অরাজ
শিল্পী: মারিয়া ব্লানচার্ড
প্রচ্ছদ » ওয়াল্টার এলেন জেঙ্কিন্স ।। গণতন্ত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়

ওয়াল্টার এলেন জেঙ্কিন্স ।। গণতন্ত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়

  • অনুবাদ: কাজী মোতাহার হোসেন

[১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন মাহেনও পত্রিকায় এ অনুবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয়। অরাজের পাঠকদের জন্য তা অনলাইনে তুলে দেয়া হলো। সম্পাদক]

কাজী মোতাহার হোসেন

পৃথিবীর যেসব দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছে, সেইসব দেশে সমাজের সর্বস্তরের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত ও পরিচালিত হইয়া থাকে, এবং ইহাকে জাতীয় জীবনের একটা অচ্ছেদ্য অংশ বলিয়াই মনে করা হয়। কিন্তু সবসময় এমন অবস্থা ছিল না। পঞ্চাশ বৎসর পূর্বেও প্রায় সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগসুবিধা কেবল সমাজের বিশেষ গৌভাগ্যবান শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় তখন আত্মসংহত হইয়া পার্থিব সমস্যাবলী হইতে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করিয়া যাইত। ভাগ্যবানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করিয়া ভাবরাজ্যের কঠিন কঠিন সমস্যা সম্বন্ধে চিন্তা করিতেন, প্রাচীন সংস্কৃতি ও পূর্ববর্তী পণ্ডিতগণের জ্ঞানরাশি আয়ত্ত করিতেন, এবং খ্যাতনামা মনীষী ও সহপাঠীদের সংশ্রবে আসিয়া আপন আপন ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন করিতেন। দেখা যায়, অনেক দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্য হইতেই অধিক সংখ্যক রাজনীতিবিশারদ বা রাষ্ট্রপরিচালকের আবির্ভাব হইয়াছে। কিন্তু কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণেই এরূপ হইয়াছে, তাহা বলা যায় না। উপরােক্ত রাজনীতিজ্ঞ ও রাষ্ট্রচালকগণ এমন সব পরিবারে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, যেখানে জন্মগত উত্তরাধিকার এবং অনুকল পরিবেশের ফলে স্বভাবতঃই নেতার সৃষ্টি হইয়া থাকে এবং তাহাদেরই সন্তানগণ স্বতঃই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করিয়া থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যাবলীর মধ্যে দুইটি প্রধান উদ্দেশ্য রহিয়াছে; প্রথমতঃ গবেষণা ও জ্ঞানােন্নয়ন, দ্বিতীয়তঃ অধ্যাপনা ও তরুণদের শিক্ষাদান। অতীতকালে দ্বিতীয়টি প্রধানতঃ প্রথমটি হইতেই উদ্ভূত হইত। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান লক্ষ্যই ছিল জ্ঞানােন্নয়ন। তরুণেরা কৃষ্টি ও জ্ঞানার্জনের পরিবেশে কিছুকাল বাস করিবার ফলে আপনা আপনি উহা হইতে হিতকর বিদ্যা আত্মস্থ করিয়া লইতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়ােগরহিত বিশুদ্ধ আলােচনা ও কর্মসূচীর ফলে অল্পাধিক মনঃসংযম স্বভাবতঃই অভ্যস্ত হইয়া পড়ে। ছাত্রদের সমবেত ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়া ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্ব বিকাশেরও সুযােগ উপস্থিত হয়। অধ্যাপকেরা অনেক সময় গবেষণাকেই একমাত্র উপযুক্ত কার্য মনে করিয়া শিক্ষাদান ব্যাপারটিকে অনেকটা আপদ বলিয়া গণ্য করিতেন। তথাপি তাহারা সাজাইয়াগােছাইয়া যুক্তিতর্কের সাহায্যে যেটুকু আলােচনা করিতেন, তাহাতেই জ্ঞানপিপাসু চিত্ত উদ্বুদ্ধ শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর হইতে পারিত। কোনাে বিশিষ্ট পণ্ডিত ভালােভাবে শিক্ষাদান করিতে না পারিলেও, যদি তিনি জ্ঞানলিপ্সা ও সত্যানুসন্ধিৎসা জাগ্রত করিতে পারিতেন, তবে কেবলমাত্র তাহাঁর সংস্পর্শে আসিয়াই শিক্ষার্থীদের যথার্থ উপকার হইত।

