অরাজ
শিল্পী: আঁদ্রে মেসোঁ
প্রচ্ছদ » দীপেশ চক্রবর্তী।। অতিমারির যুগ? কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক ও গ্রহীয় প্রেক্ষাপট

দীপেশ চক্রবর্তী।। অতিমারির যুগ? কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক ও গ্রহীয় প্রেক্ষাপট

  • অনুবাদ: সারোয়ার তুষার

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর “An Era of Pandemics? What is Global and What is Planetary About COVID-19” শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রবন্ধ ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে Critical Inquiry ব্লগে প্রকাশিত হয়। বর্তমান রচনাটি সেই প্রবন্ধটিরই বাংলা তর্জমা। দীপেশ চক্রবর্তীর প্রবন্ধটি প্রকাশের এক বছর পর এর বাংলা তর্জমা প্রকাশিত হচ্ছে; ব্যাপারটা একদিক থেকে যেমন কাকতালীয়, অন্যদিক থেকে আশঙ্কারও। কারণ যে বিশেষ পরিস্থিতি— অর্থাৎ অভিনব এক অতিমারির বাস্তবতায় দীপেশ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন— ঠিক এক বছর পরও পরিস্থিতির খুব একটা যে পরিবর্তন হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। অর্থাৎ, এই প্রবন্ধে যে বর্তমান সময়কে ‘অতিমারির যুগ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, সম্ভবত সেই পূর্বাভাসটি যেকোনো যুক্তিসিদ্ধ অনুমান ও ইতিহাসনির্ভর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ দ্বারা আজ অনেক বেশি সিদ্ধ।

প্রবন্ধটি পড়বার সময়ে কেবল খেয়াল রাখা দরকার যে, ‘Global’ আর ‘Planetary’ দুটি পৃথক বর্গ, পরস্পরের প্রতিশব্দ নয়। এই দুইয়ের মধ্যে যে কোনো লেনদেন হয় না, তা নয় মোটেও। কিন্তু বিশ্লেষণী কায়দায় এদের তফাতটা মনে না রাখলে আমরা কেবল মানুষকে এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রেখে আমাদের যাবতীয় আলোচনার পসরা সাজিয়েই ক্ষান্ত হবো। ‘Global’ বর্গের বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে ‘বৈশ্বিক’ যা একটি মনুষ্যকল্পিত দুনিয়া (কাল্পনিক নয়)। অর্থাৎ, মানুষ যেভাবে এই গ্রহের সার্বিক জীবনের ইতিহাস থেকে নিজেকে বিচ্যুত ও আলাদা করে কেবলই তার নিজের এক জগৎ নির্মাণ করেছে ‘Global’ তথা বৈশ্বিক ক্যাটাগরি সেই ‘মানুষীদুনিয়া’র দ্যোতক।

মানুষী’ ইতিহাস ও রাজনৈতিক বীক্ষায় মানুষে মানুষে শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতা, জাতবর্ণ ও অন্যান্য বৈষম্য, বিভেদ, অন্যায় অবিচার ইত্যাদির প্রসঙ্গ থাকে। মানুষই মানুষের প্রতি অত্যাচার, অবিচার করে। সেই অত্যাচার, অবিচারের প্রতিবিধানে সাম্য, ন্যায় ও গণতন্ত্রের অনিবার্য লড়াইও মানুষকে করতে হয়। কিন্তু তা কেবলই মানুষের কথা মাথায় রেখে। মনুষ্যকেন্দ্রিক ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার চিন্তায় ধরেই নেয়া হয় “আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে”র মতো করে এই গ্রহের সমস্ত আয়োজন মানুষের জন্য। মানুষ হাত বাড়ালেই যেন তার মুঠো ভরে যাবে, কারণ ‘শস্যের মাঠ ভরা’। শুধুমাত্র উৎপাদনে প্রাচুর্য আর বণ্টনে সুষমতা নিশ্চিত করাটাই যেন কাজ। রসদ আর পর্যাপ্তি নিয়ে যেন কোনো সংকট নেই।

অন্যদিকে, প্ল্যানেটারি তথা গ্রহীয় ইতিহাসবীক্ষায় মানুষ আর এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে নয়। কেবল মানুষে মানুষে পার্থক্য ও বৈষম্য বোঝা এবং তার প্রতিবিধানে কেবল মানুষেরই জন্য সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ফরমায়েশ করা গ্রহীয় ইতিহাসবীক্ষার অধীত বিষয় নয়। প্ল্যানেটারি তথা গ্রহীয় ইতিহাস, বিজ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষ আর সমস্তকিছুর কেন্দ্রে নয়। ‘গ্রহীয়’ এমন এক ঐতিহাসিকদার্শনিক বর্গ যা মানুষকে কেন্দ্রচ্যুত করে এই গ্রহের সার্বিক স–জীব ও অ–জীব সত্তার প্রসঙ্গকে মুখ্য করে তোলে। সার্বিক জীবনের ইতিহাসের অংশ হিসেবে মানুষ প্রজাতিকে পাঠ ও পুনর্নির্মাণ করে। এই গ্রহের যাবতীয় স–জীব ও অ–জীব সত্তার মতো মানুষও এক প্রজাতিমাত্র; অধীশ্বর বা শাসক নয়। ফলে প্ল্যানেটারি তথা গ্রহীয় বিজ্ঞান ও ইতিহাসে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

তাহলে এক্ষেত্রে ইতিহাসের কাজ বা ভূমিকা কী? দীপেশ চক্রবর্তী মনে করেন, গ্রহীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে জীববৈচিত্র‍্যের সঙ্গে মনুষ্যসভ্যতার সম্পর্ক ভাবাই নতুন ইতিহাসচর্চার কাজ (দীপেশ ২০২১)প্রথাগত পুঁজিবাদের বিশ্লেষণে যে সকল বিদ্যার অধ্যয়ন করতে হয়, যেমন— ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, সাহিত্য ইত্যাদি— এসবের সাথে ভূতত্ত্ব, জেনেটিকস, জীববিজ্ঞান, জীব ও প্রাণের ইতিহাস সংশ্লিষ্ট নানাবিধ বিদ্যাও অধিগত করতে হয়। অর্থাৎ, পুঁজির ইতিহাসের সঙ্গে পৃথিবী ও প্রাণের ইতিহাস এক বিন্দুতে এসে পৌঁছানোর ফলে গ্লোবাল ও প্ল্যানেটারি তথা মানুষী ও নামানুষীর (non-human) যুগপৎ বোঝাপড়ার কোন বিকল্প নেই। এই অপারগ ও নিরুপায় পরিস্থিতি মানবতাবাদী সমাজতাত্ত্বিককে বিজ্ঞানের সাথে এবং ইতিহাসবিদকে সময়ের প্রচলিত ধারণা সম্পর্কে নতুন সংলাপে লিপ্ত হওয়ার তাগিদ দিচ্ছে। ফলে এই নতুন পরিস্থিতি অনুধাবন ও মোকাবেলায় পুনর্গঠিত বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই বিশ্বনাগরিককে স্বস্ব নৈতিক ও রাজনৈতিক বর্গসমূহকে বাছাই করতে হবে বলে আমরা মনে করি।

