অরাজ
আর্টওয়ার্ক: লেনিন অন ট্রাক শিল্পী: নিকোলাই কারাকোরাভ সূত্র: ফাইন আর্ট আমেরিকা
প্রচ্ছদ » মর্গান ও লেনিন প্রসঙ্গে

মর্গান ও লেনিন প্রসঙ্গে

শহিদুল ইসলাম

উনিশ শতক বিশ্বের পাঁচজন মহামানবের জন্ম দেয়। তাঁরা হলেন চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২), কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩), লুইস হেনরি মর্গান (১৮১৮-১৮৮১) ফ্রেডারিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫) এবং  ভি. আই. লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)। আমার মনে প্রশ্ন দেখা দেয় অনেক আগে যে, ডারউইন, মার্কস ও এঙ্গেলস এই তিনজন যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের পাঠ্যসূচিভূক্ত করা হয়েছে, মর্গান ও লেনিনের ক্ষেত্রে তা হল না কেন? ১৮৭৭ সালে মর্গানের সাড়া জাগানো Ancient Society  প্রকাশিত হয়। তাঁকে আমেরিকার নৃতত্ত্বের জনক বলা হয়। অথচ নৃতাত্বিক বিভাগের বাইরে সাধারণ সাংস্কৃতিক জগতে তিনি আজও অনালোচিতই রয়ে গেলেন। কেন? ১৯৭৫ সালে বুলবন ওসমান বইটির বাংলা অনুবাদ করেন। বাংলা একাডেমি  বইটি প্রকাশ করে। বুলবন ওসমান বইটির ‘পূর্বাপরে’ আমাদের জানান যে, আদিম সমাজ  প্রকাশিত হবার পর কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস বইটির ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তাঁরা উক্ত বইয়ের দ্বারা সমাজ বিবর্তনের ‘প্রতি বেশি আকৃষ্ট’ হন। তাই বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বের সমাজ ও নৃবিজ্ঞানীরা মর্গানের অবদানকে যথাযথ মূল্য না দিয়ে তাঁর তথ্যসমূহের ভুলভ্রান্তি খোঁজায় নিযুক্ত হয়ে পড়েন। মর্গান মার্কসবাদী ছিলেন না। বরং ওসমান বলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন পুঁজিবাদই হল সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজব্যবস্থা, যুক্তরাষ্ট্রই হল সর্বশ্রেষ্ঠ গণতন্ত্র এবং খৃষ্টধর্মই হল একমাত্র সত্য ধর্ম। তাহলে কি মার্কস-এঙ্গেলসের প্রশংসা করাই তাঁর কাল হয়ে দাঁড়ালো? সেটাই কি তাঁর জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দিল? বুলবন ওসমান তাই মনে করেন। (ওসমান, ২০০০:৯)

লুইস হেনরি মর্গান

সম্প্রতি ড. ক্রিস্টোফার রায়ান ও ক্যাসিলডা জেথার Sex At Down বইতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মর্গানের বক্তব্য বিবেচনা করেছেন। সেই সঙ্গে যৌনতা সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল ডারউইনের চেয়ে অনেক বেশি সত্যের কাছাকাছি। সেই বইতে তাঁরা মর্গান সম্পর্কে লেখেন,

The Only American scholar to have been cited by each of the other intellectual giant of his century Darwin, Freud and Marx, many consider Morgan the most influential social scientist Of his era and the father of American anthropology. Ironically, it may Marx and Engels’s admiration that explains why Morgan’s work is not better known today. Though he is was no Marxist…. (Ryan, Jetha 2100: 64)

এতে প্রমাণ হয় যে, ভলতেয়ারের শখের গণতন্ত্রের আজ কি পরিণতি? যে সমাজ ভিন্ন মতাবলম্বিদের যথাযথ সম্মান দিতে জানে না সে সমাজ কি গণতান্ত্রিক? সমাজের শাসক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী কতটা রাজনৈতিক ভাবাদর্শ দ্বারা অন্ধ তার বড় প্রমাণ। কেবল সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা অন্ধেত্বের কথা বিশ্বময় প্রচার করা হয়। এটা কি পুঁজিবাদী সমাজের বুর্জোয়া শাসক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মতান্ধতা নয়?

দুই.

