অরাজ
আর্ট: এনার্কি আর্টিস্ট: আলেক্সি মোরজ
প্রচ্ছদ » অ্যালবার্ট মেল্টজার ।। নৈরাজ্যবাদ: পক্ষে-বিপক্ষে

অ্যালবার্ট মেল্টজার ।। নৈরাজ্যবাদ: পক্ষে-বিপক্ষে

ভূমিকা 

নৈরাজ্যবাদের ঐতিহাসিক পটভূমি

মজার ব্যাপার যে আমরা যেই বিষয়গুলোকে নৈরাজ্যবাদী পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করি সেগুলোর মূল প্রোথিত রয়েছে প্রাচীন সমাজে। একই সাথে এটাও বেশ আগ্রহোদ্দীপক যে, শত শত বছর ধরে রাষ্ট্রের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংঘটিত কৃষক আন্দোলনগুলোর মধ্যেও রয়েছে এক প্রকারের নৈরাজ্যবাদী চিন্তা। কিন্তু আধুনিক সময়ের নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনগুলোর পক্ষে অন্যান্য শ্রমজীবী তত্ত্বের চেয়ে পুরনো আমলের সেসকল আন্দোলনকে অধিক প্রাসঙ্গিক ভাবার কোন সুযোগ নেই। আধুনিক নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনকে বুঝতে হলে আমাদের তুলনামূলক সাম্প্রতিক সময়ের দিকে তাকাতে হবে। যদিও ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ের আগেও লিবারেল তথা উদারবাদী, রাষ্ট্র-বিরোধী এবং ফেডারালবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী বিদ্যমান ছিল যাদেরকে আমরা বর্তমানে নৈরাজ্যবাদী আখ্যা দেই, কিন্তু ১৯ শতকের মধ্যবর্তী পর্যায়ে এসেই এ ধরনের গোষ্ঠীগুলো প্রকৃত অর্থে নৈরাজ্যবাদী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া শুরু করে। 

আমরা নৈরাজ্যবাদের পূর্বসূরি হিসেবে পৃথক তিনটি দার্শনিক ধারার কথা বলতে পারি—গডউইন, প্রুধোঁ এবং সম্ভবত হেগেল। এদের কেউই আসলে নৈরাজ্যবাদী ছিলেন না, যদিও প্রুধোঁই প্রথম নৈরাজ্যবাদের আধুনিক অর্থের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন (তিনি সেটা গ্রহণ করেছিলেন ফরাসি বিপ্লব থেকে, যেখানে সর্বপ্রথম ‘নৈরাজ্যবাদ’ শব্দটা নিন্দাসূচকভাবে নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল)। এদের কেউই নৈরাজ্যবাদী কার্যক্রম বা সংগ্রামে যুক্ত হননি এবং প্রুধোঁ তো সরাসরি সংসদীয় কার্যক্রমেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। নৈরাজ্যবাদের ওপর রচিত সবচেয়ে অসমৃদ্ধ, কিন্তু আপাতভাবে নৈর্ব্যক্তিক বই হলো পল এলটজবেশারের (Paul Eltzbacher) ‘নৈরাজ্যবাদ’। এই বইয়ে নৈরাজ্যবাদকে দেখানো হয়েছে অনেকটা বহুমুখী একটি তত্ত্ব হিসেবে যার কিছুটা গডউইন কিংবা প্রুধোঁ কিংবা স্টার্নার (আরো একজন ব্যক্তি যিনি নৈরাজ্যবাদের কোন উল্লেখ করেন না) কিংবা ক্রপোতকিন থেকে এসেছে, যার প্রত্যেকটিই একটি নির্দিষ্ট চিন্তার বিভিন্ন রূপ। এই বইটিকে মোটামুটি মূল্যহীন একটি জিনিসের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তির চিন্তার বিবরণ হিসেবে তা গ্রহণযোগ্য। প্রুধোঁ সারা জীবনেও কোন কার্যক্রমের ঘোষণা দেননি এবং ক্রপোতকিনও তার সময়ের কেবল বিশেষ কিছু নৈরাজ্যবাদীদের জন্য লেখেন নাই। একই সাথে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর লেখা অন্যান্য বইও একই রকম মূল্যহীন। নৈরাজ্যবাদ সম্পর্কে অনেক অধ্যাপকের ধারণাই তৈরি হয়েছে মূলধারার গণমাধ্যম থেকে। নৈরাজ্যবাদ কোন চিন্তাহীন ধ্বংসাত্মক তত্ত্ব নয়। আবার কিছু উদারনৈতিক চিন্তা নৈরাজ্যবাদকে যেমন মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের উপাসনাকারী তত্ত্ব মনে করে, নৈরাজ্যবাদ সেটাও না—সেই মানুষ বা প্রতিষ্ঠান যতোই স্বাধীন হোক না কেন। 

গডউইন ছিলেন রাষ্ট্রবিহীন সমাজ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, যা পরবর্তীতে তিনটি পৃথক ধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। একটি ধারা ছিল নৈরাজ্যবাদীদের (যেই বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো)। দ্বিতীয় ধারাটি হলো মার্কিন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, যার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন হেনরি ডেভিড থরো এবং তার অনুসারীরা। এটিকে মাঝেমধ্যে নৈরাজ্যবাদী ভাবা হলেও এই চিন্তা একই সাথে আধুনিক ‘উদারবাদী’ পুঁজিবাদেরও উদ্ভব ঘটায়। একই সাথে তা টলস্টয় ও গান্ধীর শান্তিবাদী সংঘের উদ্ভবের জন্যও দায়ী, যার দ্বারা পরবর্তীতে পুরো হিপি সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়েছিল। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রয়োগকৃত না হয়ে পুঁজিপতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার ফলে) একটি ডানপন্থী তত্ত্বে পরিণত হয়েছে। 

গডউইনের চিন্তা থেকে উৎসারিত দ্বিতীয় ধারা থেকে ‘শান্তিবাদী নৈরাজ্যবাদ’ কিংবা ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নৈরাজ্যবাদের’ উদ্ভব ঘটেছে, যা প্রথম ধারার চিন্তা তথা বিপ্লবী নৈরাজ্যবাদ থেকে পুরোপুরি আলাদা। মাঝেমধ্যে এই শান্তিবাদী ধারার ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে ‘এটিই নৈরাজ্যবাদ’। শান্তিবাদী আন্দোলনগুলো, বিশেষত গান্ধীর আন্দোলন, সাধারণত ছিল সর্বগ্রাসী এবং সেগুলো কর্তৃত্ব ফলাতো (হয়তো-বা কেবল নৈতিক পন্থায়)। বেঞ্জামিন টাকারের (Benjamin Tucker) মতধারা—তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কারণে—হরতাল প্রতিরোধের জন্য পুলিশী ক্ষমতার আরোপকে মেনে নিয়েছিল, কারণ এমনটা করা মালিকপক্ষের ‘স্বাধীনতা’। এসকল তথাকথিত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা কোন না কোন সময়ে পুলিশী ক্ষমতা প্রয়োগের পক্ষে, তথা সরকারব্যবস্থার পক্ষে কথা বলেছে। কিন্তু নৈরাজ্যবাদের সংজ্ঞাই হলো সরকারব্যবস্থার অনুপস্থিতি। 

গডউইন থেকে উদ্ভুত তৃতীয় ধারাটি হলো সাধারণ উদারনৈতিকতাবাদ, কিংবা রক্ষণশীল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। 

গডউইনের চিন্তার প্রথম ধারা অর্থাৎ রাষ্ট্রবিহীন সমাজ নির্মাণের ধারণাকে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল অ্যাম্ব্রোস কুডনের (Ambrose Cuddon) মাধ্যমে। কুডনের বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদ ও রাষ্ট্রবিহীন সমাজতন্ত্র ইংরেজ চার্টিস্ট আন্দোলনের শেষ ভাগে এসে যুক্ত হয়েছিল। এটি ফরাসি প্রুধোঁবাদীদের সাথেও সংহতি প্রকাশ করেছিল। প্যারিসে যারা প্রুঁধোর তত্ত্ব গ্রহণ করেছিল তারা নিজেদের নৈরাজ্যবাদী মনে করতো না, বরং তারা নিজেদের রিপাব্লিকান বলতো। তাদের বেশিরভাগই ছিল স্বনির্ভর কারিগর যারা নিজেদের ব্যবসা পরিচালনা করতো। তৎকালীন ফরাসি অর্থনীতির পুরোটাই কৃষক ও কারিগরদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। মুদ্রণকারী, বই বাঁধাইকারী, কামার, দর্জি, স্বর্ণকার, টুপির কারিগর—এরা সবাই ছিল নিজস্ব ব্যবসার পরিচালক বা খামারি, যারা ছিল মালিকের অধীনে কাজ করা একজন শ্রমিক থেকে আলাদা। এরা ছিল স্বাধীন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এবং রাষ্ট্র থেকে তারা কোন সুযোগ সুবিধা ভোগ না করলেও করের বোঝা তাদের বহন করতে হতো, যুদ্ধেও তাদের অংশগ্রহণে বাধ্য করা হতো। সেই সময়ে তারা টিকে থাকার জন্য সহায়ক একটি অর্থনৈতিক কাঠামো খুঁজছিল এবং ক্রমবর্ধমান পুঁজিবাদের সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। 

মার্ক্স এদেরকে বলেছেন ‘পেটি বুর্জোয়া’ (petty bourgeois) অর্থাৎ গৌণ বুর্জোয়া শ্রেণি। ১৯ শতকের প্রেক্ষাপটে এর অর্থ ভিন্নতর ছিল। তিনি যৌক্তিকভাবেই দাবি করেছেন এই ‘পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি’ সমসাময়িক কারখানা শ্রমিকদের মতো সংঘবদ্ধ ছিল না (তিনি খামারের শ্রমিকদের অবজ্ঞা করতেন); তিনি আরো বলেন, এই শ্রেণির মানুষকে যখন জোরপূর্বক শিল্পায়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তারা তাদের শ্রেণি বহির্ভুত কোন সুশৃঙ্খল দলের তৈরি করা নিয়ম মেনে কাঠামোভুক্ত হয়নি, বরং তারা ছিল স্বাধীনচেতা এবং চাপিয়ে দেওয়া কাঠামোর ব্যাপারে তারা ছিল সন্দিহান। তাদের এই অসন্তুষ্টি প্রায়শই সহিংসতার রূপ নিতো। তারা নৈরাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং সিন্ডিকালবাদের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির মাঝে নৈরাজ্য ছড়িয়ে দেয়। (এই দাবি এখনকার মার্ক্সবাদীদের মধ্যে দেখা যায়, যখন তারা পেটি বুর্জোয়া বলতে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু বোঝায়—হিসাবরক্ষক কিংবা আইনজীবী—এবং এর ফলে মার্ক্সের যথেষ্ট যৌক্তিক একটি পর্যালোচনাটি বর্তমান সময়ে এসে উদ্ভট একটি তত্ত্বে পরিণত হয়েছে।)

এসকল ইংরেজ ও ফরাসি আন্দোলন প্রথম ইন্টারন্যাশনালে একত্রিত হয়। শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক অ্যাসোসিয়েশন তার অস্তিত্বের জন্য মার্ক্সের কাছে ও পরোক্ষভাবে হেগেলীয় দর্শনের কাছে ঋণী। কিন্তু ইন্টারন্যাশনালের ভেতরে কেবল মার্ক্সের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রই ছিল না, একই সাথে ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র, ব্লাংকিবাদ (শ্রমিক শ্রেণির রিপাব্লিকানবাদ), ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়নবাদ, জার্মান কর্তৃত্ববাদ ও সুবিধাবাদী সমাজতন্ত্র, এবং স্প্যানিশ, সুইস ও ইতালীয় রাষ্ট্রবিহীন সমাজতন্ত্রও বিদ্যমান ছিল। একই সাথে ছিল জাতীয় রিপাব্লিকানবাদ ও বিভিন্ন ফেডারালবাদী ধারার চিন্তা। 

বাকুনিনকে সাধারণত যেভাবে নৈরাজ্যবাদের ‘প্রতিষ্ঠাতা’ বলা হয়, তিনি আসলে তা ছিলেন না। জীবনের শেষভাগ পর্যন্ত তিনি নৈরাজ্যবাদীই ছিলেন না। তিনি ফেডারালবাদ ও সমাজতন্ত্রের দীক্ষা পেয়েছিলেন জুরার (Jura) সুইস শ্রমিকদের কাছ থেকে এবং গডউইন ও প্রুধোঁপন্থী ‘ফেডারালবাদী’ কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী সমাজতন্ত্রীদের চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। অনেক দেশেই, বিশেষত স্পেন ও ইতালিতে, বাকুনিন কর্তৃক মার্ক্সের চিন্তার সমালোচনাই ফেডারালবাদী আন্দোলনকে সংজ্ঞায়িত করেছিল। (যদিও নৈরাজ্যবাদীদের কাছে মার্ক্স ছিলেন ইন্টারন্যাশনালের একজন ‘খলনায়ক’, এটা বলতেই হয় যে, মার্ক্স যদি সমাজতন্ত্রের একটি বিশেষ রূপের কাঠামো দাঁড় না করাতেন তাহলে কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হতো না এবং বাকুনিনও এর বিরোধী কোন তত্ত্ব দিতে পারতেন না।) 

১৮৬৯ সাল নাগাদ ইন্টারন্যাশনালে একটি যথেষ্ট স্পষ্ট প্রবণতা গড়ে ওঠে যাকে ‘বাকুনিনবাদী’ বলা হচ্ছিল; যা একদিকে ছিল গডউইন প্রভাবিত, অন্যদিকে প্রুধোঁ প্রভাবিত। যখন এই ইন্টারন্যাশনাল প্যারিস কমিউনের মুখোমুখি হয় তখন তারা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় (যদিও এই বিচ্ছেদ বহু আগেই ঘটার কথা ছিল এবং অনেকটাই ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জায়গায় চলে গিয়েছিল)। অ-নৈরাজ্যবাদী ও মার্ক্সবাদীরা প্যারিস কমিউনের ব্যাপারে তাদের ভিন্ন ভিন্ন পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের ফলে বুঝতে পারে যে তারা একে অপরের থেকে আলাদা। 

একই ভাবে, অনেক বছর ধরে নৈরাজ্যবাদীরা সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের একটা অংশ গঠন করে যেতে থাকে যেখানে মার্ক্সবাদী ও সমাজ-গণতন্ত্রীরাও (Social-Democrat) অন্তর্ভুক্ত ছিল। মার্ক্স একটি গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। জার্মান সমাজতন্ত্রী আন্দোলন লাসাল (Lassalle) দ্বারা অধিক প্রভাবিত ছিল; অন্যদিকে ইংরেজ সমাজতন্ত্রের ওপর অধিক প্রভাব ছিল র‍্যাডিকাল প্রথাবিরোধিতার খৃষ্টীয় ও সংস্কারবাদী ধারাসমুহের। কেবল মার্ক্সের মৃত্যুর পরেই, যখন তাঁর চিন্তা জার্মান সমাজ-গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক মতবাদ হয়ে ওঠে, নৈরাজ্যবাদীরা সমাজতন্ত্রী ইন্টারন্যাশনালগুলো থেকে পুরোপুরি বহিষ্কৃত হয়। সমাজ-গণতন্ত্রও বিভক্ত হয়ে পড়ে যার একদিকে ছিল ইংরেজ উদারনৈতিকতা এবং অন্যদিকে সমাজ-গণতন্ত্র। ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ সমাজ-গণতন্ত্রী (বলশেভিকরা, যারা প্রকৃত অর্থে কখনো সংখ্যালঘিষ্টের চেয়ে বেশি কিছু হতে পারেনি) এবং সংস্কারবাদের মধ্যেও দেখা দেয় বিরোধ। 

সে সময়ে নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের মধ্যে সেই অর্থে কোন বিভাজন দেখা দেয়নি। মূলধারার জনমত টলস্টয়ের মতো মানুষকেও নৈরাজ্যবাদী আখ্যা দিয়ে দেয় (তিনি নিজে কখনো দাবি করেননি তিনি নৈরাজ্যবাদী। তিনি তা ছিলেনও না; এমনকি প্রচলিত অর্থে তিনি খৃষ্টান কিংবা শান্তিবাদীও ছিলেন না। তার ভক্তরা এসব বিষয়ে তার চেয়ে বোধহয় একটি বেশিই বুঝতে চেয়েছিল)। বরং তিনি ছিলেন অন্যান্য ব্যঙ্গাত্মক-নৈরাজ্যবাদীদের মতো গডউইনবাদের ‘দ্বিতীয় ধারার’ অনুসারী একজন ব্যক্তি। আমরা যেটিকে ‘মূলধারার’ নৈরাজ্যবাদ বলতে পারি তা ছিল অনেক বেশি সংলগ্ন ও সংহত এবং তার কাঠামো গঠিত হয়েছিল কয়েকজন তাত্ত্বিকের লেখার মাধ্যমে; পিটার ক্রপোতকিন তাঁদেরই একজন।

প্যারিস কমিউনের রক্তাক্ত অবদমন ও পৃত্থিবীর বিভিন্ন স্থানে নিপীড়নের পর—জারের রাশিয়া এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য—নৈরাজ্যবাদ তার পরিচিত জঙ্গিবাদের পর্যায়ে এসে উপনীত হয়। নৈরাজ্যবাদ পালটা লড়াই চালিয়ে যায়, টিকে থাকে এবং বিপ্লবী সিন্ডিকালবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায় (কিংবা সেখানে উপস্থিত হয়) যা শুরু হয়েছিল ফ্রান্সে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দেশপ্রেমের চিন্তার পুনর্জাগরণ, সংস্কারবাদী সমাজতন্ত্রের বিস্তার এবং ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটা শুরু করলে নৈরাজ্যবাদ তার ভিত্তি হারিয়ে ফেলতে থাকে। এবং যদিও নৈরাজ্যবাদ রুশ বিপ্লবের সময় সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছিল, পরবর্তীতে তা বলশেভিক প্রতিবিপ্লবের দ্বারা পরাজিত হয়। ১৯৩৬ সালের স্প্যানিশ বিপ্লবের সময় নৈরাজ্যবাদকে দেখা যায় প্রতিরোধমূলক ও সৃষ্টিশীল উভয় ক্ষেত্রেই সোচ্চার হতে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাগাদ নৈরাজ্যবাদকে একাধিক বৈপ্লবিক কার্যক্রম ও শ্রমিকদের আন্দোলনে প্রয়োগ করা হয়। বিকল্প পন্থাসমূহও প্রয়োগের চেষ্টা করা হয় এবং ব্যর্থতার পর বাতিল করে দেওয়া হয়। জার্মান বিপ্লবের ফলে শ্রমিকদের কাউন্সিল গঠনের ধারণার সূত্রপাত ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প শ্রমিকদের সংগঠনের (IWW) অভিজ্ঞতা শিল্প শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনের সম্ভাব্যতাকে স্পষ্ট করে তোলে এবং দেখায় কীভাবে ‘পুরনো জগতের খোলসের ভেতরেই নতুন জগৎ’ নির্মাণ সম্ভব। মার্ক্সবাদী সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ‘আগুন বনাম আগুনের’ চিন্তা, রাশিয়ার প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা বিহীন সমাজতন্ত্রের অর্থ, এবং সর্বত্র সংস্কারবাদী সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে নৈরাজ্যবাদী চিন্তাধারা রূপ লাভ করে। 

যদিও অনেকেই নৈরাজ্যবাদী দর্শনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন, তবুও সে অর্থে নৈরাজ্যবাদের কোন ধরাবাঁধা তাত্ত্বিক ছিলেন না। নৈরাজ্যবাদ এমন একটি ধারা যা কোন দর্শনের মধ্য দিয়ে নয়, বরং চর্চার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। প্রায়শই কোন একজন বুর্জোয়া তাত্ত্বিক হাজির হন যিনি ইতোমধ্যে কৃষক-শ্রমিকদের দ্বারা গঠিত হওয়া চিন্তাগুলোই পুনরায় লিপিবদ্ধ করেন। বুর্জোয়া ইতিহাসবিদ ও অন্যান্য লেখকেরা (সেই বুর্জোয়া ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই) তাকে একজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান। এর ফলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় শ্রমজীবী মানুষ যেন বুর্জোয়া নেতৃত্বের ওপরই নির্ভরশীল। 

প্রায়শই, বুর্জোয়া একাডেমিকরা তাদের নিজস্ব উদারনৈতিক দর্শন প্রকাশের জন্য ‘নৈরাজ্যবাদ’ শব্দটি ধার করেন। কিংবা মূলধারার সাংবাদিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের অপছন্দের বিষয়গুলো প্রকাশের জন্য ‘নৈরাজ্যবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। কিছু অধ্যাপক ও শিক্ষকের জন্য ‘নৈরাজ্যবাদের’ অর্থ টলস্টয়বাদ থেকে আইরিশ রিপাব্লিকান বাহিনী, মাদক গ্রহণ থেকে জঙ্গিবাদী ট্রেড ইউনিয়ন, জাতীয়তাবাদ থেকে বলশেভিকবাদ, হিপি দল থেকে ইসলামী মৌলবাদ, পাংক সংস্কৃতি থেকে কোন কিছুর সহিংস প্রতিবাদ পর্যন্ত প্রায় সবকিছুই হতে পারে! এটা একাডেমিকদের মূর্খতা ছাড়া কিছুই না। তাদের এমনটা করার উদ্দেশ্য ছিল ১৯৬০ এর দশকের কিছু সাংবাদিকদের থেকে নিজেদের আলাদা করে তোলার চেষ্টা, যেসকল সাংবাদিক উপরওয়ালাদের হুকুম অনুযায়ী চর্চামুখী মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী যেকোন কিছুকেই‘নৈরাজ্যবাদী’ এবং নৈরাজ্যবাদী যেকোন কিছুকে ‘জাতীয়তাবাদী’ হিসেবে উপস্থাপন করতো। 

নৈরাজ্যবাদের কিছু অবিচ্ছেদ্য নীতি

আমাদের জন্ম হয় মুক্ত মানুষ হিসেবে 

আমাদের অধিকার আমাদের থেকে অবিচ্ছেদ্য। জগতে জন্মানো সকল মানুষ তার পূর্ববর্তী সকল প্রজন্মের কর্মফলের উত্তরাধিকারী। কেবল জন্মসূত্রেই পুরো জগতের ওপর সকলের অধিকার রয়েছে। আদর্শ বা বাধ্যবাধকতার নামে চাপিয়ে দেওয়া দায়িত্ব—যেমন দেশপ্রেম, রাষ্ট্রের প্রতি দায়, ঈশ্বরের উপাসনা, ক্ষমতাশালী ও কর্তৃত্ববান শ্রেণির প্রতি আনুগত্য, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার প্রতি সম্মান—সবগুলোই মিথ্যা। 

সকলের জন্ম যদি মুক্তমানব হিসেবে হয়, তাহলে দাসত্ব মানেই হত্যাকাণ্ড 

কেউই কাউকে শাসন করার যোগ্য নয়। এমনটা কোথাও বলা হচ্ছে না যে, মানবাজাতি নিখুঁত, কিংবা কেবল তার সহজাত সাধুচরিত্রের (বা সেটার অভাবের) মাধ্যমে তাকে শাসন করতে দেওয়া উচিত (কিংবা উচিত না)। এ ধরনের শাসন অপশক্তির কারণ হয়ে ওঠে। এমন কোন অতিমানব বা সুবিধাভোগী শ্রেণি নেই যারা ‘ত্রুটিপূর্ণ মানবজাতির’ উর্ধ্বে এবং আমাদেরকে শাসন করা যাদের নৈতিক দায়িত্ব। দাসত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ মানে জীবনের আত্মসমর্পণ। 

