অরাজ
আর্ট্ওয়ার্ক: দ্য পা্ওয়ার অব ট্রুথ সিরিজ সূত্র: চাইনা ডেইলি
প্রচ্ছদ » সাউল নিউম্যান ।। মার্ক্সবাদ ও ক্ষমতা প্রশ্ন

সাউল নিউম্যান ।। মার্ক্সবাদ ও ক্ষমতা প্রশ্ন

অনুবাদ: তৌকির হোসেন

(প্রথম অংশ)
মার্ক্সিজম এবং এনার্কিজমের মধ্যকার যে বিতর্ক, তা ঊনবিংশ শতাব্দীর র‍্যাডিকাল রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিলো। এনার্কিস্ট মিখাইল বাকুনিন ছিলেন মার্ক্সের অন্যতম দুর্দান্ত সমালোচক, যার বিরুদ্ধ মত প্রথম আন্তর্জাতিকে বিভক্তি পর্যন্ত টেনেছিল। এই দুই বিপ্লবী শক্তির মধ্যকার যে বিতর্ক তা আজকের দিনেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এই আলোচনা মার্ক্সিজম এবং এনার্কিজমের মধ্যকার সকল তর্ক-বিতর্ক নিয়ে না বরং আধিপত্য, ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব— সংক্রান্ত বিতর্কের সাহায্যে বর্তমান রাজনৈতিক তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি মোকাবেলা করবে। বিভিন্ন ঘরানার তাত্ত্বিক, এক্টিভিস্টগণ প্রায় সময়ই নিজেদের মধ্যে আলোচনায় থাকেন কিভাবে এমন একটা বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন অর্জন করা যাবে, যেই বিপ্লবের ধারণার সাথে কর্তৃত্ব কিংবা শাসনের ইঙ্গিত যুক্ত থাকবে না। সাম্প্রতিক কম্যুনিজমের ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্ট অন্তত আর কিছু না হলেও, বিপ্লবের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার চর্চার পথ যে আরও সুগম করা যায় সেই বিষয়ে আমাদের সতর্ক করে দেয়। ইতিহাসের অন্যতম মুক্তিকামী আন্দোলনটিও দিনশেষে যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলো সেইগুলোকেই পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিল। মিশেল ফুকোর মতে এক অর্থে যা ছিলো কেবল গার্ডের পরিবর্তন।

আর্ট্ওয়ার্ক: দ্য পা্ওয়ার অব ট্রুথ সিরিজ
সূত্র: চাইনা ডেইলি

যদিও রাশিয়ার বিপ্লব পুরোপুরি মার্ক্সের তত্ত্বকে প্রতিনিধিত্ব করে না। যারা বলে থাকেন— বলশেভিক বিপ্লব কোন সত্যিকার মার্ক্সিস্ট বিপ্লব না, তাদের অভিযোগও আমাদের আমলে নিতে হবে। এবং মার্ক্স নিজেও সম্ভবত কবরের মধ্যে নড়াচড়া করে উঠেছিলেন এই বিপ্লবের ধরনধারণ দেখে। মার্ক্সিজম এবং এনার্কিস্ট ক্রিটিকগুলো আমরা তাদের মতো করেই তত্ত্বের আতশীতে বিচার করব। মার্ক্স, এঙ্গেলস কিংবা ক্লাসিকাল মার্ক্সিস্টদের আলাপ আলোচনাতেই আমরা আটকে থাকব না, বর্তমান সময়ের মার্ক্সিস্ট/এনার্কিস্ট চিন্তকদের নিয়েও আমরা কথা বলব। মার্ক্সিজম এবং এনার্কিজমের মধ্যকার বিতর্ক ক্ষমতা, আধিপত্য এবং কর্তৃত্বের ধারণা ঘিরে আবর্তিত হয়। এর সাথে অবধারিতভাবে চলে আসে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার ব্যাপারটি। মার্ক্সিস্ট এবং এনার্কিস্ট  উভয়ের কাছেই রাষ্ট্র— ব্যক্তি স্বাধীনতার পরম শত্রু । মার্ক্স এবং এঙ্গেলস উভয়েই রাষ্ট্রকে বিচার করেছেন একটি অস্ত্র হিসাবে যার মাধ্যমে এক অর্থনৈতিক শ্রেণি অন্য শ্রেণির উপর প্রভাব খাটায়, আধিপত্য বিস্তার করে। তাহলে রাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে এমন একটা জিনিস যা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই জায়গায় মার্ক্স খুব সোজাসাপ্টা না। তিনি সব জায়গায় খাটে— এরকম আলাদা কোন রাষ্ট্রের ধারণা দিয়ে যান নাই। তিনি কিছু কিছু সময় রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক, শ্রেণি শাসনের অস্ত্র হিসাবে দেখেছেন আবার কিছু সময় একে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছেন যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বুর্জোয়াদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। রাষ্ট্রের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিধি কতটুকু তা মার্ক্স-এনার্কিস্ট বিতর্কের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং তা নিয়ে আরও বিশদভাবে আমরা আগাব।

