অরাজ
রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম
প্রচ্ছদ » সম্পর্ক স্বাধীনতা রবীন্দ্রনাথ

সম্পর্ক স্বাধীনতা রবীন্দ্রনাথ

  • সেলিম রেজা নিউটন

মুখস্থ সম্পর্কে ছিলাম না কোনো দিন। মুখস্থের মুখ চোখে পড়া মাত্র মুখ ফিরিয়েছি। শিরোনামের ‘সম্পর্ক’টাও আমার অজানা সম্পর্ক বটে। সম্পর্ক মাত্রই আমার কাছে প্রেম। প্রেমে পড়েছি তাঁর। এ রচনা লিখতে বসে তাঁর সাথে আমার প্রেমের দাগগুলোকে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি মাত্র। খেয়াল করছি, বিশ্বপ্রকৃতিতে অবস্থিত ব্যক্তি-মানুষের “স্বাধীনতার নিয়ম”গুলোকে ক্রম-আত্মস্থ করার সূত্র ধরেই সম্পর্ক আমার তাঁর সাথে। রবীন্দ্রনাথের সাথে। যুক্তি আর মুক্তিকে কেন্দ্র করেই আমার রবীন্দ্রনাথ। যুক্ত তিনি সকলের সাথে। সর্বময় যুক্ততার সর্বজনীন উপলব্ধিই তাঁর মুক্তি-আকাঙ্ক্ষার সারসত্তা। যাবতীয় বদ্ধতাকে মুক্ত করার সাধনাই তাঁর সাধনা। “যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ” তাঁর মূলমন্ত্র। আবিশ্ব যুক্ততার “বিশ্বধর্ম” তাঁর একান্ত উপলব্ধি। যুক্ততার যুক্তি তাই বন্ধন হয়ে ওঠে না তাঁর জন্য। বিশ্বধর্ম হয়ে ওঠে বিশ্বজনীন মুক্তিধর্ম। “বিশ্বধর্মের সঙ্গে আমাদের ইচ্ছাকে মেলাতে পারলেই আমরা বস্তুত স্বাধীন হই। স্বাধীনতার নিয়মই তাই।”

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম

আমার যুক্তিবোধ কোনো গুরুজনের কাছ থেকে আয়ত্ত-বস্তু নয়। বই পড়েও শেখা নয়। আগুনের সাথে কয়লার সংযুক্তির শিখায়ই কেবল শিক্ষা করা যায় এ যুক্তিবোধ। নিছক মনুষ্যস্বভাবে। নিতান্তই জন্মসূত্রে। কোনোকিছু সহকারে যা জন্মায়, তা-ই সহজ। আমার যুক্তিবোধ আমার সাথেই জন্মেছে। তাই আমার যুক্তিবোধ সহজ। সহজাত। সহজ যুক্তি এই যে: যুক্তি কোনো তর্কযুক্তি নয়। মতবিরোধের যুক্তিও নয়। ওসব নিছক গালাগালির যুক্তি। (স্মর্তব্য: “মতবিরোধ নিয়ে তোমরা যাকে যুক্তি বলো আমরা তাকে বলি গাল”।)। গালাগালির যুক্তির কথা এখানে হচ্ছে না। লজিকবিদ্যার যুক্তির কথাও নয়। আমার যুক্তিবোধ সম্পর্কের। ভালোবাসার। প্রেমের। এবং অবশ্য-অবশ্যই মুক্তির আর স্বাধীনতার।