দাসত্বের অর্থ যদিও হয় হত্যাকাণ্ড, তাহলে সম্পদ মানেই চৌর্যবৃত্তি

মানুষ যে তার প্রাকৃতিক, সহজাত উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তার কারণ এর একটা অংশ তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তা ঘটেছে বলপূর্বক (ক্ষমতা কাঠামোর মাধ্যমে বৈধতা পাওয়া দখলদারিত্ব কিংবা লুটতরাজ) কিংবা ভাঁওতাবাজির (যেখানে মানুষকে বোঝানো হয়েছে রাষ্ট্র কিংবা তার তাঁবেদার শ্রেণি কিংবা উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদশালী শ্রেণির সুযোগ-সুবিধাসমূহ তাদের প্রাপ্য) মাধ্যমে। মালিকানার সকল বিদ্যমান কাঠামো নিশ্চিত করে যেন কিছু মানুষ তাদের শ্রমের ফসল থেকে বঞ্চিত হয়। এটা সত্য যে, একটা প্রতিযোগিতামূলক সমাজে, কেবল ব্যক্তি মালিকানাই মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে (প্রুধোঁ এটাই বলতে চেয়েছিলেন যখন তিনি নিজেকে আত্মনির্ভরশীল কারিগর হিসেবে পরিচয় দিয়ে ঘোষণা দেন “সম্পত্তি মানে মুক্তি”, যেটিকে তার প্রাথমিক বক্তব্যের সাথে সংঘাতময় মনে হতে পারে যেখানে তিনি বলেন সম্পত্তি মানেই চুরি)। কিন্তু মালিকানার নীতি, যার সাথে সমাজ জড়িত, সেটি বিদ্যমান সকল বৈষম্যের মূল কারণ। 

সম্পত্তি যদি চুরি হয়, তাহলে সরকারব্যবস্থা মাত্রই স্বৈরাচার

আমরা যদি সমাজতন্ত্রী সমাজের নীতি মেনে নেই এবং উত্তরাধিকারী সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতাশালী শ্রেণির বিলুপ্তি ঘটাই, রাষ্ট্র তখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। যদি রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা হয়, অপ্রয়োজনীয় সরকারব্যবস্থা স্বৈরাচারের রূপ ধারণ করবে যেহেতু সরকার কাঠামোর তখন নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অন্য কোন উপায় থাকবে না। “সমাজতন্ত্র বিহীন স্বাধীনতা মানে শোষণ, স্বাধীনতা বিহীন সমাজতন্ত্র হলো স্বৈরাচার” (বাকুনিন)। 

সরকারব্যবস্থার অর্থ যদি হয়ে থাকে স্বৈরাচার, তবে নৈরাজ্যের অর্থ মুক্তি

যারা ‘নৈরাজ্য’ বলতে বিশৃঙ্খলা কিংবা কুশাসনকে বুঝে থাকেন, তারা আসলে ভুল না। যদি তারা সরকারব্যবস্থাকে আবশ্যক মনে করে, যদি তারা মনে করে সচিবালয় থেকে আমাদের জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে আমরা বাঁচতে পারবো না, বা যদি ভাবেন আমাদের ভালো থাকার জন্য রাজনীতিবিদদের প্রয়োজন এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য আচরণ বজায় রাখার জন্য পুলিশ প্রয়োজন, তাহলে তারা সঠিক যদি তারা মনে করে থাকেন নৈরাজ্য বলতে সরকারব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত কিছুকে বোঝায়। কিন্তু যারা ভিন্নমত পোষণ করে থাকেন এবং মনে করে থাকেন সরকারব্যবস্থা মাত্রই স্বৈরাচার, তারাও সঠিক, যদি তারা মনে করে থাকেন নৈরাজ্য মানে মুক্তি। সরকারব্যবস্থা যদি হয়ে থাকে সুবিধাভোগী শ্রেণির তোষামোদ, শোষণ এবং বণ্টনব্যবস্থার অকার্যকারিতা, তাহলে নৈরাজ্য মানে সুশৃঙ্খলা। 

শ্রেণি সংগ্রাম

বৈপ্লবিক নৈরাজ্যবাদের ভিত্তি হলো শ্রেণি সংগ্রাম; যদিও এটা সত্য যে, অনেক নৈরাজ্যবাদী তাত্ত্বিকই মার্ক্সীয় পরিভাষা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এই কথাটাকে অন্যভাবে উপস্থাপন করবে। তবে নৈরাজ্যবাদের এই বক্তব্য মার্ক্স, এঙ্গেলসের শ্রেণি সংগ্রাম বিষয়ক যান্ত্রিক (যেখানে মনে করা হয় কেবল শিল্পের সাথে জড়িত সর্বহারার পক্ষে সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব) দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে না। এটাও মনে করে না যে নির্দিষ্ট সর্বহারা শ্রেণির অনিবার্য ও বৈজ্ঞানিকভাবে অনুমানযোগ্য জয়ই চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করবে। বরং যদি ১৯১৪ সালের আগে কোন সময়ে নৈরাজ্যবাদের জয় হতো—যখন শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে নৈরাজ্যবাদের চিন্তা জনপ্রিয় হয় ওঠেনি—তাহলে তা হতো কৃষক ও কারিগর শ্রেণির জয়, যারা ছিল শিল্প শ্রমিক ও সর্বহারা শ্রেণির চেয়ে অধিক দরিদ্র। 

আগেও যেমনটা বলেছি, মার্ক্সবাদীরা নৈরাজ্যবাদীদের পেটি বুর্জোয়া বলে গালি দেয়। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে এই পরিভাষা মার্ক্সের চিন্তাকে হাস্যকর করে তোলে। মার্ক্স তা করেছিলেন বুর্জোয়া (যারা নিয়োগকর্তা ও ব্যবসায়ী হিসেবে পূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করতো) ও গৌণ নাগরিকদের (যেমন, স্বনিযুক্ত শ্রমিক) মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণের জন্য। মার্ক্স যে সময়ের প্রেক্ষাপটে নৈরাজ্যবাদীদের ‘পেটি বুর্জোয়া’ হিসেবে অভিহিত করেন, তখন নৈরাজ্যবাদীরা একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও কৃষি সমাজের ভাঙ্গনের ফলে উদ্ভুত ‘হতাশার’ কারণে সহিংসতার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছিল, যেহেতু নৈরাজ্যবাদীরা শিল্প শ্রমিকদের মতো চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুন সহজে মেনে নিতে পারেনি। মার্ক্স কেবল তার সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর্যালোচনা করেছেন, বিশেষত প্যারিস ও বার্সেলোনার কমিউনগুলো ভেঙে যাওয়া কিংবা তাঁর সময়ে ঘটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভাঙ্গন। কিন্তু বর্তমানের প্রেক্ষাপটে, আজকের দিনের নৈরাজ্যবাদীদের কেতাদূরস্ত ব্যাংকার, ব্যবসায়ী বা ভদ্রলোক শ্রেণির লোক হিসেবে ভাবা (যাদেরকে জোরপূর্বক শিল্পকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে তারা সহিংস হয়ে উঠেছে) হবে নিতান্ত হাস্যকর। 

মার্ক্স মনে করতেন শিল্প শ্রমিক বা সর্বহারার পক্ষে নিজেদের মতো চিন্তা করার সামর্থ্য নেই—এর কারণ তাদের যথেষ্ট অবসর বা স্বাধীনতা নেই—এবং সে কারণে ট্রেড ইউনিয়নের ধারণা তৈরি ও সংঘবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের একটি বহিরাগত ‘শিক্ষিত শ্রেণির’ নেতৃত্ব প্রয়োজন হয়। তার সময়ে এই পণ্ডিতদের, ও পরবর্তীতে ছাত্রদের অভিজাত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত মনে করা হতো। 

মার্ক্স বর্তমান সময়ের বাস্তবতা অনুমান করতে পারেননি, যেখানে ছাত্ররা নিজেরাই একটি হতাশ শ্রেণি যারা মার্ক্সের দীক্ষা গ্রহণ করে একঘেয়ে চাকরি নয়তো বেকারত্ব বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে এবং নিজেদের চিন্তা ও বাস্তবতার ভিত্তিতে নব্য বামপন্থা তৈরি করেছে, যারা স্পষ্টতই উৎপাদক শ্রেণির (productive class) অন্তর্ভুক্ত নয়। যেকোন শ্রেণিই তার নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে বৈপ্লবিক শ্রেণি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে; তবে কেবল উৎপাদক শ্রেণিই পারে উদারবাদী (libertarian) বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে, কারণ তাদেরই কোন প্রয়োজন নেই কাউকে শোষণ করার। বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশে শিল্পায়ন সংঘটিত হওয়ার ফলে পুরনো ‘পেটি বুর্জোয়া’ শ্রেণি শিল্পে নিযুক্ত সর্বহারা শ্রেণি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং এই পেটি বুর্জোয়াদের অবশিষ্ট সবাই শ্রমিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বদলে হয়ে ওঠে পুঁজিপতি শ্রেণি; যেহেতু তারা টিকে থাকার জন্য অর্থনৈতিকভাবে সম্প্রসারণ করতে এবং শ্রমিক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু কিছু পশ্চিমা দেশের সাম্প্রতিক প্রবণতা হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির স্থানচ্যুতি (displacement) এবং তাদেরকে উৎপাদনকারীর ভূমিকা থেকে ক্রমাগত সরিয়ে ফেলা। খননকার্য, জাহাজ নির্মাণ, বস্ত্র উৎপাদন, বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প, এমনকি গোটা শহরও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এবং এসকল শ্রমিকদের বাধ্য করা হচ্ছে গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানে বা সুপারমার্কেটের কর্মীর মতো সেবাখাতে বিভিন্ন চাকরি নিতে। এই কাজগুলো উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত না এবং এর ফলে শ্রমিকরা ক্রমশ তাদের শক্তির উৎস (industrial muscle) হারাচ্ছে।

শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক বা সর্বহারা শ্রেণি গঠনের সময়ে নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন নৈরাজ্য-সিন্ডিকালবাদী আন্দোলনের রূপ নেয়, যার উৎপত্তি হয়েছিল স্বয়ং শ্রমিকদের মধ্য থেকে। ফলে, বহিরাগত নেতৃত্ব ছাড়া শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনের চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারে না—এমন ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। নৈরাজ্য-সিন্ডিকালবাদ হলো কর্মস্থলে শ্রমিকদের সংগঠিত করা—প্রাথমিকভাবে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের জন্য এবং পরবর্তীতে কর্মস্থলসমূহ দখল করে নেওয়ার জন্য। ফলে এটি প্রথাগত ট্রেড উনিয়ন আন্দোলনের চেয়ে অধিক কার্যকরী হয় এবং একই সাথে পুঁজিবাদকে এড়িয়ে যাওয়ার বদলে রাষ্ট্র পরিচালিত অর্থনীতিকেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। 

নৈরাজ্যবাদ বা মার্ক্সবাদ কোনটাই শ্রমিক শ্রেণিকে আদর্শায়িত (idealise) করেনি (প্রোপাগাণ্ডা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম)—এটি ছিল খৃষ্টান সমাজতন্ত্রীদের কাজ। এমনকী এটাও কখনো বলা হয়নি যে, শ্রমিক শ্রেণি প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারে না। বরং দেখা যায়, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের মধ্যে পরিবর্তন মেনে নিতে চাওয়ার প্রবণতা কম। শ্রমিক শ্রেণির সকল সদস্য ফেরেশতা না এমনটা বললে একদিকে যেমন পাঠকের ধৈর্য্য পরীক্ষা করা হবে, একই সাথে এর মাধ্যমে এক অর্থে এমনটাই দাবি করা হবে যে শ্রমিকেরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রের ব্যাপারে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে অনুপোযোগী। আর আমার ধারণা, কেবল স্বর্গেই ফেরেশতাদেরকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হবে। 

আর্টওয়ার্ক: ডিসকোভারিং আননোন
শিল্পী: মেডেরিক তুরে
সূত্র: আর্টসি

সংগঠন ও নৈরাজ্য

কর্তৃত্বপরায়ণ রাজনৈতিক দলের সদস্য বা অনুসারীদের পক্ষে এটা বিশ্বাস করা বেশ কঠিন যে, কোন প্রকারের সরকারব্যবস্থা ছাড়াই মানুষ নিজেদের সংগঠিত করতে পারে। এর ফলে তারা দাবি করে—এবং এটি নৈরাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে একটি প্রচলিত সমালোচনা—‘নৈরাজ্যবাদীরা সংগঠনে বিশ্বাস করে না’। কিন্তু সরকার গঠিত হয় মানুষকে কেন্দ্র করে, সংগঠন গঠিত হয় কোন বিষয় বা চিন্তাকে কেন্দ্র করে। 

একটি প্রচলিত ধারণা হলো নৈরাজ্যবাদীরা ‘অন্যদের সংগঠন ভেঙে ফেলে কিন্তু নিজেদের সংগঠন তৈরি করতে পারে না’। এই কথাটাও সাধারণত বলা হয়ে থাকে এমন একটি বাস্তবতায় যেখানে বিপজ্জনক, শ্রেণিবিভক্ত, কিংবা অর্থহীন সংগঠনগুলো প্রভাবশালী এবং সেগুলো উদারবাদী সংগঠন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। একই সাথে এটাও মেনে নিতে হয় যে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে অনেকেই নৈরাজ্যবাদী সংগঠন নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছেন; কিন্তু পৃথিবীর অনেক স্থানে এমন সংগঠন দেখাও যায়। 

একটি সংগঠন হতে পারে গণতান্ত্রিক কিংবা স্বৈরাচারি, কর্তৃত্বপরায়ণ কিংবা উদারবাদী। এমনকি অনেক উদারবাদী সংগঠন রয়েছে যারা ঠিক নৈরজ্যবাদী নয়; যা প্রমাণ করে সকল সংগঠনকে শ্রেণিবিভক্ত হতে হবে এমনটা না।  

অনেক ট্রেড ইউনিয়নই, বিশেষত যদি তারা সফলতার মুখ দেখে, তখন তারা তাদের আন্দোলনকে সুশৃঙ্খল রাখতে ও পুঁজিবাদী বাস্তবতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য কর্তৃত্বপরায়ণ বা শ্রেণিবিভক্ত হয়ে ওঠে (যদি তারা শুরু থেকেই এমনটা না হয়ে থাকে)। কিন্তু নিয়োগকর্তাদের সংগঠনগুলোর মধ্যে কি এমন প্রবণতা দেখা যায়? সেখানে এমনটা ঘটলে এবং কোনরূপ স্বার্থহানি ঘটলে অনেকেই সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসবে। এমন সংগঠনে সবাইকে স্বাধীনভাবে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হয় কারণ কারো কারো কাছে হুমকি প্রতিরোধের উপায় ও ক্ষমতা রয়েছে। এমনকি যখন কর্তৃত্বপরায়ণতা ফ্যাসিবাদের রূপ ধারণ করে, নিয়োগকর্তারা তখনও তাদের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখে। নাৎসিবাদ এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র পুঁজিপতিদের প্রতিও নিষ্ঠুরতা দেখায় যখন শ্রমিকদের অবদমন সম্পন্ন হওয়ার পর তাঁবেদার শ্রেণিরও (যে শ্রেণির কারণে একনায়ক ক্ষমতা দখল করতে পেরেছে) স্বাধীনতা সীমিত করে ফেলা হয় নয়তো পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়। 

কেবল সবচেয়ে বৈপ্লবিক ইউনিয়নগুলোই পেরেছে তাদের গণ শ্রমিক আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামোকে অনানুষ্ঠানিক রাখতে যেখানে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ সীমিত এবং যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেই তৃণমূল পর্যায়ের শ্রমিককেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

একটি কর্তৃত্বপরায়ণ সমাজে নৈরাজ্যবাদীর ভূমিকা 

থর‍্যো (Thoreau) বলেছিলেন, “দাস সমাজে মুক্ত মানুষের জন্য একমাত্র জায়গা হচ্ছে জেলখানা” (যদিও তিনি নিজে সেখানে কেবল এক রাত কাটিয়েছেন)। এটি যথেষ্ট উত্তেজনাদায়ক একটি কথা হলেও সে অনুযায়ী জীবনযাপন করা ঠিক হবে না, তার যতোই সত্যতা থাকুক না কেন। একজন বিপ্লবীকে সকল প্রকারের দমন নিপীড়ণের ব্যাপারে প্রস্তুত থাকতে হবে, কিন্তু কেবল একজন আত্মনিগ্রহকামীর (masochist) পক্ষেই সম্ভব সেগুলোকে স্বাগতম জানানো। একজন ব্যক্তি তার বিদ্রোহে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারবে বা চাইবে তা পুরোপুরি নির্ভর করে তার নিজস্ব কার্যক্রম ও সিদ্ধান্তের ওপর; এর কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। নৈরাজ্যবাদীরা বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের সামাজিক বিদ্রোহ ও পুনর্নির্মাণ কর্মকাণ্ড সংগঠিত ও তাতে অংশগ্রহণ করেছে। উদারবাদী শিক্ষাব্যবস্থা (libertarian education), শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করা, যৌথীকরণ (collectivisation), ব্যক্তির বিভিন্ন প্রকারের ডাইরেক্ট অ্যাকশন, এর কিছু উদাহরণ।  

নৈরাজ্য-সিন্ডিকাল্বাদ প্রচারের কারণ, পুরো সমাজের সার্বিক সামাজিক পরিবর্তন নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হলো অর্থনীতিতে পরিবর্তন ঘটানো। এটাও সত্য যে ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড কিছু মুক্তিকামী কার্যক্রমেও ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কিছু মানুষ গ্রামাঞ্চলে একটি কমিউন নির্মাণ করে যেখানে তারা সমমনা অন্য মানুষদের নিয়ে বসবাস শুরু করতে পারে এবং যতোক্ষণ না বাইরের জগত তাদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে ততোক্ষণ তারা বাইরের জগতের ব্যাপারে না ভেবেও থাকতে পারে। এই ব্যবস্থায় তারা একটি মুক্ত অর্থনীতির মধ্যে বসবাস করতে পারে যদি তারা মৌলিক কিছু সমস্যার সমাধানে সমর্থ হয়; কিন্তু এতে করে কোন সামাজিক পরিবর্তন ঘটবে না।

ব্যক্তিগত উদ্যোগের নিন্দা করা এই আলোচনার উদ্দেশ্য নয়, বরং তার বিপরীত। পুরো একটি দেশ স্বৈরশাসকের অধীনে থাকতে পারে এবং পুরো জনগোষ্ঠী পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, কিন্তু কেউই কিছু করবে না যতোক্ষণ না কোন একজন ব্যক্তি সামনে এগিয়ে এসে প্রতিবাদ জানায় এবং স্বৈরশাসকের পতনের দাবি তোলে। কিন্তু এরকম কোন প্রতিবাদী, সাহসী, ও যোগ্য মানুষের উদ্ভব ঘটার আগেই অনেক সময় সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।  

এমনটা ঘটলে যেকোন গণমুখী কার্যক্রমই শেষমেশ হয়ে উঠবে গ্যাস চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সারি। আমরা মনে করি না “সর্বহারা শ্রেণি খারাপ কিছু করতে পারে না”, বরং দেখা গেছে যে তারা এমনটা করতে পারে। কিন্তু সংগঠন মানেই শক্তি। আমরা গণ কার্যক্রমের কথা বলি কারণ তা কার্যকরী এবং সর্বহারার হাতেই ক্ষমতা রয়েছে পুরনো অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলে নতুন কাঠামো নির্মাণের। এই মুক্ত সমাজ গঠিত হবে শ্রমিকদের কাউন্সিলের ভিত্তিতে কর্মক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেওয়া ও কর্তৃত্ববাদী কাঠামোসমূহ গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। বর্তমান সময়ের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ব্যবস্থার ভেতরেই তা করা সম্ভব। 

শ্রমিকের নিয়ন্ত্রণ

যখন আমরা কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিয়ন্ত্রণের কথা বলি, তা অন্যদের থেকে—যারা কেবল ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকের অংশগ্রহণ দাবি করে কিংবা মনে করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনেই ব্যবস্থাপনামূলক কার্যক্রমে শ্রমিকের অবদান থাকতে পারে—আলাদা। পুঁজিবাদী সমাজে আত্ম-ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারা একটি বড় মাপের অর্জন এবং তা মাঝেমধ্যে সম্ভব হয় যখন শ্রমিকরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, কিংবা আরো বেশি সম্ভবপর হয় যদি সেই কাজ হয়ে থাকে যথেষ্ট বিপজ্জনক এবং যদি সেই কাজকে বাইরে থেকে তদারকির কোন সুযোগ না থাকে। এটিই নৈরাজ্যবাদের মূল কথা এবং এটাকে সিন্ডিকালবাদের সাথে মিলিয়ে ফেলা যাবে না, যদিও উভয়ই মনে করে ভবিষ্যতের সমাজ হতে হবে স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বশাসিত। আমরা শ্রমিকের ওপর যেকোন কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে, এমনকি যদি তা তাদের নিজেদের প্রতিনিধির মাধ্যমেও হয়ে থাকে। 

এর অর্থ সম্ভবত শিল্পকে ক্ষুদ্রতর ইউনিটে বিভক্ত করা এবং আমরা তার পক্ষে। আমরা জাতীয়করণের নামে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে। 

এটা বলা জরুরি নয়, তবুও বলতে হয়, শ্রেণি সংগ্রাম ছাড়াও ব্যক্তিগত মুক্তির অন্যান্য পন্থা রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে পেটের দায়ে তা প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু এগুলোর কোনটির পক্ষেই বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমাজ পালটানো সম্ভব নয়। আত্ম-নিয়োগকৃত কারিগর আর প্রুধোঁর যুগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে না (হয়তো নতুন সমাজ ব্যবস্থায় তা পুনরুজ্জীবিত হবে)। নিজের ইচ্ছামতো কাজ করা থেকে মানুষ সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে, কিন্তু সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমগুলো সব রয়েছে মৌলিক অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত মানুষদের হাতে।

সাম্প্রতিক সময়ের প্রবণতা আত্ম-নিয়োগকৃত কারিগরের গুরুত্বকেই তুলে ধরে। পুঁজিবাদের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ার কারণে শাসকগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন শিল্পকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। এমতাবস্থায়, সমাজে পরিবর্তন আনতে হলে মূলধারার পুঁজিবাদের বাইরে কাজ করে যাওয়া মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পুঁজিবাদের প্রবণতার বিগত পরিবর্তনসমূহের সময় এই অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা থেকেই মূলত নৈরাজ্য-সিন্ডিকালবাদের উদ্ভব ঘটেছে। 

