অরাজ
আর্টওয়ার্ক: মহাত্মা গান্ধী সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
প্রচ্ছদ » মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নৈরাজ্য

মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নৈরাজ্য

  • সেলিম রেজা নিউটন
আর্টওয়ার্ক: সত্যাগ্রহ
শিল্পী: পরেশ মৈত্র
সূত্র: টুইটার

সহিংসতার ঘনীভূত ও সুসংহত রূপের প্রতিনিধিত্ব করে রাষ্ট্র। ব্যক্তির আত্মা থাকে, কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু আত্মাবিহীন একটা মেশিন, সেহেতু তা কখনোই সহিংসতা থেকে মুক্ত হতে পারবে না— কেননা এর খোদ অস্তিত্বটাই তো সহিংসতার কাছে ঋণী। (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৪-ক: ৩১৮)

মুখের মহাত্মা নয়, অহিংস প্রতিরোধ

এই ৩০শে জানুয়ারি ছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ৬৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। চে গুয়েভারার সহিংস ইমেজ-ইতিহাস নিয়ে বাংলাদেশে যাঁরা কর্পোরেট-ব্যবসায় এবং বাম-ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন, তাঁদের কারো পক্ষেই এই দিনটাকে স্মরণ করা সম্ভব হয়নি। কর্তৃত্বপরায়ণ ও হিংসাজীবী বুদ্ধিজীবী-দল-প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে ব্যবসায় নিয়োজিত হওয়া নিতান্তই কঠিন। কেননা এঁরা সকলেই আজ রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে কোনো না কোনোভাবে নিয়োজিত। আর মহাত্মা গান্ধীর খুন-হয়ে-যাওয়া ইমেজ-ইতিহাস তো আগাগোড়াই রাষ্ট্রহীন সমাজের অভিসারী। তিনি যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধানের নোংরা গদিতে বসেননি, সেটা কিন্তু এমনি-এমনিই নয়। শুরুতেই উদ্ধৃত মহাবাক্যটি তার ইশারা মাত্র। শৈব-তান্ত্রিক মুক্তি-সাধক মহাত্মা গান্ধীর চমকে দেওয়ার মতো এই বাক্যটি সম্পর্কে কি আমরা জানতাম? কিংবা রাষ্ট্রের সহিংস চরিত্র সম্পর্কে গান্ধীর এই বিশ্লেষণ-ধারা প্রসঙ্গে কি আদৌ আমরা কিছু জানতাম? না, জানতাম না।

ধন্যবাদ ইতিহাসকে এবং শাসন-দীক্ষায়ন-প্রকৌশলকে: গান্ধীকে আজ মুখের ‘মহাত্মা’ বানিয়ে, প্রতিরোধ-অসম্ভব-অহিংসা বানিয়ে, ফটো করে তুলে রাখা হয়েছে রাষ্ট্রীয় অফিসের দেওয়ালে দেওয়ালে। মহাত্মা গান্ধী বলতে আজ আমরা স্রেফ দুধ-ভাত-অহিংসার কথা মুখস্থ করি; ভুলে যাই ‘সাহসীদের অহিংসা’র কথা (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৪৬: ১২৯), কিংবা ‘অহিংস প্রতিরোধ’-এর কথা (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৪-খ: ৫০৭)।

গান্ধী কি অ্যানার্কিস্ট ছিলেন?

গান্ধীর কাছ থেকে রাষ্ট্র সম্পর্কে এরকম তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো নৈরাজ্যপ্রবণ মতামত শুনতে আমরা, আমি অন্তত, প্রস্তুত ছিলাম না। অথচ খোদ কংগ্রেস পার্টির শুরুর দিককার সভাপতি স্যার শঙ্করন নায়ার ১৯২২ সালেই সুবিস্তারিত তথ্যপ্রমাণসহ আস্ত একটা বই লিখে ফেলেছিলেন এ কথা প্রমাণ করার জন্য যে গান্ধী আসলে একজন অ্যানার্কিস্ট (স্যার শঙ্করন নায়ার, ১৯২২)। তাঁর অভিযোগ সত্য ছিল। তাঁর প্রমাণাদি গ্রাহ্য ছিল। কিন্তু আমার দশক-জোড়া নৈরাজ্য-অধ্যয়নের ধারা-বাহিকতায় কয়েক বছর আগে যখন ‘গান্ধী কি অ্যানার্কিস্ট ছিলেন?’ নামের রচনাটা (জোশ ফাত্তাল, ২০০৬) চোখে পড়ে, তখন আমার বিরাগই উত্পন্ন হয়েছিল বরং।

