অরাজ
আর্টওয়ার্ক: মেনি হিডেন ট্রুথ শিল্পী: রোমিরো জারদয়া সূত্র: কার্টুন মুভমেন্ট
প্রচ্ছদ » রিচার্ড রর্টি ।। প্রাকৃতিক নিয়ম-শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই

রিচার্ড রর্টি ।। প্রাকৃতিক নিয়ম-শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই

অনুবাদ: নিসর্গ নিলয়

প্রাগমাটিস্ট দার্শনিকদের মতে, তাঁরা গ্রীক দার্শনিকদের মত করে ভাবতে চান না- বাহ্য অবস্থা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করে ভাবার দরকার নেই, তেমনি মন ও শরীর, বুদ্ধি ও চেতনা এসবের পার্থক্যও তাঁরা করতে চান না। ডারউইন আসবার পরে, আমরা নিজেদেরকে নীৎশের মত করে ‘চালাক-চতুর জন্তু’ ভাবি, যারা দিনদুনিয়ায় কী ঘটছে সেটা নিয়ে ভাববার/কথা বলবার বিভিন্ন উপায় বের করেছে, সেগুলো সামলাবারও বিভিন্ন উপায় বের করেছে। কিন্তু তারা অনুভূতির জগৎ, বাহ্য অবস্থা ও বাস্তবতা ইত্যাদিকে ভেদ করা, তার দেহের উর্ধ্বে ওঠা, এসব নিয়ে কিছু করতে পারে নি।

প্রাগমাটিজমের বেশিরভাগই আপনি মেলাতে পারবেন হাইডেগারের ‘অন্টো-থিওলজিকাল ট্রাডিশনের’ সমালোচনার সাথে।[১] দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রাগমাটিজমকে সত্যের (truth) সংজ্ঞা বা তত্ত্ব বলে ভাবা হয়। আমার মনে হয় প্রাগমাটিস্টরা এভাবে বললে ভাল করবেন: আমরা কোন একটা বিষয়ের ন্যায্যতা (justification) বিষয়ে বলতে পারি, কিন্তু সেটা সত্য কিনা আমরা বলতে পারি না।[২] আমরা জানি কিভাবে আমরা একটা বিশ্বাসের ন্যায্যতা দিই, জানি আমরা সেইসব ন্যায্য বিশ্বাসকে ‘সত্য’ বলে বিশেষায়িত করি,  এটাও জানি যে একটা বিশ্বাসের ন্যায্যতা নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত তাকে সত্য বলা যায় না। কিন্তু ‘সত্য’ সম্বন্ধে আমরা এতটুকুই জানি। আর ন্যায্যতার ব্যাপারটাও দর্শক (audience) কিংবা সত্যতার দাবিদারের (truth candidate) ভিত্তিতে আপেক্ষিক। কিন্তু সত্য কখনো আপেক্ষিক না। যেহেতু এটা আপেক্ষিক না, তাই আসলে এটা নিয়ে কিছু বলাও যাচ্ছে না। সত্য (Truth with a capital T) অনেকটা খোদার মত। খোদাকে (সংজ্ঞা দেবার জন্য) নিয়েও কিন্তু খুব বেশি কিছু বলা যায় না। এজন্যই ধর্মতাত্ত্বিকরা অবর্ণনীয়তা/ভাষাতীত অবস্থা (ineffability) নিয়ে অনেক কথা বলেন। সমসাময়িক প্রাগমাটিস্টরা বলেন, সত্য একটা অসংজ্ঞায়িত বিষয়। কিন্তু এতে দুর্ভাবনার কিছু নেই। আমরা এর ব্যবহার জানি, একে আমাদের সংজ্ঞায়িত করতে হবে না।

আর্টওয়ার্ক: রিচার্ড রর্টি
শিল্পী: এল. ডব্লিউ. জেফরি
সূত্র: পাঙ্ক আউটসাইডার

নীৎশের কথা যদি আমরা বিবেচনা করি, “প্রকৃত ঘটনা বলে কিছু নেই, যা আছে তা শুধুই এর ব্যাখ্যা” –এটা আমাদেরকে প্রাগমাটিজমের একটা মৌলিক ধারণা দেয়। কোন ব্যাখ্যা-বিস্তারই একটা আরেকটার তুলনায় সত্যের কাছাকাছি বলে দাবি করা যায় না। কোন কোন ব্যাখ্যা হয়ত অন্যগুলোর চেয়ে বেশি কার্যকর, কিন্তু এর বেশি কিছু আসলে বলা যায় না। নীৎশের মতে, ব্যাখ্যার উর্ধ্বে উঠে সত্য পাওয়া সম্ভব নয়, নয় ব্যাখ্যার গভীরে গিয়েও। প্রাগমাটিস্টদের যে কথাটা আমি বললাম, তাঁরা বাহ্যিকতা ও বাস্তবতার পার্থক্য থেকে বের হতে চান – সেটাও আসলে কাছাকাছি বক্তব্য।

