অরাজ
আর্টওয়ার্ক: বুলশিট জব শিল্পী: জন রিওরডান সূত্র: স্ট্রাইক ম্যাগাজিন
প্রচ্ছদ » বেহুদা চাকরি: ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাসকদের রাজনৈতিক প্রকল্প

বেহুদা চাকরি: ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাসকদের রাজনৈতিক প্রকল্প

  • ইরফানুর রহমান রাফিন

একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা চিকিৎসকের কাজের সোশাল ভ্যালু আছে, কালকে এরা দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে গেলে, শহরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে এবং মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরা শুরু করবে।

একজন কবি বা শিল্পীর কাজেরও সোশাল ভ্যালু আছে, কালকে এরা দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে গেলে, মানুষের জীবন শুষ্ক বিবর্ণ হয়ে যাবে।

ডেভিড গ্রেইবার (১৯৬১- ২০২০)

কিন্তু একজন এইচআর কনসালট্যান্ট, ফিন্যান্সিয়াল স্ট্র্যাটেজিস্ট, পিআর রিসার্চার বা কর্পোরেট লইয়ারের কাজের ন্যূনতম কোনো সোশ্যাল ভ্যালু নাই, কালকে এরা দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে গেলে, মানুষের বস্তুগত বা সাংস্কৃতিক কোনো ধরণের ক্ষতি হবে না। ইন ফ্যাক্ট, অনেকের ধারণা, আসলে লাভ হবে। শেষোক্তরা নিজেরাও জানে তাদের কাজ কতোটা পয়েন্টলেস। পাবলিকলি না হলেও অনেকসময় প্রাইভেটলি স্বীকারও করে। আক্ষেপ করতে করতে।

সদ্যপ্রয়াত নৃবিজ্ঞানী ডেভিড গ্রেইবারের ভাষায় এদের চাকরিগুলো Bullshit Job, বাংলা অনুবাদে বেহুদা চাকরি । ২০১৩ সালে গ্রেইবার Srike! ম্যাগাজিনের আগস্ট ইস্যুর জন্য On the Phenomenon of Bullshit Jobs নামে একটা রচনা লেখেন। সেখানে তিনি বেহুদা চাকরির তত্ত্বটা দাঁড় করান। পরে সেটাকে সম্প্রসারিত আর সংহত করে একটা বই লেখেন, যা ২০১৮তে Simon & Schuster থেকে প্রকাশিত হয়।

বেহুদা চাকরির সংজ্ঞা–

a bullshit job is a form of paid employment that is so completely pointless, unnecessary, or pernicious that even the employee cannot justify its existence even though, as part of the conditions of employment, the employee feels obliged to pretend that this is not the case.

গ্রেইবার দেখিয়েছেন, বেহুদা চাকরিগুলা মোটেও productive না। এগুলোর ক্রমসম্প্রসারণের পেছনে নিছকই অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য নাই। আছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।

১৯৬০–এর দশকে পশ্চিমা দেশগুলোতে ক্যাম্পাসগুলোকে কেন্দ্র করে পুঁজিবাদী জীবনযাপন পদ্ধতির বিরুদ্ধে তীব্র এক ছাত্র বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। যা পরবর্তীতে বৃহত্তর সমাজকে নানাভাবে আলোড়িত করে। শাসকরা এতে আতঙ্কিত বোধ করে এবং আর কোনোদিন যেন বিদ্রোহ দেখা না দেয়, সেই ব্যাপারে সচেষ্ট হয়।

বেহুদা চাকরির বৈশ্বিক বাস্তবতা এরাই তৈরি করেছে। এইসব চাকরির উদ্দেশ্য মোটেও productivity maximization না। এইসব চাকরির উদ্দেশ্য মানুষকে অহেতুক ব্যস্ত রাখা। মানুষকে অহেতুক ব্যস্ত রাখতে পারলে, সে আর বিদ্রোহ করার সময় পাবে না, তাতে শাসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এটাই ১৯৮০র দশক পরবর্তী নিওলিবারেলিজমের আসল দর্শন। নিওলিবারেলিজম মোটেই নিছক অর্থনৈতিক ব্যাপার নয়। এটা একটা পলিটিকাল প্রজেক্ট।

ডেভিড গ্রেইবারের এসেটা অভাবনীয় রকমের সাড়া ফেলে। পাবলিশ করার সাথে সাথে ভাইরাল হয়ে যায়। Srike!-এর অরিজিনাল পেজ হিটের সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়, এতো বেশি ট্র্যাফিকের কারণে পেজটা কয়েকবার ক্রাশ করে।

হপ্তাখানেকের মধ্যে এসেটা অসংখ্য ভাষায় অনুদিত হয়। পৌঁছে যায় ফরাশি, জর্মন, চেক, পোল, রুশ, রোমানীয়, লাতভীয়, এস্তোনীয়, কাতালান, নরওয়েজীয়, সুইডিশ, গ্রিক, তুর্কি, কোরীয় ইত্যাদি নানান ভাষার পাঠকদের কাছে। বেহুদা চাকরির মতো তত্ত্বটাও বৈশ্বিক হয়ে ওঠে।

বিপুল পরিমাণ মানুষ গ্রেইবারের সাথে যোগাযোগ করে। গোপনে জানায় তার তত্ত্বটা বাস্তবে কতোটা প্রাসঙ্গিক। বছরখানেক পরে ঘটে যায় এক অদ্ভূত ঘটনা।

২০১৫র জানুয়ারিতে লন্ডন আন্ডারগ্রাউণ্ড গেরিলা পোস্টারে ছেয়ে যায় যাতে গ্রেইবারের Srike! এসের বিভিন্ন লাইন কোট করা ছিলো। কোটেশনের জন্য তারা নিচের লাইনগুলো বেছে নেয়:

  • Huge swathes of people spend their days performing tasks they secretly believe do not really need to be performed.
  • It’s as if someone were out there making up pointless jobs for the sake of keeping us all working.
  • The moral and spiritual damage that comes from this situation is profound. It is a scar across our collective soul. Yet virtually no one talks about it.
  • How can one even begin to speak of dignity in labor when one secretly feels one’s job should not exist?