আর্টওয়ার্ক: আইনস্টাইন গান্ধী মার্কস হিটলার
শিল্পী: মকবুল ফিদাহ হুসেন
সূত্র: পিনটারেস্ট

মার্কসীয় ডগমার সাথে অন্তরঙ্গ-ঐকান্তিক-সুদীর্ঘ সংসর্গ থাকার কারণে আগা-গোড়াই আমি যেকোনো, বিশেষত অ্যানার্কিস্ট, ডগমা সম্পর্কে সাবধান থাকি। তাই, এর আগে, লেভ তলস্তয় খ্রিষ্টিয় অ্যানার্কিস্ট ঘরানার সক্রিয় মানুষ ছিলেন বলে যাবতীয় নৈরাজ্য-ইতিহাসবিদের কাছে শুনেও বিরক্ত হয়েছিলাম, যদিও সেসব ইতিহাসবিদ (যেমন পিটার মার্শাল, ২০০৮: ৪২২-৪২৭) কেউই ফেলনা ছিলেন না। কিন্তু যখন সত্যি সত্যি তলস্তয়ের ‘রুশ উদারনীতিবাদীদের প্রতি একটি চিঠি’ (১৮৯৬), ‘দেশপ্রেম ও সরকার’ (১৯০০), ‘তুমি খুন করবে না’ (১৯০০), ‘নৈরাজ্য প্রসঙ্গে’ (১৯০০), ‘জার এবং তাঁর সহকারীদের প্রতি’ (১৯০১), ‘শ্রমজীবী জনগণের প্রতি’ (১৯০২), গান্ধী-তলস্তয় পত্রবিনিময়-সংকলন (তলস্তয়, ১৯৩৭) ইত্যাদি রচনা পড়তে থাকলাম তখন হাঁ হয়ে যাওয়া ছাড়া পথ থাকল না। বিশেষ করে যখন ডেভিড স্টিফেন্সের সম্পাদনা করা তলস্তয়-রচনা সংকলন সরকার মানে সহিংসতা (তলস্তয়, ১৯৯০) হাতে এল তখন একেবারে টাশ্‌কি খেয়ে গেলাম: তলস্তয়ের অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও স্বরচিত নৈরাজ্য-প্রবণতা সম্পর্কে আর সামান্যতম সংশয়ও থাকল না।

তারপরও গান্ধী নৈরাজ্যবাদী ছিলেন কিনা তা নিয়ে জোশ ফাত্তালের উপরোক্ত অন্বেষণ আমাকে সংশয়েই রাখে। রচনাটিতে সেকেন্ডারি সোর্স থেকে কোট করা গান্ধীর এমনসব গা শিউরানো নৈরাজ্যিক কথা ছিল, যেগুলো গান্ধীর নিজের বইয়ে স্বচক্ষে দেখা ছাড়া শান্তি পাচ্ছিলাম না। আজকের শুরুর উদ্ধৃতিটাও ফাত্তালের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। তিনি সেটা পেয়েছিলেন ইগনাটিয়াস জেসুডাসান (১৯৮৭) এর গ্রন্থে। শেষ পর্যন্ত, ক-দিন আগে ভারত-সরকারের প্রকাশ করা মহাত্মা গান্ধীর ৯৮ খণ্ডের, ৫০ হাজার পৃষ্ঠার, রচনা সংগ্রহ (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৯৯) ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করার পর ঐ উদ্ধৃতি-সম্বলিত মূল রচনাটা যখন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকল তখন আর হতাশার সীমা থাকল না। আমি নিরুপায় হয়ে স্বরাজ-অরাজ-নৈরাজ্যের দৃষ্টান্ত দেখতে থাকলাম পাতার পর পাতায়।