বিগত পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে অনেক নূতন চিন্তাধারা প্রবর্তিত হইয়াছে এবং জাতীয় জীবনের সহিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কিরূপ সংস্পর্শ হইবে, সে ধারণাও সম্পূর্ণ বদলিয়া গিয়াছে। অবশ্য নানা কারণে ঐরূপ অবস্থার উদ্ভব হইয়াছে, কিন্তু ইহার প্রধান কারণ হইতেছে এই যে, বর্তমান যুগে মানুষের জীবনধারার মূল ভিত্তি স্বৈরতন্ত্র হইতে সরিয়া আসিয়া গণতন্ত্রের উপর স্থাপিত হইয়াছে। অবশ্য এখনও এমন অনেক লােক আছেন যাঁহারা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় হইবে জাগতিক ব্যাপারাদি হইতে বিচ্ছিন্ন গজদন্তের শুচিশুভ্র প্রাসাদবিশেষ এবং সেখানে সাধনার বিষয় হইবে কেবল বিশুদ্ধ জ্ঞান এবং সত্যের সন্ধান। কিন্তু এরূপ লােকের সংখ্যা দ্রুত হাস পাইতেছে; অতএব তাহাদের উক্ত মত উপেক্ষা করা যাইতে পারে। মােট কথা, যে কারণেই হউক, আর ব্যক্তিবিশেষের যত অপ্রিয়ই হউক এ সত্য অস্বীকার করিবার পায় নাই যে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যাবলী বাস্তব জীবনের সহিত সম্পর্কিত হইয়া পড়িয়াছে এবং ভবিষ্যতে আবার যে কখনও এই সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন হইয়া যাইবে, এরূপ সম্ভবনাও নাই। কিন্তু ইহাতে একটি নতুন বিপদের আশঙ্কা দেখা দিয়াছে, যাহা চিন্তা করিয়া বহু শিক্ষাবিদ বিচলিত হইয়া পড়িয়াছেন। বিপদটা এই যে, বাস্তব জীবনের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচী একীভূত করিয়া ফেলিলে প্রয়ােজনের দিকটা অত্যধিক প্রাধান্য লাভ করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাপীঠ এবং সংস্কৃতিসদন বলিয়া যে মূল্য আছে তাহা বিনষ্ট হইয়া যাইতে পারে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকিতেই হইবে; কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য হইতে সত্যানুসন্ধান এবং জ্ঞানােন্নতি অপসারিত হইলে বড়ই পরিতাপের বিষয় হইবে। বিশ্ববিদ্যালয় যদি কেবলমাত্র শিল্প প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত হয়, (সে শিল্প যতই উচ্চাঙ্গের বা প্রয়ােজনীয় হউক কেন) তাহা হইলে উহার দেহ বলিষ্ঠ মনে হইলেও উহা প্রাণহীন হইয়া পড়িবে। ইহা প্রকতই বিপদের কথা। বর্তমানে সকল বিশ্ববিদ্যালয়কেই যে সমস্যার সম্মুখীন হইতে হইতেছে তাহা এই যে, ইহার পরিকল্পনা এবং কার্যাবলী একদিকে পারিপার্শ্বিক সমাজপ্রয়ােজনের সহিত খাপ খাওয়াইয়া লইতে হইবে, অন্যদিকে তেমনি ইহাকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্ররূপেও অব্যাহত রাখিতে হইবে; অন্য কথায় সামাজিক প্রয়ােজন বলিতে কেবল পার্থিব উন্নতিই নহে, পারমার্থিক উৎকর্ষও বুঝিতে হইবে। অতীতকালে, যখন স্বৈরতন্ত্র প্রচলিত ছিল এবং (যে কারণেই হউক) ব্যক্তিবিশেষ অপ্রতিহত ক্ষমতার অধীশ্বর ছিলেন, তখন দেশের সকল সমস্যাই ছিল আভ্যন্তরীণ সমস্যা। তখন শাসকের ইচ্ছা ছিল অপ্রতিহত—উহা যুক্তিসঙ্গত বা লিখিত নিয়মাধীন হইবার কোনাে বাধ্যবাধকতা ছিল না। এমনকি উহা ন্যায়সঙ্গত না হইলেও চলিত। কাজে কাজেই তখনকার অধীশ্বর বা তাঁহার কর্মচারী ও উপদেষ্টাগণের পক্ষে কোনও বিশিষ্ট জ্ঞান বা শিক্ষা অপরিহার্য ছিল না।