গ্রীক দর্শন মনে করে, প্রশ্ন করতে করতে একটা পর্যায়ে এসে আপনি থেমে যাবেন, কারণ আপনি লক্ষ্যে এসে পৌঁছাবেন। অন্যদিকে প্রাগমাটিস্টরা বলে, ‘লক্ষ্যে এসে পৌঁছানোর’ ব্যাপারটা যে আসলে কী সে বিষয়ে আমাদের কোন ধারণাও আসলে নেই। জিজ্ঞাসার মাধ্যমে সত্যের কাছাকাছি যাওয়া যায় বা বিভিন্ন ব্যাখ্যাকে প্রকৃত ঘটনা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায় –এ ধারণার কোন ব্যবহার আমরা করতে পারি না। আমরা শুধু জানি, কীভাবে আমাদের কামনা ও বিশ্বাসের ন্যায্যতা অন্যান্য মানুষের সাথে আলাপ করা যায়। এতদূর পর্যন্ত এসে এটুকু বলা যায়, মানবজীবন সবসময় এরকমই থাকবে। সময়ের উর্ধ্বে উঠে চিরন্তনে যাওয়া, আলাপ পার হয়ে নিশ্চয়তায় যাওয়া – প্লেটোনীয় ধারণাগুলিকে প্রাগমাটিস্টরা মানব ইতিহাসের এমন একটা পর্যায়েরফসল মনে করেন, যখন জীবন সম্বন্ধে মানুষ ছিল মরিয়া, তারা ভেবে পায় নি যে জীবন এর থেকে উৎকৃষ্ট হতে পারে কিনা। তাই তারা অন্য একটা জগতের আশ্রয় নিয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব ইত্যাদির সাথে সাথে প্রাগমাটিজমের আগমন। এসব বিষয় উনিশ শতককে প্রগতিতে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল।

আপনি যেমুহূর্তে ভাববেন দর্শনের লক্ষ্য ইতিহাস ও সময়ের ওপারে যাওয়া নয় বরং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জীবনকে আরও উৎকৃষ্ট করা, এটা দর্শনের উপকারিতা সম্বন্ধে আপনার চেতনাকে পালটে দেয়। প্লেটোনীয় ও ধর্মতত্ত্বীয় যুগে দর্শনের লক্ষ্য ছিল আপনাকে এমন একটা জীবন বা জগতের সন্ধান দেওয়া যেটা এই জগতের থেকে ভাল, যেখানে গিয়ে আপনি আশ্রয় নিতে পারেন। সেটা হতে পারে খোদা, কিংবা প্লেটোনীয় জগৎ, চিন্তাশীল জীবন ইত্যাদি। প্রকৃতির শৃঙ্খলার (natural order) সাথে একাত্ম হবার এই চিন্তার প্রতিক্রিয়ায় বলা যায়, প্রাকৃতিক নিয়মশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই, তবে আমাদের নাতি-পুতিদের জন্য আরও ভাল জীবন রেখে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। সকল দার্শনিক ব্যাখ্যা, অনুপ্রেরণা বা যা বলেন… এখান থেকে আসাই যথেষ্ট।

ফুটনোট:

১. অন্টো-থিওলজি কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কাণ্ট, তাঁর ‘Critique of Pure Reason’ (1781) বইতে। অন্টো-থিওলজি বা এর সমালোচনার ব্যাপারটা বেশ জটিল। খুব মোটাদাগে বলতে গেলে, হাইডেগারের মতে অন্টো-থিওলজির একটা বড় বিষয় হল মেটাফিজিক্স, এবং এখানে আলোচনা হয় মানুষ (জাগতিক বা মৌলিক সত্ত্বা) ও খোদার সত্ত্বা (চূড়ান্ত বা উচ্চতর সত্ত্বা) বিষয়ে। আরও দেখতে পারেন এই আর্টিকেলে: https://www.rep.routledge.com/articles/thematic/ontotheology/v-1

২. ন্যায্যতা বা জাস্টিফিকেশনের একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক আমি আমার বন্ধুকে বললাম, “জানিস পাশের রাস্তায় একটা কুকুর আকাশে উড়ছে।” – এই কথাটা হল আমার স্টেটমেণ্ট, যেটাকে আমি ‘সত্য’ বলে দাবি করছি। এখন আমার বন্ধু জিজ্ঞেস করল, “কেমনে বলছিস যে কুকুর উড়ছে? চল তো গিয়ে দেখি।” পাশের রাস্তায় গিয়ে দেখা গেল, কোন কুকুর উড়ছে না। অর্থাৎ আমি যেটা দাবি করেছি সেটা ‘সত্য’ না। এটা না করে বন্ধু এভাবেও বলতে পারে, “ধুরু, কুকুর কি কখনো ওড়ে নাকি? উলটাপালটা কথা বলিস না!” এখানেও সে আমার দাবিকে ‘অসত্য’ বলে প্রমাণ করল।

