- অনুবাদ: আরিফ রেজা মাহমুদ
[সম্পাদকীয় ভূমিকা: জোভান্নি জেন্তিলে (১৮৭৫–১৯৪৪) ছিলেনে ইতালীয় দার্শনিক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। ১৯২০ এর দশকে তিনি পরিণত হন ফ্যাসিবাদের কর্তৃপক্ষীয় দার্শনিকে। এর আগে ইতালীয় দার্শনিক বেনেদিত্তো ক্রোচের সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন La Critica পত্রিকা। জেন্তিলের ফ্যাসিবাদ বিষয়ক প্রধান গ্রন্থ Origini e dottrina del fascismo ১৯২০–এর দশকের শেষভাগে রচিত। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে Libreria del Littorio প্রকাশনা সংস্থা থেকে। গ্রন্থটির প্রথম ইংরেজি অনুবাদ, টীকা ও সম্পাদনা করেন ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্থনি জেমস গ্রেগর। Origins and Doctrine of Fascism ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে Transaction Publishers থেকে। বর্তমান রচনাটি গ্রন্থের প্রচ্ছদ প্রবন্ধটিরই (একই শিরোনাম) সর্বশেষ অংশ।
ফ্যাসিবাদ বিষয়ক বিপুল সমালোচনা সত্ত্বেও বারংবার এর পুনর্জন্ম ও উত্থান ঘটেছে, এমনকি সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোতে। এর প্রধান কারণ বিংশ শতকেই ফ্যাসিবাদ নিয়ে মহীরূহ দার্শনিক ও চিন্তকদের বিভ্রম। নিজ সমাজ ও রাজনীতির সংকট থেকে উদ্ভূত ক্লেদকেই ফ্যাসিবাদের সমরূপ হিসেবে হাজির করার প্রবণতা বিদ্যমান থেকেছে দশকের পর দশক। ফ্যাসিবাদ মাত্রই ‘ উগ্র জাতিবাদ‘ ‘একনায়কত্ব‘ আর সামরিকতাপূর্ণ রাষ্ট্রকেই বোঝানো হয়েছে। খুব কম বিদগ্ধজনই ফ্যাসিবাদের চিন্তার পাটাতনে প্রবেশ করে এর সমালোচনা করেছেন। অনেকে এমনকি এর চিন্তাগত স্বীকৃতিটুকুও স্বীকার না করে কেবল ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন। বি–ফ্যাসিকরণ প্রশ্নটি হাজির হয়েছে উদারবাদী সংসদীয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্ন হিসেবেই। কিন্তু নব্য উদারবাদের বাড়বাড়ন্তর সঙ্গে একই সঙ্গে প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে এক নব্য ফ্যাসিবাদ। আর তা ঘটেছে বিপুল উদারবাদী সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশগুলোতেও। যুদ্ধ সহিংসতার যুক্তি হিসেবে হাজির হয়েছে খোদ গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নিরপত্তা নিজেই। যেন, নব্য উদারবাদ আর নব্য ফ্যাসিবাদ একাকার। তাহলে সংকট কোথায়? এই প্রশ্ন থেকেই ফ্যাসিবাদের চিন্তার পাটাতনে প্রবেশ করতে চায় অরাজ। ফ্যাসিবাদী সাহিত্যর ধ্রুপদী রচনাকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেও এর অনুবাদ জরুরি যাতে মোকাবিলার পথ তৈরি হয়।]
মূল লেখা
একবার ফ্যাসিবাদের মহান দ্যুচে আলোচনা করেছিলেন: ‘বল নাকি ঐকমত্য?’ শিরোনামে এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, এই দুই পরিভাষা অবিচ্ছেদ্য; একটিকে স্বীকার করলে অন্যটিকেও স্বীকার করতে হয়, কারণ একটির অস্তিত্ব অন্যটির ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও নাগরিকের স্বাধীনতা এক অটুট বৃত্তে আবদ্ধ, যেখানে কর্তৃত্ব স্বাধীনতাকে পূর্বানুমান করে, আর স্বাধীনতা কর্তৃত্বকে। স্বাধীনতা কেবল রাষ্ট্রের মধ্যেই পাওয়া যায়, আর রাষ্ট্র মানেই কর্তৃত্ব। রাষ্ট্র কোনো বিমূর্ত সত্তা নয়, যা আকাশ থেকে নেমে এসে নাগরিকদের মাথার ওপর ভেসে থাকে। বরং রাষ্ট্র ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই একাত্ম; সেই কারণেই ব্যক্তিকে রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হয়, খুঁজে বের করতে হয়, এবং তাকে স্বীকৃতি দিতে হয়। কারণ সেটি শেষ পর্যন্ত তার নিজেরই সৃষ্ট।