নৈরাজ্যবাদী যেখানে বিদ্রোহী

প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একজন নৈরাজ্যবাদীর নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু না। ইতিহাসে অসংখ্য উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে একজন নৈরাজ্যবাদী একাই তার সংগ্রাম চালিয়ে গেছে; হয়তো কখনো তার পুরো দেশে সে-ই একমাত্র নৈরাজ্যবাদী ছিল। বর্তমান সময়ে হতো এই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, যেখানে অনেকেই নিজেদের নৈরাজ্যবাদী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। যদিও এদের সংখ্যা অতি নগণ্য, কিন্তু এরা কেবল তরুণ বয়সে নিজেদের রাগ কিংবা বিরুদ্ধাচরণকে ব্যাখ্যা করার জন্য ‘নৈরাজ্যবাদ’ শব্দটা ব্যবহার করে না। 

এমন পরিস্থিতিতে নৈরাজ্যবাদীরা হয়তো একাই নৈরাজ্যবাদী আদর্শের জন্য লড়াই করে যাবে, কিন্তু পাশাপাশি অন্যান্য লড়াইয়েও অংশগ্রহণ করবে; যেমন, সামরিকতার বিরোধিতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, জাতীয়তাবাদ বিরোধিতা, কিংবা শ্রেণি সংগ্রাম। অৎবা তারা চাইলে নিজেদের সংগঠনও তৈরি করতে পারে। 

নৈরাজ্যবাদের চিন্তাভাবনা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে তা মানুষের চরিত্র পালটে দেয়, বা নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনকে সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে বিচার করতে হবে—এমনটা মনে করা ভুল হবে। নৈরাজ্যবাদীদের তৈরি করা সংগঠনও সংস্কারবাদী (reformist) কিংবা কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে; মানুষ নিজেই ক্ষমতা বা অর্থের লোভে নীতিভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে। দেখা যায় এমন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার পর সাধারণত এসকল ব্যক্তি ‘নৈরাজ্যবাদী’ শব্দটাকে তার উদ্দেশ্য হাসিলের পথে একটা বাধা হিসেবে দেখে এবং তার পরিচয় থেকে শব্দটি সরিয়ে ফেলে। এই শব্দটি যদি কোন কারণে ‘সম্মানজনক’ হয়েও ওঠে তখন আমাদের নতুন কোন শব্দ খুঁজে বের করতে হবে, যা উদারবাদী বিদ্রোহের ধারণাকে সমানভাবে ধারণ করে। বর্তমানে, আপাতত ‘নৈরাজ্যবাদ’ শব্দটি বর্ণনামূলক কিন্তু অপব্যবহৃত শব্দ হিসেবে থাকতে পারে। 

সকল সংগঠনেই সংযুক্ত ব্যক্তিদের একটা প্রভাব থাকে এবং অঞ্চল বা দেশ ভেদে বিরোধী চিন্তাধারা ও উপদলেরও উদ্ভব ঘটতে পারে। কেউ কেউ বলে থাকে নৈরাজ্যবাদের বিভিন্ন রূপ রয়েছে। সিন্ডিকালবাদ, সমাজতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, শান্তিবাদ, এই সবগুলোই নৈরাজ্যবাদের বিভিন্ন ধরন হিসেবে উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু বিষয়টা আসলে এমন না। কেউ যদি বিরোধী উপদল তৈরি করতে চায়, তা ব্যক্তিগত কারণে হোক কিংবা মতাদর্শিক পরিবর্তনের কারণে—তখন তাকে ব্যানারের জন্য হলেও একটা পৃথক নাম ঠিক করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে নৈরাজ্যবাদের কোন পৃথক পৃথক রূপ নেই। নৈরাজ্যবাদী-সমাজতন্ত্রকে যেকোন সংজ্ঞায় (সাধারণত ক্রপোতকিনের আলোচনায়) দেখানো হয় সরকারব্যবস্থা বিহীন সমাজতন্ত্র হিসেবে, নৈরাজ্যবাদের কোন আলাদা রূপ হিসেবে নয়। একটি বিকল্প চিন্তা, যাকে নৈরাজ্যবাদী-সংহতিবাদ বলা হয়ে থাকে (যা একসময় স্প্যানিশ নৈরাজ্যবাদীদের পছন্দ ছিল), দেখা যায় সেটিও তার চর্চার জায়গায় একই রকম। কর্তৃত্ববিহীন সমাজ তৈরি করতে গেলে ভবিষ্যতের পুঙ্খানুপুঙ্খ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা সম্ভব হয় না। সমাজতন্ত্র বা সংহতিবাদ—উভয় ক্ষেত্রেই যেখানে শাসনকার্য পরিচালিত হয় তৃণমূল পর্যায় থেকে—একে অপরের থেকে বা সিন্ডিকালবাদ থেকে আলাদা কিছু না। সবগুলোই একই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্থায়ী সংগ্রাম। 

সমাজতন্ত্র, নৈরাজ্যবাদীদের চিন্তায়, হলো এমন একটি সমাজ যার ভিত্তি জনসাধারণ। সংহতিবাদ (Collectivism) হলো সমাজকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ইউনিটে বিভক্ত করা। যদি সমাজ খুবই ক্ষুদ্রাকার না হয় (যেমন, গ্রামাঞ্চল) তাহলে সেটিকে বিভিন্ন ইউনিটে (Collectives) ভাগ করতে হবে, যাতে প্রত্যেকেই (কেবল তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নয়) শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে। তা না হলে এই কাঠামোটি হয়ে উঠবে স্রেফ এক প্রকারের শিল্পায়িত গণতন্ত্র (industrial democracy)। মুক্ত সমাজতন্ত্র যদি চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে থাকে, সিন্ডিকালবাদ হচ্ছে সংগ্রাম চালিয়ে নেওয়ার উপায় বা মাধ্যম। এটি হলো শ্রমিকদের ইউনিয়নের মাধ্যমে শিল্পায়িত ব্যবস্থাকে মুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজে রূপদানের প্রচেষ্টা। 

রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র মুক্ত সমাজতন্ত্রের বিকল্প নয়, বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র হলো পুঁজিপতি শ্রেণির জন্য রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক দলের একটি বিকল্প। সমাজতন্ত্র মানেই নৈরাজ্যবাদ নয়, যদি তা রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র না-ও হয়ে থাকে। সমাজতন্ত্রের প্রকৃত কর্তৃত্ববাদী কাঠামোকে (যেখানে পূর্ণ শ্রেণিবিভক্ত ক্ষমতা চর্চা ছাড়াই রাষ্ট্র সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, কিংবা যখন সরকারব্যবস্থা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে) কোনভাবেই নৈরাজ্যবাদ বলা যাবে না। সিন্ডিকালবাদ মানেই তা বৈপ্লবিক না, আবার বৈপ্লবিক সিন্ডিকালবাদ (যেখানে কারখানাগুলোতে সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে শ্রমিকরা কর্মস্থলের দখল নিয়ে নেয়) মানেই তা উদারবাদী নয়, যেহেতু তা রাজনৈতিক কর্তৃত্বের চর্চাকারী রাজনৈতিক দলের সাথে মিলে কাজ করতেও পারে। এই কারণেই আমরা বেশ ভারি একটা শব্দ ব্যবহার করি: নৈরাজ্য-সিন্ডিকালবাদ (anarcho-syndicalism)। যেখানে শ্রমিক উৎপাদনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে, সমাজ হবে স্বশাসিত ও তৃণমূল পর্যায় থেকে নিয়ন্ত্রিত, থাকবে না কোন কর্তৃত্বকামী সরকারব্যবস্থা। 

শিল্পী: গিওর্গে ভারতুসু

অহিংসা

শান্তিবাদ কি নৈরাজ্যবাদের একটি ধারা? যদিও অপ্রকৃত বা ভুয়া নৈরাজ্যবাদের মধ্যে শান্তিবাদ অনেকখানি জায়গা দখল করে রেখেছে, শান্তিবাদের সংগ্রামী উদারনীতি ও নৈরাজ্যবাদের যেকোন ইতিবাচক কার্যক্রমকে অস্বীকার করার প্রবণতা একে (যা চূড়ান্ত অহিংসার কথা বলে, কেবল সামরিকতা-বিরোধিতার কথা না) করে তোলে কর্তৃত্বপরায়ণ। চরম অহিংসার পক্ষে থাকা গোষ্ঠী সবসময় একজন অভিজাতকে মেনে চলে। গান্ধীর সত্যাগ্রহ এর একটি উদাহরণ উদাহরণ, যে সবাইকে এক প্রকারের বল প্রয়োগের মাধ্যমে কিংবা নৈতিকতার দোহাই তুলে সবাইকে তার নীতি মেনে চলার জন্য চাপে রাখতো। প্রথাগত শান্তিবাদী আন্দোলনগুলোর সাধারণ ইতিহাস হলো, তারা যেকোন বৈপ্লবিক উত্থানকে নিস্তেজ করার চেষ্টা করতো এবং দেখা যেতো তারা হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান করছে নয়তো তাদের সমর্থিত সরকারের আগ্রাসী আচরণকে ক্ষমা করে দিচ্ছে।  

ভারত ও ইজরায়েল দুটো দেশের অভ্যুদয়ের পেছনেই একটা সময়ে শান্তিবাদী ভাবাদর্শ বিদ্যমান ছিল। পারমাণবিক বোমা উদ্ভাবন ও নির্মাণের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল অহিংস শান্তিবাদীরা এবং জাতিপুঞ্জ (League of Nations) গঠনে অতি উৎসাহী ব্যক্তিরা। কোয়েকাররা ছিল শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী কিন্তু ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তারা ছিল যথেষ্ট অত্যাচারী। আর ঔপনিবেশিকদের কুখ্যাতি সম্পর্কে তো সবাই জানেই। সাম্প্রতিক কালে যারা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময়কার নৈরাজবাদী কার্যক্রমকে প্রত্যাখ্যান করেছিল (কারণ তারা “অহিংস নৈরাজ্যবাদী”), তাদের অনেককেই অন্যান্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোতে সংঘটিত আরো ভয়াবহ সহিংসতায় সমর্থন দিতে দেখা গেছে। 

আবার এমন নৈরাজ্যবাদীও রয়েছে যারা মনে করে, শান্তিবাদের সাথে নৈরাজ্যবাদ অসংগতিপূর্ণ নয়; কিন্তু বর্তমানে এটাও বলা হয়ে থাকে যে, এই শান্তিবাদী পদ্ধতিসমূহ কেবল একটি কৌশলগত দিক, তা কোন মৌলিক নীতি নয়। এমন চিন্তাকে আবার ‘টলস্টীয় নৈরাজ্যবাদের’ (যা টলস্টীয় কিংবা নৈরাজ্যবাদী কোনটিই নয়) সাথে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। টলস্টয় মনে করতেন নৈরাজ্যবাদীরা সব বিষয়েই ঠিক কিন্তু তারা মনে করে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন। তাঁর কাছে সামাজিক পরিবর্তনের অর্থ ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অর্থাৎ ব্যক্তি নিজেকে পালটানোর মাধ্যমে সমাজকে পালটাবে (যা শেষমেশ গিয়ে আধ্যাত্মিকতায় ঠেকে)। তিনি কোন অহিংস বিপ্লবের কথা বলেননি, বরং তিনি এমন একটি বিরোধিতা বিহীন নীতির (nonresistance) কথা বলতেন যা ছিল খৃষ্টীয় শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু তিনি নিজেও সবসময় সেই জীবনযাপন করতেন না। 

এখানেই বলতেই হয় যে, এমন চিন্তাধারা অ্যাংলো-আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গির শান্তিবাদের প্রতিই ইঙ্গিত করে। গ্রেট ব্রিটেনে তা আরো ভয়াবহ, যেখানে বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্ব পালনে অস্বীকারের প্রসঙ্গের কারণে শান্তিবাদ ও রাষ্ট্রের মধ্যে তর্কের সূত্রপাত ঘটে। যেসকল দেশে সামরিক দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি আইনত নিষিদ্ধ, সেসকল জায়গায় শান্তিবাদের অর্থ চূড়ান্ত অহিংসা না-ও হতে পারে। 

নৈরাজ্যবাদীর আশু লক্ষ্য

যে ব্যক্তি সংস্কার ঘটায় তাকে ‘সংস্কারপন্থী’ (reformist) বলা হয় না (সাধারণত তারা তা করেও না, তাদের কাজ রাজনৈতিক কৌশলের দিকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া); সে এমন একজন ব্যক্তি যে সিস্টেমের বিভিন্ন অংশের উন্নয়নসাধন ছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পায় না। কিছু আইন বাতিল করা ও অবিলম্বে কিছু আইন সংস্কারের জন্য আন্দোলন পরিচালনা করা অপরিহার্য; কিন্তু এই সংস্কারের জন্য পরিচালিত আন্দোলনকে ইতিবাচক মনে করা, কিংবা সংখ্যালঘিষ্ট গোষ্ঠী বা পুরো সমাজের সংস্কারের দাবি তোলা, বৈশিষ্ট্যগতভাবেই সংস্কারপন্থী। এই সংস্কারপন্থা থেকে পরিব্যাপ্ত ভাবাদর্শ ও কার্যক্রমকেই আমরা বর্তমানের বামপন্থা বলে থাকি। তা উচ্চাভিলাষী, ও আপাতদৃষ্টিতে সংখ্যালঘিষ্টের অধিকার রক্ষায় নিযুক্ত আমলাদের জন্য নতুন শিল্পের (ইন্ডাস্ট্রি) সূচনা করে, যা স্বয়ং সংখ্যালঘুদের কাছ থেকেই তাদের লড়াই করার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। নারী মুক্তির প্রসঙ্গেও এমন প্রবণতা লক্ষ করা যায়, যা বামপন্থীদের দ্বারা প্রান্তিকীকরণের শিকার হওয়ার কারণে একটি সংখ্যালঘিষ্টের সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়। 

অনেক সময় অপরাধ ঠেকানোর জন্য প্রণীত আইন মূল অপরাধের থেকে বেশি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। সামাজিকভাবে কল্যাণকর হতে পারে ভেবে কখনোই আইন প্রণয়ন করা উচিত নয়, যেহেতু নিশ্চিতভাবেই সে আইনের ভুল ব্যাখ্যা করা হবে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা বিচারকদের ব্যক্তিগত অভিমত চাপিয়ে দেওয়ার একটা মাধ্যম হয়ে দাঁড়াবে। দরিদ্র শ্রেণির মানুষকে সামান্য আর্থিক মূল্যের চুরির দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার পুরনো ব্রিটিশ প্রথা পার্লামেন্ট কিংবা বিচারকদের আদেশের মাধ্যমে বাতিল হয়নি, বরং তা হয়েছিল যখন জুরি সদস্যরা বলা শুরু করলো যে চুরি হওয়া পণ্যের মূল্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। 

নৈরাজ্যবাদীরা একক কিংবা দলবদ্ধভাবে সংস্কারের জন্য দাবি তুলতে পারে, কিন্তু নৈরাজ্যবাদী হিসেবে তারা চায় মানুষের চিন্তায় ও আচরণে পরিবর্তন আনতে, আইন পাশ করতে নয়। যখন মানুষের চিন্তাভাবনা পালটাবে, আইন আপনাআপনি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে এবং একটা পর্যায়ে আইন প্রয়োগকারীরাও সেই আইন পরিচালনা করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত মদ উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা এবং ব্রিটেনে জনকর (Poll Tax) এর দুটি উদাহরণ। এমতাবস্থায় আইন পরিবর্তন করে জনমতের সাথে খাপ খাওয়াতে হয়।

ব্রিটেনের কালোজাদুবিদ্যা সংক্রান্ত আইন (Witchcraft Act) বিলোপ করা হয় ১৯৫১ সালে এবং এর ঠিক আগ পর্যন্ত এর প্রয়োগ দেখা যেতো। হাসি তামাশার বিষয় হয়ে ওঠার ভয়ে সরকারি অভিযোক্তারা (Public Prosecutor) এই আইনের অল্প কিছু অনুচ্ছেদেরই ব্যবহার করতো। রাজনৈতিক কারণে এই আইন বিলুপ্ত ঘোষিত হয়, কিন্তু একই রকম হাস্যকর ধর্মনিন্দা আইন (Blasphemy Act) রয়ে যায় এবং মুসলিমদের বিক্ষোভের কারণেই কেবল তা পার্লামেন্টের দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। মুসলিমদের বিক্ষোভের বিষয় ছিল, যদি খৃষ্টবাদকে অপমানের জন্য কাউকে দণ্ডিত করা হয়, ইসলাম ধর্মের অবমাননার জন্য কেন কাউকে দণ্ডিত করা হবে না? 

‘১৩৮১’ নামে পরিচিত একটি ব্রিটিশ আইন স্কোয়াটারদের (squatter, যারা বেআইনিভাবে কোন অব্যবহৃত স্থাপনা বা জমিতে বসবাস করে) বোঝাতে সমর্থ হয়েছিল যে, যেকোন পরিত্যক্ত বা উপেক্ষিত স্থাপনায় বসবাস শুরু করা কোন অপরাধ নয়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ব্রিটেনে এ ধরনের কোন আইনই ছিল না। এমন একটি আইন বিদ্যমান থাকার উড়োকথাই মানুষের জন্য যথেষ্ট ছিল। 

যেকোন প্রকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ জারি রাখতে হয়। যখনই সরকারের সুযোগ-সুবিধা কোন কারণে হুমকির মুখে পড়ে, তারা গণতন্ত্র আর দয়াশীলতার ভান ধরা বন্ধ করে দেয়; যেই ভণ্ডামি অধিকাংশ রাজনীতিবিদেরই পছন্দের কাজ। তখন নৈরাজ্যবাদীরা বাধ্য হয় ‘বিশৃঙ্খলার প্রতিনিধি’ (agents of disorder) হয় উঠতে। যদিও নৈরাজ্যবাদ এই বিশৃঙ্খলার চেয়ে অনেক বেশি কিছু এবং বিশৃঙ্খলার প্রতিনিধি মাত্রই নৈরাজ্যবাদী নয়। 

একজন মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী হয়তো বলবে, “নৈরাজ্যবাদীরা বিশৃঙ্খলা ঘটাতে সমর্থ হলেও তারা ক্ষমতা দখল করতে পারে না। ফলে তারা তাদের সৃষ্ট পরিস্থিতির সুযোগ নিতে ব্যর্থ হয় এবং বুর্জোয়া শ্রেণি তার ক্ষমতা সংগঠিত করে ফ্যাসিবাদের সূচনা ঘটায়”।

রক্ষণশীল রাজনীতির সমর্থক হয়তো বলবে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীরাই নৈরাজ্যবাদী কারণ “তারা তারা ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেওয়ার উদ্দেশ্যে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে”। দুটোই খুব উদ্ভট চিন্তা। নৈরাজ্যবাদীরা ‘ক্ষমতা দখলে’ ততোটাই সক্ষম, যতোটা একজন টিটোটালার (teetotaler; যারা মদ ও অন্যান্য সকল ধরনের চিত্তপ্রভাবকারী দ্রব্য থেকে দূরে থাকে) মাতাল হতে সমর্থ। কিন্তু তাতে আর সে নৈরাজ্যবাদী থাকবে না। ক্ষমতায় থাকা নৈরাজ্যবাদীরা কারো চেয়ে বেশি ভালো বা বেশি খারাপ হবে এমন না, বরং তারা সমাজতন্ত্রী বা ফ্যাসিবাদীদের মতো খারাপও হতে পারে। ক্ষমতার প্রভাবে সবচেয়ে নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিও কলুষিত হতে পারে। নৈরাজ্যবাদীদের কাজ “ক্ষমতা দখল” করা নয় (যারা এই পরিভাষা ব্যবহার করে তারা নিজেদের জন্য ক্ষমতা দখল করতে অধিক আগহী), বরং ক্ষমতার সকল ভিত্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া। সবার হাতে ক্ষমতা থাকার অর্থ বিশেষ কারো হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত না হয়ে পড়া। 

কেউ যদি কোন প্রকারে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তখন রাষ্ট্র আগের চেয়ে বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে এবং সবকিছু ধ্বংস করতে উদ্যত হয়, নয়তো নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। এ কারণে নৈরাজ্যবাদীরা বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য সংগঠন তৈরি করে। নৈরাজ্যবাদ প্রকৃত অর্থেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মতবাদ হওয়ার কারণে অনেকেই মনে করে এমন সংগঠন তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া হওয়া উচিত ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ও ‘স্বেচ্ছাকৃত’। অর্থাৎ, যতোক্ষণ না পুরো সমাজ নিজেদের সংগঠন তৈরি করছে ততোক্ষণ পর্যন্ত (প্রচারণামূলক সংগঠন ব্যতীত) কোন সংগঠন থাকতে পারে না। এটা একদিকে যেমন আরামকেদারায় বসে নৈরাজ্যবাদ চর্চার মতো, অন্যদিকে তা এমন একটি প্রসঙ্গও উত্থাপন করে যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না—যতোক্ষণ না নিজেদের সংগঠনের ওপর সমাজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, ততোদিন এসকল সংগঠনের পক্ষে মানবজীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সম্ভব না, উচিতও না। 

বিভিন্ন ঘটনাসূত্রে দেখা গেছে অবদমনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন হয় ঐক্যের, থাকতে হয় ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি। এমনকি যখন শ্রমিকদের কাউন্সিল গঠন করা হয়, সেখানেও প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলাদলি দেখা দেয়, যারা কাউন্সিলের পরিসীমার বাইরে নিজেদের সংগঠিত করে সেটিকে কব্জা করতে চায় এবং পরিশেষে তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। এ কারণেই এমন একটি সংগঠিত আন্দোলন প্রয়োজন যা এ ধরনের কর্তৃত্বপরায়ণতাকে রুখতে পারবে। কোন কোন ক্ষেত্রে সংগঠনের ভেতর থেকেই নেতৃত্বের ওপর আক্রমণ চালানোর মতো অনুশাসনকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া অনুশাসনের মতোই তীব্র হতে হয়। এ ধরনের আক্রমণ বা সন্ত্রাসবাদের সাথে জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসবাদের কোন মিল নেই; জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসবাদ রাষ্ট্র প্রণোদিত সন্ত্রাসবাদেরই অপর নাম এবং একে অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের চেয়ে প্রায়ই কম সমালোচনার শিকার হতে হয়। নৈরাজ্যবাদী সন্ত্রাসবাদ মূলত ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতালোভী অত্যাচারী ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়। জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাস হলো জনগণের বিরুদ্ধে চালানো যুদ্ধের মতো। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার। 

শ্রমিকের আত্মরক্ষা

বিপ্লবের সময়ে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীরা লাল ফৌজ গঠনের ওপর নির্ভর করে। এক পার্টির অধীনস্ত এই “লাল” ফৌজ হয়ে ওঠে একটি লাল পতাকার তলে থাকা পুরনো সামরিক বাহিনী। আমরা বারেবারেই দেখেছি, কীভাবে এরূপ ফৌজ নতুন পতাকাতলে আসা জাতীয়তাবাদী সামরিক বাহিনীর মতো সেটিও অবদমনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার ওঠে—অনেক ক্ষেত্রে তা ক্ষমতা গ্রহণের আগেই হয়ে থাকে। 

শ্রমিকের দ্বারা গঠিত সেনাদলকে রহিত করার জন্য একটি সামরিক বাহিনী তৈরি করা হলে তা বিপ্লবকে নস্যাৎ করে ফেলে (স্পেন ১৯৩৬)। চে গেভারা লাল ফৌজ সম্পর্কিত কিছু নতুন রোমান্টিক ধারণা প্রচার করতে চেয়েছিলেন, যেখানে তিনি এই ফৌজকে কল্পনা করেছিলেন কৃষকদের সেনাবাহিনীর অগ্রদল (advance guard) হিসেবে। গেভারার এই চিন্তায় মাখনোভীয় (ইউক্রেন ১৯১৭) ও জাপাতিস্তা/ম্যাগোনিস্তা (মেক্সিকান-নৈরাজ্যবাদী) স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে সংযুক্ত হয়েছিল পার্টি বুদ্ধিজীবীদের নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাধারা। এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে, প্রারম্ভিক উদ্যম বিজয়ের দিকে ধাবিত করলেও, নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্ব একটা পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়; কিন্তু তা যদি ব্যর্থ হয়, নেতারা তখন পালানোর পথ বেছে নেয়। 

নৈরাজ্য-সিন্ডিকালবাদীদের কাছে আত্মরক্ষার অর্থ হলো, শ্রমিকেরা প্রত্যক্ষ শত্রুর বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করার জন্য অস্ত্র ধারণ করবে; এবং এখানে শ্রমিকের দ্বারা গঠিত সেনাবাহিনীর গণতান্ত্রিক ধারণা বিদ্যমান। যদিও কৌশলগত কারণে এখানে বিভিন্ন ধরনের নেতৃত্ব, আদেশ প্রদান ও দায়িত্ব অর্পণের মতো বিষয়ের উদ্ভব ঘটতে পারে, কিন্তু এই বাহিনীতে এমন কোন অফিসার থাকবে না যার দায়িত্ব কেবল আদেশ দেওয়া, কিংবা এমন কোন শ্রেণিবিভাজন থাকবে না যেখানে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ক্রমানুসারে আদেশ প্রদানের ‘চেইন অফ কমান্ড’ বিদ্যমান। 

সশস্ত্র জনগণের ধারণা অনেক তথাকথিত সামরিক ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের কাছেই উপহাসের বিষয়, কিন্তু এ উপহাস কেবল শ্রমিকেরা যখন নিজেদের স্বার্থে বাহিনী গঠন করে থাকে তখনই দেখা যায়। আবার ক্ষুদ্রাকার কোন রাষ্ট্রে যদি এমনটা ঘটে, তখন তারা সেটিকে নাগরিকদের বাহিনী (অর্থাৎ একটি অপেশাদার বাহিনী যারা তাদের অস্ত্র রেখে পুনরায় কাজে ফেরত যায় এবং প্রয়োজন মোতাবেক আবার অস্ত্র তুলে নেয়) বলার চেষ্টা করে থাকে। এ ধরনের ‘নাগরিকদের বাহিনী’ (ইজরাইল বা দক্ষিণ আফ্রিকায় যেমনটা দেখা যায়) সাধারণত ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া জাতীয়তাবাদী ও আগ্রাসী নীতিরই বাস্তবায়ন করে। এ জাতীয় সেনাবাহিনী যদি আন্তর্জাতিক শ্রেণি সংগ্রামে কোন ভূমিকা না রাখে, তখন আবার এই “বিশেষজ্ঞেরা” সেনাদলটির গণতান্ত্রিক কার্যপ্রক্রিয়া ও সেটির কার্যকারিতার প্রশংসা করতে কুন্ঠিত হয় না। 

বিপ্লব কীভাবে হবে?