ফ্রেডরিখ হেগেল
১৭৭০–১৮৩১
পোট্রেট: স্কলেসিঙ্গার
সূত্র: উইকিপিডিয়া

মার্ক্সের রাষ্ট্র বিষয়ে আলাদা হওয়ার জায়গাটি হচ্ছে হেগেল। হেগেলের মতে লিবারেল বা উদারনৈতিক রাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক নীতিবান মুরুব্বি যার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, সংঘাত আমরা প্রতিহত করতে পারি। ফিলোসফি অফ রাইট বইয়ে হেগেল দাবি তুলেন, নাগরিক সমাজ প্রচন্ড অহংকারে জর্জরিত এবং নিজের নিজের স্বার্থের জন্যে ক্রমাগতই নিজেদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। নাগরিক সমাজের শরীর এক সর্বজনীন স্বার্থপরতা দিয়ে গঠিত। এবং এ থেকে মুক্তির জন্যে হেগেলের মতে আধুনিক রাষ্ট্রকে এমন একটি ইউনিভার্সাল বা বিশ্বজনীন আইনি ব্যবস্থা, সামষ্টিক চেতনার উৎপাদন ঘটাতে হবে যাতে করে এই স্বার্থপরতাকে রাজনৈতিক খেলার মাঠ থেকে দূরে রাখা যায়। সোজা করে বললে, এমন একটা রাষ্ট্র যা সমাজের কতিপয়ের স্বার্থের জন্যে কাজ না করে, সর্বজনীন হয়ে উঠবে। এবং এই রাষ্ট্র সর্বসাধারণের ভালোই চায় এবং ভালোই করে। হেগেলের কাছে আধুনিক উদারনৈতিক রাষ্ট্র সমাজের দ্বন্দ্ব-বিভক্তির সমাধান। এটি নৈতিক এবং যৌক্তিক জ্ঞানের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটায়। এই যে রাষ্ট্র সর্বসাধারণের ভালো চায় কিংবা সমাজের ভালো চায়, অথবা করতে পারে— মার্ক্স এই বক্তব্য মানতে পারলেন না। মার্ক্সের কাছে রাষ্ট্র সবসময়ই একটা নির্দিষ্ট রাষ্ট্রই যেটা নিজেকে সর্বজনীন দেখাতে চায়। এর বিশ্বধার্মিক ভাবসাব কতিপয় অর্থনৈতিক স্বার্থ (যেমন— ব্যক্তিগত সম্পদ) ঢাকার একটা মুখোশ। এই জায়গা থেকেই মার্ক্স পরবর্তীতে দাবি করেন, রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শ্রেণি— বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্ব করে। হেগেলের বিপরীতে গিয়ে মার্ক্স প্রশ্ন তুলেন, রাষ্ট্র আদৌ নাগরিক সমাজের মধ্যকার সমস্যা, দ্বন্দ্বগুলোকে হটাতে পারে কিনা এবং যেহেতু পারে না, তাই রাষ্ট্রকেই সরাতে হবে। এইভাবে মার্ক্স নাগরিক সমাজের সর্বজনীন সীমাবদ্ধতার কথা তুলে বু্র্জোয়া রাষ্ট্রের বিলোপের কথা বলেন।  যারা মার্ক্সের অরাজ কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী চিন্তাভাবনার আলাপ তুলেন, তারা মূলত এই পয়েন্টকেই নানাভাবে দেখানোর চেষ্টা করেন। তবে মজার ব্যাপার, মার্ক্স যতই হেগেলের রাষ্ট্রীয় তত্ত্বের ধারণার বিরোধিতা করেন না কেন তিনি এই তাত্ত্বিক কাঠামোর বাইরে যেতে পারেন নাই। এর প্রমাণ আমরা পাই, মার্ক্স বিপ্লব পরবর্তী সময়ে যে ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রের ধারণা দেন তাতে, যেখানে মার্ক্স বলেন রাষ্ট্র সকল কর্তৃত্বকে কেন্দ্রীভূত করবে একক শক্তি/পার্টির হাতে। মার্ক্সের তাই এখানের চিন্তাভাবনা যতই কর্তৃত্ববিরোধিতাকে ফুটায়ে তুলুক না কেন, তিনি যে এখানে কর্তৃত্বের সমস্যার সাথে— আধিপত্য এবং উঁচু-থেকে-নিচু এইরকম শ্রেণিকাঠামোর (যা পার্টিযন্ত্রের মধ্যে থাকে, কলকারখানা এবং প্রযুক্তির মাঝে বিরাজ করে) সাথে বোঝাপড়ায় যাননি— তা অস্বীকার করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে, যারা মার্ক্সের কর্তৃত্ববিরোধী চিন্তার বৈশিষ্ট্যকে বারবার উল্লেখ করেন, তারাও দিনশেষে এটা মানতে বাধ্য হবেন, মার্ক্স ক্ষমতার বিস্তৃত সমস্যার জায়গাগুলোর সাথে বোঝাপড়ায় যথেষ্ট উপকারি নন। যে ক্ষমতার সমস্যা শ্রেণিদ্বন্দ্বের বাইরে অবস্থান করে এবং যাকে অর্থনৈতিক মাপকাঠির ছাঁচে ফেলা যায় না।

 

মার্ক্সের রাষ্ট্র-ধারণা

বাউয়ারের ক্রিটিক

মার্ক্সের বিভিন্ন ধারার মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় ধারণা হচ্ছে, অর্থনৈতিক এবং শ্রেণি শক্তি রাজনৈতিক বিষয়াদি নির্ধারণ করে থাকে। এমনকি মার্ক্সের নিজের কাছেও সমাজের অর্থনৈতিক শক্তিই সমস্ত ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংষ্কৃতিক, সামাজিক ঘটনাবলীর নিয়ামক। আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হয়, রাজনৈতিক ব্যবস্থাই সমাজে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে; বাস্তবে— উৎপাদন ব্যবস্থা যে ধরনের সামাজিক সম্পর্ক নির্মাণ করে তার ভিত্তিতেই রাজনীতি নির্ধারিত হয়। মার্ক্সের এই বক্তব্যের হদিশ আমরা পাই তার অন দ্য জুইশ কোশ্চেন প্রবন্ধে। এটি আসলে ব্রুনো বাউয়ারের এক প্রবন্ধের প্রতি মার্ক্সের সমালোচনা ছিলো, যেখানে বাউয়ার অভিমত দেন, ধর্মীয় যে সকল ব্যাপারস্যাপার মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে তা থেকে মুক্তির জন্যে রাষ্ট্রকে সেকুলার হয়ে উঠতে হবে। মার্ক্স অন্যদিকে বলেন, রাষ্ট্র সেকুলার হয়ে উঠলে ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে উঠবে, ব্যক্তিগত চর্চার জায়গা হয়ে উঠবে; যার অর্থ এটা না— রাষ্ট্র ধর্ম থেকে মুক্তি পাচ্ছে। ধর্ম তখনও নানাভাবে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত বা অন্যান্যভাবে প্রভাবিত করে যাবে: “ধর্ম থেকে রাজনৈতিক মুক্তি মানুষের সর্বশেষ কিংবা সর্বোচ্চ মুক্তি না।” বাউয়ারের যে রাজনৈতিক মুক্তি তা বরং সমাজে ধর্মকে আরও সুসহংত করবে এবং সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত বিভাজনের জায়গা প্রশস্ত করবে। বরং মার্ক্স রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যকার এই বিভাজনগুলো মুছবার চেষ্টা করেছেন। ওই রাজনৈতিক মুক্তি ধর্মের খপ্পর থেকে উদ্ধারের কোন সুবিধাই তৈরি করবে না। বাউয়ার রাষ্ট্রের ধার্মিক বৈশিষ্ট্য এবং ধর্ম থেকে সমাজকে মুক্ত করার যে ক্ষমতা এর রয়েছে তার উপর জোর দেন। আর মার্ক্সের জোর এখানে নাগরিক সমাজের উপর। সমাজে ধর্ম বা অর্থনীতির কারণে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, তা থেকে রাষ্ট্র মুক্তি দিতে পারে না; কারণ, রাষ্ট্র নিজেই এই বিচ্ছিন্নতার প্রতিফলন। মার্ক্সের জন্যে এইখানে আসল ক্ষমতা নিহিত রয়েছে নাগরিক সমাজ এবং ধর্মীয়/ব্যক্তিগত সম্পত্তির যে প্রভাব তার ভিতর।