ও খেয়াল রাখা জরুরি, প্রগতিশীল সামাজিক ইতিহাসে (পড়ুন মানুষী বিশ্ববীক্ষায়) এ যাবৎ ‘এজেন্সি’কে যে অর্থে পাঠ ও নির্মাণ করা হয়েছে; গ্রহীয় পরিপ্রেক্ষিতে ‘এজেন্সি’ কথাটির অর্থ মৌলিকভাবে আলাদা। এতকাল যা ছিল মানুষের স্বায়ত্তশাসন ও সচেতন কর্তাসত্তা হাসিলের মামলা, তা আবির্ভূত হয়েছে মানুষী কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় এক নৈর্ব্যক্তিক ও অচেতন পুঞ্জিভূত ভূতাত্ত্বিক ক্ষমতা হিসেবে। মানুষ না পারছে এই ‘এজেন্সি’কে অস্বীকার করতে, না পারছে একে হজম করতে: “The use of the word agency in the expression ‘geological agency’ was very different from the concept of ‘agency’ that my historian-heroes of the 1960s— E.P. Thompson, for instance, or our teacher Ranajit Guha —had authored and celebrated. This agency was not autonomous and conscious, as it was in Thompson’s or Guha’s social histories, but that of an impersonal and unconscious geophysical force, the consequence of collective human activity.” (Chakrabarty 2021: 3)

সুতরাং, এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েই তাহলে আলোকায়ন ও আধুনিকতার সূত্র ধরে ‘মানুষ’ কথাটার যে বিশেষ দ্যোতনা প্রচলিত আছে; তাকে ছাপিয়ে গ্রহীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মানুষ’ ও সার্বিক প্রাণের তাৎপর্য আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। ‘অতিমারির যুগ’ কিংবা আরও সার্বিকভাবে ভূব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানীদের সতর্কবাণী ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তি (sixth great extinction) থেকে স্থায়ী পরিত্রাণের লক্ষ্যে এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আবেদন এড়ানো ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে বলে আমরা মনে করি।

সম্প্রতি ‘লৌকিক প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত দীপেশ চক্রবর্তীর জলবায়ু পরিবর্তন ও বর্তমান অতিমারি: মানুষের ইতিহাসে একটি সন্ধিক্ষণ বইটিতে বার কয়েক বর্তমান প্রবন্ধটির প্রসঙ্গ টেনেছেন লেখক। কাজেই স্বতন্ত্র পাঠ ছাড়াও এই অনুবাদটিকে সদ্য প্রকাশিত বইয়ের সাথে মিলিয়ে পড়ার সুযোগ থাকছে।

ঋণ স্বীকার: দীপেশ চক্রবর্তীর এই প্রবন্ধটির হদিস পাই বোধিচিত্তের মাধ্যমে। তর্জমা বিষয়ক নানা খুঁটিনাটি সলাপরামর্শের জন্য বরাবরই বন্ধু সহুল আহমদ ও তানভীর আকন্দের প্রতি নির্ভর করি। এই তর্জমার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তর্জমাটির প্রকাশ উপলক্ষ্যে তাদের প্রতি আমার শুকরিয়া জানাই।

অনুবাদক

শিল্পী: এলিসা লোরি

মূল প্রবন্ধ

এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আমি যে বিষয়টির অবতারণা করতে চাই শুরুতেই তা বলে নেয়া যাক।

কোভিড১৯ অতিমারির বর্তমান মুহূর্তটি কেবলমাত্র বিশ্বায়িত ধনতন্ত্রের ইতিহাস এবং মানবজীবনের ওপর এর ধ্বংসাত্মক প্রভাবের সাথে সম্পর্কিত নয়। এটি এই গ্রহে জৈবিক জীবনের ইতিহাসের একটি মুহুর্তেরও প্রতিনিধিত্ব করে যখন মানুষ এমন একটি ভাইরাসের পরিবর্ধক হিসেবে কাজ করছে, চীনের কিছু বাদুড় কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে যার পোষক হয়ে আছে। বাদুড় একটি অতি প্রাচীন প্রজাতি, যারা প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ বছর ধরে বিরাজ করছে— ভাইরাস তার চেয়েও অতি অতি প্রাচীন। ডারউইনবাদী জীবনের ইতিহাস অনুযায়ী, সমস্ত ধরনের জীবনই তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ানোর চেষ্টা করে। চীনে বিচিত্র/উদ্ভট (exotic) মাংসের বিপুল চাহিদার দরুন, করোনা ভাইরাস অপরাপর প্রজাতিসমূহকে টেক্কা দিয়ে মানবদেহে একটি মোক্ষম এজেন্ট পেয়েছে যা ভাইরাসটিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। কেন? কারণ অত্যন্ত সামাজিক জীব মানুষ জীবনের অপার সম্ভাবনার সন্ধানে নিজেরই তৈরি এক ঘনবসতিপূর্ণ মানুষীদুনিয়ায় সদা গতিশীল।

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আমাদের ইতিহাস বিশ্ব অর্থনীতির মহাউল্লম্ফন (great acceleration) ও প্রসার প্রত্যক্ষ করছে এই মুক্তির বাসনা নিয়ে যে, এটি লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র‍্যমুক্ত করবে। অন্ততপক্ষে এটি এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেপথ্যে নৈতিক বৈধতা হিসেবে ক্রিয়াশীল তো ছিলই। ভাইরাসের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে এই উল্লম্ফনের ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত বিশৃঙ্খলা এবং মানবিক গতিশীলতা মওকা হিসেবে কাজ করেছে। শেষপর্যন্ত মানুষ হয়তো ভাইরাস মোকাবেলায় সফল হবে— অন্তত আমি সেই প্রত্যাশাই করি— কিন্তু আদতে ভাইরাস ইতোমধ্যেই এই যুদ্ধ জিতে গেছে। ডারউইনবাদী জীবনের ইতিহাসে এ এক তামাশাই বটে! এবং এর প্রতিঘাতে সৃষ্ট পরিবর্তনসমূহ মানুষী বৈশ্বিক ইতিহাস এবং এই গ্রহের জৈবিক প্রাণের ইতিহাস; উভয়ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