আমরা জানি না। বৈপ্লবিক অবস্থা আসন্ন হলে—যেমনটা ১৯৩৬ ও ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে কারখানা দখল করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে হয়েছিল, ১৯৩৬ সালে স্পেনে ফ্যাসিবাদের উত্থানের সময়ে হয়েছিল, ১৯১৭ সালে রুশ সেনাবাহিনী ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে হয়েছিল, কিংবা ইতিহাসে আরও অসংখ্যবার অসংখ্য জায়গায় ঘটেছে—আমরা হয় সেটার জন্য প্রস্তুত থাকি, নয়তো থাকি না (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাকি না)। প্রায়শই শ্রমিকেরা আংশিকভাবে প্রস্তুত থাকে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের আংশিক ক্ষতি করার মাধ্যমে সেটিকে আরও হিংস্র ও আক্রমণাত্মক করে তোলে। কেবল একজন ব্যক্তির মাধ্যমেও বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু কেবল তখনই তা ঘটে, যদি সেই সমাজে ইতোমধ্যেই পুরনো শেকল ভেঙে ফেলে মুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা গড়ে ওঠে। এমতাবস্থায় সামগ্রিক পরিস্থিতি একটি সামাজিক বিপ্লবের রূপ নিতে পারে। বর্তমানে আমাদের যে সমস্যাটির মুখোমুখি হতে হয় তা হলো, জগতের অর্ধেক মানুষই পরিবর্তন ঘটানোর জন্য মুখিয়ে আছে, কিন্তু অবদমন প্রতিরোধের জন্য তাদের কোন সামরিক শক্তি নেই কিংবা বিপ্লব টিকিয়ে রাখার মতো সক্ষমতাও তাদের নেই। বাকি অর্ধেকের শক্তি ও সামর্থ দুটোই আছে, কিন্তু পরিবর্তন ঘটানর কোন ইচ্ছা তাদের নেই; তারা হয় পুঁজিবাদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে নয়তো প্ররোচণার কাছে মাথানত করেছে। 

নতুন সমাজ নির্মাণ

কর্তৃত্ববাদী সমাজ বলতে কী বোঝায়?

শোষণ—স্বার্থের জন্য নিয়ন্ত্রণ—অবদমন। নিপীড়নের মাধ্যমগুলো গঠিত হয় রাষ্ট্রের নানা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে—

সরকারব্যবস্থার হাতিয়ার: আইন, আদালত, রাজতন্ত্র, জনপ্রশাসন, সামরিক বাহিনী, পুলিশবাহিনী ইত্যাদি।

প্ররোচনার হাতিয়ার: শিক্ষাব্যবস্থা, টিভি, রেডিও, পত্রিকা ও অন্যান্য গণমাধ্যম, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি আপাত দৃষ্টিতে বিরোধী শক্তি মনে হলেও যেগুলো প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান অবস্থা মেনে নেওয়ার কথাই বলে (সংসদের বিরোধী দল এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ)। এছাড়া মূলধারার বাইরে অবস্থিত বিভিন্ন বিকল্প ভাবাদর্শও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে; উদাহরণস্বরূপ, বিপ্লবকে কেবল একটি জীবনযাপন পদ্ধতি কিংবা সঙ্গীতের ধরন হিসেবে তুলে ধরা, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের একাডেমিক শিক্ষা ইত্যাদি। 

শোষণের হাতিয়ার: মুদ্রাব্যবস্থা, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্যক্তিগত, সামষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় চাকরিদাতা, ভূমির মালিকানা। পুঁজিবাদের অধীনের এগুলো থেকে কোন মুক্তি নেই। 

সংস্কারের দাবি করা অধিকাংশ রাজনৈতিক কর্মীই এই স্বাধীনতা বিরোধী ব্যবস্থার কোন না কোন অংশের শোষণ থেকে মুক্তির দাবি তোলেন। রিপাব্লিকানরা রাজতন্ত্র থেকে মুক্তি চান, সেক্যুলাররা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে মুক্তি চান, সমাজতন্ত্রীরা চান শোষণের সকল হাতিয়ার থেকে মুক্তি পেতে, শান্তিকামীরা চান সামরিক বাহিনীর বিলোপ। আর নৈরাজ্যবাদ এই সবগুলোর বিলুপ্তির দাবি তোলে। একজন প্রকৃত নৈরাজ্যবাদীর বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি মনে করেন সকল প্রকারে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকেই মানুষকে মুক্ত করা দরকার, তিনি মনে করেন তা করা সম্ভব, যতো দ্রুত সম্ভব ততোই মঙ্গল এবং তা করার জন্য তিনি প্রতিনিয়ত কাজ করে যান। 

অনেকেই রয়েছে, বিশেষত বামপন্থীদের মধ্যে, যারা মনে করেন এমন একটা অবস্থা আকাঙ্ক্ষিত হলেও তা অসম্ভব। আবার ডানপন্থীদের অনেকে মনে করেন এমনটা সম্ভব, কিন্তু তারা সেটা চান না। আবার অনেকে নৈরাজ্যবাদী আদর্শের দাবিগুলোকে আকাঙ্ক্ষিত ও সম্ভব মনে করলেও তা বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করতে অনাগ্রহী। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী মানুষদের দিকে তাকালে হয়তো আমরা নৈরাজ্যের আদর্শের সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করা মানূষদেরও খুঁজে পেতে পারি। 

পুলিশবাহিনী হলো রাষ্ট্রের ভিত্তিস্বরূপ (যদিও অনেক ক্ষেতে সরকারকে এর বদলে কিংবা এর পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর ব্যবহারও করতে হয়; অনেক দেশে সরকারের বদলে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এতো বেশি সময় ধরে অব্যাহত যে সামরিক নেতারাই সকল নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করে ফেলছে)। 

কেবল নৈরাজ্যবাদই পুলিশবাহিনীর বিলোপ সাধনে বিশ্বাস করে এবং এটি নৈরাজ্যবাদের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে আমরা বর্তমানে যে ধরনের পুলিশবাহিনী দেখে থাকি সেগুলো যথেষ্ট সাম্প্রতিককালে উদ্ভূত এবং যে সময়টাতে পুলিশবাহিনী গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তখন এর বিরুদ্ধে যে আপত্তিগুলো তোলা হয়েছিল তার প্রায় সবগুলোকেই আমরা সত্য হয়ে উঠতে দেখি। আপত্তিগুলোর মধ্যে একটি ছিল, পুলিশবাহিনী স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে কাজ করতে সমর্থ, যা একটা পর্যায়ে পুলিশী রাষ্ট্রের সূচনা ঘটাবে। পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে সংসদীয় বিতর্ক স্কুল কলেজের বিতর্ক প্রতিযোগিতার মতো অর্থহীন হয়ে পড়ে (এবং হয়তো তার চেয়েও বেশি একঘেয়ে হয়ে যায়)।

হেলফান্ড পারভুসের দেওয়া জার্মান টাকার কারণে লেনিন রাশিয়ায় ফিরে এসে লেটিশ (লাতভিয়ার অধিবাসী) ভাড়াটে সৈনিকদের পুলিশ হিসেবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। লেনিনই ছিলেন একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি সে সময়ে এমনটা করতে সমর্থ ছিলেন এবং তা বলশেভিকদের সাফল্য নিশ্চিত করেছিল। নাৎসিরা একটা সময়ে খুনিদের গ্যাং তৈরি করলে রিপাব্লিকান পুলিশবাহিনী তা নীরবে সহ্য করে যায়; কিন্তু কেবল যখন আইনি প্রক্রিয়ায় নাৎসিরা পুলিশবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, তখনই তাদের বিজয় নিশ্চিত হয়। 

রাষ্ট্র ব্যতীত কি জীবন নির্বাহ সম্ভব? 

সাধারণভাবে এটা প্রায়ই মেনে নেওয়া হয় যে, রাষ্ট্রের কিছু উপাদান ছাড়াও জীবনযাপন করা সম্ভব। কিন্তু সকল উপাদান বিলুপ্ত হয়ে গেলেও কি তা সম্ভব? রাষ্ট্রের কিছু উপাদান স্পষ্টতই অপ্রয়োজনীয়, কিছু বিষয় স্রেফ আলঙ্করিক, কিছু বিষয়ের উদ্দেশ্য আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়, কিছু জিনিস শ্রেণি স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত, তবে কিছু বিষয় হয়তো কার্যকরী এবং সমাজের অনিবার্য কিছু ক্রিয়া বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয়। 

একটি দিয়ে অপরটির কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। রাজতন্ত্রের যদি কোন সামরিক বাহিনী না থাকে, তাহলে সেটা যেমন বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে কাউকে রক্ষা করতে পারবে না, তেমনই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না থাকলে পুলিশও কাউকে স্বর্গে যাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। মানুষের সাধারণ বোধবুদ্ধির মধ্য দিয়ে যদি কোন আইন বানানো হয়, সেটা নিঃসন্দেহে বর্তমানে আইন নামের যে জগাখিচুড়ি বিদ্যমান, তার থেকে বহুগুণে ভালো হবে। বিদ্যমান আইনের ধারক বাহক হচ্ছে আইনজীবী ও রাজনীতিবিদেরা, যারা একে অপরের চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত। 

এটা সত্য যে, সরকার চাইলে প্রয়োজনীয় সামাজিক ক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে এবং কখনো কখনো তা করেও থাকে; রাষ্ট্রের অন্যান্য উপাদানগুলোও তা করে থাকে, সে উপাদান যতোই নিপীড়নমূলক হোক না কেন। রেলব্যবস্থা সবসময় রাষ্ট্রায়ত্ত ছিল না, বরং বিভিন্ন পুঁজিপতির মালিকানাধীন ছিল এবং একইভাবে ভবিষ্যতে তা শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণাধীনও হয়ে উঠতে পারে। যদি বলা হয়, যেহেতু কয়লা খনিগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত বিধায় রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় এবং রাষ্ট্র না থাকলে আমাদের কয়লা থাকবে না, তাহলে তা বোকামি ছাড়া কিছুই হবে না। সামরিক বাহিনীকেও মাঝেমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ সহযোগিতা প্রদানের মতো সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব অর্পণ করা হয়; মাঝেমধ্যে শ্রম-সংহতি বিরোধী শক্তি হিসেবেও (শ্রমিকদের হরতাল বা অবরোধের সময়ে) তাদের ব্যবহার করা হয়ে থাকে; একই সাথে পুলিশবাহিনী হিসেবেও তাদের ব্যবহার করা হয়। এর কারণ রাষ্ট্র এমন একটা সমাজ ভেঙে দিতে চায় না, যা তাকে সমর্থন করে। 

এমনকি পুলিশও মাঝেমধ্যে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সম্পাদন করে থাকে—কারও পোষা কুকুর হারিয়ে গেলে তাকে থানায় যেতে হতে পারে কারণ হারানো পোষা কুকুরকে সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুলিশ নিজে থেকেই এই দায়িত্বটা নিয়েছে। তার মানে এই না যে, পুলিশ বা থানা না থাকলে আমরা কোনদিনই আমাদের হারিয়ে যাওয়া পোষা কুকুর খুঁজে পেতাম না; বা এর অর্থ এটাও না যে, মানুষ মাঝেমধ্যে কুকুর হারিয়ে ফেলে ও থানায় সেটিকে খুঁজে পাওয়া যায় বলে পুলিশের নৃশংসতা (বিশেষত সামাজিক অশান্তির সময়ে) আমাদের আমাদের প্রতিনিয়ত সহ্য করে যেতে হবে। ইনস্যুরেন্সের জন্য সকল গাড়ির মালিকই তাদের হারানো বা চুরি হয়ে যাওয়া গাড়ির কথা পুলিশকে জানায়, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এই কাজটা পুলিশ ছাড়া সম্ভব না। 

পুলিশ ছাড়া কীভাবে প্রতারণা সনাক্ত করা যায়, তা যদি ইনস্যুরেন্স কোম্পানি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে কীভাবে পুলিশ ছাড়া সমাজ নিরাপদ রাখা যায়, তাও মানুষ খুঁজে বের করতে সমর্থ। দুঃখজনকভাবে পুলিশবাহিনী থাকার কারণেই সমাজের মানুষ ভাবতে পারে না কীভাবে তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। মানুষ সামাজিক সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সকল চিন্তাই হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকটা বাচ্চাকে রাস্তায় দৌঁড়াতে দেখলেই তারা এখন ভয় পেয়ে যায়, বাচ্চাগুলোর বয়স যা-ই হোক না কেন। তাদের একমাত্র প্রতিক্রিয়া হলো পুলিশের কাছে ছুটে যাওয়া এবং পুলিশও বিষয়টি সামাল দিতে পারে না। 

এককালে কুসংস্কার প্রচলিত ছিল যে, চার্চ যদি কোন দেশকে ত্যাজ্য ঘোষণা করে, তাহলে সে দেশের ওপর দুর্যোগ নেমে আসবে। চার্চের দ্বারা ত্যাজ্য হওয়া দেশের কোন মানুষের পক্ষেই আর সাধারণভাবে তার জীবনযাপন করে যাওয়া সম্ভব থাকে না। এই কুসংস্কার কোন অনর্থক বিষয় ছিল না, যতোক্ষণ মানুষ চার্চের কথায় বিশ্বাস করতো। কোন দেশ যদি বিশ্বাসীদের সংঘ থেকে বহিষ্কৃত হতো, সেখানকার চার্চ পরিচালিত হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে যেতো, ব্যবসা-বাণিজ্যে ভরসার অভাব দেখা দিতো (যাজকেরা ব্যবসায়ীদের শপথ গ্রহণ করাতো এবং এ ধরনের শপথ ব্যতীত অঙ্গীকার রক্ষার কোন দায় কারও ওপর বর্তাতো না), শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বসে পড়তো (সে সময়ে চার্চগুলোই স্কুল পরিচালনা করতো), শিশু জন্মালেও (এটা আবার চার্চ বন্ধ করতে পারেনি) তাকে খৃষ্টীয় বিধি মোতাবেক নামকরণ করা যেতো না এবং ফলে শিশুটিকে বিশ্বাসীদের সংঘে যোগ দিতে দেওয়া হতো না। চার্চের মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হতো বলে সকল দম্পতিই এক অর্থে ছিল অবিবাহিত এবং তাদের শিশুরা গণ্য হতো ‘জারজ সন্তান’ হিসেবে। অর্থাৎ নরক কাকে বলে সেটা আর বাস্তবে কাউকে বোঝানোর দরকার পড়তো না। আমাদের বোধশক্তি আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেলেও একটি কুসংস্কারের জায়গায় আরেকটি কুসংস্কার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চার্চের বিশ্বাস স্থানান্তরিত হয়েছে রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস আনার মধ্যে। আমরা যদি সরকারকে প্রত্যাখ্যান করি তাহলে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বসে যাবে (যেহেতু স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা বড় অংশই সরকারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় পরিচালিত হয়), অনেক হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাবে ও স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হবে, কেউই কাজে যোগ দিবে না কারণ সরকারই শ্রমবাজারের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, ইত্যাদি। এখানে বাস্তবতা হচ্ছে, চার্চ বা রাষ্ট্র কোনটাই নয়, বরং আমরা মানুষেরা নিজেরাই সবকিছু শ্রম দিয়ে তৈরি করেছি, এবং মানুষ শ্রম না দিলে তাদের পক্ষে কিছু করাই সম্ভব না। এমনকি অভিজাত, সুবিধাভোগী শ্রেণীকেও মানুষের শ্রম টিকিয়ে রেখেছে, চার্চ বা রাষ্ট্র নয়। 

টাকার মিথ

রাষ্ট্রের মিথের সাথে জন্ম নেয় দ্বিতীয় আরেকটি মিথ—টাকা তথা মুদ্রার মিথ। কোন মুদ্রার মুল্য নির্ভর করে রাষ্ট্রের ক্ষমতার ওপর। সরকারের পতন ঘটলে তাদের মুদ্রাও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে আসা কিছু জালিয়াত কনফেডারেট ডলার বিনিময়ের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মার্কিন গৃহযুদ্ধে দক্ষিণের রাজ্য তথা কনফেডারেসির পরাজয়ের কারণে সেই ডলার ছিল মূল্যহীন। পরবর্তীতে ইউরোপীয়দের কাছে রয়ে যাওয়া সেই ডলার তার প্রাথমিক মূল্য হারিয়ে ফেললেও শখের সংগ্রহযোগ্য জিনিস হয়ে ওঠে এবং প্রতিটা ডলারের দাম এক ডলারের চেয়েও বেশি হয়ে যায়। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইচ্ছা করেই অতিরিক্ত মাত্রায় কনফেডারেট ডলার ছাপাতে থাকে ও চুইংগামের মোড়ক হিসেবে সেগুলোর ব্যবহার শুরু করে যাতে করে প্রকৃত ডলারের দাম কমে না যায়। 

কাইজারের জার্মানির যখন পতন ঘটে, রাজকীয় মার্কও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। স্প্যানিশ রিপাব্লিক যখন পরাজিত হয়, তাদের ব্যাংকগুলো তখন তাদের মুদ্রা বাতিল ঘোষণা করে। এরকম অসংখ্য গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে। তারপরেও অনেক মানুষই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তাদের দেশের সম্পদ খুঁজে পাওয়া সম্ভব কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদিত কোন মুদ্রণশালায়। এই প্রিন্টিং কারখানাগুলো থেকে টাকা বের হওয়া মাত্রই যেন আমাদের সম্পদ তৈরি হয়, তা বন্ধ হয়ে গেলে আবার আমরা দরিদ্র হয়ে পড়ি। এর বিকল্প হিসেবে আবার ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড বের করা শুরু করে। এ সম্পর্কিত আরেকটি পুরনো ও বর্তমানে অপ্রচলিত মিথ হলো, ছাপানো মুদ্রাকে কোন এক রহস্যময় ভল্টে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রখা স্বর্ণের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে। যে স্বর্ণ আবার কয়েক হাজার মেইল দূরের কোন এক খনি থেকে তুলে আনা। তবে সরকারব্যবস্থাগুলো এই মিথকে অনেক আগেই অচল ঘোষণা করেছে (যদিও তারা এ সংক্রান্ত রিচুয়াল জারি রেখেছে)। সরকারের প্রচার করা নতুন মিথ হলো, যদি অধিক হারে মুদ্রা ছাপানো হয় তাহলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিবে এবং সে কারণেও আমরা দরিদ্র হয়ে যাবো। মুদ্রাস্ফীতির কারণে যাতে আমরা গরিব না হয়ে যাই সে জন্য আমাদের অর্থনৈতিক কঠোরতা বজায় রাখতে হবে, চাকরি ও ঘরবাড়ি হারাতে হবে; অর্থাৎ অন্যভাবে গরিব হতে হবে। 

যুদ্ধের সময়ে, খাদ্যদ্রব্য ও কাপড়ের রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হলে মুদ্রার স্থান দখল করে নেয় কুপন, যার মাধ্যমে পণ্যের যথাযথ বণ্টন নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হতো। মুদ্রাব্যবস্থা যতোই চলতে থাকে, পণ্যের কালোবাজার ততোটাই অনিবার্য হয়ে ওঠে; তবে রেশনিং প্রক্রিয়া আমাদের ধারণা দেয় মুদ্রা ব্যতীত রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র কেমন হতে পারে। যদি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কুপন ছাপানো হয় তাহলে পদ্ধতিটা অর্থহীন হয়ে পড়বে। মুদ্রাও রেশনিং ব্যবস্থার একটি রূপ, যেখানে কিছু মানুষ অন্যান্যদের চেয়ে বেশি পেয়ে থাকে। মজুরি বৃদ্ধির সংগ্রাম মূলত নিজের অংশ খানিকটা বৃদ্ধির চেষ্টামাত্র। তারাই ধনী যারা অন্য সবার আগে নিজের ভাগটুকু বুঝে নিতে পারে। কিন্তু মুদ্রা বা কুপন কোন ব্যবস্থাই সামগ্রিক সম্পদের আকারে কোন পার্থক্য তৈরি করতে পারে না, এগুলো মূলত বণ্টন প্রক্রিয়ার—সম কিংবা অসম—দুটি রূপ। রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাজে পণ্য সংগ্রহের জন্য মুদ্রা অপরিহার্য। এমনটা বলা হয়তো হাস্যকর মনে হতে পারে যে, মুদ্রা একটি মিথ—“হোক না সেটা মিথ, আমার তা আরও লাগবে”—কিন্তু তা মিথই বটে। 