এবার লেনিন প্রসঙ্গে। লেনিন একটি রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী এবং ১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাই বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্ব তাঁকে ত্যাগ করবে, এতে আমি আশ্চর্য হই না। তাঁর রাজনৈতিক মতবাদের বিরোধিতা আমি করতেই পারি, তাঁর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরোধিতা আমি করতেই পারি। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, লেনিনের নাম যদি উক্ত মতাদর্শের সঙ্গে মিশে না যেত, তাহলে প্লেটো, অ্যারিস্টেটল, কান্ট, হিউম, হবস, স্পিনোজা, হেগেলের সঙ্গে তাঁরও নাম একজন দার্শনিক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিভূক্ত হত।

ভি আেই লেনিন

পাণ্ডিত্যের বিচারে সমসাময়িক দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের চেয়ে তিনি কোনভাবে কম ছিলেন না। রাজনীতি, আন্দোলন, বিপ্লবের সাফল্য ও ব্যর্থতার পাশাপাশি তিনি দুহাতে কেবল সমসাময়িক ঘটনাই নয়, পৃথিবীর সমাজ, সভ্যতা ও অর্থনীতি নিয়ে লিখে গেছেন। সম্ভবত তাঁর রচনার ৯৭ খণ্ডের মধ্যে আমার কাছে আছে ৬২ খণ্ড। তাঁর Philosophical Notebook বইটি পৃথিবরি ইতিহাসে এক জীবন্ত দলিল। সেই সঙ্গে সমসাময়িক ঘটনার উপর তাঁর ব্যক্তিগত মতের চুলচেরা বিশ্লেষণ। কিন্তু আমি যে খণ্ডটি নিয়ে আজ লিখতে বসেছি, সেটি তাঁর তৎকালীন বস্তুবাদের আড়ালে ভাববাদী দার্শনিক আধিপত্যের মুখোশ উন্মোচনকারী। সেটি ১৪ নম্বর খণ্ড। নাম Materialism And Empirio Criticism: Critical Comments On A Reactionary Philosophy । বইটি প্রকাশ করেছে মস্কোর প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, লেখা ১৯০৮ সালে। ১৯৭২ সালে বইটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। লেনিন যদি রাজনীতি বিপ্লব না করে কেবল এই একটি বই লিখতেন, তাহলে আমার বিশ্বাস বিশ্বের একাডেমিক মহল তাঁকে এভাবে দর্শনের বাইরে রাখতে পারতেন না। এই বইটি সামনে রেখে দেবীপ্রসাদ চট্টপাধ্যায় লিখেছেন দার্শনিক লেনিন । (চট্টপাধ্যায় ১৯৮০)। এখানে তিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানের ইতিহাসকার ও দার্শনিক জে. ডি. বার্নালের একটি উক্তির উল্লেখ করেছেন। ‘লেনিন যদি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অন্যতম না’ও হতেন, তাহলেও নিছক অর্থনীতি ও দর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর বুদ্ধিবিদ্যার অবশ্যই স্বীকৃতি হত। বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ বিচারবাদ গ্রন্থে মাখের দৃষ্টবাদ (Positivism) প্রবণতা এবং এই প্রবণতার বশবর্তী হয়ে তাঁর অনুগামীরা রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছিলেন তা বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান যে, বস্তুনিষ্ট বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্ত দাবি সত্বেও সকলে যে পথে এগুচ্ছিলেন তা বার্কলে ও প্লেটোর ভাববাদে প্রত্যাবর্তনের পথ ছাড়া আর কিছু না; অতএব এ মত প্রতিক্রিয়াকেই সমর্থন করে। (চট্টপাধ্যায়: ২৫; Bernal, J. D: 1969 : 1169)