মানুষী প্রেক্ষাপট: মহা উল্লম্ফন এবং অতিমারির উদীয়মান যুগ

এই করুণ বৈশ্বিক অতিমারি যে এক দশক বা তারও আগেই আমাদের দুয়ারে হানা দেয়নি সেজন্য আমাদের নিজেদেরকে স্রেফ ভাগ্যবানই মনে করতে হবে। হংকংয়ের বিজ্ঞানীদের একটি দল প্রায় ২০০৭ সালে অর্থাৎ তেরো বছর আগে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছিল যে, করোনাভাইরাস “জিনগত সমন্বয়/পরিবর্তনে পারদর্শী” যা “নতুন জিনোটাইপ এবং প্রাদুর্ভাবের দিকে ধাবিত করতে পারে”। “ঘোড়াশয় বাদুড়ের দেহে কোভিডসার্স (SARS) জাতীয় ভাইরাসের উপস্থিতি এবং দক্ষিণ চীনে উদ্ভট স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাংস খাওয়ার যে বিকট সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, এই দুইয়ে মিলে এক টাইমবোমা সৃষ্টি হয়েছে। সার্স কিংবা নোভেল ভাইরাস জাতীয় ভাইরাস প্রাণীদেহ কিংবা ল্যাবরেটরি থেকে পুনরাবির্ভাবের সম্ভাবনা উপেক্ষা করা উচিত নয়” []। এই সতর্কতাবার্তাটি পাত্তা দেয়া হয়নি []। স্পিলওভার: অ্যানিমাল ইনফেকশন্স অ্যান্ড দ্য নেক্সট হিউম্যান প্যানডেমিক (২০১২) বইয়ে ডেভিড কোয়ামেন মন্তব্য করেছিলেন যে সার্স করোনাভাইরাস সম্পর্কে “সবচেয়ে গুরুতর বিষয়” এটি মানুষের শরীরকে যেভাবে আক্রান্ত করে: “কোনো ব্যক্তি অত্যন্ত সংক্রামক হয়ে উঠার পরে নয়, বরং আগেই লক্ষণসমূহ দেখা দেয়।” [] কোয়ামেনের পর্যবেক্ষণ, “আরও করুণ কাহিনি এখনও বলার অপেক্ষায় আছে”। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছিলেন যে পরের বড় করোনাভাইরাসটি বিপরীত বৈশিষ্ট্যসহ হাজির হবে, “লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই উচ্চ সংক্রামকতা।” কোয়ামেন তার গবেষণার মূল বার্তা মনে করেছিলেন: “আপনি যদি উচ্চ ঘনত্বে বসবাসরত এবং নিত্যনতুন সংক্রমণের সম্মুখে উন্মোচিত একটি ক্রমবর্ধনশীল জনগোষ্ঠী হন, তাহলে পরের বিরাট অতিমারিটির আগমন সময়ের ব্যাপার মাত্র।” ২০০৭ বা ২০১২তে এই পয়গম্বরসুলভ ভবিষ্যদ্বাণী কেউ কানে তোলে নাই।

সেই কৃষির উদ্ভাবন এবং বিভিন্ন প্রাণীদের গেরস্থালি পোষ মানানোর সময় থেকেই মারি ও অতিমারি মানুষের সঙ্গী। শিকারী সম্প্রদায়সমূহও কিছু সংক্রামক রোগের শিকার হয়েছিল কিন্তু, “বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে বেঁচে থাকা স্তন্যপায়ী বর্গের জ্ঞাতিকুটুম্বদের মতোই, তারা এমনসব ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত হতো যা তাদেরকে অল্প জনসংখ্যার মধ্যেই নিরাময়ের সুযোগ তৈরি করে দিত; জনাকীর্ণ অবস্থার মারির সাথে এর কোনো মিল নেই।” [] প্রাণীকুলের গার্হস্থ্যকরণ ও কৃষির সহগমনে “প্রাণীদেহের রোগজীবাণু মানুষের দেহে বিবর্তনে নানামুখী ভূমিকা রেখেছে।” [] কৃষির উদ্ভবের পর থেকেই মানুষ বহু মারি ও অতিমারি দেখে এসেছে। তবে বর্তমানের সাথে সেসবের পার্থক্য হলো: অতীতের এই আজাবগুলোর মধ্যে “একবারে কয়েক শতাব্দী বা কমপক্ষে বহু দশকের দূরত্ব ছিল; কিন্তু এই রোগবালাইসমূহের বর্তমানে ঘনঘন আবির্ভাব ঘটছে,”। কথাগুলো সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে সংক্রামকরোগ বিশেষজ্ঞ ডেভিড মোরেন্স এবং তার সহলেখকবৃন্দ লিখেছেন। তবে এই রোগগুলোগুর উত্থান এখন আরও ঘন ঘন হয়ে উঠছে []

মোরেন্স ও তার সহকর্মীরা ২০০৩ থেকে শুরু করে বিগত সতেরো বছরে বিশ্বে কমপক্ষে পাঁচটি অতিমারি বা প্রায় অতিমারির এই প্রাদুর্ভাব লক্ষ করেছেন: মারাত্মক তীব্র শ্বাসযন্ত্রের লক্ষণসহ “প্রায় অতিমারি” সার্স (২০০৩), একটি ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারি ( এইচওয়ান-এনওয়ান পিডিএম, ২০০৯), চিকুনগুনিয়া অতিমারি (২০১৪), জিকা অতিমারি (২০১৫) এবং “আফ্রিকার পাঁচটি দেশের ওপরে মহামারি আকারে ইবোলা সংক্রমণ” (২০১৪২০১৫) (“P”, পৃ:)। তারা একমত যে, “সম্প্রতি ‘অতিমারি’ শব্দটি ভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে” এবং তারপরেও তারা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছান তা যেন আমাদের মুখের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে: “স্পষ্টতই আমরা সংক্রামক রোগ ও পুরানো ছোঁয়াচে শত্রুদের ফিরে আসার এক নতুন অতিমারির যুগে প্রবেশ করেছি।”

মোরেন্স এবং অ্যান্টনি ফাউচির আরও সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রের সিদ্ধান্তও একই:

১২,০০০ বছর আগেকার নিওলিথিক বিপ্লবের কাল থেকে, যখন শিকারি মানব প্রথম পশুপালন করতে ও ফসল ফলাতে গ্রামে গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিল, সেই তখন থেকেই নতুনভাবে আবির্ভূত (এবং পুনরাবির্ভূত) সংক্রামক রোগবালাই মানুষকে হুমকির মুখে ফেলেছে। মানুষে আশ্রয় নেয়া মারাত্মক পরিণতিসম্পন্ন প্রাণীদেহের প্রাচীন রোগগুবালাইগুলোর মধ্যে রয়েছে: গুটিবসন্ত, ম্যালেরিয়া, হাম ও বিউবনিক প্লেগ। কিন্তু গত দশক নজিরবিহীন অতিমারি বিস্ফোরণ প্রত্যক্ষ করেছে: এইচওয়ান-এনওয়ান “সোয়াইন” ইনফ্লুয়েঞ্জা (২০০৯), চিকুনগুনিয়া (২০১৪) এবং জিকা (২০১৫)। পাশাপাশি আফ্রিকার বৃহৎ অঞ্চলগুলোতে ইবোলা জ্বরের মহামারি আকারে উত্থান ঘটেছে (২০১৪ থেকে বর্তমান)। এই সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে, আমরা একটি অতিমারির যুগে প্রবেশ করেছি। []