ফ্যাসিবাদ আসলে উদারনীতির বিপরীতে নিজকে এমনভাবে দাঁড় করায় না যে, একদিকে কর্তৃত্বের ব্যবস্থা আর অন্যদিকে স্বাধীনতার ব্যবস্থা। বরং ফ্যাসিবাদ নিজেকে দেখে এক বাস্তব ও সুস্পষ্ট স্বাধীনতার ব্যবস্থা হিসেবে, যা উদারনীতির বিমূর্ত ও ভ্রান্ত স্বাধীনতার বিপরীতে অবস্থান করে। উদারনীতি শুরু হয়েছিল আগের উল্লিখিত বৃত্তটিকে ভেঙে দিয়ে—অর্থাৎ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে, স্বাধীনতাকে কর্তৃত্বের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে। উদারনীতি এমন এক স্বাধীনতা খুঁজেছে, যা রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়ায়; এমন এক স্বাধীনতা, যা রাষ্ট্রকে সীমারেখা হিসেবে ধরে নেয়, আর রাষ্ট্রকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতার অনিবার্য সীমা হিসেবে মেনে নেয়। এগুলো ছিল বিমূর্ত ধারণা ও শূন্য কল্পনা, যেগুলো উনবিংশ শতকের সেই উদারপন্থীদের কাছেই সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যারা স্বাধীনতার স্বার্থে এক শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন ও আগাম অনুমান করেছিলেন।
ফ্যাসিবাদের কৃতিত্ব হলো, এটি সমসাময়িক উদারনীতির এই ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে অবস্থান নিয়েছিল এবং ঘোষণা করেছিল, উদারনীতি যে স্বাধীনতার কথা বলে, তা জনগণেরও নয়, ব্যক্তিরও নয়। তদুপরি, যেহেতু সর্বাঙ্গ রাষ্ট্র সবচেয়ে সুসংগত ও মৌলিক উপায়ে কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার ঐক্য ও সম্পূর্ণতা বাস্তবায়িত করতে চায়। আরও বেশি সত্যনিষ্ঠ ও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে। তাই নতুন রাষ্ট্র পুরনো রাষ্ট্রের তুলনায় আরও ‘উদার’।
কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার এই বৃত্ত কেবল ব্যক্তির চেতনার মধ্যেই বাস্তবায়নযোগ্য। সেই চেতনা ঐতিহাসিকভাবে উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে এবং বৌদ্ধিক ও নৈতিক অর্জনের ঐতিহ্যের সঙ্গে গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্র তার কাঙ্ক্ষিত বাস্তবতায় পৌঁছাতে পারত না যদি এটি তার সমস্ত চেতনাকে একটি সার্বভৌম শক্তি হিসেবে সেই ক্ষেত্রে ব্যবহার না করত। এটি সেই শক্তি যা কোনো শর্ত বা সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়। অন্যথা, রাষ্ট্র তার অন্তরের গভীরে শুধু বাতাসে ভেসে থাকত। কেবল সেই মূল্যবান এবং জীবন্ত আত্মিক চেতনাই সম্পূর্ণ যা কোন কিছুই বর্জন করে না।

রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব আলোচনা বা সমঝোতার বিষয় নয়, বা এর নিজ ক্ষেত্রকে অন্য নৈতিক বা ধর্মীয় নিয়মের সঙ্গে ভাগ করার ব্যাপারও নয়, যা এর সচেতনতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব শক্তিশালী এবং সত্যিকারের, যদি চেতনায় তা সম্পূর্ণভাবে অবাধ থাকে। রাষ্ট্রকে সচল করার চেতনা হলো চেতনার পূর্ণতা, যার সব উপাদানই তার উৎপাদন।