তখনকার দিনে দেশের ঘটনাস্রোতের উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে উল্লেখযােগ্য প্রভাব লক্ষিত হয় না। বস্তুতঃ জ্ঞানােন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের দান প্রচুর হইলেও মানবেতিহাসের উপর ইহার প্রভাব অতি নগণ্য। তখন বিশ্ববিদ্যালয় বাঞ্ছিত হইলেও অপরিহার্য বলিয়া বিবেচিত হইত না। গণতন্ত্রের যুগে ইহার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাইয়াছে—এখন ইহা শুধু বাঞ্ছনীয় নহে, অপরিহার্যও বটে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় গণতন্ত্রকে রূপ দিবার জন্য এবং ইহার সৃষ্ট সমস্যাসমূহের সমাধানের জন্যও ততােধিক অপরিহার্য। গণতন্ত্রের সহিত বিবিধ প্রকার সমতার ধারণা জড়িত আছে। এইসব সমতার কোনাে কোনােটি সম্বন্ধে যতই মতভেদ থাকুক না কেন, ‘সুযােগের সমতাকে অত্যাবশ্যক বলিয়া মানিতেই হইবে। শিক্ষার দ্বারাই প্রখর বুদ্ধি এবং স্বাভাবিক ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিরা নিজেদের ক্ষমতার বিকাশ সাধন করিয়া নেতৃত্ব লাভের যােগ্য হইতে পারেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ই সম্ভাব্য সর্বোচ্চ শিক্ষার সুযোগ দান করে। সুতরাং যাহারা যােগ্যতার বিচারে এই শিক্ষা দ্বারা উপকৃত হইবার ক্ষমতা রাখে, গণতান্ত্রিক দেশে তাহাদের সকলকেই সমান সুযােগ ও সুবিধা দিতে হইবে। সে দেশে বয়ঃপ্রাপ্ত সকলেই যাহাতে সন্তোষজনকভাবে নিজেদের নাগরিক অধিকারের সদ্ব্যবহার করিতে পারে, সে জন্য সুষ্ঠ প্রাথমিক শিক্ষা অপরিহার্য। সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সমধিক যাহা শেষ পর্যায়ে নেতৃবৃন্দের শিক্ষাক্ষেত্র রূপে সুফলপ্রসূ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়া সমাপ্ত হইবে।

স্থানীয় কোনাে সাময়িক পত্রিকায় সম্প্রতি একটি অতি সঙ্গত ও নির্ভুল উক্তি প্রকাশিত হইয়াছিল যে, জনসাধারণ তথ্যাভিজ্ঞ এবং সুশিক্ষিত না হইলে কোনাে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই কার্যকরী হইতে পারে না। নিরক্ষরতা আর গণতন্ত্র অবশ্যই পরস্পরবিরােধী । কিন্তু নিরক্ষরতা দূর হইলেও বর্তমান জটিল রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রের সুষ্ঠ পরিচালনার জন্য কার্যকরীভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত সুনিয়ন্ত্রিত নেতার আবশ্যক। এমনকি নিরক্ষরতা দূর করিতে হইলেও এইরূপ বহু সুশিক্ষিত লােকের প্রয়ােজন।