আত্মাহীন মেশিনের কথা

তো, কী প্রসঙ্গে কোথায় রাষ্ট্রের সহিংস চরিত্র আর আত্মাহীনতার কথা তুলেছিলেন গান্ধী? সেটা ছিল ১৯৩৪ সালের নভেম্বর মাসে গান্ধীর প্রাইভেট সেক্রেটারি নির্মল কুমার বসুর নেওয়া একটি সাক্ষাত্কারে। প্রথমে সেটা দ্য মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় এবং পরে দ্য হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় ছাপা হয়। এবং সেটা মোটেও কোনো মুখ-ফস্কানো কথা ছিল না। কথা উঠেছিল খাদি দিয়ে পুঁজিবাদ ও পুঁজিপতিদেরকে ঠেকানো যাবে কিনা তাই নিয়ে। সে কথা গিয়ে ঠেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সাথে অহিংসার সম্পর্ক প্রসঙ্গে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অসমতা যেহেতু সমাজে হিংসা তৈরি করে, নির্মল বসু তাই জানতে চাইছিলেন সম্পত্তির ব্যক্তি-মালিকানার জায়গায় রাষ্ট্রীয় মালিকানা কায়েম করে তাহলে আমরা সহিংসতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করব না কেন। উত্তরে গান্ধীর কথা তাঁর মুখ থেকেই শুনি:

এটা ব্যক্তি-মালিকানার চেয়ে ভালো। কিন্তু সহিংসতার নিরিখেই— সেটাও আপত্তিকর। এটা আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস যে রাষ্ট্র যদি সহিংসতা দিয়ে পুঁজিবাদকে দমন করে, তাহলে রাষ্ট্র নিজেই সহিংসতার চক্রে জড়িয়ে যাবে, এবং কখনোই তা অহিংসার জন্ম দিতে পারবে না। সহিংসতার ঘনীভূত ও সুসংহত রূপের প্রতিনিধিত্ব করে রাষ্ট্র। ব্যক্তির আত্মা থাকে, কিন্তু রাষ্ট্র যেহেতু আত্মাবিহীন একটা মেশিন, সেহেতু তা কখনোই সহিংসতা থেকে মুক্ত হতে পারবে না— কেননা এর খোদ অস্তিত্বটাই সহিংসতার কাছে ঋণী। (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৪-ক: ৩১৮)

এরকম সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা শোনার পরও নির্মল বসু রাষ্ট্রের হাতে অন্তত কিছু ক্ষেত্রে ‘সহিংসতার ন্যূনতম প্রয়োগ’ এর দায়িত্ব দেওয়ার ব্যাপারে নাছোড়। বিশেষ একটা উদাহরণ দিচ্ছেন তিনি। বলছেন: ধরুন, এক জন শিল্পী তাঁর ছেলের কাছে কিছু ছবি রেখে গেলেন। ছেলেটা ছবিগুলোর মূল্য বুঝল না। সে সেগুলো বেচে দিল বা নষ্ট করে ফেলল। এতে করে এক জনের আহাম্মকির জন্য পুরো জাতির একটা ক্ষতি হয়ে গেল। তখন কি গান্ধীর মনে হবে না যে ঐ ছেলের কাছ থেকে ছবিগুলো নিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহিংসতার ন্যূনতম প্রয়োগ করাটা রাষ্ট্রের পক্ষে যুক্তিসঙ্গত? উত্তরে গান্ধী বলছেন:

হ্যাঁ, রাষ্ট্র আসলে ঐ জিনিসগুলো নিয়ে নেবে, এবং আমার বিশ্বাস, [এক্ষেত্রে] রাষ্ট্র যদি সহিংসতার ন্যূনতম প্রয়োগ ঘটায় তবে সেটা যুক্তিসঙ্গতও হবে। কিন্তু এই ভয়টা সবসময়ই থেকে যায় যে রাষ্ট্রের সাথে যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করবেন তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র হয়ত সহিংসতার অতিরিক্ত প্রয়োগই ঘটাবে। (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৪-ক: ৩১৮)

নিজেরই মনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই: এ কি গান্ধীর কথা শুনছি নাকি প্রুধোঁ বাকুনিন লুইজ মিশেল গিওম হিন্স ক্রপোৎকিন ম্যালাতেস্তা বা এমা গোল্ডম্যানদের কথা শুনছি! কিন্তু এখানেই থেমে যাচ্ছেন না গান্ধী। বলছেন:

ব্যক্তিগতভাবে যেটা আমি বেছে নেব সেটা রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতার ঘনীভবন নয় …; কেননা আমার মতে, রাষ্ট্রের সহিংসতার চেয়ে ব্যক্তি-মালিকানাজনিত সহিংসতা কম ক্ষতিকর। (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৪-ক: ৩১৮)

এবার নির্মল কুমার বসুর প্রশ্ন:

তাহলে কি বাপু আমরা ধরে নেব আপনার সাথে সমাজতন্ত্রীদের [পড়ুন ‘বলশেভিক সমাজতন্ত্রীদের’] মৌলিক পার্থক্যটা এইখানে যে আপনার বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ যতটা না অভ্যাসের বশে জীবন চালায় তার চেয়ে বেশি চালায় আত্ম-নির্দেশনার সাহায্যে, আর তাঁরা বিশ্বাস করেন নিজ সিদ্ধান্তের তুলনায় অভ্যাস দিয়েই বরং জীবন চালায় মানুষ। তা-ই যদি হয় তাহলে আপনি আত্মশুদ্ধির চেষ্টা চালাতে থাকেন কেন যখন নাকি তাঁরা সচেষ্ট হন এমন একটা সিস্টেম গড়ে তুলতে যেখানে একজন মানুষের অন্য মানুষকে শোষণ করার বাসনা চরিতার্থ করাটা অসম্ভব বলে বিবেচিত হবে? (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৪-ক: ৩১৮)

ইউরোপের উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে গড়ে ওঠা ‘শ্রমজীবী মানুষদের আন্তর্জাতিক সমিতি’ তথা ‘প্রথম আন্তর্জাতিক’-এর ভেতরে মার্কসবাদীদের সাথে নৈরাজ্যবাদীদের রাষ্ট্রতর্ক তীব্র হয়ে উঠেছিল যে প্রশ্নে, এ তো ঠিক সেই প্রশ্ন! এখানে নির্মল কুমার বসু যেন প্রতিনিধিত্ব করছেন মার্কসবাদী-বলশেভিক রাষ্ট্রতন্ত্রীদের, আর গান্ধী যেন প্রতিনিধিত্ব করছেন নৈরাজ্যবাদীদের। তো, নির্মল বসুর উপরের প্রশ্নটার উত্তরে গান্ধী বলছেন:

মানুষ যে আসলে অভ্যাস দিয়েই চলে সে কথা স্বীকার করে নিয়েও আমার মনে হয়, নিজের ইচ্ছাশক্তির অনুশীলনের সাহায্যে বাঁচাটাই তার জন্য অধিকতর ভালো। আমি আরো বিশ্বাস করি, মানুষ তাঁদের ইচ্ছাশক্তিকে এতটা দূর পর্যন্ত উন্নত করে তুলতে সক্ষম যে তার ফলে শোষণের ব্যাপারটা কমে এসে ঠেকবে একেবারে ন্যূনতম পর্যায়ে। রাষ্ট্রের ক্ষমতার বাড়বাড়ন্তকে আমি চরমতম ভয়ের চোখে দেখি, কেননা যদিও নাকি দেখতে মনে হয় যে শোষণের প্রশমন ঘটানোর মাধ্যমে রাষ্ট্র আমাদের মঙ্গল সাধন করছে, কিন্তু আসলে তা মানব-জাতির সর্বোচ্চ ক্ষতি সাধন করে— ব্যক্তিসত্তার ধ্বংস ঘটানোর মাধ্যমে; অথচ যাবতীয় প্রগতির গোড়ায় আছে এই ব্যক্তিসত্তাই। (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৪-ক: ৩১৯)