তত্ত্বটা নিয়ে গণমাধ্যমে রীতিমতো সাড়া পড়ে যায়। যুক্তরাজ্যে YouGov নামে একটা পোলিং এজেন্সি আছে। তারা ব্রিটনদের মধ্যে গ্রেইবারের রচনার ভিত্তিতে তৈরি করা প্রশ্নভিত্তিক একটা পোল চালু করে। পোলে অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেক মনে করেন তাদের চাকরিগুলো সমাজে মূল্যবান অবদান রাখছে, আর তাই সেগুলো বেহুদা চাকরি নয়। ১৩ শতাংশ বলেন তাদের চাকরিগুলো অর্থবহ না বেহুদা সেই ব্যাপারে তারা নিশ্চিত না। ৩৭ শতাংশ বলেন তাদের চাকরিগুলো বেহুদা চাকরি।

কিছুদিন পরে নেদারল্যান্ডসে একই বিষয়ে পোল হলে, সেখানকার পোলে অংশগ্রহণকারীদের ৪০ শতাংশ জানান তাদের চাকরিগুলো বেহুদা চাকরি। গ্রেইবারের তত্ত্বটা তাই স্ট্যাটিসটিকাল রিসার্চ দ্বারাও সমর্থিত। গ্রেইবার মনে করেন, বেহুদা চাকরি শুধু সমাজের জন্যই ক্ষতিকর নয়, শেষ বিচারে এগুলো ব্যক্তির বিকাশের বিরোধীও বটে। যে-সময় মানুষ ব্যয় করতে পারতো সৃষ্টিশীলতার চর্চায়, বা অবসর উপভোগে, এই চাকরিগুলো তা ইঁদুরের মতো খেয়ে ফেলছে। রাজনৈতিকভাবেও এটা একটা ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

গ্রেইবারের ভাষাতেই বলি-

There is something very wrong with what we have made ourselves. We have become a civilization based on work—not even “productive work” but work as an end and meaning in itself. We have come to believe that men and women who do not work harder than they wish at jobs they do not particularly enjoy are bad people unworthy of love, care, or assistance from their communities. It is as if we have collectively acquiesced to our own enslavement. The main political reaction to our awareness that half the time we are engaged in utterly meaningless or even counterproductive activities— usually under the orders of a person we dislike—is to rankle with resentment over the fact there might be others out there who are not in the same trap. As a result, hatred, resentment, and suspicion have become the glue that holds society together. This is a disastrous state of affairs.

ডেভিড গ্রেইবার তাঁর বইটিতে পরিষ্কার করে বলেছেন, তিনি এই ভয়ানক পরিস্থিতির অবসান চান। আমরাও, অন্তত আমাদের কেউ কেউ, তাই চাই।

পাদটীকা

১. গ্রেইবার লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিকসে অধ্যাপনা করতেন। ছিলেন অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্টের মাস্টারমাইন্ডদের একজন, উত্তর সিরিয়ার রোজাভা রেভল্যুশনের আমৃত্যু সমর্থক। ২০২০এর ২ সেপ্টেম্বর ইতালির ভেনিসে তাঁর অকাল প্রস্থানে মানবজাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো।

 

ইরফানুর রহমান রাফিন

ইরফানুর রহমান রাফিনের জন্ম ১৯৯২এ, ঢাকার শাহবাগে। হোম টাউন কুমিল্লা। বিদ্যাশিক্ষা শহিদ বাবুল একাডেমী, সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পেশাগত জীবনের শুরু বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র (সিবিএস) গবেষণা সহকারী হিসেবে, পরবর্তীতে মানব উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রে (এইচডিআরসি) গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন, বর্তমানে তাসফিয়া তানজিম আহমেদ প্রমার সাথে ব্রেড অ্যান্ড রোজেস নামক একটি অনুবাদমূলক লেখালিখির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে আছেন। ধর্ম থেকে ইতিহাস আর রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি বহু বিষয়ে অপার আগ্রহ আছে তার, এসব বিষয়ে নিজের ওয়েবসাইটে লেখেন, এছাড়াও পত্রপত্রিকায় ও ওয়েব পোর্টালে তার লেখা ছাপা হয়েছে। প্রকাশিত বইঃ চলে যাওয়া সময় (কবিতা, আনন্দম: ২০১৯) এবং এক অসাধারণ অন্ধ সময়ের স্মৃতি (উপন্যাস, [কলকাতা] কাউন্টার এরাঃ২০২০ [ঢাকা] আফসার ব্রাদার্স: ২০২১)। ইমেইল যোগাযোগ: irrafin2020@gmail.com।