যুক্তি বলতে যুক্ততা বোঝায়। আমার যুক্তিবোধ হলো যুক্ততার বোধ। একটা কিছু অন্য কিছুর সাথে যেভাবে সম্পর্কিত, যেভাবে যুক্ত, যেভাবে পার্থক্যযুক্ত, সেটাই তাদের মধ্যকার যুক্তি। ঐ যুক্তিতেই তারা পরস্পর-সম্পর্কিত। এই অর্থে যুক্তিবোধ লজিকবিদ্যা-বিবর্জিত কিছুও নয়। সম্পর্কই যুক্তি – যুক্ততা। আর প্রেমও এক প্রকার সম্পর্ক। যুক্তিই তাহলে প্রেম। যুক্তিবোধই প্রেমবোধ। যুক্তির অনুভূতি তথা যুক্ততার অনুভূতিই তাহলে প্রেমের অনুভূতি। উপরন্তু প্রেম স্রেফ এক প্রকার সম্পর্কই নয় – সর্ব প্রকার সম্পর্কই প্রেম। যাবতীয় সম্পর্কই একেক ধরনের প্রেম। প্রেম তাহলে নিছকই সম্পর্ক। টান। কীভাবে একে অন্যকে টানে, টানাটানি হয়, সেটাই তাদের মধ্যকার যুক্ততা, সম্পর্ক, প্রেম। প্রেম তাই টানাপোড়েনমুক্ত হয় না। হতে পারে না। টানাটানিতে অন্তর পোড়ে। না পুড়লে প্রেম হয় না। আলো হয় না। সম্পর্ক হয় না। যে সম্পর্ক এমনকি নষ্ট হয়ে যায় বলে মনে হয়, সেও এক প্রকার সম্পর্কই। তাতে দূরত্ব বেশি। টান কম। তাই টানাটানি কম। দহনও কম। তবু সেটা সম্পর্ক। দুর্বল সম্পর্ক। দুর্বল সম্পর্ক মানেই খারাপ সম্পর্ক না। প্রবল সম্পর্কও খারাপ হতে পারে। টানাপোড়েন তাহলে সমস্যা না। টানাপোড়েনই সম্পর্ক বরং। কোনো না কোনো প্রকার টানাপোড়েন। টান ছাড়া সচলতা নাই। আর এই মহাবিশ্বে কিছুই স্থির নয়। অনড় নয়। সচল। সম্পর্ক তাই অনড় নয়। সদাপরিবর্তমান। “পাল্টায় মন, পাল্টায় চারপাশ, রাস্তায় আসে নতুন রুটের বাস; পাল্টায় চেনা মুখের দেখন-হাসি, পাল্টাও তুমি তোমায় দেখতে আসি” (কবীর সুমনের গান)।

অনেকেই এই অপরিহার্য পরিবর্তন মানতে চান না। নিজেরা বদলান। কিন্তু বদলটাকে খেয়াল করতে চান না। স্বীকার করেন না। যাঁরা স্বীকার করেন, তাঁদেরকে উল্টো বলেন পাল্টি-খাওয়া লোক। পাল্টে যাওয়া প্রেমিকের মুখ দেখতে চান না কেউ। মান্নাদের মতো তাঁদের অন্যতম ‘সিগনেচার সং’ হয়: “তুমি কি সেই আগের মতোই আছ? নাকি অনেকখানি বদলে গেছ? খুব জানতে ইচ্ছে করে।” জানতে আসলে ইচ্ছা করে ‘তুমি’ বদলাও নি। কেউ বদলাবে না। সব আগের মতো থাকবে।

কৃষি-কেন্দ্রিক, ভূমি-মালিকানাভিত্তিক এই সামন্ত মনন ভারতবর্ষকে ভাষায় গাছের মতো অনড় করে রেখেছিল সহস্র বছর (কার্ল মার্ক্স, “ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের ভবিষ্যত ফলাফল”)। আমাদের মন এখনও সেই অচলায়তনে স্থির হয়ে থাকতে চায়। একেবারে কালাপাহাড়ি আইকনোক্লাস্টের মতো করে সেই “অচলায়তন“কে আক্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ। বাঁধ ভেঙে “মুক্তধারা” বওয়ানোর সাধনায় অনির্লিপ্ত থাকেন জীবনভর।

জীবন তো আর থেমে থাকে না। “রাস্তার নাম পাল্টায় একদিন, ধারা পাল্টায় মাও সে তুং-এর চীন; প্রেম পাল্টায়, শরীরও পাল্টে যায়, ডাকছে জীবন: আয় পাল্টাবি আয়” – এ ডাক কবীর সুমনের নয় আসলে। এ ডাক শুষ্ক-সজল জীবনের। এ ডাকে সাড়া দেয়া সহজ নয়। তার জন্য নিজেকে সহজ করে তুলতে হয়। স্বরচিত মুখোশের আড়ালে, আর কল্পখোলসের ভেতরে নিজেকে বন্দি করে রাখলে চলে না। নিজের দায়িত্বটুকু অন্তত নিতে হয়। নিজের অধীন হতে হয়। স্বাধীন হতে হয়। তবেই জীবনপ্রবাহের গতিধর্ম-স্থিতিধর্মের স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়। পরিবর্তনকে ভয় লাগে না। অনেকে সেটা মানতে পারেন না। অনড় স্থিরতা চান তাঁরা। ধ্রুব প্রেম চান। তাঁদের প্রেমও পাল্টায় না, শরীরও পাল্টায় না। ওগুলো পাল্টালেও মনটা পাল্টায় না। রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন হৃদয়’ পর্যন্ত ‘পুলকে দুলিয়া’ ওঠে অথচ আমাদের নতুন হৃদয়ের ভদ্রলোকেরা সুস্থির, গৃহপালিত, গেরস্থালি প্রেম চান।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম

সম্পর্কের স্থিরতা চাওয়া কেন? ভয়ে। পরিবর্তনের ভয়। নতুনের ভয়। তা ছাড়া, সম্পর্ক সুস্থির হলে, তাকে নিজের দরকার মতো ব্যবহার করতে সুবিধা হয়। সুস্থির সম্পর্ক হলো কেজো সম্পর্ক। প্রয়োজন পূরণের সম্পর্ক। দরকারের সম্পর্ক। উদ্দেশ্য হাসিলের সম্পর্ক। উদ্দেশ্য: নিজের স্থূল কামনা বাসনা প্রলোভনকে চরিতার্থ করা। এ হলো স্থূল সম্পর্ক। স্থূল সম্পর্ক কামপরায়ণ। স্থূল প্রেমিক আসলে প্রেমিকই নন। সম্পর্ক-সন্ধানী তিনি – সুযোগসন্ধানী। ধান্দাবাজ। কামুক তিনি। তিনি শুধু নিজের ইন্দ্রিয়বাসনা চরিতার্থ করতে চান। ষড়রিপুর কাছে নিজেকে সঁপে দেন তিনি। রিপু আর ইন্দ্রিয়ই তার সুখ। নিজেকে সুখী করতে চান তিনি। কিন্তু তাঁর আনন্দ হয় না। কেননা কামনা কোনোদিন পরিতৃপ্ত হয় না। এই অপরিতৃপ্তি তাঁকে ব্যর্থতার অনুভব দেয়। ব্যর্থতা তাঁর কাছে অসহনীয়। তিনি চান সফলতা। সফলতার তাড়না থামতে দেয় না। আরো চাই আরো চাই স্পৃহা কেড়ে নেয় স্বাধ-আহ্লাদ-সাধনার স্বাদ। প্রয়োজনের সম্পর্ক তাই আনন্দহীন। কেননা তা উদ্দেশ্যপরায়ণ।

প্রেম অবসরের ঘটনা। প্রেম কোনো ব্যস্ত কাহিনী নয়। ব্যস্ততা অফিসের প্রসঙ্গ। বাণিজ্যের প্রসঙ্গ। অবকাশ নিজেই প্রেম। উদ্দেশ্যহীন অবকাশ। এর সম্পর্ক রিক্ততার সাথে। রবীন্দ্রনাথের দেখা সেই রিক্ত একটা ঘরের মধ্যে এর বাস:

ঘরের মধ্যে একেবারে কোনো আসবাব নেই। একটি দেয়ালে একখানি ছবি ঝুলছে। ওই ছবি আমার সমস্ত চোখ একা অধিকার করে; চারি পাশে কোথাও চিত্তবিক্ষেপ করবার মতো কিছুই নেই। রিক্ততার আকাশে তার সমস্ত অর্থটি জ্যোতির্ময় হয়ে প্রকাশ পায়। ঘরে যদি নানা জিনিস ভিড় করত তবে তাদের মধ্যে এই ছবি থাকত একটি আসবাবমাত্র হয়ে, তার ছবির মাহাত্ম্য ম্লান হত, সে আপনার সব কথা বলতে পারত না।

কাব্য সংগীত প্রভৃতি অন্য-সমস্ত রসসৃষ্টিও এইরকম বস্তুবাহুল্যবিরল রিক্ততার অপেক্ষা রাখে। তাদের চারিদিকে যদি অবকাশ না থাকে তা হলে সম্পূর্ণ মূর্তিতে তাদের দেখা যায় না। আজকালকার দিনে সেই অবকাশ নেই, তাই এখনকার লোকে সাহিত্য বা কলাসৃষ্টির সম্পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত। তারা রস চায় না, মদ চায়; আনন্দ চায় না, আমোদ চায়। চিত্তের জাগরণটা তাদের কাছে শূন্য, তারা চায় চমকলাগা। (রবীন্দ্রনাথ, “পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি“, রবীন্দ্র-রচনাবলীর বৈদ্যুতীন সংস্করণ।)

