অরাজ
আর্টওয়ার্ক: লং লিভ দ্য কমিউন সূত্র: গ্রাহাম ব্লগ
প্রচ্ছদ » মিখাইল বাকুনিন।। ন্যাশনাল ক্যাটেকিজম

মিখাইল বাকুনিন।। ন্যাশনাল ক্যাটেকিজম

অনুবাদ: সহুল আহমদ

১৮৪৮ সালের মহাবিদ্রোহের পর শ্রমজীবী মানুষের বৈপ্লবিক সংগঠন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। পরবর্তী দেড় দশকজুড়ে বিপ্লবীদের পিছে ফেউয়ের মতো লেগে ছিল ইউরোপের সরকারগুলো। বিপ্লব তৎপরতা থেমে থাকেনি। নানাস্থানে গোপনে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন রকমের বিপ্লবী সংগঠন।১৮৪৮ সালের মহাবিদ্রোহের সময় রুশ বিপ্লবী মিখাইল বাকুনিন মুক্তিবাদী ছিলেন। স্বাধীনতার প্রাণস্পৃহা ছিল তার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মর্মে। বাকুনিন রচনা সংকলনের সম্পাদক ও অনুবাদক স্যাম ডলগফ মনে করেন, ১৮৬৬ থেকে রুশ বিপ্লবী বাকুনিন নৈরাজ্যবাদী ধ্যান-ধারণার জগতে প্রবেশ করেন। National Catechism বাকুনিনের নৈরাজ্যবাদ আলিঙ্গনের স্মারক রচনা। বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠা আন্দোলনের জন্য মৌলিক সংকল্প’র ধারণায়ন করেন। কেন্দ্রীভূত আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক রাষ্ট্রকে একটা ফেডারেল সংগঠন দ্বারা প্রতিস্থাপনের সংকল্প এতে পষ্ট হয়। ফেডারেল সংগঠনের মৌলিক নীতিই হল: উপর থেকে নিচে নয়, নিচ থেকে উপরে। সংগঠন প্রশ্নে বাকুনিনের ফেডারেল পদ্ধতিই পরবর্তীকালে প্যারী কমিউনেরও সংগঠন প্রণালী ছিল। একই সঙ্গে তিনি জোর দেন সামাজিক বিপ্লবে। National Catechism লেখা হয় ১৮৬৬ সালে। স্যাম ডলগফ অনূদিত ও সম্পাদিত Bakunin on Anarchy গ্রন্থে রচনাটি সংকলিত হয়েছে। বইটি ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়।-সম্পা

 

ভূমিকা

বিভিন্ন দেশের জাতীয় ক্যাটেকিজমেকিছু কিছু গৌণ বিষয়ে ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু এমন কিছু নির্দিষ্ট মৌলিক বিষয় রয়েছে যা সকল দেশের জাতীয় সংগঠন বা সংস্থাগুলোকে স্ব-স্ব-ক্যাটেকিজমের ভিত্তি হিসেবে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। বিষয়গুলো হচ্ছে:

১) যে কোনো দেশের জন্য সর্বোচ্চ জরুরি বিষয় হচ্ছে, জনগণের মুক্ত ফেডারেশনে যোগদানের ইচ্ছা যা কেন্দ্রীভূত, আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক সংস্থাগুলোকে একটা ফেডারেল সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করে। এই ফেডারেল সংগঠনের ভিত্তি হবে অঞ্চল, প্রদেশ, কমিউন, সমিতি এবং ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ও স্বায়ত্বশাসন। এই ফেডারেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রত্যক্ষভাবে বা সরাসরি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য; এটি এমন কোনো সংগঠন হবে না যা উপর থেকে নিচে বা কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত সংগঠিত। আরোপিত বা কঠোরভাবে ছত্রবদ্ধ ঐক্যের নীতি খারিজ করে এটি মুক্ত ফেডারেশনের নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হবে  নিচ থেকে উপরে দিকে বা পরিধি থেকে কেন্দ্রের দিকে। এর মুক্ত বা স্বাধীন ব্যক্তিরা বহু স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত সংঘ বা সমিতি গড়ে তুলবেন। এই সংঘ বা সমিতিগুলো গঠন করবে স্বায়ত্বশাসিত কমিউন, এর কমিউনগুলো গঠন করবে স্বায়ত্বশাসিত প্রদেশ, এর প্রদেশগুলো গঠন করবে অঞ্চল এবং এই অঞ্চলগুলো স্বাধীনভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে দেশ তৈরি করবে,পালাক্রমে আজ না হোক কাল এগুলোই সৃষ্টি করবে সর্বজনীন বিশ্ব ফেডারেশন।

২) প্রত্যেক ব্যক্তি, কমিউন, সংঘ [বা সমিতি], প্রদেশ এবং দেশের সংশ্লিষ্ট যে কোনো কাঠামো  থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্ণ অধিকারের স্বীকৃতি।

৩) রাজনৈতিক সমতা ব্যতীত রাজনৈতিক মুক্তি অসম্ভব। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতা ব্যতীত রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সমতা অসম্ভব।