ব্রুনো বাউয়ের
(১৮০৯- ১৮৮২)

রাজনৈতিক শক্তি নয় বরং অর্থনৈতিক শক্তিই সমাজকে চালনা করে, শাসন করে। একটা জিনিস গুরুত্বপূর্ণ— বাউয়ারের মতই মার্ক্স রাজনৈতিক মুক্তির সুরাহা খুঁজতে চেয়েছেন। তিনি দেখলেন এই মুক্তি আসতে পারে যদি রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের মধ্যকার যে ফারাক রয়েছে তা আরও বিস্তৃত হয়। এবং যে সকল অব্যক্তিগত অর্থনৈতিক শক্তি রয়েছে (সামষ্টিক উৎপাদন, ব্যক্তিগত ফায়দা বাদে) তাকে আরও বলবৎ করা যায় (তাদের উপর রাজনৈতিক প্রভাবগুলোকে ধীরে ধীরে হ্রাস করার মাধ্যমে)। কম কম রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অর্থই হলো একক মালিকানার নিয়ন্ত্রণ কমানো।

এইখানে অন দ্য জুইশ কোশ্চেন প্রবন্ধের আলোচনার উদ্দেশ্য মার্ক্স এবং বাউয়ারের ফারাক দেখানো। মার্ক্স যেখানে সমাজ তথা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রের দিকে কথা তুলেন, সেখানে বাউয়ার রাষ্ট্র থেকে সমাজের দিকে ফেরত আসেন। বাউয়ার বিশ্বাস করতেন, সমাজকে ঠিকঠাক রাখার ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতেই নিহিত, তাই রাষ্ট্র যদি ধর্ম থেকে মুক্ত হতে পারে তাহলে সেক্যুলার রাষ্ট্রে ধর্ম তার গুরুত্ব এমনিতেই হারাবে। মার্ক্স অন্যদিকে বিশ্বাস করতেন, আসল আধিপত্য, আসল ক্ষমতা নিহিত রয়েছে নাগরিক সমাজের ভিতর: “রাজনৈতিক না, বরং নাগরিকের জীবনই তাদের পরস্পরের মধ্যকার আসল বন্ধন।” মার্ক্সের মতে, বাউয়ার রাষ্ট্রকে একটা স্বাধীন সত্তা হিসেবে ধরে নিয়েছেন যা একটি মারাত্মক ভুল। রাষ্ট্র একক নির্ধারক এবং স্বায়ত্তশাসিত হয়ে কাজ করতে পারে না। রাষ্ট্র বরং অর্থনৈতিক শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার কাজকর্ম পরিচালনা করে।

যদিও বাউয়ার কোনভাবেই এনার্কিস্ট ছিলেন না, কিন্তু তার বিশ্বাসের একটা জায়গায় নৈরাজ্যবাদী ধারণার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রাষ্ট্র নিজেই একটি নির্ধারক, স্বায়ত্তশাসিত শক্তি যার আলাদা অস্তিত্ব রয়েছে, আলাদা ক্ষমতা রয়েছে সমাজের উপর। বাউয়ার যেখানে এই ক্ষমতাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন, নৈরাজ্যবাদীরা একে নেতিবাচক এবং ধ্বংসাত্মক হিসেবে দেখেন। অবশ্য চিন্তার এই ধারা এও বিশ্বাস করে, রাজনৈতিক ক্ষমতাই সমাজের প্রধান নির্ধারকরূপে কাজ করে থাকে (যা মার্ক্স সমালোচনা করেন)। মার্ক্স এইজন্যে পিয়েরে জোসেফ প্রুঁধোর বক্তব্য খারিজ করেন যার বক্তব্য ছিলো— রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নানাভাবে তৈরি করতে পারে। মার্ক্সের মতে, রাষ্ট্রের কাছে এইরকম কোন ক্ষমতা থাকতে পারে না, কেননা এটি তো কেবল অর্থনৈতিক শক্তিসমূহেরই এক প্রতিফলন যার পরিবর্তন ঘটানো উচিত। বাউয়ার বিশ্বাস করতেন, মার্ক্স রাষ্ট্রের ব্যাপারে এক প্রকার অন্ধবিশ্বাস পোষণ করেন৷ রাষ্ট্র তার কাছে অর্থনৈতিক শক্তির এক রকম ফলাফল: ” তিনি (মার্ক্স) বলেন, ‘দারিদ্র্য রাজনৈতিক দাসত্ব সৃষ্টি করে থাকে— যা রাষ্ট্র।’ কিন্তু তার এই বক্তব্যকে যদি একটু ঘুরায়ে বলা হয়— ‘রাজনৈতিক দাসত্বের প্রতিরূপ রাষ্ট্র নিজে টিকে থাকার জন্যে সবসময়ই দারিদ্র্যকে হাজির রাখে; যার অর্থ— দারিদ্র্য মুছতে চাইলে রাষ্ট্রকেই মুছে ফেলা প্রয়োজন’— এই বক্তব্য মার্ক্স মানতে পারেন না।