অনেকেই মনে করে থাকে, যদি কোন ধনকুবের একটা ইয়ট না কিনতো, তাহলে সেই টাকা দিয়ে একটা বা কয়েকটা হাসপাতালের জন্য এক্স-রে মেশিন কেনা সম্ভব হতো। তারা এটা বুঝতে চায় না যে, যারা ইয়ট বানায় তারা এক্স-রে বানাতে পারে না। আবার অন্য অনেকে মনে করে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ব্যয় করা রাষ্ট্রীয় খরচ যারা কাজ করে তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে, বেকারত্বকে রাষ্ট্র একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যেখানে, বেকারত্বের দ্বারা জর্জরিত মানুষের শোচনীয় অবস্থাকে অন্যান্যদের জন্য কাজ করার একটি উদ্দীপনা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। একটি প্রতিযোগিতামূলক সমাজে একজন ব্যক্তি সেটাই পায় যা সে দখলে নিতে সমর্থ। 

করারোপের মিথ 

অনেকের মধ্যেই একটা উদ্ভট চিন্তা রয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় সাহায্যের অর্থ হলো, যারা কাজ করে তাদের কাছ থকে নিয়ে অকর্মণ্য মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা। একই রকম উদ্ভট ধারণা হলো, ধনী মানুষেরা কর্মসংস্থান তৈরি কিংবা দানশীলতার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করে থাকে। ব্রেন্ডান বেহানকে একবার একজন বলার চেষ্টা করেছিল, আয়ারল্যান্ডের অন্যতম ধনী গিনেস (Guinness) পরিবার ডাবলিনের দরিদ্র মানুষদের জন্য কতোকিছুই না করেছে। উত্তরে বেহান বলেন, “ডাবলিনের দরিদ্র মানুষ গিনেস পরিবারের জন্য যা করেছে, সে তুলনায় তা কিছুই না”। ‘যাদের অর্থ-সম্পদ আছে তারা দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করে থাকে’—কর ধার্য করার মাধ্যমে এমনই একটি মিথের পুনরুৎপাদন করা হয়। যাদের সম্পদ কম তারা তাদের টাকা গুনতে পারার আগেই করারোপের মাধ্যমে সেটা তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অন্যদিকে ধনীরা পেশাদার উপদেষ্টাদের সাহায্যে কর ফাঁকি দেওয়ার নানা ফন্দি আঁটে। অর্থের ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করা হয়। অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানো কিংবা ঋণের ব্যবস্থা করা, উভয়ই সম্ভব হয় যদি তা অর্থনৈতিক অভিজাতদের স্বার্থে কাজে লাগে। আবার এই অভিজাতেরা যদি অর্থনৈতিক শিথিলতা ডেকে আনতে চায়, তখন তারাই বাজার থেকে মুদ্রা তুলে নেয় এবং ঋণের বণ্টন নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়। অর্থনৈতিক মন্দাকে যেভাবে দুর্ভিক্ষ, খরা, বন্যা কিংবা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তা সেরকম নয়। 

অভিবাসনের প্রভাব

বৃহদাকার কোন চাকরিদাতা যদি তার মুনাফা বাড়াতে চায় কিংবা উৎপাদন খরচ কমাতে চায়, তার জন্য কয়েকটি বিকল্প রয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে সহজসাধ্য উপায় হলো মজুরি কমিয়ে দেওয়া। কিন্তু যদি শ্রমিকেরা সংঘবদ্ধ থাকে তাহলে তারা এমন পদক্ষেপ প্রতিহত করতে সমর্থ হয় এবং এর ফলে পুঁজিপতির হাতে আর দুটি বিকল্প থাকে। হয় তাকে তার কারখানা এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যেখানে শ্রমিকের খরচ তুলনামূলকভাবে কম, নয়তো কম খরচের শ্রমিককে তার কারখানায় নিয়ে আসতে হবে। প্রথম বিকল্পটিতে অনিবার্যভাবেই অনেকখানি পরিবেশ দূষণ ঘটবে (যদিও তাতে পুঁজিপতিদের কখনোই কিছু যায় আসেনি) এবং তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল কোন জায়গায়ও যেতে হতে পারে। ফলে সহজ ও স্বল্প ব্যয়ের উপায় হলো কম খরচের শ্রমিককে নিয়ে আসা। 

এভাবে অভিবাসনকে উসকে দেওয়ার মাধ্যমে, তার সকল অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পর, পুঁজিপতি একজন ডানপন্থী রাজনীতিবিদের রূপ ধারণ করে এবং অভিবাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে সে মূলত শ্রমিকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বকেই প্ররোচিত করে; এই দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে ওঠে ধর্মীয় কিংবা বর্ণগত বিভাজন যা কয়েক প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে জানপন্থী রাজনীতির প্রতি একটা ঝোঁক তৈরি হয়। শ্রমিকশ্রেণি যদি সারাক্ষণ ঘৃণা ও বিদ্বেষের মধ্যে অবস্থান করে এবং প্রতিনিয়তই নির্বাসিত হওয়ার ভয়ে থাকে, তাহলে সেটা পুঁজিপতির জন্যই লাভজনক হয়। অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়ার ফলে মালিক মজুরি সংক্রান্ত ব্যাপারেও পুঁজিপতির যথেষ্ট লাভ হয়। কেবল তখনই পুঁজিপতির ক্ষতি হয় যখন হিটলারের মতো ফ্যাসিবাদী শক্তি সামরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে পুঁজিপতিদের ইচ্ছার বদলে নিজের স্বার্থ হাসিলে অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠে। 

মজুরি প্রথা ও মুদ্রাব্যবস্থার বিলোপ

“সমাজতন্ত্র” শব্দটি এতো পরিব্যাপ্ত হয়েছে যে তা প্রায় সব ধরনের পুনর্গঠনমূলক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে, এমনকি বিপ্লব-বিরোধী কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হওয়া শুরু করেছে। এই শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে উদারনৈতিকতাবাদ থেকে স্বৈরাচার পর্যন্ত সবকিছুই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাস্তবে যেকোন সমাজতন্ত্রী তত্ত্বই মজুরি প্রথা ও মুদ্রাব্যবস্থার বিলুপ্তির কথা বলে। এর কারণ, প্রকৃত অর্থেই একটি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন হবে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন এবং এর মাধ্যমে তারা মজুরির দাসত্ব থেকে মুক্তির চেষ্টা চালাবে। মজুরি ও মুদ্রাব্যবস্থা হচ্ছে সেই দাসত্বের শেকলস্বরূপ যা ভাঙতে হবে। 

মজুরির কোন একটি পুনর্গঠিত ধরন কিংবা বিনিময়ের কোন একটি মাধ্যমে হতে পারে একটি মুক্ত সাম্যবাদী সমাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাঠামো; বিশেষত একটি বিপ্লব-পরবর্তী সমাজে, যেখানে মানুষ তখনও শ্রমের বিনিময়ে কিছু পেয়ে অভ্যস্ত। কিন্তু বিদ্যমান মুদ্রাব্যবস্থায় অর্থ কোন ভৃত্য (বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে) নয়, বরং তা নিজেই মানুষের ওপর কর্তৃত্ব আরোপ করে থাকে। মজুরি হচ্ছে সমাজের শ্রেণিবিভাজনে ব্যক্তির অবস্থান নির্ধারণের একটা উপায় যা ব্যক্তিকে বজায় রাখতে বাধ্য করা হয়। এমনকি নিজের তৈরি করা মানদণ্ডেও সেটা ব্যক্তির যথাযথ মূল্যায়নেও ব্যর্থ হয়। এ ধরনের কাঠামো নস্যাৎ করা জরুরি। 

আমরা আগেই দেখেছি, বর্তমান সরকার, কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের চেয়েও ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান (যেমন, ব্যাংক) জাতীয় সম্পদের হিসাবনিকাশ করে থাকে। সেই হিসাবের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তারা মুদ্রা ছাপায়, ঋণের পরিমাণ ও বণ্টনের ধরন নির্ধারণ করে। বিদ্যমান সরকারব্যবস্থার কার্যকারিতার (যা দৈনন্দিন গণমাধ্যমে চলতে থাকা রাজনৈতিক বুলি সংক্রান্ত প্রসঙ্গ এবং এই মুহুর্তে আমাদের ভাবনার বিষয় নয়) ওপর নির্ভর করে অর্থনৈতিক পর্যালোচনা কিংবা বাজেট কতোটুকু নির্ভুল হবে। অর্থ মন্ত্রনালয় এরপর তার বিবেচনা অনুযায়ী জাতীয় সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রে ‘দানশীল’ কিংবা ‘কঞ্জুস’ হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে বেতন ও মজুরি নির্ধারিত হয় সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, পারিবারিক ক্ষমতা, ট্রেড ইউনিয়নের দর কষাকষির ক্ষমতা, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে। এসকল উপাদানের কার্যকারিতার ভিত্তিতে জাতীয় সম্পদে প্রত্যেকের ‘ভাগ’ নির্ধারিত হয়। যারা এই উপাদানগুলোর কোনটাই ব্যবহার করতে পারে না, তাদেরকে টিকে থাকার জন্য যা দেওয়া হয়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। সরকার জাতীয় সম্পদ নিয়ে যা-ই করুক না কেন, তার কোন বাস্তব পরিবর্তন ঘটে না। 

নৈরাজ্যবাদ কি পুঁজিবাদের সাথে সংগতিপূর্ণ? 

নৈরাজ্যবাদকে কেবল এমন একটি কাঠামো হিসেবে ভাবা সম্ভব যেখানে তা মুক্ত, সমাজতান্ত্রিক এবং তা এমন কোন অর্থনৈতিক চাহিদা তৈরি করে না যার মাধ্যমে অবদমনের চর্চা করা সম্ভব।  সাধারণ জ্ঞান আমাদের বলে, যেকোন পুঁজিবাদী সমাজই চাইলে “রাষ্ট্রকে” (মার্কিন পরিভাষায়) উৎখাত করতে পারে, কিন্তু যদি সেখানে কিছু মানুষ ক্রমশ অর্থ কুক্ষিগত করতে থাকে এবং অন্য মানুষেরা অপরের হাতে অর্থ কুক্ষিগত করার জন্য প্রতিনিয়ত শ্রম দিতেই থাকে, তাহলে তা সংগঠিত সরকার কিংবা সরকারব্যবস্থার ব্যক্তিমালিকানাধীন কোন রূপকে উৎখাত করতে পারে না। “উদারবাদী” নব্য ডানপন্থীরা যে “নৈরাজ্য-পুঁজিবাদের” (anarcho-capitalism) স্বপ্ন দেখে, তার সাথে প্রকৃত নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের নৈরাজ্যবাদী চিন্তার কোন সম্পর্ক নেই। এটি এক প্রকারের মিথ্যা যা অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতাকে আড়াল করার চেষ্টা করে, অনেকটা জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রের মতো। লাগামহীন, অবাধ পুঁজিবাদ, যদি তা পরিবর্তনকামী রাষ্ট্রের দ্বারা বাধাগ্রস্ত না-ও হয় (রাষ্ট্রকে সামাজিক সহিংসতা ও সংঘাত এড়ানোর জন্য শোষণের ওপর খানিকটা লাগাম টানতেই হয়), তারপরেও পুঁজিবাদকে শ্রেণি সুবিধা বজায় রাখার জন্য বল প্রয়োগের আশ্রয় নিতে হয়, তা রাষ্ট্রের তরফ থেকে হোক কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে। তারা যে বিষয়ে বিশ্বাস করে তা হলো মূলত সীমিত রাষ্ট্রের ধারণা—যেখানে রাষ্ট্রের একমাত্র দায়িত্ব শাসক শ্রেণিকে রক্ষা করা, শোষণের জায়গায় হস্তক্ষেপ না করা, এবং শাসক শ্রেণিকে যতোটা সম্ভব সুলভ মূল্যে সেবা প্রদান করা। এছাড়াও তা আরো একটি দায়িত্ব পালন করতে পারে—কোন ধরনের অপরাধবোধ ছাড়া কর ফাঁকি দেওয়ার বুর্জোয়া চিন্তাকে নৈতিক ন্যায্যতা প্রদান। অনেকটা শান্তিবাদ যেভাবে কোন ধরনের অপরাধবোধ ছাড়াই বিপদ এড়িয়ে যাওয়াকে বৈধতা প্রদান করে, সেরকম। 

সামাজিক নিয়ন্ত্রণ

পুঁজিবাদী সমাজে সমষ্টিগত নিয়ন্ত্রণ আরোপের ইতিহাস বেশ অস্বস্তিকর। সামগ্রিক কাঠামো এড়িয়ে গিয়ে বিভিন্ন সংঘ বা কমিউনিটি নির্মাণের অনেক চেষ্টাই হয়েছে যেগুলো পুরোপুরি সামগ্রিক, প্রকৃত সমাজ না হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। সমবায়মূলক সমাজ ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতোই একচেটিয়া পুঁজিবাদের চাপের ঝুঁকিতে থাকে। সমবায় খামারগুলো—অর্থাৎ যে সমষ্টিগত ব্যবসায়িক সত্তাসমূহে ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য সাধারণ মজুরির চেয়ে কম মজুরিতে কাজ করে থাকে—কারুশিল্পের ব্যবসার মতো কখনোই একচেটিয়া বাজারে ঠিক উঠে দাঁড়াতে পারে না। এই সবগুলোই সমৃদ্ধি লাভ করতে পারতো যদি সামগ্রিক কাঠামোটি মুক্ত হতো, কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। 

তারপরেও আমরা দেখি, বিভিন্ন সামাজিক পণ্য সমান ভাবে সবার জন্য বিদ্যমান, তা কোন মূল্য পরিশোধের বিনিময়ে হোক কিংবা বিনামূল্যে। হাইওয়েগুলো এখনো উন্মুক্ত, রাষ্ট্র কিংবা পুঁজিবাদ (এখনো) পারেনি সকল রাস্তায় প্রবেশ ও চলাচলের জন্য টোল আদায় করতে (তবে ইউরোপের প্রধান হাইওয়েগুলোতে তা ঘটেছে)। পানি একসময় বিনামূল্যে পাওয়া যেতো, বর্তমানে পানির মূল্য নির্ধারণের জন্য মিটার বসানো হয়, যেন আমরা সবাই সাহারায় বসবাস করছি যেখানে পানির রেশনিং প্রয়োজন। তবে আপাতত বায়ুর জন্য আমাদের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে না। 

নৈরাজ্যবাদ মনে করে অর্থনীতিবিদ্যা ভিত্তিক এসকল বক্তব্য বাজে কথা ছাড়া কিছুই না। যেসকল সেবা প্রাকৃতিকভাবে কিংবা মানুষের শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত হয়, তার মালিকানা থাকবে মানুষেরই হাতে। 

একটি ক্রান্তিকালীন সমাজ কি প্রয়োজন? 

নৈরাজ্যবাদ মনে করে না কোন ক্রান্তিকালীন তথা transitional সমাজের প্রয়োজন রয়েছে। এমন এওটি সমাজের চিন্তা প্রচার করেছিল লেনিনবাদীরা, যারা মনে করতো কয়েক বছরের কঠোর একনায়কতন্ত্রের পর রাষ্ট্র আপনাআপনি ক্ষয়ে যাবে। এমন দাবি প্রাথমিকভাবে তোলা হয়েছিল সদ্য জন্মানো সোভিয়েত রিপাব্লিককে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ হিসেবে, কিন্তু সেই একনায়কতন্ত্র স্থায়ী হয় দীর্ঘ ৭০ বছর এবং মানুষ বিরক্ত হয়ে ওঠে। ক্ষয়ে গিয়েছিল কেবল সেসকল মানুষ যারা একটি মুক্ত সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতো। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রকে জিইয়ে রেখে ও ক্রমাগত শক্তিশালী করে তুলে সেটির ‘ক্ষয়ের’ কথা ভাবা অযৌক্তিক। লেনিনবাদীরা এটিকে ন্যায্যতা দেয় এটা বলে যে, রাষ্ট্র হচ্ছে সামগ্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র যা শ্রমিক শ্রেণিকে অবদমনের মাধ্যমে পুঁজিবাদী শ্রেণিস্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় তার একটি একটি অংশমাত্র। এই অংশটুকু ক্ষয়ে যেতে পারে (যদিও দীর্ঘ সময়ের রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রে তেমনটা ঘটেনি)। যা ক্ষয়ে যাবে না তা হলো, রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য অংশগুলো, যদি না রাষ্ট্রকে গোড়া ও আগা উভয় দিক থেকেই উৎপাটিত করা যায়। 

নৈরাজ্যবাদের কাছে ক্রান্তিকালীন একটি সমাজ প্রয়োজনীয় মনে হয় না বলে এমন নয় যে এরকম কোন সমাজের উদ্ভব ঘটবে না। নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় কি? হয়তো বর্ণবাদ, লিঙ্গীয় বৈষম্য, ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথাবাদী আচরণ, ইত্যাদির প্রতি পালটাতে থাকা আচরণ হয়তো একটি ক্রান্তিকালীন সমাজেরই লক্ষণ, যা ইতোমধ্যেই বিদ্যমান। বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে হয়তো কোন সচেতন বিপ্লব ছাড়াই শ্রমিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, যা নিজেই একটি ক্রান্তিকাল। 

এমনও একটি ক্রান্তিকালের কথা ভাবা যেতে পারে যেখানে সমাজের একটি অংশ নতুন কাঠামোর দিকে বিবর্তিত হচ্ছে এবং অপর অংশ পুরনো কাঠামোতে আটকে রয়েছে। শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানার উপস্থিতি, একই এলাকায় কট্টরপন্থী পুরনো ঘরানার পারিবারিক ব্যবস্থার পাশাপাশি উন্মুক্ত সম্পর্কে জড়িত মানুষদের বসবাস হয়তো এরকম একটি সময়ের প্রতিই ইঙ্গিত করে। কিন্তু স্পষ্টতই কোন একটা সময়ে দুটি ব্যবস্থার একটিকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতেই হবে। মানুষ যদি কোন বাধ্যবাধকতা ছাড়া নিজেই ঠিক করতে পারতো সে কোন ধরনের কাজ করবে, তাহলে পুঁজিবাদ টিকে থাকতো না। তখন পুঁজিবাদ চেষ্টা করতো তার কর্তৃত্বকে আরও সুসংহত করে তোলার (সম্ভবত ফ্যাসিবাদী গ্যাং গড়ে তোলার মাধ্যমে, ইতালিতে শ্রমিকেরা কারখানার দখল নেওয়ার সময়ে যেমনটা হয়েছিল) নয়তো তার কর্মকাণ্ড গুটিয়ে ফেলতো (যা ইতালিতে পুঁজিপতিরা সাময়িকভাবে করতে বাধ্য হয়েছিল, যদিও তাদের অনেকেরই গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল)। 

একটি মুক্ত সমাজ

কেবল সরকারব্যবস্থার শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হলেই চলবে না, জীবনধারণের সকল প্রয়োজীনয়তা বিনামূল্যে লভ্য হলেই কেবল একটা সমাজকে মুক্ত বলা যাবে। 

এটাও সত্য যে, যদি কোন পণ্যের যোগান কম থাকে, তাহলে সমাজ যতোই মুক্ত হোক না কেন, সেসকল পণ্যকে কোন না কোন ভাবে রেশনিং ব্যববস্থার মধ্যে আনতেই হবে। তা হতে পারে ‘শ্রম-মূল্য’ কার্ডের দ্বারা কিংবা সাধারণ ‘ন্যায্য রেশনিং’ ব্যবস্থার মাধ্যমে। যাকে দেখা যেতে পারে একটি ভিন্নতর মুদ্রাব্যবস্থা বজায় রাখার প্রক্রিয়া হিসেবে (কিন্তু সেখানে মুদ্রা বা অর্থ বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থার মতো হবে না, সেখানে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমের উর্ধ্বে অর্থের কোন মূল্য থাকবে না)। 

একটি মুক্ত সমাজের এমন একটা অর্থনীতি আমরা সাজাতে পারি না যা বৈশিষ্ট্যগতভাবেই কোন কিছু মেনে নিতে বা প্রত্যাখ্যান করতে সমর্থ। একজন কর্তৃত্ববাদী অর্থনীতিবিদ সেটা পারেন (“যতোক্ষণ আমি বা আমার পার্টি ক্ষমতায়, আমরা এটা-ওটা করবো”)।

একটি নৈড়াজ্যবাদী সমাজ সহজাতভাবেই একটি মুক্ত সমাজ, কিন্তু একটি মুক্ত সমাজ সকল ক্ষেত্রেই একটি নৈরাজ্যবাদী সমাজ নয়। কয়েকটি জায়গায় এর ঘাটতি থাকতে পারে এবং কিছু কিছু ঘাটতি এর প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে স্তিমিত করে ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরা বিপ্লব ঘটালে লিঙ্গীয় বৈষম্য জারি থাকতে পারে, যার ফলে সমাজের একাংশের স্বাধীনতা খর্ব হবে এবং বিপ্লব তার গৌরব হারাবে; একই সাথে আগ্রাসী মনোভাব টিকে থাকারও একটা আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। বিভ্রান্ত উদারবাদী তথা লিবারেলরা মনে করে অবদমনমূলক শক্তিগুলোকে সহ্য করে যেতে হয়, কিন্তু তা একটা সময়ে সকল স্বাধীনতাই কেড়ে নিবে এবং বিরোধিতা করার অধিকার বিপন্ন হলে তা বিপ্লবকেও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবে। 

একটি মুক্ত সমাজ সকল প্রকারের অবদমনমূলক প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে এবং কিছু প্রতিষ্ঠান হয়তো অন্যগুলোর চেয়ে বেশিই স্থায়ী হয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এমনই একটি কাঠামো; ধর্মীয় বিশ্বাস সবচেয়ে ভয়াবহ ও অত্যাচারী স্বৈরতন্ত্রের মাঝেও টিকে থাকতে পারে এবং নিশ্চিতভাবেই সরকারব্যবস্থাবিহীন সমাজেও তা টিকে থাকবে। তবে যেসকল ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজেদের মতামত অপরের ওপর চাপিয়ে দেয় না, ধর্মান্তরে বাধ্য করে না, ধর্মীয় বিদ্বেষ উসকে দেয় না, তাদের আইন, রীতিনীতি অপরকে মানতে বাধ্য করে না, নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবের সাথে তাদের কোন সংঘাত থাকার কথা নয়। 

চাকরিদাতারা কাজের সুযোগ তৈরি করে দেয় না

নৈরাজ্যবাদ একটি আদিম, মৌলিক সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় বিশ্বাস করে এবং তা হলো, কাজ এমন কোন বিষয় নয় যা চাকরিদাতা প্রদান করে থাকে। চাকরিদাতার হয়তো কাজ বণ্টনের আইনি অধিকার রয়েছে, কিন্তু একটি দেশের সম্পদ তৈরি হয় শ্রমিকের শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদের সমন্বয়ে, নিয়োগকর্তা কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে নয়। চাকরিদাতারা কেবল পারে সম্পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে। 