আর্নেস্ট মাখ

উনিশ শতকের শেষের দিকে আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের যাত্রাপথটা নির্বিঘ্ন ছিল না। তৎকালীন দৃষ্টবাদ (Positivism) শক্তিবাদ (Energitivism) প্রভৃতি পরাক্রমশালী দর্শনের বিরুদ্ধে কঠিন এক লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল নবজাতক আধুনিক বিজ্ঞানকে এবং সেইসব ভাববাদী দর্শনকে পরাজিত করে নিজের জায়গা করে নিতে হয়েছিল। সেই নবজাত বিজ্ঞানের প্রতি দর্শন ও জ্ঞানতত্ত্বের সামান্যই সমর্থন ছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনাকারীরা অষ্ট্রীয় পদার্থবিজ্ঞানী ও দার্শনিক  আর্নেস্ট মাখের (১৮৩৮-১৯১৬) দৃষ্টবাদের সুনামিতে ভেসে গিয়েছিলেন। আইনস্টাইন, ম্যাক্স প্লাঙ্কও বাদ যাননি। ১৮৮০ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে দৃষ্টবাদ ছিল ইউরোপের প্রতিনিধিত্বশীল দার্শনিক মতবাদ। নবজাত পদার্থবিজ্ঞানীরা দৃষ্টবাদকে বিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত অংশ বলেই মনে করতেন। তাঁরা তখন বুঝতে পারেননি যে, এটা বস্তুগত পৃথিবীর বিষয়নিষ্ঠ (Objective) ব্যাখ্যার জায়গায় বিষয়ীগত (Subjective) ব্যাখ্যা ছাড়া কিছু নয়। ম্যাক্স প্লাঙ্ক পরে বলেন যে, ‘আমি ১৮৮৫ সাল থেকে ১৮৮৯ সালের মধ্যে মাখবাদের কড়া সমর্থক ছিলাম’। (Blackmore, J.T: 216; চট্টপাধ্যায় ১৯৮০:২৩২)

কিন্তু তিনি ১৯১১ সালের ৯ ডিসেম্বর রাইডেন বক্তৃতায় মাখবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সে সময় মাখবাদের ভাববাদে বন্দী আইনস্টাইন সহজভাবে সে বিতর্ক মেনে নিতে পারেননি। ১৯১১ সালে এক চিঠিতে আইনস্টাইন মাখকে বলেন, ‘আপনার প্রয়াসের তাৎপর্য প্লাঙ্ক কেন বুঝতে পারেন না, আমি তা ঠিক বুঝতে পারি না।’ ১৯১৩ সালে মাখের কাছে লেখা আর এক চিঠিতে তিনি প্লাঙ্কের অবিবেচনাপ্রসূত সমালোচনা খণ্ডন করেন। লেখেন, ‘এমন কি যাঁরা নিজেদের মাখ-বিরোধী বলে মনে করেন তাঁদেরও হুঁশ থাকে না যে মাতৃদুগ্ধ পানের মতই তাঁরা নিজেরা মাখের মত থেকে কতটা পুষ্টি সংগ্রহ করেছেন।’ (চট্টপাধ্যায় ১৯৮০: ২৭, Holton: 1973:222) মাখবাদের মোহ থেকে মুক্ত হতে আইনস্টাইনের আরও প্রায় দশ বছর সময় লাগে। ১৯২১ সালে আইস্টাইন তখনই মাখবাদের মোহ থেকে মুক্ত যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে ১৯১৬ সালে মৃত্যুর পূর্বে মাখ আপেক্ষিকতাবাদ ও কোয়ান্টাম তত্ত্বকে আক্রমন করার জন্য নিজকে প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন। প্লাঙ্কের মত তিনিও ১৯২২ সালে প্যারিসের এক সভায় মাখের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘মাখ একজন উৎকৃষ্ট বিজ্ঞানী কিন্তু একজন নিকৃষ্ট দার্শনিক।’ (Clark:1972:205)| ৬৮ বছর বয়সে লেখা তাঁর আত্মজীবনীতে ভুল স্বীকার করে লেখেন, ‘যাহোক অল্প বয়সে মাখের জ্ঞানবাদী অবস্থান আমাকেও ভীষণ প্রভাবিত করেছিল, সে অবস্থান এখন আমার কাছে অপরিহার্য ভুল বলে মনে হয়।’ (Schilpp, P.A : 1949:11)

আইনস্টাইন
(১৮৭৯-১৯৫৫)

এই ছোট আলোচনায় আমরা দেখলাম প্রথম জীবনে আর্নেস্ট মাখের ভাববাদী দর্শনের জোয়ারে ভেসে গেলেও প্লাঙ্ক ও আইনস্টাইন আগে-পরে তাঁদের ভুল বুঝতে পারেন এবং মাখের দৃষ্টবাদকে মারাত্মকভাবে আক্রমন করেন।