বোনাপার্টিজমের প্রশ্ন

 যদিও এটা সত্য, মার্ক্স রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক শক্তি এবং শ্রেণিস্বার্থের উৎপাদন হিসেবেই দেখেছেন, কিন্তু কিছু কিছু সময়ে তিনি রাষ্ট্রকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হিসাবেও চিন্তা করেছেন। তার দ্য এইটিন্থ ব্রুমাইর অফ লুই বোনাপার্ট গ্রন্থে ১৮৫১ সালের ফ্রান্সে সংঘটিত একটি অভ্যুত্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে লুই বোনাপার্টের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় শক্তি সর্বোচ্চ ক্ষমতা দখল করে। রাষ্ট্রীয় শক্তি বুর্জোয়াদের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনভাবে কাজই করেনি, কিছু ক্ষেত্রে বুর্জোয়াদের স্বার্থের বিরুদ্ধেও কাজ করেছে। এইজন্যে মার্ক্স বলেন, “কেবল দ্বিতীয় বোনাপার্টের সময়েই রাষ্ট্র নিজেকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন করে রাখতে পেরেছিলো।” যদিও এই রাষ্ট্রের ধারণা রাজনৈতিকভাবে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করলেও, এর সীমানা বা পরিধি ওই বুর্জোয়াদের অর্থনৈতিক স্বার্থের বাইরে যেতে পারে নাই। বোনাপার্টিস্ট রাষ্ট্র পুঁজিবাদী শ্রেণিরই সন্তান, ক্রমশ তা দৈত্যাকার রূপ ধারণ করেছিলো। বু্র্জোয়ারা বোনাপার্টকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠ করেছিলো যেন তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ সে ঠিক রাখতে পারে এবং শ্রমিকদের ঠান্ডা করে রাখতে পারে। কিন্তু, বু্র্জোয়া পার্লামেন্টের বিরুদ্ধেই এক সময় বোনাপার্ট খেপে উঠে। মার্ক্সের মতে, বোনাপার্টিস্ট রাষ্ট্র বু্র্জোয়া ক্ষমতারই একটি বিকৃত, সহিংস রূপ— যা নিজেই একটি বু্র্জোয়া দৈত্য হয়ে উঠে বু্র্জোয়াদের বিরুদ্ধাচারণ করতে শুরু করে। এটি বুর্জোয়া স্বার্থ বাঁচাবার জন্যে বু্র্জোয়াদের আত্মহত্যার একটি অন্যতম উদাহরণ। অন্যভাবে, অর্থনৈতিক স্বার্থের গতি ঠিক রাখার জন্যে এই দৈত্যের প্রয়োজন ছিলো: “যদি অর্থসম্পত্তি রক্ষা করতে হয়, তাহলে রাজার মুকুট মাটিতে নামাতে হবে।” এবং বু্র্জোয়ারাও একপ্রকার নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলো, যদি এর অর্থনৈতিক ক্ষমতা টিকায়ে রাখতে হয়। আর বোনাপার্টিস্ট রাষ্ট্র এই বিসর্জনেরই ফলাফল।

লুই নেপোলিয়ন বোনাপার্ট
১৮০৮- ১৮৭৩
শিল্পী: জেভিয়ার উইন্টারহল্ট

তাহলে, মার্ক্সিস্ট তত্ত্বে বোনাপার্টিস্ট রাষ্ট্রের যে রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের ধারণা তাকে আসলে কতখানি স্বাধীন বলা যাবে? এ নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। ডেভিড হেল্ড এবং জোল ক্রিগারের মতে, মার্ক্সিস্ট তত্ত্বে রাষ্ট্র এবং শ্রেণির মধ্যকার সম্পর্কে দুটো ধারা আছে। প্রথমটি, আমরা একে যদি ধরি ১(ক)— যা বোনাপার্টিজমের খোদ মার্ক্সের ব্যাখা দ্বারা প্রভাবিত— রাষ্ট্রের তুলনামূলক স্বায়ত্তশাসনের ধারণার উপর জোর দেয়। এই ধারা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ও আমলাতন্ত্র যে সমাজে আলাদা বলয়জুড়ে রয়েছে, সেই ধারণার উপর জোর দেয়। এর কাঠামো যে অর্থনৈতিক শ্রেণি দিয়ে পুরোপুরি নির্ধারিত হয়ে আছে এরকমও নয়, কিন্তু তাদের এই আলাদা বলয় সমাজের কেন্দ্রীয় একটি বিষয়। আর দ্বিতীয় ধারা, ২(ক), যা হেল্ড এবং ক্রিগারের মতে মার্ক্সিস্ট চিন্তায় সবচেয়ে প্রভাবশালী, রাষ্ট্রকে দেখে শ্রেণি আধিপত্য জারি রাখার একটি অস্ত্র হিসেবে। শ্রেণিস্বার্থ রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করে এবং রাষ্ট্রের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে।

হেল্ড এবং ক্রিগারের মতে, এই দুই  বিপরীতধর্মী ধারা আলাদা আলাদা বিপ্লবী কৌশলের জন্ম দেয়। কারণ, প্রত্যেকের রাষ্ট্রকে দেখার চোখ ভিন্ন। প্রথমটির সাপেক্ষে বিপ্লবী কৌশল হবে ১(খ)— রাষ্ট্র যেখানে বিপ্লবী কৌশল এবং মুক্তির একটি অস্ত্রবিশেষ। কারণ, রাষ্ট্রকে এখানে একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানরূপে দেখা হচ্ছে এই অর্থে রাষ্ট্র শ্রেণিস্বার্থের সাথে এসেনশিয়ালভাবে যুক্ত নয়। একে পুঁজিবাদ এবং বুর্জোয়া শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। দ্বিতীয়টির সাপেক্ষে বিপ্লবী কৌশল হবে ২(খ)— সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রাষ্ট্রের ধ্বংসই কাম্য। কারণ, রাষ্ট্র এখানে এসেনশিয়ালি বুর্জোয়া রাষ্ট্র, শ্রেণি শোষণের অস্ত্র। লেনিন এই ধারার খুব ভালো উদাহরণ।

রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসনের এই প্রশ্ন এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে এর ভূমিকার পৃথক পৃথক ব্যাখা এই ছকের মাধ্যমে দেখানো যেতে পারে:

মার্কিস্ট  প্রস্তাবনা

১(ক) স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র ———-> ১(খ) রাষ্ট্র বিপ্লবের একটি অস্ত্র

২(ক) নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ———–> ২(খ) বিপ্লবে রাষ্ট্র ধ্বংস করতে হবে