নৈরাজ্যবাদ মনে করে অস্থিতিশীল বাজার, মুদ্রাস্ফীতি, মন্দা, বেকারত্ব, এমনকি যুদ্ধের মতো ঘটনা বন্যা, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, খরার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়। বর্তমানে প্রায় সবাইই জানে অনেক ক্ষেত্রে এসকল বিপর্যয় সৃষ্টিই করা হয় প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে। 

হয়তো ভবিষ্যতের কোন প্রযুক্তিনির্ভর, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সমাজে (এক ধরনের ‘নিয়োগকর্তাদের ইউটোপিয়ায়’) শ্রমিক শ্রেণি উৎপাদনশীল শ্রেণি দ্বারা স্থানচ্যুত হবে। আমরা প্রতিনিয়তই এমনটা ঘটতে দেখি, যেখানে অলাভজনক হওয়ার কারণে অর্থনীতির বৃহদাকার অংশ বন্ধ করে ফেলা হয় এবং মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়। ইতোমধ্যেই আমরা এমন কিছু প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটতে দেখি যা মানুষকে একটি কেবল উৎপাদনশীল শ্রেণিতে পরিণত করার চক্রান্তে লিপ্ত—যেখানে মানূষ হবে কেবল প্রযুক্তির পরিচালক, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সহকারী কিংবা রিসেপশনিস্ট, পরিচারক, কেরানি, ধনী মানুষের ভৃত্য। নৈরাজ্য-সিন্ডিকালবাদীরা মনে করে এমন সমাজ তৈরির প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করতে হবে। তারা কাজের আরাধনা করতে অসম্মতি জানায় এবং কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের মনুষ্যত্ব কেড়ে নেওয়া ও তাকে বিচ্ছিন্নতাবোধে জর্জরিত করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। এ দিক থেকে তারা অন্যান্য ঘরানার কিছু নৈরাজ্যবাদী থেকে আলাদা যারা মনে করে কাজের কোন উদ্দেশ্য নেই এবং তারা বাধ্য হয়েই রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। 

নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপত্তি

যখনই নৈরাজ্যবাদীরা বর্তমান সমাজকে আক্রমণ করে, তখনই সাধারণ মানুষের ভয় ও পূর্বানুমানকে উসকে দেয়। এই সাধারণ মানুষও জানে বিদ্যমান সমাজ কতোটা ভয়াবহ এবং তারা ভয়াবহ অবস্থার কিছু কাঠামোর বাইরে কোন জীবনের কথাও ভাবতে পারে না। নৈরাজ্যবাদের কথা শুনলে তারা এমন কিছু আপত্তির কথা তুলে, যেগুলো এক অর্থে ভবিষ্যতের একটি মুক্ত সমাজ বলতে তারা যা বোঝে, তারই বিরুদ্ধে উত্থাপিত কিছু আপত্তি। 

আসলে তারা রাষ্ট্র প্রচারিত ‘নৈরাজ্যকর অবস্থার’ ধারণাকে ভয় পায়। তারা মনে করে কোন শাসকগোষ্ঠী না থাকলে সমাজ খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, নৃশোংসতায় ভরে যাবে। কিন্তু আমরা জানি যে, শাসক বা রাষ্ট্র থাকা অবস্থাতেও এগুলো নেহাত কম হচ্ছে না, রাষ্ট্র এগুলো থামাতে পারছে না, হয়তো চাচ্ছেও না। একটা খবরের কাগজ তুললেই বোঝা যায় সরকার শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক অশান্তি, সংঘাত বেড়েই চলেছে, কিংবা সরকার দুর্বল হয়ে পড়লেও এগুলোর কোন কমতি থাকে না। এমনকি যে জায়গায় সরকারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং একাধিক গোষ্ঠী রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য উঠে পরে লেগেছে, সেখানে অবস্থা আরও ভয়াবহ। বাস্তবে “নৈরাজ্যকর অবস্থা” কোথাওই বিদ্যমান নেই—সব জায়গাতেই সরকার প্রণোদিত নয়তো সরকার গঠনের জন্য সহিংসতা বিদ্যমান।

সরকার সর্বোচ্চ যা করতে পারে তা দুর্দশার নিবারণ নয়, বরং যা করে থাকে তা হলো শাস্তি প্রদান। সরকার যদি কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে অবদমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং এর ফলে প্রাথমিক অপরাধের চেয়ে শাস্তির ভয়াবহতাই অধিক হয়ে ওঠে—‘সমাধান’ হয়ে ওঠে সমস্যার চেয়ে বেশি ভয়াবহ। 

“পুলিশবাহিনী ছাড়া আমরা কীভাবে থাকবো?” কোন সমাজই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিবে না, সেখানেই পুলিশ থাকুক বা না থাকুক। যখন অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা হয় তা কেবল অপরাধপ্রবণতা ‘দেখে রাখে’ না, একই সাথে অপরাধপ্রবণতাকে উসকেও দেয়, কিন্তু অপরাধের সাথে সমাজের মানুষের বোঝাপড়া চালানোর ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। এর কারণ হলো, পাশের বাসায় একটা খুন হলে সেটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, আমার নয়! একটি কর্তৃত্ববাদী সমাজে প্রতিবেশির প্রতি আমাদের দায়িত্ব ক্ষুণ্ণ করা হয়, যেখানে রাষ্ট্র আমাদের আচরণের দায়ভার গ্রহণ করে থাকে। 

“নোংরা কাজগুলো কারা করবে?” এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া কেবল একজন নৈরাজ্যবাদীর দায়িত্ব নয়, তা পুরো সমাজের দায়িত্ব। অনেক কাজই রয়েছে যেগুলো সামাজিকভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত, যার মজুরি অত্যন্ত কম এবং যেসকল কাজ কেউ আদতে করতে চায় না। ফলে মানুষকে এক রকম বাধ্যই করা হয় সেগুলো করতে, নয়তো বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে সেগুলোর জন্য প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সেসকল কাজের মজুরি বাড়ানো হয় (তখন আবার সেটার চাহিদা সামাজিকভাবে বৃদ্ধি পায়)। কিংবা এ ধরনের কাজের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যে চাপ তৈরি করা হয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে নয়তো বেকারত্বের ভয় দেখিয়ে। মাঝেমধ্যে পুঁজিপতি সস্তা শ্রমের জন্য অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগ দিয়ে থাকে, যার মাধ্যমে সমস্যাটা কয়েক প্রজন্মের জন্য ধামাচাপ দিয়ে রাখা যায়। কিংবা হয়তো সে কাজগুলো একেবারেই সম্পন্ন হয় না। 

এমতাবস্থায় রাষ্ট্র কী করবে তা অনেকটাই নিররভর করে রাজনৈতিক বিষয়সমূহের ওপর। একটি নৈরাজ্যবাদী সমাজ কী করবে, তা কেবল একজন ভবিষ্যদ্বক্তাই বলতে পারবেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, নৈরাজ্যবাদী সমাজ কী করতে পারবে না—তা কারও ওপর জোরজবরদস্তি করতে পারবে না, যেহেতু বল প্রয়োগের কোন অর্থনৈতিক বা অন্য হাতিয়ার তার থাকবে না। এই প্রশ্নটা সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতার পর্যালোচনার দাবি রাখে, যা নতুন কিছু সমস্যারও উদ্রেক করে। কিন্তু এই কারণে কি আমরা সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতাকে প্রত্যাখ্যান করবো?

“নৈরাজ্যবাদীরা যদি ক্ষমতা দখল না করে এবং অন্যান্য ধরনের সমাজতন্ত্রকে রহিত করে, তাহলে তারা এক অর্থে ফ্যাসিবাদের জন্যই জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে”। নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ভ্রান্তিকরভাবে নৈরাজ্যবাদী চিন্তার সাথে শান্তিবাদকে গুলিয়ে ফেলে। যেকোন পরিস্থিতিতে সবসময়ই স্বৈরতন্ত্রকে (ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী কিংবা একেবারে নিজস্ব গণ্ডিতে) এড়িয়ে যাওয়ার নিশ্চিত উপায় হলো ব্যক্তিগতভাবে স্বৈরাচারকে নির্মূল করা। এই কাজটা তখনই কেবল একটি প্রতীকী কার্যক্রমে পরিণত হয় যখন স্বৈরাচার ক্ষমতায় থাকলেও আদেশ প্রদানের সকল হাতিয়ার রাষ্ট্র প্রধানের হাতে রয়ে যায়। 

সুযোগ পেলে যে কেউই ক্ষমতা দখল করতে চাইবে। নৈরাজ্যবাদীরা নিজেদের কোন সুবিধাভোগী অভিজাত হিসেবে দাবি করে না এবং কখনো এমনটাও বলতে পারবে না যে, তারা ক্ষমতার মোহ থেকে মুক্ত, কিংবা ক্ষমতা লাভ করলে তা অন্য যে কারও চেয়ে সুষ্ঠুভাবে তার প্রয়োগ করবে। 

নেতৃত্ব

নৈরাজ্যবাদীরা কি নেতৃত্বে বিশ্বাস করে? তারা সবসময়ই বলতে চায় যে তারা করে না, কিন্তু অনেক নৈরাজ্যবাদীই নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, কখনো কখনো সামরিক বাহিনীর নেতাও হয়েছেন (বুয়েনাভেঞ্চুরা দুরুতি কিংবা নেস্টর মাখনো এর উদাহরণ), কোন সংগঠন বা ভাবাদর্শের নেতা হিসেবেও তাদের উত্থান ঘটতে দেখা যায়। যেকোন দল বা গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই কিছু মানুষ সহজাতভাবেই নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে আসেন, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তারা একেবারে ভিন্ন শ্রেণির মানূষ। নেতা হয়ে উঠলে অনেকেই নেতৃত্বের দায়ভারের কথা ভুলে যায়। অর্থাৎ, তাদের সমর্থকেরা হয়ে ওঠে তার অন্ধ ভক্ত এবং সেই নেতৃত্ব আর দৃষ্টান্তমূলক কোন বিষয় থাকে না, তা হয়ে হয়ে ওঠে চিন্তাবিহীন নতি স্বীকারের একটি বিষয়। 

সঙ্গীতজ্ঞ, শিল্পী, বিজ্ঞানীরা উন্নাসিক হওয়া ছাড়াই এক ধরনের ‘অভিজাত’ হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকার রাখার অর্থ এটা হতে পারে না যে, জগতের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধায় অন্য মানুষের চেয়ে তার অধিকার বেশি থাকবে কিংবা যে বিষয়ে সে পারদর্শী নয় সে বিষয়ে তার অভিমতকে অন্যান্যদের অভিমতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, যুদ্ধ থামানো সম্ভব কি-না এই বিষয়ে আইনস্টাইন ও ফ্রয়েডের মধ্যেকার কথোপকথন; যেখানে আইনস্টাইন ফ্রয়েডের কাছ থেকে শান্তিবাদের একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন এবং ফ্রয়েড বলতে চেয়েছেন, সহিংসতা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের সহজাত বিষয়। শেষ পর্যন্ত যেসকল বিজ্ঞানীরা শান্তিবাদী ছিলেন কিংবা লীগ অফ নেশনসের সমর্থক ছিলেন, কিংবা আইনস্টাইনের মতো দুটোই ছিলেন, তারাই পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার করেন। 

একইভাবে একটি অফিসে কাজ করেও একজন ব্যক্তি আমলা না হয়ে থাকতে পারেন (একজন আমলা হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার ক্ষমতা আসে কর্মক্ষেত্রে তার পদের মাধ্যমে)। একটা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানে কোন পদে অধিষ্ঠিত থাকা ব্যক্তি সবার উর্ধ্বতন হওয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন (যেমনটা জোসেফ স্টালিনের ক্ষেত্রে হয়েছিল)। সোজাসাপ্টা ভাষায় বললে ‘আমলা’ যেন একটা শব্দ যা সবচেয়ে কার্যকরী ব্যক্তির মুখে ছুঁড়ে মারা হয়, কিন্তু আমলা হওয়ার সাথে যোগ্যতা বা কার্যকরী হওয়ার কোন সম্পর্কই নেই। একইভাবে প্রকৃত অর্থেই নৈরাজ্যবাদী কোন ব্যক্তি প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বের জায়গায় কখনো নিজেকে স্থাপন করবেন না। আবার নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষাও করবেন না, নিজেই দায়িত্ব তুলে নিবেন। নেতৃত্বের অভিশাপ মূলত অন্ধ ভক্ত হয়ে ওঠার অভিশাপ; যা নেতার দোষ নয়, বরং অনুসারীদের আজ্ঞাবহতার দোষ। হিটলার কতোটুকু ক্ষতি করতে পারতো যদি সবকিছু তার একার করতে হতো? 

জনমত কি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে পারে?

অবশ্যই পারে। এমনকি একটা মুক্ত সমাজেও তা ঘটা সম্ভব। কিন্তু এমনটা বলার অর্থ মুক্ত সমাজের বিরোঢিতা করা নয়। এর অর্থ জনমতকে কখনই বাইরের শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হতে দেওয়া যাবে না। অর্থনৈতিকভাবে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একটা সমাজেও সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে কিছু বিদ্বেষ রয়ে যেতে পারে, প্রথাগত পারিবারিক মূল্যবোধ পুরোপুরি নির্মূল নাও হতে পারে, কিংবা ধর্মীয় গোঁড়ামিও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এরকম সমাজ তখন কেবল অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত সমাজ হিসেবে বিবেচিত হবে। 

কিন্তু যদি বিদ্বেষকে ন্যায্যতা দেওয়ার কোন কাঠামো না থাকে, প্রথাবিরোধী জীবনযাপন করা মানুষের বিরুদ্ধে অবদমন না থাকে, সর্বোপরি উপর থেকে নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষকে প্ররোচিত করার মাধ্যমে অবদমিত করার কোন ব্যবস্থা না থাকে, তখনই জনমত তার অন্তর্গত নানা বিদ্বেষ বৈষম্যকে ছাড়িয়ে যেতে সমর্থ হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত মানেই তা যথাযথ নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে নিজের সুবিধামতো পরিচালিত করা শাসকগোষ্ঠীর কার্যক্রমের একটি অংশমাত্র। 

ঐক্য

নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ আনা হয় এবং এই অভিযোগটা সাধারণত তারাই এনে থাকে যারা নৈরাজ্যবাদী চিন্তার প্রতি প্রাথমিকভাবে আগ্রহী হয়েছেন। একই রকম আদর্শে বিশ্বাসীরা কেন ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নেন? একটি একক মুক্তিকামী বামপন্থা কেন তৈরি হয় না? এতো বিভক্তিই বা কেন?

আমরা যদি কার্যনির্বাহী কাউন্সিল গঠনের কাজ শুরু করি (যেমন শিল্প শ্রমিকদের প্রাক-ইউনিয়ন)—যেমনটা আমরা সুযোগ ও শ্রমিকদের সমর্থন পেলে করতে চাই—সেখানেও সামাজিক দল গঠনের প্রথম ধাপ হবে শিল্প কার্যক্রমের ভিত্তিতে তা করা। সেখানে আমরা কেবল মুক্তিকামী বামপন্থীদের সাথে সমবেত হবো না, একই সাথে (শ্রমিক কাউন্সিলের ক্ষেত্রে) সংস্কারপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল, এমনকি কর্তৃত্ববাদী আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিরাও সংযুক্ত হবেন। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নৈরাজ্যবাদী চিন্তা ও আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার অর্থ নির্জনবাসী হয়ে যাওয়া নয়। নৈরাজ্যবাদী দলকে নিজেদের পরিচয় অক্ষুণ্ণ রাখতে হয়, কিন্তু কেবল পার্টির মাধ্যমে সেই পরিচয় ব্যবহৃত হয় অপরকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। 

বর্তমানের নৈরাজ্যবাদী হওয়ার ভান করা মানুষেরাই (তারা লিবারেল হোক কিংবা নৈরাজ্যবাদকে একটি ‘লাইফস্টিল’ হিসেবে নিক) বামপন্থার ভেতরে নিজেদের আবদ্ধ ক্ষেত্র তৈরি করতে চান (অবশ্য বামপন্থা নিজেই যথেষ্ট আবদ্ধ হয়ে পড়েছে)। তারা মনে করেন, নির্দিষ্ট কিছু বিষয় ও আদর্শে বিশ্বাসী হওয়া বাধ্যতামূলক এবং তা না হলে কাউকে দলভুক্ত করা যাবে না। এ ধরনের ব্যধিসুলভ বিচ্ছিন্নতার (যা তারুণ্য, লিঙ্গ, বর্ণ, জাতীয়তা, বিকল্প সংস্কৃতি ইত্যাদির ভিত্তিতে ঘটতে পারে) সাথে নৈরাজ্যবাদের কোন সম্পর্ক নেই। বরং নৈরাজ্যবাদ বিরোধী প্রচারণাই এগুলোকে বেশি করে উসকে দেয়। 

নৈরাজ্যবাদের মার্ক্সীয় সমালোচনা

যারা নৈরাজ্যবাদ সম্পর্কে সত্যিকার অর্থেই জানতে চায়, তারা প্রথমেই নৈরাজ্যবাদী চিন্তার এই সমালোচনার সাথে পরিচিত হন। এখান থেকেই মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী ও সমাজ-গণতান্ত্রিক সমালচনাসমূহের সূচনা ঘটে। নৈরাজ্যবাদের মুখোমুখি হলে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীরা মনে করেন তা মার্ক্সবাদের মৌলিক চিন্তাগুলোর বিরোধী। মার্ক্সবাদকে মনে করা হয় মৌলিক শ্রমজীবী দর্শন (যে বিশ্বাস বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনকে জর্জরিত করে ফেলেছে)। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে করা হয়, শিল্পে কর্মরত সর্বহারা শ্রেণি মুক্তির জন্য নিজেদের ছাড়া কারও ওপর নির্ভর করতে পারে না। এরূপ মতবাদে এমনটা বলার কোন জায়গাই নেই যে, শ্রমিক শ্রেণি হয়তো তাদের নিজের শ্রেণির বাইরের কারও চাপানো কর্তৃত্ব উৎখাত করতে প্রস্তুত নয়। 

মার্ক্সবাদ সাধারণত নৈরাজ্যবাদের সমালোচনা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু যখন এর কর্তৃত্ববাদী মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায়, তখন সে মুখ খুলতে বাধ্য হয় (“কোন ধরনের পরিচালনা—তথা কর্তৃত্ব—ছাড়া শ্রমিকেরা কীভাবে রেললাইন চালাবে?”) এবং নৈরাজ্যবাদের ওপর আক্রমণ না চালিয়ে নৈরাজ্যবাদীদের ওপর চড়াও হয়। এরূপ আক্রমণ বেশ সমস্যাজনক। ইতিহাসে কোন সময়ে কোন ব্যক্তি যদি যদি নিজেকে নৈরাজ্যবাদী দাবি করে থাকে, সে মৃত হোক কিংবা জীবিত, তার সকল চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের ভার যেন অন্য একজন নৈরাজ্যবাদীকেই বহন করতে হবে। আবার কেউ যদি সাময়িকভাবেও নিজেকে নৈরাজ্যবাদী বলে থাকে, কিংবা অন্য মানুষও যদি কাউকে (ভ্রান্তিকরভাবে হলেও) নৈরাজ্যবাদী বলে থাকে, তার দায়ও কোন একভাবে সকল নৈরাজ্যবাদীর ওপর এসে পড়ে। এমনকি যারা নৈরাজ্যবাদী নয় তারা যদি কোন কাজ বা চিন্তাকে (ভুল করে হলেও) নৈরাজ্যমূলক মনে করে থাকে, সেটাও যেন সকল নৈরাজ্যবাদীর দায়। কিন্তু মার্ক্সবাদীরা কেবল সেসকল ব্যক্তির দায় গ্রহণ করতে সম্মত হয়, যারা কোন নির্দিষ্ট মার্ক্সবাদী পার্টির কার্ডধারী সদস্য। 

তবে মার্ক্সবাদ নৈরাজ্যবাদের জন্য একটি যৌক্তিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে—রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কীভাবে উপেক্ষা করে যাওয়া যায়? এবং এমনটা করা উচিত কি-না? এই প্রশ্নটা মার্ক্সবাদের দুটি ভিন্ন ধারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করে। যেহেতু মার্ক্সবাদীদের কেউ কেউ সামগ্রিক পুঁজিবাদী ক্ষমতা কাঠামোতে পূর্ণ অংশগ্রহণ করেছেন, আবার অনেকে অস্পষ্টভাবে ‘পার্লামেন্টকে একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের’ কথা বলেছেন। লেনিন মার্ক্সবাদের এই সংকটের ব্যাপারে অবগত ছিলেন এবং মনে করতেন যে মার্ক্সবাদ নিজের সুবিধার্থে রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে ব্যবহার করে এবং মনে করে পার্লামেন্টের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে পুঁজিবাদকে বিতাড়িত করা যাবে, সে ধরনের মার্ক্সবাদের যে সমালচনা নৈরাজ্যবাদীরা করে থাকে, তা অযৌক্তিক কিছু নয়। ফলে তিনি ভিন্ন একটি বিষয়ের ওপর মনোনিবেশ করেন, যা মূলত মার্ক্সই শুরু করেছিলেন। তা হলো, নির্দিষ্ট কিছু নৈরাজ্যবাদীদের সমালোচনা করা, যা আজও লেনিনবাদী চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। 

যেহেতু নৈরাজ্যবাদের সমালোচনার কিছু তারা খুঁজে পায় না, লেনিনবাদীরা—বিশেষত ট্রটস্কিবাদীরা—এখনো ব্যক্তিকে আক্রমণের রাস্তা বেছে নেন। সমালোচনার জন্য লেনিন কেবল গুটিকয়েক ব্যক্তিকে আলাদা করেছিলেন যারা অল্প কিছু সময়ের জন্য তাদের আদর্শ থেকে সরে এসেছিল; কিন্তু পরবর্তী কালের লেনিনবাদীরা মনে করেন সকল নৈরাজ্যবাদীই অল্প কয়েকজনের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী। যদিও রুশ সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীদের মতো ব্যক্তিদের নৈরাজ্যবাদী হওয়ার তকমা অন্যেরাই দিয়েছিল। 