চিত্তের এ জাগরণই প্রেম। আত্মজাগরণ। হেনরি ম্যাকে-এর “নৈরাজ্য” কবিতার মতো “যখন প্রত্যেকে জেগে উঠবে অন্ততপক্ষে নিজের নিকটে” তখন আমরা প্রেমময় সমাজ পাব। আত্মজাগরণই আত্মবিকাশ। আত্মপরিচয়। আত্ম-অধীনতা। স্ব-অধীনতা। স্বরাজ। এ বস্তুর নামই প্রেম। প্রেম ছাড়া স্বাধীনতা নাই। আত্মপরিচয়ের বিকাশ যার মধ্যে ঘটে নি, যার আত্মা এখনও সুপ্তিকাতর, প্রেম তার কাছে অনুষ্ঠান। নায়কনায়িকার হাত-ধরাধরি করে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনুষ্ঠান। মিডিয়া-ম্যানুয়ালে সূচিবদ্ধ অনুষ্ঠান। প্রেম কোনো ভিড়ের গল্প নয়–

ভিড়ের ঠেলাঠেলির মধ্যে অন্যমনস্কের মন যদি কাব্যকে গানকে পেতে হয় তা হলে তার খুব আড়ম্বরের ঘটা করা দরকার। কিন্তু সে-আড়ম্বরে শ্রোতার কানটাকেই পাওয়া যায় মাত্র, ভিতরের রসের কথাটা আরো বেশি করে ঢাকাই পড়ে। কারণ, সরলতা স্বচ্ছতা আর্টের যথার্থ আভরণ। যেখানে কোলাহল বেশি, ভিড় বৃহৎ, মন নানা কিছুতে বিক্ষিপ্ত, আর্ট সেখানে কসরত দেখাবার প্রলোভনে মজে, আপনাকে দেখাতে ভুলে যায়। আড়ম্বর জিনিসটা একটা চিৎকার; যেখানে গোলমালের অন্ত নেই সেখানে তাকে গোচর হয়ে ওঠবার জন্যে চীৎকার করতে হয়; সেই চীৎকারটাকেই ভিড়ের লোক শক্তির লক্ষণ জেনে পুলকিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আর্ট তো চীৎকার নয়, তার গভীরতম পরিচয়ে হচ্ছে তার আত্মসংবরণে। আর্ট বরঞ্চ ঠেলা খেয়ে চুপ করে যেতে রাজি আছে, কিন্তু ঠেলা মেরে পালোয়ানি করার মতো লজ্জা তার আর নেই। হায় রে লোকের মন, তোমাকে খুশি করবার জন্যে রামচন্দ্র একদিন সীতাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন…। (রবীন্দ্রনাথ, “পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি“, রবীন্দ্র-রচনাবলীর বৈদ্যুতীন সংস্করণ।)

দেশ-দশ-সমাজের বাইরে নয় প্রেম। যে নিজেকে চেনে, পরিবেষ্টনী-প্রকৃতিপুঞ্জকে সহকারেই নিজেকে চেনে সে। যে নিজেকে ভালোবাসে, সে ভালোবাসে সবাইকে। কিন্তু তাই বলে প্রেম চিৎকার নয়। আড়ম্বর নয়। কোলাহল নয়। গোলমাল নয়। ক্রমাগত ভিড় ঠেলাঠেলি করে সিনেমা হলের টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট জোটানোর সফলতা নয়। প্রেম অপ্রয়োজনের। অকারণের। অকারণই তো কাব্য, কলা, সাহিত্য, গান, আর্ট। অকারণেই আনন্দ। “তাসের দেশ“-এর “বসন্তে যারা ঝাঁকে ঝাঁকে চলেছে হিমালয়ের দিকে”, সেই হাঁসের দলের অকারণ আনন্দের মতো। রবীন্দ্রনাথ জানেন: “ওড়বার আনন্দ [হলো] অকারণের আনন্দ”।

বৃথা ওড়ার আনন্দের নাম প্রেম। বৃথা-সম্পর্কের নাম প্রেম। উদ্দেশ্যহীন, কামনাহীন, প্রত্যাশাহীন সম্পর্কের নাম প্রেম। প্রেম শুধু প্রেমকেই চায়। প্রেমের কোনো পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য নাই। পূরণ করার মতো বিশেষ কোনো ধান্দা নাই। সম্পর্কিত সত্তাকে সুখী করার সাধনার নাম প্রেম। সম্পর্কিত সত্তা সুখী হলেই প্রেমিকের সুখ। এ হলো কামনা মোচনের সাধনা। রিপু, ইন্দ্রিয়, আর কামনাকে অতিক্রম করে প্রেম। নিষ্কাম কর্মযোগের নাম প্রেম। প্রেমে তাই সবই পাওয়া যায়। কোনো অভাবই থাকে না প্রেমে। মন মলিন হয় না। ভাব থাকে শুধু। আনন্দ থাকে। মিলনের আনন্দ। রক্ত-ক্ষরণের আনন্দ। পোড়ার আনন্দ। আলোর আনন্দ। অকারণ আনন্দ।