এই রাষ্ট্রের তত্ত্ব এবং এদের সাথে সংযুক্ত বিপ্লবী ধারণার ডাইকোটমির বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশ্ন তোলা যায়। কেউ কেউ বলতে পারেন, ২(ক) থেকেও তো ১(খ) তে যাওয়া যায়। অর্থাৎ, যদি রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সবকিছুই শ্রেণির মাধ্যমে নির্ধারিত হয় ২(ক) তাহলে এই রাষ্ট্রকেও তো আমরা বিপ্লবের একটি অস্ত্র হিসাবে দেখাতে পারি। আবার, রাষ্ট্র যদি অর্থনৈতিক বা শ্রেণি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়, কেবল স্বায়ত্তশাসিত বা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে কাজ করতে থাকে ১(ক) তাহলে এই রাষ্ট্রকেও তো বিপ্লবের মাধ্যমে ধ্বংস করা যায়।

একটি এনার্কিস্ট প্রস্তাবনা

১(ক) স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র ———-> ২(খ) বিপ্লবে রাষ্ট্র ধ্বংস করতে হবে

২(ক) নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ———–> ১(খ) রাষ্ট্র বিপ্লবের একটি অস্ত্র

এই দুই আর্গুমেন্টের র‍্যাডিকালি দুই জায়গায় বসানোর পিছনে এই যুক্তিটিই রয়েছে। এবং এই যুক্তি এক ধরণের এনার্কিস্ট রাষ্ট্রের ধারণার কাছাকাছি বসবাস করে। এনার্কিজম রাষ্ট্রকে দেখে স্বায়ত্তশাসিত ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে যার আধিপত্য বিস্তারের নিজস্ব কৌশল রয়েছে। এই কারণে রাষ্ট্রকে বিপ্লবের নিরপেক্ষ অস্ত্র হিসেবে দেখাটা ভুল যেমনটা মার্কিস্ট ১(খ) প্রস্তাবনায় আমরা দেখি। বিপ্লবের সময়ে, পরিবর্তনের সময়ে রাষ্ট্র নিজস্ব কৌশলের বদৌলতে ঠিকই আধিপত্য, শোষণ কায়েমের পথে টিকে থাকতে পারে। এই বিপ্লব যদি প্রলেতারিয়েতদের হাত ধরেও হয় (মার্ক্সের প্রস্তাব যা), এই রাষ্ট্রকে তখনও বিশ্বাস করা যায় না কারণ এর নিজের টিকে থাকার আলাদা কৌশল আছে যা বিপ্লব নিরপেক্ষ। তাই রাষ্ট্রকে আলাদাভাবে নিরপেক্ষ ধরে বিপ্লবের সহায়ক অস্ত্র হিসাবে বিবেচনা করা আদতে খুব যুক্তিসঙ্গত কিছু না। এইজন্যে রাষ্ট্রকেই এখানে বিপ্লবী কৌশলে ধ্বংস করতে হবে। আবার এনার্কিস্ট যুক্তি অনুসারে, ২(ক) থেকে আমরা দেখি, রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের একটা যন্ত্র— যা আরও ক্ষতিকর; কারণ রাষ্ট্র এখানে এমন একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান যা সবসময়ই বুর্জোয়া শ্রেণির আজ্ঞাধীন। বু্র্জোয়া শ্রেণি যেমন খুশি তেমনভাবে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করতে পারে স্বার্থরক্ষার জন্যে। এইখান থেকে এনার্কিস্ট প্রস্তাবনা ২(খ) অনুসারে, বিপ্লবী কৌশলে রাষ্ট্রের ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কখন করতে হবে? যখন এই রাষ্ট্র বিপ্লবী গোষ্ঠীর হাতে রয়েছে, যখন তারা একে নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও এই নিরপেক্ষ শব্দের অর্থ নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক আছে। মার্ক্সিস্ট যুক্তি অনুসারে, নিরপেক্ষতা হচ্ছে শ্রেণিস্বার্থ থেকে মুক্ত হয়ে স্বায়ত্তশাসন, যেখানে এনার্কিস্টদের কাছে নিরপেক্ষতা ঠিক তার বিপরীত জিনিস বোঝায়— শ্রেণিস্বার্থের অধীনে থাকা। কারণ, রাষ্ট্র যখন শ্রেণিস্বার্থের অধীনে থাকে তখন রাষ্ট্রেরও যে টিকে থাকার নিজস্ব কৌশল আছে তা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না; তখন এটি শ্রেণিস্বার্থের আজ্ঞাবহ দাস হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, মার্ক্সের বোনাপার্টিস্ট রাষ্ট্র যা তুলনামূলক স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র সেখানেও রাষ্ট্রের নিজস্ব কলাকৌশল চিন্তাভাবনার বাইরে রাখা হয়। এনার্কিস্টরা ঠিক এই কারণে, রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেন, কারণ রাষ্ট্র স্বায়ত্তশাসিত একটি ব্যাপার যার নিজস্ব কৌশল রয়েছে অর্থনৈতিক/শ্রেণি-স্বার্থের বাইরে; তাই রাষ্ট্রকে বিপ্লবের নিরপেক্ষ অস্ত্র ভাবা ভুল। এনার্কিস্টদের কাছে নিরপেক্ষতা এইক্ষেত্রে সন্দেহপূর্ণ একটি ধারণা।

মার্ক্স যতটা না এই বোনাপার্টিজমের প্রশ্ন নিয়ে ভাবান্বিত ছিলেন তার থেকে বেশি এনার্কিস্টরা এই প্রশ্ন নিয়ে চিন্তিত। কেননা বোনাপার্টিজমের প্রশ্নের আলোকে মার্ক্সের রাষ্ট্র, বিপ্লবের ধারণার বিভিন্ন আঙ্গিক প্রকাশ পায়। নিঃসন্দেহে মার্ক্স এইক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো তিনি কিভাবে এই বিরোধিতা করেছেন— একটা স্বায়ত্তশাসিত বোনাপার্টিস্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে না বুর্জোয়া আধিপত্যেরই এক ভিন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং এর বিপ্লবী কৌশলে কিরকম ভূমিকা থাকতে পারে সেই আঙ্গিকে—যা আমাদের বিতর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসেবে বিবেচিত হবে।