এখানে যে সমস্ত অতিমারির নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে শ্বাসযন্ত্রের লক্ষণযুক্ত মার্স (MERS) যা ২০১২ সালে কুঁজওয়ালা উট থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল; এই সবই মূলত জুনোটিক তথা প্রাণীজ— এগুলো হচ্ছে ভাইরাস এবং ব্যাকটিরিয়াজনিত তেমন সংক্রমণ যা পোষক পরিবর্তন করে বন্যপ্রাণী থেকে মানুষে আশ্রয় নিয়েছে, কখনও কখনও অন্য প্রাণীর মাধ্যমে। ২০০৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে ১৪০৭টি “মানব রোগজীবাণুর ৫৮ শতাংশ উৎসই প্রাণীজ”। মেক্সিকোর কানকুনে ২৪২৭ ফেব্রুয়ারী ২০১১তে আঠারোটি দেশ থেকে আসা চুরাশিজন অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের একটি পর্যালোচনা উল্লেখ করেছে,“বিশ্বজুড়ে উদ্ভূত সংক্রামক রোগের পচাত্তর শতাংশ ছিল বন্যপ্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমিত”।[] সেই সম্মেলন থেকে আরও মন্তব্য করা হয়: “প্রতি বছর ১.৫ বিলিয়ন প্রাণী যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা হচ্ছে, পাশাপাশি একটি বিরাট আন্তর্জাতিক অবৈধ প্রাণী রফতানি প্রক্রিয়ার বাস্তবতায় ইকোহেলথ আর মর্জিমাফিক নয়, বরং অপরিহার্য নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।” [] আমরা ২০০৯এর অন্য একটি গবেষণা থেকে জেনেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পশু আমদানির সিংহভাগ (৯২ শতাংশ) ছিল, “বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পোষা জন্তু কেনাবেচা বাণিজ্যের জন্য মনোনিত করা হয়েছিল।” [১০] প্রায় ৮০ ভাগ চালানে বন্যজন্তু ছিল, যার বেশিরভাগ অংশেরই “চালানের আগে বা পরে কোনো বাধ্যতামূলক রোগজীবাণু পরীক্ষার আওতায় আনা হয় নাই”। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানিকৃত জ্যান্ত প্রাণী প্রাণীজ রোগবালাই এর “উদীয়মান হটস্পট দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে উদ্ভূত।” [১১]

কিসে অতিমারি ঘটে? মোরেন্স ও তার সহকর্মীরা এই প্রশ্নের জবাব হয়তো এর চেয়ে বেশি সোজাসাপ্টাভাবে দিতে পারতেন না: “মানুষই অতিমারির চূড়ান্ত কারণ।” তারা চিহ্নিত করেছেন যে এটি হলো, “বনভূমি উজাড়, কৃষির ঘনীভবন, নগরায়ণ এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বিনষ্টের” ফলাফল যা “বন্যজীবন এবং তাদের সম্ভাব্য প্রাণীজ রোগবালাই এর সাথে মানুষের সংস্পর্শ অনিবার্য করে তোলে” (“P,” পৃ: )। এই মতামত কোনোভাবেই অভিনব কিছু নয়। অতিমারি সংক্রান্ত বেশিরভাগ অধ্যয়নই শেষপর্যন্ত এই উপসংহারেই উপনীত হয়। কোয়ামেন লিখেছেন: “বিষয়টিকে খুল্লামখুল্লা আকারে রাখতে হলে: মানবসৃষ্ট পরিবেশগত চাপ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা জন্তুজানোয়ারের রোগ জীবাণুগুলোকে আরও বেশি মানব জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আনছে; অন্যদিকে মানব প্রযুক্তি ও ব্যবহার সেই রোগজীবাণুগুলোকে আরও ব্যাপকভাবে দ্রুত ছড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, “পরিস্থিতিটির তিনটি দিক রয়েছে,”— মানুষেরা

ধ্বংসাত্মক হারে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের সংহতি বিনষ্ট করছে। গাছ কাটা, রাস্তা তৈরি, জুম চাষ (slash and burn agriculture), বন্যপ্রাণী শিকার ও খাওয়া… গবাদি পশুর চারণভূমি তৈরির উদ্দেশ্যে বনজঙ্গল উজার করা, খনিজ উত্তোলন, নগর ব্যবস্থাপনা, শহরতলীর সম্প্রসারণ, রাসায়নিক দূষণ, সাগরে নিয়ট্রিয়েন্ট ভেসে যাওয়া, টেকসইভাবে সামুদ্রিক খাবার আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তনও প্রাকৃতিক ভূপৃষ্ঠের ওপর অপরাপর সব “সভ্যকরণ” দখলদারিত্ব— এ সকল উপায়েই বাস্তুসংস্থানকে আমরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। [S, পৃ ৪০৪১]

দ্বিতীয়ত, “ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাক”সহ এই জাতীয় “লক্ষ লক্ষ অজানা প্রাণী” বাস্তুতন্ত্রে বাস করে— যাকে ভাইরাস বিশারদরা বলছেন “ভাইরাস্ফিয়ার”, জৈবদেহের একটি বিস্তৃত জগত যা সম্ভবত অন্যান্য প্রতিটি দলকে রীতিমতো বামন করে তোলে” (S, পৃ ৪১)। এবং অবশেষে, “প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের ব্যাঘাত এ জাতীয় জীবাণুগুলোকে আরও বিস্তৃত বিশ্বে অবমুক্ত করে” (S, পৃ ৪১) বলে মনে হচ্ছে। রোগজীবাণু বিশারদগণ “স্পিলওভার” বলতে সেই মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করেছেন যখন এক জন্তু বা পাখির শরীর থেকে জীবাণু অন্য জন্তুর (বিশেষত মানুষের) শরীরে অতিথি হিসেবে বাসা বাঁধে।

প্রাণীজ সংক্রামক রোগসমূহের ঘন ঘন উত্থানের এই উপলব্ধিটি আরও বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সমর্থন করে। এর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রোগ্রামের প্রকাশনা “আসন্ন অতিমারির প্রতিরোধ: প্রাণীজ রোগবালাই ও সংক্রমণ শৃঙ্খল ভাঙ্গার উপায় (২০২০)” এবং প্রকৃতির জন্য বিশ্বব্যাপী তহবিল সংস্থার প্রকাশনা “প্রকৃতির ক্ষয় ও অতিমারির উত্থান”। [১২]