স্বৈরতান্ত্রিক দেশে ব্যক্তির শাসন আর শক্তির শাসন চলে। সেখানে শিক্ষিত চিন্তাবিদের তেমন আবশ্যক নাই—সেখানে প্রয়ােজন শিক্ষিত সৈনিকের। কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র এবং প্রগতির সৃষ্ট সমস্যাবলী সমাধানের জন্যই প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন লােকদিগকে বাছিয়া বাছিয়া যথােপযুক্ত শিক্ষা দিয়া লইতে হয়। গণতন্ত্র কার্যকরী করিতে হইলে যে সৈন্যদল আবশ্যক হয়, সে হইতেছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুশিক্ষিত নেতার দল। বর্তমান অসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক যুগে এখনও দেশরক্ষার জন্য সৈন্যদলের প্রয়ােজন আছে বটে; কিন্তু শুধু দৈহিক নিরাপত্তা হইলেই চলিবে না; ইহা ছাড়া আরও অনেক জরুরী সমস্যাও রহিয়াছে যাহার সমাধান প্রয়ােজন।

আমরা এক দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতে বাস করিতেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ও এই পরিবর্তনের মধ্যে কাজ করিতেছে। যেকোনাে বিষয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বর্তমানে যেন জটিল হইয়া উঠিয়াছে। শুধু যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পন্থাই জটিল, তাহা নহে, আসলে বর্তমান যুগে আমাদের যেসব সমস্যার সম্মুখীন হইতে হইতেছে সেগুলিই পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশী জটিল। সেগুলি এতই দূরূহ যে, উহার সন্তোষজনক সমাধান করিতে হইলে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান এবং তদনুযায়ী শিক্ষিত মনের আবশ্যক। শুধু রাজনীতিজ্ঞ ও শাসকবর্গের জন্যই নহে, শিল্পপতি এবং বণিকদের জন্যও এইরূপ বিশিষ্টজ্ঞান আয়ত্ত করা আবশ্যক। এখন আভ্যন্তরীণ সমস্যা ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক নীতি প্রয়ােগ করিতে হইবে। রাষ্ট্রপরিচালকগণকে শুধু বহুদর্শী ও পারদর্শী হইলেই চলিবে না, কোনাে বিষয়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার জন্য সেসম্বন্ধে যথাযােগ্য জ্ঞানার্জনও করিতে হইবে। অবশ্য তাঁহাদের পক্ষে আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক ব্যাপারের সমুদয় বিভাগেই নৈপুণ্য অর্জন করা সম্ভব নহে। তাই, যেসব বিষয়ের ভার তাঁহাদের উপর ন্যস্ত হইয়াছে, সেই সেই বিষয়ে সুস্পষ্ট ও সংস্কারমুক্তসম্পন্ন কতিপয় সুদক্ষ উপদেষ্টার প্রয়ােজন। শিল্পপতি এখন আর শুধু আঞ্চলিক জ্ঞান লইয়াই কিংবা আপন খেয়ালখুশীমতাে বলিয়াই সাফল্যের সহিত ব্যবসায়বাণিজ্য পরিচালন করিতে পারেন না। উহা সম্ভব ছিল বিগত যুগের ক্ষুদ্র খণ্ডিত পৃথিবীতে। বর্তমানে যে পরিবর্তন সংঘঠিত হইয়াছে তাহার ভালােমন্দ বিচার না করিয়াও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এখন শিল্পপিত ব্যবসায়পরিচালকগণকে কর্মীদের অভিপ্রায় বা মতামতের দিকেও লক্ষ্য রাখিতে হইবে। শ্রমিকেরা কি অবস্থায় জীবনযাপন করিতেছে, সে সম্বন্ধে অবহিত হইতে হইবে এবং তাদের দায়িত্ব কিছুটা নিজেদের স্কন্ধে বহন করিতে হইবে। ইহা ছাড়া তাঁহাদিগকে গবর্ণমেন্টের বাধানিষেধের অনুবর্তী হইয়া এবং বর্তমান কঠিন অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া কাজ করিতে হইবে। অধিকন্তু, তাঁহাদের ব্যবসায় সংক্রান্ত কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ভিন্নদেশীয় ব্যবসায় নীতি বা সাম্প্রতিক অবস্থার উপর নির্ভর করিয়া থাকে; তাই কার্যকরীভাবে ব্যবসায়বাণিজ্য পরিচালন করিতে হইলে বর্তমানে বৈদেশিক অবস্থা এবং উহার গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধেও সম্যক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করিতে হইবে। পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে যেকাজ অতি সহজে মালিক বা পুঁজিপতি স্বয়ং নিম্নস্থ কর্মচারীদের সাহায্যে অথবা বিনা সাহায্যেই সম্পন্ন করিতে পারিতেন, তাহাই এখন শ্রমিক, গবর্ণমেন্ট, ট্রেড