অরাজ
আর্টওয়ার্ক: ইউ এস পলিটিকস শিল্পী: জিনা স্যান্ডার্স সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » সাশা আব্রামস্কি ।। হংকং থেকে কাশ্মীর থেকে আমেরিকা: কর্তৃত্ববাদের উত্থান

সাশা আব্রামস্কি ।। হংকং থেকে কাশ্মীর থেকে আমেরিকা: কর্তৃত্ববাদের উত্থান

  • অনুবাদ: তৌকির হোসেন

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক  ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়ে কর্তৃত্ববাদের ছবি স্পষ্টভাবে আমাদের চোখের সামনে ধরা পড়ছে। বিশ্বের রাজনীতি দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এর সাথে রাজনৈতিক ডিসকোর্স এক ধরনের বিপদজনক রূপ ধারণ করছে।

আর্টওয়ার্ক: ডিভারিং টার্কি
শিল্পী: এন্তানিও রদ্রিগেজ
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

তুরস্কের রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের ক্ষমতাসীন দল তাদের বই পুড়ানোর কর্মকান্ড গর্বের সাথে প্রচার করে যাচ্ছে। ২০১৬ সাল থেকেই ক্ষমতাসীন দলটি বিরোধী পক্ষের সমস্ত প্রকার লেখাপত্র, বইপুস্তক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়ার জন্যে সরানো এইসব বইয়ের সংখ্যা হতবাক করে দেওয়ার মতো— তিন লাখেরও বেশি।

চীনের হংকং-এ অপরাধী প্রত্যর্পণ বিল ঘিরে দেশটির মানুষজনের বিক্ষোভ দমন করতে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা আরও কঠোর হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের গ্যাং তৈরি করা হয়েছে। যারা কেন্দ্রীয় সরকারের ইশারায় বিক্ষোভকারীদের উপর হামলে পড়েছে, পিটিয়েছে, আহত করেছে। এর পরপরই পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যাতে দেখানো হয়েছে কিভাবে নগরের বিক্ষোভ দমন করার জন্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের রিপোর্টে এও সন্দেহ করা হচ্ছে, চীনা সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ হংকং এর সীমান্তে জমায়েত হচ্ছিলো, যাতে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের উপর অপারেশন চালনা করা যায়; যদিও এই রিপোর্টগুলো নির্ভুল কতটুকু তা নিয়ে এখনও অস্পষ্টতা বিদ্যমান।

আর্টওয়ার্ক: নো টু এক্ট্রডিশন
শিল্পী: জাচারি বোরোমেও
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

এরই মধ্যে ভারতের জাতীয়তাবাদী সরকার একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশটির উত্তরের জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে যে সাংবিধানিক বন্দোবস্ত ছিলো তা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অনুযায়ী, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার ফলে, কাশ্মীর এর আগে যে ধরনের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত স্বাধীনতা এবং ভূমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করত তা একেবারে লোপ করে দেওয়া হয়েছে। এর আগের আইনের বলে কাশ্মীর ভূখন্ডের জমি বাইরের মানুষ কিনতে পারতো না। নতুন আইনের মাধ্যমে তা পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে কাশ্মীর এখন অন্যান্য ভারতীয় অঙ্গরাজ্যের মতই— মর্যাদাহীন।

এর পিছনে অবশ্য একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ রাজের অবসান হওয়ার পর ভারতীয় উপমহাদেশ পাকিস্তান ও ভারত এই দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। তখন মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু-কাশ্মীর এলাকা হিন্দু রাজার অধীনে শাসিত ছিলো, তারই সিদ্ধান্তে জম্মু-কাশ্মীর স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভোট দেয়। এ নিয়ে পাকিস্তান ও ভারত প্রক্সি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এই যুদ্ধ সরাসরি প্রত্যক্ষ যুদ্ধে রূপ নেয়। যার ফলাফল এই রাজ্যকে ঘিরে বিভিন্ন সময়ের যুদ্ধ— রক্ত, হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞের সিলসিলা। এবং এটির একটি অস্পষ্ট সমাধানও তখন হাজির করা হয়— কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং এলাকাটিকে এমন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ দেওয়া, যা অন্য কোন অঙ্গরাজ্য ভোগ করে না। যদিও হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এই সমাধানকে কখনোই মনেপ্রাণে মেনে নেয়নি, তবুও ভারতের অসাম্প্রদায়িকতা এবং বহু-জাতিত্বের উদাহরণ হিসেবে এটি তাদের দেখতে হয়েছিলো।