প্রথম প্রকাশনিটিতে “প্রাণীজ রোগের উত্থানের সাতটি বড় মনুষ্যক্রিয়াকলাপ সংক্রান্ত প্রভাবক” তুলে ধরা হয়েছে: () বিশেষত এশিয়া এবং উপসাহারীয় আফ্রিকাতে প্রাণীজ আমিষের চাহিদা বাড়ছে যেখানে “আমিষ ভোগের মাথাপিছু বৃদ্ধির হারের সাথে সাথে বেশ কয়েকটি নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের অঞ্চলে জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটছে।” () টেকসই কৃষি, বিশেষত গৃহপালিত পশুপালনের ক্ষেত্রে যা একই মাত্রার সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ “বৃহৎ সংখ্যক অনুরূপ প্রাণী পুনরুৎপাদন করে” (সোয়াইন ফ্লু’র কথা স্মরণ করুন); () বন্যজীবজন্তুর ব্যবহার ও শোষণ বৃদ্ধি; () নগরায়নজনিত কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের লাগামহীন ব্যবহার, ভূমির ব্যবহারে পরিবর্তন ও খনিজসম্পদ, গ্যাস এবং তেল উত্তোলনের মতো নিষ্কাশনমূলক শিল্প এবং এর ফলে মানুষ ও বণ্যপ্রাণীর অভিনব মিথস্ক্রিয়া, () মানুষের চলাফেরা ও বাণিজ্য বৃদ্ধি, () প্রাণীজ উৎসজাত নিত্যনতুন খাবার এবং নতুন নতুন বাজারে (মাছমাংসসামুদ্রিক খাবারের আর্দ্র বাজারসহ) বন্যপ্রাণীজাত খাবার চাহিদার দরুন খাদ্য সরবরাহ চেইনের পরিবর্তন। কৃষি ঘনীভবনের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ।

() জলবায়ু পরিবর্তন, যেহেতু “বহু পশুপক্ষী বাহিত রোগবালাই জলবায়ু স্পর্শকাতর এবং যে উষ্ণতর, আর্দ্রতর ও অধিকতর দুর্যোগপ্রবণ বিশ্বের পূর্বাভাস পাওয়া যায়, তেমন ভবিষ্যত দুনিয়ায় বেশিরভাগ সংখ্যক ফুলেফেঁপে উঠবে।” [১৩]

প্রকৃতির জন্য বিশ্বব্যাপী তহবিল সংস্থার (World Wide Fund For Nature-WWF) প্রকাশনা “প্রকৃতির ক্ষয় ও অতিমারির আবির্ভাব”ও হুবুহু একই প্রস্তাবনা তুলে ধরেছিল:

মনুষ্য কার্যকলাপই আমাদের গ্রহের প্রলয়ংকারী পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। মানুষের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমবর্ধমান ভোগ ভূমি, নদী ও মহাসাগরসমূহ, জলবায়ু ব্যবস্থা, জৈবভূরাসায়নিক চক্র এবং বাস্তুসংস্থানের কার্যকারিতায় যেভাবে গভীর পরিবর্তন ঘটিয়েছে— তা আমাদের নিজস্ব স্বাস্থ্য এবং সার্বিক মঙ্গলামঙ্গলের ক্ষেত্রেও বড় প্রভাব রেখেছে। জাতিসংঘের দ্য ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্সপলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিস (আইপিবিইএস) এর মতে, তিন চতুর্থাংশ ভূমি ও দুইতৃতীয়াংশ সামুদ্রিক পরিবেশের একটি অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং প্রায় দশ লক্ষ প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। ডব্লিউ ডব্লিউ এফএর লিভিং প্ল্যানেট রিপোর্ট ২০১৮ মাত্র চল্লিশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বিশ্বজুড়ে মেরুদণ্ডী প্রাণীর সহজপ্রাপ্যতার প্রাচুর্যে ৬০% গড় হ্রাস নথিবদ্ধ করেছে। বনভূমি নিধন ও প্রাকৃতিক আবাসস্থলে অদলবদলসহ ভূমিব্যবহারের পরিবর্তন বন্যজীবজন্তু বাহিত উদীয়মান প্রায় অর্ধেক রোগবালাই এর জন্য দায়ী। [১৪]

শিল্পী: ভ্লাদিমির কুশ

২০২০ এর দশকের গোড়ার দিকে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যামেরুনের স্বাস্থ্য ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় হওয়া একটি গবেষণায় ঐতিহ্যবাহী বন্যপ্রাণী শিকারীদের জীবনের ওপর বনভূমি নিধনের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত খতিয়ে দেখা হয়েছিল। গবেষণাটির লেখকেরা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে, উচ্চমূল্যের বিভিন্ন জাতের কাঠের “বাছাইকৃত কর্তন”— নিষ্কাশন ও যোগাযোগব্যবস্থার ব্যয় নির্বাহে মধ্য আফ্রিকায় নির্বাচিত গাছ কাটার পদ্ধতি— এর সাথে “রাস্তাঘাট নির্মাণ ও অপেক্ষাকৃত আদিম বনাঞ্চলে শ্রমিক পরিবহনের বিষয়টি জড়িত।” [১৫] এর ফলে শিকারের পদ্ধতি এবং রোগজীবাণুর চিরায়ত পোষকদেহ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের প্রাকৃতিকতার বিচ্ছেদ ঘটে। কিছু ক্ষেত্রে, এর ফলে “মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে পোষকদেহের ঐশ্বর্য” হারাতে শুরু করে। (“B,” পৃ ১৮২৩) পোষক প্রজাতির বৈচিত্র্যের এই ক্ষতি “কিছু অত্যন্ত সক্ষম প্রাণীজ এজেন্টের পোষকতার আধিক্য বৃদ্ধি করে এবং মানুষের মধ্যে সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে” (“B,” পৃ ১৮২৩)

এই বিভাজন মানব জনসংখ্যা এবং প্রাণীজ পোষকদেহের মধ্যে যোগাযোগের অঞ্চলকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। সমীক্ষার লেখকেরা লিখেছেন: “ঐতিহাসিকভাবে, শিকার কার্যক্রম বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোকে ঘিরে বৃত্তাকারে হতো, যার দরুন শিকারের সীমানা থেকে দূরের প্রান্তে এর তেমন কোনো প্রভাব ছিল না। সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা মানেই হচ্ছে রাস্তা থেকে সমান দূরত্বে শিকারীরা শিকারের ফাঁদ বিছিয়ে শিকার করতে সক্ষম হচ্ছে। ফলে উন্নত সড়ক ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে মানুষজন্তুর পরিবর্তিত নিরবিচ্ছিন্ন সংস্পর্শ” একদিকে শিকারঅঞ্চলের বৃদ্ধি ঘটায় এবং অন্যদিকে, অণুজীব আবির্ভাবের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। (“B,” পৃ ১৮২৩)