এখানে যে দুইটি উপায় দেখানো হল তা হচ্ছে একটা বক্তব্যের ন্যায্যতা আছে কি না তা পরীক্ষা করার অন্যতম উপায়। প্রথম উপায়টি (ঘটনাস্থলে যা যেভাবে ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করা) হল এম্পিরিকাল পদ্ধতি, যা বিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত। দ্বিতীয় উপায়টি হল ইনডাক্টিভ ফিলোসফিক্যাল আর্গুমেণ্টেশন। পূর্বের সকল অভিজ্ঞতায় আমরা জানি, কুকুর কখনো আকাশে ওড়ে না। সুতরাং আমার বক্তব্যটি সত্য হবার ন্যায্যতা পায় না।

মজার বিষয় হল, ন্যায্যতা কীভাবে প্রমাণ করা হবে তার উপায় দর্শনে বা বিজ্ঞানে বলা থাকলেও সবসময় এটা কাজ করে না। ন্যায্যতা ‘উৎপাদন’ করাও সম্ভব। যেমন, বিজ্ঞানের যুগ (সপ্তদশ শতাব্দী) আসার পূর্বে মানুষ জানত যে, ‘সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে।‘ কীভাবে আমরা এটা সত্য বলে মানব? কারণ ‘ধর্মে/ধর্মগ্রন্থে বলা আছে’। সাধারণ মানুষ কিন্তু একেই ‘সত্য’ বলে জানত। এখানে ধর্মতত্ত্ব তার দাবির ন্যায্যতা ‘উৎপাদন’ করছে। বিজ্ঞান আসার পরে এই দাবি ‘অসত্য’ প্রমাণিত হল। কিন্তু মজার ব্যাপার, বিজ্ঞান যে কোন দাবিকে ‘সত্য’ বলে সবসময় প্রমাণ করে তাও কিন্তু নয়। যেমন, বিজ্ঞান আসবার পূর্বে মহাবিশ্ব সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ছিল একরকম, নিউটন আসবার পরে মহাবিশ্বের সেই ইমেজ আমাদের মস্তিষ্কে আর থাকল না। ম্যাক্স প্লাঙ্ক, আইনস্টাইনের তত্ত্বের পরে সেটা আবার পরিবর্তিত হল। বিজ্ঞানের সুবিধা হল, সে নিজের মধ্যে কোন খুঁত পাওয়ামাত্র আগাগোড়া শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সমস্যা হল, ‘সত্য’ তাহলে কোথায়? মহাবিশ্বের ‘সত্য’ চেহারাটা দেখতে কেমন?

রর্টি এখানেই বলছেন, সত্য যে কী জিনিস সেটা আসলে আমরা জানি না বা জানার দরকার নেই। আমাদের শুধু এটা জানলেই চলবে যে, কীভাবে একটা বক্তব্যকে ‘সত্য’ বলা যায় এবং কীভাবে তার ন্যায্যতা দেখানো যায়, কারণ সত্যের ব্যাপারটা পুরাপুরি আপেক্ষিক। যেমন, আন্দোলনের সময় ক্ষমতাধারীরা প্রমাণ করতে চায়, আন্দোলনকারীরা আসলে হঠকারী এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। আবার, আন্দোলনকারীরা দেখাতে চায়, ক্ষমতাধারীর দাবি ভুল এবং আসলে তাদের উপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। দুই পক্ষই তাদের দাবিকে ন্যায্য বলে। আমি যতদূর দেখেছি, বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাধারী তার দাবির ন্যায্যতা ‘উৎপাদন’ করে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত ম্যাস মিডিয়ার মধ্য দিয়ে। এখানে, মিডিয়া হয়ে উঠছে ন্যায্যতা উৎপাদনের টুল।

[রিচার্ড রর্টির একটি সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশের ভাবানুবাদ। সাক্ষাৎকারের ভিডিও লিংকটি এখানে :  https://www.youtube.com/watch?v=5nTRunosX8w
আমেরিকান দার্শনিক রিচার্ড রর্টি (১৯৩১-২০০৭) ছিলেন একজন এনালিটিকাল দার্শনিক। তিনি শিকাগো ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়বার পর দীর্ঘদিন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন।]

নিসর্গ নিলয়

নিসর্গ নিলয় গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, নৃবিজ্ঞান বিভাগে। ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। জন্ম ১৯ জুলাই, ১৯৯৪। নিলয় এনার্কি, এথনিসিটি, জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশ, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে লিখছেন। এছাড়া সম্পাদনা করেছেন ’আর্টিলারি’ পত্রিকা। বর্তমানে অরাজ সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। ইমেল: nisharggoniloy@gmail.com