লেনিনবাদের এই ধারা থেকে নৈরাজ্যবাদের আরেকটি সমালোচনার উদ্ভব ঘটেছে (যা মূলত ট্রটস্কিপন্থী ও মাওবাদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ); নৈরাজ্যবাদীরা কেবল নৈরাজ্যবাদী হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডের জন্যই দায়ী নয়, একই সাথে তারা নৈরাজ্যবাদী চিন্তা প্রভাবিত সকল শ্রমিকের জন্যও দায়ী। সিএনটি-র (C.N.T. অর্থাৎ Confederacion Nacional del Trabajo বা National Confederation of Labor) কথা এখানে প্রায়ই উচ্চারিত হয়, কিন্তু গৃহযুদ্ধের আগে ও পরের এর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস কখনোই তুলে ধরা হয় না; খালি সরকারব্যবস্থায় এর অংশগ্রহণের কথাই বলা হতে থাকে। এজন্য নাকি সবসময়ই নৈরাজ্যবাদীদের দায়ভার গ্রহণ করা উচিত! কিন্তু ট্রটস্কিপন্থীরা আবার U.G.T.-র (Union General de Trabajadores বা General Union of Workers) মতো সংস্কারপন্থী ইউনিয়নকে এর ইতিহাসের কোন অংশ না মানে নিয়েই সমর্থন দিয়ে পারে। সকল দেশেই তারা সংস্কারপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সাথে যোগ দেয় (শ্রমিক হলে), নয়তো তাদের চিন্তা মেনে নেয় (ছাত্র হলে)। তাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু একটি বৈপ্লবিক ট্রেড ইউনিয়নকে কোন একবারের আদর্শ চ্যুতির জন্য সবসময়ই জবাবদিহি করতে হবে। তদুপরি, যদি তা ভেঞে পড়ে সেটির পুনর্গঠনের কোন প্রয়োজন নেই; কিন্তু সংস্কারপন্থী ইউনিয়নকে সুবিধা অনুযায়ী নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। এটাই হলো স্পেন বা অন্য কোন দেশে বিদ্যমান অনুরূপ ইউনিয়ন সম্পর্কে ট্রটস্কিপন্থী চিন্তার রূপ। তারা মূলত এমন একটি সংস্কারপন্থী ইউনিয়নকে সমর্থন দিতে চায়  যেটার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রয়েছে যাকে তারা কব্জা করতে পারে এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বহীন ইউনিয়নগুলোকে (যেখানে তারা বুঝে উঠতে পারে না কী বা কাকে কব্জা করতে হবে) তারা এই মর্মে খারিজ করে দিতে চায়। 

প্রটেস্ট;
শিল্পী: অর্ডি;
সূত্র: আর্টমাজিউর

পেটি বুর্জোয়া

অ-বিপ্লবী ইউনিয়নগুলোকে সহ্য করতে না পারা এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে ইউনিয়ন গড়ে তোলার জন্য নৈরাজ্যবাদীদের অপছন্দ করার মতো পরস্পরবিরোধী সমালোচনা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীরা তুলে ধরার পাশাপাশি তারা মনে করে সকল নৈরাজ্যবাদীই ‘পেটি বুর্জোয়া’। 

এর ফলে আরেকটি জটিলতা দেখা দেয়। নৈরাজ্য-সিন্ডিকালবাদী ইউনিয়নের অস্তিত্বের সাথে কীভাবে সেটির ‘পেটি বুর্জোয়া’ উৎসের মেলবন্ধন ঘটানো যায় এবং বর্তমানের অধিকাংশ মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীই যে প্রথাগত কোন পেশায় যুক্ত বা সেটার জন্য পড়াশুনা করছে, এই ব্যাপারটার সাথেই বা কীভাবে বোঝাপড়া চালানো যায়? এর উত্তর সাধারণত হয়ে থাকে, যেহেতু নৈরাজ্যবাদ ‘পেটি বুর্জোয়া’ আদর্শ, তাই যারা এর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে ‘তাদের পেশা বা সামাজিক প্রেক্ষাপট যা-ই হোক না কেন’, তারাও ‘পেটি বুর্জোয়া’; এবং যেহেতু মার্ক্সবাদী শ্রমজীবী শ্রেণির দর্শন, তাই এর সাথে সংযুক্ত প্রত্যেকেই শ্রমজীবী, ‘অন্তত বিষয়গতভাবে’। এমন চিন্তা এক ধরনের সমাজতাত্ত্বিক অযৌক্তিকতা, যেন ‘শ্রমিক শ্রেণি’ মানেই একটি ভাবাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি। একই সাথে এই চিন্তা তর্ক এড়িয়ে যাওয়ার জন্য মার্ক্সবাদীদের একটি সহজাত বক্তব্য।  

মার্ক্স অবশ্য তাঁর অনুসারীদের মতো বুদ্ধিহীন ছিলেন না। তাঁর সময়ে ‘পেটি বুর্জোয়া’ বলতে আইনজীবী, হিসাবরক্ষক, কারখানার ম্যানেজার, বা কোন সমাজতাত্ত্বিককে বোঝানো হতো না (তারা ছিল বুর্জোয়া এবং শব্দটা ছিল ‘পেটিট’ (petit), যার অর্থ ক্ষুদ্র, ‘পেটি’ (petty তথা হীনচেতা) নয় এবং এর দ্বারা বোঝাতো যে এরা ঠিক বুর্জোয়া নয়)। সামান্য একজন নগরবাসীর সুযোগ সুবিধা ধনীদের তুলনায় ছিল কম, কিন্তু সে তার কাজের কারণে বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতো। মার্ক্স মনে করতেন, নৈরাজ্যবাদ হচ্ছে কারিগর শ্রেণির আন্দোলন, যেই শ্রেণির কাজের পর চিন্তাভাবনা ও কথা বলার সময় রয়েছে এবং যারা কারখানার সার্বক্ষণিক কাজের চাপে পিষ্ট নয়। এই শ্রেণি ছিল তুলনামূলকভাবে স্বাধীন, কৃষকদের মতো পিছিয়ে পড়া নয় এবং এদেরকে সহজে ভয় দেখানো যেতো না। ইংল্যান্ডে এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে র‍্যাডিকাল রাজনৈতিক চিন্তার উন্মেষ ঘটতে দেখা গিয়েছিল; যার কারণ বোধ হয় তৎকালীন ইংল্যান্ডে রাষ্ট্র ছিল তুলনামূলক কম অবদমনমূলক এবং এর অপ্রয়োজনীয়তা ততোটাও স্পষ্ট ছিল না। অন্যান্য দেশে এই শ্রেণির মানুষ ছিল আরও বেশি র‍্যাডিকাল; সুইজারল্যান্ডের জুরা অঞ্চলের ঘড়ির কারিগরদের নৈরাজ্যবাদ যথেষ্ট সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। তা প্যারিসে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্যারিস কমিউন আদতে ছিল রাজা তৃতীয় নেপোলিয়ন ও তার যুদ্ধের কারণে কারিগর থেকে নিতান্ত দরিদ্র মানুষে পরিণত হওয়া শ্রেণির মানূষের বিদ্রোহ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পৃথিবীব্যাপী যতোই ছড়িয়ে পড়তে থাকে, এই কারিগর শ্রেণি ততোই ধ্বংসের মুখোমুখি হতে থাকে এবং একটা সময়ে তারা কারখানা ব্যবস্থার অন্তর্গত হয়ে পড়ে। মার্ক্সবাদীরা দেখায়, শিল্পায়নের শিকার হওয়া এই কারিগরেরাই পরবর্তীতে নৈরাজ্যবাদী হয়ে ওঠে। তারা কারখানায় কাজ করার উপযোগী মানসিকতা পোষণ করতো না। সর্বহারা শ্রেণি যেভাবে নেতৃত্ব ও পার্টির কর্তৃত্ব মেনে নিতে স্বচ্ছন্দ ছিল এবং সারাজীবন একটা কারখানায় কাজ করে যেতে সম্মত ছিল, একজন স্বাধীনচেতা কারিগরের পক্ষে তা ছিল যথেষ্টই কঠিন। 

এই বক্তব্য যে সঠিক তা বোঝা যায় স্পেন ও প্যারিসের পাশাপাশি ইতালি, বুলগেরিয়া, রাশিয়ায় ইহুদিদের নিবাস সহ বিভিন্ন জায়গার কমিউন ধ্বংস করে দেওয়ার ঘটনার মাধ্যমে। নৈরাজ্যবাদী ইউনিয়নের কাজ হবে কারখানার দখল নেওয়া এবং সেখানকার গণউৎপাদন কাঠামো ভেঙে ফেলে সে জায়গায় কারিগরি ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত করা। এটিকেই মার্ক্স বলতে চেয়েছিলেন ‘পেটিট বুর্জোয়া’ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সময়ের সাথে এর অর্থও পুরোপুরি পালটে গেছে। মার্ক্সের অনুসারীরা তাঁর বক্তব্যকে পুরোপুরি ভুল বুঝেছে। 

ভ্যানগার্ড

মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীদের পরিবর্তনের প্রতি অনীহা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে পার্টি সম্পর্কে লেনিনের ধারণার মধ্য দিয়ে। লেনিন দেখেছিলেন সমসাময়িক রাশিয়া ছিল বৃহদাকার কিন্তু মন্থর সত্তা, যেখানে কৃষকেরা কোনভাবেই তাদের অবস্থার পরিবর্তনে আগ্রহী নয়, বরং তারা সকল কষ্ট সয়ে যেতে রাজি। তাই তিনি অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ‘সর্বহারা’ শ্রেণির দিকে দৃষ্টিপাত করেন। কিন্তু তাঁর সময়ের রাশিয়াতে ‘সর্বহারা’ শ্রেণি ছিল খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ। তারপরেও তিনি দেখেন যে, এই শ্রেণির মধ্যেই প্রগতির ব্যাপারে খানিকটা আগ্রহ রয়েছে, যদিও তিনি খেয়াল করেন এই শ্রেণির মানুষের নেতৃত্বে রয়েছে একদল ধুর্ত, হিসেবি, নৃশংস ও উচ্চশিক্ষিত মানুষ (যারা কেবল সে সময়কার রাশিয়ার উচ্চবিত্ত শ্রেণি থেকে আসতো)। এই সর্বহারা শ্রেণি যে পার্টি তৈরি করবে তাকে হতে হবে যতোটা সম্ভব সর্বহারা শ্রেণির পার্টি, যেখানে সেই শ্রেণির মানুষ নিজেরাই নিজেদের সংঘবদ্ধ করে তুলবে এবং ক্ষমতা দখল করবে। তখনই এরা অন্য সকল রাজনৈতিক দলকে বিলুপ্ত করে ফেলার দায়িত্ব ও অধিকার লাভ করবে। 

বর্তমান যুগে কোন দেশে এমন প্রক্রিয়া পরিচালনার চিন্তা করা মুর্খতা ছাড়া কিছুই না। অসংখ্য রাজনৈতিক দল নিজেদের সর্বহারা শ্রেণির দল হিসেবে দাবি করে, কিন্তু প্রকৃত অর্থেই সেরকম রাজনৈতিক দল থাকার কথা কেবল একটি। অন্যদের সাথে এই দলগুলোর তুলনা করলে দেখা যাবে এই দলগুলোর সদস্যের না আছে কোন রাজনৈতিক বুদ্ধি না আছে যথাযথ বোঝাপড়া। এই দলগুলোর বেশিরভাগ লোকই অতি-উৎসাহী, তাদের জানার গণ্ডি অত্যন্ত সীমিত এবং একজন সাধারণ শ্রমিকের চেয়ে তারা শ্রেণি সংঘাত সম্পর্কে যথেষ্ট কমই বোঝে। 

রুশ বিপ্লবকে একটি পৌরাণিক কাহিনীতে পরিণত করে ফেলা হয়েছে এবং এই বিপ্লবের নেতাদের ওপর এতো বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে সকলেই মনে করে তারা রুশ বিপ্লবের নায়কদের মতো নেতৃত্বের গুণাবলি ধারণ করে। কিন্তু যেহেতু তাদের সেই গুণগুলো নেই, এর ফলে শ্রমিক শ্রেণি ও তথাকথিত নব্য বামপন্থীদের মধ্যে দেখা দেয় চরম বিভেদ। এর ফলে নব্য বামপন্থীরা ভারি ভারি শব্দ ব্যবহার করে এবং আশা করে তাদের কথাবার্তা জ্ঞান হিসেবে সবাই গ্রহণ করবে। বৃহত্তর ‘আন্দোলনে’ মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের চিন্তাভাবনাগুলোকে তারা ফিরিয়ে আনতে চায় ও প্রতিনিয়ত রুশ কৃষকদের মতো একটি আর্থ-সামাজিক শ্রেণি খুঁজে বেড়াতে থাকে এবং পরিশেষে তারা ‘তৃতীয় বিশ্বের’ মিথে গিয়ে পতিত হয়। 

নৈরাজ্যবাদ সম্পর্কে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীদের যে সমালচনা বা প্রশ্নটিকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া যায় তা হলো, রাজনৈতিক কার্যক্রম বিবেচনা করা প্রয়োজন নাকি অপ্রয়োজনীয়। যখনই তাদের সমালোচনাকে নির্দিষ্ট শ্রেণির বাইরে প্রয়োগ করা হয়েছে, তখনই এর ফলে কেবল শ্রেণির বাইরের মানুষ লাভবান হয়েছে। 

নৈরাজ্যবাদের সমাজ-গণতান্ত্রিক (Social-Democratic) পর্যালোচনা

শুরুর দিককার সমাজতন্ত্রীরা বুঝতে পারেননি যে সমাজতন্ত্র ও নৈরাজ্যবাদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে। দুটোই এক অর্থে ছিল সাম্যবাদী ও সমাজতন্ত্রী। কিন্তু সমাজতন্ত্র চেয়েছিল সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে, কিন্তু নৈরাজ্যোবাদীরা চেয়েছিল বৈপ্লবিক পন্থার মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। এ কারণে পূর্বেকার অনেক নৈরাজ্যবাদী ও সমাজতন্ত্রী দলেই (বিশেষত ব্রিটেনে) শ্রমিক শ্রেণি যোগ দিয়েছিল এবং প্রায়ই তারা সংঘ অদলবদল করতো। কিছু বিষয় হয়তো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে, কিছু বিষয় শিল্পায়নের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, কিন্তু যতো দ্রুত সম্ভব বিপ্লবের আহ্বান জানানো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ফলে একটি ছিল অপরটির সম্পূরক বিষয়। যদিও এটাও সবাই উপলব্ধি করেছিল যে, একসময় হয়তো দুটো ধারাকে আলাদা হয়ে যেতে হবে। অন্তত এমনটাই মনে করা হয়েছিল। 

এই বিষয়টি পালতে যায় কারণ সমাজতন্ত্র নিজেই পালটে গিয়েছিল। তা নিজের উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করে রাষ্ট্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ধীরে ধীরে ‘সমাজতন্ত্রের’ অর্থ হয়ে দাঁড়ায় সবকিছুর ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং এর ফলে নৈরাজ্যবাদের আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে ওঠার বদলে সমাজতন্ত্রীরা নৈরাজ্যবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত সত্তা হয়ে ওঠে। শুরুতে তারা বলতো ‘নৈরাজ্যবাদীরা একটু বেশিই অধৈর্য্য’; পরবর্তীতে সংসদীয় সমাজতন্ত্রীরা নৈরাজ্যবাদীদের দেখতো এমন মানুষ যারা সমাজকে একেবারেই পালটাতে চায় না, তা এখনই কিংবা পরে। তারা নৈরাজ্যবাদের কট্টরপন্থী সমালোচনাকেই তাদের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় এবং মনে করা শুরু করে রাষ্ট্রই সকল আইনের ধারক-বাহক এবং বিদ্যমান অর্থনৈতিক নকশাই একমাত্র প্রতিষ্ঠিত আইনি নকশা। একটি রাষ্ট্রবিহীন সমাজের ধারণা কিংবা এর পক্ষে কথা বলাকেই তারা গর্হিত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা শুরু করে। এরকম কোন আইন না থাকলেও, আজও কোর্টে একজন পুলিশ কিংবা সাংবাদিক নৈরাজ্যবাদের কথা বললে ধরেই নেয় কোন এক ধরনের অপরাধের পক্ষে কথা বলা হচ্ছে। 

সংসদীয় ব্যবস্থার অধিকাংশ সমর্থক ইচ্ছা করেই সংসদীয় ব্যবস্থার সাথে প্রতিনিধিত্বমূলক উৎকৃষ্ট ব্যবস্থাস্বরূপ গণতন্ত্রকে গুলিয়ে ফেলে, যেন যথাযথ প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই উপস্থিত রয়েছে। এ কারণেই কট্টর সংসদীয় দৃষ্টিভঙ্গি অগণতান্ত্রিক, যেহেতু সেখানে ধরে নেওয়া হয় কয়েকশ মানুষ সারা দেশের সকল মানুষের জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে। 

‘সমাজতন্ত্রের’ ধারণার রুশিকরণ এবং সংসদীয় চর্চা ও গণতন্ত্র থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার ফলে সমাজ-গণতান্ত্রিকেরা মনে করার সুযোগ পেয়েছে যে, যারা বিপ্লবের কথা বলে তারা মূলত স্বৈরতন্ত্রের পক্ষেই কথা বলছে। নৈরাজ্যবাদীদের আর যাই হোক কোনভাবেই একনায়ক হয়ে ওঠার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে না (যদিও মুর্খ কিছু সাংবাদিক তা মাঝেমধ্যেই করে থাকে), তাই একমাত্র উপায় হচ্ছে তাদেরকে ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা এবং সে কারণে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল গোটা শ্রম আন্দোলনগুলোকেই কলঙ্কিত করে ফেলতে পেরেছে। এমন চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ধার করে এবং তাদের রচিত ‘অপরাধী-সিন্ডিকালবাদ’ আইন রচনা করে যা ছিল ফ্যাসিবাদী দেশগুলো প্রণীত আইনের সদৃশ। 

মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদীদের মতো সমাজ-গণতন্ত্রীরাও মুখ ফুটে বলতে পারে না যে, নৈরাজ্যবাদের সাথে তাদের মূল সমস্যা হচ্ছে, নৈরাজ্যবাদ ক্ষমতা ও শ্রেণি সুবিধার বিরুদ্ধে। প্রশ্ন করা হলে তারা খালি বলে যায় নৈরাজ্যবাদ ‘অসম্ভব’। তা যদি অসম্ভবই হয়, তাহলে নৈরাজ্যোবাদকে ভয় পাওয়ারই বা কারণ কী? কেনই-বা পর্তুগাল ও স্পেনের মতো দেশগুলোতে যখন স্বৈরাচার প্রতিরোধ করার একমাত্র উপায় ছিল নৈরাজ্যবাদ, তখন তারা কমিউনিস্ট পার্টিকে সমর্থন দিয়েছিল? স্পেনে, সোলাশিস্ট পার্টির উত্থানের আগ পর্যন্ত ব্রিটিশ লেবার পার্টি সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বাধীন অংশগুলোকে সমর্থন দিলেও নৈরাজ্যবাদীদের জন্য কিছুই করেনি। 

সর্বহারার একনায়কত্ব ‘সম্ভব’, বরং একটু বেশিই সম্ভব। যদি এমনটা ঘটে তা হবে সমাজতন্ত্রীদের শেষ দিন। কিন্তু যদি নৈরাজ্যবাদীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলে, তাহলে অন্ততসমাজতন্ত্রীরা তাদের বিকল্প তুলে ধরার সুযোগটুকু পাবে। তারা কেবল ভয় পায় যে, তাদের বিকল্প পুরোপুরি প্রত্যাখ্যাত হবে। কেই-বা রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র বেছে নিতে যাবে যদি তাদের রাষ্ট্রবিহীন সমাজতন্ত্রের সন্ধান দেওয়া হয়? 

পুঁজিবাদী বিশ্বে একজন সমাজ-গণতন্ত্রী বৈপ্লবিক পদ্ধতি এবং নৈরাজ্যবাদীদের ‘অধৈর্য্য’ ও ‘অপরাধপ্রবণোতার’ বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। কিন্তু একটি সমাজতান্ত্রিক জগতে, সমাজ-গণতন্ত্রও একই রকম ‘অপরাধপ্রবণ’ (হয়তো আরও বেশি), যেহেতু তারা এক সময়ে বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে আঁতাত করেছিল, যা আজ প্রমাণিত। ‘অধৈর্য্য’ হওয়ার অভিযোগ মেনে নেওয়া একটু কঠিন হয়ে যায় যখন আইনিভাবে পরিবর্তন সাধনের কোন উপায় অবশিষ্ট থাকে না এবং সংসদীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটানোর চিন্তা একটি স্বপন ছাড়া কিছুই না। সমাজ-গণতন্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করে যখন স্বৈরতন্ত্র বিজয় লাভ করে (যদি না তারা বিদেশি শক্তির কাছে সাহায্যের আবেদন জানাতে পারে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে যেমনটা হয়েছিল)। এই দৃষ্টিভঙ্গির দেওয়ার কিছু নেই। ফ্যাসিবাদ বা লেনিনবাদের বিরুদ্ধে তাদের কোন সংগ্রাম নেই কারণ এমনটা করার কোন সাংবিধানিক পদ্ধতি তাদের জানা নেই। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলোতে তারা কোনকিছুই ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারছিল না এবং শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল চাপ কমানোর জন্য খানিকটা উদারনৈতিকতাবাদের প্রচার করতে। এখন আমরা জানি এর প্রভাব কতোটা ভয়াবহ ছিল। তারপরেও নৈরাজ্যবাদ সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলোর ওপর বৈপ্লবিক আক্রমণ পরিচালনার পদ্ধতির সন্ধান দিয়ে এসেছে যা কেবল সমাজ-গণতন্ত্রীরা প্রত্যাখ্যানই করে না, তারা পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর সাথে জোট বেঁধে সেই আক্রমণ প্রতিহত করারও চেষ্টা করে। 

নৈরাজ্যবাদের প্রতি লিবারেল-গণতান্ত্রিক আপত্তি

লিবারেল গণতন্ত্র কিংবা অ-ফ্যাসিবাদী কট্টরপন্থা, সরাসরি নৈরাজ্যবাদের সমালোচনা করতে ভয় পায় কারণ এমনটা করলে লিবারেল-গণতন্ত্রের পুরো পুরো যুক্তিটাই নস্যাৎ হয়ে যাবে। ফলে তারা মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয় এবং নৈরাজ্যবাদীদের মার্ক্সবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে (এর ফলে নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমগ্র মার্ক্সীয় সমালোচনাটাই তারা উপেক্ষা করে যায়)। তাদের আক্রমণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নৈরাজ্যবাদী মার্ক্সবাদের সহিংস একটি ধারা কিংবা কট্টর মার্ক্সবাদ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা। 

প্রকৃত নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লিবারেল-গণতন্ত্রের কোন বক্তব্য নেই কারণ তারা নৈরাজ্যবাদের চিন্তাকে আত্মসমর্থনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে; তারা প্রতিনিয়ত ‘স্বাধীনতার’ কথা বললেও তাদের প্রায় সকল কাজই মানূষের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে ব্যস্ত। তারা ভান করে যে সংসদীয় চর্চা গণতন্ত্রের একটি রূপ, কিন্তু চাপে পড়লে আবার মাঝেমধ্যে স্বীকার করে নেয় যে এটি কোন গণতন্ত্রই না এবং প্রায়ই সেটিকে গণতান্ত্রিক করে তোলার উপায়ের সন্ধান করে। এটি নিঃসন্দেহে একটি একনায়কতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যেখানে সুষ্ঠু কিংবা দুর্নীতির মাধ্যমে নির্বাচিত কিছু মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়; পুরো বিষয়টি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় সংবিধানের অজুহাত তুলে। 

লিবারেল অর্থনীতি অনেকটা ডোডো পাখির মতোই বিলুপ্ত। যা দেখা যায় তা হয় বড় বড় ফার্মগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য, নয়তো রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। তবুও রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিনিয়ত মুক্তবাজার অর্থনীতির কতাহ বলে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়িক জগতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে না, কিন্তু ব্যবসায়ীদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতার ব্যাপারটি আবার তারা সবসময় মানতে চায় না। যদি সত্যিই মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচলন থাকে তাহলে মুদ্রা চলাচলে কোন ধরনের বাধা থাকারই কথা না। যদি সত্যিই আমাদের স্বাধীনতা থাকতো যেকোন উদ্রা বেছে নেওয়ার, তাহলে মুক্ত সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের সাথেই টিকে থাকতে পারতো এবং একটা পর্যায়ে পুঁজিবাদকে হটিয়ে দিতো। 