নিকোস পুলাঁতজাস যিনি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের তুলনামূলক স্বায়ত্তশাসনের উপর জোর দিয়েছিলেন, বলেন— মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের কাছে বোনাপার্টিজম ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের একটা ব্যতিক্রমী ধরন না বরং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বেশভূষা এই বোনাপার্টিস্ট রাষ্ট্রের পরতে পরতেই আছে। এই চিন্তা মার্ক্সের রাষ্ট্র-ব্যাখাকেই প্রশ্নের সম্মুখীন করে। রালফ মিলিব্যান্ড অন্যদিকে বলেন, মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের কাছে এই রাষ্ট্র সমানভাবেই শ্রেণি শাসনের একই অস্ত্র। আমরা এইখান থেকে কী বুঝতে পারি? মার্ক্স নিজে কখনো রাষ্ট্রের তত্ত্ব দিয়ে যাননি, অন্তত যদি একটা সঙ্গতিপূর্ণ তত্ত্বের আশা করি, মার্ক্স তাও দিয়ে যাননি। রাষ্ট্রের ব্যাপারে কখনো কখনো তাকে খুব একপেশে বা ‘একটা অস্ত্র’— এইরকম দৃষ্টিভঙ্গির জায়গাতে পাওয়া যায়। জার্মান ইডিয়োলজিতে তিনি বলেন, “রাষ্ট্র হচ্ছে সেইটাই যাতে শাসকশ্রেণির ব্যক্তিবর্গরা নিজেদের সাধারণ স্বার্থ জাহির করতে পারে।” আবার কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে বলতে দেখা যায়, “আধুনিক রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী পরিষদ বেসিকালি বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষার জন্যে একটি কমিটি।” কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো যেহেতু একটা রাজনৈতিক প্যাম্ফলেট তাই এর উপর বিশেষ জোর দেওয়া উচিত হবে না; কারণ আমরা তাত্ত্বিক জায়গাতে মার্ক্সকে দেখার চেষ্টা করছি। তবুও এটি মার্ক্সের রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তাভাবনার কিছু দিকনির্দেশনা আমাদের দিতে পারে।

সুতরাং, রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নকে আমরা কিভাবে দেখতে পারি? এর কোন পরিষ্কার উত্তর আসলে নাই। তাই এই প্রসঙ্গে মার্ক্সের অবস্থান কী ছিলো (যদিও মার্ক্সের এই বিষয়ে সচেতন কোন অবস্থান সম্ভবত ছিলোও না) তা এভাবে দাঁড় করাতে পারি: রাষ্ট্রের ফাংশনালিস্ট জায়গাগুলো বাদ দিয়েই হোক কিংবা রাষ্ট্রকে কিছু পরিমাণে স্বায়ত্তশাসন দিয়েই হোক, মার্ক্সের কাছে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শ্রেণি আধিপত্যের মাঝেই। এই কথার অর্থ, রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক অস্ত্রই হোক কি  বুর্জোয়াদের পক্ষে বা কোন কোন সময় বিপক্ষে কাজ করুক না কেন, মার্ক্সের কাছে রাষ্ট্র একটা প্রতিষ্ঠান যা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী শ্রেণিটিকে (যারা উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে) অন্য শ্রেণিদের শোষণ করতে সাহায্য করে। অন্যভাবে, রাষ্ট্রই বুর্জোয়াদের প্রলেতারিয়েতের উপর আধিপত্য এবং শোষণ তরান্বিত করতে ভূমিকা রাখে। এই ব্যাখা কিন্তু রাষ্ট্রকে তুলনামূলক রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনও দেয়: রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে কিন্তু তখনও একে বুর্জোয়াদের বৃহৎ অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে চলতে হয়।

আর্ট্ওয়ার্ক: দ্য পা্ওয়ার অব ট্রুথ সিরিজ
সূত্র: চাইনা ডেইলি

মার্ক্সের কাছে রাষ্ট্র বুর্জোয়াদের অস্ত্র। আরও ভালো করে বললে— রাষ্ট্র বুর্জোয়া শ্রেণি আধিপত্য জারি রাখার একটা প্রতিরূপ বা রিফ্লেকশান; একটা প্রতিষ্ঠান যার কাঠামো পুঁজিবাদী সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত। হ্যাল ড্রেপারের মতে, রাষ্ট্র “শ্রেণি-বিকৃতকরণ”-এর মাধ্যমে কাজ চালাতে থাকে। কী কাজ? এমন একটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো বজায় রাখা যার মাধ্যমে বু্র্জোয়াদের প্রলেতারিয়েত শোষণ করাটা সহজ হয়। সাধারণের ভালো চাওয়ার বুলি আউড়িয়ে যেন পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা যায়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রকে আমরা দেখি বু্র্জোয়াদের স্বার্থের জন্যে নিবেদিত প্রাণ। মার্ক্স ‘সমাজের কতিপয় শ্রেণিস্বার্থের ফলাফল রাষ্ট্র’ বলতে এটিই বুঝিয়েছেন।

মার্ক্সের রাষ্ট্র-ধারণার মধ্যে এইটাও দেখা সম্ভব— মার্ক্স পক্ষপাতিত্বমূলক রাষ্ট্রের একরকম হেগেলিয়ান ক্রিটিকই চালু রেখে গেছেন। যে রাষ্ট্র এক পক্ষের জন্যে কাজ করে; সমাজের, সবার জন্যে কাজ করে না। মার্ক্সের কাছে রাষ্ট্র তো এক ছদ্মবেশি চরিত্র। এটি একটি ইউনিভার্সাল রাজনৈতিক কম্যুনিটি আকারে নিজেকে হাজির করে অথচ কাজ করে কিছু নির্দিষ্ট পক্ষীয় স্বার্থের বরাতে। এই ছদ্মবেশের আড়ালে অর্থনৈতিক শ্রেণির আসল সংগ্রাম, সাধারণ মানুষের দৈন্যদশা ও বিচ্ছিন্নতা চাপা পড়ে যায়। হেগেলের মতই মার্ক্স একটি ন্যায়সঙ্গত এজেন্সি খুঁজতে চেয়েছিলেন— এক ধরনের গোষ্ঠীগত নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতার বৈধ ফর্ম আকারে, যার আবির্ভাব ঘটবে সবার স্বার্থরক্ষার্থে, ব্যক্তিগত/অব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, বৈপরীত্য ছাপিয়ে। মার্ক্স পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে দেখেছেন নাগরিক সমাজের বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ হিসেবে এবং এই বিচ্ছিন্নতা তখনই অতিক্রম করা সম্ভব যখন কোন মধ্যস্থতাকারী এজেন্ট সমাজে চলমান অর্থনৈতিক/সম্পত্তির এই বিভেদপূর্ণ সম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করবে না। তবে মার্ক্স হেগেলের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন এই জায়গাতে— এজেন্ট কে হতে পারে? মার্ক্স আধুনিক রাষ্ট্র যে এজেন্ট হতে পারে তা একেবারেই নাকচ করে দেন। কারণ, এই রাষ্ট্র বুর্জোয়া সম্পর্কের রাষ্ট্র। হেগেল যখন মধ্যস্থতাকারী এজেন্ট হিসেবে আধুনিক রাষ্ট্রকে বেছে নেন, অন্যদিকে মার্ক্স প্রলেতারিয়েতের মাঝেই ওই এজেন্টকে খুঁজে পান।