কিন্তু গান্ধীর মতো সমাজ-শিক্ষকরা তো আর প্রতিদিন দুনিয়ায় জন্মান না, কালেভদ্রে আসেন। তাহলে মানুষের আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে গান্ধীর মতো মানুষদের ব্যক্তি-প্রভাবের ওপর নির্ভর করে পরে খেই হারিয়ে ফেলার চাইতে বিশেষ কোনো প্রকার সমাজ-সংগঠন গড়ে তোলা এবং তার ওপর নির্ভর করাটাই কি বেশি কাজের নয়? নাছোড় নির্মলের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন পিছ ছাড়ে না। তাতে অবশ্য গান্ধীর ‘স্বরাজ’-এর নৈরাজ্যমুখীনতাকে বুঝতে আমাদের সহজ হয়। নির্মলের উত্তরে গান্ধীর কথা:

আমার কথা বাদই থাক। আপনাকে অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে, মানব-জাতির সমস্ত মহান শিক্ষকের প্রভাব তাঁদের জীবন অতিবাহিত হওয়ার পরেও থেকে গেছে। মুহম্মদ বুদ্ধ যিশুর মতো প্রত্যেক নবীর শিক্ষার মধ্যে একটা অংশ থাকে স্থায়ী ধরনের, আর আরেকটা অংশ থাকে যা তাঁদের সময়ের প্রয়োজন ও চাহিদার জন্য উপযোগী ধরনের। … কিন্তু তা যা-ই হোক, আপনি দেখতে পাবেন যে এইসব মানুষের প্রভাব তাঁরা চলে যাওয়ার পরও টিকে থেকেছে। অধিকন্তু, যা আমি অনুমোদন করি না তা হলো বলপ্রয়োগের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সংগঠন, যেমন রাষ্ট্র। তবে, স্বতঃস্ফূর্ত সংগঠন তো থাকতেই হবে। (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৪-ক: ১৩৯)

অধিকন্তু: গান্ধী যে ‘আদর্শ সমাজ’ এর স্বপ্ন দেখেন সেটা ‘রাষ্ট্রহীন সমাজ’-এর দিকে অগ্রসরমান একটা পথই বটে (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৪৬: ১২৯)। থামতে পারছি না, গান্ধীকে কোট করতে ভালো লাগছে:

… একটা আদর্শ সমাজে কি রাষ্ট্র-ক্ষমতা থাকবে কিংবা এরকম একটা সমাজ কি রাষ্ট্রহীন হবে? আমার মনে হয় এই প্রশ্নটা অবান্তর। আমরা যদি এরকম একটা সমাজ গঠন করার দিকে কাজ করে যেতে থাকি, অন্তত কিছুটা পর্যন্ত তো সেটা বাস্তবায়িত হতে বাধ্য এবং ততটা পর্যন্ত তো মানুষ তা থেকে উপকার পাবেই। ইউক্লিড সরলরেখার যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে করে তার কোনো প্রস্থ থাকার কথা না, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কেউ সে রকম কোনো সরলরেখা আঁকতে পারেন নি এবং কোনো দিন কেউ পারবেনও না। তার পরও আমরা জ্যামিতিতে উন্নতি ঘটাতে পারি শুধু মাত্র এই ধরনের একটা সরলরেখার কথা অনুমান করে নিয়েই। প্রত্যেকটা আদর্শের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্য।’ (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৪৬: ১২৯)