একবার যদি মুক্ত সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, অর্থাৎ যদি আমরা রাষ্ট্রের প্রতীকী মুদ্রা বর্জন করে নিজেদের মুদ্রা নির্ধারণ করা শুরু করি যেখানে শ্রমের প্রকৃত মুল্য বজায় থাকে, কে-ই বা শোষিত হতে চাইবে? কোন মুক্তবাজার অর্থনীতিবিদকে যদি একই সাথে রাজনীতিবিদের দায়িত্ব পালন করতে হতো তাহলে তিনি কোনভাবেই পরিস্থিতি এমন হতে দিতেন না। 

নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লিবারেল-গণতন্ত্রের একটি সাধারণ অভিযোগ ডানপন্থী রাজনীতি থেকে ধার করা। তা শুরু হয় সমাজতন্ত্রের (এইখানে রাষ্ট্রতন্ত্র) বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার মাধ্যমে। কিন্তু যদি রাষ্ট্র-বিরোধী সমাজতন্ত্র থেকে থাকে যা তার চেয়ে বেশিই ‘লিবারেল’, তখন সেটিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। যদি যদি সেরকম কোন সমাজতন্ত্র না থেকে থাকে, তাহলে নতুন আইন প্রণয়ন করে হলেও সেটিকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। 

এই বক্তব্যটি অবজ্ঞারও অযোগ্য; কিন্তু এই বক্তব্যই আশ্চর্যজনকভাবে গণমাধ্যমে, পুলিশ ও আইনি কাঠামোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। নৈরাজ্যবাদকে (নৈরাজ্যবাদী সংগঠন বাদ দিয়ে শুধু যদি আমরা আদর্শটির কথা ভাবি) কখনই অবৈধ ঘোষণা করা সম্ভব নয়, কারণ কেউ কাউকে বাধ্য করতে পারে না রাষ্ট্রকে ভালোবাসতে। এমনটা করা হয় রাষ্ট্রকে ‘দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করার মতো ভাঁওতাবাজির মাধ্যমে। 

লিবারেল-গণতন্ত্র নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোন যথাযথ, পূর্বানুমানহীন আপত্তি না তোলার একটা কারণ হলো এমনটা করলে তার নিজের মুখোশ খুলে যাবে এবং তার অন্তঃস্থ রাষ্ট্রবাদ ও কর্তৃত্বপরায়ণতা উন্মোচিত হয়ে পড়বে। বর্তমানে কট্টরপন্থীড়া নিজেদের সমাজতন্ত্রীদের চেয়ে বেশি স্বাধীনতাকামী ও উদার প্রতিপন্ন করার জন্য ‘লিবারেল’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড থেকে রাষ্ট্রকে দূরে সরিয়ে রাখা। নৈরাজ্যবাদীরা যখন দেখাতে সমর্থ হয় যে, একই সাথে সামাজিক ন্যায্যতা অর্জন এবং রাষ্ট্রকে উৎখাত করা সম্ভব, তখনই তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য শুনলে মনে হতে পারে যে তারা স্বাধীনতাকামী, কিন্তু নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাদের আপত্তি শুনলে বোঝা যায় যে, তারা আসলে কর্তৃত্ববাদী। এ কারণেই তারা কটাক্ষ, অপবাদ ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়, যা তাদের নৈরাজ্যবাদ বিরোধী কর্মকাণ্ডের অংশ এবং যা বিশ্বস্ত ভৃত্যের মতো গণমাধ্যমগুলো সমর্থন করে যায়। 

নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদের আপত্তি

আশ্চর্যজনকভাবে নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদী, লিবারেল কিংবা সমাজ-গণতান্ত্রিক আপত্তির চেয়ে ফ্যাসিবাদী আপত্তি তার বক্তব্যের জায়গায় তুলনামূলকভাবে সৎ। অন্যান্য দৃষ্টিভোংগিগুলো নৈরাজ্যের অধিকাংশ কিংবা কিছু চিন্তার সাথে একমত হলেও এর সম্ভাব্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে; কিন্তু ফ্যাসিবাদ মনে করে নৈরাজ্যবাদ সম্ভব এবং তারা সরাসরি ঘোষণা দেয় যে, নৈরাজ্যবাদ অনাকাঙ্ক্ষিত। 

ডানপন্থী কর্তৃত্ববাদ (যা ফ্যাসিবাদের থেকেও বিস্তৃত) সেসকল বিষয়েরই আরাধনা করে যেগুলো নৈরাজ্যবাদীরা ঘৃণা করে; বিশেষত রাষ্ট্র। ফ্যাসিবাদী তত্ত্বে রাষ্ট্রকে আদর্শায়িত করা হলেও অস্বীকার করা হয় না যে, একে ছাড়াও সবকিছু চালানো সম্ভব। কিন্তু সকল নাগরিকেরই দায়িত্ব রাষ্ট্রকে সমর্থন দেওয়া এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়া কিংবা একে নির্মূল করতে চাওয়ার দাবিকে ধরে নেওয়া হয় চূড়ান্ত অপরাধ হিসেবে। 

মাঝেমধ্যে রাষ্ট্রকে ‘কর্পোরেট জনগণ’ কিংবা ‘দেশ’ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয় এবং রাষ্ট্রকে তার আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর উর্ধ্বে একটি রহস্যাবৃত ধারণামণ্ডিত করার চেষ্টা করা হয়। সামরিক বাহিনীর শক্তি প্রদর্শন ও অবদমনকে আদর্শায়িত করা হয় (এমনটা ঘটে যখন জার্মান সম্রাট বলেছিলেন বৈশ্বিক শান্তি “কেবল একটি স্বপ্ন এবং তা ভালো কোন স্বপ্নও নয়”)। ডানপন্থী দেশপ্রেমের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ‘দেশ’ সম্পর্কিত একটি রসস্যমণ্ডিত অনুভূতি, যদিও নাৎসিদের মধ্যে প্রায়শই ‘জনগণের’ ধারণাকে আদর্শায়িত করার প্রবণতা দেখা গেছে (যদিও এই ‘জনগণের’ ধারণার সাথে জার্মান জাতীয়তাবাদের চেয়ে বর্ণবাদের প্রভাব বেশি), তারপরেও শেষ পর্যন্ত দেশের জমিকেই তারা পবিত্র মনে করে; এর ফলে উদ্ভটভাবে রাষ্ট্রের মিথ এক ধরনের যৌক্তিকতা খুঁজে পায়। একজন নৈরাজ্যবাদীর কাছে এর পুরোটাই আহাম্মকি ছাড়া কিছুই নয়। এই আহাম্মকির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা যায় যখন গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও যখন ফ্রাংকোর সমর্থকেরা জিব্রালটারের মতো একটা অনুর্বর পাথর দখল করাকে কেন্দ্র করে বহু স্প্যানীয়কে হত্যা করে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে জেনারেল মিলান দ্য আস্ত্রে, যিনি সকল ‘খারাপ স্প্যানীয়কে’ মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন এবং একটি একতাবদ্ধ স্পেন নির্মাণের লক্ষ্যে সকল কাতালান ও বাস্ক জনগোষ্ঠীর সকল মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছিলেন। এভাবে যেন তিনি (উনামুনোর ভাষায়) স্পেনকে “তার নিজের মতোই এক-চোখা, এক-হাতওয়ালা” বানিয়ে ফেলতে চেয়েছেন।  

নৈরাজ্যবাদকে ফ্যাসিবাদীরা স্পষ্টতই একটি প্রত্যক্ষ বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করে, কোন দার্শনিক বিপদ হিসেবে নয়। কেবল নৈরাজ্যবাদীদের ডাইরেক্ট অ্যাকশন নয়, বরং স্বয়ং নৈরাজ্যবাদী আদর্শই তাদের কাছে ভয়ংকর শঞকার বিষয়। ‘গণতান্ত্রিক’ সংবাদ মাধ্যমগুলো অবশেষে ফ্যাসিবাদী চিন্তার এই দিকগুলো নিজেদের করে নিতে পেরেছে এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিভিন্ন বিষয়কে তারা ‘সংবাদ’ হিসেবে উপস্থাপন করে। হিটলার তার তৈরি করা রাষ্ট্রকে সহস্ব বর্ষজীবী ভাবতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি জানতেন এই রাষ্ট্রকে ধ্বংস কিংবা প্রত্যাখ্যানও করা যায়। তার এই চিরজীবীতার ধারণা ছিল একটি বিপদ এবং একদিকে যখন তিনি রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের মতো সর্বগ্রাসী প্রতিপক্ষের দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলেন (যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিলে একটি বিরাট সামরিক শক্তি), ‘বিশ্ব নাগরিকতার’ ধারণার ওপর তার আক্রমণ নৈরাজ্যবাদ-বিরোধী চিন্তারই প্রতিফলন ঘটায়। 

‘বিশ্ব নাগরিকতা’ ও ‘রাষ্ট্রহীনতা’ এই দুটি ধারণাকে নাৎসিরা ইহুদিদের সাথে সম্পর্কিত দুটি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল; যদিও হিটলার পরবর্তী সময়ে ইহুদিদেরই একটা অংশ জাতীয়তাবাদ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। নাৎসিদের প্রণীত ‘ইহুদি কর্তৃত্বের’ ধারণার সাথে ‘নৈরাজ্যবাদ দ্বারা কর্তৃত্ব, নৈতিকতা ও নিয়মতান্ত্রিকতার ধ্বংসের’ ধারণার মধ্যে মিল ছিল। এর কারণ ফ্যাসিবাদ মনে করে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একটি খারাপ জিনিস এবং কেবলমাত্র জাতীয় স্বাধীনতাই অনুমোদনযোগ্য। হিটলারের ভাষণের (যা মাঝেমধ্যেই ছিল বিভ্রান্তিকর, কারণ জনমতকে নিজের দিকে নেওয়ার জন্য সে কোন সঙ্গতি ছাড়াই এক কথা থেকে অন্য কথায় চলে যেতো) কোন অর্থ যদি কেউ উদ্ঘাটন করতে পারে, তাহলে দেখা যাবে হিটলার মনে করতো, একটা দেশ ‘নৈরাজ্যে ডুবে গেলে’ (অর্থাৎ রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হলে) তা বিশৃঙ্খলার রূপ নিবে, যা জনগণের স্বার্থ হাসিলের বদলে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকেই সহজতর করে তুলবে। 

প্রোপাগান্ডার স্বার্থে ও নৈরাজ্যবাদকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে হিটলার রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র এবং নৈরাজ্যবাদকে গুলিয়ে ফেলেননি (যা ফ্রাংকো ইচ্ছা করেই করেছিল)। তিনি সমাজতন্ত্রকে ‘ইহুদিদের কর্তৃত্বের’ সমার্থক হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন এবং (প্রাথমিক পর্যায়ের নাৎসি চিন্তায়) প্রতিনিয়ত বলার চেষ্টা করে গেছেন, জার্মানরা জাতিগতভাবে বিশুদ্ধ এবং ইহুদিরা তাদের ওপর কর্তৃত্ব করবে যেভাবে প্রাচীন স্পার্টায় ক্রীতদাসদের সাথে করা হতো। 

একটি বিশুদ্ধ রক্তের ‘মনিব জাতি’ বা মাস্টার রেসকে জার্মানির দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে এবং তার মাধ্যমেই সম্ভব প্রতিপক্ষকে পদদলিত করা। যদি কোনভাবে স্বাধীনতা দেওয়া হয় তাহলে এই ক্রীতদাসসুলভ মানুষেরা নৈরাজ্যের দিকে ফিরে যাবে, ঠিক যেভাবে ফ্রান্সের বর্ণগতভাবে নিকৃষ্ট কেল্ট জাতি তাদের নর্ম্যান নর্ডিক মনিবদের হটিয়ে দিয়েছিল (এই বর্ণনা পাওয়া যায় হিউস্টন চেম্বারলেইন রচিত ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস থেকে)। পরবর্তীতে যখন নাৎসিবাদ একটি বৃহদাকার রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় তখন জার্মানদের জাতির উৎকৃষ্টতার চিন্তাটি সামনে নিয়ে আসা তাদের কাছে অধিক সমীচীন মনে হয়েছিল। কিন্তু এটি আসল নাৎসি দর্শন ছিল না, এমনকি নাৎসি নেতারাও ব্যক্তিগতভাবে তা বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু জনসমক্ষে এটা ার বলা সম্ভব হচ্ছিল না যে, তাদের অবস্থা প্রাচীন স্পার্টার ক্রীতদাসদের মতো। অন্তত যতোক্ষণ না তাদের ক্ষমতা গ্রহণ সম্পূর্ণ হচ্ছে। একটি পুরো জাতি যে ক্রীতদাস হয়ে জন্মাতে পারে এমন ধারণার মতো নৈরাজ্যবাদ বিরোধী চিন্তা আর কীই-বা  হতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে তা ছিল অসম্ভব।

নাৎসি প্রোপাগান্ডা বর্তমানের সংবাদপত্রে নতুন রূপ ধারণ করেছে। এমনটাও বলতে শোনা যায় যে, দেশ যদি নৈরাজ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তাহলে হয় সমাজতন্ত্রীদের উত্থান ঘটবে নয়তো ডানপন্থী একনায়কতন্ত্র আবির্ভূত হবে। 

নৈরাজ্যবাদের প্রতি ফ্যাসিবাদের আপত্তিকে যদি সংক্ষেপে বলা যায়: রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটানো অস্মভব কিছু নয়; কিন্তু যদি তা ঘটে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়, তাহলে যারা ‘বৈশিষ্ট্যগতভাবেই’ উন্নত জাতির আজ্ঞাবহ হতে চায়, তারা পুনরায় মনিব খোঁজা শুরু করবে। তাদের মধ্যে ‘কঠোর শাসনের’ প্রতি এক ধরনের নস্টালজিয়া কাজ করবে। 

নাৎসি চিন্তায়, কঠোর শাসন আসতে পারে কেবল বিশুদ্ধ রক্তের উন্নত জাতি বা মাস্টার রেসের মাধ্যমে। সেই জাতির মনিবেরা হবে নির্মাণক্ষম (যেমন তথাকথিত আর্য জাতি) এবং যে জাতির ‘ভূমির’ সাথে কোন সংযোগ নেই তাদের ক্ষমতা গ্রহণ ধ্বংস ছাড়া কিছুই ডেকে আনবে না। 

অন্যান্য ধরনের ফ্যাসিবাদী চিন্তায় বলা হয়, মানুষকে স্বাধীনতা দিলে সে তার দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ ভুলে যাবে এবং দেশের মাহাত্ম্য লঙ্ঘিত হবে। এমন চিন্তা ছিল মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের ভিত্তি। এক অর্থে তা সত্য কারণ তার কাছে দেশ হচ্ছে রাষ্ট্রের সমার্থক এবং মাহাত্ম্যের অর্থ হচ্ছে সামরিক শক্তির বিকাশ। ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে অকপট রূপ সম্ভবত স্পেনে দেখা দিয়েছিল যা স্পষ্টতই নৃশংসভাবে শ্রেণি স্বার্থ রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছিল এবং নৈরাজ্যবাদের সকল বিরোধিতার উদ্দেশ্যই ছিল শ্রমিক শ্রেণিকে অবদমিত করে রাখা। প্রয়োজন হলে শ্রমজীবী শ্রেণিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মাধ্যমে নৈরাজ্যবাদকে দমন করা হয়েছিল। 

এমনটা সকল রাজনৈতিক দর্শোনের ক্ষত্রেই সত্য, ফ্যাসিবাদ কেবল এই ব্যাপারে কোন রাখঢাক করে না। নৈরাজ্যবাদের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ বরং আরও স্পষ্টভাবে নিজের চরিত্র তুলে ধরে। 

শিল্পী: আঁদ্রে মেসোঁ

নৈরাজ্যবাদের ব্যাপারে একজন সাধারাণ মানুষের আপত্তি

মোটাদাগে দেখতে গেলে, একজন সাধারণ মানুষ নৈরাজ্যবাদের ব্যাপারে তার আপত্তির খোরাক সংগ্রহ করে গণমাধ্যম থেকে, যেই গণমাধ্যমে সবসময়ই প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর নিয়ন্ত্রণাধীন। দীর্ঘ সময় যাবত গণমাধ্যমে নৈরাজ্যোবাদ সম্পর্কে কিছু বলাই নিষেধ ছিল এবং ১৯৬০ এর দশকে এসে মার্ক্সবাদের সাথে তাকে একত্রিত করে জনগণের সামনে তুলে ধরার একটা চেষ্টা চলেছিল, যাতে একটির আলোচনা উঠলে অপরটিও আলোচিত হয় এবং তা করতে গিয়ে মানুষ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ১৯৬০ এর দশকের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে নৈরাজ্যবাদীদের মার্ক্সবাদী এবং মার্ক্সবাদীদের নৈরাজ্যবাদী হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। মাঝেমধ্যে জাতীয়তাবাদীদেরও নৈরাজ্যবাদী হিসেবে পরিচয় দেওয়া হতো। গণমাধ্যমে কেউ যদি নিজেকে নৈরাজ্যবাদী বলতো তা সাধারাণত হতো কোন অপরাধের স্বীকারোক্তি প্রদানের সময়ে। আমরা দেখেছি, এমনটা ঘটা লিবারেল-গণতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য। তবে এর মধ্যে একটি তীব্র ফ্যাসিবাদী প্রবণতা প্রচ্ছন্নভাবে বিদ্যমান। এই কারণে সংবাদ মাধ্যোমগুলো ‘স্বঘোষিত নৈরাজ্যবাদী’ কথাটির প্রচলন করে যাতে একজন প্রকৃত নৈরাজ্যবাদী থেকে নৈরাজ্যবাদের তকমা চাপিয়ে দেওয়া ব্যক্তিকে আলাদা করা যায়। 

অবস্থা খানিকটা পালটেছে; যার পেছনে রয়েছে নৈরাজ্যবাদের বাণিজ্যিকীকরণ, যা ঘটেছে সঙ্গীতের বাণিজ্যিকীকরণ এবং দর্শনশাস্ত্রের একাডেমিক অপব্যবহারের মধ্য দিয়ে। এর ফলে উদ্ভব ঘটে নৈরাজ্যবাদীর একটি মধ্যবিত্ত লিবারেল সংস্করণের যাকে দেখা হয় একজন উদার দার্শনিক, নিরীহ খ্যাপাটে ব্যক্তি, বিশ্ববিদ্যালয় ড্রপ-আউট, কিংবা উদ্ভট পোশাক পরা একজন মানুষ হিসেবে। 

প্রতিনিয়ত জনপ্রিয় হতে থাকা এমন চিন্তার বিপরীতে একজন সাধারণ মানুষ নৈরাজ্যবাদের ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে থাকে, যা পুলিশবাহিনী ও অন্যান্যরাও করে। মাঝেমধ্যে তারা বিষয়টি ‘বিপ্লবী’ শব্দটির সাথে মিলিয়ে ফেলে এবং একটা পর্যায়ে ভাবা শুরু করে সকল প্রতিবাদীই বোধ হয় নৈরাজ্যবাদী। এমন অজ্ঞতা সাধারণ মানুষের চেয়ে সাংবাদিকদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। 

যখন প্রকৃত নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলার প্রসঙ্গ আসে, তখন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তেমন মারাত্মক কোন আপত্তির সন্ধান পাওয়া যায় না। নৈরাজ্যবাদের ইতিবাচক দিকগুলোর কথা বললে হয়তো তারা সেটার বাস্তবায়নযোগ্যতা অনুমান করতে পারে না, কিন্তু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি (যেমন, রাষ্ট্র ও শাসকগোষ্ঠীর স্বৈরতন্ত্রের কথা) থেকে একই বক্তব্য উপস্থাপন করলে তারা তা সহজেই ধরতে পারে। আমরা কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক দল, অথর্ব রাজনীতিবিদদের হাত থেকে নিস্তার পেতে পারি এমন ধারণা সহজেই যে কাউকে আপ্লুত করে তুলবে। মূল আপত্তির জায়গাটা হলো সবাই নিজের জীবন নিয়ে ও জীবনের শান্তি নিয়ে চিন্তিত; তাই তারা সহজে একটি মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের সাথে টক্কর দিতে চায় না কিংবা সে সংগ্রামটা করার যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে চায় না। তার ওপর পুঁজিবাদের চাকচিক্য ও মোহ তো আছেই। রাষ্ট্র যতোক্ষণ না মানুষের রক্তের শেষ বিন্দুটুকুও শুষে নিতে চায়, ততোক্ষণ অধিকাংশেরই বোধোদয় হয় না। কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায় এবং ঘৃণার বদলে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রও ‘দেশ’ হয়ে ওঠার মুখোশ পরে ফেলে। 

নৈরাজ্যবাদের প্রান্তিকীকরণ

রাষ্ট্রীয় অপপ্রচার নৈরাজ্যবাদকে প্রান্তিক করে তুলতে তুলতে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য যতোটা শ্রম দিয়ে থাকে, অন্য কোন রাজনৈতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে তা করে না। সাংবাদিক, অধ্যাপক, গবেষকসহ প্রায় সবাইই নৈরাজ্যবাদ ও নৈরাজ্যবাদী বলতে কী বোঝায় সে ব্যাপারে বিভ্রান্ত থাকে। নৈরাজ্যবাদী বলতে তারা বোঝে ড্রপ-আউট, নেশাগ্রস্ত, জাতীয়তাবাদী আততায়ী, নতুন যুগের পরিব্রাজক, রাজনৈতিক বিরুদ্ধ মতপোষণকারী, আগ্রাসী ট্রেড ইউনিয়নবাদী, তরুণ বিদ্রোহী, মধ্যবিত্ত তাত্ত্বিক, স্বপ্নবাজ মানুষ, কমেডিয়ান, হতাশাগ্রস্ত সংস্কারবাদী, কট্টর শান্তিবাদী, খুনী, অপরাধী ইত্যাদি। একজন নৈরাজ্যবাদী এর যেকোন একটা হতেই পারেন, কিন্তু কোনভাবেই এর সবগুলো নয়। ‘নৈরাজ্যবাদী’ শব্দটির অপব্যবহার, কিংবা এর সাথে ‘স্ব-ঘোষিত’ বা ‘তথাকথিত’ জাতীয় শব্দ জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে নৈরাজ্যবাদকে প্রতিনিয়তই প্রান্তের দিকে ঠেলে দেওয়া হতে থাকে। এর বিপরীতে রাষ্ট্র প্রণোদিত তত্ত্বসমূহকে স্বাভাবিক মনে হওয়া শুরু হয়। 

আনন্দ অন্তঃলীন

আলোকচিত্রী, প্রাবন্ধিক, ও অনুবাদক। নৃবিজ্ঞানে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা সমাপ্ত। প্রথম একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজিত ২০২২ সালে৷ প্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ - 'একটি নৈরাজ্যবাদী নৃবিজ্ঞানের খণ্ডচিত্র' (২০২২); 'শাসকবিহীন জনগোষ্ঠী: নৈরাজ্যের নৃবিজ্ঞান' (২০২৩); 'ওভারটাইম: কেন আমাদের সংক্ষেপিত কর্মসপ্তাহ প্রয়োজন' (২০২৩)।