সামাজিক বিপ্লবের জরুরত

প্রত্যেকটি দেশেই নিজস্ব রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি এবং বৈপ্লবিক বিকাশের স্তর অনুযায়ী এই বিপ্লবের বিস্তার ও গভীরতা কমবেশি ভিন্ন হবে। তদপুরি এমন কিছু নির্দিষ্ট নীতি আছে যেগুলো বর্তমানে জাতীয়তা বা পরিস্থিতি নির্বিশেষে জনগণকে বিপ্লবের দিকে আকৃষ্ট ও উৎসাহ করতে পারে। এই নীতিগুলো হলো:

১)  ভূমি সমাজের সাধারণ সম্পত্তি, কিন্তু এর সুফল ও ব্যবহার কেবল তাদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে যারা এই ভূমিতে শ্রমের দ্বারা চাষাবাদ করবে। সে অনুসারে, ভূমি বর্গাও উচ্ছেদ করতে হবে।

২) যেহেতু সমস্ত সামাজিক সম্পত্তি শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত, সেহেতু কাজ করতে সক্ষম ব্যক্তি যদি কাজ না করে খায় তবে সে চোর।

৩) কেবল সৎ লোকদেরই রাজনৈতিক অধিকারের অধিকারী হওয়া উচিৎ। এমন অধিকার কেবল শ্রমিকদেরই থাকবে।

৪) রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লব একই সময়ে না হলে আজ কোনো দেশেই বিপ্লব সফল হবে না। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক বিপ্লব, তা সেটা জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার্থে বা অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের জন্য বা এমনকি একটি রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য হলেও, যদি জনগণের আশু ও বাস্তবিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সাধিত না হয় তাহলে সেটা ঝুটা বিপ্লব হবে। এর উদ্দেশ্যগুলো কায়েম হবে না এবং এর পরিণতি হবে প্রতিক্রিয়াশীল।

৫) বিপ্লব অবশ্যই জনগণের জন্য না করে বরঞ্চ জনগণের দ্বারা করতে হবে। গ্রাম ও শহরের সকল জনগণকে প্রবল উৎসাহের সহিত যদি যুক্ত না করা যায় তাহলে বিপ্লব কখনোই সফল হবে না।

আর্টওয়ার্ক: ওয়ার্কার্স আপরাইজিং
শিল্পী: জ্যাকোব স্টেইনহাট
সূত্র: ওয়েমিয়ার

৬) সকল দেশের জন্য একটি সাধারণ কর্মসূচির ধারণা ও পরিচয় দ্বারা সংগঠিত হয়ে, গুটিকয়েকজনকে জড়ো না করে বরঞ্চ সকল দেশকে একটি একক কর্মপরিকল্পনায় জড়ো করবে এমন একটি গোপন সংস্থার সমন্বয়ে, অধিকাংশ গ্রামে ও শহরে একযোগে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, এই বিপ্লব শুরু থেকেই একটা স্থানিক চেহারা ধারণ করবে। আর এর মর্ম হল এই যে,একটা দেশের কোনো একটি একক বিন্দু বা কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়া বৈপ্লবিক বাহিনীর সংখ্যাধিক্য এর উদ্ভব ঘটাবে না, অথবা এমনকি রোমান সাম্রাজ্য ধরনের বুর্জোয়া আপাত-বৈপ্লবিক যুদ্ধাভিযানের চরিত্র গ্রহণ করবে না। এর বিপরীতে, দেশের সকল অংশ থেকে বিপ্লব শুরু হবে। এভাবে এটি পুরুষ, নারী ও শিশু সকলের অংশগ্রহণে প্রকৃত অর্থেই গণবিপ্লব হয়ে উঠবে এবং এটিই বিপ্লবকে অপরাজেয় করে তুলবে।

৭) শুরুতে (যুক্তির খাতিরে, যখন জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে তার নিপীড়কদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে)এই বিপ্লব খুব সম্ভব রক্তাক্ত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হবে। কিন্তু এই পর্বটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না এবং কখনোই কাঠামোগত সন্ত্রাসবাদে পর্যবসিত হবে না।… এটি একটি যুদ্ধ হবে, বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে নয়, বরঞ্চ যুদ্ধ হবে মূলত সেই সমাজবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যার উপর তাদের ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা নির্ভর করে।