তাহলে আমার প্রশ্ন তাঁরা যখন মাখবাদে সাঁতার কাটছেন তখন লেনিন ১৯০৮ সালে আর্নেস্ট মাখ, অসওয়ার্ল্ড প্রচ্ছন্ন ভাববাদী দর্শনের কঠোর সমালোচনা করে Materialism And Empirio Criticism  বইটা লিখে কি অন্যায় করলেন। এতে কি প্রমাণ হয় না যে, মাখবাদী ভুত যখন আইস্টাইনের মতো বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীর কাঁধে ভর করে আছে, লেনিন তখন উক্ত বইটা লিখছেন। দার্শনিক হিসেবে এটা কি লেনিনের বিরাটত্ব নয়? প্রমাণ হয় না কি দার্শনিক হিসেবে লেনিন তাঁদের চেয়ে অনেক উঁচুতে বসেছিলেন?

মাখের প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে আইনস্টাইন অনেক সময় নেন। তাঁর বয়স তখন ৩২। তাই আমার মনে হয় তিনি প্যারিস সভায় মাখ সম্পর্কে যা বলেছিলেন, সেটা তাঁর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাছাড়া সাধারণভাবে সম্ভবত বলা যায় যে, অধিকাংশ বিজ্ঞানীর জন্য তা সত্য। বিজ্ঞানী হিসেবে উৎকৃষ্ট হলেও দার্শনিক হিসেবে নিকৃষ্টতর। তার আরেকটি প্রমাণ এখানে উপস্থিত করবো।

স্টেভেন ওয়েনবার্গ

স্টিভেন ওয়াইনবার্গ ১৯৭৯ সালে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পান। তিনি ১৯৯৪ সালে একখানা বই লেখেন। নাম Dreams Of A Final Theory। বইটির সাত নম্বর অধ্যায়ের নাম Against Philosophy। বইতে তিনি দর্শন বিশেষ করে মাখের দৃষ্টবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। ভাল কথা। কিন্তু তিনি সেই সাথে লেনিনের Materialism And Empirio Criticism বইটির বিরুদ্ধেও তাঁর মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ কেমন পরস্পর বিরোধী অবস্থান। তিনি দৃষ্টবাদের সমালোচনা করেছেন অথচ দৃষ্টবাদের প্রথম সমালোচক লেনিনেরও বিরোধিতা করেছেন। তাঁর কি লেনিনের প্রশংসা করা উচিত ছিল না? ওয়ানবার্গ ১৯২২ সালের আইনস্টাইনের উক্তিরও উল্লেখ করেছেন,  Mach as unborn mechanician but a deplorable philosopher। ( Weinberg 1994:180)

আলোচনা আর দীর্ঘ করবো না। বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে মার্কস ও এঙ্গেলস কত ভয়ঙ্কর নাম, তার প্রমাণ আমরা পেলাম। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃবিজ্ঞানী হেনরি লুইস মর্গানের তাঁরা প্রশংসা করেছিলেন। সেই সাংঘাতিক অপরাধের জন্য মর্গান নিশ্চিহ্ন প্রায়। আর লেনিন মাখবাদী ভাববাদ খণ্ডন করা সত্বেও বুর্জোয়া সমাজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরোপুরি নির্বাসিত। বিজ্ঞান বলতে আমরা কি বুঝি এই প্রশ্নের উত্তর আর্নেস্ট দিয়েছেন। কিন্তু আমার মনে হয় লেনিন বিজ্ঞানের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা সর্বশ্রেষ্ঠ। লেখাটি শেষ করবো তাঁর সে সংজ্ঞা উল্লেখ করে। এ সংজ্ঞা ভাববাদী বা প্রচ্ছন্ন ভাববাদী সমাজদর্শনকে অস্বীকার করে। সংজ্ঞাটি হল:

The “essence” of things, or “substance,” is also relative; it expresses only the degree of profundity of man’s knowledge of objects; and while yesterday the profundity of this knowledge did not go beyond the atom, and today does not go beyond the electron and ether, dialectical materialism insists on the temporary, relative, approximate character of all these milestones in the knowledge of nature gained by the progressing science of man. The electron is as inexhaustible as the atom, nature is infinite, but it infinitely exists.