ইউনিয়ন, অংশীদার এবং দেশীয় ও বৈদেশিক ক্রয়বিক্রয়নীতি সমন্বিত একটি বিরাট সমস্যায় পরিণত হইয়াছে। সমস্যাটি এত অভাবনীয় রূপে জটিল হইয়া পড়িয়াছে যে, বহু ক্ষেত্রে সাময়িক গোঁজামিল দিতে গিয়া অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়, কিংবা অতি শীঘ্রই অগণিত নূতন সমস্যার উদ্ভব হয়। যাহা হউক বর্তমানে এই যে নূতন পরিস্থিতি দাঁড়াইয়া গিয়াছে ইহার মুকাবেলা করিতেই হইবে। যেসব দেশ শিল্প ও বাণিজ্যে সর্বাধিক সফলতা লাভ করিয়াছে, সেইসব দেশের ব্যবসায় পরিচালক ও কার্যকারকগণের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত লােকের হার। উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে। ইহা একটি লক্ষণীয় বিষয়। অবশ্য ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা বা বিশেষ জ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় না। তখনি সুপরিকল্পিত এবং সুপরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটা জ্ঞানের ও মনঃসংযমের পটভূমিকা সৃষ্টি করা হয়, যাহা ব্যবসায় জগতেই হউক বা গবর্ণমেন্ট পরিচালনায়ই হউক বিশেষ কার্যকরী ও ফলপ্রসু হয়। শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রে শান্তি ও স্থায়িত্বের জন্য অবশ্য এমন শিক্ষিত শ্রমিকদল দরকার যাহারা আপন আপন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা ও শর্তাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের দাবীদাওয়ার স্বপক্ষে ও বিপক্ষে কি কি যুক্তি আছে সেসম্বন্ধে ওয়াকেফহাল হয়। শুধু তাহাই নহে পরিচালকদেরও উৎপাদন প্রণালী, নিয়ােগকর্তা ও নিযুক্তদের মধ্যে মানবীয় সম্পর্ক, সাধারণ ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমস্যাদি এবং জাগতিক ব্যাপারের সহিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। দেশ যতই সমুন্নত হইবে এবং জনসাধারণ যতই শিক্ষিত হইবে, ততই ইহার শিল্পবাণিজ্যবিষয়ক সমস্যা জটিলতর হইতে থাকিবে। এইসব সমস্যার সমাধানের উপযুক্ত লােক তৈয়ার করিতে হইলে তদনুরূপ শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। সাধারণ জ্ঞান ও শিক্ষার উন্নয়ন দ্বারা পরােক্ষভাবে এবং বিশেষ শিল্পজ্ঞান শিক্ষা দিয়া সাক্ষাৎভাবে শিল্পবাণিজ্য সংক্রান্ত ব্যাপারেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু করিবার আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যাবলীর মধ্যে কতকগুলি মানুষের পারস্পরিক সম্বন্ধ ও সামাজিক ব্যবহার বিষয়ে গভীরতর জ্ঞানদান করে, কতকগুলি সমবেত কর্মপন্থার মূল্যবােধ জাগ্রত করিয়া নেতৃত্ব অর্জনের ক্ষমতা জন্মায়; এবং অপর কতকগুলি সংযম ও শৃঙ্খলা শিক্ষা দেয়। ইহার সবগুলিই শিল্প ও বাণিজ্যিক জগতে সফলতা লাভ করিবার জন্য অতি প্রয়ােজনীয় উপাদান। অনেক শিক্ষাপ্রস্তাবেই শিল্পশিক্ষাকে দেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলিয়া অভিহিত করা হয়। বর্তমান জগতে শিল্পশিক্ষার মূল্য ও গুরুত্ব কেহই অস্বীকার করিতে পারে না। কিন্তু কোনাে দেশের শিল্পবাণিজ্যের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য ও যন্ত্রশিল্পের উন্নতি কাজে লাগাইবার ফলে যেসকল মানবীয় সমস্যার উদ্ভব হয়, শিল্পশিক্ষায়তনে যথােচিত লক্ষ্য না রাখিলে তৎপ্রতি অনর্থ ঘটিবার সম্ভাবনা। প্রায়ই দেখা যায়, বর্তমান পরিকল্পনাকারীরা মনে করেন, অধিক সংখ্যায় শিল্পশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করিলেই বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগের প্রয়ােজন মিটিবে। যাঁহারা নির্বিচারে পূর্বোক্ত মত পোষণ করেন তাঁহাদের বিবেচনা করিয়া দেখিতে বলি, কি কারণে জার্মানী ও আমেরিকার ন্যায় দুইটি বৃহৎ শিল্পপ্রধান দেশেও অভিজ্ঞতার ফলে জানা গিয়াছে যে, বিশুদ্ধ শিল্পশিক্ষার পাঠ্যসূচিতে সাধারণ কৃষ্টি ও সাহিত্যাদি বিষয়েও খানিকটা শিক্ষার সংমিশ্রণ রাখা প্রয়ােজন।