আর্টওয়ার্ক: ন্যাশনালিজম
শিল্পী: সোহম সেন
সূত্র: দ্য প্রিন্ট

হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতা, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই বিষয়ে অনেকদিন ধরে চলে আসা একটি সাংবিধানিক সুরক্ষা বানচালের লক্ষ্যে হাত দিয়েছেন। রাতারাতি এই মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হয়ে পড়ে সরকারের অধীনে রক্ষিত একটি কার্যত অঞ্চল। ফোন-ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ, আঞ্চলিক রাজনৈতিক মানুষজনকে ঘরের মধ্যেই গ্রেফতার, কারফিউ জারি, প্রতিরোধ-প্রতিবাদের যেকোন প্রতিবেদন শক্তির সাহায্যে দমনসহ সকল পদক্ষেপ নিতে মোদী সরকার দ্বিধা করছে না।

একই সময়ে, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ার বলসোনারো পুলিশ এবং স্থানীয় নজরদারি কমিটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, রাস্তাঘাটে অপরাধী পেলেই যেন আরশোলার মত পিষে মারা হয়; যারা এরকম অপরাধী দমনে অংশ নিবে তাদের আইনের আওতায় নেওয়া হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন। পত্রপত্রিকার বরাতে এও জানা যাচ্ছে, তিনি আমাজন বনভূমির গাছ কাটা ও ভূমিখননে বিধিনিষেধ যথাসম্ভব শিথিল করেছেন যার ফলস্বরূপ গাছ আরও দ্রুত হারে কমছে, বন ধ্বংস হচ্ছে।

আর্টওয়ার্ক: প্রে ফর আমাজন
এজানিয়া: সৌসা ম্যাকান্দো
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

এইতো কিছুদিন আগেও এই ধরনের সকল কর্মকাণ্ড এবং এর বৃহত্তর গল্পটির সম্পূর্ণ দায়ভার চাপানো হতো হোয়াইট হাউজের রাজনৈতিক ব্যর্থতার উপর। এমন না যে ওয়াশিংটনের গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকারের প্রতি আলাদা দায়বদ্ধতা রয়েছে বরং একটা লম্বা সময় ধরে আমেরিকার প্রভাব আন্তর্জাতিক পটভূমিতে আবশ্যিক ছিলো। আর  আমেরিকার কাছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্থিতিশীলতার মানে ছিলো- নিজেদের স্বার্থ ঠিক রাখা। এখন ওই অবস্থা নেই। এখন আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি, সামরিক আমলাতন্ত্রের পুরোটারই নেতৃত্ব রয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প, জন বোল্টন, মাইক পম্পেইদের মত মানুষের হাতে। যাদের কাছে দেশকে একে অপরের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আমেরিকান কর্তৃত্ব বজায় রাখাটাই গুরুত্বপূর্ণ, যাদের কাছে পররাষ্ট্রনীতিতে দূরদর্শী চিন্তা না করলেও চলে, যাদের বক্তব্য মানবাধিকারের ভাষার রাস্তা এড়িয়ে চলে, একে অন্যকে আক্রমণ, গালিগালাজই যাদের কাছে সম্পর্ক তৈরির মূল অস্ত্র।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই আকারে-ইঙ্গিতে  বলসোনারোকে আদর্শিক মিত্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন, আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদীকেও সমর্থন দিয়ে গেছেন। এর ফলে উপমহাদেশের পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলোর সম্পর্কের আগুনে আরেক দফা ঘি ছিটানো গেলো।

মনে হতে পারে, আমেরিকার অবস্থান বিশ্বের পরাশক্তিদের বিপক্ষে। আসলে তা নয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট খুব ভালোভাবেই এই পরাশক্তিদের একটি অংশ। যে কিনা নিজের ভাবমূর্তি তৈরিকরণেই সবচেয়ে বেশি আগ্রহ। এল পাসো শুটিং স্পটে গিয়ে যার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নিজের র‍্যালিতে মানুষের সংখ্যা কত সেটা নিয়ে গর্ব করতে, প্রতিপক্ষকে বাক্যবাণে ধরাশায়ী করতে তার দক্ষতা কতটুকু সেই আলাপে মনোযোগী হতে।

এরূপ পরিস্থিতিতে আমেরিকা অন্যান্য দেশগুলোর সংকটে অর্থপূর্ণ কোন অবস্থান নিবে এরকম আশা করা বৃথা। এবং যতই আমেরিকার শক্তি এইদিক থেকে হ্রাস পাচ্ছে, ততই এই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক খেলার মাঠে এক ধরণের শূন্যতা বেড়ে যাচ্ছে। এই শূন্যতা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কর্তৃত্ববাদী জাগরণ দ্রুতই পূরণ করে ফেলছে। এর ফলাফল— যত সম্ভাব্য একনায়কবাদী, কর্তৃত্ববাদী, জনতুষ্টিকারী দল আছে, যাদের একমাত্র লক্ষ্য সর্বোচ্চ ক্ষমতার দখল— তাদের ক্রমাগত উত্থান।