দেবী প্রসাদ চট্টপাধ্যায় এর বাংলা করেছেন নিম্নরূপ:

… বস্তু বা দ্রব্যের সারসত্তার কথাও আপেক্ষিক, তা থেকে মানুষের বস্তুজ্ঞান সংক্রান্ত মাত্রাটুকুই ব্যক্ত হয়। গতকাল জ্ঞানের এই গভীরতা পরমাণুর চেয়ে মৌলিক কিছুর হদিস না পেলেও এবং আজ তা ইলেক্ট্রন ও ইথারের কথা পেরিয়ে যেতে না পারলেও ডায়ালেক্টিক্যাল বস্তুবাদ দৃঢ়ভাবে দাবি করে যে, প্রকৃতি প্রসঙ্গে মানুষের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই সমস্ত হল এক একটা মাইলস্টোনের মতো- অর্থাৎ সাময়িক-আপেক্ষিক-যথার্থ অভিলাষী মাত্র। পরমাণু যেমন অফুরন্ত, ইলেক্ট্রনও সেইরকম অফুরন্ত। প্রকৃতির সীমা নেই, কিন্তু অসীম অর্থ তার অস্তিত্ব অবশ্যই স্বীকার্য। (চট্টপাধ্যায়: ১৯৮০:২১৪)

উদারনৈতিক পুঁজিবাদ কতটা অনুদার হতে পারে,আশা করি এই ছোট্ট প্রবন্ধে সেটা স্পষ্টতর হয়েছে।

তথ্যপঞ্জি

ওসমান, বুলবন: আদিম সমাজ, লুইস হেনরী মর্গান, অবসর, ২০০০

Bernal, J.D. : Science In History, pelican Book, 1969

Clarck, Ronald W: Einstein: The life And Times, Arnas Book, 1972

চট্টপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ:দার্শিনিক লেনিন, মনীষা, কলকাতা, ১৯৮০

Hotton, G: Thematic Origins Of Scientific Thought, Cambridge, Massachusetts:1973

Lenin, V.I. : Materialism And Emprio Criticism: Critical Comments On A Reactionary Philosophy, Progressive Press. Moscow 1908

Ryan, Cristopher And Jetha, Cacilda: Sex At Down: The Prehistoric Origins Of Modern Sexuality; Harper, 2010

Schilpp, P.A : Albert Einstein: Philosopher-Scientist: The Library of Living Philosophers, Everstone, Illinois, 1949

Weinberg, Steven: Dreams Of A Final Theory, Vintage Book, Newyork, 1994

২৮শে আগস্ট, ২০২০
মহম্মদপুর, ঢাকা

শহিদুল ইসলাম

বাংলাদেশের যে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী জীবননিষ্ঠ মননের সদনুশীলনে আত্মনিয়োজিত, শহিদুল ইসলাম নিরলস চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে সেই গোষ্ঠীর অন্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পেরেছেন। গত পাঁচ দশক ধরে তিনি লিখছেন। সমাজনীতি, রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, শিক্ষা, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে অনবরত লিখে চলেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।

তিনি স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন এক সমাজব্যবস্থার, অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার যেখানে মানুষ পাবে মানুষের অধিকার। বিষয়গুলো নিয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে। তিনি বিজ্ঞানের দর্শন নিয়েও গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেন।

শহিদুল ইসলামের জন্ম ১৯৪০ সালে ১০ ফেব্রুয়ারি, পাবনার ঈশ্বরদীতে। তিনি সাঁড়া মাড়োয়ারি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা, পাবনা এওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএসসি, রাজশাহী কলেজ থেকে বিএসসি (অনার্স) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করেন।

তিনি ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষকদের একজন ছিলেন। ২০০০-২০০৩ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। ২০১৩-১৫ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু ইনস্টিটিউট অব লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড বাংলাদেশ স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। সম্পাদনা করেছেন 'সমাজ ও প্রগতি জার্নাল'।

তাঁর উল্লেখযোগ্য বই: শিক্ষাভাবনা, প্রসঙ্গ শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বায়ত্তশাসন, আমরা কি ধরনের শিক্ষা চাই?, বিজ্ঞানের দর্শন, চিন্তার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস, একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, দেশভাগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, জাতীয়তাবাদ: সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্র ও রাজনীতি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ: মিথ ও বাস্তবতা, মৃত্যুহীন প্রাণ, শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ।

২০১৩ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান।

বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি নিজকে নিয়োজিত করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক নানা গবেষণায়।