প্রেম এতই অকারণ যে এমনকি দায়িত্বহীনও বটে। কর্তব্যবোধতাড়িত সম্পর্কের নাম প্রেম নয়। চুক্তি। বিবাহ। তার সম্পর্ক দায়-দায়িত্ব-অধিকারের সাথে। প্রেমের সাথে নয়। আনন্দের সাথে নয়। আনন্দ তো বন্ধুকে সুখী করাতেই। কিন্তু তা কর্তব্য নয়। কর্তব্য সংবিধানের অংশ। প্রেম বেআইনী। আইন-অতিক্রমী। সংবিধান-বহির্ভূত। তার আইন তার নিজের রচিত। তা সে বদলায়ও নিজে। প্রেম এক্ষেত্রে আর্টের মতোই। “তার মধ্যে কোনো দায়ই নেই, কর্তব্যের দায়ও না।” রবীন্দ্রনাথের কাছে শিখি উপনিষদের গল্প:

উপনিষদে লিখছে, এক ডালে দুই পাখি আছে, তার মধ্যে এক পাখি খায় আর এক পাখি দেখে। যে পাখি দেখছে তারই আনন্দ বড়ো আনন্দ। কেননা তার সে বিশুদ্ধ আনন্দ, মুক্ত আনন্দ। মানুষের নিজের মধ্যেই এই দুই পাখি আছে। এক পাখির প্রয়োজন আছে, আর-এক পাখির প্রয়োজন নেই। এক পাখি ভোগ করে, আর-এক পাখি দেখে। যে পাখি ভোগ করে সে নির্মাণ করে, যে পাখি দেখে সে সৃষ্টি করে। নির্মাণ করা মানে মাপে তৈরি করা, অর্থাৎ যেটা তৈরি হচ্ছে সেইটেই চরম নয়, সেইটেকে অন্য কিছুর মাপে তৈরি করা — নিজের প্রয়োজনের মাপে বা অন্যের প্রয়োজনের মাপে। আর সৃষ্টি করা অন্য কোনো-কিছুর মাপের অপেক্ষা করে না, সে হচ্ছে নিজেকে সৃজন করা, নিজেকেই প্রকাশ করা। এইজন্য ভোগী পাখি যে সমস্ত উপকরণ নিয়ে কাজ করছে তা প্রধানত বাইরের উপকরণ, আর দ্রষ্টা পাখির উপকরণ হচ্ছে আমি-পদার্থ। এই আমির প্রকাশই সাহিত্য, আর্ট। তার মধ্যে কোনো দায়ই নেই, কর্তব্যের দায়ও না। (রবীন্দ্রনাথ, “জাপান যাত্রী“, দ্বিতীয় অংশ, রবীন্দ্র-রচনাবলীর বৈদ্যুতীন সংস্করণ।)

এই আমির প্রকাশই সত্তার প্রকাশ। সর্বসত্তার। এই আমির প্রকাশই ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীনতার সম্ভাব্য চূড়ান্ত বাস্তব রূপ। কেননা স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। আমার প্রকাশের সীমাই আমার স্বাধীনতার সীমা। তাই বলে কোনো দায়িত্ব-কর্তব্য-আইন-কানুন-আদালত আমার প্রকাশের সীমা নির্ধারণ করতে পারে না। এই সীমা নির্ধারণ করতে পারি শুধু আমি। তা আমি নির্ধারণ করি আমার প্রকাশের সীমা অনুভব করার মধ্য দিয়ে। এ সীমাবদ্ধতা আরোপিত নয়, অন্তর্জাত নয়, অন্তঃনিবিষ্ট। আমার ভেতরের এ সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমও করতে পারি আমি। নবরূপ নবপ্রকাশের কর্তব্য-ঊর্ধ্ব আনন্দে। আবার, রূপ সৃষ্টির এ স্বাধীনতা যেহেতু আমার, এ তাই বন্ধুরও (সবার)। তাঁর স্বাধীনতাই তো আমার স্বাধীনতার মানদণ্ড। জিম মরিসনের গানের মতো: “বন্ধু তো সে যে তোমাকে পেতে দেয় পূর্ণ স্বাধীনতা যেন তুমি হয়ে ওঠো তুমিই নিজে”। প্রেম তাই স্বাধীন। সে জন্যই সীমাহীন।