প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র

প্রলেতারিয়েত হচ্ছে মার্ক্সের সেই ইউনিভার্সাল এজেন্ট যেই এজেন্ট সমাজের সকল দ্বৈততা থেকে মুক্তি দিবে; অন্তত এমনটাই মার্ক্স তার হেগেলিয়ান ট্র্যাডিশন থেকে খুঁজে পেয়েছেন। প্রলেতারিয়েতের মুক্তি এক অর্থে পরিপূর্ণভাবে সমাজের মুক্তিরই সমার্থক। মার্ক্সের তত্ত্বে আমরা এক সম্ভাবনার খোঁজ পাই। সমাজের উপর ন্যায়সঙ্গত কর্তৃত্বচর্চার সম্ভাবনা। এইখানে সমাজ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ব্যক্তিগত কর্তৃত্বের চর্চা, জনগণ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন কিংবা কর্তৃত্বের সাথে জনগণের যে বিচ্ছিন্নতা এই সমস্ত দোষে দুষ্ট। কম্যুনিজমের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে মার্ক্সের মতে সর্বসাধারণের এই সামাজিক ক্ষমতার চর্চার এই ধাপ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

কিন্তু এই সামাজিক ক্ষমতা কিভাবে সংগঠিত হবে? মার্ক্সের মতে, কিছু সময়ের জন্যে হলেও, এই ক্ষমতা রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে সংগঠিত হতে হবে। পুঁজিবাদী ও কম্যুনিস্ট সমাজের মধ্যবর্তী এই ক্রান্তিকালীন সময়ে প্রলেতারিয়েত রাষ্ট্রের সাহায্য নিয়েই রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চা ঘটাবে: “এই ক্রান্তিকালীন সময় এমন একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনকে ইঙ্গিত করে যেখানে রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রলেতারিয়েতের হাতে সোপর্দ হবে।” মার্ক্স তার অ্যাড্রেস অফ দ্য সেন্ট্রাল কমিটি টু দ্য কম্যুনিস্ট লিগ এ আরও জোর দেন, “শ্রমিকদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের হাতে যেন ক্ষমতার সর্বোচ্চ কেন্দ্রীভূতিকরণ করা যায়” সেজন্যে লড়াই করে যেতে হবে। প্রলেতারিয়েত রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগকারী ক্ষমতা শ্রেণিশত্রু  নির্মূল করার কাজে এবং পুরোনো বুর্জোয়া সংষ্কৃতি সরানোর কাজে ব্যবহার করতে পারে। এই কারণে মার্ক্স কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো তে বলেন: “প্রলেতারিয়েত তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য কাজে লাগিয়ে বুর্জোয়াদের হাত থেকে সকল প্রকার পুঁজি ও উৎপাদন যন্ত্র ছিনিয়ে এনে রাষ্ট্রের হাতে জড়ো করবে।” সুতরাং মার্ক্সের কাছে প্রলেতারিয়েতের নিয়ন্ত্রণাধীন এই রাষ্ট্র, সাময়িক হলেও, পুরো সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি মাধ্যম। যে মাধ্যম সমাজকে বুর্জোয়া আধিপত্য থেকে মুক্তিদান করবে। মার্ক্সের কাছে এই বিপ্লব তাই রাষ্ট্র ক্ষমতা ধ্বংস করা না বরং এর লাগাম অন্য কারো হাতে আনা এবং “ক্রান্তিকালীন সময়ে” এই ক্ষমতার প্রয়োজনমাফিক সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, মার্ক্সের কাছে এই প্রলেতারিয়ান রাষ্ট্র একটি সাময়িক ব্যবস্থা। এঙ্গেলস দাবি করেন, এই রাষ্ট্র যখন আর প্রয়োজন হবে না তখন এমনিতেই “ভেঙ্গে যাবে”। এনার্কিস্টরা এই প্রসঙ্গে মনে করেন, রাষ্ট্র এমনি এমনি ভেঙ্গে যাবে এইরকম আশা করা শিশুতোষ। এর কারণ পরবর্তীতে আরও পরিষ্কার হবে।

মিখাইল বাকুনিন
(১৯১৪-১৮৭৬)