এই সবকিছু সম্মিলিতভাবে অতিমারিটিকে বিশ্বায়নের সেই পর্যায়ের একটি অংশে পরিণত করে যাকে আমরা মহাউল্লম্ফনের সাথে তুলনা করি: ১৯৫০ এর দশক থেকে এই গ্রহে মানুষের উপস্থিতির জ্যামিতিক বৃদ্ধি, অর্থনীতি, গতিশীলতা, জনসংখ্যার জ্যামিতিক বৃদ্ধি, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ, মানুষের ভোগবিলাস, মানবচলাচল ইত্যাদি। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের একটি সাম্প্রতিক (২০১৭) রিপোর্ট আমাদের জানিয়েছে:

ইউরোপের শিল্প বিপ্লব শুরুর প্রায় দেড়শ বছর পরে ১৯৮৫ সালের দিকে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা [ভোক্তা সামগ্রী ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন] ১ বিলিয়নে পৌঁছেছে। এরপরে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী দুই বিলিয়নে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল পরবর্তী ২১ বছর অর্থাৎ ২০০৬ সাল; এর বেশিরভাগ অংশই চীনের অভূতপূর্ব বিকাশের ইঙ্গিতবাহী। পরবর্তী নয় বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ২০১৫ সাল নাগাদ, বৈশ্বিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঘরে তিন বিলিয়ন জনগোষ্ঠী যুক্ত হয়েছিল। পরবর্তী সাত বছরে (২০২২ সাল নাগাদ) আরও এক বিলিয়ন এবং তার পরের ছয় বছর, অর্থাৎ ২০২৮ সালের মধ্যে, এই বিশ্ব ভোক্তা জনগোষ্ঠী পাঁচ বিলিয়নে পৌঁছানোর গতিতে আছে। [১৬]

আসলে বিশ্বায়নের এই তীব্র প্রক্রিয়াটি এই শতাব্দীর শুরুতে চীন বিশ্বের একটি শিল্পসামরিক পাওয়ার হাউজ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সাথে সাথেই ঘটেছিল। বনভূমি নিধন, বন্যজীবনের আবাস এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ যে কারণগুলো এই “অতিমারির যুগ” উত্থানে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে তা পুঁজির বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার মহাউল্লম্ফনের গুরুত্বপূর্ণ গল্প।

তবে অতিমারির আরও একটি দিক রয়েছে যা ব্রুনো লাতুর আর আমি অন্যত্র “দ্য গ্লোবাল রিভিলজ দ্য প্ল্যানেটারি” (Global Reveals the Planetary) [১৭] শিরোনামের অধীনে আলোচনা করেছিলাম। এটা পরিস্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যখন আমরা দেখি ভাইরাস বিশারদ ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞগণ অতিমারির আখ্যানে ভাইরাসের ভূমিকা সংক্রান্ত আলোচনা করেন। অতিমারির এই নতুন যুগের আবির্ভাব বোঝার জন্য আমাদের কেবল বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মহান উল্লম্ফন বুঝলেই চলবে না; বরং এই গ্রহের সার্বিক জীবনের বিবর্তনের গভীর ইতিহাসের (deep history) দিকেও তাকাতে হবে এবং বর্তমান অতিমারি কীভাবে সেই ইতিহাসের একটি পর্ব গঠন করে সেটাও উপলব্ধি করতে হবে। যেমন এই নিবন্ধটি শেষ করার আগে পরবর্তী অংশে আমি অতিমারির ইতিহাসের এই গভীর দিকটি এবং সার্বিক জীবনের বিবর্তনের ইতিহাসটি সংক্ষেপে মূল্যায়ন করবো।

অতিমারির গ্রহীয় প্রেক্ষাপট

সংক্রামক রোগের আবির্ভাব ও পুনরাবির্ভাবের চ্যালেঞ্জ” সংক্রান্ত নিরীক্ষা করতে গিয়ে ২০০৪ এ লিখিত একটি নিবন্ধে মোরেন্স, গ্রেগরি ফোকার্স (Folkers) ও ফাউচি আলোচনা শুরু করেছিলেন এভাবে যে, মানুষ তার প্রযুক্তিগত ও বিবর্তনীয় ইতিহাসে একমাত্র যে প্রাকৃতিক “হানাদার”কে বশে আনতে ব্যর্থ হয়েছে তা হলো: জীবাণু গোত্রীয় জীবন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত US National Institute of Allergy and Infectious Diseases এর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা রিচার্ড ক্রাউচ-এর The Persistent Tide (১৯৮১) এ প্রকাশিত সেই সতর্কবাণী তারা স্মরণে রেখেছিলেন, “জীবাণু বৈচিত্র্য এবং বিবর্তনীয় শক্তি এখনও মানবজাতিকে হুমকিতে রেখেছে।” [১৮]

তারা তাদের নিবন্ধটি শেষ করেন সংক্রামক রোগের ইতিহাসে জীবাণুগুলোর বিবর্তন যে ভূমিকা রেখেছে তা উল্লেখ করে। তারা লিখেছিলেন, “অন্তর্নিহিত রোগবালাই এর আবির্ভাব মূলত দ্রুত বিকশিত ও খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম সংক্রামক এজেন্ট এবং তাদের মন্থরগতিতে বিকশিত পোষকসত্তার মধ্যকার একটি বিবর্তনীয় সংঘাত,” (“C,” পৃ ২৪৮)। তারা আরও যোগ করেন, “পরিবেশগত ও মানুষী আচারআচরণের অদলবদলের ত্বরিত পরিপ্রেক্ষিতে এই সংঘাতের ফয়সালা হয় নতুন পারিবেশিক অঞ্চল তৈরি হওয়ার মাধ্যমে যেখানে বিকশিত অণুজীবসমূহ তাৎক্ষণিকভাবে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়।” (“C,” পৃ ২৪৮)

এ যেন এক অশেষ ও অনন্ত সংঘাত যা মানুষকে তার প্রাযুক্তিক ক্ষমতার হালনাগাদ ও উন্নত করতে নিয়ত বাধ্য করে চলে। অন্যদিকে, খোদ মনুষ্যসৃষ্ট পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় অণুজীব বিকশিত হয় এবং পোষকদেহ বদলানোর বন্দোবস্ত করে নেয়। মোরেন্স ও ফাউচি তাদের প্রবন্ধটির শেষে এই পর্যবেক্ষণ হাজির করেছেন:

রোগজীবাণু ও মানুষের মধ্যে চলমান এই দ্বন্দ্বসংঘাতের মধ্য দিয়ে উত্থাপিত চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ জশুয়া ল্যাডারবার্গের (Joshua Lederberg) বক্তব্যে বাস্তবতার সারসংক্ষেপ রয়েছে: “জীবাণু ও মানবজাতির ভবিষ্যত সম্ভবত একটি সাসপেন্স থ্রিলারপর্ব হিসেবে আবির্ভূত হবে যার শিরোনাম হতে পারে ‘আমাদের বুদ্ধি বনাম তাদের জিন’ [“C,” পৃ ২৪৮]

মোরেন্স ও ফাউচি বর্তমান অতিমারি সম্পর্কে তাদের সাম্প্রতিক আলোকপাতে এই মূলভাবেই ফিরে আসেন:

জীবাণু ও মানুষের মধ্যে চলমান প্রাচীন লড়াইয়ে, আমাদেরকে ধারাবাহিকভাবে অবাক করে দেয়ার জন্য এবং প্রায়শই আমাদের অপ্রস্তুত করে তোলার ক্ষেত্রে জিনগতভাবে অভিযোজিত জীবাণুগুলোর শীর্ষ ভূমিকা রয়েছে”(“E”, পৃ ১০৭৮)। এমনকি মানুষের বিকাশ নিশ্চিত করার স্বার্থে জীবাণুগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমরা যে সকল প্রযুক্তি উদ্ভাবন করি, সেগুলোও সাধারণত সংক্রমণ ও বিবর্তনের নতুন পথ উন্মুক্ত করে দেয়। নাথান ওল্ফ, ক্লেয়ার ডুনাভান ও জ্যারেড ডায়মন্ডের সংক্রামক রোগ সংক্রান্ত অন্য একটি গবেষণাপত্রে এই বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে:

আধুনিক উদ্ভাবন আরও সম্ভাব্য মানবিক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া এবং/অথবা মানুষের মধ্যে সংক্রমণকে আগের চেয়ে আরও সুনিপুণ করে তোলার মাধ্যমে রোগজীবাণুগুলোর উত্থান সহজতর করেছে। এই উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে রয়েছে রক্ত ​​সংক্রমণ (হেপাটাইটিস সি), বুনোজন্তুর গোস্ত বাণিজ্যিক বেচাকেনা (রেট্রোভাইরাস), শিল্পজাত খাদ্য উৎপাদন (bovine spongiform encephalitis, BSE), আন্তর্জাতিক ভ্রমণ (কলেরা), শিরায় চালিত ড্রাগের ব্যবহার (এইচআইভি), ভ্যাকসিন উৎপাদন (Simian virus 40), এবং দুর্বল রোগ ও জীবাণুপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন বয়োজ্যেষ্ঠ রোগী। [১৯]

মানুষের সাথে তুলনায় করোনাভাইরাসের একটি বিশেষ বিবর্তনীয় সুবিধা (যা এই মুহুর্তে বিমূর্ত মানবসত্তার কল্পিত মূর্ত দেহের পিছনে একটি পীড়ার কারণ) আছে, আর তা হলো— “অণুজীবের জিনগত অস্থিতিশীলতার দরুন দ্রুত বিবর্তন যা সদাপরিবর্তনশীল বাস্তুসংলগ্ন কুলুঙ্গিগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।” (“E,” পৃ ১০৮০) মোরেন্স ও ফাউচি বলছেন এটি:

বিশেষত আরএনএ ভাইরাস যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, ফ্লাভিভাইরাস, এন্টোভাইরাস ও করোনাভাইরাস সম্পর্কে সত্যি, যেগুলোর কিনা সহজাত ঘাটতি বা অনুপস্থিত পলিমারেজ ত্রুটিসংশোধন প্রক্রিয়া রয়েছে [অন্য কথায়, তাদের নিজের প্রজনন করার সময় কোনো প্রুফরিডিং এর সুযোগ ও ক্ষমতা নেই] এবং এর ফলে এগুলো আধাপ্রজাতি বা শতশত কিংবা হাজার হাজার জিনগত রূপ হিসেবে সংক্রমিত হয়, যার কারণে মানুষের পক্ষে এগুলোকে মোকাবেলা করা বেশ অসম্ভব ব্যাপার।

এটি মূলত এমন একটি বিবর্তনবাদী লড়াই যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে হোমো সেপিয়েন্স নামক প্রজাতি মানুষ, তার সমস্ত প্রাযুক্তিক দাদাগিরির পরেও এই গ্রহে ঘটমান ডারউইনীয় জীবন ও বিবর্তনের ইতিহাসের বাইরে নয়। মানুষের মধ্যে সংক্রামক রোগগুলো জীবাণুসুলভ বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে তারা আমাদের জেনেটিক, সেল্যুলার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে ক্রমাগত সংক্রমণ নিশ্চিত করে” (“E”, পৃ ১০৭৮)। মোরেন্স ও ফাউচি এই বিষয়টিতে রিচার্ড ডকিন্সের উল্লেখ করেছেন: “জিনের প্রতিযোগিতার স্তরে বিবর্তন ঘটে এবং আমরা, ফিনোটাইপিক মানুষেরা জীবাণু ও মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতায় কেবল জিনগত ‘বেঁচে থাকার মেশিন’ হয়ে থাকি” (“E”, পৃ ১০৭৮)। যেহেতু মনুষ্যকৃত পরিবেশ বিপর্যয় বিভিন্ন ধাঁচের করোনভাইরাসকে তাদের পূর্বতন বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রজাতি থেকে মানুষে স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়, তারা অন্যান্য স্তন্যপায়ী দেহের অভ্যন্তরে কাজ করে মানব কোষগুলোতে আগেই থিতু হয়ে যায়। মোরেন্স ও ফাউচি লিখেছেন: “কোষজগতে ভাইরাসের বিবর্তনীয় ভিত্তি অনেক শক্ত। এর নমুনা হচ্ছে বাদুড়ের দ্বারা সার্স ঘরানার বিকরোনাভাইরাস বা সার্বেকোভাইরাস। বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীর রিসেপটরগুলোর নমুনা নিয়ে দেখা যাচ্ছে এদের রিসেপটর বাইন্ডিং এলাকাগুলো অত্যধিকবিকাশক্ষম” (“E,” পৃ ১০৮০)। তারা আরও বলেন, “তথ্যপ্রমাণ থেকে ধারণা করা যায় যে বাদুড় সংক্রমিত অনেক করোনাভাইরাসই আছে যাদের আবির্ভাব ঘটার মতো প্রাকঅভিযোজন সম্পন্ন হয়েছে এবং সম্ভাবনা রয়েছে অতিমারি আকারে আবির্ভাব ঘটার। ( “E”, পৃ ১০৮১)

তারা আরও যোগ করেন: “বিভিন্ন আলামত এটাই প্রমাণ করে যে আরও অনেকগুলো বিকরোনভাইরাস আবির্ভাবের জন্য ইতোমধ্যেই প্রাকঅভিযোজিত এবং সম্ভবত এদের আবির্ভাব অতিমারিরূপেই হতে পারে। ( “E”, পৃ ১০৮১)