ধ্রুব প্রেম বলে কিছু নাই। প্রেমকে যাঁরা নিটোল, গতিহীন সত্তা বলে চাউর করে চলেছেন হাজার বছর ধরে, তাঁরা প্রেমের নিজস্ব যুক্তির দিকে তাকান না। তাঁরা যুক্তিবোধহীন। আর সেকারণেই তাঁরা আবেগবোধবর্জিত। প্রেমের চাইতে প্রবল আবেগ কী আছে? অন্যের সাথে যুক্ত হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষার চেয়ে সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষা আর কী আছে? এ জন্যই যুক্তিবোধহীন যিনি, তিনি আবেগবোধহীনও বটে। (দেখার বিষয়: যুক্তিহীন বলি নি, আবেগহীন বলি নি।) যুক্তি তাহলে আবেগই বটে। যুক্তি আর আবেগ পরস্পর-বিপরীত কিছু নয়। এরা একই জিনিসের দুই নাম। একই জিনিসকে দুইভাবে দেখার জন্য দুইটা নাম মাত্র।

জ্ঞান-ইন্ডাস্ট্রি যে বস্তুকে যুক্তি বলে চালায় তা আসলে অস্ত্র। হাতিয়ার। অন্যকে ঘায়েল করার হাতিয়ার। এই যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। করা হয়ে থাকে। এই যুক্তি হলো ব্যক্তির অন্ধ বাসনার শার্টের হাতায় লুকানো ছুরি। চক্ষুহীন কামনার আঁচলে লুকানো বল্লমের ফালা। আমার বাসনা পূরণে যা কিছু প্রবল বাধা, এ দিয়ে সে সবকে বধ করা যায়। বিচারবুদ্ধিহীন কামনাবাসনা পূরণের পথ পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার্য কাস্তে এই প্রচলিত যুক্তি। এর সাথে প্রেম নেই। সম্পর্ক নেই। আছে জোরাজুরি। আছে জবরদস্তি। অর্থাৎ বলপ্রয়োগ। যুক্তির এই অর্থে বলপ্রয়োগ আর যুক্তিপ্রয়োগ একই কথা। এ যুক্তি তাই প্রেমের নয়। প্রভুত্বের। এ যুক্তি মালিকের যুক্তি। মালিকানার যুক্তি। অন্যকে নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা-কামনাবাসনা অনুসারে পরিচালিত করার যুক্তি। “যদি দেখি যে মনের মতো ফল হচ্ছে না তাহলে জবরদস্তি করতে ইচ্ছা করে, তখন, নিজের শক্তি ও অধিকারকে নয়, অন্যেরই বুদ্ধি ও স্বভাবকে ধিক্কার দিতে প্রবৃত্তি জন্মে।” জবরদস্তির যুক্তিবোধ রবীন্দ্রনাথের নয়। তাঁর যুক্তি “স্বাভাবিক” যুক্তি। ছন্দের লয় যেমন স্বাভাবিক, সে রকম স্বাভাবিক এ যুক্তিবোধ। এ যুক্তিতে জবরদস্তি নিতান্তই অচল। “আমাদের প্রাণের, আমাদের হৃদয়ের ছন্দের একটা স্বাভাবিক লয় আছে; তার উপরে দ্রুত প্রয়োজনের জবরদস্তি খাটে না”।