সুতরাং, মার্ক্সের “ক্রান্তিকালীন সময়ের” বিপ্লবী-কৌশল মোতাবেক, বৃহৎভাবে ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে। যদিও মার্ক্স সবসময় রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির “অস্ত্র” হিসেবে কিংবা শ্রেণি আধিপত্যের রিফ্লেকশান আকারে দেখেছেন; তাহলে এই জায়গায় তিনি কিভাবে ভাবেন এই “ক্রান্তিকালীন” রাষ্ট্র সমাজের সবার হয়ে কথা বলবে? এটা কি মার্ক্সের রাষ্ট্র-বিরোধিতা এবং তার হেগেল থেকে ব্যতিক্রমী হওয়ার অবস্থানটিকেই প্রশ্ন করে না? এনার্কিস্টরা এই জায়গায় মার্ক্সের চিন্তাভাবনায় অন্যতম বড় একটা গলদ খুঁজে পান। যদিও মার্ক্স এইখানে কোন সমস্যা দেখেন না। কারণ, ক্রান্তিকালীন রাষ্ট্র এখানে প্রলেতারিয়েতের হাতে তথা “সর্বজনীন শ্রেণি”-র হাতে রয়েছে যা পুরো সমাজকেই প্রতিনিধিত্ব করবে। মার্ক্স এই রাষ্ট্রকে কোন একপক্ষীয় রাষ্ট্র হিসেবে দেখেন না যেমনটা তিনি বুর্জোয়া সমাজে দেখতেন। এখন এটা দাঁড়িয়ে গেছে বিশ্বরাষ্ট্র বা ইউনিভার্সাল রাষ্ট্র হিসেবে। এমনকি মার্ক্সের ভাষ্যমতে, এই রাষ্ট্রের কোন রাজনৈতিক ক্ষমতাও নাই। কারণ, রাজনৈতিক ক্ষমতা সবসময়ই একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের স্বার্থ দ্বারা নির্ধারিত হতো। এখন যেহেতু সমাজে কোন শ্রেণি-বিভাজন বসবাস করে না, আবার বুর্জোয়াদেরও অর্থনৈতিক উচ্চ আসন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই রাজনৈতিক আধিপত্যও আর বিরাজ করে না। এই কারণে, রাজনৈতিক ক্ষমতা বলেও আর কিছু থাকছে না: “যখন ক্রমান্বয়ে শ্রেণি-বিভাজন উধাও হয়ে যাবে, সমস্ত উৎপাদন ব্যবস্থা সমগ্র জাতির হাতে সংঘের মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত হবে তখন সাধারণের ক্ষমতা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক চরিত্র হারাবে।” তিনি বাকুনিনের এই ক্রান্তিকালীন রাষ্ট্রের সমালোচনার উত্তরও দিয়েছেন: “যখন শ্রেণি আধিপত্যের পতন ঘটবে, তখন বর্তমান রাজনৈতিক সেন্সে আসলে কোন রাষ্ট্র থাকবে না।” মার্ক্সের জন্যে রাজনৈতিক আধিপত্য এবং দ্বন্দ্ব আসলে শ্রেণি আধিপত্যেরই একরকম প্রকাশ। একবার শ্রেণি আধিপত্যকে মুছে দেওয়া গেলে, রাজনৈতিক আধিপত্যও মুছে দেওয়া কঠিন কিছু হবে না: রাষ্ট্র প্রলেতারিয়েতের দ্বারা পরিচালিত একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে, যতক্ষণ না এটা “মিলিয়ে যায়”।

আমরা মার্ক্সের যুক্তিই যদি অনুসরণ করি: যেহেতু শ্রেণি ও পুঁজিবাদী সম্পর্কের ফলাফলই হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা, তাই এইসবকে হটানো গেলে, একদম সরাসরি বললে— রাজনৈতিক ক্ষমতাই আর থাকবে না। যদিও তখন মার্ক্সিস্ট বিপ্লবী প্রোগ্রামের এই রাষ্ট্র যেকোন বু্র্জোয়া সমাজের কিংবা যেকোন ধরনের রাষ্ট্র থেকে আরও বেশি কেন্দ্রীভূত এবং শক্তিশালী। ক্রমান্বয়ে এই “ক্রান্তিকালীন” রাষ্ট্র আরও শক্তিশালী হলে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা আর প্র্যাকটিস করবে না— এনার্কিস্টরা এই বক্তব্যকে খুবই খোঁড়া মানেন। তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার এই সাধারণ ধর্ম (একই সাথে যেকোন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার ধর্ম) অস্বীকার করেন; যে ধর্ম মানে— ক্ষমতা অর্থনৈতিক শক্তি থেকে স্বাধীন এবং যার নিজস্ব কৌশল রয়েছে এবং যা নিজেই নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে। এখন এটি সত্য যে মার্ক্স বোনাপার্টিস্ট রাষ্ট্রের বেলায় রাষ্ট্রকে শ্রেণি থেকে কিছুটা হলেও আলাদা করে দেখেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হলো তা যথেষ্ট কিনা। এনার্কিস্টদের মতে, তা যথেষ্ট না; কারণ, মার্ক্স পরবর্তীতে বিপ্লবের জন্যে রাষ্ট্রকেই ব্যবহার্য বিষয় হিসেবে মেনেছেন। রাষ্ট্র, প্রাকৃতিক সত্তা  হিসেবে বিচার করলে, অর্থনৈতিক শক্তি থেকে এটি স্বাধীন। এই কারণে রাষ্ট্রকে ধার করে বিপ্লব পরিচালিত করার যে প্রকল্প (যে শ্রেণিই তা নিয়ন্ত্রণ করুক না কেন) তা বিশ্বাস করা যায় না। বোনাপার্টিজমের যে সম্ভাবনা, এক অর্থে বলা যায়, এনার্কিজম তা আরও বড় পরিসরে চিন্তা করতে সাহায্য করে।

মার্ক্সের চিন্তার তাৎপর্য কোন জায়গায়? রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারণায়। রাষ্ট্রযন্ত্র যে শ্রেণির স্বার্থ ফুটায়ে তুলে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সমাজের উপকারও করতে পারে তা মার্ক্স আমাদের দেখান। যদিও মার্ক্সের মতে এই উপকারের ঘটনা যখন প্রলেতারিয়েত বা “বিশ্বজনীন শ্রেণি” রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে তখনকার ব্যাপার এবং এই যন্ত্র আদতে আধিপত্যকারী শ্রেণিরই আজ্ঞাবহ যন্ত্র। এবং আমরা এও দেখিয়েছি, মার্ক্সের এই চিন্তায় স্থূল সরলীকরণের অস্তিত্ব দৃশ্যমান। রবার্ট সল্টম্যানের মতে মার্ক্সিস্ট তত্ত্ব আপাতদৃষ্টিতে যে কাজের কাজটি করে তা হলো রাজনৈতিক শোষণ কিভাবে সংঘটিত হয় তা দেখিয়ে দেয়। এই কিভাবে— রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণের মধ্যে দিয়ে না; বরং এই কিভাবে— একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্যে, আজ্ঞাবহ হয়ে বা ওই শ্রেণির দাস হয়ে, শোষণের কার্যক্রম তরান্বিত করার মাধ্যমে।

তৌকির হোসেন