শেষ পর্যন্ত, এই সংক্রামক রোগগুলো আমাদের দেহ এবং অন্যান্য শারীরিক জীবনের রূপগুলোর মধ্যে বিদ্যমান গভীর বিবর্তনমূলক সংযোগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় (যে কারণে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আমরা আগে অন্য প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করে নিতে পারি)। কোয়ামেন বিষয়টি উল্লেখ করেছেন এভাবে:

সংজ্ঞা অনুসারে, প্রাণীজ রোগজীবাণুগুলো (আমাদের সংক্রামক রোগগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশের জন্য দায়ী) হলো বর্তমানে এবং বারবার মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে প্রবাহিত হয়। অন্য সংক্রমণগুলো (যেগুলো সংক্রামক রোগের ৪০ শতাংশ, গুটিবসন্ত, হাম এবং পোলিওসহ) রোগজীবাণুর কারণে সৃষ্ট যা মানুষের পূর্বপ্রজন্মের কাছে কোনো এক অতীতকালে একবার ভর করেছিল। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের সমস্ত রোগগুলোচূড়ান্তভাবে প্রাণীজ। তবে পশুপক্ষী বাহিত অসুখবিসুখ আমাদের এবং অন্যান্য ধরনের পোষকের মধ্যে আদিম সংযোগের প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। [S, পৃ ১৩৭]

বর্তমান অতিমারির নামানুষী গ্রহীয় দিকটি তার মানে এই: এর ফলে যে সমস্ত মানব বিপর্যয় ইতোমধ্যে ঘটেছে এবং ঘটবে (আংশিকভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে), এটি এই গ্রহের জীবনের বিবর্তনীয় ইতিহাসের একটি পর্ব। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মহাউল্লম্ফনের দ্বারা আরও তীব্র হওয়া মানুষ ও জীবাণুর এই লড়াই প্রসঙ্গে মোরেন্স ও ফাউচির মন্তব্য বরাতযোগ্য— “মানুষ নাকি জীবাণু, কে চালকের আসনে, তা হয়তো দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার।” (“E”, পৃ ১০৭৮)

জীবাণু ধাঁচের জীবনের বিভিন্ন রূপ এই গ্রহে ৩.৮ বিলিয়ন বছর ধরে টিকে আছে। অন্যদিকে হোমো সেপিয়েন্সের টিকে থাকার বয়স আনুমানিক তিনলক্ষ বছর। মোরেন্স ও ফাউচি বলেন, “অনাগত রোগ সংক্রমণের ঝুঁকির ব্যাপারে আমরা কীভাবে ভাববো এবং কীভাবে এই মুসিবতের মোকাবেলা করবো তা এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই নিহিত আছে।” (“E”, পৃ ১০৭৮)

টীকা:

[1] Vincent C. C. Cheng et al., “Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus as an Agent of Emerging and Reemerging Infection,” Clinical Microbiology Reviews 20 (Oct. 2007): 683.

[2] See David M. Morens et al., “Prespective Piece: The Origin of COVID-19 and Why It Matters,” American Journal of Tropical Medicine and Hygiene 103, no. 3 (2020): 955.

[3] David Quammen, Spillover: Animal Infections and the Next Human Pandemic (New York, 2012), pp. 207–208; hereafter abbreviated “S”.

[4] Nathan Wolfe, Claire Panosian Dunavan, and Jared Diamond, “Origins of Major Human Infectious Diseases,” Nature, 17 May 2007, p. 281

[5] Ibid.

[6] David M. Morens et al., “Pandemic COVID-19 Joins History’s Pandemic Legion,” mBio 11 (May/June 2020): 1; hereafter abbreviated “P”.

[7] Morens and Anthony S. Fauci, “Emerging Pandemic Diseases: How We Got to COVID-19,” Cell, 3 Sept. 2020, p. 1077; hereafter abbreviated “E”.

[8] R. E. Kahn et al., “Meeting Review: 6th International Conference on Emerging Zoonoses,” Zoonoses and Public Health 59 (2012), p. 6.

[9] Ibid., p. 7.

[10] Katherine F. Smith et al., “Reducing the Risks of the Wildlife Trade,” Science, 1 May 2009, p. 594.

[11] Ibid.

[12] See The United Nations Environment Programme and the International Livestock Research Institute, Preventing the Next Pandemic: Zoonotic Diseases and How to Break the Chain of Transmission (Nairobi, 2020); World Wide Fund for Nature, The Loss of Nature and the Rise of Pandemics (Gland, 2020).

[13] Preventing the Next Pandemic, pp. 15–17.

[14] The Loss of Nature, p. 14.

[15] Wolfe et al., “Bushmeat Hunting, Deforestation, and Prediction of Zoonotic Disease Emergence,” Emerging Infectious Diseases 11 (Dec. 2005):1823; hereafter abbreviated “B”.

[16] Hannes Bergthaller, “Thoughts on Asia and the Anthropocene,” in The Anthropocenic Turn: The Interplay Between Disciplinary and Interdisciplinary Responses to a New Age, ed. Gabriele Dürbeck and Phillip Hüpkes(New York, 2020), pp. 78–79.

[17] See Bruno Latour and Dipesh Chakrabarty, “The Global Reveals the Planetary,” in Critical Zones: The Science and Politics of Landing on Earth, ed. Latour and Peter Weibel (Cambridge, Mass., 2020), pp. 24­–31.

[18] Morens, Gregory K. Folkers, and Fauci, “The Challenge of Emerging and Re-emerging Infectious Diseases,” Nature 430, 8 July 2004, p. 242; hereafter abbreviated “C.” The full title of Richard Krause’s book is The Restless Tide: The Persistent Challenge of the Microbial World (Washington, D.C., 1981). For biographical details on Richard Krause (1925–2015), see Morens, “Richard M. Krause: The Avancular Avatar of Microbial Science,” Proceedings of the National Academy of Sciences of the United States of America (PNAS) 113 (Feb. 2016): 1681–683.

[19] Wolfe, Dunavan, and Diamond, “Origins,” p. 282.

তর্জমাকারীর রেফারেন্স:

দীপেশ চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার: “জীববৈচিত্র‍্যের সঙ্গে মনুষ্য সভ্যতার সম্পর্ক ভাবাই নতুন ইতিহাস চর্চার কাজ”, সাক্ষাৎগ্রহণকারী: সারোয়ার তুষার, অরাজ, ঢাকা, ২০২১

https://www.auraj.net/dipesh-interview/5503/

Chakrabarty, Dipesh. Climate of History in a Planetary Age, Chicago: Chicago University Press, 2021.

সারোয়ার তুষার