জবরদস্তির প্রবৃত্তি-যুক্তির সাথে প্রেম-ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই। এ হলো ভালোবাসার নামে, প্রেমের নামে, পিতৃত্বের নামে, মাতৃত্বের নামে, ধর্মের নামে, অন্যকে নিজের দাসত্ব করানোর যুক্তি। এ যুক্তি রবীন্দ্রনাথের না। রবীন্দ্রনাথ জানেন, মানুষ নিজেই নিজের প্রভু হতে চায়। “সমস্ত প্রলোভনসত্ত্বেও দাসত্ব তাহার পক্ষে স্বাভাবিক নয়”; কেননা “সে জানে তাহার [নিজেরই] মধ্যে প্রভুত্বের একটি স্বাধীন সম্পদ আছে”; “স্বভাবতই সে প্রভু; সে বলে আমি নিজের আনন্দে চলিব, আমার নিজের কাজের বেতন আমার নিজেরই মধ্যে— বাহিরের স্তুতি বা লাভ, বা প্রবৃত্তি-চরিতার্থতার মধ্যে নহে। যেখানে সে প্রভু যেখানে সে আপনার আনন্দে আপনি বিরাজমান, সেইখানেই সে আপনাকে দেখিতে চায়; সেজন্য সে দুঃখ কষ্ট ত্যাগ মৃত্যুকেও স্বীকার করিতে পারে। সেজন্য রাজপুত্র রাজ্য ছাড়িয়া বনে যায়— পণ্ডিত আপনার ন্যায়শাস্ত্রের বোঝা ফেলিয়া দিয়া শিশুর মতো সরল হইয়া পথে পথে নৃত্য করিয়া বেড়ায়।” আর “এই জন্যই মানুষ এই একটি আশ্চর্য কথা বলে, আমি মুক্তি চাই”। (রবীন্দ্রনাথ, “ধর্মের অর্থ“, প্রবন্ধ-সংকলন: “সঞ্চয়“, রবীন্দ্র-রচনাবলীর বৈদ্যুতীন সংস্করণ।) মুক্তি ছাড়া তাই যুক্তি নাই। মুক্তি-যুক্তির সম্পর্ককে আবিষ্কার করাই আমার রবীন্দ্রনাথকে দেখার আনন্দ।

সম্পর্ক ঘরে থাকে। সম্পর্ক থাকে বাইরেও। ঘর আর পথ শেষ পর্যন্ত আলাদা কিছু নয়। মুসাফির-রাস্তাই তো ঢোকে ঘরে। আবার, ঘর থেকেই পথে বেরোয় মানুষ। ঘর যাঁর নাই কিংবা ছিল না, পথ নামক বস্তুটার কোনো ধারণাও তাঁর নাই। ঘরে ছিলেন বলেই তিনি পথে নেমেছেন। ঘর মানে যেকোনো আশ্রয়। সকল আশ্রয়ই অস্থায়ী আশ্রয়। সম্পর্ক তাই সরাইখানা বটে। সরে সরে যায় সে সারাক্ষণ। তার ওপরকার সামিয়ানা কখনও দূরের আকাশ। কখনও তা কাছের ছাউনি, গাছতলা, ছাদ, চাতাল। সম্পর্ক তাহলে যেমন আশ্রয়ের— বিশ্রামের, সম্পর্ক তেমনই আবার অবিশ্রাম পথচলারও। কেননা পথই ঘর অনেকের। উপরন্তু, অনেকের জন্য এমনও হতে পারে: ঘরই পথ তাঁদের। ঘটনা তাহলে পথ কিংবা ঘর নয়। ঘটনা হচ্ছে হাঁটা।

রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম

সম্পর্ক হচ্ছে আত্মার আশ্রয়। আশ্রয় দরকার তার। কেননা তা হাঁটে। পথ চলে। হাঁটে, অনুসন্ধান করে, আস্বাদন করে। আস্বাদন করে একাধারে অমৃত এবং গরল। যখন সে অবিরাম হাঁটে, তখনও কিন্তু শান্ত নিষ্ঠার সাথে অস্তিত্বে একাগ্র থাকে তার আত্মা। আবার, আশ্রয় তাঁর ঘরও। কেননা সে থামেও। থামে, অনুসন্ধান করে, আস্বাদন করে। আস্বাদন করে একাধারে অমৃত এবং গরলের মধ্যবর্তী আনকা নহর। যখন সে থেমে থাকে, তখনও কিন্তু অশান্ত পরিভ্রমণে বহু-অগ্রে রত থাকে আত্মা তাহার। গৃহক্লান্ত-গৃহত্যক্ত মানুষের কাছে পথই অবিকল্প আশ্রয়। পথ হচ্ছে ঘরের সাথে তার সম্পর্ক অনুধাবনের অবসর। আবার, মরুপথে দিশাহারা মুসাফিরের আশ্রয় হচ্ছে মরুদ্যান— এক চিলতে ঘর। মরুদ্যানই মরুভূমির সাথে তার সম্পর্ক উপলব্ধি করার অবকাশ।

