ভবিষ্যৎ যোদ্ধা তৈরির জন্য সন্তান জন্ম দেয়া৷ যুদ্ধ ময়দানে প্রাণদানের থেকে উত্তম কোন জীবন-আদর্শ পৃথিবীতে নেই।” রক্তদানের এই ফ্যাসিবাদী কৌলিকতা মাতৃত্বকে অবমূল্যায়িত করে এবং ঠিক এ কারণেই তারা বস্তুবাদী দর্শনের অনুসারীদের সমালোচনা ও বাধার শিকার হয়৷ তখন ফ্যাসিস্টরা ধর্মধ্বজধারী ভন্ডামির পথ গ্রহণ করে। তাদের অভিযোগ বস্তুবাদী দর্শনের অনুসারীরা পবিত্র পরিবারকে ভেঙে ফেলতে চায়। অবশ্য, সনাতনী ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কানে আত্মউৎসর্গের এই ফ্যাসিবাদী আহবান পরিচিতই শোনাবে—তারা ক্ষত্রীয় গুণাবলির এক মনোরম প্রতিধ্বনিই শুনতে পাবে এই ফ্যাসিবাদী আহবানে।

“জাতীয় সমাজতন্ত্র” বা “হিটলার” উভয়ই মধ্যযুগীয় প্রুশীয়বাদের বিভৎস ভূত। ভারতে এখনো যা ক্ষত্রীয় গুন বলে মহিমান্বিত হয়, তারই প্রতিনিধিত্ব করে প্রুশীয়বাদ। যখন জনগণ ভূমিদাসত্বে বন্দি ছিল, তখন তাদের কাছে এই ক্ষত্রীয় ‘গুন’ প্রচার করা হতো। সামন্ত প্রভুর ভূমিদাসদের (ভারতীয় ও প্রুশিয় উভয়ই) অনেক সময়ই চাষের ক্ষেত ছেড়ে তরবারি ধর‍তে হতো। এই পেশাগত পরিবর্তন যেহেতু তাদের নয়, বরং সামন্ত প্রভুদের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিল (ঐ সময়ে ক্ষেতে খাটার থেকে ডাকাতি বেশী লোভনীয় পেশা ছিল), সেহেতু, ক্ষত্রীয় গুনের ভাবাদর্শ তথা মহিমা তাদের মাঝে স্থাপন করা প্রয়োজনীয় ছিল। একারণেই, যুদ্ধ ক্ষেত্রে মৃত্যুর আদর্শ মহাকাব্যে মহামান্বিত হয়েছে এবং প্রচারিত হয়েছে বহুবিধ কিংবদন্তি আখ্যানে। প্রকৃতপক্ষে, জনগণের মাঝে বীরত্ব সম্পর্কে এক বিকৃত ধারণা নির্মাণের জন্য এই মহাকাব্য গুলো রচিত হয়েছে; প্রুশীয় জাতীয়তাবাদের মতোই ক্ষত্রীয় বীরত্ববাদের ব্যবহারিক মূল্য ছিল সামন্ত প্রভুর ক্ষমতার সম্প্রসারণ। যদিও কখনো কখনো প্রভুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে একে দেখতে হবে এই খেলার অংশ হিসেবে। ফটকাবাজি ও রোমাঞ্চের লাভ-ক্ষতি উভয়ই রয়েছে।

“এটা আমাদের সমাধি ফলকে লেখা হোক: আমরা কঠোর ছিলাম, আমরা নিষ্ঠুর ছিলাম; কিন্তু আমরা ভালো জার্মান ছিলাম” (হিটলার)। অতিমানবের কৌলিকতা হিটলারবাদের আরেকজন নায়ককে সক্ষম করেছিল এটা ঘোষণা করতে: “নিজের তৈরী আইন ভাঙার সাহস রাষ্ট্রের থাকতে হবে”। দুনিয়াতে এই ধরনের অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা চর্চার নৈতিক সম্মতি কেবল এমন একটি অতিপ্রাকৃতিক আধ্যাত্মবাদী শক্তি তথা সর্বশক্তিমান স্বর্গীয় ইচ্ছার ছদ্ম-দার্শনিক ধারণার মাঝেই পাওয়া সম্ভব, যা কোন ধরনের প্রাকৃতিক আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ হবে না, কিন্তু তার ভূমিকা হবে সকল মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণকারী এক সার্বভৌম শক্তির। এটাই ফ্যাসিবাদের দর্শন, যার সারবত্তা হলো অতিমানবের কৌলিকতা । এটা এমন একটি দর্শন, যার সাথে বেদান্ত দর্শনে বিদ্যমান ভারতীয় আধাত্মবাদের লক্ষণীয় মিল পাওয়া যায়। দুনিয়াকে ঈশ্বরের লীলা হিসেবে দেখা ভারতীয় দ্বৈতবাদী দর্শনের সাথেও এর সাদৃশ্য রয়েছে। ঠিক এই দার্শনিক জ্ঞাতিত্বের কারণেই স্পেঙ্গলার, স্প্যান, কেইজারলিং সহ জার্মান ফ্যাসিবাদের অনেক ভাবাদর্শিক নির্মাতা প্রাচ্যের আধ্যাত্মবাদী দর্শনকে প্রশংসা করে—তাদের মতে, প্রাচ্যের বার্তাই পারবে আধুনিক পাশ্চাত্যকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করতে।

ফ্যাসিবাদের দর্শন ও ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ সারগত ভাবে অভিন্ন। যদি ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদী সভ্যতাকে বাঁচাতে সক্ষম হয়, তখন ভারতের আধ্যাত্ম সম্ভবত একটি প্রতিরূপ গৌরবের দাবি করতে পারে। কিন্তু এর মাধ্যমে বস্তুবাদের দুনিয়া মুক্ত হবে না। বরং, তা স্থুল বস্তুবাদের প্রভুত্বে মানবতাকে বন্দী রাখার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে সাহায্য করবে। এই ধরনের ‘গৌরব’ আনা দর্শন নিয়ে আমরা কি গর্বিত হতে পারি? যুগের পর যুগ ধরে একটি মিথ্যা আদর্শ লালন করার জন্য এই গৌরব কি আমাদের লজ্জিত করবে না? এই প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক এবং সেই সকল ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবা উচিত, যারা চিন্তা করতে জানেন, যারা পূর্ব সংস্কার দ্বারা চালিত নন অথবা যারা সচেতন প্রতিক্রিয়াশীল নন—অর্থাৎ, সম্ভাব্য ফ্যাসিস্ট নন।

আবদুল্লাহ হেল বুবুন

আবদুল্লাহ হেল বুবুন পড়াশুনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। আগ্রহের বিষয় মার্ক্সবাদ, সোশ্যাল থিওরি, বিজ্ঞানের দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ইতিহাস।