স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি

আজকের রাষ্ট্র-কর্পোরেট-রাক্ষসের হাত থেকে আমাদের সমাজটাকে বাঁচানোর জন্য চাই গান্ধীর মতো স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। কেবল স্বাধীন (স্ব+অধীন) যাপন ও অনুশীলনের সার্বক্ষণিক, আমৃত্যু প্রচেষ্টার ভেতর দিয়েই এরকম মাথা-উঁচু বিনয়ী ব্যক্তি গড়ে উঠতে পারেন। কর্তৃত্বপরায়ণ ও শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ তো অনেকেই আছেন কিন্তু অন্যের স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদাকে নিজের স্বাধীনতার আর আত্মমর্যাদার গ্যারান্টি হিসেবে দেখার মতো মানুষই আজ চাই।

আর্টওয়ার্ক: গান্ধী
শিল্পী: মকবুল ফিদাহ হুসেন
সূত্র: পিনটারেস্ট

কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র-ক্ষমতার বিপরীতে গান্ধীর এই যে ব্যক্তিসত্তার ‘আত্মনির্দেশনা’ > আত্ম-অধীনতা > স্ব-অধীনতা > স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা অভিমুখিন চিন্তা-তৎপরতা – এরই নাম মুক্তিপরায়ণতা, নৈরাজ্য। গান্ধীর জন্য যেটা স্বরাজ, আমার মতো অ্যানার্কিস্টের জন্য সেটাই অরাজ। উপরন্তু ‘স্বরাজ’ কথাটা দিয়ে প্রত্যেক মানুষের নিজেই নিজের ‘রাজা’ হয়ে ওঠার কামনাকে ধারণ করা যায়। কিন্তু এক দিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এক-দেড় দশকের অন্ধকার কাল-পর্বে সন্ত্রাসবাদের কারণে এবং অন্য দিকে বিপুলতম নৈরাজ্যবিরোধী প্রচারণার কারণে সারা বিশ্বে এমন বিভ্রান্তি তৈরী হয়েছে যে আজও লোকে নৈরাজ্য বলতে বিশৃঙ্খলা বোঝে। অন্ধকার ঐ কাল-পর্বে নৈরাজ্যবাদীদের সামান্যতম আইনী তত্পরতার সুযোগও রাখে নি ইউরোপের সরকারগুলো। ফলে গভীর হতাশায়, নির্মম অত্যাচারে বিগড়ে গিয়ে সন্ত্রাসের জনবিচ্ছিন্ন পথ বেছে নেন নৈরাজ্যবাদীদের একটা অংশ। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়াতেই, সেই ১৯০৭ সালের আমস্টার্ডাম-কংগ্রেসে শুধরে নিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন পথে। আর আজকের একুশ শতকের নৈরাজ্যবাদীদের ‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন’ তো প্রবলভাবে গান্ধীর অহিংস প্রতিরোধের পথই বেছে নিয়েছে (ডেভিড গ্রেইবার, ২০১১-খ; ডেভিড গ্রেইবার, ২০১২-খ)।

রাষ্ট্রীয় হিংসানীতির ক্রমবর্ধমান বিপদ

আজকের বাংলাদেশে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এমন কোনো মানুষ নাই যে আতঙ্কে নাই, দুশ্চিন্তায় যার ঘুম ব্যাহত হচ্ছে না। অপারেশন ক্লিন হার্ট, র‌্যাব-চিতা-কোবরা প্রভৃতির ক্রমাগত ক্রসফায়ার, সেনা কেয়ারটেকার-সরকারের সময় সারাদেশব্যাপী যৌথবাহিনীর আপামর নির্যাতন, এবং বিডিআর-বিদ্রোহের জন্য ঘোষিত রাষ্ট্রীয় সাধারণ ক্ষমা কার্যত প্রত্যাহার করে নিয়ে হাজার হাজার জওয়ানের চাকুরিচ্যুতি, কারাদণ্ড নির্যাতন, পরিবার তছনছ হয়ে যাওয়া, আর আটকাবস্থায় ৪৭ জন তাজা মানুষের মৃত্যু ঘটানোর মতো পরিস্থিতি রচনা করার মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজ (মার্কিন দূতাবাসের উইকিলিকস-তারবার্তা মোতাবেক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ-সাংবাৎরিক সামরিক-আইনগত-প্রশিক্ষণগত তত্ত্বাবধানে প্রাপ্ত অস্ত্র, সমরবিদ্যা, জেরা-জিজ্ঞাসাবাদ-নির্যাতনের উন্নততর তত্ত্বের বাস্তব অনুশীলন করে চলেছে আজ বহু বছর ধরে।