রবীন্দ্রনাথ আমার অবসর। আলো আনন্দ আর গানের এই অবসরটুকু আছে বলেই হাঁটতে পারি আমি। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পাই: “আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে; আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে।” আমার নশ্বর দেহ তখন আর জৈবযান্ত্রিক সায়েন্স-সম্মত জড়দেহমাত্র নয়, সদামুক্ত অবিনশ্বর আত্মার সশরীর সামাজিক অস্তিত্ব। “শরীরকে হত্যা করিলেও ইনি নিহত হন না” (শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা, দ্বিতীয় অধ্যায়, শ্লোক ২০)। আমি তখন উপলব্ধি করতে পারি সমুদয় প্রপঞ্চের সাথে আমার সমুচয় সম্পর্কের মুক্ততার সারসত্তা। অনুধাবন করতে পারি অন্তহীন সম্পর্করাশির পারস্পরিক মুক্ততার নিত্যস্বভাবটাকে। টের পাই: অনতিক্রম্য যুক্ততার স্বরূপ উপলব্ধি করার মধ্যেই আছে মুক্তির অভিজ্ঞান। টের পাই অস্তিত্বজোড়া অবিণাশী মুক্ত সম্পর্কের স্বাদ। পারস্পরিক দাসত্বের অচলায়তনে জবুথবু আমাদের প্রেম-পরিবার-রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ আইনী সম্পর্কের সীমা তখন অনন্ত স্বাধীন সম্পর্কের অভিসারী হয়ে ওঠে।

আরো অনেক কিছুর মতো, রবীন্দ্রনাথ আমার অবকাশ। নিরাকার আঁধার আর বিশেষণ-অযোগ্য বিষণ্ণতার এই অবকাশটুকু আছে বলেই আমি অনুধাবন করতে পারি এ মহাবিশ্বের সাথে আমার বন্ধনহীন যুক্ততার স্বরূপ। টের পাই বাঁচার যুক্তি। এই যুক্তিবোধ আমাকে মুক্তি দেয় যুক্তিহীন সম্পর্কের গতিহীন গ্লানি থেকে। বদ্ধ ও বাধ্যতামূলক সম্পর্করাজির যাবতীয় রাষ্ট্র-সামাজিক জবরদস্তি থেকে।

রচনা: রাবি, জুলাই-আগস্ট ২০১৩
প্রকাশ: দৈনিক বণিক বার্তা, ২১শে সেপ্টেম্বর ২০১৩

প্রাসঙ্গিক তথ্য
পত্রিকায় প্রকাশের সময় রচনাটা আমি উৎসর্গ করেছি আমার বন্ধু “চিহ্ন-সম্পাদক প্রফেসর শহীদ ইকবালের প্রীতিকমলে”। ইকবালদের পত্রিকা “চিহ্ন”-র সাম্প্রতিক কোনো একটা রবীন্দ্রবিষয়ক সংখ্যার জন্য তিনি আমাকে “আমার রবীন্দ্রনাথ” নামে একটা লেখার জন্য বলেছিলেন। এটাই সেই রচনা। কিন্তু একটুর জন্য এটা আমি তাঁর হাতে সময়মতো পৌঁছাতে পারি নি বলে চিহ্ন-তে এটা ছাপা হয় নি। এখানেও রইল এটা প্রফেসর ইকবালের প্রীতিকমলে।

পাদটীকা

১. রবীন্দ্রনাথ, গীতবিতান, পূজাপর্ব, ১১১ সংখ্যক গান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভাষা-প্রযুক্তি-গবেষণা পরিষদ পরিবেশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীর বৈদ্যুতীন সংস্করণ, রবীন্দ্র-রচনাবলী ডট এনএলটিআর ডট অর্গ। এর পর থেকে শুধু “রবীন্দ্র-রচনাবলীর বৈদ্যুতীন সংস্করণ” হিসেবে উল্লেখিত।

২. রবীন্দ্রনাথ, “শান্তিনিকেতন” গ্রন্থের ১ম পর্বের “ত্যাগ” নামাঙ্কিত অংশ, রবীন্দ্র-রচনাবলীর বৈদ্যুতীন সংস্করণ।

৩. রবীন্দ্রনাথ, “সংগীতচিন্তা” বইয়ের “সংযোজন” অংশে “কল্যাণীয় ধূর্জটি”প্রসাদকে লেখা চিঠি, রবীন্দ্র-রচনাবলীর বৈদ্যুতীন সংস্করণ।

৪. রবীন্দ্রনাথ, “শান্তিনিকেতন” গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বের “সঞ্চয়তৃষ্ণা” অংশ, রবীন্দ্র-রচনাবলীর বৈদ্যুতীন সংস্করণ।

৫. রবীন্দ্রনাথ, “পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি”, রবীন্দ্র-রচনাবলীর বৈদ্যুতীন সংস্করণ।

সেলিম রেজা নিউটন

লেখক