এডুকেশন ইজ অ্যা ওয়ে অফ ফ্রিডম
শিল্পী: নাওয়ার খালিল
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

পাশ্চাত্য দেশের শিক্ষানীতিতে বর্তমানে একটি বিষয় লইয়া বিস্তর আলোচনা চলিতেছে। বিষয়টি এইবিশ্ববিদ্যালয়েই শিল্পশিক্ষার ব্যবস্থা করা হইবে, না শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করা হইবে? এ বিষয়ে মতভেদ থাকিলেও এইসব আলােচনার মধ্যে দুইটি বিষয়ে সাধারণ মতৈক্য দেখা যাইতেছে। প্রথমতঃ ভালােই হউক আর মন্দই হউক, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে দেশের লােকশিক্ষা ব্যবস্থার এক অচ্ছেদ্য অংশ হইয়া পড়িয়াছে; দ্বিতীয়তঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত লােকদের এমন কিছু বিশেষ গুণ আছে যাহা প্রায় সমুদয় শিল্পবাণিজ্য ক্ষেত্রেই ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতার পরিপােষক হিসাবে মূল্যবান৷ শিল্পপতিরা এখন ক্রমশঃই শিল্পবাণিজ্যে কর্মচারী নিয়ােগের বেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত বুদ্ধিমান লােকদিগকেই প্রাধান্য দিতেছেন, অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়কেও এই নূতন পরিস্থিতির সহিত খাপখাওয়াইয়া ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করিতে হইবে।

কাজী মোতাহার হোসেন