৮) সুতরাং এই বিপ্লব শুরু হবে সর্বোপরি সকল প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, চার্চ, পার্লামেন্ট, ট্রাইব্যুনাল, প্রশাসন, ব্যাঙ্ক, বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের মাধ্যমে, যেগুলো কিনা রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি গঠন করে। রাষ্ট্রকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে হবে এবং দেউয়ালিয়া ঘোষণা করতে হবে; সেটা কেবল অর্থনৈতিকভাবেই নয় বরঞ্চ আরো রাজনৈতিকভাবে, আমলাতান্ত্রিকভাবে ও সামরিকভাবে (এর পুলিশ বাহিনী সহ) দেউলিয়া ঘোষণা করতে হবে। একই সাথে গ্রামীন ও শহুরে জনগণ বিপ্লবের সুবিধার্থে সকল রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিবে। তারা প্রতিক্রিয়াশীলদের দখলে থাকা সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে এবং সকল দেওয়ানি, ফৌজদারি, বিচারিক ও সরকারি নথিপত্রকে বাতিল ঘোষণা করে সম্পত্তি ও ঋণের সকল দলিলাদি পুড়িয়ে ফেলবে, দখলি [সম্পত্তির] স্থিতাবস্থা অবস্থা বজায় রাখবে। এই পদ্ধতিতে সামাজিক বিপ্লব সাধিত হবে, এবং একবার যখন বিপ্লবের শত্রুরা তাদের সমস্ত সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে তখন আর তাদের বিরুদ্ধে কোনো রক্তাক্ত পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন পড়বে না। উপরন্তু, এমনতর দুর্ভাগ্যজনক পদেক্ষেপের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার অবধারিতভাবে ভয়াবহ ও ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার দিকে নিয়ে যাবে।

৯) বিপ্লবকে যেহেতু স্থানীয়করণ করা হচ্ছে, সেহেতু এটি অগত্যা ফেডারেলিস্ট চরিত্র ধারণ করবে। ফলে প্রতিষ্ঠিত সরকারব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে কমিউনগুলো অবশ্যই একটি বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে নিজেদেরকে স্বীকৃতি দিবে: সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সকল নির্বাহককে জনগণের কাছে প্রত্যক্ষ ও কার্যকরভাবে দায়বদ্ধ থাকতে হবে এমন নীতির উপর দাঁড়িয়ে প্রশাসক ও বৈপ্লবিক ট্রাইব্যুনাল নির্বাচিত করতে হবে।

১০) এই বিপ্লবের প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়াসের সমন্বয়ে চক্রান্ত করা ও একটি শক্তিশালী গোপন সংগঠন বা সমিতি গড়ে তোলা জরুরি।

টীকা

১. ক্যাটেকিজমের (Catechism) শাব্দিক অর্থ ‘বিশেষত ধর্ম বিষয়ে প্রশ্নোত্তরে শিক্ষাদান’। গ্রীক ভাষা থেকে অনূদিত শব্দের অর্থের দ্বারা শিক্ষণ বা নির্দেশনা বা ম্যানুয়াল বোঝানো হয়। তবে শব্দটা খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে বেশি জড়িত। এটি ধর্মের শিক্ষাদানের জন্য ব্যবহৃত কোনো একটি মতাদর্শের একটি সংক্ষিপ্তরূপ বা ব্যাখ্যান বা বই। খ্রিষ্টান শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ধর্মান্তরিতদের শিক্ষাপ্রদানে এটি ভূমিকা পালন করে। ক্যাটাকিজমকে মতাদর্শিক ম্যানুয়াল হিসাবেও আখ্যায়িত করা হয়; প্রশ্নোত্তরের আকারে সেটা সাজানো হয়ে থাকে। শিক্ষণ বা নির্দেশনার এই ফরম্যাটটি কেবল ধর্মীয় পাঠেই যে ব্যবহৃত হয় তা নয়, সেকুলার পাঠেও এটি ব্যবহৃত হয়।- অনুবাদক

২. প্রবন্ধে নেশন শব্দটি ঠিক জাতি বা জাত অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। রাষ্ট্র, জাতি, সংগঠন, সংস্থা ইত্যাদি অর্থে খানিক শিথিলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে- অনুবাদক

৩. বাকুনিন বিশ্বাস করতেন যে, সাধারণ জরুরত দ্বারা তাড়িত স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত সংগঠনগুলো উপর থেকে আরোপিত বাধ্যতামূলক ঐক্যের চেয়ে বেশি টেকসই। বাকুনিনের মতে, স্বতঃস্ফুর্ত একতা ‘আসলেই পোক্ত, ফলপ্রসু এবং দৃঢ় হবে’।- ইংরেজি অনুবাদকের ফুটনোট

৪.‘পার্টি লাইন’ আরোপ করার জন্য স্বৈরশাসকের প্রতিনিধি পাঠানো।- ইংরেজি অনুবাদকের ফুটনোট

 

সহুল আহমদ

সহুল আহমদ, লেখক, অনুবাদক ও অ্যক্টিভিস্ট। গবেষণার পাশাপাশি সমকালীন বিষয়াবলীর বিশ্লেষক। জন্ম সিলেটে, ১৯৯১ সনে। পড়াশোনা করেছেন শাবিপ্রবিতে, পরিসংখ্যান বিভাগে। একাধিক জার্নাল সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত। প্রকাশিত বই: মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের অপব্যবহার; জহির রায়হান: মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনৈতিক ভাবনা; সময়ের ব্যবচ্ছেদ (সহ-লেখক সারোয়ার তুষার)। অনুবাদ: ইবনে খালদুন: জীবন চিন্তা ও সৃজন।