অসংখ্য একনায়কতন্ত্র কখনো একসাথে সুখেশান্তিতে বসবাস করতে পারে না। নরেন্দ্র মোদি সংবিধান থেকে অনুচ্ছেদ ৩৭০ মুছে দিয়ে কিছু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে এগিয়ে থাকলেও এমন না যে পাকিস্তান এইক্ষেত্রে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। তারা ওই অঞ্চলের বিদ্রোহীদের আরও ফুসলিয়ে দ্বন্দ্বকে আরও গভীরতর করে তুলতে পারে৷ চীন, হংকং এর উপর চাপ প্রয়োগ করে হয়তো আনন্দ পেতে পারে; কিন্তু দিনশেষে যদি ভাবা হয় আমেরিকা, ভারত, রাশিয়া কিংবা জাপান চীনের এই ভূরাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে একেবারেই আমলে নিবে না— তা বোধহয় ভুল হবে। তুরস্ক— যাকে সবসময়ই ভাবা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সংগঠিত জোটসমূহ থেকে দূরে থাকা, অটোমান সাম্রাজ্যের নস্টালজিয়ায় ভুগতে থাকা একটি দেশ— যখন রাশিয়া কিংবা বলসোরানোর সাথে পাল্লা দিতে থাকবে তখন এই পাল্লা দেওয়া-নেওয়া ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে। অভ্যন্তরীণ গণ্ডগোল তো আছেই, এর সাথে যুক্ত হতে পারে পরিবেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এমতাবস্থায়, অন্যান্য দেশসমূহ একযোগে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কিংবা বয়কট জারি করলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আর্টওয়ার্ক: ইনাগুরেশন ডে
শিল্পী: লুকা গ্যারোনজি
সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট

ট্রাম্প এই সব ঘটনার কিরকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এবং দেখাননি তা আমরা ভালো করেই দেখতে পাই। একদিকে একনায়ক সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে মিষ্টি আলাপ করে যাচ্ছেন, অন্যদিকে মেজাজের সাথে অন্যান্য একনায়কদের নাশকতামূলক হুমকিধামকি দিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক হুমকি দিয়ে গেছেন, তুরস্কের অর্থনীতি ধ্বংস করার শাসানিও দিয়েছেন। এরকম আচরণ আসলে ভালো কোন নেতার বৈশিষ্ট্য না বরং এরকম নেতা কেবল নিজের মেজাজ-মর্জি এবং অনুমানের উপরই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

তবে ভবিষ্যতে কী হবে তা আমরা কেউই বলতে পারি না। আবার স্রোত যা দেখায় তাও খুব সুখকর না। একনায়কতন্ত্র সবসময়ই সংকীর্ণ, ক্ষণস্থায়ী, জাতীয়বাদী স্বার্থোদ্ধারের জন্যে মারাত্মক সাংষ্কৃতিক, রাজনৈতিক ক্ষতি করে গেছে এবং এসবের জন্যে সামরিক কৌশলের সাহায্য নিতেও দ্বিধাবোধ করে নি৷ শেষে গিয়ে একনায়কতন্ত্র অন্যান্য সহিংসতার মতোই বিভিন্ন শাসকের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় গিয়ে ঠেকে। বর্তমান বিশ্বের একনায়করা যে একই আচরণ করবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

হদিস:

ইংরেজি লেখাটি ট্রুথআউট ডট অর্গে প্রথম প্রকাশ হয়েছিলো ১৩ই আগস্ট, ২০১৯। লেখাটির লিংকঃ https://truthout.org/articles/from-hong-kong-to-kashmir-to-the-us-authoritarianism-is-rising/)

সাশা আব্রামস্কি: ব্রিটিশ ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার খন্ডকালীন প্রভাষক। দ্য ন্যাশন, দ্য আটলান্টিক মান্থলি, নিউইয়র্ক ম্যাগাজিন, রোলিং স্টোনসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে রাজনীতি, দর্শন এবং অর্থনীতিতে স্নাতক এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে স্কুল অফ জার্নালিজমে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: দ্য আমেরিকান ওয়ে অফ পোভার্টি (২০১৩), ইনসাইড ওবামা’স ব্রেইন (২০০৯), আমেরিকান ফিউরিজ (২০০৭) ইত্যাদি।

তৌকির হোসেন