নৈতিকতা ও ধর্ম, যা প্রতিটি চেতনার অপরিহার্য উপাদান, রাষ্ট্রের মধ্যে থাকা আবশ্যক। তবে রাষ্ট্রের আইনকে প্রাধান্য দিয়ে তার সঙ্গে একীভূত ও দ্রবীভূত হতে হবে। মানুষ, যে তার সংকল্প গভীরে রাষ্ট্রের সংকল্পের প্রতিফলন—কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার সংশ্লেষ—হিসেবে কাজ করে, সেই মানুষই ধীরে ধীরে ধর্মীয় ও নৈতিক সমস্যার সমাধান করে। এসব দেশনা ও মূল্যবোধ ছাড়া রাষ্ট্র কেবল একটি যান্ত্রিক সত্তা হয়ে যেত এবং রাজনৈতিকভাবে যে মান অর্জনের দাবি করে তা হারাত। ‘হয় সিজার, নয়তো কিছুই নয়।’ এ থেকেই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ও রোমান ক্যাথলিক গির্জার সম্পর্কের সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চরিত্র উদ্ভূত হয়। একই যুক্তিতে, ইতালীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র, যা ইতালীয় জনগণেরই একাকার রূপ, তা হয় ধার্মিক নয়, নয়তো রোমান ক্যাথলিক।
রাষ্ট্র অধর্মী হতে পারে না, কারণ রাষ্ট্র নিজের ওপর যে চূড়ান্ত মূল্যবোধ ও কর্তৃত্ব আরোপ করে, তা ঐশি পরমত্বর সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়া বোঝা যায় না। এটি এমন একটি ধর্ম হবে, যার ভিত্তি জনগণের মধ্যে থাকবে, জনগণের সঙ্গে মেলাবে এবং অর্থ বোধগম্য হবে। এর মাধ্যমে পিতৃভূমির একমাত্র চূড়ান্ত সংকল্প ধর্মীয় অনুভূতিতে প্রকাশ পাবে। বিকল্প হলো চেতনায় ইতিমধ্যেই থাকা বিষয়গুলো বিকশিত না করা, বা যা চেতনায় নেই তা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া।
ক্যাথলিক হওয়া মানে গীর্জাকে অনুসরণ এবং তার শৃঙ্খলার অধীনে থাকা। তাই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের জন্য গীর্জার ধর্মীয় কর্তৃত্বকে স্বীকার করা ছিল রাজনৈতিকভাবে অপরিহার্য—রাষ্ট্রকে নিজের উদ্দেশ্যে কার্যকর করতে। ইতালীয় রাষ্ট্রের গীর্জা সম্পর্কিত নীতিকে এমনভাবে পরিচালনা করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ ও চূড়ান্ত থাকে, কিন্তু এটি ইতালীয়দের ক্যাথলিক চেতনার সঙ্গে সংঘাত তৈরি না করে, এবং গীর্জার অধীনে থাকা সেই চেতনার বিরোধও সৃষ্টি না করে।
এটি একটি গুরুতর সমস্যা, কারণ ক্যাথলিক গির্জার শীর্ষতাত্ত্বিক ধারণা ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ধারণার অন্তর্নিহিত স্বভাবের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে। যেমন বলা হয়েছে, ফ্যাসিবাদ উদারনীতি ও গণতন্ত্রের অস্বীকার নয়—এটি এমনকি ফ্যাসিবাদের নেতারাও প্রায়শই রাজনৈতিক কারণে উল্লেখ করেছেন। বরং ফ্যাসিবাদ মাৎসিনির মতাদর্শ অনুযায়ী উদারনীতি ও গণতন্ত্রের সবচেয়ে নিখুঁত রূপ হওয়ার চেষ্টা করে। এটি একটি দীর্ঘ, কঠিন ও উঁচু পথ।
ইতালীয় জনগণ সেই পথে বিশ্বাস ও উন্মাদনার সঙ্গে এগোচ্ছে, যা তাদের ইতিহাসে কোনো উদাহরণের সাথে মেলেনি। তারা এই যাত্রা সম্পন্ন করছে এমন এক শৃঙ্খলার সঙ্গে যা আগে কখনো দেখা যায়নি—কোনও দ্বিধা ছাড়া, কোনও আলোচনা ছাড়া, শুধুমাত্র সেই বীরত্বের মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তির প্রতি মনোযোগ রেখে, যার মধ্যে মহান নেতা হওয়ার অসাধারণ ও প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেই নেতা এগোচ্ছে নিশ্চিতভাবে, কিংবদন্তির আবহে আবৃত, প্রায় ঈশ্বর নির্বাচিত ব্যক্তির মতো, অবিরাম ও মর্যাদাপূর্ণ, যিনি প্রদত্ত উদ্যোগের একটি হাতিয়ার হিসেবে নতুন সভ্যতা গড়ছেন।
সেই সভ্যতার মধ্যে আমরা দেখতে পারি দুটি দিক—একটি যা ইতালির জন্য বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক এবং সংক্ষিপ্ত মেয়াদী মূল্য বহন করে, আর একটি যা স্থায়ী এবং সার্বজনীন মূল্য বহন করে।