আর্টওয়ার্ক: মহাত্মা
শিল্পী: মকবুল ফিদাহ হুসেন
সূত্র: পিনটারেস্ট

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে জামাত-বিএনপির অযৌক্তিক  অবস্থান এবং প্রকারান্তরে বিচারের ও খোদ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁদের সুসংগঠিত সহিংসতার উসিলায় রাষ্ট্র আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে যুদ্ধাপরাধ-বিচারের বিরোধীদেরকে সামরিক কায়দায় মোকাবেলা করতে গিয়ে আমরা যে আমাদের গরিব গণতন্ত্রের বিদ্যমান মুক্ত পরিসরগুলিকেও সামরিকতার আওতায় না এনে ফেলি। আমরা যেন সমাজকে একেবারে ভিন্নমতশূন্য করে ফেলার দিকে ঝুঁকে না পড়ি। তা না হলে অত্যাসন্ন সদা-দুঃস্বপ্নময় রাষ্ট্রীয় নিগ্রহ থেকে সামনের দিনগুলোতে শেষ পর্যন্ত আমরা কেউই বাঁচব না। এ নিয়ে এখনও যাঁরা যথেষ্ট ভাবিত নন, তাঁদের জন্য মহাত্মা গান্ধীর রাষ্ট্র এবং সহিংসতা সম্পর্কিত চিন্তাপ্রণালী উদ্দীপক হয়ে ওঠার সুযোগ আছে বৈকি।

বইপত্রের হদিস

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩০। Mohandas Karamchand Gandhi, “Letter to Narandas Gandhi” (Tuesday morning, September 16, 1930 ), The Collected Works of Mahatma Gandhi (Electronic Book), VOL. 50:23 AUGUST,1930-5 JANUARY,1930, New Delhi, Publications Division of Government of India, 1999, in 98 Volumes.

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৩। Mohandas Karamchand Gandhi, “Five Questions on Varnadharma” (Harijan Sevak, 21-4-1933), The Collected Works of Mahatma Gandhi (Electronic Book), VOL. 60 : 10 MARCH, 1933-26 APRIL, 1933, New Delhi, Publications Division of Government of India,1999, in 98 Volumes.

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৪-ক। Mohandas Karamchand Gandhi, “Interview to Nirmal Kumar Bose” (Interviewed: November 9/10, 1934). (Published first in The Modem Review and then reproduced in The Hindustan Times, 17-10-1935). The Collected Works of Mahatma Gandhi, Volume 65.

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৪-খ। Mohandas Karamchand Gandhi, “Speech at A.I.C.C. Meeting, PatnaÍI. (Published in The Bombay Chronicle, 20-5-1934 and 21-5-1934). The Collected Works of Mahatma Gandhi, Volume 63.

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৪৬। Mohandas Karamchand Gandhi, “Congress Ministries and Ahimsa”, Harijan Sevak, 15-9-1946. (A translation of this was also published in Harijan, 15-9-1946). The Collected Works of Mahatma Gandhi, Volume 92.

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৯৯। Mohandas Karamchand Gandhi, The Collected Works of Mahatma Gandhi (Electronic Book), New Delhi, Publications Division of Government of India,1999, in 98 Volumes.

 

রচনা: জানুয়ারি ২০১৩। পরিমার্জনা: মার্চ ২০১৩। দৈনিক বণিক বার্তা: ৯ই মার্চ ২০১৩

সম্পাদকীয় নোট: রচনাটি লেখকের অচেনা দাগ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।

 

সেলিম রেজা নিউটন

লেখক